Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১৭

    ২.১৭

    মনে হল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঈশমকে কেউ ডাকছে। সে খুব ব্যস্ত ছিল বলে প্রথমে খেয়াল করে নি। সে একাই আজ একশো। ওর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে আবেদালি। সে আর কাউকে সঙ্গে পাবে আশা করেনি। হ্যাঁ, আর একজনকে সে পেয়েছে, সে মানুষের নাম অলিমদ্দি। অলিমদ্দি মুড়াপাড়ার ফর্দ অনুযায়ী ধারে পাঁচটা মুনিষ নিয়ে বাজার করে ফিরছে। সুতরাং সে ছিল। আর আছে এখন যে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ইশারায় তাকে ডাকছে।

    চোখে খুব একটা আজকাল ঈশম ভালো দেখে না। আবেদালিই তার নজরে এনে দিল। চাচা ঐ দ্যাখেন আপনারে ডাকতাছে।

    —কেডা আমারে ডাকে?

    —মনে হয় হাজিসাহেবের মাইজলা বিবি।

    ওরা দুজন আরও কাছে এগিয়ে গেল। বটগাছটা পার হলেই হাজিসাহেবের অন্দরের পুকুরের ও-পাড়ে কদম গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। সে কাছে গিয়ে বুঝল, ফেলুর সেই ছলচাতুরি করে ধরে আনা বিবি। উজানে হাজিসাহেব গেছিলেন। ফেলু তার যৌবন দেখিয়ে তুলে এনেছিল বিবিকে। এ-সব এখন কত অতীতের কথা। কে আর এ-নিয়ে বাকবিতণ্ডা করে। সবই মানুষের ধর্ম ভেবে ঈশম সন্তর্পণে ও-পাড়ের ঘাটে চলে গেল। ঈশম বুড়োমানুষ বলে এ-গাঁয়ে সে প্রায় সবার কাছে আপনার জনের মতো। সে কাছে গেলে মাইজলা বিবি কোমর থেকে একটা ঘুনসি বের করে বলল, টাকা দিলাম চাচা। অর কবরে দিয়েন।

    ঈশম দেখল একটা দুটো টাকা নয়। প্রায় পাঁচ কুড়ি টাকা। সে বলল, এত লাগব না।

    মাইজলা বিবি চারদিকে তাকাচ্ছে। কেউ আবার দেখে ফেলছে কিনা। সে গোপনে টাকাটা দিতে এসেছে ঈশমকে। সে কাফিলা গাছটা পর্যন্ত যেতে পারেনি। তাকে হাজিসাহেব যেতে দেন নি। সবাই দেখে এসেছে ষাঁড়টা এবং ফেলু অদ্ভুত এক দৃশ্য তৈরি করেছে কাফিলা গাছের নিচে। মাথাটা ফেলুর ঢলে পড়েছে ষাঁড়টার ঘাড়ে। ষণ্ডের মুখ কাত হয়ে আছে। এবং যণ্ডের চোখ মরে গিয়ে নীল, কানা চোখটা দেখা যাচ্ছে না। ফেলুরও কানা চোখটা আড়ালে পড়ে গেছে। যণ্ডের গলা কাটা আর ফেলুর পেট ফেঁসে গেছে। মাইজলা বিবি আড়ালে দাঁড়িয়ে মানুষটার জন্য চোখের জল ফেলেছে। কেউ যাচ্ছে না দাফনে। সে-ই ডেকে এনেছিল ঈশমকে। খবরটা দিয়েছিল। তারপর মানুষটার দাফনের টাকা হবে না ভেবে প্রথম দাফনের জন্য কিছু টাকা, এবং পরে মনে হল মাইজলা বিবির, এই তো তার মানুষ, যার রঙ্গরসে ভুলে উজানি নৌকাতে পা দিয়েছিল। হাজিসাহেব ফেলুকে দিয়ে ফাঁদ পাতিয়ে ছিলেন। ফেলুর সে-সব দুষ্কর্মের কথা এখন আর মনে হয় না। ফেলু তার কাছে বড়-মানুষ। সে তার সামান্য এই সঞ্চিত কটা টাকা দিয়ে কী করবে! সে বলল, রাখেন।

    ঈশম বলল, না এত লাগব না। বলে সে হিসাব করল মনে মনে তারপর মাত্র গোটা পাঁচেক টাকা রেখে ফিরিয়ে দিল।

    কিন্তু মাইজলা বিবি টাকা আর ফেরত নিল না। বলল, আমি যাই চাচা। সব টাকা রাইখা দ্যান। টাকায় অর কবরে একটা মাজার বানাইয়া দিবেন। বলে বিবি আর দাঁড়াল না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা আর ঠিক না। দেখতে পেলে হাজিসাহেব আবার পাঁচন নিয়ে তেড়ে আসবে। সে বলল, মর্জিতে যা লয় করবেন চাচা।

    ঈশম এই মেয়ের মুখের দিকে আর যথার্থই তাকাতে পারছিল না। সারাজীবন, সারাজীবন বলতে প্রায় বিশ সালের ওপর হবে এই এক হাজিসাহেবের ঘরে নিঃসন্তান বিবি, দু’কুড়ির কাছাকাছি বয়স। যা কিছু সঞ্চয় তার, সবই বোধহয় এটা-ওটা বেচে। যেমন দু কাঠা খেসারি কলাই গোলা থেকে বেচে দিলে কেউ টের পায় না। সারাজীবন, জীবন বিপন্ন করে যা কিছু সে পেয়েছে সে সব দিয়ে গেল। তাকে ইঁটের বায়না দিতে হবে তবে। এখানে তো এখন ইঁট পাওয়া যাবে না। কখন যে সে কি করে!

    তবু সবাই দেখল, অদ্ভুত একখানা কাণ্ড, পরদিন নদীতে একটা ইঁটের নৌকা লেগে রয়েছে। এবং যেখানে জালালিকে কবর দেওয়া হয়েছে তার পাশে আর একটা কবর। কবরের চারপাশে ইঁট গেঁথে দিচ্ছে। কোথায় যে এত পয়সা পেল ঈশম, ঈশমকে বললে সে হাসে। সে বলল, মানুষ কখনও না-পাক হয় না। সে খুব ধর্মাধর্ম বোঝে না। সে কোরানশরিফ পাঠ করতে পারে না বলে বড় আফসোস। সময় পেলে মসজিদে বসে সেই অর্থহীন শব্দ শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যায়। তার কাছে অর্থহীন এই জন্য যে আরবী ভাষায় সব আয়াতের অর্থ সে বুঝতে পারে না, কেবল যেন এক ফকির ওকে হাত ধরে কোন নদীর পাড়ে নিয়ে যান। তারপর নদী সমুদ্রের মতো মনে হয়। অনন্ত জলরাশি, এবং একটা বড় নৌকা সে দেখতে পায়। সেই নোয়ার নৌকা। সেই নবি মানুষটা সবাইকে ডাকছেন, যারা পুণ্যবান মানুষ, গরু, ঘোড়া, হাতি, মোষ, পাখি, কবুতর কত জীব নিয়ে সে নৌকায় তুলছে। ঈশম কখনও কখনও সেই নবির মতো চরে দাঁড়িয়ে থাকে—যেন সে একটা বড় নৌকা তৈরি করে দাঁড়িয়ে আছে, প্রথমে সে নৌকায় তুলে নেবে পাগল ঠাকুরকে, তারপর সোনাবাবুকে, ফেলু বেঁচে থাকলে সে বুঝি তাকেও নিত। কেয়ামতের দিন মনে হলে মহাপ্লাবনের কথা তার মনে আসে। সে তখন আর কিছু মনে করতে পারে না।

    ফেলুর ইঁট দিয়ে বাঁধানো কবরটা দেখে হাজিসাহেব ছেলেদের ডাকলেন। বললেন, তোমরা আমার কবর ইঁট দিয়া বান্দাইয়া দিয়। আর তার মাইজলা বিবি ঘাটে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মাজারে রাতে মোমবাতি জ্বালাতে ইচ্ছা যায়। কিন্তু সে সন্ধ্যায় পারে না। পৃথিবীর যাবতীয় মানুষ যেন জেগে রয়েছে। ওকে পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু যখন এই অঞ্চল নিশুতি রাতে ঘুমিয়ে পড়ে, কোনও কাকপক্ষী ডাকে না, কেবল মাঝে মাঝে সে ঝোপে-জঙ্গলে কীট-পতঙ্গের আওয়াজ পায়, তখন ধড়ফড় করে উঠে বসে। শিয়র থেকে ম্যাচ বাতিটা তুলে নেয় হাতে। একটা মোমবাতি তুলে নেয় এবং নিশীথে কালো বোরখা পরে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে সে এই কবরে নেমে আসে। কবরের মাজারে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। সে ডাকে মিঞা আমি আইছি। মোমবাতি জ্বালাতে আইছি। সে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে। ফেলুর হয়ে সে শোক করে। কেউ জেগে নেই বলে সে মাথা নুইয়ে রাখে কবরের পাশে। এবং নামাজের ভঙ্গিতে বসে থাকে। যেন সে নামাজই পড়ছে।

    সারারাত্রি ধরে কেউ কেউ খবর পায় এক বোরখা পরা বিবি এই কবরে হাঁটাহাঁটি করে। হাতে তার মোমবাতি। সবাই আবার কোন অশরীরীর গন্ধ পায় চারপাশে। এটাই রক্ষা করেছে মাইজলা বিবিকে। সে বের হয়ে যায়। কারণ, সে এক ঘরে একা থাকে। ঝাঁপ বন্ধ থাকে। হাজিসাহেব ছোট বিবির বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকেন। পাঁচ ওক্ত নিয়মিত নামাজ পড়েন। ধর্মাধর্মে তাঁর কোনও ফাঁকি নেই।

    আর মাইজলা বিবি কেমন নিশুতি রাতে কবরের গন্ধে পাগল ব’নে যায়। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মোমবাতি জ্বালাতে পারলে সে আর স্থির থাকতে পারে না। কবরের পাশে বসলেই মনে হয় মানুষটা কবর থেকে উঠে এসেছে। এবং ওর সেই মুখ চোখ, একেবারে যৌবনকাল তার। সে যৌবনকালের ফেলুকে নিয়ে তখন একেবারে একা। মাইজলা বিবির চোখে জল, অস্ফুট গলায় বলে, আমি আর পারি না মিঞা। বাইচ্যা থাকতে তোমারে পাইলাম না মিঞা। আমার যে কি কসুর!

    হাজিসাহেব ফেলু মরেছে জেনেই মাইজলা বিবির পাহারা তুলে দিয়েছেন। হাজিসাহেবের আর কোন ডর নেই। মাইজলা বিবি শোক করতে করতে আবার সেই গানটা গায়, সখি সখি গলায় দড়ি ওলো সখি ললিতে!

    .

    বড়বৌ তখন আশায় আশায় রাত জাগে। মানুষটা যেমন সহসা ফিরে আসেন তেমনি আসবেন। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঠের দিকে তার অপলক দৃষ্টি। জ্যোৎস্না রাত বলে অনেক দূর সে অস্পষ্ট কিছু দেখার চেষ্টা করে। মেঝেতে ভূপেন্দ্রনাথ, চন্দ্রনাথ, শচীন্দ্রনাথ এখন ঘুমুচ্ছেন। ওঁরা জানেন বৌদি ঘুমাবে না। ওঁদের রাতের হবিষ্যান্ন করিয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আলাদা পাথরে দাদার জন্য সব রেখে দিয়েছে। তিনি ফিরে না এলে সকালবেলা সবাইকে হাতে হাতে বিলিয়ে দেবে সব। সোনাকে দিতে পারে না। ওর অসুখ এখনও নিরাময় হয়নি। বড়বৌ বলে রেখেছে সোনাকে, ওর অসুখ নিরাময় হলেই, সে অসুখের যে কদিন যা কিছু খেতে পায়নি সব তাকে খাওয়াবে। সোনা সেজন্য সকালে একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে দেখতে পায় জ্যেঠিমা পাগল জ্যাঠামশায়ের জন্য যা রেখেছিলেন, যেমন নারকেল, বাঙ্গি, কমলা, তরমুজ সব হাতে হাতে সবাইকে দিয়ে দিচ্ছেন। ওকে দুটো একটা কমলার কোয়া দিয়ে যান। সোনা চাদরের নিচে লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। ওর শুধু রসটা খাবার কথা। কিন্তু সে চুরি করে সবটাই খেয়ে ফেলে।

    জ্যেঠিমা কাছে এলেই ওর কেবল জানতে ইচ্ছা হয়, জ্যাঠামশাইকে কে কে খুঁজতে বের হয়েছে।

    ঈশম কাজের ফাঁকে দিনমান খুঁজছে। সে বস্তুত সময়ই পাচ্ছে না। আত্মীয়-কুটুম সব একে একে চলে আসছে। ওদের থাকবার জন্য বাঁশ পুঁতে বড় বড় লম্বা লম্বা চালা ঘর তুলতে হচ্ছে। চোয়াড়ি হবে। বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ। দান ধ্যান হবে সামান্য। পরগণার যত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সব নিমন্ত্রিত হবে। সুতরাং ঈশম বলতে গেলে সময়ই দিতে পারছে না। কেবল সকালের দিকে শশীভূষণ লাঠি হাতে বের হয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের সব ছাত্রদের ডেকে বলেছিলেন, তোরা খবর দিতে পারিস কিনা দেখ। পাগল কর্তা নিখোঁজ। তা তিনি তো এমনই ছিলেন। না বলে কয়ে বের হয়ে যান। দু’চার দিন পর ফিরে আসেন। কখনও দশ পনের দিনও হয়ে যায়। একবার মাসাধিককাল কোন খোঁজ ছিল না। তবু চিন্তার কারণ। আজ বাদে কাল বুড়ো কর্তার এত বড় কাজ! তখন মানুষটা কাছে থাকবেন না কী করে হয়! তোরা খোঁজ নিতে পারিস কিনা দ্যাখ।

    মাস্টারমশাইকে খুশি করার জন্য সবারই ভীষণ উৎসাহ। ওরা ওদের গাঁয়ে গাঁয়ে মাঠে মাঠে এমন কী যত ঝোপজঙ্গল আছে সেখানে খুঁজে খুঁজে দেখেছে। এবং দু’ক্রোশের মতো পথ হেঁটে কেউ কেউ খবর দিতে এসেছে, স্যর পাইলাম না। কোনওখানে নাই। ওরা এলে বড়বৌদিকে শশীভূষণ ডাকলেন, বললেন, জানেন বৌদি ওর নাম করুণা। ওদের বাড়ি ব্রাহ্মন্দী। ওকে খুঁজে দেখতে বলেছিলাম।

    —তুমি কাদের বাড়ির ছেলে?

    —রায়বাড়ির। আমি অর্জুন রায়ের ছেলে।

    শশীভূষণ বললেন, সবাইকে বলেছি। আমার তো ছাত্র কম নয়।

    —আমি স্যর খবর দিতে আসলাম। আমার বা’জি কইল, কেউ দেখে নাই এমন মানুষ।

    বড় বৌ বলল, তখন খুব কুয়াশা করেছিল।

    —আমার চাচারা মাঠে আছিল। ওদিক দিয়া গ্যালে এমন মানুষ নজরে না আইসা যায়!

    —ওর নাম আবদুল, বৌদি।

    বড়বৌ ওদের দুজনকেই দেখল। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছে। আবদুল সোনার সঙ্গে পড়ে। বয়স খুব বেশি নয়। তবু ছুটে এসেছে মাস্টারমশাইকে খবর দিতে। বড়বৌ বলল, তোমরা কাল আসবে। আমার শ্বশুরের শ্রাদ্ধ। কাল তোমরা খাবে। আমি ওর হয়ে তোমাদের নিমন্ত্রণ করলাম।

    তারপর শশীভূষণ বললেন, কী রে তুই! কী খবর। তোদের গাঁয়ের পাশে যে বড় গজারি বন আছে সেখানে খুঁজেছিস?

    —সব খুঁইজা দেখছি। কেউ খবর দিতে পারে নাই স্যর। সবাই কয়—এমন মানুষ হাঁইটা গেলে না চিনে কে! তাইন আমাদের দিকে যায় নাই। কেউ দেখে নাই।

    সবাই একই খবর দিয়ে গেল। আবদুল যাবার সময় বলল, সোনা কৈ! তার নাকি অসুখ হইছে স্যর?

    —দেখা করবি? যা ভিতরে যা।

    আবদুল খুব সন্তর্পণে এমন বড় বাড়ির ভিতর ঢুকে বলল, কী ঠাকুর অসুখ হইছে তোমার?

    —তুই! তুই যে!

    —আমি বুঝি কিছু খবর নিয়া আসতে পারি না?

    সোনা বলল, কী খবর?

    —মাস্টারমশয় পাগল কর্তারে খুঁইজা আনতে কইছিল।

    —পাইলি? সোনার মুখ প্রত্যাশায় ভরে উঠেছিল।

    —না পাইলাম না। কত খোঁজলাম।

    সোনাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। কাতর সে। অসুখে ভীষণ রোগা হয়ে গেছে। কথা বলতেও ওর কষ্ট হচ্ছিল। তবু বলল, আমার মনে হয় মাস্টারমশয় ঠিক কইছে! তাইন উঁচু একটা ঢিবিতে বসে আছেন। নামতে পারছেন না। তোদের বাড়ির পাশে কোন টিলা আছে?

    আবদুল ওর লুঙ্গি দিয়ে মুখ মুছে কিছুক্ষণ কী ভাবল! গরমে সে ঘেমে গেছে। সোনা ওকে বসতে বলতে পর্যন্ত পারছে না। এই বারান্দায় আবদুল উঠলে সব অশুচি হয়ে যাবে। আবদুল এটা টের পায় বলেই উপরে উঠছে না। সে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ওর শরীরে এসে রোদ পড়েছে। সামনে এমন একটা জায়গা নেই যে ছায়া আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে আবদুল কথা বলতে পারে, ঘামতে হয় না। সোনার বড় অস্বস্তি লাগছিল।

    কিন্তু আবদুলের ওসব খেয়াল নেই। সে সোনার পাগল জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কার কার বাড়ি, কোন মাঠে, অথবা গাছের ছায়ায় যদি তিনি বসে থাকেন, সে সারা বিকেল তার চারপাশে যতকিছু আছে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। এবং বা’জিকে বলে সে ছুটে এসেছে খবর দিতে, না পাওয়া গেল না।

    সোনা বলল, আমি ভাল হলে খুঁজতে বের হব। ঠিক তাঁকে পেয়ে যাব দেখবি।

    আবদুল বলল, আমারে সঙ্গে নিবা?

    সোনা এখন আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না বলে আবদুলই বলল, কাইল দই চিড়া খাইতে আইতাছি। তোমার জ্যেঠিমা খাইতে কইছে।

    সোনা যেন এতক্ষণে কিছুটা স্বস্তি বোধ করছে। সে বলল, ঠিক আসবি কিন্তু। তা নাহলে জ্যেঠিমা খুব কষ্ট পাইব।

    আবদুল আর কিছু বলল না। ওর চারপাশে ছোট ছোট কাচ্চাবাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ছুঁয়ে দেবে বলে সে বলল, যাই ঠাকুর। কারণ সে জানে, ওর আর বয়স কত, তবু জেনে ফেলেছে সে এই ছোট ছোট শিশুদের ছুঁতে পারে না। কী সব সুন্দর ডলপুতুলের মতো মুখ। ওর এইসব শিশুদের বড় আদর করতে ইচ্ছা হচ্ছিল। বিশেষ করে সোনার বোনটিকে। ফ্রক গায়ে, ববকাট চুলে ঢলঢলে মুখে আবদুলকে দেখছিল আর সোনার দিকে তাকিয়ে বলছিল দাদা ও তোমার স্কুলে পড়ে? তোমার বন্ধু? কতটুকু মেয়ে, কি সুন্দর কথা বলছিল।

    সোনা বলল, আমার ছোট বোন।

    আবদুল বলল, কি গ বইন আমার কোলে উঠবা? বলেই সে আবার কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। বলল, নারে ঠাকুর যাই। বেলা বাড়ছে। বাড়ি তাড়াতাড়ি না ফিরলে চিন্তা করব।

    —কিছু খাইলি না?

    বড় জ্যেঠিমাকে সে ডেকে বলল, অরে কিছু খাইতে দ্যান। কতদূর থাইকা আইছে।

    ছিঃ ছিঃ কী যে ভুল হয়ে গেল! বড়বৌ তাড়াতাড়ি দক্ষিণের ঘরে ছুটে গিয়ে শশীভূষণকে বলল, ওদের একটু খেতে দিচ্ছি, ওদের বসতে বলুন, ওরা কতদূর থেকে আসছে খবর দিতে।

    আরও সব দলবল আসছিল। দুজন তিনজন একসঙ্গে। ওরা এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ, কেউ কোনও খবর আনতে পারেনি। পাঁচ দশ ক্রোশ জুড়ে যে অঞ্চলে, পাগল মানুষ সবার কাছে পীরের মতো অথবা তিনি যখন হেঁটে যান, পুণ্যবান মানুষেরা ভাবে ধরণী ক্রমে শীতল হচ্ছে, কোন পাপবোধ আর জেগে থাকবে না। সেই পয়মন্ত হাতির মতো, লক্ষ্মীরূপা। করুণা বর্ষণ করবেন তিনি। পাগল মানুষ হেঁটে গেলেই সবাই এমন টের পেয়ে যায়।

    বড়বৌ সব ছাত্রদের জন্য দু’কাঠা মুড়ি বের করে দিল। নারকেল কোরা করে দিল এক গামলা। আর এক হাঁড়ি গুঁড় বের করে দিল। প্রায় বাল্য-ভোগের মতো ব্যাপারটা দাঁড়াল। ওদের বার-বাড়িতে ডালায় ডালায় সাজিয়ে দিল। লালটু-পলটু এসেছে। ওরাও ছুটে গেছে, এবং জল, যা ওরা চাইছে এনে দিচ্ছে। ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, কোথায় যে গেলেন তিনি!

    শশীভূষণ বললেন, সকালে বড়বৌদি দেখেছিলেন তিনি দরজার পাশে বসে আছেন। তারপর এত মানুষের চোখে ধূলা দিয়ে কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেলেন।

    বড়বৌ সব শুনেও কোন কথা বলছে না। যখন গেছেন আবার ফিরে আসবেন। যে-বারে হাতিতে চড়ে নিখোঁজ হলেন, কেউ এসে কোনও খবর দিতে পারেনি। অথচ এক বিকেলে সোনা এসে খবর দিয়েছিল হাতিটা উঠে আসছে। সব মানুষ এসে জড় হয়েছিল অর্জুন গাছটার নিচে। আশ্বিনের কুকুর ঘেউঘেউ করে ডাকছে। একবার হাতিটার দিকে ছুটে যাচ্ছে আবার উঠে আসছে বাড়িতে। প্রথমে হাতিটা বিন্দুবৎ ছিল। চোখের নজরে আসে না। এত বড় মাঠের ওপারে কড়া রোদের ভিতর একটা বিন্দু ক্ৰমে বড় হচ্ছিল, হতে-হতে কখন যে হাতি হয়ে গেল!

    সুতরাং যেন এ-বাড়িতে একজন মানুষ এই অসময়ে নিখোঁজ হয়ে গেছেন বলেই যা কষ্ট। এবং এত খোঁজাখুঁজি। অন্য সময় হলে কেউ এত ভাবত না। বড়বৌ জেগে থাকত শুধু। যেমন সে প্রতিবার জানালায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কখনও-কখনও কিছু চিঠি, বিয়ের পরই যে-বার মণীন্দ্রনাথ কলকাতায় গিয়ে কিছু চিঠি দিয়েছিলেন বড়বৌকে সেই সব চিঠি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে। পড়তে-পড়তে কোনও-কোনও দিন রাত কাবার করে দেয়। বড়বৌর এতটুকু কষ্ট হয় না তখন।

    তিনি আসবেন। ফিরে আসবেন। কাজের বাড়ি। এখন আর এ-নিয়ে ভেবে লাভ নেই। শুধু এমন একটা দিনে তিনি বাড়ি নেই ভেবে ভিতরটা বড়বৌর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

    শশীভূষণ পরদিন সকাল-সকাল স্নান করলেন। ওঁর কাজ শুধু আপ্যায়ন। সবাই এসে এ-সংসারে যার খোঁজ প্রথমে করে—সে মণীন্দ্রনাথ। শশীভূষণ সকাল থেকেই টের পাচ্ছিলেন, একটা কথাই তাঁকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বার-বার বলতে হবে। না তিনি বাড়ি নেই। নিরুদ্দেশে গেছেন। যেমন যান মাঝে-মাঝে তেমনি গেছেন।

    এবং এই এক প্রশ্নের উত্তর সারাদিন ওঁকে দিয়ে যেতে হবে।

    —কখন গেলেন?

    —সকালের দিকে।

    —কেউ দেখেনি কোন্ দিকে গেছেন?

    —না। কুয়াশা ছিল।

    —এদিকে জানতাম তিনি বাড়িতেই থাকতেন। বেশীদূরে যেতেন না।

    —যেতেন না?

    —অন্য কিছু কী হয়েছিল?

    —অন্য কিছু কী আর হবে! তবে পাগল মানুষ তো আর শ্রাদ্ধে বসতে পারবেন না। বুড়ো কর্তা মেজ ছেলেকে শ্রাদ্ধের মালিক করে গেছেন।

    —পাগল মানুষ কাছে ছিলেন তখন?

    —তা ছিলেন।

    —এই তো গণ্ডগোলের ব্যাপার। উনি তো পাগল বলতে আমরা যা বুঝি ঠিক তা ছিলেন না। সব বুঝতেন। হয়তো খুব কষ্ট হয়েছে মনে।

    —হয়তো তাই।

    —শুনেছি সংসারে এই বুড়ো মানুষটার ওপরই যত রাগ ছিল।

    —তাও শোনা যায়।

    —হয়তো সে-জন্য শ্রাদ্ধে বাড়ি থাকলেন না। অভিমানে দূরে সরে রয়েছেন। সব কাজকাম চুকে গেলেই আবার বাড়ি ফিরে আসবেন।

    —আমারও তাই মনে হয়।

    কোনও রকমে দায়সারা উত্তর দিয়ে আবার যারা গোপাট ধরে উঠে আসছেন তাঁদের দিকে ছুটে যাওয়া।

    —কবে বের হয়ে গেলেন?

    —বুড়ো কর্তা মারা গেলেন রাতে। সারাদিন সবার সঙ্গে শ্মশানেই ছিলেন। বিকেলের দিকে দাহ শেষ। রাতে সোনার ভীষণ ভয় পেয়ে জ্বর! তিনি সারারাত ঘরের পৈঠায় বসে। ভোরের দিকে বড়বৌদি দেখেন, নেই। পলটু খুঁজতে গেল লালটু গেল। কাছে কোথাও খোঁজ পাওয়া গেল না। তাড়াতাড়ি জবাব শেষ করতে হবে। কারণ, বোধ হয় পাঁচদোনার বড় শরিকের ছোটকর্তা দলবল নিয়ে উঠে আসছে।

    —মণি এখন কেমন আছে?

    —ভাল আছে।

    —ডাকেন একবার মণিরে দেখি।

    —উনি বাড়ি নেই। এদিকে আসুন। ফরাস পাতা লম্বা চালাঘরে।

    —না, এখানে বসব না।

    —ঈশম, ঈশম এদিকে এস। ওঁদের নিয়ে যাও, যেখানে শ্রাদ্ধ হচ্ছে সেখানে ওঁদের নিয়ে যাও। চোয়াড়ির পাশে চেয়ার পেতে দাও।

    —মহাভারত কে পড়ছে?

    —সূর্যকান্ত।

    —মহামহোপাধ্যায় সূর্যকান্ত। না কাঠালিয়ার সূর্যকান্ত?

    —মহামহোপাধ্যায় সূর্যকান্ত।

    ঈশম ষাঁড় বাছুর নিয়ে যাচ্ছে। বৃষকাঠে ষাঁড়টা সে বেঁধে রাখবে। সে কাছে এসে বলল, আসেন কর্তা।

    —যাক বাঁচা গেল। আবার দক্ষিণের মাঠে সারি-সারি মানুষ। ওরা কারা! শশীভূষণ কপালে হাত তুলে. দূরের মানুষ লক্ষ করার চেষ্টা করলেন। তিনি এ-অঞ্চলে চার-পাঁচ বছরের উপর রয়েছেন। নানা কারণে এ-অঞ্চলের মানুষেরা তার কাছে এসেছে। বেশির ভাগ বিদ্যালয়-সংক্রান্ত ব্যাপারেই ওরা আসত। তিনি প্রায় সবাইকে চেনেন। হাতে মোটামুটি সবার একটা লিস্ট আছে। লোকজন খাবে প্ৰায় হাজার হবে। তারপর আছে অলিক ভোজন। গরিব দুঃখী মানুষেরা এখনও উঠে আসতে সাহস পাচ্ছে না। ওরা গোপাটে সারি সারি মাদার গাছের নিচে কলাপাতা কেটে বসে রয়েছে কর্তাবাবুদের খাওয়া হলে ওরা খাবে।

    শশীভূষণ বললেন, ভিতরে যান।

    যাঁদের ভিতরে পাঠাবার তিনি তাঁদের ভিতরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। যারা ফরাসে বসবে তিনি তাদের ফরাসে বসাচ্ছেন। যাদের দাঁড়িয়ে থাকার কথা, তিনি তাদের দাঁড় করিয়ে রাখলেন।

    শশীভূষণও সারাদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন। বসার বিন্দুমাত্র সময় পাননি।

    সকাল থেকে দই-ক্ষীরের ভাঁড় আসছে-তো-আসছেই। সার বেঁধে ঠিক, সেই পালকি কাঁধে বেহারা

    যায় হুঁ হোম না—তেমনি ওরা দই অথবা ক্ষীরের ভাঁড় নিয়ে মাঠের উপর দিয়ে সারি সারি চলে আসছে। শশীভূষণ বার-বাড়িতে দাঁড়িয়ে লাঠি তুলে ইশারা করছেন শুধু। কোথায় গিয়ে নামানো হবে তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন।

    শ্যামাজ্যাঠা এসেছেন লাধুরচর থেকে। তিনি এসেই প্রথম খবরটা দিলেন। বললেন চন্দ্রনাথের মেলায় ত্রিকূট পাহাড়ের নিচে পাগল ঠাকুরকে কারা দেখে এসেছে। গৈরিক বসন পরনে। একটা বড় বটগাছের নিচে তিনি বসে রয়েছেন। সামনে ধুনি জ্বলছে। পাশে কীর্তন করছে কিছু লোক। যে দেখেছে সে কাছে যেতে পারেনি। তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। সে দূরে দাঁড়িয়ে প্রণিপাত সেরেছে।

    একটু থেমে শ্যামাজ্যাঠা বললেন, সে ভেবেছিল এসেই খবর দেবে তোমাদের। ফাল্গুন মাসের মেলায় সে যেতে পারেনি। পরে তীর্থ করতে বের হয়ে ফেরার পথে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গেছে। লোকজনের ভিড় কমেনি। কিছু সাধুসজ্জন ব্যক্তি তখনও গাছের নিচে কুটির বানিয়ে বসে আছেন।

    শশীভূষণ বললেন, সে কবে ফিরে এসেছে?

    —কাইল ফিরা আইছে।

    —ওর নাম কি?

    তারে আমি চিনি না। আমাদের গাঁয়ে মহাদেব সাহা আছে, ও শুইনা আইছে।

    শশীভূষণ বললেন, ঠিক দেখেছে তো?

    —না দেখলে কয়? মণির মতই হুবহু দেখতে।

    —কবে দেখেছে?

    —চাইর পাঁচ দিন আগে। কালই আইছে। মণি কত জায়গায় যায় গিয়া, এবারে হয়তো চন্দ্রনাথ পাহাড়ে চইলা গেল।

    কথাটা মুহূর্তে সারাবাড়ি রটে গেল। বড়বৌ শুনে মাথার ঘোমটা আরও টেনে শ্যামাজ্যাঠার সামনে এসে গড় হয়ে প্রণাম করল।

    শ্যামাজ্যাঠা বললেন, ভাল আছ বৌমা?

    মাথায় ঘোমটা বড়বৌর। কথা বলতে পারছে না। শুধু মাথা সামান্য নিচু করে রাখল। এ-সময় ভালো থাকার কথা না! তবু বলতে হয় বলে যেন বলা, মণি ত আর মানুষ না বৌমা। মনুষ্যকুলে দেবতার জন্ম। সে কেন তোমার ঘরে আটকা থাকব!

    বড়বৌ এবার লজ্জার মাথা খেয়ে বলল, অত দূরে তো উনি কখনও যেতেন না।

    —গেল। ইচ্ছা হইল, চইলা গেল।

    বড়বৌ জানে, তিনি না ফিরে পারবেন না। যেখানে যত পাহাড়-পর্বত থাকুক, দেবতার নির্দেশ থাকুক, সন্ত মানুষের আড্ডা থাকুক, মানুষটা যখনই বড়বৌর মুখ মনে করতে পারবেন তখন সব ফেলে ফিরে না এসে পারবেন না।

    বড়বৌ বলল, একবার ভালো করে খোঁজ নিলে হতো না?

    —আমি কাইল মহাদেবকে নিয়া যামু ভাবছি। নিজের কানে না শুনলে মন মানব ক্যান। পরশু তোমারে খবর দিয়া যামু।

    ভূপেন্দ্রনাথ, শচীন্দ্রনাথ সবাই জড় হয়ে বললেন, ঈশম যাউক খবর আনতে। আপনে মহাদেবের কাছে একটা চিঠি লিখা দ্যান। একেবারে য্যান খবর ঠিক পাইলে নারাণগঞ্জে চইলা যায়। সেখান থেকে চাঁটগাঁ মেলে। এসব কাজে দেরি করা ভালো না। তাইন ত এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না।

    শশীভূষণ বললেন, ঈশমের পক্ষে এ-কাজ একা করা কঠিন। বরং আমি সঙ্গে যাচ্ছি।

    শচীন্দ্রনাথ বললেন, তবে ত খুব ভাল হয়।

    এমন সময় লালটু এসে খবর দিল শশীভূষণকে, জ্যেঠিমা আপনারে ডাকে।

    —বল যাচ্ছি। তিনি এই বলে দক্ষিণের ঘরে ঢুকে গেলেন। বেতের একটা বড় লাঠি আছে ঘরে। কবে একবার ভূপেন্দ্রনাথ চন্দ্রনাথের মেলায় গিয়েছিলেন, মোটা হলুদ রঙের বাঁকানো লাঠি নিয়ে এসেছিলেন এক আঁটি। শশীভূষণ পছন্দ মতো একটা চন্দ্রনাথের লাঠি নিয়ে রেখেছিলেন। যাবার সময় এটা সঙ্গে নেবেন ভাবলেন। কিন্তু লাঠিটা ঠিক জায়গায় আছে কি-না দেখার জন্য দক্ষিণের ঘরে ঢুকতেই দেখলেন, বড়বৌ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

    —আপনি যাচ্ছেন?

    —ঈশম এত কথা বলতে পারবে না। আমি সঙ্গে যাচ্ছি।

    —আপনি জিজ্ঞাসা করবেন, ওঁর হাতে কিছু কালো-কালো দাগ আছে; তা সে দেখেছে কি-না।

    —কালো দাগ!

    —কেন, লক্ষ করেননি?

    —না তো!

    —হাত কামড়ে ফালা ফালা করে ফেলত একসময়। হাতে সে-সব বড়-বড় দাগ আছে। সব মিলে গেলেও ওটা দেখে নেবেন—।

    শশীভূষণ বললেন, ঠিক আছে, আপনি ভাববেন না। পেলে একেবারে ধরে নিয়ে আসব। আপনি কান্নাকাটি করবেন না।

    —না রে ভাই। আমার কান্নাকাটি কবেই শেষ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে এখন শুধু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমি মানুষটার জন্য আর কাঁদি না। তারপরই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যেতে-যেতে বলল, ধনকে বলছি আপনাদের খাবার দিতে! আপনারা খেয়ে দিন।

    সোনা দেখল বড়জ্যেঠিমা লম্বা-ঘোমটা টেনে ওর পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কেউ এ-বাড়িতে এসেছে যিনি জ্যেঠিমার গুরুজন। মার মতো লম্বা ঘোমটা বড় জ্যেঠিমাকে দিতে দেখে ভারি কৌতূহল হল সোনার। সে ডাকল, জ্যেঠিমা।

    —এখন ডাকে না বাবা। কত কাজ! তোর জ্যাঠামশাইকে আনতে যাচ্ছেন মাস্টারমশাই। ওঁদের এখন খাবার দিতে হবে। তোর মা কোথায় রে?

    জ্যাঠামশাই এত দূরে যেতে পারেন ওদের ফেলে—সোনার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে বলল, মা কোথায় জানি না জ্যেঠিমা। আমার খিদে পেয়েছে। খাব। কেউ আমাকে খেতে দিচ্ছে না।

    বড়বৌ জানে সোনা কী খেতে চায়। দই ক্ষীর খেতে চায়। বড় অভাগা মনে হয় সোনাকে। সে দুই-ক্ষীর কিছুই খেতে পাবে না। সে-ঝোল-ভাত খাবে। সকালে হেলাঞ্চার ঝোল দিয়ে ভাত দেওয়া হয়েছে। ওর খিদেটা চোখের খিদা। সে জ্যেঠিমার কাছেই একটু যা অনিয়ম করার অধিকার পায়। বড়বৌ তাকে লুকিয়ে-চুরিয়ে এটা-ওটা খেতে দেয়। আজ সে একটু মুড়ি দিয়ে ক্ষীর খাবে। সবাই যেমন খাচ্ছে। কিন্তু তাকে কে দেয়! বাড়িতে উৎসব হলেই ওর কোনও না কোনও অসুখ হয়! সে তখন চুপচাপ বসে থাকে। কখন জ্যেঠিমা আসবে অপেক্ষায় থাকে। জ্যেঠিমা এলেই যে সে খেতে পাবে।

    বড়বৌ বলল, না বাবা, আজ খাবে না। আজ তোমাকে আমি কিছু দেব না। চুপচাপ শুয়ে থাকো। বলেছি তো ভালো হলে সব পাবে।

    তবু সোনা ঘ্যানঘ্যান করছে দেখে বড়বৌ আর দাঁড়াল না। বড্ড খাই-খাই হয়েছে সোনার। সে এতটা দায়িত্ব নিতে পারছে না। ক্ষীর-দই দু-ই সোনার পক্ষে অপকারক। সুতরাং সে আর দাঁড়াল না। ধনকে খোঁজার জন্য বড় ঘরে উঁকি দিল।

    আর তখনই সোনা অবাক চোখে দেখল ফতিমা আস্তে আস্তে এদিকে পা টিপে-টিপে আসছে। ওর নানী আসছে লাঠি ভর দিয়ে। ওর নানী সোজা হতে পারে না। একেবারে ধনুকের মতো বেঁকে গেছে। বুড়োকর্তার কাজকাম হচ্ছে, মানুষজন খাবে, সামসুদ্দিনের মা কিছুতেই বাড়িতে বসে থাকতে পারছিল না। অলিজান বার-বার বলেছে, আপনে, এই শরীর নিয়া যাইবেন কি কইরা?

    —যামু ঠিক চইলা যামু। সে ফতিমাকে বলল, বইন, আমার লগে ল।

    ফতিমা এসেছে গতকাল। ওদের গ্রীষ্মের ছুটি হয়েছে কবে। কথা ছিল গাঁয়ে আসবে না কিন্তু ফতিমা বাড়ি আসার জন্য কান্নাকাটি করেছে; নানীকে দেখার ইচ্ছে ওর যে কত! বস্তুত ফতিমার সেই বাবুটির জন্য বড় মায়া। সে যত বড় হচ্ছে, বাবুটির জন্য কোমল ভালোবাসা বুকের ভিতর গড়ে উঠছে। সে নিজেও বুঝতে পারে না, মাঝেমাঝে তার বাড়ি ফিরে আসতে এত ইচ্ছা হয় কেন, শহর ভালো লাগে না কেন! কতক্ষণে সে রেলগাড়িতে চড়ে নারায়ণগঞ্জে চলে আসবে। তারপর স্টিমারে বারদী এবং তিন ক্রোশের মতো পথ হেঁটে আসতে হয়। ওর তখন যেন পথ ফুরায় না! চারপাশের গাছপালা পাখি ফেলে সে ছুটে আসে, আসতে-আসতে যখন সেই অর্জুন গাছটা দেখতে পায় তখন সে ছুটতে থাকে। এবারেই প্রথম সে ছুটতে পারছে না। সে যে বড় হয়ে যাচ্ছে, সে যে ফতিমা, শাড়ি পরেছে সুন্দর করে, কপালে কাচের টিপ, দুই বিনুনি বাঁধা মেয়ে, একেবারে কচি কলাপাতা রঙের যেন সবুজ ধান্য অবুঝ হয়ে আছে। সে ধীরে-ধীরে হেঁটে-হেঁটে বাড়ি ফিরছে। সকালে সে পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়েছে, সোনাবাবুকে অর্জুন গাছের নিচে দেখা যায় কি-না। দেখলেই সে মাঠে নেমে আসত কিছুটা। হাত তুলে ইশারা করত। তারপর সেই গাঁয়ের ছোট নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে একটু গল্প করা। কী যে এত গল্প, ফতিমা নিজেও বোঝে না। ঢাকা শহরে সোনা কবে যাবে মাঝে-মাঝে এমন বললে, সোনা চুপ করে থাকে, কবে সে যেতে পাবে জানে না। ফতিমার দুঃখ বার-বার এক দুঃখের প্রকাশ, ওর একা-একা ভালো লাগে না। সে একদিন স্বপ্ন দেখেছে, বড় একটা ঢিবির মথায় সে, সোনা, এবং পাগল জ্যাঠামশাই দাঁড়িয়ে আছেন।

    ফতিমাকে দেখেই সোনার মনে হল ফতিমা ঠিক অমলা-পিসির মতো বড় হয়ে গেছে। সে আর সোজা তাকাতে পারছে না।

    সোনা বলল, ফতিমা, তুই বড় হয়ে গেছিস?

    —যান। ফতিমা ফিক করে হেসে ফেলল।

    —হ্যাঁরে, দিদিকে বলে দেখ। সোনা সামসুদ্দিনের মাকে সাক্ষী মানল।

    ফতিমা ওসব কথায় গেল না। বলল, আপনের অসুখ! কি হইছে সোনাবাবু? আপনারে দেখতে আইছি।

    —জ্বর। টাইফয়েডের মতো হয়েছিল।

    —আপনি বড় রোগা হয়ে গেছেন।

    —তাই বুঝি! তুই কতদিন থাকবি?

    —বাজি কইছে দুই-চার দিন পর আসব।

    —তুই তখন চলে যাবি?

    — পাগল! আমি কমু অসুখ হইছে আমার। যামু না। বলেই আবার বোকার মতো ফিক করে হেসে দিল।

    —তোদের পরীক্ষা হয়ে গেছে?

    —হবে। স্কুল খুললেই হবে।

    —ইংরেজিতে কত পেয়েছিস?

    —বাষট্টি।

    অন্যান্য বিষয়ের কথাও সে বলল। প্রায় যেন এখন সোনা ওর সমবয়সী নয়! অনেক বড়। আর ফতিমাও ছোট্ট মেয়ের মতো জবাব দিয়ে যাচ্ছে। কোনও কুণ্ঠা নেই। বস্তুত ফতিমা বাবুর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলেই খুশি।

    সোনা বলল, আরবিতে কত পেয়েছিস?

    —আমি সংস্কৃত নিয়ে পড়ছি সোনাবাবু?

    —কত পেলি?

    —আটানব্বই।

    —বলিস কি!

    —আমি ফার্স্ট হয়েছি সোনাবাবু। বা’জি আমারে এই শাড়িটা কিনা দিছিল। বা’জি কইল তুই কী নিবি ফতিমা, কী চাই? ফার্স্ট হইলে তরে যে কইছিলাম কিছু দিমু। আমি কইলাম, আমাকে একটা শাড়ি কিনে দিবেন। আমি শাড়ি পরমু। এই শাড়িটা, পইরা আইছি। আমায় ভাল লাগছে না দেখতে! বলে কেমন এক শিশু-সরল মুখ নিয়ে সোনার দিকে তাকিয়ে থাকল। যেন সে বাবুকে খুশি করার জন্য শাড়ি পরে এসেছে। খুশি করার জন্য ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে।

    সোনা বলল, তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ফতিমা। তুই দেখছি আস্তে-আস্তে জ্যেঠিমার মতো কথা বলতে শিখে যাচ্ছিস। তোকে দেখতে অমলা-পিসির মতো লাগছে। বলেই সোনার মনে হল শহরে থাকলে বুঝি সবাই অমলা-পিসির মতো হয়ে যায়। ফতিমাও হয়ে গেছে। সে তো এখন কত কিছু জেনে ফেলেছে। সে বলল, আমি ভালো হলে একদিন তোদের বাড়ি যাব। তারপর তুই আমি জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে বের হব।

    —জ্যাঠামশাই বাড়ি নাই?

    —না!

    সোনাবাবু, আপনি কবে ভাল হবেন? মা চলে যাবে। বা’জি এসে মাকে নিয়ে যাবে। নানীকে বলে আমি থেকে যাব। আপনি কবে ভাল হবেন? আমি ঠিক যাব। কেউ টের পাবে না।

    সোনা চুপ করে থাকল। মা এদিকে আসছে। মা এসেই বলল, কী রে ফতিমা, তুই! তোর নানী! বস। তুই কত বড় হইয়া গ্যাছস। কী গ পিসি, তোমার নাতনী ফুলপরী সাইজা আইছে দেখছি।

    —ভাবছি, আপনেগ বাড়ি রাইখা যামু নাতনীরে। তাই ফুলপরী সাজাইয়া আনছি। কী গ সোনাবাবু, পছন্দ লাগে?

    সোনা বলল, মারব তোমাকে বলে দিচ্ছি দিদি।

    ধনবৌ বলল, কি কও সোনা। এমন কথা কইতে নাই।

    —তবে দিদি আমারে ক্ষেপায় ক্যান?

    এত সব কথায় ফতিমা ভারি লজ্জা পাচ্ছিল। সে মাথা নিচু করে নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। ফতিমা সোনাবাবুর দিকে আর কিছুতেই তাকাতে পারছে না। তাকালেই যেন সে সোনাবাবুর কাছে ধরা পড়ে যাবে। সে যে সবুজ ধান্য অবুঝ হয়ে আছে, তা ধরে ফেলবে সোনাবাবু।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }