Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১৪

    ১.১৪

    পাগল মানুষও সোনার সঙ্গে পুকুরে ডুব দিয়ে উঠে এসেছিলেন। লালটু পলটু ডুব দিয়ে উঠে এসেছিল। লালটু পলটু ডুব দিয়েছিল, এক ডুব। ওরা বাড়ি এসে নিমপাতা মুখে দিয়ে আগুনে শরীর সেঁকে ঘরে উঠে গেল। বাড়ির সবকিছু এখন সাফ করা হচ্ছে। চারপাশে গোবরছড়া এবং উঠানে সব বিছানাপত্র বের করা হয়েছে। সর্বত্র গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। পাগল মানুষ উঠানের উপর ভিজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হারান পাল দন্দির বাজার থেকে নতুন কাপড়, ফল-মূল, সাগু সব ঈশমের মাথায় নিয়ে এসেছে। নতুন মাটির সরা। মাটির গ্লাস, পাতিল সব এসেছে।

    শশীবালা বসে নেই। গোলা থেকে ধান বের করে দিচ্ছেন। মুড়ি-চিঁড়ার ধান। মাথায় করে মনজুর নিয়ে যাচ্ছে। সময় কম, দেখতে দেখতে দশ রাত্রি পার হয়ে যাবে। এতটুকু আর অন্যমনস্ক নন শশীবালা। অদ্ভুত একটা কষ্ট বুকের ভিতর বাজছে। খাটজোড়া মানুষটার দিনমান পড়ে থাকা। এখন ঘরটা বড় খালি খালি, ফাঁকা ফাঁকা। ঘরের ভিতর ঢুকলেই বুকটা তাঁর হাহাকার করছে। কতদিন আগে মানুষটা তাঁকে এ-সংসারে নিয়ে এসেছিলেন! এখন আর সব মনে করতে পারেন না। তবু মনে আছে শশীবালা বড় অবোধ বালিকা তখন। তাঁর বাবা মেয়ে পণ নিয়েছিলেন বলে আদর বড় বেশি তাঁর। মানুষটার বয়স অনেক। বড় ভয় করত দেখলে। সে মানুষটাকে প্রায় বাপের মতো সমীহ করতেন। এবং বড় হতে হতে এই সংসারেই শশীবালা কৈশোর কাল যৌবন কাল কাটিয়ে দিলেন। বয়সের তফাত মানুষটার সঙ্গে ত্রিশের উপর। ছেলেরা জন্মেছে আরও পরে। তিনি তো জানতেন না কিছু। মানুষটা তাঁকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিলেন। বাপের কথা মনে আসে না। মার কথাও মনে নেই। এই মানুষই তার সব ছিল বাপ-মায়ের স্নেহ দিয়ে এই সংসারে এক অখণ্ড প্রতাপশালী মানুষ তাঁকে বড় করে তুলেছিলেন। বড় করতে করতে মানুষটা কখন তাঁর অতি আপনার এবং নিজের হয়ে গেলেন। যেন তাঁর অঙ্গের শামিল। এখন সেই মানুষ যত বয়সেই হোক চলে গেলে বুকের ভিতরটা বড় ফাঁকা লাগে।

    বড়বৌ এসে এসব দেখে ধমক দিল।—কী দরকার মা আপনার এসব করার। আজকের দিনটা অন্তত চুপচাপ বসে থাকুন। বলে সে ঈশমকে ডাকতেই দেখল উঠানে কেউ নেই। পাগল মানুষ ভিজা কাপড়ে তখন দাঁড়িয়ে আছেন।

    সে বলল, যাও, ভিতরে যাও। বলে তাকে ধরে নিয়ে গেল পুবের ঘরে। নতুন কাপড় দু’ভাগ করে খোঁট করে দিল। একটা খোঁট পরিয়ে দিল। আর একটা খোঁট গায়ের চাদর করে দিল। ভূপেন্দ্রনাথ, চন্দ্ৰনাথ, শচীন্দ্রনাথ পুরোহিতদর্পণ দেখছিলেন। ওঁরা খেয়াল করেন নি বড়দা তখনও উঠানে। আকাশে তারা না উঠলে ওঁরা ফলমূল খেতে পারবেন না। এখনও সন্ধ্যার অন্ধকার উঠানে নামেনি। লালটু পলটু এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েরা উত্তরের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। কে আগে তারা দেখতে পাবে। তারা দেখতে পেলেই বাবা, জ্যাঠামশাই খেতে পাবেন। ওরা মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশে তারা খুঁজছিল।

    ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, শ্যামা দাদারে খবর পাঠা।

    শচীন্দ্রনাথ বললেন, কাইল যাইব ঈশম

    পাগল মানুষের গলায় চাবির সঙ্গে কাচা ঝুলছে। তিনি এখন একটা কুশাসনে চুপচাপ বসে আছেন। একটা খোঁট গায়ে। উত্তরের মাঠে ছেলেদের কোলাহল শুনতে পাচ্ছেন। দক্ষিণের পুকুরে বাবাকে দাহ করা হয়েছে। এ কথাটা মনে হল তাঁর!

    ওরা মাঠে কী করছে! ওঁর বড় জানার ইচ্ছা হল। এখন অন্ধকার নামছে। বড়বৌ এদিকে নেই। ছেলেরা কী করছে! মাঠে ওরা এমন কোলাহল করছে কেন! তিনি উঠবেন ভাবলেন।

    তখন বড়বৌ বলল, কোথাও এ ক’দিন যাবে না। যেতে নেই।

    পাগল মানুষ বড়বৌর এমন কথায় আবার বসে পড়লেন। শশীমাস্টার জানালা দিয়ে এসব লক্ষ করছেন। সোনা বসে আছে ওঁর পাশে। সেও উত্তরের মাঠে কোলাহল শুনছিল। ওরা কী করছে সবাই!

    তিনি জানালা থেকে বললেন, বড়বৌদি, লালটু পলটুকে দেখছি না।

    —ওরা তারা খুঁজছে আকাশে।

    —তারা!

    —তারা না দেখলে জল খেতে পাবে না।

    —এখনও কী তারা আকাশে ওঠেনি। তিনি বের হয়ে যাবার সময় দেখলেন সোনা শুয়ে আছে। ওর জ্বর গায়ে। অবেলায় ডুব দিয়ে জ্বর হতে পারে ভেবে তিনি নেমে গেলেন উঠোনে। ঘরে আরও মানুষ-জন রয়েছে। সোনা ভয় পাবে না। একা থাকলে ভয় পাবার কথা। ওকে তিনি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখিয়েছেন। এখন ওর মনে হচ্ছে, কে সে! কে সেই শ্মশানে আবছা অন্ধকারে এমন নৃত্য করে গেল! কে সে মানুষ!

    তিনি উঠোনে নেমে এসে দেখলেন পাগল মানুষ তেমনি বসে আছেন। তিনিও কি আকাশের কোথাও তারা উঠেছে কি-না লক্ষ রাখছেন! শশীমাস্টার দক্ষিণের পুকুরে যাবেন ভাবলেন, এবং যেতে গিয়ে তিনি দেখলেন আকাশের দক্ষিণ-পশ্চিমে কালপুরুষ উঠে বসে আছে, উত্তরে মাঠ থেকে ওরা দেখতে পাবে না। কারণ গ্রামের গাছপালা উত্তরের মাঠ থেকে এই কালপুরুষকে ঢেকে রেখেছে। তিনি যেতে যেতে ভাবছিলেন, সেই বিদেহী কে, সে কেন এখানে এসেছিল, কী তার কাজ! আর কেনই বা সোনাকে তিনি এমন একটা মজা দেখলেন এখন ভেবে পাচ্ছেন না। সোনা ভয় পায়নি তো! ভয় পেলে কম্প দিয়ে জ্বর আসতে পারে। তিনি তবু এখন এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামালেন না। কেবল বড়বৌর সঙ্গে দেখা হলে বললেন, বৌদি, সোনার মনে হয় জ্বর এসেছে।

    —সে কোথায়?

    —আমার বিছানাতে শুয়ে আছে।

    —থাকুক। ওর মা তো কাজ করছে। ঘরদোর সাফসোফ হচ্ছে। আভা এসে সব পরিষ্কার করে দিচ্ছে। এখন ও আপনার ঘরেই শুয়ে থাকুক। শশীমাস্টার এবার বললেন, লালটু পলটু আকাশে তারা খুঁজছে। অথচ এখানে দেখুন কত তারা!

    বড়বৌ আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল।

    —তাই তো!

    —এটা কি বলুন তো?

    —কোনটা?

    —ঐ যে দেখতে পাচ্ছেন না সাতটা তারা।

    —ও, ওটা তো কালপুরুষ!

    —আপনি তবে জানেন?

    —জানব না!

    লালটু-পলুট আকাশে এত তারা থাকতে কেন যে উত্তরের মাঠে তারা খুঁজছে বুঝি না!

    —আপনি যান। ওদের নিয়ে আসুন। পড়াশুনা নেই বলে তারা দেখবার নাম করে মাঠে নেমে গেছে।

    শশীভূষণ মাঠে নেমে দেখলেন ওরা বেশ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আট-দশটি ছেলেমেয়ে। এদের এখন বয়স হয়েছে। লালটু পলটু প্রায় সাবালক হতে চলেছে। এই মৃত্যুর দিনে কিছু আত্মীয়স্বজনের মেয়ে নিয়ে নক্ষত্রের খোঁজে চলে আসা শশীভূষণের ভালো লাগল না।

    তিনি মাঠে নেমে বললেন, তোমরা এত দূরে কেন? এদিকে এস।

    পলটু বলল, মাস্টারমশাই, আমরা আকাশে তারা খুঁজছি।

    —দেখতে পাচ্ছ না?

    —না।

    —এদিকে এস।

    ওরা ছুটে চলে এল।— ঐ দ্যাখো। কত তারা। দ্যাখছো সাতটা তারা?

    —দেখতে পাইছি।

    —ওর নাম কালপুরুষ।

    পলটু ছুটে বাড়ি উঠে এল। চন্দ্রনাথকে বলল, ধনকাকা তারা দেখেন আইসা।

    —কই?

    —ঐ দ্যাখেন কালপুরুষ।

    চন্দ্রনাথ দেখলেন এখন আকাশে অনেক তারা। বললেন, তোমরা তারা চেনো?

    —হ্যাঁ, সে ঘাড় কাৎ করল এবং ছুটে নেমে এল মাঠে। যেন সে কত তারা চেনে।

    তখন শশীভূষণ বলছিলেন, তোমরা সবাই উত্তরের দিকে তাকাও।

    সবাই মুখ তুলে সোজা উত্তরের আকাশে তাকাল। পলটু ছুটে এসেছে। সে জানে মাস্টারমশাই নিশ্চয়ই মাঠে দাঁড়িয়ে এখন এই গাছ ফুল মাটি সম্পর্কে কিছু বলছেন। সে আর কালপুরুষ দেখল না। সে মাঠে নেমে এসে দেখল, সবাই উত্তরের আকাশে কী দেখছে।

    পলটু বলল, মাস্টারমশয়, কি দ্যাখছেন?

    —ওটাকে সপ্তর্ষিমণ্ডল বলে।

    লালটু দেখল এখন এখানে সবাই আছে। কেবল সোনা নেই। এমন একটা আশ্চর্য সন্ধ্যায় উত্তরের আকাশে যখন মাস্টারমশাই ওদের নক্ষত্র চেনাচ্ছেন, তখন সোনা নেই ভাবা যায় না! সে বলল, মাস্টারমশায় সোনাকে ডাইকা আনি? কারণ লালটু জানে সব বলে দিলে সোনা এলে মাস্টারমশাই আবার প্রথম থেকে বলবেন। বরং সোনা এলেই আরম্ভ হবে। সোনা এই সময়ে কাছে থাকবে না, আর ওরা ঠাকুরদার মৃত্যুর দিনে আকাশের সব নক্ষত্র চিনে ফেলবে সে হয় না। সোনা এমনিতেই বড় চঞ্চল স্বভাবের ছেলে। ওর কৌতূহলের শেষ নেই। বার বার সে নানাভাবে প্রশ্ন করবে।

    শশীভূষণ লালটুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, ছোট ভাইটি কাছে নেই বলে কষ্ট হচ্ছে তার। লালটু এমনিতে সোনাকে খেলায় অথবা মাঠে নেমে গেলে, কিংবা ওরা যখন ভলিবল খেলে,সঙ্গে নিতে চায় না। সোনা বেহায়ার মতো সঙ্গে সঙ্গে থাকতে চায়। লালটু মাঝে মাঝে তেড়ে আসে। সোনা ছুটে যায়, আবার কিছুদূর গেলেই সে ওদের দিকে হাঁটতে থাকে। এমন কতদিন দেখেছে শশীভূষণ। কোনওদিন ওঁর চোখের উপর এসব হয় না। চোখের উপর করতে সাহস পায় না লালটু। কিন্তু আজ ঠাকুরদার মৃত্যুতে কেমন সব অনিত্য ভেবে ছোট ভাইটির জন্য তার কষ্টবোধ হচ্ছে। শশীভূষণ খুবই ম্রিয়মান, কেমন উদাস গলায় বললেন, সে আসবে না লালটু। ওর জ্বর এসেছে। আমার বিছানাতে কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে।

    লালটুর মুখ কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল। শশীভূষণ দেখলেন আকাশে তখন জ্যোৎস্না। আকাশে তখন ছায়াপথ আপন মহিমায় দক্ষিণ থেকে উত্তরে বিস্তৃত। তিনি বললেন, ঐ যে জিজ্ঞাসাচিহ্নের মতো দেখতে পাচ্ছ ওটা হচ্ছে সপ্তর্ষিমণ্ডল। সাতজন ঋষির নামে প্রতিটি নক্ষত্রের নাম। তুমি কাল্পনিক রেখা টানলে দেখতে পাবে ওদের অবস্থান ঠিক একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ওপর। তুমি যদি সেখান থেকে আরও একটি বড় লম্বা রেখা টেনে উপরে তুলে দাও দেখতে পাবে একটা খুব বড় উজ্জ্বল নক্ষত্র, দেখতে পাচ্ছ?

    সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠল।

    —ওটা কী হবে বলতো?

    —ওটা ধ্রুবতারা, না স্যার? দীপালি বলে মেয়েটি এমন বলল।

    —তুমি তবে চেন?

    —আমার বাবা আমাকে মাঝে মাঝে আকাশের নক্ষত্র দেখান। নাম বলেন। কিন্তু স্যার, আমি ভুলে যাই। মনে রাখতে পারি না।

    লালটু বলল, হ্যাঁ মাস্টারমশয়, তারপর?

    সে আরও জানতে চায়। এই ধ্রুবলোকের রহস্য তার জানার বড় ইচ্ছা।

    —এরা কিন্তু সবই নক্ষত্র। নক্ষত্র আর গ্রহে কী তফাত বলতো? শশীভূষণ বললেন। –নক্ষত্রের নিজস্ব আলো আছে, গ্রহের নিজস্ব আলো নেই।

    —ঠিক। খুব ঠিক জবাব। তোমার নাম কি?

    —আমার নাম দীপালি। দীপালি চ্যাটার্জি।

    —নামের আগে শ্রীমতী বলতে হয়।

    দীপালি জিভ কাটল।

    খুব ভালো হয়েছে। লালটু এমনই চেয়েছে। বড্ড পাকা। আগে আগে কথা। শহরে থাকে বলে সব জানে এমন একটা ভান সব সময়। সে এই মেয়ের মুখ থেকে কিছুই শুনতে চায় না। সে বলল, তারপর মাস্টারমশায়?

    —ঐ দ্যাখো পশ্চিমের দিকে তাকাও। কী দেখতে পাচ্ছ?

    —অনেক তারা মাস্টারমশয়।

    —দ্যাখো, বড়, একটা তারা জ্বলজ্বল করছে।

    —বড় বড় হ্যাঁ হ্যাঁ বড়।

    দীপালি বলল, ওটা শুকতারা, না স্যার?

    আবার? এই মেয়ের জ্বালায় এখানে থাকা যাবে না। লালটু বলল, স্যার, আমাদের মাথার উপর উত্তর-দক্ষিণে ছায়াপথ আছে, না?

    —আজ জ্যোৎস্না উঠেছে। ছায়পথ ভালো দেখতে পাবে না। একদিন অন্ধকার আকাশে তোমাদের ছায়াপথ দেখাব। নিজেরাও দেখতে পার। কী বিচিত্র লীলা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের।

    –স্যার, ও-সব গ্রহে আমাদের মতো মানুষ থাকে?

    —হ্যাঁ থাকে। তোমার মতো মেয়েরা থাকে। লালটু আর বিরক্তি চাপতে পারল না। এমনিতে মনে ওর ভীষণ একটা দুঃখ বাজছে। সোনা নেই। ওর জ্বর হয়েছে। ঠাকুরদা নেই। বাড়ির বড় ঘর খালি। মাস্টারমসাই নক্ষত্র দেখাচ্ছেন, তার ভিতর ফড়ফড়ি। এসব ফড়ফড়ি তার একেবারে ভালো লাগে না। সে মনে মনে বলল, দিমু ঠাস কইরা গালে এক চড়। ফড়ফড়িটা ভাইঙা যাইব।

    শশীভূষণ বললেন, এইভাবে আমরা এক বড় সৌরজগতে বসবাস করি। বড় ক্ষুদ্র এ-পৃথিবী মানুষ আরও কত ছোট, কত কিঞ্চিৎ সে। তোমরা এই মাঠে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে অণু পরমাণু জগৎ দেখতে পাচ্ছ তার ভিতর রয়েছে লক্ষ কোটির মতো সূর্য, আপন দাবদাহে নিরন্তর জ্বলছে। হিলিয়াম গ্যাস। বায়ুশূন্য আকাশ। এবং আমরা যা-কিছু নীল দেখছি সে অন্তহীন সাম্রাজ্যের স্বরূপ। তুমি আমি সেখানে অতি তুচ্ছ। আমাদের জন্ম-মৃত্যু আরও তুচ্ছ। তবু একটা নিয়ম আছে জেনে রাখ, যেমন আপন মহিমায় এই সৌরজগৎ আবর্তন করছে, তার বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, পৃথিবী সূর্য প্রদক্ষিণ করছে, রাত দিন বৎসর এবং কাল তারপর মহাকাল, এ-সবের ভিতর একটি অতি নিয়মের খেলা আছে। সে হচ্ছে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসা। শীত, গ্রীষ্ম, বসন্তের মতো আমরা আবার ফিরে আসি। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা শেষ হয়ে যাই না।

    শশীভূষণ আজ এই মৃত্যু ব্যাপারে কি একটা যেন আবেগ বোধ করছেন। তিনি, সংসার অনিত্য এমন ভাবছেন। এক পাগল মানুষ আছেন, নিত্যদিন সংসারে চুপচাপ, কোনও কথা বলেন না, বেশ আছেন, যেন কথা না বললে বেশ থাকা যায়, সংসারের সারবস্তুটি তিনি জেনে ফেলেছেন—কী হবে দুঃখ নিয়ে বেঁচে থেকে, যে ক’দিন আছ, থাক খাও, পাখি দ্যাখো—তিনি কেবল পাখি দেখছেন, শশীভূষণ ওদের নক্ষত্র দেখাচ্ছেন। শ্মশানে যে বিদেহী এসে গেল, সে কে! সে কৌ মানুষের আত্মা! কেবল কষ্ট পাচ্ছে! কেবল ঘুরছে ফিরছে, কোথায় গেলে একটু শান্তি মিলবে!

    তিনি এবার সবাইকে ডেকে বললেন, এবার তোমরা বাড়ি এস। মাঠে বেশি সময় দাঁড়াতে নেই তিনি এখন আমাদের চারপাশেই আছেন। পারলৌকিক কাজ শেষ না হলে তিনি মুক্তি পাবেন না।

    সবার এমন কথায় খুব ভয় ধরে গেল। প্রাণে ভয় ওদের সব সময়ই ছিল। তবুও ওরা আকাশে তারা দেখতে এসেছিল মাঠে। দলবল নিয়ে এসেছে। এই দিনে একা মাঠে নেমে আসে কার সাধ্য। কিন্তু শশীভূষণের এমন কথায় সবাই ওঁকে ঘিরে থাকল। মাস্টারমশাই বাড়ি উঠে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ওরাও উঠে যাবে।

    শশীভূষণ বললেন, তোমরা এদিকে কোনও কালো রঙের মানুষ দেখেছ?

    ওরা মাস্টারমশাই কি বলতে চাইছেন ঠিক বুঝতে পারছে না। ওরা তাকিয়ে থাকল।

    —এই একজন কালো রঙের মানুষ। শরীরে আগুন জ্বলছে নিভছে?

    ওরা এমন কথায় সবাই একেবারে শশীভূষণকে ভয়ে জড়িয়ে ধরল।

    —তোমরা ভয় পাচ্ছ কেন! আমি দেখেছি। আমার এখন দেখা দরকার তিনি তোমাদের ঠাকুরদার আত্মা, না অন্য কিছু।

    ওরা কথা বলতে পারছে না। একা উঠে যেতে পারলে বাড়ি উঠে যেত। তাও পারছে না। এক অবলম্বন এই মানুষ। ওরা ওঁকে ঘিরে খুব কাছে কাছে থাকছে। যেন সেই প্রেতাত্মা ওদের ছুঁয়ে দেবার জন্য চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। ভয়ে লালটু পলটু গায়ত্রী জপ করছিল।

    —মানুষের গায়ে আগুন জ্বলে নেভে এ আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি।

    —আমাদের শরীর আগুনে পুড়ে গেলে কি হয়! আমরা ছাই হয়ে যাই। আর কি থাকে! শশীভূষণকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।—ওটা দক্ষিণের মাঠে নেমে গেছে। আমি তোমাদের কী বলব, এত যে সাহস আমার, কিছুতেই আজ দক্ষিণের মাঠে নেমে যেতে সাহস পাইনি।

    ভয় মানুষকে কী করে রাখে! ভয় মানুষকে অদৃশ্য অলৌকিক কিছু আছে যা ছোঁয়া যায় না, যা অনুভূতিগ্রাহ্য নয়, তেমন এক জগতে বসবাস করতে প্রেরণা দেয়। তিনি বললেন, এই হচ্ছে আমাদের ভগবান, লালটু। যার কোনও ব্যাখ্যা চলে না, তাকে আমরা ভগবান ভাবি। তোমার ঠাকুরদা এখন কালো রঙের শরীর নিয়ে নানারকম আগুনের গর্ত সৃষ্টি করে নিজেই ভগবান হয়ে গেছেন। বলতেই ভয়ে ওঁরও কেমন শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি বললেন, এস, আর মাঠে নয়। তারা তোমাদের দেখতে হবে না।

    তারপর ছুটে এসে প্রায় সবাই উঠোনে উঠে এল। দক্ষিণের ঘরে এত লোকজন, তবু কেন জানি শশীভূষণের ভয় কাটছে না। সোনা মাথায় মুখে কাঁথা ঢেকে শুয়ে আছে। নিচে পড়ার টেবিলে নরেন দাস শ্রীশ চন্দ্র আরও গ্রামের কিছু মানুষ বসে বসে গল্পগুজব করছে ভূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে। তিনি তাদের কিছু বললেন না। যেখানে সোনা শুয়ে আছে তার পাশেই বসলেন। জ্বরটা বেড়েছে কিনা দেখার সময় মনে হয়, সোনা শক্ত হয়ে আছে। একি, এত শক্ত কেন! তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন, আপনারা আসুন। সোনা কী হয়ে গেছে!

    বড়বৌ তখন সাদা পাথরে সাগু ভিজাচ্ছিল। ফলমূল কাটছিল। ওরা তারা দেখে ফলজল খাবে। কাঁচা দুধ, মধু এবং তরমুজ। আর সাগু কলা। এই খাদ্য। রান্নাঘরে ওদের আত্মীয় পবন কর্তার বৌ আছে। ধন, রান্নার সবকিছু বের করে দিচ্ছিল। তখনই ওরা শুনল সেই অসহনীয় চিৎকার।

    সবাই ছুটে গেল। মণীন্দ্রনাথ সবাইকে এমন ছুটে দক্ষিণের ঘরে যেতে দেখে বিস্মিত হয়ে গেছেন। ফেলু ঠাকুরের চিতা থেকে মাঠে নেমে এসে তখন কোনদিকে যাবে ঠিক করতে পারছিল না। হালার কাওয়া। হালার ভগবান তুমি ঠাকুর! তোমার ভগবানগিরি ভাইঙ্গা দিমু। বলে, সে যেমন তার কোরবানীর চাকু হাওয়াতে দোলায়, তেমনি দোলতে দোলাতে সে দেখল, ওর গায়ে অজস্র জোনাকি। সেই যে গতকাল মধুর সঙ্গে সব লেপ্টে আছে শরীরে, তারা আর উড়ে যেতে পারেনি।

    ভীষণ মজা পেয়ে গেল ফেলু। সে ভাবল এখন একবার সেই ধর্মের যণ্ডটাকে দেখলে হয়। কোথায় আছে সে। তাকে চিনতে পারলেই শালা লেজ তুলে পালাবে। সে ভাবল সব শালাকে আজ ভয় দেখাবে। এই যে মাঠ আছে, সাদা জ্যোৎস্না আছে, আহা, অন্ধকার হলে খুব ভালো হতো, লোকে দেখত কেবল কাঠের মতো একটা মানুষ নিরন্তর ছুটছে আর তার গায়ে অজস্র দেব-দেবীর চোখ। চোখ জ্বলছে। সে ফের কিংবদন্তী হয়ে যেতে পারে। মানুষের ভগবান হয়ে যেতে পারে। সে বলল, আমি ভগবান, আমি আল্লা। আমি না পারি কী। কেয়ামতের দিনে আমি রসুলের পাশে বসে থাকব। বলব, হা রসুল আমার বিবিরে যে নেয় কাইরা তার ধর্ম কী? আমার যে অন্ন নাই আমার ধর্ম কী! জালালি যে পানিতে ডুইবা মরল তার ধর্ম কী!

    এমন একটা ব্যাপার হয়ে গেলে মানুষের আর থাকে কী! সে যে কী চায় নিজেও জানে না। সে মনে সুখ পাবে না, বেঁচে থেকে সুখ পাবে না, তবে কী ধর্মের নামে সুখ! সে সুখ সুখ করে বিবি বিবি করে পাগল হয়ে গেল। সে বলল, আন্নুরে, তুই কই গ্যালি! তরে কই পামু! শহরে আমি যাই কী কইরা! তুই ব্যারামি নাচারি মানুষটার কষ্ট বুঝলি না! তাজা ষণ্ড দেইখা পালাইলি! আমি আর মানুষ নাই রে আন্নু। আমি যে কী হইয়া গ্যাছি নিজেই জানি না। আমার চোখে পানি ঝরে না।

    সে নৃত্য করে সেই সৎ মানুষটার শ্মশান অপবিত্র করে দিয়ে এসেছে। সারাদিন সবাই করজোড়ে ছিল, আর সে লাথি মেরে শ্মশানের কলসি ভেঙে দিয়েছে। জল চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল আর তার হা-হা করে হাসতে ইচ্ছা হচ্ছিল। সে জানে কেউ আজ আর পুকুর পাড়ের দিকে তাকাবে না। কেউ আজ আর এ-মাঠে নেমে আসবে না। সবারই এক ভয়। মানুষ মরে গেলে শেষ হয়ে যায় না। আকাশে-বাতাসে সে ঘুরে বেড়ায়। সে ডাকল, ঠাকুর, তোমার পোলারে সাবধানে রাইখ। তুমি ত মইরা গিয়া শক্তিধর হইছ। পার কিনা দ্যাখ আমার লগে। আমি তোমার পোলা, আকালু, যারে আমি পামু খুন করমু। আমি কোনখানে যামু না। এই শরীরে বনে-জঙ্গলে ঘুইরা বেড়ামু। ফাঁক পাইলেই হ্যাৎ। হালার কাওয়া। যেন মনে হয় বাতাসে ঠাকুরের আত্মাটা এখন ভাসছে। সে জোনাকি ধরার মতো মাঠে আত্মা ধরার বাসনাতে ছুটছে। হালার কাওয়া। হ্যাৎ। সে হাত বাড়িয়ে বাতাস থেকে ঠাকুরের আত্মা ধরতে চাইল।

    এভাবে ঘুরে ঘুরে যখন বোঝা গেল মৃত আত্মা বাতাস থেকে ধরা যায় না অথবা সে ঘুরে মরছে মাঠে, অকারণ এই আত্মা খুঁজে মরা, তার চেয়ে বরং ভালো, গিয়ে বসে থাকা আকালুর ঘরের পিছনে। সে যদি রাতে তার ঘরে ফিরে আসে।

    তখন ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, মাথায় জল ঢালো বেশি করে।

    গোপাল ডাক্তার এসেছে। সে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে বসে আছে। জ্বরের জন্য অজ্ঞান হয়ে গেছে এমন বলছে। খুব বেশি জ্বর। এত জ্বরে মাথা ঠিক থাকে না। রক্ত উঠে গেছে মাথায়। সকলে চারপাশে বসে রয়েছে। কে আর কী খাবে! বড়বৌ সব ফেলে চলে এসেছে এ-ঘরে। আশ্বিনের কুকুর পাহারায় আছে। সে ঘরে ঢোকে না। সে কেবল চারপাশে লক্ষ রাখে কেউ ঘরে ঢুকে যাচ্ছে কিনা। মাথায় এত জল ঢালা হচ্ছে যে মেঝে ভেসে গেছে জলে। সোনা চোখ বুজে আছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ ছিল। এখন হাত খোলা নরম। দাঁত লেগে ছিল, এখন দাঁত খোলা। বড়বৌ মাঝে মাঝে ডাকছেন, সোনা সোনা! ভাল লাগছে? সে চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে দিচ্ছে। কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছে না। চোখদুটো এখনও লাল আছে। মাথায় রক্ত উঠে এমন হয়েছে। পাঁচের ওপর জ্বর। সে বিড়বিড় করে কী বলছে যেন। চন্দ্রনাথ মুখের কাছে কান নিয়ে গেলেন। বললেন, জল দিমু? বড়বৌ কাছে এসে বলল, জল খাবি সোনা? হাঁ কর। তুই এমন করছিস কেন! কী হয়েছে, কী কষ্ট! এই তো আমরা, কী ভয় তোর!

    শশীভূষণ কেমন বোকা বনে গেছেন। তিনি কেন যে বলতে গেলেন, আয় সোনা মজা দেখবি। বলে তিনি কেন যে পকুরপাড়ে শ্মশানের দিকে হাত তুলে দেখালেন। ভয়ে তার এমন হয়েছে। এসব বলে দেওয়া ভালো। তিনি বলে দিলেন, আমি যে কী করলাম বড়বৌদি। ওঁরও যেন ভয়ে কম্প দিয়ে জ্বর আসছে।—কী বলব আপনাদের, শ্মশানে এক আশ্চর্য ব্যাপার। আপনারা সবাই যখন বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলেন, আমি সোনাকে নিয়ে এ-ঘরে বসে রয়েছি। আমার উচিত ছিল জানালা বন্ধ করে রাখা। তবে আর এ-সব দেখতে হতো না। বলেই কেমন তিনি জানালাটার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালেন।

    দেখলে মনে হবে শশীভূষণেরও যেন কম্প দিয়ে জ্বর আসছে। তিনি বলতে পারছেন না। তিনি ঢোক গিলছেন। তিনি বললেন, পাঁজি এনে দিনটা দেখলে হতো। কী দিনে তিনি গেলেন।

    —কেন কী হয়েছে! বড়বৌ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। ধনবৌ অনবরত জল ঢেলে যাচ্ছে। ওর হাত ধরে গেছে, তবু কিছু বলছে না। সে অপলক তাকিয়ে আছে সোনার দিকে। দাহ করার সময় কাছে থাকতে না দিলেই হত এমন ভাবছে।

    শশীভূষণ বললেন, আমি বললাম মজা দেখবি? সোনাকে আঙুল তুলে দেখালাম। সোনার কৌতূহল বেশি জানি। সে বার বার আমাকে নানাভাবে এই মৃত্যু সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে। মানুষ মরে কোথায় যায়, কী হয়, কোথাও সে জন্ম নিলে আমরা চিনতে পারব কিনা—এই আমাদের ঠাকুরদা। নাকি জন্ম কোথাও কেউ নেয় না, বাতাসে আত্মাটা মিশে যায়। আমি বললাম, সোনা, কেউ মরে শেষ হয়ে যায় না। ঐ দ্যাখো, দেখলাম বৌদি, পোড়াকাঠের মতো একজন মানুষ সন্ধ্যায় আবছা অন্ধকারে শ্মশানে এসে নৃত্য করছে। গায়ে ফুলকি দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। ঠিক যেন আধপোড়া একটা মানুষ শ্মশানে ফিরে এসেছে ফের। আমার ভারি কৌতূহল হল। সোনাকে বললাম, ঐ দ্যাখ। মানুষ মরে কোথাও যায় না। এ-পৃথিবীতেই সে থাকে।

    গোটা ঘর চুপচাপ। কোনও শব্দ নেই। কেবল জল পড়ার শব্দ। গোপাল ডাক্তার বলল, এখানে এসব আলোচনা করা ঠিক না।

    সবারই হুঁশ হল। এ-সম্পর্কে আর কোনও কথা কেউ জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেল না। রাম রাম। সবাই মনে মনে রাম নাম উচ্চারণ করল।

    এই বাড়িতে আর কিছু নেই এখন মনে হয়। সবাইকে কেমন এক অশরীরী এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে। সবাই ভয়ে ভিতরে ভিতরে ফুলে যাচ্ছে। কেবল মণীন্দ্রনাথ ঘরের দাওয়ায় বসে হাঁকছেন, গ্যাৎচোরে শালা। ওঁকে কেউ খেতে দিচ্ছে না। সারাদিন না খেয়ে তাঁর খিদে বেড়ে গেছে।

    কুকুরটাও হাই তুলল। রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে। গোপাল ডাক্তার ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে আজ গেল না। সাইকেলে সে আজ আসেনি। হেঁটে এসেছে। ওকে ঈশম দিতে যাবে তার গ্রামে। সে একা একা ফিরে আসবে আবার। সে যেমন সোনার জন্মকালে হাতে লণ্ঠন, বগলে লাঠি নিয়ে বের হয়েছিল, তেমনি নিশীথে গোপাল ডাক্তারকে দিতে চলে গেল।

    সোনা তখন বাতাসে বুঝি দুলছিল। সে হাতটা তুলে বাতাসে কী খুঁজছে। সে কী খপ্ করে ধরতে চাইছে?

    ধনবৌ এমন দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল। সারারাত এই করতে করতে কখন সকাল হয়ে গেছে কেউ টের পায়নি। তারিণী কবিরাজের জন্য আবার লোক পাঠানো দরকার। ঈশমই সকালে এসে খবর দিল, একজন ওঝা আসছে। সে সোনাকে দেখবে। সকালে যে ওঝা এসেছিল তার বর্ণবহুল চেহারা বড়বৌকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। সে চুল বড় করে রেখেছে। হাতের নোখ কাটে না, পায়ের নোখ কাটে না। চোখ লাল। গাঁজার কল্কে হরেক রকমের গলায় বাঁধা। সে বলল, মরা দোষ পাইছে। সহজে নিস্তার নাই।

    তা নিস্তার না থাকুক, সোনা কিন্তু সকালের দিকে কেমন একটু নিদ্রা গেল। ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, এবারে তুমি যাও, দরকার পড়লে ডাইকা পাঠামু।

    ওঝা বলল, কর্তা, ভূত বাড়িতে পাড়া দিতে না দিতেই পালাইছে। আমার বিদায়।

    —বিদায় আর কী! কী চাও তুমি?

    —দুই কাঠা ধান। আর পাত পাইতা দই-চিড়া।

    —তা শ্রাদ্ধের দিন আইস। খাইবা।

    ওঝা চলে গেল। যাবার সময় বলল, কর্তা বাড়ি বাইন্দা দিয়া গ্যালাম। কোন ডর নাই।

    সবাই শুনল কথাগুলি। লালটু পলটুর শুনে সাহস ফিরে এল। শশীভূষণ পর্যন্ত কথাটা বিশ্বাস করলেন। এবং বাড়িতে যে এক অদৃশ্য ভয় সবসময় ঝুলে ছিল বাতাসে এক সামান্য ওঝা এসেই কেমন তা উড়িয়ে দিয়ে গেল।

    মণীন্দ্রনাথ তখন সোনার শিয়রে বসেছিলেন। সোনা বস্তুত মণীন্দ্রনাথকে শিয়রে দেখেই কেমন সাহস পেয়ে গেল। ওর ভিতরে যে ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য, তাকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে কারা, পুড়িয়ে মারার জন্য চিতার কাঠে তুলে দিচ্ছে, অমলা কমলা কাঁদছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, আগুনের ভিতর ওর সুন্দর চোখ মুখ পুড়ে যাচ্ছে, সে কালো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, পুড়ে যেতে যেতে সে একটা লেজ খসে পড়া ব্যাঙ হয়ে যাচ্ছে, অথচ আত্মাটা তার সেই ব্যাঙের ভিতর আছে, সে টের পাচ্ছে সব, কষ্ট যন্ত্রণা টের পাচ্ছে, সে আর এ-পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারছে না সোনা হয়ে, সে একটা অন্য জীব হয়ে গেছে—তাকে কেউ চিনতে পারছে না, সে, মেলায় হারিয়ে যেমন ভেউভেউ করে ছেলেমানুষ কাঁদে সে তেমনি যখন কাঁদছিল তখনই দেখল পাগল জ্যাঠামশাই ওর শিয়রে এসে বসেছেন। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তাকে একমাত্র তিনিই চিনতে পেরেছেন। বলছেন যেন, সোনা তোর ভয় নেই, আমি তোর সঙ্গে যাব। সোনার সঙ্গে যদি পাগল জ্যাঠামশাই থাকে তবে আর কি ভয়! ওর চোখে নির্ভয়ে ঘুম এসে গেল।

    পাগল মানুষ তারপর বের হয়ে এলেন। কেমন একটা অভিমান কাজ করছে। কাল রাতে কেউ তাঁকে খেতে দেয়নি। বাবা তাঁকে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়তে অনুমতি দিলেন না। তিনি ভিতরে ভিতরে ভয়ঙ্কর অভিমানে ক্ষুব্ধ। যেদিকে এখন দু’চোখ যায় বের হয়ে যাবেন। তিনি ধীরে ধীরে সকলের অলক্ষ্যে হাঁটতে থাকলেন।

    কেন যে আজ সকালে এমন কুয়াশা হল! পাগল মানুষ গোপাটে নেমে পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এটা গ্রীষ্মের দিন। তিন-চার দিন মাঝে আকাশ মেঘলা গেছে। কিন্তু ঝড়জল কালবৈশাখী কিছু হয়নি। দু’দিন খাঁ খাঁ রোদ। কাল রাতে জ্যোৎস্না ছিল। আজ সকালে কুয়াশা। তিনি পথে নেমে এলে কেউ তাঁকে দেখতে পেল না। হাসান পীরের দরগায় তিনি আজ যাবেন। কতদিন তিনি যান নি। কতদিন তাঁর হাসন পীরের সঙ্গে দেখা হয়নি। সেই কবে একবার বর্ষার শেষে হাসান পীরের দরগায় তিনি গিয়েছিলেন। হাসানের উক্তি মনে পড়ছে তাঁর।—তর যা চক্ষু মণি, চক্ষুতে কয়, তুই পীর হইবি, না হয় পাগল বইনা যাইবি।

    —আচ্ছা পীরসাহেব, আমার সেই চক্ষুতে কোনও দুরাশা জেগে আছে?

    —দুরাশা সবারই থাকে মণি, তরও আছে। দুরাশা না থাকলে মানুষ বাঁচে না।

    —আমার কি দুরাশা?

    —তর দুরাশা তুই পাইবি না, তার জন্য ঘুইরা মরবি।

    –কেন পাব না! আমার কি কসুর? সে পীরসাহেবের ভাষায় কসুর কথাটা ব্যবহার করেছিল।

    -–তর কসুর তুই বড় বেশি সাদাসিদা মানুষ। সাদাসিদা মানুষের বেশি দুরাশা ভাল না।

    —আমি ঠিক চলে যাব। এখানে থাকব না। ওর কাছে চলে যাব। আমাকে কেউ খেতে দেয়নি কাল পীরসাহেব। বাবা আমাকে মন্ত্রপাঠ করতে দিল না। আমার কী আর আছে! সারাদিন আপনার কাছে আজ বসে থাকব। তারপর হেঁটে হেঁটে পলিনের কাছে চলে যাব। কেউ আমার নাগাল পাবে না। ঠিক না পীরসাহেব ও

    কুয়াশার ভিতর তিনি হাঁটছেন আর হাঁটছেন। দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন। তিনি বড়বৌকে উদ্বিগ্ন করে তুলবেন। সে বের হয়ে গেলে খোঁজাখুঁজি হবে, সে না থাকলে সবাই ফল জল খাবে না। তাঁকে কাল বড়বৌ খেতে দেয়নি। তিনি সারাক্ষণ আশ্বিনের কুকুরের পাশে চুপচাপ বাইরে বসেছিলেন আর দেখেছেন সব মানুষের ভিড় দক্ষিণের ঘরে। কী হয়েছে সোনার! তাঁকে কেউ ডাকছে না। কেউ বলছে না, তুমি এস। তিনি যেন এ-বাড়ির কেউ নন। তিনি যেন এ-বাড়িতে অপরিচিত মানুষ। না পেরে তিনি ভোর রাতের দিকে নিজেই উঠে গেছেন সোনার কাছে। তিনি শিয়রে গিয়ে বসেছেন। ভূপেন্দ্রনাথ বলেছেন, এখন মনে হয় একটু ভালোর দিকে। মণীন্দ্রনাথ চুপচাপ কেবল সোনার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলেন। ওঁর কেন জানি বার বার ইচ্ছা করছিল, একেবারে সাপ্টে কোলে তুলে নিতে। বুকের পাশে জড়িয়ে নিলেই সব গ্লানি সোনার মুছে যাবে। অথবা এই যে কুয়াশা, এই কুয়াশায় সোনাকে নিয়ে ক্রমান্বয়ে হেঁটে গেলে এক জলাশয় পাওয়া যাবে, এক বড় মাঠ পাওয়া যাবে, তারপর হাসান পীরের দরগা, দরগাতে গিয়ে শুইয়ে দিতে পারলেই সে নিরাময় হয়ে যাবে।

    ওঁর আজকাল বড়বৌর ওপর অভিমান হলেই কোথাও গিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা হয়। কোনও কিছুর অভাব হলে অভিমানে খুব দূরে গিয়ে আজকাল বসে থাকেন না। ধারেকাছে থাকেন। যেন সোনা অথবা লালটু পলটু গিয়ে খুঁজে আনতে পারে। তিনি লালটু পলটু গেলে আসেন না। সোনা গেলে কখনও কখনও উঠে আসেন। আর বড়বৌ গেলে অনেকক্ষণ সাধাসাধি। এক অবোধ বালকের মতো হয়ে গেছেন তিনি। তাঁর আর দূরে যেতে ইচ্ছা হয় না। কেমন স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যাচ্ছেন। তবু আগে একটা দুর্গের ছবি, র‍্যামপার্ট এবং বড় একটা নদী দেখতে পেতেন। মাঝে মাঝে কী যেন একটা প্রতিমার মতো মুখ উঠেই মিলিয়ে যেত। মঝে মাঝে তিনি একটা সিলভার ওকের গাছ দেখতে পেতেন। তার নিচে কে যেন দাঁড়িয়ে ওঁর জন্য অপেক্ষা করছে। এখন আর তেমন ছবি কিছুই ভাসে না। ক্রমাগত এক নিষ্ঠুর যাত্রা তাঁকে সব ভুলিয়ে দিচ্ছে। কাল-সময় তাঁকে বড় একাকী করে রাখছে। কেবল এই বড়বৌ এবং সোনা যতক্ষণ আছে ততক্ষণই ওঁর প্রতীক্ষা, ততক্ষণই তিনি বসে থাকেন এবং মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকান, কেউ ওঁকে খুঁজতে আসছে কিনা। আজ তিনি বেশ দূরে চলে যাচ্ছেন। দেখুক সবাই কেমন মজা খেতে না দিয়ে সব ভুলে থাকার মজা দেখুক বড়বৌ।

    ঘন কুয়াশার ভিতর পথ চিনে যেতে কষ্ট হচ্ছে। তবু উত্তরের দিকে ক্রমান্বয়ে হেঁটে গেলে সেই দরগা মিলে যাবে। তিনি কুয়াশার ভিতর কেবল হেঁটে যেতে থাকলেন।

    .

    কেবল হেঁটে যেতে থাকল আরও একজন মানুষ, সে ফেলু। কুয়াশার ভিতর তাকে মানুষ বলে চেনা যাচ্ছে না, যেন একটা বড় গজার মাছ জলের নিচে সাঁতার কেটে যাচ্ছে। বিলের জল কালো, তার নিবাসে কে এসে মজা লুঠছে, সে জলের ভিতর ডুবে ডুবে শ্যাওলার অন্ধকারে তা লক্ষ রাখছে। সে কখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে। দু’হাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে যে কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না। সে সারারাত আকালুর বাড়ির পাশে যে জঙ্গলটা আছে সেখানে বসেছিল। যদি আকালু রাতে ফিরে আসে। যদি আকালু শেষপর্যন্ত কিছু ভুলে যায় নিতে, সে রাতে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সারারাত ফেলু মশার কামড় খেয়েছে। শরীর তার ফুলে গেছে। ওর শরীর এখন আর শরীর নেই। যেন সে এই কুয়াশার ভিতর এক অশরীরী হয়ে কেবল ছুটছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }