Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.১৮

    ১.১৮

    এ-ভাবেই শেষে মেলার দিন এসে গেল। ঘোড়া উঠে আসতে আরম্ভ করল এক দুই করে। গোপাট ঘরে বড় বড় ঘোড়া চলে যাচ্ছে। মাসাধিককাল মেলা। শনিবারে ঘৌড়দৌড় হবে। গলায় ঘণ্টা বাজলে মানুষেরা মাঠে নেমে ঘোড়া দেখে, কার ঘোড়া যায়। নয়াপাড়ার ঘোড়া কি বিশ্বাসপাড়ার ঘোড়া! মাঠে ঘোড়ার মুখ ভাসলেই মানুষগুলি ঘোড়া যায় বলে চিৎকার করতে থাকে।

    মেলায় যাবে সকলে। রঞ্জিত যাবে, মালতী যাবে। আবু, শোভা যাবে। ছোট ঠাকুর যাবেন। তরমুজ যাবে নৌকায়। এখন নৌকায় তরমুজ বোঝাই হচ্ছে। যাবে না শুধু সোনা। লালটু পলটু পর্যন্ত জামা পরে ঠিক হয়ে আছে, সূর্য উঠলেই ওরা হাঁটতে শুরু করবে। সোনা যাবে না, কারণ সোনার এতদূর হেঁটে যেতে কষ্ট হবে। এতদূর হেঁটে যেতে পারবে না।

    সোনা বারান্দায় বসে আছে। সে সব কিছু দেখছে এবং মনে মনে অভিমানে ভেঙে পড়ছে। কারও সঙ্গে কথা বলছে না। ছোটকাকা না বললে সে মেলাতে যেতে পারবে না। বাড়ির কেউ সাহস করে কাকাকে বলতে পারছে না। সোনা মাকে সকাল থেকে বায়না করছে, আমি যামু, তুমি ছোট কাকাকে কও, আমি যামু। মা পর্যন্ত সাহস পায়নি বলতে। ধনবৌ গতকাল একবার বলেছিল, সোনা যদি মেলায় যায়। ছোটকাকা ধনবৌকে মেলার ভিড়ের কথা বলেছিল, এতদূর সে যেতে পারবে না হেঁটে, এসব বলেছিল। আর ধনবৌ বলতে সাহস পায়নি।

    সোনা থামে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সব কিছু দেখছে, এবং লালটু পলটু পাটভাঙা প্যান্ট জামা পরে ছুটোছুটি করছে, দেখতে পেয়ে ভ্যাক করে কেঁদে দিল। যত সকলের সময় হয়ে যাচ্ছে মাঠে নেমে যাবার, তত সে ভেঙে পড়ল। কারণ শেষ পর্যন্ত আশা ছিল ছোটকাকা তাকে কাঁদতে দেখে মেলায় যেতে বলবে।

    ঈশম আসছিল তরমুজ মাথায় করে। সে এত বড় একটা তরমুজ আবিষ্কার করে অবাক। প্ৰায় এক মণের চেয়ে বেশি ওজন। সে তরমুজটা নৌকায় তুলে দেয়নি। বাড়িতে নিয়ে এসেছে। সবাইকে কেটে কেটে খেতে বলবে। আর কাটলেই ভিতরে লাল রঙ, কালো বীচি, বসন্তকালে এই তরমুজের রস শরবতের মতো। সে উঠোনে উঠেই ডাকল, সোনাবাবু কই গ। দাওটা আনেন।

    রঞ্জিত ছিল উঠোনে দাঁড়িয়ে। শোবা আবু এসেছে উঠোনে। মালতী এসেছে। যারা মেলায় যাবে তারা সবাই উঠোনে ভিড় করছে। গাঁয়ের নিচে পথ, পথ ধরে মানুষেরা সার বেঁধে মেলায় যেতে আরম্ভ করছে। সবাই মেলায় যাবে, যাবে না শুধু সোনা। সে ঈশমের ডাক শুনতে পেয়েছে। কিন্তু উঠোনে নেমে গেল না। থামে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শুধু।

    রঞ্জিতকে বলল ঈশম, দ্যান, কাইটা সকলেরে দ্যান।

    ঈশম বড় দুটো কলাপাতা কেটে আনল। প্রথম তরমুজ, ঠাকুরের জন্য কিছুটা আলাদা করে রাখা হয়েছে। বাকিটা রঞ্জিত কেটে সবাইকে দিল। দেবার সময় ঈশম বলল, সোনাবাবু কৈ? তাইনরে

    দ্যাখতাছি না।

    লালটু বলল, সোনা কানতাছে।

    —কান্দে ক্যান!

    –মেলায় যাইব বইলা।

    —আপনেরা যাইবেন, সোনাবাবু যাইব না?

    —ছোটকাকায় না করছে।

    —না করলেই হইব। বলে সে ভিতরে ঢুকে ডাকল, সোনাবাবু কই! কেডা কইছে আপনে মেলায় যাইবেন না! আমি আপনেরে মেলায় লইয়া যামু। কার সাধ্য আছে না করে দ্যাখি।

    ছোটকাকা বললেন, এতদূর হাঁইটা যাইতে পারব না। কে অরে কোলে নিয়া হাঁটব?

    —আমি হাঁটমু। চলেন কর্তা।

    যেন সহসা আকাশের সব মেঘ কেটে গেল। সোনার কি যেন হারিয়ে গিয়েছিল, সহসা মিলে গেছে। সে মাকে বলল, মা আমারে ছোটকাকায় যাইতে কইছে। ঈশম দাদা আমারে লইয়া যাইব। সোনা ছুটে ছুটে সকলকে বলতে থাকে। ঠাকুমাকে বলল, ঠাকুরদাকে বলল, আমি মেলাতে যামু। ঈশম দাদা আমারে লইয়া যাইবে। মেলায় যাবার নামে সে প্রায় আত্মহারা হয়ে গেল। এ যেন এক জীবন, মেলা, বানি, নদীনালা সব মিলে মানুষের প্রাণে এক বন্যা বয়ে আনে। রহস্যটা এতদিনে সোনা জানতে পারবে। মেলাতে কি রহস্য, কারা জাগে মেলাতে, ঘোড়দৌড় হলে বাজি জেতার জন্য সবাই আকুল হয় কেন—এসব মনে হচ্ছিল সোনার। সোনা ঈশমের হাত ধরে সবার আগে আগে মাঠে নেমে গেল। কিছু হেঁটে কিছু কাঁধে চড়ে এবং যখনই সোনা আর হাঁটতে পারছিল না, ঈশম কাঁধে তুলে নিচ্ছে। বেশিদূর যেতে না যেতেই বালিয়াপাড়া পার হলে নদীর পাড়ে সোনা জলছত্র দেখল। তারপর গাছের নিচে, সারি সারি হিজল গাছের নিচে সোনা বিন্নির খৈ এবং লাল বাতাসা দেখল। দু’পয়সার বিন্নির খৈ, এক পয়সার বাতাসা কিনে দিল ঈশম। ছোটকাকা থাকলে কিছুতেই খেতে পারত না, খেতে দিত না। কেউ কেউ আগে উঠে গেছে। সোনা দু’পকেটে বিন্নির খৈ রেখেছে, ঠোঙাতে বাতাসা। সে হাঁটছিল আর বিন্নির খৈ খাচ্ছিল। খেতে খেতেই দেখল বড় মাঠে তাঁবু পড়েছে। তাঁবুর মাথায় পতাকা উড়ছে। যজ্ঞেশ্বরের মন্দির দেখা যাচ্ছে। অশ্বত্থ গাছ ফুঁড়ে মন্দিরের ত্রিশূল আকাশের দিকে উঠে গেছে। আর সারি সারি ঘোড়া দরগার জমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেউ তালপাতার বাঁশি বাজাচ্ছে। নদীতে কত নৌকা লেগে রয়েছে। ওদের একটা নৌকা আসবে। তরমুজের নৌকা। নদীনালা ঘুরে আসতে সময় লেগে যাবে।

    রঞ্জিতের একটা দল আসবে নারায়ণগঞ্জ থেকে। এই মেলাতে দলটা ছোরা খেলা, লাঠি খেলা দেখাবে। ভুজঙ্গ, গোপাল দুদিন আগে মেলায় চলে গেছে। তাঁবু ফেলতে হবে। ছোট ছোট, এই তের চোদ্দ বছরের মেয়েরা আসবে, সাদা ফ্রক গায়ে, কালো প্যান্ট পরে এবং পায়ে কেডস জুতো। কথা ছিল, বাবুদের কাছারি বাড়িতে ওরা থাকবে। সমিতির নির্দেশে এইসব হচ্ছে। রঞ্জিত এমনভাবে চলাফেরা করছে, দলটার সঙ্গে তার যেন কোনও সম্পর্ক নেই। বরং ভুজঙ্গই সব করছিল।

    মালতী ঠিক যজ্ঞেশ্বরের মন্দিরে উঠে যাবার মুখেই দেখল, জব্বর ইস্তাহার বিলি করছে মেলাতে। সে মালতী দিদিকে দেখে এক গাল হেসে দিল।–দিদি, আপনে আইছেন। মালতী দেখল, ওর পাশে অপরিচিত দু’চারজন মুসলমান পুরুষ, মালতী ভয়ে হাসতে পারল না। একবার ইচ্ছা হল জানতে, মেলায় সামু এসেছে কিনা, কিন্তু জব্বরের দু’পাশের লোকগুলি এমনভাবে তাকাচ্ছিল যে, সে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। নদী থেকে স্নান করে আসতে হবে। কিছু ফুল বেলপাতা তিল তুলসী লাগবে—মালতী সোজা মন্দিরে উঠে গেল।

    আর তখনই একটা বাচ্চা ছেলে, ছেলের বয়স আর কত হবে, মেলায় হারিয়ে গিয়েছে। হাতে তার একটা ছোট্ট ছাগশিশু। দিদি গেছে স্নান করতে নদীর ঘাটে। ওকে গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে—দিদি আসবে, এলেই মন্দিরে উঠে যাবে।

    সংসারে তখন জ্বালা যন্ত্রণার কথা উঠেছে। ভিতরে এক মন আছে মানুষের, পাগলের মতো সেই মন নদী দেখলে কেবল উথালপাথাল করে। মেলায় এমন কত সুন্দরী হিন্দু মেয়েদের ভিড়। স্নান করে উঠে এলে, ভিজে কাপড়ে উঠে এলে, কী যে দেখায়, যুবতী মেয়ের সর্ব অঙ্গে কালসাপ যেন, কেবল দেখলেই ছোবল মারতে ইচ্ছা যায়। স্থির থাকা যায় না।

    গোপালদির বাবুদের ছেলেরা গোটা মেলাতে ভলান্টিয়ার দিয়েছে।—ওহে মানব জাতির সন্তানেরা, মিলেমিশে থাক, কুকাজ করলে ধরে বেঁধে নিয়ে যাব। জলছত্র দিয়েছে। কেউ হারিয়ে গেলে তার সন্ধান দিচ্ছে। ব্যজ পরা বাবুদের ছেলেরা কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ে দিকে দিকে খবর নিয়ে যাবার সময়ই শুনল, কে কার স্তন টিপে দিয়েছে। যুবককে ধরে ফেলেছে। লুঙ্গি পরা, গলায় গামছা বাঁধা, বগলে পাচনের লাঠি, মাতব্বর মানুষের মতো মেলা দেখতে এসেছিল। লোভে, যখন ভিড়, স্নানের ঘাটে ভিড়, তখন পরিচিত মেয়ের স্তনে হাত দিলে সব গোপন করে রাখবে—কিন্তু হিন্দু নারী, সে তার মানসম্মানের জন্য বোকার মতো হাউহাউ করে কেঁদে দিল। বাবুদের এক ছেলে দেখে ফেলেছে। কড়া নজর সবদিকে। মুঠিতে ধরে পাছায় এক ধাঁই করে লাথি মারল। সঙ্গে সঙ্গে মেলায় খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ কিছু বলতে সাহস করছে না। দরগার ঘোড়াগুলি ঘাস খাচ্ছে। বিকেল হলে মাঠে নেমে যাবে। কত বড় প্রশস্ত মাঠ। দুরে দূরে সব লাল নীল নিশান উড়ছে। দুটো একটা ঘোড়া, বোধ হয় মুড়াপাড়ার সুরেশবাবুর ঘোড়াটা এখন ধু ধু মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সাদা রঙের ঘোড়া তীরবেগে ছুটে আসছিল।

    আর তীরবেগে ছুটে যাচ্ছিল জব্বর। সে দেখল তার স্বজাতিকে টেনে বেঁধে নিয়ে কাছারি বাড়িতে তোলা হচ্ছে। কেউ একবার মুখ ফুটে কিছু বলছে না। তার স্বজাতিরা মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। সে প্রায় যেন যোজন দূরে লাফ মেরে যেতে পারে, তেমনি লাফ দিয়ে ছুটে গেল এবং ভিড়ের ভিতর পড়ে হুংকার দিয়ে উঠল, কই লইয়া যান অরে।

    কে একজন বলল, কাছারি বাড়ি।।

    —হ্যায় কি করছে!

    —স্তন টিপা দিছে।

    —দিছে ত কি হইছে। বলেই সে ভিড় ঠেলে আরও এগিয়ে গেল। ওর দলটাও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা সেই যুবকের নাগাল পেল না। একদল ব্যাজ পরা লোক আনোয়ারকে কাছারি বাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। পাছায় লাথি, কিল চড় ঘুষি, হায় আনোয়ার, তোমার মনে যে কি ইচ্ছা, এমন সুন্দর স্তনে, ফোটা পদ্মফুলের মতো স্তনে তুমি নাকি জলের অতলে স্বপ্ন দেখছিলে–যেন এক রূপালী মাছ ভাইস্যা যায়। তুমি খপ করে ধরতে গেছিলে!

    ক্রমে সূর্য নেমে যাচ্ছিল। বড় তাঁবুতে ফরাস পাতা। সেখানে বাবুদের মেয়েরা বসবে। সুন্দর সুন্দর অলঙ্কার গায়ে। দেবীর মতো মুখ। ঝলমল চোখে ঘোড়দৌড় দেখবে। অথবা নদীতে যে হাজার নৌকা ভেসে রয়েছে—সেই সব নৌকা থেকে দাসদাসী উঠে এলে মেলাময় আনন্দ, দরগা থেকে তখন এক দুই করে ঘোড়া ঠিক এই তাঁবুর নিচে প্রথম নেমে আসবে, বাবুদের প্রথম সেলাম দিয়ে কদম দিতে দিতে মাঠে নেমে যাবে—যেন আমরা এসেছি দুর দেশ থেকে, বাজি জিতে আমরা চলে যাব, আপনারা মেহেরবান লোক, আপনাদের এই মাঠে ঘোড়া ছোটাব। বাজি জিতব। বলে ঘোড়াটার খেলা দেখাতে শুরু করেছিল। এক দুই করে ঘোড়া তার পা তুলে বাবুদের ছোট ছোট মেয়েদের নাচ দেখাচ্ছিল।

    তখন মেলাতে দুটো দল। কাছারি বাড়িতে হিন্দু যুবকেরা উঠে গেছে। নিচে মুসলমান যুবকেরা। পুলিশ এসেছে। ওরা বাবুদের সপক্ষে কথা বলছিল। আইন আছে। বিচার আছে। থানায় চালান দেওয়া হবে।

    কিন্তু কে কার কথা শোনে! কাছারি বাড়ি ভেঙে আনোয়ারকে ওরা কেড়ে নিতে গেলে বাবুদের বন্দুক গর্জে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া নাচছিল দুরে, সেই ঘোড়া ভয় পেয়ে ছুটতে থাকল। যে যেদিকে পারছে ছুটতে থাকল। ঈশম তরমুজ বিক্রি করছিল। সোনা লালটু পলটু সার্কাসের তাঁবুতে বাঘ সিংহের খেলা দেখছে। ব্যাগপাইপ বাজছিল, বাঘটা থাবা চাটছে। উঁচু রিঙে একটি ফুটফুটে মেয়ে খেলা দেখাচ্ছে, তখন সেই বন্দুকের গর্জনে সারা মেলাটায় কিরকম যেন অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল।

    দুটো লাশ পড়ে গেছে। ক্রমে অন্ধকার মশালের আলো দেখা যেতে লাগল। কাছারি বাড়িতে বাবুদের মেয়েরা উঠে গেছে। দরগা থেকে সব ঘোড়া এক এক করে নেমে আসছে। সহিসের হাতে মশাল। মেলাময় মশাল জ্বলছে। মাঝে মাঝে আল্লা হো আকবর ধ্বনি উঠছিল। কাছারি বাড়িতে হিন্দুরা প্রাণ রক্ষার্থে চিৎকার করছে, বন্দে মাতরম্।

    কে কোথায় ছিটকে পড়ছে বোঝা যাচ্ছে না। সোনা, লালটু, পলটুকে তাঁবুর ভিতর বসিয়ে দিয়ে ঈশম চলে এসেছিল। সার্কাস ভেঙে গেলে ওরা ঈশমের কাছে চলে আসবে এমন ঠিক ছিল। ঈশম মেলাতে দাঙ্গা বাঁধতেই সার্কাসের তাঁবুর দিকে ছুটে যাচ্ছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। লোকজন যে যেদিকে পারছে ছুটছে। সেই ছোট্ট ছাগশিশু এবং বাচ্চাটা কারা চেপ্টে দিয়ে চলে গেছে। দিদির আশায় সে দাঁড়িয়েছিল, দিদি এলেই মন্দিরে উঠে যাবে। যখন ঘটনাটা ঘটে দুপুর হবে, আর এই দুপুর থেকেই গুঞ্জন। ক্রমে ক্রমে জব্বর এলে সেই গুঞ্জন বাড়তে থাকে—সবাই ভেবেছিল, মেলাতে বান্নিতে এমন হামেশাই ঘটে। মাতব্বর মানুষেরা এসে সব মিটমাট করে দেয়, কিন্তু তাজ্জব এই জব্বর—সে সকলকে বলছিল, আপনেগ ইজ্জত নাই। আপনেরা গরু ঘোড়া আর কতদিন হইয়া থাকবেন। ঠিক সামুর গলার স্বরে সে চিৎকার করছিল। এত মানুষজন দেখে ওর কেমন জুস এসে গেছিল ভিতরে। সে এবার নিজেকে, সে যে কত বড়, এবং ইচ্ছা করলে কি না করতে পারে, বলে আনোয়ারকে কেড়ে নেবার জন্য কাছারি বাড়িতে উঠে যাবার সময় দেখল বন্দুক গর্জে উঠছে। সে এতটা আশাই করতে পারেনি। পর পর দুটো লাশ ওর সামনে মুখ থুবড়ে পড়ল। আগুন জ্বলতে কতক্ষণ। এবার যেন সকলে মশালে আগুন জ্বালিয়ে ছুটে আসবে এবং সব তছনছ করে কাছে পিঠে যার যা কিছু অমূল্য মনে হবে ফেলে মাঠের ভিতর দৌড়াতে থাকবে।

    ঈশমও সাকার্সের তাঁবুর দিকে ছুটছে। হায় গেল, সব গেল! সে চিৎকার করে ডাকছে। সোনাবাবু! তাঁবুর সামনে এসে দেখল, তাঁবু আর নেই। সব তছনছ করে দিয়েছে। তাঁবুর একটা দিকে আগুন জ্বলছে বাঘ সিংহ ঝলসে যাচ্ছে। কাছে কোথাও কোনও লোকজন নেই। যেন নিমেষে সব লুঠপাট করে তুলে নিয়ে গেছে কারা

    ঈশম কি করবে স্থির করতে পারছে না। সে বড় মুখ করে সোনাবাবুকে নিয়ে এসেছে। হায়, কি হবে! সে আকুল হতে থাকল। আর পাগলের মতো কাছারি বাড়ির দিকে উঠে যাবে ভাবল। কিন্তু কাছে গিয়ে মনে হল—বাবুরা যে-ভাবে রুখে আছে ওর পরনে লুঙ্গি, সে কিছুতেই আর সে দিকে যেতে সাহস পেল না। তারপর মনে হল তিন নাবালক এদিকে ছুটে আসতে পারে না। কারণ ওরা পথ হারিয়ে ঠিক যেখানে সে তরমুজ বিক্রি করছিল সেদিকেই ছুটে যাবে। সে আর দাঁড়াল না। গোটা মেলাটা ক্ষেপে গেছে। চারপাশে আগুন। এই আগুন যেন কতকাল থেকে মাটির ভিতর এতদিন আত্মগোপন করেছিল। কত দিনের অপমান এইসব মানুষ হজম করে এখন বদলা নিচ্ছে। সে কী করবে ভেবে পেল না। আগুনের ভিতর দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকল, সোনাবাবু কৈ গ্যালেন গ। লালটুবাবু। আমি গাঁয়ে ফিরমু কি কইরা। মুখ দ্যাখামু কি কইরা! সে পাগলের মতো আগুনের ভিতর কেবল ডাকতে লাগল। সে ডাকতে ডাকতে ছুটছিল। চারধারে কাচ ভাঙা, কাচের চুড়ি ভেঙে পথটা লাল নীল সবুজ মিহিদানার মতো পথ, পথে ছুটতে গিয়ে ওর হাতপা কেটে যাচ্ছে। ওর হুঁশ ছিল না। ওরা হয়তো গাছের নিচে ওর জন্য দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু হায়, এসে দেখল সেখানে কেউ নেই। শুধু বড় বড় তরমুজ চারদিকে কারা ছড়িয়ে দিয়ে মাঠের অন্ধকারে মিশে গেছে। তরমুজে সব চাপ চাপ রক্ত। ওর শরীর শিউরে উঠল। পাগলের মতো হেঁকে উঠল, কেডা আমার মানুষ কাইড়া নিছ কও! বলে সেও উন্মত্ত মেলাতে কাদের হত্যা করার জন্য ছুটে গেল। সে ফাঁকা মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে উন্মত্তপ্রায় চিৎকার করে ডাকতে থাকল, সোনাবাবু কৈ গ্যালেন। রা করেন। কোন্ আনধাইরে লুকাইয়া আছেন কন, আমি ঈশম। আমি, সোনাবাবু বাড়ি নিয়া যামু। আপনেরে বাড়ি নিয়া না যাইতে পারলে আমার জাত মান কুল সব যাইব।

    ঘোড়াগুলি দ্রুতবেগে ছুটছে। যেসব ঘোড়া দরগায় ছিল তারা প্রায় সকলে জব্বরের হয়ে যেন লড়ছে। এটা যে কী করে হয়ে গেল—দোকানপাট লুঠ, মনিহারি দোকান, কাপড়ের দোকান এবং কামার কুমোরেরা এসেছে হাঁড়ি-কলসী, দা-বঁটি নিয়ে—সে সবও লুঠপাট হচ্ছিল। সার্কাসের তাঁবু থেকে দু-তিনটে মেয়ে উধাও হয়ে গেল। এবং মানুষেরা নদীর পাড়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সামনের বড় বড় সব তরমুজের নৌকা, হাঁড়ি পাতিলের নৌকা, আর কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু জলের ভিতর হাহাকারের শব্দ। কেউ কোনওদিকে তাকাচ্ছে না। যে যার প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে। ঘোড়ার পায়ের নিচে অথবা আগুনের ভিতর কার কখন প্রাণ যায় বোঝা দায়। সড়কি, বর্শা, সুপুরির শলা হাজার হাজার দু’দলের ভিতর কোথা থেকে সহসা আমদানি হয়ে গেল। যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। দীঘির দু’পাড়ে দু’দল অন্ধকারে প্রতীক্ষা করছে। রাত বাড়লেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।

    রঞ্জিত বিকেলের দিকেই প্রথম আঁচ পেয়েছিল। সে তার দলবল নিয়ে কাছারি বাড়িতে উঠে গেল। এখন সোনা লালটু পলটু আর মালতীকে খুঁজে বের করতে হবে। মেলাতে এলে মালতী অধিক সময় মন্দিরে কাটায়। সে ওদের কাছারি বাড়ি তুলে দিয়ে প্রথম মালতীর খোঁজে চলে গেল। মালতী ঠিক যেখানে বড় একটা মঠ আছে, মঠের দরজায় যেখানে ভিড়, ভিড়ের ভিতর মালতী পূজা দেখার জন্য প্রায় যেন হামাগুড়ি দিচ্ছে। রঞ্জিত আঁচল ধরে ফেলল। বলল, শোভা আবু কোথায়?

    —ওরা মন্দিরে আছে।

    —ওদের নিয়ে চলে এস।

    মালতী ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে।

    রঞ্জিত বলল, দেরি করো না। আমি সার্কাসের তাঁবুতে যাচ্ছি। ঈশমকে খবর দিতে হবে। অনেক কাজ। মেলায় গণ্ডগোল হতে পারে।

    রঞ্জিত হনহন করে হাঁটছে। দিঘির এ-পাড়ে রকমারি কাচের চুড়ির দোকান। তারপর ফুল ফলের দোকান। তারপর বিন্নির খৈ। মিষ্টির দোকান কত! তেলেভাজার দোকানগুলি পার হয়ে এলেই ফাঁকা মাঠ। মাঠে এখন তাঁবুর ভিতর গোপালদির বাবুরা বসে আছে। এই মাঠ পার হলে সাকার্সের তাঁবু, দুটো ছোট বড় সার্কাস। রঞ্জিত টিকিট কিনে দিয়েছে। ঈশম ওদের বসিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলে কথা ছিল—সার্কাস দেখা শেষ হলে যেখানে ঈশম তরমুজ বিক্রি করবে সেখানে সবাই চলে যাবে। রঞ্জিত দেরি করতে পারল না। এখানে সে ছদ্মবেশী মানুষ। তার পরিচয়ের জন্য লোক হাঁটাহাঁটি করতে শুরু করেছে। সে যতটা পারল দ্রুত সার্কাসের তাঁবুতে ঢুকে যাবার জন্য হাঁটতে থাকল। জিলিপির দোকান থেকে তখনও একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এমন কুৎসিত আকার নেবে মেলাটা অন্তত জিলিপি ভাজার মনোরম গন্ধ থেকে তা টের পাওয়া যায়নি। কেবল রঞ্জিত এবং অন্য কেউ বুঝি ভেবেছিল—সময়টা দুঃসময়। মেলা ছেড়ে এখন যা . যার মতো ফেরা দরকার।

    মেলাতে শচীন্দ্রনাথের আসার কথা ছিল। তিনি এলে এই জব্বরকে কব্জা করতে পারতেন। শচীন্দ্রনাথকে জব্বর ভয় পায়। কারণ আবেদালির সুখে-দুঃখে শচীন্দ্রনাথ আত্মীয়ের মতো। রঞ্জিত হাঁটতে হাঁটতে এসব ভাবল। সে সার্কাসের তাঁবুতে আসতেই দেখল, সার্কাস ভেঙে গেছে। গণ্ডগোলের আঁচটা ওরাও টের পেয়েছে। সব খেলা না দেখিয়ে, বাঘের খাঁচায় বাঘ, সিংহের খাঁচায় সিংহ পুরে দিল। রঞ্জিত গেটের সামেন ওদের তিনজনকে দেখে বলল, তোমাদের আর ওদিকে যেতে হবে না। আগে তোমাদের কাছারি বাড়ি দিয়ে আসি। রঞ্জিত ভেবেছিল, ওদের কাছারি বাড়ি তুলে দিয়ে ঈশমকে খবর দেবে এবং ঈশমকে সব তরমুজ নৌকায় তুলে দিতে বলবে। কাছারি বাড়ি পর্যন্ত রঞ্জিত যেতে পারল না। সূর্য অস্ত যাচ্ছে তখন—বন্দুকের গর্জন, এবং হল্লা। মানুষজন নিহত হচ্ছে।

    রঞ্জিত তাড়াতাড়ি একটু পিছনের দিকে হেঁটে গেল। ওর মনে পড়ে গেল মালতীকে সে বলে এসেছে, সার্কাসের তাঁবুর গেটে সে থাকবে। তাড়াতাড়ি সে তাঁবুর গেটে এসে দাঁড়াতেই দেখল, পেছনের দিকটায় কে তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সে এই বালকদের নিয়ে কী করবে! মালতী এখনও আসছে না, অথবা মালতী কী ওদের না দেখে ফের মন্দিরে চলে গেছে। এখন তো হাতে প্রাণ—কখন প্রাণ যায়, আর মালতীর মতো সুন্দরী যুবতী—সে এবার কেমন আকুল হয়ে ওদের নিয়ে সোজা মন্দিরের দিকে ছুটে গেল। সোনা ঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না। সহসা কেন এমন হল! যেন পঙ্গপালের মতো সব মানুষ নদীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে দেখল আবু একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সোনা বলল, মামা ঐ দ্যাখেন আবু।

    রঞ্জিত বলল, তোর পিসি কোথায়?

    আবু কাঁদছিল শুধু। বুঝল আবু এই মেলাতে হারিয়ে গেছে। এখন আর মালতীকে খোঁজা অর্থহীন। ওর বুকটা কেঁপে উঠল। ওদের কোনও নিরাপদ স্থানে পৌঁছে না দিতে পারলে সে স্বস্তি পাচ্ছে না। কিন্তু কীভাবে কাছারি বাড়ির দিকে উঠে যাওয়া যায়। সে পিছনের দিকে তাকাতেই দেখল—আগুন জ্বলছে। একমাত্র নদীর দিকেই নেমে যাওয়া যেতে পারে। নৌকা আছে। তরমুজের নৌকা। সে ওদের নিয়ে ছুটতে থাকল। অন্ধকার হয়ে গেছে। মানুষজন সব আর চেনা যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে দূরের আগুন সহসা হল্কা ছাড়লে কিছু কিছু মুখ দেখা যাচ্ছে। নির্বিচারে হিন্দু-মুসলমান—এদিকটাতে মিলেমিশে আছে। সবাই প্রাণের দায়ে নিরাপদ স্থানের জন্য ছুটছিল।

    রঞ্জিত দেখল নৌকাটা কে আলগা করে দিয়েছে। একটু দূরে ভেসে রয়েছে। সে জলে ঝাঁপ দিল। এবং মাঝ নদী থেকে নৌকা আনার জন্য সাঁতরাতে থাকলে দেখল, জলের ওপর কি সব ভেসে রয়েছে। সে বুঝতে পারল সেই ভীত সন্ত্রস্ত মানুষেরা জলে ভেসে রয়েছে। আগুন থেকে এবং হত্যা থেকে প্রাণ রক্ষার্থে ডুবে ডুবে নদী পার হচ্ছে। সে দেখল কিছু কিছু নৌকা তীরবেগে ছুটে যাচ্ছে। সে আর দেরি করল না। নৌকায় উঠে গেল। এবং মনে হল তার কিছু আবছা মতো মানুষের আভাস সেই নৌকায়

    রঞ্জিত চিৎকার করে উঠল, তোমরা কে?

    কোনও শব্দ ভেসে আসছে না।

    —কে তোমরা?

    এবার বুঝি গলা চিনতে পেরে মালতী কেঁদে ফেলল, আমি মালতী।

    —তুমি! পাশে কে?

    —শোভা, আবুরে পাইতেছি না।

    এখন আর কথা বলার সময় নয়। নৌকাটা তীরের দিকে টেনে নিয়ে যাবার সময় বলল, আবুকে পাওয়া গেছে। আর সোনা লালটু সবাই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর একটু থেমে বলল, বৈঠা দেখছি না, লগি নেই—কোথায় গেল সব!

    মালতী কোনও জবাব দিল না। তার এখন আর কোনও ভয় নেই। সে প্রাণপণে রঞ্জিতকে সাহায্য করার জন্য হাতে জল টানছিল। নৌকা পাড়ে এলে রঞ্জিত অন্ধকারে দেখল সেই মশালের আগুন এদিকেই ছুটে আসছে। সর্বনাশ, ওরা টের পেয়েছে আত্মরক্ষার্থে নদীর জলে মানুষ ভেসে পার হয়ে যাচ্ছে ওপারে। সে এ-মুহূর্তে কি করবে ভাবতে পারল না। মনে হচ্ছে নিশ্চিত হত্যা—নির্বিচারে হত্যা। সে সোনার চোখ দেখল। সোনা কিছুই বুঝতে পারছে না যেন। এমন একটা হাসিখুশির মেলা, মেলাতে কত পাখি উড়ে এসেছে, কত রঙ-বেরঙের ঘোড়া, তালপাতার বাঁশি, তিলাকদমা, বাতাসা, কী সুন্দর সব লাল-নীল নিশান উড়ছিল-এখন সেসবের কিছু নেই—কী করে তছনছ হয়ে গেল—শুধু চারদিকে আগুন জ্বলছে। মাঠে সেই সব অশ্বারোহী পুরুষ–কদম দিচ্ছে। হাতে মশাল। মশালের আলোতে মৃত্যুর কাছাকাছি যে মানুষ তাদের মুখ দেখার বাসনা। সবাই উঠে এলে রঞ্জিত জোরে নৌকাটা নদীতে ঠেলে দিল। তারপর প্রাণপণে সবাই জল টানতে থাকল হাতে। তরমুজের নৌকা, রঞ্জিত এক দুই করে সব তরমুজ জলে ফেলে পাড়ের দিকে ভাসিয়ে দিতে থাকল। অন্ধকারে এইসব তরমুজ জলে ভেসেছিল। জলে ভেসে ভেসে মানুষের মাথার মতো কত শত মানুষ জলে মুখ ডুবিয়ে পৈশাচিক উল্লাস থেকে আত্মরক্ষা করছে। আর ঠিক মাঝ নদীতে এসেই মনে হল সেই মশাল হাতে দলটা মাঠ শেষ করে নদীর কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। ওরা যদি দেখতে পায়, বর্শা ছুঁড়ে দিতে পারে। অথবা জল সাঁতরে চলে আসতে পারে। সে সবাইকে এবার নৌকা থেকে জলে নামিয়ে দিল। তারপর নৌকাটা জলে কাৎ করে রাখল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে—খালি একটা নৌকা ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। বরং কাছেপিঠে যেসব তরমুজ ভেসে যাচ্ছে অন্ধকারে ওরা সেইসব তরমুজ মানুষের মাথা ভেবে যে যার বল্লম অথবা শলা ছুঁড়ে দিলেই হাত খালি হয়ে যাবে, তখন আর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না, মাঠে উঠে যাবে। ওরা নৌকার ওপাশে শরীর লুকিয়ে জলের ভিতর মাছ হয়ে থাকবে এবং সন্তর্পণে নৌকাটাকে টেনে ওপারে নিতে পারলেই যেন ভয়ডর কেটে যাবে। ওরা নৌকাটাকে গুণ টানার মতো নিয়ে যাবে তারপর।

    মালতী একপাশে। মাঝে সোনা লালটু পলটু এবং আবু শোভা–শেষ মাথায় রঞ্জিত। শুধু সবার হাতদুটো নৌকার কাঠে। আর গোটা শরীর মুখ নৌকার ছায়ায় আড়াল করা। যেন এই নৌকায় কিছু মানুষজন ছিল, এখন ওরা নদীর জলে ডুবে গেছে। খালি নৌকা কাটা মাথা নিয়ে যায়। দু-চারটে তরমুজ গলুইর ওপর ইতস্তত ছড়নো। অন্ধকারে এমন একটা দৃশ্য তৈরি করে রাখল রঞ্জিত।

    কখন কী যেন হয়ে যায় মানুষের ভিতর। যারা ঘোড়ায় চড়ে এই হত্যাকাণ্ডে মেতে গেছে, রঞ্জিত জানে—ওরা, ঘরে বিবি বেটা রেখে এসেছে। বাজি জিতে গেলে পালা-পার্বণের মতো উৎসব লেগে যাবে। গ্রামে গ্রামে সেই বাজি জেতার মেডেল গলায় ঝুলিয়ে মানুষের কাছে দোয়া ভিক্ষা করবে। এখন দেখলে কে বলবে—এরাই সেইসব মানুষ। অন্ধকারের ফাঁক থেকে সে দেখল, ওদের হাতে সুপারির শলা, যেন এক হত্যার খেলায় মেতে গেছে। ওরা সুপারির শলা, বল্লম সেইসব তরমুজের বুকে সড়কির মতো গেঁথে দিতে থাকল আর উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। ওরা কাফের হত্যা করছিল।

    আর তখন এক মানুষ নদীর পাড়ে পাড়ে যায়। অন্ধকারে সে মানুষটা ডাকছে, সোনাবাবু কৈ গ্যালেন গ।

    অন্ধকার থেকে সাড়শব্দ আসছে না।

    দূরে তখন নৌকা ভাসিয়েছে রঞ্জিত। ওরা পাড়ে উঠে এবার ছুটতে থাকবে।

    মানুষটা ডাকছিল, আমি কারে লইয়া ঘরে ফিরমু। মানুষটা এ-পারে ডাকছে। ও-পারের মাঠে তখন ছুটতে গিয়ে আছাড় খেল সোনা। দূর থেকে, অনেক দূর থেকে কে যেন তাকে ডাকছে। সোনা ডাকল,

    মামা! আমারে কে ডাকে!

    রঞ্জিত অন্ধকার মাঠে ওকে কোলে তুলে নিল। বলল, কথা বলো না। ছোটো। সে ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, সামনে হিন্দুগ্রাম পড়বে। সেখানে রাত কাটাতে হবে। অন্ধকারে মালতীকে নিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছে না। সারারাত না হেঁটে সামনের গ্রামে সে আশ্রয় নেবে ভাবল।

    মানুষটার ডাক ক্রমে কেমন ক্ষীণ হতে হতে এক সময় বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল। সোনাবাবু আছেন? আমি ঈশম। আমি কারে লইয়া বাড়ি যাই কন!

    সোনার বার বার মনে হচ্ছিল, ওকে কে নদীর ওপারে ডাকছে! কে যেন এই নদীর পাড়ে পাড়ে ওকে অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে সেই গলার স্বর সে কিছুতেই চিনতে পারছে না। সে ভয়ে পড়ি মরি করে ছুটতে থাকল। ভয়, নিশিটিশি হতে পারে। তাকে নিশিতে ডাকছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }