Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প466 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৫০. অর্কিড ভ্যালির বাইরে দাঁড়িয়ে

    অধ্যায় ৫০

    অর্কিড ভ্যালির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে জেফরি বেগ। অস্থির হয়ে পায়চারি করছে সে। ব্যাকআপ টিম এখনও এসে পৌঁছায় নি। বার বার হাতঘড়ি দেখছে। কাছেই রমিজ লস্কর গাড়িতে বসে আছে। খুব বেশি হলে চার-পাঁচ মিনিট আগেই তার সাথে কথা হয়েছে, সে জানিয়েছে ট্রাফিক জ্যামের কারণে ফোর্স আসতে দেরি করছে, কিন্তু জেফরির কাছে মনে হচ্ছে অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে এরপর।

    পায়চারি করতে করতে রমিজের গাড়ির সামনে চলে এলো আবার । গাড়ির ভেতর থেকে জানালা দিয়ে রমিজ তাকে দেখলো। হাত তুলে জেফরিকে বোঝানোর চেষ্টা করলো ব্যাকআপ টিম কাছেই এসে গেছে।

    ঠিক তখনই জেফরির কানে ব্লুটুথ ইয়ারফোনটায় কল এলো। জামান করেছে। দ্রুত রিসিভ করলো কলটা।

    “স্যার…পাশের বিল্ডিংয়ে লাফ দিয়েছে! মিলন পাশের বিল্ডিংয়ে লাফ দিয়েছে!” চিৎকার করে বললো জামান ।

    “কি?!” জেফরি যারপরনাই অবাক হলো। “লাফ দিয়েছে মানে?”

    “স্যার! মিলন এখন পাশের বিল্ডিংয়ে আছে। এই যে আমি দেখছি!” উদভ্রান্তের মতো বললো জেফরির সহকারী ।

    “জামান!” ধমকের সুরে বললো সে। “তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”

    “স্যার, কী বলছেন? এই যে আমি দেখছি…লাল বিন্দুটা এখন পাশের বিল্ডিংয়ে!”

    “জামান, ডিভাইসটা মিলনের স্ত্রী পলির ভ্যানিটি ব্যাগে ইস্প্যান্ট করা আছে…মিলনের শরীরে না!”

    কথাটা শুনে চুপ মেরে গেলো জামান। নিজেকে এতোটা বোকা তার কখনও মনে হয় নি। তাই তো, ডিভাইসটা সুকৌশলে মিলনের স্ত্রী পলির ভ্যানিটি ব্যাগে লুকিয়ে রাখা আছে। কাজটা তো সে নিজেই করেছে রমিজ লস্করকে নিয়ে।

    “স্যার…এখানে তো দেখাচ্ছে, মানে পাশের বিল্ডিংটায় চলে গেছে,” আমতা আমতা করে বললো সে।

    ব্যাকআপ টিমের দেরিতে মেজাজটা বিগড়ে ছিলো তার, জামানের এমন বোকামিতে সেটা আরো বেড়ে গেলো । ছেলেটাকে ধমক দিতে যাবে এমন সময় চিন্তাটা তার মাথায় আসতেই থমকে দাঁড়ালো সে । অর্কিড ভ্যালির দিকে তাকালো ।

    জিপিএস ট্রান্সমিটারটি পলির ভ্যানিটি ব্যাগে ছিলো…জামান বলছে লাল বিপটা, মানে ব্যাগটা এখন পাশের বিল্ডিংয়ে!

    ওহ!

    “রমিজ! আমান! জলদি আসো!” কথাটা বলেই সে ছুটে গেলো অর্কিড ভ্যালির দিকে।

    রমিজ কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে পড়লো আমানকে নিয়ে। সে দেখতে পেলো জেফরি পিস্তল হাতে তুলে নিয়েছে । দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে অর্কিড ভ্যালির দিকে। রমিজও দৌড়াতে দৌড়াতে পিস্তল হাতে তুলে নিলো শোল্ডারহোলস্টার থেকে।

    অর্কিড ভ্যালির মেইনগেটে আসতেই জেফরি বুঝতে পারলো তার সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল হতে চলেছে।

    ভেতর থেকে মেইন গেটটা একপাশে টেনে খুলে ফেলছে দাড়োয়ান । পার্কিংলটে যে দুটো গাড়ি দেখেছিলো তার মধ্য থেকে একটা গাড়ি এরইমধ্যে এগিয়ে আসছে বের হবার জন্য।

    “গেট বন্ধ করো! বন্ধ করো!” চিৎকার দিলো জেফরি বেগ।

    দাড়োয়ান বুঝতে পারলো না, বুঝলেও কোনো কাজ হতো না। গেটটা এরইমধ্যে যথেষ্ট ভোলা হয়ে গেছে। একটা প্রাইভেটকার বের হবার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট।

    কয়েক মুহূর্তের জন্য জেফরির সাথে গাড়ির চালকের চোখাচোখি হয়ে গেলো ।

    মিলন!

    গাড়িটা আচমকা গতি বাড়িয়ে ছুটে এলো সামনের দিকে। জেফরি পিস্তলটা তা করে এক মুহূর্তও দেরি না করে গুলি চালালো ।

    পর পর তিনটি।

    গাড়ির সামনের কাঁচে তিনটি ফুটো হয়ে গেলেও গতি একটুও কমলো না। জেফরি বেগ আর গুলি করার সুযোগ পেলো না । বিস্ফারিত চোখে দেখলো গাড়িটা ছুটে আসছে । বাম দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে।

    অল্পের জন্য গাড়িটা তাকে আঘাত করতে পারলো না। কিন্তু জেফরির পেছন পেছন ছুটে আসছিলো রমিজ লস্কর আর আমান। তারা পড়ে গেলো ছুটন্ত গাড়িটার সামনে ।

    রমিজ সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও রক্ষা পেলো না। গাড়িটার সাইডবডির সাথে তার ডান পাটা ধাক্কা লাগলে ছিটকে পড়ে গেলো রাস্তার উপর।

    তবে আমান ছেলেটা প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাম দিকে। গড়িয়ে চলে গেলো এক পাশে।

    জেফরি দ্রুত উঠে দাঁড়ালেও গাড়িটা চলে গেলো বিশ-ত্রিশ গজ দূরে । সেদিকে তাক করে আরো দুটো গুলি করলো কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো কোনো লাভ হবে না।

    মিলন দ্বিতীয়বারের মতো তার হাতের ফাঁক গলে পালিয়ে গেলো ।

    রমিজ লস্করের দিকে ছুটে গেলো এবার। রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে সে । তার পায়ে আর মাথায় বেশ চোট লেগেছে বলে মনে হলো। নতুন ছেলেটার হাত-পা ছড়ে গেলেও সে ঠিক আছে। উঠে দাঁড়িয়েছে সে।

    “রমিজ?” চিৎকার করে বললো জেফরি ।

    “স্যার!” আর্তনাদ করে উঠলো সে। “আমার পা!”

    আমান নামের ছেলেটাকে ডাকলো জেফরি বেগ । “আমাদের গাড়িটা নিয়ে আসো । ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে । জলদি।”

    অধ্যায় ৫১

    বিছানায় ভ্যানিটি ব্যাগটা না পেয়ে মিলন আর পলি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য পলির কাছে মনে হয়েছিলো এটা ভুতুরে ব্যাপার। কিন্তু পরক্ষনেই বিছানার নীচে মেঝেতে ব্যাগটা পড়ে থাকতে দেখে তারা। বুঝতে পারে তাদের দুজনের প্রেমলীলার সময় বিছানা থেকে ওটা পড়ে গেছিলো।

    মিলন দ্রুত ব্যাগটা হাতে নিয়ে খুলে দেখে। ভেতরের সব কিছু বিছানার উপর ফেলে খালি ব্যাগটা চেক করে দেখতেই চকোলেট সাইজের একটি ডিভাইস পেয়ে যায় ভেতরে । মিলনের গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে।

    সঙ্গে সঙ্গে পলিকে তাড়া দেয় কাপড় পরে নেবার জন্য। দ্রুত ভাবতে থাকে মিলন। তাদের ফ্ল্যাটটা দক্ষিণ দিকে। বাইরের রাস্তা দেখা যায় জানালা দিয়ে । মিলন একটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে সানক্যাপ পরা এক লোক রাস্তাটা পার হয়ে হেঁটে যাচ্ছে কিছুটা দূরে পার্ক করা একটি গাড়ির দিকে। লোকটা গাড়ির সামনে এসে ঝুঁকে কথা বলতে থাকে ।

    লোকটার মুখ দেখতে না পেলেও হাটার ভঙ্গি আর শারিরীক গড়ন দেখে মিলন নিশ্চিত, এটা হোমিসাইডের ঐ ইনভেস্টিগেটর। গাড়িতে আরো কয়েকজন আছে। তারা তাকে ঘিরে ফেলেছে হয়তো।

    হতভম্ব পলি কোনো রকম শাড়ি পরে ফেলার পর মিলন ছুটে যায় পশ্চিম দিকের বেলকনির দিকে। সেখান থেকে মাত্র দশ ফুট দূরে আরেকটা ভবনের বেলকনি লক্ষ্য করে ডিভাইসটা ছুঁড়ে মারে। তারপরই দ্রুত ঘর থেকে পলিকে নিয়ে বের হয়ে যায় ।

    তার ভাগ্য ভালো, পার্কিংলটে কোনো পুলিশ কিংবা হোমিসাইডের কেউ ছিলো না। গাড়িতে উঠে দাড়োয়ানকে গেট খুলে দিতে বলে। দাড়োয়ান গেট খুলতে না খুলতেই ছুটে আসে জেফরি বেগ । তার হাতে পিস্তল ।

    মিলন আর সময় নষ্ট করে নি । জেফরি বেগ গুলি চালালেও সে মাথা নীচু করে ফুলস্পিডে গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে যায়। তার সামনে কে পড়লো, কে মরলো কিছুই পরোয়া করে নি। রাস্তায় নামতেই আরো দু’জন তার সামনে পড়ে যায়। তার ভাগ্য ভালো মাত্র তিনজন ছিলো । একগাদা পুলিশ থাকলে কী হতো কে জানে।

    মনে মনে ইনভেস্টিগেটরের বোকামির জন্য হেসেছিলো সে। তার হাত থেকে একবার ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাবার পরও লোকটা মাত্র দু’জন লোক নিয়ে চলে এসেছে তাকে ধরার জন্য! এখনও লোকটার শিক্ষা হয় নি ।

    .

    কোনো রকম বাধাবিপত্তি ছাড়াই ধানমন্ডি থেকে বের হয়ে যেতে পেরেছে মিলন। কমপক্ষে তিনটি গুলি তার গাড়ির সামনের কাঁচ ভেদ করে চলে গেছে। সময়মতো মাথা নীচু না করলে এতোক্ষণে ভবের লীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো।

    হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। তবে ভালো করেই জানে এই গাড়িটা আর নিরাপদ নয়। এটা পরিত্যাগ করার সময় এসে গেছে ।

    এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে চালু করলো । সাহায্য-সহযোগীতা পাবার মতো লোকজনের অভাব নেই তার। একটা নাম্বারে কল করতে যাবে ঠিক তখনই মনে পড়লো পলির কথা। তার সাথে শেষ কথা হয়েছিলো জেফরি বেগ গুলি করার আগে । তাকে বলেছিলো মাথা নীচু করে সিটের উপর শুইয়ে পড়তে ।

    রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকালো সে। সঙ্গে সঙ্গে তার রক্ত হিম হয়ে গেলো । পলি এখনও শুয়ে আছে!

    গাড়িটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলো সিটের উপর ঘুমিয়ে আছে তার পলি । মাথার চুল এলোমেলো হয়ে মুখের উপর পড়ে আছে। পুরো সিটটা রক্তে ভিজে একাকার।

    “পলি!” একটা আর্তনাদ বেরিয়ে গেলো তার মুখ দিয়ে । হামাগুড়ি দিয়ে চলে এলো পেছনের সিটে। চুলগুলো সরাতেই দেখতে পেলো পলির কপালে, ঠিক বাম চোখের উপরে একটা গুলির ফুটো । রক্তে সারা মুখ লাল হয়ে আছে ।

    পলির নিথর দেহটা দুহাতে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো মিলন। শক্ত করে ধরে রাখলো তাকে। চেষ্টা করলো শব্দ করে না কাঁদার জন্য । জোর করে মুখটা বন্ধ রাখলো কোনোমতে। আরো বেশি শক্ত করে পলির নিথর দেহটা জড়িয়ে রাখলো বুকে। জনমদুঃখি এক মেয়ে।

    এই জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো হাউমাউ করে কাঁদলো মিলন। সেই ছেলেবেলায় তার মা যখন মারা যায় তখন এভাবে কেঁদেছিলো ।

    ‘না!” আর্তনাদরত পশুর মতো গুঙিয়ে উঠলো সে ।

    .

    রমিজ লস্করের ডান পাটা ভালোমতোই ভেঙে গেছে। মাথার পেছন দিকটা পিচঢালা পথের উপর আছাড় খেয়ে পড়ার কারণে বেশ থেতলে গেছে। বাম আর ডান হাতটাও আহত হয়েছে তবে সেটা তেমন গুরুতর নয়।

    আমান নামের ছেলেটা পুরোপুরি সুস্থ আছে। হাত-পায়ে ছড়ে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছু হয় নি।

    হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমের বাইরে বসে আছে জেফরি বেগ। একটু আগে জামানও চলে এসেছে খবরটা শুনে।

    হোমিসাইডে যোগ দেবার পর থেকে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করেছে জেফরি বেগ, কিন্তু সেন্ট অগাস্টিনের জুনিয়র ক্লার্ক হাসানের খুনটার কূলকিনারা করতে গিয়ে যে পরিমাণ জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে সেটা একেবারেই অকল্পনীয় ।

    অল্পের জন্য বেঁচে গেছে জামান। মিলন তাকে খুন করার আগেই জেফরি চলে আসে। তারপর সেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় হাসানের ডায়রিটা বুক পকেটে থাকার কারণে। এখন, রমিজ লস্কর গুরুতর আহত। সে নিজেও দ্বিতীয়বারের মতো বেঁচে গেছে। আরেকটুর জন্যে মিলনের গাড়ির নীচে চাপা পড়তো।

    মিলনের মতো একজন সন্ত্রাসী শুধুমাত্র হোমমিনিস্টারের আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে কতোটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ভাবাই যায় না ।

    মনে মনে একটা প্রতীজ্ঞা করলো জেফরি বেগ, হয় ইনভেস্টিগেটর হিসেবে এটাই হবে তার শেষ কাজ নয়তো মহাক্ষমতাশালী হোমমিনিস্টারকে

    সে দেখে নেবে।

    “স্যার?” পাশে বসে থাকা জামান বললো। তারা এখন বসে আছে ইমার্জেন্সি রুমের বাইরে একটি বেঞ্চে।

    “কি?” জামানের দিকে ফিরে বললো সে।

    “আমার মনে হয় হোমমিনিস্টার আর তার ছেলে তুর্যের জড়িত থাকার কথাটা ফারুক স্যারকে বলে দেয়ার সময় এসে গেছে।”

    চুপ করে থাকলো সে।

    “পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে…মিলনের খুঁটির জোড় কোথায় আমরা সেটা জানি। এখন পুরো ডিপার্টমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে মুভ করতে হবে। শুধুমাত্র আমাদের তিনজনের মধ্যে এই ঘটনাটা সীমাবদ্ধ রাখা কি ঠিক হবে এখন?”

    “ফারুক স্যারকে বললে কী হবে তুমি জানো না?” আস্তে করে বললো জেফরি বেগ। “হোমমিনিস্টারের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা উনার নেই…”।

    “কিন্তু আমরা বলে দেখতে পারি…আজ হোক কাল হোক উনাকে তো এ কথাটা বলতে হবে।”

    “অবশ্যই বলতে হবে। আফটার অল উনি হোমিসাইডের ডিজি।”

    “তাহলে এখন বললে সমস্যা কি?”

    “সমস্যা আছে,” উদাস হয়ে বললো জেফরি বেগ। “আমাদের কাছে যেসব প্রমাণ রয়েছে তা যথেষ্ট নয়।”

    “যথেষ্ট নয়?” একটু অবাক হয়ে আবার বললো জামান, “হাসানের ডায়রি…অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যালের সাথে হোমমিনিস্টারের ফোনালাপ?…”

    “ডায়রিতে তুর্যের কথা বলা আছে, সেখানে মিনিস্টারের জড়িত থাকার কংক্রিট কিছু নেই। আর ফোনালাপ?” মাথা দোলালো জেফরি । “ঐ ল্যান্ডফোনটা হোমমিনিস্টারের বাড়ির, ঠিক আছে। ফোনালাপটিও প্রমাণ করে তুর্য হাসানের খুনের সাথে জড়িত কিন্তু কণ্ঠটা মিনিস্টারের কিনা সেটা আমরা নিশ্চিত করে জানি না। এরকম অবস্থায় হোমমিনিস্টারের বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। তাছাড়া…”

    “কি, স্যার?”

    “ফোন ট্যাপিং করার কথাটা স্যারকে বলা যাবে না।”

    “কেন বলা যাবে না? আমরা তো আর মিনিস্টারের ফোন ট্যাপ করি নি? অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যালের ফোন ট্যাপ করতে গিয়ে…”

    মাথা দোলালো জেফরি । “এটা আমরা নিজেদের তদন্তের সুবিধার্থে করেছি, হোমমিনিস্টারের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নয়।”

    “ঠিক আছে, আমরা তো আর এটা আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলছি না, আমরা আমাদের স্যারকে বলতে পারি? উনার কাছে প্রমাণ হিসেবে দেখাতে পারি?”

    জামানের দিকে চেয়ে রইলো জেফরি।

    “তা পারি। কিন্তু মিনিস্টারের ফোনালাপ শুনে ফারুক স্যার কী করবেন, জানো?”

    জামান ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো।

    “এই কেসটার তদন্ত অন্য ডিপার্টমেন্টের কাছে ট্রান্সফার করে দেবেন।”

    “এটা উনি করতে পারেন না,” জামান প্রতিবাদের সুরে বললো । “অগাস্টিনের হাসানকে যে তোক খুন করেছে সে কিন্তু আমাকেও গুলি করেছে, স্যার । আরেকটুর জন্যে আপনাকেও…” কথাটা শেষ করলো না জামান।

    “ফারুক স্যার কেন এটা করবেন জানো?”

    স্থিরচোখে চেয়ে রইলো জামান।

    “আমাদের সবার ভালোর জন্য…তোমার আমার, আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবার মঙ্গলের কথা ভেবে এটা উনি ট্রান্সফার করে দেবেন। উনি ভালো করেই জানেন, হোমমিনিস্টার কি করতে পারেন।”

    “তাহলে আমরা এখন কি করবো? ঐ হোমমিনিস্টার আর তার ভাড়াটে খুনির হাতে বার বার নাস্তানাবুদ হবো?”

    কথাটা জেফরির কানে নয়, একেবারে বুকে এসে বিঁধলো । মিলন তার অহংবোধে আঘাত করেছে। যেভাবেই হোক ঐ মিলনকে তার চাই-ই চাই। হোমমিনিস্টার আর তার ছেলেকে সে কী করতে পারবে না পারবে সেটা হয়তো অনিশ্চিত কিন্তু এই মিলনকে তার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না ।

    জেফরিকে চুপ থাকতে দেখে জামান বললো, “স্যার, আমরা এখন কী করবো?”

    “আমান ছেলেটা মনে হয় ফিল্ডে বেশ ভালো কাজ করতে পারবে, তোমার কি মনে হয়?”

    “পারবে । বেশ এনার্জিটিক । আগ্রহও আছে। ও কিন্তু সিলেকশন পরীক্ষায় হাইয়েস্ট নাম্বার পেয়েছিলো, স্যার।”

    “তাই নাকি?”

    “ওকে দিয়ে কি করাতে চাচ্ছেন, স্যার?”

    “মিলন এখন সতর্ক হয়ে গেছে, তাকে ধরাটা সহজ হবে না। আমি মিলনের সম্পর্কে প্রচুর তথ্য চাই। তার অতীত, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, কলিগ, পুলিশের খাতায় তার ক্রাইমের রেকর্ড, মামলাগুলোর রিপোর্ট এইসব।”

    “আমার মনে হয় এরকম কাজ ও ভালোই পারবে । তাছাড়া কাজটায় ঝুঁকিও কম। নতুনদের জন্য এমন কাজই ভালো হবে, স্যার।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ । “তুমি আরেকটা কাজ করবে।”

    “কি কাজ?”

    “অর্কিড ভ্যালির কোন ফ্ল্যাটে মিলন উঠেছিলো সেটা আমরা জানি না । এটা তুমি জেনে নেবে। ফ্ল্যাটটার আসল মালিক কে তাও জেনে নিতে হবে । আমার ধারণা ওটা হোমমিনিস্টারেরই হবে…কিংবা তার কোনো ঘনিষ্ঠ লোকের।”

    “ওকে, স্যার। আমি আজ থেকেই কাজে নেমে পড়বো।” একটু চুপ থেকে জামান আরো বললো, “একটা কথা বলি, স্যার?”

    “বলো।”

    “আপনি বাসায় চলে যান। একটু রেস্ট নেন । আমি আছি এখানে। রমিজ ভাইকে দেখে অফিসে চলে যাবো।”

    জামানের মুখের দিকে চেয়ে রইলো জেফরি । তার এখন বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। রেবার সাথে দেখা করতে চাইছে। প্রতিবার যখন সে ব্যর্থ হয় রেবার সাথে সময় কাটাতে চায়।

    আপন মনে মুচকি হেসে ফেললো সে। এর উল্টোটাও তো হয়!

    সফল হোক আর ব্যর্থ হোক, সব সময়ই সে রেবার সঙ্গ কামনা করে।

    অধ্যায় ৫২

    পরদিন সকাল থেকে আবারো টেলিফোনে আড়িপাতার কাজ করতে শুরু করলো জামান। এবার শুধু অরুণ রোজারিওর ফোনটাই তার টার্গেট নয়, জেফরির নির্দেশে হোমমিনিস্টারের স্ত্রীর ব্যক্তিগত ফোনটিও ট্যাপিং করছে তারা। তবে এবার সে একা । রমিজ লস্কর এখনও হাসপাতালে। ভাগ্য সহায় থাকলে, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চললেও দু’মাসের আগে সে সুস্থ হতে পারবে না।

    পর পর দু’দিন জামান শুধু এ কাজ করে যাবে। রাত আটটার পর তার অনুপস্থিতিতে কাজটা করবে কম্পিউটার । এক্ষেত্রে সমস্যা হলো কম্পিউটার সব ধরণের কল রেকর্ড করে রাখবে। সকালে এসে রেকর্ড করা কলগুলো চেক করে দেখতে হবে তখন।

    জেফরি বেগের ধারণা মিনিস্টারের স্ত্রীর ফোন ট্যাপিং করলে তুর্যের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাবে। তুর্যকে এখন ভীষণ দরকার। তার ক্ষমতাশালী বাপের সুরক্ষায় একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে ছেলেটা।

    জামান অবশ্য ভেবে পাচ্ছে না, তুর্যের অবস্থান জানার পর জেফরি কী করবে। প্রশ্নটা জেফরিকে করেছিলো, তার বস্ কোনো জবাব দেয় নি। শুধু বলেছে, এটা নিয়ে পরে ভাববে। সবার আগে জানতে হবে ছেলেটা কোথায় আছে ।

    জামানের ধারণা, তুর্যের অবস্থান জানার পর তার বস হয়তো নতুন। কোনো কৌশল খাঁটিয়ে ছেলেটার গতিবিধির উপর নজরদারি করবে। কিংবা তুর্য যাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের খুঁজে বের করবে। এরপরই হয়তো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে হোমমিনিস্টারের ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি আদায় করবে। তখন মিনিস্টারের আর কিছুই করার থাকবে না।

    পুলিশ রেগুলেন্স-এ এরকম নিয়ম আছে । একজন তদন্তকারী যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। এ কাজে কেউই বাধা দিতে পারবে না । বাংলাদেশে শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতিকে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। তারপরও ক্ষমতাশালী লোকজন, রাজনীতিকেরা বাধা হয়ে দাঁড়ায় সব সময়। সেক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি নিতে পারলে কারোর আর কিছু করার থাকে না। সেটা করতে হলে দরকার হবে জোড়ালো কিছু প্রমাণের ।

    চাতক পাখির মতো বসে আছে সে। এ কাজের জন্য বেশি লাগে ধৈর্য । জামানের সেই ধৈর্য আছে।

    তার এই ডিউটি অবশ্য রাতের বেলায় দিতে হবে না। এটাই হলো আনন্দের কথা। রাত আটটার পর ডিউটি শেষ। পরদিন সকাল নয়টা থেকে আবার শুরু করতে হবে ঠিক যেমন আজকে করেছে ।

    কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে এফএম রেডিও শুনে শুনে বিরক্তিকর সময়গুলো পার করলো। ভাগ্যিস এইসব রেডিও স্টেশন ছিলো! নইলে বসে বসে ঘোড়ার ঘাস কাটতো।

    .

    গতকাল রেবার সাথে দেখা করতে পারে নি জেফরি বেগ। আজও দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। তবে ফোনে কথা হয়েছে। সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে গেছে তারা। হুট করেই তার অসুস্থ বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিজের জন্মস্থানটা দেখে আসবে। মা-বাবার কবর জিয়ারত করবে। এ জীবনে হয়তো আর সুযোগ পাবে না।

    রেবা তার বাবাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করালে সেরে ওঠার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু সাবেক আমলা ভদ্রলোক এখনও রাজি হয় নি। সমস্ত সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে পরিবারকে অনিশ্চত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে না। রেবার বাবা আনজার সাহেবের বিশ্বাস, তার এই অসুখ ভালো হবার নয়। মাঝখান থেকে বিপুল পরিমাণের টাকা জলে ফেলা হবে ।

    যাইহোক রেবা আর তার মা এখনও হাল ছেড়ে দেয় নি। তাদের ধারণা দেশের বাড়ি থেকে ফিরে এসে রাজি করাতে পারবে ।

    একটু আগে হোমিসাইড থেকে ফিরে এসে রেবার সাথে প্রায় আধঘণটা কথা বলেছে। দেখা হবার আক্ষেপ কিছুটা হলেও কমেছে এখন । বাথরুমে গিয়ে ঝটপট গোসল করে ট্রাউজার আর ফুল স্লিভের টি-শার্ট পরে রকিংচেয়ারে দোল খাচ্ছে সে। চোখ বন্ধ করে নীচু ভলিউমে গান শুনতে লাগলো।

    হার্ড টাইমস হার্ড টাইমস! কাম অ্যাগেইন নো মোর…।

    বব ডিলান তার অদ্ভুত, অপ্রচলিত আর ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে দৃঢ়ভাবে বলে যাচ্ছে।

    রমিজ লস্করের পায়ে অপারেশন করতে হয়েছে। খুব খারাপভাবে পাটা ভেঙে গেছে তার । ডাক্তার বলেছে, সেরে উঠতে কমপক্ষে দু’মাস লাগবে । তবে মাথার চোটটা নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই।

    হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ ভীষণ ক্ষিপ্ত। মিলনের মতো একটা সন্ত্রাসী কিভাবে এতো সাহস পাচ্ছে? তার খুঁটির জোড় কোথায়?

    তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো : স্যার, আমাদের হোমমিনিস্টার। যার কাছে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলার গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়েছে, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা রক্ষার ব্রত নিয়ে যে লোক মন্ত্রী হয়েছে তার বখে যাওয়া পুচকে ছেলে পেশাদার খুনি মিলনকে ভাড়া করে নিরীহ এক ক্লার্ককে খুন করেছে, এখন সেই নষ্ট ছেলের বাবা নিজের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছে ছেলেসহ ঐ খুনিকে বাঁচানোর জন্য।

    কিন্তু কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারে নি সে। বলার সময় এখনও আসে নি ।

    অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালো। বব ডিলান এখন করুণ সুরে ফেয়ারওয়েল জানাচ্ছে তার অ্যাঞ্জেলসলিনাকে। এই গানটার চমৎকার বাংলা অনুবাদ করেছে কবীর সুমন-বিদায় পরিচিতা।

    কখনও কখনও এই গানটা শুনলে জেফরির মন খারাপ হয়ে যায়। তার মনে আশংকা জাগে, একদিন রেবাকেও এভাবে বিদায় জানাতে হবে।

    গানটা বন্ধ করে জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালো রাতের সৌন্দর্য দেখার জন্য। শীতের রাত। কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে এখন।

    এই জানালাটা দিয়ে বাইরের রাস্তা দেখা যায়, রাস্তার পাশেই একটা পার্ক আছে। আকাশের দিকে তাকালো। অসংখ্য তারা সেখানে। জানালার সামনে এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুক্ষণ।

    .

    কিন্তু পার্কের ঝোঁপের আড়ালে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সে এমনি এমনি দাঁড়িয়ে নেই ।

    তার গায়ের পোশাক কালো। মাথায় হুড দেয়া কালো রঙের একটি সোয়েটার। অন্ধকারের পক্ষে একেবারে মানানসই । রাগেক্ষোভে ফুঁসছে সে। গতকাল তার জীবনের একমাত্র ভালোবাসার মানুষটিকে চিরকালের জন্য কবরে শুইয়ে দিয়ে এসেছে। সেই শোক কাটিয়ে ওঠার জন্য বহুদিন পর পেথেড্রিনের আশ্রয় নিতে হয়েছে তাকে। আজ বিকেলের দিকে ঘুম ভাঙলে প্রথম যে কাজটি করেছে, সেটা হলো তার সামনে যে পাঁচতলা বাড়িটা আছে সেটা খুঁজে বের করা। তার জন্যে এটা তেমন কঠিন কাজ ছিলো না।

    যার জন্য এসেছে সেই জেফরি বেগ এখন নিজের ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব বড়জোর চল্লিশ গজের মতো। এই দূরত্ব খুব জলদিই ঘুচে যাবে ।

    ইনভেস্টিগেটর লোকটা অবশ্য তাকে দেখতে পাচ্ছে না। উদাস হয়ে চেয়ে আছে আকাশের দিকে । হয়তো তারা দেখছে।

    তুই তারা গুনতে থাক! আমি আসছি।

    কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলটার অস্তিত্ত্ব অনুভব করলো হাতে। ইচ্ছে করলে এক্ষুণি কাজটা করতে পারে, কিন্তু করতে পারছে না। তাই পরিকল্পনা একটু বদলে নিয়েছে।

    অধ্যায় ৫৩

    জেফরি বেগের আগেই জামান চলে এলো হোমিসাইডে । শুরু করলো ট্যাপিং করার কাজ। যথারীতি কাল রাতের রেকর্ড করা কলগুলো চেক করার কাজটাই আগে করলো সে।

    হোমমিনিস্টারের স্ত্রী নিজের মোবাইল ফোন থেকে মোট দশটি কল করেছে, আর তার ফোনে ইনকামিংকল এসেছে সতেরোটি । জামানের ধারনা এগুলোর বেশিরভাগই তদবির সংক্রান্ত। মিনিস্টারের স্ত্রী মানে অসম্ভব ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার কাছে তদবির আসবে, এটা এ দেশের রাজনীতিতে নিয়ম হয়ে গেছে।

    কলগুলো চেক করে দেখতে শুরু করলো জামান। মোট সাতাশটি কলের মধ্যে প্রথম বারোটি কল চেক করার পর দেখতে পেলো সবগুলোই ‘মাফ। নিদোষ কল। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো তার। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বাকি কলগুলো চেক করে দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেললো সে।

    আড়ি পেতে অন্য লোকের কথাবার্তা শোনার মধ্যে যে আনন্দ সেটা তো বিকৃতরুচির ব্যাপার, কিন্তু কাজের প্রয়োজনে তাদেরকে এটা করতে হয় অনেক সময়। প্রথম দিকে এভাবে ট্যাপিং করতে খুব মজা পেতো জামান। এখন আর সেই মজা পায় না। বরং বিরক্তিকর ঠেকে তার কাছে ।

    চা চলে এলে আয়েশ করে চুমুক দিলো । অফিসে সবার আগে এসেছে, এখনও বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারি এসে পৌঁছায় নি। কমিউনিকেশন্স রুমে ঢোকার আগে মাত্র দুএকজনকে দেখেছে। এখন হয়তো আরো অনেকেই চলে এসেছে।

    তার বস জেফরি বেগ আসে নি। এলে সবার আগে কমিউনিকেশন্স রুমে ঢু মারতো।

    জেফরি বেগের কথা ভাবতেই জামান নড়েচড়ে বসলো । রেকর্ড করা বাকি কলগুলো শুনে ফেলতে হবে। তার বস চলে আসবে একটু পরই, এসে যদি কলগুলো সম্পর্কে জানতে চায়?

    চায়ের কাপটা শেষ করে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে রেকর্ড করা কলগুলো শুনতে শুরু করলো সে।

    পাঁচ মিনিট পর, শেষ দুটো কলের আগের কলটা শুনে ভিমড়ি খেলো জামান।

    হোমমিনিস্টারের স্ত্রী তার এক ঘনিষ্ঠজনকে ফোন করে এসব কী বলছে! সকালে ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলেও জগিং মিস করে নি জেফরি বেগ। দ্রুত কর্নফ্লেক্স আর দুধ দিয়ে হালকা নাস্তা সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো। পত্রিকা পড়ার সময় পায় নি। বাসার নীচে অফিসের গাড়ি এসে হর্ন বাজাতে থাকলে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লো সে।

    গাড়ি চলতে শুরু করলে হাতের পত্রিকাটায় চোখ বোলালো । সাধারণ সাদামাটা একটা দিন ।

    সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু…এসিডে ঝলসে যাওয়া এক গ্রাম্য কিশোরি…শেয়ার মার্কেটের সূচকের পতন…রাজনীতিক নেতা-পাতি নেতাদের মিথ্যের ফুলঝুড়ি, ইরান আক্রমণ করার আমেরিকান পায়তারা..শীতকালীন সজির চড়া দাম…

    ভেতরের পাতাগুলোতে চোখ বুলালো। কোনো খবরই পুরোপুরি পড়লো না। কোনো খবরই তাকে আকর্ষণ করতে পারলো না, শুধু শিরোনামগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে গেলো।

    হঠাৎ ভেতরের পাতায় বাম দিকের এক কোণায় এক কলামের একটি সংবাদ চোখে পড়লো তার। এর শিরোনামটি যদি রিভার্স না হতো তাহলে হয়তো চোখেই পড়তো না।

    নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না জেফরি বেগ । এটা যদি আসমানজমিন পত্রিকা হতো সে বিশ্বাস করতো না। কিন্তু তার হাতের পত্রিকাটি মহাকাল । এ দেশের সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় আর বিশ্বাসযোগ্য একটি জাতীয় দৈনিক।

    রিপোর্টটি খুব ছোটো। জেফরি সেটা পড়লো :

    ব্ল্যাক রঞ্জুর জামিন লাভ?

    আদালত সংবাদদাতা-কুখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসী, অসংখ্য খুন আর চাঁদাবাজির মামলার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্ল্যাক রঞ্জু গতকাল আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে। উল্লেখ্য, ছয় মাস আগে আহত অবস্থায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিলো ঢাকা থেকে।

    আমাদের আদালত সংবাদদাতা জানিয়েছে, সত্যিকারের রঞ্জু কোলকাতায় লুকিয়ে থাকা অবস্থায় অন্তর্দলীয় কোন্দলে নিজের দলের লোকজনের হাতে নিহত হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। যাকে ব্ল্যাক রঞ্জু হিসেবে এতোদিন জেলে আটকে রাখা হয়েছিলো সে রঞ্জু গ্রুপেরই একজন সদস্য। এতোদিন তাকে ভুল করে জেলে আটকে রাখা হয়। গত সপ্তাহে কোলকাতা থেকে ব্ল্যাক রঞ্জুর নিহত হবার প্রমাণ আর ডেথ সার্টিফিকেট চলে এলে আদালত নিতান্তই মানবিক কারণে তার জামিন মঞ্জুর করেন।

    উল্লেখ্য, আটককৃত ব্যক্তির আসল নাম মৃণাল। তার শারিরীক অবস্থা খুবই শোচনীয়। ব্ল্যাক রঞ্জুর প্রতিপক্ষ দলের আক্রমণে তার স্পাইনাল কর্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পঙ্গু হয়ে যায়। তারপক্ষের আইনজীবি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বরাত দিয়ে আদালতকে জানিয়েছে, শীঘ্রই উন্নত চিকিৎসা না পেলে আজীবনের জন্য তার মক্কেল পঙ্গু হয়ে যাবে।

    পুলিশ কেন এতদিন এই ব্যক্তিকে ব্ল্যাক রঞ্জ হিসেবে। আটক রেখেছিলো সে ব্যাপারে জানতে চাইলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কোনো কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানায়।

    .

    জেফরি বেগের মনে হলো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। টের পেলো তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে।

    অসম্ভব!

    ওটা ব্ল্যাক রঞ্জু না? পুলিশের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

    ।অধ্যায় ৫৪

    হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ হতভম্ব হয়ে বসে আছে। অফিসে এসে নিজের রুমে ঢুকতেই ছুটে এসেছে জেফরি বেগ। রাগেক্ষোভে রীতিমতো ফুসছিলো সে। এর আগে তাকে কখনও এতোটা ক্ষুব্ধ হতে দেখে নি ।

    কিন্তু জেফরি যখন তার দিকে একটি পত্রিকা বাড়িয়ে জানালো ব্ল্যাক রঞ্জুর জামিনের খবরটি পড়তে, তখন সে নিজেও ভিমড়ি খেয়েছিলো।

    ব্ল্যাক রঞ্জুর জামিন?! অসম্ভব।

    ছোট্ট রিপোর্টটা পড়তে খুব বেশি সময় লাগে নি কিন্তু যা পড়েছে তা এখনও হজম করতে পারছে না।

    যাকে তারা ধরেছে সে ব্ল্যাক রঞ্জু না? এরচেয়ে হাস্যকর কথা আর কি হতে পারে। এসব কী হচ্ছে?

    কয়েক মাস আগে বাস্টার্ড নামের খুনিটাকে যখন বর্তমান সরকার আনুকূল্য দেখিয়ে জামিনে মুক্ত করে দিলো তখন তার এই প্রিয়পাত্রটি চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলো । রেজিগনেশন লেটার টাইপ করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো সে। অনেক কষ্টে, প্রায় দু’ঘণ্টা সময় ব্যয় করে জেফরিকে সিদ্ধান্ত বদলাতে সক্ষম হয়েছিলো অবশেষে।

    এখন আবার ব্ল্যাক রঞ্জুকে এভাবে জামিনে মুক্ত করে দেয়ার মানে কি? এই সন্ত্রাসী কি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করে নি? প্রধানমন্ত্রীর কারারুদ্ধ স্বামীর ঘনিষ্ঠ এই সন্ত্রাসী কি নির্বাচনের আগে আগে জঘন্য একটি হত্যাকাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছিলো না?

    তাহলে?

    বাস্টার্ডকে না হয় জামিনে ছেড়ে দেয়ার যুক্তি থাকতে পারে-ঐ খুনি ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের লোকজনকে একের পর এক হত্যা করে পুরো ষড়যন্ত্রটি নস্যাৎ করে দিয়েছিলো কিন্তু ব্ল্যাক রঞ্জুকে ছেড়ে দেয়ার মানেটা কি?

    আবারো কি একটি ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে? বর্তমান সরকারের ভেতরে আরেকটি শক্তি ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করছে? রাজনীতিকদের কোনো বিশ্বাস নেই। সারাক্ষণ ক্ষমতার লোভে মত্ত থাকে তারা। এজন্যে যখন যা করার তাই করে। আর এসব অন্যায়কে তারা সুন্দর একটি আপ্তবাক্য দিয়ে জায়েজ করার চেষ্টা করে সব সময় : রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। একটা দার্শনিক উপলব্ধিকে কতো বাজেভাবেই না ব্যবহার করতে জানে এরা!

    হয়তো নতুন সরকারের ভেতর আরেকটি ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে আছে যারা তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বের ফসল এটি । কিন্তু ফারুক আহমেদের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তার ধারণা, সামনে বসে থাকা জেফরিরও একই অবস্থা।

    কিন্তু জেফরি বেগের অবস্থা একেবারেই ভিন্ন। কারণ ফারুক আহমেদের সাথে দেখা করার আগেই সে আরেকটি সত্য জানতে পেরেছে। রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে অফিসে ঢুকতেই তার সাথে দেখা হয় সহকারী জামানের । ছেলেটা তার। জন্যেই অপেক্ষা করছিলো।

    জামান তাকে কমিউনিকেশন্স রুমে নিয়ে গিয়ে গতরাতে রেকর্ড করা হোমমিনিস্টারের স্ত্রীর একটি ফোনালাপ শুনতে দেয়।

    সকালের পত্রিকার রিপোর্ট আর হোমমিনিস্টারের স্ত্রীর ফোনালাপ তার কাছে একটা বিষয় একদম স্পষ্ট করে তোলে : সেন্ট অগাস্টিনের জুনিয়র ক্লার্ক হাসানকে কে খুন করেছে-কেন খুন করা হয়েছে ।

    তবে জেফরি বেগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফারুক আহমেদকে এই ব্যাপারটা জানাবে না। এখনও সে সময় আসে নি।

    “পত্রিকার রিপোর্টটি যে সত্যি সেটা কি খতিয়ে দেখেছো?” অনেকক্ষণ পর এমন একটি প্রশ্ন করলো ফারুক আহমেদ যার উত্তর তার ভালো করেই জানা ।

    “আমি এখানে আসার পথেই ডিসি প্রসিকিউশনে ফোন করেছিলাম, স্যার…খবরটা একদম সত্যি,” স্থিরচোখে চেয়ে বললো জেফরি বেগ।

    বাম কপালটা হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে মাথা নেড়ে সায় দিলো মহাপরিচালক।

    “শুধু তা-ই নয়, হোমমিনিস্টার থেকে ডিসি প্রসিকিউশনকে বলা হয়েছিলো, এ ব্যাপারে কাউকে যেনো না জানানো হয়। একটু চুপ থেকে আবার বললো সে, “বিশেষ করে আমাদেরকে।”

    “মাইগড!” ফারুক আহমেদ নিজের ডেস্কের উপর একটা ঘুষি মারলো । কী বলবে বুঝতে পারছে না।

    “নিয়ম অনুযায়ী আমাদেরকে জানানোর কথা ছিলো । রঞ্জুকে আমরাই ধরেছিলাম, আমাদের কনসার্ন ছাড়া তার জামিন কী করে হলো, স্যার?”

    “এসব কী হচ্ছে, জেফ?” মহাপরিচালক বললো ।

    “স্যার…এর আগে বাস্টার্ডকে যখন জামিন দেয়া হলো তখনও একই কাজ করেছে এই হোমমিনিস্টার ।” জেফরি তার বসকে মনে করিয়ে দিলো আগের একটি ঘটনা।

    “হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো ফারুক আহমেদ। একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকা দু’দু’জন খুনিকে এভাবে ছেড়ে দেয়ার নিশ্চয় কোনো মানে আছে।

    “আমি আর সহ্য করবো না,” শান্তকণ্ঠে বেশ দৃঢ়তা নিয়ে বললো জেফরি বেগ ।

    হোমিসাইডের মহাপরিচালক ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চেয়ে রইলো তার দিকে। “প্লিজ, মাথা ঠাণ্ডা রাখো…”

    “আপনাকে কিছু একটা করতেই হবে, স্যার…নয়তো…”

    ফারুক আহমেদ বুঝতে পারলো জেফরি কী বলতে চাচ্ছে। এবার বুঝি তার পদত্যাগ আর আটকানো যাবে না। অবশ্যই করবো। এবার আমি চুপ করে বসে থাকবো না,” জেফরিকে আশ্বস্ত করে বললো সে।

    “কি করবেন, আপনি?”

    ফারুক আহমেদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। “ইয়ে মানে…কী করবো?” একটু চুপ থেকে আবার বললো সে, “জানতে চাইবো কেন এরকম হলো…আই ডিমান্ড প্রোপার এক্সপ্লনেশন-”

    “কার কাছ থেকে?” কথার মাঝখানে বলে উঠলো জেফরি বেগ।

    ফারুক আহমেদ স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “অথথারিটির কাছে…”

    মাথা দোলালো জেফরি । “স্যার, আপনি কি এখনও বুঝতে পারছেন না? হোমমিনিস্টার নিজে এ কাজে জড়িত, তিনি সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন?”

    আস্তে করে মাথা নেড়ে সায় দিলো তবে মুখে কিছু বললো না।

    “আপনি সরাসরি হোমমিনিস্টারের কাছে এটা জানতে চাইবেন!” উত্তেজিত হয়ে বললো সে। “আর কারো কাছে না । সব কিছু উনার নির্দেশেই হয়েছে। সুতরাং জিজ্ঞেস যদি করতেই হয় উনাকেই করবেন।” একটু চুপ থেকে জেফরি আবার বললো, “আপনি কি করবেন আমি জানি না, স্যার । কিন্তু আমি রুটিরুজির ধান্দায় নিজের ডিগনিটি বিসর্জন দিয়ে এভাবে চাকরি করতে পারবো না।”

    জেফরির মনে হলো ফারুক আহমেদ সমস্ত ভয় আর দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে। গভীর করে দম নিয়ে বলতে শুরু করলো সে, “আমিও এই চাকরির পরোয়া করি না, জেফ। মোটেই না। হয়তো মানুষ হিসেবে আমি তেমন শক্ত নই, হতে পারে আমি সব সময় ম্যানেজ করার পক্ষপাতি কিন্তু আমিও তোমার মতো ডিগনিটি বিসর্জন দেবার লোক নই।”

    “আমি জানি, স্যার,” বললো জেফরি। কিন্তু আপনি যেভাবে যে পদ্ধতিতে লড়াই করতে চান সেটা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। কখনও কখনও আমাদেরকে মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে হয়।”

    “রাইট, মাইবয়, দৃঢ়ভাবে বললে মহাপরিচালক। “আমি হোমমিনিস্টারের কাছেই এই ঘটনার প্রোপার এক্সপ্লানেশন চাইবো।”

    “কবে, স্যার?” ছোট্ট করে বললো জেফরি বেগ।

    “দরকার হলে আজই!” জোর দিয়ে বললো মহাপরিচালক।

    “অবশ্য আজকে। আপনার উচিত ইমার্জেন্সি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া। এখনও ঐ বদমাশটাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানোর সময় আছে । এক মুহূর্তও দেরি করা ঠিক হবে না।”

    “আমি তাই করবো। আজকেই দেখা করবো। উনার যতো কাজই থাকুক না কেন, পনেরো মিনিটের জন্য হলেও আমাকে সময় দিতে হবে আজ। হোমিসাইডের মহাপরিচালক হিসেবে এটুকু দাবি আমি করতেই পারি।”

    নিজের বসের এমন দৃঢ়তা দেখে জেফরি খুশি হলো। “আমার একটা অনুরোধ আছে, স্যার…” বললো সে।

    “কি?”

    “আপনার সাথে আমিও যাবো।”

    ফারুক আহমেদ জেফরির দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

    “আমি অনেক কষ্ট করে ঐ ব্ল্যাক রঞ্জু আর বাবলুকে অ্যারেস্ট করেছিলাম…”।

    “বাবলুটা কে?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো মহাপরিচালক।

    “বাবলু মানে বাস্টার্ড।” জেফরি বুঝতে পারলো ফারুক আহমেদ বাবলু নামটার সাথে খুব বেশি পরিচিত নয়।

    “ও!”

    “স্যার,” জেফরি খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, “আমারও অধিকার আছে এটা জানার, কেন উনি এরকম কাজ করলেন। সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা না পেলে আমি আর হোমিসাইডে থাকবো না।”

    মহাপরিচালক কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “অবশ্যই তোমার অধিকার আছে। তুমি আমার সাথে যাচ্ছো।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বললো, “তুমি না থাকলে ঐ রঞ্জু বদমাশটা বাস্টার্ড নামের খুনিকে শেষ করে দিয়ে নিজের মিশনে নেমে যেতো। তার হাত থেকে আমাদের এখনকার প্রধানমন্ত্রী বাঁচানো সম্ভব হতো কিনা কে জানে। তোমার কারণেই বাস্টার্ডের বাড়ি থেকে রঞ্জুকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।”

    জেফরি তার বসের দিকে চেয়ে রইলো। এর আগে তাকে কখনও এতোটা ঋজু আর দৃঢ়চেতা দেখে নি ।

    অধ্যায় ৫৫

    হোমমিনিস্টারের সাথে দেখা করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে খুব কষ্ট হলো । প্রথমে মিনিস্টারের পিএস দু’দিন পর দেখা করার কথা বললে ফারুক আহমেদ জানায়, ব্যাপারটা খুব জরুরি, কোনোভাবেই অপেক্ষা করা যাবে না। যে করেই হোক, আজই দেখা করতে হবে ।

    হোমিসাইডের মহারিচালকের চাপাচাপিতে অবশেষে সন্ধ্যার পর মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য দেখা করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয় । তবে ফারুক আহমেদ অবাক হয়েছিলো যখন তাকে বলা হয় মিনিস্টারের অফিসে নয়, তাকে আসতে হবে মিন্টো রোডে মিনিস্টারের সরকারী বাসভবনে।

    এখন ফারুক আহমেদ আর জেফরি বেগ বসে আছে ড্রইংরুমে । বিশাল ড্রইংরুমটায় কম করে হলেও চার জোড়া সোফা সেট রয়েছে। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু চেয়ার। তারা ছাড়াও আরো অনেক লোকজন বসে আছে দেখা করার জন্য। এরা সবাই মিনিস্টারের পার্টির লোকজন। তবে তাদের মধ্যে চাপা ফিসফাস শোনা যাচ্ছে, মিনিস্টার সাহেব নাকি আজও কারো সাথে দেখা করবেন না ।

    প্রায় দশ মিনিট বসে থাকার পর হোমমিনিস্টারের পিএস ড্রইংরুমে প্রবেশ করলো।

    “আপনারা আসুন,” ফারুক আহমেদ আর জেফরি বেগকে বললো ভদ্রলোক।

    লোকটার কণ্ঠ শুনে তার দিকে চেয়ে রইলো জেফরি, কিন্তু ফারুক আহমেদ সেটা লক্ষ্য করলো না। ঘরের অন্য লোকগুলোও ঈর্ষার দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তাদের দুজনের দিকে।

    তাদেরকে নিয়ে পিএস ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতরে।

    মিন্টো রোডের এই বাড়িগুলো বেশ পুরনো, খুব সম্ভবত বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা যখন প্রাদেশিক রাজধানী হলো তখন এগুলো নির্মাণ করা হয়েছিলো নতুন রাজধানীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য। বলাবাহুল্য, সেইসব কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ছিলো ইংরেজ। বাড়িগুলোর নক্সা, এর ভেতরকার সাজগোজ এখনও ইংরেজদের রুচির বহিপ্রকাশ ঘটাচ্ছে ।

    মিনিস্টারের পিএসের পিছু পিছু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরতলায় উঠে গেলো তারা দু’জন । সুদীর্ঘ হলওয়ে পেরিয়ে ষষ্ঠভূজাকৃতি একটি ঘরে ঢোকার আগে পিএস তাদের দিকে ফিরে বললো, “মাত্র পনেরো মিনিট। এর বেশি সময় নেবেন না।”

    পিএসের পেছনে পেছন ঘরে ঢুকে পড়লো ফারুক আহমেদ আর জেফরি বেগ।

    হোমমিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ পাঞ্জাবি-পাজামা পরে সোফায় বসে আছেন। ঘরে তারই সমবয়সী আরেকজন লোক বসে আছে, ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে মিনিস্টারের বন্ধুস্থানীয় কেউ হবে । কিংবা নিকট আত্মীয় ।

    ফারুক আহমেদ আর জেফরি বেগ সালাম দিলে মিনিস্টার চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। জেফরিকে দেখে তিনি অবাক হয়েছেন বলে মনে হলো, তবে পরক্ষণেই নিজের বিস্মিত হবার অভিব্যক্তিটা লুকিয়ে ফেললেন। তাদেরকে বসার জন্য ইশারা করলেন তিনি।

    “খুব জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন, কারণটা কি?” শান্তকণ্ঠে ফারুক আহমেদকে বললেন মিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ। তার মুখে কোনো হাসি নেই । এক ধরণের তিক্ততা ছড়িয়ে আছে ।

    হোমিসাইডের মহাপরিচালক বুঝতে পারলো মিনিস্টার সাহেব এভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়াতে খুশি হন নি। আরে বাবা, আমিও তো খুশি না। আমার অসন্তোষের খবর কে রাখে? মনে মনে বললো সে।

    “জি, স্যার…খুবই জরুরি একটা ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি,” ফারুক আহমেদ বললো।

    “বলুন, কি ব্যাপার?”

    মিনিস্টারের পাশে বসা লোকটার দিকে তাকালো ফারুক আহমেদ। “একটু প্রাইভেটলি বলতে চাচ্ছিলাম, স্যার। কনফিডেনশিয়াল ম্যাটার।”

    নির্বিকার মুখে চেয়ে রইলেন মিনিস্টার, তারপর ফিরলেন পাশে বসা লোকটার দিকে। বিড়বিড় করে কী যেনো বললেন তাকে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা উঠে ঘর থেকে চলে গেলো।

    “হুম…এবার বলুন।”

    “স্যার, গতকাল ব্ল্যাক রঞ্জু জামিনে মুক্তি পেয়েছে…আপনি নিশ্চয় জানেন?”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিনিস্টার । “হ্যাঁ, জানি।”

    “কাজটা করা হয়েছে আমাদের কনসার্ন ছাড়া, ডিসি প্রসিকিউশন থেকে এ ব্যাপারে আমাদেরকে কিছুই জানানো হয় নি। আমাদেরকে না জানিয়ে তাকে জামিন দেয়া হয়েছে, স্যার।” বেশ সতর্কভাবে বললো ফারুক আহমেদ। একজন মিনিস্টারের কাছে সরাসরি জবাবদিহিতা চাওয়া যায় না।

    “ওই লোকটা নাকি ব্ল্যাক রঞ্জু না…তার আইনজীবিরা এটা আদালতে প্রমাণ করতে পেরেছে…তাদের কাছে হার্ড এভিডেন্স ছিলো, বুঝতেই পারছেন, আমাদের কিছু করার ছিলো না।” কাটাকাটাভাবে বললেন মাহমুদ খুরশিদ।

    “কিন্তু আমাদের কাছে অনেক এভিডেন্স আছে, স্যার,” পাশ থেকে আস্তে করে বললো জেফরি বেগ । মিনিস্টার তার দিকে তাকালেন। “ওই লোকটাই যে ব্ল্যাক রঞ্জু সেটা আমরা আদালতে প্রমাণ করতে পারতাম…যদি আমাদেরকে জানানো হতো।”

    “ওরা আদালতে আসল ব্ল্যাক রঞ্জুর ডেথ সার্টিফিকেট দেখিয়েছে। কোলকাতা মেট্রোপলিটান পুলিশের টেস্টিমোনিও সাবমিট করেছে। সেখানে আপনার রেফারেন্সও দেয়া আছে…মি: বেগ।”

    মিনিস্টারের মুখে নিজের নামটা শুনে একটু অবাকই হলো জেফরি । তবে তারচেয়েও বেশি অবাক হলো কোলকাতার পুলিশের কথাটা শুনে ।

    “রঞ্জুর আইনজীবি কিভাবে এটা জানতে পারলো, স্যার?” নিজের বিস্ময় আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না। এটা তো শুধুমাত্র আমরা জানি!”

    মিনিস্টার একটু বিব্রত হলেন। চকিতে পিএস আলী আহমেদের দিকে তাকালেন তিনি। “আপনি আর আমাদের ডিজি সাহেব কোলকাতার পুলিশ কমিশনারকে রিকোয়েস্ট করেছিলেন ব্ল্যাক রঞ্জুকে অ্যারেস্ট করার জন্য।”

    ফারুক আহমেদ কিছু বলার আগেই জেফরি বলে উঠলো, “জি, স্যার…কিন্তু যে লোক খুন হয়েছিলো সে ব্ল্যাক রঞ্জু ছিলো না। রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী ছিলো।”

    “এ কথা বললে কাজ হতো না। ওই লোকটার আইনজীবি কোলকাতা পুলিশের কাছ থেকে ব্ল্যাক রর ডেথ সার্টিফিকেট জোগার করেছে। আদালত সেটা বিশ্বাসও করেছে। আপনি আদালতে গিয়ে এ কথা বললেও কোনো লাভ হতো না। আপনার কাছে তো হার্ড এভিডেন্স নেই।”

    “আছে, স্যার। আমি যদি জানতাম রঞ্জু জামিন নেবার চেষ্টা করছে তাহলে অবশ্যই সেসব এভিডেন্স সাবমিট করতে পারতাম,” জোর দিয়ে বললো জেফরি বেগ।

    “এখন আর এটা বলে কোনো লাভ নেই। হাইকোর্ট জামিন দিয়েছে, আমরা কী করবো?”

    “কিন্তু স্যার, আমাদেরকে কেন জানানো হলো না সেটা কি জানতে পারি?” বেশ দৃঢ়ভাবেই কথাটা বললো ফারুক আহমেদ।

    মিনিস্টার তার দিকে চেয়ে রইলেন স্থিরদৃষ্টিতে। “আপনি আমার কাছ থেকে কৈফিয়ত চাচ্ছেন?” শান্তকণ্ঠে বললেন তিনি ।

    “আপনি যদি এটাকে কৈফিয়ত মনে করেন, তাহলে তাই…” ফারুক আহমেদ কিছু বলার আগেই জেফরি বলে উঠলো।

    মিনিস্টার গোল গোল চোখে চেয়ে রইলেন জেফরি বেগের দিকে । “হাউ ডেয়ার ইউ আর!” রেগেমেগে তাকালেন তিনি। “বিহেইভ ইউর সেলফ!” ধমকের সুরে বললেন জেফরিকে ।

    “স্যার, প্লিজ, ফারুক আহমেদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো। “ওর কথায় কিছু মনে করবেন না । ও আসলে মিন করে কথাটা বলে নি…”

    “আমি মিন করেই বলেছি,” দৃঢ়ভাবে বললো জেফরি।

    ফারুক আহমেদ হতভম্ব হয়ে জেফরি বেগের দিকে তাকালো আবার। মিনিস্টার আর তার পিএস যেনো আকাশ থেকে পড়লো কথাটা শুনে।

    “আপনি কার সাথে কথা বলছেন, হুঁশজ্ঞান আছে?” মিনিস্টারের পিএস ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো জেফরিকে ।

    “জি, আছে । উনি আমাদের হোমমিনিস্টার।”

    জেফরির এ কথা শুনে ফারুক আহমেদ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো । তার এই প্রিয়পাত্র কী বুঝতে পারছে কার সামনে সে কথা বলছে? জেফরির কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো?

    “কয়েকটা সাফল্য আর পত্রপত্রিকায় ছবি ছাপা হবার পর আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, মি: বেগ,” দাঁতে দাঁত পিষে বললেন মিনিস্টার । “ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। এবার ফারুক আহমেদের দিকে ফিরলেন তিনি । “আমার কাছ থেকে কৈফিয়ত চাইবার জন্যেই কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন?”

    কিন্তু ফারুক আহমেদ কিছু বলার আগেই জেফরি আবারো বলে উঠলো, “না, স্যার । আরেকটা জরুরি কারণে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

    মিনিস্টার আর হোমিসাইডের মহাপরিচালক দু’জনেই অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। পিএস লোকটা ভুরু কুচকে জেফরিকে দেখে যাচ্ছে।

    “সেটা কি, বলেন?” মিনিস্টার গম্ভীরকণ্ঠে বললেন। “আমার হাতে বেশি সময় নেই।”

    পাশে বসে থাকা পিএসের দিকে তাকালো জেফরি । “কথাটা আমি একান্তে বলতে চাই, স্যার।”

    “বলুন, কোনো সমস্যা নেই,” কাটাকাটাভাবে বললেন মাহমুদ খুরশিদ।

    “কিন্তু আমি একান্তেই কথাটা বলতে চাই, স্যার।” জেফরি অনড়।

    মিনিস্টার যেনো বিশ্বাসই করতে পারছেন না। অসহায়ের মতো জেফরির দিকে চেয়ে রইলো ফারুক আহমেদ। কিন্তু সে চেয়ে আছে সরাসরি মিনিস্টারের দিকে ।

    নিজের চেপে রাখা ক্রোধ নিঃশ্বাসের সাথে বের করে দিলেন মিনিস্টার । বোঝা গেলো জোর করে রাগ দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। “ও আমার পিএস…আমার সাথে ওর সম্পর্ক বহুদিনের। বলতে পারেন আমার পরিবারেরই।” ।

    “ঠিক আছে, স্যার, আমি চলে যাচ্ছি, নো প্রবলেম,” পিএস উঠে দাঁড়ালো। “উনি হয়তো আমার সামনে কথাটা বলতে চাচ্ছেন না।”

    “তুমি বসো,” মৃদু ধমকের সুরে বললেন মিনিস্টার। তারপর জেফরির দিকে ফিরলেন । “যা বলার জলদি বলুন, মি: বেগ । আপনাদেরকে একটু পরই উঠতে হবে।” পিএসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বসার জন্য ইশারা করলেন তিনি।

    জেফরি পাশ ফিরে দেখলো ফারুক আহমেদ মাথা নীচু করে হাত দিয়ে কপাল ঘষছে। তাকে এখানে নিয়ে এসে যে ভুল করেছে সেটাই যেনো এখন টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে ।

    “ব্যাপারটা আপনার ছেলে তুর্যকে নিয়ে।”

    জেফরির কথাটা যেনো ঘরের মধ্যে এক ধরণের আলোড়ন তুললো । চমকে উঠলেন মিনিস্টার। পিএস চট করে তাকালো জেফরির দিকে। তার চোখেমুখে বিস্ময়। আর ফারুক আহমেদ স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শুধু । মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

    “আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?” রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না হোমমিনিস্টার ।

    “আপনার ছেলে তুর্য কোথায়?” জেফরি শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলো ।

    পিএস আর ফারুক আহমেদ বিস্ময়ে চেয়ে রইলো তার দিকে। হোমমিনিস্টার ভুরু কুচকে জেফরিকে দেখে নিলেন।

    “আমার ছেলে তুর্য কোথায় মানে?” যেনো আগ্নেয়গিরি ফুঁসে উঠছে।

    “আপনার ছেলে তুর্য এখন কোথায় আছে?” কথাটা পুণরাবৃত্তি করলো সে ।

    পিএসের সাথে মিনিস্টারের দৃষ্টি বিনিময় হলো। হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ এতোটাই ভড়কে গেছে যে মূর্তির মতো বসে রইলো কেবল। তার চোখের পলক পড়ছে না। নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে যেনো ।

    “হঠাৎ তুর্যের কথা জানতে চাইছেন কেন?” পিএস জিজ্ঞেস করলো।

    “দরকার আছে।” ছোট্ট করে জবাব দিলো জেফরি ।

    তীক্ষ্ণ চোখে মিনিস্টার চেয়ে রইলেন হোমিসাইডের ইভেস্টিগেটরের দিকে। “আমি মনে করি না আমার ছেলে কোথায় আছে না আছে সেটা আপনার জানার দরকার আছে।”

    “স্যার, আমি জানি আপনার ছেলে কোথায় আছে,” আস্তে করে বললো জেফরি বেগ।

    কথাটা শুনে মিনিস্টার আর তার পিএস চমকে উঠলো । ফারুক আহমেদ আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। চাপাকণ্ঠে জেফরির হাতটা ধরে সে বললো, “জেফ, তুমি এসব কি বলছো!”

    জেফরি তার বসের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে আশ্বস্ত করে মিনিস্টারের দিকে ফিরলো আবার ।

    “স্যার, আমি জানি সেন্ট অগাস্টিনের জুনিয়র ক্লার্ক হাসানকে কারা খুন করেছে…কেন ব্ল্যাক রঞ্জুর মতো সন্ত্রাসীকে আপনি জামিনে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছেন।”

    হোমমিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে জেফরির দিকে তাকালেন। “আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?”

    “ব্ল্যাক রঞ্জু আপনার ছেলেকে কিডন্যাপ করেছে, স্যার।”

    অধ্যায় ৫৬

    এক অসহ্য নীরবতায় ডুবে আছে হোমমিনিস্টারের ড্রইংরুমটা।

    জেফরির মুখ থেকে কথাটা শুনে মিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ আর তার পিএস একদৃষ্টে অনেকক্ষণ চেয়েছিলো। ফারুক আহমেদ বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে আছে জেফরির দিকে।

    ঘরের চারজন মানুষ বুঝতে পারছে না কে এই নীরবতা ভাঙবে, কিভাবে ভাঙবে।

    জেফরি বেগই মুখ খুললো আবার। “বদমাশটা জেলে বসেই তার লোকজনদের সাহায্যে তুর্যকে সেন্ট অগাস্টিন থেকে কিডন্যাপ করেছে।”

    ফারুক আহমেদ থ বনে গেলো।

    “এ কারণেই আপনি ব্ল্যাক রঞ্জুকে জামিনে মুক্ত করেছেন। করতে বাধ্য হয়েছেন।”

    “স্যার, জেফরি এসব কী বলছে?” বিস্মিত হয়ে ফারুক আহমেদ বললো।

    “মি: বেগ ঠিকই বলেছেন, অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে করে বললেন মিনিস্টার।

    “স্যার, আপনি এতো বড় ভুল করলেন কেন?”

    জেফরির কথাটা শুনে মিনিস্টার বুঝতে পারলেন না । “ভুল!”

    “আপনি হোমমিনিস্টার হয়ে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিভাবক হয়ে তাদের সাহায্য নিলেন না…তাদের উপর নির্ভর করলেন না। পুরো ব্যাপারটা গোপন করে রাখলেন। ঐ জঘন্য সন্ত্রাসী-খুনি জেল থেকে বসে যে দাবি করেছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন ।” মাথা দোলালো জেফরি । “আপনি নিজেই যদি আপনার বাহিনীর উপর আস্থা রাখতে না পারেন তাহলে জনগণ কিভাবে আস্থা রাখবে?”

    মিনিস্টার চোখ বন্ধ করে ফেললেন আবার।

    “তুর্য স্যারের একমাত্র সন্তান,” আস্তে করে পাশ থেকে বললো পিএস । “যেভাবে ঘটনা ঘটেছে, যেভাবে ব্ল্যাক রঞ্জু চাপ দিয়েছে…” কথাটা শেষ না করে মাথা দোলালো সে। “আমরা সবাই ভীষণ ভড়কে গেছিলাম।”

    “ঐ সন্ত্রাসী কতো ক্ষমতা রাখে আমি জানি না,” মিনিস্টার উদাস হয়ে বললেন, “কিন্তু সে এ পর্যন্ত যা করেছে সেটা একেবারেই অকল্পনীয়…”

    “কি করেছে, স্যার? প্লিজ, আমাকে সব খুলে বলুন।” তাড়া দিয়ে বললো জেফরি বেগ।

    মিনিস্টার স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন ইনভেস্টিগেটরের দিকে। তারপর পিএসের দিকে ফিরে বললেন, “তুমিই বলো, ঐ দিন কি হয়েছিলো।”

    পিএস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো । মিনিস্টারের চেয়ে তার মানসিক অবস্থা যেনো আরো বেশি খারাপ।

    ব্যাপারটা জেফরির কাছে সন্দেহজনক বলে মনে হলো ।

    “গত বৃহস্পতিবার বিকেলের পর, সন্ধ্যার দিকে হবে হয়তো,” বলতে শুরু করলো পিএস। “আমার কাছে একটা ফোন আসে…”

    .

    সপ্তাহের অন্যসব দিনের চেয়ে বৃহস্পতিবার হোমমিনিস্টারের অফিসে কাজের চাপ বেশি থাকে। পিএস আলী আহমেদ যথারীতি খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামি নামি করছে তখন । নিজের রুমে বসে একজনের সাথে কথা বলছিলো সে । লোকটা পুলিশের উর্ধতন এক কর্মকর্তা। সরকার দলের সমর্থক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে বদলীর তদবির করতে এসেছে।

    এমন সময় আলী আহমেদের মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে।

    আকরাম? একটু অবাক হয় পিএস। আকরাম মিনিস্টারের ছেলে তুর্যের দেহরক্ষি। এসবি’র একজন কনস্টেবল । ড্রাইভারসহ সার্বক্ষণিক বডিগার্ড হিসেবে সে দায়িত্ব পালন করে। তুর্যকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, স্কুল থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া, এসব কাজ করে সে। এই লোক তাকে কেন ফোন করেছে?

    কলটা রিসিভ করে পিএস।

    ওপাশ থেকে আকরাম নামের লোকটা জানায় তুর্যকে স্কুলের ভেতর পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুল ছুটির পর তুর্য বাস্কেটবল কোর্টে প্র্যাকটিস করছিলো। তার সব সঙ্গিসাথি প্র্যাকটিস শেষে একে একে বেরিয়ে আসার পরও তুর্যকে না পেয়ে সে স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানে তুর্য নেই। আকরাম জানায় তুর্যের সব বন্ধুবান্ধব চলে যাবার পরও তাকে বের হতে না দেখে সে তার মোবাইল ফোনে কল দেয়, কিন্তু ফোনটা বন্ধ পেয়েছে। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না । তুর্য গেলো কোথায়?

    পিএস আলী আহমেদও অবাক হয়। এটা কি করে সম্ভব?

    আকরামকে ভালো করে খোঁজ নিতে ‘লে দেয় সে। স্কুলের দাড়োয়ান, কর্মচারি সবাইকে জিজ্ঞেস করতে বলে। কিন্তু আকরাম জানায়, সে সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে। কেউ কিছু জানে না। সারা স্কুল তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে, তুর্য কোথাও নেই।

    আশ্চর্য! ছেলেটা গেলো কোথায়? ভাবনায় পড়ে যায় পিএস। তার মনে পড়ে যায় কয়েক মাস আগের সেই ঘটনাটি । হয়তো মিনিস্টারের বখে যাওয়া ছেলেটা আবারো কোনো আকাম-কুকামে… ।

    সঙ্গে সঙ্গে আকরামকে বলে, সে যেনো স্কুলভবনের প্রতিটি রুম চেক করে দেখে । টয়লেট, স্টোররুম, সবখানে। নিশ্চয় কোথাও না কোথাও আছে তুর্য । কয়েক মাস আগে অগাস্টিনের স্টোররুম থেকে ছেলেটাকে তার সহপাঠি এক মেয়েসহ হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলো ঐ স্কুলের ক্লার্ক । বিরাট কেলেংকারির ব্যাপার হয়েছিলো সেটা। যাইহোক, খুব সহজেই সে ঘটনা ধামাচাপা দেয়া গেছে। এখন আবার ছেলেটা নতুন কোনো ঝামেলা পাকায় নি তো?

    আকরামও ঐ ঘটনার সবই জানে, সুতরাং তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয় সে। সবগুলো রুম যেনো চেক করে দেখে । আর এই ব্যাপারটা নিয়ে উচ্চবাচ্য না করে চুপচাপ কাজটা করার পরামর্শ দিয়ে ফোন রেখে দেয় পিএস।

    পনেরো মিনিট পরই আকরাম আবার কল করে। উদভ্রান্ত কণ্ঠে সে জানায় তুর্যকে খুঁজতে গিয়ে ভয়ঙ্কর একটি জিনিস আবিষ্কার করেছে স্কুলের টয়লেটের ভেতর একটা লাশ পড়ে আছে। সেই লাশটা আর কারোর নয়, ঐ ক্লার্ক ছেলেটির, যার সাথে কয়েক মাস আগে তুর্যের ঝামেলা হয়েছিলে।

    কথাটা শুনে পিএস ঘাবড়ে যায়। রাগের মাথায় হাসানকে খুন করে ফেললো না তো ছেলেটা?

    আকরাম দারুণ শংকিত হয়ে পড়ে। পিএস নিজেও ভড়কে যায় । কথাটা মিনিস্টারকে জানাতে হবে। নিশ্চয় বড় কোনো ঘাপলা হয়ে গেছে।

    সঙ্গে সঙ্গে সে চলে যায় মিনিস্টারের অফিসে। রুমে ঢোকার ঠিক আগেই তার কাছে আরেকটা ফোন আসে। এবারের ফোনটা অজ্ঞাত এক নাম্বার থেকে।

    মিনিস্টারের রুমের বাইরে দাঁড়িয়েই পিএস কলটা রিসিভ করে ।

    কিছুক্ষণ পর যখন মিনিস্টারের রুমে ঢোকে তখন তার অবস্থা খুবই করুণ। রীতিমতো বিপর্যস্ত।

    মিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ তার বহুদিনের পুরনো পিএস আলী আহমেদকে দেখে বুঝতে পারেন কিছু একটা হয়েছে। তার কাছে জানতে চান ঘটনা কি। তাকে কেন এমন দেখাচ্ছে?

    আলী আহমেদ ধপাস করে চেয়ারে বসে মিনিস্টারের দিকে চেয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপরই বলে, একটু আগে তাকে ফোন করে জানানো হয়েছে তুর্যকে কিডন্যাপ করা হয়েছে ।

    কথাটা শুনে মিনিস্টার হতভম্ব হয়ে পড়েন। এটাও কি সম্ভব? এ দেশের হোমমিনিস্টারের ছেলেকে কিডন্যাপ? এতো বড় আস্পর্ধা কার?

    পিএস সব খুলে বলে : একটু আগে আকরাম ফোন করে জানিয়েছে তুর্যকে স্কুলে খুঁজে পাচ্ছে না। তারপর অজ্ঞাত এক নাম্বার থেকে এক লোক নিজেকে ব্ল্যাক রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিয়ে ফোনে জানিয়েছে তুর্য এখন তাদের জিম্মায় আছে।

    ব্ল্যাক রঞ্জু?!

    অসম্ভব! সে তো এখন জেলে। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে। তার শারিরীক অবস্থা খুবই খারাপ। তার পক্ষে কিভাবে এরকম একটি কাজ করা সম্ভব হলো?

    পিএস জানায়, ব্ল্যাক রঞ্জু খুবই ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী । বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনের আগে খুন করার মতো দুঃসাহসও এই লোক দেখিয়েছিলো। আরেকটুর জন্যে মিশনটাতে সফল হয়ে যেতো সে। মাহমুদ খুরশিদ নিজে সেটা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন এক পেশাদার খুনিকে রঞ্জুর পেছনে লেলিয়ে দিয়ে ।

    পিএস আলী আহমেদ তার বসকে জানায়, রঞ্জু বেশ প্রস্ততি নিয়েই তার লোকজনকে মাঠে নামিয়েছে। তুর্যের এই কিডন্যাপের কথা তারা দু’জন বাদে অন্য কেউ জানলে ছেলেটাকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দেয়া হয়েছে। আলী আহমেদ বলে, সে নিজে বিশ্বাস করে যারা হোমমিনিস্টারের ছেলেকে কিডন্যাপ করার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে তাদেরকে খাটো করে দেখা ঠিক হবে না।

    পিএসের কথায় এতো সহজে দমে যান নি হোমমিনিস্টার। তিনি যখন এ ব্যাপারে কিছু একটা করার কথা যখন ভাবছিলেন ঠিক তখনই আরেকটা কল আসে পিএসের ফোনে।

    ফ্যাসফ্যাসে একটি কণ্ঠ জানায়, ব্যাপারটা তৃতীয় কারো কানে যাওয়া মাত্রই তুর্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হবে। আরো বলা হয়, তাদের জন্য একটি উপহার আছে। একটু পর একটা এসএমএস পাঠানো হবে। সেটা ব্যবহার করলেই তারা তুর্যকে দেখতে পাবে ।

    কলটা শেষ হতেই একটা এসএমএস চলে আসে পিএসের ফোনে। প্রথমে এসএমএসটার অর্থ বুঝতে পারে নি আলী আহমেদ সাহেব, কিন্তু তারপই বুঝতে পারে ব্ল্যাক রঞ্জুর দল তাদের কাছে কি পাঠিয়েছে।

    ***

    “কি পাঠানো হয়েছিলো?” সব শুনে অবশেষে জানতে চাইলে জেফরি বেগ।

    মিনিস্টার আর তার পিএস কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো।

    “একটা লিংক,” আস্তে করে বললো পিএস আলী আহমেদ।

    “কিসের লিংক?”

    “ইউ-টিউবের ।”

    “বলেন কি,” আস্তে করে বললো জেফরি বেগ । চট করেই সে ধরতে পারলো ব্যাপারটা।

    ফারুক আহমেদ কিছুই বুঝতে পারলো না। সে জেফরির দিকে চেয়ে বললো, “ইউ-টিউবের লিংক মানে?”।

    হাত তুলে নিজের বসকে চুপ থাকার ইশারা করলো জেফরি। “আমি ভিডিওটা দেখতে চাই,” পিএসকে বললো সে।

    মিনিস্টারের দিকে তাকালো পিএস। মাহমুদ খুরশিদ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন কেবল । “স্যার, উনাকে দেখাবো?”

    “দেখাবেন?” পাল্টা প্রশ্ন করলেন মিনিস্টার।

    “উনি তো সব জেনেই গেছেন,” বললো পিএস। আর কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ালেন আলী আহমদ।

    জেফরি বেগ লক্ষ্য করলো হোমমিনিস্টার তার পিএসের উপর দারুণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। বলতে গেলে তার কথায় এখন সব কাজ করেন।

    পাশের একটি ডেস্ক থেকে ল্যাপটপ তুলে এনে জেফরির সামনে রাখলেন পিএস। ইন্টারনেট কানেকশানটা অন করে কিছু টাইপ করতেই পদায় ভেসে উঠলো জনপ্রিয় ভিডিও সাইট ইউটিউবের ডেস্কটপটা।

    বাফারিং হবার সময় ভিডিওটার লিংক মুখস্ত করে ফেললো জেফরি।

    একটু পরই সেখানে ভেসে উঠলো একটি ভিডিও ।

    অল্প বয়সী এক ছেলে একটা চেয়ারে বসে আছে। তার দু’হাত চেয়ারের হাতলের সাথে শক্ত করে বাধা। মাথার চুল এলোমেলো । বাম ঠোঁটটা ফোলা । চোখের জলে গাল ভিজে একাকার ।

    তুর্য!

    জেফরি টের পেলো তার বস ফারুক আহমেদ ভিডিওটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, জেফরির এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে সে আনমনে। ফারুক আহমেদের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেলো।

    একটা অদ্ভুত ঘরে তুর্য বসে আছে। তার হাত বাধা চেয়ারের হাতলের সাথে । সম্ভবত পা দুটোও চেয়ারের পায়ার সাথে বেধে রাখা হয়েছে তবে সেটা ভিডিওর ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে না । জেফরি সেটা আন্দাজ করে নিলো।

    তুর্য একাই বসে আছে । চিৎকার করে বলছে : “প্লিজ, আমাকে মারবেন। না। প্লিজ!”

    অমনি পেছন থেকে একটা হাত চেপে ধরলো তুর্যের মুখ । লোকটাকে দেখা গেলো না, শুধু হাত আর বুকের কিছু অংশ ছাড়া । লোকটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলো তুর্য, কোনো লাভ হলো না। যেনো শক্ত কোনো কিছু দিয়ে তার চেয়ারটাও আটকে রাখা হয়েছে। তুর্য তার হাত দুটো ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে লাগলো কিন্তু ওগুলো এতো শক্ত করে বাধা যে একটুও নড়াতে পারলো না।

    পেছন থেকে যে হাতটা তুর্যের মুখ চেপে রেখেছিলো সেটা হঠাৎ করেই ছেড়ে দিলো । হাফিয়ে উঠলো ছেলেটা। চিৎকার করে বলে উঠলো : “বাবা, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে…বাবা আমাকে বাঁচাও!”

    তুর্যের চিৎকাররত মুখটা ফুজ হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। শেষ হয়ে গেলো ছোট্ট অথচ বিভীষিকাময় একটি ভিডিও।

    কয়েক মুহূর্ত ঘরের কেউ কোনো কথা বললো না। জেফরি চেয়ে দেখলো মিনিস্টার দুচোখ বন্ধ করে রেখেছেন।

    নীরবতা ভাঙলো পিএস আলী আহমেদ । “প্রথম দুদিনে এরকম প্রায় পাঁচ-ছয়টি ভিডিও পাঠিয়েছে তারা।”

    “তাই নাকি?” অবাক হয়ে বললো জেফরি বেগ । একটু চুপ থেকে মিনিস্টারের দিকে ফিরলো । এখনও চোখ বন্ধ করে রেখেছেন তিনি। “স্যার, ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে কি আপনি নিজে কথা বলেছেন?”

    আলী আহমেদের দিকে তাকালেন মাহমূদ খুরশিদ। ভদ্রলোক মাথা নেড়ে সায় দিলো।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হুম।”

    “ফোনে?”

    মিনিস্টার তার কপালের বাম পাশটা হাত দিয়ে ঘষলেন, লাল টকটকে চোখে তাকালেন জেফরি বেগের দিকে । “না।”

    অধ্যায় ৫৭

    বৃহস্পতিবার তুর্য কিডন্যাপ হবার পর থেকে হোমমিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ আর তার পরিবারের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যায় সেটা কল্পনাতীত। এতো ক্ষমতাধর একজন ব্যক্তি জেলে বন্দী ব্ল্যাক রঞ্জুর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন। ছেলের জীবন রক্ষা করার জন্য নিজের সমস্ত শক্তি আর ক্ষমতার কিছুই ব্যবহার করতে পারেন নি। একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন।

    ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের এক অজ্ঞাত লোক যোগাযোগ করতে থাকে তাদের সাথে ।

    ইউ-টিউবের বেশ কয়েকটি ভিডিওতে তুর্যের বন্দীদশা, টচারের দৃশ্য দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মিনিস্টার । তার স্ত্রী ঘটনার পর থেকে শয্যাসায়ী হয়ে যান । একজন ব্যক্তিগত চিকিৎসক ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। ঘুম ভাঙলেই তুর্যের মা এমনভাবে কান্নাকাটি করেন যে, ব্লাডপ্রেসার উঠে অবস্থা খারাপের দিকে চলে যায়।

    শুক্রবার সারাটা দিন শুধু এই ভাবনায় কাটিয়ে দিয়েছেন, ইউ-টিউবের ভিডিও আর ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের যে লোক ফোন করে, তার নাম্বারটা ট্র্যাক ডাউন করার চেষ্টা করবেন কিনা । অবশেষে যখন সিদ্ধান্ত নিলেন গোয়েন্দা সংস্থায় তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজনকে দিয়ে কাজটা করাবেন তখনই তার মোবাইলে একটা কল আসে।

    রঞ্জুর লোকটা জানায়, ইউটিউবের ভিডিও লিংক আর তার ফোন নাম্বারটা ট্রাক ড্রাউন করার বৃথা চেষ্টা যেনো তিনি না করে। যদিও করলে কোনো লাভ হবে না, তারপরও এ কাজটা করলে নিজের ছেলের হত্যাকাণ্ডের ভিডিও দেখতে পাবেন শীঘ্রই।

    মিনিস্টার যারপরনাই ভড়কে যান । রঞ্জুর দলের লোকজন টের পেয়ে গেলো কী করে, ভেবে পেলেন না তিনি।

    একটু পরই তুর্যের আরেকটি নতুন ভিডিও আপলোড করা হয় ইউ টিউবে । সেখানে দেখা যায় তুর্য ক্যামেরার দিকে চেয়ে বলছে, তার বাবা যেনো কিডন্যাপারদের দাবি তাড়াতাড়ি মেনে নেয় সে ব্যাপারে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবেদন জানায় ছেলেটা ।

    এরপরই মিনিস্টার মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েন । পিএস আলী আহমেদকে তিনি জানান, জেলে বন্দী ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে দেখা করবেন । আলী আহমেদ অবাক হয়েছিলো কথাটা শুনে, কিন্তু মিনিস্টার দৃঢ়প্রতীজ্ঞ ছিলেন এ ব্যাপারে।

    শুক্রবার রাত একটার পর পাতাকাবিহীন একটি পাজেরো জিপ প্রবেশ করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। জিপে হোমমিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ আর তার পিএস ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না । মিনিস্টারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত গাড়ি দুটো জেলখানার বাইরে অপেক্ষায় থাকে ।

    জেলারকে আগে থেকেই জানানো হয়েছিলো ব্যাপারটা । তবে তাকেও পুরো ঘটনা খুলে বলা হয় নি। শুধু বলা হয়েছিলো ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে মিনিস্টারের একটি কনফিডেন্সিয়াল মিটিংয়ের আয়োজন করতে হবে তার রুমে। তিনি যেনো অত্যন্ত গোপনে এটার ব্যবস্থা করেন।

    জেলার খুব অবাক হলেও কোনো প্রশ্ন করেন নি। মিনিস্টারের আদেশমতো সব ব্যবস্থা করে রাখেন ভদ্রলোক।

    *

    রাত ১টা দশ মিনিটে জেলারের রুমে বসে আছেন হোমমিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ। তার পাশে পিএস আলী আহমেদ। আর কেউ নেই ঘরে। এমনকি জেলার নিজেও এই মিটিংয়ে থাকতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো আগে থেকে।

    রাত সোয়া একটার দিকে জেলখানার এক রক্ষী হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে ঘরে প্রবেশ করে। সেই হুইলচেয়ারে বসা কুখ্যাত সন্ত্রাসী বহু খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্ল্যাক রঞ্জু।

    কুৎসিত একটা মুখ। কালো কুচকুচে । চোখ দুটো লাল। ঠোঁট দুটোতে লালসা আর ভোগের অসীম আকাঙ্খ বহন করছে। মুখে যে বাঁকা হাসিটা ঝুলে আছে সেটা আরো বেশি কুৎসিত, তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে ওঠে সারা মুখে লেগে থাকা বন্যহিংস্রতা।

    মিনিস্টার বসে আছেন জেলারের অফিসরুমের সোফায় । হুইলচেয়ারটা ঘরের মাঝখানে রেখেই রক্ষী লোকটা চুপচাপ চলে গেলো ।

    রঞ্জুর মুখে হাসির ঝিলিক।

    “আহ…আপনাকে অবশ্য আশা করি নি!” বললো ব্ল্যাক রঞ্জু । “রাতবিরাতে হোমমিনিস্টার একজন বন্দীর কাছে ছুটে এসেছেন! ঐতিহাসিক ঘটনা!”

    মিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ চোখ কুচকে চেয়ে রইলেন রঞ্জুর দিকে। রাগে ঘৃণায় তার মুখ বিকৃত হয়ে আছে ।

    “ইউ সন অব অ্যা বিচ!” মিনিস্টার দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলেন ।

    “আহ, কৃত্রিম অতনাদ করে উঠলো রঞ্জু। “আলোচনা করতে এসে গালাগালি করতে নেই, মিনিস্টার সাহেব…” একটু থেমে আবার বললো, “আপনি একজন পলিটিশিয়ান। পলিটিক্স হলো আর্ট অব কপ্রোমাইজ, এটা আপনি আমার চেয়েও ভালো জানেন । কম্প্রোমাইজ করতে এসে গালাগালি করাটা কি ঠিক হচ্ছে?”

    পিএস আলী আহমেদ মিনিস্টারের হাতে হাত রেখে তাকে শান্ত থাকার ইশারা করলো।

    “পিএস সাহেব নাকি?” আলী আহমেদের দিকে চেয়ে বললো রঞ্জু ।

    তার এ কথার কোনো জবাব দিলো না পিএস।

    “তুমি কি চাও?” সরাসরি বললেন হোমমিনিস্টার।

    চারপাশে তাকালো রঞ্জু। “আমি কখনও এতোদিন জেলে থাকি নি। কী একটা জেলখানারে বাবা, জাহান্নামও এর চেয়ে ভালো। দশ বছর আগে যখন এক মাসের জন্য ঢুকেছিলাম তখনও একই অবস্থা ছিলো। কোনো পরিবর্তন নেই।”

    “তুমি কি চাও?” কথাটা পুণরাবৃত্তি করলেন মাহমুদ খুরশিদ। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তিনি।

    “আহা, অধৈর্য হচ্ছেন কেন?” আশেপাশে তাকালো আবার । “কেউ তো নেই। একটু মন খুলে কথা বলি, মিনিস্টার সাহেব…” জিভ কেটে আবার বললো সে, “যা, মাননীয়’ শব্দটা ব্যবহার করতে ভুলে গেছি! আসলে অভ্যেস নেই…”

    “তোমার সাথে আমি এখানে গল্প করতে আসি নি…তুমি কি চাও সেটা বলো।”

    মাথাটা একদিকে কাত করলো রঞ্জু। “আমার লোক কি আপনাকে বলে নি আমি কি চাই?”

    “বলেছে, কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়,” মিনিস্টার বললেন।

    “কেন সম্ভব নয়, মাননীয় মিনিস্টার?” টেনে টেনে বললো কথাটা।

    “তোমার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটি খুনের…একশোটার উপরে চাঁদাবাজির…এছাড়াও আরো কতো মামলা আছে তার কোনো সঠিক হিসেব নেই। তুমি হাতেনাতে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছো। তোমার বিরুদ্ধে এতো সাক্ষি আর এভিডেন্স রয়েছে যে, এই পৃথিবীর কেউ তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না । আমি কেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তোমাকে বাঁচাতে পারবেন না । তুমি নির্ঘাত ফাঁসিতে ঝুলবে। আর আমার মনে হয় না এ দেশের কোনো রাষ্ট্রপতি তোমাকে জীবন ভিক্ষা দেবে…” এক দমে কথাগুলো বলে গেলেন মাহমুদ খুরশিদ।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো রঞ্জু। “ঠিক বলেছেন। আমার আইনজীবি, ঐ ব্যারিস্টার গর্দভটাও আমাকে এসব কথা বলেছে। খুবই চিন্তার বিষয়।” চিন্তিত হবার ভান করলো সে। “আমাকে কেউই বাঁচাতে পারবে না। এটা নাকি অসম্ভব একটি ব্যাপার। কিন্তু অসম্ভব কথাটা তো বোকাদের ডিকশনারিতে থাকে,” হা হা করে হেসে উঠলো রঞ্জু। “ভাববেন না এসব জ্ঞানগর্ভ কথা আমার নিজের…জ্ঞানীদের কোটেশন ব্যবহার করলাম একটু।”

    পিএস আর মিনিস্টার একে অন্যের দিকে তাকালো। তারা অপেক্ষা করলো এরপর রঞ্জু কী বলে শোনার জন্য ।

    “ব্যাপারটা যেনো সম্ভব হয় সেজন্যেই আমি আপনাকে বেছে নিয়েছি। আমি জানি এই কাজটা আপনি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না।”

    “অসম্ভব!” তেতে উঠলেন মিনিস্টার। “আমি কী করে পারবো?” পিএসের দিকে তাকালেন তিনি। “আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। আইনী প্রক্রিয়ার বাইরে আমি তোমাকে জেল থেকে বের করতে পারবো না। আমার অনেক ক্ষমতা আছে মানি…কিন্তু তাই বলে ইচ্ছে করলে যাকে খুশি তাকে জেল থেকে বের করে দেবো সেই ক্ষমতা আমার নেই। অন্তত, তোমার মতো কাউকে জেলে থেকে বের করে দেবার ক্ষমতা আমি রাখি না।”

    “আহ, আমার মতো কাউকে?” নিঃশব্দে হেসে ফেললো রঞ্জু। মিনিস্টার আর পিএস এক অন্যের দিকে তাকালো ।

    “কিন্তু আমার মতো একজনকে আপনি বের করেছেন, মাননীয় হোমমিনিস্টার…”

    ভুরু কুচকে চেয়ে রইলেন মাহমুদ খুরশিদ, কিছু বলতে পারলেন না ।

    “এরকম কাজ শুধু আপনিই করতে পারবেন, একটু থেমে আবার বললো সে, “এবং সেটা আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই…আপনি আমাকে জামিনের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।”

    “জামিন?” বিস্ময়ে চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো মিনিস্টারের । “তোমাকে কোন্ আদালত জামিন দেবে? কেউ দেবে না। আইনী প্রক্রিয়ায় তোমাকে বের করার কোনো সুযোগই নেই। আর বেআইনীভাবে যদি বের করার চেষ্টা করি তাহলে সে কাজে সফল তো হবেই না, মাঝখান থেকে আমার মন্ত্রীত্বটাও যাবে।”

    “না না, মিনিস্টার সাহেব…আপনি এখনও না বোঝার ভান করছেন। একটা উপায় আছে,” বেশ জোর দিয়ে বললো রঞ্জু।

    রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালেন মাহমুদ খুরশিদ। “কোনো উপায় নেই । নো চান্স । অনেক ভেবে দেখেছি…এটা আমি কোনোভাবেই করতে পারবো না ।”

    “আপনিই পারবেন,” মিটিমিটি হেসে বললো হুইলচেয়ারে বসা লোকটি।

    “আমি পারবো?” রেগেমেগে বললেন মিনিস্টার। “কিভাবে? কিভাবে তোমার মতো জঘন্য সন্ত্রাসীকে আমি জেল থেকে বের করবো?”

    মাথা দোলালো প্যারালাইজড সন্ত্রাসী। হুইলচেয়ারের চাকা ঠেলে একটু সামনে চলে এলো। সরাসরি তাকালো মিনিস্টারের চোখের দিকে।

    “ঠিক যেভাবে কয়েক মাস আগে ঐ বাস্টার্ডকে জেল থেকে বের করেছেন…”

    ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন মিনিস্টার । এই বাস্টার্ডটা এ খবর জানলো কী করে?

    “ভাবছেন আমি কী করে জানলাম?” যেনো মিনিস্টারের মনের কথা পড়ে ফেলেছে সে, মিটি মিটি হাসলো ব্ল্যাক রঞ্জু।

    মিনিস্টার স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন কেবল ।

    “আপনার এই জেলখানাটা খুবই অদ্ভুত জায়গা। এখানে সবই পাওয়া যায় । সবই জানা যায়। শুধু টাকা খরচ করতে হয়। একটু থেমে আবার বললো রঞ্জু, “কিভাবে কি জানলাম সেই লম্বা ইতিহাস বলে সময় নষ্ট করবো না।”

    মিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।

    “শুধু জেনে রাখেন, আমি জানি ঐ বাস্টার্ডকে কিভাবে জেল থেকে বের করেছেন। ওকে যেভাবে বের করেছেন আমাকেও সেভাবে বের করুন । এজন্যে আপনাকে খুব বেশি সময় আমি দিতে পারবো না । হয় আমাকে ভালো ট্রিটমেন্ট নিয়ে সুস্থ হতে হবে নয়তো আপনি একটু আগে যা বললেন তাই হবে-ফার্সির দড়িতে লটকে যাবো। কিন্তু মাঝখান থেকে আপনার ছেলেটা…” নিঃশব্দ হাসি দিলো সে । কুৎসিত আর হিংস্র এক হাসি ।

    মিনিস্টার তার পিএসের দিকে তাকালেন।

    “আমার হারানোর কিছু নেই, মাননীয় মিনিস্টার । এরকম পঙ্গু জীবন বয়ে বেড়ানোর চেয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে যাওয়াই ভালো। সুতরাং আমাকে কোনো রকম ভয় দেখাবেন না। ভাববেন না আমি আপনার জেলে আছি, আপনার মুঠোর মধ্যে আছি। মনে রাখবেন, আপনার ছেলেকে শেষ করে দিলেও আমি একবারই ফাঁসিতে ঝুলবো…” কথাটা বলে মিনিস্টারের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলো সে।

    চোখ বন্ধ করে ফেললেন হোমমিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ।

    “কিন্তু আপনার ছেলেটা বেঁচে যেতে পারে…আমিও বেঁচে যেতে পারি । সবটাই এখন নির্ভর করছে আপনার উপর।”

    মাহমুদ খুরশিদ ভেবে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছেন, এই হারামিটা বাস্টার্ডের মুক্তির ব্যাপারে বিস্তারিত সবই জানে। কিভাবে জানলো কে জানে।

    এটা ঠিক যে, বাস্টার্ডকে আইনের ফাঁক গলিয়ে বের করার কাজে এককভাবে তার ভূমিকাই ছিলো বেশি। বাস্টার্ডের পরিচয়টাই তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন। এই আইডিয়াটা দিয়েছিলো তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পরামর্শদাতা অমূল্য বাবু। কিন্তু সেটার পেছনে শক্ত কারণও ছিলো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলো তারই জেলেবন্দী স্বামী, আর সেই মিশনটা পুরো বিগড়ে দিয়েছিলো বাস্টার্ড নামের পেশাদার এক খুনি। তিনি নিজেই তো এর ব্যবস্থা করেছিলেন অমূল্য বাবুর সাহায্যে। নির্বাচনে জেতার পর সরকার গঠন করলে বাস্টার্ডকে জেল থেকে বের করার জন্য অমূল্য বাবু প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। তিনি নিজে হোমমিনিস্টার হবার দরুণ কাজটা খুব সহজেই করা সম্ভব হয়েছিলো। কিন্তু এই হারামিটা তো সেই লোক, যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনের প্রাক্কালে খুন করার মিশনে নেমেছিলো। বাস্টার্ডকে ছেড়ে দেয়া আর তাকে ছেড়ে দেয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

    “আহত হয়ে ধরা পড়ার পর আমার জীবনের আর কোনো আশা ছিলো,” বলতে লাগলো ব্ল্যাক রঞ্জু, “আমার আইনজীবি সব খুলে বলেছিলো আমাকে। স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে আমি পঙ্গু হয়ে গেছি। ভালো চিকিৎসা করাতে পারলে সেরে উঠবো…ডাক্তারও সেরকম কথাই বলেছে, কিন্তু তার জন্য সবার আগে আমাকে জেলখানা থেকে বের হতে হবে। ভালো করেই জানতাম আর কোনোদিন জেলের বাইরে বেরোতে পারবো না। কিন্তু সুযোগটা এনে দিলেন আপনি।”

    রঙুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন মিনিস্টার ।

    “হ্যাঁ, আপনি।” কথাটা বলে হুইলচেয়ারটা নিয়ে একটু দূরে চলে গেলো। “অনেকগুলো খুনের মামলা থাকার পরও ঐ বাস্টার্ডকে বের করে দিলেন। কিন্তু কিভাবে?” আবারো কুৎসিত হাসি। “অসাধারণ আপনাদের আইডিয়া । প্রথম যখন শুনলাম খুব খারাপ লেগেছিল। ঐ বানচোতটা আমার অনেক ঘনিষ্ঠ লোকজনকে হত্যা করেছে। আর কেউ আমার এতো বড় ক্ষতি করতে পারে নি। সেই খুনি এভাবে বের হয়ে গেলো!”

    মিনিস্টার কপালে হাত রেখে মাথা নীচু করে ফেললেন। এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না তার।

    “তারপরই বুঝতে পারলাম, আমারও আশা আছে। এই জঘন্য জেলখানা থেকে বের হওয়া সম্ভব। ঠিক যেভাবে ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা বের হয়েছে আমিও সেভাবে বের হতে পারি। কিন্তু আমার প্রতি তো আপনাদের সুনজর দেবার কোনো কারণ নেই। তাই ঠিক করলাম, আপনাদেরকে একটু বাধ্য করি।” হা হা করে হেসে উঠলো রঞ্জু।

    মিনিস্টার উঠে দাঁড়ালে তার পিএসও উঠে দাঁড়ালো ।

    “চলে যাচ্ছেন?” মিটিমিটি হেসে জানতে চাইলো রঞ্জু। “আমার দাবিগুলো তো এখনও সব বলি নি…”

    “তোমার যা বলার ওকে বলো,” কথাটা বলেই পিএসকে থাকার জন্য ইশারা করে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

    পেছন থেকে শুনতে পেলেন রঞ্জু চিৎকার করে বলছে, “মনে রাখবেন, আমার হারানোর কিছু নেই…কিন্তু আপনার আছে!”

    অধ্যায় ৫৮

    মাত্র পনেরো মিনিটের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো, বহু আগেই সেই পনেরো মিনিট শেষ হয়ে গেছে । এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এখানে বসে আছে তারা।

    সব শোনার পর জেফরি বেগ আর ফারুক আহমেদ চুপ মেরে রইলো কিছুক্ষণ।

    “আর তাই তার দাবিমতো কাজ করলেন আপনি?” অবশেষে নীরবতা ভাঙলো জেফরি।

    মুখ তুলে তাকালেন মাহমুদ খুরশিদ, তবে কিছু বললেন না।

    “একজন হোমমিনিস্টার হিসেবে আপনি এরকম একটা কাজ কিভাবে করলেন, স্যার?”

    জেফরির দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন মিনিস্টার ।

    “একটা পঙ্গু সন্ত্রাসীর ভয়ে এভাবে চুপসে গেলেন? আপনার এতো ক্ষমতা, এতো প্রতিপত্তি…সব ঠুনকো হয়ে গেলো?”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিনিস্টার। “ওই বদমাশটা পঙ্গু হয়ে জেলে পচে মরছে, ওর তো হারাবার কিছু নেই। কিছুদিনের মধ্যেই ওর ফাঁসি হয়ে যেতো। কিন্তু আমার হারাবার অনেক কিছু আছে, মি: বেগ!”

    দু’পাশে মাথা দোলালো জেফরি । একমত হতে পারলো না সে।

    “আপনি বিয়ে করেছেন? সন্তান-সন্ততি আছে?” বেশ শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলেন মিনিস্টার।

    “না, স্যার।”

    “তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন না । উনারা বুঝতে পারবেন, হোমিসাইডের মহাপরিচালক আর পিএসের ইঙ্গিত করে বললেন। “একজন বাবা হিসেবে এছাড়া আর কিছু করার ছিলো না।”

    “কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবার সময় কী বলেছিলেন, স্যার? ভয়-ভীতি কিংবা রাগ অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে…”

    চোখ বন্ধ করে ফেললেন মাহমুদ খুরশিদ। “সেটা আমি ভালো করেই। জানি, মি: বেগ ।”

    “জানেন কিন্তু মানেন না।”

    জেফরির এ কথায় মিনিস্টার দু’পাশে মাথা দোলালেন ।

    “একজন মিনিস্টার হয়ে, জনগণের নেতা হয়ে, তাদের জানমালের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে আপনি এরকম কাজ করতে পারেন না। পিতৃ-মাতৃত্ব এসবের দোহাই দিয়ে আপনি রঞ্জুর মতো জঘন্য এক খুনি-সন্ত্রাসীকে ছেড়ে দিতে পারেন না, স্যার । লোকটা কত মানুষ খুন করেছে, সেটা ভালো করেই জানেন। আপনি এতোটা অসহায় নন যতোটা বোঝাতে চাচ্ছেন। আপনি নিজেই যদি একজন সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি হয়ে যান তাহলে সাধারণ জনগণ কোথায় যাবে?”

    “বললাম তো, এছাড়া আমার কিছু করার ছিলো না।”

    মাথা দোললো জেফরি। ঘরের সবাই চুপ মেরে গেলে আবার । অনেকক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা বললো। এবার তার কণ্ঠ বেশ শান্ত আর ধীরস্থির।

    “অনেক কিছু করার ছিলো আপনার । রঞ্জুকে মুক্তি দিতে, ওর জামিনের ব্যবস্থা করতে কমপক্ষে এক সপ্তাহ লেগেছে, এই এক সপ্তাহের মধ্যে তুর্যকে খুব সহজেই উদ্ধার করা যেতো । আপনার নিজের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই এটা করতে পারতো। কিন্তু আপনার বোধহয় নিজের বাহিনীর উপরেই আস্থা নেই।”

    মিনিস্টার কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকালেন জেফরির দিকে। বহু কষ্টে রাগ দমন করে বললেন, “আমি প্রথমে তাই করতে চেয়েছিলাম কিন্তু…

    “কিন্তু কি, স্যার?”

    “রঙুর লোকজন কিভাবে যেনো টের পেয়ে গেলো। আমাকে ফোন করে হুমকি দিলো…মানে তুর্যকে মেরে ফেলার হুমকি।”

    “এটা কি করে সম্ভব?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো জেফরি বেগ।

    “আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমার কাছে মনে হচ্ছে রঞ্জুর দলের লোকজন যেনো আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা যেনো সব দেখছে ।”

    মিনিস্টারের এ কথা শুনে জেফরি নিজেও অবাক হলো। “আপনি কি পুরো বাড়িটা সার্চ করিয়েছেন?…মানে আড়িপাতার কোনো ডিভাইস প্লান্ট করা নেই তো?”

    মাথা দোলালেন মিনিস্টার। পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা হয়েছে, সেরকম কিছু পাওয়া যায় নি।”

    একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলো জেফরি বেগ, “রঞ্জুর দলের কে ফোন করে যোগাযোগ করে, স্যার?”

    মিনিস্টারের হয়ে জবাব দিলো তার পিএস। “তা তো বলতে পারবো না । একেক সময় একেক নাম্বার থেকে কল করে। আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি না…তারাই আমাদের সাথে যোগাযোগ করে।”

    “সব সময় কি একজনই ফোন করে?”

    আলী আহমেদ একটু ভাবলো । “মনে হয় একজনই, তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।”

    কয়েক মুহূর্ত ভেবে গেলো জেফরি বেগ, তারপর জানতে চাইলো, “স্যার…ব্ল্যাক রঞ্জুকে তো ছেড়ে দিলেন…আপনার ছেলেকে তারা মুক্তি দিচ্ছে না কেন?”

    মিনিস্টার আর তার পিএস চেয়ে রইলো তার দিকে। সাহায্যের আশায় আলী আহমেদের দিকে তাকালেন মাহমুদ খুরশিদ।

    “ওরা তুর্যকে আগামীকাল ছেড়ে দেবে…” আলী আহমেদ বললো।

    “আগামীকাল কেন?” নড়েচড়ে উঠলো জেফরি ।

    পিএস এবং মিনিস্টার দু’জনেই বুঝতে পারছে না কিভাবে কথাটা বলবে।

    “আপনি তো রঞ্জুর দাবি মিটিয়েছেন, গতকালই ওকে ছেড়ে দিয়েছেন…তাহলে ওরা কেন তুর্যকে আগামীকাল মুক্তি দেবে?”

    মিনিস্টার আর পিএসকে চুপ থাকতে দেখে জেফরি অস্থির হয়ে উঠলো । “প্লিজ, স্যার…আমাকে সব খুলে বলুন। আর কিছু লুকাবেন না। এতে আপনাদেরই ক্ষতি হবে। তুর্যেরও ক্ষতি হয়ে যাবে…”

    কথাটা শুনে মিনিস্টার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।

    “প্লিজ, স্যার?”

    “রঞ্জুর আরেকটা দাবি আছে,” পিএস শান্তকণ্ঠে বললো।

    “আরেকটা দাবি? সেটা কি?” অস্বস্তিতে পড়ে গেলো মিনিস্টার আর পিএস।

    “প্লিজ, বলুন, ব্ল্যাক রঞ্জুর আরেকটা দাবি কি ছিলো?”

    অবশেষে মুখ খুললেন মিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ। “ঐ বাস্টার্ডকে তুলে দিতে হবে তার হাতে।

    “কি?”

    জেফরি বেগ যেনো আকাশ থেকে পড়লো। এসব কী শুনতে পাচ্ছে সে । বাস্টার্ড! এসবের মধ্যে বাস্টার্ডও আছে! পরক্ষণেই বুঝতে পারলো, কেন থাকবে না! জেল থেকে বেরিয়ে রঞ্জু যদি একজন ব্যক্তিকে খুন করতে চায় তাহলে সেটা অবশ্যই বাস্টার্ড ।

    “কিন্তু সে তো দেশেই নেই। আপনারাই তাকে জামিনে মুক্ত করে বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। এখন রঞ্জুর হাতে তাকে কিভাবে তুলে দেবেন?” মিনিস্টার চুপ করে থাকলে জেফরি তাড়া দিলো । “আপনি চুপ করে থাকবেন না, প্লিজ?”

    “বাস্টার্ড কোথায় থাকে সেটা আমি জানি,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মিনিস্টার ।

    “আপনি সেটা জানেন?” জেফরির যেনো বিস্মিত হবার কোনো শেষ নেই। “তার মানে আপনারাই ওকে বিদেশের মাটিতে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখেছেন?”

    মিনিস্টার কিছু বললেন না ।

    “এখন আবার তাকে তুলে দিয়েছেন রঞ্জুর হাতে?”

    বিব্রত হয়ে পিএসের দিকে তাকালেন মাহমুদ খুরশিদ।

    “তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে রঞ্জু ওকে কিভাবে…?” কথাটা শেষ করার আগেই জেফরি বেগ বুঝে গেলো। “রঞ্জু এখন কোথায়? ও কি দেশে আছে নাকি বিদেশে চলে গেছে?”

    “আগামীকাল সকালে বিদেশ চলে যাবে…চিকিৎসার জন্য,” আস্তে করে বললো পিএস।

    “মাইগড!” বিস্ময়ে বলে উঠলো সে।

    পিএস তাকালো মিনিস্টারের দিকে।

    “সেটা বলা যাবে না,” মাহমুদ খুরশিদ বললেন। “অন্তত তুর্য রিলিজ পাওয়ার আগে তো নয়ই…”

    “আশ্চর্য!” জেফরি বেগ রাগেক্ষোভে ফুঁসতে লাগলো। “রঞ্জু বিদেশ চলে যাচ্ছে?” মাথা দোলালো দু’পাশে। “আপনি এটা কি করেছেন, স্যার? ও যদি একবার বিদেশ চলে যায় তাহলে তার নাগাল পাবেন?”

    ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন মিনিস্টার।

    “তুর্যকে যদি মুক্তি না দেয় তখন কী করবেন?”

    “তুর্য কিংবা মিনিস্টারের উপর তো ওর কোনো আক্রোশ নেই,” বললো পিএস। “রঙুর শেষ শর্তটা ছিলো বাস্টার্ড নামের খুনিটাকে ওর হাতে তুলে দেয়া। মানে ওর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয়া।”

    “আপনারা তো সেটা করেছেন, তাহলে ওরা তুর্যকে রিলিজ দিচ্ছে না কেন?”

    “আগামীকাল রঞ্জু বিদেশ চলে যাবে…বাস্টার্ডের ব্যাপারে আমরা যে তথ্যটা দিয়েছি সেটা সঠিক কিনা নিশ্চিত হবার পরই তুর্যকে ছেড়ে দেয়া হবে।”

    মাথা দোলাতে লাগলো জেফরি বেগ । এরকম স্টুপিড লোকজন ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে আছে! এদের হাতে আমরা তুলে দিয়েছি কোটি কোটি মানুষের জানমালের নিরাপত্তা? এই গর্দভগুলোকে কতো সহজেই না রঞ্জুর মতো ক্রিমিনাল হাতের মুঠোয় নিয়ে যা খুশি তাই করিয়ে নিচ্ছে। এদের কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই?

    জেফরিকে চুপ থাকতে দেখে মিনিস্টার কথা বললেন : “আপনি কিভাবে এসব জানলেন আমি জানি না। এটা আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে । কিন্তু আমি চাইবো তুর্য ছাড়া পাওয়ার আগে আপনি এ ব্যাপারে আর কিছু করবেন না।”

    হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর চেয়ে রইলো মিনিস্টারের দিকে । “আজকের সকালের আগেও আমি আপনার ছেলের কিডন্যাপের ব্যাপারে কিছু জানতাম না, স্যার,” বললো সে। ফারুক আহমেদ মাথা নেড়ে সায় দিলো। “আমি সেন্ট অগাস্টিনের জুনিয়র ক্লার্ক হাসানের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছি…আপনিও সেটা ভালো করেই জানেন।”

    জেফরির শেষ কথাটা শুনে মিনিস্টার মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

    “আপনারা অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যালকে চাপ দিয়েছিলেন,” জেফরি বেগ এই কথাটা বললো পিএসের দিকে তাকিয়ে। “হাসানের ঘটনায় যেনো কোনোভাবেই তুর্যের নামটা চলে না আসে…”

    মিনিস্টার স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ইনভেস্টিগেটরের দিকে, তবে তিনি কিছু বলার আগেই জেফরি আবার বলতে শুরু করলো ।

    “…অবশ্যই সেটা ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের চাপে পড়েই। তারা হুমকি দিচ্ছিলো, তুর্যের ঘটনা যদি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে ছেলেটাকে মেরে ফেলা হবে।”

    মিনিস্টার উঠে দাঁড়ালে ফারুক আহমেদ আর জেফরি বেগও উঠে দাঁড়ালো। তারা লক্ষ্য করলো মিনিস্টারের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।

    “আমার প্রেসার বেড়ে গেছে মনে হয়। খুব খারাপ লাগছে। আমি উপরে চলে যাচ্ছি।” জেফরির দিকে তাকালেন তিনি। “আপনার মতো ইনভেস্টিগেটরের জন্য আমি গর্বিত, মি: বেগ । সবই তো জেনে গেছেন…আমার আর কিছু বলার নেই। শুধু একটা কথা বলবো…এ ব্যাপারে আর কিছু করবেন না। আমি চাই না তীরে এসে তরী ডুবুক। আপনি নিশ্চয় আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন?”

    “পুরোপুরি বুঝতে পারি নি, স্যার,” সরাসরি বললো জেফরি বেগ ।

    মিনিস্টার গোল গোল চোখে চেয়ে রইলেন। তার শ্বাসপ্রশ্বাস আরো দ্রুত হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

    “এটা কি আপনার অর্ডার নাকি অনুরোধ?”

    “আপনার যেটা খুশি ধরে নিন,” কথাটা বলেই পিএসের দিকে ফিরলেন তিনি। “তুমি উনাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিও।”

    দরজার কাছে থেমে ফিরে তাকালেন জেফরির দিকে।

    “আমি হয়তো মিনিস্টার হবার যোগ্যতাই রাখি না। হয়তো এরকম পদে আমার থাকা উচিত নয়…” তারপর মাথা নীচু করে ঘর থেকে চলে গেলেন তিনি।

    মিনিস্টার চলে যাবার পর জেফরি বেগ, ফারুক আহমেদ আর পিএস আলী আহমেদ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো।

    প্রথমে মুখ খুললো পিএস। “স্যারের অবস্থাটা তো বুঝতেই পারছেন। একমাত্র সন্তান। বিয়ের দশ বছর পর হয়েছে। তাছাড়া উনার স্ত্রীর অবস্থা খুবই খারাপ। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। ছেলেটাকে ফিরে না পেলে উনার যে কী হবে আল্লাহই জানে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগলো পিএস, “এতো ক্ষমতা থাকার পরও তিনি কতোটা অসহায় হয়ে পড়েছেন, ভাবুন একবার।”

    “আমি ভাবতেই পারি নি এরকম ঘটনা ঘটে গেছে,” বললো ফারুক আহমেদ। “আমি তো কিছুই জানতাম না। জেফরি আমাকে কিছু বলে নি।”

    “স্যার, সেজন্যে আমি সরি…” বললো জেফরি । “আসলে আমি নিজেও জানতাম না। ভেবেছিলাম অগাস্টিনের ক্লার্ক হাসানের খুনের সাথে তুর্য জড়িত। আমি সেদিকেই এগোচ্ছিলাম। আরো শক্ত প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এক পর্যায়ে নিশ্চিত হলে আপনাকে জানাবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু হঠাৎ করে রঞ্জুর জামিনের খবরটা শোনার পর সব কিছু পরিস্কার হয়ে ওঠে আমার কাছে।”

    একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ফারুক আহমেদের ভেতর থেকে। মনে হলো না এ কথায় পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পেরেছে।

    “আমি কি কিছু কথা বলতে পারি?” পিএস বললো জেফরিকে।

    “জি, বলুন।”

    “স্যারের শেষ কথাটা আপনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন?”

    মুচকি হাসলো জেফরি বেগ । “অবশ্যই বুঝতে পেরেছি।”

    “আশা করি আপনি এসব থেকে বিরত থাকবেন।”

    ফারুক আহমেদের দিকে তাকালো জেফরি । হোমিসাইডের মহাপরিচালক বিব্রত হলো। একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের কোনো তদন্তকারীকে এভাবে ডিকটেট করা অশোভন, বিশেষ করে সেটা যখন হোমমিনিস্টারের মতো কেউ করে ।

    “আমি তো এসবের মধ্যে নেই, মি: আহমেদ।

    জেফরির কথাটা শুনে পিএস চেয়ে রইলো তার দিকে।

    “প্রথম থেকেই আমি হাসানের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছি, তুর্যের কিডন্যাপ নিয়ে নয়। কিন্তু মার্ডার কেসটা তদন্ত করতে গিয়েই একে একে সব বেরিয়ে এসেছে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো আলী আহমেদ।

    “এখন আপনার মিনিস্টার আর আপনি কি আমাকে সেই তদন্ত কাজ থেকে বিরত থাকতে বলছেন?”

    জেফরির দিকে তাকিয়ে থাকলে পিএস।

    “যদি সেটা করে থাকেন, তাহলে আমি বলবো, দুঃখিত। আমার কাজ থেকে আমাকে কেউ বিরত রাখতে পারবে না। আপনারা যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু আমি আমার ডিগনিটি হারিয়ে চাকরি করবো না।”

    “ব্যাপারটা ডিগনিটির নয়, মি: বেগ,” আস্তে করে বললো পিএস। “ইটস অ্যা ম্যাটার অব লাইফ অব অ্যা চাইল্ড…”

    “অন্য কারোর সন্তান হলে কি আপনারা তার জন্যে এতোটা করতেন?” মাথা দোলালো সে। “করতেন না। আপনাদের কাছে নিজেদের জীবনের মূল্য যতোটুকু অন্যদের মূল্য তার একশ ভাগের এক ভাগও না।”

    পিএস মাথা নীচু করে ফেললো। যেনো জেফরির চোখে চোখ রাখতে পারছে না।

    “তাছাড়া যেভাবে আপনারা ব্ল্যাক রঞ্জুর দাবি দাওয়া মিটিয়েছেন তাতে করে মনে হয় না আপনাদের উদ্দেশ্য সফল হবে…”

    পিএস মুখ তুলে তাকালো জেফরির দিকে। “মানে?” ঘাবড়ে গিয়ে বললো পিএস। “আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?”

    “ভিডিওতে দেখা গেছে তুর্যের চোখ বাধা ছিলো না,” জেফরি বললো। “অথচ তার আশেপাশেই ছিলো কিডন্যাপাররা।”

    কথাটা শুনে কিছু বুঝতে পারলো না পিএস। |||||||||| “হ্যাঁ। কিন্তু…”

    “এর মানে বুঝতে পারেন নি?”

    মাথা দোলালো ভদ্রলোক।

    “তুর্য কিডন্যাপারদের চিনে ফেলেছে।”

    এখনও বুঝতে পারলো না পিএস।

    “এটা কিন্তু খুবই খারাপ কথা, মি: আহমেদ,” হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর গুরুগম্ভীর মুখে বললো।

    পিএস লোকটা ফারুক আহমেদ আর জেফরির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বার কয়েক। “কেন?”

    “কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি,” জেফরি বলতে শুরু করলো, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিডন্যাপাররা মুক্তিপন পাবার পরও জিম্মিকে হত্যা করে। এটাই আজকালকার ট্রেন্ড। তার কারণ, যাকে জিম্মি করা হয়েছে সে তাদের মুখ চিনে ফেলে । অনেক কিছু জেনে যায়। আমাদের মিনিস্টারের ছেলেও কিডন্যাপারদের অনেক কিছু জেনে গেছে, তাদের মুখ চিনে ফেলেছে…সুতরাং বুঝতেই পারছেন।”

    পিএসের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। ভয়ে ঢোঁক গিললো লোকটা।

    “বিগত পাঁচ বছরের একটা হিসেব আমার কাছে আছে,” ফারুক আহমেদ বললো। “শতকরা ৯০টি কিডন্যাপ কেসে মুক্তিপণ পাবার পরও জিম্মিকে হত্যা করা হয়েছে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ।

    “আপনারা মনে করছেন, তুর্যকে মুক্তি দেয়া হবে না?” পিএস উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো।

    “আমি একশ’ ভাগ নিশ্চিত, কিডন্যাপাররা তুর্যকে জীবিত অবস্থায় ফেরত দেবে না।” কথাটা বলতে জেফরির খুব খারাপ লাগলো কিন্তু না বলেও পারলো না।

    “কী বলছেন?” ভয়ে পিএসের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “হোমমিনিস্টারের ছেলেকে খুন করার মতো সাহস দেখাবে ওরা??”

    “তারা এখন পর্যন্ত যা করেছে তারপর আপনি এ কথা কি করে বলেন, মি: আহমেদ?”

    জেফরির কথাটা শুনে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো পিএস।

    “এখন অপেক্ষা করে দেখুন কী হয়।”

    ঘরের মধ্যে অসহ্য এক নীরবতা নেমে এলো। অনেকক্ষণ ধরে কেউ কথা বললো না।

    পিএস মাথা নীচু করে রাখলো বেশ দীর্ঘক্ষণ। তারপর মুখ তুলে তাকালো। প্রায় ম্রিয়মান কণ্ঠে জানতে চাইলো সে, “আপনি কি স্যারের অনুরোধটা রাখবেন না?”

    “আগেই বলেছি, আমি তুর্যের কেসটা নিয়ে কাজ করছি না। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের যে লোকটা তুর্যকে কিডন্যাপ করার আগে হাসানকে খুন করেছে, আমার সহকর্মী জামানকে গুলি করেছে…” একটু চুপ করে আবার বললো সে, “এমন কি আমাকেও গুলি করেছে…তার সম্পর্কে আমার কাছে যথেষ্ট তথ্য আছে, তার ছবিও আমরা তৈরি করেছি। আমার ধারনা ওকে ট্র্যাক-ডাউন করতে পারলেই জানা যাবে তুর্যকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু সে সময় আমি পাবো কিনা জানি না। তবে হাসানের কেসটা নিয়ে আমি থেমে থাকবো না। এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।”

    পিএস একটু ভেবে নিলো। “আপনি আমার ফোন নাম্বারটা রাখুন। যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে পারেন আমাকে জানাবেন। আমি আপনাকে সর্বোচ্চ সাহায্য করার চেষ্টা করবো। স্যারকে নিয়ে ভাববেন না । উনাকে আমি ম্যানেজ করবো।”

    পিএসের ফোন নাম্বারটা নিয়ে নিলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। “আগামীকাল তুর্যকে মুক্তি দিলো কি না দিলো সে খবরটা আমাকে জানালে খুব খুশি হবো,” বললো জেফরি বেগ ।

    “ঠিক আছে, আমি জানাবো।”

    জেফরি বেগ আর ফারুক আহমেদ হোমমিনিস্টারের বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেই পিএস আলী হোসেন তাদের পেছন পেছন চলে এলো বাড়ির সামনে খোলা লনের কাছে। চেয়ে দেখলো ড্রাইভওয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারা । ডান দিকে তাকিয়ে হাত তুলে একজনকে ইশারা করলো সে।

    লনের শেষমাথায় একটা বৈঠকখানার মতো আছে, সেটার বারান্দা থেকে নেমে এলো এক লোক।

    অধ্যায় ৫৯

    গাড়িতে বসে আছে জেফরি আর তার বস্ ফারুক আহমেদ । রাত প্রায় আটটা বাজে । হোমমিনিস্টারের বাড়ি থেকে ফিরছে তারা। পনেরো মিনিটের মিটিংটা দু’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলেছে।

    বিষণ্ণ দৃষ্টিতে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ফারুক আহমেদ।

    উদাস হয়ে ভাবতে লাগলো জেফরি বেগ। বাস্টার্ড কোথায় আছে সেটা মিনিস্টার জানে। এখন সেই তথ্যটা রঞ্জুর হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি। নিজের ছেলেকে বাঁচানোর জন্য এমন একজনকে বলি দিয়েছেন যার কারণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঁচে আছেন, নির্বাচনে জয় লাভ করে সরকার গঠন করেছেন, আর মাহমুদ খুরশিদের মতো দুর্বল চরিত্রের লোকেরা হোমমিনিস্টার হতে পেরেছেন।

    জেফরির মনে পড়ে গেলো বাংলায় একটা শব্দ আছে : কৃতঘ্ন । স্কুলের পাঠ্যবইয়ে তারা পড়েছিলো। এর অর্থ, উপকারীর ক্ষতি করে যে লোক। চমৎকার! বহুকাল আগে থেকেই হয়তো এই জনপদে এরকম লোকজনের দেখা মিলতো।

    কোথায় যেনো পড়েছিলো, রাজনীতিকদের বিশ্বাস করলে তুমি ঠকবে, কিন্তু তাদেরকে উপকার করলে তোমার জীবন বিপন্ন হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

    কথাটা একদম সত্যি।

    তার বস্ ফারুক আহমেদকে বাসায় ড্রপ করে তাকেও তার বাড়িতে নামিয়ে দেবে অফিসের এই গাড়িটা ।

    রাগেক্ষোভে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালো সে।

    হঠাৎ করেই তুর্য নামের বখে যাওয়া ছেলেটার জন্য খুব মায়া হলো তার। এমনকি বাস্টার্ড নামের খুনিটার জন্যেও তার মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হলো বলে একটু অবাকই হলো।

    সম্পূর্ন ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন ধরণের দুটো মানুষের জীবন আজ হুমকির মুখে। তাদেরকে রক্ষা করার মতো কোনো উপায়ই নেই।

    যদি এরকম কোনো উপায় থাকতো তাহলে কি জেফরি বেগ চেষ্টা করে দেখতো? এই দু’জনের জীবন বাঁচানোর জন্য সে কি কোনো পদক্ষেপ নিতো?

    জেফরি নিশ্চিত করেই জানে, অবশ্যই চেষ্টার কোনো ত্রুটি করতে না সে।

    “একটা সত্যি কথা বলবে?”

    ফারুক আহমেদের কথায় ফিরে তাকালো জেফরি বেগ । “বলুন, স্যার।”

    “শুধুই কি ব্ল্যাক রঞ্জুর জামিনে বেরিয়ে আসার খবরটা জানার পর তুমি এটা বুঝতে পেরেছো?…মানে, হোমমিনিস্টারের ছেলেকে ওরা কিডন্যাপ করেছে?”

    একটু চুপ করে থেকে বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর, “না, স্যার।”

    “তাহলে এটা কিভাবে জানলে?”

    “আমি ফোন ট্যাপ করেছিলাম,” আস্তে করে বললো সে।

    “কি!” যারপরনাই বিস্মিত হলো ফারুক আহমেদ। “তুমি হোমমিনিস্টারের ফোন ট্যাপ করেছো??”

    “না, স্যার।”

    “তাহলে?”

    “আমি সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিওর ফোন ট্যাপ করেছিলাম…”

    “ওই লোকের ফোন ট্যাপ করে তুমি এসব জেনেছো?”

    “উনার ফোনে হোমমিনিস্টারের বাড়ি থেকে ফোন করা হয়েছিলো । সেখান থেকে অনেক কিছু জানতে পারি।”

    “মিনিস্টার ফোন করেছিলেন ঐ প্রিন্সিপ্যালকে?” বিস্ময়ে জানতে চাইলো ফারুক আহমেদ।

    “প্রথমে তাই ভেবেছিলাম কিন্তু…”

    “কিন্তু কি?”

    “এখন আমি নিশ্চিত, ফোনকলটা আলী আহমেদ করেছিলেন । ভদ্রলোকের কণ্ঠ শুনে বুঝতে পেরেছি।”

    “তাহলে ঐ পিএসের ফোকল থেকে তুমি এটা বুঝতে পারলে?”

    “ঠিক তাও নয়। উনার সাথে প্রিন্সিপ্যালের কথাবার্তা থেকে জানতে পেরেছিলাম হাসানের হত্যাকাণ্ডে তুর্যের নামটা যেনো চলে না আসে। উনি প্রিন্সিপ্যালকে চাপ দিচ্ছিলেন।” জেফরি একটু থেমে তার বসের দিকে তাকালো। আমি আসলে তুর্যের অবস্থান জানার জন্য মিনিস্টারের ওয়াইফের ফোন ট্যাপ করার সিদ্ধান্ত নেই। সেখান থেকেই পুরো ব্যাপারটা জানি।”

    হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো ফারুক আহমেদ।

    “মিনিস্টারের ওয়াইফের ফোন ট্যাপ করাটা নিশ্চয় বেআইনী নয়?”

    “মাইগড! তুমি করেছো কি!” অস্ফুটস্বরে বললো হোমিসাইডের মহাপরিচালক।

    “ইনভেস্টিগেশন করতে গেলে কখনও কখনও একটু দুঃসাহসী হতে হয়, স্যার!” কথাটা বলেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো জেফরি বেগ।

    ফারুক আহমেদ তার প্রিয়পাত্রের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখটা সরিয়ে নিলো ।

    গড়িটা এখন পিজি হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালটি চোখে পড়তেই জেফরির মাথায় একটা ভাবনা খেলে গেলো।

    একটা নাম । তারপরই উঁকি দিলো একটা সম্ভাবনা।

    সঙ্গে সঙ্গে জেফরি সিদ্ধান্ত নিলো আগামীকাল সকালে অফিসে যাওয়ার আগে এই হাসপাতালে আসবে ।

    তুর্যকে বাঁচানোর একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। কিন্তু তার আগে ঐ পেশাদার খুনি বাবলু, অর্থাৎ বাস্টার্ডকে বাঁচাতে হবে ।

    তুর্যের বেঁচে থাকার যদি কোনো সম্ভাবনা থেকে থাকে তাহলে সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে বাস্টার্ডের উপর।

    একমাত্র বাস্টার্ডই পারে তুর্যকে বাঁচাতে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকনফেশন (বেগ-বাস্টার্ড ৪) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কনফেশন (বেগ-বাস্টার্ড ৪) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }