Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1046 Mins Read0

    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.৯

    ১.৯

    শীতকাল এলেই মানুষটা কিছুদিন যেন ভালো থাকে। ঠাণ্ডার জন্য মণীন্দ্রনাথ গায়ে র‍্যাপার জড়িয়েছেন। আগের মতো খালি গায়ে থাকছেন না। এমন করে ভালো হতে হতে একদিন হয়তো যথার্থই ভাল হয়ে যাবেন। তখন কোথাও দু’জনে চলে যাবে এক সঙ্গে—কোনও তীর্থে অথবা বড় শহরে। অথবা সেই যে বলে না, এক মাঠ আছে, মাঠের পাশে বড় দিঘি আছে, দিঘিতে বড় বড় পদ্মফুল ফুটে থাকে, বড়বৌ গ্রীক পুরাণের এই নায়ককে নিয়ে একদিন যথার্থই সেখানে চলে যাবে। মানুষটা ভালো হলেই জলদানের নিমিত্ত কোনও জলছত্রের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। তখন হয়তো কোথাও দূরে গীর্জায় ঘণ্টা বাজবে, পুরোহিতেরা মন্ত্র উচ্চারণ করবে—পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ কোনও হ্যামলক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সোনার হরিণের স্বপ্ন দেখবেন।

    বড়বৌ মানুষটাকে আজ স্বাভাবিক দেখে এক বাটি গরম দুধ নিয়ে এল। সঙ্গে নতুন গুড়, মর্তমান কলা। কিছু গরম মুড়ি। বড় আসন পেতে সে মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।

    সেই আশ্বিনের কুকুরটা মণীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছিল। সোনা দক্ষিণের বারান্দায় পড়ছে। কুকুরটা মাঝে মাঝে ঘেউঘেউ করছিল। লাল জবা গাছটার নিচে দুটো শীতের ব্যাঙ্ ক্লপ ক্লিপ করছে। মণীন্দ্রনাথ গরম দুধ, মর্তমান কলা, নতুন গুড় মেখে খেলেন। কিছু তার প্রিয় কুকুরকে দিলেন। তারপর উঠে আসার সময় মনে হল সোনা চুপি চুপি পড়া ফেলে এদিকে আসছে। বড়কর্তা খুব খুশি—তিনি, কুকুর এবং সোনাকে নিয়ে শীতের ভোরে মাঠে নেমে গেলেন।

    ওরা সোনালী বালির নদীতে এসে নামল! এখন জলে তেমন স্রোত নেই। জল কমে গেছে। যেন ইচ্ছা করলে হেঁটে পার হওয়া যায়। পাড়ের পরিচিত মানুষেরা সোনা এবং মণীন্দ্রনাথকে আদাব দিল। আশেপাশে সব মুসলমান গ্রাম। ওদের দেখেই নৌকা নিয়ে মাঝি এ পাড়ে চলে এল। নৌকায় কুকুরটা সকলের আগে লাফিয়ে উঠেছে। সোনার অনেকদিনের ইচ্ছা—কোন ভোরে, পাগল জ্যাঠামশাইর সঙ্গে গ্রাম মাঠ দেখতে বের হবে। প্রতিদিন ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে দুপুরে অথবা সন্ধ্যায় জ্যাঠামশাই ক্লান্ত সৈনিকের মতো বাড়ির উঠোনে উঠে আসেন, পায়ে তাঁর বিচিত্র নদী-নালার চিহ্ন থাকে, গরমে তরমুজ এবং শীতের শেষে আখের আঁটি সঙ্গে আনেন। সোনার কাছে মানুষটা বনবাসী রাজপুত্রের মতো। কতরকমের গল্প শোনার ইচ্ছা এই মানুষের কাছে—পাগল বলে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শোনাতেন। নির্জন নিঃসঙ্গ মাঠ পেলেই বলতে থাকেন। পাগল বলে গল্পের আরম্ভও নেই শেষও নেই।

    জ্যাঠামশাই বলতেন, পদ্মপুকুর যাবি?

    জ্যাঠামশাই বলতেন, ইলিশমাছের ঘর দেখবি?

    তারপর কোনও উত্তর না পেলে বলতেন, রূপচাঁদ পক্ষী দেখবি?

    সোনা কোনও উত্তর করত না। উত্তর দিলেই বলবেন, গ্যাৎচোরেৎশালা। তবু একবার সে খুব সাহস সঞ্চয় করে বলেছিল, আমি পঙ্খীরাজ ঘোড়া দ্যাখমু। দ্যাখাইবেন?

    মণীন্দ্রনাথের যেন বলার ইচ্ছা, তোমার পদ্মপুকুর দেখতে ইচ্ছা হয় না! ইলিশমাছের ঘর দেখতে ইচ্ছা হয় না। রূপচাঁদ পক্ষী দ্যাখো না! দ্যাখো কেবল, পঙ্খীরাজ ঘোড়া। পঙ্খীরাজ ঘোড়া একটা আমারও লাগে। পাই কোথা! বলে সোনার দিকে অবাক চোখে তাকিয়েছিলেন।

    আজ আর সোনার কিছুতেই পঙ্খীরাজ ঘোড়ার কথা মনে হল না। সে আজ পড়া ফেলে চলে এসেছে। মা, ছোট কাকা খুঁজছেন। সোনা কই গ্যাল, দ্যাখেন, পোলাটা কই গ্যাল—সকলে খুঁজবে। সোনার ভারি মজা লাগল। মা ওকে ফতিমাকে ছুঁয়ে দেবার জন্য মেরেছে। ঠাকুমা বলেছে ওর জাতধর্ম গেল। ওকে সকলে অযথা হেনস্থা করেছে। কতদিন লালটু পলটু ওকে, একটু কিছু করলেই কান ধরে ওঠ বোস করিয়েছে—আজ ওরা সকলে ভাবুক। সে, জ্যাঠামশাইর সঙ্গে বাড়ি থেকে চুপি চুপি বের হয়ে পড়ল। পাগল বলে তিনি শুধু হেসেছিলেন। পাগল বলে তিনি তাকে এই যাত্রার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। যেন বলেছিলেন, কোথাও পঙ্খীরাজ ঘোড়া আকাশে উড়ে বেড়ায়, কোথাও না কোথাও শঙ্খের ভিতর শঙ্খকুমার পালিয়ে থাকে আর কোথাও না কোথাও ঝিনুকের ভিতর চম্পকনগরের রাজকন্যা ‘সাপের’ বিষে ঢলে আছে। তুমি আমি সেখানে চলে যাব সোনা। সবার জন্য বড় মাঠ, সোনালী ধানের ছড়া, নিয়ে আসব।

    আহা, ওরা কত গ্রাম মাঠ ফেলে চলে যাচ্ছে। যত ওরা এগুচ্ছিল তত আকাশটা ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। সোনা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে পড়েছে। এতটা হেঁটেও সে আকাশ ছুঁতে পারছে না কিছুতে। ওর কতদিনের ইচ্ছা, জ্যাঠামশাইর সঙ্গে বের হয়ে সে, যে আকাশটা নদীর ওপারে নেমে গেছে—সেটা ছুঁয়ে আসবে। কিন্তু কি করে জাদুবলে আকাশটা কেবল সরে যাচ্ছে।

    কিছু পরিচিত লোক এই নাবালক শিশুকে পাগল মানুষের সঙ্গে দেখে বিস্ময়ে বলে উঠল, সোনাবাধু, আপনে। জ্যাঠামশাইর লগে কোনখানে যাইতেছেন। হাঁটতে কষ্ট হয় না!

    সোনা খুব বড় মানুষের মতো ঘাড় নাড়িয়ে বলল, না।

    কিন্তু মণীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছেন সোনা আর যথার্থই হাঁটতে পারছে না। তিনি ওকে কাঁধে তুলে নিলেন। এখন সূর্যের উত্তাপ প্রখর। ঘাসের মাথায় আর শিশির পড়ে নেই। সূর্য মাথার ওপর উঠে গেছে। এ-সময় ওরা, কোথাও যেন ঘণ্টা বাজছে এমন শুনতে পেল।

    সোনার মনে হল বুঝি সেই পঙ্খীরাজ ঘোড়া। সে হাততালি দিতে দিতে বলল, জ্যাঠামশয় পঙ্খীরাজ ঘোড়া।

    আশ্বিনের কুকুরটা সহসা চলতে চলতে থেমে পড়ল। সে কান খাড়া করে শব্দটা শুনল এগিয়ে আসছে।

    মণীন্দ্রনাথের এখন বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ছে। সেই ঘণ্টাধ্বনি শুনেই বুঝি বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। ডানদিকে এক দীর্ঘ বন। বনের ভিতর দিয়ে হাঁটলে ফের সেই সোনালী বালির নদী পাওয়া যাবে, নদীর পাড়ে তরমুজ খেত। এখন হয়তো তরমুজের লতা এক দুই করে বিছিয়ে যাচ্ছে ঈশম। আর তখন বনের ভিতর কত রকমের গাছ। সেই ঘণ্টার শব্দ ক্রমে নিকটবর্তী হচ্ছে। বনের ভিতর কত রকমের গাছ—সব চেনা নয়। তবু গন্ধ গোলাপজামের, লটকন ফলের। সব ফল এখন প্রায় নিঃশেষ সোনা গাছে গাছে কি ফল আছে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল তারপর ফাঁকা মাঠে নামতেই দেখল, এক আজব জীব। অতিকায় জীব। ওর গলায় ঘণ্টা বাজছে। সোনা চিৎকার করে উঠল, ঐ দ্যাখেন জ্যাঠামশয়।

    কুকুরটা ছুটতে চাইল এবং ঘেউঘেউ করে উঠল। জ্যাঠামশাই কুকুরটাকে ধরে রাখলেন। সোনাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে পাশাপাশি যেন তাঁরা তিন মহাপ্রাণ সেই আজব জীবের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। কাছে এলেই ছুটতে থাকবেন তাঁরা, অন্য পথে চলে গেলে কোনও ভয় থাকবে না।

    সোনা বিস্ময়ে কথা বলতে পারছে না। আসলে এত বড় মাঠ এবং এক বিরাট জীব—এ-হাতির গল্প সে মেজ-জ্যাঠামশাইর কাছে শুনেছে। জমিদার বাড়ির হাতি। হাতিটা দুলে দুলে ওদের দিকে নেমে আসছে। কাছে এলে, ওর মতো বয়সের এক বালক হাতির মাথায় বসে অঙ্কুস চালাচ্ছে দেখতে পেল। যে ভয়টুকু ছিল প্রাণে তা একেবারে উবে গেল। সে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, জ্যাঠামশয়।

    জ্যাঠামশাই কতদিন পর যেন কথা বললেন, ওটা হাতি।

    সোনা বলল, হাতি!

    জ্যাঠামশাই বললেন, ওটা মুড়াপাড়ার হাতি।

    কিন্তু এ-কি! হাতিটা যে ওদের দিকেই ধেয়ে আসছে। বড় বড় পা ফেলে উঠে আসছে। এত বড় একটা জীব দেখে আর এমনভাব এগিয়ে আসছে দেখে সোনা ভয়ে গুটিয়ে গেল। একেবারে ওদের সামনে এসে পড়েছে। জ্যাঠামশাই নড়ছেন না। কুকুরটা ছুটোছুটি করছে। সোনা ভাবছিল পালাবে কিনা, ছুটবে কিনা অথচ এত বড় বিস্তৃত মাঠ পিছনে–সামনে ঝোপ–সে কোন দিকে ছুটে যাবে স্থির করতে পারল না। ভয়ে সে শুধু জ্যাঠামশাইকে জড়িয়ে ধরল। বলল, আমি বাড়ি যামু।

    জ্যাঠামশাই কোনও উত্তর করলেন না। তিনি এখন শুধু অপলক দৃষ্টিতে হাতিটাকে দেখছেন। যত নিকটবর্তী হচ্ছে তত তিনি কেমন মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছেন।

    ক্ষোভে এবং আতঙ্কে এবার সোনা, জ্যাঠামশাইর হাত কামড়ে দিতে চাইল। জ্যাঠামশাই ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। সে বলল, আমি মার কাছে যামু। বলে কাঁদতে থাকল।

    কিন্তু আশ্চর্য, হাতিটা ওদের সামনে এসে চার পা মুড়ে বশংবদের মতো বসে পড়ল। মাহুত, জ্যাঠামশাইকে সেলাম দিল। তারপর হাতিটাকে বলল সেলাম দিতে। হাতিটা শুঁড় তুলে সেলাম দিল।

    জসীমের ছেলে ওসমান সামনে বসে। জসীম পিছনে। সে বলল, আসেন কর্তা হাতির পিঠে চড়েন। আপনেগ বাড়ি দিয়া আসি।

    ওরা এতদূর এসে গেছেন যে জসীম পর্যন্ত বুঝতে পারছিল বেলাবেলিতে পাগল মানুষ এই নাবালককে নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবেন না। সে তাদের হাতির পিঠে তুলে নিল। সোনা হাতির পিঠে বসে মেজ-জ্যাঠামশাইর কথা মনে করতে পারছে। তিনি মুড়াপাড়া থেকে বাড়িতে এলেই এই হাতির বিচিত্র গল্প করতেন—হাতিতে চড়ে একবার ওঁরা শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে কালীগঞ্জে যেতে এক ভয়ঙ্কর ঝড় এবং একটা গাছ উপড়ে এলে এই হাতি গাছ রুখে মেজ-জ্যাঠামশাইকে মৃত্যু থেকে রেহাই দিয়েছিল। সোনার এ-সব মনে হতেই হাতির জন্য মায়া হতে থাকল। এখন মনে হচ্ছে তার, হাতির পিঠে চড়ে সামনের আকাশ অতিক্রম করে চলে যেতে পারবে। হাতিটা হাঁটছে। গলায় ঘণ্টা বাজছে। পিছনে আশ্বিনের কুকুর। কুকুরটা পিছনে ছুটে ছুটে আসছে। কত গ্রাম কত মাঠ ভেঙে, ঝোপজঙ্গল ভেঙে ওরা হাতির পিঠে–যেন কোনও এক সওদাগর বাণিজ্য করতে যাচ্ছে—সপ্তডিঙায়, সাতশো মাঝির বহর…সোনা যুদ্ধ জয়ের মতো ঘরে ফিরছে।

    জসীম সোনাকে বলল, কখন আপনেরা বাইর হইছিলেন?

    সোনা বলল, সেই ভোরবেলা।

    —মুখ ত আপনের শুকাইয়া গ্যাছে।

    —ক্ষুধা লাগছে, কিছু খাই নাই।

    —খাইবেন? বলে জসীম পাকা পাকা প্রায় দুধের মতো সাদা গোলাপজাম কোঁচড় থেকে তুলে দিল। মিষ্টি এবং সুস্বাদু গোলাপজাম। সোনা প্রায় খাচ্ছিল কি গিলে ফেলছিল বোঝা দায়।

    তখন হতিটাকে দেখে কিছু গাঁয়ের নেড়িকুকুর চিৎকার করছিল। কিছু আবাদী মানুষ বাবুদের হাতি দেখছিল—মুড়াপাড়ার হাতিটাকে নিয়ে জসীমউদ্দিন প্রতি বছর এ-অঞ্চলে ঠিক হেমন্তের শেষে, শীতের প্রথম দিকে চলে আসে। বাড়ি বাড়ি হাতি নিয়ে জসীম খেলা দেখায়।

    জসীম সোনাকে বলল, কর্তা পাগল জ্যাঠামশয়র লগে যে বাইর হইলেন—যদি আপনেরে ফালাইয়া তাইন অন্য কোনখানে চইলা যাইত?

    —যায় না। জ্যাঠামশয় আমারে খুব ভালোবাসে।

    জসীম বলল, পাগল মাইনসের লগে বাইর হইতে ডর লাগে না?

    সোনা বলল, না। লাগে না। জ্যাঠামশয় আমারে লইয়া কতখানে চইলা যায়। একবার হাসান পীরের দরগায় আমারে রাইখা আইছিল, না জ্যাঠামশয়! সোনা পাগল জ্যাঠামশাইকে সাক্ষী মানতে চাইল।

    মণীন্দ্রনাথ ঘাড় ফিরিয়ে সোনাকে দেখলেন। যেন এখন কত অপরিচিত এই বালক। বালকের সঙ্গে কথা বলা অসম্মানজনক। তিনি তার চেয়ে বরং সামনের আকাশ দেখবেন। আকাশ অতিক্রম করে আরও দ্রুত চলে যাওয়া যায় কিনা অথবা যদি তিনি আকাশ অতিক্রম করে চলে যেতে পারেন–সামনে এক বিরাট দুর্গ পাবেন, দুর্গের ভিতর পলিন—তিনি এইসব ভেবে হামাগুড়ি দিতে চাইলেন হাতির পিঠে এবং সেই ক্ষুদ্র বালক ওসমানকে তুলে অঙ্কুশ কেড়ে হাতিকে নিজের খুশিমতো চালিয়ে নিতে চাইলেন—হাতি আমাকে নিয়ে তুমি দ্রুত হেঁটে পলিনের দেশে চল—সেই কোমল মুখ আমি আর কোথাও দেখছি না।

    জসীম চিৎকার করে উঠল, কর্তা, আপনে কি করতাছেন কর্তা! ওসমান পাগল মানুষটার দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল। তিনি তার অঙ্কুস কেড়ে নিতে আসছেন। সোনা পিছন থেকে একটা পা চেপে ধরল।—জ্যাঠামশয় আপনে পইড়া যাইবেন। মণীন্দ্রনাথ আর নড়তে পারলেন না। তিনি করুণ এক মুখ নিয়ে সোনার দিকে তাকালেন। কারণ সোনার চোখে এমন এক জাদু আছে যা তিনি কিছুতেই অবহেলা করতে পারেন না। মাঠ পার হলে তিনি দেখলেন, পুবের বাড়ির নরেন দাস মাথায় কাপড়ের গাঁট নিয়ে বাবুর হাটে যাচ্ছে। হাতির গলায় ঘণ্টা বাজছিল বলে গ্রামের সব বালকবালিকা ছুটে এসেছে। আর নরেন দাসের বিধবা বোন মালতী সেই শ্যাওড়া গাছটার পাশে দেখল বড় বড় সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। শতরঞ্জি পেতে দেওয়া হয়েছে। মিঞারা, মৌলবীরা এসে জড়ো হচ্ছে। আর এই গ্রামের সর্বত্র, অন্য গ্রামের গাছে গাছে, মাঠে মাঠে ইস্তাহার ঝুলিয়ে চলে গেছে সামসুদ্দিনের লোকেরা অথবা তার ডান হাত যাকে বলা যায়—সেই ফেলু শেখ। তাতে কিছু শব্দ লেখা ছিল। লেখা ছিল—পাকিস্তান জিন্দাবাদ। লেখা ছিল, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান আর লেখা ছিল নারায়ে তকদির। মালতী নারায়ে তকদির এই শব্দের অর্থ জানত না। একদিন সে ভেবেছিল, চুপি চুপি সামসুদ্দিনকে অর্থটা জিজ্ঞাসা করবে।

    মালতী এবার নিজের দিকে তাকাল। শরীরের লাবণ্য ক্রমে বাড়ছে। স্বামীর মৃত্যুর পর ফের ঢাকায় গত মাসে দাঙ্গা হয়ে গেছে। ওর শ্বশুর এসে বলে গেল, ঢাকায় শাঁখারীরা, কুট্টিরা বড় বদলা নিছে। সেদিন থেকে মালতী খুশি। সামুরে, তুই গাছে গাছে ইস্তাহার ঝুলাইয়া কি করবি! সামুকে মনে মনে গাল দিল মালতী।

    সামিয়ানার নিচে মুসলমান গ্রামের লোকেরা জড়ো হচ্ছে। সিন্নির জন্য বড় উনুন ধরানো হচ্ছে। বড় বড় তামার ডেকচিতে দুধে জলে চালের গুঁড়ো সেদ্ধ হচ্ছে। গোপাট ধরে হাতির পিঠে রাজার মতো তখন পাগল মানুষ ঘরে ফিরে আসছেন।

    মালতী দেখল হাতির পিঠে পাগল ঠাকুর বাড়িতে উঠে আসছেন। ঘণ্টার আওয়াজে যে যেখানে ছিল ছুটে এসেছে। এই ঘণ্টার শব্দ কোনও শুভ বার্তার মতো এই অঞ্চলের সকল মানুষের কানে বাজছে ওরা মনে করতে পারল, সেই পয়মন্ত হাতি লক্ষ্মীর মতো রূপ নিয়ে, শুভ বার্তা নিয়ে তাদের দেশে চলে এসেছে। এই হাতির জন্য যারা গেরস্থ বৌ, যারা কোনওকালে একা একা ঘরের বার হয়নি তারা পর্যন্ত বাড়ির সব নাবালকের পিছু পিছু ঠাকুরবাড়ির দিকে হাঁটতে থাকল।

    অথবা হাতিটা যখন পরদিন উঠোনের ওপর এসে মা মা বলে ডাকবে তখন সব গেরস্থ বৌদের প্রাণে ‘এই হাতি আপনার ধন’ অথবা ‘এই হাতি মা লক্ষ্মীর মতো’। এই হাতি বাড়ির উঠোনে উঠে এলে জমিতে সোনা ফলবে। ওরা হাতির মাথায় কপালে লেপে দেবার জন্য সিঁদুর গুলতে বসে গেল। হাতিটার কপালে সিঁদুর দিতে হবে, ধান দূর্বা সংগ্রহ করে রাখল সকলে। আর মালতী দেখল, হাতির পিঠে পাগল মানুষ হাততালি দিচ্ছেন। হাতির পিঠে সোনা। ফতিমা, সোনাবাবুকে নিচ থেকে বলছে, আমারে পিঠে তুইলা নেন সোনাবাবু। ফতিমা হাতির পিঠে ওঠার জন্য ছুটছিল। আর তখন ফতিমার বা’জী সামসুদ্দিন সামিয়ানার নিচে বড় বড় অক্ষরে ইস্তাহার লিখছিল, ইসলাম বিপন্ন। বড় বড় হরফে লিখছিল—পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

    মালতী এইসব দেখতে দেখতে ডেফল গাছটার নিচে বসে কেমন আবেগে কেঁদে ফেলল। সে চিৎকার করে বলতে চাইল, সামুরে, তুই দেশটার কপালে দুঃখ ডাইকা আনিস না।

    হাতিটা পুকুরপাড় ধরে উঠে যাবার সময় আমের ডাল, অর্জুনের ডাল এবং জামগাছের ডাল অর্থাৎ নিচে যা পেল সব মটমট করে ডালপালা ভেঙে শুঁড় দিয়ে মুখে পুরে দিতে থাকল। আর সেই স্থলপদ্ম গাছটা, যে গাছের নিচে বসে পাগল মানুষটা স্বচ্ছ আকাশ দেখতে ভালোবাসতেন—সেই গাছটা পর্যন্ত মটমট করে ভেঙে হাতিটা মুখে ফেলে কট করে একটা শব্দ, প্রায় কাটা নারকেল খেলে মানুষের মুখে যেমন শব্দ হয়, হাতির মুখে স্থলপদ্ম গাছের ডালপালা কাণ্ড তেমন শব্দ তুলছে। জসীম বার বার অঙ্কুশ চালিয়েও হাতিটাকে দমিয়ে দিতে পারল না। হাতিটা গাছটাকে চেটে পুটে খেয়ে ফেলল। রাগে দুঃখে পাগল জ্যাঠামশাই হাত কচলাতে থাকলেন। তাঁর এই স্থলপদ্ম গাছ, তাঁর সখের এবং নীরব আত্মীয়ের মতো এই স্থলপদ্ম গাছের মৃত্যুতে তিনি বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা।

    মাঠের ভিতর সামিয়ানা টাঙানো। মোল্লা মৌলবীরা আসতে শুরু করছে। ধানকাটা হয়ে গেছে বলে নেড়া নেড়া সব মাঠ। শস্য বলতে কিছু কলাই গাছ, মসুরি গাছ। ফেলু শেখ সব জুড়িদারদের নিয়ে বড় বড় গর্ত করছে। হাজিসাহেবের চাকর দুধ ফোটাচ্ছে। বড় বড় তামার ডেকচিতে দুধ এবং জলে চালের গুঁড়ো, মিষ্টি, তেজপতা, আখরোট, এলাচ, দারুচিনি, জাফরান, লবঙ্গ। পুরানো তক্তপোশের ওপর ছিন্ন চাদর পাতা। আর হাজিসাহেবের তিন ছেলে উজান গিয়েছিল ধান কাটতে, তখন একটা খ্যাস এনেছিল উজান থেকে। সেই খ্যাস পেতে প্রধান মৌলবীসাবের জন্য একটা আসন করা হয়েছে। সব মুসলমান চাষাভুষা লোক ক্ৰমে সামিয়ানার নিচে জড়ো হচ্ছিল।

    শচীন্দ্রনাথ জানতেন, এমন একটা ঘটবে। সামসুদ্দিন ভোটে এবারেও হেরে গেছে। লীগের নাম করে এবারেও সে মুসলমান চাষাভুষা লোকের সব ভোট নিতে পারেনি, শচীন্দ্রনাথ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দাঁড়িয়ে এবারেও ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। সুতরাং তিনি এমন একটা ঘটনা ঘটবে জানতেন। সামসুদ্দিন ঢাকা গেছিল। সাহাবুদ্দিন সাহেবের আসার কথা। এত বড় একটা মানুষ আসবে এদেশে, একবার ওঁরও ইচ্ছা ছিল সামিয়ানার নিচে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই ধর্মীয় করে রেখেছে। বোধ হয় নিমন্ত্রণ করলেও তিনি যেতে পারতেন না।

    হাতিটা পুকুরপাড় ধরে উঠে আসার সময় তিনি এসব ভাবছিলেন। জসীম হাতিটাকে এখন উঠোনে তুলে আনছে। হাতিটা কাছে এলে তিনি বললেন, জসীম ভালো আছ?

    —আছি কর্তা। জসীম হাতিটাকে সেলাম দিতে বলল।

    —মাইজাদা ভালো আছেন?

    জসীম একটু নুয়ে বলল, হুজুর ভালো আছেন।

    —অনেকদিন পর ইদিকে আইলা।

    —আইলাম। আপনেগ দেখতে ইসছা হইল, চইলা আইলাম।

    —বাবুরা বুঝি এখন বাড়ি নাই?

    —না। বাবুরা ঢাকা গ্যাছে।

    সোনাকে এবার ছোটকাকা বললেন, হারে সোনা, তর ক্ষুধা পায় না। অরে নামাইয়া দে জসীম। অর মায় ত গালে হাত দিয়া ভাবতাছে, পোলাটা গ্যাল কৈ?

    হাতিটা পা মুড়ে বসে পড়ল। সোনা নেমে গেল। গ্রামে এখন এই হাতির জন্য উৎসবের মতো আনন্দ। জসীমের ছেলে ওসমান নেমে গেল। সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। জসীম পাগল মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, কর্তা, নামেন। পাগল মানুষ তিনি, তিনি এই কথায় শুধু হাসলেন। তিনি নেমে যাওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না। এই হাতি তাঁর প্রিয় স্থলপদ্ম গাছ খেয়ে ফেলেছে। ক্ষোভে জ্বলছেন। গাছের নিচে বসলেই তিনি জাহাজের সেই অলৌকিক শব্দ শুনতে পেতেন। কাপ্তান মাস্তুলে উঠে নিশান ওড়াচ্ছে। জাহাজটা পলিনকে নিয়ে জলে ভেসে গেল। আর হাতিটা সেই স্মৃতিসহ স্থলপদ্ম গাছটা চেটেপুটে খেয়ে এখন চোখ বুজে আছে।

    শচীন্দ্রনাথও অনুরোধ করলেন হাতির পিঠ থেকে নামতে; কিন্তু পাগল মানুষ তিনি—হাতির পিঠে সন্ন্যাসীর মতো পদ্মাসন করে বসে থাকলেন। এতটুকু নড়লেন না। জোর করতে গেলে তিনি সকলের হাত কামড়ে দেবেন। অথবা হত্যা করবেন সকলকে, এমন এক ভঙ্গি নিয়ে স্থলপদ্ম গাছের শেষ চিহ্নটুকু দেখতে থাকলেন।

    জসীম দেখল হাতির পিঠে বড়কর্তা বসে কেবল বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছেন। তিনি কারও অনুরোধ রাখছেন না। শচীন্দ্রনাথ বার বার বলছেন, দু’চারজন মাতব্বর মানুষ হাতিটা ঠাকুরবাড়ি উঠে আসতে দেখে জড়ো হয়েছিল—তারাও বলছে, বড়কর্তা নামেন। হাতিটা অনেকটা পথ হাঁইটা আইছে, অরে বিশ্রাম দ্যান। বড়কর্তা ভ্রূক্ষেপ করলেন না, তিনি বরং হাতিটার কানের নিচে পা রেখে বলতে চাইলেন, হেট্‌ হেট্।

    তখন হাতিটা ইঙ্গিত পেয়ে উঠে দাঁড়াল। পাগল মানুষ বড়কর্তা হাতিটা নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। জসীম ডাকল, কর্তা এইডা আপনে কি করেন! কর্তা, অঃ কৰ্তা!

    বাড়ির প্রায় সকলেই বিপদ বুঝতে পেরে পিছনে ছুটল। ততক্ষণে হাতিটা পুকুরপাড় ধরে নিচে নেমে যাচ্ছে। পুবের বাড়ির মালতী দেখল, পাগল ঠাকুর মুড়াপাড়ার হাতিটা নিয়ে মাঠে নেমে যাচ্ছে। মাঠে নরেন দাসের জমি পার হলেই সেই শ্যাওড়া গাছ, গাছে ইস্তাহার ঝুলছে, গাছে গাছে সামসুদ্দিন ইস্তাহার ঝুলিয়ে সেই এক বাক্য বলছে, ইসলাম বিপন্ন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। অথবা নারায়ে তকদির এবং এমন সব অনেক কথা লেখা আছে—যা মালতীর দু’চোখের বিষ। মালতীর চিৎকার করে বলার ইচ্ছা, সামুরে তর ওলাওঠা হয় না ক্যান!

    তখন হাতিটা নরেন দাসের জমি পার হয়ে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটছে। পিছনে ছোট ঠাকুর, জসীম, জসীমের পুত্র ওসমান ছুটছে। গ্রামের কিছু ছেলে-বুড়ো ছুটছে। ওরা সকলে হৈ হৈ করছিল—কারণ পাগল মানুষ এক অবলা হাতি নিয়ে মাঠে ঘৌড়দৌড়ের বাজী জেতার মতো ছুটছে। কিছুদূর গেলে সামসুদ্দিনের সামিয়ানা টাঙানো মণ্ডপ। মণ্ডপের বাইরে খোলা আকাশের নিচে বড় বড় ডেকছি—ফেলু সিন্নি চড়িয়েছে। মৌলবীসাব আজান দিয়ে এইমাত্র মঞ্চে উঠে নামাজ পড়ছেন। যারা দূর গাঁ থেকে সভায় ইসলাম বিপন্ন ভেবে সিন্নির স্বাদ নিতে এসেছে অথবা ইসলাম এক হও এবং এই যে কাফের জাতীয় মানুষ যাদের পায়ের তলায় থেকে সংসারের হাল ধরে আছি—কি না দুঃখ বল, এই জাতি তোমাদের কী দিয়েছে, জমি তাদের, জমিদারী তাদের—উকিল বল, ডাক্তার বল সব তারা—কী আছে তোমাদের, নামাজ পড়ার পর এই ধরনের কিছু কিছু উক্তি—যা রক্তে উত্তেজনার জন্ম দেয়—মানুষগুলি কান খাড়া করে মৌলবীসাবের, বড় মিঞার এবং পরাপরদির বড় বিশ্বাসের ধর্মীয় বক্তৃতা শোনার সময় পিছনে ফেলু শেখের চিৎকারে একে অন্যের ওপর ছিটকে পড়ল। সেই ঠাকুরবাড়ির পাগল ঠাকুর এক মত্ত হাতি নিয়ে এদিকে ছুটে আসছে। সবাই হৈ হৈ করতে থাকল। তিনি পাগল মানুষ, হাতি অবলা জীব—সারাদিনের পরিশ্রমের পর হাতিটা বুঝি ক্ষেপে গেছে। হাতিটা পাগলা হাতির মতো শুঁড় উঁচু করে চিৎকার করতে করতে সেই সামিয়ানার ভিতর ঢুকে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল।

    ফেলু তামার ডেকচিগুলির পাশে লুকিয়েছিল। ভিতরে দুধে জলে চালের গুঁড়োতে টগবগ করে ফুটছে। সেই মত্ত হাতি ভিতরে ঢুকে গেলে সকলে নানাভাবে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটছে। সকলে দৌড়ে দৌড়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করছে। সামসুদ্দিন আতঙ্কে ভাঙা তক্তপোশের নিচে লুকিয়ে পড়ল। ফেলু পালাচ্ছিল, পালাতে গিয়ে হাতিটার একেবারে সামনে পড়ে গেল। হাতিটা সহসা ওকে শুঁড়ে জড়িয়ে ধরল এবং ধরার জন্য একটা হাত ভেঙে গেল। সকলে চিৎকার করছে দূরে, কেউ কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না, হায় হায় করছে, একটা মানুষ হাতির পায়ের নিচে বুঝি শেষ হয়ে গেল। মণীন্দ্রনাথ হাতির পিঠে বসে গালে হাত দিয়ে হাতি কতটুকু কি পারে যেন এমন কিছু দেখছিলেন। যেন তিনি ভাবে মগ্ন। হাতির পিঠে চড়ে বেশ তামশা দেখা যাচ্ছে যেন, যেন এমনি হওয়া উচিত ফেলুর। পাগল ঠাকুর এবারে ফের হাতির কানের নিচে পা দিয়ে খোঁচা মারতেই একান্ত বশংবদের মতো ফেলুকে মাটির ওপর পুতুলের মতো দাঁড় করিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাতিটাকে এই স্থান-কাল-পাত্র পরিত্যাগ করে চলে যেতে বললেন। আর হাতিটাও স্থান-কাল-পাত্র পরিত্যাগ করে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে থাকল।

    .

    তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। তখন নদীর চরে ঈশম তরমুজের লতা নিড়ান দিয়ে সাফ করে দিচ্ছিল। হেমন্তের শেষে শীত এসে যাচ্ছে। সূর্য পশ্চিমে নামতে থাকলেই ঘাসে ঘাসে শিশির পড়তে থাকে। জসীম চিৎকার করছিল, আর হাতিটার পিছনে ছুটছিল। বাবুদের হাতি—সে এই অঞ্চলে হাতি নিয়ে ঘুরতে এসে কী এক দুর্যোগে পড়ে গেল—সেই বিস্তীর্ণ মাঠের ভিতর থেকে পাগল মানুষকে হাতির পিঠে তুলে না নিলেই এখন মনে হচ্ছে ভাল হতো। সেই যে তিনি হাতির পিঠে চড়ে বসলেন আর নামতে চাইলেন না। এখন কী হবে! হাতিটা ক্রমশ মাঠ ভেঙে গ্রামে, গ্রাম ভেঙে মাঠে পড়ছে। হাতির পিঠে মণীন্দ্রনাথ তালি বাজাচ্ছেন। গ্রামের ছোট বড় সকলে পিছনে ছুটে ছুটে যখন হাতিটার আর নাগাল পেল না, যখন হাতিটা নদীর চর পার হয়ে অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল—তখন মণীন্দ্রনাথ চুপচাপ বসে বুঝলেন—আর ভয় নেই। হাতিটাকে কৌশলে তিনি যেন বলে দিলেন, অবলা জীব হাতি, তুমি এবার ধীরে ধীরে হাঁটো। তোমাকে এখন আর কেউ খুঁজে পাবে না।

    রাত হয়ে গেছে। এটা কোনও মাঠ হবে, বোধ হয় দামোদরদির মাঠ হবে। আর একটু গেলেই মেঘনা। নদীর পাড়ে বড় মঠ। অন্ধকারে এখন মঠ দেখা যাচ্ছে না। শুধু ত্রিশূলের মাথায় একটা আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে।

    .

    শচীন্দ্রনাথ তখন বাড়ির ভিতর। আরও সব মানুষজন এসেছে। জসীম উঠোনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এত বড় হাতি নিয়ে পাগল ঠাকুর কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। সে মাহুত হাতির—বাবুদের হাতি, লক্ষ্মীর মতো পয়মন্ত হাতি—এখন কী হবে, সে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিল না। উঠোনের ওপর গ্রামের লোকেরা কী করা যায় পরামর্শ করছে। গ্রামে গ্রামে এখন খবরটা পৌঁছে গেছে। ঈশম লণ্ঠন হাতে আবার বের হয়ে পড়েছে এবং প্রায় একদল মানুষ লণ্ঠন হাতে সোনালী বালির নদীর চরে নেমে যাচ্ছে। তারা জোরে জোরে ডাকছিল। জসীমও বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেনি। সে ওসমানকে রেখে একা সেই দলটার সঙ্গে মেশার জন্য কাঁধে গামছা ফেলে দৌড়াতে থাকল।

    সামসুদ্দিন লণ্ঠন হাতে মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। ফেলু খুব বেঁচে গেছে এ যাত্রা। ওকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটা তছনছ ভাব এবং পাগল ঠাকুর ইচ্ছা করে এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন যেন, যেন তিনি জানতেন সামসুদ্দিনের এই যে ইস্তাহার ঝুলিয়ে স্বার্থপর মানুষের মতো একই সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হবার বাসনা—এই বাসনা ভালো নয়। পাগল মানুষ তিনি। এইটুকু ভেবে গোটা উৎসবের মতো এক ছবিকে তছনছ করে চলে গেছেন। সামসুদ্দিনের আপ্রাণ চেষ্টার দরুন এই মাঠে এত বড় একটা জাল্‌সা হতে পারছে। এত বড় জাল্‌সাতে শহর থেকে মোল্লা মৌলবীরা এসেছিল। ওরা যখন হাজিসাহেবের বাড়িতে উঠে, তোবা তোবা, কি এক বেমাফিক কাজ হয়ে গেল। সামসুদ্দিনের ইচ্ছা হল এখন সে নিজের হাত কামড়ায়। আর মনে হল গোটা ব্যাপারটাই এক ষড়যন্ত্র। যেন ছোট ঠাকুর আবার ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হতে চায়। আবার কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ছোট ঠাকুর দাঁড়াবে এবং কবিরসাবকে ধরে এনে কংগ্রেসের পক্ষে বড় এক বক্তৃতা করাবে। সে ভাবছিল, এমন একটা হাতি পাওয়া যাবে না সেদিন! হাতির পিঠে ফেলু বসে থাকবে। অথবা ফেলুকে দিয়ে মণ্ডপে আগুন ধরিয়ে দিলে যেন সব আক্রোশের শোধ নেওয়া যাবে। লণ্ঠন হাতে সামসুদ্দিন জব্বরকে দিয়ে সব তৈজসপত্র, ভাঙা টুল টেবিল, ছেঁড়া সামিয়ানা এবং বড় শতরঞ্জ সব একসঙ্গে মাঠ থেকে বাড়িতে তুলে আনার সময় এসব ভাবল।

    তখন বাড়ির বৃদ্ধ মানুষটি প্রশ্ন করেছিলেন—তিনি অতিশয় বৃদ্ধ বলেই ঘরের ভিতর বসে প্রদীপের মৃদু আলোতে সামান্য কাশছিলেন, এখন আর তিনি তেমন বেশি ঘর-বার হন না—অধিকাংশ সময় ঘরের ভিতর খাটে একটা বড় তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে শুয়ে থাকেন—অতিশয় গৌরবর্ণ চেহারার এই মানুষ উঠোনে গোলযোগ শুনে বড়বৌকে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে বড়বৌ? উঠোনে এত গণ্ডগোল ক্যান?

    বড়বৌ প্রদীপে আলো একটু উসকে দিল। টিন-কাঠের ঘর। জানালা দিয়ে শেষ হেমন্তের ঠাণ্ডা বাতাস ভেসে আসছে। বড়বৌ এই সংসারে বৃদ্ধ শ্বশুরের দেখাশুনা করার সময় প্রায়ই জানালায় দূরে সব মাঠ দেখতে পায় এবং সেই মাঠে সংসারের এক পাগল মানুষ ক্রমান্বয়ে হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন কেবল চলে যেতে চাইছেন। উঠোনের সেই গণ্ডগোল, মানুষটার এভাবে হাতিতে চড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া এ-সব বড়বৌকে বিপন্ন করছে। মানুষটা আবার ক্ষেপে গেলেন। ভোরেও বড়বৌ এই মানুষকে খেতে দিয়েছে। ভালোমানুষের মতো খেয়ে প্রতিদিনের মতো নিরুদ্দেশে চলে গেছিলেন। সংসারের ছোট এক বালক সোনা সঙ্গ দিয়েছে মাঠে মাঠে এবং গ্রামে গ্রামে। তারপর কোন এক দূর গ্রাম থেকে মাঠ ভেঙে সোনার হাত ধরে এই পাগল মানুষ গ্রামের দিকে ফিরছিলেন, তখন জসীম আসছে হাতিতে চড়ে। জসীমের ছেলে ওসমান হাতির সামনে। ওরা দেখল সেই বড় মাঠে ঠাকুর ছোট বালকের হাত ধরে কোথায় যেন চলে যাচ্ছেন। এই মানুষটার জন্য তল্লাটের সকলের কষ্ট—কারণ এমন মানুষ হয় না, কথিত আছে তিনি দরগার পীরের মতো এক মহৎ পুরুষ। জসীম পাগল ঠাকুরকে হাতির পিঠে তুলে বলেছিল, চলেন বাড়ি দিয়া আসি কর্তা। জসীম, সোনা এবং পাগল মানুষকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে এই কাণ্ড। বড়বৌ খুব দুঃখের সঙ্গে বৃদ্ধের পায়ের কাছে বসে সব বলল। বৃদ্ধ পুত্রের হাতিতে চড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ঘটনা শুনে পাশ ফিরলেন শুধু। বৃদ্ধের মুখে এক অসামান্য কষ্ট ফুটে উঠেছে। বড়বৌর কাছে ধরা পড়ে যাবেন ভাবতেই মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে শুধু অন্ধকার দেখতে থাকলেন। এই সময়ে তাঁর এক পাগল ছেলে মাঠময় ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সব দুঃখের মূলে তিনি—তাঁর জেদ, এ সব ভেবে তাঁর দুঃখের যেন অন্ত ছিল না। তিনি বললেন, বৌমা, জানালাটা বন্ধ কইরা দ্যাও। আমার শীত করতাছে।

    —একটা কম্বল গায়ে দ্যান বাবা।

    —না। জানালাটা বন্ধ কইরা দ্যাও।

    বড়বৌ জানালা বন্ধ করার সময়ই দেখল কামরাঙা গাছের ওপারে যে বড় মাঠ, ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে—সেখানে অনেক লণ্ঠন। বড়বৌ বুঝল, এইসব মানুষ যাচ্ছে অন্ধকারের ভিতর পাগল মানুষ এবং হাতিটাকে খুঁজতে

    আর জসীম অন্ধকারে ডাকছিল হাতিটার নাম ধরে-লক্ষ্মী, অ লক্ষ্মী! সে সবার আগে ছুটে ছুটে যাচ্ছিল। যেন তার ঘরের বিবির মতো এক রমণী অন্ধকারে নিরুদ্দেশ হয়েছে অথবা সেরা মানুষ পাগল ঠাকুর—দশাসই চেহারা, গৌরবর্ণ—ঠিক পীরের মতো এক মানুষের সঙ্গে তার পোষা হাতি, তার ভালোবাসার লক্ষ্মী চলে গেছে। সে প্রাণপণ ডাকছিল, লক্ষ্মী অ লক্ষ্মী! আমি তর লাইগা চিঁড়ামুড়ি তুইলা রাখছি, লক্ষ্মী অ লক্ষ্মী, তুই একবার অন্ধকারে ডাক দিহি, মাঠের কোন আনধাইরে তুই বইসা আছস একবার ডাইকা ক’ দিহি। আমি পাগল ঠাকুরের মতো তরে লইয়া ঘরে ফিরমু।

    ঈশম বলছিল, আরে মিঞা, এত উতালা হইলে চলব ক্যান। বড়কর্তা বড় মানুষ। হাতি অবলা জীব, ভালবাসার জীব। তিনি হাতির মতো পোষা জীব লইয়া পলিনেরে খুঁজতে বাইর হইছেন।

    জসীম বলল, পলিন, কোন পলিনের কথা কন!

    —আরে আছে মিঞা।

    জসীম বলল, হাঁটতে বড় কষ্ট। কিস্সা কইলে বেশি হাঁটতে পারি।

    ঈশম বলল, বড় মানুষের কথা অধমের মুখে ভাল শুনাইব না। অথবা যেন ঈশমের বলার ইচ্ছা—মিঞা, তল্লাটের লোক কে না জানে এ-কথা। তুমি এডা কি কও! তুমি জান না কর্তা ফাঁক পাইলে নৌকায়, না হয় হাঁটতে হাঁটতে নিরুদ্দেশে যান। তারপর ঈশম এক বর্ষার কথা বলল। এক বর্ষাকালে পাগল ঠাকুর নৌকা নিয়ে তিনদিন নিরুদ্দেশ ছিলেন, তার গল্প করল। সোনালী বালির নদীর জলে তখন স্রোত ছিল। তিনি একা স্রোতের মুখে নৌকা ছেড়ে বসেছিলেন। যেন সেই নাও তাঁকে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে অথবা গঙ্গার জেটির পাশে বড় এক জাহাজে পৌঁছে দেবে। পাগল মানুষ বলে তিনি মনে মনে বিলের ভিতর বড় এক কলকাতা শহর বানিয়ে বসেছিলেন এবং সারাদিন সারা রাত ধরে যেন তিনি সেই বিলের জলে পলিনকে খুঁজেছিলেন। বিলের জলে এক স্বপ্ন ভাসে, স্বপ্নে সেই বড় কলকাতা শহর—গাড়ি ঘোড়া হাতির মিছিল, আর ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ, দুর্গের পাশে মেমরিয়েল হল—কার্জন পার্ক। গড়ের মাঠে সাহেবরা উর্দি পরে কুচকাওয়াজ করছে। পাগল ঠাকুর হে হে করে হাসতে হাসতে শুধু বলছিলেন, গ্যাৎচোরেৎশালা। কারণ তাঁর প্রতিবিম্ব জলে দেখা যাচ্ছিল, আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। শহরটা নিমেষে কেমন জলের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। পাগল মানুষের প্রতিবিম্ব তখন শুধু পরিহাস করছে, হায় বেহুলা জলে ভাইস্যা যায় রে, জলে ভাইস্যা যায়।

    সবই যেন জলে ভেসে যাচ্ছিল। এতবড় বিল, এই অন্ধকার চারদিকে, জোনাকিরা জ্বলছে। উড়ে উড়ে জোনাকিরা পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথকে এবং হাতিটাকে ঘিরে ধরল। মণীন্দ্রনাথ হাতির পিঠে চড়ে বিলের পাড়ে পাড়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। বিলের জলে শুধু অন্ধকার। হেমন্তকাল বলে ঠাণ্ডা বাতাস উঠে আসছে। পাকা ধানের গন্ধ মাঠে মাঠে। এই অন্ধকারে হাতির পিঠে বসে পাকা ধানের গন্ধ পাচ্ছিলেন। আর আকাশে কত হাজার নক্ষত্র, পাগল মানুষ প্রতিদিনের মতো হাতির পিঠে বসে সেইসব নক্ষত্র দেখতে দেখতে, যেন সেইসব নক্ষত্রে কোনও একটি তার প্রিয় পলিনের মুখ—তিনি হাতিতে চড়ে অথবা নৌকায় উঠে কিছুতেই আর সেই প্রিয় পলিনের কাছে অথবা হেমলক গাছের নিচে পৌঁছতে পারলেন না। তিনি হাতিটাকে সম্বোধন করে বললেন, হ্যাঁ লক্ষ্মী, তুমি আমাকে নিয়ে পলিনের কাছে যেতে পার না। সেই সুন্দর মুখ—ঝরনার জলের উৎসে তুমি আমাকে পৌঁছে দিতে পার না!

    সহসা এই পাগল মানুষের ভিতর পূর্বের স্মৃতি তোলপাড় করলে তিনি আর স্থির থাকতে পারেন না। মনে হয় আর কিছুদূর গেলেই তিনি তাঁর প্রিয় হেমলক গাছটি খুঁজে পাবেন এবং সেই হেমলক গাছের নিচে সোনার হরিণটি বাঁধা আছে। এইভাবে কতদিন একা একা মাঠ থেকে মাঠে, গ্রাম থেকে গ্রামে এবং এমন তল্লাট নেই এ-অঞ্চলে তিনি যেখানে একা-একা চলে যান না, তারপর এক-সময় ফের মনে হয় সেখানে আর তিনি এ-জীবনে পৌঁছাতে পারবেন না। সুতরাং সেই এক বড়বৌর মুখ এবং তার বিষণ্ণ চোখ পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথকে অস্থির করে তোলে। তিনি ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন। তখন মনে হয় হাতিতে অথবা নৌকোয় কখনও সেই হেমলক গাছের নিচে পৌঁছানো যাবে না। সোনার হরিণেরা বড় বেশি দ্রুত দৌড়ায়।

    জসীম, ঈশম এবং নরেন দাসের দলটা সারারাত লণ্ঠন হাতে খুঁজে হাতিটা এবং মানুষটাকে বার করতে পারল না। ওরা সবাই রাতের দিকে ফিরে এসেছিল। আরও দুটো দলকে শচীন্দ্রনাথ পুবে এবং পশ্চিমে পাঠিয়েছিলেন। তারা নানা রকমের খবর দিল। কেউ বলল, অশ্বত্থ গাছের নিচে গত রাতে পাগল মানুষ এবং হাতিটাকে দেখেছে। কেউ বলল, বারদির মাঠের উত্তরে একদিন দেখা গেছে মানুষটাকে। উত্তর থেকে খবর এল, পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ হাতিটাকে দিয়ে সব আখের খেত খাইয়ে দিচ্ছেন। কেউ কিন্তু হাতিটার নাগাল পাচ্ছে না। সপ্তাহের শেষ দিকে আর কোনও খবর এল না। সবাই তখন বলল, না আমরা পাগল মানুষ এবং হাতিটাকে দেখিনি।

    বাড়িতে প্রায় সকলের মুখে একটা শোকের ছবি। কেউ জোরে কথা বলছে না। লালটু, পলটু, সোনা সারাদিন বড়িতেই থাকছে। পুকুরপাড়ের অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ওরা প্রতিদিনই হাতিতে চড়ে মানুষটা ফিরছেন কিনা দেখত। বিকালের দিকে জ্যাঠামশাই মাঠের ওপর থেকে উঠে আসবেন প্রতীক্ষায় অর্জুন গাছটার নিচে বসে থাকত। সঙ্গে থাকত সেই আশ্বিনের কুকুর। ওরা প্রিয় মানুষটির জন্য গাছের নিচে বসে সারা বিকেল, যতক্ষণ সন্ধ্যা না হতো, যতক্ষণ গোপাট অতিক্রম করে মাঠের বড় অশ্বত্থ গাছটায় অন্ধকার না নামত, ততক্ষণ অপেক্ষা করত। আর এ-ভাবেই একদিন কুকুরটা ঘেউঘেউ করে উঠল—কুকুরটা কেবল চিৎকার করছে—সূর্য তখনও অস্ত যায় নি। তখন ওরা দেখল কুকুরটা দৌড়ে দৌড়ে মাঠে নেমে যাচ্ছে। আবার সোনার কাছে উঠে আসছে। ওরা দেখল পুবের মাঠে আকাশের নিচে কালো একটা বিন্দুর মতো কি কাঁপছে। ক্রমে বিন্দুটা বড় হচ্ছে। হতে হতে ওরা দেখল এক বড় হাতি আসছে। সোনা চিৎকার করে বাড়ির দিকে দৌড়ে গেল, হাতিতে চইড়া জ্যাঠামশয় আইত্যাছে।

    গ্রামের সকলে দেখল পাগল মানুষ ক্লান্ত। বিষণ্ণ। চোখমুখে অনাহারের ছাপ। তিনি হাতির পিঠে প্রায় মিশে গেছেন।

    হাতিটা হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল উঠোনে। যেন এই হাতি আর কোথাও যাবে না। এখানেই বসে থাকবে। জসীম বলল, কর্তা নামেন। লক্ষ্মীরে আর কত কষ্ট দিবেন!

    গ্রামের সকলে অনুরোধ করল নামতে। কিন্তু তিনি নামলেন না।

    শচীন্দ্রনাথ বললেন, তোমরা সকলে বাড়ি যাও বাছারা, আমি দেখি। বলে, তিনি হাতিটার কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, বড়দা, বড়বৌদি কয়দিন ধইরা কিছুই খায় নাই। বৌদিরে কত আর কষ্ট দিবেন!

    কিন্তু কোনও লক্ষ্মণ নেই নামার। শচীন্দ্রনাথ বললেন, সোনা, তর বড় জ্যাঠিমারে ডাক।

    বড়বৌ ঘোমটা টেনে ডালপালা ভাঙ্গা স্থলপদ্ম গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। শচীন্দ্রনাথ বললেন, আপনে একবার চেষ্টা কইরা দ্যাখেন

    বড়বৌ কিছু বলল না। সেই সজল উদ্বিগ্ন এক চোখ নিয়ে হাতির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে মণীন্দ্রনাথ হাতি থেকে নেমে বড়বৌকে অনুসরণ করলেন—তিনি এখন এক সরল বালক যেন। তাঁর এখন বড়বৌর দুই বড় চোখ ব্যতিরেকে কিছু মনে আসছে না। ঘরে ঢুকে দেখলেন, তাঁর প্রিয় জানালাটা খোলা। তিনি সেখানে দাঁড়ালেই তার প্রিয় মাঠ দেখতে পান। এবং তখন মনে হয় মাঠে বড় এক হেমলক গাছ আছে, নিচে পলিন দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন অকারণে তিনি নদী বন মাঠের ওপারে পলিনকে খুঁজেছেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }