Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১১

    ২.১১

    সোনা বিকেলের দিকেই দেখল এই বাড়ি মানুষজনে গিজগিজ করছে। ঘোড়ায় চড়ে এলেন তারিণী সেন, তনি ঘোড়ায় চড়ে ফের নেমেও গেলেন। ব্রাহ্মন্দী থেকে রায়মশাইরা খবর পেয়ে বের হয়ে পড়েছেন। গোপালদি থেকে এসেছে অর্জুন সাহা, তার বৌ মা সবাই। লতব্দি থেকে এসেছেন অম্বিকা রায়। এসেছেন হাজিসাহেব, তাঁর দুই ছেলে। আবেদালি, হাসিমের বাপ মনজুর, সবাই এসেছে। ওরা বৈঠকখানা ঘরে বসে রয়েছে। মনজুর আমগাছ কেটে কাঠ করার দায়িত্ব নিয়েছে। যেখানে যা কিছু খবর এখন, সে শুধু এক খবর, বুড়োকর্তার মহাপ্রয়াণ হচ্ছে। শতবর্ষ পার করে মানুষটা আর একদিনও সবুজ বনে মৃত বৃক্ষ হয়ে বাঁচবেন না।

    সারাদিন ধরেই এ-ভাবে মানুষজন আসছে যাচ্ছে। ছোটকাকা শিয়রে বসে গীতা পাঠ করছেন। রায়মশাই পিঁড়িতে বসে মহাভারত থেকে বিরাট পর্ব পড়ে শোনাচ্ছেন। ঠাকুমা পায়ের কাছে সারাদিন বসে আছেন। জ্যাঠামশাইকে ধরে এনে পাশে বসিয়ে দিয়েছেন জ্যেঠিমা। মুখের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে ডেকেছে, বাবা, বাবা।

    তখন যেন এই মানুষ কত দূরে চলে যেতে যেতে কার ডাক শুনে চোখ মেলে একটু তাকাচ্ছেন, তারপরই চোখ বুজে আবার কোন দূরাগত মায়ার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন। জ্যেঠিমা ডাকছে বাবা, বাবা, ও আপনার বড় ছেলে। বলে জ্যেঠিমা শীর্ণ হাতখানা তুলে, পাগল মানুষের মাথায় ধরে রাখছেন বাবা, বাবা, আপনি আশীর্বাদ করুন আপনার পাগল ছেলেকে। তাকে বলুন, তুই আর কোথও যাবি না। ওকে আপনি বলে যান সে কি করবে!

    সোনা দেখেছিল তখন ঠাকুরদার চোখে জল। দু’চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। জ্যেঠিমা খুব ধীরে ধীরে সেই জল মুছিয়ে দেবার সময় ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। সবারই চোখ ছলছল করছে। ছোটকাকা বোধ হয় দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি কিছুক্ষণের জন্য গীতা পাঠ বন্ধ রেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। বুঝি এ-সময় ঠাকুরদার পাশে জ্যাঠামশাইর এই চেহারা সহ্য করা যায় না। বুক ভেঙে কান্না উঠে আসে।

    জ্যেঠিমা বললেন, আপনি, ওকে কিন্তু চোখে চোখে রাখবেন সব সময়

    সোনার কেমন অস্বস্তি লাগছিল। বুকের ভিতর ওরও একটা কষ্ট হচ্ছে। যা সে ঠিক এখন ছুঁতে পারছে না। ঠাকুর্দা মরে গিয়ে স্বর্গ থেকে সবসময় চোখে চোখে রাখবেন। জ্যেঠিমা কাঁদছেন। সোনার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আর ভয় কি! এখন থেকে সবসময় একজন পাহারাদার পাওয়া গেল। তিনি সব লক্ষ রখবেন। তবে আর কান্নার কী আছে! তবু কেন জানি কান্না পায়। সোনারও কান্না পাচ্ছিল! এতক্ষণ যে বুকের ভিতর অস্বস্তি, এই কান্নার জন্য। ঠাকুর্দা মরে যাবেন। এটা ভাবতেই এখন ওর কান্না পাচ্ছে। অর্জুন গাছের নিচে ঠাকুর্দাকে পোড়ানো হবে, বাবা জ্যাঠামশাই মন্দির বানিয়ে দেবেন। সোনা বিকেলে মন্দিরের চাতালে জ্যাঠামশাইকে নিয়ে বসে থাকবে। বর্ষাকাল এলে চাতালের পাশে জল উঠে আসবে। জলের নিচে রূপালি রঙের পুটিমাছ। সে এবং জ্যাঠামশাই ছিপ ফেলে পুটিমাছ ধরবে।

    সে নিজে এ-ভাবে জ্যাঠামশাইকে কোন-না-কোন কাজের ভিতর নিযুক্ত করে রাখবে। কোথাও যেতে দেবে না। কোনও কাজের ভিতর, এই যেমন মাছধরা, ফলের দিনে জ্যাঠামশাইকে নিয়ে ফল-পাকুড় পেড়ে আনা, ফসলের দিনে ঈশমদাদার পাশে বসে জমি পাহারা দেওয়া, বিদ্যালয়ে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া এবং কোনও গাছের নিচে বসিয়ে রেখে ক্লাস সেরে আসা, ফেরার পথে কোঁচড়ে জাম-জামরুল, অথবা চিনা বাদাম। চৈত্রমাসে দু’পকেটে খিরাই, দু’জনে পথে পথে খেতে খেতে আসা—এমন একটা ছবি ওর চোখের ওপর ভেসে উঠল। ঠাকুরদার কানের কাছে এ-সব বলে দেবার ইচ্ছা তার। ঠাকুরদা, কেন কাঁদেন আপনি! আমি তো আছি। সারাজীবন জ্যাঠামশাইর সঙ্গে সঙ্গে আমি থাকব। তাঁকে ফেলে কোথাও যাব না।

    কিন্তু এত মানুষজন ঘরের ভিতর, ওরা আসছে যাচ্ছে, ঠাকুরদাকে দেখে উঠোনে নেমে যাচ্ছে, ঠাকুরদার সততা সম্পর্কে ওরা কথাবার্তা বলছে, এমন মানুষ হয় না, কথিত আছে রাম রাজত্ব করেন, সীতা বনবাসে যায়….প্রায় যেন, এ-সংসারে তেমন চিত্র, এক পাগল মানুষ নিশিদিন হাটে মাঠে ঘুরে বেড়ান, এক সীতার মতো সাধ্বী নারী জানালায় দাঁড়িয়ে স্বামীর জন্য প্রতীক্ষা করে অথবা সংসারের কাজকর্মে ডুবে থাকে সে।

    সোনা ঠাকুরদার কানের কাছে গিয়ে বলতে পারল না, আমি সোনা কথা বলছি, আপনার ছোট নাতি। জ্যাঠামশায়কে আমি দেইখা রাখুম। আপনে কাঁদছেন কেন? কিন্তু এত লোকজনের ভিতর সে যে কী করে বলবে! তবু সে কোনওরকমে, শিয়রের দিকে ভিড়ের ভিতর মাথা ঠেলে শিয়রের ডানদিকে এসে গেল। একটা মোটা কম্বলে শরীর ঢাকা ঠাকুরদার। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছেন। সব শরীরটা তাঁর কাঁপছে। সোনা কোনওরকমে মাথার কাছে মুখ নিতেই, কারা যেন তাকে জোর করে সরিয়ে নিল। ওর চোখে জল। সবাই হয়তো ভেবেছে, সোনা এখন ঠাকুর্দার গলা জড়িয়ে কাঁদবে। সে বলতে পারল না, আমি কাঁদছি না, আমি কাঁদছি না, আমি গলা জড়িয়ে কাঁদব না। সোনাকে এখন তবু কারা জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ওকে বোঝ-প্রবোধ দিচ্ছে, ঠাকুরদা বুড়ো হয়েছে, মরে যাচ্ছে, কাঁদছ কেন? কী ভাগ্যবান মানুষ তিনি। তাঁর কত সুনাম। তোমরা কাঁদলে ঠাকুরদার আত্মা শান্তি পাবে না।

    সে এসে দাঁড়াল জামরুল গাছটার নিচে। তারিণী কবিরাজ গোপাটে ঘোড়ার ওপর বসেই একটা মানুষের কী যেন দেখছেন! সেই মানুষ ফেলু শেখ। সে একজন প্রবীণ মানুষকে তার কুষ্ঠের মতো ঘা দেখাচ্ছে। এবং লোকজন চারপাশে। সোনার মনটা ক্রমশ ভারি হয়ে আসছিল। তারিণী সেন ঘোড়ায় চড়ে চলে যাচ্ছেন। যারা দূরের মানুষ তারা উঠে আসছে। তারা কত রকমের সব মহৎ গল্প ঠাকুরদা সম্পর্কে বলছে। সব প্রাচীন গাঁথার মতো মনে হয়। একজন মানুষ মরে গেলে বুঝি তার অতীত সবার চোখে ঘুরেফিরে আসে। সোনার এখন এ-সব শুনতে ভালো লাগছে। সে সব মানুষদের ভিতরে ঘুরেফিরে—তার ঠাকুরদার অতীত ইতিহাস, সত্যবাদিতা, পৌরুষ এবং দানশীলতা সম্পর্কে সব শুনছে। কিন্তু একজন শুধু বলছে, তিনি একবার মিথ্যা তার করেছিলেন, তাঁর বড়ছেলেকে। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। অথচ তার করলেন, তিনি অসুস্থ, বাঁচা দায়। তিনি সেই মিথ্যা তার করে ছেলেকে আনিয়েছিলেন, এবং বড় ছেলে তাঁর ফিরে এলেই বিবাহ। বড় ছেলে তাঁর বৈঠকখানায় সারাটা দিন মাথা নিচু করে বসেছিল। পিতার সম্ভ্রমের কথা ভেবে কেমন নিরন্তর দুঃখী মানুষের মতো মুখ। সে মানুষটা, সবাইকে রামায়ণ গানের মতো তার বর্ণনা দিচ্ছিল। যেন পিতার সত্যরক্ষার্থে পুত্রের বনে গমন। জীবনের সব কিছু ভালোবাসা বনবাসে রেখে আসা।

    সোনার কেন জানি মনে হল, মানুষ কখনও সারাজীবন সত্য কথা বলতে পারে না। ঠাকুরদা যখন পারেননি, তখন আর কেউ পারবে না। বড় জ্যাঠামশাই কেন যে পাগল হয়ে গেলেন। এমন একটা মিথ্যা তার না করলে তার বড় জ্যেঠিমা এ-সংসারে আসতেন কি করে! বড় জ্যেঠিমার, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেবল সেবাশুশ্রূষা সকলের, নিজের বলতে তাঁর কিছু নেই—আর কী সুন্দর তার কথা! সোনা, জ্যেঠিমার মতো অনায়াসে এখন কথা বলতে পারে। তার কখন খিদে লাগে তিনি টের পান। সে কখন অসুস্থ বোধ করে জ্যেঠিমা চোখ দেখে ধরে ফেলেন। এবং সোনা যে বড় হয়ে গেছে তাও তিনি আজকাল ধরতে পেরে কেমন মাঝে মাঝে বলে দেন, আর কি, তোমাদের এখন পাখা হয়েছে, উড়ে যাবে। আমাদের কথা তোমরা কেউ ভাববে না।

    সে শুধু তখন বলতে পারে—না জ্যেঠিমা, আমি কখনও এমন হব না। ভালো হব আমি। আমি এই পরিবারের জন্য সব করব। ঠাকুরদা মরে যাচ্ছে বলে কী হয়েছে, আমরা তো আছি। আমি মেজদা বড়দা। সংসারের সব দুঃখ আমরা মুছে দেব। কত কিছু তার এখন বলতে ইচ্ছা হয়। সুন্দর, যা কিছু মহৎ এই পৃথিবীতে আছে সব কিছু তার হতে ইচ্ছা হয়। সে জামরুল গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠাকুরদা মরে যাচ্ছেন। মৃত্যু সম্পর্কে নানা রকম ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে তার। ওর মনে হয় ঠাকুরদা মরে কোথাও যাবেন না। সবাই অনর্থক কাঁদছে। সংসারের এমন ভালোবাসা ফেলে কেউ কখনও দূরে গিয়ে থাকতে পারে না। তিনি এ বাড়িতেই থাকবেন। তবে অদৃশ্য হয়ে থাকবেন। মরে গিয়ে মানুষ কোথাও বেশিদূর যেতে পারে না। ঠাকুরদাও বেশিদূর যেতে পারবেন না। সংসারে তার বড় জেঠিমার মতো বৌ আছে, পাগল জ্যাঠামশাইর মতো ছেলে আছে, ঈশম দাদার মতো মানুষ আছে, মার মতো ধনবৌ আছে, তবে তিনি যাবেন কোথায়! তিনি থাকবেন, এ সংসারেই থাকবেন। সকলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে থাকবেন। বিপদে আপদে তিনি সকলকে দেখবেন।

    আবার এও কেন জানি মনে হয় সোনার, ঠাকুরদা মরে গেলে আকাশের নিচে বড় বটগাছটার মাথায় একটা নক্ষত্র হয়ে জ্বলবেন। তিনি বড় ধার্মিক মানুষ, পুত্রের ম্লেচ্ছ আচরণের জন্য জীবনপণ করে বাজি ধরা ঈশ্বরের সঙ্গে—এ সব তাঁকে দেবতা বানিয়ে দেবে। তিনি এত পুণ্যবান যে, সে দেখল এখন আকাশে চাঁদ উঠেছে। লণ্ঠন জ্বেলে মানুষজন আসছে। সে মাথা তুলে আকাশ দেখে বুঝল, চাঁদের চারপাশে গোল মণ্ডল। সেখানে দেবতারা সব চুপচাপ বসে একজন গুণী জ্ঞানী মানুষের অপেক্ষায় আছেন। তিনি এলে তাঁর নিবাস ঠিক করা হবে। একজন পুণ্যবান মানুষ মাটি ছেড়ে চলে আসছে—সে কোথায় থাকবে, তার বাড়ি, বাগান, ঠাকুরপূজার ঘর এ-সবের আয়োজন করছেন তাঁরা। তার ঠাকুরদা যথার্থই পুণ্যবান মানুষ। তিনি আকাশে নক্ষত্র হয়ে যাবেন। এবং তাঁর পাগল ছেলে কোথায় নিরুদ্দেশে যান ঠিক তিনি সেখান থেকে টের পাবেন এবং তাকে চোখে চোখে রাখবেন। ঠাকুরদার আর জন্ম হবে না। তিনি আকাশ থেকে দেখতে পাবেন সোনা কী করছে, জ্যাঠামশাই হেঁটে হেঁটে কোথায় চলে যাচ্ছেন, ঈশমদাদা তরমুজ খেতে পাহারা দিতে দিতে ঘুমোচ্ছে কি-না—যেন সংসারের সব ফাঁকি এবার তিনি ধরে ফেলবেন। এবং রাতে ছোটকাকাকে স্বপ্নে বলে দেবেন, আগামী বছর দুর্দিন কি সুদিন। সোনাকে বলে দেবেন, জ্যাঠামশাই কোথায় কোন গাছের নিচে বসে আছেন। দুঃখ বলতে যেটুকু সংসারে আছে ঠাকুরদার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তা শেষ হয়ে যাবে।

    সোনা যখন এসব ভাবছিল তখন কেউ বলে গেল—তুমি সোনা যাও, ঠাকুরদার মুখে গঙ্গাজল দ্যাও—তখন ফেলু ট্যাবার পুকুরপাড়ের দিকে ছুটছে। সে জোনাকি ধরার জন্য ছুটছে। একটা জোনাকি ওকে সেই মাঠ থেকে উড়ে উড়ে এতদূর নিয়ে এসেছে।

    —কবিরাজমশয়, আমার ঘাড়া সারাইয়া দ্যান। আপনের গোলাম হইয়া থাকমু। সে এমন বলেছিল কবিরাজমশাইকে।

    —তুই কেডারে?

    —আমি ফেলু। আপনেগ ফ্যালা। হাডুডু খ্যালছি কত। আপনের মনে নাই আমার নামডা?

    —অঃ, তুই ফ্যালা। তা তর কি হইছে?

    —ঘাও হইছে।

    —কাছে আয় দ্যাখি।

    —এই যে কবিরাজমশয়। দ্যাখেন।

    ফেলুর মাথার ওপর মাছি উড়ছিল। কাছে যেতেই কী পচা গন্ধ।—আরে ফ্যালু, তুই ত ম‍ইরা যাইবি।

    —এডা কি কন কবিরাজমশয়! আমি মইরা গ্যালে আন্নুডার কি হইব?

    —তর যে বড় কঠিন অসুখ শরীরে।

    —ঘাওড়া আর সারব না!

    তারিণী কবিরাজ ঘা-টার চারপাশে টিপে টিপে দেখল।

    —জ্বলে?

    —হ জ্বলে। দাবদাহের মত জ্বলে।

    —জোনাকি জ্বললে নিভলে যেমন জ্বলে?

    –হ কবিরাজমশয়, ঠিক ধরছেন। জ্বালাডা দপ কইরা নিভা যায় আবার দপ কইরা জ্বইলা ওঠে।

    —বড় কঠিন অসুখ রে ফ্যালা। তুই এক কাম করতে পারস?

    —কি কাম কন দেখি। যা কন মাথা পাইতা দিমু।

    —শতমূলের গাছ চিনিস?

    চিনতে কতক্ষণ! বলে সে গামছা দিয়ে ওর ঘাটা ফের ঢেকে দিল। তারিণী সেন ঘোড়ার উপর বসে রয়েছেন। তিনি নামছেন না। ফেলুকে খুব কাছে আসতে বারণ করছেন। তিনি চোখ বুজে কী যেন ভাবছেন। তারপরই যেন বলে দিলেন, ঠিক কবিরাজিতে তর ব্যারামের অষুধ নাই। এডা আমি শিখছিলাম এক হেকিমদার মানুষের কাছে। তিনি কইছেন, বৃশ্চিক রোগে এডা লাগে।

    —আমার কি বৃশ্চিক হইছে কবিরাজমশয়?

    —ঠিক বৃশ্চিক না। তবে তর এই ঘাও আর ছাড়নের কথা না। সূর্যমুখি ঘাও। রোদ উঠলেই জ্বালাটা বাড়ে, রোদ পইড়া আইলে কমে জ্বালা।

    —হ, বাড়ে কমে।

    —সারে না। কবিরাজি মতে এর অষুধ নাই

    —আমি যে কি করিগ কবিরাজমশয়।

    —এটা কইরা দ্যাখতে পারস। আর তুই উবুৎল্যাঙরার গাছ চিনস?

    —না গ কবিরাজমশয়, চিনি না।

    —চিন কি তবে? সারা জন্ম শুধু ভাত গিল্যে চলে!

    —তা চলে কবিরাজমশয়। হায়, কি যে আমার হইল!

    —আজই ত পূর্ণিমা। বৈশাখি পূর্ণিমা।

    —হ, কবিরাজমশয়!

    —দিনটা ভাল আছে। শুক্লা তিথিতে এই জ্যোৎস্নায় একশটা জোনাকি ধইরা ফ্যাল। পক্ষকাল জলের ভিতর ডুবাইয়া রাখ। তারপর যখন দ্যাখবি জলটা ঘোলা ঘোলা হইয়া গ্যাছে তখন শতমূলি গাছের মূল গোলমরিচ গণ্ডা দুই জোনাকির জলে বেটে লাগাবি। কবিরাজিশাস্ত্রে এ-সব লেখা নাই। পেঁয়াজ রসুনে তগ শরীরটা ত আর শরীর থাকে না। দুরমুস বইনা যায়। কবিরাজি অষুধে কামে লাগব না। দিয়া গ্যালাম, একবার লাগাইয়া দ্যাখতে পারস! লাগানোর আগে জোনাকির জল দিয়া ঘা ধুইয়া নিবি।

    কবিরাজমশয় ওবুল্যাঙরা গাছের নিমিত্ত কি কইলেন যেন?

    —পক্ষকাল কষ্ট পাইবি। তার আগে গাছটা সিদ্ধ কইরা কিছু বাসকের ছাল, অর্জুনের ছাল, জায়ফল, লবঙ্গ ফেইলা দিয়া একটা পাচন খাইতে পারস। শরীরের রক্ত তর খারাপ। কালোমেঘের পাতা সিদ্ধ কইরা খাইতে পারস। রক্তটা ঠিক হইলে ঘাও শুকাইতে সময় লাগব না। বলেই তারিণী সেন মাঠের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটালেন। ফেলু দেখল চারপাশে তার জ্যোৎস্না। একটা জোনাকি, একটা একটা করে একশটা জোনাকি। ওর চোখের ওপর এখন জীবনের সবচেয়ে দামী এবং নামী বস্তু জোনাকি। তখনই সে দেখল মরীচিকার মতো একটা জোনাকি বেশ পুচ্ছ তুলে উড়ে যাচ্ছে।

    সে জোনাকিটাকে ডান হাতে খপ করে ধরতে গেল।

    হাওয়ায় হাওয়ায় দুলে দুলে জোনাকিটা যাচ্ছে। ফেলু ছুটছে তার পিছনে। মাঠের ভিতর ওর মনে হল আর একটা জোনাকি। এই কাছের জোনাকি হাতের বাইরে চলে যাবে, সে স্থির থাকতে পারছে না। যত সোজা মনে করেছিল জোনাকি ধরা, যত সহজে সে ভেবেছিল খপ করে ধরে কোঁচড়ে ফসলের মতো তুলে নেবে তত সে দেখল মরীচিকার মতো হাতের ফাঁকে জোনাকি উধাও। সে বলল, হালার কাওয়া।

    সে সুতরাং জিদের বশে, অথবা এক দুই মিলে এক গণ্ডা পাঁচ গণ্ডা মিলে এক কুড়ি পাঁচ কুড়িতে শ। একশ জোনাকি। সে গণ্ডার হিসাব জানে। কুড়ির হিসাব জানে। শয়ের হিসাব তার জানা নেই। সে যে এত বড় হাডু ডুডু খেলোয়াড় ছিল, নাম তার ফেলু ছিল, ভয়ে তাকে কেউ কাঁইচি চালাত না, তার নামে কিংবদন্তী ছিল কত, ফেলু খেলার দিন সারারাত তেল মাখে গায়ে, রসুন গোটার তেল। তেলটা তার ভিতর বসে যায়। সে পিছল করে রাখে শরীর। ঠিক পাঁকাল মাছের মতো সে বের হয়ে যায়। যত বড় প্যাচ দাও, যত বড় কাঁইচি চালাও, কি জুতসই, সে যে ফুসফাস বের হয়ে আসে কেউ টের পায় না। কেউ বলে মানুষটা এক ফকিরের কাছে তাবিজ নিয়েছে, গলায় মাদুলি বড় ঝোলে তার, পারো তো সেটা কেড়ে নাও। দেখবে কেমন ভুতের ভয়ে মামদোবাজি খেলা খেলে ফ্যালা।

    এখন সেই ফ্যালা মাঠের ওপর দিয়ে ছুটছে। গলায় তার সেই কালো তার জড়ানো রুপোর চাকতি। সে একটা জোনাকির সঙ্গে পারছে না। তার সব কেড়ে নিলেন এক মানুষ। পাগল মানুষ। মনে হল তার তখন ঠাকুরবাড়ি লণ্ঠন হাতে কারা উঠে যায়। বুড়ো ঠাকুর চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছেন। কত লোক যাচ্ছে দেখতে তাঁকে, আর ফেলু এখন কানা খোঁড়া বলে কেউ একবার তাকাচ্ছে না। তার যা ইজ্জত, ধর্ম সব কেড়ে নিয়েছেন মানুষটা। সে উন্মত্ত হয়ে ছুটছে। জোনাকিটা সাদা জ্যোৎস্নায় ভারি খেলা করছে বটে। কাছে এসে যাচ্ছে, খপ করে ধরতে যাচ্ছে, আবার উড়ে যাচ্ছে, হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে, ওপরে উঠে যাচ্ছে, সে ভেবেছে ছেড়ে দেবে, অন্য ঝোপে খুঁজবে জোনাকি। যেখানে জল ঘোলা, অথবা পচা ডোবা সে সেখানে চলে যাবে, তখনই আবার জোনাকিটা চোখের সামনে নেমে আসছে। যেন ধরা দিতে আসছে। সে বলল, আহারে, আমার সুন্দর জোনাকি। আয় তরে ধইরা লই। পরাণ আমার তর লাইগা কত না কান্দে।

    সে খপ্ করে ধরতে গেল। আর উড়ে গেল ফের জেনাকি। হাওয়ায় দুলতে দুলতে কঠিন রুক্ষ মাঠের ওপর দিয়ে ভেসে যেতে লাগল সে।

    ফেলুর মনে হল শরীরে তার পাখা গজিয়েছে। জেনাকির মতো দুই পাখা মেলে সেও যেন উড়ছে। কঠিন রুক্ষ মাঠের ওপর দিয়ে সে ভেসে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে। জোনাকিটা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে সে ভেসে যাচ্ছে। জেনাকিটা যত দুলে দুলে যাচ্ছে, সে তত দুলে দুলে যাচ্ছে। সে কী হাজার আরব্য রজনী গল্পের নায়ক হয়ে যাচ্ছে! তার যে কী ইচ্ছা এখন, আহা, সে কোথায় যাচ্ছে, তার যে কী ইচ্ছা, আল্লার কুদরতে সে আবার সব ফিরে পাবে, এমনকি এটা যখন ফকির প্রদত্ত ওষুধ, দানরি ফানরিতে কী না হয়, মনে হয় তার জোনাকিটা উড়ে তাকে আল্লার দরবারে নিয়ে যাচ্ছে। অথবা এই জোনাকি বুঝি তাকে একশটা জোনাকির খবর দেবে। খবর দিলেই সে খপ্ করে ধরে ফেলবে, জলে ভিজিয়ে একবার শতমূলি বেটে লাগাতে পারলেই নিরাময় হবে শরীর। এমন কি তার সেখানে একটা ব্যাঙের লেজ গজানোর মতো সুন্দর হাতও গজাতে পারে। সে তার ডান হাতটা নেড়ে বাঁ হাতটা আবার গজালে কি কি করবে, প্রথমেই তার কি করণীয় এমন ভাবতে ভাবতে সে যে কোথায় চলে যাচ্ছে!

    ফেলু ট্যাবার পুকুরপাড়ে এসে দেখল জোনাকিটা ঝোপের ভিতর লুকিয়ে পড়েছে। সে ভাবল, বা রে, বেশ মজা, তুমি কুহেলিকা, পদ্ম ফোটালে না চক্ষে, লক্ষ্মী তুমি আমারে কোনখানে নিয়া আইলা! বলেই সে ঝোপটার অন্তরালে উঁকি মারল, ঠিক মাইজলা বিবির সনে যেন এখন পীরিত তার। সে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ঝোপের ভিতর, যেমন সে একবার বটগাছের নিচে উঁকি দিয়েছিল, কখন মাইজলা বিবি তারে দেখা দেবার তরে পানিতে নেমে আসে।

    এখানেও ঠিক সেই উঁকি দিয়ে থাকা! জোনাকিটা ঝোপের এ-পাশে উড়ে এলেই খপ করে ধরে ফেলবে। আর কী আশ্চর্য, সে দেখল জোনাকিটা তার দলে ভিড়ে গেছে। এখানে সে যে উড়ে এল, সে তার দলে ভিড়ে যাবার জন্য। মরি হায় হায়! কলিজা কামড়ায়, সে নাগাল পাচ্ছে না, জোনাকিডারে। একডা দুইডা জোনাকি না, হাজার গণ্ডা জোনাকি। কেবল ঝোপের ভিতর বসে থাকছে ডালে। নাড়া খেলেই উড়ে চলে যাচ্ছে।

    সে বুঝল নড়লে উপায় নেই। চুপি চুপি চিৎ হয়ে পড়ে থাকা। যেই না উড়তে উড়তে কাছে চলে আসবে খপ্ করে ধরে ফেলা। ফেলু সেই আশায় ঝোপের ভিতর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকল। শিকারী মানুষের মতো সে জোনাকি ধরার কায়দা শিখে ফেলেছে। সে চুপচাপ শুয়ে থেকে বেশ ফল পেল। গণ্ডা দুই জোনাকি এখন তার করতলে। কোঁচড়ে রেখে সে অবাক, মরা মানুষের মতো সে পড়ে আছে, টুপটাপ কী যেন পড়ছে ডাল বেয়ে। সে সে-সব লক্ষ রাখছে না। ওরা বেশ উড়ে উড়ে আসছে। কোনওটা ধরতে পারছে, কোনওটা ধরতে পারছে না। ওর বুক জ্বালা করছে। গামছা দিয়ে ঘা ঢেকে রেখেছে। মনে হল ফোঁটাগুলো শরীরে পড়ে নিচে ভেসে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাত নয়। কারণ, আকাশ পরিষ্কার। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিপাতের মতো কিছু পড়ছে। এক ফোঁটা দু’ফোঁটা পড়ছে। সে আঙুল দিয়ে দেখল আঠা আঠা। তখনই আবার ওর বুকের কাছে দুটো জোনাকি খেলা দেখাচ্ছে। সে হাতটা তুলে একটা ধরে ফেলল। অন্য জোনাকিটা দূরে সরে গেল। দলে ভিড়ে গেল। ওরা সবাই কেন উড়ে আসছে না। চারপাশে গুঞ্জন করছে না। ফোঁটা পড়ছে। বুকে পিঠে ফোঁটা আঠার মতো। সে সে-সব ভ্রূক্ষেপ করছে না। পড়ুক। উঠে গেলেই এমন রাত আর মিলবে না। কাল, পক্ষ বিচার ঠিক না থাকলে অষুধে কাজ দেয় না। সে বলল, আনুরে, আবার আমি ফেলু শেখ। তরে নিয়া উজানে যামু। আমার শরীরে পচা গন্ধ থাকবে না। তরে নিয়া যামু শহরে। আকালু তরে আর কি আতর আইনা দ্যায়, আমি দিমু তরে পারস্য দেশের আতর। আমার শরীর সবল হইলে কি দিতে না পারি তরে। খপ্ করে সে ফের আর একটা জোনাকি ধরে ফেলল। আকালু ঘরে যায় নাই তো! বিবি, তুই আমাকে দুইটা মাস সময় দে। তরে আমি জোনাকির মত উড়াইয়া দিমু বাতাসে। খপ্।

    সে খপ্ করে আরও একটা জোনাকি ধরে ফেলল। আর কী আশ্চর্য! খপ্। সে দেখল বুকের উপর আঠায় একটা জোনাকি আটকে গেছে। খপ্। সে তুলে কোঁচড়ে রেখে দিল। আঙুলে সে আঠার মতো বস্তুটি ঠোটে ছোঁয়াল। আরে হালার কাওয়া, এয় রে কয় মধু। মধু বর্ষণ হইতাছে। ওপরে কোন বড় বৃক্ষ আছে। বৃক্ষ তুমি কার?

    —রাজার!

    —এখন কার?

    —এখন তোমার।

    —তবে মধু বুর্ষণ কর। ডালে তোমার মধুর চাক যখন আছে বর্ষণ কর। চান্দের রাইতে মধুতে আমার শরীর ভাইসা যাউক আমি শুইয়া থাকি। জোনাকিরা উইড়া আসুক। মরা কাঠ ভাইবা বসলেই, খপ্। সে খপ্ করে আরও একটা জোনাকি পায়ের পাতা থেকে তুলে আনল। ওর গোটা শরীর আঠাময় হয়ে গেছে। এখন সে ওদের না ধরলেও পারে। গোটা শরীরে জোনাকি, বিন্দু বিন্দু জোনাকি এক দুই করে এসে পড়তে থাকল।

    তাকে আর মানুষ মনে হচ্ছিল না। প্রথম একটা কাঠের গুঁড়ি মনে হচ্ছিল। উপরে ঝোপঝাড়। তার ওপর বড় বৃক্ষের ডাল। ডালে প্রকাণ্ড মধুর চাক। কোনও বন্য জীব হয়তো মধুভাণ্ডে মুখ দিতে এসে কামড় খেয়ে চলে গেছে। সব মধু এখন ঝোপের ওপর বৃষ্টিপাতের মতো পড়ে পড়ে নিচের মানুষটাকে ভিজিয়ে দিয়েছে। সে নড়ছে না। নড়লে জোনাকি উড়ে আসবে না। ওকে একটা কালো কাঠের গুঁড়ি ভেবে এক দুই করে সব জোনাকি শরীরে বসে গেলে সে যেন জোনাকির রাজা হয়ে গেল। তার ঘরে বিবি আন্নু যে এখন একা আছে, একেবারে সে তা ভুলে গেছে। আন্নুর কাছে সে আবার রাজার মতো ফিরতে পারবে, সে আবার ফসলের মাঠে ছুটতে পারবে—কী আনন্দ, কী আনন্দ। সে মশগুল হয়ে গেছে। নানারকম লতাপাতার স্বপ্ন দেখছে। চাই একশটা জোনাকি। সে গুনে আরও এক কুড়ি পাঁচ গণ্ডা করে ফেলেছে। সে উঠে বসল। এখন রাতের শেষ প্রহর। কালো মোষের মতো এক খণ্ড মেঘ আকাশের চাঁদ ঢেকে দিলে সে দেখল, ফেলু এক আশ্চর্য মানুষ হয়ে গেছে। তার শরীরে এখন অন্ধকারে বিন্দু বিন্দু জোনাকি জ্বলছে। আঠায় ওরা আটকে গিয়ে আর উড়তে পারছে না।

    আর তখনই শচীন্দ্রনাথ বলছেন, বাবা জল খান। গঙ্গাজল। হাইজাদির পরান আইছে আপনের মুখে গঙ্গাজল দিতে।

    বুড়ো মানুষ হাঁ করার চেষ্টা করলেন। তাঁর শ্বাসকষ্ট প্রবল। নাকের বাঁশি ফুলছে। নাভিশ্বাসে তিনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন। গোটা শরীর দুলছে তাঁর। ঝড়ের ভিতর সমুদ্রের তরঙ্গে যেন এক পালবিহীন নৌকা দুলে দুলে এই সসাগরা ভূমণ্ডল পার হচ্ছে।

    সোনা ঠাকুরদার মুখে সেই যে গঙ্গাজল দিতে এসেছিল আর নড়েনি। সেও পায়ের কাছে চুপচাপ বসে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত চন্দ্রনাথ, ভূপেন্দ্রনাথ কেউ ফিরে আসেন নি। তাঁরা আসেন নি বলেই এখনও আত্মাটা আছে। ওঁদের জন্য ঠাকুরদার প্রাণপাখিটা বুকের ভিতর এখনও বসে আছে। ওঁরা এলেই ওঁদের দেখে সে উড়ে যাবে। নাক অথবা কানের ভিতর দিয়ে সে বের হবে। চোখের ভিতর দিয়েও বের হয়ে আসতে পারে। চোখের ভিতর দিয়ে বের হলে চোখটা খোলা থাকবে। নাকের ভিতর দিয়ে বের হলে ডগা হেলে যাবে। আর মুখের ভিতর দিয়ে বের হলে তিনি হাঁ করে থাকবেন। ওর বড় ইচ্ছা দেখার, ঠাকুরদার প্রাণ-পাখিটা কীভাবে বের হয়ে আসে।

    সোনা, সেই আত্মা পাখির মতো, না পাখির হৃৎপিণ্ডের মতো, আত্মার কী চেহারা, বুকের কোন জায়গাটায় থাকে, কী খায়? নিঃশ্বাস ফেলে কী করে, বের হবার মুখে সে আত্মাটাকে দেখতে পাবে কি-না, সংসারে এই আত্মা কেউ কোনওদিন দেখেছে কি-না, অথবা একটা ছোট্ট হাওয়ার মতো, তাই হয়তো সেটা দেখা যায় না—তবু ওর মনে হয়েছে, নিরিবিলি চুপচাপ বসে থাকলে টের পাওয়া যাবে, আত্মা বড় অভিমানী বস্তু। চারপাশের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলে কোথায় যাবে তুমি, আবার ফিরে এসে এই দেহে তোমাকে আশ্রয় নিতে হবে। অথচ সোনা ঘরটার চারপাশে তাকালে দেখল, দরজা-জানালা বন্ধ করলেও অজস্র ফাঁকফোকর রয়েছে। সে কিছুতেই আত্মাকে আর আটকে রাখতে পারবে না। সেই চাঁদ-সদাগরের পুত্রবধূর মতো ওর ইচ্ছা এখন নিশ্ছিদ্র কোনও ঘরে ঠাকুরদাকে নিয়ে তুলতে পারলেই—তিনি আবার শতবর্ষ বেঁচে যাবেন। কেন যে মানুষ মরে যায়, বাঁচে না, সে-ও একদিন মরে যাবে, ভাবতে ভারি কষ্ট হল তার। ঠাকুরদার মতো, বাবা, মা, জ্যাঠামশাই, ছোটকাকা সবাই মরে যাবেন। সে বড় হলে একটা এমন ঘর তৈরি করবে, যেখানে হাওয়া ঢুকতে পারবে না। ঘরটায় সে তার বাবা মা অথবা জ্যাঠামশাইকে রেখে দেবে। অভিমানী আত্মা বের হয়ে যখন দেখবে উড়ে যাবার পথ নেই, তখনই ফের সে ভিতরে ঢুকে যাবে অথবা সে যদি বের হয়ে যায়, সে ঈশ্বরকে বলবে, আমাকে দিব্যদৃষ্টি দাও ভগবান। আমি আত্মার পিছনে পিছনে ছুটব। খপ করে ধরে ফেলব তাকে। যার “ আত্মা তাকে আমি ফিরিয়ে দেব। তখনই কে যেন বলল, বের করে আনুন। ঘর থেকে বের করে আনুন। বাইরে এই ধরণীর শান্ত চন্দ্রালোকে শতবর্ষ পার করে মানুষটা এবার মুক্ত হোক। ঠাকুরদাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাবার সময় হুঁশ হল সোনার, এতক্ষণ সে কী সব আজেবাজে কথা ভেবেছে। ঠাকুরদাকে সেও ধরাধরি করে উঠানে নিয়ে নামাল। শিয়রে একটি লণ্ঠন রেখে দেওয়া হল। শেষ প্রহরে ফিরে এলেন ভূপেন্দ্রনাথ, চন্দ্রনাথ। তাঁরা ঠাকুরদার পায়ে ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে থাকলেন। দেখলে মনে হবে ওঁরা যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।

    দেখলে মনে হবে ফেলুও যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সে বাড়িতে উঠেই ডাকল আন্নু, দ্যাখ আমি আইছি। তারিণী কবিরাজ ধন্বন্তরি। তার অষুধ পাইছি আমি। দ্যাখ আমার শরীরে কি জ্বলতাছে। দ্যাখ। তুইলা রাখ, বোনাকি পোকা পানিতে ভিজাইয়া রাখ। আর মাসাধিককাল আমার কষ্ট। আন্নু, আন্নু তুই ঘরের ভিতর আছস, রা করস না ক্যান! ভাল হইব না কিন্তু। কথা ক! কথা ক কইতাছি। কাফিলা গাছটার নিচে আমি খাড়াইয়া আছি। তুই আয়। খুইটা খুইটা জোনাকি তুইলা নে শরীর থাইকা।

    কোনও সাড়াশব্দ নেই ভিতরে। ঝাঁপের দরজা ভেজানো। বাগিগরুটা ফেলুর সাড়া পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, আন্নুড়া কথা কয় না। কি কারণ। কার উদ্দেশে যে বলা! যেন সে জাফরিকে বলছে, আমারে চিনতে কষ্ট হয় জাফরি। আমার শরীরে কি জ্বলতাছে দ্যাখ। আমি ইবারে ভাল হইয়া যামু। দ্যাখবি, তগ আর অভাব-অনটন থাকব না। আন্নু, আন্নু রে!

    না, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। বড় অভিমানী মেয়ে। সে এই ভেবে বলল, রাইতে ফিরি নাই, কারণ, ধন্বন্তরি আমারে কইল, ফ্যালা, পূর্ণিমার রাইতে একশডা জোনাকি ধইরা রাখ। কামে লাগব।

    —তা কি কাম? সে নিজেই প্রশ্ন করছে নিজেকে। যেন সে আন্নুর হয়ে জবাব দিচ্ছে। কাম হইছে দুরারোগ্য ব্যাধি ছাইড়া যায়। আমি ঝোপ-জঙ্গল থাইকা দ্যাখ কি কৌশলে জোনাকি ধইরা আনছি!

    তবু সাড়া দিচ্ছে না কেউ। তা দেবে না। ঘুম তো ওর ষোলআনা। ঘুমালে আর উঠতে চায় না। সে এবার ঝাঁপের দরজায় সামান্য ঠেলে ভিতরে উঁকি দেবে ভাবল, অথবা ডাকবে, আনু ওঠ। আর ঘুমাইস না। ভোর হইতে আর দেরি নাই।

    এটা কী হয়ে গেল! দরজাটা পড়ে যাচ্ছে কেন! ভিতরের দিকে একটা বাঁশে আটকানো থাকে দরজাটা। ঘুমোবার আগে আন্নু বাঁশটা ঠেলে দেয়। বাইরে থেকে ঠেলে দিলে দরজাটা ফেলে দেওয়া যায় না। কিন্তু এমন অদ্ভুত, সে দেখল দরজাটা পড়ে যাচ্ছে। ভিতরে কেউ যেন বাঁশ সরিয়ে রেখেছে। সে বলল, আমার লাইগা দরজা খোলা রাখছস! তা ভাল। তর ঘুম বিধবা মাইয়ার মত, ঘুমাইলে আর হুঁশ থাকে না। কাপড়চোপড় উইঠা যায়। একখানে তুই, অন্যখানে তর কাপড়। তা তুই এডা ভাল করস নাই। আকালু নারাণগঞ্জে যাইব মোকদ্দমা করতে। তারে আমি কোরবানী দিমু। বলেই সে হাঁ হয়ে গেল।

    যা ভেবেছিল তাই। ঘর খালি। সে এতক্ষণ জোরজার করে মনকে প্রবোধ দিয়েছে। যেন পাশেই আছে, সাড়া দেবে। জলের তরঙ্গ ভাইসা যায় মত বিবি তার লুকোচুরি খেলছে। সে বলল, তা ভাল হইছে। সে জোরে বলল, তা ভাল হইছে! সে চিৎকার করে আসমান-জমিন কাঁপিয়ে হেঁকে উঠল, তা ভাল হইছে! ওর হাতের মুষ্টিতে সেই কোরবানীর চাকু! ভাল হইছে। আমার পরাণ কাইরা নিছে আকালুদ্দিন।

    —তুমি, আকালুদ্দিন কই যাইবা। হালার কাওয়া। বলতে বলতে সে কেমন স্থবির হয়ে গেল! মেঝের উপর সেও ভূলুণ্ঠিত হল। বালকের মতো কাঁদল, আন্নু, তুই আমারে ফালাইয়া কই গ্যালি! আমার মাটি জমিন কার লাইগা!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }