Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.৮

    ১.৮

    বাইরে ইতস্তত মুরগি চরে বেড়াচ্ছিল। ভুখা পেটে জালালি ঘরের দাওয়ায় বসে। সামসুদ্দিন এবং তার মজলিস, অথবা ভিতর বাড়িতে অলিজানের রান্না গোস্ত (মেহমানদের ভোগের জন্য) সবই বিসদৃশ। জালালি কচুর ঝোপ অতিক্রম করে মাঠে দৃষ্টি দিল। ধানখেতে কিছু হাঁস শব্দ করছে— প্যাঁক প্যাঁক। ওর পেট মোচড় দিয়ে উঠল। মকবুলের আতাবেড়াতে বাছ-পাট শুকোচ্ছে। তিন চারদিন ধরে বৃষ্টি হয়নি বলে মাটি শুকনো, ঘাস শুকনো। খামারবাড়িতে জামরুল গাছ। গাছে জামরুল ফল ঝুলছে। এবং রোদের জন্য ওদের পাখির মতো মনে হচ্ছিল। আর গ্রামময় রসুন পেঁয়াজের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। আর হাঁসগুলি তখনও গোপাটের ধানখেতে প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকছে। সুতরাং জালালি বসে থাকতে পারছে না। মালতীর হাঁসগুলি আবার এই মাঠে। মিঞা মাতব্বরেরা মজলিস শেষ করে গোসলে যাচ্ছে। জালালি অলিজানের পাছদুয়ারে বসেছিল—চোখমুখ শুকনো এবং কাতর কণ্ঠ। অলিজান যেন তার এই প্রাচুর্যকে জালালির চোখের উপর ভাসিয়ে দিল। মেমানগণ বর্ষার জলে পানিতে গোসল করতে গেল। ওরা ডুব দিল অথবা জলে সাঁতার কাটল, তারপর নামাজ শেষ করে শীতলপাটিতে খেতে বসে গেল গোল হয়ে। বেশ খাওয়া–মাছের ছালোন, মুরগীর গোস্ত, রসুন সম্বারে মুগের ডাল। ওরা খেয়ে সানকিতে কুলকুচা করল। ওরা একই বদনার নলে মুখ রেখে পানি খেল। ওরা কোনও উচ্ছিষ্ট খাবার রাখল না। জালালির বসে থেকে হাঁটু ধরে গেছিল। জালালি থুতু গিলে শেষ পর্যন্ত নিজের কুঁড়েঘরটাতে আশ্রয় নিয়ে সকলের প্রতি এবং আল্লার প্রতি ক্ষুব্ধ কথাবার্তা নিক্ষেপ করে শান্তি পাচ্ছিল। মালতীর হাঁসগুলি প্যাঁক প্যাঁক করছে গোপাটের ধানখেতে; সুতরাং সে গামছা পরে গোপাটের জলে শালুক তুলতে নেমে গেল।

    মেমান সকল চলে গেল। সামসুদ্দিন ঘাটে সকলকে বিদায় জানাল। ওদের নৌকা গোপাট ধরে চলতে থাকল। কিছু পাটখেত অতিক্রম করলে নৌকাগুলি আর দেখা গেল না—মাঝে মাঝে লগির ডগাটাকে উঠতে নামতে দেখা গেল। ওরা পুবের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। পুবের বাড়ির মালতী অথবা নরেন দাসের বিধবা বোন মালতীর কথা মনে হল সামসুদ্দিনের। হিজল গাছের ইস্তাহারটাকে কেন্দ্র করে যে বচসা এবং অপমানে উভয়ে ক্ষত-বিক্ষত ছিল—এ সময়ে সবই কেমন অর্থহীন লাগল। বার বার সেই এক ইস্তাহার ঝুলত। অর্থাৎ এই দেশ সামুর, এই দেশ সামুর জাতভাইদের। গাব গাছটার নিচে মালতীর সঙ্গে কতদিন দেখা—কিন্তু মালতী কথা বলত না। কৈশোরে বয়সের কিছু স্মৃতি মনে করে কেমন কষ্ট বোধে পীড়িত হল সামু।

    ফতিমা পাশ থেকে ডাকল, বা’জান।

    সামু কেমন আঁৎকে উঠল, কিছু কইলি?

    —বা’জান, মায় আপনেরে ডাকতাছে।

    সামু ফতিমার মুখ দেখে, জলের নীল রঙ দেখে, এই ঘাস এবং মাটি দেখে, ক্রমশ সে কেমন ইসলাম প্রীতির জন্য এক গভীর অরণ্যের ভিতর ডুবে যেতে থাকল। সেই অরণ্যে সে দেখল কোনও এক ফকিরসাব ধর্মের নিশান হাতে নিয়ে মুসকিলাসানের আলোতে পথ ধরে শুধু সামনের দিকে হাঁটছেন। আলোর বৃত্তে বৃদ্ধের মুখ—অস্পষ্ট এক ইচ্ছার তাড়নাতে তিনি ক্লান্ত। সামু বার বার ডেকেও সেই শীর্ণ ক্লান্ত ফকিরকে ফেরাতে পারছে না। তিনি হেঁটে যাচ্ছেন এবং তিনি সামুকে শুধু অনুসরণ করতে বলছেন।

    ফতিমা ঘুরে এসে সামনে দাঁড়াল। বলল, মায় আপনেরে ডাকতাছে।

    সে ভিতর বাড়িতে ঢুকে গেল। তার বিবির খালি গা, নাকে নথ। বিবির চোখ ছোট, সুর্মাটানা হাতে নীল কাচের চুড়ি। পরনে ডুরে শাড়ি। গায়ে সেমিজ নেই, কাপড়ের নিচে সায়া নেই। সাদাসিধে এক প্যাচে কাপড় পরনে,সুতরাং শরীরে সকল অবয়বই প্রায় স্পষ্ট। অলিজানের শরীরটা এখন গাভীন গরুর মতো। শুধু যেন শুয়ে থাকতে পারলে বাঁচে। অথচ চোখ সুর্মাটানা বলে ইচ্ছার চেয়ে চোখে আবেগ বেশি। সে বলল, বেলা বাড়ে না কমে? আপনে খাইবেন না?

    সামু তক্তপোশে খেতে বসল। ওর বিবি কাছে বসে খাওয়াল। সামুকে খুব চিন্তিত দেখে বিবি বলল, কি ভাবতাছেন?

    সামু উত্তর দিল না। নিঃশব্দে খেয়ে যেতে থাকল।

    —কি, কথা কন না ক্যান?

    সামু বিরক্ত হল। বলল, তর সব কথায় কাম কি! দুইডা ভাত দিবি তা দ্যা। কতা বাড়াইস না।

    অলিজান বলল, কি কথা বাড়াইলাম?

    সামু মুখ তুলে অলিজানের মুখ দেখল, চোখ দেখল। অলিজানের চোখে কি যেন একটা আছে—যা দেখলে সে সব রাগ দ্বেষ হিংসা ভুলে যায়। সে বলল, আমি ভোটে লীগের তরফে খারমু ঠিক করছি। ছোট ঠাকুরের বিরুদ্ধে খারমু।

    —আপনের মাথায় যে কি ঢুইকা পড়ে না! বুঝি না! ক্যান, কী দায় পড়ছে ওই কাইজ্যা ডাইকা আননের। ছোট ঠাকুর আপনের কী ক্ষতি করছে? তিনি ত খুব ভালো মানুষ।

    সামসুদ্দিন বলল, আমি কইছি তাইন খারাপ মানুষ! বলে সে উঠে পড়ল। হাত মুখ ধুলো এবং যখন দেখল বেলা পড়তে দেরি নাই—ধনু শেখ পাটের আঁটি ঘরে তুলছে তখন নাও নিয়ে এবং ধনু শেখকে নিয়ে জলের ওপর ভেসে গেল। সে সব ঝোপজঙ্গল ভেঙে পুকুরের জল কেটে মাঠে গিয়ে পড়ল। এখন মসজিদের চালে মোরগ হেঁটে বেড়াচ্ছে। গরুছাগল সব উঠোনের উপর। বাড়ির সকল পুরুষরাই খাটতে গেছে। শুধু মনজুর নিজের জমি চাষ করে। হাজি সাহেবের কিছু জমি আছে। নয়া পাড়ার ইসমতালী বড় গেরস্থ। অলিজানকে সাদি করে সামু ভাবল, ইসমতালী-সাব এবার তার কথা বলবে। কিন্তু বড় হিন্দু ঘেঁষা লোক। সঙ্গে সঙ্গে সামুর মুখটা কঠিন দেখাল। আর এ-পাশের শালুকের জমি অতিক্রম করে জঙ্গলের ভিতর হাঁসের শব্দ পেতেই সে চোখ তুলে তাকাল। মনে হল ঝোপের ভিতর কোনও মানুষের চিহ্ন যেন। সে বলল, ঝোপের ভিতর ক্যাডা?

    ঝোপের ভিতর থেকে কোনও মুখ উঁকি দিল না। আশেপাশে বেতঝোপ এবং শ্যাওড়া গাছ। কিছু সোনালী লতা শ্যাওড়া গাছটাকে ঢেকে রেখেছে। একদল হাঁস ভয়ে প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে পুবের বাড়ির দিকে ছুটছে। আর তখন সে দেখল পানির তলা থেকে কাদামাটি সব উপরে উঠে আসছে। যেন কোনও গো-সাপ একটা বড় সাপকে ধরে পানির নিচে সামলাতে পারছে না, যেন পানির নিচে ঝোপের পাশে একটা প্রাগৈতিহাসিক জীব হেঁটে বেড়াচ্ছে।

    সামু পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল। ধনু শেখ নৌকা থামিয়ে দিল। এবং নৌকাটাকে ঝোপের পাশে নিয়ে যেতেই দেখল জলের ওপর শাপলা-শালুকের পাতার ফাঁকে জালালি মুখ জাগিয়ে নিশ্বাস ফেলছে।

    সামু বলল, আপনে এহানে কি করতাছেন?

    জালালি গলাটা কিঞ্চিৎ তুলে বলল, শালুক তুলতাছি রে বাজী।

    —এহানে কি শালুক হইছে?

    —হইছে। ইট্টু ইট্টু হইছে। বলে সে ডান হাতে একটা শালুক তুলে দেখাল সামুকে। বলল, বড় হয় নাই, কষা। তারপর জালালি বিকালের রোদে মুখ রেখে বলল, তর চাচায় ফাওসার গয়না নৌকায় মাঝি হইয়া গ্যাল কবে! না খত, না পয়সা! খাই কি, ক! এয়ের লাইগ্যা, শালুক তুইল্যা চিবাইতাছি।

    জালালি গলা পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে রেখেছে এবং জালালির চোখ দুটোতে আতঙ্ক। জালালির শুকনো মুখ দেখে সামুর কষ্ট হতে থাকল। শাপলা-শালুকের জমি পার হলে ধানখেত। মালতীর হাঁসগুলি ধানখেতের ভিতর ভয়ে ভয়ে ডাকছে। সে আকাশে কোনও বাজপাখি উড়তে দেখল না—কোনও ঝোপজঙ্গলে শেয়ালের চোখ দেখল না—শুধু জালালির মুখটা লোভের জন্য পাপের জন্য ধীরে ধীরে বীভৎস হয়ে উঠছে, যেন মুখটা এখন যথার্থই শেয়ালের মতো।

    জালালি তার জায়গা থেকে এতটুকু নড়ল না। দু’হাতে হাঁসটার গলা জলের নিচে টিপে ধরেছে। এতক্ষণ ধরে সংগ্রামের পর সে ক্লান্ত! সামুর চাকরটা এখন লগি বাইছে। হাঁড়িটা বাতাসে ভেসে দূরে সরে যাচ্ছে। সামু গোপাটের অশ্বত্থ গাছটার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেলে গাল দিল জালালি, নিব্বৈংশা। এহানে কি করতাছেন? তর মাথা চিবাইতেছি। বলে সে একটা গিরগিটির মতো জলে সাঁতার কাটতে থাকল। হাঁসটা ওর ডান হাতে। এবং হাঁসটাকে সে জলের নিচে সব সময় লুকিয়ে রাখার জন্য এক হাতে সাঁতার কেটে হাঁড়িটাকে যখন আয়ত্তে আনল তখন সামু অনেক দূরে—তখন বিকেলের রোদ সরে যাচ্ছিল এবং তখন আকাশে নানা রঙের মেঘ জমে ঈশান কোণটাকে কালো, গম্ভীর করে তুলছে।

    এবার সে বাড়ির দিকে উঠে যাবার জন্য হাঁসটাকে আড়ালে হাঁড়িতে ঢুকিয়ে দিল। পুরুষ্টু হাঁসের পেটটা এখনও নরম এবং উষ্ণ। সে পেটে হাত রেখে উত্তাপ নেবার সময় দেখল, অনেকগুলি ধানখেত পার হলে পুবের বাড়ির গাবগাছ, গাছের নিচে মালতী। মালতী ওর হাঁসগুলিকে খুঁজছে। জলের ওপর শরীরটাকে তুলে সে উঁকি দিল। এবং দূরে মানুষের শব্দ পেল জালালি। সে পরনের গামছাটা খুলে ভয়ে হাঁড়ির মুখটা ঢেকে দিল। দূর থেকে মালতীর গলাও ভেসে আসছে। সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে চারদিকে। পাটখেতের ভিতর দিয়ে অন্য প্রান্তে কিছু দেখা যাচ্ছে না। জায়গাটা নির্জন। অশ্বত্থগাছ পার হলে মনজুরদের ঘর। ধনার মা বুড়ি ছাতিম গাছের নিচে বসে এখন প্রলাপ বকছে। সে ঘরের দিকে উঠে যাবার সময় যখন দেখল কোথাও কোনও মানুষের চোখ উঁকি দিয়ে নেই, যখন অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে তখন উষ্ণ পেটটাতে আর একবার হাত রাখল। সে গামছা তুলে ফের মৃত হাঁসটাকে উঁকি দিয়ে দেখল এবং চাপ চাপ অন্ধকারের ভিতর মৃত হাঁসটার পেটে হাত রেখে ফের বড় রকমের একটা ঢোক গিলে মাংস খাবার লোভে মরিয়া হয়ে উঠল।

    জলের ওপর দিয়ে মালতীর কণ্ঠ ভেসে আসছে—আয়, তৈ তৈ।

    দূরে ধানখেতের ভিতর হাঁসগুলি তেমনি প্যাঁক প্যাঁক করছে। ঘন ধান-গাছের ভিতর হাঁসগুলি লুকিয়ে আছে। মালতী জলে নেমে গেল। হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে ডাকল, আয়, তৈ তৈ। আয়….. আয়। চারদিকে অন্ধকার। হাটুরেরা ঘরে ফিরছে। খালের ধারে লগির শব্দ। নৌকার শব্দ। সে অন্ধকারে কোনও পরিচিত হাটুরের মুখ দেখতে পেল না। অমূল্য সূতা আনতে গেছে হাটে। শোভা, আবু ঘরে ঘরে আলো জ্বালছে এবং জল দিচ্ছে দরজাতে। নরেন দাসের বৌ বৃষ্টি আসবে ভেবে সব শুকনো পাটকাটি ঘরে নিয়ে রাখছে। আর ঝড়বৃষ্টি এলে হাঁসগুলি পথ ভুল করে দূরে চলে যেতে পারে অথবা কত রকমের দুর্ঘটনা…মালতী প্রাণপণে ডাকতে থাকল, আয়, তৈ তৈ।

    শোভা, আবু গাবগাছের নিচে পিসির গলা শুনতে পেল। সেই কখন থেকে পিসি হাঁসগুলিকে ডাকছে। ওরা কাফিলা গাছ অতিক্রম করে পিসির জন্য জলে নেমে গেল এবং পিসির সঙ্গে গলা মিলিয়ে ডাকতে থাকল। আর দূরে সামুর নৌকা ভেসে যাচ্ছে। বৃষ্টি আসবে জেনেও সামু ঘরে ফিরছে না। জালালি বৃষ্টির রঙ আকাশে দেখতে পেল। জলের পাশে কাঁটা গাছের সব ঝোপ। ঝোপ পার হলে, মান্দার গাছের নিচে ওর পাটকাঠির বেড়া দেওয়া ঘর। ভিজে মাটির গন্ধ আসছে। জোটন ফকিরসাবের সঙ্গে দরগায় চলে গেছে। বাড়িটা একেবারে ফাঁকা। হাজিসাহেবের খামারবাড়ি পার হলে তবে অন্য ঘর। অন্ধকার এবং নির্জনতা সত্ত্বেও মৃত হাঁসটাকে সে গামছা দিয়ে সন্তর্পণে ঢেকে রেখেছে। বৃষ্টি নামবে। বর্ষাকাল বলে ঘরের আশেপাশে এবং সর্বত্র আগাছার জঙ্গল। এক সবুজ সবুজ গন্ধ। সুতরাং জালালি সব দেখে-শুনে নগ্ন শরীরটাকে ঘরের দিকে গোপনে তুলে নিয়ে গেল। গামছা দিয়ে যেহেতু সে হাঁড়ির মুখ ঢেকে রেখেছিল, সেহেতু নগ্ন! অন্ধকার বলে, বৃষ্টি আসবে বলে গাবগাছের নিচে মালতীর গলা শোনা যাচ্ছে না—আশেপাশে শুধু কীট-পতঙ্গের আওয়াজ।

    মালতী দেখল ওর হাঁসি তিনটে ফিরে আসছে। হাঁসাটা নেই। মালতীর বুকটা কেঁপে উঠল। কত কষ্টের এই হাঁসা। প্রতিপালন করা কত বেদনা-সাপেক্ষ। ওর প্রিয় হাঁসাটাকে না দেখে মালতী চিৎকার করে উঠল, বৌদি গো, আমার হাঁসাটা কই। হাঁসি তিনটা আইতাছে, আমার হাঁসাটা ক‍ই গ্যাল!

    নরেন দাসের বৌ পাঁজা করে সব শুকনো পাটকাঠি তুলছিল। পাটকাঠিগুলিতে মড়মড় শব্দ হচ্ছে—সুতরাং সে মালতীর চিৎকার শুনতে পাচ্ছে অথচ স্পষ্ট বুঝতে পারছে না মালতী কী বলছে। সে পাটকাঠি ফেলে গাবগাছতলায় ছুটে গেল এবং জলের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, কী হইছে তর?

    —দ্যাখেন, কি হইছে! হাঁসি তিনটি আছে, হাঁসাটা নাই। কেমন কান্না-কান্না গলায় মালতী বলল।

    —দ্যাখ, কোনখানে পলাইয়া রইছে।

    —আপনের যে কথা বৌদি! অর পরাণে বুঝি ডর নাই?

    —ডর আছে ল, ডর আছে। অমূল্য আসুক। নৌকা লইয়া খুঁজতে বাইর হইবনে। তুই জল থাইক্যা উইঠা আয়।

    সুতরাং মালতী জল থেকে উঠে এল। ওর মনটা বিষণ্ণতায় ভরে আছে। কান্না কান্না এক আবেগ বুকের ভিতর জমা হচ্ছে ক্রমশ। ওর এই হাঁসা বড় প্রিয়, বড় কষ্টে সে লালন করেছে এবং বিধবা যুবতীর একমাত্র অবলম্বন। ঝড় জলে সেই ছোট ছোট চারটা পাখি যে দিন নরেন দাস ডুলাতে করে ঘরে নিয়ে এসেছিল, সেইদিন থেকে কত যত্নের সঙ্গে এদের সে ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল। ছোট ছিল বলে ওরা কচি ঘাস খেতে পারত না, ওরা ভাত খেতে পারত না সুতরাং সে ছোট ডারকিনা মাছ ধরত পুকুর থেকে, ছোট ছোট জিড় তুলে যত্নের সঙ্গে খাইয়ে পুকুর-ঘাটে ছেড়ে ওদের বড় হতে সাহায্য করত। মালতী জল থেকে উঠে আসার সময় প্রাণপণ ডাকল, আয়, আয়, তৈ তৈ।

    অন্ধকার বলে, বৃষ্টি আসবে বলে ওরা আর গাবগাছের নিচে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না।

    .

    জালালি ঘরের ভিতর কুপি জ্বালল। ঘরে তার ছেঁড়া হোগলা এবং শিকাতে ঝোলানো নাঙলবন্দের বান্নি থেকে আনা হাঁড়ি পাতিল। একটা ভাঙা উনুন। কুপিটা জ্বলতে থাকল। সে ভিজা গামছাটা বিছিয়ে তার উপর মৃত হাঁসটাকে রেখেছে। ওর দরজার ঝাঁপ বন্ধ ছিল। কুপির আলোতে ওর তলপেট চকচক করছে। মুখে পেটুকের গন্ধ। সে হাঁসটার তলপেটে চাপ দিতেই বুঝল উষ্ণতা মরে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে হাঁসটার শরীরের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে ওর শরীরের সব পালক দ্রুত তুলতে থাকল। ওর শরীর থেকে এখনও ইতস্তত জল ঝরছে। এই জলের জন্য নিচের মাটি ভিজে উঠছে—কাদা-কাদা ভাব। সে যত্নের সঙ্গে হাঁসটাকে, গামছাটাকে শুকনো মাটিতে টেনে আনল, যত্নের সঙ্গে হাঁটু গেড়ে মাংস ভক্ষণের নিমিত্ত প্রাণপণে মৃত হাঁসটাকে আগুন জ্বেলে সেঁকতে থাকল। বাইরে বৃষ্টি।

    কতদিন থেকে যেন পেটে ভাত নেই, কতদিন থেকে যেন জাম-জামরুল খেয়ে, কখনও শালুক খেয়ে জালালি ক্ষুধা মিটিয়েছে। পেট ভরে খাবার জন্য সারাদিন থেকে খোয়াব দেখছিল। বিকেলের এই হাঁসটা সে-খোয়াবকে সার্থক করছে। সুতরাং সে তার আল্লার কাছে এ মেহেরবানিটুকুর জন্য খুশি। খুশির জন্যই হোক অথবা ক্ষুধার তাড়নাতেই হোক এবং লোভের জন্যও হতে পারে সে কাপড় পরতে ভুলে গেছিল। ওর তলপেটের ফাটা সাদা সাদা দাগগুলোতে এখনও কিছু জলের রেখা চিকচিক করছে, অনেকটা মানচিত্রের নদী-নালার মতো। কি ভেবে জালালি তলপেটে হাত রাখল এবং ভাবল এই তলপেটে ফের চর্বি হবে, ফের আবেদালি গয়না নৌকার কাজ সেরে ঘরে ফিরবে।

    জালালি হাঁসটার পেটের ভিতর থেকে নখ দিয়ে টেনে টেনে ময়লাগুলো বের করবার সময়ই ভাবল আবেদালির বড় দুঃখ। সে বলত, জব্বইরা হওয়নের পর তর প্যাট যে নাইমা গ্যাল আর উঠল না, আর তর পেটে চর্বি ধরল না।

    জালালি মনে মনে বলল এ-সময়, তুমি আমারে হপ্তায় হপ্তায় হাঁসের গোস্ত খাইতে দ্যাও দ্যাখ ক’দিনে প্যাটে চর্বি লাগাইয়া দ্যাই। ওর এ-সময় মালতীর কথাও মনে হল। মালতী বিধবা যুবতী। দিন দিন মালতীর রূপ খুইল্যা পড়তাছে। আল্লা, আমারে অর রূপটা দিলি না ক্যান। বাইরে বৃষ্টি ঘন হয়ে নামছে তখন।

    এবার হাঁসের শরীর থেকে চামড়াটা তুলে ফেলল জালালি। বাঁশের চোঙাতে সরষের তেল নেই। একটু তেল আনতে সে কোথাও যেতে পারছে না বৃষ্টির জন্য! সুতরাং সে অনেকক্ষণ ধরে শরীরটাকে সেঁকছিল আর তার জন্য সেদ্ধ-পোড়া এক ধরনের গন্ধ উঠছিল। সে এই সেদ্ধ-পোড়া মাংস একটু নুন লঙ্কাতে ভেজে দুটো সানকিতে রাখল। এক টুকরো মুখে দিল, তারপর ফুৎ করে হাড়টা মুখ থেকে বের করে চেখে চেখে মাংসটা খাবার সময় দেখল, হাঁসের পালকগুলো কখন সব বাতাসে ঘরময় হয়ে গেছে। গাছার ওপর কুপিটা দপদপ করে জ্বলছে। আলোটার দিকে চেয়ে, ঘরময় পালকগুলো দেখে এবং চুরি করে হাঁস ভক্ষণের নিমিত্ত মনে মনে অসহায় হয়ে পড়ল জালালি। আবেদালি জানতে পারলে মারধোর করবে। সেজন্য জালালি আর মাংসের হাড় না চিবিয়ে খুঁটে খুঁটে সব পালকগুলো তুলে বৃষ্টির ভিতর জলে নেমে গেল। জল ভেঙে অন্ধকারের ভিতর গোপাটের দিকে চলতে থাকল। তারপর অশ্বত্থের নিচে যে ঝোপ-জঙ্গল ছিল, সেখানে সব পালকগুলি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, আল্লা আমার ক্ষুধা পাইছে। আমি যাই। এখন বৃষ্টির জলে জালালির সব দুঃখ ধুয়ে যাচ্ছে। সুখের জন্য জালালি ঘরের দিকে ফিরছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সে বিদ্যুতের আলোয় দেখল, পাটখেত নুয়ে পড়েছে। সেই সব পাটখেত পার হলে জলের ওপর একটি আলোর বিন্দু ঘুরতে দেখল। এবং সন্তর্পণে কান পাতলে শুনতে পেল যেন তখনও মালতী ওর হাঁসাটাকে ডাকছে—আয়, আয়, তৈ তৈ। সে আর এতটুকু দেরি করল না। সে ঘরের ভিতর ঢুকে ঝাঁপ বন্ধ করে দিল। শরীর মুখ মুছল। এবার একটু সময় নিয়ে গামছাটা ভালো করে প্যাঁচ দিয়ে পরল। একটা কাঠের টুকরোর উপর বসে হাঁসের হাড় এবং গোস্ত চুষতে থাকল জালালি। মনে হল, মালতী যেভাবে ডাকছে—এখনই হয়তো হাঁসটা সানকির ওপর ডেকে উঠবে। সে গব গব করে এবার মাংস ছিঁড়ে খেতে থাকল। অথবা গিলতে থাকল। সে কিছুতেই হাঁসটাকে সানকির ওপর আর প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকে উঠতে দিল না।

    .

    বৃষ্টি থামলে সামসুদ্দিন ঘরের দিকে ফিরল। ধনু শেখ নৌকা বাইছিল। দূরে ধানখেতের ভিতর অন্য একটি আলো দেখে মালতীর কণ্ঠ শুনে বুঝল, মালতী এখনও হাঁসগুলি পায়নি। মালতী এবং অমূল্য প্রাণপণ ডাকছে—আয়, আয়, তৈ তৈ এবং এই শব্দ গ্রাম মাঠ পার হয়ে বহু দূরে চলে যাচ্ছে—বড় দুঃখের এই ডাক, বড় কষ্টের। মালতীকে অনেকদিন পর সামু এই মাঠে দেখল—কী যেন অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে। অমূল্য নৌকা বাইছিল; ধানখেতের ভিতর, পাটখেতের ভিতর অথবা অন্য কোনও ঝোপ-জঙ্গলে হাঁসটা ভয়ে লুকিয়ে আছে কি না দেখছে মালতী। এ-সময় মালতী দেখল, অন্য একটা নৌকা, পাটাতনে সামসুদ্দিন। সামসুদ্দিন যেন কিছু বলতে চাইছে। হারিকেনের আলোতে সামসুদ্দিনের মুখ স্পষ্ট। মালতী এক বিজাতীয় ঘৃণাবোধে সামুর সঙ্গে প্রথমে কথা বলতে পারল না। সামু যেন হালে তামাসা দেখছে। মালতীর কান্না পাচ্ছিল হাঁসটার জন্য। সে মাথা নিচু করে বসে থাকল। সামসুদ্দিনকে দেখে কোনও কথা বলল না। সামু আজ অপমানিত বোধ করল না কারণ মালতীর এই বসে থাকাটুকু সহায়-সম্বলহীন নারীর মতো। সুতরাং সে বলল, তর হাঁসগুলি বাড়ি যায় নাই?

    —হাঁসগুলি গ্যাছে। হাঁসাটা যায় নাই।

    মালতী সংক্ষিপ্ত জবাব দিচ্ছিল। মালতী মাথা নিচু করে বসেছিল, চারদিকে ভিজা বাতাসের গন্ধ চারদিকে আঁধার আরও ঘন। বৃষ্টি আরও ঘন হয়ে নামছে। সামু এবং অমূল্য দুজন মিলেই এবার ডাকতে থাকল, আয়, তৈ তৈ। কোথাও কোনও হাঁসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না শুধু অশ্বত্থ গাছটায় জোনাকি জ্বলছে। নিচে হাঁসের পালক উড়ছে। পালকগুলো জলে নৌকার মতো ভেসে যাচ্ছে।

    সামু, অমূল্য এবং মালতী গলা মিলিয়ে ডাকল। ওরা লণ্ঠন তুলে ধান-গাছের ফাঁকে অন্বেষণের সময় দেখল জলে ইতস্তত হাঁসের পালক ভেসে যাচ্ছে। গোপাটের অশ্বত্থ গাছটার নিচে এসে যথার্থই মালতী ভেঙে পড়ল। পালকের ধূসর রঙ, অশ্বত্থের ঘন জঙ্গল সব মিলে সে হাঁসটার মৃত্যু সম্বন্ধে সচেতন হতেই ডুকরে কেঁদে উঠল।

    এই কান্নার জন্যই হোক অথবা পালকের অবস্থানের জন্যই হোক, সামসুদ্দিন বিকেলের কিছু কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে দেখল, জঙ্গলের ফাঁকে যেন জালালির মুখ। সুতরাং অযথা সে আর হাঁসটাকে খুজল না। সে জানত এই হাঁসগুলিকে মালতী সন্তানবৎ স্নেহে লালন করে আসছে। মালতী বিধবা—সুতরাং বিধবা যুবতীর একমাত্র সম্বল!… সামু রাগে দুঃখে প্রথমে কথা বলতে পারল না। জালালির মুখটা ওর চোখের ওপর কেবল ধূর্ত শেয়ালের মতো ভেসে উঠছে, এবং মালতীর বেদনাবোধ সামুকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলল।

    সামু বলল, বাড়ি যা মালতী।
    অমূল্য বলল, চলেন দিদি।
    সামু বলল, কান্দিস না মালতী।

    মালতী এবার চোখ তুলল এবং সামুকে দেখে ভাবল সেই সামু—যার চোখ ছোট এবং গোল গোল ছিল—সেই সামু যে শান্ত ছিল, এবং মালতীর দুঃখে কৈশোর বয়সে কাতর হতো। সামু যেন আজ যথার্থই দাড়ি-গোঁফহীন পুরুষ—সামু যেন এক হিন্দু যুবকের মতো আজ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং মালতীর দীর্ঘদিনের ঘৃণাবোধ সরে গেল। সে অনেকক্ষণ নির্বোধ বালিকার মতো সামুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছু বলল না।

    নৌকা দুটো পাশাপাশি ছিল।

    হারিকেনের আলোতে ওদের মুখ স্পষ্ট ছিল। গ্রামের ভিতর থেকে কুকুরের ডাক জলের ওপর দিয়ে ভেসে আসছে। বিশ্বাসপাড়াতে হ্যাজাকের আলো এবং আকাশে অস্পষ্ট মেঘের ছায়া। কিছু নক্ষত্ৰ যেন মালতীর শোকতাপকে আরও গভীর করছে। এই শোকতাপ সামুর ভিতরেও সংক্রামিত হল। সামসুদ্দিন বালক বয়সে এই গ্রাম মাঠ পার হয়ে বাপের হাত ধরে ধরে কোথাও চলে যাচ্ছে…যেন চারিদিকে ঢাকঢোল বাজছে—চারিদিকে পাইক-বরকন্দাজ…ওর বাপ দুগ্‌গা ঠাকুরের সামনে লাঠিখেলা দেখাচ্ছে—সামুর মনে হল, সেই সব কীর্তিমান পুরুষেরা আজ অথর্ব এবং এক নতুন ভাবধারা, নতুন ধর্মবোধ মানুষকে সংকীর্ণ করে তুলছে। সে জালালির ওপর যথার্থই ক্ষেপে গেল। সে মনে মনে বলল, শালীর প্যাটে পাড়া দিয়া গোস্ত বাইর করমু।

    সামুর নৌকা ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকল। ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকল। পিছনে অমূল্য, মালতী এবং হারিকেনটা পড়ে থাকছে। হারিকেনের আলো কিছুদূর পর্যন্ত অন্ধকারটাকে ঠেলে রেখেছিল, সামু যত দূরে সরে যেতে থাকল তত মালতীর মুখ অস্পষ্ট হতে থাকল।…মালতী যেন এক রহস্যময়ী নারী। বৃষ্টির জল ধানগাছ থেকে টুপটাপ জলে এবং নৌকার পাটাতনে ঝরছে, ঠিক মালতীর চোখের জলের মতো। সামু দূর থেকে চিৎকার করে বলল, তুই বাড়ী যা মালতী। অমূল্যকে বলল, অমূল্য, নৌকা ঘাটে লইয়া যাও। রাইতের ব্যালা এই মাঠময়দানে ঘুইর না। নির্জনে মালতীর এই বসে-থাকাটুকু সামুকে অসহায় করে তুলেছিল, কারণ, কলজের ভিতর কৈশোরের কাঁটাটা বড় বেশি আজ খচখচ করছে।

    .

    ধনু শেখকে নৌকাটা আবেদালির ঘাটে সন্তর্পণে ভিড়িয়ে দিতে বলল সামু। বলল, লগির য্যান শব্দ না হয়।

    সামু সন্তর্পণে পা টিপে টিপে ওপরে উঠতে থাকল। ওকে হাঁটু পর্যন্ত কাদা ভাঙতে হল। এখন ঝোপ-জঙ্গল থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে নামছে। এখনও গাছ থেকে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা বাতাসে ঝরে পড়েছে। ঘরের ভিতর স্তিমিত আলো। ভিতরে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আবেদালি নেই, জব্বর গেছে বাবুর হাটে এবং জোটনও অনুপস্থিত। বড় ভুতুড়ে মনে হচ্ছিল। সে ঝোপের বেতপাত সরিয়ে বেড়ার ফঁকে চোখ ঠেলে দিল। দেখল, ছোট এক লম্ফ জ্বলছে। জালালি প্রায় নগ্ন হয়ে বসে আছে পিঁড়িতে। সে সানকির সব হাড় চুষছিল। হাড়ে কোনও গোস্ত লেগে নেই। সে দাঁতের ফাঁকে হাড়গুলোকে মড়মড় করে ভেঙে খাচ্ছিল। তারপর পানি খাচ্ছে। সামু দেখল, পানির ওপর যে ধূর্ত শেয়ালের মুখটা ভেসে ছিল জালালির – সারাদিন পর গোস্ত ভক্ষণে—সে মুখ সহজ এবং সুন্দর। সে মুখে আল্লার দোয়া। পানি খেতে খেতে দুবার সে তার আল্লার নাম স্মরণ করল। সামু গরিব এই মানুষগুলির জন্য ফের অরণ্যের ভিতর হেঁটে যেতে চাইছে, সুতরাং মালতীর হাঁস চুরির কথা অথবা জালালির পেট পাড়া দিয়ে গোস্ত বের করার কথা সব কেমন যেন মন থেকে নিঃশেষে মুছে গেল। কারণ জালালি একটা ছেঁড়া হোগলা পেতে এখন নামাজ পড়ছে। রসুলের মতো মুখ—সামনে দুহাত প্রসারিত জালালির। সামসুদ্দিন কিছুই বলতে পারল না। দীর্ঘ এই সংসারযাত্রার আসরে সে যেন কালনেমিনির মতো এক অলীক লঙ্কাভাগে মত্ত। ওর পা সরছিল না। মাটির সঙ্গে পা গেঁথে যাচ্ছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }