Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীল পাহাড় – ওবায়েদ হক

    ওবায়েদ হক এক পাতা গল্প166 Mins Read0

    নীল পাহাড় – ৬

    ছয়

    সূর্যের আলোতে পাহাড় যেন ঝলমল করছে, কিন্তু মানুষের মুখে মেঘ জমেছে। একটা চাপা গুমোট পরিবেশ। গভীর জঙ্গল থেকে একজন বন কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে গেছে পাহাড়িরা। কোনো মুক্তিপণ দাবি করেনি, তার মানে প্রাণের আশা ছেড়ে দেয়া যায়। পুলিশ এদিক-ওদিক লাঠি নিয়ে ঘুরঘুর করছে, জঙ্গলে ঢোকার সাহস করতে পারছে না। বিডিআর চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না, বড় বড় সংগঠনগুলো অপহণ করলে তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়, তারাই বিভিন্ন দাবী নিয়ে যোগাযোগ করে। কিন্তু এই ছোট গহিন পাহাড়ের গ্রামভিত্তিক সংগঠনগুলোর কোনো পাত্তা পাওয়ার জোগাড় নেই। তাদের কোনো দাবি নেই, তাদের জঙ্গল নষ্ট করতে যারাই ঢুকবে তারা জীবিত ফিরতে পারবে না। গহিন পাহাড়ে এমন অনেক জায়গা আছে যে সে জায়গা ম্যাপেও নেই। তাই বিডিআরও লাশের জন্যই অপেক্ষা করতে লাগল। সাঙ্গু নদীর পাড়ে কয়েকটা পয়েন্টে পাহারা বসানো হলো। লাশ ফেলতে আসলেই যাতে কিছু লোক ধরা যায়। চব্বিশ ঘন্টা পাহারা দিয়েও কাউকে ধরা গেল না, লাশ ঠিকই ভেসে এলো নদীতে। মাথা ছাড়া লাশ।

    থানচি বাজারের পাশে বিডিআর ক্যাম্পে রাখা হয়েছে লাশ, লাশ দেখতে লোকজন ভিড় করছে। চায়ের দোকানে বিক্রি বেড়ে গেছে। চায়ের চুমুকে চুমুকে লাশ ভেসে আসার বিচিত্র কাহিনি তৈরি হতে লাগল। লাশ নিয়ে নাকি পাহাড়ি চারজন সুন্দরী পরী এসেছিল।

    তাদের শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। বিডিআর-এর লোকজনের সামনে দিয়ে তারা নদীতে লাশ ভাসিয়েছে কিন্তু তারা একটুও নড়তে পারেনি। লোকজন লাশের চেয়ে সেই পাহাড়ি পরীদের দিকেই বেশি মনোযোগ দিত। তাদের শরীরের বর্ননা শুনার জন্য বারবার একই গল্প শুনতে লাগল, নিজের মনমতো বাড়িয়েও বলতে লাগল। একসময় নিজের বাড়িয়ে বলা অংশও তারা সত্য মনে করতে লাগল। বরকত আলী চায়ের আসরে মধ্যমণি হয়ে বসেছে। পাহাড়ি পরীদের রূপ বর্ণনায় সে যোগ দিল। কিন্তু মানুষের লোভের সাথে সাথে ক্ষোভটাও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সে কথার সুর কেটে সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করল।

    যে মানুষটারে খুন করছে তার নাম কি জানেন?

    সবাই মাথা নাড়ল, কেউ জানে না। সবাই নীরব হয়ে বরকত আলীর উত্তর শোনার অপেক্ষায় রইল। সে গলা উঁচু করে বলল,

    তার নাম মোহাম্মদ আবদুর রহমান। জি হ্যাঁ মোসলমানের ব্যাটা ছিল। এই জন্যই তার এই পরিণতি। যদি মালাউন, পাহাড়ি হইত তাইলে বাইচ্চা যাইত। দেখেন না কোনো সরকারি অফিসার এইখানে টিকতে পারেনি কিন্তু বলিপাড়ায় এক মালাউন ডাক্তার ঠিকই আরামে আছে। তাগো আসল ঝাল হইল আমাগো মোসলমানগো উপর। মোসলমান যেইখানে গেছে রাজত্ব করছে, এই পাহাড়েও মোসলমানগো রাজত্ব হইব, আল্লার রাজত্ব হইব।

    সবার বুক কেঁপে ওঠ, গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। মনের ভেতর মোহাম্মদ আবদুর রহমান নামটা বারবার প্রতিধ্বনি হতে থাকে, আর সাথে সাথে ক্ষোভও বাড়তে বাকে। বরকত আলীর প্রতিটি কথা তারা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতে লাগল। বরকত আলী আবার শুরু করল,

    আল্লাহ আমাগো বান্দাগো কত সুযোগ-সুবিধা দিছে, আমরা আল্লাহর হুকুম পালন করুম, বিধর্মীগো ভয়ে তার বান্দারা পলাইব না। তারা একটা লাশ ফালাইলে আমাগো দশটা লাশ ফালাইতে হইব। দরকার হয় জান দিয়া দিব আল্লাহর রাস্তায়।

    শেষের বাক্যটা সবার বুকে ধাক্কা দেয়। ইচ্ছা করে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে। একটা ক্ষোভের গুঞ্জন ওঠে। বরকত আলী গলা নামিয়ে বলল।

    সবুর করেন ভাইয়েরা। আপনেরা এক জোট হন, আইজকা সন্ধ্যায়ই হবে ইনশাল্লাহ। বলিপাড়ায় সব হারামি বিধর্মীরা থাকে, কিছু করতে হইলে আগে সেই জায়গায় ব্যবস্থা নিতে হইব।

    সবার চোখগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে, মনে মনে চাপা উত্তেজনা যেন চোখ দিয়ে ঠিকরে বের হয়। বরকত আলী এক দফা সবার দিকে তাকিয়ে আবার চায়ে চুমুক দেয়, বড় ভালো হয়েছে চা-টা।

    .

    সন্ধ্যা হয়েছে অনেক আগে। বাঙালি-পাড়ায় পুরুষেরা আলস্যে বিরতি দিয়ে ঘরে ঝিমাচ্ছে। কেউ কেউ ব্যবসার হিসাব মিলাচ্ছে। মারমা পাড়ায় ক্লান্তি, ফসল তুলে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে অনেকে। সারাদিন মাঠে কাজ করা নিজের মেয়ের চুলে চিরুনি দিচ্ছে তার মা, চুলের বন্ধন আলগা করতে পারে না সেই চিরুনি। মেয়েটি মারমা ভাষায় মাকে আহ্লাদের অনুনয় করে, তার কিছুটা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে মানিকের কানে আসে। ঘরের নিচে বাঁধা শূকরগুলো মাঝে মাঝেই ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

    ফিসফাস করে বলা গল্পগুলো মানিকের কানে আসে না, বুড়ো দাদুরা তলুঃর গল্প করেন, ঘুমে চোখ বুজে আসা ছোট খোকাটি কষ্ট করে জেগে থাকে দাদুর গল্প শোনার জন্য। নীরব সুরে জীবনের গান বেজে যায় পাহাড়ের কোলে। তার মধ্যেই ফসল তোলার খুশিতে ‘রা’ খেয়ে মাতলামি করতে থাকে এক বৃদ্ধ। সে তার ভাষায় চেঁচায়, কিছু বুঝতে পারে না মানিক, তবে শুধু তলুঃ শব্দটা বুঝতে পারে।

    মানিক ভাবল, এবার ফেরা যাক। সবাই তাকে বারণ করেছে এখানে বেশিক্ষণ না থাকতে। ভূত, প্রেত, তলুঃ সবার নাকি একযোগে সমাগম হয় রাত্রিবেলা। দিনের বেলায় তাদের বড় অসুবিধা। বিশাল আকারের তলুঃ কিংবা ভূত-প্রেতের সমাগমে মানিকের কোনো ভয় নেই, গাঙ দেবতাদের স্বরণ করলে নাকি তারা কিছু করে না, ভূত প্রেত তাড়ানোর জন্যও আলাদা দেবতা নিযুক্ত আছেন। সে ভয় পায় ফুট তিনেকের বন্য শূকরকে। এই জিনিস আক্রমণ করলে কোনো দেবতার দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যায় না।

    পাহাড়ি রাতের সুর কেটে একটা মৃদু কোলাহল শোনা গেল, যেন বহু দূরে কোনো সমুদ্র ঢেউয়ের আস্ফালন। ক্ষেপে তেড়ে আসছে। আত্মা কাঁপানো সেই কোলাহল বাড়তে থাকল। পাহাড়ের উপর থেকে মানিক দেখল, সাপের মতো ফণা তুলে এক বিশাল ছায়া রাতের নীরবতা ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে মারমা পাড়ার দিকে। এরাই সে তলুঃ, আসল দানব। এক দল মানুষের এক হিংস্র মিছিল। আছড়ে পড়ল মারমা পাড়ার প্রথম ঘরটাতে। তারপর আরেকটাতে, সংক্রমনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। একটা চিৎকার ছাপিয়ে গেল আরেকটা চিৎকারকে। চিৎকারগুলো আর্তনাদে রূপ নিল। মানুষ ছুটতে লাগল দিগ্বিদিক, একটু আগে চিরুনির ছোঁয়া পাওয়া চুলগুলো আবার এলোমেলো হয়ে গেল, দানবের হাত তার চুলের মুঠো ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, প্রাণপণে নিজের শরীরে খামিটি জড়িয়ে রাখতে চাইছে মেয়েটি। ফসলের খাড়িটি দুই হাতে জড়িয়ে রেখেছে কেউ একজন, সবাই পালাচ্ছে সে পালাচ্ছে না। সেই বাড়িতে তার রক্ত ছিটিয়ে পড়ল একটু পর। তলুঃর গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়া ছেলেটি উদ্ভ্রান্তের মতো তার দাদুকে খুঁজে ফিরছে। নিজের কোল থেকে হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাটি খুঁজছে কোনো এক মা, সে ক্রমাগত ডেকে চলেছে, ‘ও বু, ও বু’। মাতাল লোকটি আর চেঁচাচ্ছে না, কেউ একজন তার মাথাটা আলাদা করে ফেলেছে শরীর থেকে।

    আর্তনাদগুলো কমে গেল, মাঝে মাঝে দুই-একটা আর্তনাদ বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। একটু পরে পুরো পাহাড় আলোকিত হয়ে গেল, একটার পর একটা ঘর জ্বলতে থাকল। জুমের ফসলগুলো আগুনে আত্মাহুতি দিল। উল্লাস করা দানবেরা আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

    বাঙালি পাড়ার পুরুষেরা আলসেমি কাটিয়ে তাদের প্রতিবেশী মারমাদের ঘরের আগুন নিভাচ্ছে। মারমারা দুই-একজন জঙ্গল থেকে সাহস করে বেরিয়ে এসেছে, ঘর, ফসলের মায়ায়। মানিক পাহাড়ি রাস্তাটার মাঝামাঝি এসে দেখল, বাঙালি পাড়ার মধ্যে একমাত্র তার ঘরেই আগুন জ্বলছে। আগুন বেশি লাগতে পারেনি মানুষ বালি ছিটিয়ে অনেকটাই নিভিয়ে ফেলেছে। মানিক অবাক হয়ে দেখল মংওয়াইয়ের বাবা-মা নিজদের ঘর ছেড়ে তার ঘরে আগুন নিভাচ্ছে।

    আগুন একসময় নিভে গেল, রাতও পার হলো, কিন্তু দগ্ধ ঘরগুলোর মতো মানুষের মনেও কালো ক্ষত হয়ে গেল। পোড়া কাঠ থেকে তখনো থেকে থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। নিজের ঘরে এসে চোখের পানি ফেলছে ছেলে হারানো মা, তার চোখের পানি জ্বলন্ত কাঠে পড়ে ছপ করে বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। অশ্রুগুলো বাস্প হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল মেঘের সাথে। সেগুলো আবার বৃষ্টি হয়ে একদিন তাদের ঘর পোড়া ছাই মুছে দেবে। ছয়টা মেয়ে নিখোঁজ ছিল, দুই জনের লাশ পাওয়া গেছে, দুটোই মগ্ন। এখনো চারজনের কোনো খোঁজ নেই, তাদেরও লাশ খোঁজা হচ্ছে। হাতে থান কাপড় নিয়ে লাশ খোঁজা হচ্ছে, তারা জানে বাকি লাশগুলো নগ্নই হবে।

    নারী-পুরুষ মিশিয়ে আটজনের মৃতদেহের সৎকার করা হলো। ঘর পুড়ে যাওয়া কাঠ দিয়েই তাদের পোড়ানো হলো। মানিক পাহাড়ে ঘাসে গা এলিয়ে বসে আছে। দূর থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়ছে, আটটা কুণ্ডলী। মারমা পাড়াটা দেখতে কালো কোনো মৃত্যুপুরীর মতো লাগছে। মহিলারা এখনো থেমে থেমে বিলাপ করছে।

    দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি মানিকের, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সন্ধাটা কালো চাদর বিছাতে শুরু করেছে। পাহাড়ের ঢালুতে কিছু ঝোপঝাড় বাড়াবাড়ি রকমের ঘন হয়ে গেছে। সেই ঝোপটাই যেন হঠাৎ নড়ে উঠল। মানিক সংশয়ে তাকাল, কী আছে ঝোপের আড়ালে? তলুঃ নাকি শূকর? তলুঃতে ভয় নেই মানিকের, সেই জঙ্গল মানুষের আগ্রহ শুধু কুমারী মেয়েতে, সে তা নয়। ঈশ্বর তাকে এই কৃপাটুকু করেছেন। কৌতূহলটাকে মাটি চাপা দিয়ে সে উঠে চলে যেতে পারল না। এক পা দু পা করে এগিয়ে গেল ঘন ঝোপের কাছে। গুল্মের অবাধ্য ঝাড়টা সরাতেই আবছা আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেল, মানুষ। জঙ্গল মানুষ নয়, এ যে মানবী, নাকি দেবী? লম্বা চুল দিয়ে মুখটা ঢাকা, কাত হয়ে পড়ে আছে ঘাসের উপর। ঘাড়ের কাছে কালচে জমাট বাঁধা রক্ত প্রমাণ দিল যে, এই নারী অমানুষ নয়। মানিক অভ্যস্ত হাতে মেয়েটার হাত ধরে পালস চেক করতে গিয়ে যেই হাতে স্পর্শ করল, মেয়েটার শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠল, এক ঝটকায় হাতটা ছড়িয়ে নিয়ে, চুলের আড়াল থেকে মানিকের দিকে তাকাল, তার চোখে ভয়, ঘৃণা, অসহায়ত্ব মিশে ছিল। বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারল না, আবার এলিয়ে পড়ল।

    মেয়েটি চোখ খুলে ঘোলা ঘোলা চোখে চারিদিকে তাকাচ্ছে। তার ঘোর এখনো কাটছে না। ঘাড়ের কাছে ব্যান্ডেজ অনুভব করল সে, সাথে একটু ব্যথা। ছিমছাম ছোট একটা ঘর কিন্তু অপরিচিত, বাঁশের খুঁটিতে একটা হারিকেন জ্বলছে। কয়েকটা শার্ট আনমনে ঝুলে আছে এক কোনায়, টেবিলে বেশ কিছু বই গুছানো আছে, এই ঘরে একমাত্র সেগুলির যত্ন হয়। ঘরটা দেখে বুঝা যায় এটা কোনো পাহাড়ি ঘর না। মুহূর্তে ভয়ে-শঙ্কায় কুঁকড়ে উঠল মেয়েটি। তখনি মানিক ঘরে ঢুকল। তাকে দেখে শঙ্কাটা আরো বৃদ্ধি পেল মেয়েটার। মানিক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল ভঙ্গিতে বলল—

    আর একটু হলেই মরতে।

    মেয়েটি সন্দেহের দৃষ্টি অব্যাহত রাখল, গায়ের চাদরটি আঁকড়ে ধরল। মানিক তা লক্ষ করে বলল—

    তোমাকে পাহাড়ের ঢালুতে পেয়ে আমার ঘরে নিয়ে এসেছি, রাত হয়ে গিয়েছিল। তোমাকে কোলে করে হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়নি। মেন্টাল ট্রমা আর ব্লিডিং-এর কারণে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে। কয়েক দিন বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।

    মেয়েটি যেন বিভ্রান্ত, হয়তো অনেক কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ চোখের তারাটা জ্বলে উঠল, আর মুহুর্তেই চোখ ছেপে জল গড়িয়ে পড়ল। মাথা গুঁজে দিল দুই হাঁটুতে। মানিক কাছে যেতেই আবার মাথা তুলল। মানিক কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না, সে কখনোই সান্ত্বনা দিতে পারে না। নিজের এই অক্ষমতার জন্য বড্ড অসহায় লাগছিল। কিন্তু কিছু একটা বলা দরকার। কথা শুরু করার জন্যই বলল,

    তোমার নাম কী?

    তখনি মেয়েটি স্পষ্ট বাংলায় বলল—

    প্লিজ আপনি আমার কাছে আসবেন না। এখান থেকে যান।

    পাহাড়ি মেয়ের মুখে বাংলায় এমন পষ্ট উচ্চারণ শুনে মানিক একটু হতচকিত হয়ে গেল। মেয়েটির গলায় গাম্ভীর্য ছিল, আত্মসম্মান ছিল, আদেশও ছিল যা মানিকের পক্ষে এড়ানো সম্ভব ছিল না। মানিক কিছু না বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মানিক চলে যাওয়ার পরই মেয়েটির যেন একটু অনুশোচনা হলো। কিন্তু এত বড় দূর্যোগের পরে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। লোকটিকে বেশ ভদ্রই লাগছিল, সারারাত সে এ ঘরেই দিল, কোনোরকম বিদ্রোহ করার শক্তি তার গায়ে ছিল না, তবুও লোকটি তাকে কিছু করেনি। ভোরের আলো আর জোছনার আলোর মধ্যে মিল আছে, দুটোই স্নিগ্ধ কোমল। কিন্তু ভোরবেলো যত পাখির ডাক শুনা যায়, জোছনায় তা শোনা যায় না। তার বাবা এই সময়টাতে সব সময় ঘর থেকে বেরিয়ে যেত আর সে জানালা দিয়ে দেখত। আজও সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল। আবছা আলোতেই বুঝল, এটা বলিপাড়া গ্রাম। এই পাড়ার প্রতিটা ঘাস তার মুখস্থ। জানালা দিয়ে ছোট পাহাড়ের অর্ধেকটা দেখা যায়। সেই পাহাড়ের পাশ দিয়ে মানুষ হাঁটার রাস্তা তৈরি হয়েছে, মানুষ সেই পথ ধরে হাঁটে, তাই ঘাসগুলো পথ দখল করতে পারেনি, লালচে সেই পথ ঘাসগুলোর ব্যর্থতা আর মানুষের নিয়মিত চলাচলের সাক্ষী দেয়। মেয়েটি দেখল, ভোরের আলোতে সেই পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে একটি লোক, যার ঘরে সে আশ্রিত। হঠাৎ যেন লোকটিকে দেখে তার বাবার কথা মনে হলো। লোকটি তার নাম জিজ্ঞাসা করেছিল কিন্তু সে উত্তর দেয়নি, এখন মনে মনে উত্তর দিল—

    আমার নাম ক্রাসিমা।

    ক্রাসিমা সেই চারজন নিখোঁজদের মধ্যে একজন। মানিক যদি এখানের চায়ের দোকানগুলোতে ঘুরঘুর করত ক্রাসিমার নাম অবশ্যই শুনত। মানুষজন গল্প করার সময় দ্বিধায় ভুগত, তার রূপের প্রশংসা করবে নাকি গুণের। পাহাড়িদের মধ্যে একমাত্র সেই-ই কলেজে পড়তে গেছে। পাহাড়ি বৃদ্ধরা গর্ব করে তাকে নিয়ে আর তরুণেরা স্বপ্ন দেখে, দেবতাদের অবহেলা করে ক্রাসিমার জন্য মালা গাঁথে, সেই মালা তাদের দেবীর চরণে অর্পণ করার সাহস কারো হয় না। তবুও তারা মালা গাঁথে, স্বপ্ন দেখে, পূজা করে কিন্তু শ্রদ্ধা করতে পারে না, অভিশাপ দিতে পারে না। তার বাবার কথা বলার সময়ও লোকজনের মন আদ্র হয়ে যায়। যুবক বয়সেই বউ মারা যায় ক্রাসিমার বাবার। লোকে বলে ক্রাসিমার রূপ তার বাপ থেকেই পাওয়া। তরুণীরা আশায় বসে ছিল ক্রাসিমার মা হওয়ার জন্য। কিন্তু ক্রাসিমার বাবার মনে সায় দেয়নি, তরুণীরা দীর্ঘশ্বাসকে সঙ্গী করে অন্য কারো বউ হলো। বলিপাড়ার কার্বারী (গ্রাম প্রধান) ছিল ক্রাসিমার বাবা। সব পদে ইস্তফা দিয়ে শুধু বাবার পদটা ধরে রেখেছিল সে। ছোটবেলায় ক্রাসিমাকে খুব কম লোকই হাঁটতে দেখেছে, তার বাবা তাকে সব সময় ঘাড়ে করেই রাখত। বাপ-মেয়ে সকাল বিকাল পাহাড়ের কোলে বসে থাকত, তাই লোকজন ক্রাসিমাকে পাহাড়ের মেয়ে ডাকত।

    ক্রাসিমা যখন বান্দরবান কলেজে ভর্তি হলো, তখন তার বাবাকে ছাড়া যাবে না বলে গো ধরে ছিল। সে বলেছিল—

    তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকব বাবা! আমি টিকতে পারব না।

    তার বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল দেখ—

    তুই পাহাড়ের মেয়ে, তুই সব জায়গায় টিকে যাবি। আমি তোর সাথে যেতে চাই কিন্তু এই পাহাড় ছেড়ে যেতে পারব না। আমি এই পাহাড়ে জন্মেছি, এখন বুড়ো হয়ে গেছি, কখন ঈশর ডেকে নেন ঠিক নেই। আমি এই পাহাড়েই মরতে চাই।

    একটু থেমে আবার বলেছিল—

    মাগো যাই করিস, এই পাহাড়ে ফিরে আসিস। এই লোকগুলো বড় সরল, তাদের দেখিস তুই। তাদের জন্য কিছু করিস মা।

    এই আকুতিটা ক্রাসিমা কখনো ভুলতে পারে না। তার কানে বাজে এই কথাটা।

    গত রাতের কথা মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয় ক্রাসিমার। জেগেই ছিল সে, বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রতিবার এসে সে তার বাবার জন্য একটা বিশেষ রান্না করে, অতি কুখাদ্য হলেও তার বাবা চেটেপুটে খায়। বাঁশের চোঙ্গায় পাহাড়ি মাশরুম রান্না করেছিল গতকাল। ব্যঙের ছাতা মানুষ খায়, এই কথা বিশ্বাস করাতে অনেক কষ্ট হয়েছে ক্রাসিমার। ব্যাঙ্গের ছাতার ব্যঞ্জনার ভয়েই হয়তো সন্ধ্যাবেলায়ই বেরিয়ে গেল তার বাবা। ক্রাসিমা অভিমানে অপেক্ষা করছিল বাবার জন্য, ঠিক করেছিল, বাবা আসলে তাকে যখন ডাকবে সে সাড়া দিবে না।

    শান্ত পাহাড়ে হঠাৎ চিৎকার শুনে আঁতকে উঠেছিল সে। কিন্তু বুঝার আগেই দুটি বাঙালি লোক দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল। অপরিসীম হিংস্রতা ছিল তাদের চেহারায়, মশালের আলোতে তাকে দেখে সে হিংস্রতা যেন লালসায় রূপ নিল! এই রূপ ক্রাসিমা চেনে, সে জানালা দিয়ে মাঁচার উপর লাফ দিয়ে পড়েছিল, বাঁশের কঞ্চিতে লেগে ঘাড়ের কাছে অনেকটা কেটে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা সে টের পায়নি। শুধু দৌড়েছে যতক্ষণ গায়ে শক্তি ছিল, চারিদিকে চিৎকার ভেসে আসছিল, সেও চিৎকার করছিল, বাবা বাবা করে।

    কোন সময় পড়ে গিয়েছিল বলতে পারে না। দিনের আলোতে একবার জ্ঞান ফিরেছিল কিন্তু দুর্বলতার জন্য হোক আর ভয়ে হোক সে নড়তে পারেনি। সে ধরে নিয়েছিল মারা যাচ্ছে, বাবার কথা মনে হচ্ছিল বারবার।

    ক্রাসি ও ক্রাসি, ক্রাসি।

    হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠত বাবার ডাক শুনে। জেগেই কান পেতে রইত কিন্তু বাবা যে আর ডাকে না। দেবতার নাম করে বাবাকে দিব্যি দিয়েছিল—

    বাবা একবার ডাকো, একবার।

    সেই ডাক শোনার অপেক্ষায় বুঝি প্রাণটা দেহে ধরে রেখেছিল। তারপর এই লোকটাই তাকে বাঁচাল। ঘর দেখে বুঝা যায় লোকটা ডাক্তার। কিন্তু এই বলিপাড়ায় একজন ডাক্তার বসবাস করে, ভাবনাটা বড্ড বেশি অযৌক্তিক।

    ভাবনায় ছেদ ঘটলো কিছু শব্দে। মনে হচ্ছে এই ঘরের বাহিরে কিছু মানুষ ভাংচুর করছে। ক্রাসিমা বিছানার চাদর মুঠো করে ধরে সচকিত হয়ে দরজার দিকে তাকাল। তার ঘরের দরজাটা খুলে গেল। একসাথে বেশ কয়েকজন লোক ঢুকল ঘরে।

    .

    মানিক নার্স ইয়াসমিন আর মং-এর মাকে নিয়ে আনতে গিয়েছিল, মেয়েটা ট্রমায় আছে, কোনো বাঙালিকে বিশেষ করে পুরুষ বাঙালিকে হয়তো বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা ঘরে ঢুকতেই দেখল দবজাটা উপর থেকে খুলে একদিকে ঝুলছে, ঘরের জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে, হারিকেনটা আহত হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে, মোরগ হওয়ার শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রের মতো উলটে আছে চেয়ার দুটো। কাপড়-চোপড় আর ওষুধগুলোকে কান টেনে হিড়হিড় করে বের করে আনা হয়েছে ড্রয়ার থেকে, সেগুলো হতবাক হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। কেরোসিনের ঝাঁঝালো গন্ধ বাতাসে, মেঝে সিক্ত সেই তরলে। কিন্তু যে ঘরটাতে মেয়েটা ছিল সেখানে এই তাণ্ডবের বিন্দুমাত্র নেই। সব কিছু যেমন ছিল তেমনি আছে, শুধু মেয়েটা নেই। চাদরটা একটু ঝুলে আছে খাট থেকে, সেখানে এখনো ক্রাসিমার গন্ধ লেগে আছে কিন্তু ক্রাসিমা নেই।

    তিনজন মানুষের হতবাক চাহনি ঘরে ঘুরাঘুরি করছিল। তারা নিজেদের ধাতস্থ করার আগেই হাশেম ঘরে ঢুকল, সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—

    লাশ পাওয়া গেছে।

    মানিক নিঃশাস আটকে বহু কষ্টে জিজ্ঞাসা করল—

    কার?

    বরকত ভাইয়ের, গলাকাটা লাশ।

    .

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleও হেনরি রচনাসমগ্র
    Next Article তেইল্যা চোরা – ওবায়েদ হক

    Related Articles

    ওবায়েদ হক

    তেইল্যা চোরা – ওবায়েদ হক

    July 17, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.