শেয়াল ও দামামা
এক বনে ছিল এক শেয়াল। খিদায় তার পিত্তি যাচ্ছিল জ্বলে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক বিকট শব্দ শুনতে পেল। তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। ভাবল এই শব্দ যে করছে, তার সামনে পড়লে আর রক্ষে নেই। চুলোয় যাক খাবার! জানটা আগে বাঁচাই। এই ভেবে কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। ভাবল কে শব্দ করছে তা না জেনে চোদ্দ পুরুষের ভিটে ছেড়ে পালাব! কিছুতেই নয়! মরতে হয় মরব, তার আগে জানব ও কে, এমন শব্দ করছে?
এই ভেবে সে পায়ে পায়ে ঐ শব্দের দিকে এগিয়ে গেল। দৃষ্টিসীমায় পৌঁছে তার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। আনন্দে মনটাও ভরে উঠল। দেখল, একটি দামামা পড়ে আছে। কিছুদিন আগে এখানে এক যুদ্ধ হয়েছিল। সৈন্যরা ফেলে গেছে। তার উপর বাতাসের ধাক্কায় গাছের ডাল পড়ে শব্দ হচ্ছিল। দুমাদুম। শেয়ালটি কাছে গিয়ে মনের আনন্দে দামামার ছাউনি চামড়া খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করল। ক্ষুধায় যখন প্রাণ যায়-যায়, তখন অখাদ্যও অমৃত মনে হয়।
দমনক বলল: প্রভু! তাই বলছিলাম—শুধু শব্দ শুনেই ভয় পাওয়া উচিত নয়। কথায় বলে না—
কারণ না জেনে পালায় যে।
মরার আগে মরে সে।।
পিঙ্গলক দ্বিধান্বিত চিত্তে বলল: বলছতো ভালো, কিন্তু দেখছ না, আমার লোকজন সব পালাই-পালাই করছে! আমি কি করে ধৈর্য ধরি!
দমনক: প্রভু, এদের আর দোষ কি? ভৃত্যরা প্রভুকেই অনুসরণ করে। শাস্ত্রে আছে না অস্ত্র শাস্ত্র নারী আর বীণা এরা যেমন লোকের হাতে পড়ে তেমন বাজে। তাই বলছি আপনি সাহসে ভর করে একটু অপেক্ষা করুন, আমি গিয়ে বৃত্তান্তটা জেনে আসি। পিঙ্গলক কম্পিত কণ্ঠে বলল: তুমি যাবে ঐ যমের কাছে?
দমনক সাহসের সঙ্গে দৃঢ় কণ্ঠে বলল: মহারাজ! ভৃত্য প্রভুর আদেশে সাপের মুখে পা দেবে, সমুদ্রে কিংবা আগুনে ঝাঁপ দেবে। তা না হলে কিসের ভৃত্য? এর অন্যথা হলে তাকে ছাড়িয়ে দিতে বিলম্ব করবেন কেন?
দমনকের কথায় পিঙ্গলক আশ্বস্ত হয়ে বলল, তবে যাও।
দমনক ‘তথাস্তু’ বলে পিঙ্গলককে অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল।
এদিকে পিঙ্গলক ভাবল, একে বিশ্বাস করে মনের কথা খুলে বলা উচিত হয়নি। কারণ, ওর আমি চাকরি খেয়েছি, সুযোগ পেয়ে ও হয়তো এখন আমার অনিষ্ট করতে চাইছে। একবার যারা রাজার কাছে সম্মান পেয়ে পরে অবমানিত হয়, তারা অভিজাত হলেও রাজাকে শেষ করতে চায়। তাছাড়া, যারা যাকে-তাকে বিশ্বাস করে, তারা সবল হলেও দুর্বলেরা তাদের সহজেই অনিষ্ট করতে পারে। আর যারা যাকে-তাকে বিশ্বাস করেনা, তারা দুর্বল হলেও সবলেরা তাদের অনিষ্ট করতে পারেনা। বিশ্বাস ছাড়া দেবতারা পর্যন্ত শত্রুকে ধ্বংস করতে পারেনা। তাই বিচক্ষণ ব্যক্তি সুখ-সমৃদ্ধি কামনায় দেবগুরু বৃহস্পতিকেও বিশ্বাস করেনা। এসব ভেবে পিঙ্গলক আত্মগোপন করে দমনকের আগমন প্রতীক্ষা করতে লাগল।
এদিকে দমনক যমুনার তীরে সঞ্জীবককে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মনে মনে বলল ওঃ, ষাঁড়! ভালই হলো, এক ঢিলে দুই পাখি মারব। প্রথমে দুজনের মধ্যে সন্ধি করিয়ে পরে বিচ্ছেদ ঘটাব। তবেই পিঙ্গলক সুড়সুড় করে আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। রাজা কি সহজেই মন্ত্রীর কথা শুনতে চায়? শোনে বিপদে পড়লে। কথায় বলেনা—
রোগ নাই যার কি প্রয়োজন ডাক্তার।
নিরাপদ রাজার মন্ত্রীর কি দরকার।।
তাই এই সুযোগে অপমানের প্রতিশোধ নেব। এই ভেবে দমনক সঞ্জীবকের কাছে আর না গিয়ে পিঙ্গলকের দিকে ফিরে চলল।
এদিকে পিঙ্গলক গভীর আগ্রহের সঙ্গে দমনকের প্রতীক্ষায় ছিল। দমনক কাছে গিয়ে প্রণাম করে পাশে বসল। পিঙ্গলক বলল: জন্তুটাকে দেখলে?
দমনক: মহারাজের অনুগ্রহে কি না সম্ভব?
পিঙ্গলক: সত্যি বলছতো?
দমনক: মহারাজ! আপনার সামনে মিথ্যে বলব সে সাধ্য কোথায়? মনু বলেছেন না রাজা আর দেবতা সমান হলেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। দেবতা ভালোমন্দ কাজের ফল দেন পরজন্মে, আর রাজা দেন হাতে-হাতে।
দমনকের যুক্তিকে অগ্রাহ্য করতে না পেরে পিঙ্গলক বলল: মানছি, তুমি গিয়েছিলে, তবে ফিরে যে এসেছ, সে তারই উদারতায়, কারণ বড়োরা সামান্য লোকের উপর রাগ করেন না। দেখনা, প্রচণ্ড ঝড় মাটিতে নুয়ে পড়া তৃণকে ছোঁয়না, কিন্তু বৃক্ষকে ভূপাতিত করে।
পিঙ্গলকের কথায় দমনক ভীষণভাবে আহত হয় এবং তার প্রতিশোধস্পৃহাও বেড়ে যায়। কিন্তু সে-ভাব গোপন রেখে সে বলে: মহারাজের কথাই সই। তার কাছে আমি কিছুই না। তবে আপনি চাইলে আমি তাকে আপনার চাকর করে দিতে পারি। পিঙ্গলক সাগ্রহে বলল: পারবে?
দমনক: মহারাজ! বুদ্ধিবলে কি না হয়? দেখুন না
বড়ো বড়ো হাতি-ঘোড়া কত শক্তিমান।
বুদ্ধিবলে বশে তাকে মানব সন্তান।।
পিঙ্গলক সাদরে দমনকের হাত চেপে ধরে বলল: তবে তাই হোক! আজই তোমার চাকরি ফিরিয়ে দিলাম। এখন থেকে আমার ভালোমন্দ সব তোমার হাতে। এর অন্যথা হবেনা।
দমনক ‘যথাজ্ঞা’ বলে কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধি লাভের আশায় মহানন্দে পুনরায় ছুটে চলল যমুনার তীরে। সঞ্জীবককে ধমক দিয়ে বলল: এই বেটা! কচি-কচি ঘাস খেয়ে গায়ে চর্বি হয়েছে! খামোখা গাঁক্ গাঁক্ শব্দ করছিস! তোর কি প্রাণের মায়া নেই? জানিস এটা কার রাজত্ব?
সঞ্জীবক সভয়ে বলল: কার?
দমনক: রাজা পিঙ্গলকের। পশুরাজ সিংহ। ঐতো মহারাজ বসে আছেন সিংহাসনে। তাকে ঘিরে আছে সব সাঙ্গোপাঙ্গ। অজানা শব্দ শুনে আমায় পাঠিয়েছেন তোকে ধরে নিয়ে যেতে। চল।
দমনকের কথা শুনে সঞ্জীবকের পিলে গেল চমকে। এমন নিশ্চিন্ত জীবনে একি উৎপাত এসে জুটল! কম্পিত কণ্ঠে সে দমনককে বলল: ভাই! তোমাকে দেখেতো সজ্জনই মনে হচ্ছে। একটা ব্যবস্থা করে দাওনা যাতে প্রভু আমার প্রতি সদয় হন।
দমনক ভাবল: ওষুধ গিলেছে। আমার বাসনা পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে বলল: তা তুমি এখানেই থাক। প্রভুর সঙ্গে কথা বলে সময়মতো আমি তোমায় নিয়ে যাব।
এই বলে দমনক পিঙ্গলকের কাছে গিয়ে সভয়ে বলল: মহারাজ! এ স্বয়ং শিবের বাহন নন্দী। বলে কি-না—মহাদেব তাকে বলেছেন, এই বন তোর খেলার মাঠ, যথেচ্ছ ঘুরে বেড়া আর যমুনার তীরে চরে বেড়া।
পিঙ্গলক মাথা নেড়ে বলল: তা-ই হবে। তা নাহলে এক সামান্য ঘাসখেকো দেবতার অনুগ্রহ ছাড়া এই গভীর অরণ্যে একাকী ঘুরে বেড়াতে পারে? তা তুমি কি বললে? দমনক: মহারাজ! আপনিই বা কম কিসে? আমি বললাম: এ বন হচ্ছে চণ্ডীদেবীর বাহন পিঙ্গলকের, যার কথায় ঝরা পাতা বোঁটায় জোড়া লাগে। আপনি আমাদের অতিথি। তাই চলুন, মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভাইয়ের মতো যদ্দিন ইচ্ছা থাকবেন; পানাহার করবেন।
পিঙ্গলক সাগ্রহে জানতে চাইল: কি বললে?
দমনক: কি আর বলবে? বলল, মহারাজ যাতে প্রসন্ন হন, তার ব্যবস্থা তোমায় করে দিতে হবে, ভাই!
আমি তাকে আশ্বস্ত করে আপনার কাছে ফিরে এলাম। এখন আপনার মর্জি।
পিঙ্গলক দমনকের হাত চেপে ধরে বলল: তুমি আমায় বাঁচালে! তেষ্টায় আমার প্রাণ যায়! তোমার মতো বিশ্বস্ত লোককে তাড়িয়ে দিয়ে আমি বড্ড ভুল করেছিলাম। আজ তার মাশুল দিচ্ছি। আমি তাকে অভয় দিলাম। তুমিও আমার জন্য তার অভয় চেয়ে নিয়ে তাকে শিগগির এখানে নিয়ে এস। আজ আমি বুঝলাম—শক্ত-সমর্থ-সরল স্তম্ভ যেমন বাড়ির ছাদটাকে ধরে রাখে, তেমনি সৎ, অকুটিল এবং রাজভক্ত কর্মচারীও গোটা রাজ্যের ভার বহন করে।
পিঙ্গলকের কথায় দমনক তো মহাখুশি! তাকে আর পায় কে? মহারাজ এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন। তার পরামর্শ শুনতেও প্রস্তুত। তার মতো ভাগ্যবান আর কে? তাই মনের আনন্দে সে সঞ্জীবকের দিকে যাচ্ছে আর ভাবছে—
শীতে আগুন অমৃত আর অমৃত রাজসম্মান।
সুন্দর চেহারা অমৃত আর অমৃত দুগ্ধপান।।
একথা ভাবতে ভাবতে সে সঞ্জীবকের কাছে গিয়ে খুব বিনম্রভাবে বলল: বন্ধু! অনেক কষ্টে মহারাজকে রাজি করিয়েছি। তুমি এবার নিশ্চিন্তে তার কাছে যাও। তবে মনে রেখ, আরাম পেয়ে যেন আবার আমায় ভুলে যেও না। ওরা রাজার জাত। মতিগতির ঠিক নেই। যা করি দুজনে পরামর্শ করে করব। আমি মন্ত্রী হয়ে তোমার পরামর্শ নিয়ে রাজ্য চালাব। তাহলে নিশ্চিন্তে আমরা রাজ্যশ্রী ভোগ করতে পারব। শিকারে গিয়ে যেমন একজন পশুদের তাড়া করে, অন্যজন শিকার করে, আমরাও তেমনি একজন প্রজাদের তাড়া দেব, অন্যজন মারব। তাহলে আমাদের আর বিপদ থাকবে না। আর একটি কথা মনে রেখ। রাজার কাছে ছোট-বড় অনেকেই থাকে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও স্বার্থোদ্ধারের জন্য তাদের সম্মান করতে হয়; অভিমানবশত যে তা না করে সে হোমরাচোমরা হওয়া সত্ত্বেও অধিকার হারায়, যেমন হারিয়েছিল দন্তিল।
সঞ্জীবক: কি হয়েছিল দন্তিলের?
দমনক: শুনবে? তবে শোন…