Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পত্রগুচ্ছ – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প135 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কাজী মোতাহার হোসেন-কে

    কাজী মোতাহার হোসেন-কে

    পদ্মা

    ২৪.২.২৮ সন্ধ্যা

    (“Vulture” – স্টিমার)

    প্রিয় মোতাহার!

    আমার কেবলই মনে পড়ছে (বোধ হয় ব্রাউনিং-এর) একটি লাইন, –

    How sad and bad, and mad it was, –

    But then, how it was sweet!

    আর, মনে হচ্ছে, ছোট্ট দুটি কথা – ‘সুন্দর’ ও ‘বেদনা’। এই দুটি কথাতেই আমি সমস্ত বিশ্বকে উপলব্ধি করতে পারি।…

    ‘সুন্দর’ ও ‘বেদনা’ , এ দুটি পাতার মাঝখানে একটি ফুল – বিকশিত বিশ্ব। একটি মক্ষীরানি, তাকে ঘিরেই বিশ্বের মধু-চক্র

    বাগানের মালি রাতদিন লাঠি নিয়ে বাগান আগলে আছে। বেচারা মানুষ তাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। মউমাছি তার মাথার ওপর দিয়ে গজল-গান গেয়ে বাগানে ঢোকে, সুন্দরের মধুতে ডুবে যায়, অস্ফুট কুঁড়ির কানে বিকাশের বেদনা জাগায়, প্রস্ফুটিত যে – তাকে ঝরে পড়ার গান শোনায়; – তার এতটুকু বাধে না, দেহে না, মনেও না। বেচারা মালি – যেন অঙ্কশাস্ত্রী মশাই! হাঁ করে তাকিয়ে দেখে আর মউ-মক্ষীর চরিত্রের এবং ‘আরো কত কি’-র সমালোচনা জুড়ে দেয়। মউ-মক্ষী কিছু শোনে না, সে কেবলই গান করে – সুন্দরের স্তব সে গান। তাকে মারো, সে সুন্দরের স্তব করতে করতেই মরবে। কোনো দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই, ভয় নেই। তাকে আবার বাঁচিয়ে ছেড়ে দাও, সে আবার সুন্দরের স্তব করবে, আবার বাগানে ঢুকে ফুলের পরাগে অন্ধ হয়ে ভগ্নপক্ষ হয়ে মরবে।

    সুষমা-লক্ষ্মীর বাগান আগলে বসে আছে নীতিবিদ বুড়ো সামাজিক হিতকামীর দল, – স্টার্ন, রিজার্ভ, রিজিড, ডিউটিফুল! কত বড়ো বড়ো বিশেষণ তাদের সামনে ও পেছনে! তারা সর্বদা এই ‘পোজ’ নিয়ে বসে আছে যে, তারা যদি না থাকত, তা হলে এক দিনে এই জগৎটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ত, একটা ভীষণ ওলটপালট হয়ে যেত। – বেচারা! দেখলে দয়া হয়।

    এদের মাঝেই – হয়তো কোটির মাঝে একটি – আসে সুন্দরের ধেয়ানী, কবি। সে রিজার্ভ নয়, ডিউটিফুল নয়, সে কেবলই ভুল করে, সে কেবলই Falls upon the thorns of life, he bleeds! সে সমস্ত শাসন সমস্ত বিধি নিষেধের ঊর্ধ্বে উঠে সুন্দরের স্তব গান করে skylark-এর মতো। সে কেবলই বলে, ‘সুন্দর – বিউটিফুল!’ মিলটনের স্বর্গের পাখির মতো তার পা নেই, সে ধুলার পৃথিবী স্পর্শও করে না।…

    কবি এবং মউ-মক্ষী। বিশ্বের মধু আহরণ করে মধুচক্র রচনা করে গেল এরাই।

    কোকিল, পাপিয়া, ‘বউ-কথা-কও’, ‘নাইটিঙ্গেল’, ‘বুলবুল’ – ডিউটিফুল বলে এদের কেউ বদনাম দিতে পারেনি। কোকিল তার শিশুকে রেখে যায় কাকের বাসায়, পাপিয়া তার শিশুর ভার দেয় ছাতার পাখিকে, ‘বউ-কথা-কও’ শৈশব কাটায় তিতির পাখির পক্ষপুটে! তবু, আনন্দের গান গেয়ে গেল এরাই। এরা ছন্নছাড়া, কেবলই ঘুরে বেড়ায়, শ্রী নাই, সামঞ্জস্য নাই, ব্যালেন্স-জ্ঞান নাই; কোথায় যায়, কোথায় থাকে – ভ্যাগাবন্ড একের নম্বর! ইয়ার ছোকরার দল! – তবু এরাই তো স্বর্গের ইঙ্গিত এনে দিল, সুন্দরের বৈতালিক, বেদনার ঋত্বিক – এই এরাই, শুধু এরাই! কবি আর বুলবুল

    কবি আর বুলবুল পাপ করে, তারা পাপের অস্তিত্বই মানে না বলে। ভুল – ভুলের কাঁটায় ফুল ফোটাতে পারে বলে।

    আমার কেবলই সেই হতভাগিনির কথা মনে পড়ছে – যার ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে ‘ডিউটিফুল’, আর পায়ের তলায় প্রস্ফুটিত শতদলের মতো – ‘বিউটিফুল’। পায়ের তলার পদ্ম – তার মৃণাল কাঁটায় ভরা, দুর্দিনে তার দল ঝরে যায়, পাপড়ি শুকিয়ে পড়ে – তবু সে সুন্দর! দেবতা গ্রেট হতে পারে – কিন্তু সুন্দর নয়। তার আর সব আছে, চোখে জল নেই।

    তুমি মনে করতে পার মোতাহার – আমারই চিরজনমের কবি-প্রিয়া আমারই বুকে শুয়ে কাঁদছে তার স্বর্গের দেবতার জন্য! মনে করো – সে বলছে আমায় – মাটির ফুল, আর তার দেবতাকে – আকাশের চাঁদ! আচ্ছা এমনি করে তোমায় কেউ বললে তুমি কী করতে বলো তো!

    আমার কথা স্বতন্ত্র। আমি এক সঙ্গে কবি এবং নজরুল। ওই কথা শুনে কবি খুশি হয়ে উঠল – বললে – এই বেদনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছ তুমি, ‘তোমায়’ –এর ঊর্ধ্বে, তোমার দেবতারও ঊর্ধ্বে নিয়ে যাব আমি – আমি তোমায় সৃষ্টি করব।

    কিন্তু নজরুল কেঁদে ভাসিয়ে দিলে। মনে হল সারা বিশ্বের অশ্রুর উৎস-মুখ যেন তার ওই দুটো চোখ। নজরুলের চোখে জল! খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে, না? এই চোখের দু-ফোঁটা জলের জন্য কত চাতকই না বুক ফেটে মরে গেল! চোখের সামনে!

    তুমি ভাবছ – আমি কী হেঁয়ালি! কী সব বলছি – যার মাথামুণ্ডু কিছু খুঁজে পাবে না। সত্যিই পাবে না। বুকের গোলকধাঁধায় কখনও ঢুকেছ কি বন্ধু? ওর পথ নেই, সমাধান নেই, মাথামুণ্ডু মানে – কিচ্ছু না!

    ওর মাঝে দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে শিশুর মতো কাঁদা ছাড়া আর কোনো কিছু করবার নেই!

    তুমি হয়তো পরজন্ম মান না, তুমি সত্যান্বেষী গণিতজ্ঞ। কিন্তু আমি মানি – আমি কবি।

    আমি বিশ্বাস করি যে, আমায় এমন করে চোখের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে – সে আমার আজকের নয়, সে আমার জন্ম-জন্মান্তরের, লোক-লোকান্তরের দুখ-জাগানিয়া। তার সাথে নব নব লোকে এই চোখের জলে দেখা এবং ছাড়াছাড়ি।

    তুমি হয়তো মনে করছ – বেচারা শেলি, বেচারা কিটস, বেচারা নজরুল! কেঁদেই মরল। রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, ‘দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মতো, কিটস-এর মতো খুব বড়ো একটা tragedy আছে, তুই প্রস্তুত হ!’ জীবনে সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারণে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি, কিন্তু আমারই জীবন রয়ে গেছিল বিশুষ্ক মরুভূমির মতো তপ্ত-মেঘের ঊর্ধ্বে শূন্যের মতো। কেবল হাসি কেবল গান! কেবল বিদ্রোহ – যে বিপুল সমুদ্রের উপরে এত তরঙ্গোচ্ছ্বাস, এত ফেনপুঞ্জ, তার নিস্তরঙ্গ নিথর অন্ধকার-তলার কথা কেউ ভাবে না। তাতে কত বড়ো বড়ো জাহাজ-ডুবি হল, সেইটেরই হিসেবে রাখলে শুধু, – আর সে যে কত বড়ো বড়ো জাহাজ-ডুবি হল, সেইটেরই হিসেবে রাখলে শুধু, – আর সে যে কত যুগ ধরে আপনার অতল তলায় বসে কেবলই শুক্তির পর শুক্তির বুকে মুক্তামালা রচনা করে গেল এবং আজ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে রইল তার সেই মুক্তামালা , – এ খবর কেউ রাখলে না।

    ফরহাদ, মজনু, চন্দ্রাপীড়, শাজাহান – এরা যেন এক একটা দৈত্য-শিশু। কিন্তু স্বর্গকে আজও ম্লান করে রেখেছে এরাই। – ফরহাদ পাগলটা শিরিঁর কথায় একটা গোটা পাহাড়কেই কেটে ফেললে। পাহাড়ের সব পাথর শিরিঁ হয়ে উঠল। প্রেমিকের ছোঁয়ায় পাহাড় হয়ে উঠল ফুলের স্তবক। পাষাণের স্তবগান উঠল ঊর্ধ্বে। কোথায় স্বর্গ! কোন তলায় রইল পড়ে!

    লায়লি – সাধারণ মেয়ে, মজনুঁ তাকে এমন করে সৃষ্টি করে গেল, যেমন করে – দেবতা তো দূরের কথা, ভগবানও সৃষ্টি করতে পারে না!

    শাজাহান – আরেক ফরহাদ! মোমতাজকে শিরিঁর মতো অমর করে গেল তাজমহলের মহাকাব্য রচনা করে। তাজমহল – যেমন নির্বাক ভাস্করের পাষাণ স্তব! মর্মরের মহাকাব্য!

    এইখানেই মানুষ স্রষ্টাকে হার মানিয়েছে।

    আমি চাচ্ছিলাম এই দুঃখ, এই বেদনা। কত দেশ-দেশান্তরে, গিরি-নদী-বন-পর্বত-মরুভূমি ঘুরেছি আমার এই অশ্রুর দোসরকে খুঁজতে। কোথাও ‘দেখা পেয়েছি – এই আনন্দের বাণী উচ্চারিত হয়নি আমার মুখ দিয়ে।

    তাই তো এবারকার তীর্থযাত্রাকে আমি বারেবারে নমস্কার করেছি। এতদিনে আমি যেন আপনাকে খুঁজে পেলাম। এবারে আমি পেয়েছি – প্রাণের দোসর বন্ধু তোমায় এবং চোখের জলের প্রিয়াকে।

    আর আজ লিখতে পারলাম না বন্ধু! বালিশ চেপে বুকের যন্ত্রণার উপশম হয়?

    তোমার –

    নজরুল

    .

    ২

    কৃষ্ণনগর

    ২৫.২.২৮

    বিকেল।

    বন্ধু!

    আজ সকালে এসে পৌঁচেছি১। বড্ড বুকে ব্যথা। ভয় নেই, সেরে যাবে এ ব্যথা। তবে ক্ষত-মুখ সারবে কিনা ভবিতব্যই জানে। ক্ষত-মুখের রক্ত মুখ দিয়ে উঠবে কিনা জানি না। কিন্তু আমার সুরে, আমার গানে, আমার কাব্যে সে রক্তের যে বন্যা ছুটবে তা কোনোদিনই শুকোবে না।

    আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো অভাব ছিল sadness-এর। কিছুতেই sad হতে পারছিলাম না। তাই ডুবছিলাম না। কেবল ভেসে বেড়াচ্ছিলাম কিন্তু আজ ডুবেছি, বন্ধু! একেবারে নাগালের অতলতায়।

    ভাসে যারা, তাদের কূল মেলা বিচিত্র নয়। কিন্তু যে ডোবে, তার আর উঠবার কোনো ভরসা রইল না। প্রতাপ-শৈবলিনী ভেসেছিল এক সাথে, তাদের কূলও মিলল।

    তোমাকে দু-দিনেই বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছি – তোমার গণিতের পাষাণ-টবে ফুলের চারা দেখতে পেয়েছি বলে। অদ্ভুত লোক তুমি কিন্তু! নিজেকে কেবলই অসুন্দরের আড়াল দিয়ে রাখছ! তোমাকে আমার নখ-দর্পণে দেখতে পাচ্ছি। – নিঃস্বার্থ, কোমল, অভিমানী, প্রেমিক – কিন্তু সবকে গোপন করে চলতে চাও যেন। তোমার তৃষ্ণা আছে, কিন্তু নেলসনের২ মতো তোমার তৃষ্ণার বারি অনায়াসে আরেকজনের মুখে তুলে দিতে পার।

    তুমি দেবতা! তোমাকে যদি কেউ ভুল করে, তবে তার মতো ভাগ্যহীন আর কেউ নেই।…

    তোমায় আমি বুঝি। কিন্তু কোনো নারী – সুন্দরের উপাসিকা নারী –কোনো অঙ্কশাস্ত্রীর কবলে পড়েছে, এ আমি সইতে পারিনে। নারী হবে সুন্দরের অঙ্কলক্ষ্মী, সে অঙ্কশাস্ত্রের ভাঁড়ার-রক্ষী হবে কেন? আমি কবি, হিসেব যেখানে – সেখানে আমি খড়গহস্ত। তুমি ভাবতে পার যে, সুন্দরই যার ধ্যান, সেই নারী রাস্তায় বসে দিনের পর দিন পাথর ভাঙবে, আর তারই পাশে সমানে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে পাহারা দেবে কর্তব্যপরায়ণ স্টার্ন একটা লোক? এবং ওই পাথর- ভাঙিয়ে লোকটা মনে করবে – সে একটা খুব বড়ো কাজ করছে! আর যে-কেউ তাকে দেবতা বলুক, – আমি তাকে বলি প্রাণহীন যক্ষ। অকারণে ভূতের মতো রত্ন-মানিক আগলে বসে আছে। সে রত্ন সে-ও গলায় নিতে পারে না – অন্যকেও নিতে দেবে না।

    হায় রে মূঢ় নারী! তাকে চিরকাল আগলে রইল বলেই যক্ষ হয়ে গেল দেবতা! অঙ্কের পাষাণ-টবে ঘিরে রেখে তিলোত্তমাকে তিলে তিলে মারাই যদি বড়ো দেবত্ব হয়, তবে মাথায় থাক আমার সে দেবত্ব! আমি ভালোবাসলে তাকে আমার বাঁধন হতে মুক্তি দিই। আমি কবি, আমি জানি কী করে সুন্দরের বুকে ফুল ফোটাতে হয়।

    যে যক্ষ রাজকুমারীকে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে পাষাণ-পুরীতে সোনার খাটে শুইয়ে রাখলে, তার অতি স্নেহকে কি দেবত্ব বলে ভুল করবে? হয় তাকে মেরে ফেলো, কিংবা ছেড়ে দিয়ে বাঁচতে দাও। রূপার কাঠির জাদুতে ঘুমিয়ে রইল বলেই রাজকুমারী হয়তো যক্ষকে অভিশাপ দিলে না – হয়তো বা দেবতাই মনে করলে! কিন্তু যেদিন না-চাওয়ার পথ দিয়ে এল না-দেখা রূপকুমার, তখন কোথায় রইল ‘যক্ষ’- কোথায় রইল পাষাণপুরী! আমার মনে হয় কী জান? ওই দেবতার মোহ যেদিন তেপান্তরের রূপকুমারীর ঘুচবে, সেদিন সে বেঁচে যাবে – বেঁচে যাবে।

    সে শুভদিনের প্রতীক্ষা করেই আমি মালা গাঁথব, গান রচনা করব। আমি এত বড়ো ধৈর্যহারা বোকা blunt নই যে, যাকে পেলাম না – তাকে আমার এই জন্মেই পেতেই হবে। তাকে মড়া-আগলা করে আগলাব, এ-প্রবৃত্তি আমার – কবির – হবে না; এ তুমি নিশ্চিত জেনো। যাক, বহু জন্ম হারিয়েছি তাকে পাবার জন্য আরও বহু জন্ম অপেক্ষা করতে পারব। তাই তো, যেই শুনলাম, আমার জন্য আর একজনের মুখ ম্লান হয়ে গেছে, অমনি চলে এলাম চিরদিনের মতো।

    বোধ হয় তোমার মনে আছে বন্ধু, তোমাকে শেষ অনুরোধ করে এসেছিলাম যে, তুমি কারুর অবিচারের বিচার কোরো না। কারুর ভুলের প্রতিশোধ ভুল দিয়ে কোরো না। কে তোমায় অপমান করতে পারে, যদি নিজেকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পার!

    যার কল্যাণ কামনা কর, সে যদি কোনোদিন তোমায় দুর্ভাগ্যবশত বিষদৃষ্টিতেই দেখে – তাকেই বরণ করে নিয়ো। তাকে ত্যাগ কোরো না। এ তোমার শুধু বন্ধুর অনুরোধই নয়, আরও কিছু।

    খবর দিয়ো – সব খবর। বুকের ব্যথা হয়তো তাতে কমবে। এখন কী ইচ্ছে করছে জান? চুপ করে শুয়ে থাকতে, সমস্ত লোকের সংস্রব ত্যাগ করে পদ্মার ধারে একটি একা কুটিরে। হাসি-গান আহার-নিদ্রা সব বিস্বাদ ঠেকছে।

    তোমার ছেলেমেয়েদের চুমু দিয়ো – তোমার বউকে সালাম।

    সেরে উঠলে জানাব। তোমার চিঠি চাই। এ চিঠি শুধু তোমার এবং আর একজনের। একে secret মনে কোরো। আর একজনকে দিয়ো এই চিঠিটা দু-দিনের জন্য।

    কতকগুলো ঝরা মুকুল দিলাম, নাও।

    তোমার

    নজরুল

    .

    ৩

    কৃষ্ণনগর

    ১.৩.২৮

    বিকেল

    প্রিয় মোতিহার!

    তোমায় এবার থেকে মোতিহার বলে ডাকব। কাল সকাল সাড়ে দশটায় তোমার এবং তোমার বোনের চিঠি পেয়েছি১। কালই উত্তর দিতাম, কিন্তু পরশু রাত্তির থেকে জ্বরটা ও গলার ব্যথা বড্ড বেড়ে ওঠায় কিছুতেই বসতে পারলাম না। তোমাদের চিঠি পাওয়ার পর থেকে জ্বর আরও বেড়ে ওঠে। সমস্ত দিন-রাত্তির ছিল – আজ ছেড়েছে সকালে। জ্বর ছেড়েছে, কিন্তু গলার ব্যথা সারেনি। কথা বলতে পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছে। আজ উপোস করছি। আল্লা মিয়াঁ রোজা না-রাখার শোধ তুলে নিলেন দেখছি – আচ্ছা করেই।

    সকালে তোমার বোনকে শেষ চিঠি লিখলাম। শেষ চিঠি মানে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে চিঠি দিয়ে আর অপমানিত করব না তাঁকে – এবং আমাকেও।

    বড্ড ‘শক’ পেয়েছি কাল ওঁর চিঠি পড়ে। শরীর মন দুই অসুস্থ বলে হয়তো এতটা লাগল – হবেও বা! কেমন লাগল – জান? বাজপাখির ভয়ে বেচারি কোকিল রাজকুমারীর ফুলবাগানে লুকোতে গিয়ে বুকে সহসা ব্যাধের তির বিঁধে যেমন ঘাড়মুড় দুমড়ে পড়ে, তেমনই।

    কাল থেকে কোথায় পালাই কোথায় পালাই করছিল মনটা। দৈব মুখ তুলে চেয়েছে। একটু আগে দিলীপের তার পেলাম, – আমি ফিরেছি কিনা জানতে চেয়েছে। এখনই তার করলাম – ফিরেছি। কাল দুপুরে কলকাতা যাচ্ছি। এখন সেখানে দু-দশদিন থাকব। অতএব তোমরা কেউ পত্র দিলে সেখানেই দিয়ো।

    আমার কলকাতার ঠিকানা, – ১৫, জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলিকাতা।

    ওখানে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু নলিনীকান্ত সরকার (musician) থাকেন। যাকে ‘বাঁধনহারা’ dedicate করেছি।

    এর মধ্যে তোমাদের চিঠি এসে পড়লে কলকাতায় redirected হয়ে যাবে– ব্যবস্থা করে গেলাম।

    তোমার অভিমান-তপ্ত চিঠি আমার যে কী ভালো লাগছে – তা আর কী বলব! কত বারই না পড়লাম – যেন প্রিয়ার চিঠি! ভাগ্যিস তুমি মেয়ে হয়ে জন্মাওনি – নইলে এবার তোমায়ই হয়তো ভালবেসে ফেলতাম ঢাকা গিয়ে। এমন দর্পণের মতো স্বচ্ছ, শহদের মতো মিষ্টি মন কোথায় পেলে বল তো নীরস গণিতবিদ।

    কাল তোমার চিঠিটা যদি এসে না পড়ত – তোমার বোনের চিঠির সাথে, তাহলে কী যে হত আমার – তা আমি ভাবতেও পারিনে।

    সে যাক। আজ যে তোমার চিঠি পাবই – মনে করেছিলাম। কেন চিঠি এল না, বলো তো? আমি রবিবারে তোমায় চিঠি পোস্ট করেছি এখানে। সে চিঠি অন্তত মঙ্গলবার সকালে পাওয়া উচিত ছিল তোমার। দেরি হয়ে গেছিল বলে Late-fee দিয়ে পোস্ট করতে দিয়েছিলাম। নিজে যেতে পারিনি পোস্ট করতে – কিন্তু যাকে দিয়েছি সে তো ভুল করবে না।

    কাল তোমার চিঠি পাবই আশা করছি। বোধ হয় নিরাশ হব না। আর, যদি হইই, কী আর করব।

    তুমি ছাড়া ঢাকার আর কারুর চিঠি পেতে ভয় করবে আমার – যদি ওই রকম চিঠি হয়। তবে, ওই এক চিঠি পেয়েই যতদূর বুঝেছি – আমায় তিনি দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে দয়া করবেন না।

    তোমার চাওয়া গানটা এবং তোমার লেখা (অগ্রদূত) চিঠিটা পাঠালাম। কপি করবার মতো হাতে জোর নেই, ভাই! কী যে দুর্বল হয়ে গেছি, তা ভাবতে পার না। গলায় ভিতর ঘা-ই হল না কি, solid কিছু খেতে পারছিনে। এর জন্যেও অন্তত কলকাতা যাওয়ার দরকার আমার। অগ্রদূতের চিঠিটা তোমার দেখা হলে পর আবার আমায় পাঠিয়ে দিয়ো কলকাতায়। ওটার উপর তোমার কোনো দাবি নেই।

    বুদ্ধদেব বসুকে একটা কবিতা পাঠালাম।৪ গজল-গানের স্বরলিপিও পাঠাচ্ছি আজকালের মধ্যে – দেখা হলে বোলো।

    আবুল হোসেন৬ খুব রেগেছেন, নয়? ওঁর কাছে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ো। আমি যে কেমন করে ফিরে এসেছি, আমিই জানিনে।

    আবুল হোসেন, মি. বোরা৭, কাজী আবদুল ওদুদ৮ প্রভৃতিকে আমার সকল অপরাধ ক্ষমা করতে বোলো।

    বুদ্ধদেব খুব রেগে চিঠি দিয়েছে – কেন অমন করে না বলে চলে এলাম। কেন যে এলাম, তা কি আমিই জানি।…

    তুমি নিশ্চয় যাও তোমার বোনের ওখানে। ওঁর দিন কেমন কাটছে। আমার খুব হয়তো বদ্‌নাম করছেন – খুব ক্ষুব্ধ হয়তো আমার উপর – না? কী সব আলাপ হল তোমাদের মধ্যে আমায় নিয়ে? কত কথাই না জানতে ইচ্ছা করে, বন্ধু! জানাবে কি?

    তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই; সত্য যত বড়ো নিষ্ঠুর হোক – তাকে সইতে পারব – এ ভরসা আছে আমার।

    আচ্ছা মোতিহার! তুমি কোনোদিন কাউকে ভালোবেসেছিলে? তখন তোমার কী মনে হত? খুব কি যন্ত্রণা হত বুকে? সে ছাড়া জগতের আর সব-কিছু কি বিস্বাদ ঠেকত তখন?

    এত সুন্দর এত কোমল – একমুঠো ফুলের মতো তোমার মন – হয়তো আজও পিষ্ট হয়নি কোনো বে-দরদির রাঙা চরণে। তোমার চিঠি পড়ে এক একবার হাসি পাচ্ছে, আবার খুশিও হয়ে উঠছি এই ভেবে যে, তুমি তো পুরুষ মানুষ – তোমারই যদি এই অবস্থা হয় আমায় দেখে বা ভালো লেগে – কোনো তরুণী যদি কোনোদিন ভালোবাসত আমায়, তাহলে তার কী অবস্থা হত।

    তুমি এক জায়গায় লিখেছ, ‘মনে হয় যেন একটু দুঃখ পাচ্ছি – কিন্তু কী মধুর সে দুঃখ!’ এ দুঃখ কি আমাকে হারিয়ে? আমায় বলতে তোমার সংকোচ হবে না নিশ্চয়। সেতুই কি শেষে জলে পড়ে গেল?

    আচ্ছা মোতিহার! তুমি যে দেবতার পায়ে ‘চুঙ্গল’৯ (অবশ্য তোমার এ কথাটার মানে জানি না) এবং মাথায় শিং দেখেছ – সে দেবতা কি আমি? আমার বন্ধুরা আমার গোঁ ও শরীর দেখে আমায় ‘বাবা তারকনাথের ষাঁড়’ বলে গালি দেন – শত্রুরাও অন্তত এই শরীরটার আর শিং দুটোর জন্যই ভয়ে জড়সড় – কিন্তু এরই মধ্যে তুমি এ কথা জানলে কী করে – বলো তো! এ জানার ‘সোর্স’ কি ‘অন্য কেউ?’ তুমি আমার শিং দেখেছ – তিনি তো আমার হয়তো দশটা মুণ্ডু বিশটা হাত দেখেছেন! কোরানে আছে – শয়তানের চেয়ে সুন্দর করে কাউকে সৃষ্টি করেননি খোদা। আমরাও তো বিউটিফুলের উপাসক, – জগতে সুন্দর ছাড়া পাপ-পুণ্য – মন্দ-ভালোর খবরই রাখিনে, – কাজেই শিং যে দেখবে ফুলচন্দন দিতে এসে, তাতে আর বিচিত্র কী!

    আচ্ছা, সত্যি করে লিখো তো, আমি যে তোমায় চিঠি দিয়েছি – এ খবর তুমি জেনেছিলে – না দেখেছিলে?

    গত বছর এমনই দিনে তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ঢাকায়। কিন্তু সে বার তো তুমি অনেকটা দূরে দূরেই ছিলে। এবার কি খুব একটা দুঃখের ভিতর দিয়েই আমরা পরস্পর পরস্পরকে পেয়েছি? এ রহস্যের তো হদিস খুঁজে পাচ্ছিনে, বন্ধু! তোমরা গণিতবিদ, ক্লিয়ার ব্রেন তোমাদের, হয়তো এর solution খুঁজে পাবে।

    ‘Sympathetic vibration’ music-এ আছে জানতাম – ওটা mathematics-এও আছে জেনে mathematics-এর ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে।

    আচ্ছা, telepathy টা কি Science-এর না কাব্যের? এমনি দু-একটা জায়গায় এসে অঙ্কে-কবিতায়-বিজ্ঞানে-সুরে হৃদয়-বিনিময় হয়ে গেছে বোধ হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে এইবার আমার নতুন করে মনে হচ্ছে – স্রষ্টা গণিতবিদ না কবি। লোকটা এত হিসেবি অথচ এত সুন্দর!

    আমার বেদনার একটা উপশম হয়েছে এই ভেবে যে, অন্তত একজনের দীর্ঘনিশ্বাস পড়েছে আমার পত্রের প্রতীক্ষায় থেকে – তা হোক না সে পুরুষ। আচ্ছা বন্ধু, এত শক্ত মনের পুরুষ, তার কান্না পায় আমার এতটুকু অবহেলায়, – আর একজন নারী – হোক না সে পাষাণ-প্রতিমা – তার কিচ্ছু হয় না? (আমার আর একজন বন্ধু আছেন প্রফেসার সাতকড়ি মিত্র। রংপুরে ইকনমিক্সের অধ্যাপক। তিনি বাড়ি এলে আমার কাছেই থাকতেন দিনরাত – তখন আমি কলকাতায় থাকতাম। তাই দেখে তাঁর স্ত্রী জানালায় দাঁড়িয়ে আমায় ‘সতিন’, ‘সতিন’ বলে গাল দিতেন। অনেক বন্ধুর স্ত্রীরই আমি ‘সতিন’।) কিন্তু ভাবতে পারছিনে – মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে বন্ধু একজন নারী – সেও এত নিষ্ঠুর হতে পারে?

    যাক, আজ ডাকের সময় যাচ্ছে। আবার লিখব। কলকাতাতে ওই ঠিকানায় চিঠি দিয়ো। তুমি আমার ভালোবাসা নাও।

    খোকা-খুকিদের চুমু দিয়ো। ইতি –

    তোমার

    নজরুল

    .

    ৩

    ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট,

    কলিকাতা

    ৮.৩.২৮

    সন্ধ্যা।

    প্রিয় মোতিহার!

    পরশু বিকেলে এসেছি কলকাতা। ওপরের ঠিকানায় আছি। ওর আগেই আসবার কথা ছিল – অসুখ বেড়ে ওঠায় আসতে পারিনি।

    দু-চারদিন এখানেই আছি। মনটা কেবলই পালাই পালাই করছে। কোথায় যাই ঠিক করতে পারছিনে। হঠাৎ কোনোদিন কোনো এক জায়গায় চলে যাব। অবশ্য দু-দশ দিনের জন্য।

    যেখানেই যাই – আর কেউ না পাক, তুমি খবর পাবে।

    বন্ধু! তুমি আমার চোখের জলের ‘মোতিহার’, বাদল-রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে, সেদিন অন্তত তোমার বুক ব্যথিয়ে উঠবে তোমার ওই ছোট্ট ঘরটিতে শুয়ে – যে ঘরে তুমি আমায় প্রিয়ার মতো জড়িয়ে শুয়েছিলে। অন্তত এইটুকু সান্ত্বনাও নিয়ে যেতে পারব। এ কি কম সৌভাগ্য আমার? সেদিন তোমার শয়নসাথি প্রিয়ার চেয়েও হয়তো বেশি করে মনে পড়বে এই দূরের বন্ধুকে। কেন এ-কথা বলছি শুনবে?

    বন্ধু আমি পেয়েছি – যার সংখ্যা আমি নিজেই করতে পারব না। এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু। ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে ওঠেনি কেউ!

    আমার চোখের জলের বাদলা রাতে এরা কেউ এসে হাত ধরেনি। আমার চোখের জল! কথাটা শুনলে এরা হেসে কুটপাট হবে!

    আমার জীবনের সবচেয়ে গোপন সবচেয়ে করুণ পাতাটির লেখা তোমার কাছে রেখে গেলাম। আমার দিক দিয়ে এর একটা কী যেন প্রয়োজন ছিল!…

    আচ্ছা, আমার রক্তে রক্তে শেলিকে১ কিট্‌সকে২ এত করে অনুভব করছি কেন? বলতে পার? কিট্‌স-এর প্রিয়া ফ্যানিকে৩ লেখা তাঁর কবিতা পড়ে মনে হচ্ছে, যেন এ কবিতা আমি লিখে গেছি। কিট্‌স-এর ‘সোর-থ্রোট’ হয়েছিল – আর তাতেই মরল ও শেষে – অবশ্য তার সোর্স হার্ট কি না কে বলবে! – কণ্ঠপ্রদাহ রোগে আমিও ভুগছি ঢাকা থেকে এসে অবধি, রক্তও উঠছে মাঝে মাঝে – আর মনে হচ্ছে আমি যেন কিট্‌স। সে কোন ফ্যানির নিষ্করুণ নির্মমতায় হয়তো বা আমারও বুকের চাপ-ধরা রক্ত তেমনি করে কোনদিন শেষ ঝলকে উঠে আমায় বিয়ের বরের মতো করে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে।

    তারপর হয়তো বা বড়ো বড়ো সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়তো আমার নামে! দেশপ্রেমিক, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী – বিশেষণের পর বিশেষণ! টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে – বক্তার পর বক্তা।

    এই অসুন্দর শ্রদ্ধানিবেদনের শ্রাদ্ধ-দিনে – বন্ধু! তুমি যেন যেয়ো না। যদি পার, চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোনো একটি কথা স্মরণ কোরো। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশে-পাশে যদি একটা ঝরা, পায়ে-পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বোলো – ‘বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি।’

    আকাশের সব চেয়ে দূরের যে তারাটির দীপ্তি চোখের জলকণার মতো ঝিলিমিলি করবে – মনে কোরো সেই তারাটি আমি। আমার নামে তার নামকরণ কোরো! কেমন?

    মৃত্যুকে এত করে মনে করি কেন জান? ওকে আজ আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হচ্ছে বলে। মনে হচ্ছে, জীবনে যে আমায় ফিরিয়ে দিলে, মরণে সে আমায় বরণ করে নেবে।

    সমস্ত বুকটা ব্যথায় দিনরাত টনটন করছে – মনে হচ্ছে, সমস্ত রক্ত যেন ওইখানে এসে জমাট বেঁধে যাচ্ছে। ওর যদি মুক্তি হয়, বেঁচে যাব। কিন্তু কী হবে, কে জানে?

    হয়তো দিব্যি বেঁচে থাকব – কিন্তু ওই বেঁচে থাকাটা অসুন্দর বলেই ওকে যেন দু-হাত দিয়ে ঠেলছি। বেঁচে থাকলে হয়তো তাকে হারাব। তারই বুকে তিলে তিলে আমার মৃত্যু হবে।

    কেবলই মনে হচ্ছে, কোন নবলোকের আহ্বান আমি শুনতে পেয়েছি। পৃথিবীর সুধা বিস্বাদ ঠেকছে যেন।…

    তোমার চিঠি পেয়ে অবধি, কেবলই ভাবছি আর ভাবছি। কত কথা – কত কী, তার কি কূল-কিনারা আছে।

    কত কথা জানতে ইচ্ছে করে! কিন্তু কী সে কত কথা, তা বলতে পারিনে। দু-দিন আগে পারতাম। আজ আর পারব না। হৃদয়ের প্রকাশ যেখানে লজ্জার কথা – হয়তো বা অবমাননাকরও, সেখান পর্যন্ত গিয়ে পঁহুচবে আমার কাঙাল মনের এই করুণ যাচ্ঞা, এ ভাবতেও মনটা কেমন যেন মোচড় খেয়ে ওঠে।

    আমার ব্যথার রক্তকে রঙিন খেলা বলে উপহাস যিনি করেন, তিনি হয়তো দেবতা–আমাদের ব্যথা-অশ্রুর বহু ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমি ‘মাটির নজরুল’ হলেও সে-দেবতার কাছে অশ্রুর অঞ্জলি আর নিয়ে যাব না।

    কবির কাব্যের প্রতি এত অশ্রদ্ধা যাঁর – তাঁকে শ্রদ্ধা আমি যতই করিনা কেন – পুনরায় কাব্যের নৈবেদ্য দিয়ে তাঁকে ‘খেলো’ করবার দুর্মতি যেন আমার কোনোদিন না জাগে।

    ফুল ধুলায় ঝরে পড়ে, পায়ে পিষ্টও হয়, তাই বলে কি ফুল এত অনাদরের? ভুল করে সে ফুল যদি কারুর কবরীতেই খসে পড়ে, এবং তিনি সেটাকে উপদ্রব বলে মনে করেন, তাহলে ফুলের পক্ষে প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে তখ্‌খনি কারুর পায়ের তলায় পড়ে আত্মহত্যা করা।

    পদ্ম তার আনন্দকে শতদলে বিকশিত করে তোলে বলেই কি ওটা পদ্মের বাড়াবাড়ি? কবি তার আনন্দকে কথায়-ছন্দে সুরে পরিপূর্ণ পদ্মের মতো করে ফুটিয়ে রাঙিয়ে তোলে বলেই কি তার নাম হবে ‘খেলো’? অকারণ উচ্ছ্বাস? সুন্দরের অবহেলা আমি সইতে পারিনে বন্ধু, তাই এত জ্বালা।

    তুমি আমার ‘শেষ চিঠি’ দেখেছ, লিখেছ। ‘শেষ চিঠি’ লিখে একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন দিয়েছ। তোমার এ প্রশ্নের কী উত্তর দিব?

    জল খুব তরল, সর্বদা টলটলায়মান, – কিন্তু যে দেশের ঋতুলক্ষ্মী অতিরিক্ত Cold – সে দেশের জলও জমে বরফ হয়ে যায় – শুনেছ? অতিরিক্ত শৈত্যে জল জমে পাথর হয়, ফুল যায় ঝরে, পাতা যায় মরে, হৃদয় যায় শুকিয়ে।…

    ভিক্ষা যদি কেউ তোমার কাছে চাইতেই আসে অদৃষ্টের বিড়ম্বনায়, তাহলে তাকে ভিক্ষা না-ই-দাও, কুকুর লেলিয়ে দিয়ো না যেন।…

    আঘাত আর অপমান, এ দুটোর প্রভেদ বুঝবার মতো মস্তিষ্ক পরিষ্কার হয়তো আছে আমার। আঘাত করবার একটা সীমা আছে, যেটাকে অতিক্রম করলে – আঘাত অসুন্দর হয়ে ওঠে – আর তখনই তার নাম হয় অবমাননা। – গুণীও বীণাকে আঘাত করেই বাজান, তাঁর অঙ্গুলি-আঘাতে বীণার কান্না হয়ে ওঠে সুর। সেই বীণাকেই হয়তো আর একজন আঘাত করতে যেয়ে ফেলে ভেঙে।

    মন্থনের একটা স্টেজ আসে – যাতে করে সুধা ওঠে। সেইখানেই থামতে হয়। তারপরেও মন্থন চালালে ওঠে বিষ।

    যে দেবতাকে পূজা করব – তিনি পাষাণ হন তা সওয়া যায়, কিন্তু তিনি যেখানে আমার পূজার অর্ঘ্য উপদ্রব বলে পায়ে ঠেলেন, সেখানে আমার সান্ত্বনা কোথায় বলতে পার…?

    তুমি অনেক কথাই লিখেছ তাঁর হয়ে। তোমায় আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু একটা কথা তোমায় মনে রাখতে বলি, বন্ধু! আমার বেদনায় সান্ত্বনা দেবার জন্য তাঁর সোজা কথাকে রঙিন করে বলে আমায় খুশি করতে চেয়ো না যেন। এতে আমি হয়তো একটু ক্ষুব্ধই হব।

    আমার আহত অভিমানের দুঃখে তুমি ব্যথা পেয়ে কী করবে, বন্ধু? সত্যিই আমি হয়তো অতিরিক্ত অভিমানী। কিন্তু তার তো ঔষধ নেই। বীণার তারের মতো নার্ভগুলো সুরে বাঁধা বলেই হয়তো একটু আঘাতে এমন ঝনঝন করে ওঠে।– ছেলেবেলা থেকে পথে পথে মানুষ আমি! যে স্নেহে যে প্রেমে বুক ভরে ওঠে কানায় কানায় – তা কখনও কোথাও পাইনি। শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা – শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। ও নিয়ে কি আমি ধুয়ে খাব? তাই হয়তো অল্পেই অভিমান হয়। বুকের রক্ত চোখের জল হয়ে দেখা দেবার আগেই তাকে গলার কাছে প্রাণপণ বলে আটকিয়েছি। এক গুণ দুঃখ হলে দশ গুণ হেসে তার শোধ নিয়েছি। সমাজ রাষ্ট্র মানুষ – সকলের ওপর বিদ্রোহ করেই তো জীবন কাটল!

    এবার চিঠির উত্তর দিতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। না জানি কত উদ্‌বিগ্ন হয়েছ। কী করি বন্ধু, শরীরটা এত বেশি বেয়াড়া আর হয়নি কখ্‌খনো। ওষধ খেতে প্রবৃত্তি হয় না। কেন যেন ‘মরিয়া হইয়া’ উঠেছি ক্রমেই। বুকের ভিতর কী যেন অভিমান অসহায় বেদনায় ফেনায়িত হয়ে উঠছে। রোজ তাই কেবলই গান গাচ্ছি। ডাকেরও অভাব নেই। রোজ হয়তো দশ জায়গা হতে ডাক আসে। কেবলই মনে হচ্ছে, আমার কথার পালা শেষ হয়েছে, এবার শুধু সুরে সুরে গানে গানে প্রাণের আলাপন।…

    কাল একটি মহিলা বলছিলেন, ‘এবার আপনায় বড্ড নতুন নতুন দেখাচ্ছে। যেন পাথর হয়ে গেছেন! সে হাসি নেই। সে কথার খই ফুটছে কই মুখে? বেশ ভাবুক ভাবুক দেখাচ্ছে কিন্তু।’

    আচ্ছা ভাই মোতিহার, বলতে পারিস – তোর ফিজিক্স শাস্ত্রে আছে কি না জানিনে – আকাশের গ্রহতারার সাথে মানুষের কোনো relation আছে কি না। সত্যিই তারায় তারায় বিরহীরা তাদের প্রিয়ের আশায় অপেক্ষা করে?

    আমায় সবচেয়ে অবাক করে নিশীথ রাতের তারা। তার শব্দহীন উদয়াস্ত ছেলেবেলা থেকে দেখি আর ভাবি। তুমি হয়তো অবাক হবে, আমি আকাশের প্রায় সব তারাগুলিকে চিনি। তাদের সত্যিকারের নাম জানিনে, কিন্তু ওদের প্রত্যেকের নামকরণ করেছি আমার ইচ্ছা মতো। সে কত রকম মিষ্টি মিষ্টি নাম, শুনলে তুমি হাসবে। কোন তারা কোন ঋতুতে, কোন দিকে উদয় হয়, সব বলে দিতে পারি। জেলের ভিতর যখন সলিটারি সেলে বন্ধ ছিলাম, তখন গরমে ঘুম হতো না; সারারাত জেগে কেবল তারার উদয়াস্ত দেখতাম – তাদের গতিপথে আমার এই চোখের জল বুলিয়ে দিয়ে বলতাম – ‘বন্ধু, ওগো আমার নাম-না-জানা বন্ধু! আমার চোখের জলের পিচ্ছিল পথটি ধরে তুমি চলে যাও অস্তপারের পানে, আমি শুধু চুপটি করে দেখি! হাতে থাকত হাতকড়া – দেওয়ালের সঙ্গে বাঁধা, চোখের জলের রেখা আঁকা থাকত বুকে মুখে – ক্ষীণ ঝরনাধারার চলে যাওয়ার রেখা যেমন করে লেখা থাকে।

    আজও লিখছি – বন্ধুর ছাদে বসে। সব্বাই ঘুমিয়ে – তুমি ঘুমুচ্ছ প্রিয়ার বাহুবন্ধনে। আরও কেউ হয়তো ঘুমুচ্ছে – একা শূন্য ঘরে – কে যেন সে আমার দূরের বন্ধু – তার সুন্দর মুখে নিবু-নিবু প্রদীপের ম্লান রেখা পড়ে তাকে আরও সুন্দর আরও করুণ করে তুলেছে – নিশ্বাস-প্রশ্বাসের তালে তালে তার হৃদয়ের ওঠাপড়া যেন আমি এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি– তার বাম পাশের বাতায়ন দিয়ে একটা তারা হয়তো চেয়ে আছে – গভীর রাতে মুয়াজ্জিনের আজানে আর কোকিলের ঘুম-জড়ানো সুরে মিলে তার স্তব করছে। – ‘ওগো সুন্দর! জাগো! জাগো! জাগো!…’

    আচ্ছা বন্ধু, ক-ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয় – তোমাদের বিজ্ঞানে বলতে পারে? এখন কেবলই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে – যার উত্তর নেই মীমাংসা নেই সেই সব জিজ্ঞাসা।

    যেদিন আমি ওই দূর তারার দেশে চলে যাব – সেদিন তাকে বোলো এই চিঠি দেখিয়ে – সে দিন দুটি ফোঁটা অশ্রু তর্পণ দেয় শুধু আমার নামে! হয়তো আমি সেই দিন খুশিতে উল্কা-ফুল হয়ে তার নোটন-খোঁপায় ঝরে পড়ব।

    তাকে বোলো বন্ধু তার কাছে আমার আর চাওয়ার কিছু নেই। আমি পেয়েছি – তাকে পেয়েছি – আমার বুকের রক্তে, চোখের জলে। বড্ড ঝড় উঠেছিল মনে তাই দুটো ঝাপটা লেগেছে তার চোখে মুখে। আহা! সুন্দর সে, সে সইতে পারবে কেন এ নিষ্ঠুরতা? সে লতার আগায় ফুল, সে কি ঝড়ের দোলা সইতে পারে? দখিনের গজল-গাওয়া মলয়-হাওয়া পশ্চিমের প্রভঞ্জনে পরিণত হবে – সেকি তা জানত? ফুল-বনে কি ঝড় উঠতে আছে?

    বলো বন্ধু, আমার সকল হৃদয়-মন তারই স্তবগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে। আমার চোখ-মুখে তারই জ্যোতি – সুন্দরের জ্যোতি – ফুটে উঠেছে। পবিত্র শান্ত মাধুরীতে আমার বুক কানায় কানায় ভরে উঠেছে – দোল পূর্ণিমার রাতে বুড়িগঙ্গায় যেমন করে জোয়ার এসেছিল তেমনি করে। আমি তার উদ্দেশ্যে আমার শান্ত স্নিগ্ধ অন্তরের পরিপূর্ণ চিত্তের একটি সশ্রদ্ধ নমস্কার রেখে গেলাম। আমি যেন শুনতে পাই, সে আমায় সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা করেছে। আমার সকল দীনতা সকল অত্যাচার ভুলে আমাকে আমারও ঊর্ধ্বে সে দেখতে পেয়েছে – যেন জানতে পাই। ভুলের কাঁটা ভুলে গিয়ে তার ঊর্ধ্বে ফুলের কথাই যেন সে মনে রাখে।

    সত্যিই তো তার – আমার সুন্দরের – চরণ ছোঁয়ার যোগ্যতা আমার নেই। আমার যে দু হাত মাখা কালি। বলো, যে কালি তার রাঙা পায়ে লেগেছিল, চোখের জলে তা ধুয়ে দিয়েছি।

    আর – অগ্রদূত! বন্ধু! তোমায়ও আমি নমস্কার – নমস্কার করি। তুমি আমার তারালোকের ছায়াপথ। তোমার বুকেই পা ফেলে আমি আমার সুন্দরের ধ্রুবলোকে ফিরে এসেছি! তুমি সত্যই সেতু, আমার স্বর্গে ওঠার সেতু।

    ভয় নেই বন্ধু, তুমি কেন এ ভয় করেছ যে, আমি তার নারীত্বের অবমাননা করব। আমি মানুষের নীচে না উপরে, জানি না; কিন্তু তুমি ভুলে গেছ যে – আমি সুন্দরের ঋত্বিক। আমি দেবতার বর পেলাম না বলে অভিমান করে দু-দিন কেঁদেছি বলেই কি তাঁর অবমাননা করব? মানুষ হলে হয়তো পারতাম। কিন্তু বলেছি তো বন্ধু, যে, কবি মানুষের – হয় বহু ঊর্ধ্বে অথবা বহু নিম্নে। হয়তো নিম্নেই। তাই সে ঊর্ধ্বে স্বর্গের পানে তাকিয়ে কেবলই সুন্দরের স্তবগান করে।

    আমি হয়তো নীচেই পড়ে থাকব; কিন্তু যাকে সৃষ্টি করব– সে স্বর্গেরও ঊর্ধ্বে আমারও ঊর্ধ্বে উঠে যাবে। তারপর আমার মুক্তি।

    সে যদি আমার কোনো আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তাকে বোলো– আমি তাকে প্রার্থনার অঞ্জলির মতো এই করপুটে ধরে তুলে ধরতে – নিবেদন করতেই চেয়েছি। – বুকে, মালা করে ধরতে চাইনি। দুর্বলতা এসেছিল, তাকে কাটিয়ে উঠেছি। সে আমার হাতের অঞ্জলি, – button hole-এর ফুল-বিলাস নয়।…

    ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে আবার লিখছি। কিন্তু আর লিখতে পারছিনে ভাই! চোখের জল কলমের কালি দুই শুকিয়ে গেল।

    তোমরা কেমন আছ জানিয়ো। তার কিছু খবর দাও না কেন? না, সেটুকুও নিষেধ করেছে? ঠিক সময়মতো সে ওষুধ খায় তো?

    কেবলই কিট্‌সকে স্বপ্ন দেখছি – তার পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যানি ব্রাউন। পাথরের মতো। ভালোবাসা নিয়ো। ইতি–

    তোমার

    নজরুল

    এই ঠিকানাতেই চিঠি দিয়ো। এবার ‘সওগাতে’ কিছু লিখতে পারিনি – শরীর মনের অক্ষমতার জন্য। এ মাসে লিখব অবশ্য। ইতি-

    নজরুল

    .

    ৪

    ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট

    কলিকাতা

    ১০.৩.২৮, রাত্রি ২টা

    প্রিয় মোতিহার!

    কাল সকালে তোমার চিঠি পেয়েছি। সুন্দরের ছোঁয়া-লাগা চিঠি। তারই আনন্দে অভিভূত হয়ে কেটেছে আমার দুটো দিন। দুটি কথা তাতেই এত মধু!

    কাল ঘুমুতে পারিনি। আজও কিছুতেই ঘুম এল না। তাই তোমায় চিঠি লিখতে বসে গেলাম।

    কাল থেকে মনে হচ্ছে, আমার সব অসুখ সেরে গেছে। সত্যি ভাই, আজ অনেকটা ভালো আছি।

    আজ ‘দেবদাস’ দেখতে গেছিলাম ছায়াচিত্রে১ – সে কথা পরে লিখছি। রোসো আগে দরকারি কথা কয়টা লিখে নিই।

    কাল আমার চিঠি পোস্ট করার একটু পরেই তোমার চিঠি এসে পঁহুচল।

    আমার চিঠি বোধ হয়, আজ সন্ধ্যয় পেয়েছ। না? আচ্ছা, তোমরা কলকাতার চিঠি কখন পাও, সকালে না সন্ধ্যায়? মনে করে লিখো কিন্তু।

    তাহলে আমি চিঠি দিয়ে তার পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় বসে বসে ভাবব যে, এতক্ষণ তুমি আমার চিঠি পড়ছ।

    আচ্ছা ভাই, আমার সব চিঠিই কি তোমার বোনকে২ দেখাও? বড্ড জানতে ইচ্ছা করছে। চিঠিগুলো আবার ফিরিয়ে নাও তো?

    উনি যদি দেখেন সব চিঠি, তা হলে একটু সাবধানে লিখব, বন্ধু। বাপরে। ওঁর একটা চিঠি পেয়েই তার তাল আজও সামলাতে পারছিনে। ওঁকে রাগাবার দুঃসাহস আর আমার নেই।

    লিখি আর ভয়ে বুক দুরু দুরু করে কাঁপে, এই রে! বুঝি বা কোথায় কী বেফাঁস লিখে তাঁকে ‘খেলো’ করে ফেললাম। এই বুঝি ‘কবির খেয়াল’ হয়ে গেল লেখাটি!– এমনইতর এ ভয় সব।

    আচ্ছা, তোমাদের গণিতজ্ঞদের মতো দুটি লাইনে দু-হাজার কথার উত্তর লেখার কায়দাটা আমায় শিখিয়ে দেবে?

    গণিতের প্রতি আমার ভয় কি কোনো দিনই যাবে না? গণিতজ্ঞ লোকেরা বড্ড কঠোর নিষ্ঠুর হয় –এ অভিযোগের সদুত্তর তুমি ছাড়া বুঝি আরেকটা নেই জগতে। ওদের কেবল intellect, heart নেই।

    গণিতের প্রতি আমার ভয় কি কোনো দিনই যাবে না? গণিতজ্ঞ লোকেরা বড্ড কঠোর নিষ্ঠুর হয় –এ অভিযোগের সদুত্তর তুমি ছাড়া বুঝি আরেকটা নেই জগতে। ওদের কেবল intellect, heart নেই।

    কিন্তু, একটা সত্যি কথা বলব? হেসো না কিন্তু। আমার এতদিনে ভারী ইচ্ছে করছে অঙ্ক শিখতে। হয়তো চেষ্টা করলে বুঝতে পারি এখনও জিনিসটে। আমি আমার এক চেনা অঙ্কের অধ্যাপকের কাছে পরশু অনেকক্ষণ ধরে আলাপ-আলোচনা করলাম অঙ্ক নিয়ে। এম.এ. ক্লাসে কী অঙ্ক কষতে হয় – সব শুনলাম সুবোধ বালকের মতো রীতিমতো মন দিয়ে। শুনে তুমি অবাক হবে যে, আমার এতে উৎসাহ বাড়ল বই কমল না। কেন যেন এখন আর অত কঠিন বোধ হচ্ছে না ও জিনিসটে। আমি যদি বি.এ.-টা পাস করে রাখতাম, তাহলে দেখিয়ে দিতাম যে, এম.এ.-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট কবিও হতে পারে ইচ্ছে করলে।

    যদি ঢাকায় থাকতাম, তাহলে তোমার কাছে আবার একবার যাদব চক্রবর্তীর৩ Algebra নিয়ে বসে যেতাম – একেবারে (a+b)2 থেকে শুরু করে। সত্যি ভাই মোতিহার, আমায় অঙ্ক শেখাবে? তাহলে ঢাকায় যেতে রাজি আছি। এমন অঙ্ক শিখিয়ে দিতে পারে না কেউ, যাতে করে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এম.এ.-কে হারিয়ে দিতে পারি?

    এখন কেবলই মনে হচ্ছে, কী ছাই করলাম কবিতা লিখে! তার চেয়ে অঙ্কর প্রফেসর হলে ঢের বেশি লাভবান হতে পারতাম।

    যাক। তোমার বোনকে বোলো, এত দূরে থেকেও তাঁর ভয় আর আমার গেল না। বেশি চা ও পান খেতে তিনি এমনই কথায় কথায় নিষেধ করেছিলেন, সেই অবধি ওই দুটো জিনিস মুখের কাছে তুলেই এতটুকু হয়ে যাই ভয়ে। হাত কাঁপতে থাকে। আমার স্কুলের অঙ্কের মাস্টার ভোলানাথ বাবুকে মনে পড়েও অত ভয় হয় না।

    ওকে বোলো, ‘অবুঝের মতো অত্যাচার’ করতে হয়তো এখন থেকে ভয়ই হবে।

    অঙ্কের মহিমা আছে বলতে হবে।

    কিন্তু মন কেন এমন করে অবুঝের মতো কেঁদে ওঠে? ওখানে যে আমি নাচার।

    ওঁকে একটা অনুরোধ করবে বন্ধু আমার হয়ে? বোলো – ‘যাকে ভাসিয়ে দিয়েছ স্রোতে, তাকে দড়ি বেঁধে ভাসিয়ো না! ওকে তরঙ্গের সাথে ভেসে যেতে দাও, পাহাড় কি চোরাবালি কি সমুদ্দুর এক জায়গায় গিয়ে সে ঠেকবেই।’ যেই সে স্রোতে ভাসতে যাবে, অমনি দড়ি ধরে টানবে – এ হয়তো তাঁর খেলা, আমার কিন্তু এ যে মৃত্যু।

    একটি ছোট্ট আদেশের বেড়া এমন অলঙ্ঘ্য হয়ে ওঠে, তা কে জানত!

    তোমার চিঠির কতকগুলো দরকারি কথার উত্তর দিতে হবে। কালকের চিঠিতে যা সব লিখেছি, তা তো তোমার চিঠির উত্তর নয়। তা হয়তো ‘কবির খেয়াল।’

    তবে ও রোগে তোমাকেও ধরেছে বলে তোমায় লিখতে ভয় নেই।

    এই চিঠি পড়ে যদি কেউ রাগ করেন, তাহলে তাঁকে বোলো – পাথরের রাগ করতে নেই। তাহলে পাথর নড়তে হয়?

    তোমার বউ বেচারির বয়স কত হল! নিশ্চয়ই এখন ছেলেমানুষ। তার ওপর, তোমার মতো ছেলেমানুষ নিয়ে ঘর করা। ও ব্যাচারিরই বা দোষ কী?– দাঁড়াও বন্ধু, আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করে নিই – তোমার বউ-ও কি আমার চিঠি পড়েন? দোহাই ভাই, ও কর্মটি কোরো না। এ চিঠি কেবল তোমার জন্য। আরেকজনকে তোমার বউ বেচারির বয়স কত হল! নিশ্চয়ই এখন ছেলেমানুষ। তার ওপর, তোমার মতো ছেলেমানুষ নিয়ে ঘর করা। ও ব্যাচারিরই বা দোষ কী?– দাঁড়াও বন্ধু, আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করে নিই – তোমার বউ-ও কি আমার চিঠি পড়েন? দোহাই ভাই, ও কর্মটি কোরো না। এ চিঠি কেবল তোমার জন্য। আরেকজনকে

    আমি হাত গুনতে পারি। আমি জানি, তুমি যেদিন শিশির ভাদুড়ির ‘ভ্রমর’৪ দেখে এসেছিলে, সেদিন সারারাত বউ-এর রসনা-সিক্ত মধু-বিষের আস্বাদ পেয়েছিলে। অন্তত তাঁর মাথার কাঁটাগুলোর চেয়ে বেশি বিঁধেছিল তাঁর কথাগুলো সেদিন তোমার বুকে। তারপর সেদিন চাঁদনি-রাতে কোনো অপরাধের জন্য সারারাত ‘দেহি পদ-পল্লবমুদারম’ গাইতে হয়েছিল শ্রীমতীর পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে! তোমার বউ-এর ভাগ্য ভালো ভাই, হিংসে হয় একবার! দেখো, তোমার বউ-ও এই চিঠি লেখার আর প্রিয় সম্ভাষণের ঘটা দেখে আমায় সতিন না ঠাওরান!

    যাক উড়ের লড়াই-এর মতো দাম্পত্য কলহ বলতে বহ্বারম্ভে লঘু-ক্রিয়া। এতদিনে তোমার চিরদিনের ‘ওগো’ সম্ভাষণের ফাটলে সিমেন্ট পড়েছে বোধ হয়। রোজকার মতো বাহুতে চুড়ির এবং বুকে নাকছাবির চাপে পুলক অনুভব করছ! আমি এইখানে থেকেই শান্তিমন্ত্র পাঠ করছি। তোমার শিগ্‌গির আর একটি খোকা হোক! বাঢ়ম!

    ভাগ্যিস এবার ‘সওগাতে’ কিচ্ছু লিখিনি, তাই ‘কারুর’ চোখে পড়ার সৌভাগ্য হয়ে গেছে আমার। সেই ‘কারুর’কে বোলো, লিখলে যে লেখা চোখে পড়ত – তাতে হয়তো চোখ করকর করত! চোখের জল চাই বলে কি ‘চোখের বালি’ হয়ে সেই জল দেখব?

    এতদিন লিখেছি বলেই হয়তো চোখে পড়িনি, আজ না লিখে যদি চোখে পড়ে থাকি, তাহলে আমার না-লেখা অক্ষয় হোক! ওর পরমায়ু বেড়ে যাক!– আমি কিন্তু ফাল্গুনের ‘সওগাত’৫ আজও চোখে দেখিনি। কাজেই ওতে কি আছে না আছে – জানিনে। অবশ্য আমি ইচ্ছে করলে হয়তো কিছু না কিছু লেখা দিতে পারতাম। ইচ্ছে করেই দিইনি। কিছু ভালো লাগছে না ছাই। কেবলই ঘুরে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করছে – নিরুদ্দেশভাবে। অনেক দূর-দূরান্তরে।

    আমার সাদা পাতার জয়জয়কার হোক। ওই পাতাটাই আজ অন্তত ভুল করেও এক-জনকে আমার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

    তোমার বোন ঢাকা থাকতে আমি ওখানকার কাজ নেব না– একথাও শুনেছ?

    যাক শুনেইছ যখন, তখন সব কথা খুলেই বলি। তার আগে একটা কথা জিজ্ঞাসা করে নিই, তিনি আমার সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে কীভাবে কথা বলেন? তিনি কি তাঁর এবং আমার সব কথাই তোমাকে বলেছেন? না তুমি আন্দাজি আঁচ করে নিয়েছ সব? তুমি কিন্তু খলিফা ছেলে! ভয়ানক দুষ্ট! কিউপিডের মতো।

    তোমার কাছে অন্তত আমার দিকটা তো আর লুকোছাপা নেই। আমার জীবনে এত বড়ো পরিবর্তন এত বড়ো সৌভাগ্য আর আসেনি, বন্ধু। যে বেদনার সাথিকে কবিতায় কল্পনায় স্বপ্নে খুঁজে ফিরেছি – রূপে রূপে যার স্ফুলিঙ্গ দেখেছি, তাকে দেখেছি – পেয়েওছি, বুকের বেদনায় চোখের জলে। কয় মুহূর্তের দেখা, তারই মাঝে তাঁর কত বিরক্তিভাজন হয়েছি, হয়তো বা কত অপরাধও করে ফেলেছি।

    পাওয়ার বেভুল আনন্দে যে আত্মবিস্মৃতি আমার ঘটেছে, তা তাঁর ঘটেনি। কাজেই আমি কী করেছি, না করেছি, কী লিখেছি, না লিখেছি তা আমার মনেও নেই, কোনোদিন মনে পড়বেও না। কেবল মনে আছে তাঁকে – তাঁর প্রতিটি গতি-ভঙ্গি, হাসি কথা চলাফেরা সব। ওই তিনদিনের দেখা তাঁকে – আজও তেমনই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার চোখের সামনে। তেমনি হাসি, তেমনি কথা – সব! ফিরে ফিরে মনে আসছে ওই তিনদিনের মানুষটি। একবার নয়, দু-বার নয়, দিনে হাজার বার করে। আমার সকল চিন্তা কল্পনা হাসি গান ঘুম জাগরণ – সব কিছুতে দিবারাত্তির জড়িয়ে আছে ওই কয়েক মুহূর্তের স্মৃতি। ওই তিনটি দিন আমার কাছে অন্তত কালের মতো অক্ষয় হয়ে রইল। তার আঘাত, বেদনা, অশ্রু আমার শাশ্বত লোকের শূন্য-ভাণ্ডার পূর্ণ করে দিয়েছে। এর চেয়ে বেশি পেতে গেলে যে আঘাত পাব, তা সইতে পারব না, বন্ধু! যে পূজারি দেবতা প্রকাশের আরাধনা করে, তার মতো দুঃসাহসী বোধ হয় কেউ নেই। সুন্দর দেবতাও প্রথমে হয়তো দেখা দেন রূদ্ররূপে। সে আঘাত কি সকলে সইতে পারে?

    দূর থেকে অঞ্জলি নিবেদন করব – সকলের আড়ালে সরে গিয়ে আমার হৃদয়রক্ত দিয়ে তাঁকে সৃষ্টি করব, রাঙিয়ে তুলব– শুধু এইটুকু অহংকার থাকুক আমার। তাঁর পায়ের তলার পদ্মটিতেই আমার ধ্রুবকে পাই যেন, তার ঊর্ধ্বে তাকালে স্থির থাকতে পারব না।

    আমার পূজার উপচারের আড়ালে লুকাতে পারি যেন নিজেকে – দেবতা যেন পূজাই দেখতে পায় এবার – পূজারিকে নয়। আশীর্বাদ করো – ধ্রুবলোকে অক্ষয় হোক এবার।

    যাবার দিনে পরিপূর্ণ চিত্তে যেন বলে যেতে পারি, আমি ধন্য হয়ে গেলাম– আমি ভালোবেসে মরলাম। তাঁকে বোলো, আমার ধ্যান-লোকে তার প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। আমার আর তাঁকে হারাবার ভয় নেই।

    দশই তারিখের লেখা চিঠিটা পোস্ট করিনি; রোজ মনে করছি – হয় তো তোমার চিঠি চলে আসবে আজ। তার পরই এটা দেব।

    আজ ১৮ই মার্চ। আমি চিঠি পোস্ট করছি ১০ই তারিখে, অন্তত ১২ই তারিখে তা পেয়েছ। পাওনি কি?

    আজও তার উত্তর দিলে না কেন? না, এরই মধ্যে পুরোনো হয়ে গেলাম, বন্ধু? যা হোক একটা লিখো – শান্তি পাব। সব কথার উত্তর না-ই দিলে, এমনি চিঠি দিয়ো।

    আমি এখন ভালো আছি। এ কয়দিন বিনা-কাজের ভিড়ে এক চিন্তা ছাড়া– লিখতে পারিনি কিছু।

    এর মধ্যে একটা মজা হয়ে গেছে। তেমন কিছু নয়, তবু তোমায় লিখছি। দৈনিক ‘বসুমতী’তে৬ দিনকতক আগে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল যে, কোনো ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক মৃত্যুশয্যায় শায়িত – কোনো সুস্থকায় যুবকের কিছু রক্ত পেলে তিনি বাঁচতে পারেন। তিনি কলকাতাতেই থাকেন। আমি রাজি হয়েছি রক্ত দিতে। আজ ডাক্তার পরীক্ষা করবে আমায়। আমার দেহ থেকে রক্ত নিয়ে ওঁর দেহে দেবে। ভয়ের কিছু নেই এতে, তবে দু-চারদিন শুয়ে থাকতে হবে মাত্র। কী হয়, পরে জানাব – কাজেই দু চারদিন চিঠি দিতে দেরি হলে কিছু মনে কোরো না, লক্ষ্মীটি।

    তবে দু-চারদিন শুয়ে থাকতে হবে মাত্র। কী হয়, পরে জানাব – কাজেই দু চারদিন চিঠি দিতে দেরি হলে কিছু মনে কোরো না, লক্ষ্মীটি।

    আজ আর সময় নেই। এখুনি বেরুব ডাক্তারের কাছে। আমার বুক-ভরা ভালোবাসা নাও। তোমার ছেলেমেয়েদের চুমু খেয়ো আমার হয়ে।

    তাঁর খবর একটু দিস ভাই। এ-কয়দিন তো শুয়েই থাকব, ও-টুকু পেলেও বেঁচে যাব।

    তোমার

    নজরুল

    .

    ৫

    The Saogat

    11, Wellesly Street

    Calcutta, 31.3.1928

    প্রিয় মোতিহার!

    একটু আগে তোমার চিঠি পেলাম। বড্ড মন যেন কেমন করছে।… সওগাতের (বার্ষিকের, মাসিকের) লেখা শেষ করেছি বিকেলে। আজ আমার মুক্তি, বাণীর মন্দির-দুয়ার থেকে অলক্ষ্মীর উন্মুক্ত প্রান্তরে।… গাঁঠরি বাঁধাবাঁধি করে রাখলুম – নিশ্চিন্তে কোথাও একটু হাফ ছেড়ে বাঁচবার জন্য। এখ্‌খনি হুগলি যাব, একজন সাহিত্যিক বন্ধুর বাড়িতে সন্ধ্যায় গান। সেখানে দু-দিন থেকে বোধ হয় কৃষ্ণনগরেই যাব। কলকাতায় কুড়ি-একুশ দিন কাটল, আর ভালো লাগে না এক জায়গা।… তোমার চিঠি হয়তো কৃষ্ণনগর গিয়ে পড়ে আছে। তবে সে চিঠি যেমন redirect করে পাঠাবারও কারও তাগিদ নেই, তেমনই তা খুলে পড়ে দেখবারও কেউ নেই। আমার চিঠি ওরা খোলে না। তাদের খবর জানতে চেয়েছ – তারা ভালোই আছে হয়তো, কেননা ওরা ভালো থাকলে চিঠি দেয় না। অন্য কী খবর চাও – লিখো। পারি যদি উত্তর দেব।… তুমি ভাবতে পার বন্ধু, একটি অন্ধকার ঘরে দু-জন দু-জনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে কাঁদছে। ভাবছ কী অমানুষ আমি! নয়? তাই ভাবো।…

    তোমার চিঠির জন্য কী করে যে কাটিয়েছি এ কয়দিন, তা যদি বুঝতে, তাহলে তোমার চিঠি লিখবার অবসরের অভাব হত না। আজ যদি তোমার চিঠি না আসত তাহলে তোমায় আর কখনও চিঠি দিতাম না। কী যে রাগ হচ্ছিল তোমার উপর সে কী বলব! এক একবার মনে হয়েছে, খুব করে গাল দিয়ে তোমায় শেষ চিঠি দিই, তোমার চিঠির জন্য কী করে যে কাটিয়েছি এ কয়দিন, তা যদি বুঝতে, তাহলে তোমার চিঠি লিখবার অবসরের অভাব হত না। আজ যদি তোমার চিঠি না আসত তাহলে তোমায় আর কখনও চিঠি দিতাম না। কী যে রাগ হচ্ছিল তোমার উপর সে কী বলব! এক একবার মনে হয়েছে, খুব করে গাল দিয়ে তোমায় শেষ চিঠি দিই,

    আমি আবার বিষ্যুতবার কলকাতা ফিরে আসব। সেদিন সন্ধ্যায় Broad – casting-এ আমার গান গাইতে হবে। তোমাদের ঢাকায় wireless সেট নেই কারুর? তাহলে শুনতে পেতে হয়তো। কী গ্র্যান্ড হত বলো তো তাহলে! আমি এখান থেকে গান করতেম – আর তোমরা ঢাকা থেকে শুনতে। এখন থেকে হপ্তায় অন্তত দু-তিন দিন করে গাইতে হবে আমায় Broad casting-এ। আমি বিষ্যুতবারে দুটো গান আর আমার নতুন কবিতা ‘রহস্যময়ী’ আবৃত্তি করব। ‘রহস্যময়ী’ চৈত্রের ‘সওগাতে’ বেরুবে।১ ওর ‘তুমি মোরে ভুলিয়াছ’ নামটা বদলে ‘রহস্যময়ী’ করেছি।২ দেখো এক কাজ করা যায়। Broadcasting Company আমায় একটা মেশিন প্রেজেন্ট করবে – সেইটে তোমায় প্রেজেন্ট করব আমি। ওরা ওটা দিলেই তোমায় পাঠিয়ে দেব। কিন্তু ঠিক করে নিতে পারবে তো? তোমরা বৈজ্ঞানিক, গণিতজ্ঞ, হয়তো পারবে।

    লিখছি, আর কেন যেন মন কেঁদে কেঁদে উঠছে। তোমার বোনের অসুখ, অথচ তুমি জানাওনি এর আগে? তুমি না জানালেও রোজ দেখেছি তারে ঘুমের আড়ালে – স্থির, শান্ত, উদাস – রোগ-পান্ডুর। সন্ধ্যা-তারাটির মতো। কেবলই মনে হয়েছে কত যেন অসুখ করেছে তার। তবু শফিক৩ এসেছে শুনে অনেকটা আশ্বস্ত হওয়া গেল। শফিক তার বাঁশিতে গানে তাঁকে অনেকটা ভালো রাখতে পারবে। শফিক কি দু-এক দিনের মধ্যেই চলে যাবে আবার? আচ্ছা ভাই মোতিহার, তোমার কথা তো তোমার বোন শোনেন; তাঁকে বুঝিয়ে তাঁর বাড়ি পাঠিয়ে দাও না। মা-বাপের কোলে থাকলে হয়তো অনেকটা ভালো থাকবে। আমার কেবলই ভয় করে কেন? কী যেন ভয়। তা ঠিক বলতে পারছিনে! শফিককে এখন যেতে মানা করো। কী হবে দুটো মাস কামাই করলে? শফিক থাকলে সে ভালো হয়ে যাবে, অন্তত ওষুধটা খাবে হয়তো সময় মতো।

    যাক্‌, তোমার চেয়ে বা আর-কারুর চেয়ে তো তাঁর শুভার্থী কেউ নেই। কিন্তু তবু কেন শান্তি পাই না? দিলীপের৪ গান শোনার পর কি আর আমার গান ভালো লাগবে? এমনিই তো আমার গান ভালো লাগেনি! আফতাবউদ্দিনের বাঁশি শুনলে কেমন? অদ্ভুত লোকটা, না?

    তোমার আমন্ত্রণ হয়তো নিলাম। আমার আবার কাজ কী? লিখি, গান করি, আড্ডা দিই, আর ঘুরে বেড়াই – এই বই তো না! তবে শফিককে৫ গান শেখাতে পারব কি না জানিনে। শুনেছি, শফিক খুব ভালো গান জানে। অন্তত ওর বাঁশি শোনবার জন্য যাব। হাঁ, আর একটা খবর দিই তোমায়। আগামী ১৪ই এপ্রিল আমি গ্রামোফোনে গান ও আবৃত্তি দিচ্ছি। তা বেরুবে হয়তো জুলাই-এ।

    বার্ষিক ‘সওগাতে’ দুটো কবিতা দিলাম– ‘উমর ফারুক’ আর ‘হিংসাতুর’৬। চৈত্রের সওগাতে ‘রহস্যময়ী’ (কবিতা), ‘মৃত্যুক্ষুধা’র continuation আরেকটা কবিতা ও একটা গজল-গান যাচ্ছে৭ । চৈত্রের ‘সওগাত’ বেরুবার দেরি আছে। আগে বার্ষিকীটা বেরুবে – আর এক সপ্তাহের মধ্যেই।… আরও অনেকগুলো কবিতা লিখেছি। ইচ্ছা করে, সবগুলো পাঠিয়ে দিই, কিন্তু পাঠাব না – ভয় নেই। যে কাগজে বেরোয়, তা-ই পাঠাব এখন থেকে। ‘জাগরণ’-এর জন্য লেখা চাওয়ার অর্থ বুঝলাম না৮। ‘জাগরণ’ বলে কাগজ বেরুচ্ছে নাকি, না বেরুবে? কার কাগজ? চিঠি লিখবার আগের একটা ছোট্ট কবিতা লিখছিলাম– সেইটেই দিচ্ছি এই সাথে। দরকার হলে কাজে লাগাতে পার।… তোমার ‘চোখের জ্বালা’ হল কেন আবার? চোখের বালির জন্য?

    ‘দু-দিনের দেখা’ গল্পটার এমন কিছু বেশি পরিবর্তন করিনি৯। মাঝে মাঝে দু-চারটে লাইন সংযোগ বা বিয়োগ করেছি মাত্র। তাতে তাঁকে ছাড়িয়ে আমি উঠিনি, – তুমি তাঁকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলো। ওটা ছাপা হয়ে গেছে। বলো যদি, পাঠিয়ে দিতে পারি ওই ফর্মাটা। আচ্ছা, ব্যবস্থা করছি ওটা পাঠাবার।… আজ আমার বইগুলো পাঠাব তাঁকে। সব বই ছাপা নেই। অনেকগুলো out of print হয়ে গেছে। তোমাকেও পাঠাব দু-দিন পরে। আজ আর সময় নেই বলে এ-কথা বলছি। অভিমান কোরো না লক্ষ্মীটি!

    এপ্রিলের শেষাশেষি বা ছুটিতে তোমার বোন কোথায় থাকবেন? ঢাকায় না অন্য কোথায়ও, অবশ্য জানিয়ো। ভুলো না যেন। ছানু১০ কখন ফিরবে? তাড়াতাড়ি উত্তরটা দিয়ো, লক্ষ্মীটি! ভালোবাসা নাও।

    শরিফের [য] বিয়ের কী হল? নুরুন্নবী চৌধুরী১১ এসেছিলেন কি?

    … রক্তদান করিনি১২ । ডাক্তার-শালা বলে, হার্ট দুর্বল। শালার মাথা! মনে হচ্ছিল, একটা ঘুষি দিয়ে দেখিয়ে দিই কেমন হার্ট দুর্বল। ভিতরের কথা তা নয়। ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক ‘মুসলমানের’ রক্ত নিতে রাজি হলেন না। হায় রে মানুষ, হায় তার ধর্ম! কিন্তু কোনো হিন্দু যুবক আজও রক্ত দিলে না। লোকটা মরছে – তবুও নেবে না ‘নেড়ে’র রক্ত।

    দেরি হয়ে গেল – তবু ঈদের কোলাকুলি নাও…হ্যাঁ, আমি ঢাকা যেতে রাজি আছি তোমার লিখিত শর্ত মতো। তবে আমারও একটা শর্ত আছে। সে হচ্ছে, আমি যদি কোনোদিন হঠাৎ চলে আসতে চাই কোনো কারণে, – বা অকারণে, তাহলে আটকে রাখতে পারবে না। এই একটি শর্ত শুধু।

    তোমার

    নজরুল

    .

    ৬

    ১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট

    সওগাত অফিস

    কলিকাতা

    বিষ্যুতবার

    প্রিয় মোতিহার!

    তোমার চিঠি রবিবার সকালে পেয়েছি কৃষ্ণনগরে – কলকাতা এসেছি তিন-চারদিন হল। এখন আবার দিলীপ১ ফিরে এসেছে – পরশু সকালে। এখন দিন-রাত গান আর গান। দুটো নতুন গান লিখেছি। গিয়ে শোনাব। কিন্তু পনেরোই তারিখ তো! যেতে পারছিনে, ভাই। বোধ হয় এপ্রিলের শেষ হপ্তায় যেতে পারব। এখন এত ব্যস্ত যে নিশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই।

    ওদিকে বুদ্ধদেবের দলও তাড়া দিচ্ছে যাবার জন্য এবং তাদের ওখানে ওঠার জন্য।২ একটা ঝগড়া বাধবে দেখছি। অবশ্য তোমারই জয় হবে – এটাও স্থির নিশ্চয়।

    চৈত্রের ‘প্রগতি’তে দুটো গজল বেরুবে আমার স্বরলিপি-সমেত৩। বেরুলে দেখো।

    বার্ষিক ‘সওগাত’ বেরুল। তোমার বোনকে পাঠালাম একখানা। তোমার খানা এঁরা পাঠাচ্ছেন বলে আর আমি পাঠালাম না। আমার দ্বিতীয় কবিতাটা যায়নি, আর জায়গা ছিল না বলে। সেটা বোধ হয় চৈত্রের ‘সওগাতে’ যাবে। চৈত্রের ‘সওগাত’ আর এক সপ্তাহের মধ্যে বেরুবে বলছেন। ‘রহস্যময়ী’ চৈত্রের সওগাতে যাবে না, বোধ হয় বৈশাখে যাবে।

    কতকগুলো লেখা জমেছিল, পাঠিয়ে দিলাম তোমার বোনকে। ভয়ে কিন্তু বুক দুরু দুরু করছে। না জানি কী শাস্তি ভোগ করতে হবে আবার। যাক, তেমন দেখি যদি, তাহলে আর পদ্মা পারই হব না। যদি খুব রাগেন, আমায় জানিয়ো।

    দিলীপ আবার আমায় কৃষ্ণনগর ধরে নিয়ে যাচ্ছে পরশু। কৃষ্ণনগরই ওর আসল বাড়ি। সেখানে তিন-চারদিন হবে হয়তো। তারপর কলকাতা ফিরে আসব। কৃষ্ণনগরের বাসা এবার তুলছি। কলকাতায় বাসা দেখছি – ওদের জন্য। ওরাও নাকি নিশ্চিন্ত হয় তাহলে এবং আমিও হই।

    আমার গ্রামোফোনে গান ১৪ই এবং ১৫ই এপ্রিল। চারখানা গান এবং দুটা আবৃত্তি দেব। দিলীপ, সাহানা, কে. মল্লিক প্রভৃতি আরও পাঁচ-সাতজন গাইয়ে আমার গান দেবেন এই সাথে।

    রেডিয়োতে সেদিন আবৃত্তি করিনি; কেন যেন ভালো লাগল না। তুমি ঠিক ধরেছ, তেওড়া তালে ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে গানটা গীত হবার আগেই আমার গান হয়েছিল। আবৃত্তি আমিই ইচ্ছা করে করিনি। রেডিয়োতে গান দেবার আর সময় হবে না এক সপ্তাহের মধ্যে।

    আজ খুব তাড়াতাড়ি লিখছি চিঠিটা – বড্ড সময়ের অভাব। যারা সব গ্রামোফোনে আমার গান দেবেন – তাঁদের সুর-শিক্ষা দিতে হচ্ছে।

    …হ্যাঁ, ‘রহস্যময়ী’ কবিতাটা তুমি কোথায় পেলে সেদিন? যাক, যে রূপেই পাও, কেমন লেগেছে ওটা তোমার? এখানে সাহিত্যিক আসরে পড়েছিলাম ওটা, সকলেই ভয়ানক প্রশংসা করেছেন। বড়ো রথীরা বলেছেন, ওইটেই আমার লেখা শ্রেষ্ঠ love poem, গিয়েই একদিন আবৃত্তি করে শোনাব।

    শফিক৭ কি চলে গেছে? কোনদিন গেল? এখন তা হলে ওঁকে দেখাশোনা করছে কে? অবশ্য তুমি থাকতে ওঁর চিন্তা নেই। তবু রাত্রে তো ওঁকে হয়তো একা থাকতে হয়। যাক, সীমার অতিরিক্ত হয়তো চিন্তা ও প্রশ্ন করছি। ওঁর শরীর এখন কেমন? ওঁকে নিয়ে একি পাগলের মতো দুশ্চিন্তা আমার।…

    দিলীপ তোমাদের Burdwan House-এ দু-দিন গেছিল বলল। তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে খুব – বলল। তোমার এবং তোমার বোনের খুব প্রশংসা করল। আমায় যেতে বলেছে – তাও জানাতে ভোলেনি। ওঁর বাবা-মা কবে আসছেন? একটা কথা, কিছু মনে কোরো না, তুমি হঠাৎ আমাদের ভাই-বোন পাতিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়েছ কেন বলো তো। যদি ব্যবধানের নদী সৃষ্টি হয়েই যাবে আমাদের মধ্যে, আমি এপারেই থাকব, কাজ নেই আমার ওপারে গিয়ে মুখোশ পরে। আমি তোমাদের মতো হতে পারিনে, তা আর কী করবে বল। তাঁর ইঙ্গিতে যদি ও-কথা লিখে থাক, তা হলে তাঁকে বোলো, আমাকে ভয় করার তাঁর কিছুই নেই। আমি তাঁর বিনানুমতিতে গিয়ে বিরক্ত করব না – বা তাঁর শান্তির ব্যাঘাত করবনা। বন্ধু, তুমি, অনুগ্রহ করতে গিয়ে আর আমায় দুঃখ দিয়ো না।

    তুমি মনে করছ হয়তো, কত অসহায় আমি আজ! তাই বুঝি ওই মতলব ঠাউরিয়েছ, না? যাক, ওখানে গিয়ে এ নিয়ে দস্তুরমতো ঝগড়া করব তোমার সাথে। – হাঁ, কী নাটক লিখব বলো তো! ওদের ideal কী, তা তো জানা নেই। নাটকটা ওখানে গিয়েই লিখে দেব দু-দিনে।

    আমার ভালোবাসা নাও। খুব আনন্দে আছ, না? এখন নিজের বাড়িই শ্বশুরবাড়ি হয়ে গেছে বুঝি? তাড়াতাড়ি চিঠি দিয়ো। সতিন ভাবিকে সালাম।

    ছেলেমেয়েদের চুমু।

    তোমার

    নজরুল

    .

    ৭

    ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট,

    কলিকাতা

    সকাল

    প্রিয় মোতিহার!

    নতুন বছরের নতুন ভালোবাসা নাও। তোমায় চিঠি দিয়াছি বোধ হয় হপ্তা খানিকেরও আগে। পেয়ে উত্তর দিয়েছ কি না জানিনে। মিস ফজিলতুন্নেসাকে১ আমার দু-খানা বই ছাড়া আর সব বই (১৬ খানা) পাঠিয়েছি কাল তা তিনি পেয়েছেন বোধ হয়। তিনি তো দেবেন না, তুমিই প্রাপ্তি-সংবাদটা দিয়ো।

    দিলীপ২ ও নলিনীদা৩ কৃষ্ণনগর গিয়েছিলেন, আমি যেতে পারিনি। গ্রামোফোনে যাঁরা আমার গান দেবেন তাঁদের গান শেখানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এখন তা শেষ হয়েছে। আমি গ্রামোফোনে গান দেব পরশু শুক্রবার বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। চারটা গান এবং ‘নারী’৪ আবৃত্তি দেব আমি নিজে। কেমন উতরাবে জানিনে। আগামী শনিবার রাত্রি ৮ || ০টা কী ৯টায় গান ও আবৃত্তি করব রেডিয়োতে। শুনবার চেষ্টা কোরো ওখান থেকে – এবং কেমন হয় জানিয়ো। এর পরেই কলকাতার প্রোগ্রাম আমার শেষ হবে। আপাতত Family কলকাতায় আনা হবে না হয়তো। সুবিধেমত বাড়ি পাচ্ছিনে। তারপর ঢাকা যাত্রার আয়োজন।

    বোধ হয় দিন দশেকের মধ্যেই সেখানে গিয়ে পঁহুছব। যাবার আগে তার করব। কিন্তু তার আগে তোমার চিঠি পাই যেন। পার তো আজই চিঠি দিয়ো জেলিয়াটোলা স্ট্রিটে৫ এবং জানিয়ো আমার এখন যাওয়া ভালো হবে কি না। নানান দিক থেকে এ প্রশ্ন করছি।

    আমার বইগুলো ওকে পাঠাতে এত লজ্জা করছিল, সে আর কী বলব। আমি একটুও অত্যুক্তি বা বিনয় করছিনে, ভাই! ও লেখাগুলোয় আমার অপরিণত মন ও বয়েসের এত সুস্পষ্ট ছাপ আছে যে, তা পড়তে এখন আমারই লজ্জা করে। আমার ওপর তোমাদের ধারণা হয়তো শিথিল হয়ে যাবে এসব পাগলের প্রলাপ পড়ে। বইগুলো পাঠানোর পর থেকে আমার আর অসোয়াস্তির অন্ত নেই। পোকা-খেগো ফুল দিয়ে কি দেবতার অর্ঘ্য দেওয়া যায়? বার্ষিক ‘সওগাত’ পেয়েছ কি?’ দু-দিনের দেখায় আমার গোদা হাতের ছাপ লেগে অসুন্দর হয়ে ওঠেনি তো৬? উনি কী বললেন?

    ওঁর শরীর কেমন? শফিক৭ কখন গেল? ওর বাবা মা কখন আসবেন? সব লিখো।

    আমার কোনো কিছু ভালো লাগে না আর! এত আড্ডা গান – কিছুতেই মনকে ডুবাতে পারছিনে। এর কোথায় শেষ – কে জানে? কেবলই বিস্বাদ ঠেকছে – আলো বাতাস, হাসি – গান! সব, কী যে হবে কী যে করব – আমি জানিনে।

    কী করছ এখন? কেমন করে তোমাদের দিন যাচ্ছে – জানতে এত ইচ্ছা করে– লোভ হয়। – যাক – চিঠি দিয়ো। ইতি–

    তোমার নজরুল

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরুবাইয়াত-ই-হাফিজ – কাজী নজরুল ইসলাম
    Next Article নজরুল প্রবন্ধসমগ্র – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    ভাঙার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    বাঁধনহারা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    মৃত্যুক্ষুধা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }