বিষ্ণুরূপী তাঁতি
এক নগরে থাকত দুই বন্ধু
এক তাঁতি আর এক ছুতার। দুজনে খুব ভাব
সেই ছোটবেলা থেকেই। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না। যেখানে যায় এক সঙ্গে। যা করে তা-ও এক সঙ্গে। এমনি জোড়মানিক। হরিহর আত্মা।
সেই নগরে ছিল এক বারোয়ারি মন্দির। লক্ষ লোকের সমাগম হয় পালা-পার্বণে। বসে বিরাট মেলা। হাতি-ঘোড়া, বাঘ-ভাল্লুক কত কি আসে! সার্কাস, নাচ-গান, কবির লড়াই নানা রকম বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে সেখানে। তাই দুজনে একদিন গেল সেই মেলায়। মেলার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ দেখে চন্দ্রমা যেন আকাশ ছেড়ে হাতির পিঠে চড়ে মেলায় ঢুকছে! না, চন্দ্ৰমা নয় রাজকন্যা! লোকে তা-ই বলছে। তাঁতি তাকিয়েই আছে! অপলক! কিছুক্ষণের মধ্যে সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। ছুতার তো হতবাক! বিমূঢ়! কি হলো ওর? কালক্ষেপণ না করে ধরাধরি করে তাকে নিয়ে গেল নিজের বাড়ি। বদ্যি-কবিরাজ ডেকে চিকিৎসা করায় অল্পতেই জ্ঞান ফিরল। তারপর নিভৃতে জিজ্ঞেস করলে তাঁতি বন্ধুকে যা বলল, তা শুনে তো তার আক্কেল গুড়ুম! তাঁতি বলল: রাজকন্যাকে দেখার পর থেকেই কামশরে আমি বিদ্ধ হয়েছি। মরণ আমার নিশ্চিত, কারণ এর কোনো প্রতিকার নেই, একমাত্র মরণ ছাড়া। তাই তুমি আমার চিতা সাজাও। আর যদি তোমাকে কখনও কষ্ট দিয়ে থাকি, বন্ধু হিসেবে মাফ করে দিও!
এই বলে তাঁতি নীরবে কাঁদতে লাগল। বন্ধু ছুতারও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কিছুক্ষণ ভেবে সে বলল: বন্ধু, ধৈর্য ধর! তুমি যেখানে যাবে, আমারও গন্তব্য তা-ই। দুচোখ কি দুদিকে তাকাতে পারে? তাই চিতা সাজাতে হলে দুটোই সাজাব। কিন্তু ভাবছি—যে আগুনে তোমার হৃদয় পুড়ছে, তা থেকে তোমার দেহটাকে বাঁচাই কি করে? তবে এটাও ঠিক—সব রোগেরই ওষুধ আছে। শাস্ত্র বলছে না—সর্বস্যৌষধমস্তি। তুমি আমার ওপর ভরসা রাখ। যা হোক ব্যবস্থা একটা হবেই।
এই বলে ছুতার কিছুক্ষণ চিন্তা করে সোৎসাহে বলল: বন্ধু, হয়ে গেছে! সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে! আজ রাতেই তুমি রাজকন্যার সঙ্গে মিলিত হতে পারবে।
তাঁতি উদাস কণ্ঠে বলল: এত রক্ষী পাহারা দিচ্ছে! একমাত্র বায়ু ছাড়া আর কেউ যেখানে ঢুকতে পারে না, সেখানে এটা কি করে সম্ভব? মিছেমিছি তুমি আমায় নাচাচ্ছ! এ তোমার বন্ধুবাৎসল্য! আর কিছু নয়!
ছুতার দৃঢ়তার সঙ্গে বলল: তুমি শুধু আমার কথামতো কাজ করবে, তারপর দেখবে আমার বুদ্ধির জোর কতখানি!
এই বলে ছুতার তার পরিকল্পনা খুলে বলল। তাঁতিকে সে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-ধারী বিষ্ণুরূপে সাজিয়ে দিয়ে রাতের বেলা অন্তঃপুরে পাঠাবে। যন্ত্রচালিত গরুড়ে চড়ে সে যাবে। ছুতার দ্রুততার সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে ফেলল এবং বিষ্ণুরূপী তাঁতি যথাসময়ে রাজকন্যার সামনে গিয়ে হাজির হলো। হতভম্ব রাজকন্যা কিছু বলার আগেই তাঁতি বলল: তুমি আমার লক্ষ্মী। আগের জন্মে রাধা ছিলে। তোমায় ছাড়া আমি থাকি কি করে, বল তো!
স্বয়ং বিষ্ণুকে দেখে রাজকুমারী বিমোহিত, বিস্মিত! ‘না’ বলার সাহস নেই। তাই বলে নারীর ভূষণ ত্যাগ করাও সহজ নয়। অতঃপর বিষ্ণুরূপী তাঁতির সর্বৈব সান্ত্বনায় রাজকুমারী নিজেকে তার হাতে তুলে দিল। ভোর হওয়ার আগেই ‘আবার দেখা হবে’ বলে তাঁতি চলে গেল।
এভাবে চলতে লাগল বিষ্ণুরূপী তাঁতি আর রাজকন্যার গোপন অভিসার। কিন্তু গোপন বিষয় আর কতদিন গোপন থাকে? বীজের অঙ্কুরের মতো তা একদিন প্রকাশ পায়ই। রাজকন্যাও ধরা পড়ে গেল। রক্ষীরা একদিন রাজাকে গিয়ে জানাল: মহারাজ! আমাদের দায়িত্ব পালনে এতটুকু ফাঁক নেই যে রাজকুমারীর মইলে মাছিও ঢুকতে পারে! কিন্তু তারপরেও বলছি রাজকন্যার মহলে কেউ একজন গোপন অভিসারে আসে!
রাজার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! তিনি ব্যাকুল চিত্তে ভাবতে লাগলেন: মেয়ের বাবার চিন্তার আর শেষ নেই! কখন কি কেলেঙ্কারি ঘটে বসে! মেয়েকে কার হাতে দেব
এ এক বিরাট সমস্যা! আবার দিলেও সুখী হবে কি-না সে-ও এক সমস্যা! মেয়ে জন্মালেই বাপ-মায়ের মন উড়ে যায়!
এসব ভাবতে ভাবতে রাজা গেলেন অন্তঃপুরে। রানিকে গিয়ে বললেন: এতকাল দুধ—কলা দিয়ে যাকে পুষেছ, এবার সে ছোবল মারার জন্য তৈরি। রানি বিস্ময়াবিষ্টের ন্যায় তাকিয়ে আছেন। রাজা তখন সব কথা খুলে বলে রানিকে বললেন: জেনে এস রাতের বেলা মেয়ের ঘরে কে আসে! রানির বুকটা যেন কে চেপে ধরল! দুরু দুরু বক্ষে কম্পিত পদে তিনি গেলেন রাজকন্যার প্রাসাদে। বললেন: পাপিষ্ঠা! বল, তোর কাছে কে আসে? কার যমের বাড়ি যাওয়ার সাধ হয়েছে?
রাজকন্যা সলজ্জভাবে সব খুলে বললে রানির বুক থেকে পাথরটা সরে গেল। তাঁর শরীরটা যেন পালকের ন্যায় হালকা হয়ে গেল। তিনি যেন উড়ে গিয়ে রাজাকে বললেন: মহারাজ! আমাদের ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন! স্বয়ং বিষ্ণু আমাদের জামাতা! গরুড়বাহন আমাদের মেয়েকে গান্ধর্বমতে বিবাহ করেছেন! রাতের বেলা তিনিই আসেন!
আনন্দে রাজা যেন রানিকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলেন। নিজেকে সংবরণ করে বললেন: তাহলে আমাদের চেয়ে সুখী আর কে আছে? এবার জামাইয়ের আশীর্বাদে আমি পৃথিবী জয় করব।
উচ্ছ্বাস স্তিমিত হলে রাজা-রানি রাতের অপেক্ষা করতে লাগলেন। কখন তাঁদের জামাতা অভিসারে আসবে। অপেক্ষার সময় যে আর কাটে না। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রাজা-রানি সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। হঠাৎ দেখেন গরুড়ে চড়ে স্বয়ং নারায়ণ আসছেন তাঁদের মেয়ের ঘরে! তাঁদের আনন্দ আর দেখে কে? রাজা পরের দিনই শুরু করেন পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহ জয় করতে। তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদা সমস্ত রাজা জোটবদ্ধ হয়ে তাঁকেই আক্রমণ করেন। রাজা কিছুতেই পেরে উঠছেন না। দিনে দিনে তাঁর রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বাকি আছে শুধু দেয়ালঘেরা প্রাসাদটুকু। রাজা তখন মেয়েকে ডেকে বললেন: মা, তুমি জামাইকে একটু বল, নাহলে তো আর রক্ষে নেই। স্বয়ং বিষ্ণু যার জামাতা তার কি-না এই দশা! রাজকুমারী পিতাকে আশ্বস্ত করে তাঁতিকে গিয়ে বলল: আপনি স্বয়ং নারায়ণ যাঁর জামাতা, তাঁর রাজ্য এভাবে ধ্বংস হলে আপনারই যে অপযশ হবে, প্রভু! সে তো আমি সইতে পারব না! এটা তো আমার কাম্য হতে পারে না!
তাঁতি বীরত্বের সঙ্গে বলল: অবশ্যই নয়। আজই আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। তুমি শ্বশুর মহাশায়কে বল—তিনি যেন নিজে যুদ্ধে যান। আমি আগে থেকেই শত্রুসৈন্যদের দুর্বল করে রাখব, তিনি মারবেন। আমি নিজের হাতে মারলে ওরা যে স্বর্গে যাবে!
রাজকন্যা মহাখুশি হয়ে পিতাকে গিয়ে সব বলল। রাজাও পরের দিন সাড়ম্বরে যুদ্ধে গেলেন। এদিকে তাঁতির কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিল। সে ভাবল: সুখের জীবন শেষ! আজ ধরা পড়তেই হবে! ফলে রাজকন্যার সঙ্গে চিরতরে বিচ্ছেদ ঘটবে। এমনকি জীবনটাও যেতে পারে! তার চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েই মরা ভালো। তাতে অন্ততঃপক্ষে দেশের কাজে প্রাণ যাবে। এরূপ ভেবে তাঁতি গরুড়ে চড়ে আকাশে উঠে গেল।
এদিকে বৈকুণ্ঠে স্বয়ং বিষ্ণু চিন্তাগ্রস্ত হলেন। তিনি গরুড়কে ডেকে বললেন: বৈনতেয়, তাঁতির পো’র কাণ্ড দেখেছ?
গরুড় বলল: প্রভুর কৃপায় সবই জানি!
বিষ্ণু: ও-বেটা যুদ্ধে মারা গেলে সবাই ভাববে মানুষের হাতে বিষ্ণু তাঁর বাহনসহ মারা গেছে। তাতে সর্বনাশ তো আমাদেরই! কেউ আর আমাদের পুজো দেবে না।
গরুড়: তা এখন কি কর্তব্য, প্ৰভু?
বিষ্ণু: তুমি গিয়ে ঐ কাঠের গরুড়ে ভর কর, আর আমি তাঁতির মধ্যে ঢুকি। এছাড়া আর উপায় কি?
কথামতো কাজ হলো। বিষ্ণু যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে শত্রুসৈন্যদের মায়াবশে দুর্বল করে দিলেন। আর রাজা তাদের হত্যা করলেন। যুদ্ধশেষে তাঁতি যখন মাটিতে নেমে এল, তখন সবাই তাকে চিনে ফেলল: এ-যে আমাদেরই তাঁতির পো! তাঁতি তখন সব ঘটনা খুলে বলল। রাজা তার বুদ্ধি ও সাহস দেখে এবং সর্বোপরি তার সাহায্যে নিজ প্রভাব ফিরে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন। শুধু তা-ই নয়, সাড়ম্বরে তিনি রাজ্যসহ রাজকন্যাকে তার হতে তুলে দিলেন।
তাঁতির কাহিনী শুনে করটক বলল: তাতো বুঝলুম, কিন্তু সঞ্জীবক আর পিঙ্গলকের ক্ষেত্রে আমাদের আর কি করার আছে?
দমনক বিজ্ঞের ন্যায় মাথা নেড়ে বলল: আছে, আছে! দেখ
ধনুকধারী তীর ছুঁড়লে কেউ মরে কেউ মরে না।
বুদ্ধিমানে বুদ্ধি ছাড়লে তার সামনে কেউ বাঁচে না ॥
করটক: বুদ্ধিতে তুমি সেয়ানা এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পিঙ্গলকের সঙ্গে সঞ্জীবকের ছাড়াছাড়ি ঘটানোর শক্তি তোমার কোথায়?
দমনক: শোন, শাস্ত্রে আছে না—
কৌশলেতে পারবে যা গায়ের জোরে হয় না।
কাক মারল কেউটে সাপ দিয়ে সোনার গয়না ॥
করটক: কি রকম?
দমনক: শোন তাহলে…