চড়ুই কাঠঠোকরা মাছি ব্যাঙ ও হাতি
এক বনে এক গাছের ডালে বাস করত এক চড়ুই দম্পতি। চড়ুইনী সম্প্রতি ডিম পেড়েছে। একদিন দুপুর বেলা প্রখর রোদে অতিষ্ঠ হয়ে ঐ গাছের নিচে আশ্রয় নিল এক মস্ত হাতি। গরমে সে পাগল প্রায়। হঠাৎ শুঁড় দিয়ে মটাৎ করে ভেঙ্গে ফেলল সেই ডালটি, যে ডালে ছিল চড়ুইর বাসা। আর যায় কোথা? ডিমগুলো ফেটে চৌচির! শোকে চড়ুইনী বিলাপ করতে লাগল।
কাছেই থাকত তাদের বন্ধু কাঠঠোকরা। বন্ধুর বিলাপ শুনে ছুটে এল। সব শুনে সে বলল: দেখ, যা হারিয়ে গেছে, মরে গেছে কিংবা ছেড়ে গেছে—তার জন্য শোক করে মূর্খরা। সংসারে কারও জন্য শোক করা মানে দ্বিতীয়বার কষ্ট পাওয়া। তাই পণ্ডিতেরা কখনও শোক করেন না।
চড়ুইনী বলল: তা তো বুঝলুম, কিন্তু ঐ বজ্জাত হাতিটার কি হবে? ও যে আমার সব্বনাশ করল! এর কোনো শাস্তি হবে না? তুমি যদি আমার প্রকৃত বন্ধু হও, তাহলে এর একটা বিহিত কর। তবে আমার শান্তি হবে।
কাঠঠোকরা: ঠিকই বলেছ, ভাই। কথায় বলে না—
বিপদে যে পাশে থাকে বন্ধু বটে সে।
সুসময়ে বন্ধু বলে কে না পাশে বসে।।
তাই আমি কথা দিচ্ছি, ঐ নচ্ছার হাতিটাকে মেরে আমি তোমার সন্তান-শোক দূর করব। তবে এর জন্য আমার এক মাছি বন্ধু আছে, বীণারব—ওর সাহায্য দরকার। চলো আমরা ওর কাছে যাই।
কথামতো কাঠঠোকরা আর চড়ুইনী গেল মাছির কাছে। কাঠঠোকরা সব খুলে বলল। মাছি শুনে বলল: বন্ধু, তোমার কাজে লাগতে পারলে আমি তো ধন্য। তাছাড়া—
বন্ধুর কাজ বন্ধু করে সে তো জানে সবে।
বন্ধুর বন্ধুর কাজ সে তো বড় ভবে।।
তবে আমার এক ব্যাঙ বন্ধু আছে—মেঘনাদ। ওর সাহায্য প্রয়োজন। চলো আমরা ওর কাছে যাই।
এই বলে তিনজন গেল মেঘনাদের কাছে। মেঘনাদ সব শুনে বলল: কোনো চিন্তা করো না। ধরে নাও, বেটা হাতির বাচ্চা মরেছে।
এই বলে ব্যাঙ সমস্ত পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলল এবং চারজন চলল হাতির উদ্দেশে। এদিকে হাতিটা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গাছের নিচে বসে ঝিমোচ্ছে। এই সুযোগে মাছি তার কানের কাছে গিয়ে মধুর বীণারবে গান শুরু করে দিয়েছে। হাতিটা শুনতে শুনতে মধুর আবেশে বুঁদ হয়ে আছে। এই সুযোগে কাঠঠোকরা দ্রুত তার চোখদুটো খুবলে নেয়। মুহূর্তে হাতিটা মাতালের ন্যায় ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে তৃষ্ণায় তার ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন বিশাল এক গর্তে বসে ব্যাঙ জোরে জোরে ডাকতে থাকে। হাতিটা জলের আশায় সেদিকে ছুটতে গিয়ে পড়ে সেই গর্তে। আর পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়।
তুচ্ছ চড়ুইদের হাতে হাতির এই করুণ মৃত্যুর ঘটনা শুনে টিট্টিভ বলল: তুমি যথার্থই বলেছ। আমি তাহলে সবাইকে নিয়েই যাব সমুদ্রকে শুষতে।
এই বলে টিট্টিভ কাক, বক, সারস, ময়ূর সবাইকে ডেকে বলল—সমুদ্র তাদের ডিম চুরি করেছে সে কথা। তাই সমুদ্রকে শুষে ফেলে তার প্রতিশোধ নিতে হবে। পাখিরা শুনে বলল: এ কাজে আমরা কেন? এর জন্য তো আমাদের রাজা গরুড়ই রয়েছেন। চলো না, তাঁর কাছে যাই।
টিট্টিভসহ পাখিরা তখন সবাই গেল গরুড়ের কাছে। তারা জোড়হাতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল: প্রভু! আপনি আমাদের মা-বাপ! আপনি না দেখলে আমরা বাঁচব কি করে? গরুড়: কি হয়েছে, বলো?
পাখিরা: প্রভু! ঐ সমুদ্র টিট্টিভের ডিম চুরি করেছে। এর উপযুক্ত বিচার হওয়া উচিত, কারণ—
একের গর্হিত কাজ অপরেতে করে।
রাজা যদি প্রথমের বিচার না করে।।
আর এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বংশই যে লোপ পাবে! তাছাড়া, মনুর মতে রাজার কর্তব্য হলো ঠগ, জোচ্চোর, দুর্বৃত্ত, ডাকাত, খুনি—এদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করা। তা নাহলে প্রজাপীড়নের সন্তাপ থেকে যে আগুন জন্মে তা রাজা, রাজ্যশ্রী সব পুড়ে ছাই করে দেয়। জগতে যার কেউ নেই, রাজাই তার সব। অন্ধ প্রজার চোখের মণি রাজা। রাজার যে ঐশ্বর্য, তার সবই প্রজার দান। তাই রাজা যদি ঐশ্বর্য চান তাহলে সর্বপ্রকারে প্রজার পালন করতে হবে, যেমন করে গোয়ালা— দুধের জন্য—গাভী আর বাছুরকে, কিংবা মালী—অঙ্কুরের জন্য—বীজকে। মনু আরও বলেছেন, রাজা উত্তমরূপে প্রজাপালন করলে প্রজার পুণ্যের ছয় ভাগের একভাগ তিনি পান। আর তা না করলে প্রজার পাপের ছয় ভাগের এক ভাগ তাঁর উপর বর্তায়।
পাখিদের কথা শুনে গরুড় ক্রুদ্ধ হয়ে বলল: তোমরা ঠিকই বলেছ! প্রজাপালনের একমাত্র দায়িত্ব রাজার! তা নাহলে সে কিসের রাজা? দাঁড়াও, এক্ষুণি আমি দুরাত্মা সমুদ্রকে উচিত শিক্ষা দিচ্ছি!
ঠিক এই সময় বিষ্ণুদূত এসে হাজির। গরুড়কে বলল: ভগবান বিষ্ণু দেবকাজে অমরাবতী যাবেন। শিগগির চলো।
গরুড় অভিমানভরে বলল: প্রভুকে প্রণাম জানিয়ে বলো, অমি আর তাঁর কাজ করব না। ঊষর জমিতে লাঙ্গল দিয়ে যেমন কোনো লাভ হয় না, তেমনি ভৃত্যের প্রতি উদাস প্রভুর সেবা করেও কোনো লাভ নেই।
বিষ্ণুদূত বিস্মিত হয়ে বলল: ভাই গরুড়! তোমার কি হয়েছে আজ? কস্মিন কালেও তো তুমি প্রভুর প্রতি এমন আচরণ করো নি! আমায় খুলে বলো।
গরুড়: প্রভুর অপর ভৃত্য সমুদ্র আমার প্রজার ডিম চুরি করেছে। তুমি প্রভুকে গিয়ে বলো, এর বিচার না করা পর্যন্ত আমি আর তাঁর কাজ করব না। দরকার হলে তিনি তাঁকে বহন করার জন্য অন্য ভৃত্য রাখতে পারেন।
দূতমুখে সব শুনে বিষ্ণু বললেন: গরুড়ের রাগ যথার্থ, কারণ প্রজারক্ষায় ব্যর্থ রাজার সম্মান কোথায়? তাই যাই, নিজেই গিয়ে খাতির করে তাকে নিয়ে আসি। কথায় বলে না— নিজের ভাল চাইলে সৎকুলজাত অনুরক্ত ভৃত্যকে সন্তানের ন্যায় যত্ন করা উচিত। তাছাড়া, রাজা ভৃত্যের কাজে খুশি হয়ে কেবল অর্থই দেয়, আর ভৃত্য? সে সম্মান পেলে রাজার জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে।
এসব চিন্তা করে বিষ্ণু স্বয়ং চলে এলেন গরুড়ের আস্তানায়। তাঁকে দেখে সলজ্জ গরুড় বিনয়ের সঙ্গে বলল: প্রভু! সমুদ্র আপনাকে আশ্রয় দেয় বলে সেই অহঙ্কারে সে আমার প্রজার ডিম চুরি করে আমায় অপমান করেছে। কেবল আপনার মুখ চেয়ে আমি ওকে এতক্ষণ শুকিয়ে ফেলিনি, কারণ মনিবের খাতিরে লোকে তার কুকুরকে পর্যন্ত প্রহার করেনা। সেবাশাস্ত্রেই তো আছে—
প্রভুর যাতে মানের হানি কিংবা চিত্তে পীড়া হয়।
জীবন গেলেও সে-কাজ কুল-ভৃত্য দ্বারা হবার নয়।।
গরুড়ের যুক্তিপূর্ণ কথায় খুশি হয়ে বিষ্ণু বললেন: তুমি যথার্থই বলেছ। ভৃত্যের অপরাধে কেউ তাকে সাজা দিলে তা যেমন মনিবের গায়েও লাগে, তেমনি ভৃত্যের লজ্জাজনক কাজের দায়ভারও মনিবেরই, ভূত্যের নয়। তাই চলো, সমুদ্রের কাছে গিয়ে ডিম ফিরিয়ে এনে টিট্টিভকে খুশি করি।
তা-ই হলো। সমুদ্রের কাছে গিয়ে বিষ্ণু অগ্নিবাণ ধনুকে জুড়ে সমুদ্রকে ভর্ৎসনা করে বললেন: এক্ষুণি টিট্টিভের ডিম ফিরিয়ে দাও, নইলে তোমাকে স্থলে পরিণত করব। অমনি সমুদ্র যেমন হাত বাড়িয়ে ডিম নিয়েছিল, তেমনি হাত বাড়িয়ে আবার তা ফিরিয়ে দিল। টিট্টিভ ডিমগুলো স্ত্রীর হাতে দিয়ে তাকে শান্ত করল।
দমনক এবার সঞ্জীবককে বলল: তাই বলছিলুম, বন্ধু! শত্রুর বল না জেনে লড়তে যাওয়া ঠিক নয়। তবে নীতিশাস্ত্র বলে পুরুষকে কখনও উদ্যম ছাড়তে নেই। সঞ্জীবক: কিন্তু আমি কি করে বুঝব যে পিঙ্গলক আমাকে মারতে চায়?
দমনক: প্রমাণ চাচ্ছ? তবে শোনো—রাজসভায় গিয়ে যদি দেখ সে তোমার সঙ্গে আগের মতো ব্যবহার করছে না, কিংবা তার চোখ দুটো লাল, ভুরু কুচকে তাকাচ্ছে এবং জিহ্বা দিয়ে নাক চাটছে—তাহলে বুঝবে মতলব ভালো নয়। আর এর বিপরীত হলে বুঝবে সুপ্রসন্ন।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে দমনক আবার বলল: এবার তাহলে আজ্ঞা করো, নিজের বাসায় যাই। তবে দেখ, গোপন মন্ত্রণাটা যেন আবার ফাঁস না হয়ে যায়! তাহলে তোমারও শেষ, আমারও শেষ! আর যদি সাহসে না কুলোয় তাহলে রাতের অন্ধকারেই কেটে পড়, কারণ বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত হলো— বংশের জন্য ব্যক্তি ছাড়বে, গ্রামের জন্য ছাড়বে বংশ, প্রয়োজনে দেশের জন্য গ্রাম ছাড়বে, কিন্তু জগৎ ছাড়বে নিজের জন্য। আর টাকা বাঁচাবে বিপদের জন্য, টাকা দিয়ে বাঁচাবে স্ত্রী, কিন্তু নিজেকে বাঁচাবে টাকা অথবা স্ত্রী কিংবা উভয়কে দিয়েই। আর ধর্মের কথা বলছ? সে তো নিজেকে সব দিক থেকে গুছিয়ে তার পরে।
এই বলে দমনক বিদায় নিয়ে চলে গেল করটকের কাছে। করটক বলল: কি করে এলে, ভাই?
দমনক: বীজ পুঁতে এলুম, ফল ধরল বলে।
করটক: কি করেছ, খুলে বলো।
দমনক: দুজনের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছি। দেখো, কেউ কারও সঙ্গে আর কথাটি পর্যন্ত বলবে না। এমনও হতে পারে যে, একজন আরেক জনকে মেরেই ফেলল।
করটক: কাজটা কি ভালো হলো? দুজনে কেমন সুখে ছিল—যেন আত্মার আত্মীয়। অথচ ফেলে দিলে একেবারে রেষারেষির মাঝ দরিয়ায়! শাস্ত্র বলছে না—অকারণে কেউ কারও সুখ নষ্ট করলে, জন্মজন্মান্তরে সে কষ্ট পায়। তাছাড়া, নীচ ব্যক্তি শুধু অপরের ক্ষতিই করতে পারে, উপকার নয় যেমন ইঁদুর কেবল ঘরের বাঁধই কাটে, বাঁধ দিতে পারে না।
করটকের কথায় দমনক একটু উত্তেজিত হয়ে বলল: তুমি রাজনীতির অ-আ-ক-খ ও বোঝনা, তাই এসব নীতির কথা বলছ! উন্নয়নকামী ব্যক্তি শুরুতেই শত্রু, অগ্নি কিংবা ব্যাধি নির্মূল করে ফেলে। দেখ, ঐ বেটা সঞ্জীবককে আমরাই এনেছিলাম, অথচ সে-ই কি-না আমাদের পদ কেড়ে নিল! রাজা এখন আর আমাদের চেনেই না! তুমি যা-ই বলো, এ আমি সহ্য করতে পরব না। আর মনে রেখো—উদ্যমী পুরুষরাই কেবল সুন্দরী গৃহলক্ষ্মী, স্থায়ী রাজ্যলক্ষ্মী আর অফুরন্ত ধন-সম্পদ ভোগ করতে পারে, অলসের পক্ষে এ সম্ভব নয়। রাজনীতির মূল কথাই হলো মুখে মিষ্টি, অন্তরে বিষ, আর অনিষ্টকারী হত্যায় অকুণ্ঠা। তাছাড়া, সঞ্জীবক মরলে আমাদের তিনটি লাভ—প্রতিশোধ গ্রহণ, মন্ত্রীত্ব পুনঃপ্রাপ্তি এবং ভুরিভোজ। আর পিঙ্গলক মরলেও ক্ষতি নেই; রাজত্ব তখন আমাদেরই হবে। কাজেই তুমি চুপ করে থাক। যা করার আমিই করব। দেখ—
পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে বুদ্ধিমানের জীবন চলে।
সিংহ পালায় শিকার ফেলে চতুরকের বুদ্ধিবলে।।
করটক: সে আবার কি?
দমনক: শোনো তাহলে…