দন্তিল ও গোরম্ভ
পুরাকালে বর্ধমান নামে এক নগর ছিল। সেখানে বাস করত এক কারবারি—দন্তিল। নানা পণ্যের কারবার ছিল তার। চতুর কারবারি শ্যামও রাখত, কুলও রাখত; অর্থাৎ সুকৌশলে সে রাজা এবং নগরবাসী উভয়কেই খুশি রাখত। তাই সকলেই তাকে পছন্দ করত। সে জানত যে কেবল রাজার মঙ্গল করে, লোকে তাকে কুনজরে দেখে; আবার যে কেবল দেশের মঙ্গল করে, রাজা তাকে ত্যাগ করে; আর সে-ই বুদ্ধিমান যে উভয়কে খুশি করে।
এভাবে সুখেই কাটছিল তার দিন। একদিন এল সেই অলক্ষুণে কাল। সেদিন ছিল দন্তিলের বিয়ে। বাড়ি-ভরা আত্মীয়-স্বজন। রাজা-রানিসহ গোটা রাজবাড়িটাই যেন তার বাড়িতে। খাচ্ছে-দাচ্ছে আর তারই দেয়া পোশাক-পরিচ্ছদ পরে সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজার বাড়ির এক ঝাড়ুদার, গোরম্ভ, সেও এসেছে। আসবেইতো, মানাতো নেই। কিন্তু সে গিয়ে বসল একেবারে এমন জায়গায় যেখানে তার বসার কথা নয়। দেখে দন্তিলের পিত্তি গেল জ্বলে। ধৈর্য ধরা আর সম্ভব হলো না। সামান্য ঝাড়ুদারের এত সাহস! দিল গলা ধাক্কা একেবারে বাড়ির বাইরে। আর যায় কোথা? দন্তিলের ভাগ্যতরী ডুবল!
এদিকে হাজার লোকের সামনে গলা ধাক্কা খেয়ে প্রতিশোধ স্পৃহায় ফুঁসতে লাগল গোরম্ভ। আঁতে ঘা লাগলে গোখরো থাক দূরের কথা, ঢেঁাড়াও ঘুরে দাঁড়ায়। তাই ফন্দি আঁটছে গোরম্ভ—কিভাবে এই অপমান শতগুণে ফিরিয়ে দেয়া যায়। আহার-নিদ্রা প্রায় বর্জিত। শরীর শুকিয়ে কাঠ। এক সময় হতাশ হয়ে ভাবল—স্বয়ং রাজার যে প্রিয়জন, তার অনিষ্ট করা কি সহজ কাজ? কারো অনিষ্ট করার ক্ষমতা যার নেই, তার রাগ করা শোভা পায়না; ছোলার দানা যতই লাফালাফি করুক, তাওয়া ভাঙা কি তার পক্ষে সম্ভব?
কিন্তু দেহের ক্ষত যেমন শুকায় না, তেমনি মনের ক্ষতও যায় না। তাই গোরম্ভ হাল না ছেড়ে সুযোগ খুঁজতে লাগল। একদিন এসে যায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেদিন ভোরবেলা রাজার ঘুমটা পাতলা হয়ে এসেছে। পালঙ্কের পাশ দিয়ে সে ঝাড়ু দিচ্ছিল। হঠাৎ বলে উঠল—ইস! কি আস্পর্ধা ঐ দন্তিলের! রানিকে ধরে আলিঙ্গন!
রাজা ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন: কি বললে, গোরম্ভ? সত্যি?
গোরম্ভ চমকে ওঠার মতো ভাব করে বলল: ‘মাফ করবেন, হুজুর! সারারাত জেগে জুয়ো খেলেছিতো, তাই ঘুমের ঘোরে কি বলেছি খেয়াল নেই।’ এই বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।
কিন্তু রাজার মনে সাপ ঢুকে অনবরত দংশন করতে লাগল। তিনি ভাবলেন গোরম্ভ আর দন্তিল উভয়েরই অন্তঃপুরে অবাধ যাতায়াত। গোরম্ভ নিশ্চয়ই দিনের বেলা কখনো দেখেছে দন্তিল রানিকে আলিঙ্গন করছে, তাই রাতের বেলা ঘুমের ঘোরে তা কেবলই ওর মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। আর মানুষের গোপন কথা জানা যায় ঘুমের ঘোরে কিংবা নেশার ঘোরে তার কথা থেকে। আর স্ত্রীচরিত্র! সেতো অকূল দরিয়া! তারা কথা বলে একজনের সঙ্গে, তাকায় আর একজনের দিকে এবং ভাবে আর একজনের কথা। তারাতো আগুন কিংবা সাগরের মতো—যতই কাঠ দাও ততই জ্বলে কিংবা হাজার নদী মিশলেও উদর পূর্তি হয়না। তাদের সতীত্ব নির্ভর করে গোপন স্থান, সুযোগ আর প্রার্থীর অভাবের উপর।
এমনি সব ভাবতে ভাবতে রাজার মেজাজ গেল বিগড়ে। তিনি দন্তিলের উপর বেজায় ক্ষেপে রাজবাড়িতে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেন। দন্তিল শুনেতো মাথায় হাত! হঠাৎ কি হলো যে রাজা তার উপর এমন ক্ষেপে গেলেন! অনেক ভেবেও কোনো কারণ খুঁজে পেলনা। পরে আক্ষেপ করে বলল: সাদা কাক, সত্যবাদী জুয়াড়ি, সাপের ক্ষমা, কামনার প্রশান্তি, ক্লীবের ধৈর্য, মাতালের তত্ত্বচিন্তা আর রাজার বন্ধুত্ব—এ-কি কেউ কখনো দেখেছে না শুনেছে? রাজার কোনো প্রিয় পাত্র নেই। আমিতো জ্ঞানত রাজার কোনো অমঙ্গল করিনি; তার ভালো বৈ মন্দ করিনি। তাহলে কেন তিনি আমার উপর এমন বেজার হলেন?
এরূপ ভাবতে ভাবতে দন্তিল অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার শরীর ভেঙ্গে গেল। ব্যবসা—বাণিজ্য লাটে উঠল। অবশেষে একদিন সাহসে ভর করে সে রাজবাড়িতে গেল কারণটা জানার জন্য। কিন্তু দারোয়ান তাকে সিংহদ্বারে আটকে দিল। সেখানে উপস্থিত ছিল গোরম্ভ। সে মুচকি হেসে দারোয়ানকে বলল: করছ কি! রাজার প্রিয়পাত্র যে! অমান্য করলে চাকরি যাবে।
গোরম্ভের কথা শুনে দন্তিল বুঝতে পারল—সেদিনের অপমানের শোধ নিয়েছে দন্তিল। এ তারই কাজ। এখন একে শান্ত করা ছাড়া আর উপায় নেই। তাই তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল: ‘আমার ভুল হয়েছে, ভাই! রাতের বেলা তুমি বাড়ি এস।’ বাড়ি গেলে দন্তিল তাকে উত্তম ভোজে আপ্যায়িত করে নববস্ত্র ও দক্ষিণা দিয়ে তুষ্ট করল। যাওয়ার সময় গোরম্ভ বলে গেল: ‘যে সাপ তোমায় দংশন করেছে, এবার দেখ, আমার বুদ্ধির জোরে সেই সাপই তোমার বিষ তুলে নেবে।’ গোরম্ভ চলে যাওয়ার পর দন্তিল মনে মনে বলল:
দাঁড়িপাল্লার দাঁড়ি আর দুষ্ট লোকের ব্যবহার।
দুইই সমান—অল্পে ওঠে অল্পে নামে আবার।।
এদিকে দন্তিলের নিকট থেকে উপঢৌকন পেয়ে গোরম্ভ তার প্রতিশ্রুত কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ খুঁজতে লাগল। একদিন এসেও যায় সে সুযোগ। ভোরবেলা রাজা চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে আছেন। গোরম্ভ ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। হঠাৎ সে বিড়বিড় করে বলে উঠল: ‘ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! রাজা হয়ে কি-না চাকরানির কাপড় ধরে টানাটানি করে! এরকম হলে রাজবাড়িতে আর পরস্ত্রীর নিরাপত্তা কোথায়?’
রাজা শুনে লাফ দিয়ে উঠে কান ধরে টেনে তুললেন। ‘হারামজাদা! কি বললি?’
গোরম্ভ করজোড়ে বলল: পায়ে পড়ি, হুজুর! রাতে নেশাটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল; তাই মাথার ঠিক নেই। এবারকার মতো মাফ করে দিন।
রাজা বললেন: ‘আর এরকম হলে শুধু চাকরি নয়, জানটাও যাবে।’ গোরম্ভ ‘যে আজ্ঞে’ বলে বেরিয়ে গেল। রাজা তখন ভাবলেন: ‘সেদিন এই নেশাখোর জুয়াড়ির কথায় বিশ্বাস করে দন্তিলের প্রতি আমি অন্যায় করেছি। এর প্রতিকার করা উচিত।’ এই বলে সেদিনই তিনি দন্তিলকে ডেকে পাঠান।
এরপর দমনক সঞ্জীবককে উদ্দেশ করে বলল: তাই বলছিলাম— রাজার লোককে কক্খনো অবহেলা করতে নেই, হোক সে মুখ্য কিংবা গৌণ।
সঞ্জীবকও তার কথায় সায় দিয়ে বলল: ‘যথার্থই বলেছ, বন্ধু। আমি তোমার কথামতোই চলব; এর অন্যথা হবেনা।’ অতঃপর দুজনে পিঙ্গলকের কাছ গেল। পিঙ্গলক ও সঞ্জীবক উভয়ের কুশল বিনিময়ের পর পিঙ্গলক বলল: ‘তোমার কোনো ভয় নেই, বন্ধু। তুমি নিশ্চিন্তে এখানে থাকতে পার। তবে মনে রেখ, এখানে সব মাংসভোজী পশুদের বাস, তার মধ্যে একা তুমি তৃণভোজী। তাই সব সময় আমার কাছাকাছি থাকবে, নইলে বিপদ হতে পারে।’ এই বলে পিঙ্গলক দলবল নিয়ে যমুনার শীতল জলে প্রাণ জুড়িয়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল।
যতই দিন যেতে লাগল পিঙ্গলক ও সঞ্জীবকের বন্ধুত্ব ততই ঘনিষ্ঠতর হতে লাগল। এক সময় দমনককে প্রধানমন্ত্রীর পদে উন্নীত করা হলো। সুযোগ বুঝে দমনক ভাই করটককেও চাকরি দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এল। পিঙ্গলক সঞ্জীবকের ব্যবহারে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়ল যে, দুজনের কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারছেনা। এক পর্যায়ে পিঙ্গলক সঞ্জীবককে বয়স্যের চাকরি দিয়ে একেবারে নিজের কাছেই রেখে দিল। রাজকার্যের প্রতি পিঙ্গলকের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এক সময় দমনক ও করটকের উপর রাজ্যভার ছেড়ে দিয়ে তারা দুজনে একান্ত আলাপে মশগুল হয়ে পড়ল। অন্য পশুদেরতো কথাই নেই, স্বয়ং দমনকেরও তাদের কাছে যাওয়ার অনুমতি ছিলনা। এতে তারা ক্ষুব্ধ হলো। শুধু তারাই নয়, ক্ষুব্ধ হলো সকলে, কারণ কারো খাবার জুটছিলনা মহারাজের অনুমতি ছাড়া কেউ কিছু করতেও পারে না। তাই তারা না খেয়ে মারা যাচ্ছিল। অনেকেই পিঙ্গলকের চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। যাবেই বা না কেন? বিনা বেতনে আর কে কতদিন চাকরি করে? তাছাড়া মড়া গাছে যেমন পাখি থাকেনা, তেমনি যে রাজার কাছে কিছু পাওয়ার নেই, তার কাছেও কেউ থাকেনা।
এমতাবস্থায় করটর একদিন দমনককে বলল: ভাই, তুমি যেহেতু প্রধানমন্ত্রী, সেহেতু রাজাকে তোমার কিছু বলা উচিত, তা নাহলে তুমি দোষের ভাগী হবে। শাস্ত্রে বলে না
রাজা কর্ণপাত না করলেও মন্ত্রীদের বলতে হয়, যাতে নিজের উপর দোষ না চাপে, যেমন বিদুর বলতেন ধৃতরাষ্ট্রকে। তাছাড়া মদমত্ত রাজা আর হাতি যখন বিপথে হাটে, তখন দোষ হয় মন্ত্রী আর মাহুতের। আর এই ঘাসখেকোটাকেতো তুমিই এনেছ! নিজের জ্বালানো আগুনে এবার নিজের ঘরই পুড়ছে!
দমনকের নিজের উপর ভীষণ রাগ হলো। সে বলল: ষাঁড়টাকে এত করে বোঝালাম, কিন্তু কাজ হলোনা; রাজার ছায়া পেয়ে আমার কাছ থেকে সরে পড়ল! আর প্রভু ও তাতে মজে গেল! যার ভয়ে তেষ্টা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, আমায় ভুলে এখন তাকে নিয়ে মেতে আছে! আসলে দোষটা আমারই, প্রভুর নয়! কথায় বলে :
শেয়াল মরল রক্তলোভে গুরু শিষ্যবেশে।
দূতী মরল পরের কাজে সবই নিজের দোষে।।
করটক: কি সে ঘটনা? খুলে বল।
দমনক: বলছি, শোন…