Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.৩০

    ১.৩০

    তখন মালতী হাসছিল। রঞ্জিতের কথা শুনে হাসছিল। এমন প্রতিশোধ স্পৃহা থাকে হাসিতে, রঞ্জিত মালতীর মুখ না দেখলে যেন টের পেত না। কী করুণ আর অসহায় মুখ মালতীর! কী কঠিন হাসি!

    খুপরি ঘরটার ভিতর মালতী একটা পাতিহঁসের মতো বসেছিল। হেমন্তের শেষ রোদ নেমেছে ওর ঝাঁপের দরজায়। হেমন্তের শেষ বলে শীতশীত করছে। একটা পাতলা কাঁথা গায়ে মালতী ছোট কম্বলের আসনে বসে আছে। অশৌচের শরীর যেন! অবজ্ঞা চারপাশে। নরেন দাস রোদ থেকে খড় তুলে এক জায়গায় জড়ো করছে। আভারানী ধান ঝাড়ছে। শোভা আবু বাড়ি নেই।

    মালতী সহজে ঘর থেকে আজকাল বের হতে চায় না। মাঝে মাঝে বাড়ির নিচে এক গাব গাছ আছে, সেখানে গিয়ে বসে থাকে।

    রঞ্জিত এলেই ঝাঁপটা খুলে দিয়েছিল মালতী। কারণ এই ঝাঁপ থাকলে অন্ধকার থাকে চারপাশে। সে ক্রমে অন্ধকার ভালোবাসছে। চিড়িয়াখানার জীবের মতো আর বেঁচে থাকতে পারছে না। সে যে এখন কী করবে! ভিতরে তার কী যে হয়েছে! সারাক্ষণ শীতশীত ভয় ভয়। বুকটা কাঁপে। কঠিন হাসি হাসলে নরেন দাস ভয় পায়। রঞ্জিতের সঙ্গে দেখা হলেই বলে, যান, গিয়া দ্যাখেন, পাগলের মত হাসতাছে।

    এমন শুনেই রঞ্জিত এসেছিল। এলেই মালতী বিনীত বাধ্যের যুবতী হয়ে যায়। সে একটা জলচৌকি ঠেলে দেয় বাইরে। মাথা নিচু করে বসতে বলে। রঞ্জিত বসলেই যেন মালতী কেমন বল পায় শরীরে। তার একমাত্র মানুষ, যাকে কথাটা বলবে বলে সে স্থির করেছে। সে যে এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছিল না বলেই চোখে মুখে দীনহীন চেহারা। সে কিছুতেই কথাটা বলতে পারে না। সে কেমন মানুষটার মুখ দেখতে দেখতে মুহ্যমান হয়ে যায়।

    রঞ্জিত বলল, তুমি এমন পাগলামি করলে চলবে কেন মালতী!

    —কি পাগলামি ঠাকুর?

    —মাঝে মাঝে তুমি গাব গাছতলায় ছুটে যাও। সেখানে চুপচাপ বসে থাক। কিছু খাও না।

    —কিছু খেতে ভাল লাগে না ঠাকুর।

    —ভাল না লাগলে তো চলবে না। খেতে হবে বাঁচতে হবে।

    —তোমারে ঠাকুর কইলাম একটা চাকু দিতে। তুমি কিছুতেই দিয়া গ্যালা না।

    —আবার তোমার এক কথা।

    —আমার আর কোন কথা নাই।

    —তুমি অমন করলে নরেনদা কি করবে তোমাকে নিয়ে?

    —আমারে নিয়া কারো কিছু করতে হইব না।

    —এমন বলে না, বলতে নেই। যেন অসুস্থ মালতীকে রঞ্জিত বুঝ-প্রবোধ দিচ্ছে।

    —তোমার কি মনে হয় ঠাকুর আমারে ভূতে পাইছে?

    —তুমি তো জান মালতী, এ-সব আমি মানি না।

    —তবে তুমি দাদার কথা বিশ্বাস কর ক্যান?

    —করি, কারণ তোমার মুখ দেখলে আমার ভয় হয়।

    —কি ভয়?

    —কেমন অস্বাভাবিক চোখমুখ তোমার। তুমি তো এমন ছিলে না মালতী। তুমি মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকো। তিনি তোমার সব ভাল করে দেবেন।

    —ঠাকুর, তোমার এত বিশ্বাস ভগবানে?

    —আর কি বলব তোমাকে! আমার কেবল ভয় হয় আবার তুমি কিছু করে না বস!

    —আমি মরতে চাই না ঠাকুর। বিশ্বাস কর, আমি মরতে চাই না। তুমি কাছে থাকলে আমি মরতে পর্যন্ত সাহস পাই না। তারপর সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, যদি চাকুটা দিতা। আমি এখন কী যে করি।

    রঞ্জিতের মাথায় এখন হেমন্তের রোদ। আর কোথাও কোনও পরিচিত পাখির ডাক। ঘরে যুবতী মেয়ে অন্ধকারে বসে আছে। সে যেন দীর্ঘদিন থেকে রঞ্জিতকে কিছু বলবে বলে ঘুম যেতে পারছে না। চোখের নিচে কালি। হাত পা শীর্ণ। মুখে ক্লান্তি। এবং চারপাশে অদ্ভুত এক নির্জনতা। অথচ বার বার সে চাকুর প্রসঙ্গে ফিরে আসছে।

    সে বলল, মালতী তুমি কপালে সিঁদুর দিয়েছিলে। পায়ে আলতা। কি যে সুন্দর লাগছিল।

    মালতী জবাব দিল না।

    —তোমার এমন সুন্দর চোখ মালতী। আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারছি না। তোমাকে আর কি বলব।

    মালতী মাথা নিচু করে রাখল। কিছু যেন ভাবছে

    রঞ্জিত বলল, আমি চলে যাব মালতী। তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে কি না জানি না। কবে দেখা হবে তাও বলতে পারি না। আমার অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে গেল। যাবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলাম।

    মালতীর চোখ বড় বড় দেখাচ্ছে। সে বলল, আমি জোরে জোরে পাগলের মতো হাসি ক্যান জিগাইলা না?

    —জিজ্ঞেস করে কী হবে। কিছু করতে পারছি না। জিজ্ঞেস করে লাভ কী!

    মালতী বলল, তোমার অজ্ঞাতবাস শেষ। মালতীর বুকটা বলতে গিয়ে ধড়াস করে উঠল।

    –শেষ। পুলিশ খবর পেয়ে গেছে আমি এখন এ-অঞ্চলে আছি। আজ কী কাল পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টার হতে পারে ভেবে পালাচ্ছি।

    মালতী এনকাউন্টার শব্দটা বুঝল না। সে এখন নিজের যে এক অতীব দুঃখ আছে ভুলে যাচ্ছে। সে কেবল তার প্রিয়জনের মুখ দেখছিল। এই মানুষ তার কাছে এলে কোনও সন্দেহের কারণ থাকে না। কারণ সে এই মেয়েকে কতদিন লাঠি খেলা ছোরা খেলা শিখিয়েছে। রঞ্জিত এক মহান আদর্শে নিমজ্জিত। সামান্য এক বিধবা যুবতী তার কাছে কিছু না। বরং মালতীর কঠিন চোখমুখ সে এলেই সহজ হয়ে যায়। নরেন দাসের ধারণা এবং অন্য সকলের ধারণা মালতী রঞ্জিতকে ভয় পায়। এখন সেই যুবক ফের নিরুদ্দেশে যাবে। নিরুদ্দেশে গেলে তার আর থাকল কী! সে এখন সবই ওকে বলে দিতে পারে। অথচ কীভাবে বলবে! এমন একটা কথা, যা নরেন দাস জেনেও বেমালুন চেপে যাচ্ছে। মালতী এবার কান্না কান্না গলায় বলে ফেলল, ঠাকুর, আমি মরতে চাই না। তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে চল।

    রঞ্জিত দেখল চোখ ফেটে জল পড়ছে মালতীর।

    ক্রমে বিকেল মরে আসছে। মাঠ থেকে ধানের গন্ধ আসছিল। যেন মনে হয়, এই যে মাঠ চারদিকে, ফসল সর্বত্র এবং কলাই খেতের নীলচে রঙের ফুল এবং ধান উঠতে আরম্ভ করেছে, দূরের মাঠে ধান কাটার গান শোনা যাচ্ছিল—সবই অর্থহীন মালতীর কাছে। মালতী কী করবে এখন! অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে রঞ্জিত কী বলে।

    এতদিন রঞ্জিত তার সমিতির নির্দেশে কত বড় বড় কাজ অবহেলায় সমাধান করেছে। কুমিল্লাতে সে হাডসন সাহেবকে খুন করে পলাতক। পুলিশের লোক জানে সে আগরতলা হয়ে শিলচর এবং শিলচর থেকে আসামের কোথাও উধাও হয়েছে। নিখোঁজ। তার শৈশবের পরিচয় দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও পুলিশ সংগ্রহ করতে পারেনি। সে-ই রঞ্জিত, সে-ই সুখময় দাস, সে-ই কখনও চরণ মণ্ডল এবং সে যে নদী পার হতে গিয়ে একবার নীলের বাদ্যি বাজিয়ে ছিল গোপাল সামন্ত নামে—সে-সব পুলিশ খবর রেখেও রঞ্জিত নামে এক বালক এখানে কৈশোর কাটিয়ে পলাতক তা তারা জানে না। এ-অঞ্চলের মানুষেরা জানে রঞ্জিত দেশের কাজ করে বেড়ায়—এই পর্যন্ত। এখন মালতী তার সামনে গোঁজ হয়ে বসে রয়েছে এবং জীবনপাত করে যে আদর্শ সবই অর্থহীন। মালতীর গোঁজ হয়ে বসে থাকা সে একেবারে সহ্য করতে পারছে না। সে বড় দুর্বল বোধ করছে।

    তার সামনে কত বড় মাঠ, শস্যক্ষেত্র। সে সামান্য ফসলের জমি নিয়ে কী করবে! মালতীকে সে কোথাও পৌঁছে দিতে পারছে না। এই নিয়তি মালতীর। কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে হেঁটে হেঁটে গাছপালার ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল।

    মালতী যেমন খুপরি থেকে একটা হাঁসের মতো বের হয়ে এসেছিল তেমনি সে ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকে বসে থাকল। একটু পরে এল শোভা। বাঁ হাতে ওর লণ্ঠন। ডান হাতে কলাই করা থালাতে খ‍ই এবং গুড়, মালতীর রাতের আহার। খেতে দিলেই মালতী ঝাঁপ বন্ধ করে দেবে। তারপর এক অন্ধকার নিয়ে, চোখ কোটরাগত করে সে শুয়ে থাকবে। ঘুম নেই চোখে। কেবল মনে হয়, কোন মরুপ্রান্তে একটা পত্র পুষ্পহীন বৃক্ষ তাকে হাতছানি দিচ্ছে।

    রঞ্জিত হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ে চলে এল। সেই এক অর্জুনগাছ, গাছটা ডালপালা মেলে বড় হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে ক্রমে অন্ধকার নামছে। দক্ষিণের ঘরে শশীমাস্টার ছেলেদের পড়াচ্ছেন। সোনা খুব জোরে জোরে পড়ে। সে তার কঠিন কঠিন শব্দ রঞ্জিত বাড়ি এলেই শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ে। সে যে কত বড় হয়ে গেছে এবং কতসব কঠিন কঠিন শব্দ জেনে ফেলেছে এই বয়সে, সে রঞ্জিতমামাকে তা জানাতে চায়। সে এত দুঃখের ভিতরও মনে মনে হাসল। সে চলে যাবে। এসব ছেড়ে যেতে ওর সব সময়ই কেমন কষ্ট হয়। দিদির কাছে সে মানুষ বলে যা-কিছু টান এই দিদির জন্য। এবং স্বামী তার পাগল বলে সব সময়ই মনের ভিতর নানারকমের চিন্তা—মানুষটা এভাবে সারাজীবন বাঁচবে আর কবিতা আবৃত্তি করবে, দিদির জীবনটা বড় দুঃখে কেটে গেল। এখানে এলে সে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে এমন ভাবে! সব মাঠঘাট চেনা। তাই যেন যাবার আগে সব ঘুরে ঘুরে একটু দেখে যাওয়া। পুকুরপাড় থেকেই সে দক্ষিণের ঘরের আলোটা দেখতে পেল। শশীমাস্টার দুলে দুলে পড়ান। ইতিহাস থেকে তিনি—‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী’ ছেলেদের বলার সময় কেমন মাটি এবং মানুষের নিমিত্ত তিনি উত্তাপ পান। শশীমাস্টার এই তিন ছেলেকে সন্তানের মতো স্নেহ করেন।

    সে অন্ধকার থেকে এবার উঠে এল। সংসারে আপনজন বলতে তার দিদি। আর কেউ নেই। স্বামী পাগল মানুষ। সে সোজা বাড়ি উঠে এল এবার। নিজের ঘরে ঢুকে পোশাক পাল্টাল। ওর স্যুটকেসের ভিতর যা যা থাকার কথা ঠিক আছে কি-না দেখে নিল। মহেন্দ্রনাথ নিজের ঘরে বসে আছেন। এ-সময় তিনি সামান্য গরম দুধ খান। দিদি নিশ্চয়ই মহেন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে আছে।

    সে দিদিকে বলে তাড়াতাড়ি দুটো খেয়ে নিল। মহেন্দ্রনাথের ঘরে ঢুকে প্রণাম করার সময় বলল, আমি আজই চলে যাচ্ছি।

    বড়বৌ আর এখন এসবে বিস্মিত হয় না। কখন কোথায় থাকবে অথবা যাবে কেউ জানতে চাইলে সে চুপচাপ থাকে। আগে বড়বৌ এ-নিয়ে সামান্য অশান্তি করত রঞ্জিতের সঙ্গে। এখন আর করে না। অসময়ে কোথাও চলে যাচ্ছে বললে বিস্মিত হয় না। বরং সে সব ঠিকঠাক করে দেয়। কথা বেশি বলে না। রঞ্জিত বুঝতে পারে দিদি তার এই চলে যাওয়া নিয়ে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছে! দিদি চুপচাপ থাকলে সে টের পায়, চলে গেলে নিশ্চয় দিদি তার কাঁদবে। সে যাবার আগে যেমন প্রণাম করে থাকে, এবারেও তা করল। তারপর বিষণ্ণ মুখ দেখে যেমন বলে থাকে, কই তুমি হাসলে না? আমি যাব অথচ তুমি হাসলে না। না হাসলে যাব কি করে?

    বড়বৌ জোর করে হাসে তখন। হেসে বিদায় দেয় এই ছোট ভাইটিকে।

    —এই তো আমার দিদি। বলে সে সকলের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য প্রথমে দক্ষিণের ঘরে ঢুকে গেল। শশীমাস্টারকে বলল, চলে যাচ্ছি। সোনার মাথায় কী ঘন চুল হয়েছে, সে চুলে হাত ঢুকিয়ে আদর করল সোনাকে। বলল, যাচ্ছি আমি। তোমরা ভাল হয়ে থেক। মা’র কথা শুনবে। জ্যাঠামশাইকে দেখে রাখবে।

    শশীমাস্টার বললেন, তা’ হলে আবার বনবাসে যাচ্ছেন?

    –যেতে হচ্ছে।

    —ফিরবেন কবে?

    —বোধহয় আর এখানে ফিরতে পারব না।

    —কেন?

    —অসুবিধা আছে।

    —আপনি স্বদেশী মানুষ, আপনাদের সব জানার সৌভাগ্য আমাদের হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে আপনার মতো বনবাসে যেতে ইচ্ছা হয়। জাতির সেবা করতে ইচ্ছা হয়।

    —জাতির সেবা তো আপনি করছেন। এর চেয়ে বড় সেবা আর কী আছে?

    —কিন্তু কি জানেন, বলে শশীমাস্টার উঠে দাঁড়ালেন। দেশ স্বাধীন যে কবে হবে বুঝতে পারছি না।

    —হয়ে যাবে।

    —হবে ঠিক! তবে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছি না বলে দেরি হচ্ছে। রঞ্জিত এমন কথার কোনও জবাব দিতে পারল না।

    —আপনার কি মনে হয়?

    —কিসের ব্যাপারে বলছেন?

    —এই স্বাধীনতার ব্যাপারে।

    —সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লে সংসার চলবে কী করে?

    —তা ঠিক বলেছেন। কিন্তু লীগ যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে, তাতে যে শেষপর্যন্ত কি হয়! রঞ্জিত এ-কথার জবাব দিতে হবে বলেই অন্য কথায় চলে এল।—এরা কিন্তু আপনার খুব ভক্ত। এরা আজকাল যত্ন নিয়ে দাঁত মাজছে।

    শশীমাস্টার বললেন, দাঁতই সব। আপনার দাঁত দেখি।

    অন্য সময় হলে রঞ্জিত কি করত বলা যায় না। কিন্তু এখন সে চলে যাচ্ছে বলে খুব সরল সহজ হয়ে গেছে। তাই সে কোনও কুণ্ঠা প্রকাশ না করে শশীমাস্টারকে দাঁত দেখাল।

    শশীমাস্টার লণ্ঠন তুলে সবক’টা দাঁত দেখলেন। যেন কুশলী ডাক্তার ওর দাঁত দেখছেন। মাড়ি টিপে টিপে দেখলেন। তারপর পলটুকে এক ঘটি জল আনতে বলে রঞ্জিতের মুখের দিকে তাকালেন।—আপনার নিচের পাটির দাঁত কিন্তু ভাল না।

    রঞ্জিত হাসতে হাসতে বলল, কি করলে ভাল হবে?

    —রোজ রাতে একটা করে হরতুকি খাবেন। বলে তিনি বাইরে গেলেন। হাত ধুলেন. তারপর ফিরে এসে বললেন, হরতুকিতে দাঁত শক্ত হয়। লিভারের কাজ ভাল হয়। সুনিদ্রা হবে। এবং পরিপাকে এত বেশি সাহায্য করবে—বলে একটু থামলেন। কি যে খুঁজে খেরোখাতাটা পেয়ে পাতা উল্টে গেলেন। ‘হ’ এই শব্দের পাতা থেকে হরতুকি কত নম্বর পাতায় আছে খুঁজে হরতুকির গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে শোনাতে থাকলেন।

    রঞ্জিত দেখল লম্বা খাতায় নানারকম আয়ুর্বেদীয় ফুল-ফলের নাম। তাদের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ। রঞ্জিত বলল, এদের এসব বলুন। দেশের মাটিতে যা হয় পৃথিবীর কোথাও তা পাওয়া যায় না।

    শশীমাস্টার বললেন কি লালটু-পলটু, মামা কি বলছেন! তোমার মামা তো আজ চলে যাবেন। প্রণাম কর।

    সকলে একসঙ্গে উঠে এসে কে আগে প্রণাম করবে, দুপদাপ প্রণাম সেরে কে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে সবার আগে বসবে তার প্রতিযোগিতা যেন। রঞ্জিত বলল, পরীক্ষা পাসের সময় এটা চাই। সবার আগে যেতে হবে। বারান্দায় বাড়ির পাগল মানুষ চুপচাপ বসে আছেন। সে তাঁর কাছে গিয়ে বলল, জামাইবাবু আমি আজ চলে যাচ্ছি। বলে সে দু’পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। প্রণাম করার সময় বলল, আশীর্বাদ করবেন, আমি যেন ভালো কিছু করতে পারি।

    তিনি বসেছিলেন। বসে থাকলেন। কোনও উচ্চবাচ্য নেই। তাঁর চোখ অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। তবু বোঝা যায় সারাজীবন ধরে মানুষটি এক সোনার হরিণের পিছনে ছুটছেন। মানুষটার দিকে তাকালেই রঞ্জিতের চোখ ছলছল করে ওঠে।

    সে তাড়াতাড়ি এবার পশ্চিমের ঘরে ঢুকে গেল। ধনবৌকে প্রণাম করার সময় বলল, ধনদি, আজ চলে যাচ্ছি।

    ধনবৌ বলল, সাবধানে থাইক।

    তারপর সে শচীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে খুব ঘন অন্ধকারের ভিতর মাঠে নেমে গেল। শশীমাস্টার, সোনা, লালটু, পলটু হ্যারিকেন নিয়ে পুকুরপাড় পর্যন্ত এসেছিল। তারপর আর যায়নি। রঞ্জিত নিজেই বলেছে, আপনারা ফিরে যান মাস্টারমশাই। অন্ধকারে আমি ভালো দেখতে পাই। আলো থাকলে বরং চোখ ঝাপসা লাগে।

    অন্ধকার নেমে আসতেই আবার সেই মাঠ, সোনালী বালির নদী, তরমুজের জমি এবং উপরে আকাশ, চিত্র-বিচিত্র সব নক্ষত্র আর মাঠের নির্জনতা ওকে শৈশবের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। শৈশবে সে, সামসুদ্দিন আর মালতী-মালতীকে নিয়ে তারা নদীতে সাঁতার কাটত। সাঁতার কেটে ও-পাড়ে উঠে যেত। গয়না নৌকার নিচে কখনও কখনও রঞ্জিত লুকিয়ে থাকলে মালতী ভয় পেত। সে ডাকত, ঠাকুর।

    কে যেন তেমনি মনে হয় এখনও তার পিছনে ডাকছে। ঠাকুর, তুমি আমাকে কার কাছে রেখে গেলা? তুমি দেশের কাজ করে বেড়াও, আমি কি তোমার দেশ না? তোমার এই জলা-জমি অথবা মাটিতে আমি বড় হয়ে উঠি না! আমার সুখ-দুঃখ তোমার সুখ-দুঃখ না! ঠাকুর, ঠাকুর, কী কথা বলছ না কেন?

    রঞ্জিত যত দ্রুত হাঁটবে ভেবেছিল, সে তত দ্রুত হেঁটে যেতে পারছে না। কে যেন তাকে কেবল নিরন্তর বলে চলেছে, আমি কী করি ঠাকুর! মনে হল সে যেতে যেতে কোনও গাছের ছায়ায় অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছে। যত তাড়াতাড়ি সে এ অঞ্চল ছেড়ে যাবে ভেবেছিল, কেন জানি সে তত তাড়াতাড়ি যেতে পারছে না। বস্তুত ওর পা চলছিল না। তার মাথার উপর বড় এক আকাশের মতো পবিত্রতা নিয়ে মালতী জেগে রয়েছে। সে আর এক পা বাড়াতে পারল না।

    মনে মনে সে আজ কখনও জীবনে যা ভাবেনি, যা-কিছু স্বপ্ন ছিল সব মিথ্যা প্রতিপন্ন করে অন্য জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়বে ভাবল। দেশ উদ্ধারের চেয়ে কাজটা কেন জানি কিছুতেই কম মহৎ মনে হচ্ছে না।

    সে সেই অশ্বত্থ গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকল। অন্ধকার কী ঘন! আর কী প্রাচীন মনে হয় এইসব তরুলতা। সে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কিছু প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করছে। বিন্দু বিন্দু সব আলো গাঁয়ের ভিতর জ্বলছে নিভছে। রাত এখনও তেমন গভীর নয়। ভুজঙ্গ কবিরাজকে লাঠিখেলা ছোরাখেলার সব নির্দেশ, আর কোথায় আখড়া খুলতে হবে নূতন, সে গেলে কার সঙ্গে ওদের যোগাযোগ রাখতে হবে সবই সে ঠিকঠাক বলেছে কি-না আর একবার এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভেবে নিল। কোথাও তখন কোনও কুকুর আর্তনাদ করছে। শেয়ালেরা ডাকছে। জালালির কবরে এক ঝোপ কাশের বন সৃষ্টি হয়েছে এতদিনে। সেই কাশের সাদাফুল এই অন্ধকারে এক ফালি জ্যোৎস্নার মতো দুলছে চোখে। বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ জীবনসংগ্রাম ছিল জালালির। মৃত্যুর পর একখণ্ড ভূমি পেয়ে সে এখন কী মনোরম হাসছে। জালালি তার নতুন এই ভূ-খণ্ডে এখন কাশফুল হয়ে বেঁচে আছে। গাছের গোড়ায় ভালোবাসার মাটি—সে তা পেয়ে ছোট্ট শিশুটির মতো হাসছে। কাশফুলের মতো পবিত্র হাসিটি মুখে লেগে আছে জালালির।

    অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মনে হল, এই একখণ্ড জমি সকলের প্রাপ্য। সবাইকে এই দিতে হবে। অভুক্ত এবং ভূমিহীন মানুষ, ভূমিহীন বলতে পায়ের নিচে মাটি নেই এমন মানুষ সে ভাবতে পারে না। তার ঘর থাকবে, চাষ-আবাদের জমি থাকবে, সে কিছু খাবে, খেতে পাবে, খেতে না পেলে মানুষের স্বাধীনতার অর্থ হয় না। মানুষের স্বাধীনতা বলতে সে এই বোঝে। তার কেন জানি এবার মনে হল, সে একখণ্ড জমি মলতীকেও দেবে।

    অথবা এই অন্ধকারে, ঘন অন্ধকারে দাঁড়ালেই সে কেমন সাহসী মানুষ হয়ে যায়। ওর মৃত্যুভয় থাকে না। রাতের পর রাত, এমন সব মাঠ-জঙ্গল, নদী-বন, যদি কোথাও পাহাড় থাকে, সিংহ-শাবকের মতো পাহাড় বেয়ে ওঠা, যেন নিরন্তর এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে অভিযান—দুঃসহ এইসব অভিযান তাকে মাঝে মাঝে বড় বেশি বাঁচার প্রেরণা দেয়। কিছু না করতে পারলেই মনে হয় সে মৃত। একঘেয়ে জীবন তখন। বাঁচার কোনও প্রেরণা থাকে না। উৎসাহ-বিহীন মানুষের মতো তাকে অধার্মিক করে ফেলে। হাডসন সাহেবকে হত্যার পর সে আবার নতুন কিছু করতে যাচ্ছে। প্রায় এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে অভিযানের মতো এই ঘটনা। অন্ধকারে নরেন দাসের বাড়ি স্পষ্ট। বিন্দু বিন্দু আলো এখনও জ্বলছে। বোধহয় নরেন দাস গোয়ালে গরু বাঁধছে এবং আভারানী ঘাট থেকে বাসন মেজে এলেই সে এগুতে পারবে। ওদের এবার শুধু শুয়ে পড়তে দেরি। মালতীকে নিয়ে ভয়ডর তাদের কমে গেছে। কারণ মালতীর শরীরে আর কোনও ঘোড়া দৌড়ায় না। মালতী রুগ্‌ণ, শীর্ণকায়, অবসন্ন এবং শরীরের ভিতর মালতীর ধর্মাধর্ম এখন ঢাকঢোল বাজাচ্ছে। মালতীকে ঘরে জায়গা দিচ্ছে না নরেন দাস। মালতী এখানে থাকলে পাগল হয়ে যাবে।

    ক্রমে রাত বাড়ছে। ভোর রাতের দিকে ঠাকুরবাড়ি পুলিশে ঘিরে ফেলবে। এমন খবরই তার কাছে আছে। সন্তোষ দারোগা নারানগঞ্জে গেছে আর্মড ফোর্সের জন্য। সামান্য একজন মানুষকে ধরবার জন্য সন্তোষ দারোগা গোপনে গোপনে সেখানে মহোৎসবের ব্যাপার করে ফেলছে। ভীষণ হাসি পেল দারোগার ভয় এত বেশি ভেবে।

    কে সেই মানুষ, সে এখন ভেবে পাচ্ছে না—যে তাকে ধরিয়ে দিচ্ছে। এখানে কার সঙ্গে শত্রুতা। কয়েক ক্রোশ দূরে থানা। যেতে আসতে সময় অনেক। জলা জায়গা বলে কেউ বড় এদিকটাতে আসতে চায় না। সে এখানে বেশ অজ্ঞাতবাসে কাটিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু চুপচাপও বসে থাকা যায় না। সমিতির কাছে সে নির্দেশ চেয়ে পাঠাল। তাদের নির্দেশমতো একের পর এক আখড়া খুলে চলেছিল গ্রামে গ্রামে। তারপর এক খবর, এক মানুষ বাউল সেজে চিঠি দিয়ে গেল—পুলিশ তার সূত্র আবিষ্কারে ব্যস্ত। তাকে পালাতে হবে।

    এবারে মনে হল নরেন দাসের বাড়ির যে বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলছিল, তা নিভে গেছে। সে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে। ওপরে জহর কোট। কোটের নিচে হাত রেখে দেখল—না, ঠিক আছে। সে এবার সন্তর্পণে এগুতে থাকল, তার আর এখন ভয় নেই। দেখল সামনের অন্ধকারে একটা জীব ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে। সে রিভলবারটা চেপে ধরতেই মনে হল, ওটা বাড়ির আশ্বিনের কুকুর। সে চলে যাচ্ছে বলে তাকে বিদায় জানাতে এসেছে।

    রঞ্জিত বলল, বাড়ি যা। এখানে কী?

    কুকুরটা তবু পায়ে পায়ে আসতে লাগল।

    সে বলল, তুই যা বাবা। আমি এতদিনে একটা ভালো কাজ করতে যাচ্ছি।

    কিন্তু কুকুরটা পাশে পাশে হাঁটছেই।

    —কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস না?

    কুকুরটা এবার পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

    —হ্যাঁ হয়েছে। খুব হয়েছে। এবারে যা।

    কুকুরটা যথার্থই এবার ছুটে পুকুরপাড়ে উঠে গেল। এবং অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রঞ্জিত কোনদিকে যাচ্ছে দেখল।

    রঞ্জিত মালতীর দরজার সামনে সন্তর্পণে দাঁড়াল। ঝাঁপের দরজা। টর্চ জ্বেলে সে ঝাঁপের দরজায় ফাঁক আছে কি-না দেখল। সে কোনও ফাঁক খুঁজে পেল না। সুতরাং খুব সন্তর্পণে বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকল, মালতী। মনে হল তখন ভিতরের জীবটা জেগে আছে। সামান্য ডাকেই তার সাড়া মিলেছে।

    সে উঠে বসেছে। গলার স্বর চিনতে পেরে মালতীর বুক কাঁপছিল। সে কাঁপা হাতেই ঝাঁপ খুলে দিল।

    —আমি।

    মালতী কথা বলল না।

    —এবার আমরা যাব।

    মালতী বুঝতে পারছে না—আমরা যাব বলে রঞ্জিত কী বোঝাতে চাইছে। সে মাথা নিচু করে ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

    —আমার সঙ্গে তুমি যাবে?

    —কোথায়? সহসা মালতী রঞ্জিতের মতো প্রশ্ন করল।

    —যেদিকে দু’চোখ যাবে!

    —কিন্তু আমার যে কথা ছিল ঠাকুর।

    —এখন আর কোনও কথা না মালতী। দেরি করলে আমরা ধরা পড়ে যাব।

    —কিন্তু আমার ভয় করছে। তোমাকে সবটা বলতে না পারলে—

    —রাস্তায় সবটা তোমার শুনব। তুমি তাড়াতাড়ি এস।

    মালতী এবার খুপরির ভিতর ঢুকে দুটো সাদা থান, সেমিজ এবং পাথরের থালা নিল সঙ্গে।

    —এত নিয়ে পথ হাঁটতে পারবে না।

    সে পাথরের থালা রেখে দিল।

    রঞ্জিত বলল, আমাদের রাতে গজারির বনে গিয়ে ঢুকে পড়তে হবে।

    ওরা নদীর চরে নেমে আসতেই শুনল টোডারবাগের ওপাশে কারা টর্চ জ্বালিয়ে আসছে। ঘোড়ার খুরের শব্দ। রঞ্জিত বুঝতে পারল, রাতে রাতে সন্তোষ দারোগা গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। সে মালতীকে বলল, জলে ঝাঁপিয়ে পড়।

    পুলিশের লোকগুলি টর্চ এবার নিভিয়ে দিল। ওরা চলে যাচ্ছে।

    রঞ্জিত বলল, জলে ডুবে থাক।

    ওরা জলের ভিতর যখন ডুব দিল, তখনই মনে হল কেউ টের পেয়ে গেছে। সে বলল, মালতী, সাঁতার কাটতে হবে। যত জোরে সম্ভব। বলে সাঁতার কেটে ওরা নদীর পাড়ে উঠলে দেখল টর্চের আলো এসে এ-পাড়ে পড়েছে। বুঝি রঞ্জিত ধরা পড়ে গেল। টর্চের আলোতে বুঝি ওকে খুঁজছে।

    রঞ্জিতের এমন একটা ভয়াবহ ব্যাপারে যেন ভ্রূক্ষেপ নেই। মালতীকে নিয়ে যে সামান্য অসুবিধা। সে মালতীকে বলল, বুঝতে পারছ ওরা কিছু টের পেয়েছে। ওরা আগে এসে গেল।

    মালতী কিছু বুঝতে পারছে না। সে বসে বসে এখন ওক দিচ্ছে।

    —কি হয়েছে তোমার?

    মালতী বলল, ঠাকুর, তুমি পালাও। দেরি করলে ওরা ধরে ফেলবে।

    রঞ্জিত যেমন স্বভাবসুলভ হাসে, তেমনি হাসল। সে বলল, এটা তুমি পরো। এটা আমাকে বিপদ থেকে অনেকবার রক্ষা করেছে।

    মালতী দেখল, কালো রঙের একটা বোরখা। ওরা বনের ভিতর ঢুকে পোশাক পাল্টে ফেলল। সে তার স্যুটকেস থেকে এক এক করে সব বের করল। বলল, এখানে টিপলে গুলি বের হবে। এই দ্যাখো। এটাকে বলে ট্রিগার। সে আলো জ্বেলে সব বোঝাল। এই ট্রিগার। ভাল হোল্ডিং চাই। এমিঙ খুব তীক্ষ্ণ দরকার। কিন্তু একি মালতী, ওক দিচ্ছ কেন? মালতী ওক দিতে দিতে কথা বলতে পারছে না।

    রঞ্জিত বলল, তোমার কী হয়েছে মালতী তুমি ঠিক করে বল। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

    মালতী যা এতদিন বলবে ভাবছিল, ঘৃণায় যা বলতে পারছিল না, এখন এই দুঃসময়ে রঞ্জিতকে সে তা মরিয়া হয়ে বলে ফেলল।

    —ঠাকুর, আমি মা হইছি। তিন অমানুষ আমারে জননী বানাইছে। আর কিছু বলতে পারছে না। মালতী উপর্যুপরি ওক দিচ্ছে কেবল।

    অন্ধকারে রঞ্জিত কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। মালতী পায়ের কাছে বসে ওক দিচ্ছে। ওপারে ইতস্তত টর্চের আলো। বনের ভিতর আলো ঢুকছে না। সেই আলোর কণা শুধু বৃষ্টিপাতের মতো পাতার ফাঁকে ফাঁকে সামান্য ঢুকছে। রঞ্জিত এবার হাঁটু গেড়ে বসল। মাথায় হাত রাখল মালতীর। বলল, আমাদের অনেক পথ হাঁটতে হবে মালতী। আমরা কোথায় যাব জানি না। তুমি ওঠ।

    এভাবে নদীর পাড়ে যে বন, যে বনে একবার সোনা পাগল জ্যাঠামশাইর সঙ্গে হাতিতে চড়ে মাঠ অতিক্রম করেছিল, সেই বনে মালতী এবং রঞ্জিত সারারাত সকাল হবার আশায় গাছের নিচে পাশাপাশি শুয়ে ছিল। রঞ্জিত আর একটা কথাও বলেনি। মালতী ভয়ে ঘাসের ভিতর মুখ লুকিয়ে রেখেছে। দু’জনই সারা রাত জেগে ছিল। এরপর কী কথা বলে যে আবার স্বাভাবিক হওয়া যায় রঞ্জিত ভেবে উঠতে পারছে না। কোথায় যাবে, কার কাছে নিয়ে যাবে এবং সে এমন এক মেয়ে নিয়ে এখন কী করে? গাছের শাখা-প্রশাখা বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে। শেষ রাতের জ্যোৎস্না গাছের পাতায় পাতায়। সেই যেন পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির। অথবা কে যেন আবার উচ্চৈঃস্বরে পড়ে চলেছে—অ্যাট লাস্ট দি সেলফিস জায়েন্ট কেম। খুব সকালে আকাশ ফর্সা না হতে মালতীই ডেকে দিয়েছে। রঞ্জিতের চোখে ভোর রাতের দিকে ঘুম এসে গেছিল।

    রঞ্জিত ধড়ফড় করে উঠে বসল। সে নিজে একটা লুঙ্গি পরল। সে তার স্যুটকেস থেকে আঠা এবং রঙিন কিছু পাট বের করে একেবারে অন্য মানুষ সেজে গেল। বোরখার নিচে বিবি, আর রঞ্জিত এক মিঞাসাব। ভাঙা ছাতি বগলে। মিঞা-বিবি মেমান বাড়ি যাচ্ছে এমনভাবে রঞ্জিত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকল।

    যেতে যেতে মালতী বলল, তুমি ঠাকুর আমাকে জোটনের কাছে রাইখা যাও

    রঞ্জিত কথা বলল না। এ অবস্থায় ওকে কোথায় আর নিয়ে যাওয়া যাবে। সে দরগার উদ্দেশে হাঁটতে থাকল। দিনমানে হাঁটলে সে মালতীকে নিয়ে জোটনের দরগায় পৌঁছাতে পারবে। মালতীকে আপাতত জোটনের কাছে রেখে সে কোথাও চলে যাবে ভাবল।

    আর সে হাঁটতে হাঁটতেই কার ওপর আক্রোশে বনের ভিতর চিৎকার করে উঠল, বন্দেমাতরম্। আক্রোশের প্রতিপক্ষ জব্বর, না সন্তোষ দারোগা, ওর চোখমুখ দেখে তা ধরা গেল না।

    ।। প্ৰথম খণ্ড সমাপ্ত।।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }