Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১০

    ২.১০

    এর ভিতর সেদিন দু’জন মানুষ এসেছিল ফেলুর বাড়ি। মাথায় তাদের কালো রঙের টুপি। লাল রঙের পুচ্ছ টুপিতে। কালো রঙের পাতলা সস্তা আদ্দির পাঞ্জাবি। নিচে কালো গেঞ্জি। গেঞ্জিটা ভেতর থেকে জেল্লা মারছে। পরনে খোপ-কাটা লুঙ্গি। পাতলা নুর থুতনিতে। ওরা এসে লম্বা কাফিলা গাছটার নিচে দাঁড়াল। গরুর ঘরটা ফেলুর এখন খালি পড়ে আছে। আর একটা ঘর সম্বল। শোলার বেড়া ঘরে। নাড়া দিয়ে আন্নুর জ্বালায় একটা আতাবেড়া পর্যন্ত করতে হয়েছে। একটু আড়াল না করে রাখলে বিবি ধনেখালি শাড়ির মতো। চিৎপাত হয়ে থাকে খালি উঠোনে। যারা পথ দিয়ে যায়—এক খুবসুরত বিবি বান্ধা আছে এই ঘরে, ওরা চোখ মেরে যায়। ফেলু এটা বোঝে। এখানে, এই বড় কাফিলা গাছটার নিচে এলেই শালা মনুষ্য জাতির লোভ বেড়ে যায়। উঁকি দিয়া দ্যাখে—ফেলু বাড়ি আছে কি নেই। বিবিটা তার কি করছে! দেখে ফেললে আন্নুকে, লোভে দু’ঠোট চুকচুক করতে থাকে। হালার কাওয়া!

    সে সেজন্যে এক হাতেই সব ঠিকঠাক করে রাখছে। কেউ যেন তার বিবিকে যখন তখন দেখতে না পায়, চারপাশে নাড়ার বেড়া, সব সময় বিবি ভিতরে থাকুক এমন ইচ্ছা তার। এটা শীতকাল নয়। গ্রীষ্মের দিন। এ-দিনে বড় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে যায়। কারণ সেই যে সূর্য মথার উপরে উঠে কিরণ দিতে থাকে, কিছুতেই আর পশ্চিমে নেমে—হালার কাওয়া, অস্ত যেতে চায় না। চারপাশটায় যত জমি সবই রোদে খাঁ খাঁ করছে। গাছের পাতা ঝরছে। উড়ছে। পুকুরের জল শ্যাওলায় নীল রঙ। নদীতে পায়ের পাতা ডোবে না। মানুষের দুর্দিন বলতে যা বোঝায়, একটা পাতা পর্যন্ত পড়ে থাকে না গাছের নিচে। গরিব-দুঃখী মানুষেরা সব গাছের পাতা সংগ্রহ করে রাখছে। বর্ষার দিনে আগুন জ্বালাবে বলে। সারাদিন এখন আন্নু পাতা জড়ো করছে বাঁশ ঝাড়ের অন্ধকারে। আতাবেড়ার আড়ালে বলে ফেলুর পরাণে ডর থাকে না। ফেলুর বাঁ-হাতটা উড়ে গিয়ে যে ঘা-টা হয়েছে, কিছুতেই শুকোচ্ছে না। এখন প্রায় কুষ্ঠের আকার ধারণ করেছে। সারাক্ষণ ভনভন করে মাছি বসছে। সে বসে গামছা দিয়ে ঘায়ের মাছি তাড়াচ্ছিল তখন। আর ঘা-টাতে গরম রসুন গোটার তেল লাগাচ্ছিল। ঘায়ের ভিতরটা সারাক্ষণ জ্বলে। খাঁ খাঁ করে দাবদাহের মতো। হেকিমি কবিরাজিতে কাজ দিল না। গোপাল ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল চুপি চুপি ওষুধ আনতে। কিছুতেই কিছু হয়নি। মূলে আছে এর এক মানুষ। পাগল মানুষ মুড়াপাড়ার হাতি দিয়ে মানুষটা তার এমন শক্ত শরীর বিনষ্ট করে দিল। সে যে কী করে! হালার কাওয়া, এখন বাতাসে ফুঁ দিয়ে পাখি ওড়ান। পদ্য কন দুই চাইর লাইন। মেম সাহেবানির কইলজা চিবাইতে না পাইরা গাছের নিচে থাকেন বইসা। হেসে কন গ্যাৎচোরেৎশালা। মাইনসে কয় সাধুসন্ত। ফকির! পীর হইতে পারেন। ফেলু কয়, ঐ হালার কাওয়া যত নষ্টের গোড়া।

    তখন সে দেখল, কাফিলা গাছটার নিচে মোল্লাজানের মতো দুই মানুষ। ফিফিক্ করে দুই গালের ফাঁকে হাসছে। ফেলু মানুষ দু’টাকে দেখেই দ্রুত চোখ নামিয়ে আনল। আবার দুই মোল্লা মোতাবেক মানুষ। তারা কেন এসেছে সে জানে। গত সালেও একবার এসেছিল ওরা। সে সেদিন হাঁসুয়া নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল। সে শালা কারে ডরায়। সে টুণ্ডা ফেলু। তবু মনের রোগটা ঠিক বেঁচে আছে। এখনও ফেলু হাঁক দিলে আন্নুর কলিজা কাঁপে। সে তেমনি হাঁকল, কেডা মিঞা গাছের নিচে খাড়াইয়া আছেন?

    —আমি ভাইসাব আমিনুল্লা।

    —আবার কি মনে কইরা?

    —আইছিলাম একবার আকালুসাবের খুঁজে।

    —তা সাহেব কি উঠানে আমার খাড়াইয়া আছে?

    —তা ঠিক না!

    —তবে কি ঠিক! উঠোনে পাখি খুঁইজা বেড়ান?

    ওরা এবার আমতা আমতা করতে থাকল।

    —মিঞা, মনে করেন বুঝি না কিছু?

    —তা ঠিক না! মনে হইল একবার ফ্যালু মিঞার খবর নিয়া যাই।

    —তা ভাল কাম করছেন। তামুক খান তাইলে।

    —খাই তবে। যখন কইলেন খাইতে।

    ফেলুর চোখটা এবার আতাবেড়ার ও-পাশে উঠে গেল। আন্নুটা আবার মানুষের গলা পেয়ে উঁকি দিচ্ছে কি-না! উঁকি দিলেই সে যদি হাতের কাছে হাঁসুয়া পায় তবে ফিকে দেবে বেড়ার ফাঁকে। এমন চোখেমুখে যখন ফেলু আতাবেড়ার দিকে তাকাচ্ছে, তখন আমিনুল্লা বলল, নাই।

    চমকে উঠল ফেলু।—কি নাই?

    —আকালুসাব নাই।

    —নাই ত কই গ্যাছে! ফেলুর পরাণে জল এল।

    —গ্যাছে নারায়ণগঞ্জে।

    —গ্যাছে ক্যান?

    —তা পয়সা থাকলে মামলা করবে না! আপনের মত গাছের নিচে খাড়াইয়া থাকব?

    —সেই কথা।

    ওরা এসে এবার নির্ভয়ে হোগলার ওপর বসল।

    —নেন, তামুকটা টান দ্যান। নিবা যাইব।

    আমিনুল্লা বলল, আপনের ভাইসাব কড়া তামাক পছন্দ

    ফেলু দেখল বিবিটা কোথায় এখন! বলল, বড় পছন্দ। তারপর সে ডান হাত দিয়ে গামছায় আড়াল করা ঘা থেকে মাছি তাড়াল। ফেলুর শরীর থেকে কেমন একটা পচা গন্ধ উঠছে। ফেলু বুঝি টের পেয়ে গেছে বিবি মানুষের গন্ধ পেয়ে বাঁশ ঝাড়ের নিচে থেকে উঠে এসেছে। কোন এক অদৃশ্য স্থান থেকে সে তাজা মানুষদের দেখছে।

    ফেলু উঠে যাবার সময় ওরা দেখল, সে তার ঘা-টা গামছার আড়ালে ঢেকে রেখেছে। ওরা বুঝতে পারল দুর্গন্ধ উঠছে ঘা থেকে। তা’ছাড়া ওরা এই হাতটা কবে গেল জানে না। ওরা জানত, এই মানুষের হাত পাগল ঠাকুর হাতি দিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন। বাঁ-হাতের কব্জি কতকাল ফুলেফেঁপে ছিল। তারপর হাতটা একদা শুকিয়ে গেল। শুকনো লতার মতো হাতটা ওর শরীরে দুলত। হাতটার কোন ধর্মকর্ম ছিল না। কোন বোধ ছিল না। রক্ত চলাচল না হলে যা হয়। সেই হাত ওর ব্যাঙের লেজের মতো করে খসে পড়েছে কেউ জানে না। সে সারাক্ষণ বাঁ দিকের হাতে একটা গামছা ফেলে রাখে। কাঁধের নিচে লাল দগদগে ঘা। ঘা দেখে ওদের শরীর কেমন গুলাতে থাকল। এত বড় একটা ঘা নিয়ে মানুষটা বেঁচে আছে কী করে! ওরা এসেছিল এই পথে আন্নুকে একবার দেখবে বলে। বিবি নাকি এ-তল্লাটে চান্দের লাখান মুখখান আর আকালুসাব আছে বিবির পিছনে এবং ফেলু এই বিবিকে নিয়ে রাত-বিরাতে ঘাস বিচালি ধানের ছড়া, মটর দানা যা পায় জমি থেকে চুরি করে আনে।

    ফেলু ভিতরে কী যেন খোঁজাখুঁজি করতে গেছে। সে ফের আসছে। কলকিতে আগুন। সে ফুঁ দিয়ে দিয়ে আসছে কলকিতে। আর একটা চোখ ওর সজাগ, সে গোপনে দেখছে দুই মিঞার চক্ষু কি কয়, কোন দিকে চক্ষু তাড়া করে। বিবি তার বড় লবেজান। ওরা এসেছে চুরি করে বিবিকে দেখে যাবে বলে। এরা সবাই আকালুর বান্দা। আকালুকে খুশি করতে পারলে এই ইবলিশদের আর কিছু লাগে না। তবু ডেকে তামুক সেবন, যেন আল্লা মেহেরবান বলে বসে যাওয়া মুখোমুখী, তারপর হাঁক দেওয়া— তোমরা মিঞা মনে কর আমি কিছু বুঝি না?

    না কী সে মনে মনে আকালুকে ভয় পায়। ভয় পায় বলে ডেকে এনেছে—বইসা যান মিঞা, গরীবখানায় বইসা যান। আবার কখনও কখনও ফেলুর মনে হয় ওরা সব এসেছে গরু-ছাগলের ব্যাপারির মতো। আকালুই হয়তো পাঠিয়েছে। জমি বাড়ি সব তার বন্ধক। তালাকনামা লিখে দিলে যদি বন্ধক ছুটে যায়, সব মিলে যায়, তবে মন্দ হয় না। এবং দুই বিঘা ভুঁই মিলে গেলে সে কিছু একটা ফসল করে বাকি দিন গুজরান করে ফেলতে পারবে। ওরা ব্যাপারির মতো খোঁচা দিয়ে দেখতে চায় ফেলুর বিবির দামদর কত

    কিন্তু মিঞা দু’জন ফুতফাত তামুক খেয়ে বসে থাকল। কিছু আর বলছে না। ওরা আতাবেড়ার ফাঁকে আন্নু বিবির মুখ দেখে ফেলেছে। দেখেই কেমন গুম হয়ে গেছে। ঘরে য্যান শয়তানটা একটা পরী মন্ত্র পড়ে বেঁধে রেখেছে। ডানা কেটে দিয়েছে। উড়তে পারছে না। কষ্টে বিবির চোখ মরা গাঙের মতো। বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিয়েই আন্নু অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু আতাবেড়ার ও-পাশ থেকে কচ্ছপের মতো গলা বের করেছিল। আর কিছু ওরা দেখতে পায়নি। আন্নু আর অধিক বের করতে পারে না। ওর গায়ে ফুটা-ফাটা হাজার রকমের তালিমারা শাড়ি।

    একবার আকালু একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল। শাড়ি দেখে ফেলু তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিল। এবং যা হয়, কেউ কিছু দিলেই আন্নুর পিঠ আর ঠিক থাকে না। ভয়ে আন্নু তেল সাবান, গন্ধ তেল এবং চিরুনি খড়ের গাদায় লুকিয়ে রাখে! পরবের দিনে অথবা মানুষটা মেঘনাতে ঢাইন মাছ শিকারে গেলে পটের বিবি সেজে বসে থাকে আকালু কখন আসবে। অবশ্য আন্নু জানে ফেলু কোনও নির্দিষ্ট তারিখে ফিরে আসে না। আগে অথবা পরে আসে। ফেলু ফেরার আগেই সে ফের তার টুটা-ফাটা শাড়ি অথবা গামছা পরে বাঁশঝাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে।

    ফেলু ফিরেই শুকনো মুখ দেখে বলবে, তুই এহানে বিবি?

    —তোমার লাইগা মনডা বড় কান্দে।

    আর সেই ফেলুর এখন কিছুই নেই। সে মেঘনা নদীতে আর ঢাইন মাছ শিকার করতে যেতে পারে না। সে টের পায় বিবি তার কাছে আসে না। কেবল দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। দুর্গন্ধে টেকা দায় এমন চোখমুখ তার। এখন বিবি কেবল আকালুর বিবি হতে চায়। আকালুর বিবি হওয়ার জন্য সে হাতে পায়ে ধরে কাঁদতে পারত, আমাকে তালাক দ্যাও মিঞা, আমি যাই সাগরেরি জলে, তুমি আমারে ছাইড়া দ্যাও। কিন্তু পারে না। প্রাণে বড় ভয়। মান্ধাতা আমলের কোরবানীর চাকুটার ভয়। সেই ভয়ে বাড়ির চারপাশটায় বিবি ঘুরঘুর করে। বিবি তার হকের ধন। আন্নু তার দু’বিঘা জমি-জিরাতের মতো। ওর বাড়িঘরের মতো সে বিবিকে ভোগের নিমিত্ত পেয়েছে। তার ভোগ শেষ না হলে কোন শালা লেবে! যেমন তার দুটো মাটির সানকি, একটা পেতলের বদনা, বাঁশঝাড়, পাটকাঠির ঘর, উড়াট জমি, এক বিবি, সে তো দশটা পাঁচটা বিবি রাখেনি ঘরে, তবু তার এই সামান্য সম্পত্তির জন্য কি লোভ আকালুর! তার হাত গিয়ে সে এখন এটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সে মরলেই আকালু তাজিয়া নাচাবে উঠানে। ফেলু এবার বলল, তা মিঞা আকালু মামলা করতে গ্যাল ক্যান?

    কালু মিঞা বলল, ওডা তো তোমার জানার কথা।

    —আমার জানার কথা! কি যে কন! ফেলু একেবারে বিনয়ের অবতার বনে গেল। সে যে এ-সব টের পায় না তা নয়। সব টের পায়। এই দুই হোমন্দির পুত আইছে আকালুর পক্ষে। আকালুর ছিনালি করতে আইছে।

    আমিনুল্লা মোল্লা মোতাবেক বলল, গ্যাছে তোমার নামে এক নম্বর ঠুইকা দিতে।

    ফেলু চোখ বড় বড় করে ফেলল। সে মামলা মোকদ্দমাকে বড় ভয় পায়। ওর নামে মামলা রুজু করলেই দু’দিন পর পর ছোটো নারায়ণগঞ্জে। তার তাজা বিবিটা একা একা থাকবে। ফাঁক বুঝে তাজিয়া নাচাবে আকালু। সে ভীষণ শক্ত হয়ে গেল। সে মামলা করতে গেলে বিবিকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। তবু সে মামলার নামে ঘাবড়ে গেল। তার এখন প্রায় ভিক্ষা সম্বল। তার নামে এতবড় মানুষটা মামলা করতে গেল!

    বস্তুত এই আমিনুল্লা আর কালু মিঞা এসেছিল যেনতেন প্রকারেণ ফেলুকে ঘাবড়ে দিতে। বুদ্ধিটা আকালুসাবেরই। সে-ই ফেলুকে যখন তখন ভয় দেখাতে বলছে। টাকার জোরে আকালু বাজি ফাটাচ্ছে। আকালুর দল ভারি, সে পঙ্গু, তার অর্থবল নেই। সে গরিব। সে আকালুর কাছে কিছু না। তবু সে তার পিছনে কেন লাগে! একটা বিবি তার।—দ্যাশে কত খুবসুরত বিবি আছে মিঞা। তোমার টাকার অভাব নাই। শহরে যাও, ধইরা আন। ফেলু বড় অসহায় বোধ করল। এই কামডা ভাল না মিঞা। ফেলু এক হাত তুলে মোনাজাত করল আল্লার কাছে। আমি অমানুষ আল্লা। তুমি আমার কসুর ক্ষেমা দিয়। বিবিরে নিয়া রঙ্গ তামাশা করে না য্যান। গলার নালি হ্যাৎ কইরা দিমু তবে ছিঁড়া।

    আমিনুল্লা বলল, তা মিঞা কথা কওনা ক্যান?

    —কি কমু কন?

    —একটা ফয়সালা কইরা ফ্যাল। আকালুসাব নেতা মানুষ, তার লগে তুমি পার?

    —কি ফয়সালা?

    —তালাকনামা লিখা ফ্যাল। গোপনে কাজটা হইয়া যাউক।

    ফেলুর মনে হল বজ্রাঘাত মাথায়। অথবা মনে হচ্ছে ওর মাথায় কারা হাতুড়ি পেটাচ্ছে। সে সেই দিনের মতো উঠে দাঁড়াল। ঘা-টা গামছায় ঢাকা। তবু মাছি ভনভন করছে। খড়ি উঠে গেছে শরীরে। তার শরীর সেই আদ্যিকালের একটা গাছের মতো। ডালপালা ভেঙে গেছে। তবু সে মহাসমারোহে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। মহাসমারোহে পৃথিবীর ঝড় জল রোদ সহ্য করতে করতে সহসা নিজের ভিতর দুটো হাত গজিয়ে নিতে ইচ্ছা হচ্ছে। সে আর পারছে না। ভয়ঙ্কর কঠিন উক্তি ওর মুখে এসে গেছিল। সে তা প্রকাশ করল না। করলেই ওরা পালাবে। সে ঘরের ভিতর টলতে টলতে ঢুকে গেল। তখন দুই মিঞা বুঝতে পারল ফেলু ক্ষেপে গেছে। ওরা উঠানে এখন বসে থাকলে এই দিনের বেলাতেই সে হাঁসুয়া নিয়ে গলা দু’খান করে দেবে। ফেলু যত সত্বর ঘরের দিকে ছুটে যাচ্ছে তার চেয়ে দ্রুত ওরা মাঠে দৌড়ে নেমে গেল।

    ফেলু ঘর থেকে বের হয়ে দেখল ওরা উঠানে নেই। হাতে ওর সেই কোরবানের চাকুটা। উঠানের এক কোণে ওর বাগি গরুটা ফেলুকে জাবর কাটতে কাটতে দেখছে। ফেলু উঁকি দিয়ে কী যেন মাঠে খুঁজছে। উঠানের চারপাশে তাকাচ্ছে। ফেলু তাকাতেই দেখল জাফরি যেন সব বুঝে গেছে। সে তার বাগি গরুটাকে বলল, দুই মিঞা কোনদিকে গ্যাল জাফরি! গলার নালিতে কত খুন আছে একবার দ্যাখতাম।

    বাড়ির শেষে ফেলু বড় কাফিলা গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। গাছটা থেকে আঠা পড়ে পড়ে গোড়া আর চেনা যায় না। ডালপালা নেই, পাতা দুটো একটা। দেখলে মনে হয়, গাছটা মরে গেছে। শুধু ফেলু জানে গাছ ভিতরে তেমনি তাজা, এখনও এক কোপে কত আঠা যে ওগলায়। গাছটা মাথায় খুব লম্বা নয়। খুশি মতো ফেলু ডালপালা কেটে বাড়ির চারাপাশে বেড়া দেয়। কাণ্ড এখনও এত নরম যে সে একবার শাবল দিয়ে গাছটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল। সে এই গাছটার নিচে এসে দাঁড়ালেই বড় মাঠ দেখতে পায়। আর দেখতে পায় সেই ষণ্ড। সে দেখল আজ দুই মিঞা ভয়ে প্রায় মুখপোড়া যণ্ডের মতোই লুঙ্গি তুলে ছুটছে। সে এবার চিৎকার করে উঠল, অঃ হালার পো হালারা, কুত্তার মত পালাও ক্যান। খাড়াও। দ্যাহি মরদখানা ক্যামন! বিবিরে নিয়া আমার তাজিয়া নাচাইতে পার কিনা দ্যাহি!

    তখনই দেখল ফেলু কোত্থেকে সেই ধর্মের ষণ্ড মাথা নিচু করে উঠে আসছে। কালো রঙ! কী কালো, প্রায় ঈশান কোণের কালবোশেখিতে মেঘের রঙ এমন হয়। দুই শিঙ তরবারির মতো আকাশের দিকে উঠে গেছে। কী ধারালো, নিমেষে সে বসুন্ধরা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে যেন।

    ফেলু তার এক চোখে দেখছে যণ্ডটাকে। ষণ্ড ও-পাশ থেকে আর এক চোখে দেখছে। ফেলু একটা গোলাপফুলের মতো কোরবানীর চাকুটা দু’আঙুলে ধরে রেখেছে। ষণ্ডটা এতক্ষণে ফেলুকে হয়তো তেড়ে এসে কাফিলা গাছটায় গেঁথে দিত—কিন্তু হাতে এক কোরবানীর চাকু। দেখলেই যণ্ড টের পায়, বড় ধারালো ওটা, গলার ভিতর ঢুকিয়ে দিলে নালি ফাঁক। যেন ফেলু ওটা একটা গোলাপফুল তুলে এনেছে বাগান থেকে। আও মিঞা, খাড়াইলা ক্যান। বাগিচা থাইক। তোমার লাইগা ফুল তুইলা আনছি। আও। আও। বলে এক হাতে ফেলু ষণ্ডটাকে উদ্দেশ্য করে উরু থাবড়াতে থাকল। আর চাকুটাকে নাচাতে থাকল হাওয়ায়।

    ষণ্ড নিমেষে বেমালুম ভালোমানুষ হয়ে গেল। শিঙ দিয়ে আর মাটি তুলল না। গোঁত্তা খেল না আর মাটিতে। সরল যুবার মতো হেঁটে পাখপাখালি দেখতে দেখতে নেমে যেতে থাকল। যেন এক পোষমানা জীব, ফেলুকে দেখেই মাঠে ঘাস খেতে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু ফেলুর কেমন দুই মিঞাকে কাছে না পেয়ে জিদ চড়ে গেল। মিঞার বদলে এই ষণ্ড। সে মাঠে নেমে লড়াই করবে, সে হাঁকল, হাঁ হাঁ হাঁ। ষণ্ডটা এবার ঘুরে দাঁড়াল। মাঠের দুই পাশে দুইজনা। দুই জীব। আদিম এবং উৎকট চোখমুখ দুই জীবের। ফেলুর নেই ডানদিকের চোখ, যণ্ডের নেই বাঁ দিকের চোখটা। জীবের চার পা। ফেলুর দু’পা, একহাত এখন ওরা এত কাছাকাছি যে উভয়ে উভয়ের অর্ধেকটা দেখছে। সবটা দেখতে পাচ্ছে না। ফেলু এখন যেন চিনতেই পারছে না, এটা জীব না অন্য কিছু। কী তার ধর্ম, কী তার স্বভাব। যণ্ডটাও বুঝতে পারছে না। সামনের জীবটা মানুষ, না পীর, না ইবলিশ! যণ্ডের মনে হল, হালার আজব জীব। সে ভয়ে লেজ খাড়া করে বিলের দিকে ছুটতে থাকল। পথে আসছিলেন তারিণী সেন। তারিণী কবিরাজ। ঘোড়ায় চড়ে আসছেন। এত বেশি জোরে ছুটছে ষণ্ড যে তারিণী সেনের ঘোড়া পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেছে।

    ফেলু জোরে জোরে হাঁকল, হাজিসাব, আপনের ষণ্ড আমারে ডরাইছে।

    .

    তারিণী কবিরাজ যাচ্ছেন ঠাকুরবাড়ি। বুড়ো ঠাকুরের এখন-তখন অবস্থা। সঙ্গে রেখেছেন মকরধ্বজ। পকেটের ভিতর ঘোড়ার পিঠে কত রকমের সব লাল নীল রঙের বড়ি। ঘোড়ার পিঠে তারিণী কবিরাজ উঠছেন আবার নামছেন। মাঠের উপরে এমন একজন মানী লোককে আসতে দেখে সে ভাবল একবার যাবে কবিরাজমশাইর কাছে। হাতের ঘা-টা তাকে দেখাবে। এই না ভেবে সেও ঘোড়ার পিছনে লেজ খাড়া করে ছুটতে থাকল।

    .

    সকাল থেকেই বাড়ির ভিতরে সবাই ব্যস্ত। সোনা অর্জুন গাছের নিচে এসেছিল পাগল জ্যাঠামশাইকে ডেকে নিয়ে যেতে। তিনি গাছটার নিচে বসে আছেন। কিছুতেই বাড়ির ভিতর যাচ্ছেন না। সোনা নিয়ে যেতে না পারলে বড়বৌ আসবে। তখনই সে দেখল সম্মান্দীর তারিণী কবিরাজ ঘোড়ায় চড়ে আসছেন। সে জ্যাঠামশাইকে ফেলে ছুটে গেছে বাড়িতে—তারিণী দাদা আইতাছেন। বড়বৌ এবং শচীন্দ্রনাথ খবর পেয়ে উঠানে নেমে এলেন। নরেন দাস ছুটে এল। কবিরাজমশাই বড় ঘরে ঢুকে বললেন, ঠাকুরদা, কেমন আছেন?

    বড়বৌ সব উত্তর দিচ্ছিল কবিরাজমশাইকে। কারণ বৃদ্ধ মানুষটির কথা বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল ভোরে তিনি সবাইকে কাছে ডাকলেন। বড়বৌ, শচি, শশীবালা, ধনবৌ সবাইকে। তাঁর বড় ইচ্ছা নৌকাবিলাস পালাগান শোনার। মহজমপুরের যোগেশ চক্রবর্তীকে খবর দিতে হবে। ঈশম যাবে ভাবছিল—তখনই হঠাৎ চোখ বুজে যেন কী বুঝতে পারলেন, বললেন, না দরকার নেই। কাল আমার একশ বছর পূর্ণ হবে। তোমরা আত্মীয়স্বজন সবাইরে খবর দ্যাও। তারপর থেকেই হৈচৈ বাড়িতে। তিনি বলেছেন, পরদিন ভোররাতে সবার মায়া কাটাবেন। আর সবুজ বনে মৃত বৃক্ষ হয়ে বেঁচে থাকবেন না।

    ফেলু দৌড়ে এসেছিল গোপাট পর্যন্ত। সে আগে এসে ধরতে পারল না। ঠাকুরবাড়ি সে কোনও দিন উঠে যেতে সাহস পায় না। সে হারমাদ মানুষ। ওকে দেখলেই ভয় পায় সকলে। সে সেজন্য গোপাটের মাদার গাছের নিচে বসে থাকল, কখন কবিরাজমশাই আবার ঘোড়ায় চড়ে গোপাটে নেমে আসবেন।

    তারিণী সেন বললেন, ঠাকুরদা, আমি তারিণী। কি কষ্ট হইতাছে কন!

    মহেন্দ্ৰনাথ হাত সামান্য ওপরে তুলে ইশারায় যেন বললেন, কোনও কষ্ট না। এখন তাঁর সব কৃপা। তোমরা আর আমাকে তাড়না করবে না, এমন মুখচোখ তাঁর।

    শচি বললেন, তারিণীকাকা, কি মনে হয়?

    —টিকব না। যা কইছে ঠিকই কইছে।

    —কিছু খাইতে চায় না।

    —সবাই কাছে বইসা থাক। অষুধ দিয়া আর কোন দরকার নাই।

    মন মানে না। বড়বৌ বিকেলে ঈশমকে পাঠিয়ে দিয়েছিল তারিণী কবিরাজের কাছে। তিনি প্রবীণ মানুষ। প্রবীণ বদ্যি। তিনি এই সংসারের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত। এবং প্রায় আত্মীয় সম্পর্ক। সেই থেকে মানুষজন সব পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, আত্মীয়স্বজন যা আছে সবার কাছে এবং তারিণী কবিরাজকে খবরটা দিতে বলা হয়েছিল। খবর পেয়েই চার ক্রোশ পথ ঘোড়ায় চড়ে চলে এসেছেন। ঈশম আসেনি। সে আসবে দক্ষিণে যত আত্মীয়স্বজন আছে তাদের খবর দিয়ে। হারান পাল গেছে উত্তরে, নরেন দাস গেছে পুবে আর শশীমাস্টার গেছেন মুড়াপাড়া। তিনি যাবার সময় গোলাকান্দাল, পেরাব, পোনাব এবং দূরে দূরে যে সব গ্রামে আত্মীয়স্বজন আছে সবাইকে খবর দিয়ে চলে যাচ্ছেন—তিনি বলে যাচ্ছেন, মুড়াপাড়া যাচ্ছি। ঠাকুরের দুই ছেলে আছে তাদের খবর দিতে! ঠাকুরকর্তা আগামীকাল দেহ রাখবেন।

    আর দীনবন্ধু থাকল নানারকম কাজকর্মের তদারকিতে। কোথায় দাহ করা হবে ঠিক আছে। অর্জুন গাছটার নিচে রাখা হবে। তিনি গাছ লাগিয়ে তাঁর দাহ করার জায়গা ঠিক করে রেখেছেন। কোন আমগাছ কাটা হবে, সেটাও ঠিক করে রাখতে হয়।

    তারিণী কবিরাজ বললেন, পাগলকর্তারে দ্যাখতাছি না।

    —অর্জুন গাছের নিচে বসে আছেন।

    —ডাইকা আনেন। কাছে বইসা থাকুক।

    বড়বৌ সোনাকে পাঠিয়েছিল ডাকতে। কিন্তু তিনি আসছেন না। দীনবন্ধু একবার খবর নিয়ে গেল, কি রকম লাগছে। কেমন আছে?

    বড়বৌ বলল, বিকেলের টানে চলে যাবে মনে হয়

    —ধনবৌদিরে কন রান্নাবান্না শেষ করতে। পোলাপান যা আছে অগ খাওয়াইয়া দ্যান। আপনেরা-অ দুইডা মুখে দ্যান।

    বড়বৌ সে-সবের কোনও উত্তর দিল না। বলল, দেখুন তো ঠাকুরপো, আপনার দাদাকে নিয়ে আসতে পারেন কিনা?

    —তাইন কোনখানে?

    অজুর্ন গাছটার নিচে বসে আছে। সোনাকে পাঠিয়েছিলাম। আসছে না।

    —আপনি যান বৌদি। আপনি না গ্যালে আসবেন না।

    —যাই কি করে বলুন। তারিণীকাকা এসেছেন, ওর জন্যে জলখাবার করতে হবে। ধন রান্না করছে। মা তো বিছানাতেই চুপচাপ বসে আছেন। কাল থেকে কিছু খাচ্ছেন না। কোন দিকে সামলাই বলুন।

    সুতরাং দীনবন্ধু অর্জুন গাছটার নিচে গিয়ে ডাকল, এখানে বইসা থাকলে হইব? বাড়ি যান। পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ দেখলেন দীনবন্ধু তাকে নিতে এসেছে। তিনি পিছন ফিরে বসে থাকলেন। শচি এলেন। তিনিও নিয়ে যেতে পারলেন না। শচি ফিরে এসে বললেন, আপনি যান। দেখেন আনতে পারেন কিনা।

    অগত্যা সব কাজ ফেলে বড়বৌ পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়াল। দেখল, তার মানুষ এখন ঘাসের ওপর বসে আছেন। দুটো-একটা পাতা গাছ থেকে ওঁর মাথার ওপর ঝরে পড়ছে। সে কাছে গেলেও মানুষটা চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না। কাছে গিয়ে মাথার চুলে নরম আঙুলে বিলি কাটতে থাকল। প্রায় সন্তানের মতো যেন তার আদর। সে বলল, ওঠ। এ সময় এখানে বসে থাকতে নেই। চারপাশে তিনি হাতড়াচ্ছেন। সবাই বলছে তিনি তোমাকে খুঁজছেন। ওঠ, ওঁর পায়ের কাছে বসে থাকবে। কোথাও আজ বের হবে না।

    বড়বৌ একটু থেমে দূরের গোপাটে কাকে যেন আলগা হয়ে বসে থাকতে দেখল। কে বসে আছে এমনভবে। ঝোপজঙ্গলের জন্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। বড়বৌ উঁকি দিলে জঙ্গলের ওপাশে মানুষটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সুতরাং ফের বলা। এই মানুষকে কিছু-না-কিছু একা একা বলে যেতেই হয়, তিনি তো তার কোনও জবাব দেবেন না। সে বলল, মেজ ঠাকুরপো, ধন ঠাকুরপোকে খবর দেবার জন্য শশীমাস্টারমশাই গেছেন। কবিরাজকাকা এসেছেন। এসেই তিনি তোমার খোঁজ করেছেন। তোমার বোনের কাছে লোক পাঠানো হয়েছে। পশি, ইছাপুরা লোক গেছে। তোমার মামাবাড়িতে খবর দিতে গেছে হারান পাল।

    সে সব খুলে বলছে। কীভাবে কী সব কাজ হচ্ছে সংসারে, সব বলছে। এই মানুষ বাড়ির বড় ছেলে। তাঁর সব জানা উচিত। তিনিই দাঁড়িয়ে থেকে সব করতেন। তাঁর হয়ে বুঝি বড়বৌ আর শচি সব করছে। সুতরাং ঠিক ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, না কোথাও ভুল থেকে গেল, মানুষটাকে এমন জানানো। বলতে বলতে নিজের কাছেই ভুল ধরা পড়বে। অঃ, তাই তো, সোনার মামাবাড়িতে লোক পাঠানো হয়নি। তাউইমশাই খুব দুঃখ পাবেন। সে তাড়াতাড়ি সোনাকে ডেকে বলল, তোর ছোটকাকে ডাক তো।

    শচি এলে বলল, সোনার মামাবাড়িতে কে গেছে?

    —কেউ যায় নাই।

    —কাউকে পাঠিয়ে দিন।

    এ-সময় কী কী করণীয়, বড় ছেলে তাঁর, সব জানা উচিত। অথবা এই যে সব করা হচ্ছে, আত্মীয় পরিজনদের খবর দেওয়া হচ্ছে-তিনি যেন সবই জানেন এবং তাঁর পরামর্শ মতোই হচ্ছে এমন সম্মান দেখনো প্রয়োজন। বড়বৌ এ-জন্য সব বিস্তারিত বলে যাচ্ছে মানুষটার পাশে দাঁড়িয়ে।

    বড়বৌ বলল, কি দেখছ?

    মণীন্দ্রনাথ গাছের ডালের দিকে চোখ তুলে দিলেন।

    বড়বৌ বলল, সামনে শুধু মাঠ। ফসল নেই। জমি চাষ করা। বৃষ্টি পড়লেই পাটের বীজ বুনে দেওয়া হবে। এ-সময়ে তুমি কিছু দেখতে পাবে না।

    মণীন্দ্রনাথ পা ছড়িয়ে বসলেন। যেন তিনি কোনও বড় নদীর পাড়ে বসে আছেন। সকালবেলা। রোদের তাত তেমন প্রচণ্ড নয়। দক্ষিণ থেকে বাতাস বইছে। কী ঘন চুল এই বয়েসে! চুল তাঁর একটাও পাকেনি। ছেলেমানুষের মতো বড় বড় চুল। বাতাসে চুল উড়ছে। ঘাটে জল কম। ঘোলা জল। কলমিলতার সবুজ আভা মরে যাচ্ছে। রুক্ষ কঠিন মাঠ। ধু ধু বালিরাশি আর কিছুক্ষণ পরই নদীর চরে উড়তে থাকবে।

    বড়বৌ বলল, তিনি যাই করে থাকেন, তোমার ভালো ভেবে করেছেন।

    মণীন্দ্রনাথ ছোট ছেলের মতো অভিমানের চোখ নিয়ে দেখলেন বড়বৌকে। কোনও কথা বললেন না। কথা বলেনও না তিনি। বেশি পীড়াপীড়ি করলে তাঁর প্রিয় কোনও কবিতা আবৃত্তি করেন। বড়বৌ এই অভিমানী মানুষটিকে দেখে ভাবল, তিনি হয়তো এখুনি কোনও কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবেন। বড়বৌ তাড়াতাড়ি বলে ফেলল, এ-সময় সবাইকে কাছে থাকতে হয়। তুমি তাঁর বড় ছেলে। কত আশা ছিল তাঁর তোমাকে নিয়ে।

    মানুষটা এবার মাথা গুঁজে দিল দু’হাঁটুর ভিতর। ওঁর কি কান্না পাচ্ছে। অথবা রাগে, অভিমানে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। বড়বৌ প্রায় এসেছে এখন জননীর মতো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল। লক্ষ্মী এস। এমন করতে নেই। তুমি যদি পাশে না থাক, তিনি মরেও শান্তি পাবেন না।

    পাগল মানুষ সেই যে মাথা গুঁজে দিয়েছেন হাঁটুর ভিতর, কিছুতেই মাথা তুলছেন না। বড়বৌ হাত ধরে টানছে। ওর মাথার ঘোমটা সরে গেছে সামান্য, বাঁ হাতে ঘোমটা টেনে ঠিক রাখছে। বুকের আঁচল সরে যাচ্ছে। ঝোপের ও পাশে একটা লোক লুকিয়ে বসে আছে। সব দেখছে বসে বসে। সকালের রোদ্দুর গাছের ডালে, পাতার ফাঁকে, মাটিতে এসে পড়েছে। মুখে বড়বৌর সকালের রোদ্দুর বড় মায়াময়। মুখে কপালে তার ঘাম। কপালে সিঁদুর বাসি দাগের মতো। লালপেড়ে কাপড়, শ্যামলা রঙ তার আর এই শ্রী সকালবেলার মাঠে বড় মাধুর্য বয়ে আনছে। ফেলু কবিরাজের আশায় বসে থেকে ঝোপের ভিতর সব দেখছে। সুন্দর লাবণ্যময় পা, পাতার ওপর লালপেড়ে শাড়ি কি শরিফ্ মনে হচ্ছে। অথচ এত টানাটানিতেও মানুষটা উঠছেন না। সামনের জমিতে সেই ষাঁড়টা এখন নিরিবিলি ঘাস খাচ্ছে। কোথায় কি হচ্ছে কিছু দেখছে না।

    বড়বৌ টেনে তুলতে না পেরে বলল, তুমি তো জানো, তোমাকে ভালো করার জন্য তিনি কী না করেছেন!

    পাগল মানুষটার হাই উঠছে। তাঁর এ-সব শুনতে আর ভালো লাগছে না।

    বড়বৌ এক এক করে এবার এ-সংসারে পুরানো ইতিহাস বলে গেল। মানুষটার তবু যদি চৈতন্য হয়। এমন সময় এ-পাগলামি বড়বৌরও ভালো লাগছে না। কবে একবার মহেন্দ্রনাথ নদী পার হয়ে শ্মশানে চলে গিয়েছিলেন, মৃতদেহের জন্য সেই শ্মশানে একা একা রাত্রিবাস এবং মৃতদেহ চুরি, তারপর সেই কাপালিকের জন্য কত কিছু হোমের কাঠ বিল্বপত্র আর অমাবস্যা রাতের অন্ধকারে নিশীথে শিবাভোগ এবং নদীর পাড়ে শ্মশানভূমিতে এক ভয়ঙ্কর কঠিন যাগযজ্ঞে এই মানুষের, আরোগ্য কামনা করেছিলেন, সে সব মনে করিয়ে দিতে চাইলেন। যেমন তিনি জীবনে একবার মিথ্যা তার করে, সন্তানের ভলোবাসা কেড়ে নিয়েছিলেন, তেমনি তিনি প্রৌঢ় বয়সে প্রায় তাঁর ঈশ্বরের সঙ্গে হারজিতের বাজিতে পড়ে গিয়ে—যা কিছু অকল্পনীয়, যা কিছু মানুষের দ্বারা সিদ্ধ, ভূত অথবা পিশাচ কোনও কিছুই বাদ রাখেননি। যেন তিনি দৈবের সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য ক্রোশের কর ক্রোশ নিশীথে হেঁটে যেতেন, কোনও ফকির অথবা আউলবাউলের উদ্দেশে। তাঁর বড় ছেলে পাগল। কেউ বাণ মারতে পারে, বন্ধন করে দিতে পারে—তিনি মন্ত্রসিদ্ধ মানুষের খোঁজে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথাও তেমন মানুষ খুঁজে পেলেন না। শুধু মিথ্যার অহঙ্কার। যাগযজ্ঞ, তুকতাক সব মিথ্যার সঙ্গে লড়াই! যেদিন যথার্থই হেরে গেলেন, সেদিন থেকে আর ঘরের বার হলেন না। সবাই দেখল মানুষটা অন্ধ হয়ে গেছেন। কেউ কেউ বলেছে মানুষটা হেরে গিয়ে সারারাত মাঠে শীতের ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে মানুষটার দুটো চোখই চলে গেল। এখন সেই মানুষ নিজেও চলে যাচ্ছেন। বড়বৌর মায়া হতে লাগল। কোনও রকমে একবার নিয়ে যাওয়া, এই শেষ সময়ে শিয়রে অথবা পায়ের কাছে বসিয়ে রাখা। সে কেমন কাতর গলায় বলল, তোমার এতটুকু মায়াদয়া নেই? তিনি তোমাকে কীভাবে চারপাশে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছেন!

    পাগল মানুষ দেখল তখন একটা ষাঁড়, বড় ধর্মের ষাঁড় ঘাসের জন্য ফোঁপাচ্ছে। কঠিন মাটি, জল নেই কতদিন। ঘাস পুড়ে গেছে। সূর্য মাথার ওপর থেকে যেন নামে না। কঠিন দাবদাহে ষাঁড়টা লাফাচ্ছিল। এমন কি সেটা এই পুকুর-পাড়ে উঠে আসতে পারে। কেমন ভয়ে ভয়ে পাগল ঠাকুর এবার উঠে দাঁড়ালেন।

    মনের ভিতর ভয় জাগলেই তিনি দেখতে পান এক কাটামুণ্ড হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। দুই কান তার লম্বা। সাপের চোখের মতো চোখ। নীল এবং অন্ধকার। তিনি দেখতে পান কখনও মুণ্ডটা অতিকায় বাদুড় হয়ে তাঁর চোখের ওপর ঝুলছে। তিনি তখন কাটা মুণ্ডর ভয়ে পিছনে ছুটতে থাকেন। নিশিদিন সেই কাটামুণ্ড কে যেন সুতো দিয়ে অদৃশ্য এক স্থান থেকে তাঁর চোখ বরাবর ঝুলিয়ে দিয়ে বলছে, এই দ্যাখো, এই হচ্ছে তোমার ধর্ম। তার সবটা থাকে না। কিছুটা থাকে। যা দেখলেই সত্যিকারের মানুষ ভয় পায়। নিশীথে সে এক অতিকায় বাদুড় হয়ে যেতে পারে। যক্ষ রক্ষ সব তার দোসর। তুমি তার ভয়ে কীটের শামিল। খুশি মতো তখন তোমাকে বলি অথবা জবাই দেওয়া চলে। তখনই ভয়ে মণীন্দ্রনাথের নিরিবিলি এক আশ্রয়ের কথা মনে হয়। বড়বৌ সেখানে সাদা পাথরে লাল বর্ণের ফলমূল আহার নিমিত্ত রেখে দিয়েছে। পানীয়ের নিমিত্ত রেখেছে ঠাণ্ডা জল। তিনি তখন একা একা সেই জানালায় যাবেন বলে হাঁটতে থাকেন!

    বড়বৌ দেখল মানুষটা এবার ঘরের দিকে ফিরছেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }