Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.২০

    ১.২০

    ঈশম সহসা হেঁকে উঠল, কর্তারা ঠিক হইয়া বসেন! নৌকাটা খাল থেকে ঠেলে শীতলক্ষ্যার জলে ফেলে দেবার সময় এমন হেঁকে উঠল।—স্রোতের মুখে পইড়া গ্যালেন। পানিতে পইড়া গ্যালে আর উঠান যাইব না। সামনে বড় নদী, শীতলক্ষ্যা নাম তার।

    এত বড় নদীর নাম শুনে সোনা ছইয়ের ভিতরে ঢুকে বসে থাকল। লালটু পলটু ছইয়ের ওপর বসে ছিল এতক্ষণ। বড় নদীতে পড়ে গেছে শুনেই লাফিয়ে পাটাতনে নামল। দেখল—বড় নদী তার দুই তীর নিয়ে জেগে রয়েছে। স্রোতের মুখে নৌকা পড়তেই বেগে ছুটতে থাকল। সারা পথ বড় কম সময়ে পার হয়ে এসেছে। পালে বাতাস ছিল। উজানে নৌকা বাইতে হয়নি। আর কি আশ্চর্য নদীতে পড়তেই ঢাক-ঢোলের বাজনা। পূজার বাজনা বাজছে। দুই পাড়ে গাছ-পালা-পাখি এবং গাছ-পালা-পাখির ভিতর সোনা বড় অট্টালিকা আবিষ্কার করে কেমন মুহ্যমান হয়ে গেল। সারি সারি অট্টালিকা। এত বড় যেন সেই বিল জুড়ে অথবা সোনালী বালির নদীর চর জুড়ে—গ্রাম মাঠ জুড়ে—শেষ নেই বুঝি অট্টালিকার। রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। সে আর ছইয়ের নিচে বসে থাকতে পারল না। হামাগুড়ি দিয়ে বের হতেই দেখল জলে সেইসব ঐশ্বর্যমণ্ডিত প্রাসাদের প্রতিবিম্ব ভাসছে। যেন জলের নিচে আর এক নগরী। সে তার গ্রাম ছেড়ে বেশিদূর গেলে মেলা পর্যন্ত গেছে। কোথাও সে এমন প্রাসাদ দেখেনি—সে এবার উঠে দাঁড়াল। নৌকার মুখ এবার পাড়ের দিকে ঘুরছে। সামনে স্টীমার ঘাট, ঘাটের পাশে বুঝি নৌকা লাগবে। পাড়ে পাম গাছ। সড়ক ধরে পাম গাছের সারি অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। সড়কের ডাইনে নদীর চর এবং কাশফুল। উত্তরের দিকে পিলখানার মাঠ, মাঠ পার হলে বাজার এবং আনন্দময়ী কালীবাড়ি। ঘাটে রামসুন্দর এসেছিল ওদের নিতে–সে পাড়ে উঠে যাবার সময় সব বলল।

    নদী থেকে যত কাছে মনে হয়েছিল, যেন নদীর পাড়েই এই সব অট্টালিকা—নদীর পাড়ে নেমে মনে হল সোনার, তত কাছে নয়। ঠিক সড়কের পাশে পাশে হাঁটু সমান পাঁচিল। পাঁচিলের মাথায় লোহার রেলিঙ। ছোট-বড় গম্বুজ! কোথাও সেই গম্বুজে লাল-নীল পাথরের পরী উড়ছে। দু’পাশে সারি-সারি ঝাউগাছ। গাছের ফাঁক দিয়ে দীঘিটা চোখে পড়ছে। দু’পাড়ে বিচিত্র বর্ণের সব পাতাবাহারের গাছ, ফুলের গাছ, কত রকমারী সব ফুল ফুটে আছে, যেন ঠিক কুঞ্জবনের মতো। সাদা পদ্মফুল দিঘিতে—দু’পাড় বাঁধানো এবং ঝরনার জল যেন পড়ছে তেমন কোথাও শব্দ শুনে সোনা চোখ তুলে তাকাল। দেখল পাশে ছোট একফালি জমি। কি সব কচি ঘাস, লোহার জাল দিয়ে বেড়া। ভিতরে কিছু হরিণ খেলা করে বেড়াচ্ছে।

    লালটু-পলটু এই হরিণ অথবা চিতাবাঘের গল্প তাকে বলেছে। সে মনে-মনে একটা বিস্ময়ের জগৎ আগে থেকে তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু কাছে, এত কাছে এমন সব হরিণশিশু দেখে সোনা হতবাক। রামসুন্দর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। লালটু-পলটু পিছনে আসছে। সে ছুটে ছুটে এতটা এসেছিল। তারপর গেলেই বুঝি সেই চিতাবাঘ এবং ময়ূর। ময়ূরের পালক সে যাবার সময় নিয়ে যাবে ভাবল। তখনই মনে হল ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠছে। নুড়ি বিছানো রাস্তা। সাদা কোমল আর মসৃণ। সে দুটো-একটা নুড়ি তাড়াতাড়ি পকেটে পুরে ফেলল। তারপর মুখ তুলতেই দেখল, খুব সুন্দর এক যুবা এই অপরাহ্ণে ঘোড়ায় কদম দিতে দিতে ফিরছেন। পিছনে ফুটফুটে একটি মেয়ে। গায়ে সাদা ফ্রক। জরির কাজ ফ্ৰকে। ঘাড় পর্যন্ত মসৃণ চুল। সোনার মতো ছোট এক মেয়ে—যেন সেই রেলিঙ থেকে একটা বচ্চা পরী উড়ে এসে সেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে। সোনাকে পলকে দেখা দিয়েই সহসা উড়ে গেল। সদর খুলে গেছে ততক্ষণে। ঘোড়ার পিঠে সেই যুবা দিঘির পাড়ে বাচ্চা পরী নিয়ে উধাও হয়ে গেল। সোনা কেমন হতবাকের মতো তাকিয়ে থাকল শুধু।

    তার মনে হল ছোট্ট এক পরী ক্ষণিকের জন্য দেখা দিয়ে চলে গেছে। যেদিকে ঘোড়া গেছে, সোনা সেদিকে ছুটতে থাকল। ছুটতে ছুটতে সেই সদর দরজা। লোহার বড় গেট, ভিতরে একটা মানুষের গায়ে বিচিত্র পোশাক। হাতে বন্দুক কোমরে অসি। মাথায় নীল রঙের পাগড়ি। দরজা বন্ধ বলে সোনা ঢুকতে পারছে না ভিতরে। ঘোড়াটা এত বড় বাড়ির ভিতর কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল! সোনার কেমন ভয় ভয় করছে। পেছন দিকে তাকিয়ে দেখল, রামসুন্দর, লালটু পলটু আসছে।

    সোনা ছোট্ট এক প্রাণপাখির মতো অট্টালিকার নিচে দাঁড়িয়ে থাকল। যেন সে এক রাজার দেশে চলে এসেছে। রাজবাড়ি। এই সদরে মানুষ-জন বেশি ঢুকছে না। দীঘির দক্ষিণ পাড় দিয়ে মানুষ-জন যাচ্ছে। এ-ফটক অন্দরমহলের। সোনা নিরিবিলি এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে রামসুন্দর তাড়াতাড়ি হেঁটে গেল।

    মহলের এই ফটকে সবাই ঢুকতে পারে না। কেবল আপনজনেরা ঢুকতে পারে। অথবা কিছু আমলা যারা এই পরিবারে দীর্ঘকাল ধরে আশ্রিত। বিশেষ করে ভূপেন্দ্রনাথ, যার সততার তুলনা নেই, পারিবারিক সুখ-দুঃখে যে মানুষ প্রায় ঈশ্বরের শামিল। সোনা ঘোড়াটার পিছু-পিছু ছুটে ভেতরে ঢুকতে চাইলে মল্ল মানুষের মতো দুই বীরযোদ্ধা ফটক বন্ধ করে ছোট এক প্রাণপাখিকে ভিতরে ঢুকতে মানা করে দিল। সোনা প্রথম গরাদের ফাঁকে মুখ ঢুকিয়ে দিল। সে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করছে। অনেক দূর থেকে যেন কী এক সুর ভেসে আসছে। কে গান গাইছে যেন। সামনে সারি-সারি থাম, কারুকাজ করা কাঠের রেলিঙ। মাথার ওপর ঝাড়লণ্ঠন। সে প্রায় ফড়িঙের মতো উড়ে উড়ে ভিতরে চলে যেতে চাইছে।

    তখন কোথাও এক নর্তকী নাচছিল। ঘুঙুরের শব্দ কানে আসছে। তখন কোথাও ঢাকের বাদ্যি বাজছিল। ছাদের ওপর সারি-সারি পাথরের পরী উড়ছে। ওরা বাতাসে শরীরের সব বসনভূষণ আলগা করে ওড়াচ্ছে। অথবা পা তুলে হাত তুলে নাচছিল। চারপাশে সব মসৃণ ঘাসের চত্বর। কোমল ঘাসে ঘাসে পোষা সব বুলবুল পাখি। ছোট-ছোট কেয়ারী করা গাছ। গাছে-গাছে ফুল ফুটে আছে। দক্ষিণ থেকে এ-সময় কিছু পাখি উড়ে এসেছিল। সে-সব পাখি কলরব করছে। সে ফটকে মুখ রাখতেই দেখল—লাল অথবা হলুদ রঙের পোশাক পরে, ছোট-ছোট মেয়েরা লুকোচুরি খেলছে, তখনই রামসুন্দর হাঁকল, ফটক খুলতে হয়। ভূইঞা কর্তার পরিজন আইছে। সঙ্গে-সঙ্গে ক্যাচ-ক্যাঁচ শব্দ তুলে লোহার ফটক খুলে গেল। সোনাকে সেই মল্ল মানুষরা আদাব দিল! লালটু পলটু কি গম্ভীর! চাপল্য ওদের বিন্দুমাত্র নেই।

    ওরা শেষে একটা জলের ফোয়ারা পেল। সোনা যত দেখে,তত চোখ বড় হয়ে যায়। সেই মানুষ দু’জন বন্দুক ফেলে সোনাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাইলে, সোনা রামসুন্দরের পেছনে চলে গেল। কিছুতেই ওরা সোনাকে কাঁধে তুলে নিতে পারল না। ভূইঞা কর্তার পরিজন এই সোনা, ছোট্ট সোনা। জাদুকর-এর পালিত পুত্রের মতো মুখ চোখ। ওরা সোনাকে কাঁধে তুলে ভূপেন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যেতে চাইল। যেন নিয়ে গেলেই ইনাম মিলে যাবে তাদের—কিন্তু সোনা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছে। কেমন একটা ভয়-ভয় ভাব। বেশি জোরজার করলে হয়তো সে কেঁদেই ফেলবে।

    সোনা হেঁটে যেন এ-বাড়ি শেষ করতে পারছে না। সে যে এখন কোথায় আছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথার ওপর বড় বড় ছাদ। ছাদে ঝাড়লণ্ঠন দুলছে। লম্বা বারান্দা, জালালি কবুতর খিলানের মাথায়, জাফরি কাটা রেলিঙের পর্দা—কত দাসদাসীর কণ্ঠ—এসব যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। রামসুন্দর হাত ধরে মহলার পর মহলা পার করে নিয়ে যাচ্ছে। আহা, এ-সময় পাগল জ্যাঠামশাই থাকলে সোনার এতটুকু ভয়ডর থাকত না। দেওয়াল বড় বড় তৈলচিত্র পূর্বপুরুষদের। তারপরই নাটমন্দির। এখানে এসেই সে আবার আকাশ দেখতে পেল। ওর যেন এতক্ষণে প্রাণে জল এসেছে।

    ভূপেন্দ্রনাথ কাছারি বাড়িতে বসে ছিলেন। পূজার যাবতীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের হিসাবপত্র নিচ্ছিলেন। তখন কানে গেল—ওরা এসে গেছে। মোটা পুরু গদীতে বসে ছিলেন তিনি। সাদা ধবধবে চাদর বিছানো। মোটা তাকিয়া। মানুষ-জন কিছু প্রজাবৃন্দ নিচে বসে রয়েছে। তিনি সব ফেলে ছুটে গেলেন। কারণ এবার কথা আছে সোনা আসবে পূজা দেখতে। শেষ পর্যন্ত শচী ওকে পাঠাল কিনা কে জানে! সকাল থেকেই মনটা উন্মনা হয়ে আছে। রামসুন্দরকে ঘাটে বসিয়ে রেখেছেন দুপুর থেকে। কখন আসবে, কখন আসবে এমন একটা অস্থির ভাব। তিনি সব ফেলে ছুটে গেলে দেখলেন নাটমন্দিরে সোনা দেবী প্রণাম করছে। পরনে নীল রঙের প্যান্ট। পায়ে সাদা রবারের জুতো, সিল্কের হাফশার্ট গায়ে। শুকনো মুখ। সেই কখন বের হয়েছে। ভূপেন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি গিয়ে সোনাকে বুকে তুলে নিলেন। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে—কত কিছু চেয়ে নেবার ইচ্ছা এই বালকের জন্য। কিন্তু আশ্চর্য, কিছু বলতে পারলেন না। বড় বড় চোখে দেবী এদের দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতে তাঁর বরাভয়। মা-মা বলে চিৎকার করে উঠলেন ভূপেন্দ্রনাথ। সোনা সহসা এই চিৎকারে কেঁপে উঠল। ভূপেন্দ্রনাথের চোখে জল।

    দেবীর প্রতি অচলা ভক্তি। যেন পূজা নয়, প্রাণের ভিতর এক বিশ্বাসের পাখি নিয়ত খেলা করে বেড়ায়। সোনাকে বুকে নিয়ে ভূপেন্দ্রনাথ দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে। দেবীর অপার মহিমা, মহিমা না হলে এই সব সামান্য মানুষ বাঁচে কী করে, খায় কী করে, প্রাচুর্য আসে কী ভাবে! এই যে সোনা এসেছে, সেও যেন দেবীর মহিমা। নির্বিঘ্নে এসে গেছে এবং এই দেশে মা এসেছেন। শরৎকাল, কাশফুল ফুটেছে, ঝাড়লণ্ঠনে বাতি জ্বলবে। চরের ওপর দিয়ে হাতি যাবে। ঘণ্টা বাজবে হাতির গলায়। হাতিটাকে শ্বেতচন্দনে, রক্তচন্দনে সাজানো হবে। সবই দেবী এলে হয়। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে ভূপেন্দ্রনাথ—এই সব নাবালকের জন্য মঙ্গল কামনা করলেন। দেবীর বড়-বড় চোখ। নাকে লম্বা নোলক, হাতের শঙ্খ-পদ্ম-গদা সব মিলে যেন কোথাও এক বরাভয়। আনন্দময়ীর বাড়ির পাশের জমিতে নামাজ পড়বে মুসলমান চাষাভুষা মানুষেরা। ওটা মসজিদ নয়। ভাঙা প্রাচীন কোন দুর্গ, ঈশা খাঁর হতে পারে, চাঁদ রায়, কেদার রায় করতে পারে, এখন সেই ভাঙা দুর্গে নামাজ পড়ার জন্য লোক ক্ষেপানো হচ্ছে। আজ সকালে এমন খবরই কাছারি বাড়িতে দিতে এসেছিল—মুসলমানরা বিশেষ করে বাজারের মৌলবীসাব, যার দুটো বড় সুতার কারবার আছে, যে মানুষের নদীর চরে একশো বিঘা ধানের জমি, খাসে রয়েছে হাজার বিঘা, সেই মানুষ বাবুদের পিছনে লেগেছে। বোধ হয় এই দেবী, দেবীর মহিমাতে সব উবে যাবে। কার সাধ্য আছে দেবীর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়! যেন হাতের শাণিত তরবারি এখন সেই মহিষাসুরকেই বধে উদ্যত। ভূপেন্দ্রনাথের মনে বোধ হয় এমন একটা ছবি ভেসে উঠেছিল। সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার, মা-মা। তোর এত মহিমা! তোর এত মহিমার কথা তিনি উচ্চারণ করেন নি। কেবল সোনা, জ্যাঠামশাইর চোখে জল দেখে ভাবল, মানুষটা তাদের কাছে পেয়ে কাঁদছে। মা-মা বলে কাঁদছে।

    সোনা এতটা পথ বাড়ির ভিতর হেঁটে এসেছে, অথচ সেই ছোট্ট মেয়ে কমলাকে সে কোথাও দেখতে পেল না। কোথায় আছে এখন কমলা! সে ভেবেছিল, ভেতরে ঢুকে গেলেই কমলাকে দেখতে পাবে। কিন্তু না সে নেই। সে খেতে বসে পর্যন্ত সন্তর্পণে চারদিকে তাকাচ্ছিল। কত বালক-বালিকা ছুটোছুটি করছে। কেবল সেই মেয়ে যে ঘোড়ায় চড়া শেখে, তাকে দেখতে পাচ্ছে না। ছোট্ট মেয়ে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে গেলে বড় আশ্চর্য দেখায়। সোনা যতক্ষণ এই ভিতর বাড়িতে ছিল কমলাকে দেখার আগ্রহে চারদিকে যেন কী কেবল খুঁজতে থাকল।

    .

    শচীন্দ্রনাথ সকাল থেকে খুব ব্যস্ত ছিলেন। ছেলেরা সব পূজা দেখতে চলে গেছে। দুপুরে মনজুর এসেছিল সালিশি মানতে। মনজুর এবং হাজিসাহেবের ভিতর বিরোধ ক্রমে ঘনিয়ে আসছে। হাজিসাহবের বড় ছেলে, মনজুরের যে সামান্য জমি আছে সেখানে গত গ্রীষ্মে কোদাল মেরে আল নামিয়ে দিয়েছে। বর্ষায় যখন পাট কাটা হয়, কিছু পাট জোর-জবরদস্তি করে কেটে নিয়ে গেছে মনজুর একা। হাজিসাহেবের তিন ছেলে। হাজিসাহেবের বড় সংসার। পাটের এবং আখের বড় চাষ। অথচ সামান্য জমির প্রলোভনে একটা খুনোখুনি হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সারা বিকেল শচীন্দ্রনাথ হাজিসাহেবের বাড়িতে বসে একটা ফয়সালার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ফয়সালা হলেই চলে যাবেন। উঠোনের জলচৌকিতে তিনি বসে ছিলেন। পানতামুক আসছিল। শচীন্দ্রনাথ কিছুই খাচ্ছেন না। এখন আসতে পারে ইসমতালি, প্রতাপচন্দ। বড় মিঞা আসতে পারে। তবু শচীন্দ্রনাথই সব। তিনি এক সময় হাজিসাহেবের মেজ ছেলের খোঁজ করলেন।

    —আমির কৈ গ্যাছে?

    —আমির নাও নিয়া গ্যাছে বড় মিঞারে আনতে।

    বড় মিঞা ঘাট থেকে উঠে এসে শচীন্দ্রনাথকে আদাব দিল। বলল, কর্তা ভাল আছেন?

    —আছি একরকম। তা তোমার এত দেরি?

    —কইবেন না, একটা বড় নাও নদীর চরে কেডা বাইন্দা রাখছে।

    —নাও কার জান না?

    কার বোঝা দায় কর্তা। দুই মাঝি। আর আছে বড় একখানা বৈঠা, পাল আছে। নাওডারে দ্যাখতে গ্যাছিলাম।

    —মাঝিরা কি কয়?

    —কিছু কয় না। কই যাইব, কোনখান থাইকা আসছে কিছু কয় না।

    —কিছুই কয় না?

    —না। রাইতের বেলা আপনের গান শোনা যায় কেবল।

    —কি গান!

    —মনে হয় গুণাই বিবির গান। চরে সারা রাইত ঝম-ঝম শব্দ হয়।

    —গ্যাছ একবার রাইতে?

    —কর্তা, ডর লাগে। রাতের বেলা গান শুনতে গ্যাছিলাম। যত যাই তত দ্যাখি নাও জলে-জলে ভাইসা যায়। দিনের বেলাতে গ্যালাম, দ্যাখি দুই মাঝি আছে। বোবা কালা। কথা কয় ইশারায়।

    —কার নাও, কি জন্য আইছে জানতে পারলা না?

    —না কর্তা।

    —আশ্চর্য!

    —হ কর্তা। বড় আশ্চর্য!

    মনজুর আসতেই অন্য কথা পাড়লেন শচীন্দ্রনাথ। হাজিসাহেব মাদুরে বসে—প্রায় নামাজের ভঙ্গিতে, হাতে লাঠি, লাঠির মুখে চাঁদের বুড়ি—বুড়ো হাজিসাহেব সালিশি মেনে নিলেন। কথা থাকল, যে পাট কাটা হয়েছে, সব ওরা ফিরিয়ে দেবে। এবং জল নেমে গেলে কথা থাকল জমির আল সকলে মিলে ঠিক করে দেবে।

    শচীন্দ্রনাথ এবার মনজুরকে বললেন, হা রে মনজুর নদীর চরে নাকি বড় নাও ভাইসা আইছে?

    —আইছে শুনছি।

    —চরের কোনখানে?

    –সে অনেক দূর কর্তা।

    অনেক দূর বলতে যথার্থই অনেক দূর। নদী-নালার দেশ। বর্ষাকালে এইসব গ্রাম অন্ধকারে দ্বীপের মতো জেগে থাকে। তারপর জল। শুধু জল। নদী-নালা তখন দু’পাড়ের সঙ্গে মিশে যায়। বড় বড় বাগান, ফলের এবং আনারসের। আর অরণ্য কোথাও জলে নাক ভাসিয়ে জেগে থাকে। দক্ষিণে শুধু গজারির বন। বনে বাঘ থাকে। ইচ্ছা করলে সেই নাও নিমেষে গজারি বনে পালিয়ে যেতে পারে। ইচ্ছা করলে এই নাও জলে জলে নিমেষে উধাও হয়ে যেতে পারে। টের পাবার জো নেই। প্রায় যেন এক লুকোচুরি খেলা। খালে বিলে, বিলের দু’পাশে বড় গজারির অরণ্য—দশ-বিশ ক্রোশ জুড়ে অরণ্য। সে সব অরণ্যে এখন এ-সময় ভিন্ন ভিন্ন দুর্ঘটনা খুবই স্বাভাবিক।

    ঘাটের ওঠার আগে শচীন্দ্রনাথ বললেন, অলিমদ্দি, ল একবার ঘুইরা যাই।

    —কই যাইবেন?

    —নদীর চরে। বড় নাও আইছে। অসময়ে বড় নাও।

    অলিমদ্দি লগি মেরে মাঠে এসে পড়ল। এসব মাঠে জল কম। কম জল বলে অলিমদ্দি কিছুটা পথ নৌকা বাইল। নদীর জলে পড়তেই সে বৈঠা বের করে পাল তুলে দিল, তারপর চারদিকে চোখ মেলে বলল, কই গ কর্তা, নাও ত দ্যাখতাছি না।

    —চরে নাও নাই!

    —কই আছে! থাকলে দ্যাখা যাইত না!

    শচীন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন। পাটাতনে দাঁড়িয়ে দেখলেন যথার্থই চরে কোনও নৌকা নেই। বড় নৌকা দূরে থাকুক; হাটে গঞ্জে যাবার কোষা নৌকা পর্যন্ত তিনি দেখতে পেলেন না। তিনি বিস্ময়ে বললেন, আশ্চর্য!

    ঘরে ঘরে এখন লণ্ঠন জ্বলছে। আশ্বিন মাস বলে রাতের দিকে শীত পড়ার কথা। কিন্তু গরমই কাটছে না। ঠিক ভাদ্র মাসের মতো ভ্যাপসা গরমে শচীন্দ্রনাথের শরীর ঘামছিল। অলিমদ্দি এসে গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিচ্ছে। গরুর ঘরে একটা বড় লম্বা মশারি টাঙানো। ধোঁয়া উঠে এলে অলিমদ্দি মশারি ফেলে দিল। তখন শচীন্দ্রনাথ বড় ঘরে ঢুকে বললেন, বাবা নদীর চরে শুনছি একটা বড় নাও ভাইসা আইছে—

    —কার নাও!

    —তা কইতে পারমু না।

    —দ্যাখ দ্যাখ, কার নাও। লক্ষ্মীর নাও হইতে পারে, আবার অলক্ষ্মীর নাও হইতে পারে! দ্যাখ, একবার খোঁজখবর কইরা।

    –সকাল হলে ভাবচি বড় মিঞার নাও, হাজিদের নাও আর চন্দদের নাও নিয়া বাইর হমু—কোনখানে নাওটা অদৃশ্য হইয়া থাকে দ্যাখতে হইব।

    কারণ বর্ষাকাল এলেই ডাকাতির উপদ্রব বাড়ে। সতরাং এই এক বড় নৌকা ভেসে এসেছে, এবং দিনের বেলা কোথায় অদৃশ্য হয় কেউ জানে না, রাত নিঝুম হলে সকলে ভয়ে ভয়ে থাকে। রাত হলে এইসব গ্রাম জলে জঙ্গলে একেবারে নিঝুম পুরীর মতো। কারণ গ্রামের বাড়ি সব দূরে দূরে। শুধু নরেন দাসের বাড়ি, ঠাকুরবাড়ি এবং দীনবন্ধুর বাড়ি সংলগ্ন। তারপর পালবাড়ি। হারান পালের দুই ছেলে, ভিন্নমুখী দুই ঘর একউঠোনে করে নিয়েছে। রাত হলে সব কেমন নিঝুম হয়ে আসে। মালতীর আর তখন ঘুম আসে না। রঞ্জিত এতদিন ছিল বলে ভয়ডর কম ছিল। রঞ্জিত চলে গেল ওর আর কী থাকল! যা হবার হবে। সে তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বে ভাবল।

    আশ্বিনের এই রাতে এমন গরম যে দরজা বন্ধ করলে হাঁসফাঁস লাগে। এখনও নরেন দাস জেগে আছে। তাঁতঘরে কি যে করছে নরেন দাস! আভারানী বাসন মাজতে ঘাটে গেছে। আবু গেছে হারিকেন নিয়ে। সে পাড়ে হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে। দরজা খোলা রেখে একটু হাওয়া খাওয়ার জন্য পাটি পেতে মালতী শুয়ে পড়ল। গরমে গরমে শরীর যেন পচে গেছে। এই গরম, রাতের অন্ধকার সব মিলে মালতীকে নানারকম হতাশায় পীড়িত করছে। কিছুই নেই আর। হায়, জীবন থেকে তার সব চলে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। গরমের জন্য সায়া সেজিম শরীর থেকে আলগা করে দিতে দিতে এমন সব ভাবল। মানুষটা এখন কোথায় আছে, কী কাজ এমন সে করে বেড়ায়, যার জন্য নানা স্থানে তাকে ছদ্মবেশে পালিয়ে বেড়াতে হয়। ছদ্মনামটা তার কেউ জানে না। ওর একটা ছবি সে দেখেছে, ছবিতে রঞ্জিতকে চেনাই যায় না। লম্বা দাড়ি, মাথায় পাগড়ি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা—যেন এক প্রৌঢ় সন্ন্যাসী। মালতী এই ছদ্মবেশ কিছুতেই বিশ্বাস করেনি। একদিন, তখন লাঠিখেলা ছোরাখেলা হয়ে গেছে। যে যার মতো যার-যার বাড়ি চলে গেছে। মালতীকে জ্যোৎস্নায় সহসা পিছন থেকে কে এসে আঁচল টেনে ধরল—দেখল সেই সন্ন্যাসী। রুদ্র মূর্তি, মালতী ভয়ে মূর্ছা যাবার মতো। রঞ্জিত তখন বলল, আমি রঞ্জিত মালতী, চিনতে পারছ না। মালতী কাপড়টা বুকের কাছে টেনে রাখার সময়, সেই দৃশ্য মনে করে কেমন উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সেদিনই কেবল রঞ্জিত একবার মাত্র ওকে দুহাতে জাপ্টে ধরে ভয় ভাঙিয়েছিল, আমি রঞ্জিত, তুমি চিনতে পারছ না! মালতী এখন ভাবছে সে বোকা। ভালো করে মূর্ছা গেলে মানুষটা নিশ্চয়ই পাঁজাকোলে তুলে নিত। ঘরে দিয়ে আসত। সে খিলখিল করে হেসে উঠে তখন দু’হাতে জড়িয়ে ধরে সহসা অবাক করে দিতে পারত। আর মানুষটা নিজেকে বুঝি তখন কিছুতেই সামলে রাখতে পারত না। মনে হতেই ভিতরটা ওর উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপে উঠল। এবার সে সায়া সেমিজ পুরোপুরি আলগা করে ঘাটের দিকে তাকাল। অন্ধকারের জন্য ঘাটের কিছু দেখা যাচ্ছে না। গাবগাছটার নিচে জল উঠে এসেছে। সেখানে জলে মাছ নড়লে যেমন শব্দ হয় প্রথমে তেমন একটা শব্দ পেল। অমূল্য থাকলে এ-সময় বড়শিতে মাছ আটকেছে ভেবে ছুটে যেত। কিন্তু মালতী জানে-নরেন দাস কোনও বড়শি জলে ফেলেনি। একা মানুষ বলে সারাদিন খাটা-খাটনি গেছে। এখনও রাত জেগে তাঁতঘরে সূতা ভিজাচ্ছে মাড়ে। কাল ফিরবে অমূল্য। কাজের চাপ তখন কমবে।

    শোভা সকাল সকাল শুয়ে পড়েছে। শরীর ভাল নেই। জ্বর-জ্বর হয়েছে। আবু এসে ঘরে ঢুকলেই দরজা বন্ধ করে দেবে ভাবল মালতী। ঘাটে হারিকেন তেমনি জ্বলছে। আবুকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু আলোটা সহসা নিভে গেলে শুনতে পেল ঘাটে বাসন পড়ার শব্দ। মালতী ভাবল, ঘাট বুঝি পিছল ছিল, উঠে আসার সময় বৌদি পা ঠিক রাখতে পারেনি, পড়ে গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁতঘরে ঢুকে কারা যেন ধস্তধস্তি শুরু করে দিয়েছে। মালতী এবার উঠে বসল। এ সময়ে চোর ছ্যাঁচোড়ের উপদ্রব বাড়ে। সে ডাকল, দাদারে তর ঘরে লড়ালড়ি ক্যান! কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার—না কোনও শব্দ, না কোনও চিৎকার। ফের সব নিঝুম। সে তাড়াতাড়ি সায়া-সেমিজ ঠিক করে উঠে বসল। আলো জ্বালাবে এই ভেবে হারিকেনটা টেনে আনার জন্য উঠে দাঁড়াতেই দুই ছায়ামূর্তি অন্ধকারে সাপ্টে ধরে মুখে কাপড় ঠেসে দিল। এই ঘরে এখন ধস্তাধস্তি। শোভা জেগে গেল। অন্ধকারে শুধু ফোঁস ফোঁস শব্দ। কিল লাথি এবং মহাপ্রলয়ের মতো ঘটনা। সে ভয়ে ডাকতে থাকল পিসি-পিসি। তারপর আর কারও কোনও সাড়া নেই। কারা যেন ভূতের মতো এই গৃহ থেকে যুবতী মেয়ে তুলে বর্ষার জলে ভেসে গেল।

    সোনা খেয়ে উঠে নাটমন্দিরের সিঁড়িতে নেমে এল। লালটু পলটু এখন জমিদারবাবুর ছেলেদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। সোনা এ-বাড়ির কাউকে চেনে না। সেই আকাশ আবার মাথার ওপর। সে যেন অনেকক্ষণ কোঠা বাড়ির ভিতর দিয়ে হেঁটে এসে আকাশটাকে দেখে ফেলল। সব কিছুই নতুন। অপরিচিত মুখ। জ্যাঠামশাই আগে আগে হেঁটে যাচ্ছেন। সে প্রায় সব সময় জ্যাঠামশাইর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে। সে একটা সাদা হাফ শার্ট গায়ে দিয়েছে। নীল রঙের প্যান্ট। চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখ বড় বলে অপরিচিত মানুষজনেরা ওকে ঘিরে ধরেছে। ওর নাম কি, জিজ্ঞাসা করছে। জ্যাঠামশাই তখন সামান্য হাসছেন। নাম বলতে বলছেন। এবং সে যে চন্দ্রনাথ ভৌমিকের ছোট ছেলে, বিকেলের ভিতরেই সেটা ছড়িয়ে পড়ল। নাটমন্দিরের পুরোহিত মশাই সোনাকে দুটো সন্দেশ দিল খেতে। সে সন্দেশ দুটো খেল না। জ্যাঠামশাইকে দিয়ে দিল রেখে দিতে। সে জ্যাঠামশাইকে ফেলে খুব একটা দূরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। লালটু পলটু ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। দীঘির পাড়ে ব্যাডমিন্টন খেলা হবে,সোনা যায়নি। বস্তুত সোনা যেতে সাহস পায়নি। ঈশম এলে সে যেন যেতে পারত। ঈশম এখন নদীতে আছে। এ ক’দিন সে নদীতে থাকবে। ছইয়ের ভিতর সে শুয়ে বসে অথবা মাছ ধরে, বেলে মাছ এবং পুঁটি মাছ ধরে কাটিয়ে দেবে। নিজের নৌকায় রান্না করবে, এবং খাবে।

    মাঝে মাঝে সোনার আর যা মনে হচ্ছিল, সে এক মেয়ের কথা, যে মেয়ে বাপের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে অন্দরে ঢুকে গেল। সোনার সেই জগতে মাঝে মাঝে চলে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ছোট ছোট মেয়েরা, ছেলেরা লুকোচুরি খেলছে জরির টুপি পরে, সিল্কের ফ্রক গায়ে দিয়ে। সোনার ইচ্ছা হল সেই বড় উঠোনটাতে চলে যেতে। যেখান সে ফুল ফুটে থাকার মতো মেয়েদের ফুটে থাকতে দেখে এসেছে। সে জানত, ওরা এত বড় যে, তাকে তারা খেলায় নেবে না। সে একপাশে শুধু দাঁড়িয়ে থাকবে। সে খেলবে না। খেলা দেখবে! ওর মুখে দুঃখী রাজকুমারের ছবি ভেসে উঠবে। তখন হয়তো কোনও ছোট্ট মেয়ে ওর হাত ধরে বলবে, এস, আমাদের সঙ্গে খেলবে! আমরা লুকোচুরি খেলব! সেই জগৎটাতে যাবার বড় প্রলোভন হচ্ছিল সোনার। পরী কী হুরী হবে কে জানে, ছোট্ট এক মেয়ে তার চোখের উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে গেল—এখন আর সোনার অন্য কথা মনে আসছে না। কাছারিবাড়িতে বসে শুধু সেই ছোট্ট মেয়ের মুখ মনে ভাসছে। তখন জ্যাঠামশাই ডাকলেন, সোনা আয়!

    কোথায় যাবে! সোনা এখন ঠিক বুঝতে পারছে না। জ্যাঠামশাই একটা শার্ট গায়ে দিলেন। ধুতি পাট করে পরলেন। তারপর ওরা যেদিকে খেতে গিয়েছিল, সেদিকে না গিয়ে একটু বাঁ দিক ঘেঁষে বারান্দার নিচে যে কেয়ারি করা ফুলের বাগান আছে তার ভিতর ঢুকে গেলেন। যেন এই মহলাতে ঢুকতে হলে তুমি প্রথমে কিছু ফুল ফল দেখে নাও–তেমনি দৃশ্য এই ঢোকার মুখে। নানা রকমের গাছ এবং ফুল ও ফল। এ-রাস্তাটা যে বাড়ির ভিতরই আছে অনুমান করতে পারেনি। আর এ-কী বাড়ি রে বাবা, যেন সেই কী বলে না, শেষ নেই তার, সোনা একপথে এসে এখন আবার অন্য পথে নেমে যাচ্ছে। তার বাড়ি সেই অজ পাড়াগাঁয়ে। সেখানে মাত্র প্রতাপ চন্দ্রের বাড়িতে দালান, অন্য বাড়ি সব টিনকাঠের। ওদের বাড়ির দেয়াল এবং মেঝে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। দক্ষিণের ঘর, পুবের ঘর, সব ঘরের একটা নাম আছে। এখানে কোনও নাম নেই। এখানে সব হলঘরের মতো ঘর। জ্যাঠামশাই যেতে যেতে সব ঘরগুলির নাম বলে যাচ্ছেন। দেয়ালে বড় বড় তৈলচিত্র। সে-সব তৈলচিত্র কার, কোন সালে মারা গেছে, কার জন্ম কোন মাসে, বাবুদের হাতি কবে কেনা হয়েছে, যেতে যেতে জ্যাঠামশাই হাতি কেনার গল্প করতে থাকলেন। তারপর একটা সিঁড়ি। দোতলায় উঠে গেছে। কার্পেট পাতা। সোনা এ-সবের কী নাম কিছু জানে না। জ্যাঠামশায় সোনাকে সব বলে যাচ্ছেন। কী সুন্দর আর নরম কার্পেট। সোনার খালি-পা ছিল। সে খুব আস্তে আস্তে, বুঝি দ্রুত হেঁটে গেলে কার্পেটে পা লাগবে—সে তেমনভাবে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল। দু’পাশে সব রেলিঙ্। কেবল মেয়েরা এখানে গিজগিজ করছে। ভূপেন্দ্ৰনাথ এমন মানুষ যে তাঁর কাছে অন্দর সদর সমান। সে একটা পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, বৌঠাইরেন, আমি আইছি। সোনা পাশে চুপচাপ পলাতক বালকের মতো দাঁড়িয়ে থেকে এই ভিতর বাড়ির ঐশ্বর্য এবং বৈভব দেখতে দেখতে কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। ওর মনে হল এখানে মানুষ থাকে না, দেব-দেবীরা থাকে। সে-যতটা পারল জ্যাঠামশাইর জামা-কাপড়ের ভিতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করল।

    সোনা কান পেতে থাকল। কে সাড়া দিচ্ছে, কোনদিকের দরজা খুলছে, সেই মেয়েটা কোথায়? এসব ভাবনার সময়ই মনে হল পর্দা নড়ছে। পর্দার ওপাশে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ভূপেন্দ্রনাথের সবুর সইছে না। সে পর্দার এপাশ থেকে বলে উঠল, বৌঠাইরেন, সোনা আইছে।

    বৌঠানের পাশে রাঙা চেলি পরে ছোট্ট এক মেয়ে-কেবল সেই থেকে ঘুরঘুর করছে। শালিক না চড়ুই কি পাখির যেন ছানা তার চাই। সে পুতুলের ঘর সাজাবে! পূজোর দিন বলেই রাঙা চেলি পরেছে। পায়ে আলতা। কপালে টিপ লাল রঙের। চুল বব-ছাঁট। চোখে লম্বা কাজল। হাতে হাতির দাঁতের কারুকাজ করা বালা। কমলা, পুজোর দিনে কত রকমের গয়না পরেছে। সেও ঠাকুমার পায়ে পায়ে বের হয়ে এল।

    ভূপেন্দ্রনাথ ফের বললেন, সোনা আইছে বৌঠাইরেন।

    বৌঠান চারদিকে তাকালেন। কোথায় সেই ছেলে! সোনা জ্যাঠামশাইর পিছনে এমন লেগে আছে যে সহসা দেখা যায় না। কমলা বলল, দাদু সোনা কোথায়?

    ভূপেন্দ্রনাথ জোর করে সোনাকে পেছন থেকে টেনে আনল, এই হইল সোনা!

    কমলা বলল, দেখি সোনা তোমার মুখ। কেমন পাকা পাকা কথা কমলার! সেই মেয়ে! সোনা লজ্জায় আরও আড়ষ্ট হয়ে গেল।

    বৌঠান সোনাকে অপলক দেখল। ভূপেন মিথ্যা বলেনি। দেখেই বোঝা যায় এই সোনা ভূপেন্দ্রনাথের বড় আদরের। চন্দ্রনাথের ছোট ছেলে সোনা। চন্দ্রনাথ বিকালে এ-বাড়ির কাছারিবাড়িতে রোজ আসে। ভোরের দিকে কোনও কেনও দিন দেখা করে যায়। পুজোর সময় কাজের চাপ বলে বোধ হয় ভোরে দেখা করে যেতে পারেনি। এবার শচীন্দ্রনাথ সোনাকে আসতে দিয়েছে, ভূপেন্দ্রনাথের প্রাণে বড় আনন্দ। পূজোর ক’টা দিন তিনি খুবই ব্যস্ত থাকবেন, তবু আপন রক্তের এই তিন বালকের উপস্থিতি তাঁকে বড় মহিমময় করে রাখছে। ভূপেনের মুখ দেখলে এ-সব যেন টের পাওয়া যায়। বাড়ি থেকে ফিরে এলেই সে বৌঠাকুরানীকে বলত, বোঝলেন বৌঠাইরেন, সোনা যে কী হাসে না, কী বড় চোখ না, কী সুন্দর হইছে পোলাটা—আপনেরে আর কি কমু! বড় হইলে আপনেরে আইনা দ্যাখামু। সেই সোনা এ বাড়ি আসতেই এখানে টেনে নিয়ে এসেছেন, দ্যাখেন, আনছি। দ্যাখেন, মুখখানা একবার দ্যাখেন বৌঠাইরেন।

    বৌঠাকুরানী সোনার মুখ দেখতে দেখতে শুধু ভাবলেন, ভূপেনের কথায় কোনও অতিশয়োক্তি ছিল না—পোলার মুখ ত রাজার মতো হইছে। কুষ্ঠি করাইছ নি!

    —কুষ্ঠি সূর্যকান্তরে দিছি করতে। বলে সে সোনাকে বলল, প্রণাম কর। জ্যাঠিমা হন।

    সোনা উবু হয়ে প্রণাম করলে দু’হাতে তুলে ধরলেন এবং চিবুক ধরে আদর করার সময়, হাতে একটা চকচকে রুপোর টাকা দিলেন। হাতে ওর রুপোর টাকা সে নেবে কি নেবে না ভাবছিল। জ্যাঠামশাইর দিকে সে তাকাল। তিনি চোখের ইশারায় সোনাকে অনুমতি দিয়েছেন। সোনাকে এই প্রথম দেখলেন বড় বৌঠাকুরানী। এই সোনা, এত বড় বৈভবের ভিতর প্রথম ঢুকেছে। সোনাকে তিনি বুঝি রুপোর টাকা দিয়ে বরণ করে নিলেন। হাতে টাকা, এমন টাকা-পয়সা কত আঁচলে বাঁধা থাকে, এ-যেন আশ্চর্য যোগাযোগ, কথা ছিল টাকাটা দিয়ে ময়নার বাচ্চা কিনে দেবেন কমলাকে। তখনই কিনা সোনা দরজায় দাঁড়িয়ে—তিনি টাকা দিয়ে সোনাকে আশীর্বাদ করলেন।

    কমল মনে মনে ফুঁসছিল। ভূপেন্দ্রনাথ ওর সম্পর্কে দাদু হন। ভূঁইঞা-দাদু সে ডাকে। দাদু কোনও কথা বলছেন না। কমল যে এ-বাড়ির মেজবাবুর মেয়ে, ওরা যে দু-বোন ঠাকুরমার কাছে শরৎকাল এলেই চলে আসে, মেজবাবু আসেন এসব বলছে না। মেজবাবু সরকারি অফিসে বড় চাকুরি করেন। বিদেশে তার প্রবাসজীবন দীর্ঘদিন কেটেছে। তার মা মাঝে মাঝে দেশের গল্প করেন। সে দেশটাতে একটা নদী আছে, নাম টেমস নদী, সে দেশটাতে একটা গ্রাম আছে, তার নাম লুজান। একটা গীর্জা আছে সকলে ওকে সেন্ট পলের গীর্জা বলে, দুপাশে গাছ আছে, ওরা নাকি উইলো গাছ, দুপাশে জমি আছে, শোনা যায় সন্ধ্যা হলে স্কাইলার্ক ফুল ফুটে থাকে। অমলা কমলা সে-সব গল্প শোনার সময় তন্ময় হয়ে যায়! আর সামনে এই বালক সোনা নাম, তাকে সেইসব দেশের গল্প না বলতে পারলে, এতবড় নদী পার হয়ে আসা, এত বড় বাড়িতে বসবাস করা বৃথা, এবং ছুটতে না পারলে, সে যে কমল, মা তার বিদেশিনী, এ সব যেন বোঝানো যাচ্ছে না। দাদু মাকে বাবাকে ভালোবাসে না। বাবার জন্য দাদু আলাদা বাড়ি করে দিয়েছে। বুঝি মাকে নিয়ে এমন সান্ত পরিবারে ঢোকা বারণ। না, এসব সোনাকে বলা যাবে না। দিদি এখন থেকে ওকে সব শেখাচ্ছে। দিদি বলে দিয়েছে, সবকিছু সবাইকে বলতে নেই। আমি তোমাকে সোনা সব কিন্তু বলব না। আমাকে ঠাকুমা শালিকের বাচ্চা এনে দেবে। আমি পুতুল খেলব। তোমার মুখ দেখলে কেবল আমার পুতুল খেলতে ইচ্ছা হয়।

    সোনা হাতের টাকাটা পকেটে রাখল। তখন কমল আর সহ্য করতে পারল না। সোনা এবং ভূঁইঞা-দাদু চলে যাচ্ছে। সোনা ঠাকুমাকে তার ভালো নাম বলেছে। ভাল নাম ওর অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক। কি নাম রে বাবা। কত বড় নাম! তার মামাদের যেমন অদ্ভুত সব নাম—জন, ক্যামবেল, মার্টিন, বিশপ—কী সব নাম মামাদের! সে মনেই রাখতে পারে না। সোনার নামটাও প্রায় তাই! সে আর সহ্য করতে পারছে না। বলেই ফেলল, সোনা আমাকে কী বলে ডাকবে?

    বোধ হয় ভূপেন্দ্রনাথ কমলের কথা শুনতে পাননি। বৌঠাকুরানী এবং ভূপেন্দ্রনাথ কিছু পারিবারিক কথাবার্তা বলছিলেন। ওদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় কে একজন অনেকদিন পর পূজা দেখতে এসেছেন। দেখাশোনার জন্য যেন আলাদা লোক দেওয়া হয়, এ-সব কথা বলছিলেন। তখন সোনা কেন জানি কমলের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। আমি তোমাকে আবার কি ডাকব। কমল ডাকব। পুচকে মেয়ে, বুঝি এমন বলার ইচ্ছা সোনার।

    —দাদু, আমাকে সোনা কমল পিসি ডাকবে না? বলে সোনার দিকে গরবিনীর চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকল।

    এতক্ষণে সোনার মনে হল কমলের চোখ ঠিক কালো নয়। ঠিক নীল নয়। ঘন নীল অথবা কালো রঙের সঙ্গে হলুদ মিশালে এক রঙ–কি যে রঙ চোখে বোঝা দায়। তারপর মনে হল বেথুন ফলের মতো রঙ। বেথুন ফল পাকলে খোসা ছাড়িয়ে নিলে এমন রঙ হয়। সোনা দেখল, কমল ওর দিকে টগবগ করে তাকাচ্ছে। গাল ফুলিয়ে রেখেছে। সোনা ছড়া কাটতে চাইল, গাল ফুলা গোবিন্দের মা চালতা তলা যাইও না। কিন্তু এই বাড়ি, এতবড় বাড়ির বৈভব ওকে এখনও ভীতু করে রেখেছে। সে কিছু বলতে পারল না।

    এ-সময় ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, তোমারে, সোনা কমল-পিসি ডাকবে। কি ক’ন বৌঠাইরেন। কমল সোনার বড় হইব না?

    —তা তোমার হইব। আটদশ মাসের বড় হইব।

    সোনা যেন একটু মিইয়ে গেল। বৌঠাকুরানী ভূপেন্দ্রনাথকে বললেন, মায়রে ছাইড়া থাকতে পারব ত?

    —পারব।

    —না পারলে ভিতর বাড়িতে পাঠাইয়া দিও।

    —দিমু।

    বস্তুত এই পরিবারে ভূপেন্দ্রনাথ যথার্থ আত্মীয়ের মত। এই তিন বালক, আত্মীয়ের সামিল। লালটু পলটুর সমবয়সী বৌঠাকুরানীর দুই বড় নাতি, ওর বড় ছেলে অজিতচন্দ্রের ছেলে এবং ছেলের ছোট শ্যালক নবীন। লালটু পলটু এলে কাছারিবাড়ির লনে অথবা দীঘির পাড়ে খেলা—ব্যাডমিন্টন খেলা। বাবুদের আরও সব আমলা কর্মচারীর ছেলেরা সমবয়সী না হলেও—একসঙ্গে পূজার কটা দিন খুব হৈচৈ—যেন প্রাণে আর ঐশ্বর্য ধরে না। সারাদিন পূজার বাজনা। কেবল বাদ্য বাজে। ঢাক ঢোল বাজে। কাঁসি বাজে। আর অষ্টমীর দিনে বাবুদের বাড়ি পাঁঠা বলি। শীতলক্ষ্যার পাড়ে পাড়ে তখন কী জাঁকজমক। নবমীতে মোষ বলি, হাড়কাঠে তখন পাঁঠা, মোষ, মোষের বলিদান। ভোর থেকে কমল বৃন্দাবনীর সঙ্গে ফুলের বাগানে ঠিক মৌমাছি হয়ে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়। কলকাতার কমল গাঁয়ে এসে পূজার এ-কটা দিন ফুরফুরে পাখি হয়ে যায়।

    সেই কমল সোনার হাত ধরে সারা প্রাসাদ ঘুরে ঘুরে বেড়াল। হা-হা করে হাসল। হাসবার সময় সে বড় হলঘরে তার এই হাসির প্রতিধ্বনি কেমন শোনাল কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। হাত ধরে সে ছুটল। বড় বড় খিলান আর টানা লম্বা বারান্দা। ছোটার সময় সে পকেট ধরে রেখেছিল। পকেটে টাকাটা আছে। ছুটতে ছুটতে ওরা অন্দরের দিকটায় এসে গেল। কেমন নিঝুম, বাড়ির পিছনে বড় বড় গাছ সব। সারি সারি সুপারি ফলের বাগান। কমল হাত ধরে এবার ফিরে আসার সময় বলল, সোনা, ঐ দ্যাখ আমার দিদি দাঁড়িয়ে আছে। যাবি?

    সোনা ঘাড় কাত করল। সে এখনও কমল অথবা কমল-পিসি কিছুই বলছে না। কেবল কমলের হাত ধরে সে হাঁটছে।

    বারান্দায় রেলিঙে সেই মেয়ে। সোনা নাম বলে দিতে পারে। মেয়ের নাম অমলা। রেলিঙে ঝুঁকে সেই মেয়ে এখন ওকে দেখছে। লম্বা ফ্রক হাঁটুর নিচে। ঘাড়ের কাছে চুল। একেবারে সোনালী রঙ চুলের। আর কাছে যেতেই দেখল চোখ একেবারে নীল।

    কমল বলল, সোনা!

    দিদি যেন ওর ঘুম থেকে উঠেছে এমনভাবে তাকাল। অমলা হাই তুলে বলল,–কি নাম তোমার?

    এই মেয়ে কথা বলছে, কী যে ভালো লাগছিল। সে এইসব বালিকার মতো কথা বলতে চাইল, আমার নাম শ্রীঅতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক।

    —আমাকে তুমি কি বলে ডাকবে? অমলা বলল।

    কমল বলল, সোনা, তোর পিসি হয়। অমলা পিসি।

    আর ডল পুতুলের মতো এই মেয়ে কমলা। ডাকে সবাই কমল বলে। সোনা খুব ধীরে ধীরে ওদের মতো কথা বলল, তুমি আমার কমল-পিসি। তুমি আমার অমলা-পিসি।

    কমলা খুব যেন খুশি। অমলা আবার রেলিঙে ঝুঁকে কি যেন দেখছে।

    সোনা বলল, কমল, তুমি ঘোড়ায় চড়তে পার?

    কমল বলল, হ্যাঁ রে, তুই আমার নাম ধরে ডাকছিস। আমি দাদুকে কিন্তু বলে দেব।

    সোনাকে কেমন বিমর্ষ দেখাল। সে বলল, আমি জ্যাঠামশয়ের কাছে যামু। সে রাগ করলে কমল অন্য কথায় এল। বলল, আমি ঘোড়ায় চড়তে পারি। সোনাকে কাছে এনে বলল, যামু কিরে, যাব বলবি

    সে তবু যেন খুশি হয় না। অথবা ওর যেন এখন বলার ইচ্ছা, আমার এক পাগল জ্যাঠামশাই আছে। কিন্তু সে তা না বলে বলল, ছাদে বড় বড় পুতুল। কেবল উইড়া যায়।

    কমল বলল, নদীর পাড়ে কাশবনে ফুল ফুটলে ওরা স্থির থাকতে পারে না। বাকিটুকু বলল না। বাকিটুকু অমলাদি ওকে বলেছে। কাশ ফুল ফুটলে বসন-ভূষণ ঠিক থাকে না। সব ফেলে কেবল নদীর চরে উড়ে যেতে চায়।

    পরীদের কথা শুনেই অমলা কেমন ফের ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতো সোনাকে দেখল। সে যেন এই প্রথম দেখছে। সে সোনার চুলের ভিতর হাত রাখল এবার। সব ভুলে গেছে মতো বলল, কাদের ছেলে রে!

    —অমা, তুমি জান না! এই না বললাম তোমাকে! আমাদের চন্দ্রনাথ দাদুর ছেলে!

    —ও মাঃ, তাই বুঝি। তবে তো আমাদের জিনিস—এমন এক মুখ করে সে সোনাকে বুকের কাছে সাপ্টে ধরতে চাইল। সোনা একটু সরে দাঁড়াল। মেয়ের শরীরে কি যেন গন্ধ—মিষ্টি, বাগানে বেল ফুল ফুটলে সে এমন একটা গন্ধ পেত। মেয়ের চোখ এত নীল যে আকাশকে হার মানায়। সোনার একবার ইচ্ছা করছিল চোখ দুটো ছুঁয়ে দেখতে। বিষণ্ন গোলাপের পাপড়ি ঝরে গেলে যেমন কাতর দেখায় এই চোখ এখন তেমন কাতর দেখাচ্ছিল। কেবল হাই তুলছে অমলা। তুমি সোনা এস, বলে সহসা সোনাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাইল।

    সোনা বলল, আমি জ্যাঠামশাইয়ের কাছে যামু।

    —কি রে, দিদিকে ভয় পাস কেন?

    অমলা বলল, এই শোনো। বলে কেমন ঝলমল করে উঠল খুশিতে। সোনার এমন মুখ, হাসিখুশি মুখ, ঝলমল আকাশের মতো মুখ দেখতে বড় ভালো লাগল।—এস, আমার সঙ্গে এস। এস না, ভয় কি! কমলের মতো আমি তোমার পিসি। আমাকে তুমি অমলা-পিসি ডাকবে। এস না।

    কমল বলল, আয় না। ভয় কি!

    ওরা সিঁড়ি ধরে নামবার সময় ছোটবৌরানী বলল, কার ছেলে রে!

    —সোনা, চন্দ্রনাথ দাদুর ছেলে।

    বৌঝিরা বলল, ওমা, এ কেরে?

    কমল গর্বের সঙ্গে যেন পরিচয় দিল, জান না! চন্দ্রনাথ দাদুর ছেলে।

    —এ ছেলে কথা বলে না! মা, একি ছেলে রে! অমলা হাসতে থাকল।

    সোনা বলল, আমি জ্যাঠামশয়ের কাছে যামু।

    কমলা যেন সোনার চেয়ে কত বড় এমন চোখে মুখে কথা বলল, না লক্ষ্মী, তুমি এস। দিদি তুই সোনাকে ভয় দেখাস কেন রে!

    অমলা বলল, ভয় কোথায় দেখালাম! সোনা, এস।

    লোকজনের ভিড় ঠেলে ওরা ঠাকুমার ঘরে ঢুকে গেল। এ-ঘরটাও সেই বড় হলঘরের মতো। বড় বড় খাট পড়েছে। বারান্দায় ময়না পাখি। যাবার সময় অমলা পাখির খাঁচাটাকে ঘুরিয়ে দিয়ে গেল। কমল কি যেন কথা বলল পাখিটার সঙ্গে। বলল, এর নাম সোনা। পাখিটা দাঁড় থেকে নেমে ডাকল, কমল, কমল, নাম বল। সোনা সোনা নাম বল। পাখির গলায় সোনা তার নাম শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। সোনাকে দেখে পাখিটা তখন খাঁচার ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে।

    বড় এই ঘরটাতে ঢুকেই অমলা লাফ দিয়ে খাটে উঠে গেল। সে আলমারির ওপর থেকে বড় একটা চামড়ার স্যুটকেস টেনে নামাল। কি যেন ওরা দেবে সোনাকে। কমল ওর বাক্স খুলে ফেলল। ওরা কে আগে কি দেখবে সেজন্য স্যুটকেশ থেকে সব টেনে নামাল। অমলার বয়স আর কত, এই এগারো বারো, কমলের বয়স কত এই নয় দশ–কে জানে কার সঠিক বয়স—তবু দু’জনের ভিতর সোনাকে খুশি করার জন্য প্রতিযোগিতা, এই দ্যাখো সোনা বলে, পুঁতির মালা, ঝিনুক এবং ছোট ছোট নুড়ি পাথর বাক্স খুলে দেখাল। কমল বলল, তুমি কী নেবে সোনা!

    সোনা বলল আমি কিছু নিমু না।

    অমলা বলল, এই দ্যাখো কী সুন্দর ছবি, ছবি নেবে?

    —না, আমি কিছ নিমু না

    অমলা বলল, এই দ্যাখো কী সুন্দর ময়ূরের পালক, পালকের কলম দিয়ে তুমি লিখতে পারবে।

    —আমি জ্যাঠামশাইর কাছে যামু কমল।

    —ও মা! দিদি, দ্যাখ সোনা আমাকে কমল ডাকছে। পিসি ডাকছে না।

    অমলা হাসল। পুচকে মেয়ের কি বড় হবার সাধ। সে এবাব বলল, বাইস্কোপের বাক্স নেবে সোনা! এখন যেন অমলা কমলা যে যার তূণ থেকে শেষ অস্ত্র বের করছে। অমলা বলল, চোখ রাখো, কী সুন্দর ছবি দেখা যাচ্ছে! দ্যাখো কী সুন্দর একটা মেয়ে ডালিম গাছের নিচে, খোঁপায় ফুল গোঁজা। তারপর অমলা আর একটা ছবি লাগিয়ে বলল, দু’জন সিপাই, মাথায় ফৌজি টুপি। পাশে দুটো বাঁদর। গলায় গলায় ভাব। পা তুলে সোনাকে দেখে নাচছে।

    সোনা এবার ফিক্ করে হেসে দিল। বাঁদর নাচছে দু’পাশে। সে এবার সাহস পাচ্ছে যেন।

    অমলা বলল, এই দ্যাখো। অমলা ছবিটা প্যাল্টে দিতেই সোনা দেখল, একটা ঝরনা। একটা প্রজাপতি। এবং ঝোপের ভিতর মস্ত এক বাঘ। সোনা চোখ বড় বড় করে বলল, অমলা, একটা বাঘ।

    —এই রে! তুমি আমাকেও নাম ধরে ডাকছ। বলেই খুশিতে গালে গাল লেপ্টে দিল সোনার।

    সোনাকে নিয়ে অমলা কমলা একসময় ছাদে উঠে এল। সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমে শীতলক্ষ্যার বুকে নেমে আসছে। ডায়নামোর শব্দ ভেসে আসছে। চারদিকে আলোতে আলোময়। মনে হয় যেন এখানে এসে সব পৃথিবীটা খুশিতে ঝলমল করে ফুটে উঠেছে। কতদূর পর্যন্ত আলো, আলোতে আলোময় এই মাটি এবং গাছ ফুল পাখি। কি উঁচু ছাদ! সে ছাদের ওপর ছুটে বেড়াল। কার্নিসের কাচে ঝুঁকে দাঁড়াল। নিচে দীঘির জল। জলে আলোর প্রতিবিম্ব ভাসছে। দূরে শীতলক্ষ্যা নদী এবং পাশে চর, তারপর পিলখানার মাঠ। মাঠে হতিটা বাঁধা থাকে। ছাদে দাঁড়িয়ে সে, সব দেখার চেষ্টা করল। অমলা কমলার সঙ্গে সেই থেকে তার ভাব হয়ে গেছে, সে বাড়িময় ছুটে বেড়িয়েছে। অমলা কমলার শরীরে কি যেন মৃদু সৌরভ, এই সৌরভ মনের ভিতর এক আশ্চার্য রং খুলে ধরছিল। অমলা কমলা ওর দু’পাশে দাঁড়িয়ে কোথায় কী আছে, কোনদিকে গেলে মঠ পড়বে, মঠের সিঁড়িতে সাদা পাথরের ষাঁড়, গলায় তার মোতি ফুলের মালা, আরও কি সব খবর দিচ্ছিল। এখন সে ছাদে উঠে এসেছে, ছাদের দুপাশে দুই মেয়ে তাকে কেবল বড় হতে বলছে। সে মাকে ফেলে অনেকদূর চলে এসেছে। সে যেন ক্রমে বড় হয়ে যাচ্ছে। ওর ভয় ভয় ভাবটা থাকছে না। যেমন মেলায় বিন্নির খৈ খেতে খেতে অথবা ঘোড়দৌড়ের মাঠে কালু শেখের ঘোড়া দেখতে দেখতে সে পৃথিবীর যাবতীয় মাধুর্য শুষে নিত, ঠিক তেমনি এই ছাদে আজ গ্রহ-নক্ষত্ৰ দেখতে দেখতে আকাশের মাধুর্য শুষে নেবার সময় তার মায়ের মুখ মনে পড়ে গেল। এই দুই মেয়ের ভালোবাসা তাকে আর ছোটাতে পারল না। ছাদের এক কোণে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। বড় কাতর দোখাচ্ছে তাকে। অমলা কমলা আদর করতে চাইলে সে প্রায় কেঁদে ফেলল। এত দূরদেশে এসে মায়ের জন্য মন খারাপ, ভিতরটা তার কেমন ছটফট করছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }