Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীল পাহাড় – ওবায়েদ হক

    ওবায়েদ হক এক পাতা গল্প166 Mins Read0

    নীল পাহাড় – ৯

    নয়

    থুইনুপ্রু মানিকের দিকে না তাকিয়েই সিগারেট টেনে চলেছে, ফাইভ ফাইভ সিগারেট। পাতার বিড়ি ফুঁকা পাহাড়িদের কাছে বিলাসিতাই বটে। গতকালের প্রচ্ছন্ন হুমকিটা ভুলেনি সে, তার মাথায় খেলা করছে মুক্তির চিন্তা। পাহাড় পেরিয়ে সাঙ্গু নদীর ঘাট, তারপর মা। থুইনুপ্রু দিকে তাকিয়ে বলল—

    এখনো লাল আছে, ক্ষতটা কালো কিংবা সবুজ হতে শুরু করলেই বিপদ। আর একদিন ব্যথাটা সহ্য করুন, আমার মনে হয় আপনার পা ঠিক হয়ে যাবে।

    একটা সাদা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল পা-টা। খায়াচিং আরো পাতা নিয়ে ঘরে ঢুকলো তার পেছনেই ক্রাসিমা। ক্রাসিমাকে দেখেই মানিকের বুকটা যেন ভারী হয়ে গেল, সব স্বাভাবিকতা এলোমেলো হয়ে গেল, গতকাল রাত থেকেই সব এলোমেলো হয়ে গেছে। এই ক্রাসিমা যেন সেই আগের ক্রাসিমা নয়। মানিক নিজেকে সামলে খায়াচিংকে বলল—

    এখন আর কোনো পাতা লাগবে না।

    খায়াচিং কিছু বলল না, তার বোধ হয় একটু মন খারাপ হলো, সে পাতাগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। মানিক আর ক্রাসিমার দিকে তাকাল না, থুইনুপ্রুকে বিশ্রাম করতে দিয়ে সে বেরিয়ে এলো। তারপর ক্রাসিমার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল-

    আর কোনো পাতা লাগবে না তো, ওগুলো ফেলে দাও।

    ক্রাসিমা একটু হেসে বলল-

    এগুলো আপনার জন্য, আপনি রাতে ঘুমাতে পারেন না, কাজাচাই বলেছে। খায়াচিং বলেছে এই বেল পাতা বালিশের নিচে রাখলে ঘুমের আর কোনো সমস্যা হবে না।

    মানিক ক্রাসিমার দিকে তাকিয়ে বলল—

    আমার বালিশের নিচে বেল পাতা রাখলে কি কাজাচাই-এর নাক ডাকা বন্ধ হবে?

    ক্রাসিমা খিলখিল করে হেসে দিল, মানিক অপলক দেখল সে হাসি, এত সুন্দর করে হাসতে আর কাউকে দেখেনি সে।

    ক্রাসিমা হাসি থামিয়ে বলল—

    শুধু কাজাচাই-এর নাকডাকার জন্যই ঘুমাতে পারেননি?

    মানিক বলল—

    না ঠিক তা নয়। কান্নাও শুনেছিলাম, গভীর রাতে কে যেন কাঁদছিল।

    ক্রাসিমার মুখটা মুহুর্তেই বদলে গেল, বিষাদ ভর করল তার উচ্ছল চেহারায়। বলল—

    উমে, খুব দুঃখী মেয়ে। দিনে কাঁদে না কেউ শুনে ফেলবে সেই ভয়ে। সবাই ঘুমিয়ে গেলে মনের দুঃখে কাঁদে।

    মানিক বলল—

    কী হয়েছে তার?

    ক্রাসিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—

    তার সন্তানের মৃত্যুর দিন গুনছে।

    মানিক ভ্রু কুঁচকে বলল—

    মানে?

    ক্রাসিমা বলতে লাগল—

    উমে থাকত নাইক্ষ্যংছড়িতে। বাবা মা ছিল, ছোট একটা ভাই ছিল। সবাই মরেছে বাঙালি স্যাটেলরদের হাতে। আর্মির বন্দুক তাদের বাঁচায়নি, তামাশা দেখেছে। তাকেও মেরে ফেলেনি, কিন্তু উমের দুর্ভাগ্য সে মরেনি। পনেরোটা নগ্ন লাশের উপর শুয়ে ছিল সে, যারা ধর্ষণ করে তার গলা টিপেছিল, তারা আর একটু ধৈৰ্য্য ধরলেই মেয়েটা বেঁচে যেত, মানে মরে যেত। সে মরেনি, তবে মরতে চেয়েছিল, মেয়েটা আমাকে সব বলেছিল। এখানে এসে যখন জানলো তার পেটে আরো একটা জীবন আছে তখন আর মরতে পারেনি সে। কিন্তু কোনো বাঙ্গালির সন্তানকে পাহাড়িরা মেনে নেবে না। তারা উমেকে আশ্রয় দিয়েছে তার বাচ্চাকে নয়। বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথেই বাচ্চাকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হবে। উমে প্রতি রাতেই তার পেটে হাত বুলিয়ে কাঁদে, যত দিন তার সন্তান তার পেটে আছে তত দিন সে নিরাপদ। একটা দিন চলে যায় আর একটা দিন কমে যায় তার বাচ্চার জীবনের।

    বলতে বলতেই ক্রাসিমার চোখ ছলছল করে উঠল।

    মানিক বলল—

    কেউ কি এত নিষ্ঠুর হতে পারবে? এটা তো উমেরও সস্তান, সে তো পাহাড়ি। হয়তো বাচ্চা হওয়ার পর একজন পাহাড়ি সন্তানকে নদীতে ভাসানোর কথা কারো মাথায়ই আসবে না, সবাই ভুলে যাবে।

    ক্রাসিমা বলল—

    ভুলে যাবে না, কোনোদিন ভুলেনি।

    আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, তখনি চিৎকার করে এলোমেলো চুলে একটা মেয়েকে দা হাতে নিয়ে ছুটতে দেখা গেল। মেয়েটার চুলগুলো ঘরের ছাদ থেকে ঝুলে পড়া ছনের মত, ধূলিমাখা খামি পরে আছে, তার বুক খোলা, সে থুইনুপ্রুর নাম ধরে ডাকছে—

    সম্ভবত তার জন্যই এই দা। হঠাৎ মানিকের সামনে এসে থেমে গেল, তার দিকে তাকিয়ে বলল—

    আমার পোলা কই? আমার দুধ খাইব কে? তার ভূক লাগে না?

    খায়াচিং পেছন থেকে ছুটে এসে দা-টা হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল। মেয়েটির বুকটা ঢেকে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে গেল। বার দুয়েক হাত দিয়ে চোখ মুছল সে। মানিক হতবিহ্বল হয়ে আছে, খায়াচিং-এর চলার পথের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল—

    এই মেয়েটা কে?

    ক্রাসিমা বলল—

    উথাই।

    .

    উথাইয়ের দা হাতে করে ছুটে চলা আর তার পেছনে খায়াচিং, দৃশ্যটি এই গ্রামে সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্য। প্রথম প্রথম সবাই আঁতকে উঠত, বাচ্চারা ভয়ে মায়ের পেছনে লুকাত, বাঁশের হুঁকো ফেলে বৃদ্ধরা ছুটে আসত, মহিলারা চেঁচামেচি করে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তুলত। এখন খায়াচিং ছাড়া কেউ বিচলিত হয় না, থুইনুপ্রুও না। উথাই থুইনুপ্রুর সামনে পড়েছিল একদিন, থুইনুপ্রুর গাম্ভীর্যের কাছে টিকতে পারেনি, হাত থেকে দা ফেলে কেঁদে দিয়েছিল। সেই থেকে সবাই নিশ্চিন্ত হয়েই থাকে। থুইনুপ্রু তাদের মাথা, তিনি সবচেয়ে ভালো বুঝেন। গ্রামের প্রতিটা মানুষ এই কথাটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে।

    পাঁচ মাসের সন্তান পেটে নিয়ে উথাই তখন বিতাড়িত। খায়াচিং ছাড়া সবাই ফিরিয়ে দিয়েছে। খায়াচিং উথাইকে নিয়ে চলে এসেছিল এই গ্রামে। কিন্তু থুইনুপ্রুর কাছে কিছু লুকাবার উপায় নেই, সে ঠিকই উথাইয়ের ইতিহাস জেনেছিল। তবুও সে দয়া করে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। শর্ত ছিল বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে হবে, সবার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল, একটা নিষ্পাপ, নির্দোষ শিশুকে হত্যা করা হবে ভেবে। থুইনুপ্রু সেদিন গলা উঁচু করে বলেছিল, আমরা যুদ্ধ করছি, আমাদের শত্রু আমরা চিনি। ঘরে শত্রু নিয়ে যুদ্ধ চালানো যাবে না। তারা এভাবেই আমাদের শেষ করতে চায়। এরকম মন নরম করে রাখলে একটার পর একটা ঘটনা ঘটতেই থাকবে, কত পাহাড়ি মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে প্রতি বছর? তারা পরিকল্পনা করে এসব করছে। তাদের বীজ আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। একসময় মারমা-পাহাড়ি কিছুই থাকবে না, থাকবে শুধু বাঙালি।

    সবার চোখের সামনে যেন সব ষড়যন্ত্র পরিষ্কার হয়ে গেল, বৃষ্টি শেষে সবুজ পাহাড়ের মতো। মনের ভেতর একটু খচখচানি থাকার পরও থুইনুপ্রুর কথার উপর কেউ কথা বলতে পারে না, সেই সবচেয়ে ভালো জানে, ভালো বুঝে, সে-ই তাদের মধ্যে একমাত্র ছিক্কিত (শিক্ষিত)।

    আংসাই নিজ হাতে নদীতে ডুবিয়েছিল বাচ্চাটাকে। উথাই জানতেও পারেনি তার ছেলে হয়েছিল নাকি মেয়ে? সেই শোক সে ভুলেনি, একবারও দুধ খাওয়াতে পারেনি তার সন্তানকে। উথাইয়ের চোখে সে জ্বালা আগুন হয়ে জ্বলে। চোখে পানি নেই তার, থাকলে হয়তো আগুন কিছুটা হলেও নিভত। নদীর পানির বুদবুদে তার বাচ্চার চিৎকার থেমে গিয়েছিল, দুধের জায়গায় মুখে নদীর পানি ঢুকেছে। যে নদী মায়ের বুকের দুধের মতে পাহাড়িদের জীবন বাঁচায়, সে নদী তার সন্তানকে হত্যা করেছে, আরো কত সন্তানকে না জানি হত্যা করেছে। থুইনুপ্রু সাঙ্গু নদীকে খুনি করেছে, তার জন্যই সব ক্ষোভ উথাইয়ের কিন্তু সে খুনি হতে পারে না। পারলে অনেক আগেই থুইনুপ্রুর বসন্তের দাগে ভরা মুখটি রক্তে ভেসে যেত।

    .

    শীতকাল নয় এখন কিন্তু কুয়াশার শীতল পরশ অনুভব করছে মানিক। কুয়াশা কেটে সে হাঁটছে, একটু পরেই বুঝতে পারল এগুলো কুয়াশা নয়, মেঘ। বৃষ্টি হওয়ার আগে সব অহংকার ছেড়ে দিয়ে মেঘ পাহাড়ে নেমে আসে। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকে, যেন অভিমান ভাঙাচ্ছে পাহাড়ের। মানিক বাতাস টেনে বুক ভরে মেঘ ঢুকিয়ে নিল। ভোরবেলার মেঘের মঞ্চে আরো দুটি চরিত্র আছে, একজন জানালা দিয়ে তাকিয়ে নিজের বাবাকে খুঁজছে মেঘে, প্রতিদিন চোখ পাতে সে এই পথে। মানিককে দেখে এক মুহুর্তের জন্য উচ্ছল হয়ে গিয়েছিল, মনে হলো যেন বাবার ছায়া খুঁজে পেয়েছে। আরেকজন বাকি দুই চরিত্রের চোখ আড়াল করে মেঘের আবরণে হেঁটে চলেছে মানিকের পিছু। পাহাড়ের উপর গিয়ে দাঁড়াল মানিক, চোখ ছোট করে খুঁজছে আঁকাবাকা একটা রেখা, সাঙ্গু নদীর রুপালি স্রোতের রেখা। মেষের জন্য দৃষ্টি বেশি দূর যায় না, তবুও মানিক দাঁড়িয়ে থাকে, মেঘ ভরে নেয় বুকে।

    মেঘ কাটতে শুরু করেছে, কোথাও গিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরবে হয়তো। মানিক দেখল, তার পাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানিক ক্ষণিকের জন্য আঁতকে উঠল। মেঘের পর্দার জন্য এতক্ষণ দেখা যায়নি মেয়েটাকে। মুখে কোমল, নিষ্পাপ ভাব আছে, তার গালে দুটি অশ্রু রেখা দেখা যায়, এই দাগ বোধহয় আর মুছবে না। মেয়েটির পেট দেখে বুঝা যায়, সে সন্তানসম্ভাবা। মানিক কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল—

    তোমার নাম কি উমে?

    মেয়েটি ঘাড় কাত করল, তারপর চুপ করে রইল। মানিক বলল—

    কিছু বলবে আমাকে?

    মেয়েটি হঠাৎ কেঁদে দিল, দুই হাত একসাথে করে মাথা নুইয়ে বলল—

    আমার বাচ্চাটারে বাঁচান ডাক্তার বাবু।

    মানিক ইতস্তত করে বলল—

    আমি কী করে বাঁচাব বলো, আমি নিজেই মরতে বসেছি।

    উমে বলল—

    আপনি পারবেন বাবু, আপনি শুধু ঐ থুইনুপ্রুর ওষুধে একটু বিষ মিশাইয়ে দিলেই হবে, কেউ কিছু বুঝব না।

    মানিক মাথা নাড়িয়ে বলল—

    না আমি তা পারি না, আমি ডাক্তার, খুনি নই। আমি মানুষ মারি না, বাঁচাই।

    হঠাৎ উমে মানিকের হাতটা ধরে তার পেটের উপর রাখল, বলল—

    ডাক্তার বাবু, এইটাও মানুষ। এইটারে বাঁচান। আমার আর কেউ নেই বাবু, এইটা ছাড়া।

    মানিকের শরীর শিহরিয়ে উঠল, বাচ্চাটা নড়ছে। দূরে একটা গুঞ্জন শুনে দুজনেই সচকিত হয়ে তাকাল, পাহাড়ের গা বেয়ে কিছু মানুষ নেমে আসছে। অনায়াসে বড় বড় বোঝা নিয়ে মারমা ভাষায় ছড়া কাটতে কাটতে পাহাড় বেয়ে আসছে তারা, সবার সামনে মংতো। উমে মানিকের দিকে আকুতি মাখা দৃষ্টি দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।

    .

    থুইনুপ্রুর মুখে খুব কম মানুষ হাসি দেখেছে, মানিক তাদের মধ্যে একরুন। নিজের পাটা একটু নাড়াতে পারছে সে, ব্যথাটা অনেক কম এখন। মানিক সাধারণত অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা বলে না থুইনুপ্রুর সাথে, থুইনুপ্রুও বলে না। কিন্তু আজ সে নিয়ম ভঙ্গ করল থুইনুপ্রু। একটু হেসে বলল—

    ডাক্তার বাবু আপনার ফেরার সময় বোধহয় আর দেরি নয়।

    মানিক গম্ভীর হয়ে বলল—

    হুম আর বেশি দিন লাগবে না, আমার ভিজিট ফি দিবেন না?

    থুইনুপ্রু মুখে হাসিটা ধরে রেখেই বলল—

    কী চান?

    মানিক বলল—

    উমের সন্তানের জীবন চাই।

    মুহূর্তেই থুইনুপ্রুর মুখটা হিংস্র হয়ে উঠল, তার নষ্ট চোখটা পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরে বলল—

    আপনি নিজের জীবন নিয়ে ফিরে যাবেন এটাই আপনার ভিজিট। আমাদের নিজস্ব ব্যাপার নিয়ে আপনার কোনো কথা না বললেও চলবে, না হলে হয়তো এইটাও পাবেন না।

    মানিক কিছু বলল না। চোয়াল শক্ত করে পায়ে ড্রেসিং করতে লাগল।

    .

    চঞ্চল ফিঙের মতো চট করে একপলকেই দিন উড়ে চলে যায় মানিকের। রাতটা মনে হয় অনাথ আশ্রমের খাবারের লাইনের মতো, একেবারে শেষে দাঁড়িয়ে থাকা মানিকের মনে হয় সে লাইন আর শেষ হবে না। উমের কান্না রাতের ক্লেশ আরো বাড়িয়ে দেয়।

    ভোরবেলা সে মুক্তির পথ খুঁজে পাহাড়ে কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না, মাঝে মাঝে দূরে মেঘের দেয়ালে ক্রাসিমার চেহারাটা ভেসে ওঠ। নিজেকে ধিক্কার দেয় মানিক, কিন্তু তবুও চেয়ে থাকে মেঘের দিকে।

    এই গহিন পাহাড়ে একটা দিন থেকে অন্য একটা দিন আলাদা করা যায় না, প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটে এখানে। গুটি কয়েক পুরুষ ছাড়া এখানে শুধু নারী, বৃদ্ধ আর বাচ্চারা থাকে। ঢাকার পাশে এরকম একটা গ্রামে গিয়েছিল মানিক। সেখানে কোনো পুরুষ নেই।

    পরে শুনেছিল গ্রামে কার নামে যেন মামলা হয়েছিল, পুলিশ আসবে শুনে সব গ্রামছাড়া হয়েছে। বাচ্চারা ভূত প্রেত রাক্ষস ভয় পায়, আর বড় হলে পুলিশকে ভয় পায়। কিন্তু এই গ্রামে পুলিশের ভয় নেই, নারীদের মধ্যে আতঙ্ক নেই, শুধু কিছু মানুষ চোখ ভেজায় দুঃখে আর স্বস্তিতে, নিজের ঘর হারানোর দুঃখে আর নতুন ঘর পাওয়ার স্বস্তিতে। বাচ্চারাও মাঝে মাঝে পুরনো বন্ধুর স্মৃতিতে কাতর হয়ে পড়ে, খেলার সময় নতুন বন্ধুকে পুরনো বন্ধুর নামে ডেকে ফেলে, তারপর একটু নীরব হয়ে যায়, সেই পুরনো বন্ধুর রক্তমাখা চেহারা মনে পড়ে যায়। বুড়োরা হুঁকো টানে আর বুড়িরা শুধু গল্প করে, কেউ আশেপাশে না থাকলে নিজে নিজেই গল্প করে, তাদের গল্পগুলো বেশিরভাগই দুঃখের গল্প। নিজে নিজেই কেঁদে ওঠে গল্প বলতে বলতে।

    কিন্তু আজকের দিনটা আলাদা। পায়ে শুকনো মাটি মাখা একটা পুরুষের দল গ্রামে হাজির হয়েছে। তাদের মুখে দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্তি আর যাত্রা শেষে তৃপ্তি দেখা যাচ্ছে। গ্রামে যেন রং লেগেছে, মলিন কাপড় ছেড়ে মেয়েরা রঙিন পাট ভাঙা খামি পরেছে, কপালে চন্দন ফোটা দিয়েছে, ঠোটে লাল জর্দা রং ছুঁইয়েছে, হাতে বৈসাবীর সময় কেনা চুড়ি পরেছে। বুড়িরা তবুও কাঁদছে তবে তা দুঃখের বলে মনে হচ্ছে না, কিন্তু বুড়োরা হুঁকো টানায় ইস্তফা দেয়নি, আনন্দে-দুঃখে এই হুঁকোই তাদের সব সময়ের সঙ্গী, সবচেয়ে আপন, সম্ভবত বউয়ের চেয়েও বেশি। তারা হাসি মুখে হুঁকো টানছে। বাচ্চাদের আনন্দের সীমা নেই, তারা উল্টাপালটা স্লোগানে একটা মিছিলও করে ফেলল। মিছিল জমল না, কারণ সবাই আলাদা আলাদা স্লোগান দিচ্ছে। মানিক অবাক হয়ে সব দেখছে, এত আনন্দ একসাথে দেখেনি সে কখনো। বাচ্চাদের মিছিল পেরুনো মাত্র ক্রাসিমা এলো। তার চুল রঙিন ফিতা দিয়ে বাঁধা, তাতে আবার নীল রঙের ফুল গোঁজা আছে। তার চোখ দুর্গার মতো নয়, কবিরা তার চোখের উপমা দিয়ে যাননি কিন্তু তার চোখে যা আছে তা হলো সাঙ্গুর গভীরতা আর ছলছল জল। মানিক সেখানে ডুবে যায় আবার ভাসে। হাবুডুবু খেতে খেতে সে ক্রাসিমাকে জিজ্ঞাসা করে—

    আজ কী?

    আজ উৎসব।

    কিসের উৎসব?

    আজ সব পুরুষেরা দক্ষিণের পাহাড় থেকে ফিরে এসেছে, অনেক দূরে পাহাড়ের পাশে সমতল জায়গায় চাষবাস করে তারা। এখানেই থাকে বছরের ছয় মাস। ওরা ফিরে আসলে উৎসব হয়। আমারও এটা প্রথম উৎসব।

    তোমার চুলে এটা কী ফুল?

    এটার নাম নীলাতা, মংতোদা এনে দিয়েছে। আজ সন্ধ্যায় আসল উৎসব শুরু হবে, মংতোদা বাঁশি বাজাবে। উনি খুব ভালো বাজায়, যে কেউ শুনলে থমকে যায়। আমার উপর খাবারের দায়িত্ব পড়েছে, আমার খুব ভয় লাগছে। আচ্ছা এখন যাই।

    কেন যেন মানিকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ক্রাসিমার নতুন জামা, চুলের ফিতা আর নীলাতা ফুলের উৎস যে একই তা মানিক ক্রাসিমাকে না জিজ্ঞাসা করেই বুঝে ফেলল। সবার মধ্যে একটা কর্মব্যস্ততা, সবাই কিছু না কিছু করছে। কিন্তু মানিকের কিছু করার নেই, সে বাঁশিও বাজাতে জানে না, সে তাদের লোক নয়। সে এক বন্দি ডাক্তার, যে পালানোর ফন্দি আঁটছে।

    .

    সন্ধ্যাটায় রং আরো বেড়ে গেল। আগুনের কুণ্ডলীটাকে কেন্দ্র করে বৃত্তটা আজ অনেক বড়। থুইনুপ্রুকে আনতে গিয়েছিল মংতো, কিন্তু সে আসেনি। সে আর উমে ছাড়া বাকি সবাই আছে এই বৃত্তে। খাবার দেয়া হলো, মুরগি আর চালতার একটা স্যুপ বানানো হয়েছে, সবজি দিয়ে একটা পদ বানানো হয়েছে যেটার নাম তোহজা, আর নাপ্পির তরকারি যেটা শুঁটকি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। গোল করে পাতার বাসনে সবাই খেল, আহামরি কিছু হয়নি কিন্তু সবাই চেটেপুটে খেলো। চেটেপুটে খাওয়ার দৃশ্যটা ক্রাসিমা মন ভরে দেখল। মানিকের দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি আজ সে, মানিক বারবার একটা দৃষ্টির জন্য মুখিয়ে ছিল, একটা হাসি ভরা দৃষ্টিতে তার উৎসব হয়ে যেত। কিন্তু ক্রাসিমা তাকায়নি। তারপর তামাক খেল সবাই, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তামাক খেল, মানিকের দিকে কেউ হুঁকো এগিয়েও দিল না, দিলেও খেত না সে, মানা করত, তখন হয়তো ক্রাসিমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত। কিন্তু মানা করার সুযোগটাও সে পেল না, তার মনে এই বিগ্রহ কাঁটার মতো বিঁধতে লাগল। ক্রাসিমা একবার হুঁকোতে টান দিয়েই কাশতে লাগল আর তার কাশি দেখে সবাই হেসে অজ্ঞান। ক্রাসিমা মংতোর পাশেই বসেছিল, ইচ্ছে করে বসেছে নাকি উপর থেকে কেউ এই দুটি প্রাণীকে এই বিশেষ মুহূর্তে একসাথে এনে ফেলেছে কে বলতে পারে। দক্ষিণের পাহাড় থেকে আসা পুরুষেরা তাদের বউয়ের পাশে বসেছে, তাদের মুখগুলো লাজুক লাজুক। এদিক-সেদিক দেখার ভান করে একজন আরেকজনকে দেখছে। মংতো তার বাঁশি বের করল, সবাই চুপ হয়ে গেল। হাসির শব্দ নিমিষেইে বাতাসে দ্রবীভূত হয়ে গেল। মংতো শুরু করল। কী হৃদয়কাড়া করুণ সুর, সুরে যেন পাহাড়ের গন্ধ লেগে আছে। ক্রাসিমা নেশাহত দৃষ্টিতে মংতোর দিকে চেয়ে আছে।

    মানিকের মনে হলো এরা সবাই একটা পাখির পালক, একটার সাথে আরেকটা কী অদ্ভুত মিল, কী গোছানো! ক্রাসিমা আর মংতো যেন রঙিন সে পাখির একই রঙের দুটি পালক। ক্রাসিমা আর মংতোকে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তির মতোই লাগছে। মানিক নিজেকে আর আরোপিত করে পাখির পালকগুলোকে বেমানান করল না। সে উচ্ছিষ্ট, সারাজীবন তাই ছিল, এখনো তাই আছে।

    সে চলে এলো আসর ছেড়ে, তাতে আসরের কোনো ক্ষতি হলো না। গ্রামের এক পাশে পাহাড়ে বসে আছে সে, চাঁদটার জন্য অপেক্ষা করছে। গ্রাম থেকে মৃদু কোলাহল ভেসে আসছে, নাচ-গান হচ্ছে এখন। মৃদু কোলাহলটা তার একাকিত্বটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

    ঘাসের উপর শরীরটাকে সঁপে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। আকাশে ধীরে ধীরে মেঘ জমছে।

    .

    কোলাহলটা ধীরে ধীরে মিইয়ে গেছে, মানিক খেয়ালও করেনি। মোহাবিষ্ট হয়ে আকাশ দেখছে সে। হঠাৎ চুড়ির শব্দে তার মোহভঙ্গ হলো, ক্রাসিমা এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। মানিক উঠে বসল। ক্রাসিমা মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল—

    একা একা জোছনা দেখেন?

    আমি একা একাই দেখি।

    কিন্তু আমি কখনো একা দেখি না।

    বলতে বলতেই মানিকের পাশে এসে বসল। ব্যস্ত রাস্তায় ছোট্ট ছেলেটার মতো রাস্তা পার হতে পারছে না যেন চাঁদটি। মেঘেরা ছুটে যাচ্ছে তার সামনে। পাহাড়ে মেঘের ছায়া পড়ছে, আবার সরে যাবে, মনে হচ্ছে চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়ে আবার টেনে নিচ্ছে। সেই চাদরের নিচে দুটি মানুষ চুপচাপ বসে আছে, তাদের মনে অনেক দ্বিধা, অনেক প্রশ্ন। মেযেদের ষড়যন্ত্রেই কিনা, হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো, চাঁদটা মেঘকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোঁটা যেন এক একটি জোছনার কণা। মানিক-ক্রাসিমা দুজনেই অভিভূত হয়ে গায়ে জোছনা মাখছে। মানিক নিজের সংশয় জোছনায় ধুয়ে ফেলে বলল—

    তুমি কি জানো মংতো তোমাকে অনেক পছন্দ করে?

    আমাকে সবাই পছন্দ করে।

    তোমাকে আর মংতোকে পাশাপাশি খুব মানাবে।

    সবাই তো তাই বলে।

    তুমি কি বলো?

    ক্রাসিমা কিছু বলল না, দুই হাত ছড়িয়ে ঘাসে শুয়ে পড়ল, চাঁদের কণা গায়ে মাখতে লাগল। মানিকও শুয়ে পড়ল দুই হাত ছড়িয়ে, সে জানতেও পারল না, ক্রাসিমার চোখের কোণে শুধু বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে না, সেখানে অশ্রুও ছিল।

    বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, মেঘেদের দৌরাত্ম শেষ। জোছনা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো পাহাড়ে। সব কিছু আরো স্পষ্ট, আরো পবিত্র লাগছে। ক্রাসিমা মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল—

    আপনি সব সময়ই একা একা জোছনা দেখেন? কোনো সঙ্গী নেই আপনার? আমি বাবার সাথে দেখতাম।

    আমি তো অনাথ, কোনো আপনজন নেই, সঙ্গি নেই।

    কেউ আপনাকে আপন করতে চায়নি?

    জানি না কিংবা বুঝিনি, আমি তখন আমাকে খুঁজছিলাম।

    একটু থেমে মানিক আবার বলা শুরু করল—

    তখন আমি আমার মা-বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলাম, চকের সাদা আঁচড়ে আর কলমের কালিতে। অনাথ আশ্রমে সব কিছুই সীমিত, দোয়াতের কালিও তাই। আমার কালি সব মায়ের নামেই ঢেলে দিতাম। ক্লাসে লেখার জন্য কালি অবশিষ্ট থাকত না। পণ্ডিত বাবু দাঁড় করিয়ে রাখতেন। আমি জানতাম না পেছনের বেঞ্চে এক জোড়া চোখ আমার জন্য জল ফেলত। একদিন দেখি আমার বেঞ্চে কডলিভার তেলের শিশিতে এক শিশি কালি রাখা আছে। কালি পেয়েই আমি খুশি, পণ্ডিত বাবুর ক্লাসে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটতে লাগল। একদিন তাকে দেখলাম, আমার বেঞ্চে খালি শিশিটাতে কালি ঢালছে, আমার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় দৌড়ে পালিয়ে গেল। পেছনের বেঞ্চের এই শ্যামলা মেয়েটিকে আগে কখনোই খেয়াল করিনি। যেদিন থেকে আমি পণ্ডিত বাবুর ক্লাসে বসে কাটাতাম সেদিন থেকে সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকত তাও আমার চোখে পড়েনি। আমার রেজাল্ট খুব ভালো হলো, মেয়েটি ছিটকে পড়ল। একদিন লাজুক মুখে এসে আমাকে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গেল। চিঠিতে কিছুই লেখা ছিল না, সাদা চিঠি।

    আমি কিছুই বুঝিনি। পরে বুঝেছিলাম, তার কাছে কালি ছিল না, সব তো আমাকেই দিয়ে দিয়েছে। তার চিঠি অসম্পূর্ণ ছিল না। সে কডলিভারের শিশিতে তার শব্দগুলো ভরে পাঠিয়েছিল। সাদা চিঠির অর্থ হলো আমি যা চাই লিখতে পারি, সব কিছু সে আমার উপরই সঁপে দিয়েছিল।

    ক্রাসিমা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। মানিক থামতেই বলল—

    সে এখন কোথায়?

    মানিক আবার বলল—

    একাত্তর সালে আমাদের আশ্রমে পাকিস্তানিরা হামলা করেছিল, সব কাগজপত্র নষ্ট করে দিয়ে যায়, তাতে খুব একটা সমস্যা হয়নি কিন্তু যাওয়ার সময় মেয়েদের নিয়ে যায়। মাসিরা অনুনয় করে বলেছিল, এরা বাচ্চা মেয়ে। তারা শুধু হেসেছিল। সেই মেয়েরা আর আশ্রমে ফিরে আসেনি। তবে তার সাথে আমার আরো দুবার দেখা হয়েছিল। প্রথমবার, অতিরিক্ত সেজেছিল সে, ঠোঁটে লাল কড়া লিপস্টিক, পাউডারের কারণে তার শ্যামলা রংটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সে হতবিহ্বল হয়ে আমার চেম্বারে বসে ছিল। তার পোশাক-সাজ কিছুই তার দৃষ্টির সাথে মানাচ্ছিল না। সেই প্রথম আমি তার সাথে কথা বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছো? সে শুধু হাসল। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় থাকো? সে বলল, আমি যেখানে থাকি সেখানের ঠিকানা লোকদের না জানলেই ভালো। হাহাকার করেছিল মনটা। সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে তোমার? সে বলল, ‘কিছু হয়নি’। বলেই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর অনেক দিন দেখিনি তাকে; যেদিন আবার দেখা হলো, সেদিন তার মুখে কোনো সাজ ছিল না—

    তবুও শ্যামলা রংটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল, চোখে গাঢ় কাজল ছিল না, ঠোটে কোনো লিপস্টিকও ছিল না। সে দুটো খুন করেছিল, নিজের পেটের বাচ্চাকে আর নিজেকে। মর্গে শুয়ে ছিল সে। সেটাই তার সাথে আমার শেষ দেখা।

    ক্রাসিমা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে মানিকের দিকে। তারপর জিজ্ঞাসা করল—

    সে সাদা চিঠিতে আপনি কী লিখেছিলেন?

    আমার মায়ের নাম, যদিও পরে জেনেছি সেই মা আমার জন্মের পঞ্চাশ বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি মা চেয়েছিলাম, মা পেয়েছিলামও।

    ক্রাসিমা বলল—

    পেয়েছিলেন মানে?

    মানিক উঠে দাঁড়াল, মৃদু বাতাসে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। ক্রাসিমার দিকে তাকিয়ে বলল—

    তুমি জানতে চেয়েছিলে না সেই চিঠির কথা, যেটা আমার জামার পকেটে ছিল। তুমি চাইলে এখন তা পড়তে পারো।

    মানিকের ঘরের বারান্দায় হারিকেন জ্বালিয়ে বসে আছে ক্রাসিমা আর মানিক। শুকনো চাদরে নিজেদের ঢেকে নিয়েছে তারা। সবাই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে, চারদিকে নিস্তদ্ধ্বতা। মানিক ভাঁজ খুলে চিঠিটি ক্রাসিমার দিকে এগিয়ে দিল। ক্রাসিমা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল—

    .

    স্নেহাম্পদ মানিক,

    এই চিঠি আমি গত বিশ বছর ধরে লেখার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারিনি। আমি দরিদ্র মানুষ, আত্মমর্যাদা ছাড়া কিছুই নেই আমার। নিজের বিবেকের সাথে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আজ করলাম, কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম না আজ। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলাম।

    তোমার চোখেমুখে নিজের পরিচয়ের জন্য যে আকুতি আমি দেখেছি সেই তুলনায় আমার প্রতিজ্ঞা কিছুই না।

    নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে আজ আবার আনন্দও হচ্ছে। আমি এই চিঠি লিখেছি কিন্তু মনে মনে প্রত্যাশা করছি কখনো যেন তা তোমার কাছে না পৌঁছায়। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এই করুণাটুকু আমায় করতেই পারে।

    তোমার মাতামহের সাথে আমার পরিচয় ছিল, তার নাম ছিল নগেন্দ্র চক্রবর্তী। ব্রাহ্মণ ছিলেন, পূজা-অর্চনা করতেন। খুব রসিক মানুষও ছিলেন, আমি চায়ের দোকানে যেতাম শুধু উনার গল্প শুনতে। তার মেয়ে অর্থাৎ তোমার মা, ছিল তার মতোই উচ্ছল স্বভাবের, নাম ছিল চঞ্চলা চক্রবর্তী। নামের মতোই চঞ্চল ছিল সে। কিন্তু হঠাৎ চঞ্চলা কেমন কুঁকড়ে যায়, পেয়ারা গাছে ডাসা ডাসা পেয়ারা কিন্তু চঞ্চলার অবহেলায় সেগুলো গাছেই ঝুলে রইল, ঘুড়ি কেটে যায় কিন্তু তার পেছনে চঞ্চলা ছুটে বেড়ায় না। নগেন্দ্র বাবুও কেমন নির্জীব হয়ে গেলেন, চায়ের আড্ডায় আসেন না। আসলেও অনিচ্ছায় দু’চুমুক দিয়ে আবার চলে যান। এর মধ্যেই আমি ঢাকায় অনাথ আশ্রমে চাকরি নিয়ে চলে এসেছি। একদিন রাতে হঠাৎ নগেন্দ্র বাবু অনাথ আশ্রমে উপস্থিত। তাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম, খুশিও হয়েছিলাম। তাকে বসতে বলার সাথে সাথেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলেন। আর বলতে লাগলেন আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেল চন্দন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে? তিনি বললেন, “তোমাকে বিশ্বাস করি, আপনও মনে করি তাই তোমার কাছেই আসলাম, আমাকে তুমি উদ্ধার করবে জানি।” তারপর বললেন, “চঞ্চলা সেদিন ঘুড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে কেশবপুর চলে গিয়েছিল, তুমি তো জানোই আমার মেয়েটি কেমন চঞ্চল। সে যে বড় হয়েছে তা সে বুঝে না, মনটা এখনো শিশুর।

    সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। নদীর ধার ধরে সে একা একা আসছিল, তখনি কিছু জানোয়ার তার উপর হামলা করে” বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। আবার বলতে শুরু করলেন “মেয়েটা আমার অনেক কষ্টে বাড়ি এসেছিল সেদিন, দুই দিন মূর্তির মতো বসে ছিল। তার মা তাকে জোরে কাঁদতে নিষেধ করেছে, পাড়া-পড়শি জানলে মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন তো আর উপায় নেই, মেয়ে যে আমার অন্তঃসত্ত্বা। মেয়েকে ঘরের ভেতরই রেখেছি এখন, সবাইকে বলেছি চঞ্চলা মামার বাড়ি গেছে।” তিনি তারপর বললেন, “এই বাচ্চা নষ্ট করার জন্য চেষ্টা করছি, মেয়ের জীবনের কথা চিন্তা করে শুধু বিষ খাওয়ানো বাদ রেখেছি, কিন্তু বাচ্চাটা নষ্ট হচ্ছে না। এই বাচ্চা আসলে আমাদের সমাজ ছাড়া হতে হবে, এই সন্তান যে পাপের সন্তান, জারজ সন্তান। এখন তুমিই আমাদের বাঁচাও। মানুষ খুন করতে পারলে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতাম কিন্তু সেই পাপ করে নরকে যেতে পারব না, তুমি এই বাচ্চাটার ব্যবস্থা করো অনাথ আশ্রমে। যদি কিছু পয়সা লাগে তো দিব, সাধ্যে যা আছে। এই উপকারটুকু করো।”

    আমি বললাম “কিন্তু চঞ্চলা কি রাজি হবে?” নগেন্দ্র বাবু বললেন, “সে ভার তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও, সে কিছু জানবে না যদি তুমি কিছু না জানাও। তার মানসিক অবস্থা ভালো না, সে এখন কিছুই বুঝবে না। ভবিষ্যতে কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলব, মৃত সন্তান হয়েছিল। তুমি ভাই আমায় কথা দাও, কাউকে কিছু বলবে না। ঈশ্বরের কাছে আজীবন তোমার জন্য প্রার্থনা করব” আমি কথা দিয়েছিলাম। আজ সে কথা ভাঙলাম। তোমাকে আশ্রয়ে আনার পর মাস ছয়েকের মধ্যে নগেন্দ্র বাবু পরিবার সমেত কোথায় যেন চলে যান। কাউকে কিছু বলে যাননি। চঞ্চলাকে আমি আর দেখিনি।

    বুড়ো মানুষ, আর হয়তো বেশি দিন বাঁচব না। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। তুমি যখন ছিলে তখন তো নিজেই এসে দেখে যেতে, এখন মাঝে মাঝেই হাসপাতালে যেতে হয়। সেদিন কী যেন হলো, অফিসেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। সবাই মিলে হাসপাতালে ভর্তি করে দিল। আমি যেদিন হাসপাতাল ছেড়ে আসছি সেদিন মহিলা ওয়ার্ডে একজন মানুষকে দেখে থমকে গিয়েছিলাম। বুড়ো হলেও আমার স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখরই আছে। বিছানায় শুয়ে আছে চঞ্চলা চক্রবর্তী, তোমার মা। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, মুখে বয়সের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে, অসুস্থ-অচেতন মুখ, তারপরও আমার চিনতে ভুল হলো না। তার স্বামী, ছেলে, মেয়েরা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে তোমারও থাকার কথা ছিল। তোমার কথা মনে হতেই সব প্ৰতিজ্ঞা ভুলে গেলাম। তাই আমাকে আজ লিখতে বসেছি, তুমি যাতে অন্তত একবার হলেও মায়ের হাতের স্পর্শ পাও। মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের শেষ দৃশ্যে যাতে তুমিও থাকো। মেডিসিন ওয়ার্ডের এগারো নম্বর বেডে সে আছে। তুমি যদি চাও নিজের পরিচয় দিতে পারো আর না চাইলে না দিতে পারো। সে সিদ্ধান্ত আমি তোমার বিবেকের উপর ছেড়ে দিলাম।

    একটা কথা তোমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলি, কারো বীর্যে মানুষ জারজ হয়ে যায় না, পিতার পশুত্বে তুমি পশু হবে না। মানুষ হওয়ার জন্য পিতা লাগে না, মন লাগে, মনুষ্যত্ব লাগে।

    এই বৃদ্ধকে যদি পারো ক্ষমা করে দিও। আমি অনাথ আশ্রম ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছি। অবশিষ্ট কয়েকটা দিন সেখানেই কাটাব। তোমার জন্য সারাজীবন আশীর্বাদ করেছি, বাকি জীবনও করব।

    .

    ইতি

    চন্দন কুমার ভৌমিক

    ঢাকা অনাথ আশ্রম

    .

    চিঠিটা পড়ে ক্রাসিমা মনের ভেতর মানিকের জন্য পৃথিবী সমান মমতা অনুভব করল। নিজের মধ্যে যতটুকু আছে সব উজাড় করে দিতে ইচ্ছা হলো। কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটি ফেরত দিয়ে চুপ করে বসে রইল। মানিক বলল—

    ক্রাসিমা আজ রাতেই আমি চলে যাব। আমাকে যেতেই হবে।

    আপনার মার কাছে যাবেন?

    না মায়ের জন্য নয়, নিজের জন্য যাব। উমের সন্তানের জন্য যাব। বিডিআর ক্যাম্পে গিয়ে তোমাদের সংগঠনের কথা বলে দিব। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসব। তাতে হয়তো উমের সন্তানটা বাঁচবে। আমার সাথে উমের সন্তানটার কোনো পার্থক্য নেই, আমরা দুজনেই জারজ। আরেকজনের দোষে এই বাচ্চার মৃত্যুদণ্ড কেন হবে? সে বাঁচুক মায়ের পরিচয়ে কিংবা নিজের পরিচয়ে।

    ক্রাসিমা বলল, পাহাড়িদের কোনো ক্ষতি হোক তা চাই না। তবুও আমি চাই আপনি যান।

    তোমার সাথে হয়তো আর দেখা হবে না।

    হতেও পারে, তখন আমার হাতে হাতকড়া থাকবে। আচ্ছা আপনার মায়ের সাথে দেখা হলে কি আপনি আপনার পরিচয় দিবেন?

    দিব, শুধু নিজের পরিচয় দিব। আমি ডা. মানিক, এটাই আমার পরিচয়।

    ঠিক আছে, আপনার যাত্রা সফল হোক। শুভ কামনা ছাড়া আপনাকে দেবার মতো কিছুই নেই আমার।

    বলেই ক্রাসিমা বারান্দা থেকে নেমে গেল, তারপর নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল। একবারও ফিরে তাকাল না। দুই-একবার শুধু হাত দিয়ে চোখ মুছলে। মানিক বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল, যতক্ষণ ক্রসিমার ছায়া দেখা যায়।

    .

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleও হেনরি রচনাসমগ্র
    Next Article তেইল্যা চোরা – ওবায়েদ হক

    Related Articles

    ওবায়েদ হক

    তেইল্যা চোরা – ওবায়েদ হক

    July 17, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.