উট শেয়াল চিতা কাক
এক বনে ছিল এক সিংহ। নাম মদোকট। তার অনুচরেরা হলো শেয়াল, চিতা আর কাক। একদিন বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তারা এক অদ্ভুত জন্তু দেখতে পেল। সিংহ বলল: বাঃ! এমন জন্তু তো কখনো দেখিনি। খোঁজ নাও তো ও কে? কোথা থেকেই বা এল।
কাক উড়ে গিয়ে সব জেনে এসে বলল: হুজুর, ও হচ্ছে উট। নাম ক্ৰথনক। বণিকদল থেকে ছিটকে পড়ে এখন পথভ্রষ্ট। তবে খুব শান্ত। আপনি চাইলে ভোজে লাগানো যায়।
সিংহ ধমক দিয়ে বলল: খবরদার! ও এখন আমাদের অতিথি। যেভাবেই হোক আমাদের বাড়িতে এসে পড়েছে। তাই ওকে বধ করা অন্যায়। শাস্ত্র বলছে না—শত্রুও যদি নির্ভয়ে বাড়িতে আসে তাহলে তাকে হত্যা করলে শত ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ হয়। তাই ওকে অভয় দিয়ে আমার কাছে নিয়ে এস।
সিংহের কথামতো সবাই মিলে এথনককে নিয়ে এল। সেও সিংহকে প্রণাম করে বসল। তারপর সিংহ জানতে চাইলে সে সব ঘটনা খুলে বলল। বণিকদলের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছিল। কিভাবে সে ছিটকে পড়ল। ইত্যাদি। সব শুনে সিংহের মায়া হলো। সে বলল: আজ থেকে তুমি আমাদের বন্ধু। তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি নির্ভয়ে এই বনে চরবে, আর পান্নার মতো কচি ঘাস খাবে। কি হবে গ্রামে গিয়ে আবার ভার বয়ে?
ক্রথনক রাজি হয়ে গেল। সেই থেকে তাদের সঙ্গে থাকে, খায়। এভাবে ছাড়াঘাস খেয়ে অল্পদিনের মধ্যেই সে নাদুস-নুদুস হয়ে ওঠে।
একদিন এক প্রকাণ্ড বুনো হাতির সঙ্গে মদোৎকটের লড়াই বাঁধে। হাতির মুষলের মতো দাঁতের আঘাতে মদোৎকটের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। প্রাণটা কোনোরকমে বেঁচে যায়। কিন্তু শিকার ধরার ক্ষমতা আর থাকে না। তাই সবাই এক প্রকার উপোস করে দিন কাটাতে থাকে। শেষে একদিন মদোৎকট বলল: আমার সঙ্গে-সঙ্গে তোরাও যে না খেয়ে মরতে বসেছিস। যা-না, একটা জানোয়ার-টানোয়ার ধরে নিয়ে আয়। ওটাকে মেরে তোদের খাওয়ার ব্যবস্থা করি।
সিংহের কথায় সবাই বেরিয়ে পড়ে শিকারের সন্ধানে। কিন্তু কোথাও কিছু পায় না। তখন শেয়াল বলে: দেখ, অযথা ঘুরে লাভ কি? শিকার তো আমাদের সঙ্গেই আছে।
কাক বলল: কে?
শেয়াল: কেন, ক্ৰথনক।
চিতা: কিন্তু সে তো হুজুরের প্রিয়ভাজন। তার গায়ে হাত তুলবে কে?
শেয়াল: আরে, সে ব্যবস্থা আমি করছি।
কাক ও চিতা: তবে তাই হোক।
এরপর শেয়াল গেল সিংহের কাছে। বলল: মহারাজ, বনে কিছুই পাওয়া গেল না। এদিকে খিদেয় যে সবার প্রাণ যায়। আপনারও তো পথ্য দরকার। তাই বলছিলুম, আজকের ভোজটা ক্ৰথনককে দিয়ে হয় না?
মদোকট গর্জে উঠল। রক্তচক্ষু হয়ে বলল: ধিক পাপিষ্ঠ! আর একবার একথা বললে তোকেই মেরে ফেলব। বলেছি না, কাউকে অভয় দিয়ে তাকে আর মারা যায় না। শাস্ত্রে আছে না:
অন্নদান গোদান কিংবা ভূদান।
সবার সেরা দান হলো অভয়দান।।
কিন্তু ধূর্ত শেয়াল দমবার পাত্র নয়। সে জোড়হাতে বলল: হুজুর, মানলুম আপনার কথা। কিন্তু কেউ যদি হুজুরকে ভক্তি করে স্বেচ্ছায় আত্মদান করে, তাহলে তো দোষ নেই। তাই ও যদি নিজে থেকে ওকে মারতে বলে, তাহলে আর ওকে মারতে পাপ কেথায়? তাছাড়া আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু আপনাকে তো বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আপনার কিছু হলে আমরা যাব কোথায়? কথায় বলে না—বংশের যিনি প্রধান, তাঁকে যে-করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে হবে, কারণ তিনি গেলে তো সবই গেল। দেখুন, ঢাকার নাভিটি (কেন্দ্র) ভাঙলে শলাগুলি কি আর ভার বইতে পারে?
শেয়ালের যুক্তির কাছে এবার মদোৎকট হেরে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল: তা তোরা যা ভালো বুঝিস কর! আমি আর কি বলব।
প্রভুর সম্মতি পেয়ে ধূর্ত শেয়াল এক শ্বাসে ছুটে গেল কাক আর চিতার কাছে। বলল: অনেক কষ্টে প্রভুর মন পেয়েছি। এবার খুব সাবধানে এথনককে ফাঁসাতে হবে। এই বলে সমস্ত পরিকল্পনা খুলে বলে তিনজন গেল ক্রথনকের কাছে। শেয়াল বলল: প্রভুর অবস্থা খুব খারাপ। এক্ষুণি আমাদের তাঁর কাছে যাওয়া উচিত।
শেয়ালের কথা শুনে তারা চারজনই সিংহের কাছে গেল। শেয়াল কাঁদ-কাঁদ স্বরে বলল: কদিন যাবৎ প্রভুর উপবাস যাচ্ছে। তার ওপর শরীর অসুস্থ। আজও কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। এতদিন হুজুরের নিমক খেয়েছি। আজ যেভাবেই হোক তাঁর প্রাণ রক্ষা করতে হবে। নিজের জীবন দিয়ে হলেও।
একথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে কাক সিংহকে প্রণাম করে জোড়হাতে বলল: প্রভু, আপনার অনেক অন্ন খেয়েছি। আজ তার কিছুটা হলেও শোধ করার সুযোগ দিন। আমাকে দিয়েই আপনার আজকের আহার হোক। তাতে হুজুরের খিদে মিটবে। আমারও স্বর্গলাভ হবে। শাস্ত্রে আছে না—
প্রভুর জন্য নিজেরে দান করে যেই ভৃত্য।
পুণ্যবলে স্বর্গলাভ হবে যে তার নিত্য।।
একথা শোনার সঙ্গে-সঙ্গে শেয়াল লাফ দিয়ে সামনে এসে বলল: অনেক হয়েছে হুজুরের ঋণ শোধ করা। এবার সরতো। তোমার মতো দশ-বিশটা কাক খেলে হুজুরের কি হবে? কথায় বলে না—কাকের মাংস আর কুকুরের এঁটো এ খাওয়াও যা, না খাওয়াও তা। আর ইহলোকে পরলোকে সবাই তোমাকে চেনে। তাই আজকের সুযোগটা, ভাই, আমাকেই দাও।
শেয়ালের কথা শুনে কাক সরে গেল এবং শেয়াল কাছে এসে সিংহের কাছে হাত জোড় করে নিজেকে সমর্পণ করল। এমন সময় চিতা কাছে এগিয়ে এসে শেয়ালকে বলল: ভালোই বলেছ, ভাই। কাকের চেয়ে তুমিই বা আর কত বড়? তোমায় খেলে হুজুরের পেট আর কতটা ভরবে? তাছাড়া কথায় বলে না—কুলীনকুলে জন্ম যার, প্রাণ গেলেও সে অখাদ্য খায় না। তাই আজকের সুযোগটা আমায় দাও। তুমি অনেক বুদ্ধিমান। তুমি হুজুরের অনেক উপকার করেছ। সেই পুণ্যে তুমি এমনিতেই স্বর্গে যাবে। হুজুরের সেবার দ্বারা আমায় একটু পুণ্য অর্জন করতে দাও, ভাই।
কাক, শেয়াল আর চিতার এসব আচরণ দেখে সরলপ্রাণ ক্রথনক ভাবল—এদের কি প্রভুভক্তি! নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য কি আকুলতা! ধন্য এদের জীবন! আর প্রভুও এদের মারছেন না। তাই আমি-ই বা পিছিয়ে থাকব কেন? এই ভেবে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে সে বলল: তোমরা হুজুরের স্বজাতি। কারো আছে নখ, কারো বা ঠোঁট। শাস্ত্রে আছে—স্বজাতিবধে মহাপাপ! তাছাড়া তোমাদের তিনজনকে খেলেও তো হুজুরের খিদে মিটবে না। আর আমিও তার হাছে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। দলভ্রষ্ট হয়ে একা একা এই বনে ঘুরছিলাম। হুজুর আশ্রয় দিয়েছেন। সুতরাং এই সুযোগে তার ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করি। শাস্ত্র বলছে:
প্রভুর তরে জীবন দিয়ে সেবক যাহা লভে।
যোগী কিংবা যাজ্ঞিক তা পায় না কভু ভবে।।
তাই এই সুযোগটা আমি হাতছাড়া করছি না।
এই বলে ক্রথনক যেই সিংহের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করল, অমনি শেয়াল আর চিতা মিলে তার পেট চিরে নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে ফেলল। তারপর সবাই মিলে পরম তৃপ্তি ভরে আহার করল।
সঞ্জীবক কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল: তাই, ভাই দমনক, আমি আর ওখানে যাচ্ছি না। কারণ আমি বুঝে ফেলেছি—তার চারপাশে এখন অসৎ লোকের ভিড়। আর অমাত্যরা অসৎ হলে জনগণ সেই রাজার অনুরক্ত হয় না, কিংবা রাজাও জনগণের মঙ্গল চিন্তা করে না। দেখ—
শকুন হলেও সেব্য রাজা, হংস যদি হয় সভাজন। হংস হলেও ত্যাজ্য রাজা, শকুন যদি হয় সভাজন। তাই আমি নিশ্চিত যে, প্রভুর পাশে কেউ একজন দুর্জন আছে, যে আমার বিরুদ্ধে তার কানে লাগিয়েছে। সাপের সঙ্গে বরং বাস করা যায়, কিন্তু দুর্জনের সঙ্গে নয়। কারণ সাপ শুধু তাকেই ছোবল মারে, যে তাকে আঘাত করে। কিন্তু দুর্জন কান ধরে একজনের, মারে আরেক জনকে। তারপরেও যেহেতু তুমি আমার বন্ধু, তাই তুমিই বলো এখন আমার কি করা উচিত।
দমনক একটু ভেবে বলল: আমারও মনে হয় এমন কু-প্রভুর সেবা না করাই ভালো। কথায় বলে না—গুরুর যদি দেমাকে ঠিক পথে পা না পড়ে, তিনি যদি কর্তব্যাকর্তব্য ভুলে যান, তাহলে তাঁকেও বর্জন করতে হবে।
সঞ্জীবক: তা বটে, কিন্তু পিঙ্গলককে না বলে যাই কি করে? তাতেও তো বিপদ! দেখ, শক্তিমান শত্রুর হাত অনেক লম্বা। তার কাছ থেকে দূরে গেলেই বিপদ যায় না। দূর থেকেও সে শত্রুকে টেনে আনে। তাই তার মোকাবেলা না করে আমার উপায় নেই। তাছাড়া বীরের পরিচয় যুদ্ধক্ষেত্রে। এতে মরলেও যশ, বাঁচলেও যশ। আর হাজার তীর্থসেবা, তপস্যা কিংবা যাগ-যজ্ঞ করায় যে ফল লাভ হয় পরকালে, যুদ্ধে জয়ী কিংবা নিহত বীরের সে ফল লাভ হয় তৎক্ষণাৎ। তাই পিঙ্গলকের সঙ্গে না যুঝে আমি যাব না।
সঞ্জীবকের এরূপ মনোভাব দেখে দমনক একটু ভয়ই পেয়ে গেল। সে ভাবল, কি জানি, চোখা-চোখা শিং দিয়ে এ আবার প্রভুকে মেরেই ফেলে কি-না! তাই একে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে দমনক বলল: তাতো বুঝলুম, বন্ধু! কিন্তু চাকরে—মনিবে কি লড়াই শোভনীয়? তাছাড়া শত্রু বলবান হলে দুর্বলের উচিত লুকিয়ে আত্মরক্ষা করা। শত্রুর বল না জেনে যুদ্ধে গেলে মরণ নিশ্চিত, যেমন মরেছিল বোকা টিট্টিভ—সমুদ্রের হাতে।
সঞ্জীবক: কি রকম?
দমনক: শোন, বলছি…