Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নূরজাহান – ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলন এক পাতা গল্প2063 Mins Read0

    ১.২১-২৫ মাটির গাছাটা (কুপিদানি)

    ১.২১

    মাটির গাছাটা (কুপিদানি) কতকালের পুরানা কে জানে! জন্মের পর থেকে এই একটা মাত্র গাছাই দেখে আসছে মজনু। এক সময় বিলাতিগাবের মতো রঙ ছিল। দিনে দিনে সেই রঙ মুছে গেছে। এখন চুলার ভিতরকার পোড়ামাটির মত রঙ। মাটির তৈরি

    একখান জিনিস কী করে এতকাল টিকে থাকে? তাও প্রতিদিন ব্যবহার করার পর!

    আসলে গরিব মানুষের সংসারের কোনও জিনিসই সহজে নষ্ট হয় না। অভাবের সংসারে প্রতিটি জিনিসই দামি। যত্নে ব্যবহার করার ফলে ভঙ্গুর জিনিসও বছরের পর বছর টিকে থাকে। মজনুদের সংসারে যেমন করে টিকে আছে গাছাটা।

    সেই গাছার ওপর এখন জ্বলছে পিতলের কুপি। কুপির বয়স গাছার চেয়েও বেশি। প্রায়ই ছাই দিয়ে মেজে পরিষ্কার করে মরনি, ফলে এখনও ঝকঝক করে। পুরানা মনে হয় না।

    চকিতে শুয়ে আনমনা চোখে কুপির দিকে তাকিয়ে আছে মজনু। মাঝারি ধরনের পাটাতন ঘরের পুরাটা আলোকিত হয়নি একখান কুপির আলোয়। অর্ধেকের কিছু বেশি হয়েছে। বাকিটা আবছা মতন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পা ছড়িয়ে বসে পান চাবাচ্ছে মরনি। খানিক আগে মজনুকে খাইয়ে নিজেও খেয়েছে রাতের ভাত, তারপর টুকটাক কাজ সেরে পান মুখে দিয়ে বসেছে। এখন কিছুটা সময় উদাস হয়ে বসে পান চাবাবে। গত চারমাসে চুপচাপ বসে পান খাওয়ার এই অভ্যাসটা হয়েছে তার। পান সে আগেও খেত তবে চুপচাপ থাকত না। মজনু ছিল, সারাদিনের জমে থাকা সবকথা খালা বোনপোয় এসময় বলত। চারমাস ধরে মজনু বাড়িতে নাই, কথা সে কার সঙ্গে বলবে! তবে মজনু বাড়িতে আসার পর এসময় চুপচাপ থাকা হয় না তার। আজ হচ্ছে। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেই মজনু আনমনা হয়ে আছে। ভাত খাওয়ার সময় তেমন কোনও কথা বলল না। খেয়েই চকিতে শুয়ে পড়ল। এখন উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে কুপির দিকে।

    পান চাবাতে চাবাতে মজনুর দিকে তাকাল মরনি। ঘুমাইছস নি বাজান?

    মজনু নরম গলায় বলল, না।

    তয় চুপ কইরা রইছস ক্যা? কথাবার্তি ক।

    সড়কের সেই লোকটার কথা মনে পড়ল মজনুর। সে একটু উত্তেজিত হল। চঞ্চল ভঙ্গিতে উঠে বসল। আরে তোমারে তো একখানা কথা কই নাই খালা। নূরজাহানের লগে সড়ক দেকতে গেছিলাম। ওহেনে কনটেকদারের ছাপড়া ঘরের সামনে একজন মাইনষের লগে দেহা অইলো।

    মরনি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কার লগে?

    চিনি না।

    তয়?

    ঘটনাডা হোনো। বলেই লোকটা কেমন করে তার দিকে তাকিয়েছিল, কী কী কথা জিজ্ঞাসা করল সব বলল মজনু। চলে আসার সময়ও যে তাকে যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়েছিল লোকটা, মজনুর বুকের ভিতর কেমন করছিল এবং সেও যে বার বার ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল, সব বলল। শুনে পান চাবাতে ভুলে গেল মরনি। চিন্তিত গলায় বলল, বাড়ি কই?

    কামারগাও।

    কামারগাও শুনে বুকটা ধ্বক করে উঠল মরনির। দিশাহারা গলায় বলল, কামারগাও?

    হ অমুনঐত্তো হোনলাম।

    তর লগে কথা কইলো আর তুই ঠিক মতন হুনলি না?

    আমার লগে কয় নাই। কনটেকদারের লগে কইতাছিল, আমি দূর থিকা হুনছি।

    তয় তর লগে বলে কথা কইলো? তুই জিগাচ নাই বাড়ি কই?

    না।

    নাম জিগাইছস? নাম কী?

    আমি তারে কিছুই জিগাই নাই। সে আমারে দুইখান কথা জিগাইছে। রাইত অইয়া যায় দেইক্কা নূরজাহান আমারে টাইন্না লইয়াছে।

    দেখতে কেমুন?

    ভাল না! কাহিল।

    বয়স কত?

    গাছি মামার লাহান। মোখে দাঁড়িমোচ আছে। চুল আর দাঁড়িমোচে পাকনও ধরছে। খয়রি রঙ্গের চাইর গায়দা রইছে। মুখহান দেইক্কা আমার কেমুন জানি মায়া লাগলো।

    মরনি চিন্তিত গলায় বলল, এহেনে আইছে কীর লেইগা?

    মাডি কাটতে।

    লগে লগে বুক হালকা হয়ে গেল মরনির। যা অনুমান করেছিল তা না। সেই মানুষের মাটি কাটতে আসবার কথা না। অবস্থা ভাল তার। সচ্ছল গিরস্থ। সে কেন আসবে মাটিয়াল হতে! এটা অন্য কেউ।

    প্রশান্ত মুখে আবার পান চাবাতে লাগল মরনি।

    মজনু বলল, মানুষটা কে অইতে পারে কও তো খালা? এমুন কইরা চাইয়া রইলো আমার মিহি!

    মরনি নির্বিকার গলায় বলল, কী জানি?

    আমগো আততিয় স্বজন না তো?

    কেমতে কমু? না মনে অয়। আমগো অমুন আততিয় নাই।

    তারপরই চিন্তিত গলায় মজনু বলল, ও খালা, আমগ বাড়ি কামারগাও না?

    কথাটা যেন বুঝতে পারল না মরনি। থতমত খেয়ে বলল, কী কইলি?

    কইলাম আমার বাপ চাচারা থাকে না কামারগাওয়ে?

    মরনি গম্ভীর গলায় বলল, হ থাকে। তয় তর বাড়ি কামারগাও না। তর বাড়ি এইডা। তর ঘর এইডা। তরে যে জন্ম দিছে তার বাড়ি কামারগাও।

    তারপর মন খারাপ করা গলায় বলল, মাইনষের নিয়মঐ এইডা, জন্মদাতারে বহুত বড় মনে করে তারা। যেই বাপে আহুজ ঘর থিকা ঠ্যাং ধইরা ফিক্কা হালায় দেয় পোলারে, জীবনে পোলার মিহি ফিরা চায় না, পোলার খবর লয় না, চিনে না, পোলার খাওন পরন দেয় না, একদিন হেই পোলায়ঐ বাপ বাপ কইরা পাগল অইয়া যায়।

    খালার কথার ভিতরকার অর্থটা বুঝল মজনু। বুঝে হাসল। আমি কইলাম বাপ বাপ কইরা পাগল অই না। আমার কাছে জন্মদাতা বড় না, বড় তুমি, যে আমারে বাচাইয়া রাখছে, পাইল্লা বড় করতাছে। আমি বাপ বুঝি না, বুঝি তোমারে।

    কথা শেষ করার পর কেন যে আবার সেই লোকটার কথা মনে পড়ল মজনুর! কেন যে সেই লোকটার মুখ ভেসে উঠল চোখের সামনে! আর বুকের ভিতর কেন যে হল আশ্চর্য এক অনুভূতি, মজনু বুঝতে পারল না।

    .

    ১.২২

    শিশুর মতো শুয়ে আছে নূরজাহান। শাড়ি উঠে আছে ডানপায়ের গুড়মুরা ছাড়িয়ে একটুখানি উপরে। বিকালের বেণী করা চুল ঘুমাবার আগে আলগা করে দিয়েছে। খোলা চুল তেল চিটচিটা বালিশের পিছন দিকে লুটাচ্ছে। গভীর ঘুমে ডুবে থাকার ফলে শ্বাস পড়ছে ভারী হয়ে। মা বাবা কেউ তা খেয়াল করতাছে না। তারা আছে যে যার কাজে।

    ঘরে জ্বলছে হারিকেন। চিমনির মাজার কাছটায় চিকন সাদা সুতার মতন ফাটল। রঙ চটে যাওয়া কাটার একপাশে ‘বায়েজিদ’ ছাপ মারা। বহুদিনের পুরানা হওয়ার পরও কোম্পানির ছাপ গা থেকে মুছে যায়নি হারিকেনের।

    সন্ধ্যাবেলা হারিকেন আজ খুবই যত্নে পরিষ্কার করেছিল হামিদা। ফাটা কাঁচ সাবধানে মুছে, কেরোসিন ঢালার মুখে ছোট্ট চোঙা বসিয়ে, বোতল থেকে পরিমাণ মতো কেরোসিন ঢেলে হারিকেন যখন জ্বেলেছে, লগে লগে উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছিল তাদের গরিব ঘর। নূরজাহান তখনও ফিরেনি। দবির ফিরেছিল। ফিরে হামিদাকে হারিকেন জ্বালাতে দেখে অবাক হয়েছিল।

    এই বাড়িতে বিশেষ কোনও দরকার না হলে হারিকেন জ্বালান হয় না। অন্ধকারে জ্বলে শুধু কুপি। বাড়িতে মেজবান মেহমান (অতিথি) এলে রাতের বেলায় সেই মেজবানরা যদি থাকে, মেজবানদের সামনে তো আর টিন পিতলের কুপি দেওয়া যায় না! গরিব হলেই বা কী, মানইজ্জ কি গরিব মানুষদের থাকবে না! তাও না হয় বাড়িতে যদি হারিকেন না থাকত! না থাকা ভিন্নকথা। থাকবার পরও মেজবানের সামনে দিবে না এত কিরপিন (কৃপণ) কি কোনও গিরস্ত হতে পারে! নাকি হওয়া উচিত। তবে বান তুফানের (ঝড় বাদলার) রাতে, বৈশাখ যষ্ঠি মাসে, আষাঢ় শাওন মাসে হারিকেন জিনিসটা দরকারী। দমকা হাওয়ায় টিকতে পারে না কুপি। সলতা (সলিতা) যতই বাড়ানো থাকুক সো সো করা বাতাস ছাড়লে লগে লগে ঘরবাড়ি আন্ধার। দবির গাছির তুলনায় গরিব গিরস্ত ঘরেও তখন জ্বলতে দেখা যায় হারিকেন। একবেলা ভাত না খেয়ে থাকতে পারে মানুষ বান তুফানের রাতে আন্ধারে থাকতে পারে না। ভয় পায়। মনে হয় আন্ধারে যখন তখন সামনে এসে দাঁড়াবে মৃত্যু। মানুষ দেখতে পাবে না কিন্তু তার ঢের (টুটি) টিপে ধরবে আজরাইল। জান কবচ করবে।

    সন্ধ্যাবেলা হামিদাকে আজ হারিকেন জ্বালাতে দেখে দবির অবাক হয়ে ভেবেছিল, বাড়িতে কোনও মেজবান আসেনি, দিনও বান তুফানের না তাহলে হারিকেনের দরকার কী!

    হামিদা বলেছিল, কাম আছে। কী কাম তা বলেনি। দবির জানতে চায়নি। খাওয়া দাওয়ার পর, নূরজাহান শুয়ে পড়ার পর, তামাক সাজিয়ে স্বামীর হাতে হুঁকা ধরিয়ে দেওয়ার পর হামিদা তার কাম নিয়ে বসেছে। ঘরের মেঝেতে হোগলা একখান বিছানোই থাকে। এই হোগলায় বসে খাওয়া দাওয়া করে তিনজন মানুষ। রাতেরবেলা তিনজন মানুষের দুইজন, মা মেয়ে উঠে যায় চকিতে আর দবির একখান বালিশ মাথায় দিয়া এই হোগলায়ই টান টান।

    আজকের ব্যাপারটা হয়েছে অন্যরকম। রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে মেয়ে একা উঠে গেছে চকিতে আর পুরানা মোটা একখান কথা বের করে, সুই সুতা নিয়া, হাতের কাছে হারিকেন, হামিদা বসেছে কাঁথা সিলাই করতে, তালি দিতে। হুঁকা হাতে দবির গিয়ে বসেছে দুয়ারের সামনে। বসে হুঁকায় প্রথম টান দিয়েই বলল, ও তাইলে এই কাম! এই কামের লেইগা হারিকেন আঙ্গান (জ্বালান) লাগে!

    পুরানা, ছিঁড়ে ত্যানা ত্যানা হয়ে গেছে এমন সুতি শাড়ির পাইড় (পাড়) থেকে টেনে টেনে বের করা সুতা ফেলে দেওয়া ম্যাচের বাক্সে সযতনে প্যাচিয়ে রাখে গিরস্ত বাড়ির বউঝিরা। কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে এই সুতা দিয়ে। সে কাঁথা ছেলে বুড়া যারই হোক না কেন। হামিদাও তেমন করে কাঠিম (ম্যাচ বাক্সে সুতা প্যাচিয়ে রাখার পদ্ধতি) বানিয়ে রেখেছ হলুদ রঙের সুতা। এখন সুতা দুই ঠোঁটের ভিতর কায়দা করে নিয়ে, ঠোঁটে লেগে থাকা আঠাল ছাপে শক্ত করে কাঁথা সিলাবার জংধরা একখান সুইয়ের পিছনে ঢুকাবার চেষ্টা করতাছে। জ্যোতি কমে আসা চোখে এই কাজ করা কঠিন। সুতা ঢুকলো কী ঢুকলো না বুঝাই যায় না। আসল জায়গায় না ঢুকে পাশ দিয়ে চলে যায় সুতা। লোকে মনে করে ঠিক জায়গায়ই ঢুকেছে। খুশি মনে সুতার আগায় টান দিতে গিয়ে বেকুব হয়ে যায়। হামিদাও দুই তিনবার হল। ফলে মেজাজটা খারাপ, ঠিক তখনই দবিরের কথা।

    রুক্ষ গলায় হামিদা বলল, হারিকেন না আঙ্গাইয়া কেতা সিলাইতে বহন যায়নি!

    দবির অবাক হল। ক্যা, বহন যাইবো না ক্যা?

    জায়গা মতন সুতার অগা ঠিক তখনই ঢুকাল হামিদা। কাজটা করতে পেরে মেজাজ ভাল হল। কাঠিম থেকে অনেকখানি সুতা বের করে দাঁতে সেই সুতা কেটে হারিকেনের পাশে কাঁথা ফেলে মন দিয়ে তালি দিতে লাগল। স্বামীর দিকে তাকাল না। সরল গলায় বলল, কুপি আঙ্গাইয়া কেতা সিলাইতে বইলে কুনসুম না কুনসুম কেতায় আগুন লাইগ্যা যায়। কেতা সিলানের সময় অন্যমিহি খ্যাল থাকে না মাইনষের।

    তামাক টানতে টানতে মাথা নাড়ল দবির। হ ঠিক কথা।

    তারপরই যেন চকিতে শোয়া মেয়েটার কথা মনে পড়ল দবিরের। শুয়ে পড়ার পর থেকেই সাড়া নাই। এত তাড়াতাড়ি ঘুমাইয়া গেল!

    গলা উঁচু করে নূরজাহানের দিকে একবার তাকাল দবির। তাকিয়েই বুঝে গেল ঘুমে কাদা হয়ে গেছে মেয়ে। দুনিয়াদারির খবর নাই।

    দবিরের গলা উঁচু করাটা হঠাৎ করেই দেখতে পেল হামিদা। কথায় আর একটা ফোর (উঁচ ঢুকিয়ে টেনে বের করা) দিতে গেছে, না দিয়ে বলল, কী দেখলা?

    নূরজাহানরে দেখলাম। হোয়নের লগে লগে ঘুমাইয়া গেছে!

    ঘুমাইবো না! যেই দৌড়াদৌড়ি করে হারাদিন! মাইয়াডা যত ডাঙ্গর অইতাছে হেত বেবাইন্না (বেয়াড়া) অইতাছে। এই মাইয়ার কপালে দুক্কু আছে।

    দবির একটু রাগল। রোজ রোজ এক প্যাচাইল পাইড়ো না তো! দুক্কু কপালে থাকলে কেঐ খনডাইতে পারবো না।

    চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকাল হামিদা। মাইয়া লইয়া কোনও কথা কইলে এমুন ছ্যাত কইরা ওডো ক্যা?

    উড়ুম না? একটা মাত্র মাইয়া আমার!

    এক মাইয়া যার বারো ভেজাল তার। ডাকের (প্রচলিত) কথা।

    থোও তোমার ডাকের কথা। ভেজাল অইলে অইবো। আমার মাইয়া আমি বুজুম।

    তারপর কেউ কোনও কথা বলে না। হামিদা কাঁথা সেলাই করে, তালি দেয় আর দবির তামাক টানতে টানতে উদাস হয়ে তাকায় বাইরের দিকে।

    দুয়ার বরাবর, বাড়ির পুবদিকে, রান্নাচালা আর ছাপড়া ঘরটার পিছনে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের মাথায় কখন উঠেছে কুমড়ার ফালির মতন চাঁদ। আসি আসি করা শীতের কুয়াশা শেষ বিকাল থেকেই নাড়ার ধুমার মতো জমেছিল চারদিকে। সন্ধ্যার অন্ধকারে অনেকক্ষণ দেখা যায় নাই সেই কুয়াশা। এখন চাঁদের মৃদু আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শিউলি ফুলের পাপড়ির মতো কোমল জ্যোৎস্না আর মাকড়শার জালের মতো মোলায়েম কুয়াশার মিশেলে তৈরি হয়েছে অপার্থিব এক আলো। এই আলো ছুঁয়ে বইছে উত্তরের হাওয়া। গভীর দুঃখ বেদনায় দীর্ণ হওয়া মায়ের নিঃশব্দ কান্নার মতো প্রকৃতির গাল চুঁইয়ে পড়ছে শিশির।

    হাওয়া মৃদু হলেও বাঁশের পাতা এবং ডগায় শন শন শব্দ হচ্ছিল। সেই শব্দ কেন যে শুনতে পায় না দবির! তামাক টানতে টানতে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ করেই তার মনে হল এই সুন্দর নিঝুম প্রকৃতিকে বিরক্ত করতাছে তার হুঁকার শব্দ। প্রকৃতির মাধুর্য নষ্ট করে দিচ্ছে। ভেঙে খান খান করতাছে মূল্যবান নৈশব্দ। লগে লগে হুঁকা থেকে মুখ সরাল দবির। এক হাতে হুঁকা ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল বাঁশঝাড়ের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনের ভিতরটা কেমন যেন হয়ে গেল তার, কানের ভিতরটা কেমন যেন হয়ে গেল। বাঁশঝাড়ের মাথা ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া উত্তরের হাওয়ায় দবির গাছি শুনতে পেল। ঝোড়া খাজুরগাছের মাথা বরাবর তার পেতে আসা হাঁড়িতে টুপ টুপ করে ঝরছে প্রকৃতির অন্তর থেকে টেনে তোলা রস।

    এই রস কি খাজুরের নাকি প্রকৃতির বুক নিংড়ানো অলৌকিক কোনও তৃষ্ণার! এই রস কি খাজুরের নাকি দূর নক্ষত্রলোক থেকে পৃথিবীর মতো বিশাল, উন্মুখ একখানা হাঁড়িতে এসে পড়ছে সৃষ্টিকর্তার মহান করুণাধারা! সেই ধারায় চিরকালের তরে তৃষ্ণা মিটছে এই পৃথিবীর তৃষ্ণার্ত, অভাজন মানুষের।

    দবির গাছি কোন রস পতনের শব্দ পায়!

    অনেকক্ষণ নিঝুম হয়ে আছে দবির, তার হুঁকার শব্দ পাওয়া যায় না দেখে কাঁথা সিলাতে সিলাতে স্বামীর দিকে তাকাল হামিদা। তাকিয়ে অবাক হল। একহাতে হুঁকা ধরে এমন করে বাইরের দিকে তাকিয়ে কী দেখছে দবির!

    হামিদা বলল, ও নূরজাহানের বাপ কী দেহো বাইরে?

    থতমত খেয়ে হামিদার দিকে মুখ ফিরাল দবির। ফ্যাল ফ্যাল করে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কথা বলল না।

    হামিদার ভুরু কুঁচকে গেল। কী অইছে?

    এবার যেন কথা কানে গেল দবিরের। বলল, কী কও?

    তুমি হোনো নাই কী কইছি?

    না।

    ক্যা?

    কইতে পারি না!

    কইতে পারবা না ক্যা? কী অইছে তোমার? এত কাছে বইয়াও আমার কথা হোনতাছো না! কী দেখতাছিলা বাইরে?

    কিছু না।

    তয়?

    ঝোড়া খাজুরের রস ঝরছে হাঁড়িতে, তার টুপ টুপ শব্দ, সেই শব্দের সূত্র ধরে দূর কোনও অচিনলোকের ইঙ্গিত, এসব হামিদাকে খুলে বলল দবির। শুনে দিশাহারা হয়ে গেল হামিদা। কাঁথা সেলাই শেষ না করেই উঠল। দাঁতে সুতা কেটে কাঁথা থেকে সরিয়ে আনল সুই। কথায় বেশ একটা ঝাড়া দিয়ে সেই কথা যত্নে মেলে দিল ঘুমন্ত নূরজাহানের গায়ে। দবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি দুয়ার দেও। রাইত অইছে। হুইয়া পড়ো।

    দরজার একপাশে হুঁকা রেখে দরজা বন্ধ করল দবির, হোগলায় এসে বসল।

    চকি থেকে নামিয়ে দবিরের বালিশ হোগলায় রেখেছে হামিদা। একখান কাঁথাও রেখেছে। রাতে একটু একটু শীত পড়ছে দুইদিন ধরে। কাঁথা না হলে চলে না।

    কিন্তু দবির এমন চুপচাপ হয়ে আছে কেন? কথা বলছে না, শুয়ে পড়ছে না! কেমন বিহ্বল হয়ে বসে আছে! ব্যাপার কী?

    হামিদার কী রকম ভয় ভয় করতে লাগল। হারিকেন নিভিয়ে নূরজাহানের পাশে শুয়ে পড়ল সে। শুয়েই বলল, নূরজাহানের বাপ হুইছো?

    অন্ধকার মেঝে থেকে দবির বলল, না।

    ক্যা?

    ঘুম আহে না। খালি খাজুরগাছের কথা মনে অয়, রসের কথা মনে অয়। কানে হোনতাছি খালি রস পড়নের আওজ। টুপ টুপ, টুপ টুপ।

    শীতের দিন আইলে এমুন অয় তোমার। এইডা কইলাম ভাল না। খাজুরগাছ, রস এই হগল কইলাম জোয়াইরা বোয়ালের লাহান। রাইত দুইফরে লোভ দেহাইয়া ডাইক্কা বিলে লইয়া যায় মাইনষেরে। পাইনতে ডুবাইয়া মারে। হেই মাছের ডাক মনের ভিতরে থিকা হোনে যেই মাইনষে হেয় কইলাম রাইত দোফরে ঘর থিকা বাইর অইয়া দেহে বিয়ান অইয়া গেছে। আসলে মাইট্টা জোচনায় রাইত দোফররে বিয়ান মনে অয়। তোমার নমুনা কইলাম অমুন দেকতাছি। রসের আশায় রাইত দুইফরে কইলাম ঘর থিকা বাইর অইয়া যাইয়ো না! ফয়জরের আয়জান অইবো, আমারে ডাক দিবা তারবাদে ঘর থিকা বাইর অইবা। মিয়ার ছাড়া কইলাম ভাল না। গলায় টিবিদা (টিপ দিয়ে) মাইরা খাজুর গাছের আগায় উডাইয়া রাখবো। সাবদান।

    হামিদার কথা কিছুই কানে যাচ্ছে না দবিরের। অন্ধকার ঘরে তখনও হোগলায় বসে আছে সে। মেয়ের পাশে শুয়ে কথা বলে যাচ্ছে হামিদা আর দবির গাছি শুনছে টুপ টুপ শব্দে চারপাশের গ্রামের প্রতিটি খাজুরগাছ থেকে মাটির হাড়িতে ঝরছে রস। ঝরে ঝরে পূর্ণ করে তুলছে হাড়ি। ভোরবেলার একলা তৃষ্ণার্ত শালিখ পাখি হাড়ির মুখে বসে ঠোঁট ডুবাচ্ছে রসে। তৃষ্ণা নিবারণ করতাছে।

    .

    ১.২৩

    ছনুবুড়ির ঘুম ভাঙল রাত দুপুরে।

    চাঁদ তখন ম্লান হতে শুরু করেছে। গ্রামের গাছপালা চকমাঠ খাল পুকুর আর মানুষের বসতভিটায় অলস ভঙ্গিতে পড়েছে দুধের সরের মতো কুয়াশা। জ্যোৎস্নার রঙ হয়েছে টাটকিনি মাছের মতো, কুয়াশার রঙ যেন বহুদিন থানবন্দি থাকা কাফনের কাপড়। রাত দুপুরের নির্জন প্রকৃতি, মেদিনীমণ্ডল গ্রামখানি ধরেছে অলৌকিক এক রূপ। শীত রাত্রির বুকপিঠ ছুঁয়ে হু হু, হু হু করে বইছে উত্তরের হাওয়া। উত্তরের কোন অচিনলোকে জন্ম এই হাওয়ার, মানুষের কল্যাণে কে পাঠায় হাওয়াখানি মানুষ তা জানে না।

    রাত দুপুরের এই হাওয়ায় ছনুবুড়ির গা কাঁটা দিল না, প্রবল শীতে শরীরের অজান্তে কুঁকড়ে এল না শরীর। বুকটা কেমন আইঢাই করে উঠল, তৃষ্ণায় ফেটে যেতে চাইল গলা।

    এরকম শীতের রাতে কার পায় এমন তৃষ্ণা! ঘুম ভাঙার পর কার বুক করে এমন আইঢাই!

    ছনুবুড়ি বুঝতে পারল না এমন লাগছে কেন তার। ছানিপড়া ঘোলা চোখে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক তাকাতে লাগল।

    ঘরের ভিতর গাঢ় হতে পারেনি অন্ধকার। চারদিকে আছে বাঁশের বেড়া। ঘর তোলার পর ছইয়াল (বাঁশের কাজ করে যারা) ডেকে কখনও সারাই করা হয়নি। বৃষ্টি বাদলায় খেয়েছে যা, গোপনে সময় নামের খাদক খেয়েছে তারচেয়ে বেশি। ফলে বেড়াগুলি এত জীর্ণ, এত নড়বড়া, না রোদ জ্যোৎস্না আটকাতে পারে, না বৃষ্টি বাতাস।

    আজ রাতে জ্যোৎস্না ঢুকেছে চারদিক দিয়ে আর হাওয়া ঢুকছে শুধু উত্তর দিক দিয়ে। ছনুবুড়ি শুয়েছে উত্তরের বেডা বরাবর মুখ করে। হাওয়ার ঝাপটা সরাসরি এসে লাগছে তার মুখে।

    ছনুবুড়ির পিঠের তলায়, মাটিতে পাতলা করে বিছানো আছে ডাটি। (ধানের ছড়া কেটে নেওয়ার পর দুটো অংশ হয় খড়ের। আকাশ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকে যে অংশ তাকে বলে ডাটি। ডগা অর্থে। আর কাদা মাটিতে লেপটে থাকে যে অংশ তা হচ্ছে নাড়া। নাড়া ব্যবহার করা হয় রান্নার কাজে। ডাটি দিয়ে গরিব গৃহস্ত ঘর গোহালের বেডা তৈরি করে। শীতকালে পিঠের তলায় বিছিয়ে শোয়) তার উপর পুরানা ছেঁড়া একখানা হোগলা। হোগলার উপর মোটা ভারী, বেশ বড় একটা কাঁথা। কত জায়গায় যে ছিঁড়ে ঝুল বেরিয়েছে কাঁথার, ইয়ত্তা নাই। এই কথাখানা দুইভাগে ভাঁজ করে শোয়ার সময় ভিতরে ঢুকে যায় ছনুবুড়ি। এক কাজে দুইকাজ হয়। যে কাঁথা গায়ে সেই কথাই বিছানায়। তাতেই কী শীত মানে (নিবারণ)? মানে না। ডাটি হোগলা কাঁথা এই তিন শত্রু কাবু করে পাতাল থেকে ঠেলে ওঠে অদ্ভুত এক হিমভাব। উঠে সুঁচ ফুটাবার মতো ফুটা করে রোমকূপ। শরীরের ভিতর দখল নেয়। এদিকে শূন্যে আছে উত্তরের হাওয়া, কুয়াশা শিশির। সব মিলিয়ে শীতকালটা বড় কষ্টের। যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। বয়সের ভারে নত হওয়া মানুষ কত পারে যুদ্ধ করতে! ফলে মৃত্যুটা তাদের শীতকালেই হয় বেশি। শীতের মুখে মুখে গ্রামাঞ্চলের বুড়ারা তাই প্রমাদ গোনে। এই শীতটা পার করতে পারলে আর একটা বছর বেঁচে থাকা যাবে। বুড়াদের জন্য শীত যেন এক মৃত্যুদূত। আজরাইল ফেরেশতা। ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়েই থাকে। এদিক ওদিক হলেই জান কবচ করবে, উদিস পাওয়া যাবে না।

    ছনুবুড়ির হচ্ছে উল্টা। না মাটির হিমভার না উত্তরের হাওয়া, আজকের এই রাত দুপুরে কোনওটাই গায়ে লাগল না তার বুকের ভিতর অচেনা অনুভূতি তো আছেই, কলিজা আর কণ্ঠনালী ফেটে যাচ্ছে প্রবল তৃষ্ণায়। তার ওপর হচ্ছে ভয়াবহ এক উষ্ণভাব। যেন পাতাল থেকে উঠে তার দীর্ঘকাল অতিক্রম করে আসা দেহে রোমকূপ ফুটা করে ঢুকছে অচেনা এক তুসের আগুন। উত্তরের হাওয়ায় একটুও নাই শীতভাব। খালিকালের কোনও কোনও দুপুরে দূর প্রান্তর অতিক্রম করে আসে এক ধরনের উষ্ণ হাওয়া, সেই হাওয়ায় গায়ের কাপড় ফেলে দিতে ইচ্ছা করে মানুষের, লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে পুকুরের পানিতে, উত্তরের হাওয়াটা এখন তেমন লাগছে ছনুবুড়ির। মাটির গর্তে বদনার নল দিয়ে গরম পানি ঢেলে দেওয়ার পর যেমন ছটফট করে বেরিয়ে আসে তুরখোলা ঠিক তেমন করে কাঁথা থেকে বের হল সে। কাঁথার সঙ্গে শরীর থেকে যে খসে গেছে চামড়ার মতো লেগে থাকা মাটি রঙের থান, ছনুবুড়ি তা টের পেল না। শরীরে এমন এক উষ্ণভাব, ছনুবুড়ির ইচ্ছা করে শীতন্দ্রিা থেকে বেরিয়ে আসার পর সাপ যেমন করে তার ছুলুম (খোলস) বদলায় তেমন করে শরীর থেকে খুলে ফেলে বহু বর্ষা বসন্তের সাক্ষী ঝুলঝুলা চামড়া। শরীর শীতল করে। আর একটা আশ্চর্য কাণ্ড আজকের এই রাত দুপুরে নিজের অজান্তেই করে ফেলে ছনুবুড়ি। শিরদাঁড়া সোজা করে যৌবনবতী কন্যার। মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়। কতকাল আগে দেহ তার বেঁকে গিয়েছিল মাটির দিকে, সেই দেহ আর সোজা হয়নি। দেহ হয়েছিল নরমকঞ্চির ছিপ। সেই ছিপের অদৃশ্য বড়শিতে গাঁথা পড়েছিল মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা বিরাট এক মাছ। বহুকাল ধরে সেই মাছ ছনুবুড়িকে টেনে রেখেছিল মাটির দিকে। সোজা হতে দেয়নি। আজ বুঝি মাছ গেছে আনমনা হয়ে গেছে। সেই ফাঁকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে ছনুবুড়ি। দাঁড়াবার পর বহুকালের চেনা এই ঘর হঠাৎ করেই অচেনা লাগে তার চোখে। ছানিপড়া চোখে পরিস্কার দেখা যায় না সবকিছু। ছনুবুড়ির চারপাশে ছড়ানো আছে গিরস্থের কত না দীনহীন স্থাবর, দরকারে অদরকারে এই ঘরে এসে জড় হয়েছে কত না হাঁড়িকুড়ি, কত ঘটিবাটি। একপাশে লোটে মুখ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছনুবুড়ির বয়সের কাছাকাছি বয়সের ঢেঁকি। ঢেঁকির পায়ের কাছে দুইজন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাড় দিতে পারে এমন একটা ভিত। ভিতের ঠিক উপরে বাতার সঙ্গে ঝুলছে মোটা দড়ির আংটা। ধানবানার সময় এই আংটা ধরে দাঁড়ায় বাড়ির বউঝিরা। তালে তালে ধান বানে, মনের সুখে গান গায় ‘ও ধান বানি রে, ঢেঁকিতে পাহার দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া’।

    ঢেঁকির দিকে তাকিয়ে ঘরের ভিতরকার এই একটা মাত্র জিনিস পরিষ্কার চিনতে পারল ছনুবুড়ি। আশ্চর্য এক অনুভূতি হল। ছনুবুড়ি টের পেল তার দেহ আর মানুষের দেহ নাই, দেহ তার মরা কাঠের ঢেঁকি হয়ে গেছে। কারা যেন দুইজন অদৃশ্যে থেকে তার দেহঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে। ধুপ ধুপ, ধুপ ধুপ। পাড়ে পাড়ে ললাটে মুখ থুবড়ে পড়ছে সে। সেই ললাটে ধানের মতো খোলসমুক্ত হচ্ছে ছনুবুড়ির জীবন।

    তারপর আবার সেই কলিজাফাটা তৃষ্ণা টের পেল ছনুবুড়ি। মনে হল কোনও পুকুরে নেমে উবু হয়ে, আঁজলা ভরে পানি তুলে জীবন ভর খেলেও এই তৃষ্ণা মিটবে না। পানি খেতে হবে পুকুরে মুখ ডুবিয়ে। এমন চুমুক দিবে পানিতে, এক চুমুকে পুকুর হবে পানিশূন্য তবু তৃষ্ণা মিটবে না ছনুবুড়ির।

    ছনুবুড়ি তারপর পাগলের মতো হাঁড়ি মালসা হাতাতে লাগল, ঘটিবাটি হাতাতে লাগল। একটু পানি, একটু পানি কি নাই, কোথাও! ভুল করেও কি কেউ একটু পানি রাখে নাই কোনও হাঁড়িতে!

    ছনুবুড়ির ইচ্ছা হল গলার সবটুকু জোর একত্র করে চিৎকারে চিৎকারে দুনিয়াদারি কাঁপিয়ে তোলে, পানি দেও, আমারে ইট্টু পানি দেও। আমার বড় তিয়াস লাগছে।

    এক সময় একটা হাড়িতে সামান্য একটু পানি ছনুবুড়ি পেল। দুইহাতে সেই হাঁড়ি তুলে মুখে উপুড় করল সে! দিকপাশ ভাবল না।

    কিন্তু এ কেমন পানি? এ কোন দুনিয়ার পানি পানি কি এমন হয়! গলা দিয়ে যে নামতেই চায় না! এ কেমন পানি!

    ঠিক তখনই মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য আনমনা মাছ মনস্ক হয়। প্রবল বেগে দিকবিদিক ছুটতে শুরু করে। ফলে আচমকা এমন টান লাগলো ছনুবুড়ির দেহে, বহুকাল মাটিমুখি ঝুঁকে থাকা দেহ তার কঞ্চির ছিপের মতো ভেঙে যায়।

    ছনুবুড়ি মুখ থুবড়ে পড়ে।

    আকাশের চাঁদ তখন মাত্র হাঁটতে শিখেছে এমন শিশুর মতো অতিক্রম করেছে কয়েক পা, জ্যোৎস্না হয়েছে আরেকটু স্নান। কুয়াশা যেন মুর্দারের কাফন। থান খুলে সেই কাফনে কে যেন ঢেকে দিয়েছে দুনিয়া, ছনুবুড়ির পর্ণকুট্টির। এই কাফন পেরিয়ে বয়ে যাওয়ার সাধ্য নাই হাওয়ার। ফলে হাওয়া হয়েছে স্তব্ধ।

    গাছের পাতায় পাতায়, লতাগুল্ম এবং ঘাসের ডগায় ডগায় তখন ঝরছিল নিশিবেলার অবোধ শিশির। গ্রাম গিরস্থের খাজুরগাছ হাঁড়ি পূর্ণ করছিল বুক নিংড়ানো মধুর রসে।

    .

    ১.২৪

    মিয়াদের ছাড়াবাড়ির কাচির (কাস্তে) মতো বেঁকা খেজুরগাছটার গলার কাছে তাবিচের মতো বাঁধা হাঁড়ির মুখে বসে একটা বুলবুলি পাখি ঠোঁট ডুবাচ্ছে রসে। শীত সকালের সূর্য পুব আকাশ উজ্জ্বল করেছে খানিক আগে। এখন গাছপালার বনে, শস্যের চকমাঠ আর খাল পুকুরে, ঘাসের ডগায় আর মানুষের উঠান পালানে ছড়িয়ে যাচ্ছে রোদ। কুয়াশা উধাও হয়েছে কোন ফাঁকে। প্রকৃতির নিঃশব্দ কান্নার মতো ঝরেছে যে শিশির, সেই শিশির এখনও সিক্ত করে রেখেছে চারদিক। সারারাত আশ্চর্য এক শীতলতা উঠেছে মাটি থেকে, ঘাসবন আর গাছপালা থেকে, খাল পুকুর আর মানুষের ঘরবাড়ি থেকে। পাখির ডানার তলায় লুকিয়ে থাকার মতো রোদের উষ্ণতা এখনও ছড়াতে পারেনি চারদিকে। তবে শিশিরসিক্ত গ্রামখানি রোদে আলোয় ঝকমক ঝকমক করতাছে। যেন বা এই মাত্র স্বামীর সংসার থেকে পালকি চড়ে বাপের বাড়ি আসছে কোনও গৃহস্থ বউ, পালকি থেকে নেমে বহুকাল পর মা-বাবা ভাই বোনকে দেখে গভীর আনন্দে হাসছে, তার সেই হাসির দ্যুতি মোহময় এক আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে।

    ভার কাঁধে দবির গাছি বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ফজরের আজানের পর। ভারের দুই দিকে দুইটা দুইটা করে চারটা মাটির ঠিলা। এক ঠিলার মুখে এলুমিনিয়ামের বড় একটা মগ। যে যে বাড়িতে গাছ ঝুড়েছে দবির সেই সেই বাড়িতে গিয়ে গাছের গলা থেকে খুলবে হাঁড়ি। হাঁড়ির অর্ধেক রস দিবে গিরস্তকে বাকি অর্ধেক ঢালবে নিজের ঠিলায়। এই ভাবে এক সময় কানায় কানায় ভরবে চারটা ঠিলা, দবির রস বেচতে বের হবে।

    আজ প্রথম দিন। বাড়ি থেকে বেরিয়েই দবির গেছে হালদার বাড়িতে। মজনুদের চারটা গাছ ঝুড়েছে, সেই সব গাছের রস নামিয়েছে। রস তেমন পড়ে নাই। কোনও হাঁড়িরই বুক ছাড়িয়ে ওঠেনি। তবু সেই রস নিয়ে মজনুর খালা মরনির কী আগ্রহ। দবির পৌঁছাবার আগেই ঘুম থেকে উঠে বালতি হাতে খাজুরতলায় এসে দাঁড়িয়েছে। ভাগের রস বুঝে নেওয়ার পর ডাকাডাকি করে তুলেছে মজনুকে। ও মজনু মজনু, ওট বাজান, রস খা। দেখ কেমুন রস পড়ছে! কেমুন মিড়া রস!

    নিজে তখনও মুখে দেয়নি রস তবু বলছে মিষ্টি রস। শুনে হেসেছে দবির। ঠাট্টার গলায় বলেছে, ও মরনি বুজি, তুমি তো অহনরি রস মুখে দেও নাই, মুখে না দিয়া কেমতে কইতাছো মিডা রস?

    দবিরের দিকে তাকিয়ে মরনিও হেসেছে। আমগো গাছের রস মিডাই অয় গাছি। আমি জানি।

    সব বচ্ছর রস কইলাম এক রকম মিডা অয় না। এহেক বচ্ছর এহেক রকম অয়। এইডা অইলো মাডির খেইল। মাড়ি যেই বচ্ছর আমোদে থাকে, খাজুরের রস, আউখের রস হেই বচ্ছর খুব মিডা অয়। আর মাডি যদি ব্যাজার থাকে তাইলে রস অয় চুকা (টক)।

    একটু থেমে হাতের কাজ করতে করতেই দবির বলেছে, তুমি ইট্টু মুখেদা দেহ না বুজি রস এই বচ্ছর কেমুন মিডা!

    মরনি লাজুক হেসে বলল, না। পোলা আছে বাইত্তে, অরে আগে না খাওয়াইয়া গাছের রস আমি মুখে দিতে পারি না।

    শুনে এত মুগ্ধ হল দবির, কয়েক পলক মরনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হাসিমুখে প্রত্যেকটা গাছের গলায় হাঁড়ি ঝুলাল, যত্ন করে ভার তুলল কাঁধে। যাই বুজি, বিয়ালে তো দেহা অইবোঐ।

    মরনি বলল, যাওন নাই। তয় আমার বাড়ির রস আপনে ইট্টু মুখে দিলে পারতেন। রসটা কেমুন পড়ল বোজতাম।

    ঠিক তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে এল মজনু। চোখে ঘুম লেগে আছে। এক হাতে চোখ ডলছে। মজনুর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে দবির বলল, ঐ যে তোমার বইনপো উটছে। অরে খাওয়াও। আমি একজন মাইনষেরে কথা দিছি, তারে রস না খাওয়াইয়া নিজে মুখে দিমু না।

    কারে কথা দিছেন? মাইয়ারে?

    না গো বুজি, আছে আরেকজন। বিয়ালে কমুনে তোমারে।

    ভার কাঁধে দ্রুত হেঁটে দবির তারপর চকে নেমেছে। এই সময় হাঁটার গতি এত বাড়ে দবির গাছির, যেন হাঁটে না,সে দৌড়ায়। কাঁধে রসের ভার থাকার ফলে পালকির বেহারাদের মতো মুখ দিয়ে তার হুমহাম শব্দ বের হয়। তীব্র শীতের সকালেও গায়ে থাকে না সুতার তেনাটি (জামা অর্থে)। গা ভিজা থাকে জ্যাবজ্যাবা ঘামে। এই বছরের শীতের প্রথম দিন আজ। রসের প্রথম দিন। পরিশ্রমটা আজ বেশিই যাবে দবির গাছির। কয়েক দিন গেলে এই পরিশ্রম আর গায়ে লাগবো না। সয়ে যাবে। শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাবেন তাহাই সয়।

    ভোরবেলার দেশ গ্রাম তখনও জেগে ওঠেনি। চারদিক ডুবে আছে কুয়াশায়। খোলা চকমাঠ, ছাড়াবাড়ির গাছপালার আড়াল আর গিরস্তবাড়ির কোণাকানছিতে (আনাচ কানাচে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার একটু একটু করে সরছে। পায়ের তলার মাটি আড়মোড় ভাঙছে। এই মাটির ওপর দিয়ে ভার কাঁধে ছুটে যায় এক মাটির সন্তান। এইবাড়ি যায় ওইবাড়ি যায়, রসের নেশায় মাতাল হয়ে খাজুরগাছে চড়ে, হাঁড়ি নামায়। দুনিয়ার আর কোনওদিকে খেয়াল থাকে না তার।

    মিয়াদের ছাড়াবাড়ির কাছাকাছি আসতেই রোদ উঠে গেল। রোদের আলোয় দূর থেকে বেঁকা গাছটার হাঁড়িতে বুলবুলি পাখিটাকে রসে ঠোঁট ডুবাতে দেখল দবির। দেখে গভীর আনন্দে বুক ভরে গেল। পয়লা দিনই এত রস পড়ছে! গলা তরি ভরছে ঠিল্লা! এই গাছের পা ছুঁয়ে যে দয়া চেয়েছিল দবির গাছ তা হলে সেই দয়া করেছে।

    বুক ভরে শ্বাস নিল দবির। গাছটাকে বলল, মা মাগো, আল্লায় তোমারে বাচাইয়া রাখুক মা। রোজ কিয়ামতের আগতরি বাইচ্চা থাকো তুমি।

    দ্রুত হেঁটে খাজুরতলায় এল দবির। এসেই আলফুকে দেখতে পেল খাজুরতলায়। বসে বিড়ি টানহে। পায়ের কাছে কাত হয়ে পড়ে আছে পিতলের বড় কলসি। দবিরকে দেখে হাসল। এত দেরি করলা ক্যা গাছি?

    কাঁধের ভার নামিয়ে দবির বলল, বেবাক কাম সাইরা তার বাদে আইলাম। তুই আইছস কুনসুম?

    আর কইয়ো না, বিয়াইন্না রাইত্রে কুট্টিরে দিয়া ডাক পারন শুরু করতাছে বুজানে। রসের চিন্তায় রাইত্রে মনে অয় ঘুমাইতে পারে নাই।

    বুজান অহনতরি ঢাকা যায় নাই?

    না। রস না খাইয়া যাইবো নি?

    এত রস কাঁচা খাইবো?

    পাগল অইছো! দুনিয়ার কিরপিন মানুষ। নিজে একলা আদা (আধা) গেলাস খাইয়া বেবাক রস কুট্টিরে দিয়া জ্বাল দেওয়াইবো। তোয়াক (গুড় করার আগের অবস্থাটিকে বলা হয়। আসলে তরল গুড়) কইরা রাখবো। পয়লা পয়লা কহেক বতল তোয়াক বানাইবো তার বাদে বানাইবো খালি মিডাই। শীতের দিনে কুট্টির খালি এই কাম। আর আমার আইয়া কলস লইয়া বইয়া থাকতে অইবো খাজুরতলায়।

    দবির আর কথা বলল না। বেঁকা গাছটার পায়ের কাছে হাত দিয়ে সালাম করল তারপর তড়তড় করে উঠে গেল গাছে। বুলবুলি পাখিটা তখন আর নাই। কোন ফাঁকে উড়ে গেছে।

    এই বাড়ির কাজ সারতে সারতে বেলা আরও খানিকটা বাড়ল। প্রথম দিন হিসাবে রস ভালই পড়েছে। আলফুর কলসি প্রায় ভরে গেছে। দবিরের চারখান ঠিলা পুরা ভরেনি। তবু মন প্রফুল্ল তার। মনে মনে গাছগুলিকে শুকরিয়া জানিয়ে ভার কাঁধে তুলল।

    আলফু বেশ কায়দা করে নিজের কলসিটা কাঁধে নিয়েছে। বাড়িমুখি হাঁটতে হাঁটতে বলল, কই যাইবা গাছি?

    দবির বলল, যামু এক জাগায়। পয়লা দিনের রস একজন মানুষরে খাওয়ান লাগবো।

    .

    ১.২৫

    বড় ঘরের সামনে, মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে বসে বিলাপ করতাছে বানেছা। এভাবে ছড়িয়ে বসার ফলে তার সাত সোয়াসাত মাসের পেট ডিমআলা বোয়াল মাছের পেটের মতো বেঢপ হয়ে আছে। থেকে থেকে বুক চাপড়াচ্ছে সে, মাটি চাপড়াচ্ছে। প্রায়ই তার বুক থেকে, পেট থেকে সরে যাচ্ছে শাড়ি। ইচ্ছা করেই যেন তা খেয়াল করতাছে না সে। বিলাপ করে কাঁদছে ঠিকই তবে চোখে একফোঁটা পানি নাই।

    অদূরে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে আজিজ, চোখে নিঃশব্দ কান্না। তার হাতের কাছে রাখা আছে তামা পিতলের ভার। ভার কাঁধে সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়েছিল, রোজকার মতো গাওয়ালে যাবে, যাওয়া হয়নি। তার আগেই হামেদ দৌড়ে এসে বলল, বাবা ও বাবা, দাদী দিহি ল্যাংটা অইয়া পইড়া রইছে।

    শুনে চমকে উঠেছে আজিজ। কোনহানে?

    ঐ ঘরে, মুখের সামনে কাইত অইয়া রইছে মাইট্টা তেলের হাড়ি।

    কচ কী?

    হ।

    ল তো দেহি।

    উঠানের কোণে ভার নামিয়ে ঢেঁকিঘরে গিয়ে ঢুকেছে আজিজ। ঢুকে দেখে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে ছনুবুড়ি। গায়ে কাপড় নাই। একপাশে পড়ে আছে তার বিছানা আর ছেঁড়াকাঁথা। ছনুবুড়ির মুখের কাছে কাত হয়ে পড়ে আছে মাইট্টাতেলের হাঁড়িটা। একফোটা তেলও নাই হাঁড়িতে। বড় ঘরের পশ্চিম উত্তর কোণার খাম ঘুণে ধরছে। একদিন গাওয়ালে না গিয়া খামে মাইট্টাতেল লাগারে আজিজ এই ভেবে কোলাপাড়া বাজার থেকে দুই তিনদিন আগে তেলটা কিনে এনেছিল। সেই তেল ফেলে দিয়েছে ছনুবুড়ি ভেবে প্রথমে খুব রেগে গেল আজিজ। রেগে গেলে দাঁতে কটমট শব্দ হয় তার। সেই শব্দ করে চাপা গলায় বলল, ওমা, কেন ঘুমান ঘুমাও? শইল্লে কাপোড় থাকে না, পোলাপানে আইয়া ল্যাংটা দেহে, শরম করে না তোমার! তেলের হাড়িডা হালায় দিছো! পাশসিকার (পাঁচসিকা) মাইট্টাতেল কিন্না আনলাম পশশু, বেবাকটি হালায় দিলা! কেমুন ঘুমান ঘুমাও!

    ছনুবুড়ি কথা বলে না। নড়ে না।

    আজিজের এতকথা শুনেও কথা বলছে না ছনুবুড়ি এরচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা হতে পারে না। আজিজ খুবই অবাক হল। এই প্রথম মনের ভিতর কামড়টা দিল তার। হাঁটু ভেঙে ছনুবুড়ির সামনে বসল। মায়ের খোলা পিঠে হাত ছোঁয়াল। ছুঁইয়ে চমকে উঠল। যেন শীতকালের কচুরিভরা পুকুরের পানিতে হাত দিয়েছে।

    ছনুবুড়ির ঘরের সামনে ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে বানেছা। কোলে লেপটে আছে ছোট বাচ্চাটা। দুইহাত দিয়ে ধরে মায়ের বাদিককার বুক চুষছে। অন্য ছেলেমেয়েগুলি আছে তার দুইপাশে।

    ছনুবুড়িকে ছুঁয়ে দিয়েই ফ্যাল ফ্যাল করে বানেছার মুখের দিকে তাকাল আজিজ। বানেছা খসখসা গলায় বলল, কী অইছে?

    শইলডা মাছের লাহান ঠাণ্ডা!

    শীত পড়ছে, হুইয়া রইছে ল্যাংটা অইয়া, শইল তো ঠাণ্ডা অইবোই। ডাক দেও।

    ছনুবুড়িকে তারপর ধাক্কাতে লাগল আজিজ। মা ওমা, মা। ওড ওড, বেইল উইট্টা গেছে।

    বুড়ির কোনও সাড়া নাই।

    এবার গলা একটু চড়াল বানেছা। শইলডা আগে কাপোড় দিয়া ঢাইক্কা দেও। ল্যাংটা মার সামনে বইয়া রইছো শরম করে না তোমার?

    শুনে আজিজের বাচ্চাকাচ্চারা হি হি করে হাসতে লাগল। দিশাহারা ভঙ্গিতে কাথার তলা থেকে ছনুবুড়ির কাপড় বের করে তার শরীর ঢেকে দিল আজিজ। বানেছার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, আমার কেমুন জানি ডর করতাছে।

    এবার বানেছাও ভুরু কুঁচকাল। মইরা গেছেনি?

    হেমুনঐত্তো লাগে।

    নাকি ভ্যাক ধরছে।

    একথায় মেউন্না আজিজও একটু রাগল। ছোটখাট একটা ধমক দিল বানেছাকে। কী কও তুমি! ভ্যাক ধরব ক্যা! ভ্যাক ধরনের কী অইছে! শীতের দিনে খালি গায়ে হুইয়া কেঐ ভ্যাক ধরে!

    আবার ছনুবুড়িকে ধাক্কাতে লাগল আজিজ। মা ওমা, মা।

    স্বামীর কাণ্ড দেখে খুবই বিরক্ত হল বানেছা। আগের চেয়েও গলা চড়াল। এমুন শুরু করলা ক্যা তুমি! টাইন্না উডাও না ক্যা!

    এবার দুইহাতে ছনুবুড়িকে টেনে তুলতে গেল আজিজ। তুলতে গিয়ে ছেলেবেলার একটা কথা মনে পড়ল। ছেলেবেলায় আজিজের স্বভাব ছিল উপুড় হয়ে শোয়া। সকালবেলা উপুড় হয়ে শোয়া ছেলের দুই হাতের তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মা তাকে চিৎ করত। আদরের গলায় বলত, ওট বাজান, ওট। বেইল উইট্টা গেছে। আর কত ঘুমাবি! আজ সেই কাজটা করতাছে আজিজ। আজ যেন সে মা আর মা হয়ে গেছে ছেলেবেলার আজিজ।

    ছনুবুড়ির মুখখানা নিজের দিকে ঘুরিয়েই আঁতকে উঠল আজিজ। মুখ মাখামাখি হয়ে আছে মাইট্টাতেলে। মুখের ভিতর মাইট্টাতেল, কষ বেয়ে নেমেছে মাইট্টাতেল।

    দৃশ্যটা বানেছাও দেখল। দেখে চোখ সরু করে বলল, মাইট্টাতেল খাইছেনি। পানি মনে কইরা মাইট্টাতেল খাইছে? হায় হায় করতাছে কী? মাইট্টাতেল খাইলে তো মানুষ বাঁচে না!

    মাইট্টাতেলে মাখামাখি মুখখানা বিকৃত হয়ে আছে ছনুবুড়ির। ছানি পড়া ঘোলা চোখ কোটর থেকে ঠিকরে বের হতে গিয়েও বের হতে পারেনি, তার আগেই থেমে গেছে। এই চোখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে গেল আজিজ। প্রথম চিৎকারটা তারপর আজিজই দিল। হায় হায় আমার মায় তো নাই, আমার মায় তো মইরা গেছে!

    স্বামীর চিৎকার শুনে খানিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বানেছা। তারপর নিজেও বিলাপ শুরু করল। এইডা কেমতে অইলো গো, আল্লাগো আমার! কোন ফাঁকে গেল গো, আল্লা গো আমার।

    বাড়িতে এই ধরনের কাণ্ড প্রথম। বাড়ির শিশুরা কোনও মৃত্যু দেখেনি। মা বাবার মিলিত বিলাপ শুনে তারা বেশ মজা পেল। হি হি হি হি করে হাসতে লাগল। বানেছার কোলের বাচ্চাটা দুধ খাওয়া ভুলে ড্যাব ড্যাব করে তাকাতে লাগল। হামেদ ভাবল দাদীর কায়কারবার দেখে তার মা বাবা কি একলগে কোনও গান ধরল! দাদীর মতো গভীর ঘুমে ডুবে থাকা মানুষকে কি গান গেয়ে জাগাতে হয়? কয়দিন আগে গোঁসাই বাড়িতে হয়ে যাওয়া বেহুলা লখিন্দর পালায় ঘুমিয়ে থাকা লখিন্দরকে কাঁদতে কাঁদতে গান গেয়ে যেমন করে জাগাতে চেয়েছিল বেহুলা, ব্যাপারটা কি তেমন কিছু! এসব ভেবে মা বাবার সঙ্গে সেও প্রায় গলা মিলাতে গিয়েছিল, বড়বোন পরি চোখ গোরাইয়া (পাকিয়ে) তার দিকে তাকাল। হামেদের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, দাদী মইরা গেছে। এর লেইগা মায় আর বাবার এমুন করতাছে। এইডা গান না, কান্দন।

    হামেদ নাকমুখ কুঁচকে বলল, দাদী মইরা গেছে, মার কী? মায় কান্দে ক্যা? মায় তো দাদীরে দুই চোক্কে দেখতে পারে না। হেদিন বউয়া খাইতে চাইছিল, দেয় নাই। দাদী মরছে মার তো তাইলে আমদ। মায় কান্দে ক্যা?

    আজিজের বড়ছেলের নাম নাদের। সে বলল, মায় কান্দে আল্লাদে। দেহচ না চোক্কে পানি নাই। মাইনষেরে দেহানের লেইগা কান্দে।

    শুনে বিলাপ ভুলে দুই ছেলেকে একলগে ধমক দিল বানেছা। চুপ কর। প্যাচাইল পাড়লে কিলাইয়া সিদা কইরা হালামু। মাইনষেরে দেহানের লেইগা কান্দি আমি, না?

    তারপর পরির দিকে তাকিয়েছে বানেছা। আইজ রান্দন বাড়ন যাইবো না। জের থিকা মুড়ি মিডাই বাইর কইরা বেবাক ভাই বইনে মিলা খা গা। যা।

    শুনে আনন্দে নেচে উঠেছে শিশুরা। যে যেমন করে পারে পরির পিছন পিছন গেছে বড়ঘরে। ওদিকে ছেলেমেয়েদের লগে কথা শেষ করে আবার বিলাপ শুরু করেছে বানেছা। মাকে জড়িয়ে ধরে আজিজের বিলাপ তো ছিলই, শীত সকালের এই বিলাপ দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছিল চারদিকে। শুনে চারপাশের বাড়িঘর থেকে গিরস্থালি ফেলে একজন দুইজন করে মানুষ আসতে লাগল এই বাড়িতে। মিয়াবাড়ি মেন্দাবাড়ি হালদারবাড়ি হাজামবাড়ি জাহিদ খাঁর বাড়ি বেপারীবাড়ি, আস্তে ধীরে প্রতিটি বাড়ির লোক এল। আজিজের বাড়ির উঠান ভরে গেল।

    মেন্দাবাড়ির মোতালেবের স্বভাব হচ্ছে গ্রামের যে কোনও বাড়ির যে কোনও কাজে মাতাব্বরিটা সে তার হাতে রাখতে চায়। আজও তাই চাইল। প্রথমেই মুর্দার যে ঘরে আছে সেই ঘরে ঢুকে গেল। বিলাপ করতে থাকা আজিজকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বাইরে নিয়ে এল। কাইন্দো না কাইন্দো না! মা বাপ কেঐর চিরদিন বাইচ্চা থাকে না। আল্লার মাল আল্লায় নিছে। কাইন্দা কী আর তারে ফিরাইয়া আনতে পারবা?

    উঠানে এনে তামা পিতলের ভারের সামনে আজিজকে বসিয়ে দিয়েছে মোতালেব। আবার বলেছে, কাইন্দো না কাইন্দো না। আল্লার মাল আল্লায় নিছে। অহন টেকা পয়সা দেও কোলাপাড়া বাজারে যাইগা। কাফোনের কাপোড় লইয়াহি।

    রাবির জামাই মতলেবের দিকে তাকাল মোতালেব। ঐ মতলা, তুই চদরি বাড়ি যা। বাঁশ কাইট্টা আন।

    ভিড়ের মধ্যে বাদলাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাবি। মানুষজন দেখে বাদলা গেছে আল্লাইন্দা (আদি) হয়ে। মায়ের কোলে চড়ে বসেছে। যেদিকের কোলে চড়েছে সেদিকটা রাবির বেঁকে গেছে। ব্যাপারটা বিন্দুমাত্র পাত্তা দিচ্ছে না রাবি। মোতালেবের দিকে তাকিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, হেয় যাইতে পারবো না, হের কাম আছে।

    মোতালেব একটু থতমত খেল। তারপর নিজেকে সামাল দিয়ে বলল, মানুষ মইরা গেছে হেরে মাডি দেওনডাই অহন বড়কাম। মতলা, তুই যা তো! বাঁশ কাইট্টা দিয়া তার বাদে কামে যাইচ।

    এসময় হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এল তছি পাগলনী। মামানী বলে মইরা গেছে? কেমতে মরল, এ্যা? কেমতে মরল! হায় হায় সব্বনাশ অইছে তো!

    কুট্টি বলল, মাইট্টাতেল খাইয়া মরছে।

    দৌড়ে ছনুবুড়ির ঘরে ঢুকল তছি। হাউমাউ করে খানিক কাদল তারপর বড়ঘরের সামনে বসা বানেছার সামনে এসে দাঁড়াল। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল, মাইট্টা তেল তো ইচ্ছা কইরা খায় নাই, পানির পিয়াস লাগছিল, পানি মনে কইরা মাইট্টাতেল খাইছে। মরনের সমায় বহুত পিয়াস লাগে মাইনষের। আহা রে মরনের সমায় ইট্টু পানিও মুখে দিতে পারলো না!

    তছির কথা শেষ হওয়ার লগে লগে দুইহাতে বুক চাপড়ে বিলাপ করে উঠল বানেছা। ইট্টু পানিও মুখেদা মরতে পারলো না গো, আল্লা গো আমার।

    বানেছার বিলাপ শুনে কান্না ভুলে তছি একেবারে তেড়ে উঠল। অহন এত বিলাপ করচ ক্যা মাগী, বাইচ্চা থাকতে তো একওক্ত খাওন দেচ নাই। দূর দূর কইরা খেদাই দিছচ। তোর অইত্যাচারে চোর অইয়া গেছিলো মামানী। মাইনষের বাড়ি বাড়ি গিয়া ঘোরছে খাওনের লেইগা। অহন আল্লাদ দেহাইয়া কান্দচ তুই, না? চুপ কর, চুপ কর তুই। তোর কান্দন হোনলে শইল জ্বলে।

    তছির কথা শুনে বানেছা আর লোকজন যারা এসেছে তারা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কুট্টি মুখে আঁচল চেপে হাসতে লাগল। এখনই বানেছা আর তছির চুলাচুলি লেগে যাবে ভেবে এইদিকে একটা ধমক দিল মোতালেব। ঐ তছি চুপ কর। এত প্যাচাইল পারিচ না।

    তছির দুইভাই মজিদ আর হাফিজদ্দির দিকে তাকাল মোতালেব। বলল, তরা দুইজন আলফুরে লইয়া গোরস্তানে যা। কবর খোদ। মজনু যাইয়া মান্নান মাওলানারে লইয়াহুক। আলার মারে ক নাওয়াইতে (গোসল)। কাফোন খলফা আমি লইয়াইতাছি। দুইফরের আগেঐ দাফন কইরা হালামুনে। যা, দেরি করিস না।

    আজিজের দিকে তাকাল মোতালেব। দেও আজিজ, টেকা পয়সা দেও। কাপোড় খলফা লইয়াহি।

    দুইহাতে চোখ মুছে আজিজ বলল, তুমি কষ্ট করবা ক্যা, আমি যাই।

    শুনে মোতালেব একেবারে হা হা করে উঠল। আরে না মিয়া, তুমি যাইবা ক্যা? মা মরছে তোমার আর তুমিই যাইবা তার কাফোনের কাপোড় কিনতে, মাইনষে কইবো কী! আমরা কি মইরা গেছিনি? আমরা কি নাই? দেও টেকা দেও।

    কাফনের কাপড় কিনার ব্যাপারে মোতালেবের আগ্রহ দেখে অনেকেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, ঠোঁট টিপে হাসল। রবার বাপ অখিলদ্দি তার পাশে দাঁড়ানো ইদ্রিসকে ফিসফিস করে বলল, কাফোনের কাপোড় থিকাও চুরি করনের তাল করতাছে মোতালেইব্বা। মানুষ এমুন অয় কেমতে? একটা মানুষ মইরা গেছে আর তার উপরে দিয়া চুরির তাল!

    ইদ্রিসও অখিলদ্দির মতোই নিচু গলায় বলল, চোরের সবাব কোনওদিন বদলায় না। সুযুগ পাইলে মার নাকের ফুলও চুরি করে চোরে।

    মোতালেবের উদ্দেশ্যটা যে আজিজও না বুঝেছে, তা না। এজন্যই দোনোমোনোটা সে করতাছে। কিন্তু মোতালেব নাছোরবান্দা। আতুড় (লুলা অর্থে) মেয়েটা কোলে নিয়ে তার বউও যে এসেছে এই বাড়িতে, স্বামীর স্বভাব নিয়ে লোকের কানাকানি সেও যে শুনছে, লজ্জায় মুখখানা যে অনেক আগেই নত করে রেখেছে, সেদিকে একদমই খেয়াল নাই মোতালেবের। একটা মৃত্যুর সুযোগে তার পকেটে যে আসবে কয়েকটা টাকা সেই স্বপ্নেই বিভোর হয়ে আছে সে। বারবারই তাগিদ দিচ্ছে আজিজকে। দেরি কইরো না মিয়া। বেইল অইতাছে। কোলাপাড়া যাইতে আইতে সময় লাগবো।

    শেষ পর্যন্ত না পেরে অসহায়ের মতো মোতালেবের দিকে তাকাল আজিজ। কত লাগবো?

    দেড় দুইশো টেকা দেও। কাপোড় খলফা গোলাপ পানি আগরবাত্তি, এমুনঐ লাগবো। বাচলে তো হেই টেকা তোমারে ফিরত দিমু। এত চিন্তা করতাছো ক্যা?

    আজিজ কাতর গলায় বলল, এত টেকা লাগবো!

    তয় লাগবো না? মুদ্দারের খরচা কী কম?

    অখিলদ্দি বিরক্ত হয়ে বলল, দিয়া দেও আজিজ। অরে বিদায় করো।

    অখিলদ্দির খোঁচাটা বুঝল মোতালেব, গায়ে মাখল না। এই সব খোঁচা গায়ে মাখলে পকেটে পয়সা আসবে কেমনে!

    লজ্জা যা পাওয়ার পেল মোতালেবের বউ। মেয়েকে এককোল থেকে আরেক কোলে এনে কোনওদিকে না তাকিয়ে, কেউ যেন দেখতে না পায় এমন ভঙ্গিতে বাড়ির নামার দিকে চলে গেল। রসের ভার কাঁধে ঠিক তখনই দবির এসে উঠছিল এই বাড়িতে। গাছিকে দেখে মায়ের কোলে বসা মেয়েটা বলল, রস খামু মা।

    শুনে স্বামীর ওপরকার রাগ মেয়ের ওপর ঝাড়ল মোতালেবের বউ। তীক্ষ্ণ গলায় ধমক দিল মেয়েকে। চুপ কর চোরের ঝি। রস খাইবো!

    কথাটা শুনে হা হা করে উঠল দবির। ধমকায়েন না, ধমকায়েন না। রস দেকলে পোলাপান মানুষ তো খাইতে চাইব।

    তারপর মেয়েটার দিকে তাকাল সে। তুমি বাইত্তে যাও মা। আমি তোমগো বাইত্তে আইতাছি। রস খাওয়ামুনে তোমারে। অহনঐ খাওয়াইতাম, ইট্টু অসুবিধা আছে দেইক্কা খাওয়াইতে পারলাম না। তুমি যাও, আমি আইতাছি।

    দবির প্রায় দৌড়ে উঠল আজিজদের বাড়িতে। উচ্ছল গলায় বলল, কো ছনুবুজি কো? ও বুজি, এই যে দেহো পয়লা দিনের রস তোমারে খাওয়াইতে লইয়াইছি। তোমারে না খাওয়াইয়া একফোডা রসও আমি বেচুম না। এই রসের লেইগা মিয়াবাড়ির বুজির কাছে তুমি আমারে চোর বানাইছিলা, হেই কথা আমি মনে রাখি নাই।

    তারপরই উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের দিকে চোখ পড়ল দবির গাছির, উঠানের মাটিতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা বানেছা, আজিজের দিকে চোখ পড়ল। দবির হতভম্ব হয়ে গেল। কী অইছে, আ, কী অইছে? বাইত্তে এত মানুষ ক্যা? ছনুবুজি কো?

    দবিরের কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল তছি। মামানী তো নাই, মামানী তো মইরা গেছে। তোমার রস হেয় কেমতে খাইবো গাছিদাদা! মইরা যাওনের সমায় একফোডা পানিও খাইতে পারে নাই। পানি মনে কইরা খাইছে মাইট্টাতেল।

    যে উজ্জ্বল মুখ নিয়ে এই বাড়িতে ঢুকেছিল দবির সেই মুখ ম্লান হয়ে গেল তার। গভীর দুঃখে বুকটা যেন ভেঙে গেল। নিজের অজান্তে কাঁধ থেকে রসের ভার নামাল। বিড়বিড় করে বলল, মইরা গেছে, ছনুবুজি মইরা গেছে! আমারে যে কইছিলো পয়লা দিনের রস যেন তারে খাওয়াই, আমি যে তারে কথা দিছিলাম খাওয়ামু, অহন, অহন আমি কেমতে আমার কথা রাখুম!

    দৌড় দিয়া ছনুবুড়ির ঘরে ঢুকল দবির। নিজের কাপড়ে গলা পর্যন্ত ঢাকা ছনুবুড়ি শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। মুখ এখনও মাখামাখি হয়ে আছে মাইট্টাতেলে, চোখ ঠিকরে বের হতে চাইছে কোটর থেকে। মনে করে মুখটা কেউ মোছাইয়া (মুছিয়ে) দেয় নাই, মনে করে চোখ দুইটা কেউ বন্ধ করে দেয় নাই।

    ছনুবুড়ির সামনে মাটিতে বসল দবির। মাজায় বান্ধা গামছা খুলে গভীর মমতায় তার মুখখানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, বুজি ও বুজি, আর একটা দিন বাইচ্চা থাকতে পারলা না তুমি! আমি যে তোমারে কথা দিছিলাম পয়লা দিনের রস তোমারে না খাওয়াইয়া কেরে খাওয়ামু না, তুমি তো আমারে আমার কথা রাখতে দিলা না। এই রস আমি অহনে কারে খাওয়ামু!

    কথা বলতে বলতে চোখ ভরে পানি এল দবির গাছির। আস্তে করে হাত বুলিয়ে ছনুবুড়ির-খোলা চোখ বন্ধ করে দিল। তারপর যে গামছায় ছনুবুড়ির মুখ মুছিয়েছিল সেই গামছায় চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

    উঠানে তখন পুরুষপোলা তেমন নাই। আজিজের কাছ থেকে টাকা নিয়া মোতালেব চলে গেছে কোলাপাড়া বাজারে। মতলেব গেছে বাঁশ কাটতে। আলফু মজিদ আর হাফিজদ্দি গোরস্থানে গেছে কবর খুঁড়তে। মজনু গেছে মান্নান মাওলানাকে খবর দিতে। জানাজা তিনিই পড়াবেন।

    ‘উঠানে নেমে আর কোনওদিকে তাকাল না দবির। ভার কাঁধে দুঃখি পায়ে বাড়ির নামার দিকে চলে গেল। সেখানে একটা বউন্না গাছে পা ঝুলিয়ে বসে তখন চিৎকার করে গান গাইছে হামেদ। আবদুল আলিমের গান। কাঁচা বাঁশের পালকি করে মাগো আমারে নিয়ো।’

    গানের কথা কানে লাগে দবির গাছির। কাঁচা বাঁশের পালকি করেই তো গোরস্থানে নেওয়া হবে ছনুবুজিকে। চদরি বাড়িতে বাঁশ কাটতে গেছে মতলেব। এই এতদূর থেকেও তার বাঁশ কাটার টুক টুক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আজকের পর ছনুবুড়ির সঙ্গে আর কারও দেখা হবে না কোনওদিন। কাঁচা বাঁশের পালকি চড়ে এমন এক দেশে চলে যাবে সে, মানুষের সাধ্য নাই সেই দেশ থেকে ফিরত আসার।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইন দ্য হ্যান্ড অব তালেবান – ইভন রিডলি
    Next Article শ্রেষ্ঠ গল্প – ইমদাদুল হক মিলন

    Related Articles

    ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলনের বিবিধ রচনা

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    অন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    এসো – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    দুই বাংলার দাম্পত্য কলহের শত কাহিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদিত

    July 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.