শেয়াল গুরু ও দূতী
এক নির্জন জায়গায় ছিল এক পোড়ো মন্দির। সেখানে বাস করতেন এক গুরু-ঠাকুর। তিনকুলে তাঁর কেউ ছিলনা—কিছু শিষ্য আর যজমান ছাড়া। মন্দিরে আগত পুণ্যার্থীরা যা প্রণামী দিত, তা তিনি গোপনে জমাতেন। দেখতে দেখতে তার পরিমাণটা হয়ে উঠল লোভনীয়। গুরুর মতি-গতিরও পরিবর্তন ঘটল। মানুষের প্রতি তাঁর অবিশ্বাস জন্মিল। তাই টাকার পুঁটলিটা তিনি কখনোই বগলচ্যুত করতেন না। একি যন্ত্রণা! সাধে কি আর বলে—টাকা আয় করা কষ্ট, রক্ষা করা কষ্ট, ব্যয় করা কষ্ট কেবল কষ্ট, কষ্ট আর কষ্ট! তারপরও মানুষ এর পেছনেই ছোটে অন্ধের মতো! সংসার বিবাগী গুরুও ছুটছেন।
কিন্তু চোরের উপরেও যে বাটপার আছে, সে-কথা গুরু-ঠাকুর বুঝতে পারেন নি! তাই একদিন আষাঢ়ভূতি নামে এক জোচ্চোর টাকাটা দেখে ফেলল। কিন্তু সমস্যা হলো গুরুতো ওটা কিছুতেই বগলছাড়া করছেন না। মন্দিরের দেয়ালও পাশ্, তাই সিঁধ কাটারও উপায় নেই। কিন্তু ওটা যে তার চাই-ই।
আষাঢ়ভূতি উপায় খুঁজতে থাকে। শেষে একদিন ঠিক করে যেভাবেই হোক, গুরুর বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। তাঁকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাঁর শিষ্য হতে হবে। পণ্ডিতেরাইতো বলেন—নির্লোভ হলে উচ্চপদ পাওয়া যায়না, চতুর না হলে কারো প্রিয় হওয়া যায়না, আর সত্যি কথা বলে কখনো ঠগ-জোচ্চোর হওয়া যায়না।
এরূপ চিন্তা করে আষাঢ়ভূতি একদিন ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ বলে গুরুকে সাষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করল। গুরুও ‘আয়ুষ্মান্ ভব’ বলে তাকে আশীর্বাদ করলেন। এই প্রশ্রয়টুকু পেয়েই আষাঢ়ভূতি গদগদভাবে বলল: গুরুদেব, অসার এ সংসার! যৌবন যেন পাহাড়ী নদীর বেগ, খানিক পরেই শান্ত! জীবনটা যেন খড়ের আগুন, নিমেষেই ছাই! আনন্দ-ফূর্তি যেন শরৎকালের মেঘ, দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়! দারা-পুত্র-পরিবার—সবই যেন নিশার স্বপন, চেতন ফিরলে আর নেই! আমি সব বুঝতে পেরেছি! আমার আর ভালো লাগেনা! আপনি আমার মুক্তির পথ দেখান!
শেয়ালের মিষ্টি কথায় যেমন কাক ভুলেছিল, তেমনি আষাঢ়ভূতির কথায় গুরুও মজে গেলেন। বিস্ময়াবেশে তিনি বললেন: চমৎকার! যৌবনেই যার এমন বৈরাগ্য, সে-ইতো ধন্য! শাস্ত্র বলছে :
যৌবনে যে এমন শান্ত সে-ই শান্ত সুনিশ্চয়।
ধাতু ক্ষীণ হইলে বলো কে-ই বা না শান্ত হয়।।
তাছাড়া সজ্জন প্রথমে মনেই বৃদ্ধ হন, পরে দেহে; কিন্তু দুর্জন কেবল দেহেই বৃদ্ধ হয়, মনে কখনোই নয়। তুমি সজ্জন। মহাদেবের কৃপা তুমি পাবেই।
গুরুর কথা শুনে আষাঢ়ভূতি ছুটে গিয়ে তাঁর পা জড়িয়ে ধরে। বলে: আপনি আমায় দীক্ষা দিন।
গুরু আর না করতে পারলেন না। রাজি হয়ে গেলেন। তবে অন্তরের কোণে সন্দেহের দানাটুকু রয়েই গেল। তাই আষাঢ়ভূতিকে বললেন: একটি শর্ত—রাতের বেলা তুমি আমার ঘরে ঢুকতে পারবে না। বাইরের ঐ কুঁড়েঘরে থাকবে। কারণ সন্ন্যাসীদের একা থাকাই ভালো—তোমারও, আমারও। দেখ, শাস্ত্র বলছে:
রাজা নষ্ট কুমন্ত্রণায়, সাধু নষ্ট মেলামেশায়।
ব্রাহ্মণ নষ্ট বেদ ছাড়লে, ছেলে আদিখ্যেতায় ॥
বংশ নষ্ট কুলাঙ্গারে, স্বভাব নষ্ট দুষ্ট-সেবায়।
অভদ্রতায় ভাব নষ্ট, বিষয় নষ্ট অবহেলায় ॥
স্নেহ নষ্ট দূরবাসে, অহঙ্কারে মেয়ে নষ্ট।
টাকা নষ্ট অতিব্যয়ে, অযতনে কৃষি নষ্ট ॥
আষাঢ়ভূতি আরো জোরে পা জড়িয়ে ধরে সোৎসাহে বলল: গুরুদেব! আপনি আমায় দীক্ষা দেবেন এটাই আমার পরম পাওয়া! আহার-নিদ্রা কোনো ব্যাপার নয়!
অতঃপর গুরু প্রীত হয়ে যথাশাস্ত্র তাকে শিষ্য করে নিলেন।
এভাবে দিন যায়, মাস যায়। আষাঢ়ভূতি পরম যত্নে গুরুর হাত-পা টিপে দেয়। এতে গুরু মহাসন্তুষ্ট হন। কিন্তু টাকার পুঁটলিটা বগলছাড়া করেন না। তাই মনে মনে আষাঢ়ভূতি ভীষণ অধৈর্য হয়ে পড়ে। তার কি এভাবেই জীবন কাটবে! এতো তার কাম্য নয়! একবার ভাবে—বেটাকে শেষ করে দিয়ে পুঁটলিটা নিয়ে নিলেইতো হয়! এমন সময় একটি সুবর্ণ সুযোগ আসে। ভিন গাঁয়ের এক শিষ্য আসে নিমন্ত্রণ নিয়ে। তার ছেলের অন্নপ্রাশনে গুরুকে যেতেই হবে। ভুরিভোজ এবং উপরি পাওনার আশায় গুরুও সানন্দে রাজি হয়ে যান। যথাসময়ে আষাঢ়ভূতিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শিষ্যবাড়ি যাত্রা করেন। পথে পড়ে একটি নদী। গুরু বললেন: বৎস, স্রোতস্বিনীতে স্নানটা সেরে নেই। ততক্ষণে তুমি মহেশ্বরের এই কন্থাটি সযত্নে রক্ষা কর। এর কোনো ক্ষতি হলে তিনি রুষ্ট হবেন। তাতে উভয়েরই অমঙ্গল!
এই বলে গুরুদেব টাকার পুঁটলিসহ যাবতীয় জিনিসপত্র একটি কাঁথায় মুড়ে আষাঢ়ভূতিকে দিয়ে নদীর দিকে যাত্রা করলেন। আষাঢ়ভূতিও ‘যথাজ্ঞা’ বলে দুহাত বাড়িয়ে সেটি নিয়ে পথের পাশে একটি গাছের নীচে বসে পড়ল। নদীর পথে একটি ছোট ঝোঁপ-ঝাড় পড়ে। গুরু এক সময় তাতে অদৃশ্য হয়ে যান। স্নান সেরে তীরে উঠে দেখেন একদল মেষ চরে বেড়াচ্ছে এবং দুটি শিংওয়ালা মেষ সজোরে পরস্পরের কপালে ঢুঁ মারছে। তাতে কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। পাশেই ছিল এক ক্ষুধার্ত শৃগাল। সে আর লোভ সামলাতে পারলা না। চুঁসাটুসির মধ্যেই চেটে চেটে গরম তাজা রক্ত খেতে লাগল। হঠাৎ দুদিক থেকে মেষদুটি এসে আঘাত করায় শেয়ালটা অক্কা পেল। গুরু মনে মনে বললেন: লোভের তরী ওকে ভবনদী পার করে দিল!
শেয়ালটার জন্য দুঃখ করতে করতে গুরু ফিরে এসে দেখেন—আর সবই আছে, নেই কেবল আষাঢ়ভূতি আর তাঁর টাকার পুঁটলিটা। তিনি বিলাপ করতে করতে বললেন: আষাঢ়ভূতি! আমার এত কষ্টের সঞ্চয় শেষ পর্যন্ত নিয়ে পালালে! এই তোমার গুরুসেবা!
আর কি করার আছে? বেলাও পড়ে আসছে। অগত্যা আষাঢ়ভূতির পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে তিনি এগুতে লাগলেন। কিছুদূর যেতেই সন্ধ্যে হয়ে এল। অজানা জায়গা! কোথায় যাবেন তিনি? কোথায়ই বা রাত কাটাবেন? এমন সময় দেখতে পেলেন— এক তাঁতি সস্ত্রীক যাচ্ছে মদের ভাঁটিতে। গুরু তার উদ্দেশে বললেন: আমি পরদেশী। তোমার অতিথি হতে চাই। অতিথি সৎকার পরম ধর্ম। শাস্ত্রে আছে—সূর্যাস্তের অতিথির সেবা করলে গৃহস্থের শতযজ্ঞের ফললাভ হয়।
তাঁতি গুরুর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে স্ত্রীকে বলল: ইনি আমাদের অতিথি। অতিথি নারায়ণ। তুই এঁকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে আদর-যত্ন কর। আমি তোর জন্য বারুণি নিয়ে আসব।
তাঁতিবৌ এ-কথায় মহা খুশি হয়ে গুরুকে নিয়ে বাড়ি গেল। তার খুশির কারণ তাঁতি আজ রাতে আর ঘরে ফিরবে না। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে ভাঁটিখানায়ই পড়ে থাকবে। তাই প্রেমিক দেবদত্তের সঙ্গে রাতটা তার ভালোই কাটবে। কথায় বলে:
বাদল দিন, ঘন আঁধার
রাজপথে চলা ভার।
পতি যাচ্ছে দূরদেশে
মন্দ মেয়ে সুখে ভাসে ॥
কিংবা—
কুল-হারানো লোকনিন্দা বন্দীদশা জীবন ক্ষয়।
সব সইতে রাজি যার পরপুরুষে প্রণয় রয় ॥
তাই তাঁতিবৌ কোনোরকমে গুরুর জন্য আহার-নিদ্রার ব্যবস্থা করে সেজে-গুজে অভিসারে যাত্রা করল। কিন্তু বিধি বাম! টলতে টলতে তাঁতি আজ তাড়াতাড়িই ফিরে এল। তাকে দেখামাত্র বিদ্যুৎ-বেগে তাঁতিবৌ ঘরে এসে সাজ-গোজ খুলে ফেলল। কিন্তু তাঁতির চোখ এড়াতে পারল না। সে চুলের মুঠি ধরে জিজ্ঞেস করল: পাপিষ্ঠা! কোথায় যাচ্ছিলি? এতদিন লোকের কানাঘুষোয় বিশ্বাস করিনি। আজ নিজের চোখে দেখলাম। বল! কার কাছে যাচ্ছিলি? কে তোর নাগর?
তাঁতিবৌ ঝামটা মেরে বলল: কি সব আবোল-তাবোল বকছ? মদে তোমার মাথা ঠিক নেই। আমি আবার যাব কোথায়? তোমার পথ চেয়েইতো বসে ছিলাম।
স্ত্রীর মিথ্যা কথা শুনে তাঁতির মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে অগ্নিকণ্ঠে বলল: হারামজাদি! পাপিষ্ঠা! অনাচার করে আবার মিথ্যে বলছিস! তোর পাপের ফল ষোলআনা পেকেছে! আজ তোকে খাওয়াবই!
এই বলে লাঠিপেটা করে তার সর্বাঙ্গ ফুলিয়ে দিল। অতঃপর ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে সে আবার টলতে টলতে পড়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে নাপিতবৌ এসে বলল: সই, সেই কখন থেকে দেবদত্ত অপেক্ষা করছে! তাঁতিবৌ: আমি কি করব, সই? দেখনা, মিনসে আমায় মেরে কি করেছে! তারপর আবার বেঁধে রেখেছে! আমার বোধ হয় আর তার দেখা হলো না-রে!
নাপিতবৌ: এই নে, আমি তোর বাঁধন খুলে দিচ্ছি, তুই যা।
তাঁতিবৌ: কি করে যাব? দেখছিস না, মিনসে পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে! জেগে উঠে আমায় না দেখলেতো মেরে ফেলবে!
নাপিতবৌ: আচ্ছা, তোর জায়গায় আমি আছি। তুই আমায় বেঁধে রেখে যা। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।
কথামতো কাজ হলো। তাঁতিবৌয়ের জায়গায় নাপিতবৌ নিজেকে বেঁধে রেখে সইকে নাগরের কাছে পাঠালো। এদিকে তাঁতির মদের নেশা কিছুটা হালকা হলে সে স্ত্রীর উদ্দেশে বলতে লাগল: ওরে মুখপুড়ি! প্রতিজ্ঞা কর আজ থেকে আর বাড়ির বাইরে যাবি না। আর আমার সঙ্গে খর্খর্ করে কথা বলবি না। তাহলে ছেড়ে দেব। নাপিতবৌ ভয়ে চমকে উঠল। সর্বনাশ! এই মরার পো যদি সত্যিই জেগে ওঠে তো রক্ষে নেই! মান আর জান উভয়ই যাবে। আবার কথা বললেও বিপদ! গলার আওয়াজে ধরা পড়ে যাব! তাই চুপ থাকাই ভালো। দেখি কি হয়!
তাঁতি কিন্তু কথার উত্তর না পেয়ে খেপে গেল। সে অপমানিত বোধ করে বলল: অন্যায় করে আবার চুপ করে আছিস! তোর সাহসতো কম নয়, হতচ্ছাড়ি! দেখাচ্ছি মজা! এই বলে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে এসে ছুরির এক হ্যাচকা টানে দিল নাপিতবৌর নাক কেটে। ঝরঝর করে রক্ত পড়ে ভিজে গেল মাটি। তাঁতি আবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল এদিকে তাঁতিবৌ মনের ক্ষুধা মিটিয়ে হাসতে-হাসতে, নাচতে-নাচতে বাড়ি ফিরল । সইকে জিজ্ঞেস করল: সব ঠিকঠাক আছে তো? মিনসে আবার কিছু করেনি তো? নাপিতবৌ ত্রস্ত কণ্ঠে বলল: নাক বাদে আর সবই ঠিক আছে!
তাঁতিবৌ কাছে এসে সইয়ের নাক কাটা দেখে ভীষণ কষ্ট পেল। বলল: পরজনমে আমি তোর বাঁদি হয়ে এ ঋণ শোধ করব, সই!
নাপিতবৌ: সে হবে, এখন আমার বাঁধন খুলে দে দিকিনি। আমি বাড়ি যাই। নইলে নাক তো গেছেই, জানটাও যাবে! অতঃপর তাঁতিবৌ দ্রুত তার বাঁধন খুলে দিল এবং নাপিতবৌ তাঁতিবৌকে আবার আগের মতো বেঁধে রেখে নিজের বাড়ি চলে গেল।
এদিকে তাঁতির মদের নেশা কেটে গেলে স্ত্রীর কাছে এসে চড়া গলায় বলল: কি রে, হারামজাদি! এখনও চুপ করে আছিস! বললি না, কোথায় গিয়েছিলি? নাক তো গেছেই, এবার কানটাও খোয়াতে চাস?
এবার তাঁতিবৌ ঝামটা মেরে বলল: ওরে হতভাগা! আমার মতো সতীর গায়ে হাত তোলে এমন সাধ্যি কার? তেত্রিশ কোটি দেবতা জানে আমি কেমন সতী! তিন লোকের দেবগণ শোনো: আমি যদি সতী হই, মনে মনেও যদি অন্য পুরুষ কামনা না করে থাকি, তাহলে এই মুহূর্তে আমার কাটা নাক যেন জোড়া লেগে যায়। আর যদি অসতী হই তাহলে যেন আমার মরণ হয়!
মুহূর্তকাল পরে চিৎকার করে বলল: ওরে ড্যাকরা! চেয়ে দেখ, আমার সতীত্বের জোরে কাটা নাক জোড়া লেগে গেছে!
স্ত্রীর কথা শুনে তাঁতির মনে ধন্দ লাগল। সে প্রদীপ জ্বালিয়ে স্ত্রীর মুখের কাছে ধরে তো হতবাক! এ কি করে সম্ভব! কিন্তু সে তো নিজের হাতেই নাক কেটেছে, আবার নিজের চোখেই দেখছে। তাই অবিশ্বাস করবে কি করে? নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে রক্তে মাটি এখনও ভিজা! অগত্যা দ্রুত বাঁধন খুলে দিয়ে স্ত্রীকে বিছানায় নিয়ে সে কি সোহাগ! সোহাগে সোহাগে সর্বাঙ্গ ভরে দিয়ে তার মান ভাঙাতে লাগল।
এদিকে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গুরু নির্বাক দর্শকের মতো এই দুই রমণীর কাণ্ড-কারখানা অবলোকন করেছেন আর ভাবছেন: হায়রে স্ত্রীলোক! তোমার দ্বারা কি না সম্ভব হয়! বুদ্ধিতে তোমার কাছে বৃহস্পতিও হার মানে! শাস্ত্র কি আর এমনি বলেছে: মেয়েদের মুখে মধু, হৃদয়ে বিষ! তাইতো পুরুষরা সেই মধুর লোভে তার অধর পান করে, কিন্তু বেরিয়ে আসে হলাহল! স্ত্রীলোক প্রথমে প্রেমের অভিনয় করে পুরুষকে আকৃষ্ট করে এবং যতক্ষণ না পুরুষটি মজে যায় ততক্ষণ অভিনয় চলতে থাকে। যখনই বুঝতে পারে সে মজেছে, অমনি টোপগেলা মাছের মতো হ্যাঁচকা টানে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এরূপ ভেবে ভেবে কোনোরকমে গুরু সে রাতটা কাটিয়ে দিলেন। এদিকে নাপিতবৌ দূতীয়ালি করতে গিয়ে নাক হারিয়ে এখন চিন্তায় পড়ে গেছে—স্বামী ফিরে এলে কি জবাব দেবে এই ভেবে। তার স্বামী কাজের চাপে সেদিন রাজবাড়ি থেকে ফিরতে পারেনি। সকাল বেলা এসে বাইরে থেকেই হাঁক দিয়ে বলল: কৈ গো, আমার ক্ষুরের বাক্সটা দে তো, আজ অনেককে কামাতে হবে।
কিন্তু নাপিতবৌ কাটা নাক নিয়ে সামনে আসবে কি করে? ধরা পড়ে যাবে যে! তাই ঘরের কাজে যেন খুবই ব্যস্ত এমন ভাব করে সে বাক্স থেকে ক্ষুরটা বের করে বাইরে ছুঁড়ে মারল। স্ত্রী কাছে তো এলই না, উপরন্তু শুধু ক্ষুরটা ছুঁড়ে মারল। এতে নাপিতের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে চিৎকার দিয়ে ক্ষুরটা আবার স্ত্রীর দিকে ছুঁড়ে মারল। নাপিতবৌ তো এমন একটি সুযোগই খুঁজছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার দিয়ে বাইরে এল এবং পাড়ার লোককে ডেকে বলল: তোমরা দেখ! মিনসে আমার নাক কেটে দিয়েছে! তোমরা এর বিচার কর!
লোকজন ছুটে এসে দেখে সত্যিই নাপিতবৌর নাক কাটা। তারা রাজার লোককে খবর দিল। এদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় নাপিত তো হতবিহ্বল! রাজার লোক এসে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পেল না। তারা তাকে ইচ্ছেমতো উত্তম-মধ্যম দিল। তারপর তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দুজনকেই নিয়ে গেল রাজ দরবারে।
বিচারকরা নাপিতকে জিজ্ঞেস করলেন: কেন তুমি স্ত্রীর অঙ্গহানি করেছ? সে কি পরপুরুষগামিনী? না-কি তোমায় মারতে গিয়েছিল? বল?
নাপিত নিরুত্তর এবং নতমুখী। বিচারকরা বললেন: নিরপরাধের মুখ থাকে প্রসন্ন, কথা হয় স্পষ্ট, চোখের দৃষ্টিতে থাকে ক্রোধের ভাব; সে কথা বলে সোজা হয়ে বুক ফুলিয়ে। কিন্তু এ দেখছি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ স্খলিত পদে সভায় প্রবেশ করল। এর মুখ ফ্যাকাশে। কপালে ঘাম ছুটছে। গলার স্বর ও মুখের রং বদলে গেছে। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। এ-সবই অপরাধীর লক্ষণ। স্ত্রীলোকের গায়ে হাত! গুরুতর অপরাধ! তাই এর দণ্ডও হবে গুরুতর। শূলে চড়িয়ে মৃত্যু।
বিচারকদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জল্লাদ নাপিতকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে। লোকজন বলাবলি করছে। তা শুনে গুরু ছুটে এসে বলেন: তোমরা থাম! এর কোনো দোষ নেই। সমস্ত দোষ ঐ নষ্টা মেয়েলোকের। একজন ভালো লোককে তোমরা মৃত্যুদণ্ড দিওনা। গুরুর কথায় জল্লাদেরা থমকে দাঁড়াল। তারা গুরুকে বলল: আপনার যা বলার বিচারকদের বলবেন, চলুন। এই বলে তারা গুরু এবং নাপিত উভয়কে বিচারালয়ে নিয়ে গেল। গুরু তখন বিচারকদের উদ্দেশে বললেন:
শেয়াল মরল রক্তলোভে গুরু শিষ্যবেশে।
দূতী মরল পরের কাজে সবই নিজের দোষে ॥
বিচারকরা বললেন: গুরুদেব, খুলে বলুন! গুরু তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বললে নাপিত ছাড়া পায়। কিন্তু বিচারকরা সিদ্ধান্ত দেন: নারী, শিশু, ব্রাহ্মণ, তপস্বী এবং রোগী এই পাঁচজনের অপরাধ গুরুতর হলেও মৃত্যুদণ্ড হয়না, হয় অঙ্গহানি। তাই নাপিতবৌ নিজের দোষে নাক হারিয়েছে, এবার বিচারে তার কান কাটা যাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জল্লাদ তার দু-কান কেটে দেয়। এসব দেখে গুরু তাঁর টাকার শোক ভুলে শান্ত মনে আবার মন্দিরে ফিরে যান।
দমনক এসব বলে নীরব হলে করটক বলল: তা-তো বুঝলাম। কিন্তু গুরু নিজেও তো কম চালাক নন। তবে আষাঢ়ভূতি তাঁর টাকা চুরি করল কি করে?
দমনক বলল: তাঁরও বুদ্ধির ঘাটতি ছিল। দেখ:
ভালো করে আঁটলে ফন্দি অন্ত পায় না ব্ৰহ্মা।
বিষ্ণুরূপ ধরে তাঁতি ভুঞ্জে রাজকন্যা ॥
করটক: মানে?
দমনক: বলছি, শোন…