Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.১৯

    ১.১৯

    মেলার দাঙ্গা মেলাতেই শেষ হয়ে গেল। ঈশম বাড়ি ফিরে এসেছিল সকলের শেষে। শীর্ণ চেহারা, দুর্বল। দেখলে মনে হবে, শরীর থেকে প্রাণপাখি উড়ে গেছে। সে সেই যে ডাকছিল, মাঠে মাঠে নদীর পাড়ে, ডাক আর থামেনি। কেমন চোখ ঘোলা—যেন সে কোনও নাবালককে হত্যা করে ফিরছে। কে যেন বলল, ঈশমকে দেখে এসেছে বিলের পাড়ে বসে বিড়বিড় করে কি বকছে। শচীন্দ্রনাথ আর দেরি করেন নি। মেলার দাঙ্গা এদিকে ছড়ায়নি। রাতে রাতে শেষ হয়ে গেছে। রূপগঞ্জ থেকে একদল পুলিশ নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চে একদল আর্ম পুলিশ এসে শেষপর্যন্ত দাঙ্গা আয়ত্তে এনেছে। মাতব্বর মানুষেরা আবার সবাইকে মিলেমিশে থাকতে বলে ভাবল—যাক, এবারের মতো ফয়সালা হয়ে গেল। সামু খবর পেয়ে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছে। বিলের পাড়ে যাবার সময় সামুর সঙ্গে শচীন্দ্রনাথের দেখা – সামু বলল কর্তা কৈ যান?

    —যামু ফাওসার বিলে।

    —এই সকাল সকাল!

    —ঈশমটা ত ফিরে নাই। দাঙ্গাতে ঈশম বুঝি গ্যাল মনে হইল। এখন শুনতাছি ঈশম বিলের পাড়ে দুই দিন ধইরা বইসা আছে।

    শচীন্দ্রনথ ঈশমকে প্রায় বিলের পাড় থেকে ধরে এনেছিলেন। চোখমুখ দেখলে আর বিশ্বাসই করা যায় না এই সেই ঈশম। সোনা লালটু পলটু ঈশমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ওদের দেখে ওর কেমন শরীর কাঁপছিল। সে হাসতে পারল না। সে যেন বিশ্বাস করতে পারল না—ওরা ফিরে আসতে পারে। সে নাবালকদের মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, বাবু আপনেরা বাইচ্যা আছেন। বাবু গ, বলে তার ভিতর থেকে কেমন কান্নার আবেগ উঠে আসছিল।

    শচীন্দ্রনাথ ধমক দিলেন।—এই, ওঠ। যা, এখন সান কইরা খা। তারপর ঘুমাইবি। তরমুজ খেতে আজ আর নাইমা যাইতে হইব না। তোমরাও যাও। অরে একটু বিশ্রাম নিতে দ্যাও, বলে সোনা লালটু পলটুকে বৈঠকখানার ঘর থেকে নেমে যেতে বললেন। ওরা নেমে না গেলে ঈশম সারাদিন ওদের সামনে বসে থাকবে এবং পাগলের মতো হাউমাউ করে আবেগে সুখের কান্না কাঁদতে থাকবে।

    মেলা থেকে মালতীও ফিরে এসে কেমন ভয়ে দিন কাটাতে থাকল। রাত হলে সে ঘরের বার হতো না। কুপি জ্বেলে বসে থাকত। রাত হলে শোভা আবুকে বুকে নিয়ে কেবল দুঃস্বপ্ন দেখত। এক একদিন বলার ইচ্ছা হতো, ঠাকুর, আর পারি না। রাইতে ঘুম নাই চোখে, মনে হয় কারা য্যান রাইতে বাড়ির উঠোনে ফিসফিস কইরা কথা কয়। তোমারে ঠাকুর বুঝাইতে পারি না, পরাণে কি জ্বালা। সেই যেন জালালির মতো, জ্বালা সহে না প্রাণে! জ্বালা মরে না জলে। ঠাণ্ডা হাত! উষ্ণ স্পর্শের জন্য মালতীকে কাতর দেখাচ্ছে। অথবা যেন বলার ইচ্ছা, ঠাকুর, আমারে নিয়া, যেদিকে দুই চক্ষু যায়, চইলা যাও। কিন্তু সকাল হলে, যখন টোডারবাগের মাঠে মোরগেরা ডাকে, সূর্য গাবগাছটার ফাঁকে উঁকি মারে তখন কিছু আর মনে থাকে না। তখন মনটা পাগল পাগল লাগে, কোনও ফাঁক-ফিকির খোঁজা, কী করে মানুষটারে দ্যাখা যায়।

    একদিন সে রঞ্জিতকে বলল, আমারে একটা চাকু দিবা ঠাকুর?

    —চাকু দিয়ে কী করবে?

    —আমারে দাও না। কাঠের চাকু দিয়া আর খেলতে ইসছা হয় না।

    —হাত তোমার এখনও ঠিক হয়নি মালতী। ঠিক হলে এনে দেব।

    মালতীর বলার ইচ্ছা হতো, আমার হাত ঠিক নাই কে কয়! তুমি আমারে আইনা দ্যাও, দ্যাখ একবার কি খেলাটা খেলি। বঝি মরণ খেলার সখ। অমূল্যর বড় বেশি বাড় বাড়ছে। রঞ্জিত আসার পর থেকেই অমূল্য কেমন মরিয়া। সে ফাঁক-ফিকিরে আছে, মালতীকে পেলেই সাপটে ধরবে, ঝোপে জঙ্গলে অথবা কবি-গান হলে, যাত্রা গান হলে, যখন কেউ বাড়ি থাকবে না, তখন সাপটে ধরবে। মালতী বাড়ি পাহারা দেবার জন্য শুয়ে থাকে, থাকতে থাকতে দরজায় শব্দ, কে তুমি! আরে কথা কও না ক্যান, দরজা খুইলা চইলা আস, একবার চাঁদের লাখান মুখখানা, বলেই ভিতরে ভিতরে মরণ খেলার জন্য মালতী প্রস্তুত হতে থাকে। তখনই মনে হয় যেন জব্বর দাঁড়িয়ে আছে গাছতলাতে, ইস্তাহার বিলি করছে। বলছে, মালতী দিদি আইলেন। ওর পাশের মানুষগুলি দাঁত বের করে মালতীকে দেখছে। ঠিক এমন একটা ছবি ভাসলেই, ওর বায়না রঞ্জিতের কাছে, ঠাকুর দ্যাও না, বড় একটা চাকু, দিবা আমারে, সূর্য ডুবলে আমার বুকে জল থাকে না।

    দাঙ্গার পর থেকে এই লাঠিখেলা ছোরাখেলা রাতের আঁধারে। অথবা অন্য কোথাও ডে-লাইট জ্বেলে। এবং বড় দালানবাড়ির মাঠকোঠা পার হলে যে নির্জন জায়গা গ্রামের, সেখানে সবাই জমা হতো। এখন আর রঞ্জিত এসব দেখে বেড়ায় না। সে দূরে চলে যায়, কোথায় যায়, কেন যায়, কেউ জানেনা। কবিরাজ এবং গোপাল দেখাশোনা করছে। ফাল্গুন-চৈত্র গেল। বোশেখ মাস বড় গরম। গরমে জ্যোৎস্না উঠলে ডে-লাইট জ্বালা হতো না। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় খেলা হতো। মুখগুলি তখন ভলো করে যেন চেনা যেত না। মালতী শোভা আবুকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরবাড়ি চলে আসত। ধনবৌ, বড়বৌ থাকত। পালবাড়ি থেকে সুভাষের মা আসত। হারান পালের বৌ আসত। চন্দদের বড় বড় দুই মেয়ে মতি গগনি আসত। ধীরে ধীরে খেলা জমে উঠলে, সোনাদের নতুন মাস্টারমশাই শশীভূষণ সকলের হাতে ভিজা ছোলা গুড় দিতেন। এই দেশে কোথায় কবে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে! তিনি ইতিহাসের ছাত্র। যখন স্বাধীনতা আসে, এমন গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। বেধে গেলে এইসব লাঠিখেলা আপন প্রাণ রক্ষার্থে কাজে আসে।

    কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে। ঠিক এ-অঞ্চলে বাস করলে টের পাওয়া যায় না। অভাবে অনটনে মানুষ চলে আসছিল, শশীভূষণ এই দলের বুঝি। তিনি চাকুরি নিয়ে চলে এলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সোনা শশীভূষণের পায়ের কাছে বসে ইতিহাসের গল্প শুনত, ট্রয় যুদ্ধ, ট্রয়ের সেই কাঠের ঘোড়া। শহরের দরজায় কাঠের ঘোড়াটা কারা রেখে গেল। কত বড় ঘোড়া! নগরীর শিশুরা সেই কাঠের ঘোড়ার চারপাশে ঘুরে ঘুরে গান গাইছিল। সেই কাঠের ঘোড়া সমুদ্রের বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে আছে—কী বড় আর উঁচু। এবং ভিতরে হাজার হাজার সৈন্য। সেই ট্রয়ের নগরী এবং সমুদ্রের বালিয়াড়ির কথা মনে হলেই সোনার মনে হয় রাজার এক দেশ আছে। বাবার কাছে সে গল্প শুনেছে। মুড়াপাড়ার বাবুদের বাড়ি নদীর পাড়ে। প্রাসাদের মতো অট্টালিকা। নদীর চরে কাশফুল এবং বড় চর পার হলে পিলখানার মাঠ। মাঠে সব সময় হাতিটা বাঁধা থাকে। বাবুদের মেয়ে অমলা কমলা। কমলা ওর বয়সী মেয়ে। ওরা কলকাতায় থাকে। পূজার সময় ওরা আসে। কেন জানি সোনার ট্রয় নগরীর কাঠের ঘোড়ার কথা মনে হলে নদীর চরে হাতিটার কথা মনে হয়। অমলা কমলার কথা মনে হয়। আর মনে হয় সেই অট্টালিকার মতো প্রাসাদের কথা। বড়দা মেজদা পুজা এলেই যায়। সে যেতে পারে না। মেলা থেকে এসে এবার কেন জানি তার মনে হল, দাদাদের মতো সেও এবার মুড়াপাড়া যেতে পারবে। বাবুদের হাতি, শীতলক্ষ্যা নদী, পিলখানার মাঠ এবং নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সেই স্টিমারটা দেখতে পাবে। কী আলো, কী আলো! সারা নদী উথালপাথাল করে আলোটা গ্রামের দু’পাশের মাঠে, ঘাসে ঘাসে, নদীর চরে, কাশবনে কিছুক্ষণের জন্য স্থির উজ্জ্বল হয়ে থাকে। সোনা মেলা থেকে এসেই কেন জানি ভাবল সে বড় হয়ে গেছে। সে এবার মুড়াপাড়া দুর্গাপূজা দেখতে যেতে পারবে।

    এই শশীভূষণ ভোর হলে তক্তপোশে বসে থাকতেন। দুলে দুলে কী সব বই পড়তেন। সোনা চেয়ারে বসে পা দোলাত এবং মনোযোগ দিলে ওর পড়া শিখতে বেশি সময় লাগত না। তারপর এদেশে বর্ষকাল এলে নৌকায় করে স্কুল। মাস্টারমশাই কাঠের পাটাতনের মাঝখানে বসে থাকতেন। ঈশম লগি বাইত। ওরা তিন ভাই, গ্রামের আরও চার পাঁচজন ছেলে একসঙ্গে মাস্টারমশাইকে নিয়ে বিদ্যালয়ে চলে যেত।

    বর্ষা এলেই কত শালুক ফুল ফুটে থাকে চারদিকে। তখন এসব অঞ্চলে আর হাতি ঘোড়া উঠে আসতে পারে না। কেবল জল আর জল। ধানের জমি, পাটের জমি। জলে জলে দেশটা ডুবে থাকে। মাছ, ছোট বড় রুপোলী মাছ জলের নিচে। স্ফটিক জল। ধানখেতে পাটখেতে কত রাজ্যের সব পোকামাকড়। ছোট বড় নীল সবুজ রঙের কাঁচপোকার মতো আবার হলুদ রঙ কোনও পোকার! সূর্য উঠলে এই সব পোকামাকড় পাতার নিচে লুকিয়ে থাকে। সোনা নৌকায় উঠলেই কৌটোয় যত সোনাপোকা ধরে আনে। একবার সে একটা আশ্চর্য রকমের পোকা পেয়েছিল—সোনালী রঙের কাঁচপোকা। টিপ দেবার মতো। পোকাটাকে পোকা বলে চেনাই যায় না। মুক্তো বিন্দুর মতো মাঝখানে উজ্জ্বল। চারদিকে তার সোনালী রঙ। কালো একটা বর্ডার দেওয়া, হাত-পা বলে কিছু নেই। সত্যি কপালে টিপ দেবার জন্য যেন এই কাঁচপোকা। সে ফতিমার জন্য কাঁচপোকা কৌটোর ভিতর রেখে দিয়েছিল। কবে ফতিমা আসবে! এখন আর দেখা হয় না। বর্ষা এলে এ-গ্রামে হুট করে চলে আসতে পারে না ফতিমা। সে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে গোপনে কাঁচপোকা ওর স্যুটকেসে তুলে রাখল। বর্ষা শেষ হলে সে ফতিমাকে কপালে টিপের মতো পরিয়ে দেবে।

    সোনা এইসবের ভিতর বড় হতে হতে একদিন দেখল, মেজ জ্যাঠ্যামশাই নৌকা পাঠিয়েছেন। মুড়াপাড়া থেকে নৌকা এসেছে। ছোটকাকা বললেন, সোনা, তুমি যাইবা দুগ্‌গা ঠাকুর দ্যাখতে! কান্দাকাটি কইর না কিন্তু। সোনা এবার দূরদেশে যাবে। আকাশে বাতাসে পূজার বাজনা বেজে উঠল। মুড়াপাড়া থেকে নৌকা এসেছে। অলিমদ্দি বড় একটা মাছ তুলে আনল। সোনা, লালটু, পলটু মাছটাকে টেনে রান্নাঘরে তুলছে। কত বড় মাছ। ওরা তিনজনে নড়াতে পারছে না। বড়বৌ, ধনবৌ মাছটা দেখে তাজ্জব। ঢাইন মাছ! পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ এত বড় মাছটা দেখে উঠোনের ওপর নাচতে থাকলেন।

    সোনা বলল, আমি মুড়াপাড়া যামু দাদা।

    –কে কইছে তুমি যাইবা?

    —কাকায় কইছে।

    লালটু ভেবেছিল মা হয়তো বলেছেন। মা বললে এ সংসারে কিছু হয় না। মার কিছু বলার কোনও অধিকার নেই। ছোটকাকা যখন বলেছে, তখন যথার্থই যাবে সোনা। কেউ বাধা দিতে পারবে না। লালটু কেমন বিরক্ত হয়ে বলল, ভ্যাক্ কইরা কাইন্দা দিলে হইব না, আমি বাড়ি যামু—বলে লালটু সোনাকে মুখ ভেংচে দিল। এই অভ্যাস লালটু পলটুর। সোনাকে ওরা সহ্য করতে পারে না। বাড়িতে সোনা সবার ছোট বলে ওর আদর বেশি। এতদিন সে মুড়াপাড়া যেতে পারে নি—এটা একটা সান্ত্বনা ছিল। সেই সোনা ওদের সঙ্গে যাচ্ছে। রাগ হয় না!

    সোনাও ছেড়ে দেবার পাত্র না। সে দুগ্‌গা ঠাকুর দেখতে যাবে। ওর প্রাণে কি যে আনন্দ। মন প্রসন্ন দাদারা খারাপ বলে সে খারাপ হবে কেন! সে দূরদেশে যাবে। সে কতদূর! একদিন লেগে যাবে যেতে। কত নদী বন মাঠ পড়বে যেতে। সে লালটুকে মন প্রফুল্ল থাকলে দাদা বলে ডাকে। পলটুকে বড় দাদা সে এখন মোটামুটি স্কুলের ভালো ছাত্র। সে এখন দূরের মাঠে একা নেমে যেতে পারে। যব খেতে লকোচুরি খেলেতে আজ-কাল আর ভয় পায় না।

    ধনবৌ সোনার মুখ দেখতে থাকল। বড় করে কাজল টেনে দিয়েছে চোখে। সুন্দর মুখ। যত লাবণ্য চোখে। বয়সের অনুপাতে লম্বা বেশি। একটু মাংস থাকলে শরীরে এ-লাবণ্য সবুজ দ্বীপের মতো। সোনার চোখ বড়। কাজল দিলে সে চোখ আরও বড় দেখায়। কপালের একপাশে কড়ে আঙুলে ধনবৌ লম্বা করে কাজল টেনে দিল। বাঁ পা থেকে সামান্য ধুলো নিয়ে সোনার মাথায় দিল এবং সামান্য থুতু ছিটিয়ে দিল শরীরে। তারপর সোনাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। চুমু খেল কপালে। সোনার কেমন সুড়সুড়ি লাগছিল—কাতুকুতুর মতো। সোনা খিলখিল করে হাসছিল।

    সোনা একেবারে পুরোপুরি পাগল মানুষের মুখ পেয়েছে। শরীরের গড়ন দেখলে বোঝা যায়, তেমনি লাবণ্যময় শরীর তার, বয়সকালে উঁচু লম্বা হবে খুব। ধনবৌ সোনাকে কোলে নিয়ে আদর করতে চাইল। কিন্তু সোনার সংকোচ হচ্ছে। সে লজ্জা পাচ্ছিল। বলল, আমার লজ্জা করে। আমি কোলে উঠমু না মা।

    দূরদেশে যাবে ছেলে। সাত আটদিন ধনবৌ এই ছেলে বুকে নিয়ে শুতে পারবে না। বুকটা কেমন টনটন করছিল। বলল, লও তোমারে নৌকায় দিয়া আসি। এই বলে জোরজার করে কোলে তুলে নিতে চাইল।

    সোনা কিছুতেই উঠল না।

    ধনবৌ বলল, আমার যে ইচ্ছা করে তোমারে একটু কেলে লই। বলে ফের ছেলেকে দু’হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে গেল।

    —ধ্যাৎ, তুমি কি যে কর না মা! আমারে তুমি কোলে নিবা ক্যান! আমি বড় হই নাই।

    —অ—মারে! আমার সোনা বড় হইছে। বড়দি শুইনা যান, কি কয় সোনা। সোনা নাকি বড় হইছে। কোলে উঠতে লজ্জা।

    নৌকা ঘাটে বাঁধা। ওরা তিনজনে যাবে মুড়াপাড়া। দুগ্‌গা ঠাকুর দেখতে যাবে। গ্রামের পুজো প্রতাপ চন্দ করে। কতকালের এক মামলা আছে। কেউ সে বাড়ি ঠাকুর দেখতে যেতে পারে না। ছোট বালকদের মন মানবে কেন! পুজোর সময় হলেই ভূপেন্দ্রনাথ নৌকা পাঠিয়ে দেন।

    সুতরাং সোনা লালটু পলটু যাচ্ছে মুড়াপাড়া। ঈশম নিয়ে যাচ্ছে। এ-ক’দিন অলিমদ্দি বাড়ির কাজ করবে। ঈশমেরও যেন ক’দিন ছুটি। সে এই দলবল নিয়ে হৈচৈ করে ফিরে আসবে। সে সকলের আগে নৌকায় উঠে বসে আছে। ভাল লগি নিয়েছে। বৈঠা নিয়েছে। অন্যের লগি বৈঠা ওর পছন্দ নয়। পালের দড়িদড়া ঠিক আছে কিনা দেখে নিচ্ছে। খুঁটিনাটি কাজ। দূরদেশে যাবে। একদিন লেগে যাবে। সে সবকিছু, এমন কি হুঁকো-কলকে ঠিক করে নিল। দশ ক্রোশের মতো পথ! এখন এই সকালে রওনা হলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। ঘুরে ফিরে যেতে হবে। নদীতে এবং বিলে বাতাস পেলে, স্রোতের মুখে তুলে দিতে পারলে তবে সকাল সকাল যেতে পারবে।

    সোনা ঠাকুর্দাকে প্রণাম করল। বলল, দাদু আমরা মুড়াপাড়া পূজা দ্যাখতে যাইতাছি।

    বুড়ো মানুষটি খুঁজেপেতে চিবুক ধরে বলল, তাই বুঝি!

    লালটু বলল, দাদু দশরায় আপনের লাইগা কি কিনমু?

    বুড়ো মানুষটা কোনও উত্তর দেবার আগেই পলটু ঠাট্টা করে বলল, ঝুমঝুমি বাঁশি কিনমু।

    -–দ্যাখছ, দ্যাখ বড়বৌ—কি কয় তোমার পোলা! আমাকে ঝুমঝুমি বাঁশি কিনা দিব কয়।

    —ঠিকই বলেছে। আপনি ছেলেমানুষের মতো কাঁদেন। আপনাকে কেউ খেতে দেয় না কন!

    —আমি কই বুঝি!

    —কন না!

    —আমার কিছু মনে থাকে না বড়বৌ।

    পলটু নৌকায় উঠে দেখল, পাগল মানুষ গলুইতে বসে আছে চুপচাপ। সে কখনও বাবা বলে ডাকে না। এই মানুষ বড় অপরিচিত তার কাছে। এই মানুষের পাগলামি কেমন বিরক্তিকর। সে যত বড় হচ্ছে, এক পাগল মানুষ তার বাবা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। বাবাকে এড়িয়ে চলার একটা স্বভাব গড়ে উঠেছে পলটুর ভিতর। কিছুটা যেন শাসনের ভঙ্গি। এই মানুষের কোনও অসম্মান ওকে পীড়া দেয়। নানাভাবে সেসব অসম্মান থেকে মানুষটাকে রক্ষা করার বাসনা। কিন্তু সে আর কী মানুষ যে,–এই পাগল মানুষকে ধরে বেঁধে রাখবে।

    নৌকার গলুইয়ে চুপচাপ বসে আছেন তিনি। পাটাতনের ওপর পদ্মাসন করে বসে আছেন। পলটু নৌকায় উঠেই বলল, আপনে নামেন। কই যাইবেন আপনে?

    পাগল ঠাকুর পলটুর কথার কোনও জবাব দিলেন না। ছেলেমানুষের মতো ফিফিক্ করে হাসলেন। পলটু এবার রেগে গিয়ে বলল, আপনে নামেন। নামেন কইতাছি। মণীন্দ্রনাথ এতটুকু নড়লেন না। কথা বললেন না। বরং কাপড়টা বেশ যত্ন নিয়ে পাট করে পরলেন। পোশাকে কোনও অশালীন কিছু আছে, এই ভেবে কাপড়টা বেশ গুটিয়ে পরলেন। হাতকাটা শার্ট গায়ে। শার্টটা টেনেটুনে দিলেন। মাথার চুল হাতেই পাট করতে থাকলেন। দ্যাখো, এই চুল আমার, এই বসনভূষণ আমার—এবার আমি তোমাদের সঙ্গে যেতে পারি। বলে ধ্যানী পুরুষের মতো ফের পদ্মাসনে বসে পড়লে পলটু হাত ধরে টানতে আরম্ভ করল, নামেন আপনে। মা। মা–আ। সে চিৎকার করতে থাকল। যেন বড়বৌ এলেই সব ফয়সালা হয়ে যাবে। কিন্তু বড়বৌর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

    ঈশম কিছু বলছিল না। সে বেশ মজা পাচ্ছে। সে চুপচাপ ছইয়ের ওপাশে বসে আছে। কিছু দেখতে পাচ্ছে না মতো বসে বেতের ঝোপে বোলতার চাক খুঁজছে।

    পলটু বলল, নামেন এখন। নৌকা ছাইড়া দিব।

    কে কার কথা শোনে! এমন শরৎকালের সকাল, ঠাণ্ডা হাওয়া ধানখেত থেকে ভেসে আসছে, কোড়ার ডাক ভেসে আসছিল। নদীতে নৌকায় পাল দেখা যাচ্ছে। পাল তুলে নদীতে গ্রামোফোন বাজাতে বাজাতে কারা যেন যায়। সোনালী বালির নদী থেকে সব বড় বড় মাছ ধান খেতে শ্যাওলা খেতে উঠে আসছে। কত শস্যক্ষেত্র দু’পাশে অথবা স্ফটিক জল—কারণ পাট কাটা হলে গ্রাম মাঠ দ্বীপের মতো। চারপাশে যেন দীঘির জল টলটল করছে। বিশাল জলরাশি নিয়ে এইসব বাড়ি জমি এবং নদী ভেসে রয়েছে। মণীন্দ্রনাথের কতদিন থেকে কোথাও যাবার বাসনা। বর্ষা এলেই তিনি বন্দী রাজপুত্রের মতো শুধু অর্জুন গাছটার নিচে বসে থাকেন। মুড়াপাড়া থেকে নৌকা এসেছে শুনেই ওঁর দুরদেশে যাবার ইচ্ছা হল। সবার আগে যা কিছু পরনে ছিল, তাই নিয়ে তিনি নৌকায় উঠে বসে আছেন। চুল কি সুন্দরভাবে পাট করেছেন। ভদ্র মানুষের মতো চুপচাপ। একেবারে সেই এক সরল বালক যেন। পলটু যত এসব দেখছিল তত ক্ষেপে যাচ্ছিল। সে এবার ভয় দেখাবার জন্য বলল, ডাকমু ছোট কাকারে?

    মণীন্দ্রনাথ খুব অপরাধী চোখে পলটুর দিকে তাকালেন। যেন বলার ইচ্ছা—বাছা, আর ডেকো না, আমি তোমাদের পাশে চুপচাপ বসে থাকব। মণীন্দ্রনাথের বড় অবলা জীবের মতো চোখ। চোখে এক অসামান্য অসহায় দুঃখ ভেসে বেড়াচ্ছে—আমি যে এক পাগল মানুষ। কতকাল ধরে হাঁটছি। তবু সেই দুর্গের মতো প্রাসাদে পৌঁছাতে পারছি না। তিনি তাঁর জাতককে এমন কিছু বুঝি বলতে চাইছেন।

    লালটু পলটু উঠে এল। ছোট কাকা ঘাটে এসেই বললেন, ভিতরে কে বইসা আছে রে?

    সঙ্গে সঙ্গে মণীন্দ্রনাথ ছই-এর ভিতর থেকে গলা বাড়িয়ে দিলেন। হামাগুড়ি দিয়ে যেন কত বাধ্যের ছেলে, বের হয়ে পাটাতনে দাঁড়ালেন। ধনবৌ বড়বৌ এসেছে ঘাটে। নৌকা ছেড়ে দিলে ওরা চলে যাবে। তখন মণীন্দ্রনাথ পাড়ে উঠে আসছেন। চোখমুখে কি ভয়ঙ্কর উদাসীনতা। নৌকার গলুইয়ে জল দিয়ে ঈশম ঘাট থেকে দড়ি ছেড়ে দিলে পাগল মানুষ ছুটে যেতে চাইলেন। বড়বৌ এখন ঘাটে। সুতরাং কোনও ভয় নেই। সে যেমন দু’হাত ছড়িয়ে অন্যান্যবার আগলে রাখে এবারেও আগলে রাখল। বলল, এস, বাড়ি এস। বড়বৌর সেই এক বিষণ্ণ মুখ! কত আর বয়েস এই বড়বৌর। ত্রিশ হতে পারে, তেত্রিশ হতে পারে। বড়বৌর বয়স মুখ দেখে ধরা যায় না। বড়বৌর দিকে তাকিয়ে পাগল মানুষ আর নড়লেন না। সোনা ছইয়ের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখল, বড় জেঠিমা জ্যাঠামশাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। সোনার বড় কষ্ট হতে লাগল। সে এবার গলা ছেড়ে হাঁকল, জ্যাঠামশয়।

    মণীন্দ্ৰনাথ কেমন দু’হাত ওপরে তুলে দিলেন। আশীর্বাদ করার মতো ভঙ্গিতে দু’হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সোনা এবার চিৎকার করে বলল, দশরা থাইকা কি আনমু?

    পার তো আমার জন্য কপিলা গাইর দুধ এনো—যেন এমন বলার ইচ্ছা। আর যদি পার, শীতলক্ষ্যার চরে এখন যেসব কাশফুল ফুটে থাকবে, বাতাসে তা আমার নামে উড়িয়ে দিও। সেই এক মেয়ে, পলিন যার নাম, পার তো তার নামে কিছু কাশফুল জলে ভাসিয়ে দিও।

    সোনা দেখল জ্যাঠামশাই কিছুই বলছেন না! জেঠিমা চুপচাপ। ক্রমে নৌকা ভেসে যেতে থাকল। ক্রমে ধানখেত পার হলে, সোনালী বালির নদী। নদীতে নৌকা নেমে গেলে আর কিছু দেখা গেল না। সোনাও এবার ছইয়ের ভিতর চুপচাপ বসে থাকলে ঈশম বলল, কি দ্যাখছেন সোনাবাবু?

    বিলের জলে নৌকা ছেড়ে দিয়েছিল ঈশম। সোনাকে এমন চুপচাপ দেখে কথা না বলে পারছিল না।

    সোনা অপলক শুধু দেখছিল। এমন অসীম জলরাশি, পারাপারহীন জলরাশি—কত দূর চলে গেছে—বুঝি আর এই নাও এবং মাঝি বিল পার হবে না—জল শুধু জল। সোনা বিস্ময়ে হতবাক। সোনা কিছু বলল না। এই বিলে আবেদালির বৌ ডুবে মরেছে। এই বিলের জলে এক ময়ূরপঙ্খী নাও আছে—সোনার নাও, পবনের বৈঠা। সোনার বলতে ইচ্ছা ঈশমকে—এই যে জল, জলের নিচে যে নাও, সোনার নাও পবনের বৈঠা—পারেন না আপনে সেই নাও তুলে আনতে। আমি, আপনে আর পাগল জ্যাঠামশাই সেই নাও নিয়ে বিল পার হয়ে চলে যাব। যেন এমন নাও মিলে গেলেই ওরা সেই র‍্যামপার্টে চলে যেতে পারবে। চোখ নীল, সোনালী চুল মেয়ের—আহা, বড় ডুব দিতে ইচ্ছা করছিল বিলের জলে। ডুব দিয়ে ময়ূরপঙ্খী নৌকাটা তুলে আনতে ইচ্ছা হচ্ছিল সোনার।

    .

    ভোরবেলা উঠে মালতী যেমন অন্যদিন সে তার হাঁস কবুতর খোঁয়াড় অথবা টঙ থেকে ছেড়ে দেয়, যেমন সে অন্য কাজগুলি করে চুপচাপ কিছুক্ষণ উঠানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি সে আজও দাঁড়িয়ে থাকল। হাঁসগুলি জলে ভেসে দূরে চলে যাচ্ছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি মালতীর। কারা যেন সারারাত অন্ধকারে বাড়িটার ঝোপে জঙ্গলে ঘোরাফেরা করেছে। দাঙ্গার পর থেকেই মালতীর প্রাণে অহেতুক ভয়! নরেন দাসের বৌ বলেছে, তর যত কথা! কে তরে আর নিতে আইব।

    সুতরাং সকালবেলা রাতের সেই ফিসফাস শব্দের কথা কাউকে সে বলতে পারল না। ভয়ে সে যথার্থই রাতে দরজা খুলে বের হয়নি। দু-একবার ওঠার অভ্যাস রাতে। সে সব চেপেচুপে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে।—কে কে! এমন কি সে রাতে দু-তিনবার কে কে বলে চিৎকার করে উঠেছিল। –কারা কথা কয় গাছের নিচে। সে একবার ঝাঁপ তুলে দেখবার চেষ্টা করেছে। কখনও মনে হয়েছে—সেই দাঙ্গা,দাঙ্গার আগুন চোখের ওপর জ্বলছে। সে এসব দেখলেই আঁতকে উঠত—তারপর মনে হতো, না, স্বপ্ন! জব্বরকে মালতী দু’দিন উত্তরের ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। নরেন দাস তেড়ে গেছে, তুমি এখানে ক্যান মিঞা! তারপর বলত, তর বাপ আইলে, না কইছি তা…। জব্বর হাসত। হাসতে হাসতে দাড়িতে হাত বুলাত। বড় দাড়ি-গোঁফ, চেনা যায় না—জব্বর এখন মাতব্বর মানুষ যেন। সে ওর মায়ের মৃত্যুর পর এদিকে অনেকদিন ছিল না। কোথায় কোন গঞ্জে সে এখন তাঁত কিনে ব্যবসা করার চেষ্টা করছে। আবেদালির সঙ্গে ওর কোনও সেম্পর্ক নেই। আবেদালি আবার নিকা করে ভাঙা ঘরে শণ দিয়েছে। বিবির জন্য আতাবেড়া দিয়েছে। আবেদালির হাঙ্গা করা বৌ মল বাজিয়ে এখন ঘরের ভিতর শুয়ে-বসে থাকে। আবেদালিকে জব্বর আর পরোয়া করে না। এমন কি সেদিন বাপ-বেটাতে বচসা। লাঠালাঠি। আবেদালি বলেছিল, হারে পুত, তুই জননীর গায়ে হাত দ্যাস। সেই জব্বর এখন এদিকে এলে আর বাপের কাছে ওঠে না। সে ফেলু শেখের বাড়ি এসে ওঠে। এবং যে ক’দিন থাকে, ফেলুর বিবিকে আতর কিনে এনে দেয়। সুগন্ধ তেল কিনে আনে হাট থেকে এবং বড় ইলিশ কিনে এনে দু’চার রোজ প্রায় যেন জব্বর এক নবাব- পয়সার ওপর উড়ে বসে বেড়ায়। ফেলুর বিবি তো জব্বর এলেই উল্লাসে আর বাঁচে না। ফেলু সব বোঝে। সেই এক উক্তি তার—হালার কাওয়া! ভয়ডর নাই। তারপর কব্জিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ডান হাতটাতে সামান্য নিরাময়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে। বাঁ হাতের কব্জি তেমনি ফুলে ফেঁপে আছে। কালো রং। কুমিরের চামড়ার মতো খসখসে! মরা চামড়া উঠছে কেবল। কালো তারে সাদা কড়ি এবং আলকাতরার মতো চ্যাটচ্যাটে তেল মাখতে মাখতে হাতটা আর হাত নেই। জব্বর এলে বিবি তার নাচে গায়, ফুরফুরে বাতাসে উড়ে বেড়ায় আর কী সব সলা-পরামর্শ—ফেলু তখন ছেঁড়া মাদুরে জামগাছটার নিচে শুয়ে থাকে। নিদেন যখন চক্ষে আর সয় না, বাগি বাছুরটা নিয়ে মাঠে নেমে আসে। তারপর রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার—হালার কাওয়া, আমারে ডরায় না! সেই বিবি পর্যন্ত কিছুদিন হল জব্বরের সঙ্গে কথা কয় না, কী এমন ঘটনা— ওর জানার ইচ্ছা ছিল, কী এমন ঘটনা ওদের দু’জনকে মাঠের মতো বোবা বানিয়ে রেখেছে। সে আসে না, সে না এলে ফেলুর এখন আহার জোটা দায়।

    কোনও কোনও দিন জব্বর সোজা উঠোনে উঠে আসত। তারপর মালতীকে ডেকে বলত, দিদি আছেন?

    মালতী বাইরে এলে জব্বর বলতো, আপনের শ্বশুরবাড়ি যাইতে ইচ্ছা হয়না? আপনে শ্বশুরবাড়ি আর যাইবেন না?

    —না রে, কই যামু! কে আর আছে আমার! কি আর আছে আমার!

    —কি যে কন দিদি, কি নাই আপনের?

    মালতীর চোখে তখন জ্বালা ধরে যেত। মলতীর চেয়ে ছোট এই জব্বর। কিছু ছোট হবে। কত ছোট হতে পারে—সকালের হাওয় মুখে লাগবার সময় এমন ভাবল। আর দেখল এক কদর্য মুখ, চোখে এখন জব্বরের কী যেন লালসা। সে বুঝি ঘুরঘুর করতে ভালাবাসছে। সময় অসময় নাই সে লোক নিয়ে উঠোনের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। এইসব দেখলেই মালতীর ভয়টা বাড়ে। তখন যেন বলার ইচ্ছা, তোমার ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিমু। অথবা সেই মানুষটার কাছে চলে যেতে ইচ্ছা হয়–ঠাকুর, দিবা আমারে একটা বড় চাকু, আইনা দিবা!

    জব্বরের কথা মনে আসতেই মালতীর শরীর কেমন শক্ত হয়ে গেল। সে আর দাঁড়াল না। হেঁটে হেঁটে দীনবন্ধুর ডেফল গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। সে একটু আড়াল দেওয়া জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সে মানুষটাকে খুঁজছে। না, নেই মানুষটা। সে দুটো লেবুপাতা ছিঁড়ল, যেন সে এখন এখানে লেবু পাতা তুলতে এসেছে। মানুষটার বদলে সে শশীভূষণকে বৈঠকখানা ঘরে দেখতে পেল। তিনি গোছগাছ করছেন—স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, তিনি দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু সে গেল কোথায়? এ সময়ে মানুষটা জানালায় বসে থাকে। টেবিলের ওপর গাদা বই। কেবল বইয়ের ভিতর মানুষটা ডুবে থাকে। সে গেল কোথায়! মালতী আর অপেক্ষা করল না। কাঁখে জলের কলসী থাকলে এত ভয়ের কারণ থাকে না। একটা অছিলা থাকে। তবু যখন ভাবতে ভাবতে ঠাকুরবাড়ির উঠোনে উঠে এসেছে তখন আর ফেরা যায় না। সে ভিতর বাড়িতে ঢুকলে দেখতে পেল, ঘাট থেকে বড়বৌ ধনবৌ উঠে আসছে। মালতী এ-বাড়ির সকলকেই দেখতে পেল। কেবল রঞ্জিত নেই। রঞ্জিতকে কিছু বলা দরকার। একমাত্র মানুষ এই সংসারে যাকে সব বলা যায়। সে সোনাকে অনুসন্ধান করল। সে থাকলে তাকে বলা যেত, সোনা, তোমার মামা গ্যছে কোনখানে? কিন্তু সোনা, লালটু পলটু কেউ নেই।

    বড়বৌ মালতীকে দেখেই কি যেন টের পেল! বলল, তোর মুখ এমন কালো কেন রে? কিছু হয়েছে! কেউ কিছু বলেছে?

    —কি হবে আবার!

    —চোখ দেখলে মনে হয় সারা রাত না ঘুমিয়ে আছিস।

    মালতী এবার লজ্জা পেল। সে বলতে পারত, অনেক কিছু—না ঘুমিয়ে সে থাকবে কেন, সে তো বিধবা মানুষ, তার আর কার জন্য রাত জেগে থাকা। সুতরাং সে যা-ও ভেবেছিল, রঞ্জিত কই বৌদি, অরে দ্যাখতাছি না, সে তাও বলতে পারল না।

    মালতী উঠোন পার হয়ে এল। ঠাকুরঘরের পাশে সেই শেফালি গাছটা। সে গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। ফুলে ফুলে গাছের চারপাশটা সাদা হয়ে আছে। খুব ভোরে যারা ফুল তুলে নেবার নিয়ে গেছে। এর পরও ফুল ফুটেছে এবং ফুল ঝরে পড়েছে। মালতী কি ভেবে কোঁচড়ে ফুল তুলতে বসে পড়ে। কিছু কাজ ছিল না হাতে অথবা এও হতে পারে, কী করে এই উঠোনে কোন অছিলায় দেরি করা যায়—যদি রঞ্জিত কোথাও গিয়ে থাকে, তবে এক্ষুনি চলে আসবে। ফুল তুলতে তুলতে সে হয়তো চলে আসবে। সে রঞ্জিতের জন্য গাছের নিচে ফুল তোলার অভিনয় করছে। মালতীর খোঁপা খুলে গিয়েছিল—খালি গা মালতীর—সাদা থানে মালতীকে এই সকালে সন্ন্যাসিনীর মতো দেখাচ্ছে। কি পুষ্ট তার বাহু। এমন পুষ্ট বাহু আর শরীর নিয়ে সে কী করবে! রঞ্জিতের কাছে সে বুঝি এমন একটা প্রশ্ন করতেই এসেছে—আমি কী করি! আমি কী যে করি! তখনই উঠোনে পায়ের শব্দ। বুঝি রঞ্জিত। সে চোখ তুলে দেখল ছোটকর্তা। পিছনে অলিমদ্দি। অলিমদ্দিকে নিয়ে তিনি বোধ হয় যজমান বাড়ি যাচ্ছেন। পূজা-পার্বণের সময় এটা। দুর্গাপূজার সময়—সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, দশমীর পর ফাঁকা ফাঁকা ভাবটা পূর্ণিমাতে এসে ভরে যায়। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা—রাতে কোজাগরী জ্যোৎস্না। কি সাদা! কত ইচ্ছা তখন মালতীর। নদীর চরে সাদা জ্যোৎস্নায় তরমুজ খেতে চুপচাপ রঞ্জিতকে পাশে নিয়ে বসে থাকে। অঞ্জলিতে দু’হাত তুলে বলে, আমি বড় দুঃখিনী। তুমি আমারে নদীর পাড়ে নিয়ে যাও—অথবা যেন বলার ইচ্ছা, জলে নাও ভাসাওরে। মালতীর কেবল রঞ্জিতকে নিয়ে সাদা জ্যোৎস্নায় সোনালী বালির নদীর জলে নিভৃতে সাঁতার কাটতে ইচ্ছা হয়। জলে নাও ভাসাতে ইচ্ছা হয়।

    সে রঞ্জিতের প্রতীক্ষাতে বসে থাকল। সে এল না। দু’বার বড়বৌদি এদিকে এসেছিল, দুবারই বলবে ভেবেছিল, বৌদি রঞ্জিতকে দ্যাখতাছি না। কিন্তু বলা হয়নি। সঙ্কোচে সে বলতে পারেনি। বৌদি বৌদি, মনের ভিতর আকুতি তার, বৌদি বৌদি, আমি ফুল নিতে আসি নাই বৌদি, আমি…

    বড়বৌ বলল, কিছু বলবি আমাকে!

    —বৌদি, রঞ্জিতকে দ্যাখতাছি না।

    —ও ঢাকা গেছে।

    —ঢাকা গ্যাল। কেমন বিস্ময়ের সঙ্গে বলল,

    —হ্যাঁ, গেল। সন্ধ্যায় দেখি ওর এক বন্ধু এসে হাজির। বাউল মানুষ। এ বাড়িতে তো মানুষের শেষ নাই। বৈরাগী বাউল লেগেই আছে। খাবেদাবে, শোবে, রাত কাটাবে। ভোর হলে যেদিকে চোখ যাবে সেদিকে নেমে যাবে। ভাবলাম সেই বুঝি। ওমা, রাতে দেখি, কি সব ফিসফিস করে কথা। আমাকে বলল, দিদি ঢাকা যাচ্ছি, কবে ফিরব ঠিক নেই, ফিরব কিনা আর, তাও বলতে পারি না। এক নিঃশ্বাসে বলে গেল বড়বৌ।

    মালতী আর বড়বৌর সামনে দাঁড়াতে পারল না। সে বুঝি ধরা পড়ে যাবে। সে ছুটে বের হয়ে গেল। তুমি এমন মানুষ রঞ্জিত! সে যেন আর পারছে না! কোথাও ছুটে গিয়ে বুঝি ঝাঁপ দেবার ইচ্ছা। সে তেঁতুল গাছটা পার হয়ে গেল এবং বড় যে গাছটা পুকুরপাড়ে ছায়া ছায়া ভাব সৃষ্টি করে রেখেছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে সে হাউহাউ করে বুঝি প্রাণ খুলে কাঁদতে পারবে। কেউ টের পাবে না। সে ফুলগুলি এবার জলে ফেলে দিল। এবং দাঁড়িয়ে দেখল ফুলগুলি জলে ভেসে ভেসে কত দূরে যায়! রাতের অন্ধকারে ফিসফিস করে কারা যেন কথা বলে! আমি কই যাই ঠাকুর! মালতী সহসা চিৎকার করে উঠতে চাইল। কিন্তু পারল না। অভিমানে চোখ ফেটে শুধু জল নেমে আসছে তার।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }