সিংহ শেয়াল নেকড়ে
এক বনে থাকত এক সিংহ। নাম তার বজ্রদন্ত। বজ্রের ন্যায় ভয়ানক দাঁত তো! তাই এই নাম। তার ছিল দুই সহচর—চতুরক নামে এক শেয়াল, আর ক্রব্যমুখ নামে এক নেকড়ে। অতিশয় চালাক বলে শেয়ালের নাম চতুরক। আর মুখে সব সময় কাঁচা মাংস থাকত বলে নেকড়ের নাম ক্রব্যমুখ।
সুখেই তাদের দিন কাটছিল। একবার দাবানল লেগে বন গেল পুড়ে। তাই খাদ্যাভাব দেখা দিল। পরপর বেশ কয়েকদিন তাদের অনাহারে থাকতে হলো। একদিন এক বণিকদল উটের সারি নিয়ে যাচ্ছিল বাণিজ্যে। হঠাৎ এক বাচ্চা উট ছুটতে ছুটতে দলছাড়া হয়ে পড়ল। শেয়াল বলল: প্রভু! খাবার মিলেছে; ঐ দেখুন! এই বলে সে উটশাবককে দেখিয়ে দিল। সিংহ একটু ভেবে বলল: এ নিতান্তই বাচ্চা; একে মারা ঠিক হবে না; অন্য কিছুর সন্ধান কর।
দুষ্টু শেয়ালের আবার মায়া-দয়া! সে ঠিক করল— একেই মারতে হবে; খিদের সময় আবার মায়া-দয়া? প্রকাশ্যে বলল: প্রভু! শাস্ত্রে আছে ‘শরীরম্ আদ্যং খলু ধর্মসাধনম্’ শরীর রক্ষাই হলো বড় ধর্ম। না খেয়ে খেয়ে আপনার শরীর আধখানা হয়ে গেছে। এভাবে চললে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি অনিবার্য। তখন আমাদের কি হবে? আর ও যদি স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গ করে তাহলে আর দোষ কোথায়?
চতুরকের কথায় সিংহ মৌনী থাকল। ‘মৌনং সম্মতিলক্ষণম্’—এই প্রবাদবাক্য স্মরণ করে তাই চতুরক গেল উটের কাছে। বলল: বাছা! বুঝতে পেরেছি তুমি মাকে হারিয়েছ। তা, এটাতো প্রভু বজ্রদন্তের রাজ্য। এখানে তার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাটিও পড়ে না, বাতাসটিও নড়েনা। তাই তুমি যদি মায়ের কাছে যেতে চাও তাহলে তার সাহায্য লাগবে।
উটশাবক কাতরভাবে বলল: আমাকে কি করতে হবে?
চতুরক: তুমি প্রভুর সেবায় নিজেকে উৎসর্গ কর। তিনি দৈববলে তোমায় মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেন।
উটশাবক রাজি হয়ে সিংহের কাছে গেল এবং তার আবেদনে সাড়া দিয়ে সিংহ তাকে মেরে ফেলল। কিন্তু কয়েকদিনের অনাহারী, তদুপরি শিকারটি বাচ্চা। তাই চতুরক মনে মনে ভাবল, যেভাবেই হোক এটাকে সে একাই খাবে। কিন্তু কিভাবে? মুহূর্তকাল চিন্তা করে সে সিংহকে বলল: প্রভু! আজ পূর্ণিমা। গঙ্গায় নতুন জল। তাই স্নানটা সেরে নিলে ভালো হতো না?
সিংহ: কথাটা মন্দ বলোনি। আমি ডুব দিয়ে আসি। তোমরা ততক্ষণ চুপ করে বসে থাক। এই বলে সে চলে গেল।
এদিকে চতুরক ভাবতে লাগল কিভাবে ক্রব্যমুখকে ফাঁসানো যায়। কিন্তু উপায় বের করতে সময় লাগল না। এমনিতে কি আর শেয়ালকে বলে পণ্ডিত! সে ক্রব্যমুখকে বলল: দীর্ঘদিন না খাওয়া! তোমার মুখটা এবারে শুকিয়ে গেছে! তুমি এক কাজ কর। এক পাশ দিয়ে একটু খেয়ে নাও। প্রভুকে আমি সামলাব।
ক্রব্যমুখের আসলেই আর তর সইছিল না। তাই সে দু-এক কামড় দিতেই অদূরে সিংহকে দেখে চতুরক বলল: বন্ধু! সরে দাঁড়াও, প্রভু আসছে! ক্রব্যমুখ তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়াল। সিংহ আসামাত্রই চতুরক ক্রব্যমুখের উদ্দেশে অভিযোগের সুরে বলল: এতদিন বাদে প্রভুর জন্য আহারের ব্যবস্থা হলো, আর তুই সেটাকে এঁটো করে দিলি!
সিংহ তাকিয়ে দেখে ক্রব্যমুখের মুখে রক্ত। তাই হুঙ্কার দিয়ে বলল: ধর ওকে, ওকেই আগে খাব। আর যায় কোথা! এক ছুটে ক্রব্যমুখ দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। এদিকে বজ্রদন্ত আসনে বসে যেই আহার শুরু করবে, ঠিক তখনই অদূরে বিকট ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল। বজ্রদন্ত চতুরককে বলল: দেখতো কিসের শব্দ!
বনের অদূর দিয়ে এক বণিকদল যাচ্ছিল উটের সারি নিয়ে। প্রথমটির গলায় ঝোলানো এক বিশাল ঘণ্টা থেকে এমন শব্দ বেরুচ্ছিল। চতুরক সুযোগ বুঝে ফিরে এসে বলল: প্রভু, সর্বনাশ! সেই উটের দল বাচ্চার খোঁজে এদিকেই আসছে! বলছে: যে আমাদের বাচ্চা ধরেছে তার বাপ-ঠাকুরদা পর্যন্ত ধরে নিযে যাব। এ-কথা শুনে বজ্রদন্ত মরা উটটির দিকে একবার তাকিয়ে ভোঁ-দৌড়ে পালিয়ে গেল। আর চতুরক তৃপ্তিভরে একাই সেটা ভক্ষণ করল।
দমনক করটকের উদ্দেশে বলল: তাই বলছিলাম—বুদ্ধিমানের বুদ্ধির কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। প্যাঁচটা কেবল ঠিকমতো কসতে হবে। তাহলে আর ফসকানোর জো থাকবেনা। এই বলে করটক ও দমনক গেল রাজসভায়।
এদিকে দমনককে বিদায় দিয়ে সঞ্জীবক ভাবছিল—কি ভুলটাই না সে করেছে! নিজে তৃণভোজী হয়ে মাংসখেকো ঐ পিঙ্গলকের দলে ভিড়ে নিজের বিপদ সে নিজেই ডেকে এনেছে। এখন উপায় কি? পালিয়ে যাবে? কিন্তু এই বনে কে তাকে অশ্রয় দেবে? মাংসখেকোরতো অভাব নেই। কারো-না-কারো হাতে তার প্রাণ যাবেই। তার চেয়ে বরং পিঙ্গলকের কাছেই ফিরে যাওয়া ভালো। তার শরণাগত হলে সে হয়তো পূর্বমিত্রতা স্মরণ করে ক্ষমাও করতে পারে। তাছাড়া কথায় বলে না—
আগুনেতে পুড়লে পা শুকাইতে ঘা।
আগুন দিয়েই তৈরি ঐ মলম লাগা।
এসব চিন্তা করে সঞ্জীবক ভয়ে ভয়ে রাজসভায় গেল। কিন্তু পিঙ্গলকের চোখে চোখ পড়তেই তার পিলে গেল চমকে! চোখ লাল! কটমট করে তাকাচ্ছে তার দিকে! তখন তার দমনকের কথা মনে পড়ল। দমনক যেমনটি বলেছিল, ঠিক তেমনটিই সে দেখছে। তাই সঞ্জীবক অন্য দিনের মতো পিঙ্গলকের কাছে না গিয়ে দূর থেকে প্রণাম করে অন্যত্র সরে বসল। তা দেখে পিঙ্গলকেরও দমনকের কথা মনে পড়ল। দমনক যেমন বলেছিল, সঞ্জীবকের আচরণে তা-ই সে দেখতে পেল। তাই পিঙ্গলকের আর ধৈর্য মানল না। সে হুঙ্কার দিয়ে পড়ল গিয়ে সঞ্জীবকের উপর। তীক্ষ্ণ নখের আচরে সঞ্জীবকের দেহ হলো ক্ষত-বিক্ষত। সঞ্জীবকও তার বজ্রের ন্যায় শৃঙ্গ দিয়ে মারল গুঁতো। পিঙ্গলকের পেটের চামড়া ছিঁড়ে ফেলে কোন রকমে সে রক্ষা পেল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে গর্জন করতে লাগল। এই ভয়ঙ্কর কাণ্ড দেখে করটক তখন দমনককে তিরস্কার করে বলল: মূর্খ! এই বুদ্ধি নিয়ে তুই মন্ত্রী হতে চাস? এই কি মন্ত্রীর কাজ? অহিংস পথে যে রাজার সমস্যার সমাধান করতে পারে, সে-ইতো প্রকৃত মন্ত্রী। দেখ, বৈদ্যের পরীক্ষা হয় রোগের চিকিৎসায়, আর মন্ত্রীর পরীক্ষা হয় দ্বন্দ্ব নিরসনে। কিন্তু তুই এর বিপরীত। তুইতো রাজনীতির ‘র’-ও জানিস না। ব্রহ্মা বলেছেন না—শত্রুজয়ে প্রথমে প্রয়োগ করতে হয় সাম। তারপর দান। তাতেও কাজ না হলে ভেদ এবং সবশেষে দণ্ড। কিন্তু তোর মধ্যে শুধু যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। দেখ, এই দ্বন্দ্বে রাজা মারা গেলে তোর মন্ত্রী হওয়া শেষ, কারণ তৃণভোজী সঞ্জীবক আজ-না-হোক কাল মারা পড়বেই। আর পিঙ্গলক বাঁচলেও তোর লাভ হবে না। সে তোকে আর বিশ্বাস করবে না, কারণ সঞ্জীবককে তুই-ই তার নিকট নিয়ে এসেছিলি।
মুহূর্তকাল নীরব থেকে আবার বলল: অবশ্য তোকে আর দোষ দিচ্ছি কেন? দোষ তো আসলে রাজার। তোকে প্রশ্রয় দিয়েই আজ তার এই দশা। তোর যেকোন কথাই তিনি বিশ্বাস করতেন। তোর মতো মন্ত্রীরা যার পাশে থাকে, সেই রাজার মৃত্যু অবধারিত। সেই রাজা গুণের আধার হলেও সজ্জনেরা তার কাছে যায় না, যেমন পরিষ্কার ও সুস্বাদু জল হলেও কুমির থাকলে সেই হ্রদে কেউ নামে না। অবশ্য তোর মতো মূর্খকে উপদেশ দেয়াও বিপদ! তাতে সে শান্ত না হয়ে বরং উপদেশদাতারই ক্ষতি করে, যেমন করেছিল বানর—বাবুইর বাসা ভেঙ্গে।
দমনক: কি রকম?
করটক: শোন তাহলে…