শশক ও সিংহ
এক বনে ছিল এক সিংহ। নাম তার ভাসুরক। গায়ের জোর অসীম। থাবায় দশটা—পাঁচটা পশু মারে। দুইটা খায়, তিনটা ফেলে। এতে বনের পশুকুল প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। তাই সকলে মিলে একদিন গিয়ে বলল: প্রভু, আপনি আমাদের মা-বাপ! আপনি রক্ষা না করলে আমরা বাঁচব কি করে?
ভাসুরক অর্ধনিমীলিত চোখে তাকিয়ে বলল: কি হয়েছে?
পশুরা: প্রভু, আপনি রোজ যেভাবে মারছেন, তাতে আমাদের বংশ রক্ষা করাই যে দায় হয়ে পড়েছে! এভাবে চললে একদিন আপনার আহারের সঙ্কট হবে যে!
ভাসুরক বিস্ফারিত চোখে বলল: তাহলে তোরা কি করতে চাস?
পশুরা: আমরা ভাবছি, প্রতিদিন একটি করে পশু আপনার নিকট পাঠাব। আপনি নিশ্চিন্তে বসে খাবেন। তাতে দুটি লাভ। খাবারের জন্য আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আর আমাদেরও বংশবৃদ্ধি ঘটবে। শাস্ত্র বলে না—গোয়ালা যেমন দুধের জন্য গাভী ও তার বাছুরের যত্ন নেয়, তেমনি রাজাকেও খাজনা পেতে হলে রাজ্য ও প্রজার দেখ—ভাল করতে হয়। তা নাহলে অচিরেই রাজ্য সম্পদশূন্য হয়ে পড়ে। মালী যেমন জল দিয়ে অঙ্কুরগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে, রাজাকেও তেমনি প্রজাদের বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এতে রাজ্যের যেমন শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, রাজারও তেমনি সুনাম ছড়িয়ে পড়ে
পশুরা এসব বলে ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে আছে ভাসুরকের দিকে। কি বলে তা-ই ভাবছে। ভাসুরক ভাবল: প্রস্তাবটা মন্দ নয়। বিনা প্ররিশ্রমে যদি আহার জোটে তো ভালই। এখন না হয় গায়ে জোর আছে। ধরে-মেরে খাচ্ছি। কিন্তু বয়স হলে? তাই এদের প্রস্তাবে রাজি হওয়াই উত্তম। প্রকাশ্যে বলল: তা-ই হবে, তবে এর ব্যতিক্রম হলে কিন্তু সবকটাকেই মেরে ফেলব। মনে থাকে যেন।
পশুরা ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেল। পরদিন থেকে পালা করে একটি করে পশু ভাসুরকের কাছে যায় এবং সে নিশ্চিন্তে বসে খায়। কেউ যায় ইচ্ছায়, কেউ যায় অনিচ্ছায়। যুবা—বৃদ্ধ এবং জাত নির্বিশেষে এভাবে চলতে থাকে। অবশেষে একদিন আসে এক খরগোসের পালা। সে কিছুতেই রাজি নয়। কিন্তু নিয়ম ভাঙলে সকলের বিপদ! তাই সবাই মিলে জোর করে তাকে পাঠিয়ে দিল।
যেতে যেতে খরগোস ভাবছে—কিভাবে সিংহটাকে জব্দ করা যায়। দুই পা আগায় তো এক পা পিছোয়। এভাবে অর্ধেক পথ যেতে যেতেই দুপুর হয়ে গেল। ভাসুরকের খাবার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। সেদিকে খরগোসের ভ্রূক্ষেপ নেই। হঠাৎ পথে পড়ল এক পাতকুয়া। খরগোস আনমনে নিচের দিকে তাকাতেই জলের উপর তার ছায়া ভেসে উঠল। বিদ্যুৎ গতিতে তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। মনে মনে বলল: হারামজাদাকে শায়েস্তা করার উপায় পেয়ে গেছি! এই বলে সে ভাসুরকের পথে চলতে লাগল।
খরগোস যখন ভাসুরকের কাছে পৌঁছল তখন বিকেল হয়ে গেছে। তাকে দেখে ভাসুরক দাঁত কটমট করে ছুটে এল। খরগোস হাত জোড় করে বলল: প্রভু, আমার কোনো দোষ নেই! আমি ঠিক সময়েই আসছিলাম। আমি ছোট বলে আমার সঙ্গে আরো চারটি খরগোসও আপনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু, পথে আরেকটি সিংহ আমার পথ আটকে বলল: কোথায় যাচ্ছিস, আমাকে বাদ দিয়ে?
আমি বললাম: আমরা প্রভুর কাছে যাচ্ছি। আমরা গেলে তার আহার হবে।
সে রেগে বলল: কে আবার প্রভু? আমিই এ বনের রাজা। তোরা আমার আহার হবি।
আমি বললাম: সে হয় না। এক বনে রাজা তো একজনই হয়।
সে বলল: ঠিক আছে। ঐ চারটাকে এখানে রেখে তোর প্রভুকে ডেকে নিয়ে আয়। যুদ্ধে যে জিতবে সে-ই হবে এ বনের রাজা।
আমিও ‘আচ্ছা’ বলে আপনার কাছে চলে এলাম। এখন প্রভু যা করেন।
খরগোসের কথা শুনে ভাসুরক তো রেগে আগুন! তার রাজ্যে আবার কে এল ভাগ বসাতে? সে বলল: রাজ্য, বন্ধু, সম্পদ আর সম্মান যুদ্ধ করেই অর্জন করতে হয়। তাই চল, দেখি সেই পাষণ্ড কোথায় লুকিয়ে আছে!
খরগোস বলল: প্রভু যথার্থই বলেছেন। কিন্তু সে তো দুর্গের মধ্যে আছে। সেখানে আপনি ঢুকবেন কি করে?
ভাসুরক: হোক দুর্গ, শত্রুকে ছাড়তে নেই। শাস্ত্রে আছে না—শত্রু, ব্যাধি আর আগুন ছোট হোক বড় হোক—এদের সমূলে বিনাশ করতে হয়। যে নিজের ভাল চায় সে উঠতি শত্রুকেও উপেক্ষা করেনা। উঠতি শত্রু আর নতুন ব্যাধি উভয়ই সমান পরে ভয়ানক হয়।
খরগোস: তা ঠিকই বলেছেন, প্রভু। কিন্তু যাওয়ার আগে আরেকবার ভাবুন। ঐ সিংহটা কিন্তু জোয়ান। নিজের এবং শত্রুর শক্তি সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে যুদ্ধে যাওয়া আর জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দেয়া একই কথা।
ভাসুরক: তুই পথ দেখা। সে ভাবনা আমার। খিদেয় আমার পেট জ্বলছে!
এরপর খরগোসটি আগে-আগে পথ দেখিয়ে ভাসুরককে নিয়ে গেল সেই কুয়োর কাছে। বলল: প্রভু, ঐ হচ্ছে তার দুর্গ। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ভাসুরক নিচের দিকে তাকিয়ে জলের উপর নিজের ছায়া দেখতে পেল। যেই গর্জন করে উঠল, অমনি তার প্রতিধ্বনি উপরে উঠে এল। ভাসুরক ঘার নাড়ালে তার ছায়াটাও ঘার নাড়ায়। ভাসুরক সত্যিই তার ছায়াকে শত্রু মনে করে যেই ঝাঁপিয়ে পড়ল, অমনি কুয়োর জলে ডুবে অক্কা পেল। খরগোসটি তখন মনের আনন্দে বনে গিয়ে সবাইকে ঘটনাটা বলল। সেই থেকে তারা নিশ্চিন্তে বসবাস করতে লাগল।
তাই বলছিলুম—বুদ্ধির কাছে গায়ের জোর কিছুই নয়। বুদ্ধি দিয়ে আমি ঐ পিঙ্গলক আর সঞ্জীবকের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাবই।
করটক এবার আশ্বস্ত হয়ে বলল: তবে তা-ই হোক। তোমার পথ নিষ্কণ্টক হোক।
এই বলে করটক দমনককে আশীর্বাদ করলে দমনকও অগ্রজকে প্রণাম করে রাজসমীপে যাত্রা করল। দমনক দূর থেকে তাকিয়ে দেখল পিঙ্গলক একাই বসে আছে। এই সুযোগে কাছে গিয়ে বলল: পেন্নাম হই, প্ৰভু।
পিঙ্গলক অনেক দিন পরে দমনককে দেখে কিছুটা অনুযোগের সুরে বলল: তুমি এতদিন কোথায় ছিলে, বন্ধু?
দমনক গম্ভীর কণ্ঠে বলল: হুজুরের তো আর আমাকে প্রয়োজন নেই, তাই আসি না। তবে …!
পিঙ্গলক উদ্বেগের সঙ্গে বলল: তবে কি? থামলে কেন?
দমনক: আপনার বিপদ দেখে আর দূরে থাকতে পারলাম না। কথায় বলে না—যার মঙ্গল চাও, সে না বললেও তার বিপদ দেখে দূরে থেকনা; তার ভালো-মন্দ সম্পর্কে তাকে জানাও।
পিঙ্গলক অতীতের কথা স্মরণ করে সাগ্রহে বলল: তুমি তো আমার বন্ধু, শুধু মন্ত্রীই নও। তা কি বিপদের আশঙ্কা করছ, বল না!
দমনক চারদিকে তাকিয়ে চুপি চুপি বলল: প্রভু, ঐ বেটা সঞ্জীবকের মতি-গতি ভালো ঠেকছে না! বলে কি-না—তোমাদের রাজা পিঙ্গলকের নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা হয়ে গেছে। ও বেটা মনেও দুর্বল, দেহেও দুর্বল। তাই ওকে মেরে আমি নিজেই রাজা হব। তোমাকে বানাব মুখ্যমন্ত্ৰী।
দমনকের কথা শুনে পিঙ্গলকের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। সে বিশ্বাস করতে পারল না যে, সঞ্জীবক এতটা বিশ্বাসঘাতক হতে পারে। সে বলল: আমার বিশ্বাস হয় না যে, সে আমার এতটা অনিষ্ট করতে পারে! আমি যে তাকে ভীষণ ভালোবাসি! সে আমার প্রাণসম, দমনক!
দমনক আরো একটু কাছে গিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল: প্রভু, ভৃত্য হোক আর বন্ধু হোক, রাজলক্ষ্মী কে না চায়? যারা অপারগ কেবল তারাই রাজাকে ঘিরে থাকে।
পিঙ্গলক: তবুও তার প্রতি আমার মন বিরূপ হচ্ছে না। কারণ, দেখ:
কত খুঁত তবু দেহ কার না প্রিয়।
শত দোষ তবু প্রিয় হয় যে প্ৰিয়।।
দমনক: প্রভু, সমস্যা তো এখানেই! রাজার যে সবচেয়ে প্রিয়, রাজত্বে তো ভাগ বসাতে সে-ই সাহস পায়। রাজার স্নেহ পেয়ে প্রথমে সে বিশ্বাস অর্জন করে। এতে রাজা তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে সে তার উদ্দেশ্য হাসিল করে।
এরপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে দমনক আবার বলল: তাছাড়া প্রভু যে সঞ্জীবকের মধ্যে আহামরি কি দেখেছেন জানিনা। ওর কি গুণ আছে? ও একটা তৃণভোজী। কিন্তু আপনার শত্রুরা সব মাংসভোজী। বিপদে পড়লে ও কি আপনাকে উদ্ধার করতে পারবে? মাংসভোজীদের হঠানো ওর কাজ নয়। তাই বলছি—যেকোন একটা দোষ খাঁড়া করে ওকে মেরে ফেলুন, নিজের পথ নিষ্কণ্টক করুন।
পিঙ্গলক দ্বিধান্বিত চিত্তে বলল: কিন্তু কাউকে একবার সভায় গুণবান ঘোষণা করে পরে তাকে আসামি নির্ধারণ করে দণ্ড দিলে নিজেরই অযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। দেখ, দেবতারা পর্যন্ত তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দৈত্যদেরও বর দেয়। আর বিষবৃক্ষ হলেও নিজের হাতে বড় করে তাকে নিজের হাতেই ছেদন করা যায় না। কাউকে একবার অনুগ্রহ করে চিরদিন তা বজায় রাখাই সজ্জনের ধর্ম। তাছাড়া যে তোমার উপকার করে তার নিকট ভালো থাকায় কোনো কৃতিত্ব নেই, বরং যে তোমার অপকার করে, তার নিকট ভালো থাকাই উত্তমের ধর্ম। কজেই সঞ্জীবক যদি আমার ক্ষতিও করে তথাপি আমি তাকে মারতে পারব না।
পিঙ্গলকের কথায় দমনক একটু হতাশ হলেও দমবার পাত্র সে নয়। সে আরো একটু জোর গলায় বলল: প্রভু, এটা কিন্তু রাজধর্ম নয়। বিদ্রোহীকে ক্ষমা করা রাজনীতি—বিরোধী। শাস্ত্র বলে মারি অরি পারি যে কৌশলে। দেখুন, অর্থে সমান, সামর্থ্যে সমান, উদ্যোগী, গোপন খবর জানে এবং রাজত্বে ভাগ বসাতে পারে– এমন ভৃত্যকে যে না মারে, তার হাতে সেই রাজার নিজেরই মৃত্যু হয়। তাছাড়া লক্ষ্য করছি যে, সঞ্জীবকের সঙ্গে মেশার পর থেকেই আপনার স্বভাবেরও পরিবর্তন ঘটেছে। আপনি রাজকার্যে মন দিচ্ছেন না। আমিষ ছেড়ে দিয়েছেন। এতে রাজকর্মচারীরাও অসন্তুষ্ট। তারা সবাই চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ফলে বিপদ আরো বাড়ছে। কারণ ঘনিষ্ঠজনেরা সংসর্গজা আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে শত্রুর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়। শাস্ত্র বলে দোষগুণা ভবন্তি সঙ্গগুণে দোষ-গুণ দেখা দেয়। যেমন, এক ফোঁটা জল গরম লোহায় পড়লে মুহূর্তে উড়ে যায়, পদ্মপাতায় পড়লে মুক্তোর মতো দেখায়, আর ঝিনুকের মধ্যে পড়লে একেবারেই মুক্তো হয়ে যায়। মহারাজকে আর কি বলব। অসৎসঙ্গে পড়লে মানুষ কি-না করতে পারে? মহামতি ভীষ্মও দুষ্ট দুর্যোধনের পাল্লায় পড়ে গরু চুরি করেছিলেন। তাই পণ্ডিতেরা বলেন:
ঠাঁই দিয়োনা না জেনে স্বভাব আর গুণ।
ছারপোকার দোষে তাই মরল যে উকুন।।