Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১৬

    ২.১৬

    বিকেলের দিকে সোনার জ্বর আবার বেড়ে গেল। ওর ভীষণ শীত করছিল। কম্প দিয়ে জ্বর আসছে। সে ভেবেছিল জ্বর না এলে কাল ঠিক জ্যেঠিমাকে ধরে দুটো ভাত খাবে। ভাত না খেলে কী যে কষ্ট! যেন সে কতদিন না খেয়ে আছে। মুখ বিস্বাদ। কেবল জল খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। মাথা ধরেছে ভীষণ। মাথা ধরার জন্য সে খুব চিৎকার করছিল। জ্যেঠিমা এসে ওর মাথাটা কাপড়ে বেঁধে দিয়ে গেছে। খুব চাপ দিয়ে বাঁধা। বেশ তার আরাম বোধ হচ্ছে। সে এখন জানালা দিয়ে পালেদের ডুমুর গাছ দেখতে পাচ্ছে। ডুমুর গাছে সেই নীলবর্ণের পাখি। সে দেখে চোখ বুজে ফেলল। কারণ কেবল মনে হচ্ছে এই অসুখে যদি সে মরে যায়। আর ভালো না হয়। তবে সেই নীলবর্ণের পাখিটার সঙ্গে আর একটা ডালে গিয়ে বসবে। তাকে কেউ আর দেখতে পাবে না। সে সব দেখতে পাবে—এবং দেখেও মাকে বলতে পারবে না, মা আমি গাছের ডালে বসে আছি। কারণ, এমন বললেই মা তাকে ভয় পাবে। সে তো আর সোনা থাকবে না, সে মায়ের কাছে তখন একটা অশরীরী আত্মা হয়ে যাবে। এসব ভাবলেই তার কষ্টটা বাড়ে। সে যেন দেখতে পায় সে মরে গেছে মা তার মাথা কোলে নিয়ে বসে কাঁদছে। সে একটা নীলবর্ণের পাখি হয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। তার শরীরটা উঠোনে ফেলে রেখেছে অথবা ঠাকুরদার পাশে আর একটা চিতা জ্বলছে, সেই চিতায় ওর এমন নরম শরীর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

    ধনবৌ কী একটা কাজে ঘরে এলে সোনা বলল, মা জানালাটা বন্ধ কইরা দ্যাও।

    —ক্যান রে!

    —আমার ভয় করে।

    ধনবৌ বুঝল সোনার ভয় কাটেনি। সে জানালা বন্ধ করে দেবার সময় বলল, কোন ভয় নেই। ঠাকুরদা তোমার মরে গিয়ে স্বর্গে গেছেন। সেখান থেকে কেউ কখনও ফিরে আসে না।

    —আচ্ছা মা, আমি মরে গেলে ঠাকুরদার সঙ্গে আমার দেখা হবে?

    ধনবৌ বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। বলল, এমন বলতে নাই।

    আচ্ছা মা, তুমি কাঁদবে আমি মরে গেলে?

    —জানি না।

    সোনা বুঝল সে মাকে রাগিয়ে দিচ্ছে। সে বলল, মা, বড় জ্যাঠামশয় আসেন নাই?

    —না।

    —কেউ গেছে খুঁজতে?

    —না।

    —ঝড় উঠবে, না মা? আকাশটা কি কালো!

    —চুপচাপ শুয়ে থাক। কথা বলো না।

    সোনা কাঁথার ভিতর মুখ টেনে নিল। সে সারা গায়ে কাঁথা টেনে চুপচাপ শুয়ে থাকল। মাথার কাছে জল। ঘরের চারপাশে ট্রাঙ্ক, কাঠের আলমারি। উপরে কাঠের সিলিঙ। অন্যদিন এঘরে শুয়ে থাকলেই একটা পরিচিত গন্ধ পায়। কিন্তু আজ সে কেমন একা পড়ে গেছে। বড় জ্যাঠামশাই বাড়ি থাকলে ওর শিয়রে হয়তো এখন বসে থাকত। সে এমন জ্বরের ভিতরও জ্যাঠামশাইর জন্য কেমন ছটফট করছে। ভেবেছিল তার জ্বর সেরে যাবে। সে তবে খুঁজতে যেতে পারত। কিন্তু আবার কম্প দিয়ে জ্বর আসায় তার কান্না পাচ্ছিল। মা ঘরে নেই। সে তার ছোট বোনের নাম ধরে ডাকতে থাকল।

    বোনের সে সাড়া পেল না। মাথা থেকে কাঁথা সরিয়ে সে উঠোনের দিকে মুখ ফেরাল। নানা কাজে সবাই ব্যস্ত। সে দেখল হেঁটে হেঁটে হারান পালের বৌ চলে গেল। যাবার আগে উঁকি দিল দরজায়, কি গ, কর্তা, কেমন আছেন? সম্মান্দির জ্যেঠিমা এসেছেন। তিনি চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। ঠাকুমা বোনকে কোলে নিয়ে দক্ষিণের ঘরের দিকে যাচ্ছেন। সে ডাকলে শুনতে পাবে না বলে ডাকল না। কেউ তার কাছে আসছে না। ওর কষ্ট হচ্ছে। বাইরের পৃথিবী তার কাছে কী সুন্দর এখন, সে এই ঘরে চুপচাপ শুয়ে শীতে কষ্ট পাচ্ছে, চোখ জ্বালা করছে, পৃথিবীর যাবতীয় মানুষের কী অনন্ত সুখ, সে কেবল একা দুঃখী মানুষ এই ঘরে অসুখে কষ্ট পাচ্ছে। এবং রাতের দিকে তার কেমন শ্বাসকষ্ট হতে থাকল।

    আর এক দুঃখী মানুষ তখন ফেলুর পায়ের তলায়। হাসান পীরের দরগাতে তখনও একটা শকুন আর্তনাদ করছে। মরা পলাশের ডালে কিছু শকুনের চোখ নিচের দিকে। চোখ মেলে তাকাচ্ছে। এক অতিকায় মানুষ পায়ের নিচে পড়ে আছে ফেলুর। কেমন চুপচাপ অসীম নীরবতা চারপাশে। ফেলু মুখটা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। বিদ্যুৎ চমকালে সে মাঝে মাঝে দেখতে পায়, চোখদুটো খোলা। গলা কাটা, চারপাশে রক্তপাত, এবং বৃষ্টি পড়ছে একফোঁটা দু’ফোঁটা। কড়াৎ করে মেঘ ফেটে গেলে সে দেখতে পেল জলের প্লাবন নেমেছে এই পৃথিবীতে। পাতা থেকে জল পড়ছে। সবুজ পাতা থেকে নির্মল জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। ফেলু সোজা দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখতে পাচ্ছে, এক হাতে যণ্ডের গলা সে জবাই করেছে। তার কাছে মানুষটা ঠিক হাজিসাহেবের খোদাই ষাঁড়টার মতো। সে এতটুকু মায়া বোধ করল না। সে এমন কী হাহা করে হাসতেও পারল না। পায়ের নিচে যণ্ড পড়ে আছে। গভীর রাত এবং চারপাশে কোনও লোকালয় নেই বলে, সে জানে এখানে আর কে আসে! তার ভালো লাগছিল। হাতি তার হাত ভেঙে পার পেয়ে গেল। জাল্‌সা ভেঙে দিল। কেউ কিছু বলতে পারল না। ভাঙা-মসজিদে নামাজ পড়তে কেউ পেল না—সেই এক মানুষ ভূপেন্দ্রনাথ, সবাই ভয় পায়, এখন কে তোমারে রক্ষা করে! বলে সে পা দিয়ে মুখটা মাড়িয়ে দিল। শক্ত হয়ে গেছে। ঘাড়টা শক্ত। মুখ হাঁ করা। কত অনায়াসে সে পিছন থেকে গলাতে নিমেষে পৌঁচ মেরে দিয়েছিল। ঠিক হালার জবাই করা য্যান একটা মুরগি। টেরও পেল না মানুষটা, পিছনে তার দুশমন। চোখের পলকে গলা হ্যাৎ করে দিল। দিল কী দিল না, সে চাকুটা কত অনায়াসে টেনে দিয়ে আবার লুকিয়ে পড়েছিল। অন্ধকার এত তীব্র, এত ঘন যে সে দেখতে পেল না ঠাকুরের মুখটা ব্যথায় কতটা নীল হয়ে যাচ্ছে। সে কেবল দেখল যেন একটা জবাই করা মুরগি উড়ে বনের ভিতর লাফাচ্ছে।

    আকাশে এত যে মেঘ, এবং এমন যে বৃষ্টি এবং গাছপালা অঝোরে ভিজছে, বাতাসে ঝড় আর ডালপালা ভেঙে পড়ছে চারপাশে, ফেলু খেয়াল করতে পারছে না।

    জল পড়ছে বলে একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। নানা রকমের কীট-পতঙ্গ এখন ডাকছে। কী বিচিত্র তার আওয়াজ। ফেলু কান পাতল। ভাঙা পাঁচিলে সাপের গর্ত থাকতে পারে, সেখানে সাপেরা যেন হিসহিস করছে। এমন প্রচণ্ড উত্তাপের পর এই জল সব পথঘাট ভাসিয়ে দিচ্ছে। সাপেরা এবার বের হয়ে পড়বে। ওর এবার যথার্থ ভয় করতে থাকল। শকুনের সহসা আর্তনাদে ফেলু বলল, কর্তা আমারে ডর দ্যাখায়। আমার নাম ফেলু। শকুন আমারে ডর দেখায়।

    মনে হল এবার কে যেন এই বনে হাসছে।

    ফেলু বলল, কেডা হাসে?

    আবার হাসে।

    ফেলু বলল, আমার নাম ফেলু। তিন যণ্ডের এক যণ্ড শেষ। আর আছে দুই ষণ্ড। কিন্তু বড় ষণ্ডটা যদি সিং বাগিয়ে রাখে তবে তার বুকের রক্ত জল হয়ে যায়। সে বলল, কেউ আপনারা আমার বিবিরে দেখেছেন?

    নানা রকমের শব্দের ভিতর, কারণ, প্রথম বর্ষা নেমেছে, ধরণী শান্ত শীতল হচ্ছে, মাটির নিচে জল ঢুকে যাচ্ছে, নানারকম পোকা-মাকড় তেষ্টায় কষ্ট পাচ্ছিল এতদিন, এখন এই জল ওদের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। ওরা আনন্দে ডাকছিল। তা ছাড়া আছে কত জীব এই পৃথিবীতে আর অঝোরে বৃষ্টিপাতে জল নেমে যাবার শব্দ। সেই শব্দের ভিতর বড় বড় ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। কোনও ধূর্ত শেয়াল মৃতের গন্ধ পেয়ে চারপাশে হয়তো হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওদের পায়ের শব্দও উঠতে পারে। আর সব শুকনো ঘাসপাতা যা এতদিন শুকনো খড়খড়ে ছিল, তারা জল পেয়ে সব জল শুষে নিচ্ছে। মাটি জল শুষে নিচ্ছে। কতরকমের সব গর্ত মাটিতে। কত পোকা-মাকড় ভিন্ন ভিন্ন আবাস সৃষ্টি করে মাটির পৃথিবীতে বেঁচে আছে। তারাও জল শুষে নিচ্ছে। ফলে কী যে বিচিত্র শব্দ, সেই শব্দের ভিতর ভিন্ন ভিন্ন আওয়াজ পেলে ফেলুর আর দোষ কী! ওর মনে হচ্ছিল, কেউ হাসছে, আবার মনে হচ্ছে, হাসান পীরের দরগায় বসে কেউ কাঁদছে। সেই যে মরা অশ্বত্থ গাছ আছে, যেখানে সব শকুনের নিবাস, তারা এমন ঝড়ে কঁকিয়ে উঠতে পারে—সুতরাং ওর মনে হল, কেউ গাছের ওপরে উঠে গিয়ে শোকে আকাশফাটা আর্তনাদ করছে। কী যে মনে হচ্ছে না, সেই সব প্রাচীন গর্ত থেকে কিছু সাপখোপ বের হতে পারে, এখানে কোনও আলো জ্বলছে না যে সে দেখতে পাবে আলোর ভিতর আকালু আন্নুকে নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে। সে পাগলের মতো চারপাশে এইসব বিচিত্র শব্দের বিরুদ্ধে লড়াই আরম্ভ করে দিল। বলল, কারে ডর দ্যাখাও মিঞা? আমারে? ডরাই না! দুনিয়ার এক আল্লা বাদে কারে ডরাই! এই বলে যেই না সে ভেবেছে এখান থেকে এবার ছুটে পালাবে, নয়তো ধরা পড়ে গেলে জেল ফাঁসি, তখনই মন হল সে যেভাবে পোঁচ চালিয়েছে গলায়, এ পোঁচ যেন দারোগাসাবের চেনা। এমন আর হাতসাফ কার হবে! ফেলুর। সুতরাং ফেলুকে ধরার জন্য আবার দারোগা-পুলিশ! ঘায়ের ওপর ঘা। সে সেজন্য আর দ্রুত ছুটে নেমে যেতে পারল না। এই লাশ নিয়ে তার এখন ঝামেলা। সে এমন একটা লাশকে গায়েব করে না দিতে পারলে ওর এবার নির্ঘাত গলা যাবে। সে তাড়াতাড়ি ফের উঠে এল। জল পড়ছে তো পড়ছেই। নিবারণ হচ্ছে না বৃষ্টিপাতের। রক্ত জলে ধুয়েমুছে যাচ্ছে। একবিন্দু রক্ত কোথাও লেগে থাকছে না! যা রক্ত এখনও গলাটা ওগলাচ্ছে, বৃষ্টির জলে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে! এবং এই ধরণী সব শুষে নিচ্ছে। সব কষ্ট যন্ত্রণা নিমেষে মুছে দিয়ে আবার ঘাস পাতা পাখি পোকা-মাকড় সব সজীব। লাশ তুলে নিলে কে বলবে এখানে কিছুক্ষণ আগে এক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে গেছে ফেলু।

    বাগের ভিতর ঢুকে লাশটাকে সে যেখানে রেখে গেছে ঠিক সেখানে এসে ফের দাঁড়াল। পুবদিক ফর্সা হয়ে আসছে। সে বুঝল আর দেরি করলে চলবে না। সে তাড়াতাড়ি হাসান পীরের কবরের কাছে এগিয়ে গেল। বৃষ্টিপাতের জন্য জল চারপাশে। মাঠে জল জমে গেছে। খুব জোর বর্ষণের ফলে চারপাশটা খাল বিলের মতো হয়ে গেছে। কবরের ভিতর জল জমে গেছে। যে বড় শানটার নিচে হাসান পীরের কঙ্কাল এখনও পড়ে আছে, যেখানে পাগল ঠাকুর আসত মাঝে মাঝে, এবং বলশালী মানুষ বলে যে মাঝে মাঝে শান তুলে কথা বলত পীরের সঙ্গে, সেই শানের নিচে সে ভাবল চাপা দিয়ে রেখে দিলে কেউ টের পাবে না। জল জমে গেছে কবরে। জলের ভিতর লাশটা পড়ে থাকবে। ওপরে শান চাপা। সুতরাং দু’দিন যেতে না যেতেই পচে মাটির সঙ্গে জলের সঙ্গে মিশে যাবে। এবং যেমন হাঁ করে হাসান পীরের কঙ্কালটা তাকিয়ে আছে ফেলুর দিকে, তেমনি পরে এসে সে একবার দেখে যাবে এই মানুষ কী ভাবে খুবসুরত মুখ নিয়ে উঁকি দিয়ে থাকে। তখনই যে সে বলতে পারবে, আমার নাম ফেলু। হালার কাওয়া।

    অর্থাৎ আমি মানুষ একখানা মিঞা। ভয় ডর নাই। সুখ সখ সব গেছে। বিবি আমার পলাতক। আমি মরেও মরি না। আমার বাঁচার বড় সখ। আমারে তোমরা কেউ বাঁচতে দিতে চাও না। আমার মরণ হাঁকবা ঠাকুর, তোমার কী আস্পর্ধা? আমি জানি তুমি আমারে হাতির পায়ের নিচে রাইখা মারতে চাইছিলা। পাগলা ঠাকুর! সে এবার একটা ঠ্যাঙ ধরে টানতে গিয়ে দেখল ভীষণ ভারি। তার এক হাতে কত আর শক্তি! সে এক হাতে টানাটানি করে লাশ এতটুকু হেলাতে পারল না। সে ডানদিকের পা’টা ওর ডান বগলে ফেলে কপিকলের মতো আটকে দিল। তারপর টানতে থাকল। কিছুটা নড়ছে। নড়ছে! সে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। পাশেই জল জমে আছে। জলের ভিতর নিয়ে ফেলতে পারলে এত ভারি লাগবে না। এবং এই ভেবে সে টেনে সে লাশ জলের ভিতর ভাসিয়ে দিল। তারপর ঠেলে ঠেলে যেখানে সেই কবর এবং নানারকমের গাছগাছালির ছায়া সেখানে সে ঠেলে ফেলে দিয়ে শানটা তোলার চেষ্টা করছে। ওর পক্ষে শান তোলা ভারি কষ্টকর। একমাত্র এ অঞ্চলে এই পাগল মানুষ পারতেন এত ভারি শান তুলে পীর সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে। আর কেউ পারত না। ফেলু এমন গল্প শুনেছে। সে তখন যথার্থ ফেলু, হা-ডু-ডু খেলোয়াড় ফেলু, তখন এমন বীরগাঁথা শুনে একবার এই হাসান পীরের দরগায় চলে এসেছিল। অনেক চেষ্টা করেও বলশালী ফেলু দু’হাতে শানটা নাড়াতে পারেনি। আজ সে কীভাবে যে পারবে! তা’ছাড়া কী উপায়! আছে এক উপায়। কবরের উপর বৃষ্টির জল জমে প্রায় হাঁটুজল। জলের নিচে এখন শানটা পাতলা হবে খুব। ওকে খুশি খুশি দেখাল। সে বলল, আমার নাম ফেলু। হালার কাওয়া!

    এক হাতে সে অনায়াসে লাশটাকে জলের ওপর ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিল। জল খুব অল্প। তবু যেখানে গর্তমতো জায়গা সেখানে খাল বিলের মতো জল। সে জলে টেনে এনে একেবারে ঠেলে ফেলে দিতেই ওর মুখ-চোখ শরীর সব কর্দমাক্ত হয়ে গেল। জোনাকিরা যা আটকে ছিল, মরে গেছে বোধ হয়। জলে ধুয়ে গেছে। সে আর জীব নেই। সে অশরীরী নয়। সে ফেলু। বার বারই তার মনে হচ্ছিল সে ফেলু। ফেলু শেখ।

    শানটা তুলে কবরে ফেলে দিতেই মনে হল একদিকে ঠ্যাং বের হয়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি জলের ভিতর ঠ্যাংটা ঢুকিয়ে দিল। পুব দিকটা এবার যথার্থই ফর্সা হয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি লাফ মেরে মাজারের ওপাশে চলে গেল। সে এখানেও হাঁটু গেড়ে বসল। শানটা জলের ভিতর থেকে তুলল। তারপর পা-টা ভিতরে ঢুকিয়ে দিলে বুঝল আর কিছু পড়ে নেই। সব অদৃশ্য। কেবল সে একা জেগে আছে। আর গাছগাছালি। শকুনেরা উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু লাশটাকে শানের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া মানেই ওদের আহার থেকে বঞ্চিত করা। মনে হল, সেই রাজা শকুনটা এবার ফেলুকে তেড়ে আসবে। সে মাঠে নেমে গেলেই দলবল নিয়ে শকুনগুলি ওকে তেড়ে আসবে। সে এবার কিন্তু সত্যি ভয় পেয়ে গেল। গাছপালার নিচে থেকে সে বের হচ্ছে না। সে দাঁড়িয়ে আছে। এবং গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে সেই রাজা শকুনটা ওকে উঁকি দিয়ে দেখছে কি-না। এই দেখতে দেখতে সে দেখল পুবের দিকে সূর্য উঠে গেছে। গাছের নিচে সকালের রোদ। আকাশ একেবারে পরিষ্কার নীল। কেবল প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুন চষা জমিতে জল জমে সূর্যের আলো ঝলমল করছে। সে হয়তো এই গাছের নিচে হাসান পীরের দরগায় আরও অনেকক্ষণ ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, কারণ, সেই এক ভয়, যেন মাঠে নেমে গেলেই শকুনেরা ওকে তাড়া করবে, যেমন এক দঙ্গল মাছি সব সময় ওকে তাড়া করছে, ওর ঘায়ের ওপর বসার জন্য ভনভন করে উড়ছে সঙ্গে সঙ্গে! যেখানে সে যায়, মাথার উপর সেই ভনভন করে মাছিদের ওড়া। সে কতদিন এই মাছি খপ্ করে ধরে ফেলে মেরে ফেলেছে। তালুতে চিপে প্রতিশোধের চোখে তাকিয়ে থেকেছে। ওর ঠিক এই মাছিদের মতো মনে হচ্ছে, এই শকুনেরা ওর দিকে এবার থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসবে। এবং সে যেখানে যাবে, তাকে তাড়া করবে। এমন সব আজগুবি ভয় ওকে মাঝে মাঝে এমন পেয়ে বসে যে সে আর স্থির থাকতে পারে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। পাষাণের মতো কেবল দাঁড়িয়ে থাকে। সে হয়তো এই কবরে তেমনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু সহসা ওর মনে হল সে তার বাগি গরুটার খোঁটা মাঠে পুঁতে দিয়ে এসেছে গতকাল সকালে। ওটা না খেয়ে আছে। এক খোঁটায় সে ঘুরে ঘুরে মরছে। অথবা হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে। কেউ নাই তার। না আন্নু, না ফেলু কাছে ভিতরে ভিতরে ফেলু গরুটার জন্য কেমন মমতা বোধ করল। সে তার নিজের জানের কথা মনে রাখতে পারল না। এই যে এখন এত শকুন মাথার উপর উড়ছে, মাঠে নেমে গেলেই তেড়ে আসতে পারে ভেবে সে যে নেমে যাচ্ছিল না মাঠে, এ সময় আর তা মনে থাকল না। সে বিহনে গরুর চোখ অন্ধকার। সে গতকাল বের হবার আগে গরুর চোখদুটো দেখেছে। দেখে ভুলতে পারছে না। একমাত্র পৃথিবীতে এই বাগিগরুটাই ওর ভিতরের দুঃখটা টের পেয়েছে। সেই গরুটা এখন তার কাছে, জানের মায়া বড় না ভালোবাসা বড় বুঝতে দিচ্ছে না। সে এবার চোখ বুজে সোজা চষা জমির ওপর দিয়ে জল কাদা ভেঙে ছুটতে থাকল।

    সে চোখ বুজে ছুটছে। ভয়ে সে পিছনে তাকাচ্ছে না। তাকালেই যেন সে দেখতে পাবে শকুনেরা ঝাঁকে ঝাঁকে তাকে তাড়া করছে। এমন পুষ্ট খাবার সে লুকিয়ে রেখেছে শানের নিচে। পচে যাবে, মাটিতে মিশে যাবে, তবু সে খেতে দেবে না। না কী সেই ঠাকুর, পাগল ঠাকুর যাঁর প্রাণ নিশীথে ভুবনময় ঘুরে বেড়ায়, ওর পিছনে শকুন লেলিয়ে দিয়েছেন! মানুষজন ভাবত, এই মানুষ সামান্য মানুষ নন, পীর মানুষ, সে মানুষ প্রাণ ফিরে পেতে কতক্ষণ।

    সে ভয়ে কতক্ষণ যে এভাবে ছুটেছিল তার হুঁশ নেই। বেশ বেলা হয়ে গেছে। এখন আর শকুনেরা নাগাল পেতে পারে না। সে তার গাঁয়ে উঠে এসেছে প্রায়। পাশে সেই গ্রাম। ঠাকুরবাড়ির দিকে সে তাকাল। মানুষজন লেগেই আছে। বাড়িটিতে মানুষের যে কী কাম এত! সে বুঝতে পারে না। সে দেখল হাসিমের বাপ দুধ নিয়ে যাচ্ছে। ইসমতালি নিয়ে যাচ্ছে এক টিন গুড়, কেউ মধু দিয়ে আসছে, কেউ বাঁশ মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। কত কাজ সে-বাড়িতে। সবাইকে কেমন কেনা গোলাম বানিয়ে রেখেছে। তা রেখেছে। সে যে এমন একটা মজার কাজ করে ফেলেছে, যেন সে কোনও মানুষ হত্যা করে নাই, সে হত্যা করেছে আজব একটা জীবকে, যার কোনও হুঁশ নেই। সে যেমন ডাল কেটে, ঘাস কেটে ধার দেখে তেমনি সে আকালুকে জবাই করার আগে ধার দেখে এসেছে কোরবানীর চাকুটার। আর তখনই সে দেখল পয়মাল সেই যণ্ড। বাগি গরুটার পিছনে লেগেছে। গরুটা দুপা এমন ছুঁড়েছে যে লাথি খেয়েও নড়ছে না। হালার কাওয়া। তুমি এক ষণ্ড। আমার জীবের লগে পীরিত তোমার। সে সহ্য করতে পারছে না, ওর ভিতরে আগুন দপ করে জ্বলে উঠেছে। আবার পায়ের রক্ত মাথায়। আকালু তার বিবি নিয়ে পালায়, ধর্মের যণ্ড ওর জীবকে জোর করে পাল খাওয়াতে চায়, এত আস্পর্ধা! এত বড় যণ্ডের সঙ্গে পারে কী করে তার জীব। সে ফের টেনে ধরল চাকুটা। এবং বাতসে আবার ইস্পাতের ফলাটাকে খেলাতে থাকল।

    যণ্ডটা ফেলুকে দেখতে পাচ্ছে না। বাগি গরুটার পাছা মোটা এত বেশি যে সেখানে মুখ লুকালে ফেলুকে দেখা যায় না। ফেলুর কাছে শালা যণ্ড এখন আকালু বনে গেছে। সেই তাজা চেহারা। রোদের ভিতর চকচকে ফেজ টুপি মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভাগা গরুটা তার বিবি। যেন আন্নুর কোনও ইচ্ছা ছিল না। সারা জীবন সে এই বাগি গরুর মতো পিছনে পা ছুঁড়ছে, আর আকালু সে-সব তুচ্ছ করে নাক উঁচু করে রেখেছে বিবির পিছনে। মেয়েমানুষ কত পারে! সে পারেনি বলে মানসম্মান নিয়ে শেষপর্যন্ত ভেগে গেছে। আন্নুর মতো ওর বাগি গরুটার জোরজার করে পাল-খাওয়া মুখ দেখে সে তার রোষ সামলাতে পারল না। চাকুটা তুলে সে জানের মায়া না করে যণ্ডটার গলার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এবং অতর্কিতে গলকম্বলটা ফাঁক করে দিতেই যণ্ডের হুঁশ হল, গোত্তা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে চার পায়ের ওপর উঠে দাঁড়াল। সবটা টেনে দিতে পারেনি। চার পায়ের ওপর শক্ত করে দাঁড়াতেই ষণ্ডটা দেখল ওর গলায় চাকু চালিয়ে দুশমনটা ছুটছে। গলগল করে রক্ত ওগলাচ্ছে নালিটা। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মহাজীবটা এবার ছুটতে থাকল। ফেলুও পড়িমড়ি করে বাড়ির দিকে উঠে যাচ্ছে।

    যণ্ডটা মাঠের ওপর দিয়ে ফেলুকে মেরে ফেলার জন্য তেড়ে যাচ্ছে।

    লোকজন দেখেতে পাচ্ছে ফেলু ছুটছে মাঠের ওপর দিয়ে আর যণ্ডটা ছুটছে পিছনে। ধর্মের ষণ্ড সামান্য এক মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

    গেল গেল রব। সবাই যেখানে যত মানুষ আছে ফেলুর চিৎকারে ছুটে আসছে। আমারে বাঁচান, আমারে বাঁচান। এক হাত ওপরে তুলে সে ছুটছে। সে জানে তার রক্ষা নেই। সে যণ্ডের চোখের ভিতর তার মরণ দেখে ফেলেছে। মহারোষে ছুটছে। জীবের শেষ সময়। চোখের ওপর নীল রঙের পর্দা। এবং দুশমনটা সেই নীল রঙের একটা দৃশ্যের ভিতর কেবল ছুটে যাচ্ছে। সেও ছুটে যাচ্ছে। ফেলু পিছনে তাকাচ্ছে, আহা, এ-যে উঠে এল। আমারে বাঁচান। কেডা আছেন, আমারে বাঁচান গ, আমারে রক্ষা করেন।

    মানুষজন কেউ এগোচ্ছে না। সবাই দাঁড়িয়ে বুঝি তামাশা দেখছে। না এমন মনে হল না। কিছু লোকজন ছুটছে। বড়বৌ রাতে ঘুমাতে পারেনি। সেও এই চিৎকার শুনে মানুষের সোরগোল শুনে ছুটে এসেছিল পুকুরপাড়ে। কে আর যাবে সামনে! মানুষে আর যণ্ডে লড়াই। মরিয়া হয়ে ফেলু যেই না রুখে দাঁড়াবে ভাবল এবং ফাঁক বুঝে আর একটা চোখ গেলে দেবে ভাবল তখনই যণ্ডটা কেমন অদৃশ্য হয়ে গেছে ওর চোখের ওপর থেকে। বস্তুত যণ্ডটা তখন ওর যে চোখটা নেই সেদিকে আছে। মুখ ঘুরালেই সে দেখতে পেত কী রোষ জীবের। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কেবল চার পায়ের ওপর লাফাচ্ছে। আহা সে যদি সবটা টেনে দিতে পারত! সে আর পারল না। যণ্ডটা ওর উপর এসে দ্রুত লাফিয়ে পড়েছে। ওর যদি দুটো চোখ থাকত! আহা দুটো চোখ। ধর্মের যণ্ডের মতো সে একচক্ষু জীব হয়ে গেছে। সবটা দেখতে পায় না। কিছুটা দেখতে পায়। কিছুটা দেখে, কিছুটা জানে, কিছুটা বোঝে এবং শেষপর্যন্ত ফেলুর মতো একটা বাগিবাছুর মাঠে ছেড়ে দেয়। সে বলল, আল্লা এডা কি হইল! কারণ যণ্ড তার প্রবল প্রতাপান্বিত দুই শিঙ নিয়ে এমন জোরে ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে যে সে জানে না পিছনে এক বড় কাফিলা গাছ আছে, নরম গাছ এবং সে তার সামনে দাঁড়িয়ে ষণ্ডের সঙ্গে লড়াই করার জন্য শেষবার প্রস্তুত হচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে কেউ ছুটে আসছে না। সে হায় হায় করে বাতাসে ছুরি শান দিতেই প্রবল প্রতাপান্বিত যণ্ড শিং ঢুকিয়ে একবার গাছের সঙ্গে গেঁথে নিজে চার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। পেটের ভিতর শিঙ ঢুকে কাফিলা গাছ ফুঁড়ে ওপাশে শিঙ বের হয়ে গেছে। সে কেমন একটা দীনহীন মানুষের মতো শেষবার ডাকল, আল্লা আমার এই আছিল কপালে! বলতে বলতে সে দেখল, তার পেটের ভিতর থেকে সব রক্ত উপছে যণ্ডের মুখ রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। যণ্ডের গলকম্বল ছিঁড়ে গেছে বলে গরম রক্ত এবং শ্বাসনালীর ভিতর থেকে রক্ত প্রবলবেগে বের হয়ে ফেলুকে ভাসিয়ে দিচ্ছে।

    দুই জীব এখন দুই পরম আপনজনের মতো কাফিলা গাছের নিচে পড়ে আছে। যণ্ডের প্রাণ নেই, ফেলুর প্রাণ নেই। আহা ফেলু তুমি একখানা মানুষ! তোমার জয় দিবার কেহ নাই হে! আমি লেখক তোমার হয়ে জয় দিলাম। ফেলু তুমি বড় মানুষ হে। তুমি জান লড়াই করতে। তোমাকে এভাবে মরতে দেখে আমার ভারি কষ্ট হচ্ছে।

    সব গ্রাম ভেঙে পড়েছে তখন এই মাঠে। ফেলুর বাড়ির সামনে। কেউ কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ ষণ্ডটা এমন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কেন বুঝতে পারছে না। সবার ধারণা যণ্ড ফেলুর পেট ফাঁসিয়ে দিয়েছে, তারপর বাগে পেলে যে সামনে পড়বে তারই পেট ফাঁসাবে। ষণ্ড ক্ষেপে গেছে। ওরা সবাই লাঠি বাঁশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফেলুকে ফেলে দিয়েছে এবং এবার এদিকে ছুটে আসবে। ধর্মের ষাঁড়। ওকে কিছু করতে নাই। তা একটা জান গেছে তো কী হয়েছে! তা ছাড়া ফেলুর তো এ-ভাবেই যাবার কথা। সুতরাং যাতে অন্যদিকে ছুটে না যায়, এবং তেড়ে গিয়ে অন্য কাউকে আঘাত না করে সেইজন ওরা চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরে। অথচ বেশ সময় পার হয়ে গেছে, কেন ষণ্ডটা উঠে আসছে না! দু একজন এবার পা পা এগুতো থাকল। আরে এডা কি হইল! যণ্ডটার গলা কাটা। ফেলুর চোখ খোলা। পেটের নাড়ি সব বের হয়ে আসছে। শিঙের ভিতর জড়িয়ে গেছে। ফেলু এক হাতে তখনও কোরবানীর চাকুটা শক্ত করে ধরে আছে।

    লোকগুলি বলল, হা আল্লা।

    ফেলু আর ধর্মের যণ্ড এখন জড়াজড়ি করে পড়ে আছে গাছটার নিচে। আকাশে সূর্য তেমনি কিরণ দিচ্ছে। ঠাকুরবাড়িতে তেমনি কেউ মধু, দুধ, দই এবং বাঁশ নিয়ে যাচ্ছে। বড়বৌ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখছে। মানুষটা ফিরে আসেননি। মাঝরাতে সোনার কী যে আবার হয়েছিল। আবার আগের রাতের মতো ভয়ে নীল হয়ে গেছিল। জ্বর। সে কেবল বলছে, আমি মরে গেলাম। জ্যেঠিমা আমাকে কারা মেরে ফেলছে। জল। জল। ঐ ঐ আসছে, আসছে।

    সবারই বিছানা থেকে উঠতে বেলা হয়ে গেছে। সাদা পাথরে ফলমূল কেটে রেখে দিয়েছিল বড়বৌ। যদি তিনি আসেন। আসেননি। সকালে উঠে সবাইকে ডেকে, বড়বৌ এখন পাগল মানুষের জন্য রাখা ফলমূল বিতরণ করে দিচ্ছে।

    তখনই এ-গাঁয়ে খবর এল যণ্ডটা ফেলুর পেট এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিয়েছে।

    ঈশম এসে তখন বলছিল, ঠাইরেন একটা কথা কই।

    বড়বৌ সব ফলমূল ততক্ষণে বিলিয়ে দিয়েছে। হাতে তার খালি সাদা পাথরের থালা। সে, ঈশম কী বলবে, কোনও গোপনীয় কথা নিশ্চয়ই, সুতরাং সে সবাইকে চলে যেতে বলল, কিছু বলবে?

    —ফেলুডা না-পাক মানুষ। দাফনের টাকা অর জাতভাইরা কেউ দিব না কয়।

    বড়বৌ বুঝতে পারল ঈশম দাফনের জন্য কিছু টাকা চায়। সে গোপনে এই টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এবং দাফনের নিমিত্ত যা কিছু করণীয় সে করবে।

    বড়বৌ তার যা সঞ্চয় ছিল, তা থেকে কিছু দিয়ে দিল। বলল, সারাটা জীবন ফেলুর বড় কষ্ট গেছে।

    —তা গেছে বড়মামি।

    —অথচ দ্যাখো ফেলুর কী না ছিল! সেই চেহারা। এখনও আমার চোখে ভাসে, ফেলু গোপালদি থেকে যে-বার হা-ডু-ডু খেলে শীল্ড নিয়ে আসে। গাঁয়ের লোকে ওকে নিয়ে কত বড় উৎসব করেছিল। আর আজকে ওর দাফনের টাকা কেউ দিচ্ছে না।

    ঈশম চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর সহসা কী মনে হতেই বলল, বড় মামা ফিরা আইছেন?

    —না। আসেননি।

    শশীভূষণও এ-সময় উঠোনে কি কাজে চলে এসেছিলেন। তিনি বললেন, শুনেছেন বড়বৌদি, ফেলুর পেটে খোদাই ষাঁড়টা শিং ফুড়ে দিয়েছে।

    —শুনেছি।

    —বড় হারমাদ ছিল।

    বড়বৌ কিছু বলল না।

    —কর্তা ফিরেছেন আপনার?

    বড়বৌ মাথার ঘোমটা টেনে দিল। বলল, না।

    —আজ ঠিক ফিরে আসবেন। আজ নিয়ে দু’দিন হল না?

    —দু’দিন। বলে শশীভূষণকে সে অনুরোধ করল, আপনি একবার যাবেন বিকেলে খুঁজতে? লালটু পলটুকে পাঠাবেন? ওরা তো আপনার কথা শোনে।

    ঈশম বড়মামির চোখ দেখলেই সব টের পায়। সে বলল, বড়মামি আমি যামু। বিকালে কোন কাজ হাতে রাখমু না। কেবল মাঠেঘাটে বড়মামারে খুইজা বেড়ামু।

    শশীভূষণ বললেন, ঠিক পেয়ে যাবে। দেখ গিয়ে হয়তো কোন ঢিবিতে উঠে বসে রয়েছেন। সেখান থেকে কী করে নামবেন বুঝতে পারছেন না। একমাত্র তুমি অথবা সোনা তাকে নামিয়ে আনতে পার। কী বলেন বড়বৌদি ঠিক না?

    বড়বৌ এমন কথায় ম্লান হাসল।

    কেউ আর এখন বড়বৌর কথার গুরুত্ব দিতে চায় না। তিনি নিরুদ্দেশে গেছেন, চলে যান বার বার, তাঁকে কেউ ফিরিয়ে আনতে পারে না, তিনি নিজেই চলে আসেন। সুতরাং শশীভূষণ বললেন, আপনি অযথা ভাবছেন বড়বৌদি। ভেবে তো কিছু হবে না।

    ঈশম চলে গেল তখন। শশীভূষণ বললেন, কখন বের হয়েছে, আপনি দেখেননি বের হতে?

    —না দেখিনি। কি যে কুয়াশা করল!

    —কোনদিকে নেমে গেছেন কেউ বলতে পারে?

    —তাও জানি না। সোনাকে নিয়ে এত বেশি সবাই ব্যস্ত ছিলাম যে ওঁদের হবিষ্যান্ন পর্যন্ত করাতে পারিনি। মানুষটা না খেয়ে কোথায় যে বের হয়ে গেলেন!

    —আসবেন। চলে আসবেন ঠিক।

    —সে তো আমিও জানি চলে আসবেন। কিন্তু মন যে মানে না। না খেয়ে কোথায় যে উপবাসী মানুষটা বসে রয়েছেন! বলতে বলতে বড়বৌর চোখ থেকে টপটপ করে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। শশীভূষণও বড়বৌর এমন চোখমুখ দেখলে বড় কষ্ট পান। যেন বোঝ-প্রবোধ দেবার মতো বললেন, আচ্ছা পাঠাচ্ছি লালটু পলটুকে। আমি নিজেও খুঁজতে যাব। আপনি অযথা কাঁদবেন না।

    কান্না ভাল নয় বড়বৌও জানে। কাঁদলে মানুষের কোনও শুভ হয় না। সে চোখ আঁচলে মুছে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিচ্ছিল তখনই শচীন্দ্রনাথ এসে বললেন, বড়দা রাতে ফিরা আইছেন?

    কারণ শচীন্দ্রনাথ জানেন রাতে তিনি প্রায়ই ফিরে আসেন। সকালে অনেক সময় টের পাওয়া যায় না। হয়তো পুকুরপাড়ে কিংবা চুপচাপ ঘরেই বসে রয়েছেন। সুতরাং বড়বৌদি ওকে ঠিক খবর দিতে পারবে! সেজন্য প্রশ্ন করে জেনে নিলেন, তিনি এসেছেন কিনা! আসনেনি। শচীন্দ্রনাথকে আদৌ উদ্বিগ্ন দেখাল না। এখন কত নিয়মকানুনের ভিতর থাকতে হয়, তা না করে তিনি মাঠে ঘাটে কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যে যা দিচ্ছে খেয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এটা ভালো লাগছে না। না খেলে মানুষটা এমন অনিয়মের ভিতর এত বলশালী থাকেন কী করে! কিন্তু বড়বৌর মনে হয় তিনি হাঁটছেন, হাঁটছেন। চারপাশে যা কিছু রয়েছে, এই যে নীচতা হীনতা, সব অবহেলা করে হেঁটে যাচ্ছেন। কোথাও কিছু তিনি খাচ্ছেন না। কেবল উপবাসী থেকে সন্ন্যাস জীবনযাপন করছেন।

    তখনই মনে হয় বড়বৌর, কোথাও গীর্জায় ঘণ্টা বাজছে। একটা নীল মতো মরুভূমি জায়গা। চারপাশে ধু ধু বালুরাশি। কোনও গাছপালার চিহ্ন নেই। একজন মানুষ নিয়ত তার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। দূরে অতি দূরে গীর্জায় ঘণ্টাধ্বনি। প্রায় কোনও মহামান্য সন্ন্যাসীর মতো এই মানুষ তখন মরুভূমি পার হয়ে দুঃখী মানুষের আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। বলছেন, ঐ দ্যাখো আকাশে কত আলো, পৃথিবীর গাছপালার ভিতর অথবা এই যে মরুভূমি তার ভিতর ঈশ্বরের কী অপার রুরুণা! তিনি হাত তুলে সবাইকে আশীর্বাদ করছেন। ঘাস ফুল পাখিকে বলছেন, অনন্তকাল এই পৃথিবীতে তোমরা বিচরণ কর। তোমরা সুখে থাকো।

    যখন তিনি এমন মানুষ তখন তাঁর পৃথিবতে আর কে শত্রু থাকবে! কে তাঁর অনিষ্ট করবে! সুতরাং বড়বৌ লালপেড়ে একটা নতুন কোরা শাড়ি পরে বড় আয়নার সামনে দাঁড়াল। বড়বৌ বলে তাকে হবিষ্যান্ন করতে হচ্ছে। সে সিঁদুর দিতে পারছে না কপালে। চুল আঁচড়াতে পারছে না। চুলে তেল দিতে পারছে না। সেও কেমন ধীরে ধীরে সন্ন্যাসিনী হয়ে যাচ্ছে। মানুষটা ফিরে এলে সে আবার বড় করে কপালে সিঁদুর ফোঁটা দেবে। যা কিছু অলঙ্কার আছে পরবে। তখন মাথা নেড়া থাকবে মানুষটার। পরনে নতুন কোরা ধুতি। সে মৎস্যস্পর্শের দিন এমনভাবে সেজে আসবে যে মানুষটা তাকে দেবদাসী ভেবে চোখ বুজে ফেলবে। মানুষটা ফিরে এলে কী যে করবে না এবার! তাঁর পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে থাকলে তাঁকে ঠিক কপিলাবস্তু নগরের সেই সন্ন্যাসী রাজকুমারের মতো মনে হবে। সে যশোধরা। এমন মনে হতেই কেন জানি বড়বৌর আর কোনও দুঃখ থাকল না। সে এখন এ-ঘর ও-ঘর ছুটে ছুটে কাজ করছে।

    সোনার কপালে হাত রেখে বলছে, কীরে তুই ভালো হবি না! কবে হবি! কবে যাবি আনতে তোর জ্যাঠামশাইকে? তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠ। কত লোকজন আসবে কত বড় কাজ হবে বাড়িতে আর তুই শুয়ে থাকবি, আমার ভালো লাগে!

    আবেগের বশেই এসব বলে গেল বড়বৌ। তার ভালো লাগছে—সেই মুখ, সন্ন্যাসী রাজকুমারের মুখ তার চারপাশে এখন এক অদৃশ্য ছবি হয়ে আছে। তার চারপাশে ঘুরছে ফিরছে। মনে মনে বড়বৌর সঙ্গে তার সঙ্গে তাঁর মানুষ কথা বলছেন। তার আর ভয় কী! সে কাঁদবে কেন! অতীতের সেই কপিলাবস্তু নগর তার প্রাসাদ, রাজা শুদ্ধোধন এবং সেই সুন্দর স্বপ্ন মায়া দেবীর—মহারাজ রাতে এক সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম। একটা ছোট্ট সাদা হাতি আস্তে আস্তে আমার কোলে নেমে এল। তারপর ধীরে ধীরে সে কোথায় মিলিয়ে গেল দেখতে পেলাম না। বৈশাখী পূর্ণিমায় রাজকুমারের জন্মের দিনটি কল্পনা করতে বড়বৌর আজ খুব ভালো লাগছিল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }