ধর্মবুদ্ধি ও পাপবুদ্ধি
এক গ্রামে ছিল দুই বন্ধু—ধর্মবুদ্ধি ও পাপবুদ্ধি। দুজনে খুব ভাব। একদিন পাপবুদ্ধি ভাবল আমার যা বিদ্যে, তা দিয়ে অর্থোপার্জনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ভবিষ্যৎটা কাটবে কি করে? তাই ব্যবস্থা একটা করতেই হয়।
এই ভেবে সে একদিন ধর্মবুদ্ধিকে গিয়ে বলল: বন্ধু, বয়সতো দু-কুড়ি হলো, আর ক—দিনই বা বাঁচব? বৃদ্ধ বয়সের সম্বল কিছু টাকাকড়িতো জোগার করতে হয়। তাছাড়া দেশ-বিদেশ না ঘুরলে জ্ঞানার্জনও সম্পূর্ণ হয়না। কথায় বলে না—
কত দেশ কত ভাষা কত বেশ কত ভূষা
আরও কত কি।
ঘুরিয়া যে দেখিল না জীবন তার কিছুই না
ছি! ছি! ছি! ছি! ছি!!
ধর্মবুদ্ধি শুনে বলল: তাইতো! বিদেশ না গেলে কুনো ব্যাঙ আর মানুষে তফাত কি? বিদেশ ভ্রমণে বিদ্যা, ধন, যশ, খ্যাতি সবই হয়। তাই আমাকেও যেতে হবে।
এই বলে সে গুরুজনদের অনুমতি নিয়ে পাপবুদ্ধির সঙ্গে বিদেশ গেল। সেখানে তার বুদ্ধি ও জ্ঞানবলে দুজনে প্রচুর অর্থোপার্জন করল। তারপর একদিন পাপবুদ্ধি বলল: বন্ধু, আর কত? এবার চল ফিরে যাই। কথায় বলেনা—
প্রবাসীর লাভ হলে বিদ্যা শিল্প ধন।
স্বজনের লাগি মন হয় উচাটন।
পাপবুদ্ধির কথায় সায় দিয়ে দুজনে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। সারা পথ পাপবুদ্ধি ভাবছিল—কিভাবে ধর্মবুদ্ধিকে ঠকিয়ে পুরো টাকাটাই হাতিয়ে নেয়া যায়। বাড়ির কাছাকাছি এসে সে ধর্মবুদ্ধিকে বলল: বন্ধু, শাস্ত্র বলে—টাকা দেখলে সন্ন্যাসীরও মন টলে, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরতো কথাই নেই। এত টাকা দেখলে সবাই ভাগ চাইবে। তাই সব টাকা বাড়ি নেয়া ঠিক হবেনা। অল্প কিছু নিয়ে বাকিটা বনের মধ্যে কোথাও পুঁতে রেখে যাই। প্রয়োজনমতো দুজনে এসে নিয়ে যাব।
কৌশলটা ধর্মবুদ্ধির ভালই লাগে। তাই সে পাপবুদ্ধির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। তারপর তারা বাড়ির অদূরে বনের মধ্যে এক শমীবৃক্ষের নীচে গর্ত খুড়ে টাকাগুলো রেখে দেয়। এবং অল্প কিছু টাকা নিয়ে যার যার বাড়ি যায়।
দু-একদিন পরে পাপবুদ্ধি গভীর রাতে এসে টাকাগুলো নিয়ে যায় এবং ভোরবেলা ধর্মবুদ্ধির কাছে গিয়ে বলে: বন্ধু, জানইতো, আমার হচ্ছে রাবণের গুষ্টি। টাকা যা এনেছিলাম, শেষ। তাই চল, কিছু টাকা নিয়ে আসি।
ধর্মবুদ্ধি সরল মনে বলল: চল।
কিন্তু গিয়ে দেখে, টাকা নেই। গর্ত খুড়ে কে যেন আবার তা বন্ধ করে রেখেছে। ধর্মবুদ্ধি কিছু বলার আগেই পাপবুদ্ধি জোর গলায় বলে উঠল: বেটা চোর! টাকা তুই নিয়েছিস! এক্ষুণি আমার অর্ধেক ফিরিয়ে দে! নইলে রাজার কাছে নালিশ করব!
ধর্মবুদ্ধি: খবরদার বদমাস! আমি হচ্ছি ধর্মবুদ্ধি। এসব জোচ্চুরি আমার কাজ নয়। ধর্মবুদ্ধি সব সময় পরস্ত্রীকে মায়ের মতো, টাকাকে মাটির ঢেলার মতো এবং সবাইকে নিজের মতো দেখে। এ তোর কাজ। এক্ষুণি আমার প্রাপ্য ফিরিয়ে দে। নইলে আমিও রাজার কাছে নালিশ করব।
এমনিভাবে কিছুক্ষণ বাদানুবাদের পর অবশেষে উভয়ই রাজার কাছে যায় এবং পরস্পরের নামে নালিশ করে। রাজার আদেশে বিচার কাজ শুরু হয়। বিচারক বলেন, শাস্ত্রে আছে—
বিচার-কাজে দেখবে দলিল,
তার অভাবে সাক্ষী-সাবুদ।
তার অভাবে দৈববাণী
বলেন এসব মনস্বী-বুধা
তা তোমরা যে টাকা ভাগাভাগি করেছ, তার কি কোনো দলিল আছে?
উভয়: আজ্ঞে, না।
বিচারক: তাহলে কোনো সাক্ষী?
ধর্মবুদ্ধি বলল: ধর্মাবতার, আমরা যখন টাকাগুলো মাটির নীচে রাখি, তখন সেখানে আর কেউ ছিলনা।
পাপবুদ্ধি সঙ্গে সঙ্গে বলল: ধর্মাবতার, আমার সাক্ষী বনদেবতা। তিনিই বলে দেবেন কে চোর, কে সাধু।
বিচারক: তবে তা-ই হোক। কাল সকালে আমরা সবাই একসঙ্গে সেখানে যাব। তোমরা কেউ একা সেখানে যাবেনা। সম্মত হয়ে ধর্মবুদ্ধি আর পাপবুদ্ধি বাড়ি ফিরে গেল।
ধর্মবুদ্ধি বুঝতে পারছে না কি করবে। সে কেবল ধর্মে আত্মসমর্পণ করে সকালের অপেক্ষা করছে। এদিকে পাপবুদ্ধি বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধ বাবাকে সব খুলে বলে। বলে: কঠিন সমস্যা, বাবা! বিচারে হারলে এতগুলো টাকাও যাবে, সঙ্গে জীবনটাও! একমাত্র উপায় আছে, যদি তুমি রাজি হও।
বাবা বললেন: কি করতে হবে?
পাপবুদ্ধি: বনের মধ্যে এক বিশাল শমীবৃক্ষ আছে। তাতে আছে এক বিরাট গর্ত। তুমি আজ রাতেই গিয়ে সেই গর্তে লুকিয়ে থাকবে। কাল সকালে বিচারক যখন জানতে চাইবেন কে চোর, তখন তুমি বলবে ধর্মবুদ্ধিই চোর। ব্যাস! তারপর আজীবন সুখে কাল কাটাব!
পরের দিন সকালে ধর্মবুদ্ধি আর পাপবুদ্ধি বিচারকের সঙ্গে গেল সেই শমীবৃক্ষের তলায়। সঙ্গে রাজার লোকেরা। বিচারক জোড়হাতে শমীবৃক্ষের দিকে তাকিয়ে বললেন: হে বনদেবতা! নিজের বুদ্ধিতে যখন কুলোয় না, মানুষ তখন দেবতার সাহায্য কামনা করে। আমরাও তোমার সাহায্যপ্রার্থী। বলে দাও, গচ্ছিত অর্থ কে চুরি করেছে—ধর্মবুদ্ধি না পাপবুদ্ধি?
অমনি বৃক্ষকোটর থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় উত্তর এলো: ধর্মবুদ্ধি চুরি করেছে, সে-ই চোর।
সবাই বিস্মিত হয়ে গেল! জাগ্ৰত বনদেবতা! ধন্য পাপবুদ্ধি!
বিচারক বললেন: বিচার শেষ। এবার দণ্ডদানের পালা।
ধর্মবুদ্ধিকে কি দণ্ড দেয়া যায় এ নিয়ে যখন পরামর্শ চলছে, তখন ধর্মবুদ্ধি শমীবৃক্ষের কোটরের চারপাশে দাহ্য পদার্থ ছড়িয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল। আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। এক সময় ঢুকে পড়ল কোটরের মধ্যে। অমনি আর্তনাদ করে বেরিয়ে এলো পাপবুদ্ধির পিতা। দেহের অর্ধেকখানা পুড়ে ছাই। সেই অবস্থায়ই সে খুলে বলল পাপবুদ্ধির কীর্তি-কাহিনী এবং বলল: পাপবুদ্ধিই চোর।
এই বলে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করল জীবন দিয়ে। তখন রাজপুরুষেরা পাপবুদ্ধিকে ধরে শূলে চড়াল। আর ধর্মবুদ্ধির প্রশংসা করতে করতে বলল: পণ্ডিতেরা কোনো উপায় চিন্তা করলে সঙ্গে সঙ্গে তার খারাপ দিকটাও ভাবেন, নইলে বিপদ আরও বাড়ে, যেমন সাপের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে বেজির হাতে মারা পড়ে বোকা বকেরা।
ধর্মবুদ্ধিঃ তাই না-কি? শুনি তাহলে ঘটনাটা!
রাজপুরুষরা: শোনো তাহলে…