গোঁজ-ওপড়ানো বানর
কোনও এক শহরে বাস করত এক বণিক। সে একটি মন্দির তৈরি করছিল নিকটবর্তী গাছ-পালার মধ্যে। কারিগররা সেখানে করাত দিয়ে গাছ ফাঁড়ছিল। তখন দুপুর বেলা। কারিগররা গেছে খেতে। এই সুযোগে একদল বানর এল। ওরা প্রায়ই আসে ছোটাছুটি করে, কিচির-মিচির করে, আবার চলে যায়। ঐদিন এক বানর লাফ দিয়ে উঠল আধচেরা একটি অঞ্জন কাঠের ওপর। তার মধ্যে ছিল একটি গোঁজ ঢোকানো। বানরটি খেলতে খেলতে গোঁজটি উপরে ফেলল। যেই না উপরে ফেলা, অমনি তাতে পিষ্ট হয়ে সে অক্কা পেল। তাই বলছিলাম:
যার যা কাজ নয় করতে গেলে তা।
মরতে হবে, যেমন ম’লো বোকা বানরের ছা ॥
আমরা তো যা হোক খেয়ে-পড়ে ভালই আছি। কি দরকার এসব ঝামেলায় যাওয়ার? দমনক বলল: তুমি দেখছি কেবল খাওয়ার কাঙাল। চাকরি নেই বাকরি নেই, মরার মতো বেঁচে আছি। একে কি বাঁচা বলে? এভাবে তো কাক-বক, কুকুর-বেড়ালও বাঁচে। আমি এভাবে বাঁচতে চাই না। যে-বাঁচা লোকসমাজে প্রশংসা পায়, আমি তেমন বাঁচা বাঁচতে চাই। ছোট মন নিয়ে তা সম্ভব নয়।
দেখ, ছোট নদী অল্পতেই ভরে যায়, ইঁদুরের অঞ্জলি সামান্যতেই পূর্ণ হয়, আর যারা কাপুরুষ তারা অল্পতেই তুষ্ট হয়। আরও দেখ, পতাকার স্থান যেমন বাঁশের আগায়, তেমনি যার অবস্থান সমাজের উঁচুতে না হয়, তার জন্ম কেবল মায়ের যৌবনই হরণ করে।
করটক বলল: কিন্তু আমরা এমন কি, যে রাজা আমাদের কথা শুনবে? কথা সেখানেই বলা উচিত যেখানে সাদা কাপড়ে রঙের মতো লাগে।
উত্তরে দমনক বলল: দেখ, রাজার সঙ্গে যার সম্পর্ক থাকে, লোকে তাকে ভয় পায়, শ্রদ্ধা করে। তা না হলে কে কাকে ঠেঙায়? যারা বিদ্বান, বীর, শিল্পী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং সেবক রাজা ছাড়া তাদের গতি নেই। যারা আত্মাভিমানে রাজার কাছ থেকে দূরে থাকে, তাদের প্রায়শ্চিত্ত আমরণ ভিক্ষা। ও আমার দ্বারা হবে না। তাই আমি ওর নিকট যাবই।
করটক বলল: দেখ দমনক, রাজাদের মর্জি ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। এই ভালো তো এই মন্দ, ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট। তাই তুমি গিয়ে কি বলবে? কিভাবে তাকে বশ করবে? দমনক বলল: দেখ, যারা বুদ্ধিমান তারা যার যে ভাব তা সঠিক বুঝে নিয়ে চট করে বশ করে ফেলে। রাজা ক্রুদ্ধ হলে প্রশংসা, তার প্রিয়জনকে ভালোবাসা, অপ্রিয়জনকে নিন্দা করা, তার দানের প্রশংসা করা এগুলি হলো তন্ত্র-মন্ত্র ছাড়াই বশীকরণের উপায়। এভাবে সব সময় মন জুগিয়ে চললে রাক্ষসকেও বশ করা যায়। এই বলে করটকের নিকট বিদায় নিয়ে দমনক পিঙ্গলকের নিকট গেল।
এদিকে ভয়ার্ত পিঙ্গলক পুরনো চাকরকে আসতে দেখে মনে জোর পেল। তাকে কাছে ডেকে বলল: এতদিন কোথায় ছিলে, বন্ধু?
করটক মনে মনে বলল: বেটা হারামজাদা! তাড়িয়ে দেয়ার সময় কুকুর-বেড়ালের মতো ব্যবহার করেছে। আর এখন বিপদে পড়ে এমন গদগদভাবে কথা বলছে যেন আমি ওর চোদ্দ পুরুষের পরমাত্মীয়! কিন্তু প্রকাশ্যে জোরহাতে বলল: প্রভু, অভয় দিলে বলি। পিঙ্গলক: নির্ভয়ে বল।
দমনক: মহারাজ, মালিক যদি সব ভৃত্যের সঙ্গে সমান ব্যবহার করেন, গুণের কোনো তারতম্য না করেন, তাহলে গুণবান ভৃত্যেরা সেখানে থাকে কি করে? তাইতো এতদিন দূরে দূরে ছিলাম। কিন্তু আমরা হলাম বংশানুক্রমে আপনাদের গোলাম। তাই বিপদের সময় দূরে থাকি কি করে? দেখুন, না ডাকতেই যে প্রভুর বিপদে পাশে দাঁড়ায়, কিংবা প্রভুর ক্ষতিকর কিছু দেখলে আদেশের অপেক্ষা না করেই যে প্রতিবিধান করে, সে-ইতো প্রকৃত ভৃত্য।
পিঙ্গলক দমনকের মনের কথা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল: ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকেতো চিনিই। তা কি বলবে নির্ভয়ে বলে ফেল।
দমনক বলল: মহারাজ, গোপন কথা শুধু চার কানেই হতে হয়, ছয় কান হলে তা ফাঁস হয়ে যায়।
পিঙ্গলক দমনকের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সভাসদদের দিকে তাকাল এবং তারা সবাই চলে গেল। তখন দমনক বলল: মহারাজ, জল না খেয়েই ফিরে এলেন যে? ভৃত্যের নিকট ধরা পড়ে যাওয়ায় পিঙ্গলক লজ্জা পেল। প্রথমে কিছু বলতে পারল না। তারপর মুচকি হেসে বলল: ও কিছু না, এমনি।
দমনক বলল: মহারাজ, যদি আমাকে বলার মতো না হয় তাহলে থাক, কারণ মানুষের কিছু কথা গোপন রাখতে হয় স্ত্রীর কাছে, কিছু আত্মীয়-স্বজনের কাছে, কিছু বন্ধু—বান্ধবদের কাছে, কিছু ছেলে-মেয়েদের কাছে। আর কিছু কথা আছে যা বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা বলা ঠিক-কি-ঠিক-না ভালোভাবে বিবেচনা করে তবে বলেন।
পিঙ্গলক ভাবল: এ যথার্থই যোগ্য লোক। একে বলা যায়। তাই সে বলল: এ-বনে অদ্ভুত এক জন্তু এসেছে! বিকট তার আওয়াজ! যেমন আওয়াজ, তেমনই তার শক্তি! আমি আর এ বনে থাকব না!
দমনক বলল: মহারাজ, ডাক শুনেই ভয় পেলেন? জন্তুটা কি তা না জেনেই বাপ—পিতামো’র এই রাজত্ব ছেড়ে চলে যাবেন? কথায় বলে না ভয়ঙ্কর শত্রুর আক্রমণেও যে-রাজার ধৈর্য টলে না, তার পরাজয় নেই। দেখুন, ঘোর গ্রীষ্মে পুকুর শুকায়, কিন্তু সমুদ্র? সে আরও উত্তাল হয়। তাই বলছিলাম—ধৈর্য ধরুন, ভাল করে না জেনে কেবল শব্দ শুনেই পালাবেন না যেমন পালাতে চেয়েছিল দামামার শব্দে শেয়াল।
পিঙ্গলক: খুলে বলতো ব্যাপারটা!
দমনক: বলছি…