Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প471 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৯. প্যারিস থেকে আবার কলকাতা

    প্যারিস থেকে আবার কলকাতা চলে যাই। বইমেলায় যাবো। বাঁচতে যাই কলকাতায়। তোমাকে সম্ভবত আবার ভুলে থাকতে যাই। কিন্তু সত্যি কি ভোলা হয়! তুমি কখনও কলকাতায় আসোনি মা। তোমাকে দেশের কোথাও নিয়ে যাইনি, কলকাতায় নিয়ে আসার কথা কল্পনার মধ্যেও কখনও ছিলো না। দেশে যখন ছিলাম, বন্ধুদের নিয়ে কলকাতা বেড়াতে আসতাম। তুমি যখন ছোট ছিলে, তোমার বাবা কলকাতা থেকে তোমার জন্য লাল একটা জামা কিনে নিয়ে গিয়েছিল। কলকাতার কথা শুনেছো শুধু, কোনওদিন দেখনি কলকাতা কেমন দেখতে। আমি যখন দেশে ফিরে কলকাতার গল্প করতাম, তুমি নিঃশব্দে শুনতে। কোনওদিন বলোনি আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে কলকাতা। বলার সাহস হয়তো পেতে না। তোমার স্বপ্নগুলো ঠিক কেমন ছিল মা? কখনও উড়তো কি? নাকি চিরকালই খাঁচায় বন্দি ছিল? তুমি যেমন ছিলে? এবার বাবাকে কলকাতায় আসতে বলি। আমি বললেই তো ঘটনা ঘটে যায় না। বাবাকে রাজি করানো মানে হিমালয় পর্বতকে নড়ানো। ময়মনসিংহ থেকে তাকে ঢাকায় আনা, ভিসা করা, টিকিট করা, বিমানে ওঠানো ছোটদাই করে এই কাজগুলো। বাবা আর সুহৃদ আসে কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে। তবে বইমেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, একেবারে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মাত্র কয়েক দিনের জন্য আসে। তখন কলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হচ্ছে। বাবাকে নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিই। ঢাকার শহীদ মিনারে একুশে ফ্রেব্রুয়ারির ভোরে খালি পায়ে হেঁটে ফুল দিতাম, হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে। সেই শহীদ মিনারের তুলনায় কলকাতার মিনার কিছু নয়। লোকও নেই বেশি। তারপরও তো শহীদ মিনার। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা স্মরণ করছে বাংলা ভাষার জন্য পূর্ববঙ্গের বাঙালির আত্মত্যাগ এ বড় ভালো লাগা দেয়। বাংলার পূর্ব আর পশ্চিমকে আমি আলাদা করে দেখি না। দেখিনা বলেই আমি কলকাতায় এলে মনে করি দেশে ফিরেছি। যে দেশে এলে নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হতে পারে, সে দেশ দেশ নয়তো কী!

    তাজ বেঙ্গল হোটেলেই আমার সঙ্গে কদিন থাকে বাবা আর সুহৃদ। সুহৃদ সেই যে তোমার অসুখের সময় দেশে গিয়েছিলো, দেশেই থেকে গেছে। ওকে দেশেরইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সে চাইলেও আর ফিরতে পারছে না আমেরিকায়। আমেরিকায় ফেরারই কী দরকার, আমি বুঝি না। আমার শান্তিনগরের বাড়িতে থাকে। ওকে নিয়মিত টাকা পাঠাই বিদেশ থেকে। বই, কমপিউটার, কাপড়চোপড়, বইপত্র, খাওয়া দাওয়া যা দরকার সবকিছুর জন্য। তার নাকি দেশের পড়াশোনা ভালো লাগে না। আসলে সত্যি বলতে কী, আমেরিকার ইস্কুলের তুলনায় দেশের ইস্কুলেরপড়াশোনার চাপ বেশি, তাই ভালো না লাগায় ধরেছে। ছোটদা ছেলেকে খুব মানুষ করতে পারছে আমার মনে হয় না। সুহৃদ, লক্ষ করলাম, বন্ধুদের জন্য আনা যে হুইস্কি আনিয়েছিলাম, তার থেকে খানিকটা খেয়ে নিয়েছে। খেয়ে ধরা পড়ারপরও মিথ্যে বলছে যে খায়নি। বিশ্বাস হয় না এই ছেলেকে কী ভীষণ আদর দিয়েই না বড় করেছিলে! ছোটদাতার অগুণতি প্রেমিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ছেলের দেখাশোনা করবে কখন, বলো! মাস্টার রেখে দিয়েছে, সে মাস্টারের কাছেও নাকি যায় না। আমেরিকার ক্লাস এইটের ছেলের বিদ্যে বাংলাদেশের ইস্কুলে ক্লাস ফাইভের ছেলের মতো। প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবে ব্রিটিশ ইস্কুলের নিয়মে, ও লেভেল। কিন্তু পড়াশোনা করার ছেলে কি ও? এই অতি-চাপ থেকে বাঁচতে ওর এক চিন্তা আমেরিকায় ফিরে যাবে কী করে। আমেরিকার গ্রিন কার্ডও তখন ওর হয়নি। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে এবার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। পড়াশোনা না করলেও টেনিস খেলাটা সে নিয়মিত খেলছে। টেনিসের দল নিয়ে এশিয়ায় কোন কোন দেশে নাকি খেলেও এসেছে। কলকাতায় আসার কয়েক মাস পর কয়েকজন টেনিস খেলোয়ারের সঙ্গে লন্ডন গেছে খেলতে, ওখান থেকেপরিকল্পনা কানাডাতে খেলতে যাবে, কানাডা থেকে আমেরিকায়। তখনও আমেরিকার ভিসাতার জোটেনি। ছোটদা লন্ডনে ফ্রি টিকিটে নিয়ে এলো সুহৃদকে। ওকে দিয়ে আমাকে ফোন করালোপ্যারিসে, চলে যাচ্ছে আমেরিকায়, দেখা কবে হয় কে জানে। আমি যেন এক্ষুণি চলে আসি লন্ডনে।

    আমাকে একটিবার দেখতে চায়, যেহেতু কাছেই আছি। আমি খবর পেয়ে উড়ে চলে গেলাম লন্ডনে। ছোটদা আর সুহৃদকে পেয়ে আমার কী যে ভালো লাগলো। কিন্তু খানিক পরই ছোটদা সোজাসুজি বলে দিল, সে লন্ডন পর্যন্ত সুহৃদকে এনেছে। কালই সে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে বিমানে, সুহৃদকে কানাডা বা আমেরিকার টিকিটের টাকা দেওয়া, ওখানে থাকা খাওয়ার খরচ দেওয়া তারপক্ষে সম্ভব নয়। তার মানে টাকা আমাকে দিতে হবে। আসলে আমি জানতাম না, আমাকে দেখার জন্য নয়, সুহৃদকে দিয়ে প্যারিস থেকে আমাকে লন্ডন ডেকে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য হল, আমার ঘাড়ে সুহৃদকে ফেলা। যে ছেলেকে তার জন্ম থেকে ভালোবাসছি, সে ছেলেকে তো মাঝপথে রেখে তার বাবা চলে গেলেও আমি চলে যেতে পারি না। তার জন্য আমি তো নিঃস্ব হয়ে গেলেও, জীবন দিয়ে হলেও যা কিছু করার করবো। কিন্তু আমি তো অঢেল টাকা আনিনি। ছোটদার সে নিয়ে ভাবনা নেই। সে জানেনা কী করে সমস্যার সমাধান হবে। চলে গেল ছোটদা। আমার ওপর সুহৃদের সব দায়িত্ব ওর কানাডায় যাওয়া, হোটেলে থাকা, কানাডা থেকে আমেরিকা, যদি আমেরিকায় ঢুকতে না দেয় তবে ঢাকায় ফেরত যাওয়া, তার ওপর আবার যদি কোনও অঘটন ঘটে, সেই অঘটন সামলান। লন্ডনের কোনও এক হোটেলে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড থেকে যত ক্যাশ টাকা তোলা যায় তুলোম। কিন্তু ও টাকায় ওর যাত্রা হবেনা। ছোটদা দেখ আমাকে কী দুরবস্থার মধ্যে ফেলে চলে গেল। এখন কোত্থেকে আমি টাকা পাবো, লন্ডনে আমার কোনও ব্যাংক নেই যে আমি টাকা তুলবো। প্রত্যেকটা ক্রেডিট কার্ডের জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকার অংক থাকে, যেটুকু তুমি তুলতে পারো। আশংকা আমাকে আঁকড়ে ধরে লন্ডনের ব্যাংক থেকে জার্মানির হামবুর্গেশহরের ব্যাংকের ফোন নম্বর যোগাড় করি, সেখানে ফোন করে ব্যাংকের লোকদের লন্ডনের ওই ব্যাংকে এক্ষুণি দশ হাজার ডয়েচে মার্কপাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করি। সাধারণত এ ধরনের অনুরোধ মানে না ব্যাংক, কিন্তু জানি না কেন, মানলো। যে কেউ তো এমন উড়ো ফোন করে টাকা চাইতে পারে। কী করে জার্মানির ব্যাংক জানবে যে ফোনটা আমিই করেছি! কিছুরই তো প্রমাণ নেই। হাতে তো আমার অ্যাকাউন্টের তথ্যাদিও কিছুই ছিল না যে ওদের জানাবো। কণ্ঠস্বরও চেনা হওয়ার খুব কোনও কারণ ছিল না। সুহৃদকে টিকিট করে দিলাম কানাডা যাওয়ার নানা দেশের টাকা আমার ওয়ালেটে থাকে, ওসব ভাঙিয়েও কানাডার টাকা করে দিলাম। জার্মানির ডয়েচে মার্ককে পাউণ্ড করা, পাউণ্ডকে ডলার করা। এভাবেই আব্দার আহ্লাদ যার ছোটবেলা থেকেইপূরণ করে আসছি, পূরণ করি। সুহৃদকে কানাডার উড়োজাহাজে তুলে দিয়েতবে আমি ফিরলাম প্যারিসে। সুহৃদ শেষ অবদি পৌঁছেছিল নিউইয়র্কে, বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়েই। যে টাকা দিয়েছিলাম, তার অর্ধেকও তার দরকার পড়েনি। একদিন নাকি নিউইয়র্কের রাস্তায় কালো একদল গুণ্ডা তার বাকি টাকাগুলো কেড়ে নিয়েছে। এভাবেই আমার কষ্টের উপার্জন গেছে। বাবাকে কলকাতায় ডাক্তার দেখালাম। ওষুধপত্র যেভাবে খেতে বলেছে, সেভাবে বারবার অনুরোধ করলাম খেতে। চেয়েছিলাম বাবা আরও কটা দিন থাকুক। কিন্তু যে মানুষ ময়মনসিংহের বাড়ি আর চেম্বার ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না, তাকে আর কতদিন রাখা যায়! শুধু তোমার অসুখের সময় বেরিয়েছিল। আমাকে দেখতে বেরোলো বটে, কলকাতায়, কিন্তু যেহেতু আমি আর দুদিন বাদে মরছি না, বাবার যাই যাইটা মাত্রা ছাড়া হয়ে উঠলো। জোর করে, ধমক দিয়ে, বুঝিয়ে, অনুরোধ করেও বাবাকে বেশিদিন রাখতে পারিনি। একটাই বিছানা ছিল বড় তাজের সুইটে। ওতে বাবা, সুহৃদ আর আমি একসঙ্গে ঘুমিয়েছি। অনেক রাত জেগে গল্প করেছি। বাবার বোনের ছেলে মোতালেব এসেছিলো। ওকে দিয়ে খাবারটাবার বাইরে থেকে আনিয়েছি। হোটেলের রেস্তোরাঁয় খেতে চাইনি, অকারণে অত্যধিক দাম, তাই। এখন আবার ভাবি, কেন আমি বাবাকে ভালো রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন খাওয়াইনি। কেন বাবাকে যত সময় দিয়েছি তার চেয়েও বেশি দিইনি। নিখিল সরকারের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবাকে। বাবা অনেকটা যেন স্বস্তি পেলেন কেউ আমাকে বাবার মতো স্নেহ করছে দেখে। যে মেয়ে দেশে ফিরতে পারছে না, সেই মেয়েকে যারা ভালোবাসছে, তার ভালো মন্দ যারা দেখছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে বাবা বিনয়ে গলে পড়েছে। সুইডেন থেকে দেশে ফিরে যাওয়ার আগের দিন মাইকেলকে জড়িয়ে ধরে ‘টেইক কেয়ার মাই ডটার, প্লিজ মাইলে, টেক কেয়ার মাই ডটার’ বলে জোরে জোরে কাঁদছিলে তুমি। নিখিল সরকারকে জড়িয়ে ধরে না কাঁদলেও বাবার চোখে মুখে তোমার সেই আকুতিই ছিলো। বুদ্ধদেব গুহ আমার হোটেলে এসেছিলেন। তাঁকে দেখে, তাঁর গান শুনে বাবা বিষম মুগ্ধ। দেশ থেকে জাদুকর জুয়েল আইচ এসেছিলেন। তাঁর জাদু দেখেও বাবা ভীষণ খুশি। এমনকী কোনও এক কালে বাবার চণ্ডিপাশা ইস্কুলের ছাত্র ছিলো দাবি করে এক বয়স্ক লোক বাবার সঙ্গে দেখা করার নাম করে মূলত আমাকেই দেখতে আসতো, তাঁর সঙ্গেও বাবা ঘণ্টা দুঘণ্টা বসে কী কথা বলতো কে জানে। বাবা একসময় কী কথায় যেন বাড়িঘর জমিজমা ভাগ করার পরিকল্পনা করছে বললো। আমি বলেছিলাম সব চারভাগেসমান ভাবে ভাগকরতে। পরে অবশ্য বলেছিলাম, আমার কিছুই চাইনা, শুধু অবকাশটা চাই। আমার বড় হয়ে ওঠা, আমার কৈশোর, যৌবন যে বাড়িতে, যে আঙিনায় কেটেছে, দাবি করেছি সেই স্মৃতিটুকুই। বাবা শুধু রহস্যের হাসি হাসলো। বাবার এই হাসি আমার জন্ম থেকে চেনা। বাবার রহস্য চিরকালই আমার কাছে রহস্যই থেকে যেত। যেদিন বাবাকে কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে নামিয়ে দিতে গেলাম, বুক ফেটে যাচ্ছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, বাবার সঙ্গে এই বোধহয় আমার শেষ দেখা! আমার সেই মনে হওয়াটা ভুল ছিল না মা। বাবার সঙ্গে ওই-ই ছিল আমার শেষ দেখা।

    বাবা দেশে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর আমিও ফিরে যাই প্যারিসে। কেন যে যাই কে জানে। অবশ্য কলকাতায় বাড়ি নেই ঘর নেই, এক হোটেলে হোটেলে আর কদিন থাকবো। আর ভিসাও তো ফুরিয়ে যায় দেখতে দেখতে। কিন্তু সেবার কী হলো শোনেনা, বোম্বে থেকে আমার হোটেলে ফোন করলেন অশোক সাহানি, এক মারাঠি লোক, তিনি আমার শোধ উপন্যাসটা বাংলা থেকে মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বইটা ছাপাও হয়েছে বোম্বেতে। অশোক সাহানির আবদার এবার যেন কলকাতা থেকেপ্যারিস ফেরারপথে বোম্বেতে আমি কয়েকঘণ্টার জন্য থামি, বইটার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি। রাজি না হওয়ার কিছু নেই। কলকাতা থেকে সন্ধেয় বোম্বেতে পৌঁছেপ্যারিসের রাতের বিমান ধরার বদলে সকালে বোম্বে পৌঁছে শোধের অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে প্যারিসের দিকে রওনা হবো, এতে ক্ষতি নেই কোনও কিন্তু বিশাল গণ্ডগোল বেধে গেল। অশোক সাহানি আমার বোম্বের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার খবর ছাপিয়ে দিয়েছেন ওখানকার পত্রিকায়। আর সঙ্গে সঙ্গে বোম্বের মুসলিম মৌলবাদীদের মিছিল শুরু হয়ে যায়। তারা ঘোষণা করে দেয় বোম্বের মাটিতে পা দেওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। আমি এলে বিমান বন্দরে ওরা আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এদিকে এসবখবরে বোম্বের মৌলবাদবিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদ শুরু হল। মুহুর্মুহু ফোন আসতে শুরু করলো তিস্তা শীতলবাদি, জাভেদ আনন্দ, এমনকী জাভেদ আখতারেরও। তাঁরা চান আমি যেন আবার ঘুণাক্ষরেও না সিদ্ধান্ত নিই বোম্বে না আসার। আসলে আমি সিদ্ধান্ত না নিলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উপদেশ ছিল বোম্বে হয়ে না গিয়ে দিল্লি হয়ে যেন প্যারিস যাই। ওতেই রাজি ছিলাম। কিন্তু যতবার ওঁদের বলি, বোম্বে হয়ে যাবো না, ততবারই ওঁরা বলেন, আমি না গেলে মৌলবাদীদের বিজয় ঘোষিত হবে, মৌলবাদীরাপার পেয়ে যাবে এই অবৈধ ফতোয়া দিয়ে। ওঁরা নাহয় আন্দোলন করছেন, কিন্তু মরতে তেহবে একা আমাকে, আমিই যখন টার্গেট। লেখার আরও বই আছে বাকি, জেনে শুনে জীবন হারাতে চাই না এখন। বোম্বের মাটিতেপা দিলে আমাকে মেরে ফেলবে, যারা ঘোষণা করেছে, তারা ছোটখাটো কোনও দল নয়। তারা যে কত ভয়ংকর, তা আমি বাংলাদেশে দেখে এসেছি। মূর্খ উন্মাদের সামনে বুক পেতে দাঁড়াবার কী প্রয়োজন। আর পাশ্চাত্যের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার অভিজ্ঞতা যার আছে, তার কখনও এ দেশের নড়বড়ে নিরাপত্তার ওপর আস্থা রাখার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ওঁরা বলেই চলেছেন, সরকারের সঙ্গে কথা হয়েছে ওঁদের। নিরাপত্তার ব্যবস্থা কঠোর করা হবে। শেষে অন্তত এইটুকু বলে নিস্তার পেতে চাই যে মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন না বোম্বেতে আমি যাই। ওঁরাও জোঁকের মতো লেগে থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজি করালেন। বোম্বে যেদিন নামলাম, আমি তো অবাক, মহেশ ভাট, আমার প্রিয়পরিচালক দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়, হাতে ফুল। দাঁড়িয়ে আছেন আমার প্রিয় গীতিকার জাভেদ আখতার, দাঁড়িয়ে আছেন শাবানা আজমি, আমার প্রিয় অভিনেত্রী। শাবানা আজমি দিল্লিতে ছিলেন। দিল্লি থেকে চলে এসেছেন বোম্বের বিমান বন্দরে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে। পুনে থেকে লজ্জার প্রকাশক এসেছেন। তিস্তা, জাভেদ ওঁরা তো ছিলেনই। ওঁরা হিন্দু মৌলবাদের বিপক্ষে যেমন লড়েন, মুসলিম মৌলবাদের বিপক্ষেও লড়েন। বিমান বন্দরের ভিআইপি রুম আমাকে বিশ্রামের জন্য দেওয়া হল। বিশ্রামের কোনও দরকার ছিল না। আমি রীতিমত উত্তেজিত। কী যে কথা বলবো ওঁদের সঙ্গে বুঝতে পারছিলাম না। সাংবাদিকদের ভীষণ ভিড়। বিমান বন্দর ঘিরে আছে শত শত পুলিশ। আয়োজকরাই বললেন, আমাকে নাকি জেড সিকিউরিটি দেওয়া হচ্ছে। একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে শহরে। বোম্বের রাস্তা থেকে জঙ্গিদের গ্রেফতার করাও হচ্ছে। আমাকে প্রথম জুহু বিচে জাভেদ আনন্দর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে দুপুরের খাওয়া। নিজে সে পারসি। কিন্তু ধর্মমুক্ত। কমব্যাট নামের একটা মৌলবাদ বিরোধী ম্যাগাজিন ছাপান তিস্তা আর জাভেদ। ওই বাড়ির উঠোনে বসেশাবানা, জাভেদ আখতার, তিস্তা–ওঁদের সবার সঙ্গে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে আলোচনা হয়। মহেশ ভাট বলেন, আমার জীবন নিয়ে তিনি একটা সিনেমা বানাতে চান। কোথাও ঘোষণাও দিয়ে দেন। বিদেশে আমাকে ঘিরে অনেক উৎসব হয়। যত বড় আর জমকালোই হোক না কেন সেইসব উৎসব বা সংবর্ধনা, বোম্বের এই উৎসব আমাকে উত্তেজনা দেয়, কারণ এঁদের কাজের সঙ্গে আমি পরিচিত, আর এঁরা একই লড়াই করছেন, যে লড়াই আমি আমার লেখার মাধ্যমে করছি বহু বছর। আমরা একই উপমহাদেশের মানুষ। আমাদের ইতিহাসটাও যেমন এক, আমাদের লড়াইটাও প্রায় একইরকম। এর আগে জাভেদ আখতারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল স্টকহোমে। তিনি ভারতীয় অভিবাসীদের আমন্ত্রণে ওখানে গিয়েছিলেন, কবিতা শোনাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে ডেকেপাশে বসালেন, পড়েছিলেনও আমাকে নিয়ে একটা কবিতা শব্দের জাদুকর তিনি। কিন্তু কাছে এলে বুঝি কী সাধারণ মানুষ এঁরা। শাবানাও। আমার মতোই সাধারণ। দুঃখ সুখ এঁদেরও আর সবার মতোই। আসলে দেশেবিদেশে যত বড় মানুষের সঙ্গেপরিচয় হয়েছে, কাউকে আমার খুব দুর্বোধ্য ঠেকেনি। রাতে অনুষ্ঠানেরপর জাভেদ আখতার বসে রইলেন টেলিভিশনের সামনে, কখন আমাদের অনুষ্ঠানের খবর বা আমার খবর দেখায় দেখতে। অনুষ্ঠানে সবাই বক্তৃতা করেছিলেন। শোধ বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা প্রচুর পুলিশ পাহারায়হয়, মূলত মৌলবাদবিরোধী মূল্যবান একটা অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।

    প্যারিসে পৌঁছোনোর পর খবর পাই, ‘আমার মেয়েবেলা’ বইএর জন্য আমি এবারের আনন্দ পুরস্কার পেয়েছি। কত তোপুরস্কার পেয়েছি বিদেশে। কিছুই আমাকে এত সুখ দিতেপারে না, যত সুখ আনন্দ পুরস্কারের খবরটি দেয়। খুব গোপন একটি তথ্য আমাকেপুরস্কার কমিটির একজন জানান, তা হল, বিরানব্বই সালে কমিটির একজনই আমার আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন, এবার দুহাজার সালেও ওই একজনই বিরোধিতা করলেন, তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। মানুষের মুখ ও মুখোশ আমি কখনও আলাদা করতে পারি না। মুখোশকেই মুখ বলে চিরকাল মনে করেছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কোনওকালেই কিছু নিয়ে বিরোধ ছিল না। তাঁকে শ্রদ্ধা করি, লেখক হিসেবে তো বটেই, তাঁর নাস্তিকতা এবং বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর লড়াইএর ঘোর সমর্থকআমি। তিনিও সবসময় বলে আসছেন, আমাকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। অনেক আগে, বাংলাদেশে লজ্জা নিষিদ্ধ করার পর বিবিসি একটা তথ্যচিত্র করেছিলো আমার ওপর। ওই তথ্যচিত্রেই দেখিয়েছে আমার সম্পর্কে কলকাতার কফি হাউজে বসে বুদ্ধদেব গুহ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন–তিন বড় সাহিত্যিকের আলোচনা। তিনজনের মধ্যে একজনই আমার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন, তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকে সবসময় খুব কাছের মানুষ ভাবতাম। কখনও কল্পনাও করিনি আনন্দ পুরস্কার কমিটির সভায় বসে আমার বিরুদ্ধে বলেন তিনি। হতেই পারে যে তিনি মনে করছেন না পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য আমি। হতেই পারে তিনি আমাকে লেখক বলেই মনে করছেন না। কিন্তু মুশকিল হল তাঁর সঙ্গে কথা বললে সেটা বোঝার কোনও উপায় থাকে না। বরং মনে হয়, আমাকে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ লেখক ভাবেন আর আমার পক্ষে এইমাত্রই হয়তো কোথাও থেকে যুদ্ধ করে এলেন। এরপর তোমা, তুমি জানোনাপশ্চিমবঙ্গে আমার বই নিষিদ্ধ হয়, এবং যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন, তার মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন। কিছু কিছু সত্যকে, আজও, সবকিছু জানার পরও, আমার অসম্ভব বলে মনে হয়।

    দুদুবার বিজেপি সরকার আমাকে ভিসা দিয়েছে ভারত ভ্রমণের। কিন্তু আনন্দপুরস্কার নিতে কলকাতায় যাওয়ার জন্য ভারতের ভিসা নিতে গেলে দূতাবাস থেকে বলে দিলো ভিসা দেবে না। কী কারণ, বোম্বেয় আমার বিরুদ্ধে মুসলমানদের মিছিল হয়েছে, তাই। কলকাতায় জানিয়ে দিলাম খবর, আমাকে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। মহেশ ভাটের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, তাঁকেও জানালাম। কী কী সব মন্ত্রী টস্ত্রীর সঙ্গে নাকি কথা বলেছেন, তাতে কাজ হবে বলে মনে করেছিলেন। শেষে দেখলেন অসম্ভব। ওদিকে কলকাতা থেকে আনন্দবাজারের মালিক অভীক সরকার চেষ্টা করতে লাগলেন, শুনলাম তিনি দিল্লি অবধি গেছেন এ নিয়ে সরকারের বড় কারও সঙ্গে কথা বলতে। অবাক হই ভেবে বিজেপি নাকি মুসলমান বিরোধী। বিরোধীদলে বসে অনেক কিছুই হয়তো বলে, কিন্তু ক্ষমতায় বসে অন্য দল যেভাবে দেশ চালায়, বিজেপিও একইভাবে চালায়। মুসলমান মৌলবাদীদের অন্যায় আব্দার অন্য দলের মতো বিজিপিও মেনে নেয়। মুসলমানের ব্যক্তিগত আইন যেটি খুব উলঙ্গভাবে নারীবিরোধী, সেটি দূর করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বললেও ক্ষমতায় এসে সেই বিধি ভাবনা উড়িয়ে দেয় বিজেপি। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর শেষ মুহূর্তে ভিসার অনুমতি জোটে। কিন্তু যারা আমাকে আগে রীতিমত আদর যত্ন করেছিলো দূতাবাসে, তারা আদর যত্ন তো দূরের কথা, বরং গম্ভীর মুখে আমাকে শর্তের একটি কাগজ দেয় সই করার জন্য। ভিসা পেতে হলে যা আমাকে মানতে হবে, তা হল, ভারতের রাজনীতি নিয়ে কোনও শব্দ উচ্চারণ করা চলবে না, কলকাতা ছাড়া আর কোনও শহরে পা দেওয়া চলবে না, পুরস্কার সম্পর্কিত অথবা সাহিত্য সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া কোনও সাক্ষাৎকার দেওয়া চলবে না। ভিসা দেওয়ার আগে টিকিট দেখে নিয়েছে যে ফিরছিপাঁচদিনপর। না, পাঁচদিনের বেশি আমাকে ভিসা দেওয়া হয়নি।

    টিকিট পড়ে রইলো টেবিলের কাগজপত্রে ডুবে। ভিসা পাসপোর্টও কিছুর তলায়। সেদিন আমি ভুলে গেছি যে আমার কলকাতায় যাওয়ার কথা। দিব্যি মগ্ন ছিলাম কবিতায়, ভাসছিলাম, ডুবছিলাম চিরাচরিত নিঃসঙ্গতায়। যারা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল দমদম বিমান বন্দরে, তাদের ফোনে আমার গভীর রাতের ঘুম ভাঙে। তুমি আসোনি কলকাতায়? বললাম, কাল আমার ফ্লাইট। বলো কি, তোমার তো ফ্লাইট আজকে ছিলো! উঠে কাগজপত্রের জঙ্গল থেকে টিকিট বের করে দেখলাম ভুল আমিই করেছি। কলকাতা থেকে আবার জরুরি টিকিটের ব্যবস্থা করে দিল যেন পরদিন আমি ফ্লাইট ধরতে পারি। যেদিন আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হবে সেদিন গিয়ে কলকাতা পৌঁছোলাম। বন্ধুরা আমার পুরস্কার পাওয়ায় রীতিমত উত্তেজিত। আমার দুএকটা সাদামাটা শাড়ি দেখে বিশ্ব রায় দৌড়ে গিয়ে গরদের একটা লাল পাড় শাড়ি কিনে নিয়ে এলো, ব্লাউজও বানিয়ে নিয়ে এলো অল্প সময়ে। বিশ্ব রায় গতবারের কলকাতা ভ্রমণে চমৎকার বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। যত বেশি থাকা হয় কলকাতায়, তত বেশি বন্ধু গড়ে ওঠে। অনেকে নাম দেখে, যশ দেখে বন্ধু হতে চায়। কিন্তু সেই বন্ধুত্বে কোনও না কোনওসময় চিড় ধরেই। বাঙালিরা, লক্ষ করেছি খুব দ্রুত বন্ধু হতে পারে। বিদেশিরাও বন্ধু হয়, তবে এমন তুড়ি বাজিয়ে হয় না। বন্ধু হতে ওরা সময় নেয় অনেক। স্বতস্ফূর্ততা আমার রক্তে। বাঙালির ভালোবাসা আমার নির্জনতা নিমেষে ঘুচিয়ে দেয়। জানি না কী দেয় আমাকে, মনে হয় হারিয়ে যাওয়া গোটা একটা দেশ দেয়।

    বাবার সঙ্গে আরেকবার দেখা হতে আমারপারতো। কলকাতার আনন্দপুরস্কার অনুষ্ঠানে বাবাকে অনেক বলেছিলাম আসতে, আসেনি। সম্ভবত আমার চেয়েও তখন তার প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে দেশের বাড়ি, চেম্বার, তার সকাল সন্ধে রোগী দেখা, দাদার সংসারের দায়িত্ব নেওয়া। আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো আমার মেয়েবেলার জন্য, যে আনন্দ থেকে আমার বইটা ছাপানো হয়নি, সেই আনন্দই আমাকে পুরস্কার দিল! এই প্রথম পুরস্কার অনুষ্ঠান গ্র্যান্ড হোটেলের বদলে রবীন্দ্র সদনে করা হল। পুরস্কার অনুষ্ঠানের মঞ্চ অসাধারণ, যেন বনেদি একটি বৈঠক ঘর। সেই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তোমার কথা বলেছিলাম মা। বক্তৃতার পুরোটাই তোমাকে শোনাতে ইচ্ছে করছে, শোনো।

    নমস্কার। এখানে আগেও এসেছিলাম আমি, এই মঞ্চে, এসেছিলাম পাশের দেশ থেকে, তখন ঢাকার হাসপাতালে চাকরি করি, পাশাপাশি লিখি, কটি মাত্র বই বেরিয়েছে। এবার এলাম, তবে আর পাশের দেশ থেকে নয়, বহু দূরের দেশ থেকে, এখন আর ডাক্তারি করা হয় না, কেবল লেখাই কাজ। তখনকার সেই বিরানব্বই সালের আমি আর আজকের আমির মধ্যে অনেক পার্থক্য। মাঝখানে আট বছর কেটে গেছে, আর এই আট বছরে অনেক কিছু ঘটে গেছে এই একটি জীবনে। যা ঘটেছে, সবই লেখার কারণে। লিখি বলে ডাক্তারি ছাড়তে হয়েছে, লিখি বলে মিছিল হয়েছে, হত্যার হুমকি এসেছে, মাথার মূল্য ধার্য হয়েছে, লিখি বলে মামলা জারি হয়েছে, হুলিয়া বেরিয়েছে, ধর্মঘট হয়েছে, মানুষ খুন হয়েছে, লিখি বলে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি পালাতে হয়েছে রাতের পর রাত। লিখি বলে স্বজন বন্ধু সব ছাড়তে হয়েছে, ছাড়তে হয়েছে ঘর বাড়ি, ব্রহ্মপুত্র, দেশ। লিখি বলে আবার পুরস্কারও জুটেছে।

    জীবন এমনই! অনিশ্চিত। আজ সম্মান পাচ্ছি, কাল হয়ত অসম্মানের চূড়ান্ত হব। আজ ঢিল ছুঁড়ছে কেউ তো কাল বাহবা দেবে। আজ মনে রাখছে তো কাল ভুলে যাবে। আজ বেঁচে আছি, কাল মরে যাব। জীবনের কোনও তো অর্থ নেই আসলে, যদি না নিজেরা অর্থপূর্ণ করি জীবনকে। একটি ব্যাপার আমি বেশ বুঝতে পেরেছি, ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা আমাকে তাড়া করতে করতে যেখানে নিয়ে ফেলেছে, অনাত্মীয় একটি পরিবেশে, অচেনা একটি জগতে, যেন আমি একা একা কষ্ট পেতে পেতে মরে যাই, যেন আমি হারিয়ে যাই বিষম বিরুদ্ধ স্রোতে, ভুলে যাই কী কারণে এই আমি, আমি সেখানে, এটা ঠিক, আমাকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে, নিজের সঙ্গে নিজেকেই। এক আমি চাই সবার অলক্ষ্যে একটি বিন্দুর মত, ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যেতে, অভিমানে, বিষাদে। আরেক আমি হঠাৎ হঠাৎ বিষাদ ঝেড়ে উঠে দাঁড়াই বাঁচব বলে। বেঁচে থাকতে হলে আর এমন কিছু নেই আমার, যে, নিয়ে বাঁচি। এক লেখা ছাড়া।

    বাংলা থেকে দূরে আমি, লিখি বাংলায়। বাঙালির জীবন থেকে হাজার মাইল দূরে বসে বাঙালির গল্প লিখি। এ যে কী রকম কঠিন কাজ, সে আমি বুঝি। আমার প্রতিদিনকার জীবন যাপনে বাংলার ছিটেফোঁটা নেই। স্মৃতি নির্ভর সব, যা কিছুই লিখি। ছ বছরপর কলকাতায় আসার সুযোগ হল, এ আমার জন্য পরম পাওয়া! এ সুযোগ আমি হারাতে চাই না। এর মধ্যেই সুযোগটি কেড়ে নেবার পাঁয়তারা চলছে, জানি না, ভারতে এই আমার শেষ আসা কিনা। আগেই বলেছি, জীবন অনিশ্চিত। আর আমার জীবনে অনিশ্চয়তা বরাবরই বড় বেশি।

    .

    যে বইটির জন্য আজ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, সেই বইটিই, মাত্র আধঘণ্টার উড়ান দূরত্বে, পাশের দেশে, আমার নিজের দেশে, নিষিদ্ধ। ওখানে ছাপা হওয়ার আগেই এটি নিষিদ্ধ। বলা হয়েছে, এ অশ্লীল একটি বই, বলা হয়েছে, এটিপড়লে লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। এরকম কথা আমার অন্য বই সম্পর্কেও বলা হয়, যা কিছুই উচ্চারণ করি আমি, ওই একই দোষ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছি এই অপরাধে আমাকে বারবার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। এসব আমার অধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়। কিন্তু কারও অধর্মীয় অনুভূতিকে মোটে মূল্য দেওয়ার বিধান কোথাও নেই, কোনও আইন নেই যে আশ্রয় নেব। আমার জন্য এই দিনটি অবিশ্বাস্য একটি দিন, যখন বাংলা সাহিত্য থেকে দূরত্ব আমার ক্রমশ বাড়ছে, এবং আমি আশংকা করছি দিন দিন এই ভেবে যে লেখার শক্তি বুঝি আমার ফুরিয়ে গেছে, আমার বুঝি শুরুতেই সারা হল, তখনই এই আশ্চর্য সম্মান নাছোড়বান্দার মত একটি ইচ্ছে জাগাচ্ছে ভেতরে আমার, লেখার ইচ্ছে। …আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতেন, বিষম খুশি হতেন। স্বামী এবং কন্যা চিকিৎসক, আর তাঁকে মরে যেতে হয়েছে বিনা চিকিৎসায়। অভাবে, অনাহারে, অনাদরে, অবহেলায়, অসম্মানে, অত্যাচারে মার সারা জীবন কেটেছে। আমার মার একার গল্পই যথেষ্ট সমাজে নারীর অবস্থান জানতে। আমি যখন নারী পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিখছিলাম, লিখে নাম করছিলাম, আমি কিন্তু নিজের মার দিকে ফিরে তাকাইনি। দেখিনি কতটা যন্ত্রণা তিনি সইছেন, দেখিনি পুরুষতন্ত্রের পাকে পড়ে কেমন একটি দাসী বনেছেন তিনি, যে দাসীর প্রধান এবং প্রথম কাজ স্বামী সন্তানের সেবা করা, তাদের সুখী করা। মা আমাদের সবাইকে সুখী করেছিলেন নিরন্তর সেবায়, তাঁর নিজের যে আলাদা একটি জীবন আছে, এবং সে জীবনটি যে কেবল তাঁরই, সে জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার তাঁর আছে, তা তাঁকে কখনই জানতে দেওয়া হয়নি। নারী যে সম্পূর্ণ মানুষ তা সেই আদিকাল থেকেই স্বীকার করা হয়নি, আজও হয় না। পুরুষের পাঁজর থেকে তৈরি নারী, পুরুষেরা যাহা বলিবে, নারীকে তাহাই করিতে হইবে, না করিলে তাহাকে আচ্ছা করিয়া পিটাইতে হইবে। নারীর ঘাড়ের একটি হাড় বাঁকা, তাই তারা বাঁকা পথে চলে। স্বাধীনতায়, আর যারই অধিকার থাকুক, কুকুর বেড়াল গরু ছাগল, নারীর অধিকার নৈব নৈব চ। এই আমিও, নারীবাদের জন্য দিনরাত আপোসহীন লড়াই করেও মাকে আমি মা ছাড়া আলাদা কোনও নারী হিসেবে দেখিনি, আর মা মানেই তো, সমাজ আমাদের যা শিখিয়েছে, সংসারের ঘানি টানে যে, সবচেয়ে ভাল রাঁধে যে, বাড়ে যে, কাপড় চোপড় ধুয়ে রাখে, গুছিয়ে রাখে যে; মা মানে হাড় মাংস কালি করে সকাল সন্ধে খাটে যে, যার হাসতে নেই, যাকে কেবল কাঁদলে মানায়, শোকের নদীতে যার নাক অবদি ডুবে থাকা মানায়। সমাজের অনেক কিছুই আমরা মেনে নিই না বটে, প্রতিবাদ করি, কিন্তু অজান্তে অনেক সংস্কারই গোপনে লুকিয়ে থাকে এই আমাদের ভেতরই। আসলে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র এত শক্ত হয়ে বসে আছে আমাদের ঘাড়ে, এত বেশি ছড়িয়ে আছে আমাদের রক্তে, মস্তিষ্কে, অনেক সময় এ থেকে দূরে এসেছি ভেবেও কিন্তু এরই বীর্যে খাবি খেতে থাকি।

    ভাবলে আমার অবাক লাগে যে, যত বিজ্ঞান নির্ভর হচ্ছে মানুষ, ততই যেন ধর্মের বিস্তার হচ্ছে জগত্ময়। বিবর্তন তত্ত্বেষথেষ্ট প্রমাণ নেই, এই কারণ দেখিয়ে অলৌকিক সৃষ্টিতে বিশ্বাসী হওয়ার আন্দোলন চলছেতথাকথিত উন্নত বিশ্বেও। সভ্যতা কি শেষ অবদি পেছন দিকে হাঁটবে, মধ্যযুগের অন্ধকারই কি তবে মানুষের গন্তব্য! ধর্মের জালে সবচেয়ে বেশি আটকা পড়ে নারী, এ আমরা সবাই জানি। পুরুষের তৈরি এই ধর্ম, এই সমাজ এই জঞ্জাল থেকে নারী যদি বেরিয়ে না আসে, আগেও বহুবার বলেছি, আবারও বলছি, নারীর মুক্তি নেই। কেবল নারীর নয়, পুরুষেরও নেই। দারিদ্র্য, বন্যা, খরা পীড়িত দেশে পুংলিঙ্গের জয় জয়কার যেমন, পুঁজি-পীড়িত দেশেও তেমন। কোথাও আমি দেখিনি একটি সত্যিকার বৈষম্যহীন সুস্থ সমাজ। অর্থনৈতিক মুক্তিই সকল বৈষম্য থেকে মুক্তি দেবে মানুষকে, এ কেবলই তত্ত্বকথা। যুক্তি এবং মুক্তচিন্তার সুষ্ঠু চর্চাই অন্ধকার সরাতে পারে, পারে ক্ষুধা, অজ্ঞানতা, অশিক্ষা, অন্ধতা, বৈষম্য আর সন্ত্রাসের গ্রাস থেকে বাঁচাতে মানুষকে। আমার মেয়েবেলা বইটির অনেক চরিত্রই, আমার চারপাশের, দরিদ্র নয়, কিন্তু অতি নিচ, অন্ধ, অজ্ঞান। আমি জীবন যেমন দেখেছি, লিখেছি। ও কেবল আমার জীবন নয়, সমাজের অধিকাংশ মেয়ের জীবনই ওরকম। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা, বিষাদে বিবর্ণ হয়ে থাকা। ওই বয়সেই মেয়েরা শিখে নিতে বাধ্য হয় যে মেয়েতে ছেলেতে তফাৎ অনেক, মেয়েদের অনেককিছু করতে নেই, ভাবতে নেই, অনেক কিছু বুঝতে নেই, বলতে নেই। আমিও তেমন শিখেছিলাম।

    মাত্র দুশ কী আড়াইশ পাতায় পুরো শৈশব কৈশোর কি তুলে আনা সম্ভব! ছিটেফোঁটা যা মনে পড়েছে, আধখেচড়া, অনেকটা খসড়া মত, লেখা। ধোঁয়াটে, ধুলোটে; অস্পষ্ট, অপুষ্ট, অদক্ষ হাতের স্কেচ। সামান্য বইটির জন্য আজ যে অসামান্য সম্মান আমাকে দেওয়া হচ্ছে, তা আমাকে কুণ্ঠিত করছে, সেই সঙ্গে গর্বিতও। আমি ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ। ভালবাসা আমি ঢের পেয়েছি, এত ভালবাসা পাবার যোগ্য আমি নই। এ জীবনে দুঃখ সুখ দুটোই বড় প্রবল হয়ে আমার কাছে ভিড়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এত দুঃখ পাবারও আমার মত সামান্য একজন মানুষের জন্য প্রয়োজন ছিল না। আমার বুঝি ওই ভাল ছিল, সূর্যাস্তের সবগুলো রঙ গায়ে মেখে কাশফুলে ছাওয়া ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ক্লান্তিহীন, বাতাসের উল্টোদিকে, কেবল দৌড়ে যাওয়া। আমার বুঝি ওই ভাল ছিল, জীবনভর জীবন দেখতে দেখতে যাওয়া। ছোট ছোট দুঃখ সুখে দোলা। বেশ ভাল করেই জানি আমি ভাল সাহিত্যিক নই, ভাল নারীবাদীও নই। জীবন যেহেতু অর্থহীন, আর এই জীবন যেহেতু বড় এক প্রাপ্তিও, তাই জীবনের যা কিছু, সবই ভোগ করতে চাই, আর এই ভোগে যা কিছুই বাধা হয়ে আসে, ডিঙোতে চাই, রীতি, নীতি, যন্ত্র, মন্ত্র, পুরুষতন্ত্র, ধর্ম, বর্ম সবই। মাত্র কদিনের এই জীবনকে খামোকো অদ্ভুত সব নিয়মের জালে জড়াবো কেন! কেনই বা শেকলে বাঁধব! স্বাধীনতা, এই শব্দটির মূল্য আমার কাছে অনেক। এটি পেতে গিয়ে বার বার আমি পরাধীন হয়েছি। বারবার শেকল ছিঁড়েছি। নারীমাংসের গন্ধ পেলে হাঁ-মুখোপরাধীনতা একশ দাঁত মেলে দৌড়ে আসে, কামড়ে খেতে চায়। নারীর জীবন চলে যায় কেবল জীবন বাঁচাতে।

    আমি আর যাই করি, প্রতারণা করি না, না নিজের সঙ্গে, না অন্যের সঙ্গে। অকপটে সত্য বলতে আমার বেশ আনন্দ হয়। জীবনে এ নিয়ে অনেক ভুগতে হয়েছে আমাকে। নিজের দেশে যেমন, অন্য দেশেও তেমন। আর লেখার বেলাতেও, বানিয়ে গল্প লেখার চেয়ে সত্য ঘটনা লেখায় আমার আগ্রহ বেশি। চারপাশে কত গল্প ঘটছে আমাদের। কেন বানাতে যাব! আমার কল্পনাশক্তি সম্ভবত কম, আমার স্মরণশক্তির মত। আগাগোড়া দুর্বল মানুষ আমি, লোকে সবল বলে ভাবে, ভুল করে। যত যাই বলি না কেন, আমি নেহাতই সাদাসিধে মানুষ, যারাই আমার কাছে এসেছে, বুঝেছে। আমি খোলস বা মুখোশ এগুলো একেবারে গায়ে রাখতে পারি না, ওসব গায়ে আছে ভাবলেও হাঁসফাঁস লাগে। নিজের জীবনকাহিনী লিখছি, নিজেকে চিনি বলে। নিজের

    জীবনের গল্প বলা শেষ হয়ে গেলে হয়ত অন্য কারও জীবন নিয়ে লিখব, যাকে চিনি, যার চরিত্রের গভীরে যেতে পারি অনায়াসে। মানুষ, এখনও আমার কাছে বড় চেনা, আবার বড় অচেনাও। কারও সঙ্গে বত্রিশ বছর কাটিয়েও মনে হয়, তাকে ঠিক চেনা হয়নি আমার। আবার নিজের কথাও মাঝে মাঝে ভাবি, এত যে চিনি বলে ভাবি, নিজেকে কি আসলেই আমি ভাল চিনি!

    একসময় বলতাম সকলেরই দু একজন আত্মীয়, সংসার, ঘরে ফেরা, ইত্যাদি কিছু না কিছু থাকে, কেবল আমারই কিছু নেই, কেবল আমারই খরায় ফাটা বুকে বেশরম পড়ে থাকে শূন্য কলস। সকলেরই জল থাকে, দল থাকে, ফুল ফল থাকেই, আমারই কিছু নেই, সমস্ত জীবন জুড়ে ধুধু একপরবাস ছাড়া। এখন আর তেমন করে বলছি না। পরবাস আছে বটে জীবনে, এখন আপনারাও আছেন, যে ভালবাসা আমি পাচ্ছি আজ, তা সঙ্গে করে নিয়ে যাব দূরের দেশে। আমার আকাশ জুড়ে হাজার তারার মত ফুটে থাকবে এসব; অন্ধকারে, দুর্যোগে আমাকে আলো দেবে, আশা দেবে। আমি নিজেকে আরও আরও চিনতে শিখব। আমি লিখতে শিখব। আপনারা, সম্ভবত, প্রায় মরে যাওয়া লেখককে একটু একটু করে বাঁচিয়ে তুলছেন। কী দেব? শুভেচ্ছা, ভালবাসা, শ্রদ্ধা সবই গ্রহণ করুন, আমাকে ধন্য করুন। হোক না অন্য দেশে আমার জন্ম, না হয় থাকি দূরের কোনও দেশে, আমি তো আপনাদেরই মানুষ, আত্মীয়-মতো, আপন। আমার কি কোথাও আর আপন কেউ আছে? নমস্কার।

    আনন্দ পুরস্কার আমি দ্বিতীয়বার পেলাম। আমি একাই পেলাম। পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার। টাকাটা আমাকে সত্যিই আকৃষ্ট করে না। এর আগে বিরানব্বই সালে যখন পেয়েছিলাম আনন্দ পুরস্কার, পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা হয়েছিলো পুরস্কার। আর এবার এক লক্ষ থেকে হলো পাঁচ লক্ষ। অনেকে ভাবতে পারে আমার লক্ষ্মী ভাগ্য বা লক্ষ ভাগ্য ভালো। আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। প্যারিসের ব্যাংকে ও টাকা জমা করে দেওয়ার পর আমারই অজান্তে দ্রুত উড়ে যায়। আমার লক্ষ টাকার পিঠে অদৃশ্য পাখা থাকে। উড়ে যায় বলে মনোকষ্ট নেই। মনোকষ্ট শুধু তোমার জন্য। যে টাকার অভাবে তুমি সারাজীবন ছিলে, সেই টাকা আমার কাছে যত কাড়ি কাড়ি আসে, তত সেই টাকাকে আমার তুচ্ছ মনে হয়, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, সেই টাকাকে আমার বড় ঘৃণা হয়, মা। সংসারে তুমি ছিলে একা, আর আমি একা। আমার স্বামী সন্তানের উপদ্রব নেই। আমার ধন সম্পদও কারও জন্য রেখে যাওয়ার নেই। এভাবেই জীবন উড়তে থাকে, যে জীবনের, মনে হয় কোনও অর্থ নেই। এভাবেই জীবন ভেসে যেতে থাকে, যে জীবনকে খড়কুটো বলেও মনে হয় না।

    বুঝলে মাপ্যারিসহলোইওরোপের কেন্দ্র। আর আমার যত ভ্রমণ, সব এইপ্যারিস থেকেই। বিভিন্ন দেশে যাওয়া আসা হচ্ছেই। বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ আসছে, নারীর অধিকার বা মানবাধিকার বিষয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ। ইওনেস্কোতে আমি আন্তর্জাতিক ধর্মমুক্ত মানববাদী আইএইচইইউ এর ডেলেগেশন হয়ে যাই, ওখানে ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র, আইন, সমাজ ও শিক্ষার পক্ষে কড়া বক্তব্য রাখি। ইউনেস্কোয় নাকি এমন কঠিন বক্তব্য আগে কেউ রাখেনি। সব নড়েচড়ে বসেছিলো। সবখানেই তাই হয়। ক্রিশ্চান, ইহুদি বা অন্য কোনও ধর্মীয় পরিবারে জন্ম নিয়ে যে কেউ ঠিক একই কথা, যা আমি বলেছি, বললে কেউ চমকায় না। কিন্তু মুসলিম পরিবারে জন্মে ধর্মের সমালোচনা, তাও আবার সব ধর্মের সমালোচনা করলে লোকে চমকে ওঠে। আসলে আমার সংগ্রাম তো আর ধর্ম নাশ করার সংগ্রাম নয়। আমার সংগ্রাম মানবতার জন্য মূলত, সমানাধিকারের জন্য। ধর্মের সঙ্গে নারীর সমানাধিকারের বিরোধ আজন্ম। যেখানেই যাই, যত কোলাহল বা কলরবের মধ্যেই যাই, ফিরে আসি নিজের নিঃসঙ্গতায়। ফোনটা হাতের কাছে, ইচ্ছে করে কেউ জিজ্ঞেস করুক, কেমন আছি, দেশে ফিরবো কবে, ইচ্ছে করে কেউ বলুক আমার জন্য কোথাও সে অপেক্ষা করছে। বলুক আমাকে ভালোবাসে, জিজ্ঞেস করুক, কেমন আছি, কী খাচ্ছি। তুমি নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও পারে যে তোমাকে বলবো কেমন আছি আমি, কেমন থাকি প্রতিদিন। তুমি কোনও দেশে নেই, কোনও শহরে বা গ্রামে নেই। কোনও বাড়িতে নেই। তোমার কোনও ঠিকানা নেই। তোমার কোনও টেলিফোন নম্বর নেই। তোমার কিচ্ছু নেই মা। তোমার এত নেই এর কাঁটা বুকের ভেতরটায় বিঁধে থাকে।

    প্যারিসে বসে কবিতার একটি বই ছাড়া আর কিছুই লিখিনি। ফরাসি প্রকাশক, বুঝি, যে, অসন্তুষ্ট। ভালো ভালো উপন্যাস চাইছে প্রকাশক। আমি যে লেখক, আমি যে ভালো লেখক, সে কথা আরও প্রমাণ করি আমি, চাইছে। আমি যে কেবল ধর্মের বিপক্ষে লেখা, মৌলবাদীদের ফতোয়া পাওয়া কোনও নির্যাতিত নির্বাসিত বস্তু নই, তা ফরাসি প্রকাশকও প্রমাণ করতে চান। ফরাসি দেশে নাম আছে, কিন্তু নতুন বই নেই। বন্ধু বলে যাদের কাছে টানি, কিছুদিন পর তাদেরও ঠিক বন্ধু বলে আর মনে হয় না। ভালো না লাগা, হেথা নয়-হোথা নয়-অন্য কোথার বৈরাগ্য জীবন জুড়ে, ঝাঁক ঝাঁক দুশ্চিন্তা মস্তিষ্ক দখল করে নেয়। ঘোর বিষাদ আমাকে গ্রাস করে ফেলে। সুয়েনসনকে জানালাম এখানে আর আমার থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। বললো, চলে এসো সুইডেনে। কী এক অদ্ভুত অভিমানে আমি প্যারিস ছাড়লাম। বড় অনিচ্ছায় আমি ফিরে গেলাম। ক্রিশ্চান বেসও আপত্তি করেননি। তিনি যদি বলতেন না যেতে, তাহলে জীবন অন্যরকম হতো। তিনি তো জানতেনই যে সুইডেনকেচিরবিদায় জানিয়ে এসেছিলাম। প্যারিস আমার জন্য শেষ অবধি কোনও আশ্রয় হলো না। নিজেই স্বপ্ন গড়েছিলাম, নিজেই সেই স্বপ্ন ভেঙে ফেলি। আসবাবপত্র যা কিনেছিলাম প্যারিসে, দিয়ে দিলাম যাকে তাকে। বাড়ির কনসিয়াজকে ডেকে এনে বলি, যা ইচ্ছে করে নিয়ে যান ঘর থেকে। ছুটে এসে নিয়ে গেলো, যা ভালো লাগেসব। শুধুবই, কাপড়চোপড়, আর কমপিউটার, প্রিন্টার এসব জরুরি জিনিস নিয়ে গেলাম। আবারও মুভার ডাকো। আবারও হাজার হাজার টাকা খরচ করো। কিন্তু ডিপ্রেশনের ডিপোর কাছে ফিরে গেলে কি আমার ডিপ্রেশন সারবে! সুয়েনসনের বাড়িটা সুন্দর করে সাজিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। কিন্তু অন্যের বাড়ি নিজের রুচিমতো নিজের টাকা খরচ করে সাজালেই বা কী, ও তো আর নিজের বাড়ি হয়ে যাবে না।

    এর মধ্যে ভয়ংকর সব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। একটা রক্তচাপ মাপার মেশিন কিনেছিলাম প্যারিস থেকে। ডাক্তারি পড়াকালীন সময় থেকেই মেশিন থাকে আমার কাছে। আগের মেশিনটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অনেক দিন কোনও নতুন মেশিন কেনা হয়নি বলে কিনেছি। বন্ধু বান্ধবদের অসুখ বিসুখ হলে মেপে দেখি রক্তচাপ নিজেরটাও বছরে দুবছরে হয়তো মাপি। ওই মেশিনটা কেনারপর মাস চলে গেলে প্রথম ব্যবহার করলাম, সুয়েনসনের রক্তচাপ মাপার জন্য। মেশিনেরও উদ্বোধন করার জন্য। সুয়েনসনের রক্তচাপ একেবারে স্বাভাবিক। এরপর নিজের রক্তচাপ দেখে তো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। মেশিনের গণ্ডগোল হয়েছে বলে আবার মাপলাম। একই মাপ দেখাচ্ছে। ২৫০/১৫০। সুয়েনসনের রক্তচাপ আবার মেপে দেখি ১২০/৭৫। তার মানে মেশিন ঠিক আছে। ওর বেলায় যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে না, আমার বেলায় করছে। তার মানে। কি এই যে আমি এখন ব্লাড প্রেশারের রোগী? ব্যাপারটি মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শবাসনে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও মাপলাম। কোনও দুশ্চিন্তা নেই, কিছু নিয়ে কোনও অস্থিরতা নেই, তবে এই ভয়ংকর রক্তচাপটা কেন! এ নিয়ে তো বসে থাকা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, যে কোনও সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সুয়েনসনকে বললাম ক্যারোলিন্সকা হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিছুতেই সে যাবে না। অনর্গল বলে যাচ্ছে এসব আমার ন্যাকামি। তোমার অসুখ হলে বাবা তোমাকে বলতো, তেমন। উল্টো দিকের বাড়িতে পিয়া নামের এক সুইডিশ মেয়ে থাকে, ও হাসপাতালের নার্স। মধ্যরাতে ওর কাছে দৌড়ে যাই, অন্তত যদি কোনও ওষুধ থাকে, অথবা ও যদি কোনও হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যায়। না, পিয়া নেই বাড়িতে। আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে তখন কী অবস্থায় গিয়েছিলো তোমাকে বোঝাতে পারবো না। অনেক অনুরোধের পর গজগজ করতে করতে গেলো সুয়েনসন আমার সঙ্গে হাসপাতালে। ক্যারোলিন্সকা হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে গিয়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও দেখি ডাক্তার আসছেনা, রাগ করে বাড়ি চলে এলাম। এই হল বিদেশের বিপদ। আমি নিজে বলি না আমি কে বা আমি কী। বিদেশের ক্রিমিনাল, বাটপাড়, অ আ ক খরসঙ্গে এক সারিতে বসে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে ডাক্তারের। ওই অপেক্ষার সময় এমন হতে পারে যে মাথায় রক্তক্ষরণ হলো অথবা হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলো। দেশে থাকলে নিজে ডাক্তার বলে, বা চেনা বলে আমাকে তড়িঘড়ি দেখা হত। বিদেশে বিশেষ করে সুইডেনে তা হবার জো নেই। সারারাত চরম অস্থিরতায় এক ফোঁটা ঘুমোত পারিনি। সাত সকালে উপসালা শহরে গিয়ে আগে এক বন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে একটা নিফিকার্ডিন নিয়ে জিভের তলায় রেখে দুম করে স্বর্গ থেকে রক্তচাপকে নামিয়ে আনি মর্তে। বাবার পকেটে সবসময় ওই নিফিকার্ডিন নামের ওষুধ থাকে। ওভাবে দ্রুত রক্তচাপ কমানো অনুচিত জেনেও বাবা ওভাবেই কমায়। বন্ধুর বাড়িতে আগে গিয়েছি, জেনেই গিয়েছি যে তার নিজের একটা হৃত্যন্ত্রের অসুখ সম্প্রতি হয়েছিল বলে রক্তচাপ কমিয়ে রাখার ওষুধপত্র রাখছে বাড়িতে। বন্ধুটি শান্তনু দাশগুপ্ত, তুমি তো চেন, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজির রিসার্চার। সুয়েনসনের বাড়িতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো। ওর বাড়ি থেকে উপসালার অ্যাকাডেমিস্কা হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে যাই। শান্তনুর সুইডিশ বান্ধবী লেনা সঙ্গে গেল। তখন অনেক কম রক্তচাপ, ওই ওষুধটা খাওয়াতে। কম হলেও স্বাভাবিক হয়নি। ডাক্তার রক্তচাপ কমানোর ওষুধ দিলেন। কিন্তু বিটা ব্লকার আমি খাবো কেন? আমি এ দেশের ডাক্তারদের বিশ্বাস করবো কেন? এ দেশে ডাক্তার দেখানোর কারণ হলো একটাই, এখানে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান ছাড়া কোনও ওষুধ কেনা যায় না। অ্যাকাডেমিস্কা থেকে দেওয়া ওষুধ আমার পছন্দ হয়নি। ইন্টারনেট ঘেঁটে নতুন মেডিক্যাল জার্নালগুলো পড়ে মনে হয়েছে যে এসিই ইনহিবিটর ওষুধটা ভালো। সুতরাং অন্য এক হাসপাতালে গিয়ে বললাম, আমার হার্ট দেখ, আমার ইসিজি দেখ, আমাকে এসিইইনহিবিটর লিখে দাও, আমাকে সোফিয়া হেমেটে রেফার করো। সোফিয়া হেমেট সুইডেনের সবচেয়ে নামকরা হাসপাতাল, সবচেয়ে দামি। আমার যেহেতু এখন সুইডিশ পাসপোর্ট, আমি বিনে পয়সায় ওখানে দেখাতে পারি। রেফার না করলে সোফিয়া হেমেটে কেউ দেখাতে পারে না। বাবার চোখের চিকিৎসা সোফিয়াতে করিয়েছিলাম, হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালোটায়। সুতরাং সবচেয়ে ভালো জায়গাতেই আমি যাবো। ছোটখাটো আনাড়ি ডাক্তারদের হাতে তোমাকে মরতে হয়েছে, আমাকে মারতে আমি ওদের দেব না। সোফিয়া হেমেটে গিয়েও আমি ওই ওষুধ দাবি করলাম যে ওষুধকে আমি মনে করছি ভালো। মা, তোমার জীবন দিয়ে তুমি আমাকে শিক্ষা দিয়ে গেলে। আমি মুখ খুলিনি, কথা বলিনি, আনাড়ি ডাক্তাররা যা বলেছিলো, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তোমাকে হত্যা করেছি আমি। কোনও চ্যালেঞ্জ করিনি, প্রতিবাদ করিনি, আপোস করেছি সারাক্ষণ। নিজের বেলায় যদি আমিনা হতে দিই, তাহলেও যদি অন্তত প্রতিশোধ নেওয়া যায়। জানি তোমার ভালো লাগছে আমার এই সচেতনতা দেখে। কিন্তু মা, আমার কি প্রতি প্রতিবাদে তোমাকে মনে পড়ছেনা, গায়ে আমার জ্বালা ধরছেনা, এখন যা করছি, অনুতাপ করছিনা এই বলে যে, তখন তা করিনি কেন? আমার শক্তি আমার সাহস কোথায় কোন গুহায় হারিয়ে গিয়েছিল? জানি ওরা আমাকে বোবা বানিয়ে রেখেছিলো, ওরা কোনও তৃতীয় বিশ্বের মেয়েকে জোর গলায় কথা বলতে দেখতে চায় না। কিন্তু নিজের আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে ওদের সুখী করে কী পেলাম আমি? আমি তো সব হারালাম, যখন তোমাকেই হারালাম।

    বাবাকে জানিয়েছি আমার রক্তচাপ বাড়ার কথা। এত অল্প বয়সে রক্তচাপ বাড়লো বলে বাবাও অবাক। আমার রক্তে ছিল এই রোগ, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। কিন্তু দুশ্চিন্তা ত্বরান্বিত করেছে রোগটি। চল্লিশে পড়িনি এখনও, উচ্চ রক্তচাপের রোগী হলাম। দায়ী কে মা, দুশ্চিন্তা কে দিচ্ছে আমাকে! মানুষগুলোই তো, যারা আমাকে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে রাজনীতির নোংরা খেলা খেলছে! তোমার না থাকা দিচ্ছে, ভাই বোনের নির্লিপ্তি দিচ্ছে। যাদের ভালোবাসি, তারা যদি দূর থেকে ক্রমশ দূরেই যেতে থাকে, তবে হতাশার কোলে বসে আমি দিন রাত দোল খাবো না কেন, বলো। সুইডেনে বসে এক লেখা ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। সামাজিকতা মাচায় তুলে যে সুইডেনের মতো দেশে থাকতে হয়, তা তো দেখেছেই। তবে তুমি একেবারে নির্মম অবস্থাটাই দেখে গেছে। একটা অন্য গ্রহে যেন বসবাস। মানুষের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। কারও যাওয়া আসা নেই বাড়িতে। শুধু ভূতের মতো বসে থাকো, যেখানে বসে আছো। প্যারিসে আমার কাছে বন্ধুবান্ধব দেশ বিদেশ থেকে ছুটে আসতো, আমাকে দেখার নাম করে প্যারিসকেই দেখতো তারা। আর সুইডেনে থাকলে কেউ আমাকে দেখতে আসতে চায় না। এই অন্ধকার দেশে কে আসবে বলো। অন্ধকার ঠিক কেমন অন্ধকার, তো তুমি দেখেইছে। তবে গ্রীষ্মকালের দিন রাতের ঝকঝকে আলো, এই মধ্যরাতের সূর্যের দেশটায় প্যারিসের পাট চুকিয়ে ফিরে এসে ঘরদোর ভীষণভাবে সাজিয়ে লেখালেখিতে মনও দিলাম। বাড়ি সাজানোয় তো আমার কোনও লাভ নেই, আপাতত না বুঝলেও কিছুদিন পর তো হাড়ে হাড়ে টের পাবো, ওতে শরীর, মন, অর্থ ঢেলে লাভ কিছু নেই। বিদেশ বিভুইএ থাকারইচ্ছেও আমার নেই, তাছাড়া অন্যের বাড়ি সাজালে অন্যের লাভ হয়, নিজের কিছু হয় না, বিশেষ করে সেই অন্যের সঙ্গে যদি হৃদয়ের কোনও সম্পর্ক না হয়। ওসব ফালতু কাজ। ভালো কাজের মধ্যে যা করেছি, তা চারটে বই লিখেছি, ফরাসি প্রেমিক নামের একটি উপন্যাস, খালি খালি লাগে নামের একটি কবিতার বই, উতল হাওয়া আর দ্বিখণ্ডিত, আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খন্ড আর তৃতীয় খন্ড।

    অভিমান আমাকে কুঁকড়ে রেখেছিলো। আমি তো সেই যে দেশ ছাড়লাম, পরিবারের সবাইকেই ছাড়লাম। দাদা, ছোটদার কাছে কোনও কোনও করিনি, এমনকী ইয়াসমিনের সঙ্গেও যোগাযোগ পুরোটাই বন্ধ করে দিয়েছি। কারও স্বার্থপরতাকে ক্ষমা করতে আমি পারিনি। আমার কেনা গাড়ির মালিক হয়ে বসে আছে দাদা, যে মালিক তোমার ওই অসুস্থ অবস্থাতেও সে গাড়িটা চড়তে দেয়নি তোমাকে। তার বউ ছেলে মিলে তোমাকে জ্বালিয়েছে। তারা মশারির নিচে নরম বিছানায় ঘুমিয়েছে। আর তুমি বারান্দার মেঝেয় মশার কামড় খেতে খেতে রাত পার করেছে। যে টাকা তোমার সম্বল ছিলো অবকাশের নারকেল ডাব বিক্রি করে কিছু টাকা পেতে, সেটিও হাসিনা নিজে বিক্রি করে দেয় তোমার অনুপস্থিতিতে। শুভও জেনে গেছে, তুমি এ বাড়ির সবচেয়ে অবহেলা পাওয়া, অবজ্ঞা পাওয়া একটা তুচ্ছক্ষুদ্র মেয়ে মানুষ, আদরে আহ্লাদে বড় হওয়া লাটসাব হওয়া, নবাব হওয়া শুভও তোমাকে মানুষ বলে মনে করে না। গ্লানি আমাকে কুরে খাচ্ছে, আমি আর তোমাকে অবজ্ঞা করা মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে গ্লানির ভার বাড়াতে চাই না। তুমি যদি একটুখানি ভালোবাসা পেতে, উজাড় করে দিতে, আসলে তোমার টাকা পয়সা ছিলো না বলে হয়তো তুমি ভালোবাসা পাওনি। ভালোবাসার সঙ্গে তো আজকাল অর্থকড়ির সম্পর্ক বেশ আছে। তুমি যা পারতে, যেভাবেই পারতে, সেভাবে মানুষের জন্য করেছে। ভিক্ষে করতে যারা আসতো, তুমি বাড়ির গৃহিণী বলে মনে করতো তুমিও বুঝি ধনী। তুমি ওদের কাছে ডেকে বলে দিতে, তুমি ধনীর বাড়িতে থাকে, কিন্তু তুমিও ওদের মতো দরিদ্র, বলতে, আসলে ওদের চেয়েও বেশি দরিদ্র, ওদের তোভিক্ষে করে যা হোক কিছু উপার্জনের সামর্থ্য আছে, ওদেরও একধরনের স্বাধীনতা আছে যা তোমার নেই। একটা সময়, আমার মনে আছে, তোমাকে যখন পড়াশোনা কেউ করতে দিলোই না, তোমার যখন কোনও চাকরি বাকরি করার অধিকারও নেই, তখন বলতে তোমার মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবন চালাতে ইচ্ছে করে। মানুষের বাড়িতে কাজ করলে খাবারও জোটে, মাস গেলে বেতনও জোটে। স্বনির্ভর হতে চাইতে। দারিদ্রে তোমার আপত্তি ছিলো না, কিন্তু অত কুৎসিত ভাবে অপমানিত হতে চাইতে না। অপমান তোমাকে করেছি সবাই, মানুষ বলে মনে করিনি। বাবার কাছ থেকেই সম্ভবত সবাই শিখেছি। কিন্তু বাবার অনেক কিছুই তো আমি মানিনি। কিন্তু তোমাকে অপমান করাটাই শুধু মেনেছি। বাকি আর যা কিছুমানি বা না মানি। বাবার সঙ্গে তোমার যে কোনও দ্বন্দ্বে আমি তো চিরকালই বাবার পক্ষই নিয়েছি। বিদেশ থেকে বাবাকে টাকা পাঠিয়েছি। বাবা তার অ্যাকাউন্ট নম্বর কোনওদিন দেয়নি আমাকে। তখন টাকা তোমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছি, বলেছিপুরো টাকা তুলে নিয়ে গিয়ে বাবাকে দিয়ে আসতে। হ্যাঁ তুমি তাই করেছে। বাবাকে কেন আমি টাকা পাঠাতাম? বাবার কি টাকার অভাব ছিলো? ছিলো না। বাবা ভালো জামা কাপড় কেনে না, ভালো জুতো কেনে না, ভালো সেইভিং কিটস কেনে না, সে তো অভাবের জন্য নয়, সে তো স্বভাবের জন্য। সারা জীবন তা জেনেও আমি জানিনি। বাবার প্রতি ভালোবাসা বোঝাবার আর বোধহয় অন্য কোনও পথ আমার ছিলো না। যাকে বাবা বলে, যাকে তুমি বলে কোনওদিন ডাকতে পারিনি, তাকে কী করে বলবো ভালোবাসার কথা। তোমাকেও তো একসময় তুমি বলা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম, তোমার সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলতাম। বোধহয় ভাববাচ্যেই কয়েক বছর কাটিয়েছিলাম। সুইডেনে ফের সম্বোধন করতে শুরু করেছি। ওটাই বোধহয় তোমার জন্য ছিল সুখের ঘটনা। একদিনই তোমার বাথটাবে স্নান করতে দিয়েছিলাম, ফেনা বানিয়ে ফেনার মধ্যে তোমাকে ডুবিয়ে। তুমি বাচ্চা মেয়ের মতো খুশি হয়েছিলে। কী অল্পতে তুমি খুশি হতে মা, অথচ তোমাকে খুশি করতে কেউ আমরা সামান্য চেষ্টাও করিনি। কী কঠিন ছিল হৃদয় আমার। তোমারই সন্তান, তোমার মতো মাটির মানুষের, তোমার মতো বিরাট মনের। অথচ স্বার্থপরতা, হীনতা, নীচতা সব আমাদের সম্বল ছিল। তুমি আমার জীবন বদলে দিয়েছে। টাকা পয়সা এখন আমার কাছে তুচ্ছ একটি জিনিস। তোমার চলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া আমাকে জীবনের নতুন অর্থ দিয়েছে, একইসঙ্গে অর্থহীনতাও। যদি কিছুর মূল্য আমি দিই জীবনে, সে ভালোবাসার, আর কিছুর নয়। পরিবার পরিজন, বন্ধু, স্বজন, নাম যশ খ্যাতি সব অর্থহীন আমার কাছে। যেখানে ভালোবাসা, সেখানেই দৌড়ে যাই। যাকে ভালোবাসি, তাকে উজাড় করে দিই, তাকেই বোঝাই যে ভালোবাসি। ভালোবাসার জন্য মাইল মাইল পাড়ি দিই। জীবন বাজি রাখি।

    যে মানুষ আর যে বাড়ি ছেড়ে আমি একবার বেরিয়ে গেছি, সেখানে তার কাছে ফিরে আসা ঠিক কী রকম, তুমি নিশ্চয়ই বোঝে। বুঝবে না কেন, তুমি তো সব বুঝতে। ভাবতাম, কিছুই বোধহয় বোঝে না, তুমি যে কত সংবেদনশীল মানুষ ছিলে, সহজ এবং সরল, সহৃদয় এবং সহিষ্ণু, তোমার আশেপাশের মানুষদের কেউ তো তেমন ছিল না। ভেতরে ভেতরে এত যে বুঝতে, জগৎ এবং জীবন তুমি কী চোখে দেখতে, কী গভীর চোখে, তা বোঝার সাধ্য আমার কেন, কারওরই ছিল না। তোমাকে আমি চিনতে শুরু করলাম তোমার অসুখের পর, তোমার মতো আপন মানুষটিকে হারানোর যে ক্ষত এবং ক্ষতি তা আমি জীবন দিয়ে এখন অনুভব করি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনিষিদ্ধ – তসলিমা নাসরিন
    Next Article নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ফেরা – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }