Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.৩

    ২.৩

    গাছ-পাতার ফাঁকে সূর্যের আলো-ছায়া ছায়া ভাব, হেমন্তের শীত। সোনা চিঠি হাতে অর্জুন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। শীত এসে যাচ্ছে বলে সকাল সকাল দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। চিঠিটা অমলা লিখেছে। নতুবা কে তাকে চিঠি দেবে! অমলার কথা মনে হলেই সে নীল রঙের আবছা আলো, পুরানো পাঁচিলের গন্ধ টের পায়। সেই ভাঙা কুঠির অন্ধকার এবং অমলার মুখ, চোখ, শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চোখের উপর ভেসে ওঠে। তার ভিতরে কেমন একটা অনুভূতি হয়—মনে হয় জ্বর আসছে কম্প দিয়ে। শীত করছে। সে, ভিতরে ভিতরে মায়ের মুখ মনে ভাবলে শক্ত হয়ে যায়। সে একটা পাপ কাজ করে এসেছে। মা বুঝি টের পেয়েছে। মুড়াপাড়া থেকে ফিরে আসার পরই মা ভালোভাবে কথা বলে না। মা যেমন ওর সামান্য অসুখ করলে মুখ দেখে টের পায় তেমনি টের পেয়ে গেছে। গায়ের গন্ধ শুকে মা টের পেয়েছে বুঝি সোনা আর পবিত্র নেই। সোনা মুড়াপাড়া থেকে নতুন একটা অসুখ বাধিয়ে এসেছে।

    সোনা বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকল। আজ সে খেলতে গেল না পর্যন্ত। প্রতাপ চন্দের মাঠে ভলিবল নেমেছে। সোনা খেলে না। বোধহয় আগামীবার সে খেলতে পারে। এখনও মাঠ থেকে বল কুড়িয়ে দেয়। এবং খেলা হলে ওর মতো সমবয়সীরা মাঠে নেমে কিছুক্ষণ বল নিয়ে লাফালাফি করে—সেই লাফালাফির নেশাও কম নয় তার। বিকেল হলেই সে ছুটবে। কিন্তু এই চিঠি সারাক্ষণ তাকে নানাভাবে বিব্রত করেছে। সে কোথাও এমন জায়গা খুঁজছে যেখানে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়লে কেউ টের পাবে না। চিঠি পড়ে অমলাকে লিখবে, তুমি আমাকে আর চিঠি দিও না। কারণ সোনার ভয়, অমলা হয়তো লিখবে, তুই কাউকে বলে দিস নি তো! এসব কথা কিন্তু কেউ কখনও বলে দেয় না। বলতে নেই। শুধু আমি তুই জানি। আবার যখন তুই মুড়াপাড়া আসবি তখন আমরা আরও বড় হয়ে যাব। কী মজা হবে না তখন!

    সোনা শোবার ঘরে ঢুকে আয়নায় মুখ দেখল। সে মাঝে মাঝে আজকাল চুরি করে আয়নায় মুখ দেখছে। আয়না ধরলেই মা জ্যেঠিমা রাগ করনে। জ্যেঠিমা বলবেন, কী এত মুখ দেখা! এমন বয়সে এত বেশি মুখ দেখতে নেই। কখনও বলবেন, আয়না ধরবে না সোনা। তোমাদের জ্বালায় কিছু রাখা যায় না। সব ভেঙে ফেলছে। সে চুরি করে মুখ দেখছে। মা বিছানায় শুয়ে আছে। সোনা টেবিলের ধারে খুটখুট করছে। ধনবৌ মাথা তুলে দেখল, সোনা নিবিষ্ট মনে আয়নাটা মুখের কাছে এনে দেখছে। নানাভাবে দেখছে মুখ। চোখ বড় করে, কপাল টানটান করে দেখছে। টেবিল থেকে চুরি করে মার স্নো মাখছে। সুন্দর করে চুল আঁচড়ে সে বিছানার দিকে তাকাতেই মায়ের চোখে চোখ পড়ে গেল। ভারি লজ্জা পেল সোনা। ধনবৌ ছেলের সাজগোজ দেখে কাছে ডাকল। সোনা কাছে গেলে চুলটা আরও ভালো করে পাট করে দিল। স্নো যেখানে মুখের সঙ্গে মিশে যায়নি, সেটা সুন্দর নরম হাতে মিলিয়ে দিল। বড়বৌ এসেছে দেশলাই নিতে। এসে দেখল মা ছেলেকে সাজিয়ে দিচ্ছে। এই অবেলায় সোনা কোথায় যাবে! অন্যদিন এ-সময় খেলার জন্য ওকে কিছুতেই আটকে রাখা যায় না বাড়িতে। সে জামা-কাপাড় পাল্টেই ছুটতে থাকে মাঠের দিকে। তাকে ধরে রাখা যায় না। গোপাটে নেমে গেলে বড়বৌ ডাকবে, সোনা, লক্ষ্মী আমার, চাদর গায়ে দিয়ে যা। ঠাণ্ডা লাগলে জ্বর হবে। কে কার কথা শোনে! সে ছুটে মাঠে নেমে যায়।

