Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.২৩

    ১.২৩

    মণীন্দ্রনাথ এত বড় রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে ঢুকেই মোটামুটি স্বাভাবিক মানুষ হয়ে গেলেন। তিনি এখন সোনাকে সঙ্গে নিয়ে কাছারিবাড়ির উঠোনে পায়চারি করছেন। ভূপেন্দ্রনাথ ট্রাঙ্ক থেকে তাঁর ধুতি বের করে দিয়েছেন, পাঞ্জাবি খুলে নিজেই পরিয়ে দিয়েছেন। লম্বা মানুষ এবং বলিষ্ঠ বলে জামা-কাপড় সবই খাটো খাটো দেখাচ্ছে। রামপ্রসাদ দেখাশোনার ভার নিয়েছে—কোথায় কোনদিকে একা একা চলে যান দেখার জন্য রামপ্রসাদ থাকল। অনর্থক এই দেখাশোনার ভার রামপ্রসাদের ওপর। মণীন্দ্রনাথ কেবল কথা বলছেন না এই যা। নতুবা দেখে মনে হবে তিনি ফের তাঁর প্রবাস-জীবন থেকে ফিরে এসেছেন। এই মনোরম জগতে সোনার হাত ধরে কেবল তাঁর ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছা।

    উৎসবের বাড়ি। মানুষজন ভ ত্মীয়কুটুম কেবল আসছে। নদীর ঘাটে নাও এখন লেগে আছে। ঢাক-ঢোলের শব্দ নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে। জ্যাঠামশাইর হাত ধরে টানতে টানতে সোনা নাটমন্দির পার হয়ে এল। সে মনে মনে কাকে যেন খুঁজছে। কমল কোথায়! এত বড় বাড়ির ভিতর থেকে কমলকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। সে জ্যাঠামশাইকে ময়ূর দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট এক চিড়িয়াখানা বাবুদের। ছোট দুটো বাঘ আছে, হরিণ আছে, ময়ূর আছে আর কচ্ছপ আছে। জ্যাঠামশাইকে সে বাঘ দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। কমল সঙ্গে থাকলে বড় ভালো হত। কমল ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। সারাটাক্ষণ সে কমলকে কাছে পেতে চায়।

    কমলের জন্য সে চারদিকে তাকাতে থাকল। বারান্দা পার হয়ে গেল। বড় বড় হলঘর পার হয়ে গেল। পরিচিত অপরিচিত মানুষজনের ভিতর দিয়ে সে চলে যাচ্ছে। জ্যাঠামশাই ওকে কেবল অনুসরণ করছেন মাত্র। মাথার উপরে সেই ঝাড়লণ্ঠন। একটা চড়ুই পাখি ধুতরো ফুলের মতো কাচের জারে ফরফর করে উড়ছে। দশটা বাজতে দেরি নেই। বড়দা মেজদা যে কোথায় থাকে! ওরা বড়বাবুর মেজ ছেলের সঙ্গে কোথায় এখন বন্দুক দিয়ে বিলের জলে হাঁস মারতে গেছে। সে কমলকে আর যেন কোথাও খুঁজে পেল না। সে জ্যাঠামশাইকে টানতে টানতে দীঘির পাড়ে নিয়ে এল। জ্যাঠামশাইকে বলতে চাইল—আমরা এক নতুন জায়গায় চলে এসেছি। এখানে বড় নদী শীতলক্ষ্যা, চরে কাশবন, দীঘির পাড়ে চিতাবাঘ, হরিণ, ময়ূর, দূরে পিলখানার মাঠ, ঝাউগাছ, নদীর পাড়ে পামগাছের বন এবং দূরে চলে গেলে বাবুদের অন্য অনেক শরিক এবং তাঁদের দুর্গাপূজা–জ্যাঠামশাই এই যে দ্যাখছেন, এটা ময়ূর। দ্যাখেন দ্যাখেন। সে জ্যাঠামশাইকে নিয়ে ময়ূরের খাঁচার পাশে বসে পড়বে ভাবতেই দেখতে পেল, দীঘির পাড় ধরে চন্দ্রনাথ হনহন করে ফিরছেন। সোনা সে তার বাবাকে দেখে জ্যাঠামশাইর পিছনে লুকিয়ে থাকল। চন্দ্রনাথ মহালের আদায়পত্রের জন্য বের হয়ে গিয়েছিলেন, ফলে দু’দিন এদিকে আসতে পারেননি। আজই তিনি নৌকায় মহাল থেকে ফিরে এসেছেন। সোনা, জ্যাঠামশাইকে বাইরে নিয়ে এসেছে সব দেখাবে বলে। সোনা যেন কত অভিজ্ঞ প্রবীণ এবং জ্যাঠামশাই তার হাত ধরে হাঁটছেন এমন ভাব। দূরে পিলখানার মাঠ পার হলে আনন্দময়ীর কালীবাড়ি, বাজার-হাট এবং রাতে সেই অদ্ভুত শব্দ—ডায়নামো চলছে। তার ইচ্ছা ছিল সব দেখিয়ে যে-ঘরটায় ডায়নামো আছে, সেদিকে জ্যাঠামশাইকে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাবাকে দেখেই সে ভয় পেয়ে গেল।

    মহাল থেকে ফিরেই চন্দ্রনাথ শুনেছেন, সোনা এবার পূজা দেখতে এসেছে। চন্দ্রনাথ নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলেন। সোনার মুখ দেখার জন্য কেমন ব্যাকুল হয়ে আছেন। দীঘির পাড়ে এসে দেখলেন, বড়দা মণীন্দ্রনাথ। ময়ূরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মণীন্দ্রনাথকে দেখে চন্দ্রনাথ প্রথমে খুবই হতবাক। এই পাগল মানুষ একা এখানে দাঁড়িয়ে আছে। আর তিনি এলেনই বা কার সঙ্গে! মেজদা বলে পাঠিয়েছেন কেবল সোনা এসেছে। সুতরাং মণীন্দ্রনাথকে দেখতে পাবে আশাই করেননি। চন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি দাদার দিকে হেঁটে গেলেন। কাছে যেতেই দেখলেন পিছনে সোনা বড়দার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে।

    —তুমি, সোনা, এখানে?

    —জ্যাঠামশায়কে ময়ূর দেখাইতে নিয়া আইছি।

    —লালটু পলটু কই?

    —ওরা পাখি মারতে গ্যাছে।

    পূজার ছুটিতে বাবুদের ছেলেরা শহর থেকে চলে আসে। ওরা বন্দুক নিয়ে পাখি শিকারের খেলায় মেতে ওঠে। চন্দ্রনাথ সোনাকে দেখেই কেমন আকুল হতে থাকলেন। সোনা তার মায়ের মুখ পেয়েছে, না বড়দার মুখ পেয়েছে বুঝতে পারছে না। এইসময় যেন সেই মা অর্থাৎ দূরের এক গ্রামে, বড় বড় চোখে ধনবৌ নিত্যদিন শ্রম করে চলেছে সংসারের জন্য। দূরবর্তী গ্রামে কোমল এবং সুন্দর এক জননীর মুখ ভেসে উঠলে চন্দ্রনাথ সোনাকে বুকে নিয়ে আদর করতে চাইলেন। বললেন, আয় তরে কোলে লই।

    সোনা জ্যাঠামশাইকে আরও জোরে সাপ্টে ধরল। সে কোলে উঠতে চাইল না। কারণ সোনার কাছে এই পাগল মানুষ, চন্দ্রনাথের চেয়ে কাছের মানুষ। সে তার বাবাকে কদাচিৎ দেখতে পায়। বাবা সাধারণত তিন-চার মাস অন্তর বাড়ি যান। অধিকাংশ সময় রাতের বেলা। অধিক রাতে। সোনা টের পায় না। ভোর হলে সে দেখতে পায় বিছানাতে মা নেই। বাবা তাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। সোনা প্রথমে অবাক চোখে তাকায়, তারপর চোখ বড় করে দিলে সে বুঝতে পারে, তার বাবা প্রবাস থেকে ফিরেছেন, আখ, আনারস, যে-দিনের যা তিনি নিয়ে এসেছেন। সোনা তখন চুপচাপ ভালো ছেলের মতো শুয়ে থাকলে, বাবা তাকে কতরকমের কথা বলেন, এবার উঠতে হয়, উঠে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে হয়! লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে—এমন সব একের পর এত পুণ্যশ্লোকের মতো কথা, কিছু সংস্কৃত উচ্চারণ, ধর্মাধর্মের কথা, সূর্যস্তব আরও কি যেন তিনি এই ছেলে অথবা এই যে সংসার, গাছ ফুল মাটি এবং গোপাটে অশ্বত্থগাছ, তারপর দূরে দূরে সোনালী বালির নদী, নদীর চর, সব মিলে বুঝি তার বাবা জন্মভূমি সম্পর্কে, জননী সম্পর্কে এবং গুরুজনদের সম্পর্কে আচার ব্যবহার শেখাতে গাছপালা পাখিদের ভিতর টেনে নিয়ে যান—সোনার মনে হয় বাবার হাতে আলাদিনের প্রদীপ আছে, তার যা খুশি বাবা তাকে এনে দিতে পারেন। ফলে তার কাছে চন্দ্রনাথ সব সময়ই জাদুর দেশের মানুষ।

    চন্দ্রনাথ কেবল সোনার সঙ্গে কথা বলছেন, মণীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলছেন না, এ-কারণে মণীন্দ্রনাথ বুঝি মনে মনে রেগে যাচ্ছেন। চন্দ্রনাথ বুঝতে পেরে বললেন, আপনের শরীর কেমন? বড়বৌদির শরীর? এসব বলা নিরর্থক। তবু কুশল প্রশ্ন না করলে, এত বড় মানুষটা যে এখনও আছেন, এই সংসারে আছেন, যেন না থাকলেই বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগবে, মানুষটাকে শুধু সম্মান দেখানো— মানুষটা আছেন বলেই যেন সব আছে! চন্দ্রনাথ এবার সোনাকে বললেন, জ্যাঠামশাইরে ধইরা ভিতর বাড়ি লইয়া যাও। কোন্‌দিকে আবার ছুটব তখন তুমি ধইরা রাখতে পারবা না। তারপর চন্দ্রনাথ হাঁটু গেড়ে পাগল মানুষের পায়ে মাথা ঠেকালেন।

    সোনা জ্যাঠামশাইর হাত ধরে কাছারিবাড়ির দিকে হাঁটছিল। চন্দ্রনাথ যেতে যেতে বললেন, তুমি যে পূজা দ্যাখতে আইলা, তোমার মার কষ্ট হইব না?

    সোনা বলল, মায় তো আমারে কইল আইতে।

    চন্দ্রনাথ ছেলের মাথায় হাত রাখলেন, রাইতের ব্যালা কিন্তু কাইন্দ না।

    সোনা চুপ করে থাকল। জ্যাঠামশাই ওর পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এখন বাড়ির ভিতরে যেতে চাইছেন না। অথচ চন্দ্রনাথের ইচ্ছা—এই গাছপালা রোদ্দুরের ভিতর সোনা না ঘুরে এখন কাছারিবাড়িতে চলে যাক। রোদ উঠেছে। এই রোদে ঘুরে বেড়ালে সোনা অসুস্থ হতে পারে! আর এই রোদে যার মুখ দেখলে কেবল ধনবৌর কথা মনে হয়, প্রবাসে তিনি কতদিন ধরে যে একা, এই পূজার সময়ে চলে যেতে পারলে বড় মনোরম, সোনার মুখ দেখে চন্দ্রনাথ বাড়ি যাবার জন্য ভিতরে ভিতরে আকুল হয়ে উঠেছেন। এখন বর্ষাকাল বলে আর যখন তখন বাড়ি যাওয়া হয়ে উঠছে না। গেলেই নৌকা করে যেতে হয়। শীতে অথবা হেমন্তে মহালে বার হচ্ছেন, মহালে বের হবার নামে তিনদিনের কাজ একদিনে সেরে বাড়ি চলে যান, দু’রাত বাড়িতে থেকে কাছারিবাড়ি ফিরে আসেন, মহালে আদায়পত্রের নামে লুকিয়ে চুরিয়ে চলে যাওয়া। কোনও ছুটিছাটার বালাই নেই, বাবুদের মর্জি, যাও, দু’দিন ছুটি! আবার হয়তো ছ’মাসে কোনও সময়ই করে উঠতে পারেন না চন্দ্রনাথ। ভূপেন্দ্রনাথ ছোটভাইর মুখ দেখে ধরতে পারেন সব, তিনি বাবুদের বলে-কয়ে ছুটি করে দেন। এছাড়া মহালের নাম করে চন্দ্রনাথ যখন বাড়ি চলে আসেন তখন প্রায়ই খুব রাত হয়ে যায়, নিশুতি রাত। বেলায় বেলায় মহালের কাজ সেরে বাড়িমুখো হাঁটতে থাকেন। দশ ক্রোস পথ হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন চন্দ্ৰনাথ। নিশুতি রাতে কড়া নাড়লে ধনবৌ টের পায়, মানুষটা আর থাকতে পারছে না, চলে এসেছে। ধনবৌ নিজেও কত রাত না ঘুমিয়ে থেকেছে, কারণ ধনবৌ বলতে পারে না চন্দ্রনাথ কবে আসবে। দরজায় কড়া নাড়লেই বুকটা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। খুব চুপি চুপি যেন সোনা টের না পায়, টের পেলেই উঠে বসবে, ঘুমাবে না, সারারাত বাবা ওর জন্য কি এনেছে এবং লালটু ওর তক্তপোশ থেকে উঠে এসে বাবার সঙ্গে শুতে চাইবে। ফলে ধনবৌ প্রায় লুকিয়ে দরজা খুলে দেয়। আহা, চন্দ্রনাথ দীঘির পাড় ধরে হাঁটার সময় ভাবলেন, ধনবৌ নিশ্চয়ই রাতে ঘাটে বাসন মাজতে মাজতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। দূরের অন্ধকারে লগির শব্দ শুনলেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষটা বুঝি নৌকা করে নদীর চরে উঠে আসছে। ধনবৌ নিজেও বুঝি আর অপেক্ষা করতে পারছে না। রাতে জানালায় মুখ রেখে জেগে বসে থাকছে। দরজার কড়া বুঝি এক্ষুনি নড়ে উঠবে, চুপি চুপি দরজা খুলেই দেখতে পাবে তার স্বামী চন্দ্রনাথ, শক্তসমর্থ মানুষ, মোটা গোঁফ এবং ভাটা ভাটা চোখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। স্বামী তার পালিয়ে সহবাস করতে চলে এসেছে। ধনবৌ হাত-পা ধোবার জল এবং গামছা হাতে দিয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করে, চন্দ্রনাথ কী খাবেন। চন্দ্ৰনাথ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলেন না। শুধু লণ্ঠনের আলো মুখের কাছে নিয়ে যান। ধনবৌর মুখ দেখতে দেখতে কী যেন তিনি বলতে চান। বলতে পারেন না। ধনবৌ তখন সব বুঝতে পেরে মিষ্টি মিষ্টি হাসে।

    কি সব ভাবছেন তিনি। চন্দ্রনাথ এবার মণীন্দ্রনাথকে বললেন, সময় মত স্নান করবেন। সময় মত খাইবেন। ছুটাছুটি করলে বাবুরা কিন্তু রাগ করব।

    মণীন্দ্রনাথ আর দাঁড়ালেন না। সোনার হাত ছেড়ে হাঁটতে লাগলেন। সোনা বলল, বাবা, যাই? বলে সে আর বাবার আদেশের অপেক্ষা করল না। সে জ্যাঠামশাইকে ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল।

    সোনা যেতে যেতে বলল, জ্যাঠামশয়, আমি কিন্তু আপনের লগে সান করমু, আপনের লগে খামু। সোনা আরও বলতে চাইল, এই যে দেখছেন, দীঘি পার হলে বাঘ আছে, বাঘের বাচ্চা আছে। সেই চিড়িয়াখানাতে নিয়ে যাবার ইচ্ছা এখন সোনার। সে টানতে টানতে বাঘের খাঁচার সামনে নিয়ে দাঁড় করাল। চিতাবাঘ্রে দুটো বাচ্চা, চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে। কান খাড়া করে যেন বাঘদুটো সোনা এবং মণীন্দ্রনাথকে দেখতে থাকল। ডানদিকে হেঁটে গেলে ছোট্ট এক জলাশয়, পাড়ে পাড়ে লোহার রেলিঙ, জলাশয়ে কুমীর। শীতলক্ষ্যার জলে কুমীরের ছা ভেসে এসেছিল। গোলা করে মাছের জন্য ডালপালাএবং জলের ভিতর পচা এক শ্যাওলাভূমি তৈয়ার করে রাখলে এই কুমীর মাছ খেতে ঢুকে আটকা পড়ে গেল গোলাতে। সেই থেকে ছোট্ট কুমীরের জন্য এই জলাশয়। লালটু পলটু বাঘ, হরিণ, ময়ুরের গল্প করেছে, কিন্তু কুমীরের গল্প করেনি। কাল এসেই ওরা কুমীর দেখে এসেছে। সোনা তখন অমলা কমলার সঙ্গে ছাদে উঠে নক্ষত্র দেখছিল—রাতে শুতে গেলে কাছারিবাড়িতে এই গল্প। চিড়িয়াখানাতে এবার একটা কুমীর এসেছে। সে জ্যাঠামশাইকে, যেন জ্যাঠামশাই এক নাবালক, সোনা বড় মানুষ, সে যাচ্ছে আর কথা বলছে, বাঘে কি খায়, ময়ূরে কখন পেখম ধরে, হরিণেরা কি খেতে ভালোবাসে, বাবুদের এইসব হরিণ কোত্থেকে ধরে এনেছে—বিজ্ঞের মতো যা সে এতদিন শুনেছে—এক এক করে বলে যাচ্ছিল।

    বাঘের খাঁচার পাশে মণীন্দ্রনাথ সহসা দাঁড়িয়ে গেলেন। এবং গরাদ ধরে নাড়তে থাকলেন। সোনা তাড়াতাড়ি ভয় দেখাল মণীন্দ্রনাথকে, জ্যাঠামশয়, বাঘে কিন্তু মানুষ খায়। দুষ্টামি করলে কিন্তু বাঘে লাফ দিব। মণীন্দ্রনাথ সোনার কথা শুনে হা-হা করে হাসতে থাকলেন। তারপর ছাদের দিকে তাকিয়ে সহসা চুপ মেরে গেলেন। সোনা এতদূর থেকেও চিনতে পারল, ছাদে উঠে অমলা রোদে চুল শুকাচ্ছে।

    মণীন্দ্রনাথ এবার সোনাকে কাঁধে তুলে নিতে চাইলেন। সোনা জ্যাঠামশাইর কাঁধে উঠল না। বলল, আসেন দ্যাখি কে আগে যায়। বলে সোনা ছুটতে থাকলে দেখল পাগল মানুষ ছুটছেন না। ছাদের দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। অমলার চুল সোনালী রঙের। চোখ নীল। অমলাকে দেখে জ্যাঠামশাই কেমন স্থির হয়ে গেলেন! আর আশ্চর্য এই মানুষ যথার্থই সেই থেকে ভালো হয়ে গেলেন যেন। সোনাকে তেল মাখিয়ে দিলেন গায়ে, স্নান করিয়ে দিলেন। একসঙ্গে খেতে বসলেন। সোনার মাছ বেছে দিলেন, এবং বিকেলে হাত ধরে নদীর পাড়ে বেড়াতে গেলেন।

    আর তখনই সোনা দেখল একটা ল্যান্ডো গাড়ি আসছে। দুই সাদা ঘোড়া। অমলা কমলা হাওয়া খেতে বের হয়েছে। ওরা সোনাকে দেখে বলল, যাবে সোনা?

    —জ্যাঠামশাইরে নিলে যামু।

    ওরা গাড়ি থামাতে বলল। জ্যাঠামশাইকে তুলে নিল সোনা। অমলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর জ্যাঠামশাইর দিকে চেয়ে বলল, আমার বড় জ্যাঠামশয়। কলিকাতায় চাকরি করত।

    ওরা সাদা সিল্কের ফ্রক গায়ে দিয়েছে, পায়ে সাদা মোজা, কেডস্। মণীন্দ্রনাথেব সিল্কের পাঞ্জাবি আর পাট করা ধুতি, সাদা জুতো। সোনার সোনালী রঙের সিল্ক, সাদা হাফ প্যান্ট! পায়ে রবারের জুতো। দুই সাদা ঘোড়া নদীর পাড় ধরে ওদের এখন হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে। সোনা ঘাটে দেখল, নৌকায় ঈশম বসে মাছ ধরছে। সে চিৎকার করে উঠল, ইশমদাদা যাইবেন? হাওয়া খাইতে যাইবেন?

    সোনার কাছে ছোট বড় ভেদ থাকল না। যেন এই গাড়িতে উঠে ইচ্ছা করলে সকলেই হাওয়া খেতে যেতে পারে। সে তার জ্যাঠামশাইর দিকে তাকিয়ে বলল, যাইবেন পিলখানার মাঠে? হাতি দ্যাখামু আপনেরে। কমলা তুমি যাবে?

    অমলা বলল, আমিও যাব। কমল, তুই, আমি সোনা। সে এখন পাগল মানুষটাকে দেখল, দেখতে দেখতে বলল, আপনি যাবেন? কিন্তু কোনও কথা বলল না বলে জোরে অমলা বলল, আপনি যাবেন হাতি দেখতে? আমরা কাল ল্যাণ্ডোতে হাতি দেখতে যাব। নদীর চরে নেমে যাব। যাবেন?

    এত করেও অমলা মণীন্দ্রনাথকে কথা বলাতে পারল না। এমন কি তিনি আজ গ্যাৎচোরেৎশালাও বললেন না। কেবল মাঠ, নদী এবং কাশফুল দেখতে দেখতে ফিরে ফিরে অমলাকে দেখলেন। অমলা উল্টে ওর মায়ের চেহারা পেয়েছে। মণীন্দ্রনাথ অমলার দিকে তাকিয়ে শিশুর মতো অভিমান করে বসে আছেন যেন।

    আশ্বিনের সূর্য নদীর ওপারে নেমে যাচ্ছে। গাড়িটা এগুচ্ছে! ঘোড়ার পায়ের শব্দ। ঠক ঠক। বেশ তালে তালে, ঘোড়াদুটো যাচ্ছে, সোনা যেন কোথায় কবে একবার এমন দুটো সাদা ঘোড়াকে গাড়ি টেনে নিতে দেখেছে। খুব বরফ পড়েছে, গাছে গাছে পাতা ঝরে গেছে, চারদিকে বরফের পাহাড়। মাঝে সিঁথির মতো পথ। কে যেন এমন করে তাকে কোথাকার রাজা-রানীর গল্প করেছিল। সোনা এবং মণীন্দ্রনাথ একদিকে, অমলা কমলা একদিকে। নানারকমের পাখি নদী পার হয়ে যাচ্ছে। ওপারের মানুষ প্রায় দেখা যাচ্ছে না বললেই হয়। জল নদীর নিচে নেমে যাচ্ছে ক্রমে। লাল ইঁটের বাড়ি ওপারে প্রায় ছবির মতো মনে হচ্ছিল সোনার। সে কতরকমের কথা বলতে চাইছে। তার মনে হল, সেই আলো জ্বালার মানুষটা, আর কিছুক্ষণ পরই, যেই না সূর্য অস্ত যাবে, মানুষটা লম্বা পোশাক পরে আলো জ্বালবে। মানুষটাকে সোনার বড় ভালো লাগে, মেজ জ্যাঠামশাইকে মানুষটা যমের মতো ভয় পায়। কেবল দেখা হলেই আদাব দেয়। ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর পিঠের ছেঁড়া জামার ভিতর থেকে শীর্ণ শরীরটা কত রুগ্‌ণ ধরা যায়। মানুষটা সন্ধ্যা হলেই সেই কলটা চালিয়ে দেয়। ভটভট শব্দ হতে আরম্ভ করলেই ম্যাজিকের মতো সারা বাড়িতে লাল নীল আলো জ্বলতে থাকে।

    লোকটা সোনাকে বলেছে, সে আজ আলো জ্বালার সময় সেই ম্যাজিক কলটা তাকে দেখাবে! ওর নাম ইব্রাহিম। সোনাকে সকালে উঠেই একবার আদাব দিয়েছে। সোনা দেখেছে বাড়ির নিয়মকানুন আলাদা। সকাল হলেই ফরাসের যত চাকর তারা সোনাকে আদাব দিয়েছে। তোষাখানার চাকরেরা আদাব দিয়েছে। এ বড় আশ্চর্য সংসার। জ্যাঠামশাইকে দেখে মানুষগুলি দূর থেকে আদাব দিতে দিতে চলে যাচ্ছে। ইব্রাহিম নুয়ে গেছে কতকটা। আদাবের সময় আর তাকে নুইতে হয় না। যাত্রা গানে সোনা একবার আওরঙজেবের পালা দেখেছিল। সোনার কাছে প্রায় সেই বাদশার শামিল। সাদা দাড়ি নাভি পর্যন্ত নেমে গেছে। লোকটার হাতে এত বড় বাড়ি, এবং তার অন্ধকার, লোকটাকেও সোনার মনে হয় মহাভারতের দেশের মানুষ! অমিত তেজ এই মানুষের। হাতে তার জাদুর কাঠি, যন্ত্রে ছোঁয়ালেই ফুসমন্তরে কথা বলে ওঠে। আলো জ্বলে ওঠে। ও মাঝে মাঝে চিৎকার করে। বলে দিলাম ফুস মন্তর কথা কবে যন্তর।

    সে গাড়িতে বসে দেখল বেলা পড়ে আসছে। ফিরতে দেরি হলে ইব্রাহিম তার জন্য অপেক্ষা না করে যদি সেই জাদুর ঘরে গিয়ে বসে থাকে। সোনা কমলকে দ্রুত গাড়ি চালাবার কথা বলল।

    কমল বলল, গাড়ি তো চলছেই।

    —আমরা ফিরে যাব কমল। সোনা যতটা পারছে কমলের মতো কথা বলতে চাইছে। খুব বেশি কঠিন না বলা। একটু বইয়ের ভাষায় কথা বলতে হয় এই যা। তবু উচ্চারণ ঠিক থাকে না বলে, অমলা কমলা ঠোঁট টিপে হাসে। সে ভাবল এবার থেকে বড় জেঠিমার কথাগুলি মনে রাখার চেষ্টা করবে। সোনা বলতে পারত, ফিরে না গেলে আলো জ্বলবে না। কারণ ইব্রাহিম বলেছে আমি গেলেই সে আলো জ্বালাবে।

    কমল বলল, তোকে আমরা ছাদে নিয়ে যাব। সেখান থেকে ভালো দেখতে পাবি।

    অমলা বলল, আমরা ছাদে আজকে লুকোচুরি খেলব। তুই আসবি সোনা?

    অমলা সোনাকে দেখছিল। অমলা সোনার চোখ মুখ দেখে, কি সুন্দর চোখ, এবং কি মিষ্টি করে কথা বলে, আর এই বালক যেন সেই মায়ের মুখে বাইবেল বর্ণিত বালক, সাদা পোশাকে সোনাকে প্ৰায় মাঝে মাঝে তেমনই দেখাচ্ছে। সোনা এতটুকু আনন্দ পেলেই উৎসাহে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে ঘোড়ার ছুটে যাওয়া দেখছে। ওরা গাড়ি থামিয়ে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। এদিকটা গঞ্জের মতো জায়গা। সারি সারি লোক যাচ্ছে। অমলা কমলাকে দেখে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে যাচ্ছে।

    তারপরে ক্রমে গাড়িটা এসে এক মাঠে পড়ল। মণীন্দ্রনাথ চুপচাপ বসে এতক্ষণ নদীর দু’তীর দেখছিলেন, এখন মাঠ দেখছেন। আর ফিরে ফিরে অমলাকে দেখছেন। যেন তার পলিন, শৈশবের পলিন—কি যে চেহারা তার! ধীর স্থির মণীন্দ্রনাথ অমলাকে আদর করার জন্যে মাথায় হাত রাখলে অমলা ভয় পেতে থাকল। সোনা বলল, ভয় নাই অমলা। আমার জ্যাঠামশয় কাউকে কিছু বলে না। অনিষ্ট করে না। আর আশ্চর্য, এমন বলতেই মানুষটা ঠিকঠাক হয়ে বসলেন। ওরা সবাই যেন তীর্থযাত্রায় বের হয়েছে এমন মুখ মণীন্দ্রনাথের। অমলা গল্প করতে থাকল কবে সেই শিশু বয়সে ল্যান্ডোতে তারা এই মাঠে এসে পড়তেই ভীষণ কুয়াশা নেমে এসেছিল। ইব্রাহিম তখন ল্যাণ্ডো চালাত। দুই ঘোড়াকে ঘাস খাওয়ার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে অমলা কমলা ছুটাছুটি করছিল মাঠে! কিন্তু সহসা কুয়াশা নামলে ইব্রহিম ঘোড়া দুটোকে খুঁজে পেল না। শীতের দিন ছিল। ইব্রাহিম দুই কাঁধে দুই মেয়ে নিয়ে ফেরার সময় দেখেছিল, এক বৃদ্ধ রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। বৃদ্ধের হাতে লাঠি। মেজবাবুর ফ্রুট শুনবে বলে দেশ থেকে বের হয়েছে। অমলার বাবা সুন্দর ক্ল্যারিওনেট বাজান। তিনি দেশে এসেছেন, তিনি রাতে ফ্রুট বাজাবেন। কিন্তু কুয়াশায় সেই মানুষ রাস্তা হারিয়ে ফেললে ইব্রাহিম হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল। আর আশ্চর্য, সেই মানুষ এক বড় ক্লারিওনেট বাজিয়ে। সে তার চেয়ে বড় ওস্তাদ মেজবাবু জেনে এখানে চলে এসেছিল। কিন্তু পরে জানা যায়, মেজবাবু তার নিচের ঘরে সেই মানুষকে আটকে রেখেছিলেন। এবং ওস্তাদ স্বীকার করে সব সুর তান লয়—যা কিছু ফুটের রহস্য জেনে নিয়েছিলেন। সেই ওস্তাদ মানুষ এত ভাল ফ্রুট বাজায় যে, সে বাজাতে আরম্ভ করলে অকালে কাশের বনে ফুল ফুটতে থাকে, পাখি উড়তে থাকে মাথার উপর। মানুষটা সব কিছু উজাড় করে দিল মেজবাবুকে। নিজের বলতে কিছু আর রাখল না। এসেছিল কিছু নিতে, কিন্তু এসে দেখল, বড় কাঁচা হাত মেজবাবুর। এত বড় বাড়ির সম্মানিত ব্যক্তি তার কাছে হেরে যাবে, ভাবতেই সে কষ্ট পেয়েছিল বড়। নিচের ঘরে সারা রাত দিন তখন মেজবাবু মানুষটার কাছে পড়ে থাকতেন। তালিম নিতেন। নাওয়া-খাওয়ার সময় ছিল না। আর কি বিস্ময়ের ব্যাপার, সেই মানুষ সব দিয়ে থুয়ে নদীর জলে নেমে গিয়েছিল। মানুষটার আর কোনও সম্বল ছিল না। সে দুঃখী মানুষ ছিল, সে হাটে বাজারে গঞ্জে ফ্রুট বাজাত, বড়বাবুর মেজছেলে তাও নিয়ে নিল। তার আর অহঙ্কারের কিছু ছিল না। যেন সে তার স্বর হারিয়ে ফেলেছে, সুর হারিয়ে ফেলেছে। সে একা একা নদীর পাড় ধরে চলে যেতে চাইলে মেজবাবু বললেন, বুড়ো বয়সে আর কোথায় যাবে? থেকে যাও। কে আর তোমার ফ্রুট শুনবে! তুমি তো বলেছ, যা তুমি আমায় দিয়েছ, হাটে বাজারে আর তুমি তা বাজাবে না। তুমি পয়সা পাবে কোথায় তবে? খাবে কি?

    খালেক মিঞা প্রথম জবাব দিতে পারেনি। পরে বলেছে, যে আজ্ঞে হুজুর। হুজুরের ল্যাণ্ডোতে সে সেই যে এসে বসল আর নড়ল না। চোখে দেখে না ভালো, তবে গাড়িতে চড়ে বসলে খালেক মিঞা একাই একশ। খালেক এখন বাতাসের আগে ল্যাণ্ডো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

    নদীর ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। কাশফুলের মাথায় ক্রমে জ্যোৎস্না উঠবে এবার। নদীতে যেসব নৌকা আছে তার লণ্ঠন এবার এক দুই করে জ্বলবে। নদীর পাড়ে এসেই ল্যাণ্ডোটা বাঁক নিল। সূর্যাস্ত হচ্ছে বলে এখন একটা লাল রঙের আভা নদীর দু’পাড়ে গ্রামে মাঠে। ল্যাণ্ডোর মানুষগুলোর মুখে পর্যন্ত সেই লাল রঙ। সূর্যাস্ত হলেই অন্ধকার, তারপর মাথার উপর নীল আকাশ। শরতের আকাশে জ্যোৎস্না উঠলে বুঝি ঝাউগাছটার নিচে ল্যাণ্ডোটা এসে দাঁড়াবে। পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ তখন ল্যাণ্ডো থেকে নেমে যাবেন।

    ঝাউগাছটার নিচে পৌঁছাতে ওদের অন্ধকার হয়ে গেল। ঘোড়াগুলি এখন কদম দিচ্ছে। এখন আর দ্রুত ছুটছে না ঘোড়া। কারণ ওরা প্রাসাদের কাছে কালীবাড়ির মাঠটায় এসে গেছে।

    মণীন্দ্রনাথ নেমে গেলে অমলা বলল, তোর মনে থাকবে তো সোনা।

    সোনা ঘাড় কাত করে মনে থাকবে এমন সম্মতি জানাল। ছাদের ওপর যখন জ্যোৎস্না উঠবে, সে কমলা অমলার সঙ্গে লুকোচুরি খেলবে। ঢাকের বাদ্য বাজবে, ঢোলের বাদ্য বাজবে, আর ওরা লুকোচুরি খেলবে, ছাদে অথবা রান্নাবাড়ি পার হলে অন্দরের যেসব দাসী বাঁদীদের ঘর আছে তার আশেপাশে। কিন্তু কালীবাড়ির মাঠে আসতেই সোনার কি মনে পড়ে গেল। সে বলল, আমি নামব অমলা।

    এখানে নামবি কেন? অমলাকে অধীর দেখাল।

    সোনা বলতে পারত, সেই যে জাদুর মেশিনটা আছে যা ঘোরালে তারে তারে বিদ্যুৎ খেলে যায়, আলো জ্বলে ওঠে, ঘরে নীল লাল রঙের আলো জ্বালা হয়, এবং পূজার দিন বলে ছোট ছোট গাছে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে টুনি ফুলের মতো আলোর মালা খেলা করতে থাকে—তার এখন সেই জাদুর মেশিনটার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো চাই। ইব্রাহিম বলেছে সে সেই মেশিনটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, হাতে তার জাদুর কাঠি ছোঁয়ালেই শব্দ হয় নানারকমের—কি বিচিত্র শব্দ যেন, নদীর জলে বৈঠা পড়ছে অথবা কাঠে বাড়ি মারছে খটখট—না শব্দটা ঠিক এমন নয়, শব্দটা ভটভট এই এক ধরনের শব্দ, আর ইব্রাহিম বড় বড় চোখে তার লম্বা জোব্বার ভিতর থেকে কত রকমারি জাদুর কাঠি বের করে দেখাবে বলেছে। সোনা সেই আশায় লাফিয়ে নেমে পড়ল ল্যাণ্ডো থেকে।

    কোথায় ইব্রাহিম এখন! সে চারদিকে খুঁজতে থাকল। জাদুর মেশিনটা যে-ঘরে থাকে, সে সেখানে গেল হাঁটতে হাঁটতে। ল্যাণ্ডোটা এখন সদরে ঢুকে যাচ্ছে। কোথাও যেন সে ঘোড়ার ডাক শুনতে পেল। এবং কিছু বালক-বালিকা—ওরাও এসেছে দেখবে বলে, কারণ পুজার ক’টা দিন এই প্রাসাদ যেন গ্রামের ছেলে-বুড়োদের কাছে আশ্চর্য এক মায়াপুরী, এই পূজার ক’টা দিন প্রাসাদের দালান-কোঠা, নীল রঙের মাঠ, হ্রদের মতো বড় দীঘি এবং বিচিত্র বর্ণের ফুলের গাছ সব মিলে এক মায়াকানন। দূর থেকে মানুষেরা হেঁটে হেঁটে চলে আসে। সোনা যেতে যেতে সেইসব মানুষদের দেখতে পেল নদীর পাড়ে বসে আছে। অথচ ডানদিকে সেই গোল ঘরটা লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। আশ্চর্য ইব্রাহিমকে সে দেখতে পাচ্ছে না। ইব্রাহিম বলেছে, তাকে আলো জ্বালানো দেখাবে। এই আলো জ্বালানো সোনার কাছে প্রায় এক অলৌকিক ঘটনার মতো। সে আর দেরি করতে পারল না। সে ছুটে গিয়ে জালে মুখ রাখতেই দেখল, ইব্রাহিম যন্ত্রটার ওপর ঝুঁকে কি করছে!

    সে ডাকল, ইব্রাহিম।

    ইব্রাহিম কোনও উত্তর করল না। সূর্য অস্ত গেছে বলে এবং সন্ধ্যা নামছে বলে ঘরের ভিতরটা সামান্য অন্ধকার। ইব্রাহিমের মুখ অস্পষ্ট। ওর মুখে ঘাম। সে যেন যন্ত্রটাকে বশ মানাতে পারছে না। গোয়ার্তুমি করছে সেই জাদুর মেশিনটা। যত গোয়ার্তুমি করছে তত সে টেনে টেনে কি সব খুলে ফেলছে, চারপাশে ঘুরে ঘুরে টেনে টেনে কি পরীক্ষা করছে, আর সে পাগলের মতো চোখ মুখ করে রেখেছে অথবা উদ্‌বিগ্ন চোখমুখ, এত যে বালক-বালিকা চারপাশে, সবাই ওর কৌশল দেখতে এসেছে, ইব্রাহিম মিস্ত্রী, নামডাক এত যে এই মানুষ প্রায় মরা হাতি লাখ টাকার মতো, সেই মানুষ এখন বিনা নোটিশে এমন ঘাবড়ে গেছে যে সোনা পর্যন্ত আর ডাকতে পারল না, ইব্রাহিম, তুমি আমায় আসতে বলেছিলে। কি করে এমন একটা জগৎটাকে নিমেষে জাদুর দেশের শামিল করে দাও দেখাবে বলেছিলে, এখন তুমি কিছু করছ না। তোমাকে ডাকলে সাড়া দিচ্ছ না।

    সোনার এবার ভয় ভয় করতে থাকল। সে একা যাবে কি করে! ইব্রাহিম বলেছিল, আলো জ্বালা হলে, সে তাকে কাছারিবাড়ি পৌঁছে দেবে। এখন সেই ইব্রাহিম একেবারে মোল্লা মৌলবী হয়ে গেল। অথব ফকির দরবেশ। কোনও কথা বলছে না। সে যে বিড় বিড় করে কোরাণশরিফ পাঠ করছে। সোনা কিছুতেই বলতে পারল না, অ ইব্রাহিম, আমারে তুমি তবে আইতে কইছিলা ক্যান! এখন আমি যামু কি কইরা!

    যদি সেই হেমন্তের হাতিটা ফিরে আসত এখন। ওরা গেছে ল্যাণ্ডোতে আর বড়দা মেজদা গেছে বাবুদের সঙ্গে। হাতিতে চড়ে ওরা হাওয়া খেতে গেছে। হাতিটার গলায় ঘণ্টা বাজলেই সে টের পেত হাতিটা ফিরছে। না কোথাও কেউ ফিরছে না। শুধু অপরিচিত বালক-বালিকা এবং মানুষজন যাদের সে চেনে না, যারা প্রতিমা দেখতে আসে একমেটে, দু’মেটে হলে, তারাই আবার এই আলো জ্বালা দেখতে এসেছে। বাবুরা থাকেন শহরে। পূজায় এলে এই বাড়ির কলের একটা মেশিন ঘুরতে থাকে। তখন এই বাড়িঘর নিয়ে প্রাসাদের আলো নিয়ে এবং রকমারি সব পাথরের মূর্তি নিয়ে এই গ্রামটা শীতলক্ষ্যার জলে শহর বনে যায়। সোনাও এসেছে এই শহরে। সে যা কিছু দেখছে তাতেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে।

    অন্ধকারটা ক্রমে ভারী হচ্ছে। গাছপালা ঘন বলে আকাশে যে সামান্য জ্যোৎস্না, তা এই ঘরে অথবা ঘাসের বুকে গাছের ডালপালা এবং পাতা ভেদ করে নামতে পারছে না। সবাই বলছে, কি হইল ইব্রাহিম, তোমার পাগলি কথা কয় না ক্যান!

    —কইব কইব। না কইয়া যাইব কই!

    সোনা বলল, ইব্রাহিম, তুমি আইতে কইছিলা।

    ইব্রাহিম যেন এতক্ষণে টের পেয়েছে সোনাবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। সে বলল, কর্তা, পাগলির যে কি হইল!

    —কি হইছে?

    —কথা কইছে না।

    আর তখনই সোনা দেখল, মেজ জ্যাঠামশাই এদিকে ছুটে আসছেন। সঙ্গে অন্দরের চাকর নকুল। চোখে মুখে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার ছাপ। এখানে যে সোনা একা এবং অপরিচিত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তিনি তা পর্যন্ত লক্ষ করছেন না। তিনি নিজে এবার ভিতরে ঢুকে টর্চ মেরে কি দেখলেন। ইব্রাহিমকে সরে যেতে বললেন, তারপর কি দেখে বললেন, এটা এখানে কেন!

    সোনার মনে হল ডাক দেয়, আমি জ্যাঠামশয় এখানে!

    কিন্তু সোনা মেজ জ্যাঠামশাইকে মস্ত বড় মানুষ ভাবতেই সে ডাকতে সাহস পেল না। যেমন তিনি এসেছিলেন, তেমনি চলে গেলেন। সোনা বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকল। এখন আর অন্ধকার নেই। এত বড় আকাশ মাথার উপর আর ছোট্ট এক ফালি চাঁদ এবং হাজার নক্ষত্রকে ব্যঙ্গ করছে এই মায়াকানন, প্রাসাদ। চারপাশে আলোর মালা। চারপাশে বড় বড় ম্যাগনোলিয়া ফুলের গাছ, তার বিচিত্র বর্ণের পাতা এবং ছোট ছোট কীট-পতঙ্গের শব্দে সোনাকে কেমন মুহ্যমান করে দিল। সে একা একা হেঁটে যাচ্ছে। তার ভয়ডর কিছু থাকল না। এত আলো চারপাশে, এত গাছগাছালির ভিতর অজস্র আলো, দূরে কারা এখন ছুটোছুটি করছে এবং পূজার বাজনা বাজছে নিয়ত—সোানার ভয়ড়র একেবারে উবে গেল। ওর মনে একটা অতীব স্বপ্নের দেশ, দেশটার নাম কেবল সে এক মেয়ের মুখের সঙ্গে তুলনা করে মিল খুঁজে পায়—সে মেয়ে অমলা। তার অমলা পিসি। অমলা তাকে আজ ছাদে যেতে বলেছে। তুই সোনা ছাদে আসবি, আসবি কিন্তু। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব। সোনা ল্যাণ্ডোর সেই সুন্দর মুখ মনে করতে পারল. এবং কলকাতার মেয়ে অমলা। কলকাতা খুব বড় শহর, ট্রামগাড়ি, হাওড়ার পুল কি সব অত্যাশ্চর্য সামগ্রী নিয়ে বসবাস করছে কলকাতা। অমলা সেখানে থাকে, সেখানে বড় হয়েছে। আশ্চর্য রকমের নীল চোখ! এবং আলোর মতো মুখে নিয়ত কথার ফুলঝুরি-সোনা এই আলোর রাজ্যে হাঁটতে হাঁটতে কেমন সরল এক মায়ার টানে ছুটতে থাকল।

    সোনা দীঘির পাড়ে পাড়ে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে সোনা কাছারিবাড়ি ঢুকে গেল। কত লোকজন কত আমলা কামলা চারপাশে। সে সব ফেলে ছুটছে। এত জোরে ছুটতে দেখলে জ্যাঠামশাই বকবে, সে চারদিকে একবার দেখে নিল। না, মেজ জ্যাঠামশাই কাছে কোথাও নেই। পূজামণ্ডপে নানা রকমের প্রদীপ, জ্বালানো হচ্ছে। দেবীর মূর্তিতে গর্জন লাগানো হয়েছে। এবং ঝিলমিল রঙের সব গর্জন এখন চাকচিক্যময় হয়ে গেছে। সোনা এই প্রতিমার সামনে ধরা পড়ে যাবে, তুমি এক আশ্চর্য মায়ার টানে ছুটে যাচ্ছ সোনা–আমি সব টের পাচ্ছি। সোনা সেজন্য মণ্ডপে দেবীর মুখের দিকে তাকাল না পর্যন্ত। কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে ডানদিকের বারান্দায় উঠতে সোনা দেখল একটা ইজিচেয়ারে বড় জ্যাঠামশাই শুয়ে আছেন। মুখ বুজে পড়ে আছেন। গায়ে একটা সিল্কের পাঞ্জাবি, পায়ে দামী জুতো, পূজোর সময়ে এই পোশাক মেজ জ্যাঠামশাইর—যা কিছু ভাল পোশাক পাগল জ্যাঠামশাইকে পরতে দিয়েছেন, অথবা নিজে হাতে পরিয়ে দিয়ে এখানে বসিয়ে রেখেছেন। পায়ের নিচে রামসুন্দর, একটু দূরে বসে তামাক কাটছে। রাশি রাশি তামাক কাটা হচ্ছে। রাশি রাশি রাব ঢেলে এক সুগন্ধ তামাকের সৃষ্টি এবং পাশে পাগল জ্যাঠামশাই—সোনা আজ এখানে এসেও মুহূর্ত দেরি করল না। তার হাতে সময় নেই। ওর দেরি হয়ে গেছে। সেই কখন থেকে ছাদের ওপর অমলা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। অমলা, অমলা-পিসি। কলকাতার অমলা। কত বড় শহর কলকাতা। মেমরিয়েল হল, রূপালী রঙের বেড়া এবং দু’পাশে সব সুরম্য অট্টালিকা। সুদূর সেই কলকাতার মতো অমলার শরীরে এক দূরের রহস্য নিমজ্জিত। সোনার বয়স আর কত! তবু এই টান সোনাকে কেমন পাগলের মতো ছুটিয়ে মারছে। সে পাগল জ্যাঠামশাইর কাছ থেকে পালাবার জন্য ডানদিকের বারান্দায় উঠে এল না। সে বড় থামের পাশে নিজেকে প্রথম লুকিয়ে ফেলল। তারপর আবার ছুটে সিঁড়ি ভাঙতে থাকল।

    সিঁড়ি ভাঙার সময়ই সে ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেল। দীঘির ওপারে মঠ। মঠে কেউ এখন বড় ঘণ্টায় শেকল টেনে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। সকালে সোনা ভেবেছিল সন্ধ্যায় জ্যোৎস্না উঠলে সে এবং পাগল জ্যাঠামশাই সেই মঠে চলে যাবে। সে পাগল জ্যাঠামশাইকে সিঁড়িতে বসিয়ে রাখবে। যেখানে পাথরের বৃষ রয়েছে তার ডান দিকে সে দাঁড়াবে। শ্বেত পাথরের বাঁধানো মেঝে। মেঝের উপর দাঁড়ালে সে শেকলটা হাতে নাগাল পায়। সে এক দুই করে ঘণ্টা বাজাবে আর জ্যাঠামশাই সেই ঘণ্টাধ্বনি এক-দুই করে গুনবেন। নিচে এসে বলবে—কত বার? জ্যাঠামশাই বলবেন, দশ বার। একমাত্র সে-ই যেন এভাবে ক্রমে মানুষটাকে নানা কাজের ভিতর অথবা জ্যাঠামশাই যা ভালোবাসেন, তার ভিতর নিয়ে যেতে যেতে এক সময় নিরাময় করে তুলবে। কিন্তু এই ঘণ্টাধ্বনি শুনে সোনা কেমন থমকে গেল। যেন পাগল জ্যাঠামশাই বলছেন, সোনা যাবি না, মঠের সিঁড়িতে ঘণ্টা বাজাবি না? আমি এক দুই করে গুনব। গুনতে গুনতে একশ ঠিক ক্রমান্বয়ে বলে যাব। সব ঠিক-ঠিক ক্রমান্বয়ে বলে গেলে দেখবি সোনা আমি একদিন ভাল হয়ে যাব।

    সিঁড়িতেই সে থমকে দাঁড়াল। সে ওপরে যাবে, না নিচে নেমে পাগল জ্যাঠ্যামশাইকে নিয়ে মঠের সিঁড়িতে গিয়ে বসে থাকবে। এমন একটা দোমনা ভাব ভিতরে তার কাজ করছে। বরং ওর এখন ঐ মঠেই চলে যেতে বেশি ইচ্ছে। সে এত উঁচু মঠ কোথাও দেখেনি। হাজার হবে টিয়াপাখি, নীল রঙের। পাখিরা সব মঠের ভিতর বাসা বানিয়ে নিয়েছে। জ্যোৎস্না রাত হলে পাখিরা চক্রাকারে মঠের চারপাশে ওড়ে। মঠটার কথা মনে হলেই এমন সব পাখিদের কথা মনে হয়। পাখিদের কথা মনে হলেই ওর গুলতিটার কথা মনে হয়। মেলা থেকে রঞ্জিতমামা তাকে একটা গুলতি কিনে দিয়েছিল। সে সেই গুলতি দিয়ে কাক, শালিক, টিয়াপাখি এবং কাঠবিড়ালি যা পেত সামনে, মারার চেষ্টা করত। কিন্তু সে এদের সঙ্গে পারত না। জামরুল গাছটার নিচে ছোট খোঁদল, খোঁদলে সেই কাঠবিড়ালি, সকাল হলেই গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ত। সোনা পড়া ফেলে ছুটত জীবটার পিছনে। ছোট্ট জীব এ-গাছ থেকে ও-গাছে লাফিয়ে পড়ত। সোনালী রোদে সে কটকট করে ডাকত। সোনা গুলতি মারলে বিড়ালটা হাতজোড় করে রাখত। কিন্তু সোনা কর্ণপাত না করলে তখন খেলা আরম্ভ হয়ে যেত। সোনার মনে হতো এই সে এক জীব, ছোট্ট জীব! জীবের কি বড়াই। একেবারে ভয় পায় না। গাছের পাতায় পাতায় যেন উড়ে বেড়ায়। শুধু এই জীব কেন, যা-কিছু সুন্দর এবং সজীব, এই যেমন রোদ, মাটি, শরতের বৃষ্টি, সব কিছুরই পিছনে তাড়া করতে সে ভালোবাসে। অমলা তার কাছে খুব এক দূরের রহস্য বয়ে এনেছে। সে সেজন্য নড়তে পারছে না। কার কাছে যাবে? পাগল জ্যাঠামশাই, বড় মঠ এবং জ্যোৎস্না রাতের মাঠ না অমলা, কমলা। সে অন্ধকারে কিছু স্থির না করতে পেরে সিঁড়ির মুখে যেমন চপচাপ দাঁড়িয়েছিল তেমনি দাঁড়িয়ে থাকল।

    একজন পাইক বরকন্দাজের মতো মানুষ ওর পাশ কাটিয়ে গেল। ওকে দেখতে পায়নি। দেখতে পেলেই বলত, কে? অন্ধকারে কে জাগে! তাকে তাড়া করত। আর অন্ধকার থেকে আলোয় এলেই, আরে, এ যে সোনাবাবু! আপনে এখানে কি করতাছেন? আশ্চর্য, সোনা এইসব মানুষদের দেখে–কি লম্বা আর উঁচু। সব সময় করজোড়ে থাকে। ওকে দেখলে পর্যন্ত করজোড়ে কথা বলে। ওর ইচ্ছা হল সিপাইটাকে একটু ভয় পাইয়ে দেয়। এবং সে মুখ বাড়াতেই দেখল সামনে অমলা কমলা এবং অন্য সব ছোট ছোট মেয়ে অথবা ছেলে। দাসীবাদীদের ঘর পার হয়ে সব কোথায় যাবে বলে হৈ-হৈ করে নেবে যাচ্ছে।

    সে এবারেও নড়ল না।

    কমলার মনে হল কেউ যেন থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, কে রে তুই?

    সোনা আলোতে এসে বলল, আমি।

    –তোকে খুঁজতে যাচ্ছি। সেই কখন থেকে আমরা তোর জন্য বসে আছি।

    ওরা ফের উপরে উঠে যাবে মনে হল। কিন্তু দোতলার সিঁড়িতে উঠেই ওরা ছাদে গেল না। ওরা একটা ফাঁকা মতো জায়গায় চলে গেল। এখান থেকে রান্নাবাড়ির কোলাহল পাওয়া যায়। মাছ ভাজার গন্ধ আসছে। ওরা একটা ঝুলন্ত বারান্দায় এসে গেল। এখন ওরা যে যার দলে দলে ভাগ হয়ে যাবে। তারপর ছড়িয়ে পড়বে রান্নাবাড়ির চারপাশে।

    সুতরাং ওরা অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ল। অথবা বলা যায় লুকিয়ে পড়ল। অমলা সোনাকে নিজের দলে রেখেছে। সে ভেবেছিল সোনাকে নিয়ে কোথাও সে লুকিয়ে পড়বে। কিন্তু সোনা যে কোথায় সহসা অদৃশ্য হয়ে গেল। সে একটা চিলেকোঠায় উঠে গেল। এখানে তাকে কেউ খুঁজে পাবে না।

    আর সোনার এখন যেন এ-বাড়ির সব চেনা হয়ে গেছে। কোনদিকে তোষাখানা, কোনদিকে বালাখানা, কোথায় ঠাকুরবাড়ি, কোথায় সেই বৌরানীর মহল, এবং মহলের পর মহল পার হতে কত সময় লেগে যায় সে সব জানে! ওরা আর বেশিদূর যাবে না, গেলে সে বাদ যাবে।

    সোনা কিন্তু কিছুদূর এসেই কেমন ভয় পেয়ে গেল। এদিকটা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা। ভাঙা পাঁচিল নিচে। পাঁচিলের ওপাশে সেই বড় বনটা। সোনা বেশি দূরে যাবে না। বড় বড় দুটো আলোর ডুম জ্বলছে বলে এবং দাসী বাঁদীদের কি নিয়ে বচসা হচ্ছে বলে ভয়টা তেমন জোরালো হচ্ছে না। তবু সে এমন একটা জায়গা চাইছে, যেখানে সে পালালে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। সে তেমন একটা জায়গা না পেয়ে কেমন হতাশায় ডুবে যাচ্ছিল আর তখন দেখল অমলা ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেন অমলা এতক্ষণ ওকেই খুঁজছে।

    অমলা বলল, আমার সঙ্গে আয় সোনা।

    অমলা সোনাকে সাহায্য করতে পারবে। সে অমলার পিছু পিছু নুয়ে নুয়ে হাঁটতে থাকল। মাথা তুলে দাঁড়ালেই ওপাশের রেলিং থেকে ওদের দেখতে পাবে।

    সোনা এবং অমলা এই করে উত্তরের বাড়ি পর্যন্ত চলে এল। বড় বড় দরজা পার হয়ে যে যার মতো লুকিয়ে পড়ছে। অমলা ফিফিস্ করে এদিকে আয়, এদিকে আয় করছে। একটা অন্ধকার মতো লম্বা বারান্দায় ওরা এসে পড়ল। এখান থেকে অতিথিশালার দিকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। সিঁড়িটা ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে গেছে। কাঠের সিঁড়ি। সোনা এবং অমলা ঘুরে ঘুরে নামছে। ওরা নামতে নামতে যেন একটা নির্জন জায়গায় চলে এল। নীল রঙের অল্প আলো। সোঁদা সোঁদা পাঁচিলের গন্ধ। সামনে একটা পরিত্যক্ত ঘর। হাট করে একটা পাট খোলা। কিছু ইঁদুর-এর শব্দ। উপরে একটা গাছ। কী গাছ এই আলোতে চেনা যায় না। দুটো-একটা বাদুড়ের মতো জীব ওদের শব্দ পেয়ে উড়ে গেল। ওরা দরজা অতিক্রম করে পাঁচিলটার পাশে একটা কিছু ধ্বংসস্তূপের মতো দেখতে পেল। এককালে বোধহয় এখানে একটা কুয়ো ছিল। কুয়োটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখানে এসেই অমলা বলল, চুপ করে দাঁড়া। এখানে আমাদের খুঁজতে কেউ সাহস পাবে না। আমরা রান্নাবাড়ির পেছনটাতে চলে এসেছি।

    সোনা ভয়ে জবাব দিল না।

    —কি রে, একেবারে চুপ করে আছিস কেন? কথা বল।

    —আমার বড় ভয় লাগছে।

    ভয় কি রে! এখানে আমি বৃন্দাবনীর সঙ্গে রোজ আসি। সকালে ফুল তুলতে আসি। তারপরই ওদের মনে হল কেউ যেন কাঠের সিঁড়িটা ধরে নিচে নেমে আসছে। অমলা কোনও কথা আর বলল না। সে একেবারে চুপ হয়ে গেল। সোনা একেবারে অমলার পাশাপাশি সংলগ্ন হয়ে আছে। যেন সে এখন বলির পাঁঠা। অমলা যা-যা বলবে সোনা তাই তাই করবে। সোনাকে অমলা দুটো সন্দেশ দিল খেতে। তারপর যখন দেখল সিঁড়ি থেকে শব্দটা আর উঠে আসছে না, কেউ বোধহয় সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাবাড়ির দিকে চলে গেছে, তখন অমলা বলল, তুই কমলার সঙ্গে ভাব করবি না, কেমন?

    আবার শব্দ হচ্ছে কাঠের সিঁড়িতে। বোধহয় কমলা তার দলবল নিয়ে ওদের খুঁজতে আসছে। মলিনা, আলো, মধু কিংবা আরও কেউ কেউ হবে। যে-ই হোক, এদিকে আসতে ওরা সাহস পাবে না। মাথার উপর একটা লম্বা ডাল। পাঁচিলের ওপাশ থেকে ডালটা এপাশে ঢুকে গেছে। আর তারই নিচে সেই ভুতুড়ে ঘরটা। ঘরটার অন্ধকারে অমলা সোনাকে জড়িয়ে ধরেছে। বলছে, ভয় কি রে! এই দ্যাখ, দ্যাখ না সোনা। বলে অমলা সোনার হাত নিয়ে কেমন খেলা করতে থাকল।

    সোনা আবার বলল, এখানে না অমলা। আমার এসব ভালো লাগে না। সোনা বার বার অমলার মতো কথা বলতে চায়, ওর অমলার মতো কথা বলতে ভালো লাগে।

    তখন কমলার দলবলটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। সোনা বলল, কমলা আমাকে বাইস্কোপের বাক্‌স দেবে বলেছে।

    অমলা বলল, আমি তোকে রোজ একটা স্থলপদ্ম এনে দেব। বৃন্দাবনী বাবার জন্যে গোলাপের তোড়া বানাবে। তোকে আমি ফুলের তোড়া দেব। বলে আর সোনাকে কথা বলতে দিল না। ওর চুলে অমলা হাত দিয়ে আদর করতে থাকল। মাথাটা এনে নাকের কাছে রাখল। একেবারে রেশমের মতো নরম চুল। সোনা কেমন ভীতু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। কলকাতার মেয়ে অমলা কত কিছু জানে! এই বয়সে সোনা আর কী করতে পারে! অমলা ওকে নিয়ে কী করতে চায়! তুই কী সুন্দর সোনা! তোর চোখ কি বড়! তোকে আমি কলকাতা নিয়ে যাব। কত বড় শহর দেখবি। কত বড় চিড়িয়াখানা জাদুঘর।

    সোনা বলল, বইয়ে আছে জাদুঘরে বড় একটা তিমি মাছের কঙ্কাল আছে।

    —তুই গেলে দেখতে পাবি, কত বড় কঙ্কাল

    সোনা বলল, আমার ভয় লাগে।

    অমলা বলল, একটু নিচে। তুই কীরে! ভয় পাস কেন এত।

    সোনা বলল, ঈশম একটা বড় মাছ ধরছিল।

    অমলা যেন আর পারছে না। সোনার কাছে কী চাইছে। সোনার হাতটা কোন অতলে যেন নিয়ে যাচ্ছে। সোনার যেন কিছু জ্ঞানগম্যি নেই। যেন সে কিছু জানে না। অমলা কেমন বিড়বিড় করে বকছে,

    সোনা কত বড় মাছ রে?

    —খুব বড়।

    —দে, তবে হাত দে।

    সোনা বলল, না।

    —তবে তোকে চুমু খাই

    —না।

    —কেন কি হবে?

    —গালে থুতু লাগবে।

    —মুছে ফেলবি। তুই কি বোকা রে।

    আবার সেই কথা সোনার মুখে। ওর ভয়, এটা যে কী, কোন ওষধিতে গড়া, একবার খেলে আর খেতে নেই, ধরা পড়ে গেলে ভয়, তাছাড়া এ বড় এক পাপ কাজ। সোনা নিজের কাছে নিজেই কেমন ছোট হয়ে যাচ্ছে। অথচ একটা ইচ্ছা-ইচ্ছা ভাব, রহস্য নিয়ে জেগে আছে কলকাতার মেয়ে, সে এক দূরের রহস্য, যা সে এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, কেবল নদীর জলে শাপলা ফুলের মতো ফুটে থাকার স্বভাব তার, সে যেন জলের উপর ভেসে আছে, লজ্জা ভয় সঙ্কোচ ওকে ক্রমে জলের উপর ভাসিয়ে রাখছে, ওর হাত নিয়ে সেই অতলে ছেড়ে দিলেই সে জলের ভিতর ডুবে যাবে। পাপের ভিতর হারিয়ে যাবে।

    সে বলল, না অমলা। না, না।

    অমলা বলল, লক্ষ্মী সোনা। দে হাত দে। তুই আবার বাঙাল কথা বলিস কেন?

    সোনা কেমন গুটিয়ে আসছে। সে যেন পৃথিবীতে একটা বিশুদ্ধভাব নিয়ে বেঁচে ছিল এতদিন, অমলা তাকে সেখান থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ওর এখন ছুটে যেতে ইচ্ছা করছে। অথচ অমলার প্রীতিপূর্ণ চোখ, সোনালী চুল, চোখের নীল রঙ, আর শরীরে যেন উজ্জ্বল সোনালী বাতি জ্বলছে নিয়ত—এমন এক শরীর ছেড়ে ওর যেতে ইচ্ছা করছে না। সারাক্ষণ সে অমলার পাশে পাশে হাঁটতে ভালোবাসে, কিন্তু এখন অমলা যা ওকে করতে বলছে—তা, কেন জানি ওর কাছে একটা পাপ কাজ বলে মনে হচ্ছে।

    অমলা সোনাকে আর সময় দিল না। সোনার মুখটা টেনে টুক করে একটা চুমু খেল। তারপর বলল, ভালো লাগছে না?

    সোনা বুঝল কি বুঝল না টের পেল না। ভাঙা দরজাটা বাতাসে সরে গেছে। নীলচে আলোতে সোনার মুখ অস্পষ্ট। অমলা সেই মুখ দেখে বলল, কী রে, চুপ করে আছিস কেন? ভালো লাগছে না?

    ভালো লাগছে না বললে অমলা রাগ করবে। অমলা ওকে আর ভালোবাসবে না। সন্দেশ দেবে না, ফুল-ফল দেবে না। সে বলল না কিছু। ঘাড় কাৎ করে সুবোধ বালকের মতো সম্মতি জানাল।

    আর কথা নেই অমলার। যেন এবারে পাসপোর্ট মিলে গেছে। সে তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে করছে। সোনারও কেমন ভালো লেগে যাচ্ছে। সেই হাত নিয়ে খেলা, নতুন খেলা, জীবনের এক অদ্ভুত রহস্যময় খেলা, আরম্ভ হয়ে গেল।

    অমলা প্যান্টের দড়ি বাঁধার সময় বলল, কী রে তোর ভালো লাগেনি?

    সোনা ফিক করে হেসে দিল।

    —হাসলি যে?

    সোনা কিছু না বলে বাইরে এসে দাঁড়াল। কিছু না বুঝেই সোনা বোকার মতো হাসল। এবং বাইরে আসতে আবার সেই হাসি।

    —কি রে, তোর কি হয়েছে সোনা? এত হাসছিস কেন?

    সোনা জোরে জোরে হাসতে থাকল। এটা কী একটা হয়ে গেল। অমলা-পিসি তাকে এটা শেখাল। বেশ একটা খেলা, তার জীবনে এসে গেল। এখন আর অমলাকে নিয়ে ছাদের উপর অথবা একটা নীল রঙের মাঠে কেবল ছুটতে ইচ্ছা করছে। এখন আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না। কী সুন্দর লাগছে অমলাকে, অমলা নিত্যনতুন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। কিন্তু মায়ের মুখ মনে পড়তেই সে কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। তার মনে হল সে একটা পাপ কাজ করে ফেলেছে। তার আর কিছু ভালো লাগছে না। একা, নির্জন এই ভাঙা পাঁচিলে সে বড্ড একা একা। পাশের এই অমলাকে এখন আর সে যেন চিনতে পারছে না। সে তারপরই যথার্থই ছুটতে থাকল।

    অমলা বলল, সোনা ছুটে যাস না। পড়ে যাবি সিঁড়ি থেকে। অমলাও দু’লাফে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যেতে থাকল। সোনা এখন যেভাবে ছুটছে, পড়ে গেলে মরে যাবে! সে সোনার চেয়েও দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে সোনাকে সাপটে ধরল।—সোনা, এই সোনা, তোর কী হয়েছে? এভাবে ছুটছিস কেন? অন্ধকারে পড়ে গেলে মরে যাবি।

    সোনা অমলাকে দু’হাতে ঠেলে ফেলে দিল। অন্য সময় হলে অমলা কেঁদে ফেলত, কিন্তু এখন সোনার চোখ দেখে ভয়ে সে কিছু বলতে পারছে না। সে কাছে এসে বলল, তোকে একটা ভালো গল্পের বই দেব। আমার সঙ্গে আয়।

    সোনা চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। অমলা তাকে বার বার ডাকল—সে উত্তর করল না। ঢাকের বাদ্যি বাজছে মণ্ডপে। সে একটা বড় হলঘর পার হয়ে যাচ্ছে। কতরকমের ছবি ঘরটাতে। কতরকমের বাঘের অথবা হরিণের চামড়া। ঢাল তলোয়ার সাজানো এই হলঘরটাতে এলেই সোনা মনে মনে রাজপুত্র হয়ে যায়। অথচ মাথায় সোনার মুকুট, পায়ে নূপুর, কালো রঙের ঘোড়া এবং কোমরে রূপালী রঙের বেল্ট আর লম্বা তরবারি। এই হলঘরে এলেই সোনার এক রাক্ষসের দেশ থেকে বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধারের ইচ্ছা জাগে! আজ ওর সেই ইচ্ছাটা জাগছে না। হলঘর পর্যন্ত পিছু পিছু অমলা এসেছে। তারপর আর আসতে সাহস পায়নি। দরজার মুখে সে দাঁড়িয়ে সোনার চলে যাওয়া দেখছে।

    দরজা পার হতেই সে একবার পিছন ফিরে তাকাল। অমলা এখনও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক বন্দিনী রাজকন্যার মতো মুখ করে রেখেছে। রাজপুত্র সোনা। কিন্তু এখন সে কী করবে! কোথায় যাবে! ওর মনে হচ্ছিল সবাই ওর এই পাপ কাজের কথা জেনে ফেলেছে। পাগল জ্যাঠামশাইর পাশে বসলেই তিনি যেন সোনার শরীরের গন্ধ শুঁকে বলে দেবেন, তুমি সোনা বড় তরমুজের মাঠ দেখে ফেলেছ। রহস্য তোমার অন্তহীন। তুমি সোনা, আমার পাশে বসবে না। সোনার এখন কেবল কান্না পাচ্ছে।

    থামের আড়ালে এসে থামতেই সোনা দেখল, পাগল জ্যাঠামশাই ইজিচেয়ারে শুয়ে নেই। সব পরিচিত, অপরিচিত লোক গিজগিজ করছে মণ্ডপের সামনে। ওর সেখানে যেতে ইচ্ছা হল না। ওর কেবল কেন জানি মায়ের মুখ বার বার মনে পড়ছে। ঠিক পাগল জ্যাঠামশায়ের মতো মা-ও ওর হাতের গন্ধ শুঁকলেই টের পেয়ে যাবে। সে একটা পাপ কাজ করে ফেলেছে টের পেয়ে যাবে। এখন কি করলে যে সব পাপ তার ধুয়ে মুছে যাবে—সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। মা বলেছে, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সব বলে দিলে পাপ খণ্ডন হয়ে যায়। সে জলের কাছে তার যা-কিছু পাপ সব বলে দেবে এবং ক্ষমা চেয়ে নেবে।

    সে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে জল এবং জলের দেবতাকে বলবে, হে জলের দেবতা, আর তখনই সে দেখল কাছারিবাড়ি এসে গেছে। রামসুন্দর বসে রয়েছে একটা গোল টেবিলে। চারপাশে কাঠের চেয়ার। বাবুদের ছেলেরা গোল হয়ে বসেছে। রামসুন্দর সুন্দর গল্প বলতে পারে। একটু দূরে পাগল জ্যাঠামশাই বসে আছেন। মাথার উপর আকাশ, আর মৃদু জ্যোৎস্নার আলোতে সে ভাবল, কাল ভোরে সে পাগল জ্যাঠামশাইকে নিয়ে নদীর পাড়ে চলে যাবে। মা যেমন দুঃস্বপ্ন দেখলে সকাল সকাল সোনালী বালির নদীতে চলে যান, জলের কাছে দুঃস্বপ্নের হুবহু বলে দেন, বলে দিলেই সব দোষ খণ্ডন হয়ে যায়, তেমনি সে বলে দেবে। দিলেই তার যত দোষ খণ্ডন হয়ে যাবে।

    এমন মহাপাপ করে সোনার কিছুই ভালো লাগছিল না। এমন কি এখন যে রামসুন্দর গল্প বলছে তাও শোনার আগ্রহ নেই। সে কাছারিবাড়ির ভিতরে ঢুকে মেজ জ্যাঠামশাইর বিছানায় শুয়ে পড়ল এবং সারাদিনের ক্লান্তিতে তার ঘুম এসে গেল।

    সে ঘুমের ভিতর একটা কুঠিবাড়ির স্বপ্ন দেখল। সামনে বিস্তীর্ণ এক মাঠ। মাঠে কোনও শস্য ফলে না। নুড়ি বিছানো পথ, পাশে খোয়াই। খোয়াই ধরে জল নেমে আসছে। সাদা, নীল, হলুদ রঙের পাথর। জল নির্মল বলে পাথরগুলির রঙ জলের উপর নানা রঙ নিয়ে ভেসে থাকছে। আর কুঠিবাড়ির পিছনেই একটা পাহাড়। তার ছায়া সমস্ত কুঠিবাড়িটাকে শান্ত স্নিগ্ধ করে রেখেছে।

    সোনা সকালের রোদে বের হয়ে পড়েছে। সে কার হাত ধরে যেন নিয়ত ছুটছে। সে তার মুখ দেখতে পাচ্ছেন। পিছনের বেণী কেবল ঝুলতে দেখছে। লাল রিবন বাঁধা চুলে রূপালী রঙের ফ্রক গায়ে মেয়েটা তাকে নিয়ে সেই খোয়াইর দিকে ছুটে চলেছে।

    খোয়াইর পাড়ে এসে সোনা ভয় পেয়ে গেল। মনে হল তার, এমন গভীর জল এবং স্রোত পার হয়ে সে ও-পাড়ে উঠে যেতে পারবে না। মেয়েটা বলছে, কি রে, ভয় কি! আয়! আয় না, দেখ আমি, কেমন তোকে পার করে দিচ্ছি।

    আলগা হাতে সোনাকে যেন মেয়েটা খোয়াইর ওপারে নিয়ে যাবে বলে হাত বাড়াল। খোয়াইর জল পার হবার সময় পায়ের কাছে ছোট ছোট মাছ চারপাশে খেলা করে বেড়াচ্ছিল। ঠাণ্ডা জল। এমন জল এই সুন্দর সকালকে যেন মহিমময় করে রাখছে। সোনা আর কিছুতেই ওপাড়ে উঠে যেতে চাইছে না।

    —কি রে, খুব ভালো লেগে গেছে! আর উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না! সোনা মেয়েটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না। ওর দিকে কেবল পিছন ফিরে থাকছে। সোনাকে কেবল পিছন ফিরে কথা বলছে। সোনা বলল, খুব ভালো লাগছে।

    এত ভালো লাগছে যে সোনার কেবল জলের মাছ হয়ে যাবার ইচ্ছা হচ্ছে। আর কি অবাক, যেই না তার ইচ্ছা জলের মাছ হয়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গেই যে জলের মাছ হয়ে গেল। মেয়েটা হাসল ওর দিকে তাকিয়ে, কি রে, তুই জলের মাছ হয়ে গেলি? বলতে বলতে মেয়েটাও জলের নিচে টুপ করে ডুব দিল। আর কী আশ্চর্য! সে এবং মেয়েটা দু’জনই হলুদ এবং নীল রঙের চাঁদা মাছ হয়ে খোয়াইর হাঁটুজলে সাঁতার কাটতে থাকল। তারপর দু’জন এক ভয়ঙ্কর স্রোতের মুখে এসে আটকে গেল। উজানে উঠে যাবার জন্য নীল রঙের মাছটা লাফ দিতেই পাড়ে এসে পড়ল। এবার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সোনা শ্বাস ফেলতে পারছে না। সে পাড়ে লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছে। শ্বাসকষ্ট প্রায় মৃত্যুকষ্টের শামিল। সোনা ঘুমের ভিতর স্বপ্নে হাঁসফাস করছিল এবং এক সময় ঘুম ভেঙে গেল তার। সে ঘেমে গেছে! আর সে দেখল কে যেন তাকে পাঁজাকোলে রান্নাবাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। সে চোখ তুলে দেখল পাগল জ্যাঠামশাই নিয়ে যাচ্ছেন। এতক্ষণে মনে হল সোনার, সে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

    সে বলল, জ্যাঠামশয়, মাছ দ্যাখলে কি হয়?

    পাগল মানুষ বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা। এখন সোনা মুখ দেখে বুঝতে পেরেছে তিনি যেন বলতে চেয়েছেন, রাজা হয়। স্বপ্নে মাছ দেখলে রাজা হয়।

    পরদিন সকালে সোনা সূর্য উঠতে না উঠতেই জ্যাঠামশাইকে টানতে টানতে শীতলক্ষ্যার পাড়ে নিয়ে গেল। সামনে ছোট চর, পাড়ে কাশবন। বাঁদিকে মঠতলায় স্টিমার ঘাট। দশটায় স্টিমার আসার কথা। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসে।

    সকাল বলে এবং আশ্বিনের মাস বলে ঘাসে ঘাসে শিশির। জ্যাঠামশাই, সোনা এবং প্রিয় আশ্বিনের কুকুর নদীর পাড়ে হাঁটছে। এরা তিনজনে চরে নামতেই দেখতে পেল সেই হাতিটা, হেমন্তের হাতি। এখন আশ্বিনের শেষাশেষি চরের ওপর দিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে। ওর ইচ্ছা হল জোরে চিৎকার করে ডাকে, জসীম। আমাবে জ্যাঠামশয়রে নিয়া যাও। আমি মার কাছে যামু গিয়া। আমার এখানে ভাল লাগে না। কিন্তু বলতে পারল না। ভয়ে সে বলতে পারল না। যদি আবার জ্যাঠামশাই হাতিতে চড়ে নিরুদ্দেশে চলে যান।

    অথচ গত রাত্রের ঘটনা মনে হতেই সে তার মায়ের কাছে ফিরে যেতেও সাহস পাচ্ছে না। এখন কেবল মনে হচ্ছে খালেক মিঞার মতো সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এই কুয়াশা পার হলেই এক জগৎ, সেখানে নিয়ে যাবার জন্য অমলা তার সুন্দর চোখ নিয়ে অপলক প্রতীক্ষা করছে। সোনা জ্যাঠামশাইর হাত ধরে নদীর ঘাটে দাঁড়াল। অথচ পাপের কথা কিছু বলতে পারছে না। কী বলবে! সামনের জলে কিছু কাশফুল ভেসে যাচ্ছে। এই ফুল দেখতে দেখতে সে তার মহাপাপের কথা ভুলে গেল। ওর কেবল মনে হচ্ছে এতদিনে সেই দূরের রহস্যটা সে যেন কিছু কিছু ধরতে পারছে। এখন ওর চারপাশের ফুল-ফল, পাখি, দু’পাশে নদীর চর, নদীর জলরাশি এবং এই যে হাতি চলে যাচ্ছে নদীর পাড়ে-পাড়ে, জ্যাঠামশাই পিছনে তার সূর্য-ওঠা দেখাচ্ছেন, কুকুরটা সকালের রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর স্টিমার ঘাটে যাত্রীরা বসে আছে, কিছু কিছু ঘাসের নৌকা, খড়ের নৌকা মাঝনদীতে…সবাই যেন গান গায় তখন, কোন্‌খানে ভাসাইলা নাও, দুই কূলের নাই কিনারা, য্যান এই নাও ভাসাইয়া দিছে সোনা, অমলা অথবা কমলা অথবা ফতিমারে নিয়া সোনাবাবু মাঝগাঙের মাঝি হইয়া গ্যাছে।

    সোনা এই নদীকে সাক্ষী রেখে কোনও পাপের কথা বলতে পারল না। সে সোজা উঠে এল ফের জ্যাঠামশাইর হাত ধরে। সকালের রোদ সোনার মুখে পড়েছে। যেন মুখটা সূর্যের আলোতে জ্বলছিল।

    পাগল মানুষ সোনার মুখ দেখে কি যেন ধরতে পারছেন। তিনি আশীর্বাদের মতো সোনার মাথায় হাত রাখলেন।…তোমার ভিতর বীজের উন্মেষ হচ্ছে সোনা। এই হতে হতে কিছু সময় পার হলে তুমি কিশোর হয়ে যাবে! তখন দেখবে রহস্যটা যা এখন ছুঁতে পারছ না, তা ধরতে পারবে। আরও বড় হলে, দুই কূলের নাই কিনারা, তুমি জলের ভিতর ডুবে যাবে। না ডুবতে পারলে পাড়ে-পাড়ে তার সন্ধানে থাকবে। তারপর খুঁজে না পেলে আমার মতো পাগল হয়ে যাবে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }