Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.২৭

    ১.২৭

    সকাল থেকেই বিসর্জনের বাজনা বাজছে। দেবীর চোখে মুখে বিষণ্ণতা। তিনি আবার হিমালয়ে যাচ্ছেন। আগমনী গান যে যার গাইবার এতদিন গেয়েছে। এবারের মতো আর গাইবার কিছু নেই।

    এইদিন সব কিছুতেই একটা বেদনার ছাপ। এত যে রোদ ঝিলিমিলি আকাশ, এত যে উজ্জ্বল দিন, কোথাও মালিন্য নেই—তবু কী যেন সকলের হারিয়ে যাচ্ছে। এই মণ্ডপের সামনে সকলেই এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে। বড় হুজুর সকাল থেকেই নাটমন্দিরে একটা বাঘের চামড়ার উপর বসে আছেন। পরিধানে রক্তাম্বর। কপালে রক্ত চন্দনের তিলক। এই দিনে–মা ভুবনময়ী, ভুবনমোহিনী, হে মা জগদীশ্বরী, তুই একবার নয়ন ভরে তাকা মা, হেন্ন প্রার্থনা এই মানুষের।

    মেজবাবু এবারেও প্রতিবারের মতো ফ্রুট বাজাবেন। নগেন ঢালি এসেছিল ঢোল নিয়ে। সে গতকাল হাটে বাজারে গঞ্জে ঢোল পিটিয়ে চলে এসেছে।

    গ্রাম গ্রামান্তরে এই খবর রটে গেলে চাষী বৌ’র মুখের রঙ বদলে যায়। সকাল সকাল খেয়ে নিতে হবে। শীতলক্ষ্যার তীরে গাঁ। জমিদারবাবুদের সব দালানকোঠা নদীর পাড়ে পাড়ে। আঁচলে একটা চৌ-আনি বেঁধে, পানে ঠোঁট রাঙা করে মাথায় ঘোমটা টেনে দশরায় যাবে, যাবার আগে দীঘির পাড়ে বসে মেজবাবুর ফ্রুট বাজনা শুনবে। সকাল সকাল বের না হতে পারলে জায়গা পাওয়া যাবে না। নদীর পাড়ে পাড়ে যেসব গাছ আছে, সেসব গাছের নিচে রাত থাকতেই লোক এসে জমতে শুরু করেছে। চাষী মানুষেরা অথবা বৌ-রা সামিয়ানার নিচে যেতে পারবে না। কাছ থেকে দেখবে মেজবাবুকে এমন শখ এইসব চাষী বৌয়ের। কিন্তু সিপাইগুলি এমন করে, লাঠি নিয়ে তাড়া করে, কার সাধ্য ওরা সামিয়ানার নিচে গিয়ে বসে। কতবার চাষী বৌ ভেবেছে লুকিয়ে চুরিয়ে সে চলে যাবে সামিয়ানার নিচে, কাছ থেকে দেখবে মেজবাবুকে, ফ্রুট বাজনা শুনবে—কিন্তু তার মানুষ বড় ভীরু, সে কিছুতেই তার বৌকে ভিতরে ঢুকতে দেবে না। একটা ঝাউগাছের নিচে বসে ওরা বাবুর ফ্রুট বাজনা শুনবে। যতক্ষণ না নদীর জলে, সব গ্রামের প্রতিমা বিসর্জন হবে, ততক্ষণ মেজবাবু ক্রমান্বয়ে ফ্রুট বাজিয়ে যাবেন। একের পর এক সুর, সবই তখন বড় করুণ মনে হয়, নিরিবিলি এক জগৎ সংসারে কী যে কেবল বাজে, প্রাণের ভিতর কী যে বাজে—ফুট শুনতে শুনতে তারা অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে যায়।

    সকাল থেকেই জায়গা নেবার জন্য দূর গ্রামান্তর থেকে লোকজন আসতে আরম্ভ করেছে। আমলা কর্মচারীদের কাজের বিরাম নেই। মঞ্চ করা হয়েছে। দীঘির পাড়ে এক মঞ্চ, রোশনচৌকি যেন বাজাবে সেখানে। সে মঞ্চে তিনি শীতলক্ষ্যার ও-পারে সূর্য ঢলে পড়লেই উঠে যাবেন। কলকাতা থেকে তাঁর আরও দু’জন শিষ্য এসেছে। ওরা বাজাবে। এখন খালেক কোথায়! খালেক পীড়িত। কাছারিবাড়ি পার হলে এক অশ্বশালা আছে, কিছু ঘোড়া আছে, সাদা রঙের, কালো রঙের ঘোড়া সেখানে। আস্তাবলের এক পাশে খালেকের ছোট ঘর। আলো নেই, বাতাস আসে না। সূর্য দেখা যায় না। খালেক সেই ঘরে শীর্ণকায় মানুষের মতো অনাহারী দুঃখী এবং চোখেমুখে ক্লিষ্ট এক ভাব। খালেক মিঞা শরীর শক্ত করে পড়ে আছে। খালেক আজই সূর্যাস্তের সময় মারা যাবে। সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। হাত পা স্থবির। পাষাণের মতো ভারী লাগছে সব। দশমীর দিন সেও ফ্রুট বাজায়। সেও মেজবাবুর পাশে বসে থাকে। আজ সে তার আঙুলগুলি এইদিনে নেড়ে নেড়ে দেখতে চাইছে—পারছে না। ভারী ভারী—পাষাণের মতো ভারী। ইব্রাহিম একবার দেখে এসেছে। ভূপেন্দ্রনাথ দু’বার দেখে এসেছেন। ওষুধ বা পথ্য সে কিছুই খাচ্ছে না। সে টের পেয়ে গেছে সূর্যাস্তের সময় ফ্লুট বাজালেই সে এক অদ্ভুত সুরলহরীর ভিতর ডুবে যেতে যেতে পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ ভুলে যাবে। সে মরে যাবে। তবু সে এই দুঃসময়ে এটা তার দুঃসময় কী সুসময়, সে মনে মনে এটা সুসময় জানে, সে যেন কার পদতলে বসে সারাজীবন ফ্লুট বাজাবে, তার জন্য তৈরি হচ্ছে।

    যখন একটা মানুষ মরে যাবে বলে চিৎপাত হয়ে অশ্বশালার পাশে পড়ে আছে তখন একজন মানুষ, আদ্যিকালের এক তালপাতার পুঁথি সামনে রেখে পড়ে চলেছেন—জয়ং দেহি, যশো দেহি। এই মানুষ মহালয়ার চণ্ডীপাঠ করেন না। বিসর্জনের দিন চণ্ডীপাঠ। এমন উল্টো ব্যাপার ভূ-ভারতে কবে কে দেখেছে। তিনি পদ্মাসন করে বসেছেন। বাঘছালের উপর বসে। সামনে দেবীপ্রতিমা। বিসর্জনের বাজনা বাজছে। তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, হে জগদম্বে, হে মা ঈশ্বরী, বলে সুর ধরে যেন বলে চললেন, অপরাধ ক্ষমা করতে আজ্ঞা হয় মা। তুই আজ চলে যাবি, অ মা উমা, এই বুঝি তোর ইচ্ছা ছিল, বলে শিশুর মতো করজোড়ে তিনি কাঁদতে থাকলেন। এবং কাঁদতে কাঁদতে তিনি মহিষাসুর বধে চলে এলেন। দেবীর গা থেকে কী তেজ বের হচ্ছে! শরীরে কাঁটা দিয়েছে। কি গ মা, তুই ভয় পেলি, তিনি পাঠ করতে করতে মাঝে মাঝে এইসব স্বগতোক্তি করছেন।—হে মা, তুমি এখন মধু পান কর। থেমে তিনি বললেন, মধু পান নিমিত্ত শরীরে অপার শক্তি সঞ্চয় করেছ—যা দেবী সর্বভূতেষু, দেবী তোমার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে হাজার দেবসৈন্য সৃষ্টি হচ্ছে, তারা যে সব মুহূর্তে বিনাশ হয়ে গেল মা। মহিষাসুর নিমেষে সব ধ্বংস সাধন করছে। মা, তোর বুঝি এই কপালে ছিল, মায়াপাশে আবদ্ধ করতে পারলি না! বলে তিনি যেসব ভক্ত পাশে বসে চণ্ডীর ব্যাখ্যা শুনছিল, তাদের ব্যাখ্যা করার সময় দেখলেন, এক বালক নাটমন্দিরের পশ্চিমের বারান্দায় বড় একটা থামের আড়ালে ঈশমের গল্পের মতো মনোযোগ দিয়ে চণ্ডীপাঠ শুনছে। সেই এক কিংবদন্তী, গর্জে গর্জে কে গর্জন করছে. দেবীর গর্জন, না অসুরের!

    এই বৃহৎ সংসারে তিনিই সব। অমলার ঠাকুরদা প্রভাবশালী মানুষ। একমাত্র দেবীর সামনে এসে তিনি শিশু বনে যান। শিশুর মতো কাঁদেন। কেবল ক্ষমাভিক্ষার মতো মুখ। সেই মুখে, চণ্ডীপাঠের সময় গর্জে গর্জে এমন শব্দ উচ্চারণে সোনা হেসে ফেলেছিল। তক্ষুনি চিৎকার। যেন গোটা বাড়িটা কাঁপছে। সকলে ছুটে এসেছে।—কে হাসে! সোনা পালিয়ে যাবে ভেবেছিল! কিন্তু চক্ষু রক্তবর্ণ, নাসিকা ঈগল পাখি প্রায়, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা এবং কাপালিক সদৃশ মুখ—ক্ষণে ক্ষণে মুখের কী পরিবর্তন—সোনা আর নড়তে পারেনি। বললেন, অঃ তুই। দেবীমহিমা শুনতে ভালো লাগছে!

    সোনা ঘাড় কাৎ করে দিল।

    —তবে দাঁড়া!

    সোনা একটা থামের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।

    অনেকক্ষণ পরে হুঁশ হল কমলা ওকে পিছন থেকে চুপি চুপি ডাকছে।—সোনা, এখানে কী করছিস!

    সে বলতে পারল না চণ্ডীপাঠ শুনছে। ঋষি পুরুষেরা নানারকম কিংবদন্তী লিখে গেছে তালপাতার পুঁথিতে, এখন সে সবই দেবীমহিমা হয়ে গেছে। ওর কাছে প্রায় সবটাই ঈশমের সেই যে এক সূর্য আছে না, জলের নিচে এক রূপালী মাছ আছে, মাছটা সূর্য মুখে অথবা সেই মাছটা কী জালালি? যে কেবল বিল পার হয়ে নদী পার হয়ে সাগরে চলে যায় সূর্য মূখে। সকাল হলেই পুবের আকাশে সূর্যটাকে লটকে ডুব দেয় ফের। সাগরে সাগরে মহাসাগরে ঘোরাফেরা তার।

    সে বলতে পারত, ঋষি পুরুষেরা কিংবদন্তী লিখে গেছে তালপাতার পুঁথিতে। আমি তাই শুনছি। বলতে পারত, আমাদের ঈশম ওর চেয়ে অনেক বেশি ভালো কিংবদন্তী জানে। সে ভাবল, বড় হলে তালপাতার পুঁথিতে সেও তা লিখে রাখবে। সুতরাং সে চণ্ডীপাঠ শুনছে, না কিংবদন্তী শুনছে পুরাকালের, এখন এই মেয়ে কমলাকে তা প্রকাশ করতে পারল না।

    সোনা কিছু বলছে না দেখে ফের কমলা বলল, পাঁচটায় হাতি আসবে। হাতিতে আমরা দশরা দেখতে যাব। তুই আমাদের সঙ্গে যাবি।

    সোনা বস্তুত এখন জ্যাঠামশাই-র সেই কালরাত্রি, মহারাত্রি বলা যেতে পারে—জালালিকে তুলে আনছেন বিলের পাড় থেকে এমন একটা দৃশ্য দখতে পাচ্ছে। জ্যোৎস্না রাত, শীতে পাগল জ্যাঠামশাই-র মুখ সাদা ফ্যাকাসে—ঠিক জ্যোৎস্নার মতো রঙ, এখন সোনার এসব মনে হওয়ায় সে কমলার কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।

    —এই শুনছিস আমি কি বলছি?

    —কী?

    —আমাদের সঙ্গে হাতির পিঠে দশরা দেখতে যাবি?

    —যাব।

    —একটু সকাল সকাল ভিতরে চলে আসবি। আমরা তোকে সাজিয়ে দেব। পাউডার মেখে দেব। সোনা হাঁটতে থাকল।

    —কি রে, মনে থাকবে ত?

    সে ঘাড় কাৎ করে বলল, মনে থাকবে তার। তারপর বলল, আর কে কে যাবে?

    —আমি, দিদি, সোনাদি, রমা, বাচ্চু।

    —আর কেউ যাবে না?

    —আর কে যাবে জানি না। তুই কিন্তু আগে আগে চলে আসবি। মুখে তোর পাউডার মেখে দেব। সোনা তার এই বয়স পর্যন্ত মুখে পাউডার মাখেনি। সে বেটাছেলে। বেটাছেলে পাউডার মাখে না, বাড়িতে এমন একটা নিয়ম আছে। মা জ্যেঠিমা কদাচিৎ মুখে পাউডার মাখেন। সে পাউডার মাখতে প্রায় দেখেইনি বললে চলে। দূর দেশের আত্মীয়-বাড়িতে যেতে হলে হেজলিন স্নো মেখেছে, শতীকালে মা তার মুখে স্নো মাখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই গরমের সময় সে পাউডার মাখবে এবং ওর মুখ আরও সুন্দর দেখাবে ভাবতেই লজ্জায় গুটিয়ে গেল।

    সে বলল, জ্যাঠামশয় যাবে না?

    —না।

    —জ্যাঠামশয় না গেলে আমিও যাব না।

    —তুই কি রে, সোনা! যারা ছোট তারাই যাবে। বড়রা হেঁটে যাবে। ঠাকুমা তোকে নিয়ে যেতে বলেছে। এই বলে যেমন দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসেছিল তেমনি দ্রুত উপরে উঠে গেল। সিঁড়ির মুখে অমলা দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, কি রে, পেলি সোনাকে?

    —হ্যাঁ।

    —কী বলল?

    —বলল, যাবে।

    —বলেছিস তা সকাল সকাল আসতে। পাউডার মেখে দেব মুখে, বলেছিস?

    —সব বলেছি। তুই না দিদি…, কি বলতে গিয়ে থেমে গেল। বাবা এদিকে আসছেন। বাবা দশমীর দিন ধুতি-চাদর পরে একেবারে বাংলাদেশের মানুষ হয়ে যান। তারপর কলকাতায় যাবার দিন এলেই ‘একেবারে সহেবসুবো মানুষ। তখন তিনি বাংলাতে পর্যন্ত কথা বলেন না। তখন বাবাকে বরং বেশি পরিচিত মানুষ মনে হয় ওদের। ওরা বাবার সঙ্গে সহজেই তখন কথা বলতে পারে।

    কিন্তু এখন ওরা পালাবার পথ খুঁজছিল। এই অসময়ে ওরা নাটমন্দিরের কাছে চলে এসেছে—এটা ঠিক না। দেখলেই বাবা ধমক দেবেন। সুতরাং ওরা যতবারই সোনাকে কাছারিবাড়ির দিকে খুঁজতে গেছে, খুব সন্তর্পণে গেছে। এমনকি অন্দরের দাসী-বাঁদীদের চোখও যেন না পড়ে। প্রায় লুকোচুরি খেলার মতো চলে যাওয়া, তারপর সোনাকে না পেলে বিমর্ষ হয়ে ফিরে আসা।

    বাবা এখন করিডর পার হয়ে যাচ্ছেন, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবেন। বাবার ঘরটা বাবা না থাকলে সবসময় তালা দেওয়া থাকে। বড় বড় আলমারি—কত বই সব এবং কাচের জানালা দরজায় নানা-রকমের কারুকাজ। বাবার ঘরে পুরানো আমলের লম্বা আবলুস কাঠের খাট এবং পালঙ্ক বলা চলে, কতকাল থেকে পালঙ্ক খালি। বাবা এলে এই পালঙ্কে না শুয়ে ছোট একটা তক্তপোশে শুয়ে থাকেন। ডানদিকের ঘরটাতে বিলিয়ার্ড টেবিল। অবসর সময় বাবা একাই টেবিলে লাল-নীল রঙের বল নিয়ে খেলা করেন। আর দেওয়ালে বাবার কোর্টের ছবি। গভর্নরের সঙ্গে বাবার ভোজ খাওয়ার ছবি। বিলাতে লিঙ্কন হলে পড়ার সময়কার ছবি। মায়ের সঙ্গে তোলা ফোটো—বোধহয় জায়গাটা ওয়েলসের কোনও একটা গ্রামের। মামাবাড়িতে যাবার সময় বড় একটা ক্যাসল পড়ে। একটা ক্যাসলের ছবিও এ-ঘরে রয়েছে। ছাত্রাবস্থায় বাবার সেই সতেজ মুখ দেখার জন্য দুই বোন চুরি করে এই ঘরে ঢুকে যায়। বাবার কাছে ধরা পড়লে দু’বোন ছুটে পালায়। সোনা বলেছিল, বাবার ঘরটা দেখবে। অমলা বলেছিল, দেখাবে। কিন্তু কী করে দেখানো যায়! সোনার বুদ্ধি নেই মোটেই। কেবল কথা বললেই হাসে। চুপি চুপি দেখে চলে যাবে তেমন সে নয়। এটা কি, এটা কেন, এই লাল-নীল রঙের বল দিয়ে কী হয়! আমি দুটো বল নেব। অথবা সে ওসব দেখতে দেখতে এমন অন্যমনস্ক হয়ে যাবে যে, ধরা না পড়ে যাবে না। সোনা এমন ছেলে যে, ওকে নিয়ে কিছু করা যায় না। পালানো যায় না। সে বোকার মতো বার বার ধরা পড়ে যায়।

    সোনা তখন ভূপেন্দ্রনাথকে বলল, জ্যাঠামশয়, দশরাতে যামু। কমলা আমারে নিয়া যাইব। হাতিতে চইড়া যামু কইছে।

    দশমীর দিন এই হাতি আসে বিকেলে। জসীম জরির পোশাক পরে। মাথায় তার জরির টুপি। বাড়ির বালক এবং বালিকারা সকলে মিলে দশরা দেখতে যায়। হাতির শুঁড়ে শ্বেতচন্দনে ফুল-ফল আঁকা থাকে। কপালে কানপাতা এবং শরীরে নানারকমের কলকা আঁকা অথবা ধানের ছড়া এবং লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। গলায় কদম ফুলের মালা। যেই না মেজবাবুর ফ্রুট বাজনা আরম্ভ হবে, হাতিটা নিয়ে জসীম রওনা হবে পিলখানার মাঠ থেকে। তারপর সোজা অন্দরমহলের দরজায়। সেখানে হাতিটা দাঁড়িয়ে থাকবে। কপালে চাঁদমালা তার। তখন বাড়ির বৌরানীরা সোহাগ মেগে নেবে প্রতিমার। প্রতিমার পায়ে সিঁদুর ঢেলে নিজের নিজের কৌটায় পুরে রাখবে। সম্বৎসর এই সিঁদুর কপালে দেবে আর মেজবৌরানীর জন্যেও সিঁদুর আসে সোনার কৌটায়। সেটা মেজবাবু কলকাতা যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যান। মেজবৌরানী কপালে সিঁদুর দেন না। লম্বা গাউন পরেন। গীর্জায় যান। তবু এক ইচ্ছা এই পরিবারের—বিশেষ করে বৌঠাকুরানীর অর্থাৎ মেজবাবুর মার মন আদৌ মানে না। তিনি সব বৌদের জন্য যেমন কৌটায় দেবীর পা থেকে সিঁদুর কুড়িয়ে রাখেন তেমনি মেজবৌরানীর জন্যও সিঁদুর কুড়িয়ে নেন। মেজবাবুকে দেবার সময় অনুরোধ করবেন একবার অন্তত সিঁদুরটা যেন কপালে ছোঁয়ায় বৌ! মেজবাবু তখন সামান্য হাসেন। তারপর যার জন্য দেবীর পা থেকে সিঁদুর সঞ্চয় করা—সে এই হাতি। সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী এই পরিবারের। দশমীর দিনে কপালে নিজ হাতে বৌঠাকুরানী সিঁদুর পরিয়ে দেন। চাঁদমালা পরিয়ে দেন। তারপরই বাজনা বাজে। ঢাকের বাজনা, বিসর্জনের বাজনা। পরিবারের সব বালক-বালিকা সেজেগুজে হাতিতে চড়ে বসে। প্রতিমা নিরঞ্জনের লোকেরা, জয় জগীদশ্বরী, জয় মা জগদম্বা আর জয় বাড়ির বড় হুজুরের—এইসব জয় দিতে দিতে প্রতিমা বের করে নিয়ে যায়। এইসব জয়ের ভিতর শোনা যায় মেজবাবু মঞ্চের উপর বসে ফ্রুট বাজাচ্ছেন। দক্ষিণের দরজা দিয়ে প্রতিমা যায়, উত্তরের দরজা দিয়ে হাতি যায়। আর মাঝখানে বড় চত্বর। তারপর দীঘি। দীঘির পাড়ে রোশনচৌকির মতো মঞ্চ, ক্রমান্বয়ে, এক সুরে বেজে চলেছে। নদীতে এক দুই করে প্রতিমা নামছে। ক্রমে সন্ধ্যা নামছে নদীর চরে কাশফুলের মাথায়। দশমীর চাঁদ আকাশে। আর ঢাক বাজছে, ঢোল বাজছে। নৌকায় সারি সারি দেবী প্রতিমা, বিসর্জনের বাজনা, হৈচৈ আলো-আঁধারির খেলা। হাউই পুড়ছে আলো ফুটছে কত রকমের। থেকে থেকে মেজবাবুর ফ্রুট বাজনা। করুণ এক সুর এই বিশ্বচরাচরে অপার মহিমা নিয়ে বিরাজ করছে। মেজবাবু বুঝি এই সুরের ভিতর ফ্রুট বাজাতে বাজাতে স্ত্রীর ভালোবাসার জন্য কাঁদেন।

    আজ আবার সেইদিন এসে গেছে। নিত্যকার মতো ভূপেন্দ্রনাথ সকাল সকাল স্নান করে এসেছেন নদী থেকে। নিত্যকার মতো ময়ূরের ঘর, বাঘের খাঁচা এবং হরিণেরা যে যেখানে থাকে সেসব জায়গায় ভূপেন্দ্রনাথ ঘোরাঘুরি করছেন। সাফসোফ ঠিকমতো হয়েছে কি না, এসব যদিও ওঁর দেখার কথা নয়—তবু এতগুলি জীব এই প্রাসাদে প্রতিপালিত, প্রতি মানুষের মতো তাদের সুখ-দুঃখ বুঝে ভূপেন্দ্ৰনাথ নিজে দেখেশুনে সব বিধিমতো ব্যবস্থা করে থাকেন। তাছাড়া আজ দেবী চলে যাচ্ছেন হিমালয়ে। কি এক বেদনা সবসময় সকাল থেকে প্রতিবারের মতো ওকে বিষণ্ণ করে রাখছে। তারপর নিত্যকার মতো মঠের সিঁড়ি ভেঙে ভিতরে ঢুকে শিবের মাথায় জল, বৃষের পায়ে জল এবং শেকল টেনে এক দুই করে শতবার ঘণ্টাধ্বনি।

    খালেকের অসুখ। কুলীনপাড়া থেকে ডাক্তার এসে দেখে গেছে। আর এখন যারা বিদায় চাইছে, যেমন পুরোহিত এবং অন্য অনেকে, তারা এখন সবাই কাছারিবাড়িতে ভূপেন্দ্রনাথের অপেক্ষায় বসে আছে। তাছাড়া গত সন্ধ্যায় যারা কাটা মোষ নিয়ে গিয়েছিল তারা আসবে নতুন কাপড়ের জন্য। যে- সব প্রজাদের জমি বিলি করার সময় ঠিক ছিল মায়ের পুজায় পাঁঠা অথবা মোষ এবং দুধ-কলা, আনাজ যার যা কিছু ফসলের বিনিময়ে দেবার কথা—তারা তা দিয়েছে কি না, না দিলে তাদের ডেকে পাঠানো, এসব কাজও ভূপেন্দ্রনাথের জন্য পড়ে থাকে। আর এমন সব কাজের ভিতরে ভূপেন্দ্রনাথের দুপুর গড়িয়ে গেল। কিছুই আর তাঁর ভালো লাগছে না। বিষাদ-বিষণ্ণ প্রতিমার সামনে তিনি চুপচাপ অনেকক্ষণ একা একা দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বড়বৌ এবং ধনবৌর জন্য দেবীর পা থেকে সিঁদুর তুলে নিয়েছেন। আবার সেই নির্জনতা এই বাড়িকে গ্রাস করবে। এ ক’দিন কী ব্যস্ততা! কী সমারোহ! গোটা প্রাসাদ সারাদিন গমগম করেছে। আজ কারো কোনও ব্যস্ততা নেই। দীঘির চারপাশে সকলে জমা হচ্ছে।

    বিকেলেই জসীম হাতিটার পিঠে পিলখানার মাঠে চেপে বসল। তখন গরদের কাপড় পরছেন মেজবাবু। গরদের সিল্ক। হাতে হীরের আংটি। কালো রঙের পাম্পশু জুতো। মেজবাবু তাঁর ঘর থেকে বের হচ্ছেন। তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন। আগে পিছনে পরিবারের আমলা কর্মচারী। আতরের গন্ধ সকলের গায়ে। সবার আগে ভূপেন্দ্রনাথ, পরে রক্ষিতমশাই এবং সকলের শেষে বাবুর খাস খানসামা হরিপদ। যেন একটা মিছিল নেমে যাচ্ছে দক্ষিণের দরজায়। ওরা নেমে এল নাটমন্দিরে। এখানে মেজবাবু গড় হলেন। দেবীর পায়ের বেলপাতা অঞ্জলির মতো করে হাতে তুলে নিলেন। ওরা বড় বড় থামের ওপাশে এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেলে সোনার মনে হল, দেবী এখন ওর দিকে তাকিয়ে নেই। দেবী তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। চোখমুখ কাঁপছে। ঘামের মতো মুখটা চকচক করছে। সে আরও কাছে এল। দুর্গাঠাকুরের চোখে জল পড়ছে কি না দেখার জন্য একেবারে মণ্ডপের ভিতর ঢুকে গেল।

    সে প্রথম সিংহটাকে একবার ছুঁয়ে দেখল। দীঘির পাড়ে সকলে এখন যে যার জায়গা নিচ্ছে বলে কেউ আর মণ্ডপে নেই। এই সময়, সুসময়ও বলা চলে, একবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা দেবীকে, অসুর অথবা সেই বাচ্চা ইঁদুরটাকে। গণেশের পায়ের কাছে যে একটা কাঁটালতায় বসে আছে। সে সিংহের মুখে প্রথম হাতটা ভরে দিল। অসুরের বুক থেকে যে রক্ত এ ক’দিন গড়িয়ে পড়েছে সেটা হাত দিয়ে দেখল—কেমন শুকনো হয়ে গেছে রক্তটা। এবং সিংহটা খাবলা খাবলা মাংস তুলে নিয়েছে। ওর কেন জানি এই অসুরের জন্য মায়া হল। সে অসুরের মাথায় হাত দিয়ে কোঁকড়ানো চুলে আদর করার মতো দাঁড়িয়ে থাকল। এবার মজা দেখাচ্ছি। সিংহটার চোখে সে একটা চিমটি কেটে দিল। কিছু রং উঠে এল নখে। দেবীর মহিমায় সিংহটা সোনাকে ভয় পাচ্ছে না। সে এবার উঁকি দিয়ে দেবীর চোখ দেখল, জল পড়ছে। তা তোমার এত কষ্ট যখন থেকে গেলেই হয়। দেবীর সঙ্গে কথা বলতে চাইল মনে মনে। ওর ভয় ছিল, কাছে গেলেই দেবী রাগ করবে। কিন্তু কী ভালোবাসার চোখ। সে বলল, তা তোমার এমন জীব কেন বাহন মা। আমি ওকে সুড়সুড়ি দেব নাকে। এই বলে সে ছোট একটা কাঠি যেই না নাকের কাছে নিয়ে গেছে অমনি এক শব্দ হ্যাচ্চো। কেউ নেই আশেপাশে—অথচ হ্যাঁচ্চো দিল কে। সিংহটা সত্যি তবে হাঁচি দিল! সে থতমত খেয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে দেখল পাগল জ্যাঠামশাই মণ্ডপের সিঁড়িতে। তিনি হাঁচি দিয়েছেন। পাগল মানুষের ঠাণ্ডা লাগে না। সোনা এই প্রথম জ্যাঠামশায়ের ঠাণ্ডা লাগায় ভাবল তিনি তবে ভালো হয়ে যাচ্ছেন। সে জ্যাঠামশাই-র হাত ধরে বলল, আমি হাতিতে চড়ে দশরা দেখতে যাব।

    দীঘির পাড়ে তখন মেজবাবু ফ্রুট বাজাচ্ছেন। সোনার মনে হল ওর দেরি হয়ে গেছে। সে পাগল জ্যাঠামশাইকে ফেলে কাছারিবাড়িতে ছুটে গেল। জামা-প্যান্ট বদলে নিতে হবে তাড়াতাড়ি।

    যারা প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য নাটমন্দিরে এসেছে তারা সবাই গামছা বেঁধেছে কোমরে। ওরা ঠাকুর কাঁধে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। রামসুন্দর যাচ্ছে মাথায় ঘট নিয়ে। ঠাকুর নদীর চরে নামানো হবে। সেখানে আরতি হবে, ধূপধুনো জ্বলবে। বড়দা, মেজদা ঠাকুরের সঙ্গে নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে। সে যেতে পারছে না। ওর জন্য অমলা কমলা বসে রয়েছে। সে যাবে হাতিতে।

    ভুপেন্দ্রনাথ সোনাকে জামা-প্যান্ট পরিয়ে দিল। মাথা আঁচড়ে দিল। সোনা আর দাঁড়াতে পারছে না। সে কোনওরকমে ছুটতে পারলে বাঁচে। সবাই সব নিয়ে চলে যাচ্ছে। ওর জন্য কেউ কিছু রেখে যাচ্ছে না।

    এখন রোদ নেমে গেছে। সেইসব হাজার হাজার লোক নদীর পাড়ে বসে পামগাছ অথবা ঝাউগাছের ছায়ায় নিবিষ্ট মনে ফ্রুট বাজনা শুনছে। হাজার হাজার মানুষ, মানুষের মাথা গুনে বলা কঠিন কত মানুষ—এসেই যে যার মতো জায়গা করে মেজবাবুর ফ্রুট বাজনা শুনতে বসে যাচ্ছে।

    অশ্বশালার পাশে এক মানুষ আছে—তার বুঝি ইন্তেকাল হবে এবার। সেও এক মনে, দু’হাত বুকের ওপর রেখে সেই সুরের ভিতর ডুবে যাচ্ছে। সে চিৎপাত হয়ে, গঞ্জে শহরে যেমন ফ্রুট বাজাত; তেমনি বুকের উপর দু’হাত নাড়ছে। সেও বুঝি শেষবারের মতো মেজবাবুর সঙ্গে মনে মনে ফুট বাজাচ্ছে। এমন আশ্বিনের বিকেলে এই পৃথিবীর বুকে সে ফ্রুট না বাজালে আর কে বাজাবে! সে দু’হাত অনেক কষ্টে উপরে তুলে রাখল। যথার্থই সে আজ ফ্রুট বাজাচ্ছে। তারপর হাত দুটো ওর ক্রমে অসাড় হয়ে যাচ্ছে। বুকের উপর হাত, চোখ বোজা—মানুষটার দুনিয়াতে কেউ নেই, আছে শুধু দুই ঘোড়া, এক ল্যাণ্ডো আর এক ফুট। সে চুরি করে মেজবাবু না থাকলে নিশুতি রাতে নদীর চরে একা বসে ফুট বাজাত। সে নানারকম সুরের ভিতর তন্ময় হয়ে থাকত। তেমনি আজও সে তন্ময় হয়ে যাচ্ছে। দীঘির পাড়, শীতলক্ষ্যার চর, নদী মাঠ সব যেন এই সুরের ভিতর হাহাকার করছে। সে মেজবাবুর ফ্রুট বাজনা শুনতে শুনতে চোখ বুজে, এক আল্লা, তার কোন শরিক নেই…শরিক নেই…নেই…সে আর শ্বাস নিতে পারছে না। অসহ্য এক যন্ত্রণা ভিতরে। সে হাত দুটো আর উপরে রাখতে পারল না। অবশ হয়ে আসছে সব। এক আশ্বিনের বিকেলে ক্রমে এভাবে সে মরে যাচ্ছে। কেউ খেয়াল করছে না।

    তখনই সোনা ছুটছিল। হাতিটা অন্দরে এসে গেছে। জসীম হাতির পিঠে বসে প্রতীক্ষা করছে নিশ্চয়। সবাই ওর জন্য হাতির পিঠে নদীর পাড়ে এখনও নেমে যেতে পারছে না। হাতি বুঝি ওকে ডাকছে! ফ্রুট বাজছে। দীঘির পাড়ে হাজার মানুষ। বিচিত্র বর্ণের মেলা। ইব্রাহিম কলের ঘরটাতে বসে আছে। সময় হলেই আলো জ্বেলে দেবে।

    সোনা তার পাগল জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছে। যেন তার পাগল জ্যাঠামশাই, সে যা বলবে তাই শুনবেন। জ্যাঠামশাই দশরাতে চলে যাবেন একা একা। সে জ্যাঠামশাই-র সঙ্গে দশরাতে মেলা দেখবে। হাতির পিঠে বসে থাকবে না! ফেরার সময় দু’জন হেঁটে হেঁটে লাড্‌ডু খেতে খেতে ফিরে আসবে।

    কিন্তু জ্যাঠামশাই না দীঘির ঘাটে, না সেই সব মানুষের ভিতর। এদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। হাতিটা অন্দরে দাঁড়িয়ে এখন শুঁড় নাড়ছে। কান দোলাচ্ছে। অমলা কমলা বিরক্ত হচ্ছে। জসীমকে হাতি ছাড়তে বারণ করে দিচ্ছে বুঝি। সে প্রাণপণে কাছারিবাড়ির মাঠ পার হয়ে এল! দারোয়ানদের ঘর অতিক্রম করে সেই নাটমন্দিরের উঠোন। সে এখানে এসে শ্বাস নিল! দেখল পকেটের পয়সাগুলি পড়ে গেল কি না ছুটতে গিয়ে। সে চোদ্দটা তামার চক্‌চকে পয়সা পেয়েছে। দশরা দেখার জন্য বৌরানীরা বাড়ির সব বালক-বালিকাদের মতো ওর হাতে একটা করে তামার পয়সা দিয়েছে। সে বলেছে, সে একা নয়। ওরা দু’জন। সে এবং তার পাগল জ্যাঠামশাই। সে পাগল জ্যাঠামশাই-র জন্য একটা একটা পয়সা গুনে ভিন্ন পকেটে রেখে দিয়েছে। মেলা দেখা হলেই জ্যাঠামশাইর পকেটে পয়সাগুলি দিয়ে দেবে। কিন্তু সে কোথাও জ্যাঠামশাইকে পেল না। ওঁকে খুঁজতে গিয়ে ওর এত দেরি হয়ে গেল। সে সিঁড়ি ভেঙে ছুটছে। ওর বড় দেরি হয়ে গেল। সে লম্বা বারান্দা পার হয়ে গেল। রান্নাবাড়ির পথে গেলে সে তাড়াতাড়ি দরজায় ঢুকে যেতে পারবে। ওরা ওর মুখে পাউডার মেখে দেবে—সে পাগল জ্যাঠামশাই-র ওপর মনে মনে ভীষণ রাগ করছে। মুখে ওর পাউডার মাখা হল না। ক্ষোভে ওর এখন কান্না পাচ্ছে। সবাই এখন নিশ্চয় উত্তরের দরজাতে আছে। সে অমলা কমলাকে তাদের ঘরে গিয়ে পাবে না ভাবল। সে পড়ি মরি করে জোরে জোরে ছুটতে থাকল। আর পৌঁছেই দেখল, কেউ নেই। না হাতি, না অমলা কমলা। বাড়ির সব আলো জ্বলে উঠছে। সবাই ওকে ফেলে বুঝি চলে গেল। সে একা পড়ে গেল। সে যে এখন কি করবে! তবু একবার অমলাদের ঘরে খোঁজ নিতে হবে। দাসীবাঁদী কেউ নেই যে বলবে, ওরা গেল কোথায়! সে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল। বাড়ি ফাঁকা মনে হল। দু-একটি অপরিচিত মুখ। কেউ ওকে দেখে কথা বলছে না। সে ভয় পাচ্ছে। কোনওরকমে অমলাদের ঘরটাতে যেতে পারলেই আর তার দুঃখ থাকবে না। অমলা কমলা ওকে ফেলে হাতিতে চড়ে মেলা দেখতে যেতে পারে না। এমন সময়ই সে দেখল প্রাসাদের সব আলো নিভে গেছে। এত যে ঝাড়লণ্ঠন, এত যে বৈভব সব কেমন নিমেষে অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। দীঘির পাড়ে ফ্রুট বাজছে না। সেই ময়না পাখিটা তখনও অন্ধকারে ডাকছে, সোনা তুমি কোথায় যাও। কেউ নেই সোনা। আঁধার আঁধার।

    এমন অন্ধকার সোনা জীবনেও দেখেনি। এক হাত দূরের কিছু দেখা যায় না। কেবল ছায়া ছায়া ভাব। ছায়ার মতো মানুষেরা ছুটাছুটি করছে। ওর পাশ দিয়ে একটা লোক ছুটে বের হয়ে গেল। প্রায় অদৃশ্যলোকে সে যেন এসে পৌঁছে গেছে। সে ভয়ে ভয়ে ডাকল, অমলা!

    তখন একটা শক্ত হাত অন্ধকার থেকে বের হয়ে এল। এবং ওর হাত চেপে ধরল—কাকে ডাকছ?

    —অমলাকে।

    —তুমি কে?

    —আমি সোনা।

    —কোথায় যাবে?

    —অমলার কাছে। ওরা আমাকে নিয়ে দশরাতে যাবে বলেছে। আমার মুখে কমলা পাউডার মেখে দেবে বলেছে।

    —ওদের ঘরে তুমি যেতে পারবে না। বারণ। কেউ ঢুকতে পারবে না। সোনা বলল, না, আমি যাব।

    —না। সেই শক্ত হাত কার সোনা টের পাচ্ছে না। তবু সে যে স্ত্রীলোক সেটা সোনা বুঝতে পারল। সে বৃন্দাবনী হতে পারে। সোনা ভয়ে বিমূঢ়। রেলিঙে এসে দাঁড়াল। যদি কেউ ওকে এখন কাছারিবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে। মনে হল সিঁড়ির মুখে লণ্ঠন। সে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল মেজবাবু উঠে আসছেন। সামনে ওঁর খাস খানসামা হরিপদ। সে ফের এখান থেকে ছুটে পালাতে চাইল। মেজবাবুকে ঘরে ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে। শোকচ্ছন্ন মুখ। সোনা অবাক। এই সেই মানুষ যাকে সে কিছুক্ষণ আগে দেখে এসেছে মঞ্চে নিবিষ্ট মনে ফ্রুট বাজাচ্ছেন। এখন তিনি মূর্ছিত এক প্রাণ। সোনার ভিতরটা হাহাকার করে উঠল। অমলা কমলার কিছু হয়নি তো! ওদের ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মনে হচ্ছে ভিতরে অমলা কমলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

    হাতিটা একা অন্ধকার প্রাসাদ থেকে ফিরে গেল। কেউ দশরাতে যেতে পারল না। কোনও দুঃসংবাদ এ বাড়িতে এসেছে। কী সেই দুঃসংবাদ কেউ যেন বলতে পারছে না। পরিবারের দু-একজন ব্যাপারটা জেনেছে। এবং ভূপেন্দ্রনাথ তাদের অন্যতম। সে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। অন্ধকার প্রাসাদে সব বিসর্জন হয়ে গেছে, এখন এক নির্জন মাঠের ভিতর দিয়ে শুধু হেঁটে যাওয়া।

    সোনা জেদী বালকের মতো বলল, অমলার কাছে যাব।

    বৃন্দাবনী বলল, না। না।

    সুতরাং সোনা বাইরের দিকে চলে এসে ওদের জানালার দিকে মুখ করে মাঠে বসে থাকল। আলো জ্বললেই ওরা জানালা থেকে সোনাকে দেখতে পাবে। দেখতে পাবে সে হাঁটু মুড়ে সিড়ির উপর ওদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে আছে। কী যেন এক টান তার এই দুই মেয়ের জন্য, সোনা মনে মনে ভাবছে, ওদের কিছু হয়েছে, সে সবটা না জেনে কিছুতেই এখান থেকে নড়বে না ভাবল।

    তখনও হাতিটা যায়। অন্ধকারে গাছগাছালির ভিতর দিয়ে হাতিটা যায়। ইব্রাহিম কলঘরে একটা টর্চ নিয়ে বসে আছে। কোথায় যে কি হল! সে আলোর ঘর অন্ধকার করে বসে থাকল। শুধু ঢাকের বাজনা ভেসে আসছে। হাতিটা এখন নদীর পাড়ে নীরবে হেঁটে চলে যাচ্ছে।

    আর কোথাও বোধহয় প্রতিমা বিসর্জন হচ্ছিল। পাগল জ্যাঠামশাই কোথায় আছে কে জানে! সোনা কারও জন্য জীবনে কিছু কিনতে পারল না। দু’পকেটে ওর চক্‌চকে তামার পয়সা। উপরে জানালা বন্ধ। তখন নদীতে শেষ প্রতিমা বিসর্জন। নদীতে যে আলো, ধূপধুনো, ঢাকের বাদ্যি ছিল এবার তাও নিভে গেল। কোথাও আর কিছু জ্বলছে না। শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। উপরে আকাশ, নির্মল আকাশে সেই অন্তহীন হাজার হাজার নক্ষত্র। নক্ষত্রের আলোতে সে যেন পৃথিবীর যাবতীয় শুভবোধকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। জানালা খুলে গেলেই সে ওদের জন্য কিছু করতে পারে। সে ওদের মুখ দেখার জন্য ঘাসের ভিতর বসে আছে। দু’হাঁটুর ভিতর মাথা গুঁজে বসে আছে।

    বিসর্জনের পর ভূপেন্দ্রনাথের হুঁশ হল। সোনা কোথায়! ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। সকলের ফের অন্ধকারে ছুটোছুটি। রামসুন্দর আবিষ্কার করল সোনা মেজবাবুর দালান বাড়ির নিচে শুয়ে আছে। সোনা সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছে!

    সকালে অন্দর থেকে একটা চিঠি পেল সোনা-আমরা ভোর রাতের স্টিমারে চলে যাচ্ছি সোনা। তোর সঙ্গে আমাদের আর দেখা হল না।

    কাছারিবাড়ির সিঁড়িতে সে সারাটা সকাল একা চুপচাপ বসে থাকল। তার কিছু আজ ভালো লাগছে না। তার মনে হল নদীর চরে কাশের বনে বনে কেবল কে যেন আজ চুরি করে বুকের ভেতর ফুট বাজাচ্ছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }