জীর্ণধন ও শ্রেষ্ঠী
দক্ষিণ ভারতের এক নগরে বাস করত এক বণিক। নাম জীর্ণধন। এক সময় প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। এখন সব শেষ, তাই এই নাম।
জীর্ণধন একদিন স্থির করল—বিদেশ যাবে। কারণ, এক সময় সে দাপটে চলেছে। বুক ফুলিয়ে ফূর্তি করেছে। এখন বৈভব হারিয়ে কাপুরুষের ন্যায় চললে, শত্রু থাক দূরের কথা, সাধারণ মানুষও ছিঃ ছিঃ করবে। কেউ মান্য করবে না। তাই বিদেশ গমন জরুরি।
তার ছিল একটি লোহার তুলাদণ্ড। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। যাওয়ার আগে সেটি প্রতিবেশী এক শ্রেষ্ঠীর নিকট গচ্ছিত রেখে গেল। বছর খানেক পরে ফিরে এসে শ্রেষ্ঠীকে বলল: মহাশয়, আমার তুলাটা ফিরিয়ে দিন।
শ্রেষ্ঠী: সেতো সম্ভব নয়!
জীর্ণধন: কেন?
শ্রেষ্ঠী: আপনি যাওয়ার পরপরই ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে!
শ্রেষ্ঠীর মুখে এই অসম্ভব কথা শুনে জীর্ণধন বুঝল, তুলাটি এ মেরে দিতে চাইছে। কিন্তু, মুখে কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পরে বলল: তাহলে আর আপনার কি দোষ! সংসারটা এমনই! এখানে কিছুই কারো চিরকাল থাকেনা। যাহোক, বেলা হয়ে এল। যাই, নদীদে স্নানটা সেরে আসি। তা, আপনার শিশু পুত্রটিকে যদি বলেন স্নানের জিনিসগুলো নিয়ে আমার সঙ্গে যেতে, তাহলে ভালো হয়।
শ্রেষ্ঠী অতি আগ্রহে বলল: আজ্ঞে, অবশ্যই যাবে। ছেলেকে ডেকে বলল: বাবা, তোমার কাকামণি স্নানে যাচ্ছেন, তুমি কাপড়-চোপড় নিয়ে সঙ্গে যাওতো।
অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। শ্রেষ্ঠীর আচরণেও তা প্রকাশ পাচ্ছে। জীর্ণধন তাই মনে মনে বলল: ভয়ে কিংবা লোভে পড়েই মানুষ অন্যের পছন্দমতো কাজ করে, নিছক ভক্তির কারণে নয়। তাইতো পণ্ডিতেরা বলেছেন:
কারণ ছাড়া অতিভক্তি যদি দেখতে পাও।
সন্দ করো, হে বুদ্ধিমান, যদি বাঁচতে চাও।।
এরূপ ভাবতে ভাবতে জীর্ণধন স্নানে চলল। শ্রেষ্ঠীর শিশুপুত্রও আহ্লাদে আটখানা নদীতে যেতে পেরে। কিন্তু জগৎটাকে সে এখনো চেনেনি। তাই তার এ সরল আনন্দ। জীর্ণধন স্নান সেরে শিশুটিকে এক গুহায় ঢুকিয়ে মস্ত এক পাথর দিয়ে মুখটা দিল বন্ধ করে। তারপর ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ফিরে গেল শ্রেষ্ঠীর বাড়ি। শ্রেষ্ঠী অস্থির কণ্ঠে বলল : আমার ছেলে কোথায়?
জীর্ণধন: নদীর পাড় থেকে বাজে নিয়ে গেছে।
শ্রেষ্ঠী: মিথ্যেবাদী! বাজ কখনো একটা মানুষ নিতে পারে? দিব্যি করে বলছি, আমার ছেলে ফিরিয়ে দাও, নইলে রাজার কাছে বিচার দেব!
জীর্ণধন: তবে তা-ই হোক! রাজাই বিচার করবেন কে মিথ্যেবাদী, আর কে সত্যবাদী! এভাবে দুজন বিবাদ করতে করতে রাজদরবারে গেল। শ্রেষ্ঠী চিৎকার করে বলছে: তোমরা শোন! কি সাংঘাতিক কথা! এই জীর্ণধন আমার ছেলেকে চুরি করেছে!
শুনে বিচারকরা বললেন: ওহে জীর্ণধন, তুমি ওর ছেলেকে চুরি করেছ কেন?
জীর্ণধন: আমি চুরি করিনি; বাজে নিয়ে গেছে।
বিচারক: সেটা কি করে সম্ভব? বাজপাখি একটা মানুষ ছোঁ মেরে নিতে পারে?
জীর্ণধন: ধর্মাবতার! বাজপাখি যদি মানুষ না নিতে পারে, তাহলে ইঁদুরে কি করে লোহার তুলা খায়?
অতঃপর বিচারকরা জানতে চাইলে জীর্ণধন পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা খুলে বলে এবং বিচারের রায় অনুযায়ী জীর্ণধন তার তুলাদণ্ড এবং শ্রেষ্ঠী তার পুত্র ফিরে পায়।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর করটক দমনককে পুনরায় বলল: আরে নির্বোধ! তুইও ঐ লোভী শ্রেষ্ঠীর মতো সঞ্জীবকের সম্মান দেখে সহ্য করতে পারছিলি না। তাই এ কাণ্ড করেছিস। আর তোকেইবা কি বলব? দুনিয়ার নিয়মই হচ্ছে, নীচকুলে যার জন্ম সে কুলীনকে হিংসা করে। ভাগ্যবানকে হিংসা করে দুর্ভাগা। দাতাকে হিংসা করে কৃপণ। ধনীকে হিংসা করে দরিদ্র। সুজনকে হিংসা করে দুর্জন। সুপুরুষকে হিংসা করে কুপুরুষ। ধার্মিককে হিংসা করে অধার্মিক। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতকে হিংসা করে নির্বোধ। আর সতীকে হিংসা করে অসতী। অবশ্য মূর্খের সঙ্গে যার বন্ধুত্ব হয়, তার এরূপ দশাই হয়। তাইতো কথায় বলে:
মূর্খ বন্ধুর চেয়ে পণ্ডিত শত্রুও ভাল।
বানরের হাতে রাজা দ্বিখণ্ডিত হলো।
দমনক: কি করে হলো?
করটক: এভাবে…