উকুন ও ছারপোকা
এক রাজার ছিল এক চমৎকার বিছানা। সাদা ধবধবে দুটি চাদর বিছানো। তার ফাঁকে থাকত এক উকুন। নাম তার মন্দবিসর্পিণী। ধীরে ধীরে চলে বলে এই নাম। রাজা ঘুমিয়ে পড়লে সে তার রক্ত খেত। সুস্বাদু রাজরক্ত। এভাবে চলছিল তার দিন। মহাসুখে।
একদিন সেখানে এল এক ছারপোকা। নাম তার অগ্নিমুখ। কামড়ে বিষ তো! তাই এই নাম। তাকে দেখে উকুনের মেজাজ গেল বিগড়ে। সে দূর-দূর করতে লাগল। ছারপোকা বলল: বন্ধু, এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছ কেন? বাড়িতে চোর-ডাকাত এলেও তো মানুষ এমন করেনা। তাছাড়া শাস্ত্র বলছে না—অতিথি নারায়ণ! অতিথির সেবা করলে গৃহস্থের মঙ্গল হয়! আর দেখ, জীবনে রক্ত তো কম খাইনি। কিন্তু কি বলব? সেগুলোর কোনটা টক, কোনটা ঝাল, কোনটা তেতো। হবেনা কেন? খায় তো আজেবাজে খাবার। রাজরক্ত কোনদিন ভাগ্যে জোটেনি! রাজারা কতকিছু খায়! মাছ-মাংস, দধি—মিষ্টি, ছানা-রসগোল্লা! কত কি! তাই তাদের রক্ত না-জানি কত মিষ্টি! একবার যদি খেতে পেতুম, তাহলে জীবনের সাধ মিটে যেত! এ কারণেই তোমার কাছে এলাম। আর দেখ, জিভের স্বাদ কাঙাল আর রাজা—উভয়েরই সমান। এই স্বাদ মেটানোর জন্যই সবাই কাজ করে, দেশ-বিদেশে যায়। তা নাহলে কে আর কাজ করত? কে কার ভৃত্য কিংবা বশীভূত হতো? তাই এই শেষ বয়সে তোমার বাড়ি এসেছি এই শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে।
অগ্নিমুখের কথায় উকুনের দয়া হলো। সে সবকিছু ভুলে তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করল। তবে সতর্ক করে দিয়ে বলল: বন্ধু, মনে রেখ, রাজামশায় ঘুমিয়ে পড়লে তখন আমি তার রক্ত খাই। তোমার তো আবার ত্বর সয়না। জেগে থাকা অবস্থায় যেন কামড়-টামড় দিওনা। তাহলে দুজনেরই মরণ নিশ্চিত। একবার খেয়ে দেখ রাজরক্ত কি সুস্বাদু!
অগ্নিমুখ মহাখুশি! অবেগ-জড়িত কণ্ঠে বলল: তুমি কিচ্ছু ভেবনা, বন্ধু! আমি বাপ—মায়ের দিব্যি দিয়ে বলছি, তুমি না বলা পর্যন্ত আমি মুখই খুলব না। দেখ।
এভাবে দুজনের কথা হতে-হতে রাজামশায় এসে শুয়ে পড়লেন। ভৃত্য প্রদীপ নিভিয়ে চলে গেল। কিন্তু অগ্নিমুখের তো আর ত্বর সইছে না! দীর্ঘদিন না-খাওয়া। তাই রাজার ঘুমানোর অপেক্ষা করা তার পক্ষে আর সম্ভব হলো না। এসেই দিল কামড়। রাজা লাফ দিয়ে উঠে ভৃত্যকে ডাকলেন। ভৃত্য আলো জ্বেলে চাদর সরিয়ে দেখে উকুনটি গুটি গুটি হাটছে। অগ্নিমুখ ততক্ষণে খাটের ফাঁকে ঢুকে পড়েছে। ভৃত্য তাই উকুনটাকেই মেরে ফেলল।
দমনক এবার পিঙ্গলকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল: মহারাজ! তাই বলছিলুম, ভাল করে স্বভাব-চরিত্র না জেনে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। তাতে মহা বিপদের আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া স্বজনদের তাড়িয়ে দিয়ে পরজনদের আপন করলে মরণ নিশ্চিত। তাই তো বলা হয়:
পরকে আপন আপনকে পর করে যেই জন।
চণ্ডরব শেয়ালের মতো মরে সেই জন।।