    অথচ আজ সোনা খেলার মাঠে যায়নি। বড়বৌ সামান্য বিস্মিত হল। বড়বৌ বলল, কিরে সোনা, মাঠে গেলি না?

    সোনা মাকে, জ্যেঠিমাকে দেখল। সে কিছু বলল না। সন্তর্পণে পকেটে হাত রাখল। নীল রঙের খামটা ওর পকেটে। সে তাড়াতাড়ি এ ঘর থেকে পালাতে চায়। সোনা বের হবার মুখে শুনল, জ্যেঠিমা বলছেন, সোনা তোমার মাকে এক গ্লাস জল এনে দাও।

    সোনার ভারি রাগ হল মায়ের ওপর। মা ফাঁক ফেলেই শুয়ে থাকে। শরীর খারাপ। কী যে অসুখ মায়ের সে বুঝতে পারে না। অন্য অনেকদিন সে চুরি করে আয়নায় মুখ দেখলে মা তাকে ডাকে, তাকে সাজিয়ে দিতে চায়। সে কাছে যায় না। গেলেই ধরা পড়ে যাবে এমন ভয়ে সে দূরে থাকে। নিজেই মাথার চুলটা ঠিক করে নেয়। মা রোগা হয়ে যাচ্ছে। ভাত খেতে চায় না। তবু জ্যেঠিমা সাধ্য সাধনা করে দু’মুঠো খাওয়ান। মার সেই খাবার দৃশ্য দেখলে সোনার কান্না পায়। খেতে খেতে কোনওদিন মা মালসাতে বমি করে ফেলেন। মার জন্য সে যে কী করবে ভেবে পায় না। অথচ আজ এই জল আনতে বলায় মার ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। কী দরকার ছিল বলা জ্যেঠিমাকে, জল দিতে। জ্যেঠিমার হাতে গুচ্ছের কাজ। সেজন্য তিনি সোনাকে জল দিতে বলেছেন। সে বের হয়ে যাবার পর কেন মা জল চাইল না। সে এখন পাল বাড়ির পুকুরপাড়ে চলে যাবে। পাড়ে পাড়ে কত লটকন গাছ। ছোট ছোট গাছের ডাল বেয়ে অনায়াসে সে উপরে উঠে যেতে পারে। ডালপালা শাখার কোনও ঝোপের ভিতর বসে সে যদি চিঠিটা পড়ে তবে কেউ টের পাবে না।

    তার এখন তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে। সাঁঝ নামলে সে দূরে কোথাও যেতে পারে না। ভয় হয়। আর এসময় মা বলছেন, জল দিতে। সে জল না দিয়েই চলে যেত, কিন্তু ঈশম বলেছে জল না দিলে পরের জন্মে মাছরাঙা হয়। সে কিছুতেই মাছরাঙা হতে চায় না। সে মাছরাঙা হবার ভয়ে মার শিয়রে জল এনে রেখে দিল।

    দরজার মুখে এলেই ধনবৌ আবার ডাকল, সোনা

    সোনা পিছন ফিরে তাকালে, ধনবৌ বলল, কোনখানে যাবি?

    সোনা বলল, কোনখানে যামু না।

    —আমার শিয়রে একটু বসবি? আমারে বাতাস দিবি। শরীরটা আমার ভাল না।

    একথা শুনে সোনার রাগ বাড়ছে। সে সব সময়ই মায়ের অনুগত। মেজদার মতো সে নয়। মেজদাকে মা কোনও কিছু করতে বললেই পারবে না বলে চলে যায়। মা নিরীহ স্বভাবের। মেজদা শুধু ছোট কাকাকে ভয় পায়। সোনাই মার ফুটফরমাশ খেটে দেয়। অথচ আজ তার এমন কথায় রাগে কান্না পাচ্ছে।

    এবং এখন কত কথা মা তাকে বলছে। সে শিয়রে বসে থাকলে মায়ের খুব ভালো লাগবে। মার একা-একা ভালো লাগছে না। বাবাকে মা রাতে চিঠি লিখেছে, এই নিয়ে তিনটে চিঠি সে ডাকবাক্‌স ফেলে এসেছে—অথচ বাবা একটা চিঠির জবাব দেয়নি। আর কিছুক্ষণ সে মার কাছে বসে থাকলেই বলবে, হাঁ রে সোনা পিয়ন আইছিল?

    বাবার চিঠি এলেই মা সেদিন খুব সুন্দর সাজে। ভালো কাপড় পরে। লাল বড় সিঁদুরের টিপ কপালে এবং চুলে নানারকম ক্লিপ এঁটে মা বাবার জন্য কেবল কি প্রার্থনা করে।

    সে আর মায়ের কাছে গেল না। কাছে গেলেই সে ধরা পড়ে যাবে। তার পকেটে একটা নীল খামের চিঠি। সে বলল, আমার ভালো লাগে না। সে মায়ের সঙ্গে এই প্রথম মিথ্যা কথা বলল, আমি মাঠে যামু মা।

    ধনবৌ এবার উঠে বসল। মুখে খুব অরুচি। কিছু খেতে ভালো লাগে না। আমলকী খেলে জিভের স্বাদ ফিরে আসতে পারে। সে বলল, সোনা, আমার লাইগা আমলকী আনবি? মাঝি বাড়ির আমলকী গাছে খুব আমলকী হইছে।

    মাঝিদের বাড়িতে আমলকী গাছ। সোনা গাছটা চেনে। সময়ে অসময়ে গাছটায় ফল ধরে থাকে। সে ভাবল মার জন্য দুটো আমলকী চেয়ে নেবে। সে কতদিন আমলকী ফল খেয়ে জল খেয়েছে। আমলকী খেয়ে জল খেলেই মিষ্টি মিষ্টি লাগে জলটা। সে একটা আমলকী খেত, এবং এক ঢোক করে জল খেত।

    এতক্ষণ মা তাকে এই অন্ধকার ঘরে আটকে রাখতে চেয়েছিল, যেমন অমলা তাকে একটা অন্ধকার ঘরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল—তখন চরাচরে কদম ফুল ফোটে, কদম ফুল ফুটলেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা হয়—কেমন যেন একটা নতুন অসুখের জন্ম হচ্ছে শরীরে। ভালোবাসা, ভালো লাগার–কী একটা ব্যাপার, সে বুঝতে পারছে না, ছুঁতে পারছে না, ছুঁতে পারছে না নিজেকে—কেবল ঘুরে ঘুরে লটকনের ডালে ডালে সে একটা নিরিবিলি ঝোপ পেতেই চিত হয়ে ডালের ওপর শুয়ে পড়ল। কেউ গাছের নিচে হাঁটছে। সে তাড়াতাড়ি আবার চিঠিটা লুকিয়ে ফেলল। তারপর মুখ নিচু করে দেখল, না, কেউ নেই। গাছের মাথায় একটা সাদা বক এসে বসেছে। সে যে এক বালক, অমলার চিঠি নিয়ে এখনে পালিয়ে এসেছে, বকটা টের পায়নি। সূর্যের মুখে মুখ করে বসে আছে। কুক কুক শব্দ করছে। সোনা খুব যত্নের সঙ্গে নীল খামটা খুলল। জায়গাটা যথার্থই নির্জন। গ্রামের এটা উত্তর দিক। শীতকালে ভালো রোদ পায় না। পালেদের বাঁশ-বাগান সামনে। পশ্চিমে ছোট একটা নালা। এখনও জল আছে নালাতে। কত রকমের সব হেলঞ্চা কলমি লতা এবং জল সেঁচি আর কত সব ফড়িং, বিচিত্র বর্ণের। হেমন্তের পরেই শীত আসবে। শীত শেষ হলে নালাতে জল থাকবে না। তখন সোনা এবং সকলে খাল পার হয়ে খেলার মাঠে যাবে।

    এই খালটায় জল আছে বলে এখনও এ-পথে মানুষ নেমে আসে না। সোনা পাড়ে পাড়ে সব লটকন গাছ দেখতে পাচ্ছে। গাছে গাছে নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে আসবে—কতবার শীতের শেষে ওরা গাছের নিচে বসে থাকত নীলকণ্ঠ পাখি দেখবে বলে। কিন্তু পাখি এল না। সূর্যাস্ত হল। কোনও কোনওদিন সাদা জ্যোৎস্নায় সে ঈশমের হাত ধরে বের হতো। জ্যাঠামশাই সঙ্গে থাকতেন। তালি বজাতেন হাতে। সোনা ভেবেছিল তিনি তালি বাজালেই ওরা কোন দূরের সরোবর থেকে অথবা পাহাড় থেকে নেমে আসবে। সে নীল খামটা খুলতে গিয়ে একটা পাখির চোখ দেখতে পেল। পাখিটা কি তবে সেই তার নীলকণ্ঠ! যা সে খুঁজে বেড়াচ্ছে, জ্যাঠামশাই খুঁজে বেড়াচ্ছেন। চোখে তার কি দুঃখ! সে দেখল পাখিটা সেই পাখি, সাদা পাখি—একটা বক্, সে কক্ কক্ করছে। সে খামটা এবার ছিঁড়ে ফেলল।

    গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। বেশ বড় বড় করে লিখেছে অমলা। ধরে ধরে লিখেছে সোনাকে। সোনার মুখে এসে শেষ হেমন্তের রোদ পড়ছে পাতার ফাঁকে। মা তার শুয়ে আছে ঘরে। মার অসুখ। সে নিতান্ত বালক। সে চিঠিটা পড়ার জন্য এমন একটা গোপন জায়গায় চলে এসেছে।

    সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা—প্রিয় সোনা। আশা করি তুই ভালো আছিস। কেমন বড় মানুষের মতো লিখেছে। অমলা, কলকাতার মেয়ে। তার তো সবই তাড়াতাড়ি জানার কথা। সে সুন্দর ভাষায় চিঠি তো লিখবেই। প্রিয় সোনা, এই কথা ভাবতেই ওর মুখটা লজ্জায় মহিমময় হয়ে গেল। তোর জন্য আমাদের মন খুব খারাপ। কিছু ভালো লাগে না রে। বড় একঘেয়ে। সকালে স্কুল, বিকেলে দু’জনে আমরা টেবিল-টেনিস খেলি আর রাতে মাস্টারমশাই আসেন। এখানে আসার পর থেকেই বাবা আমাদের সঙ্গে বেশি কথা বলেন না। তারপর কিছু শব্দ অমলা কেটে দিয়েছে। এমনভাবে কেটেছে যে সোনা বুঝতে পারল না। আমরা আসার সময় তোর সঙ্গে দেখা করে আসতে পারিনি। সারা রাস্তায় আমরা কেঁদেছি। কারণ আগামী শীতে শুনেছি মা মরে যাবেন। খবর পেয়ে আমরা চলে এসেছি। এসে দেখি মা একটা সাদা বিছানায় শুয়ে আছেন। আমাদের চিনতে পারছেন না। সাদা চাদরের নিচে মায়ের নীল রঙের পা কি সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি, কমলা মায়ের সুন্দর পা ছুঁতেই দক্ষিণ জানালাটা খুলে গেল। দেখি সেখানে কারা একটা সিলভার ওক লাগিয়ে রেখেছে।

    কি যে হয়েছে মায়ের!

    চিঠিটা পড়তে পড়তে সোনার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

    মা এখন আমার জানালায় শুয়ে থাকেন। দক্ষিণের জানালাটা কারা খুলে রাখে। দুর্গের র‍্যামপার্ট জানালা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। মনে হয় বাবা আর মাকে কোনও কষ্ট দিতে চান না। মা যা ভালোবাসেন বাবা তাই করছেন। সারাদিন শুয়ে থাকেন। ওঠার ক্ষমতা নেই। গভীর রাতে রেকর্ডে বাবা কিছু ধর্মীয় সঙ্গীত বাজান, আমরা তখন ঘুমিয়ে থাকি। কোনও কোনও দিন ঘুম ভেঙে গেলে এসব টের পাই।

    সকালবেলাতে বাবা মাকে পাঁজাকোলে বারান্দায় নিয়ে আসেন। নার্সরা তখন কাছে থাকে না। রেলিঙের ধারে বসে থাকেন তিনি। যতক্ষণ না সিলভার ওকে রোদ এসে নামবে ততক্ষণ বসে থাকবেন। তারপর গাছটায় রোদ এসে পড়লেই বাবা আবার মাকে খাটে শুইয়ে দেন। যেদিন কলকাতার আকাশে রোদ থাকে না—সেদিন মায়ের যে কি কষ্ট! মার মুখ দেখলেই মনে হয় তখন, আজ অথবা কাল তিনি মরে যাবেন।

    কেন যে এমন হল সোনা!

    মা মরে গেলে আমরা কার কাছে থাকব সোনা!

    আমরা স্কুল থেকে এসে কিছুক্ষণ মায়ের পাশে বসি। বৃন্দাবনী মাকে সাজিয়ে দেয় রোজ। মা এখন আর বব চুল কাটেন না। চুল বড় হয়ে যাচ্ছে। বড় চুলে মাকে যে কী সুন্দর লাগে! মা গাউন পরেন না। সাদা রঙের সিল্ক, লাল পাড়ের সিল্ক, মা সিল্ক পরে সারা দিন বড় খাটে প্রার্থনার ভঙ্গিতে শুয়ে থাকেন। আমরা ডাকি, মা মা! মা আমাদের সঙ্গে কোনও কথা বলেন না। বুঝি শুধু দুর্গের র‍্যামপার্টে একটা নীল রঙের পাখি খোঁজেন।

    মা বড় করে সিঁদুরের টিপ পরেন। কিসের কবিতা মায়ের খুব পছন্দ। আমরা পায়ের কাছে বসে ছুটির দিনে কিসের কবিতা আবৃত্তি করি। মা শুনতে পান কি-না জানি না। বাবা বলেছেন, তোমাদের মা যা ভালোবাসেন তাই করবে। আমরা মাকে আবৃত্তি করে কবিতা শোনাই। সেই সব স্তবক যা মার খুব পছন্দ। বাবা সময়ে সময়ে যা-ই বলেন, সবই মাকে কেন্দ্র করে, বাবার সঙ্গে কার্ডিফের কোনও পার্কে মার প্রথম দেখা, বাবা মাকে কি বলতেন, বাবা ভারতবর্ষের মানুষ, বাঙালী, কলকাতায় তাঁদের বাড়ি, বাবা প্রথমে মাকে এমনই বলেছিলেন। বাবা বলেন, জানি না তোর মা কলকাতা বললেই বিষণ্ণ চোখে তাকাত।

    যেমন সেই স্তবক–

    I made garland for her bead And bracelets too And fragrant zone; She looked at me as she did love, And made sweet moan.

    সোনা কবিতার কোনও অর্থ ঘরতে পারল না। সে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ল। সোনার স্মৃতিশক্তি প্রবল। সে দু’বার পড়তে না পড়তেই কবিতাটা মুখস্থ করে ফেলল।

    চিঠিটা পড়তে পড়তে এক সময় সোনা নিজেই কেমন একটা গাছ হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছে সে স্থবির হয়ে যাচ্ছে। কারণ তার মা বিছানায়। মার অসুখ। কিছু খায় না। আগামী শীতে কি তার মাও মরে যাবে! অমলা আমি কী করি! আমিও কী মার পায়ের কাছে বসে থাকব। সেই অন্ধকার ঘরে, অমলার সাপ্টে ধরা, ওর ভালো লাগা এবং নদীর কাছে গিয়েও পাপ কাজের কথা বলতে না পারা, বলতে পারলে নদী অর্থাৎ এই জল, জল মানেই জীবন, জীবন হচ্ছে প্রাচুর্যের দেবতা, দেবতা তাকে পাপ থেকে মুক্তি দিতেন। অসময়ে তুমি, সোনা, নদীর পাড়ে হেঁটে গেলে। বন্যা এসে তোমাকে ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে। সোনা নিচে নেমে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। সে বুঝতে পারছে ভিতরে ভিতরে তার বড় কষ্ট হচ্ছে। মার পায়ের কাছে বসে কমলা অমলা আবৃত্তি করছে। সে কী করবে! মা বলেছে তাকে আমলকী ফল নিতে। সে খালপাড়ে এসে প্যান্ট খুলে ফেলল। তারপর খাল পার হয়ে ফের প্যান্ট পরে ছুটল। ঘুরে গেলে রাত হয়ে যাবে। সে খাল পার হয়ে সোজা ঢুকে গেল মাঝিবাড়ি। কিছু আমলকী ফল নিয়ে গাঁয়ের পথে বাড়ির দিকে ছুটে চলল।

    সে ঘরে ঢুকেই মায়ের শিয়রে দাঁড়াল। সে খুব হাঁপাচ্ছে। যেন ভয় পেয়ে সে ঘরে ঢুকেছে। অথবা কেউ ওকে পিছনে তাড়া করেছে।

    ধনবৌ ছেলের কাতর মুখ দেখে বলল, তর কি হইছে?

    সোনা কিছু বলল না। সূর্য অস্ত যাচ্ছে খেলার মাঠে। জানালাগুলি খোলা। দিনের আলো মরে আসছে। সে ফলগুলি মায়ের হাতে দিল।

    ধনবৌ ভেবেছিল, সোনা আমলকী না বলে এনেছে। মাঝিদের কেউ ওকে কিছু বলতে পারে। সে তাই ছুটে পালিয়ে এসেছে। তাই বলল, অরা কিছু কইছে তরে?

    —না মা। কিছু কয় নাই।

    কিন্তু অদ্ভুত, সোনা কিছুতেই ফল হাতে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে না। মায়ের শিয়রে চুপচাপ বসে রয়েছে। ধনবৌ অপলক ছেলের মুখ দেখছে। সোনা যেন কিছু বললেই কেঁদে ফেলবে। ধনবৌ মাথায় হাত রেখে বলল, কী রে, তুই কথা কস না ক্যান? কথা না কইলে আমার ভালো লাগে!

    এ-সময় বড়বৌ ঘরে এসে ঢুকল। সোনা শিয়রে বসে রয়েছে। চুপচাপ। মাথা গোঁজ করে হাঁটুর ভিতর মুখ রেখে বসে রয়েছে।

    —ধন, তুমি রাতে কি খাবে?

    —কিছু খামু না বড়দি।

    —কিছু না খেলে চলবে কেন! তোমার জন্য পাতলা করে কই মাছের ঝোল করে দিচ্ছি। দুটো হেলঞ্চার ডগা ফেলে দেব। খেতে ভাল লাগবে। শিয়রে লেবুর পাতা রেখে গেলাম। ওক উঠলেই পাতা শুঁকবে। তারপর সোনার দিকে তাকিয়ে বলল, সোনা, তুমি খেলতে গেলে না?

    সোনা এবারেও জবাব দিল না। সে মাথা গুঁজে একগুঁয়ে বালকের মতো বসে থাকল।

    বড়বৌ ধনবৌকে বলল, ওর হয়েছে কি?

    —কি কই কন। চুপচাপ বইসা আছে। কথা কইলে জবাব দেয় না।

    —তুই ওকে বকেছিস?

    —না দিদি।

    —তবে ও এমন শক্ত হয়ে বসে আছে কেন?

    —জানি না।

    –সোনা এস। বলে বড়বৌ ওকে টেনে তুলতে চাইল। কিন্তু সে মায়ের শিয়র থেকে কিছুতেই উঠল না।

    বড়বৌ বলল, ছোটকাকাকে ধরে নিয়ে গেছে! তাতে কি হল! ওরা কিছু করতে পারবে না, আবার চলে আসবে।

    কিন্তু সোনা একইভাবে বসে থাকল।

    বড়বৌ ভাবল, তবে কি রঞ্জিত নেই বলে! সে বলল, তোর মামাকে ধরে সাধ্য কার! ধরা পড়লে তো ওর ফাঁসি হবে! বলতেই বুকটা কেঁপে উঠল বড়বৌর।

    এবং সোনার প্রতি বড়বৌ আরও কোমল হয়ে গেল। চল বাইরে। দেখ তো তোর জ্যাঠামশাই

    কোনদিকে গেছেন। খুঁজে আনতে পারিস কিনা।

    সোনার ভ্রূক্ষেপ নেই। সে উঠল না।

    বড়বৌ কেমন বিরক্ত গলায় বলল, কি হয়েছে সোনা, কেউ তোমাকে কিছু বলেছে?

    সোনা বলল, না।

    —তবে এভাবে বসে আছ কেন! খেলতেও যাওনি কেন! শরীর খারাপ?

    সোনা ফের নির্বাক। এই অসময়ে সোনা ঘরের ভিতর মায়ের শিয়রে চুপচাপ বসে রয়েছে। এভাবে বসে থাকা ভালো না। এবার বড়বৌ বলল, দ্যাখ তো সোনা তোর ঈশম দাদা তরমুজের খেত থেকে উঠে এসেছে কি-না?

    কিছুতেই কিছু সে শুনল না। সে যেমন মায়ের শিয়রে বসেছিল, তেমনি বসে থাকল। মার কপালে ওর হাত। কী ঠাণ্ডা মার কপাল, শরীর! মা তার নিশিদিন বমি করে কেন! মাঝে মাঝে সে দেখেছে বমি করতে করতে মার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে কোনও কোনওদিন শিয়রে দাঁড়িয়ে মাকে বাতাস করেছে। বড় জ্যেঠিমা দুধ গরম করে দিয়েছেন। দুধ খেয়েই মা হড় হড় করে সব ফের তুলে দিয়েছে। একবার গোপাল ডাক্তার এসেছিল। মায়ের অসুখ দেখে জ্যেঠিমাকে হাসতে হাসতে কি বলে গেছে। তখন মনে হয়েছিল তার, চুরি করে ডাক্তারের সাইকেল পানচার করে দেবে। সোনাকে এমন শক্ত থাকতে দেখে ধনবৌ পর্যন্ত উঠে বসেছে। মা তার সব টের পায়। মা বলল, আমার কিছু হয় নাই সোনা। এই যেই না বলা, সোনা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

    —আমলকী ফল খাইলেই ভালো হইয়া উঠুম।

    বড়বৌ এবার হাসতে হাসতে বলল, সোনাবাবুর সে জন্য কান্না। হ্যাঁ রে, তোর মার কিছু হয় নি। তোর এবার দেখবি বোন হবে একটা। বোকা। বলে সোনাকে জোরজার করে চৌকি থেকে তুলে আনল। বোকা কোথাকার। তা তুমি বলবে তো ধন। সোনার দিকে তাকিয়ে বলল, সেজন্য তুই মার কাছে বসে আছিস! আয়। বড়বৌ সোনাকে বাইরে নিয়ে গেল। সে জ্যেঠিমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ টলটল করছে।

    —বিশ্বাস হচ্ছে না?

    ঈশম এতক্ষণে চলে এসেছে। সে বলল, তাই নাকি! এর লাইগ্যা কান্দন!

    কী যেন এক পুলক শরীরে। আনন্দে সোনার ভিতরটা সহসা আকাশের নিচে খেলা করে বেড়াতে চাইল। সে ঈশমের কথায় ফিক্ করে হেসে ছুটে পালিয়ে গেল।

    ঈশমও ছুটে গেল সোনার পিছনে। সে এসে ওকে নদীর চরে আবিষ্কার করল। কিছু খড়কুটো পাতার দরকার ছইয়ের নিচে। সে হাঁটতে হাঁটতে ছইয়ের দিকে গেল। সোনাকর্তাকে কিছু বলল না। ছোট্ট বাবুটি এখন নদীর চরে ঘাসের ওপর বসে আছে। আনমনা। নদী জল আকাশ দেখছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }