Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীল পাহাড় – ওবায়েদ হক

    ওবায়েদ হক এক পাতা গল্প166 Mins Read0

    নীল পাহাড় – ৮

    আট

    মাথায় মমতাময়ী একটা হাত স্পর্শ করেছে, কাজাচাইয়ের শক্ত কাঠের মতো আঙ্গুল নয়। মায়ের মমতাময়ী আঙুল। মানিক প্রশান্তি নিয়ে চোখ খুলল, চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে ফেলল। সে নির্ঘাত ভুল দেখছে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে একই দৃশ্য দেখে বিচলিত না হয়ে পারল না। চোখ দুটোকে একটু কচলে নিল, তাতে দৃশ্যের হেরফের হলো না। তার বিছানার পাশে ত্রাসিমা বসে আছে, সেদিনের মতো নয়। চুলগুলো পরিপাটি করে বাঁধা, মাথায় সাদা চালতা ফুলের পাপড়ি লাগিয়েছে, গায়ের পোশাকে কোনো ময়লা নেই—

    চোখে সেই ঘৃণা নেই। মানিক ক্রাসিমার দিকে তাকিয়ে বলল—

    আমি কি মারা গেছি?

    আর একটু হলেই মরতেন।

    মানিক একটু হেসে বলল—

    এই কথা একসময় আমি তোমাকে বলেছি, আজ আমরা জায়গা বদল করলাম, শোধবোধ হয়ে গেল।

    না শোধবোধ হয়নি, আমি সেদিন সব হারিয়েছিলাম, বাবা হারিয়েছিলাম।

    আমিও সব যবিয়েছি, মা হারিয়েছি। আশা করি এবার শেধবোধ হয়েছে।

    ক্রাসিমা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল—

    শোধবোধ হিসাব করলে, আমি আপনার কাছে জীবনের তরে ঋণী। তবুও পাহাড়ি হিসেবে কিছু দাবি করতেই পারি, বাঙালিরা আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে, এবার আমরা একজন বাঙালির কাছেই উপকার চাইছি। তাহলে শোধবোধ হবে।

    মানিক অবাক হয়ে বলল—

    আমি কী করতে পারি?

    ক্রাসিমা বলল—

    আপনার যা কাজ তাই করতে হবে, দিন পনেরো আগে বিডিআর-এর সাথে গোলাগুলিতে আমাদের নেতার পায়ে গুলি লেগেছিল, সেখানে ক্ষত হয়ে গেছে, আমাদের বৈদ্যরা সারাতে পারছে না, হসপাতালে নেয়াও সম্ভব নয়। তাই আপনাকে আনা হয়েছে, সেটাকে যদি আপনি অপহরণ বলেন, তবে তাই।

    আর আমার মুক্তিপণ? তোমাদের নেতার সুস্থতা? উনি সুস্থ না হলে আমাকে কি মরতে হবে?

    আপনাকে মরতে হবে না, আপনাকে শুধু চেষ্টা করতে হবে। আসলে আপনাকে আমরা জোর করছি না, শুধু সাহায্য চাইছি। এখানে এই পাহাড়ের আশেপাশে প্রায় পনেরোটা গ্রাম আছে, তাদের অধিকাংশই প্রিয়জন হারিয়ে ভিটা-মাটি ছেড়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। নেতার কিছু হলে এরা আবার দিশাহীন হবে।

    ডাক্তার হিসেবে আমি আমার কাজ করব, সে জন্য আমাকে অনুরোধ করতে হবে না। কিন্তু তুমি এখানে কীভাবে?

    আমার পাহাড়ি ভাইরা আমাকে উদ্ধার করে এনেছে।

    উদ্ধার করে এনেছে মানে? তোমাকে কি আমি বন্দি করে রেখেছিলাম?

    ক্রাসিমা একটু লজ্জা পেল, বলল—

    না না সে নয়। আর শুনুন আপনিও এখানে বন্দি নন। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ান, চাইলে চলে যেতে পারেন যদি পথ চিনে যেতে পারেন।

    শেষের খোঁচাটা হজম করে নিল মানিক। বলল—

    প্রয়োজনবোধে যেতেও পারি।

    ক্রসিমা বলল—

    আপনাকে খোঁজার জন্য নিশ্চয়ই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।

    মানিক একটু উদাস হয়ে বলল—

    না, আমাকে খোঁজার জন্য কেউ আসবে না। ছুটির দরখাস্ত করে এসেছি, আর আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেও নেই।

    ক্রাসিমা একটু আহত হলো, যদিও এটা সুংবাদই বটে, তবে মানিকের বেদনাটা যেন অনুভব করল সে। অপরাধীর ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল,

    আপনার মায়ের কথা কী বলছিলেন? মংতোদা তো বললেন, আপনি অ… মানে আপনার বাবা-মা নেই।

    মানিক চাদরের তলার বুকে হাত দিল, তার গায়ের জামাটি নেই। তার পুরো পৃথিবী যেন ফাঁকা হয়ে উঠল, সে ধরফর করে বিছানা থেকে উঠল, চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে বলল—

    আমার জামা কই?

    ক্রাসিমা একটু অবাক হলো, বারান্দায় ঝুলানো শার্টটি এনে দিয়ে বলল—

    ভিজে গিয়েছিল, শুকাতে দিয়েছিলাম।

    মানিক শার্টটি হাতে নিয়েই আগে পকেটে হাত ঢুকাল, তারপর স্বস্তির নিঃশাস ফেলল। কাগজটা একটু দুমড়ে গেছে, বৃষ্টিতে ভিজে ঢেউ হয়েছে কাগজে কিন্তু ছিঁড়ে যায়নি। ক্রাসিমা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল—

    এটা কী? চিঠি?

    মানিক শার্টটি গায়ে দিয়ে বলল—

    কিছু না।

    উপেক্ষাটা ক্রাসিমার নজর এড়ায় না। তাকে কেউ উপেক্ষা করে না, এই অভিজ্ঞতা তার নতুন। মনে মনে একটু ক্ষুব্ধ হলো নিজের উপর। মানিকের এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। এই ঘরটি অন্যান্য পাহাড়ি ঘরের মতোই তবে এখানে পুরোটাই বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি, কোনো কাঠ নেই। সে যে খাটে শুয়ে আছে সেটাও বাঁশের তৈরি। ঘরে তেমন আসবাব নেই, কোনো জানালাও নেই। মানিক ক্রাসিমাকে জিজ্ঞাসা করল—

    এই ঘরে জানালা নেই কেন?

    ক্রাসিমা বলল—

    তা জানি না, তবে এখানে কেউ থাকে না। শুনেছি কাউকে ধরে আনলে এখানেই রাখা হয়, না মারা পর্যন্ত।

    মানিক সরু চোখে তাকাল। ক্রাসিমা সে দৃষ্টি এড়িয়ে বলল—

    আপনার যদি সমস্যা না হয় তবে কি একটু আপনার রোগীকে দেখে আসবেন?

    মানিক বলল–

    হুম তাই ভালো। চলুন।

    বাহিরে আসতেই সকালের স্নিগ্ধ আলো চোখে লাগল, বাঁশ দিয়ে খোলা বারান্দা বানানো হয়েছে, একপাশে বাঁশের সিঁড়ি লাগানো আছে। নিচে বিশ-পঁচিশ জন পুরুষ-মহিলা আর কিছু বাচ্চা উদাস মুখে বসে আছে। তারা এক দৃষ্টিতে মানিকের দিকে তাকিয়ে আছে—

    তাদের চোখে হতাশা ঝরে পড়ছে। মানিক ক্রাসিমার দিকে তাকিয়ে বলল—

    এরা কারা? এখানে জড়ো হয়েছে কেন? আপনি আছেন জেনে এসেছে এরা, আশেপাশের গ্রাম থেকে এসেছে।

    এদের মন খারাপ কেন? আমি অসুস্থ ছিলাম বলে?

    না, এরা ভেবেছিল আপনাকে মারা হবে। কেননা বাঙালিকে মারা হলে এখানে উৎসব হয়, পাঠা বলি দেয়া হয়। মেয়েরা সাজে, গান গায়। পুরুষেরা ‘রা’ খায়। ঢোল বাজে, মাদল বাজে। দেবতকে পুজো দিয়ে ধন্যবাদ জানায়, আরো একজন পাহাড়ের শত্রু ধ্বংস হলো। এরা যখন জানল, আপনাকে মারা হবে না, তখন সবাই একটু হতাশ হয়ে গেছে।

    মানিক নিরীহ অতৃপ্ত চেহারাগুলোতে আবার চোখ বুলাল। তাকে জীবিত দেখে আর কারো মুখে এমন হতাশা দেখেনি সে। বাচ্চাদের করুণ মুখ দেখে বেঁচে থাকার জন্য রীতিমতো অপরাধবোধ হচ্ছে তার। সে এই নারী-পুরুষ বাচ্চাদের মজলিশ পেরুনোর সময় অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস পাড়ি দিয়ে গেল। মানিক মনে মনে পাঁঠাটার কথা ভেবে স্বস্তিবোধ করল, অন্তত তাঁর বেঁচে থাকায় পাঠাটা খুশি হবে।

    গ্রামটি বলিপাড়ার মারমা পাড়ার তুলনায় অনেক ছোট, ঘরগুলোও যেন একটু ছোট। তবে সবুজের কোনো কমতি নেই এখানে। এক গুচ্ছ বাড়ির চারপাশে বড় বড় টিলা। এই টিলাগুলো যেন গ্রামটাকে আগলে রেখেছে। প্রতিটা বাড়িই কোনো না কোনো গাছের সাথে ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন বৃদ্ধা বারান্দায় বসে কোলে তাঁত নিয়ে কাপড় বুনছে। কিন্তু তাদের নিজেদের কাপড় ব্যবহারে চরম অনীহা, অধিকাংশের উর্ধাঙ্গ খালি। তাতে তারা কিংবা অন্য কেউ বিন্দুমাত্র বিচলিত না। লোহার দা দিয়ে বাঁশ চাঁছছে কেউ কেউ। এই বাঁশ দিয়ে কী বানাবে কে জানে, তারা বাঁশ দিয়ে প্রায় সবই বানাতে পারে। গ্রামের একপাশে বুদ্ধের মন্দির, সেখানে একটা মাটির বুদ্ধ মূর্তিও আছে। মন্দিরে শুধু বুদ্ধ বাস করে, বাকি সব দেবতারা নদীতে, জঙ্গলে কিংবা ঝরনায় বাস করে।

    আদিবাসীদের সর্দার হিসেবে থুইনুপ্রু খুবই আধুনিক। তার নামের মতোই সে দুর্ভেদ্য এবং জটিল। তার ঘরে ঢুকেই মানিক প্রথমে দেখল রবীন্দ্রনাথের একটি তৈলচিত্র। পাঁঠার শুকনো মাথা ঝুলানো থাকবে আশা করেছিল সে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ দেখে একটু ভিরমি খেল। ঘরটি বেশ পরিপাটি, এলোমেলো কাপড়-চোপড় নেই, শুধুমাত্র কাপড়-চোপড় দেখেই বলে দেয়া যায় মানুষটা গুছানো। মাথায় পাখির পালক নেই, কপালে ছুয়ে আছে একটি ওয়াটার ব্যাগ। চোখ বুজে আছে থুইনুপ্রু। চোখ মেলে তাকাল মানিকের দিকে। ছোট চাপা চোখের পুরোটা দেখা যায় না, তবে এটা ফ্যাকাসে চোখ দেখেই বুঝা যায়, ঐ চোখটি তার কর্মক্ষম চোখ নয়। মুখে একটু হাসি লাগিয়ে বলল—

    হ্যালো ডাক্তার। আমি স্যরি, আপনাকে এভাবে কষ্ট দেয়া হলো। কিন্তু আমি নিরুপায়।

    মানিক কিছু বলল না, তার মনে ক্ষোভটা রয়ে গেছে। সে থুইনুপ্রুর কপালে হাত দিল, বেশ জ্বর আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। তারপর চাদরটা সরিয়ে ডান পা-টা দেখল, সবুজ পাতায় মোড়া পা-টা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফোলা দেখাচ্ছে। মানিক পাতাগুলো ধীরে ধীরে সরাতে থাকল, থুইনুপ্রু দাঁতে দাঁত চাপল, ক্রাসিমা মুখ ফিরিয়ে ফেলেছে, সে এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছে না। পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটুতে ক্ষতটা ছড়িয়ে পড়েছে। মানিক কিছুক্ষণ দেখে আবার ঢেকে দিল। থুইনুপ্রু বলল—

    পা-টা কি কেটে ফেলে দিতে হবে?

    মনে হচ্ছে কাটতে হবে না, তবে দেরি করলে গ্যাংগ্রিণ হয়ে যাবে, তখন কাটা হাড়া উপায় থাকবে না। আমার কিছু ওষুধ দরকার।

    কী কী লাগবে আপনি লিখে দেন, আমি আনিয়ে দিব।

    এভাবে আনতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে, যেতে-আসতে ছয় দিন লাগবে। তত দিনে কী হয় বলা যায় না।

    আপনি চিন্তা করবেন না দুই দিনের মধ্যেই আপনার দরকারি সবকিছু পেয়ে যাবেন।

    সেটা কী করে সম্ভব?

    আপনি সে চিন্তা করবেন না। সেটা আমার চিন্তা।

    মানিক আর কিছু বলল না, রবীন্দ্রনাথের ছবিটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি রবীন্দ্র-ভক্ত।

    নাহ, গান-সাহিত্য কিছুই পছন্দ করি না আমি। এই ছবিটা একজন উপহার দিয়েছে। আমার বউয়ের ছবি ছিল আগে এখানে। তার চেয়ে রবীন্দ্রনাথকেই বেশি মানাচ্ছিল এই ঘরে, তাই বউ সরিয়ে রবীন্দ্রনাথকেই টানিয়ে দিলাম।

    মানিক অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল, বলল—

    কিন্তু আপনার কথা শুনে আপনাকে বেশ ইন্টেলেকচুয়াল মনে হয়।

    থুইনুপ্রু চোখ বুজল, নস্টালজিয়ায় ভোগা মানুষের মতো মুখে একই সাথে তৃপ্তি, অতৃপ্তি এবং হতাশা ফুটে উঠল। তার নষ্ট চোখটা বন্ধ হওয়ায় তার চেহারায় মাধুর্য ফিরে এসেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—

    ভালো ছাত্র হিসেবে রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটিতে আমার বেশ নাম ছিল। আমার জাতীয়তা নিয়ে আমি নিজেই সন্দিহান ছিলাম। বাবা-মা বাংলাদেশে ছিল, কিন্তু আমি মনে-প্রাণে বার্মিজ। শেষ বছরে আমার বসন্ত হয়, বাংলায় সবচেয়ে সুন্দর ঋতু বসন্ত কিন্তু রোগ হিসেবে এটা ততটাই খারাপ। ক্যাম্পাসে আমাকে নিষিদ্ধ করা হলো। মানুষের চোখের ঘৃণা সইতে না পেরে বাবা-মায়ের কাছে চলে এসেছিলাম। আমাকে সেবা করতে গিয়ে তাদেরও এই অভিশাপ ভোগ করতে হলো। বসন্তু তাদের গ্রাস করেছে কিন্তু আমি বেঁচে গিয়েছিলাম অলৌকিকভাবে কিন্তু চোখটা খোয়াতে হয়েছিল। সুস্থ হওয়ার পরে পাহাড় ছেড়ে শহরে গিয়েছিলাম, টিকতে পারিনি। নাক বোঁচা পাহাড়িদের মানুষ ভিন্ন গ্রহের মানুষের মতোই দেখে। জাপানি ভাষা নকল করে আমার সাথে কথা বলত মানুষেরা।

    আশেপাশের মানুষেরা আমার নাম দিয়েছিল, জাপানি মূলা। জাপানি মূলা হওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না, আবার পাহাড়ে চলে আসলাম। সেই শহরে টিকতে না পারা মানুষগুলো, নিজের ভিটাতে পরাজিত আর অপরাধী মানুষগুলোও চলে এলো পাহাড়ে। পাহাড়ে নিজের জায়গা করতে পাহাড়িদের জায়গা দখল করতে শুরু করল, বাঙালি স্যাটেলাররা অত্যাচার করে পাহাড়িদের তাড়িয়ে দিচ্ছিল। তাদের বাঁচানোর মতো কোনো সরকার কিংবা দেবতা ছিল না। আমি তখন যোগ দেই সন্ত লারমার জেএসএসএ। তখন থেকেই বিডিআর, সরকারের শত্রু আমি। তাতে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই, কারণ অনেক শত্রু পেয়েছি কিন্তু পাহাড়িরা আমাকে বন্ধুই মনে করে।

    মানিক চুপচাপ শুনছিল। থুইনুপ্রু একটু থামতেই বলল—

    জেএসএসএ থাকতে আপনি কেন আলাদা সংগঠন করলেন?

    থুইনুপ্রু বলল—

    কারণ জনসংহতি সমিতি নিজেদের সংহতির জন্যই বেশি উৎসাহী ছিল। তারা লোভে পড়ে গিয়েছিল, টাকার জন্য অপহরণ করে আবার লুটপাট, চাঁদাবাজিও করে। পাহাড়িদের কাছ থেকেও চাঁদাবাজি করেছে ওরা। ওরা প্রভু হতে চায়। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সংগঠনে। তাই আমি আমার লোকদের জন্য সংগঠন করেছি, কোনো নাম নেই আমার সংগঠনের। বিতাড়িত পাহাড়িদের আশ্রয় দেই আমরা, আর যারা আমাদের পাহাড়ের ওপর আক্রমণ করে আমরা তাদের ছেড়ে দেই না।

    মানিক বলল—

    আপনার কিছু হলে এদের হাল সামলাবে কে?

    থুইনুপ্রু বলল—

    কেউ না কেউ ঠিকই দাঁড়িয়ে যাবে, আমার ভাইয়ের ছেলে মংতো আছে, ক্রাসিমা আছে। এরাই তো ভবিষ্যৎ।

    মানিক কপাল কুঁচকে বলল—

    এতগুলো মানুষ এখানে থাকে, পনেরোটা গ্রাম, এদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা হয় কীভাবে?

    থুইনুপ্রু বলল—

    এরা জুম চাষ করে, শিকার করে আর…।

    হঠাৎ থেমে গেল, চোখ খুলে মানিয়ে দিকে তাকাল, দৃষ্টিহীন চোখটি হিংস্র দেখাচ্ছে, সেটি একেবারে অকাজের নয়। তারপর গম্ভীর গলায় বলল—

    আমি কথা দিচ্ছি আপনার কোনো অসুবিধা হবে না এখানে, যদি আপনি চান। কিন্তু আপনি যদি নিজেই নিজের ক্ষতি করতে চান, আমার কিছু করার থাকবে না। আপনার কী কী লাগবে লিখে দিন। কিছু মনে না করলে এখন যান, বিশ্রাম নেন। আমারও ক্লান্ত লাগছে।

    মানিক মন খারাপ করল না, রবীন্দ্রনাথের ছবিটা আরেক দফা কাছ থেকে দেখে বেরিয়ে গেল।

    .

    ছোট ছোট কুটিরগুলো পাশ কাটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানিক। নতুন প্রেমে পড়লে অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে স্বপ্ন দেখে একসাথে এরকম নির্জন কুটিরে দুজন মিলে থাকবে। দোকান বাকি করে মাস চালাতে হবে না যেখানে, মাস শেষে বাড়িওয়ালার ভয়ে রাত করে বাসায় ফিরতে হবে না, টানাটানির সংসারে দূরের আত্বীয়স্বজনরা হানা দিবে না, নতুন গহনা দেখিয়ে পাশের বাসার ভাবি মনে জ্বালা ধরাবে না, গভীর রাতের আদরের স্পর্শে গরমে ঘামে ভেজা চটচট শরীর অরুচি ধরাবে না।

    উদাস ছেলেদের এই স্বপ্ন দেখতে প্রেমিকার প্রয়োজনও হয় না। নির্জনে সবুজ কুটির তাদের সবসময়ই হাতছানি দেয়। কিন্তু এই স্বপ্নগুলো কখনোই বাস্তব হয় না। মানিক কখনো এমন স্বপ্ন দেখেনি, তবুও তার উপর স্বপ্নটা যেন বাস্তব হয়ে আরোপিত হলো।

    এখানে বলিপাড়ার মারমা বসতির মতো কর্মচাঞ্চল্য নেই, অভাব নেই, ভয়ও নেই। মেয়েরা মন চাইলে দাওয়ায় বসে তাঁত বুনে নয়তো উদাস মুখে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধরা লম্বা বাঁশে গুড়গুড় করে তামাক টেনে সময় পার করে।

    বাচ্চারা বসে নেই, তাদের ব্যস্ততা সবচেয়ে বেশি। খানিক আমলকী গাছে উঠে গাছের সব আমলকী পেড়ে ফেলে, নয়তো বেঁধে রাখা শুকরটাকে ছেড়ে দিয়ে সেটার পিছনে সবাই দৌড়ায়, দলবেঁধে ঝরনায় চলে যায়, সারা দুপুর গোসল করে, পিচ্ছিল পাথরে গড়াগড়ি করে। সন্ধ্যা নাগাদ আবার ধুলোবালি মেখে মায়ের বকুনি খায়।

    কিন্তু পুরুষদের সংখ্যা বেশ কম এবানে, এদের মধ্যে কেউ কেউ জুম চাষ করতে পাহাড়ে চলে যায়। নিতান্ত অবহেলায় তারা জুম চাষ করে, ঘাড়ে করে চুপড়ি আলু নিয়ে আসে সন্ধ্যায়। সেই আলু পড়ে থাকে নিচে খোঁয়াড়ের পাশে। মনে হয় যেন এই চাষ করা প্রয়োজন নয় অভ্যাস। আসলেই প্রয়োজন নয়, এখানে কোনো অভাব নেই।

    মংতো আরো দুজনকে সাথে নিয়ে পুঁটলিতে খাবার বেঁধে কাঁধে বাঁশের বৈঠা নিয়ে চলে গেল। তারা নদী দিয়ে যাবে, নদী নিশ্চয়ই বেশি দূরে না। হয়তো এ জন্যই ওষুধপথ্য আনাতে দুই দিনের বেশি লাগবে না। কিন্তু তাকে কেন পাহাড়ি পথে তিন দিন ধরে হাঁটিয়ে আনা হলো? মানিকের মনে প্রশ্ন করেই উত্তর পেয়ে গেল মানিক। নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিডিআর চেক পোস্ট আছে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার।

    সন্ধ্যা হতেই আগুন জ্বালানো হলো সবচেয়ে বৃদ্ধ বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলার আঙ্গিনায়। সবাই গোল হয়ে বসেছে। বৃদ্ধার পাশে বসার জন্য একটা ছোটখাটো প্রতিযোগিতা হয়ে গেল। বৃদ্ধা এই প্রতিযোগিতা দেখে খুব তৃপ্তি অনুভব করে, মুখে কৃত্রিম রাগ এনে বকে দেয় সবাইকে। সে বকাতেও স্নেহ এবং প্রশ্রয় থাকে। নিজের জানালাবিহীন ঘরে বারান্দায় বসে সব দেখছিল মানিক। সে ভাবছিল সাঙ্গু নদী নিয়ে, যেটাকে অনেকে শঙ্খ নদী বলে। সেই নদীই তাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। হঠাৎ কোথা থেকে কাজাচাই উদয় হলো। তাকে টেনে নিচে নিয়ে গেল, মানিক আপত্তি করল, কিন্তু কাজাচাই তা শুনল না, শোনার ক্ষমতাও তার নেই।

    মানিক আর কাজাচাই ক্রাসিমার পাশে গিয়ে বসল, বৃত্তটা পূর্ণ হলো। আগুনের লালচে আভাটা সবার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। বৃদ্ধা গল্প শুরু করেছেন, স্বপ্নাহত মানুষের মতো সবাই এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বৃদ্ধার দিকে, মনোযোগ দিয়ে শুনছে আদিকালের কোনো এক গল্প। মানিক আর কাজাচাই শুধু মানুষের মুখ দেখছে, এই আসরে তারা দুজন শুধু মূর্খ। সবার মুখ দেখেই যেন তারা গল্পটা বুঝে নিল, মানিক ক্রাসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, আগুনের আলো তার মুখে ঢেউ খেলছে। তার মুখটাকে শরতের আকাশের মতো দেখাচ্ছে, ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলাচ্ছে। মানিক একদৃষ্টিতে সে আকাশে তাকিয়ে আছে, গল্পটা বেশ বুঝতে পারছে এখন। হঠাৎ ক্রাসিমার মুখটা লাল হয়ে উঠল, বৃদ্ধা তার যৌবনের গল্প করছেন। ক্রাসিমা বৃদ্ধা থেকে চোখ ফিরিয়ে মানিকের দিকে তাকাল, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা দুটি চোখ তার মুখ পড়ছে। ক্রাসিমা আরো রাঙ্গা হয়ে গেল। মানিকও মনে মনে লজ্জিত হলো, নিজের অসচেতন-অবিবেচক চোখ দুটিকে অভিশাপ দিতে লাগল। কে যেন গান ধরল, মারমা ভাষায়। দুই-একটা পাখির ডাক এদিক-সেদিক থেকে ভেসে আসছিল, বাকি সব কিছু নীরব। বাতাসও যেন থমকে গিয়েছিল, এই পাহাড়ি গ্রামে করুণ সুরে গান শুনে। গানের একটা কথাও মানিক বুঝেনি, কিন্তু তার বুকে উথাল-পাথাল ঢেউ বইয়ে দিল সুরটা। গান শেষ হওয়ার পরও কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল সবাই, রেশটা শেষ কতে চায়নি কেউ, নীরবতটাও যেন গানেরই অংশ। মানিক ঘাড় ঘুরিয়ে আড়চোখে ক্রাসিমার দিকে তাকাল, তার গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এসেছে, মুছতে ভুলে গেছে সে।

    আসর শেষ হয়েছে অনেক আগেই, কাজাচাই মানিককে ছেড়ে যাবে না। সে মানিকের ঘরে ঘুমাচ্ছে, সবাই ঘুমাচ্ছে। শুধু মানিক জেগে আছে। বারান্দায় বসে দীর্ঘশ্বাসের হিসাব মিলাচ্ছে। ক্রাসিমার ঢেউ খেলা চেহারাটা বারবার মনে পড়ছে, দীর্ঘশ্বাসগুলোও আরো গভীর হচ্ছে। হঠাৎ রাতের অন্ধকার চিরে একটা কান্না ভেসে এলো তার কানে। একি কোনো অশরীরী, যার বেদনাহত আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ে? আবার শুনল, তার ঘরের পেছনে আমলকী গাছের আড়ালে ছোট একটা পরিত্যক্ত ঘর আছে। সেখান থেকে কান্না ভেসে আসছে। সন্তানহারা মায়ের কান্না।

    .

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleও হেনরি রচনাসমগ্র
    Next Article তেইল্যা চোরা – ওবায়েদ হক

    Related Articles

    ওবায়েদ হক

    তেইল্যা চোরা – ওবায়েদ হক

    July 17, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.