চণ্ডরব শৃগাল
এক বনে বাস করত এক শৃগাল। নাম তার চণ্ডরব। একদিন খিদের জ্বালায় তার মাথা ঘুরছিল। এদিক যায়, ওদিক যায়। কোথাও কিছু মিলছে না! তারপর একসময় ছুটতে ছুটতে চলে যায় শহরে। আর যায় কোথা? শহরের কুকুরগুলো ধেয়ে এল। কামড়ে কামড়ে তার দেহ দিল ছিঁড়েফুঁড়ে। খিদের জ্বালা ভুলে সে এখন প্রাণভয়ে পালাচ্ছে। পথে পড়ল এক ধোপাবাড়ি। ঢুকে পড়ল সেখানে। কিন্তু কুকুরগুলো যে পিছু ছাড়ছে না। তাড়াচ্ছে তো তাড়াচ্ছেই। আর চণ্ডরবও ছুটছে। পথের পাশে ছিল এক প্রকাণ্ড নীলের গামলা। পড়ল গিয়ে তার মধ্যে। সেখান থেকে যখন উঠে এল, তখন নিজেই নিজেকে আর চিনতে পারল না। তার সারা শরীর হয়ে গেছে নীলবর্ণ। কুকুরগুলোও আর তাকে চিনতে পারল না। তাই যে-যার মতো চলে গেল। চণ্ডরবও সুযোগ বুঝে বনে ফিরে গেল।
এদিকে বনের পশু বাঘ-ভাল্লুক, চিতা-নেকড়ে, মায় সিংহ পর্যন্ত, এই অদ্ভুত জন্তু দেখে ভয় পেল। সবাই দিক-বিদিক পালাতে লাগল। ওরা বলতে লাগল:
ধরন-ধারণ বংশ কিংবা মনের কথা গায়ের জোর।
জানি না যার সামনে তার পড়ার কি-বা প্রয়োজন।।
এই বলে সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। ধূর্ত চণ্ডরব মুহূর্তে ঘটনা আঁচ করতে পারল। বুঝল, তাকে চিনতে না পেরে সবাই ভয়ে পালাচ্ছে। তাই গলার স্বর পরিবর্তন করে সবাইকে ডেকে বলল: তোমরা পালাচ্ছ কেন? স্বয়ং ব্রহ্মা আমায় সৃষ্টি করে পাঠিয়ে দিলেন এই বনে। বললেন—‘এই বনে কোনো রাজা নেই। তুমি গিয়ে ওদের রক্ষা কর।’ তাই আজ থেকে তোমরা সবাই আমার প্রজা। আমার ছত্রছায়ায় তোমরা নিরাপদে থাকবে। তোমাদের সব দায়িত্ব আমার।
চণ্ডরবের কথা শুনে সবাই আশ্বস্ত হলো। তারা ফিরে এসে সেলাম দিয়ে তার চারদিকে ঘিরে দাঁড়াল। কয়েকজন তার জন্য একটি সিংহাসনও বানিয়ে ফেলল। চণ্ডরব সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে দিল। সিংহকে দিল মন্ত্রীর পদ। বাঘকে করল শয্যাপাল। চিতাকে দিল পানের দপ্তর। নেকড়েকে করল দ্বারপাল। কিন্তু তার যে স্বজাতি—শেয়ালের দল
তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত করল না। বরং গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। এভাবে চণ্ডরবের দিন মহাসুখেই কাটছিল। বাঘ-সিংহ পশু-পাখি মেরে তার কাছে নিয়ে আসে। সে সবাইকে ভাগ করে দেয়। এ ব্যবস্থায় সবাই খুশি। তাই তাকে সবাই খুব সমীহ করে।
একদিন চণ্ডরব পারিষদবর্গ নিয়ে সিংহাসনে বসে আছে। এমনি সময় দূরবনে শেয়াল ডেকে উঠল। আজন্ম অভ্যাসবশত সেও ‘হুক্কা হুয়া’ করে ডেকে উঠল। আর যায় কোথা! সবাই বুঝতে পারল, এ যে শেয়াল! তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বাঘ—সিংহ সবাই কিছুক্ষণ লজ্জায় মাথা নত করে রইল। তারপর সিংহ হুঙ্কার দিয়ে বলল: ধর ওকে! ও আমাদের ঠকিয়েছে!
অবস্থা বেগতিক দেখে চণ্ডরব পালাতে লাগল। কিন্তু যাবে কোথায়? চারদিক থেকে সবাই এসে তাকে ধরে ফেলল। কামড়ে-আঁচড়ে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে ফেলল। তাই বলছিলুম, মহারাজ! নিজের লোককে অবহেলা করা ভালো নয়।
দমনকের মুখে চণ্ডরবের কাহিনী শুনে পিঙ্গলক কিছুক্ষণ নীরব রইল। তারপর বলল : দমনক, সঞ্জীবক যে আমার অনিষ্ট করতে চায় তার প্রমাণ কি?
দমনক: প্রভু, সে প্রতিজ্ঞা করেছে কাল সকালে আপনাকে মারবে। এটা যদি তার মনের কথা হয় তাহলে তার লক্ষণ তার শরীরে দেখা যাবে। দেখবেন তার চোখ লাল। ঠোঁট কাঁপছে। নির্ধারিত আসনে না বসে সুবিধামতো জায়গায় বসেছে। আপনার দিকে ক্রূর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এসব দেখে যা ভালো মনে হয় করবেন।
এই বলে দমনক বিদায় নিল এবং অন্যপথে সঞ্জীবকের বাড়ি গেল। মুখ তার বিষণ্ণ। চোখেমুখে উদ্বেগের চিহ্ন। তাকে দেখেই সঞ্জীবক এগিয়ে এসে সোদ্বেগে বলল: কি হয়েছে, বন্ধু? তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? অনেক দিন এদিকে আস না! ব্যাপার কি, বলত? আমার বাড়িতে তুমি এসেছ—এ যে আমার কত সৌভাগ্য! কথায় বলে না:
পৃথিবীতে সে-ই ধন্য তারই হয় জয়।
যার বাড়িতে সজ্জনেরা আপনি হাজির হয়।।
দমনক গম্ভীর কণ্ঠে বলল: চাকর আবার সজ্জন হয় না-কি? তাও আবার রাজার চাকর! সর্বদা আতঙ্কে থাকতে হয়—কখন প্ৰাণটা যায়!
সঞ্জীবক: তুমি ত মন্ত্রী, চাকর নও। তবে?
দমনক: ওই হলো! রাজার কাছে সবাই সমান। দেখ— চাকরের কি দেহ-মন কোথাও স্বাধীনতা আছে? তার ইচ্ছায় কিছু হয়? মহাভারত বলেছে না রোগী, গরিব, মূর্খ, প্রবাসী আর সেবক এই পাঁচজন হচ্ছে জীয়ন্তে মরা! এরা কুকুরের চেয়েও অধম। কুকুর তবু স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। চাকর তাও পারে না। দেখ, মুনি আর চাকর উভয়ের মধ্যে বহু বিষয়ে মিল আছে মাটিতে শোওয়া, রোগা, ব্রহ্মচর্য, কম খাওয়া ইত্যাদি, কিন্তু অমিল হলো—প্রথমজন ধার্মিক আর দ্বিতীয়জন হতভাগা-পাপী। পেটের দায়ে চাকর শীত-গ্রীষ্ম আরো কত কি যে সহ্য করে, এর কণাভাগও যদি ধর্মের জন্য সইতো, তাহলে নিশ্চয় তার স্বর্গলাভ হতো।
এসব বলে দমনক বিষণ্ণ বদনে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। সঞ্জীবক কাছে এসে তার গায়ে হাত দিয়ে সাদরে বলল: বন্ধু, আর ভনিতা না করে বলো কি হয়েছে।
দমনক সঞ্জীবকের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল: বন্ধু, মন্ত্রী হয়ে রাজার মন্ত্রণা ফাঁস করি কি করে? তাতে যে রাজারও ক্ষতি আর আমারও নরক প্রাপ্তি হবে! কিছুক্ষণ নীরব থেকে দৃঢ়কণ্ঠে আবার বলল: তা হোক, আমি বলবই। কারণ তুমি আমারই কথায় বিশ্বাস করে রাজবাড়িতে ঢুকেছিলে। এখন সেই কারণে যদি তোমার প্রাণ যায়, তাহলে আমি যে মহাপাতকে নিমজ্জিত হব! এ কথা আমার নয়, স্বয়ং মনুর সঞ্জীবকের আর ধৈর্য থাকছে না। সে দমনককে ধাক্কা মেরে বলল: আসল কথাটা কি তুমি বলবে?
দমনক গম্ভীর কণ্ঠে বলল: তোমার সম্পর্কে পিঙ্গলকের মতলব ভালো নয়। সে বলল কাল সকালে তোমাকে হত্যা করে সবাইকে ভোজ দেবে! আমি বললাম, কি সাংঘাতিক কথা, মহারাজ! ব্রহ্মহত্যা করলে তার প্রায়শ্চিত্ত আছে, কিন্তু মিত্রদ্রোহ! শাস্ত্রেওতো এর বিধান নেই!
বিস্ময় আর উদ্বেগের সঙ্গে সঞ্জীবক বলল: তা সে কি বলল?
দমনক: সে বলল রাখ তোমার মিত্র! ও হচ্ছে ঘাসখেকো, আর আমরা মাংসখেকো! সম্পূর্ণ বিপরীত। ও আর আমরা হলাম পরস্পর জন্মশত্রু। শত্রুকে কখনও বুদ্দিমানেরা উপেক্ষা করে না। দেখ, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কন্যা দিয়ে হলেও শত্রুকে অর্থাৎ জামাইকে হত্যা করে। অন্য উপায় না থাকলে এমন হত্যায় দোষ নেই। তাছাড়া—
যুদ্ধে নেমে ক্ষত্রিয় কি বাছে কৃত্যাকৃত্য।
ঘুমের ঘোরে ধৃষ্টদ্যুম্ন মারল দ্রোণপুত্র।।
তাই সাম, দান, ভেদ, দণ্ড–যেকোন উপায়েই হোক ওকে মারতে হবে।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে দমনক আবার বলল: বন্ধু, এই সাংঘাতিক পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে আমি আর থাকতে পারলাম না। ছুটে এলাম তোমার কাছে। এখন তুমি যা ভালো মনে কর, কর। পিঙ্গলকের মতো এমন ভয়ঙ্কর রাজার কাছে আমার বোধ হয় থাকা হবে না!
দমনকের কথা শুনে সঞ্জীবকের মাথায় যেন বিনামেঘে বজ্রপাত হলো। সে বিশ্বাসই করতে পারল না যে, পিঙ্গলক তার সম্পর্কে এমন সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ক্রোধে তার চোখ দুটি জ্বলতে লাগল! ক্ষুব্ধকণ্ঠে সে বলল: কি ভুলই না আমি করেছি এর সঙ্গে ভাব করে! পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেছেন:
দুর্জনের হাতে পড়ে নারী
কৃপণের হাতে টাকা-কড়ি।
মরুতে মেঘ ঢালে জল
রাজার আপন কে হয় বল॥
ওর পাল্লায় পড়ে আমি শাস্ত্রের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম যে, সমান অর্থ আর বংশ হলে তবেই বন্ধুত্ব হয়, সবলে-দুর্বলে কখনও নয়। তাছাড়া স্বজাতির সঙ্গেই স্বজাতির বন্ধুত্ব হয়, বিজাতীয়ের সঙ্গে নয়। তাইতো হরিণের সঙ্গে হরিণের, গরুর সঙ্গে গরুর, ঘোড়ার সঙ্গে ঘোড়ার, মূর্খের সঙ্গে মূর্খের এবং সজ্জনের সঙ্গে সজ্জনেরই বন্ধুত্ব হয়। যাদের স্বভাব-চরিত্র আর নেশা এক—কেবল তাদের বন্ধুত্বই স্থায়ী হয়।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে সঞ্জীবক আবার বলল: এখন আমি গিয়ে তাকে প্রসন্ন করার চেষ্টা করলেও সে প্রসন্ন হবে না। কারণ যার রাগের কারণ থাকে, তাকে বুঝিয়ে শান্ত করা যায়, কিন্তু অকারণে যে রাগ করে তাকে শান্ত করার উপায় কি? দেখ ভাই, রাজা আর সমুদ্র উভয়ই সমান। এদের মতিগতি বোঝা ভার। তুমি জান দিয়ে রাজার উপকার করবে, অথচ কেউ তোমার বিরুদ্ধে লাগালে রাজা আগের কথা ভুলে যায়। তাই রাজার চাকরি করা খুবই কঠিন ব্যাপার! তাছাড়া, আমি একটা ব্যাপার বুঝেছি যে, রাজসভায় কেউ কেউ আমাকে সহ্য করতে পারছে না। সতীন যেমন সতীনের ওপর স্বামীর অতিরিক্ত ভালোবাসা সইতে পারে না, তেমনি আমার প্রতি রাজার অতিরিক্ত স্নেহও কেউ কেউ সহ্য করতে পারছে না। আবার এও সত্যি যে, গুণীরা কাছে থাকলে নির্গুণরা সমাদর পায় না, যেমন সূর্যোদয়ে প্রদীপ ম্লান হয়ে যায়। তাই নির্দোষ হয়েও আজ আমার এই দশা!
দমনক: ঠিক বলেছ, বন্ধু! আমারও তাই ধারণা। তা তুমি রাজাকে গিয়ে সব বল। দুর্জনরা যতই বলুক, তোমার সুবচনে নিশ্চয়ই সে প্রসন্ন হবে।
সঞ্জীবক: তোমার কথা ঠিক নয়। দুর্জনরা যতই ক্ষুদ্র হোক তাদের মধ্যে বাস করা যায় না। তারা যেকোন উপায়ে আমাকে মারবেই। দেখ—
দুর্জনেরা করে—যাহা ভাবে মনে মন
না পারিলে একা, করে মিলে বহুজন।
সরল প্রাণী উষ্ট্র—তাহার দোষ না-ই বা থাক
মারল তারে মিলে চিতা শেয়াল আর কাক।।
দমনক: কিভাবে?
সঞ্জীবক: বলছি, শোন…