Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১৯

    ২.১৯

    ঈশম অনেক উঁচুতে ডাঙায় দাঁড়িয়েছিল। সামনে মেঘনা নদী। আশ্বিনের আকাশ উপরে। আশ্বিনের কুকুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে সেই নৌকাগুলি—বিন্দু বিন্দু হয়ে ভাসছে। ঠিক কাগজের নৌকার মতো ছোট হয়ে গেছে। সে খুব উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এগোবার আর পথ নেই। সে নদীর পাড়ে পাড়ে এতদূর এসেছে। ছোট নদী থেকে বড় নদীতে। ভূপেন্দ্রনাথ বার বার ওকে ফিরে যেতে বলেছেন ইশারায়—সে ফিরে যায়নি। সে পাড়ে পাড়ে হাঁটছে। কুকুরটা পাড়ে পাড়ে হাঁটছে। কুকুরটা এখন একমাত্র অবলম্বন ঈশমের। ঈশম আর আশ্বিনের কুকুর ওদের এগিয়ে দিতে যাচ্ছে। যেন সঙ্গে সঙ্গে যতদূর যাওয়া যায়। ঘাটে নৌকা ভাসালে পাশাপাশি গ্রামের অনেকে এসেছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এসেছে। তারপর ওরা দাঁড়িয়ে থেকেছে পাড়ে। ওরা আর নৌকা জলে ভাসলে এদিকে আসেনি।

    ঈশমেরও আসার কথা নয়। ভূপেন্দ্রনাথ ওকে হিসাবপত্র করে যা প্রাপ্য সব দিয়েছেন তার। সঙ্গে আরও একশত টাকা দিয়েছেন। যে ক’দিন সে একটা কাজ দেখে না নিতে পারছে সে ক’দিন অন্তত এই দিয়ে তার চলে যাবে। তরমুজের জমিটা হাজিসাহেবের মেজ ছেলে কিনে নিয়েছে। ঈশমের ভিতরে ভারি কষ্ট এই তরমুজের জমির জন্য। সে একটা কথাও বলতে পারেনি। যা দিয়েছেন ভূপেন্দ্ৰনাথ, যত্ন করে আঁচলে গিঁট বেঁধে কোমরে গুঁজে রেখেছে। ঘাটেই ভূপেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তর আর কষ্ট করে নারাণগঞ্জে গিয়ে কী হবে! সে তাতেও কিছু বলেনি। চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। আর নৌকা জলে ভাসলে দূরে সহসা দেখল শশীভূষণ গাছপালার ফাঁকে কে হেঁটে আসছে নদীর পাড়ে পাড়ে। শশীভূষণের নৌকা আগে। তিনটে বড় বড় নৌকায় সব নিয়ে এদেশ থেকে রওনা হয়েছেন ওঁরা। শশীভূষণ সোনা ধনবৌ বড়বৌ আগের নৌকায়। শশীভূষণই প্রথম দেখেছিলেন পাড়ে পাড়ে—পাড় স্পষ্ট নয়, তবু কে যেন ওঁদের নৌকা অনুসরণ করে এগুচ্ছে। শশীভূষণ সোনাকে ডেকে বলল, কে হাঁটছে রে পাড়ে পাড়ে?

    সোনা বাইরে এসে দাঁড়াল।—ঈশমদা। আমাদের কুকুরটা সঙ্গে।

    শশীভূষণ এবার পিছনের নৌকায় ভূপেন্দ্রনাথকে বললেন, দেখছেন?

    —কী? ভূপেন্দ্রনাথ চারপাশে তাকাতে থাকলেন। চারপাশে নদীর চর এবং ধানখেত। মাঝখানে নদীর জল টলটল করছে। আশ্বিন মাস বলে জল নেমে যাচ্ছে মাঠ থেকে। নানারকম পাখি নদীর চরে। তিনি বিলের এক ঝাঁক পাখি দেখতে দেখতে বললেন, কী বলছেন?

    —ঈশম এখনও আসছে পিছু পিছু।

    ভূপেন্দ্রনাথ পাটাতনে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সতর্ক নজর রাখতেই বুঝলেন ঈশম নদীর পাড়ে পাড়ে যে গ্রাম অথবা বালির চর আছে তার উপর দিয়ে হেঁটে আসছে। তিনি ঈশমকে এবার ইশারায় বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। ঈশম হাত তুলে যেন বলছে, ঠিক আছে। সে সময় হলেই ফিরে যাবে। সুতরাং ভূপেন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন, ঈশম যতক্ষণ পারে ততক্ষণ হাঁটবে। এবং ঠিক দামোদরদির মঠ পার হলে সে আর এগুতে পারবে না। সামনে বড় বাঁওড় পড়বে। সে জল ভেঙে ওপারে যেতে পারবে না। ওকে তখন ফিরে যেতেই হবে। ভূপেন্দ্রনাথ সেজন্য আর কিছু না বলে যেমন ক্লিষ্টমুখে বসেছিলেন তেমনি আবার বসে থাকলেন।

    সোনার ভারি কষ্ট। ওর ঈশমদা এতদূরে যে সে চিৎকার করে ডাকলেও শুনতে পাবে না। এখান থেকে সে যত জোরেই কথা বলুক শুনতে পাবে না। ওঁরা সবাই সব নিয়ে যেতে পারছেন, শুধু সে পারছে না পাগল জ্যাঠামশাই, ঈশম আর ফতিমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। ওদের নিয়ে যেতে পারলেই আর কোনও কষ্ট থাকত না। কিন্তু তারপরই সোনার মনে হল সে যা কিছু ফেলে যাচ্ছে, তা আর ফিরে পাবে না। আবার এদেশে সে আসতে পারবে কবে জানে না। সে বড় হলে ঠিক চলে আসবে। কারণ যত দুরেই থাক, সে তরমুজের জমি, নদীর জল, মালিনী মাছ ভুলে বেশি দিন থাকতে পারবে না কোথাও। পাটাতনে দাঁড়িয়ে কেন জানি সোনার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হল, ঈশমদাদা আপনি ফিরে যান। আমরা আবার ফিরে আসব।

    কিন্তু সে জানে তার কথা অতদূরে পৌঁছাবে না। সে একা একা দাঁড়িয়ে থাকল। বৈঠার জল ছপছপ শব্দ করছে। সামান্য হাওয়া লেগেছে পালে। আর ক্রমে নদীর দু’পাড় উঁচু হয়ে যাচ্ছে। উঁচু হতে হতে সে দেখল অনেক উঁচুতে একটা মানুষ স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক এক বিন্দু ঘাসের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না!

    ইশম জানত না সেই বিন্দু বিন্দু নৌকা থেকে এখনও একজন ওকে দেখছে! যতক্ষণ দেখা যায় দেখছে! এত উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে যে সোনার মাঝে মাঝে ভয় হচ্ছিল তিনি না নিচে পা হড়কে পড়ে যান। পড়ে গেলে অনেক নিচে পড়ে যাবেন। মেঘনা নদী বর্ষায় পাড় ভাঙতে ভাঙতে ভাঙেনি। ফাটল চারপাশে। আগামী বর্ষার জল যখন বেগে নেমে যাবে এই সব গ্রাম মাঠ ভেঙে নদীর অতলে হারিয়ে যাবে! ফলে পাড় এত খাড়া যে তাকাতেই সোনার ভয় হচ্ছিল।

    আর তখন সামনে সেই নদীর বাঁওড়। ওঁরা বাঁওড়ে পড়ে গেলে ঈশম আর কিছু দেখতে পেল না। ওঁরা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তবু সে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। মাথার উপর সূর্য উঠে গেছে। ফিরতে ফিরতে তার রাত হয়ে যাবে। একমাত্র সঙ্গি তার এই আশ্বিনের কুকুর। সকাল থেকে না খেয়ে আছে। সে বাজারে ঢুকে কিছু মুড়কি কিনে নিজে খেল এবং কুকুরটাকে দিল। এখন সে কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। ঘরে যে পঙ্গু বিবি আছে সে-কথা পর্যন্ত তার মনে নেই। নদীর পাড়ে সে কিছুক্ষণ একা বসে থাকল, একা একা হাঁটল। এ-ভাবে সে ওঁদের বিদায় দিয়ে নদীর পাড়ে একা দাঁড়িয়ে থাকবে ভাবতে পারেনি। সে এখন আবার হাঁটছে।

    তরমুজের জমিতে ফিরে মনে হল কারা ভাঙা ছইটা আলের কিনারে ফেলে রেখেছে। ওর ভীষণ রাগ হল। মাথার উপরে আকাশ। অজস্র নক্ষত্র এবং বালিয়াড়িতে নদীর জল বাতাসে খেলা করে বেড়াচ্ছে। সে ভেবেছিল এসেই এখানে বসে এক ছিলিম তামাক খাবে। কিন্তু সে যখন দেখল ওর সেই ভাঙা ছই একপাশে পড়ে আছে, আর হুঁকা কলকে, আগুন রাখবার পাতিল, কিছু খড় সবই গাদা মারা তখন রাগে হতাশায় ওর বুক ফেটে গেল। সে বলল, হায় আল্লা! তারপরই মনে হল এ-জমি তার নয়। এ-জমি হাজি-সাহেবের মেজছেলের! ওদেরই কাণ্ড! ওরা এসে ঈশমের যা কিছু ছিল সব ফেলে দিয়েছে। সে এখানে আর কোনওদিন নেমে আসতে পারবে না, তরমুজের জমিতে দাঁড়িয়ে আল্লার করুণা দেখতে পাবে না ভাবতেই চোখ ফেটে জল এসে গেল। সে খুব কম চোখের জল ফেলেছে। সে মনে মনে নিষ্ঠুর। কিন্তু আজ প্রথম তার এটা কী হল! ওর একমাত্র বিবি, যে যৌবন ভালো করে আসতে না আসতেই পঙ্গু অসাড় হয়ে গেল, অথবা ঝড়ে জলে তার যে জীবন গেছে, দুঃখ ছিল অনন্ত, কোনওদিন সে এমনভাবে মুষড়ে পড়েনি। সে হাঁটতে পর্যন্ত পারছে না। শরীর তার অসাড় হয়ে গেছে। এই জমির ভিতর তার পা যেন গেঁথে যাচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে জমিটার শোকে আকুল হচ্ছে। এ-জমি আর তার নয়—এ-জমিতে আর সে তরমুজ ফলাতে পারবে না।

    এই তরমুজের জমি বড় ভালোবাসার জমি। বিবির চেয়ে প্রিয় এবং নিঃসন্তান ঈশম এই জমিকে প্রায় সন্তান বড় করার মতো উর্বরা করে তুলেছে। সে চুপচাপ বসে থাকল জমিটার উপর

    এখন রাত বাড়ছে। বিন্দু বিন্দু আলো যা জ্বলছিল ক্ৰমে নিবে আসছে। ঠাকুরবাড়ির কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ আর পাওয়া যাবে না। ঈশম এই আওয়াজের সঙ্গে রাত কত হল টের পেত। সে বুঝতেই পারছে না রাত এখন ক’ প্রহর। সে জমিটার ভিতর বসে মুঠো মুঠো মাটি তুলে আবার ফেলে দিচ্ছে, কখনও চোখের সামনে এনে দেখছে—এই মাটি কার? এই ভালোবাসার মাটি কার? সে কে? কেন সে এখানে বসে রয়েছে?

    যেমন শেয়ালেরা ডাকে প্রহরে প্রহরে তেমনি ডেকে গেল। যেমন প্রতি রাতে পাখিদের শব্দ সে পেত নদীর চরে আজও তেমনি পাখিরা উড়ে এসে বসছে। সে এমন কি খরগোশের শব্দ, ইঁদুরের শব্দ সব টের পাচ্ছে। এই জমিটার প্রতি সবার লোভ ছিল। মায় টিয়াপাখির। কচি ডগা কেটে ওরা উড়ে যেত আকাশে। নির্জন রাত্রির অন্ধকারে বসে ঈশম সব টের পাচ্ছে। কিছুই পরিবর্তন হয়নি। কেবল সে নিজে কী ভাবে যে প্রথম ভূমিহীন হয়ে গেল! সে যে এতদিন ভূমিহীন ছিল টেরই পায়নি। আজ প্রথম জমির আলে ওর সেই প্রিয় ছই পড়ে থাকতে দেখে ভাবল, তার সব গেছে। সে সবকিছু হারিয়েছে।

    এ-ভাবে সে উঠে গেল অর্জুন গাছের নিচে। চোরের মতো সে এ-গ্রামে ফিরে এসেছে। এত বড় বাড়িটা নিশ্চিহ্ন। কেবল পুবের ঘরটা এখনও আছে। দু’-চারদিনের ভিতর এটাও ভেঙে নিয়ে গেলে প্রতাপ চন্দের ছেলেরা বেগুনখেত করবে। সে বাড়িটার চারপাশে ঘুরতে থাকল। ঘুরতে ঘুরতে ওর খেয়াল নেই কখন সকাল হয়ে গেছে। সকাল হলেই মনে হল তার পঙ্গু বিবি ঘরে আছে। গতকাল সারাটা দিন তার ভীষণ কষ্টের ভিতর গেছে। সে আনমনা থেকেছে। নিজের ভিতর ডুবে ছিল। এত সহজে এক কথায় ওরা দেশ ছেড়ে চলে যাবে ঈশম কল্পনাও করতে পারেনি। কেমন একটা ধুন্ধুমার লেগে গিয়েছিল ওর মনে। সে বেহুঁশের মতো কেবল ছুটাছুটি করেছে। সকাল হলেই সে টের পেল—ওর পঙ্গু বিবিকে গতকাল খাবার দিতে ভুলে গেছে। এমন একটা ভুলের জন্য সে আল্লার কাছে দোয়া চাইল। এবং গোপাট ধরে হাঁটতে হাঁটতে যখন সে ছোট কুঁড়েঘরটায় ঢুকে গেল, দেখল বিবি তার কেমন শক্তভাবে তাকিয়ে আছে।

    সে বলল, আমি আইছি। তরে দুইডা চাইল ডাইল সিদ্ধ কইরা দেই। তুই খা।

    বিবি তার দিকে তাকিয়েই আছে, কথা বলছে না।

    ঈশম সে সব লক্ষ করল না। সে আপন মনে হাঁড়ি-পাতিল খুঁজছে। এই প্রথম তাকে এ-বাড়িতে দুটো চাল-ডাল সিদ্ধ করতে হবে। বিবিটা ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে বলে কথা বলতে পারছে না। সারাটা শরীর অসাড় তার। খাইয়ে দিতে হয়। শুকনো ক’খানা হাড় ছেঁড়া কাঁথার ভিতর ঢাকা থাকে। সব, সে একবার এসে দিনে পরিষ্কার করে দিয়ে যেত। সে না থাকলে জোটন, মনজুরের মা অথবা জালালি করত। ওরা বেঁচে নেই। জোটন পীরানি হয়ে গেছে। কতবার সে ভেবেছে একবার ফকিরসাবের দরগায় যাবে। কিন্তু এত কাজ তার সে সময়ই করে উঠতে পারেনি। এবারে সে সব করবে। নিজের খুশিমতো ঘুরে বেড়াবে। তার কোনও বন্ধন থাকল না। বিবি একমাত্র বন্ধন। তার মায়া কাটাতে পারলেই ঈশম মুক্তপুরুষ। হাজিসাহেবের মেজ বিবিকে বলে দিলে পঙ্গু বিবির কাজকাম করে দিয়ে যায়। কাল হয়তো সে-ই দুটো খাইয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু বিবি রাগে কথা বলছে না। ঘরটার দরজা খুব ছোট। জানালা নেই। ভিতর সব সময়ই অন্ধকার থাকে। আর ঘরের ওপর বড় এক আতা ফলের গাছ। গাছের ছায়া বড় ঠাণ্ডা। ঘরে ঢুকলেই কেমন শীত শীত করে। সে একা এ-ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।

    সে বলল, কাইল মাইজলা বিবি আইছিল? তুই কিছু খাস নাই?

    কোন জবাব নেই বলে, সে হাসল। কারণ বিবির এই রাগ দেখলেই ওর যৌবনের কথা মনে হয়। বড় বালিকা ছিল সে। ঈশম তাকে মেলা থেকে পুঁতির মালা এনে দিলে এমন রাগ করে থাকত। সে হাঁড়িতে জল এনে রাখল। নোংরা শাড়িটা ধুতে গেল ঘাটে। এবং ঘাসের ওপর শুকোতে দেবার সময় মনে হল, বিবিটা কিছুতেই কথা বলছে না।

    সে ঘরে ঢুকে বলল, বেশি সময় লাগব না। দ্যাখ, কত তাড়াতাড়ি তরে ভাত পাকাইয়া দেই।

    কিন্তু কোনও উচ্চবাচ্য না। বিবির গলা এমনিতেই অস্পষ্ট। সে হয়তো ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। সে এবার মাদুরের পাশে বসে আগুন জ্বালাবার সময় বলল, দিয়া আইলাম তাইনগ। নদীর পাড়ে ছাইড়া দিয়া আইলাম।

    ঈশম তবু একা একা কথা বলছে, কী সুখ হে পারে জানি না আল্লা। এমন সোনার দ্যাশ ফালাইয়া পাগল না হইলে কেউ যায়!

    ঈশম আবার নিজেই মনকে বুঝ-প্রবোধ দেয়। গ্যাছেন বইলা আমার কষ্ট হইছে! আরে আল্লা—আমি কি কাম কাজ জানি না! আমার খাওয়নের অভাব আছে! আল্লার দুনিয়ায় কেউ না খাইয়া থাকে না। বলেই সে এবার মাথায় হাত রেখে যেমন আদর করে মাঝে মাঝে তেমনি বলল, ভাল হইলে তরে লইয়া নদীর হে পারে যামু। এই দ্যাশে আর থাকমু না!

    বিবির শরীর বড় ঠাণ্ডা মনে হল। হিম ঠাণ্ডা। শক্ত। আরে তুই এমন ঠাণ্ডা মাইরা আছস ক্যান? কি হইছে তর?

    কিন্তু না কোনও কথা না। সে তাড়াতাড়ি মাথাটা কোলের ওপর তুলতে গিয়ে দেখল একেবারে শক্ত। প্রাণ নেই। সে আবার ধীরে ধীরে শুইয়ে দিল। সে কাউকে ডাকল না। এ-ঘরে আলো ঢুকতে পারে না। সে ঘরের সব বেড়াগুলি খুলে ফেলল। এখন কী আলো ঢুকছে ঘরে! নীল কাঁথার নিচে বিবি। সেই প্রথম পঙ্গু হয়ে যাবার পর দীর্ঘদিন তাকে একা অন্ধকারে ফেলে—সে যেন নিরুদ্দেশে ছিল। আর কী আশ্চর্য, ফিরে আসার পর সে যেন এই প্রথম আলোতে মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে বিবি। ঠোটের কোণে সামান্য মিষ্টি হাসি। বয়স আর বাড়েনি বিবির। সেই শৈশবের মুখ। সে শরীরে পঙ্গু হয়েছিল। মুখে যে লাবণ্য ছিল, আজও ঠিক তেমনি আছে। মুখ তার বিন্দুমাত্র জরাগ্রস্ত হয়নি। কাল, বিন্দুমাত্র মুখে থাবা বসাতে পারেনি। তার সুন্দর মুখচোখ এত বেশি তাজা ছিল ঈশম জানত না। ওর অন্ধকারে মনে হতো বিবি তার শুকিয়ে যাচ্ছে। বিবি তার মরে যাবে। ঘরের দরজা এত ছোট যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। জল-ঝড়ে যাতে বিবির কষ্ট না হয় তেমনি করে ঘরটা ঈশম তুলেছিল। এখন মনে হচ্ছে একবার আলো জ্বেলে সে কেন দেখল না—বিবির বয়স বাড়েনি। এমন আশ্চর্য ঢলঢলে মুখ দেখে বিবির জন্য মায়া পড়ে গেল। সে কোনও লোক ডাকল না। ডাকলেই সে আর বিবির পাশে বসে থাকতে পারবে না। ওর মুখ দেখতে পাবে না। তাকে দুরে সরিয়ে নেওয়া হবে।

    আবেদালি যাচ্ছিল মাঠে। সে মাঠে যেতে যেতে দেখল ঈশমচাচা ঘরের সব বেড়া খুলে চাচির পাশে বসে রয়েছে। এখন ধান পেকে গেছে মাঠে। মাঠে কোথাও কোথাও জল-কাদা। চারপাশে আবার সেই সোনালী ধান। ধানের গন্ধ সর্বত্র। আর এ-সময় চাচা চুপচাপ চাচির পাশে বসে রয়েছে। কাজকামের মানুষ। কর্তারা সব চলে গেছে। গেলেও মানুষটার কাজের শেষ নেই। চুপচাপ বসে থাকার মানুষ নয়। সে কেমন কৌতূহল বোধ করল। তা ছাড়া কর্তাদের সে নারাণগঞ্জে তুলে দিয়ে এসেছে—ওদের যেতে রাস্তায় কোনও অসুবিধা হয়েছে কি-না, বিলের দু’বিঘা জমি কাকে দিয়ে গেল, ঈশমচাচা কী পেল, এতদিনের পুরানো বিশ্বস্ত মানুষ ঈশম, তাকে কিছু না দিয়ে কর্তারা যাবে না। সে এতসব জানার জন্য যখন ঘরটার পাশে উঠে গেল তখন দেখল পাগলের মতো চাচা চাচিকে কোলে নিয়ে বসে আছে। আবেদালিকে দেখেও কোনও কথা বলছে না। চাচিকে সে কাঁথা দিয়ে শিশুর মতো ঢেকে রাখছে।

    এমন ঘটনায় আবেদালি তাজ্জব বনে গেল। দিনদুপুরে মড়া কোলে নিয়ে বসে রয়েছে, কথা বলছে না। সে সবাইকে ডেকে আনল। চাচির ইন্তেকাল। সবাই প্রায় জোর করে বিবিকে টেনে নামাল ঈশমের কোল থেকে। ঈশম আর দাঁড়াল না। সে হেঁটে একা একা কবরখানায় চলে গেল। সারি সারি কবর। শেষ দুটো কবর জালালি আর ফেলুর। পাশেই ওর বিবির কবর হবে। জায়াগাটা এত নির্জন যে পাশাপাশি মাটির নিচে সবাই মিলে সুখেই থাকবে। সে মনে মনে আল্লার কাছে তার বিবির জন্য দোয়া মাগল। আবার কাশফুল ফুটেছে চারপাশে, মসজিদে আবার সেই তিন সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। মনজুর ইমামের কাজ করছে। এবং সেই সব পাখি তেমনি আকাশে উড়ছিল। শরতের আকাশ আর কবরের ওপর কাশের গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। সে বিবিকে মাটির নিচে রেখে কিছুদিন আর এ-দেশে থাকল না। থাকতে ভালো লাগল না। সহসা সব কিছু কেন জানি অর্থহীন হয়ে গেছে।

    সে যেতে যেতে উত্তরে চলে গেল। উত্তরে যেসব মেমানদের বাড়ি আছে তার, তাদের বাড়ি উঠে নিজের পরিচয় দিল। যৌবনে সে একবার এ অঞ্চলে এসেছিল। যারা যারা তাকে চিনত, তাদের অনেকেই বেঁচে নেই। কেউ বুড়ো অথর্ব হয়ে গেছে। কেউ তাকে চিনতে পারল না। এতদিনে ঈশমের মনে হল তার সত্যি বয়েস হয়েছে। একটা কাজকামের দরকার—কিন্তু কোথায় করে! তেমন সে বাড়ি পাবে কোথায়! সে ঠাকুরবাড়ির বাঁধা লোক ছিল বলে তার অঞ্চলের জাতি ভাইরা ওকে বিধর্মী ভাবত তাছাড়া সে তো আর যেখানে সেখানে কাজ করে নিজের মান খোয়াতে পারে না। এ-ভাবে যে তার কতদিন চলে যায়। একটা তো পেট, কোনওরকমে ঠিক চলে যাবে। আসার আগে মনজুর, হাজিসাহেবের বড় বেটা ইসমতালি সবাই ওকে থাকতে বলেছিল। কাজের মানুষ। এমন মানুষ পাওয়া ভার। সে সবাইকে বলেছে, আর না। আর কাজ না। এই বলে সে সবাইকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। বস্তুত ঈশম আর প্রাণে সাড়া পাচ্ছে না। কেবল মনে হয় তার জীবনের সব ঐশ্বর্য ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। এখন একটু ঘুরে-ফিরে মাঠে চুপচাপ একা বসে আল্লার মর্জির কথা ভাবা। তবু কাজের মতো কাজ পেলে সে করতে পারত। তেমন কাজ তাকে আর কে দেবে!

    সে একদিন দেখল, কিছু লোক সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছে। পাশাপাশি কোথাও মেলা থাকতে পারে। কিন্তু কোথায় সেই মেলা! সে প্রশ্ন করে জানতে পারল, ওরা মেলায় যাচ্ছে না, ওরা যাচ্ছে সদরে। সদরে জিন্নাহ সাহেব আসছেন বক্তৃতা দিতে। দূর দূর গ্রাম থেকে নাস্তা গামছায় বেঁধে মানুষ যাচ্ছে জিন্নাহসাহেবকে দেখতে। ঈশম যেতে যেতে ভাবল, একবার সেও চলে যাবে নাকি! এত বড় মানুষ আসেেছন, তিনি দুঃখী মানুষের জন্য নতুন স্বপ্ন দেখেছেন। আলাদা দেশ করে দিয়েছেন। এবারে তোমরা বাপুরা নিজেদের মতো করেকর্মে খাও। তারও ভারি ইচ্ছা সেই মানুষকে দেখে। সদরে গেলে সে সামসুদ্দিনের বাসায় থাকতে পারবে। কিন্তু সামসুদ্দিন কোথায় থাকে, ঠিকানা তার জানা নেই। শহরে গেলে নিশ্চয়ই সে মানুষটার নাগাল পাবে না। সে আর একা একা অতদূর যেতে সাহস পেল না।

    ফতিমারও ভারি ইচ্ছা ছিল যায়। কত লোক দূর দূর থেকে শহরে আসছে। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে দেখা যায় অজস্র অগণিত মানুষ, মাথার উপরে ফেস্টুন উড়ছে, লাল-নীল পতাকার মতো সব রঙ-বেরঙের ইস্তাহার, যেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ছে মানুষের মাথার উপর। সকাল থেকে অগণিত মানুষ যাচ্ছে আর যাচ্ছে। আকাশে বাতাসে ধ্বনি উঠছে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। আল্লাহু আকবর। কায়েদ-ই-আজম-জিন্দাবাদ। রাস্তায় রাস্তায় তোরণ, গাছে গাছে আলো এবং মিনারে মিনারে অপরূপ লাবণ্য—ফতিমা দুপুর থেকে সাজছে। সেও যাবে। কিন্তু কী যে হল, সে তার বা’জানের মুখের দিকে তাকাতেই কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সকালে সে বাজানের যে উল্লাসের মুখ দেখেছে, এই বিকেলে তার বিপরীত। সামসুদ্দিনের মুখ থমথম করছে। সে কী যেন টের পেয়ে গেছে। টের পেয়েই সে বলেছে ফতিমাকে, তোমায় যেতে হবে না। মেয়েরা কেউ যাবে না। ফতিমার এত ইচ্ছা যাবার অথচ যেতে পারছে না। সে তার বাবাকে অন্তত একবারের জন্য অনুরোধও করতে পারছে না। সে যাবে আর আসবে। একবার দেখেই সে চলে আসবে। কিন্তু বাপের মুখ দেখে ফতিমা সেটুকু পর্যন্ত বলতে সাহস পাচ্ছে না।

    সামসুদ্দিন সকাল থেকে নানাভাবে এই মহান দেশকে কীভাবে সামনে নিয়ে যেতে হবে এবং তার বক্তৃতায় কতটা বাংলাদেশ থাকবে, কতটা সারা পাকিস্তান থাকবে, সে কতটা কার হয়ে বলবে, বলা উচিত—এসব যখন ভাবছিল, তখন হক-চৌধুরী গোপনে একটা খবর দিয়ে গেল। সে পাগলের মতো হক-চৌধুরীর মুখের ওপরই না না করে উঠেছিল। তার সামনে বড় আয়না! গায়ে আচকান। সে নিজেকে আয়নায় প্রথমে চিনতে পারল না। চিনতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। সে কেমন বিষণ্ণ গলায় ডাকল, ফতিমা।

    ফতিমা বলল, যাই বা’জান।

    ফতিমা কাছে এলে বলল, একবার ফোন করে দেখ তো, কাদেরসাহেব আছেন কিনা?

    ফতিমা ডায়াল ঘোরাল। সে দু’বারের চেষ্টায় কাদেরসাহেবের বাড়ির সঙ্গে সংযোগ করতে পারলে বলল, তিনি বাড়ি নাই বা’জান।

    —ঠিক আছে। বলেই সে বারান্দায় এসে দাঁড়ালে দেখল পত্রিকার তরফ থেকে একজন রিপোর্টার এসে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকে ইশারা করে উপরে চলে আসতে বলল।

    —কি চাই বল?

    —কায়দ-ই-আজম এইমাত্র ঢাকায় এসেছেন। এ-মুহূর্তে আপনার কী মনে হচ্ছে?

    —কী যে মনে হচ্ছে বলতে পারছি না।

    —কিছু অন্তত বলুন।

    —আজ বলব না। কাল আসবে, বলব।

    পত্রিকার রিপোর্টারটি কাল যখন এল সামসুদ্দিন তাকে চা খেতে বলল। তারপর কথাপ্রসঙ্গে যেন বলা, তুমি কাল আমাকে কিছু বলতে বলেছিলে?

    রিপোর্টারটি চা-এ চিনি গুলতে গুলতে বলল, বলেছিলাম সামুভাই।

    —আজ কী শোনার ইচ্ছা আছে?

    রিপোর্টারটি যেন জানতো, সামুভাই এবারে কী বলবে। সে বলল, আমি জানি আপনি কী বলবেন।

    —কী বলব?

    —যে দেশের হাজারে মাত্র পঁচিশজন লোক উর্দুভাষায় কথা বলে, সে-ভাষা রাষ্ট্রভাষা হয় কী করে?

    —শুধু তাই নয়। আমরা হাজারে চারশ’ বারো। চারশ’ বারোজন বাংলা ভাষায় কথা বলি। তার চেয়ে বড় কথা বাপ-দাদার ভাষা বাদে অন্য ভাষা আমাদের জানা নেই। আমাদের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলাভাষা।

    রিপোর্টারটি বলল, ছাত্রলীগের বৈঠক শেষ করে ফিরতে আপনার নিশ্চয়ই রাত হয়েছিল?

    —তা হয়েছিল। কেন বল তো?

    —সাবধানে থাকবেন। আপনাদের আন্দোলন দানা বাঁধুক সরকার তা চাইছে না।

    সামসুদ্দিন এ কথায় সামান্য হাসল। সেই ছোট্ট হাসি। অথচ কী বলিষ্ঠ এবং দৃপ্ত সে হাসি। সে বলল, তোমাদের আজকের রিপোর্ট চমৎকার হয়েছে। বুঝতে পারছ এ-ব্যাপারে এখন থেকে কিছু মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকবে। হিন্দুস্থানের চর, দালাল এবং কম্যুনিস্ট জুজুর ভয় দেখিয়ে আন্দোলনকে বানচাল করে দেবার চেষ্টা করবে।

    —তা করবে।

    গতকাল তুমি কোন্‌দিকে বসেছিল? প্রেস গ্যালারিতে তোমাকে দেখিনি তো!

    -–আমি ঠিকই ছিলাম। আপনি এত বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে লক্ষ করেননি।

    -–ভাল কথা. তোমার আতাউরসাহেবেকে একটা কথা বলবে আমার হয়ে?

    রিপোর্টারটি তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কিন্তু সাসমুদ্দিন যেন কী মনে করার চেষ্টায় বসে আছে। ঠিক মনে করতে পারছে না বলে বলতে পারছেন না। এবং মুখের উপর নানারকম রেখা খেলা করে বেড়াচ্ছে। মনের গহনে ডুবে গিয়েও যেন তিনি তা খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বিব্রত বোধ করতে করতে ডাকলেন, ফতিমা ফতিমা।

    —যাই বা’জান।

    —তর বন্ধু আনজুর দাদার কী নাম যেন?

    — সফিকুর।

    —হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ছেলেটি উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে। ওর বোনটা পড়ে ফতিমার সঙ্গে। তোমাদের কাগজের কিছু কাজটাজ যদি ওকে দেওয়া যায়, তবে তো কলেজের পড়াটা চালিয়ে যেতে পারে। কোনখানে অগ বাড়ি য্যান ফতিমা?

    —মুর্শিদাবাদে। গাঁয়ের নামটা মনে নেই।

    —মনে করে আতাউরকে বলবে। আমি একটা চিঠি দিয়ে পাঠিয়ে দেব। মনে থাকবে তো। তুমি ভাই বলো মনে করে।

    রিপোর্টারটি হাসল। মাঝে মাঝে সামুভাই কেমন ছেলেমানুষ হয়ে যান কথা বলতে বলতে। সে বলল, এটা যাহোক নতুন কথা শুনালেন জিন্নাহ্-সাহেব। লাহোর রেজুলেশনের অদ্ভুত ভুল বের করেছেন এতদিন পরে—পাকিস্তান ইনডিপেণ্ডেট স্টেটস্ নয়। লাহোর রেজুলেশনের স্টেটস্ শব্দের শেষের ‘এস’টি টাইপের ভুল। একটি মাত্র ‘স’ বাদ দেওয়ার ফলে পাকিস্তান হয়ে গেল এক রাষ্ট্র। এক ভাষা, এক সংস্কৃতির দেশ।

    —দিনে দিনে আরও কত কিছু হবে। তারপর সহসা মনে পড়ে যাবার মতো বলল সামু, আমি আর বসব না। তুমি আবার এস। সময় পেলেই এস, কথা বলা যাবে। আজ আবার কার্জন হলে সুধী সমাবেশ হচ্ছে। জিন্নাহসাহেব বক্তৃতা করবেন। আজ কী বলেন আবার দেখা যাক।

    .

    জিন্নাহ টুপির ছড়াছড়ি। গেটের মুখে সামসুদ্দিন এবং ছাত্রলীগ নেতা নাইমুদ্দিন দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। আজ সামু শেরোয়ানি আচকান পরেনি। পরলেই ওর নিজেকে কেন জানি জনতার মানুষ বলে মনে হয় না। সে যেমন চিরাচরিত পোশাক পরে থাকে, পাজামা, ঢোলা পাঞ্জাবি, আজও সে তাই পরেছে। এখন সে নিজেকে সহজে চিনতে পারে। আয়নায় দাঁড়ালেও সে যে সামসুদ্দিন, ফসলের খেতে সে এবং মালতী বড় হয়েছে, মালতীর কথা মনে আসতেই এই সুসময়ে তার চোখ কেমন চিকচিক করে উঠেছে। সে ভুলতে চাইছে, যা সে ফেলে এসেছে, তার দিকে আর ফিরে তাকাবে না। অথচ কেন যে সে এমন কষ্ট পায়, কেন যে সে বাড়ি যাবার পথে দেখে ফেলেছে, ঠাকুরবাড়ির ঘর-দরজা কিছু নেই। খালি খাঁখাঁ করছে পাড়াটা। দীনবন্ধু নেই, নরেন দাস চলে গেছে। সব খালি করে দিয়ে চলে যাচ্ছে—ওর এসব মনে পড়লেই কষ্টটা বাড়ে। ফতিমা আর যায় না। সে বড়দিনের বন্ধে কিছুতেই তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেনি। গ্রাম থেকে ফিরে এসে যখন সে অলিজানকে বলত, দেখা যায় না। খাঁখাঁ করছে। হুহু করে বাতাস বইলে ঠাকুরবাড়ির পাইক খেলার কথা মনে হয়। তখন ফতিমা কিছুতেই কাছে থাকে না। ডাকলে সাড়া পর্যন্ত দেয় না। মেয়েটা সফিকুরকে ভারি পছন্দ করছে। সফিকুরের কথা শুনলে ছুটে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে যায়। আনজু এলেও সে এত ফিসফিস করে কী কথা বলে! চোখের সামনে তার মেয়েটা কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল। এ বয়সে সাদি না দিলে গাঁয়ে এতদিনে মুখ দেখাতে পারত না। কিন্তু সামু এখন দেশের বড় নেতা। তার মেয়ে বড় ইস্কুলে পাঠ নেয়। কত রাজ্যের কাগজ আসে বাড়িতে। দেশ-বিদেশ থেকে লোক আসে দেখা করতে—সে সময়ই পায় না। মেয়েটা কখন কোন ফাঁকে যে বড় হয়ে যাচ্ছে এত। সে বলল নাইমুদ্দিনসাহেব, আমরা একসঙ্গে আজ উঠে দাঁড়াব।

    নাইমুদ্দিন সামুকে ভালই চেনে। সামুভাই কী যেন ভাবছিল এতক্ষণ! এমন দৃঢ়চেতা বাঙালী, মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালী ক’টা আছে হাতে আঙুল গুনে যেন বলা যায়। সে বলল, ডর নাই সামুভাই আপনার পিছনে আমরা আছি। সারা বাংলাদেশ আছে। আপনার তবে ডর কি?

    সামু বলল, আসেন। ভিতরে গিয়া বসি।

    .

    সামুর ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সে গাড়িতে বসে চারপাশ থেকে যেন কেবল শুনতে পাচ্ছে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। উর্দুই হবে…উর্দুই…।

    সে হলের ভিতরও এমন এক সুধীসমাজের মধ্যে বসেছিল যারা জিন্নাহসাহেবের বক্তৃতা আবেগভরে শুনে যাচ্ছে। ওরা কেবল শুনে যাচ্ছে। কিছু বলছে না। আর জিন্নাহসাহেবও সময় বুঝে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক কথা, যেন তাঁর মুখে অন্য কোনও কথা নেই, তিনি যেন বাঙালীকে সেই সুদূর সিন্ধু দেশের উপত্যকা থেকে ছুটে এসেছেন কেবল বলতে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সে আর পারল না। সে চিৎকার করে বলে উঠল—না! তা হবে না। উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। থমথম করছে সারা হল। কে, কে এমন কথা বলছে। মানুষটার দিকে তাকিয়ে সুধীসমাজ মাথা নিচু করে রাখল। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে কেউ আর বলতে পারছে না। গভর্নর-জেনারেলের মুখের ওপর এমন কথা কে বলতে পারে!

    সামু আর দাঁড়ায়নি। সে মনে মনে জানে এটা হতে পারে না। সে কিছুক্ষণ বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকল। ওর দেখাদেখি কাদেরসাহেব বের হয়ে এলেন। এবং কিছু তরুণ এসে তাকে ঘিরে ধরল। বলল, আমরা আছি সামুভাই। আপনার ভাবনার কিছু নাই।

    তারপর সামু জানে চুপচাপ বসে থাকার সময় আর হাতে নেই। দেশের স্বাধীনতার পর আর এক সংগ্রাম গ্রামে মাঠে আরম্ভ হয়ে গেছে। সে দেখল জিন্নাসাহেব যখন বের হয়ে যাচ্ছেন, তখন চারপাশ থেকে অযুতকণ্ঠে গলা মিলিয়ে কারা যেন বলছে, না না না। উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে না।

    সামুর মুখের ওপর লাইটপোস্টের আলো এসে পড়েছে এতক্ষণে। কিছু বোগেনভেলিয়ার পাতা ডাল মাথার উপর। সেই আলোর ভিতর থেকে সে যেন সংগ্রামের অন্য আলোর সন্ধান পেল। সে আবার গ্রামে মাঠে চলে যাবে—বাংলার জনতার রায় নেবে। সে যখন গভীর রাতে ফিরল হাতের কাজ সেরে, তখন দেখল মেয়েটা জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘুমোয়নি। বাপের জন্য জেগে বসে আছে।

    ফতিমা বলল, বা’জান, ফিরতে এত দেরি হয় ক্যান?

    সামু খেতে বসে মেয়েকে বলল, কাজ আম্মা অনেক। আজ কী তারিখ রে ফতিমা?

    ফতিমা বলল, এগার তারিখ। সারাটা জীবন কাজ কাজ কইরাই গ্যালেন।

    —কী করি ক! কাজ থাকলে তারে ফেলতে নাই। বলে সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বাড়ি যামু। তুই যাইবি?

    বাড়ি যাবার নামে প্রতিবার সে যেমন মুখ উদাস রাখে, আজও তেমনি বাপের দিকে উদাসভাবে তাকাল। সে কিছু বলল না। যেন সে খুব মনোযোগ দিয়ে বাপের খাওয়া দেখছে—আর কিছু শুনছে না, শুনলে পাপ, দুঃখ তার বাড়ে, যতটা পারল অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করল।

    —কাদেরসাহেবের গাড়িতে যামু। গাড়ি নদীর পার পর্যন্ত যায়। বাড়ির কাছে পাকা রাস্তা গেছে।

    ফতিমা দেখল বা’জান কেবল কথাই বলছে। কিছু খাচ্ছে না। মা সব গরম করে দিয়েছে। তবু খাচ্ছে না। ভাত নাড়াচাড়া করছে শুধু। এত রাতে কেউ খেতেও পারে না। ফতিমা এসব দেখে বলল, কিছুই ত খাইলেন না?

    —ক্যান! বেশ ত খাইলাম!

    —কি আর খাইলেন। এডারে খাওয়ন কয়!

    সামু একটা সানকিতে মুখ কুলকুচা করে উঠে গেল। সামু উঠে গেলে থালাটা নিয়ে ফতিমা টেবিলে গিয়ে বসল। অলিজান ফতিমাকে কিছু লাগবে কি-না জিজ্ঞাসা করে নিজেও খেতে বসে গেল। ওরা ফরাসের ওপর বসে খাচ্ছে। ফতিমার, বাজানের যা অবশিষ্ট ছিল ওতেই পেট ভরে গেল। ফতিমা মাছ খেতে ভালোবাসে বলে অলিজান আরও একটুকরো মাছ বেশি দিয়েছে। সে মাছ খাচ্ছিল নিবিষ্ট মনে। সে বা’জানের দিকে তাকাতে পারছে না। তাকালেই আবার বা’জান বলবে—কী রে ফতিমা, কিছু কইলি না! সে না তাকালেও জানে, বা’জান খেয়ে উঠলেই বলবে, ফতিমা যাইবি ত! সুতরাং যখন জবাব দিতেই হবে, সে মাছের কাঁটা মুখে রেখেই বলল, আমি যামু না বা’জান, আমার শরীর ভাল না।

    মেয়েটার এই এক স্বভাব হয়ে গেছে। বাড়িতে কিছুতেই যেতে চায় না। বাড়ির কথা, সোনালী বালির নদীর চরের কথা বললেই ফতিমা এ-কথা সে-কথা বলে এড়িয়ে যায়। এবং সব সময়ই পড়া, স্কুল, খাতাপত্র, গল্পের বই এসবের ভিতর ডুবে থাকে। কথা ফতিমা এমনিতেই কম বলে, যত বড় হয়ে উঠছে, তত যেন ওর উচ্ছ্বাস আরও কমে যাচ্ছে। কথা তার সঙ্গে অথবা বিবির সঙ্গে—এ বাদে একজন এলে আজকাল মনে মনে খুশি হয় ফতিমা। ওর নাম সফিকুর। ওর বোন আনজু ফতিমার সঙ্গে পড়ে। অথচ কেন জানি মেয়েটা যত বড় হয়ে যাচ্ছে, তত কাছে কাছে রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে সামুর। দু’দিন পরই মেয়েটাকে কেউ নিয়ে যাবে-তার তখন বড় একা মনে হবে-বাপের প্রাণ বড় আনচান করে। সেজন্য সামু মেয়েটা যত পড়ছে, যত ভাল ছাত্রী হয়ে উঠছে তত সে উৎসাহ পাচ্ছে। শাদিসমন্দের কথা ভাবছে না। যেন মেয়েটা পড়ুক—এখনই কী শাদিসমন্দের কথা! সে বলল, গ্যালে দেখতে পারতি ঠাকুরবাড়ির অর্জুন গাছটা কত বড় হইয়া গ্যাছে। তর মালতীপিসীর কথা মনে পড়ে?

    ফতিমা মুখে সুপুরির কুচি ফেলে বলল, খুব। একটা পান সে বা’জানকে সেজে দিল। পানটা বা’জানের হাতে দেবার সময় বলল, পিসির আর কোন খোঁজখবর হইল না।

    মালতীর কথা বলে সামু কেন জানি সহসা বিমর্ষ হয়ে গেল। এই এক যুবতী তাকে বারে বারে কোথাও টেনে নিয়ে যায়—বুঝি সেই শৈশবকাল, ধানখেত এবং পাটখেতের আল অতিক্রম করে বকুল ফুল কুড়াতে যাওয়া। সে আজকাল বাড়ি গেলে কে যেন তার পাশে থাকে না—হিন্দুপাড়া খালি, খাঁখাঁ করছে। এসব ওকে পীড়ন করলে নিজের কাছেই যেন কোন কৈফিয়ত পায় না। সে কেন যে সহসা তার মেয়েকে মালতীর কথা বলতে গেল। মেয়ে বড় হয়েছে তার। সে সব বোঝে। মালতী সম্পর্কে সে একটা দুর্বলতা সারাজীবন বয়ে বেড়াচ্ছে, মেয়েটা বড় হতে হতে বুঝি তা জেনে ফেলেছে। সামু সেজন্য বলে ফেলেই একটা গোপন দুর্বলতা ফাঁস করে দিয়েছে এমন চোখেমুখে তাকালে, ফতিমা হেসে বলল, এখন আর পড়াশোনা করতে হইব না। শুইয়া পড়েন।

    সামু যেন কত বাধ্য সন্তান ফতিমার। সে চাদরটা টেনে শুয়ে পড়তে পড়তে শিশুসরল মুখ করে ফেলল। এখন দেখলে চেনাই যাবে না কার্জন হলে এই মানুষই সিংহের মতো গর্জন করে উঠেছিল, না হতে পারে না। উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। কেবল ফতিমা বোঝে, যতই বা’জান হাসিখুশি মুখ করে রাখুক, ফতিমা বুঝতে পারে, চোখের ভিতর দিয়ে তাকালে বুঝতে পারে—বা’জান আবার অস্থির হয়ে উঠেছে। দেশভাগের ঠিক আগে যেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি ভিতরে ভিতরে এক অদ্ভুত পীড়ন বোধ করছে। ভিতরে মানুষটার কি হচ্ছে না হচ্ছে অলিজান পর্যন্ত টের পায় না। বরং যতক্ষণ বাড়ি থাকে মানুষটা ততক্ষণ এই সংসারই যেন তার সব। অলিজানের সুবিধা অসুবিধা, ফতিমা পাস করলে কোন কলেজে ভর্তি হবে, সংস্কৃত নিয়ে পড়ার ইচ্ছা মেয়েটার, ওদের সুখদুঃখ এই সার মানুষটার, সেই মানুষটাই কেমন অভিমানী মন নিয়ে বলে ফেলল, ফের, তর মালতীপিসি কী এ দ্যাশে, আছে! হিন্দুস্থানে গেছে গিয়া। সোনার দ্যাশ, সোনার সিংহাসনে রাজরানী হইয়া বইসা আছে।

    .

    আর তখন মালতী বুঝি সোনার সিংহাসনে দুলে দুলে পাল্কি কাঁধে বেহারা যায় হোঁ হোম না, তেমনি যেতে যেতে হাঁক পেল, আপনেরা সকলে নামেন গ মাজননীরা। স্টেশানে আইসা গ্যাছি, নামেন।

    দলটা হুড়মুড় করে স্টেশনে নেমে পড়ল। এদিক-ওদিকে ছুটোছুটি করে প্ল্যাটফরমের বাইরে লাফিয়ে পড়ল।

    স্টেশনের বড়বাবু হাসলেন। নিত্য এমন হচ্ছে। কোত্থেকে হতচ্ছাড়া সব রিফুজি এখানে চাল চোরাচালানের জন্য চলে আসছে। এই যে দলটা স্টেশনে নেমেই ছড়িয়ে পড়েছে, ছুটছে এলোপাথাড়ি—এরা সবাই চাল চোরা-চালানের। স্টেশনে স্টেশনে এই দলটা ট্রেন থামলেই লাফিয়ে পড়বে। আর সতী-সাবিত্রীর মতো মুখ ঢেকে পালাবে। ছুটবে যতক্ষণ না প্ল্যাটফরম পার হওয়া যায়। মালতীও দেখাদেখি ছুটছিল। সে নতুন এই কাজে। সে হারুর বৌর পিছনে পিছনে ছুটছে। অভিনয়টা মালতী ধরতে পারেনি।

    তখন বেলা দুপুর। তখন হাটে সবে দূর থেকে করলা এসেছে, ঝিঙে এসেছে। হাটে গরু-মহিষ এসেছে। রাস্তার চারপাশে বড় ভিড়। বড় বড় ট্রাক দাঁড় করানো আছে রাস্তার উপর। শহরের জন্য সব্জি বোঝাই হচ্ছে। এবং সব্জির নিচে কর্ডন এলাকা থেকে চাল বোঝাই হচ্ছে। কেউ টের পাচ্ছে না। সব্জির নিচে মিহি চাল শহরে চলে যাচ্ছে।

    মালতী কতদূর পর্যন্ত ছুটে যেতে হবে জানে না। হারুর বৌ দেখল মালতী সীমানা ছাড়িয়েও ছুটছে। সে হিহি করে হেসে দিল। অতটা ছোটার কথা নয়। বাবুরা অতদূর যেতে বলেনি ছুটে। কেবল প্ল্যাটফরম পার হয়ে কিছুদূর ছুটে যেতে হবে। যেন বাবুদের কোনও দোষ নেই। দোষ থাকার কথা নয়। বাবুরা জানে সব। নিতাইর বাপ সব ব্যবস্থা করে রাখে।

    হারুর বৌ হাসতে হাসতে ডাকল, আর কৈ যাস। ইবারে থাম।

    মালতী বলল, পুলিশে ধরলে! বিনা টিকিটে এতদূর এসে পড়েছে। জেলহাজত হতে কতক্ষণ?

    —আ ল তর যে কথা! নিতাইর বাপ বাবুগ খুশি করতে গেছে।

    —তবে স্টেশনে তোরা সবাই ছুটলি ক্যান?

    —দ্যাখাতে হয় না ল, দ্যাখাতে হয়। বাবুরা দাঁড়াইয়া থাকেন। অগ করণের কিছু নাই য্যান, অবলা জীবের মত মুখ কইরা রাখে। কিছু জানে না মত দাঁড়াইয়া থাকে! যাত্রা দেখছস মালতী, কেষ্টযাত্ৰা।

    মালতী হাঁপাতে হাঁপাতে দেখল ওরা একটা ভাঙা বাড়ির সামনে সবাই জড়ো হয়েছে। সে হারুর বৌকে বলল, যাত্রা দেখি নাই আবার!

    —এডা হল যাত্রার সঙ। আমরা যাত্রা করলাম। বাবুরা দাঁড়াইয়া থাকল—অবলা জীব সব ছুইট্যা যাইতাছে, অরা কী করতে পারে! নিতাইর বাপের লগে বাবুগ লগে সলাপরামর্শ কইরাই এডা আমাগ করণ লাগে।

    মালতী বুঝতে পেরে পায়ের নিচে যেন মাটি পেল। ভাঙা বাড়িটার পাশে বড় একটা আমলকী গাছ। গাছে ফল নেই। গাছটা সামান্য ছায়া দিচ্ছিল। মালতী ছায়ার নিচে বসল। দলে ওকে নিয়ে আঠারজন। একমাত্র নিতাইর বাপ এ-দলে পুরুষমানুষ। সেই বাবুর হয়ে কাজ করে। সে রেলের পয়সা বাদেও মহাজনের কাছ থেকে আলগা কিছু পয়সা পায়। সে দলের মোল্লা।

    নিতাইর বাপ সবাইকে কেমন শাসনের গলায় বলল, এখানে বস। কেউ কোথাও যাবে না। সবাই জিরিয়ে নাও। আজ হাটবার। তোমরা ইচ্ছা করলে কিছু কেনাকাটা করে খেয়ে নিতে পার। আমরা রাত দশটার ট্রেন ধরব। বড়বাবু বলেছে, তখন চক্রবর্তীমশাইর দলের ডিউটি। ওরা লালগোলা থেকে আসবেন।

    নিতাইর বাপ আর কিছু বলল না। সে হাটবার বলেই হাটে ঘুরতে ফিরতে চলে গেল। মালতী এখান থেকে স্টেশনের মালগুদাম দেখতে পাচ্ছে। বড় বড় খাঁচায় মুরগি। শয়ে শয়ে মুরগি খাঁচার ভিতর। এই সব মুরগি শহরে চালান হচ্ছে। একটা মানুষ পরনে লুঙ্গি মাথায় পাকা চুল—মানুষটা মুরগির ঝুড়িগুলির ভিতর খাবার ফেলে দিচ্ছে। মুরগিগুলি মাঝে মাঝে বড় বেশি চিৎকার করছিল—এখানে বসে মালতী সব শুনতে পাচ্ছে। ট্রেনে রাত জেগে আসতে হয়েছে বলে মালতীর এইসব দেখতে দেখতে ঘুম পাচ্ছিল। আমলকী গাছের ছায়া বড় ঠাণ্ডা। মালতী সামন্য সময়ের জন্য চোখ বুজল।

    গঞ্জের মতো এই জায়গায় জেলার বড় হাট। হাটের ভিতর মানুষের শব্দ গমগম করছিল। দুপুর বলে রোদের তাপ ভয়ঙ্কর আর দীর্ঘদিন থেকে বৃষ্টি হচ্ছে না। শীত পড়ার আগে একবার এ-অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে। তারপর থেকে বড় মাঠের ভিতর বৃষ্টির জন্য কৃষকদের হাহাকার ভেসে বেড়াচ্ছিল। সুতরাং অভাব-অনটনের জন্য চাষা মানুষেরা শেষ সম্বল মুরগির আণ্ডা পর্যন্ত বেচে দিচ্ছে। গরু-বাছুর বলতে আর চাষার ঘরে কিছু নেই। অনটনের জন্য ওরা ওদের শীর্ণ গরু-বাছুর নিয়ে হাটে এসেছে। গাই-গরু-বলদের হাট পার হলে মোষের হাট—নিতাইর বাপ হাটটা ঘুরেফিরে দেখছিল। এবং বাজারে চালের দাম কত, আর মহাজনেরাই বা কত দামে নিচ্ছে—সে হেঁটে হেঁটে সব যাচাই করে নিচ্ছিল।

    মালতী কিসের শব্দে চোখ খুলে তাকালে দেখল, একটা আমলকী ঠিক ওর পায়ের কাছে পড়ে আছে। সে আমলকীটা তুলে তাড়াতাড়ি আঁচলে বেঁধে ফেলল। তার পাতানো বাপ নিশীথের কথা মনে পড়ছে। নিশীথের কথা মনে এলেই রঞ্জিতের কথা মনে আসে। জোটনের কথা মনে আসে। সেই দুঃসময়ের কথা তার মনে হয়। রঞ্জিত এদেশে এসেই কি এক অসুখে ভুগে ভুগে মরে গেল। মরে গেল না কেউ মেরে ফেলল ওকে, সে বোঝে না। মানুষটা তার আদর্শ ছেড়ে দিতেই আর বড়মানুষ থাকল না। ক্ষীণকায় হয়ে গেল। বাঁচার সব উৎসাহ নিভে গেল। তবু সে মানুষটাকে সারাক্ষণ স্বামীর মতো আদরযত্ন করেছে। রঞ্জিত কেমন নিরুপায় মানুষের মতো তাকাতো তখন। তুমি আমাকে মুক্তি দাও মালতী। এমন একটা চোখমুখ ছিল তার। মুক্তি তাকে দিতে হয়নি। রঞ্জিত নিজেই এ-পারে এসে ডঙ্কা বাজিয়ে চলে গেল। অথবা কখনও কখনও মনে হয় বিধবা মালতীর এ-সব ভালো নয়, স্বামীর শখ, স্বামীর শখ হলেই মানুষটা আর তার বাঁচে না। তখন মনে হয় সে রঞ্জিতকে নিজেই মেরে ফেলেছে। ভাগ্যে যার স্বামী বাঁচে না তার কেন আবার স্বামী সোহাগিনী হওয়া! আর যার কথা মনে হয় সে সামু। সামুরে, তর কথাই ঠিক। দেশ তুই পাকিস্তান কইরা ছাড়লি। এসব মনে হলেই মালতীর কষ্টটা বাড়ে। সে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। তার একা থাকতে ভয় করে। সে নিশীথকে ধরে এনেছে। এখন থেকে নিশীথ তার বাপও বটে। নিশীথ বড় দুর্বল মানুষ। অলস প্রকৃতির। ঠিক গাভিন ছাগলটার মতো। ছাগলটা আজকালই বাচ্চা দেবে। সুতরাং ওর তাড়াতাড়ি চাল নিয়ে ট্রেনে উঠে বাড়ি ফেরা দরকার। সে ডাকল, অ বৌ।

    হারুর বৌ জিলিপি কিনে এনেছিল হাট থেকে। সে বাড়িটার ভাঙা সিঁড়িতে বসে জিলিপি খাচ্ছিল। একটা জিলিপি উঠে এসে মলতীর হাতে দিল।

    মালতী জিলিপি খেতে খেতে বলল, আমার মনটা ভাল না বৌ।

    —ক্যান ভাল না। সেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ছে?

    মালতী থুথু ফেলল। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সিংহের দুই চোখ যেন। শুধু খেলা দেখানো বাকি

    চোখে মালতীর নীল রঙের উজ্জ্বল এক আভা। তীক্ষ্ণ রোদের তাপে মণিদুটো বড় হিংস্র দেখাচ্ছিল।

    —অ মালতী, তুই এমন করতাছস ক্যান?

    —আমার কী ইচ্ছা হইছিল বৌ জানস?

    —কী কইরা জানমু?

    —ইসছা হইছিল তার গলাটা কামড়ে ধরি।

    হারুর বৌ কুসুম বুঝতে পারল রাতে সেই বাবুর অন্ধকারে চুরি করে ইতরামো করার বাসনা মালতীকে এখনও কষ্ট দিচ্ছে। অসম্মান ভেবে মালতী সারা পথ আর কারও সঙ্গে কথা বলেনি। ওর চোখ দেখলে এখন মনে হয় হিংস্র এক প্রতিশোধের আশায় সে আছে।

    কুসুম বলল, গরিবের আবার মানসম্মান! গরিবের আবার ছোট-বড়!

    কুসুম গম্ভীর গলায় কথাটা বলল। কুসুম গম্ভীর গলায় কথা বললে বাবুমানুষের মতো কথা বলে। এবং এই কথার দ্বারা সে নিজের সম্মানের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চায়—অসম্মান সেও সহ্য করতে পারছে না—কিন্তু দু’বেলা অনাহার আর সহ্য হচ্ছিল না। কুসুম গর্ভবতী, কুসুম চাল চোরাচালানের জন্য বের হয়ে পড়েছে।

    কুসুম, গর্ভবতী কুসুম পা ছড়িয়ে বসল। ওর ছোট্ট ব্যাগ থেকে পান সুপারি বের করে একটু পান, চুন এবং সাদাপাতা খুব আয়াস অথবা আরামের মতো মুখে ফেলে দিতে থাকল। এতটুকু সুখ।—মালতী জিলিপিটা আলগা করে মুখে দিয়েছিল। সে কুসুমের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, এক টুকরো সুপারি দ্যা বৌ। তারপর ওরা পরস্পর মুখ দেখে এক সময় চুপ করে গেল।

    বিকেলের দিকে সেই মহাজন মানুষটি এসে সকলকে বড় আদর করে গদিতে নিয়ে গেল। নিতাই বাপ দলটার মোল্লা। সুতরাং নিতাইর বাপ আগে আগে হাঁটছিল। মাছ এবং আনাজের হাট পার হয়ে সরু এক গলি। আশেপাশে গেরস্থ মানুষের সংসার। ব্যবসা আছে বলে বোঝা যায় না। মালতী, কুসুম এক এক করে চাল নিয়ে সেই আমলকী গাছটার নিচে এসে বসল।

    মালতীর তিনটি থলে। কাঁখের থলেটা বড় এবং ডানহাতের থলেটা মাঝারি তা প্রায় ত্রিশ সের হবে তিন থলে মিলে। কুসুম এত চাল বইতে পারবে না। সে কিছু কম নিয়েছে। শরীর ওর আর দিচ্ছে না। পাগুলি হাতগুলি ক্রমশ শীর্ণ হয়ে আসছে। মালতী থলের ভিতর হাত রাখল-চালের উত্তাপ আছে—সে চালের ভিতর থেকে দুটো একটা আবর্জনা বের করে নেড়েচেড়ে দেখল যেন এই চাল কত ভালোবাসার জিনিস, এই অন্ন বড় দামী এবং সোনার মতো ভালোবাসা এই অন্নের জন্য সে ভিতের-ভিতরে পুষে রেখেছে। অন্যান্য সকলে চাল আগলে বসে আছে। এখন আর এই চাল ফেলে কেউ কোথাও যাবে না। সকলে ভালো করে বেঁধে নিচ্ছিল—যেন ওরা সকলে জেনে ফেলেছে ওদের ট্রেনে চড়ে যাবার সময় নানা প্রকারের হুজ্জতি হবে—যেন ওদের সেই নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছে দিলে গলায় সোনার হার পরা এক বাবু পান চিবুতে চিবুতে এসে সকলের থলে গুনে গুনে চাল ওজন করেন, সের প্রতি দু ছটাক চাল মেপে দিয়ে তিনি চলে যাবেন। নিতাইর বাপ পিছনে চাল চোরা চালানের হকার দু হয়ে লাঠি ঘুরাবে। সে বাবুর বরকন্দাজের মতো এই চালের পিছনে কত নাচবে-কুঁদবে।

    সুতরাং নিতাইর বাপ দলটার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ক’টা থলে গুনল। ওর মুখে বড় একটা আব, চোয়াল বসানো, দাড়ি-কামানো নয় বলে মুখ অমসৃণ–সে এ-দলের মোল্লা, তার কত দায়িত্ব—সে প্রায় সারাক্ষণ স্টেশন এবং এই আমলকী গাছ, পুরানো জীর্ণ বাড়ির সিঁড়িতে ছোটাছুটি করছে। লালগোলা থেকে যদি চক্রবর্তীবাবু না আসেন তবে মুশকিল—যার যার দল নিয়ে যার-যার খেলা। অপরের হাতে পড়ে গেলেই—পুলিশ, থানা এবং কিছু অবিবেচক মানুষের মতো মাঠে-ঘাটে সংগ্রাম—সুতরাং নিতাই বাপ সকলকে প্রথমে বলল, হ্যা গ মা-মাসীরা—বাড়তি পয়সা কত রাখলে?

    মালতী বলল, আমার হাতে কিছু নাই নিতাইর বাপ।

    —নাই ত বাবুদের পূজা দিমু কি দিয়া?

    —আমারে আগে কইতে হয়। সব টাকায় চাল কিনা ফেলছি।

    —ভাল করছ। নিতাইর বাপের ত একটা কপিলা গাই আছে।

    —তোমার কপিলা গাই আছে আমি কইছি। মালতী রুখে উঠল।

    নিতাইর বাপ মদন মালতীর দিকে এবার ভয়ে তাকাতে পারল না। ট্রেনের সেই মালতী পথ ঘাট চিনে সেয়ানা হয়ে গেছে। মালতীকে বাবুযাত্রীর সঙ্গে বচসা করার সময় মদন বড় বেশি সতর্ক করে দিয়েছিল। এখন সতর্ক করতে গিয়ে ফের অনর্থ, কারণ মালতীর বড় বড় চোখ—যেন সিংহের খেলা দেখানো বাকি, এবারে সে ট্রেনের ভিতর অথবা অন্য কোনও মাঠে সিংহের খেলা দেখাবে। মালতী দড়ি দিয়ে থলের মুখ শক্ত করে বাঁধছিল। ওর শক্ত শরীর এবং পিঠের নিচু অংশটা দেখা যাচ্ছে। সাদা থানের ভেতরে ছিট কাপড়ের সেমিজ। মালতী সাদা থানের ভিতর ঘাড় গলা মসৃণ রেখেছে এখনও। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল বলে আমলকীর ছায়া হেলে পড়েছে। কিছু কিছু মানুষ হাট-ফেরত গাঁয়ে ফিরছে। চাষা-বৌ মুরগি বগলে ফিরছে। ঝুড়িতে আণ্ডা নিয়ে ফিরছে পাইকার। মালতী গলা তুলে এসব দেখল। তারপর উঠে গিয়ে বলল হারুর বৌকে—আমাকে একটা টাকা দে বৌ। নিতাইর বাপের (গোলামের) কথা শুনলে গা জ্বইলা যায়।

    কুসুম কাপড়ের খুট থেকে টাকা খুলে দিল মালতীকে।

    তখন অন্য এক বৌ দলে বচসা করছিল। তখন সন্ধ্যা হচ্ছে। আর তখন হাটের মাঠে বড় বড় হ্যাজাক জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। মালতীর ক্ষুধায় পেট জ্বলছিল সুতরাং মুখে গন্ধ। দুর্গন্ধের মতো। সুতরাং মুখে বার বার থুথু উঠছে। দশটার ট্রেনে উঠলে পৌঁছাতে ভোর হয়ে যাবে। মদন আর একবার এসে সকলকে বলছিল, তোমরা মা-মাসীরা কিছু খেয়ে নাও। চিড়া-মুড়ি যা হোক কিছু। ট্রেন আসতে লেট হবে।

    মালতী কিছু ছোলার ছাতু এনেছিল সঙ্গে। সে বাটিতে জল দিয়ে ছাতুটা ভিজিয়ে খেল। বাটিটার গায়ে নিশীথের নাম। ছাতু খাবার সময় নিশীথের মুখ মনে পড়ছিল এবং ছাগলের মুখ পাশাপাশি। বাচ্চা ছাগলটা ঘরে এনে রেখেছে কিনা, পাতানো বাপ নিশীথ বড় বুড়ো মানুষ, ছাগলটা বাচ্চা হবার সময় চিৎকার করবে—মালতী একটা ছোট্ট ছাতুর দলা কুসুমকে দেবার সময় বাপের মুখ মনে করতে পারল। রঞ্জিতের মুখ মনে পড়ছে।

    মদন ছুটে ছুটে আসছিল। সাতটা বাজে এখন। সে এসে বলল, তোমরা মা-মাসীরা সকলে চলে এস। চক্রবর্তীবাবু সাতটার গাড়িতে চলে আসছেন। বড়বাবু তাড়াতাড়ি করতে বলছেন তোমাদের।

    স্টেশনের বড়বাবু রেলিঙের ধারে এসে উঁকি দিয়ে দেখলেন দলটা নিয়ে মদন রেললাইনের উপর দিয়ে ছুটে আসছে। কুসুম সকলের পিছনে যাচ্ছিল। ওরা কাপড় দিয়ে কাঁধের থলেগুলি ঢেকে রেখেছে। ওরা সকলে ভয়ঙ্কর লম্বা কাপড় এবং সেমিজ পরে সকল চাল প্রায় পোশাকের ভিতর আড়াল দেবার চেষ্টা করছিল। কুসুম ছুটতে পারছিল না। সকলে প্ল্যাটফরমে উঠে গেছে। কুসুমের জন্য মালতীও পিছনে পড়ে থাকল। এবং মালতীর শক্ত শরীর, সে ইচ্ছা করলে কুসুমকে বুকে নিয়ে স্টেশনে উঠে যেতে পারে। মালতী নিজের বাঁ হাতের ছোট্ট থলেটা কুসুমকে দিয়ে, ওর বড় থলেটা ডান কাঁধে নিয়ে ছুটতে থাকল।—তুই আয় বৌ। আস্তে আস্তে আয়। আমি উইঠা যাই।

    কুসুম একটু হালকা হওয়ায় প্রায় মালতীর সঙ্গে সঙ্গেই ছুটতে পারছিল। হাতে-পায়ে শক্তি কমে যাচ্ছে। ওর ছুটতে গিয়ে হাত-পা কাঁপছিল। তবু কোনওরকমে সে টেনে টেনে পা দুটোকে প্ল্যাটফরমের উপরে নিয়ে তুলল। ট্রেনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। এই ছোটাছুটির জন্য হাঁফ ধরছিল বুকে এবং পেটের ভিতর খিল ধরত মাঝে মাঝে। কুসুম আর প্রায় নড়তে পারছিল না। সে মালতীর আশায়, মালতী তাকে তুলে নেবে এই আশায় এবং ট্রেন এলে পুলিশেরা মহব্বতের গান গেয়ে হুইসল বাজাবে, মালতী কুসুমকে তুলে নেবে—মালতী যথার্থই কুসুমের বোঁচকাবুচকি সব তুলে দিল কামরার ভিতরে।

    আর ভিতরে মানুষ-জনে ঠাসাঠাসি। ওরা একা নয়, প্রায় শয়ে শয়ে মানুষ। ‘পিলপিল করে হাটের ভিতর থেকে সব উঠে আসছে। কোন এক জাদুমন্ত্রের মতো যেন—সকলে বুঝে গেছে এই ট্রেন ওদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে—কেবল এক চক্রবর্তী, রাজা মানুষ, তাদের নিয়ে যাবেন—তাদের কাছে তিনি দেবতার মতো। বড়বাবু ছোটাছুটি করছিলেন। ট্রেনের যাত্রীরা দেখল পিলপিল করে ছোট বড় মানুষ বোঁচকাবুচকি নিয়ে বাঙ্কের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। কামরার ভিতরটা অন্ধকার। আলো জ্বালা হচ্ছে না। ভিতরটা ভয়ঙ্কর অন্ধকার লাগছিল মালতীর। সে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সে আন্দাজে কুসুমকে ঠেলে দিল বাঙ্কের নিচে। ওর বোঁচকাকুঁচকি কুসুমের মাথার কাছে ঠেলে দিল, তারপর নিজে মেঝের উপর পা মুড়ে শুয়ে পড়ল। বুকের কাছে সব বোঁচকাবুচকি—সন্তানের মতো লেপ্টে থাকল। যাত্রীরা হৈচৈ করছিল। ওদের পায়ের তলায় জলজ্যান্ত এক যুবতী মেয়ে এবং আরও সব কত বুভুক্ষু মানুষের দল ঠাসাঠাসি করে শুয়ে বসে আছে। দরজা পর্যন্ত দলটা এমনভাবে শুয়ে-বসে ছিল অন্ধকারের ভিতর, মানুষের এত ঠাসাঠাসি যে, যাত্রীরা দরজা পর্যন্ত এসে ভয়ে ভিতরে ঢুকতে সাহস করল না। ভিড়ের ভিতর দেখল অন্ধকারে শুধু মানুষের পিঁজরাপোল। ভ্যাপসা গন্ধ উঠছে ভিতরে এবং হা-অন্নের জন্য অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছে-সুতরাং ভিতরটা মানুষের নরক যেন এবং ওরা সব অন্নের মতো পরম বস্তু অপরহণ করে নিয়ে যাচ্ছে—মালতী দুর্গন্ধের ভিতর পড়ে থেকে নিজের চাল এবং কুসুমের চাল আগলাচ্ছিল। এ-পাশ ও-পাশ হওয়া যাচ্ছে না, হাত পা মেলা যাচ্ছে না—সর্বত্র এই অপরহণের দৃশ্য, পা পিঠ অথবা পাছা কিছুই সরানো যাচ্ছে না। সরলেই কারও না কারও গায়ে লোগে যাচ্ছে। মালতী তবু ঠেলেঠুলে কুসুমের পা মেলার জন্য একটু জায়গা করে দেবার সময় মনে হল বাঙ্কের ওপর কিছু যাত্রী শুয়ে বসে আছে। নিচে মালতীর সিংহের মতো চোখ, শুধু খেলা দেখানো বাকি—মালতীর চোখ জ্বলজ্বল করছিল—সে তার পাছা সাপের মতো ঘুরিয়ে দিল সহসা। মনে হল বাবুটি, সেই বাবুটি, ওর পাছার কাছে বসে এই অপহরণের দৃশ্য দেখে রসিকতা করতে চাইছেন। সেই বাবুটি, যে আসার পথে হারামজাদি বলে গাল দিয়েছিলেন। বাবুটি ফেরার পথে এখানে কেন, বাবুটিকে আসার পথে কোন এক স্টেশনে নেমে যেতে দেখেছিল যেন। ফের সেই বাবু মানুষটি ঠিক বাঙ্কের ওপর পদ্মাসন করে নিমীলিত চোখে বসে আছেন। মালতী বুঝল কপালে আজ বড় দুঃখ আছে। ওর উপায় থাকল না একটু সরে বসতে, শুয়ে পড়তে, অথবা সরে অন্য কোথাও স্থান করে নিতে। একবার এই আশ্রয় থেকে বিচ্যুত হলে রক্ষা নেই—তাকে একা পড়ে থাকতে হবে। সুতরাং সে কুসুমের পিঠে হাত রাখল।

    ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ট্রেনের চাকায় এখন কারা যেন দুঃখের গান গাইছে। এই গান শুনতে শুনতে বোধ হয় কসুম ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। এক পুকুর জল, বড় বড় সরপুঁটি জলের ভিতর খেলা করছে, শাপলা-শালুকের জমি—বর্ষার দিনে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ এবং তালের মালপোয়া অথবা বর্ষার জন্য মানুষের এক পরিণত ভালোবাসা, মালতী ওর দেশের ছবি ট্রেনের চাকায় দেখতে পাচ্ছিল বোধ হয়। সেই ভালোবাসার ছবি আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মালতী অনেক চেষ্টা করেও কুসুমকে জাগাতে পারল না। কুসুম ভোঁসভোঁস করে ঘুমুচ্ছে।

    ট্রেন চলছিল, পাশাপাশি কেউ কোনও শব্দ করছে না। মাঝে মাঝে স্টেশনে ট্রেন থামছিল। কিছু হকারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারপর ক্রমশ ট্রেন এবং স্টেশন কেমন নিঝুম হয়ে আসতে থাকল। শুধু মাঝে মাঝে দলের মোল্লাদের হাঁক শোনা যাচ্ছিল—মা-মাসীরা বড় সাবধানে—কোন হল্লা করবেন না, যাত্রীদের কোন অসুবিধা ঘটাবেন না। যাত্রীদের পায়ের নিচে পড়ে থাকবেন। ওদের সুখসুবিধা দেখবেন। এবং এই বাবুর জন্য মালতীর ভয়, সুখ-সুবিধা বাবুর অন্য রকমের। এত অন্ধকার যখন, এবং মানুষে মানুষে এই ঠেসাঠেসি যখন, কোথায় কার হাত পড়ছে, পা পড়ছে অন্ধকারে ঠাহর করা যাচ্ছে না যখন–তখন বাবুর পোয়াবারো। এইসব ভেবে মালতী ক্রমশ গুটিয়ে আসছিল। এবং ছাগলটার কথা মনে পড়ছে, ছাগলটার হয়তো চারটে বাচ্চা হবে। বাপ নিশীথ ছাগলটা বেচে দেবার মতলবে ছিল। বাপের লালসা বড় বেশি। কেননা সারাদিন বড় খাব খাব করে। এই বয়েস বয়েস আর বাড়ছে না যেন নিশীথের মালতীর ফেরার জন্য সে নিশ্চয়ই এখন দাওয়ায় বসে তামাক টানছে।

    রাত বাড়ছে, মালতী ফিরছে না—নিশীথ হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে চলে এসে দেখল স্টেশনে পুলিশ; আর্মড্ পুলিশ সব। এ লাইনে কিছুদিন থেকে চাল চোরাচালান বড় বেশি হচ্ছে। কেউ পুলিশকে ভয় পাচ্ছে না। ওরা ট্রেনে চাল এনে শহরে-গঞ্জে বেশি দরে বিক্রি করছে। দুপুরে স্টেশন পার হলে পুলিশের সামনেই চেন টেনে বুভুক্ষু নরনারী চাল মাথায় করে ছোটে। ভাগে বনিবনা না হলে এমন হয়। জনতা পুলিশে সংগ্রাম। এখানে পুলিশের মাথা ভেঙে দিয়েছিল মানুষেরা। পুলিশের তরফে এবার কিন্তু খুব কড়াকড়ি। নিশীথ শুনল আজ খবর আছে—পরের ট্রেনটিতে প্রচুর চাল আসছে, চোরাই চাল। পুলিশেরা রেডি, ট্রেন আটকে এইসব চাল উদ্ধার করবে ওরা। নিশীথ প্রমাদ গুণল।

    .

    কামরার ভিতর মালতীও প্রমাদ গুণল। বাবু বড় বেশি ছটফট করছেন। বড় বেশি হাই তুলছেন। এবং হাত পা এদিক ওদিক ছোঁড়ার বড্ড বেশি বদঅভ্যাস। সবই অন্যমনস্কতার জন্যে হচ্ছে এমন ভাব। ট্রেন চলছিল। ভিতরে প্রচণ্ড গরম। জানালা খোলা বলে সামান্য হাওয়া ভিতরে ঢুকতে পারছে না আর এই সামান্য হাওয়ায় বাবু মানুষটা কিংবা সামান্য যাত্রী যারা বাঙ্কে শুয়ে বসে হাত পা ছড়িয়ে নিশীথে নির্ভয়ে ঘুমোচ্ছে অথবা যারা নিজের রসদ আগলাবার জন্য ঘুমোতে পারছে না—এই সামান্য হাওয়া তারাই শুষে নিচ্ছিল। ঘামে মালতীর সেমিজ এবং কাপড় ভিজে যাচ্ছে। হাত পা একটু খুলে ও-পাশ হতে পারলে শরীব সামান্য আসান পেত—কিন্তু মালতীর কোনও উপায় নেই—শুধু অন্ধকার সামনে, পিছনে মাঠ ফেলে ট্রেন দ্রুত ছুটছে। রাত এখন গভীর হয়ে আসছে এবং মাঝে মাঝে সেই মাঠের ভিতর দ্রুত ট্রেনটা ভয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিল যেন। আর ঠিক তখনই মনে হল ঘাড়ে কে যেন মৃদু সুড়সুড়ি দিচ্ছে মালতীর।

    প্রথমে মনে হল একটা নেংটি ইঁদুর ঘাড়ের নিচ দিয়ে সেমিজের ভেতর ঢুকে গেল। মালতী চুপ করে অন্ধকারে ঘাড়ে হাত রেখে বুঝল, নেংটি ইঁদুরটা ভীষণ চালাক। অদৃশ্য হবার ক্ষমতা রাখে। সে ঘাড় গলাতে নেংটি ইঁদুরটাকে খুঁজে পেল না। শুধু বলল, মরণ!

    মালতীর ঠিক ওপরে বাবু মানুষটা বাঙ্কে বসে আছেন। একজন লম্বা মতন ক্ষীণকায় মানুষ, মনে হচ্ছে পিলের রুগী, বাঙ্কে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। পাশের বাঙ্কে বৃদ্ধ মতন মানুষ এবং প্রায় বোবার শামিল। ছোট কামরা বলে আর যাত্রী উঠছে না। শুধু নিচে অন্ধকারে ঠাসাঠাসি করে বুভুক্ষু মানুষের নিঃশ্বাস পড়ছে। ওরা সকলে নিতাইর বাপ মদনের মতো এক মানুষের সংকেতের জন্য অপেক্ষা করছিল। সুতরাং অন্ধকারের ভিতর ইজ্জতের ব্যাপার বলে কোনও বস্তু ছিল না। মালতী গত রাতের মতো চিৎকার করতে পারত, ফোঁস করতে পারত, অথবা চোখে সিংহের খেলা দেখানো বাকি—সে সিংহের মতো গর্জন করে উঠতে পারত। সে কিছুই না করে দম বন্ধ করে শুয়ে থাকল। ট্রেন মাঠ পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। স্টেশনে এলে একটু আলো জ্বলবে—ওর ইচ্ছা তখন খুঁজে পেতে সেই নেংটি ইঁদুরকে বের করা অথবা মানুষ বা বাবুমানুষ,– মানুষটা রহস্যজনকভাবে ওর সঙ্গে সঙ্গে থাকছেন। গত রাতে এই বাবু মানুষটাই ওকে হারামজাদি বলে গাল দিয়েছিলেন—আর যাত্রী সেজে খুব সাফ-সুতরো যুবকের মতো চলাফেরা করেছেন। মালতী এবার সাহসের সঙ্গে অন্ধকারেই পরিহাস করল।

    —কী! কী বললে! বাবুমানুষটির গলার স্বরে অভিনয় ফুটে উঠল।

    —বাবু, আমি মালতী। আমি নিচে শুয়ে আছি বাবু।

    —তুমি কোন মালতী বাছা? কালরাতে যাকে যেতে দেখেছি ট্রেনে করে?

    —হ্যাঁ বাবু কাল রাতে যেতে দেখেছেন। আজ রাতে ফিরছি।

    —সঙ্গে আর কে আছে?

    —হারুর বৌ আছে, নিতাইর বাপ আছে।

    —মাঠ পার হতে পারবা?

    —ভয় কি বাবু?

    হারুর বৌ জেগে গিয়েছিল ওদের কথায়।—আমরা কোনখানে মালতী?

    —সামনে ধুবলিয়া স্টেশন। তুই ঘুমো।

    —হ্যাঁ ল তুই কার লগে কথা কস?

    —বাবুর লগে।

    —বাবুর চোখে ঘুম আসে না?

    —বলছে, আপনার চোখে ঘুম আসে না? আপনি রাতে ঘুমোবেন না?

    বাবু মানুষ বলেন, অদৃষ্ট, ঘুম আসে না রাতে। অদৃষ্ট।

    মালতী বলল, ট্রেনে ট্রেনে কি করেন বাবু?

    বাবুটি এবার হাই তুলে বলল, তোমার দলে কতজন? আঠারজন বুঝি?

    —বাবু সব গুনে-গেঁথে রেখেছেন দেখছি।

    বাবুটি এবার বিজ্ঞের মতো অন্ধকারেই হাসলেন।

    কুসুম কুঁকড়ে ছিল নিচে। ধুলোবালি কাপড়ে সেমিজে কাদার মতো লেগে আছে—ঘামে নিচটা জবজব করছিল। বাবুর বিজ্ঞের মতো হাসি উপরে এবং বাঙ্কের নিচে কুসুম—ওর পিরীতের কথা মনে পড়ছিল। কুঁকড়ে থাকার জন্য এবং মালতী লেপটে থাকার জন্য কুসুম নড়তে পারছিল না। সে কোনওরকমে হাতটা ডানদিকে এনে মালতীকে একটা চিমটি কাটল।

    —বৌ, ভাল হইব না।

    —হ্যা ল, বাবুর লগে পিরীতের কথা ক্যান?

    মালতী পায়ের নিচ পর্যন্ত বাঁ হাতে কাপড় টেনে ফিসফিস করে বলল, মানুষটারে ভাল মনে হইতেছে না। পুলিশের লোক। চুপ কইরা থাক।

    কুসুম যথার্থই ভয় পেল। স্টেশনে পুলিশ অথবা হোমগার্ডের লোক আছে। সেখানে নিতাইর বাপ আছে, বড়বাবু আছেন স্টেশনের, চক্রবর্তীবাবু আছেন। কিন্তু যে মানুষটা গা ঢাকা দিয়ে যাচ্ছে—তাকে বড় ভয় কুসুমের। সে এবার বলল, বাবুরে কইয়া দ্যাখ না, বিড়ি খায় কিনা?

    মালতী বলল, তুই বলে দ্যাখ।

    কুসুম বাঙ্কের নিচ থেকে বলল, নিতাইর বাপেরে ডাকুম নাকি?

    মালতী বলল, ডাকলে অনর্থ বাড়বে বৌ। ওরা এত ফিসফিস করে কথা বলছিল যে বাবুমানুষটি কান খাড়া করেও বিন্দু-বিসর্গ বুঝতে পারছেন না। তিনি তবু বিচক্ষণ পুরুষের মতো বসে থাকলেন। তিনি কাশলেন, হাত-পা নাড়লেন এবং মুখ জানালায় বের করে স্টেশনে পৌঁছাতে কত দেরি দেখলেন। তাঁকে দেখে এসময় মনে হচ্ছিল তিনি কোথাও কোনও খবর পৌঁছে দিতে চান।

    বাবু স্টেশনে নেমে একটা কার্ড দেখাল স্টেশনের বড়বাবুকে, আপনাদের ফোনটা দেবেন বলে তিনি তাঁর কার্ড বের করে ধরলেন।

    —হ্যালো? কে? স্যর আছেন?

    —হ্যাঁ, হ্যাঁ। হিসাব করে দেখলাম প্রায় চারশতের মত লোক যাচ্ছে চাল নিয়ে।

    —তাহলে বড় দল একটা আনতে হয়! আমার সঙ্গে মাত্র দশজন আছে।

    —ওতে হবে না স্যর। মাঠের ভেতর দিয়ে সব তবে নেমে যাবে পিঁপড়ের মতো।

    —তা’হলে বড় একটা এনাকাউণ্টার হবে বলতে চাও?

    —মনে তো হচ্ছে। বলে মানুষটা ফের গা ঢাকা দিয়ে এসে বাঙ্কে বসে পড়লেন। আসার আগে বড়বাবুকে বলে এলেন—খুব গোপন রাখতে হবে স্যর। তা না হলে আপনার আমার দু’জনের মুশকিল।

    .

    আর মদন এবং সব মোল্লারা হেঁকে হেঁকে যাচ্ছিল তখন—মা-মাসীরা বড় দুর্যোগ। মা-মাসীরা আমরা স্টেশন পর্যন্ত যাব না। তার আগে ভাঙা পোলের কাছে—সেই বড় পুরানো বাড়িটার কাছে চেন টেনে নেমে পড়ব। আপনারা মা-মাসীরা ভয় পাবেন না। আমরা আমাদের সন্তান-সন্ততির জন্য চাল নিয়ে যাচ্ছি! মা-মাসীরা কোন চুরি করছি না। জানালায় জানালায় মুখ বাড়িয়ে দলের মোল্লা হেঁকে গেল—আমরা যা করছি সন্তান-সন্ততিগণের প্রতিপালনের জন্য করছি। আমরা চুরি করছি যা, চুরি এটাকে বলে না।

    কুসুম বলল, নিতাইর বাপ কী কইল মালতী?

    —কইল, আমরা আগে নাইমা যামু। চেন টাইনা গাড়ি থামাইয়া দিমু।

    কুসুমকে চিন্তিত দেখাল। অন্য দিন ওরা স্টেশনে নেমে কাঁচা পথ ধরে ছোটার অভিনয় করে। অভিনয় রসের। স্টেশনের মাস্টারবাবু তখন হাসেন। না ছুটলে বড় গালমন্দ করেন। একেবারে চোখের ওপর চুরি। চুরিতে আরাম হারাম। তোরা ছুটলে অন্তত আমরা থেমে থাকতে পারি। অথচ আজ গাড়ি তার আগেই থেমে যাবে। চক্রবর্তীবাবুর হাতে আর কোন কৌশল নেই কুসুম ভাবল, আর কোন কৌশল নেই যার সাহায্যে তিনি ট্রেনটাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে পারেন। সেই ভাঙা পোলের পাশে থাকলে অনেকদূর তাকে এই বোঁচকাকুঁচকি টেনে নিয়ে যেতে হবে। না গেলে অনাহার। শিশু সন্তানেরা বাড়িময় হাঁসের বাচ্চার মতো কেবল প্যাক প্যাক করছে। জননী ফিরলে হাঁসের বাচ্চাগুলি শান্ত হবে। কুসুমের এতটা পথ হাঁটার কথা ভেবে চোখে জল আসতে চাইল। কারণ পেটের ভিতর নতুন বাচ্চাটাও প্যাঁক প্যাঁক করে কুসুমকে মাঝে মাঝে জ্বালাতন করছে। সুতরাং সে পেটের উপর হাত রেখে বার বার বাচ্চাটাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। অনাহার কুসুমের দিনমান—সুতরাং ভিতরের বাচ্চা কেবল খাই খাই করছে। কুসুম রাগে দুঃখে স্বামীকে মনে মনে গাল পাড়তে থাকল—মানুষটা মরে না ক্যান! মরলে হাড় জুড়ায়। দেশ ছাইড়া মানুষটার মান ইজ্জত সব গেছে।

    মালতী বলল, কার কথা কস?

    —আর কার কথা! বলে কুসুম বুঝতে পারে না মনের ভিতর কথা রাখার অভ্যাস তার কবে শেষ হয়ে গেছে।

    মালতী দেখল বাবু সামনের স্টেশনেও নেমে গেলেন।

    —হ্যালো, স্যর আছেন? তিনি ফোন তুলে অনুসন্ধানের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

    —হ্যাঁ, হ্যাঁ বলছি।

    —ওরা চেন টানবে বলছে।

    —চেন টানবে? ওরা ভাঙা পুলের কাছে চেন টানবে বলছে।

    —ওখানে শালগাছের বড় বন আছে না!

    .

    সঙ্গে সঙ্গে জানালায় মোল্লাদের সকলের মুখ দেখা গেল। আপনারা চেন টানার সঙ্গে সঙ্গে মা-মাসীরা বের হয়ে পড়বেন। আপনারা আর শুয়ে থাকবেন না। আমাদের সামনেই নামতে হবে। বোঁচকাচকি সব কাঁধে হাতে নিয়ে রেডি থাকেন।

    বাবুটি মালতীর ঘাড়ে শেষবারের মতো নেংটি ইঁদুরগুলি অন্ধকারে ছেড়ে দিতে চাইলেন। মালতী অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। বার বার সেই ইঁদুরটাকে মালতী ঘাড় গলা থেকে নামিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু শেষবার সে কিছুতেই পারছে না। বাবুর হাতটা ক্রমশ শক্ত হয়ে মালতীর স্তন জাপটে ধরেছে। মালতীর চোখে সিংহের খেলা দেখানো বাকি—সে শক্ত হাতে এবার ছুঁড়ে ফেলে দিতেই বাবুটি বললেন, কোথায় নামবে বাছারা! ভাঙা পোলের কাছে নামবে?

    কুসুম জানতো না অন্ধকারে বাবুমানুষটি মালতীর মতো যুবতীর সঙ্গে রঙ্গতামাশা করছেন। মালতী, অসহিষ্ণু মালতী মোল্লাদের ভয়ে এই যাত্রী মানুষটাকে কিছু বলতে পারছে না, সে রাগে দুঃখে এবং অসম্মানের ভয়ে সরে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু বুভুক্ষু মানুষের এখন নেমে যাবার তাড়া। তারা উঠে অন্ধকারেই নিজের নিজের বোঁচকা ঠিক করে নিচ্ছে। এবং অন্ধকারে ট্রেনটি ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেলে মানুষটি বললেন, কোথায় নামবে বাছারা। পুলিশের বুটের শব্দ শুনতে পাচ্ছ না? বন্দুকের ভেতর থেকে শব্দ ভেসে আসছে না?

    কুসুম হাউমাউ করে কেঁদে দিল, আমাদের কি হবে বাবু!

    বাবুটি বিজ্ঞের মতো হাসলেন—যেখানে আছ সেখানে থাকো। এক পা নড়বে না।

    মালতী বলল, ওদের যেতে দেন বাবু। আপনি পুলিশের লোক, আমাদের মা-বাপ।

    বাবুটি বললেন, কেউ নামবে না বাছারা। বাবুটি এবার সাধারণ পোশাক খুলে ব্যাগের ভিতর থেকে হুইসিল বাজালেন।

    তখন নিতাইর বাপ চিৎকার করে জানালায় জানালায় ছুটে যাচ্ছিল।

    —তোমরা দাঁড়িয়ে থেকো না। মাঠের ভিতর নেমে যাও। অন্ধকারে যেখানে দু’চোখ যায় চলে যাও। পুলিশ ট্রেনটাকে ঘিরে ফেলেছে।

    মালতী বলল, বৌ, তুই নেমে যা। আপনারা যারা আছেন নেমে যান। বাবুটি বললেন, না, কেউ নামবে না।

    —তোমরা নেমে যাও মা-মাসীরা—বলে সে বাবুটির কাঁধে মাথা রাখল অন্ধকারে।

    পুলিশের দলটা জানালা দিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ছে। অন্য দরজা দিয়ে কুসুম নেমে গেল। অন্ধকারের ভিতর মালতী টের করতে পারছে। মালতী এবার নিজের বোঁচকাবুচকি নিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর নেমে যেতে চাইলে পেছন থেকে বাবুটি ধরে ফেলল।

    মালতী চাল ফেলে অন্ধকারে ছুটতে চাইলে বাবুটি দরজা বন্ধ করে দিল। কিন্তু অন্য দরজায় পুলিশ—বাবুটি ভালো মানুষের মতো দরজা খুলে বললেন, দেখ এখানে কিছু চাল আছে। তুলে রাখ।

    মালতী বোঁচকাকুঁচকি ফেলে ছুটছে। যেদিকে কুসুম চলে গেছে সেদিকে ছুটছে। বাবুটি মালতীকে অনুসরণ করছে।

    সামনে মস্ত শালের জঙ্গল। চাঁদের আলোতে এই বন এবং সামনের প্রান্তর বড় রহস্যময় লাগছিল। মানুষের সোরগোল। কান্নাকাটি এবং চিৎকার শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ট্রেনটা একটা বড় জন্তুর মতো একা পড়ে চিৎকার করছিল যেন। মালতী ছুটে ছুটে কুসুমের কাছে চলে গেছে। সে ঝোপের ভিতর লুকিয়ে পড়ছিল—দেখল এদিকটা ফাঁকা। সামনের মাঠে কিছু মানুষের সোরগোল পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে পুলিশের দলটা কিছু লোককে পাকড়াও করে নিয়ে যাবার জন্য সেখানেও একধরনের হায় হায় রব। পুরানো ভাঙা বাড়ি দেখা যাচ্ছে দূরে। সে যাবার পথে এক বৃদ্ধকে এই পোড়ো বাড়িতে লুকিয়ে পড়তে দেখেছিল। বোধ হয় সেই মানুষ এখনও সেখানে আছেন। দেয়ালের ফাঁকে তার ভাঙা হ্যারিকেন জ্বলছিল—সেই আলো দেখে সে কুসুমকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

    কুসুম চলতে চলতে বলল, পেটে কামড় দিছে!

    মালতী ওর সব চাল বোঁচকা কাঁধে হাতে নিয়ে বলল, ইবারে হাঁট বৌ।

    তখন পিছন থেকে বাবুটি বললেন, কোথায় যাবে বাছা!

    কুসুম হাউমাউ করে বাবুর পা জড়িয়ে ধরল।

    এদিকটা ফাঁকা এবং নিঃসঙ্গ। সামান্য দূরে শালের জঙ্গল। এবং প্রান্তরের ভিতর শুধু ইঞ্জিনের আলোটাকে দেখা যাচ্ছে। এই পোড়ো বাড়ির দিকে কেউ ছুটে আসছে বলে মনে হচ্ছে না। শুধু সেই বাবুটি দাঁড়িয়ে আছেন। খুব বলিষ্ঠ মনে হচ্ছিল দেখতে, সেই উঁচু লম্বা মানুষ দারোগাবাবুর পায়ে কুসুম পড়ে পড়ে কাঁদছিল।

    বাবুটি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, চাল নিয়ে কোথাও যেতে দেব না বাছা। আমরা পুলিশের লোক। আমরা আইন অমান্য করলে সরকারের চলবে কী করে?

    মালতী বলল, যেতে দিন বাবু। আমিও আপনার পায়ে পড়ছি।

    বাবুটি হাসলেন, আইন অমান্য করলে কারো রেহাই নেই। তুমি ত মালতী। যাবার পথে তুমি আমাকে কী বলে গালমন্দ করেছিলে ভুলে গেছ?

    হায়, সিংহের খেলা দেখানোর চোখ মালতী ভয়ে এতটুকু হয়ে গেল। বলল, বাবু আমরা অবলা জীব, আমাদের কথা ধরতে নেই।

    —অবলা জীবের মতন দেখলে মনে হচ্ছে না।

    মালতী কুসুমকে এবার ঠেলা দিল, এই তুই করছিস কী বৌ, হাঁটতে পারছিস না! নে, বলে চালের বোঁচকা কুসুমের কাঁধে দিয়ে বাবুটিরে বলল—কত বড় মাঠ দ্যাখছেন বাবু!

    —দেখছি।

    —আমার সঙ্গে আসেন। দেখবেন কত লোক সেখানে চাল চুরি করে নিয়ে যচ্ছে। একটা বোঁচকার জন্য একশটা বোঁচকা চলে যাচ্ছে।

    বাবুটি বললেন, কী করে জানলে?

    —আপনাদের হুজুর পুলিশের লোক তো সব রাস্তা চেনে না।

    —তা ঠিক বলেছ।

    মালতী কুসুমকে বলল, এই বৌ, তুই তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারস না!

    —হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি হাঁট বাছা।

    —কী করে হাঁটবে বলুন। আট মাসের পোয়াতি। মালতী হাঁটতে থাকল।

    —তা বটে! তুমি কোথায় চললে মালতী?

    —মাঠে চলেছি বাবু। মালতী পথ দেখিয়ে চলল।

    —আর কতদূর নিয়ে যাবে!

    মালতী বুঝল কুসুম ভাঙা পুল পার হতে পারেনি। আরও কিছু সময় বাবুটিকে ধরে রাখতে হবে। নতুবা কুসুমের চাল যাবে—কুসুম ঘরে ফিরে যেতে পারবে না। ওর বাচ্চাগুলি প্যাঁক প্যাঁক করবে।

    বাবুটি যেন ওর চাতুরি ধরে ফেললেন, এবং বললেন, চালাকি করার জায়গা পাস না। দুম করে পাছার ওপর লাথি মেরে দিল।

    মালতী রাগ করল না। সে ভাবল, আহা, ছাগলটা আমার চারটা বাচ্চা দেবে। সে বাবুর দিকে ঝুঁকে পড়ল। এবং বলল, হুজুর একবার দ্যাখেন আমাকে।

    বাবুটি এবার পিছন ফিরে মালতীকে দেখল। এত বড় প্রান্তর, ঠাণ্ডা বাতাস নেই প্রান্তরে। দূরে শালবনের ভিতর থেকে পোড়া বাড়ির আলোটা শুধু এক চক্ষু খোদাই ষাঁড়ের মতো মনে হচ্ছে। কোথাও এতটুকু প্রাণের উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড় বড় ফাটল—দীর্ঘদিন বৃষ্টি হয়নি—ধরণী ফেটে চিরে একাকার। জ্যোৎস্নারাতের জন্য ভয়। এই মাঠে বাবুটি মালতীর নগ্ন দেহ দেখে এতটুকু নড়তে পারলেন না। মালতী এই শস্যবিহীন মাঠে পাথরের মতো শুয়ে থেকে বলছে, হুজুরের ইসছা হয়?

    —হয়।

    সেই হবার মুখে মালতী জীবনের সব অত্যাচারের গ্লানি দূর করার জন্য শক্ত দাঁত দিয়ে বাবুটির কণ্ঠনালী কামড়ে ধরল। এবং এ-সময় দেখা গেল দূরে এক চক্ষু খোদাই ষাঁড়ের মতো আলোটা আর দেখা যাচ্ছে না। আলোটি নিভে গেল। শালের বন এবং শস্যবিহীন এই প্রান্তরে সিংহের খেলা দেখানো বাকি এমন এক চোখের বেদনা টপটপ করে এই প্রথম অসতী হবার জন্য চোখের জল ফেলছিল মালতী। আর মনে হল দূরে সেই নিঃসঙ্গ প্রান্তর থেকে কারা যেন খালি ট্রেনটিকে ঠেলে ঠেলে স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছে। এই ট্রেন ঠেলে স্টেশনে পৌঁছে দেবার জন্য মালতী দলের মধ্যে ভিড়ে গেল। ওর দাঁতে মুখে রক্তের স্বাদ লেগে ছিল। ট্রেন ঠেলে নেবার সময় সেই নোনা রক্তের স্বাদ চেটে চেটে চুষে নিচ্ছিল মালতী।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }