Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.২১

    ১.২১

    ক্রমে রাত বাড়ছে। কেমন স্তব্ধ হয়ে আছে প্রকৃতি। গাছের একটা পাতা পর্যন্ত হাওয়ায় নড়ছে না। ক্রমে এই গ্রাম আরও অন্ধকারে ডুবতে থাকল। বুঝি চরাচরে কেউ জেগে নেই। ভেসে ভেসে সেই নৌকা কোথায় যে যায়, কোথায় যে থাকে কেউ জানে না। চরের বুকে রাতের গভীরে সেই নৌকা এসে হাজির। বড় দুই কোষা নাও। কোষা নাওএর মাঝিরা বাঁধাছাদা একটা জীবকে নৌকায় তুলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    মহেন্দ্ৰনাথ তখন ডাকলেন, শচী, শচীরে।

    কোনও সাড়াশব্দ নেই। তিনি ডাকলেন, অলিমদ্দি, অ অলিমদ্দি!

    কেউ সাড়া দিচ্ছে না। পুবের বাড়িতে হায় হায় রব। তোমরা ওঠ সকলে। কে কোথায় আছ! দীনবন্ধুর বৌ চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে। দীনবন্ধু উঠোনে নেমে চিৎকার করে উঠল। সকলে আপনেরা জাগেন। সর্বনাশ হইয়া গ্যাছে। শচীন্দ্রনাথ জেগেই মাথার কাছ থেকে একটা বর্শা তুলে নিলেন হাতে। অলিমদ্দি বলল, কর্তা, আমি একটা সুপারির শলা নিলাম।

    ভুজঙ্গ এল, কবিরাজ এল, কালাপাহাড়, চন্দদের দুই বেটা এবং গৌর সরকার সদলবলে মুহূর্তে এসে হাজির।—কি হইছে!

    —কি আর হইব! তোমার আমার মান-সম্মান গ্যাছে।

    সবাই অন্ধকারে বের হয়ে পড়ল। মেঘলা আকাশ। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। নয়াপাড়াতে খবর দেওয়া হল। টোডারবাগ থেকে ছুটে এল মনজুর, আবেদালি আর হাজিসাহেবের তিন বেটা। বলল, কোনদিকে যাওয়ন যায়।

    শচীন্দ্রনাথ বললেন, চরের দিকে লও। রাইতে যদি সেই নাও জলে জলে ভাইসা যায়!

    জয়,জয় মা মঙ্গলচণ্ডীর জয়। মা গো, তর ছাওয়াল পাওয়াল—তুই যারে রাখস মা তারে কে মারে! মা গো, তুই অবলা জীবের প্রাণ, তর কাছে মা জিম্মায় থাকল দুঃখিনী মালতী।

    শচীন্দ্রনাথ নৌকায় উঠে বললেন, জব্বর কইরে! সে গাঁয়ে আইছিল, সে নাই ক্যান?

    এবার আবেদালি হা হা করে কেঁদে উঠল, কর্তা গ, আমার জানমান আর নাই। পোলার কসুর আমি কি দিয়া শোধ দিমু। সকলে থ।

    একদল থানায় গেল। সবিরুদ্দিনসাবকে খবর দিতে হয়।

    শচীন্দ্রনাথ তখন বললেন, জব্বরের কাম। তোমরা নৌকা ভাসাও জলে।

    জলে নাও ভাসাও রে, কিংবদন্তীর নাও ভাসাও। সোনার নাও পবনের বৈঠা। নাও রে—জলে নাও ভাসাও। মানুষগুলি রাতের অন্ধকারে জয় জয়মালা, গন্ধেশ্বরী, ওমা তুই পটেশ্বরী, তর দেশে জলে স্থলে দুঃখ মা, আখেরে বনিবনা হবে কি হবে না কে জানে। শচীন্দ্রনাথ চিৎকার করে উঠলেন, তিনদিকে চইলা যাও। একদল ফাওসার বিলে বিলে যাও। অন্যদল সোনালী বালির নদীর চরে। যারা পশ্চিমে যাবা সঙ্গে নিবা পালের নাও। পশ্চিমা বাতাসে পাল তুইলা দিবা।

    নৌকা এখন না ছাড়লে নাগাল পাওয়া দায়। শচীন্দ্রনাথ বললেন, আর আমি যাই, সঙ্গে নরেন দাস যাউক—সেই যেখানে চরে আলো জ্বলে সেইখানে। ওরা এবার সকলে নৌকায় উঠে বৈঠা মাথার ওপর তুলে চিৎকার করে উঠল, মাগো, তর এমন সুজলা সুফলা দ্যাশ, মাগো তুই ক্যান আবার জ্বইলা উঠলি। সংসারে বনিবনা হয় না—একি কাণ্ড মা সিদ্ধেশ্বরী। তুই মা ওর মুখ রক্ষা কর দিকি ইবারে।

    —আর কে যাইবা জলে জলে? গজারির বনে বনে অন্ধকার, আলো জ্বলে না, জোনাকি জ্বলে না। নিশুতি রাতে সাপে বাঘে বনিবনা হয় না। সেই বনের দিকে বড় নাও নিয়ে শচীন্দ্রনাথ ভেসে পড়লেন। এতক্ষণ গ্রামের ভিতর ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচি ছিল। বাড়ি থেকে বাড়িতে, গ্রাম থেকে গ্রামে নৌকার পর নৌকা ছুটে এসেছে। টেবার দুই ভাই ছুটে এসেছে। মেয়ে মহলে গুঞ্জন। চোখে মুখে ভয়ঙ্কর আতঙ্কের ছাপ—কি হল দেশটাতে! এমন দেশ উচ্ছন্নে যায়—হায়, আর সর্বনাশ হতে কি বাকি! সকলে চুপচাপ এখন জেগে বসে আছে। কেউ সে রাতে আর ঘুম যেতে পারল না।

    শচীন্দ্রনাথ, বড় মিঞা, মনজুর এবং নরেন দাস নিচের দিকের পাটাতনে। উপরের দিকের পাটাতনে অলিমদ্দি, গৌর সরকার, প্রতাপ চন্দের দুই ছেলে। সকলের হাতে বৈঠা। আর উপরে আকাশ। মেঘলা আকাশ ক্রমে কেমন পাতলা হয়ে আসছে। থেকে থেকে হাওয়া উঠছে। সবগুলি দাঁড় এক সঙ্গে উঠছে নামছে। দ্রুতবেগে প্রায় ঘণ্টায় দশ বিশ ক্রোশ তারা পাড়ি জমাতে পারে এখন। হালে মনজুর শক্ত হয়ে বসে থাকল। এই অসম্মান এখন যেন শুধু নরেন দাসের নয়—একটা জাতির, মনজুর মুখচোখ রাঙা করে হাঁকল—জব্বইরা, তুই মুখে চুনকালি মাখাইলি!

    সেই বড় নৌকার সন্ধানে ওরা চরের মুখে এসে থামল। কোথায় নৌকা। কোনও চিহ্ন নেই নৌকার চারদিকে শুধু জল, চুপচাপ ওরা জলের ওপর দাঁড় তুলে বসে থাকল। না নেই, কোথাও নেই। আদিগন্ত জলের ভিতর ইতস্তত মাছের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। ধানখেতে দুটো একটা বালিহাঁসের শব্দ। শচীন্দ্ৰনাথ তখন বললেন, নাও ইবারে দক্ষিণে ভাসাও।

    সামনে গজারি গাছের বন। মাথার উপর গজারি গাছের অন্ধকার। নিচে জল, কোথাও বুক জল, কোথাও হাঁটু জল আর কোথাও ঝোপ জঙ্গল জলের নিচে অরণ্য সৃষ্টি করে রেখেছে। নৌকা গাছের ফাঁকে ফাঁকে জলের ভিতর ঢুকলে, ওরা প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না। জলের ভিতর জোনাকিরা জ্বলছে। কত হাজার লক্ষ, যেন এক আলো অন্ধকার জগৎ। এমন আলো অন্ধকারে ওরা কিছুই দেখতে পেল না। নরেন দাস বলল, আনধাইরে আর কারে খোঁজবেন?

    কিছু পাখি ডাকল। চুপচাপ সকলে যেন আড়িপাতার মতো ভাব। এদিকটাতে কোনও গ্রাম নেই, অনেক দূরে নৌকা বাইলে সুন্দরপুর গ্রাম। ওরা যত বনজঙ্গলের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে তত ক্ৰমে সব শব্দ মরে আসছে। পাতার খসখস শব্দ হচ্ছে না। নিচে জল বলে, পাতা খসে পড়লে শব্দ হচ্ছে না। এত বড় গভীর বনে আগাছা নেই, বেতের ঝোপঝাড় চারদিকে ছড়ানো, মাথার উপর হাজার রকমের লতা দুলছে। ভয়াবহ অন্ধকার, যদি কোনও আলো জ্বলতে দেখা যায়, যদি অন্য কোনও নৌকার শব্দ কানে ভেসে আসে। কারণ, দ্রুত পালাবার মতো পথ এখানে নেই। বরং রাত কাটিয়ে দেবার জন্য এই গজারি গাছের বন। আঁধারে আঁধারে এই বন পার হলে মেঘনা নদী। নদীতে পাল তুলে দিলে ঠিক যেন আত্মীয়স্বজন যায়। অথবা নদীতে কার নৌকা ভেসে যায়, কেবা তার খোঁজ রাখে। এই গজারির বনে ওরা তন্ন তন্ন করে মালতীকে খোঁজার চেষ্টা করল। ওরা খুব আস্তে কথা বলছিল। দুটো একটা গজারি গাছের পাতা ঝরে পড়ছে। জলে জলে সেই পাতা ভেসে ভেসে অন্ধকার নদীতে নেমে যাচ্ছে। ওরা সেই পাতা অথবা পাখ-পাখালির ডাকের ভিতর নিজেদের আত্মগোপন করে রাখল। ওরা এভাবে বনের ভিতর বড় নৌকার সন্ধানে থাকল।

    না নৌকা, না সেই গুনাইবিবির গান। এমন হারমাদ মানুষ কী করে মালতীর মতো এক জবরদস্ত যুবতীকে হাফিজ করে দিল!

    শচীন্দ্রনাথ কেমন বিপর্যস্ত গলায় বললেন, নাও নদীতে ভাসাইয়া দ্যাও। বড় নাও মনে লয় নদীর জলে ভাইস্যা গ্যাছে।

    .

    —জব্বর, যুবতী কি কয়!

    —কিছু কয় না মিঞা।

    —কিছু না কইলে পার পাইব ক্যামনে?

    —ইট্টু সবুর করেন মিঞা

    —সকাল হইতে আর যে দেরি নাই জব্বর।

    জব্বর এবার পাটাতনে উঠে দাঁড়াল। নৌকা এবার গজারি বন পার হয়ে নদীতে পড়েছে। মেঘনা নদী উত্তাল। ক্রমে নদীর সব বড় বড় বাউড় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। নৌকা চালাবার নির্দিষ্ট কোনও পথ নেই। শুধু জলে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা এবং ধরে আনা যুবতীকে বশ করা। হিন্দু রমণী—সুন্দরী যুবতী মাইয়া মালতীরে বশ করে শহরে নিয়ে যাওয়া। সবুর সয় না পরাণে—হেন কাজ কে করে! সবুর না সইলে জোর জবরদস্তিতে হেনস্থা করবেন মিঞাসাব। কিন্তু ছইয়ের ভিতর যায় কার সাধ্য। মালতী এখন সাপ বাঘের মতো। ভিতরে গেলেই ছুটে কামড়াতে আসছে। কখনও হিক্কা উঠছিল। কখনও পাগলের মতো চিৎকার করছিল, আর ভয়ে দু’কসে থুতু জমছে। গলা কাঠ। হাত-পা বাঁধা মালতীর। হাত-পা আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা। তবু এই যুবতী ছইয়ের ভিতর ঢেউএ গড়াগড়ি খাচ্ছে। কখনও চুপচাপ পড়ে থাকছে। চার মাঝি, মিঞাসাব তার দুই শাগরেদ আর জব্বর। জব্বর মাঝে মাঝে ঢুকে যাচ্ছে ছইয়ের ভিতর। বশ করার কথাবার্তা বলছে। আখেরে এই মহাজন মানুষ মালতীকে ঘরের বিবি করে ফেলবে। দুই চারদিন নৌকায় নৌকায় ঘুরে বেড়ানো, গায়ে পায়ে হাওয়া বাতাস লাগানো, তারপর ঘরে ফিরে যাওয়া। এমন বর্ষার দেশে দেরি আর সয় না, মন আর মানে না। উথাল-পাথাল কইরা মন নদীর চরে ছুইটা যায় কেবল। আর এমন শরীর নিয়ে জ্বলে পুড়ে খাক কে কবে হয়! জব্বর এখন পয়সার লোভে মাতালের মতো রংদার বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে কানের কাছে—মালতী দিদি, উঠেন, কথা কন, জলপানি খান। আসমান দ্যাখেন, কত বড় নদীতে নাইমা আইছি দ্যাখেন। গতরে দিদি আগুন জ্বালাইয়া বইসা আছেন, ইবারে আগুনে পানি দ্যান। বলতে বলতে দড়াদড়ি খুলে দিচ্ছে। খুলে দিলেই যুবতী মাইয়া ভালো মাইনসের ঝি বইনা যাইব! আশায় আশায় জব্বরের এখন চক্ষু চড়কগাছ।

    গলুইর দিকে তিনজন লোক। ডোরাকাটা লুঙ্গি পরনে, কালো গেঞ্জি গায়ে। পয়সার লোভে জব্বর মালতীকে করিম শেখের নৌকায় তুলে আনল, কারণ জব্বরের দুটো তাঁত না হলে চলছে না। করিম শেখ মেলায় বিধবা মালতীকে দেখেছে। মেলাতে মালতীর রূপ দেখে সে তাজ্জব বনে গেছে। এখন তো এই সময়–মেলাতে দাঙ্গা হয়ে গেছে। দাঙ্গার সময় মেলাতে করিম শেখ দলবল নিয়ে সারা মেলা ছুটে বেড়িয়েছে, মালতী কোথায়! কোথাও সে মালতীকে খুঁজে পায়নি, সেই থেকে নেশার মতো জব্বর নারাণগঞ্জের গদিতে সূতা আনতে গেলেই বলত, কিরে জব্বইরা তর দিদি কী কয়?

    —কেবল আপনের কথা কয়। পয়সা খসানোর তালে ছিল জব্বর।

    —আমার কথা ক্যান কয় রে! আমারে চিনে।

    —চিনব না আপানেরে! কয়, মালতী দিদি কয়, হা রে জব্বইরা মেলাতে যে তর লগে সুন্দর মত মানুষ দ্যাখলাম, মানুষটা কেডারে-

    —তুই কি কইলি?

    —কইলাম খুব মেহেরবান মানুষ। জবরদস্ত আদমি। নাম করিম। নারানগঞ্জ শহরে তারে চিনে না এমন কেডা আছে!

    —এত বড় কইরা দিলি আমারে!

    —দিমু না! আপনে কত বড় মানুষ, কন!

    —আর কি কইলি?

    —কইলাম সোনার মানুষ।

    —শুইনা কি কয়?

    —কয় সোনার মানুষের বুঝি সখ থাকে না।

    —তুই কি কইলি?

    —কইলাম সখ থাকে না কি কন! সখ সুখ সব থাকে।

    তারপরই একরাতে গদিতে বসে করিম বলল, রাইতে আঁখিতে ঘুম থাকে না রে, জব্বর! য্যান এক স্বপ্নের হুঁরী উইড়া উইড়া আসে।

    —হুঁরী! কেমন চোখ বড় বড় করে দিল জব্বর। শুধু হুঁরী বললে যে অসম্মান করা হয় মালতীকে। হুঁরী পরী বশ মানে। মালতী দিদি আমার আসমানের তারা। আসমানের তারা খসাইতে ম্যাও লাগে। এই বলে জব্বর একটা বড় অঙ্কের টাকার আভাস দিতে চাইল।

    —কত ম্যাও লাগে?

    জব্বর প্রথম চারখানা তাঁত কিনতে কত টাকা লাগতে পারে ভেবে নিল। তারপর বলল, হাজার টাকা।

    —হাজার টাকায় হুঁরী পরী আসমানের তারা সব এক লগে কিনন যায় মিঞা।

    —একটা কিনতে কম লাগে তবে! বুঝি ফসকে গেল সব, সে ঢোক গিলে বলল, কম লাগে তবে —লাগে না?

    —তবে লাগুক। দ্যান যা মনে লয়।

    জব্বর শেষ পর্যন্ত দর-দাম করে পাঁচশত টাকা নিল। বাকি খরচপত্র করিম সব করবে কথা থাকল। নৌকা, মাঝি, এবং রাত-বিরাতের ফূর্তি সব করিম শেখের খরচ। প্রথম ভেবেছিল করিম নৌকায় নিজে থাকবে না, কিন্তু কেন জানি ওর অবিশ্বাস জন্মে গেল, হারমাদ জব্বর, কোনদিকে শেষে নাও ভাসাবে কে জানে—তবে তার আসমানের তারাও যাবে, নগদ টাকাও যাবে। শেষপর্যন্ত সে নৌকায় পর্যন্ত উঠে এল।

    জব্বর টাকার লোভে, দুই তাঁত করে তাঁতি হবার লোভে সময়ে অসময়ে গ্রামে চলে আসত। খরচ করত দু’হাতে, ফেলুকে নিয়ে সলাপরামর্শ করত, আর যাদের সে এ-অঞ্চল দেখাতে এনেছিল—কত বড় অঞ্চল দ্যাখেন মিঞারা, এই অঞ্চলে আমার মালতী দিদি বাড়ে দিনে দিনে, তারে লইয়া যান সাগরের জলে। মালতীকে দূর থেকে দেখাবার সময় যাদের সে এমন বলত, তারা সবাই করিম শেখের লোক। দিনক্ষণ দেখে, সময় বুঝে যখন রঞ্জিত গ্রামে নেই, যখন আনধাইর রাইত এবং যখন কেউ বলে না দিলে বোঝা দায়—কার নৌকা, কেবা এল নদীর চরে, তখনই কাজটা হাসিল করতে সময় লাগবে না। সামসুদ্দিনও এখানে নেই। সে ঢাকা গেছে। সুতরাং এ-সময়েই কামটা হাসিল কইরা ফ্যালতে হয়, এমন পরামর্শ দিল ফেলু। ফেলু বিনিময়ে দুই কুড়ি দশ টাকা পেল। বিবি আন্নু তার ডুরে শাড়ি পেল। কথা ছিল, ফেলুর বিবি সঙ্গে যাবে—কিন্তু শেষপর্যন্ত ফেলু রাজি হয়নি। তার সাহস হয়নি। ধরা পড়ার ভয়ে ফেলু এতটুকু হয়ে গেছিল।

    এখন সূর্য উঠছে। মৃদুমন্দ বাতাস পালে খেলছে। ভোরের সূর্য নদীর বুক থেকে প্রায় ভেসে ওঠার মতো। মেঘনা নদীর প্রবল ঘূর্ণির ভিতর নৌকা পড়ে না যায়—মাঝিরা খুব সন্তর্পণে বৈঠা চালাচ্ছে। হাল ধরে আছে। ছইয়ের দু’দিকে কাঠের দরজা। ভিতরটা ঘরের মতো। ঠিক যেন এক পাসি নাও। ভিতরে কথাবার্তা হলে গলুই থেকে বোঝা দায়। ছইয়ের ভিতর মালতী ফোপাচ্ছে। জব্বর উবু হয়ে বসে আছে পাশে—এবং ঠিক সেই আগের মতো রংদার বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। ফেলুর বিবি নৌকায় থাকলে এখন সুবিধা হতো। দু’কুড়ি দশ টাকা দিতে রাজি, তবু বিবিটাকে ফেলু আসতে দেয়নি। যদি বশ না মানাতে পারে, বনের বাঘ খাঁচায় ঢুকে যদি হালুম-হালুম করতে থাকে কেবল—তাহলে কী যে হবে না! জব্বরের মুখ ভয়ে শুকিয়ে আসছে। সুতরাং জব্বর মরিয়া হয়ে পায়ের কাছে এসে বসে বলল, দিদি ওঠেন। দুধ গরম কইরা দেই, দুধ খান। বল পাইবেন গায়ে গতরে

    কে কার কথা শোনে! মালতী একা পাটাতনে ঝোড়ো কাকের মতো। চোখে-মুখে কলঙ্কের ছাপ। চোখের নিচে এক রাতে কী ভয়ঙ্কর কুৎসিত কালো দাগের চিহ্ন। হাতে-পায়ে এখন দড়ি-দড়া নেই। দরজার ফাঁকে সকালের আলো ওর পায়ের কাছে এসে পড়েছে।

    জব্বর ডাকল, মালতী দিদি, ওঠেন। মুখ ধুইয়া নাস্তা করেন।

    মালতী ঘাড় গুঁজে বসে থাকল, যেন ফের বিরক্ত করলে গলা কামড়ে দেবে। জব্বর ভয়ে ছইয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে এল। তেজ এখনও মরেনি। মুখ-চোখ মালতীর পাগলের মতো লাগছে।

    —কি কয়? করিম শেখ পাটাতনে বসে হুঁকা টানছিল।

    —কয় বুড়া মাইনসের জান, সামলাইতে পারব ত!

    —কি যে কও! বয়স কত আমার! এই দুই কুড়ি মোতাবেক।

    —তা যখন পারেন, তখন সব ঠিক হইয়া যাইব।

    হুঁকা টানতে টানতেই বলল করিম, তুমি যে কইলা, তোমার দিদি আমার কথা কয়, এহনে ত দ্যাখছি, দিদি তোমার পাগলের মতো বইসা আছে।

    —আরে না মিঞা! বনের বাঘ খাঁচায় উঠাইলে তা ইট্টু এমন করে! বশ মানাতে সময় লাগে।

    —বশ না মানাইতে পারলে নদী-নালায় আর কয় রাইত ঘুরবা? কবে গদি ছাইড়া বাহির হইছি। বড় বিবি কয়, কই যান মিঞা?

    —কি কইলেন?

    —কইলাম মৎস্য শিকারে যাই! নদী-নালার দ্যাশ, পানিতে ভ্যাইসা গ্যাছে। যদি মেঘনার পানিতে ঢাইন মাছ পাই। একটু থেমে কলকের আগুন জলে ফেলে দিলেই ফস করে আগুনটা নিভে গেল। তারপর বলল, মাছ ত বঁড়শিতে আটকাইছে, এহনে মৎস্য ডাঙ্গায় তুলতে পারতেছ না—এডা ক্যামন কথা!

    —ডাঙ্গায় তুইলা ফ্যাললে আর থাকলটা কি কন? দুই চারডা লম্ফঝম্ফ। তারপর খতম। পাঁজ দোয়ারে আপনের মিষ্টি কথা ভাইসা বেড়াইব। বনের বাঘ বশ মানলে মিঞা তখন আবার ক্যান জানি সখ যায়—শিকারে গ্যালে হয়। ভাল লাগে না, পানিতে স্বাদ-সোয়াদ থাকে না। মনটা তখন আপনের আবার মৎস্য শিকারে যাইতে চায় না মিঞা? বলে জব্বর বলল, তামাক সাজি।

    —সাজ। তামুক খাইয়া সুখ পাইলাম না।

    এই খাল-বিলের দেশে করিম শেখ মুখটা ভোঁতা করে বসে থাকল। নৌকা কোনও গঞ্জের পাশ দিয়ে যাচ্ছে না। খাদ্যদ্রব্য যা ছিল সব শেষ। ঘুরে-ফিরে—যতদিন না মালতীর প্রাণে বিশ্বাস জাগে ততদিন এই খালে-বিলে এবং নদীর মোহনাতে ঘুরে বেড়াতে হবে। এখন শুধু ভালো ব্যবহার, জবরদস্তির কাজ নয়। একমাত্র সরল অকপট ব্যবহারই মালতীকে আপনার করে নিতে পারবে। এই ভেবে করিম শেখ বলল, মনের ভিতর এক পঙ্খী বাস করে জব্বর।

    —তা করে মিঞা।

    —পঙ্খীটা উড়াল দিতে চায় মিঞা। কী যে চায় পঙ্খী। পঙ্খী রে তুমি কী চাও? নতুন বিবির জন্য কেমন উদাস হইয়া যায়! পানির স্রোতে বিড়াল ভাসে—অ মন তুমি এক মাঝি। মনে পড়ে জব্বর, জবরদস্ত বিবি হালিমা—তারে বশ মানাইতে কয়দিন লাগছিল। তোমার মনে থাকনের কথা না রে, কী যে ভাবি। কেমন ছাড়া ছাড়া কথা মনের কোণে জেগে উঠছে করিমের। এখন যে সে কত উদার মোতাবেক মানুষ। সরল ব্যবহারের চিহ্ন ওর মুখে। দেখলে মনেই হবে না—করিমের ভিতরের মানুষটা বড় কুটিল, সর্পিল স্রোতের মতো। মুখে মনে এক ছবি এখন করিমের। যা খুশি মনে লয় কর, গঞ্জের ঘাট থাইকা কিনা লও। মেঘনার ইলিশ। তারপর জলে জলে ভাইসা যাও। আর পাটাতনে বইসা ইলিশ মাছের ঝোল, গরম ভাত এবং নদীর জলে ময়ূরপঙ্খী নাও ভাসাও। বড় লোভ আমার, যেন এমন বলার ইচ্ছা করিম শেখের। হিদুর মেয়ে, যৌবন যার বিফলে যায় এমন যুবতী মাইয়ারে লইয়া ঘর করতে সখ যায়—অ যুবতী, পরাণে তর কি কষ্ট, তুই ক্যামন কইরা এই যৌবনে কাইন্দা কাইন্দা মরস, তরে লইয়া যামু সাগরের জলে, ভাবতে ভাবতে করিম শেখ ফুরুৎ ফুরুৎ করে দু’বার ধোঁয়া ছেড়ে দিল আকাশে। তারপর হুঁকোটা জব্বরকে দিয়ে বলল, টান মিঞা, পরাণ ভইরা সুখটান দ্যাও! বলে, কেমন হামাগুড়ি দিয়ে চৌকাঠ পার হতে চাইলে জব্বর খপ করে দু ঠ্যাং জড়িয়ে ধরল, আরে মিঞাসাব, করতাছেন কি!

    —কি, করতাছি কি!

    —সাপ লইয়া খেলা করতে চান?

    —সাপের বিষদাঁত ভাইঙা দিতে চাই।

    —খুব সোজা মনে হইছে?

    —তা মনে হইছে।

    —সুতা বিচাকিনার মতো মনে হইছে?

    —হইছে।

    —মিঞা এত সোজা না!

    —সোজা কি না দ্যাখি। বলে সে হামাগুড়ি দিয়ে দরজা অতিক্রম করে ছইয়ের ভিতর ঢুকে গেল। এবং লেজ গুটিয়ে শেয়াল যেমন তার গর্তের ভিতর নিরিবিলি বসতে চায়, সে তেমনভাবে একটু তফাতে নিরিবিলি বসল। মালতীকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘাড় গুঁজে বসে আছে মালতী। নৌকায় তুলে আনতে জোর জবরদস্তি করতে হয়েছিল বলে শরীরের নানা জায়গায় ক্ষত এবং রক্তের দাগ। অথবা কেউ যেন শরীরের সর্বত্র আঁচড়ে খামছে দিয়েছে। সে যেন ভালোবাসা দিচ্ছে তেমনভাবে হাত রাখতে গিয়ে দেখল, গলুইর মাঝি এদিকে তাকাচ্ছে। সে পাল্লাটা এবার ঠেলে ভেজিয়ে দিল। লালসায় এখন মানুষটার জিভ চক্‌চক্‌ করছে। পদ্মফুলের মতো তাজা, গোলাপের মতো কোমল এবং স্নিগ্ধ অথবা লাবণ্যময় শরীরে যেন যৌবন কেবল নদীর উজানে যায়। করিম শেখ উত্তপ্ত লোহার উপর হাত রেখে দ্রুত সরিয়ে নেবার মতো বার দুই ছুঁতে চেষ্টা করল, বার দুই কপালে হাত রেখে ভালোবাসা দিতে চাইল। মালতী এখন কেমন ভালোমানুষের ঝি হয়ে গেছে। করিমকে কিছু বলছে না। এবার সাহস পেয়ে করিম একেবারে রাজা-বাদশার মতো হাঁকল চরে নাও বান্দ মিঞারা। ইলিশের ঝোলে ভাত খাইয়া লও তারপরই পাটাতনে যুবতী মালতীর সঙ্গে করিম শেখ এক খেলায় মেতে যাবে এমন চোখ মুখ নিয়ে ছইয়ের বাইরে এসে নদীর চরে তাকাতেই কাশবনের ভিতর বড় এক কুমির ভেসে উঠতে দেখল বুঝি। কুমিরটা ভিতরে ভিতরে এত বড় হাঁ খুলে রেখেছে ভাবতেই করিমের মুখে রক্ত এসে গেল।

    চরে নাও বেঁধে ইলিশ মাছের ঝোল, ভাত। গ্রাম অনেক দূরে। নদীর দক্ষিণ পাড়ে। কাশবন পার হলে আস্তানাসাবের কবরখানা। কতদূরে এখন এইসব জমি এবং মাঠ চলে গেছে। সামনে হোগলার বন। জল ক্রমে কমতে কমতে ডাঙার দিকে উঠে গেছে! সূর্য ক্রমে মাথার উপর উঠে আসছে। ওরা পাটাতনে বসে খেল। মালতী কিছু খেল না। চুপচাপ মালতী নদীর জল দেখছে। ওরা তখন সবাই অন্যমনস্ক। করিম নামাজ পড়ছে।

    মালতী আর ফিরতে পারছে না। কোথায় ফিরবে! ওকে হারমাদ মানুষেরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। সে রঞ্জিত অথবা অন্য কোনও মুখ এ-সময় মনে করতে পারছে না। মাথার ভিতর কী জ্বালা যন্ত্রণা! থেকে থেকে অসহায় আর্তনাদ। সে হায়, কী করবে এখন? কোথায় যাচ্ছে, তার কী ইচ্ছা, সে কে, কেন এমন করে চুপচাপ বসে আছে? কিছু কি তার করণীয় নেই? এত বড় নদী, নদীর জল—এই অতল জলে ঠাঁই হবে না জননী, বলে, সবাই যখন ঝোল ভাত খেতে ব্যস্ত, করিম যখন নিবিষ্ট মনে নামাজ পড়ছে তখন মালতী জলে ঝাঁপ দিল। জয় মা জাহ্নবী, জননী মা তুই, তোর বুকে ভেসে গেলাম। কোথায় কি করে স্রোতের মুখে পড়তেই নিমিষে দূরে গিয়ে ভেসে উঠল মালতী। মাঝিরা সকলে নাস্তা ফেলে হৈ হৈ করে উঠল। জব্বর প্রমাদ গুনে তাড়াতাড়ি জলে লাফ দিয়ে পড়ল। মাঝিরা দড়ি খুলতে গিয়ে দেখল, গিঁট লেগে গেছে, ওরা তাড়াতাড়ি দড়ি খুলতে পারল না। মালতী স্রোতের মুখে অনেকদূর চলে গেছে। মালতী কখনও ডুবে যাচ্ছে, কখনও ভেসে উঠছে। করিম পাটাতনে দাঁড়িয়ে হাঁকল, সেই এক হাঁক এ-অঞ্চলের, কে ডুইবা যায়! করিম নৌকা স্রোতের মুখে ছেড়ে দিলে মালতী চরের বুকে হোগলার জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ল।

    নৌকাটা স্রোতের মুখে কচ্ছপের মতো ভেসে যাচ্ছিল। সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু জলের ঘূর্ণি। ডানদিকে চর, চরের বুকে ধানক্ষেত। সকলে ভাবল, জলের নিচে বুঝি মালতী ডুবে গেছে। কিন্তু বর্ষায় মালতী সোনালী বালির চর পার হয়ে যেত, ঘূর্ণিতে মালতী ডুবে ডুবে বালিমাটি তুলে আনত নদীর বুক থেকে। সেই মালতী জলে ডুবে যাবে জব্বর বিশ্বাস করতে পারল না। সে নৌকায় উঠে চারদিকে তাকাল। পাশে শরবন। শরের গোড়া ফাঁক করে যেমন মাছ নদীর জলে সাঁতার কাটে তেমন এক মানুষ যেন এক শরবনে সাঁতার কাটছে।

    জব্বর চিৎকার করে উঠল, ঐ যায় দ্যাখেন!

    মাঝিরা বলল, মাছ মিঞা, মানুষ না।

    করিম বলল, হাঁ মাছ বড় মাছ। মাছের পিছনে এখন ছোটা ভাল না। করিম বরং সতর্ক দৃষ্টি রাখছে মাঝনদীতে। কারণ ভয় করিমের—একবার এই নদী পার হয়ে গেলে জেল হাজত করিমের। ঘরে তুলে না নিতে পারলে, নদীর জলে, শরবনে, যেখানে থাকুক, মাথায় মালতীর লগির বাড়ি, তখন জলের তলায় ডুবে যাবে মালতী! খাল-বিল-নদীর জলে কে কবে ভেসে যায় কে জানে! বর্ষার জল, এমন জলে যুবতী নারী ডুবে মরলে আত্মহত্যার শামিল হবে। করিম বলল, কইরে মিঞা, যুবতী মাইয়া কই?

    জব্বর কিন্তু সেই শরবনের দিকে তাকিয়ে আছে। বন ক্রমে ডাঙার দিকে উঠে গেছে। সেখানে এতবড় নাও ভাসালে চড়ায় নাও আটকে যাবে। এবং সেখানে শুধু কাদা-জল, কি করবে জব্বর! এই অসময়ে আল্লার বান্দা কে এমন আছে ধইরা আনে যুবতী মাইয়ারে—জব্বর রাগে দুঃখে এখন চুল ছিঁড়তে থাকল। এবং যেদিকে শরবন কাঁপছে অথবা নড়ছে সেদিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। আর সহসা দেখতে পেল, শরবন পার হয়ে মালতী অন্ধের মতো কবরখানার দিকে উঠে যাচ্ছে। করিম পাগলের মতো হা হা করে হাসতে থাকল। পথ হারাইছে যুবতী মাইয়া, যুবতীর সন্ধানে চল। সে এবার লাফ দিয়ে পড়ল জলে। জব্বর দেখাদেখি লাফ দিয়ে জলে নেমে গেল। করিমের শাকরেদ পর্যন্ত লোভে লালসায় জল সাঁতরাতে থাকল। যতদূর চোখ যায় শুধু জল, মনুষ্যহীন এই বনে-জঙ্গলে একটা শশকের পিছনে একদল নেকড়ে যেন দ্রুতবেগে ছুটছে। সামনে সেই ডাঙা। আস্তানাসাবের দরগা আর চারিদিকে গভীর জল। দূরে কতদূরে গেলে যেন লক্ষ যোজন দূরে মানুষের বসতি। এই ডাঙায় আটকা পড়লে নির্ঘাত মালতী পাগল হয়ে যাবে। অথবা ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে যদি কোনওরকমে পাঁচ সাত মাইল নদীর উজানে ভেসে গিয়ে লোকালয়ে উঠতে পারে, তবে জব্বর তোমার জেল হাজত। তোমার দুই তাঁতের বোনাবুনি শেষ! লোভ লালসা শেষ! যত দ্রুত পালাচ্ছে মালতী তত দ্রুত ছুটছে জব্বর, করিম, ওর শাকরেদ। শরবনের ভিতর দিয়ে ছুটছে। শরীর কেটে রক্ত পড়ছে। ওদের এখন অমানুষের মতো দেখাচ্ছিল। ভূতের মতো অথবা প্রেতের মতো যেন শ্মশানভূমিতে নৃত্য করে বেড়াচ্ছে।

    মানুষের সাক্ষাৎ এ-অঞ্চলে চোখে পড়বে না। দু’দশ ক্রোশের ভিতর প্রায় লোকালয়বিহীন এই অরণ্য, বন জঙ্গল এবং পরবে দরগায় মোমবাতি জ্বালানো হয়, পরব বাদে মানুষ এ-পথে কেউ কখনও আসে না। এই অরণ্যের ভিতর যেন মৃত এক জগৎ-সংসার চুপচাপ প্রকৃতির খেলা দেখে চলেছে। আর আসে দশ-বিশ ক্রোশ দূর থেকে মানুষ, মৃত মানুষ। ইন্তেকালে মানুষ এসে এই কবরখানায়, অরণ্যের ভিতর আশ্রয় নেয়। এবং দরগার কবরে কবরে ইন্তেকালের সময় শোনা যায়-আল্লা এক, মহম্মদ তার একমাত্র রসুল।

    এখন সুর্য আকাশে পশ্চিমের দিকে হেলে পড়তে শুরু করেছে। ওরা তিনজন হোগলা বনে ঢুকেই কেমন দিশেহারা হয়ে গেল। কারণ, কোনও শব্দ পাচ্ছে না। জলে কাদায় মানুষ ছুটলে একরকমের ছপছপ শব্দ হয়, সেসব শব্দ চুপচাপ কেমন মরে গেছে। ওরা সেই শব্দ শুনে এতক্ষণ ছুটছিল। বাতাসে শরবন কেঁপে যাচ্ছে। ঝোপে-জঙ্গলে কত সব কীট-পতঙ্গ এবং পোকামাকড়। বর্ষার জন্য সাপের ভয়। এই অঞ্চলে বিষধর সাপ, মাঠে এবং নদীর চরে গ্রীষ্মের দিনে যারা ঘুরে বেড়াত তারা জলের জন্য সব উঁচু জমিতে উঠে যাবে। অথবা ঝোপে-জঙ্গলে ঘাসের মাথায় জড়াজড়ি করে পড়ে থাকবে। আর জলজ ঘাস, জোঁক এবং এক ধরনের ফড়িংয়ের ভয় আর—প্রায় যেন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই—এই এক যুবতী এখন ওদের সবাইকে বনের ভিতর কাদায় জলে ঘুরিয়ে মারছে। যত ঘুরে মরছে তত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে জব্বর এবং পাগলের মতো চিৎকার করছে করিম, অশ্লীল সব কটুক্তি। দড়িদড়া খুলে না দিলেই হতো। এখন কি করা! হায়! এখন পদ্মফুলের মতো যে মালতী সে এখন কোথায়! এখন প্রায় ফাঁসির আসামীর মতো মুখ নিয়ে খোঁজাখুঁজি। ছুঁতে পারল না, ভালো করে সাপ্টে ধরতে পারল না, সাপ্টে ধরে সোহাগে কচুপাতার মতো নরম চুলে হাত ঢুকিয়ে, হায়! সে কিছুই করতে পারল না। সব বিফলে গেল, ভাবতেই করিম নিজের মূর্তি ধারণ করল এবার। একেবারে জানোয়ারের মতো মুখ! বলল, হালা, তুমি আমারে গরু ঘোড়া পাইছ। বলেই সে এক লাথি মারল জব্বরের পাছাতে। সঙ্গে সঙ্গে জব্বর ভয়ে ভয়ে বলল, আসেন মিঞা। মনে হয় উত্তরের ঝোপে জলে কাদায় মানুষ হাঁইটা যায়! আসেন।

    না আর না! জব্বর মনে মনে কসম খেল। পেলেই সাপ্টে ধরবে। ইজ্জতের মাথা খাবে। করিম ভাবল, না আর না। আর সোহাগ দেবে না। পেলেই জানোয়ারের মতো লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে। টানা- হ্যাঁচড়া, টানতে টানতে ঝোপের ভিতর ফেলে, ভাবতেই করিমের চোখমুখ নেশাখোরের মতো দেখাচ্ছে। যা হয় হবে, একবার মাটির ভিতর আবাদের চারা তুলে দিতে পারলে জমি তার, কার হিম্মত আর বলে, জমি তোমার না মিঞা, জমি আমার। সে এবং জব্বর শাকরেদ নাদির হন্যে হয়ে ছুটছিল। এবং ছুটতে ছুটতে মনে হল সন্ধ্যায় মালতী ডাঙায় উঠে গেছে। ওরা ডাঙায় উঠে কবরখানার ঝোপ- জঙ্গলে ওৎ পেতে থাকল। মালতী একা একা অরণ্যের ভিতর পথের খোঁজে ঘুরে বেড়ালে খপ করে ধরে ফেলবে।

    মালতী অভুক্ত। সারাক্ষণ শরবনের ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে অবসন্ন। সে এই অরণ্যের ভিতর ঢুকে দেখল দর দর করে রক্ত পড়ছে। গোটা শরীর কেটে গেছে। গায়ে শাড়ি নেই। সেমিজ ছিঁড়ে খুঁড়ে গেছে। কোথায় কোন্ জঙ্গলের লতায় পাতায় বেতঝোপের ভিতর ওর কাপড় এখন নিশানের মতো উড়ছে কে জানে। ওর হুঁশ ছিল না। সেমিজের একটা দিক ফালা ফালা। সে টলতে টলতে নির্জন বনভূমিতে ঢুকে আহত হরিণ যেমন তার শরীর ঝোপের ভিতর টেনে নেয়, সন্তর্পণে চুপচাপ পড়ে থাকে, মালতী তেমনি নিজেকে ঝোপের ভিতর অদৃশ্য করে দিল। উপরে হাল্কা জ্যোৎস্না। সামান্য সময় এই জ্যোৎস্না আকাশে থাকবে। তারপর ক্রমে কেমন ক্ষীণ এক শব্দ উঠে আসছে মনে হল; নদীর জলে শব্দ। পাড়ে ঢেউ ভাঙায় শব্দ। সহসা ঝোপে-জঙ্গলে কোন অতর্কিত শব্দ শুনলে সে আঁতকে উঠছে। ক্রমে সে নিস্তেজ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল সে মরে যাচ্ছে। দূরে দূরে সে হরিণীর দ্রুত ছুটে যাওয়ার শব্দ পেল। দূরে দূরে আকাশে এক ভেলার মতো রঞ্জিতের মুখ, মুখের ছবি, দুই চোখ রঞ্জিতের ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে। মালতী ক্রমে এ-ভাবে সংজ্ঞা হারাচ্ছে বুঝতে পারছিল। আর ঠিক তক্ষুনি দেখল ওর পায়ের কাছে তিন যমদূতের মতো অপদেবতা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে তারা নিতে এসেছে। এবার যথার্থই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ভয়ে। কিছু খচমচ শব্দ, হরিণীর দ্রুত পালানোর শব্দ এবং জলে ঢেউ ওঠার শব্দ—সারারাত সংজ্ঞাহীন মালতীর কোমল শরীরে পাশবিকতার সাক্ষ্য রেখে মালতীকে মৃত ভেবে কবরভূমিতে ফেলে অন্ধকারে ওরা সরে পড়ল সকাল হতে না হতেই। শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে যুবতীকে। কেউ টের পাবে না, বনের ভিতর এক যুবতী মাইয়া মইরা পইড়া আছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }