Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প391 Mins Read0

    ১৫. দুৰ্গা ভাইকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছিল

    দুৰ্গা ভাইকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছিল। পাড়ার নানাস্থানে খুঁজিয়া কোথাও পাইল না। অন্নদা রায় মহাশয়ের বাড়িতে কাছে আসিয়া ভাবিল—একবার এখানে দেখা যাই, খুড়িমার সঙ্গেও দেখাটা হবে এখন–

    অন্নদা রায়ের বাড়ি ঢুকিতেই একটা হৈ হৈ চিৎকার ও কান্নাকাটির কলরব তাহার কানে গেল। বাড়ির মধ্যে না ঢুকিয়া সে দরজার কাছে দাঁড়াইল। রোয়াকের একপাশে দাঁড়াইয়া অন্নদা রায়ের বিধবা ভগ্নী সখী ঠাকরুন চিৎকার করিয়া বাড়ি ফাটাইতেছেন :

    —তাই কি মনে একটু ভয় আছে নাকি? ঢের ঢ়ের জাহাবাজ মেয়েমানুষ দেখিচি, এমন আর কক্ষনো দেখিনি রে বাপু, পায়ে গড় করি।-বলে ওই যমের মতো সোয়ামী, রাগলে হাড়ে মাসে এক রাখে না।–তাই না হয় বাপু, একটু সমঝে চলি? সত্যিই তো, আজ তিন দিন ধরে বলচে ধানগুলো একটু রোদে দাও, ওগো ধানগুলো একটু রোদে দাও-কথা কি গেরাহিত্যু হয় নাকি? না কানো যায়? কগর কথা কে শোনে! গোরস্ত ঘরের বৌ ধান ভানবে, কাজ করবে। এই জানি-ত না, রাদিন পটের বিবি সেজে বসে আছে!-‘পটের বিবি’ জিনিসটি পরিস্ফুট করিবার জন্য উত্তমরূপে সাজিয়া যেরূপ ভাবে বসিয়া থাকা উচিত বলিয়া সখী ঠাকরুনের ধারণা তিনি এখানে তাহার অভিনয় করিলেনএ তো বাপু কখনও কোথাও বাপের জন্মে দেখিনি, শুনিওনি–

    দালানের মধ্য হইতে অন্নদা রায়ের পুত্ৰবধূ নাকীসুরে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল-পটের বিবি হয়ে সেজে বসে থাকি নাকি! কাল যে দশ সেরা মুগের ডাল ভাজলাম সারা বিকেল ধরে? দুপুর বেলা খেয়েই আরম্ভ করিচি, আর যখন পাঁচটার গাড়ি যাওয়ার শব্দ পেলাম তখনও খোলার তাতেই বসে আছি, দু-ধামা ডাল ভাজা রে, ভাঙা রে-করে অন্ধকার হয়ে গিয়েচে তখন উঠিচি-সে। কি অমনি হয়? গা-গতর ব্যথা হয়ে গেচে, রাত্তিরে বলি বুঝি জ্বর হল, এমনি গায়ে-হাতে ব্যথা-তা কি কেউ দ্যাখে? তার ওপর সকাল বেলা বিনি দোষে এই মার-কেন সংসারে কি বসে বসে খাই?

    এমন সময় অন্নদা রায়ের ছেলে গোকুল এক হাতে একখানা কঁচা বাঁশের পাতাসুদ্ধ ডগা ও আর এক হাতে দা লইয়া বাড়ি ঢুকিল। স্ত্রীর কান্নার শেষ অংশ শুনিতে পাইয়া গর্জন করিয়া কহিল–এখনও তোমার হয়নি-এখন তোমার আদেষ্টে বেস্তর দুকথু আছে দেখচি-আমার রাগ বাড়িও না মেলা সঙ্কাল বেলা! আজ তিনদিন ধরে ধানগুলো রোদুরে দেওয়ার জন্যে বলে বলে হয়রান-এই মেঘলা মেঘলা যাচ্চে, এর পর ধানগুলো যদি কলিয়ে যায়, তবে তোমার কোন বাবা এসে সামলাবে?…সারা বছরের পিণ্ডি জুটবে কোথেকে?

    গোকুলের বউ হঠাৎ কান্না বন্ধ করিয়া তেজের সহিত জোর গলায় বলিয়া উঠিল–তুমি আমার বাবা তুলে গালাগালি কোরো না বলে দিচ্চি-আমার বাবা কি করেচে। তোমার, কেন তুমি বাবার নামে যখন তখন যা তা বলবে?

    তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে গোকুল হাতের বাঁশ নামাইয়া রাখিয়া দা হাতে এক লাফে রোয়াকের সিঁড়ি বাহিয়া উঠিয়া কহিল—তবে রে! আজি তোমার একদিন কি আমার একদিন– তোমার বাপের বাড়ির আবদার না ঘুচিয়ে আমি আজ–

    একটা খুনোখুনি ব্যাপার বুঝি বা হয় দেখিয়া বাড়ির কৃষাণ উঠান হইতে ডাকিয়া কহিল-কি করেন। দ-ঠাকুর-কি করেন, থামুন, থামুন-পরে সে ছুটিয়া রোয়াকে উঠিল-দুর্গাঁও ছুটিয়া আসিল—সখী ঠাকুবুনও রোয়াক হইতে দালানের মধ্যে ঢুকিলেন- খুব একটা হৈ-চৈ হইল। দালানের মধ্যে গোকুলের স্ত্রী স্বামীর উদাত আক্রমণের সম্মুখে পিছাইয়া গিয়া মার ঠেকাইবার জন্য দুই হাত তুলিয়া দেওয়ালের গায়ে প্রাণপণে ঠেস দিয়া জড়োসড়ো হইয়া দাঁড়াইয়াছে, চোখে তার ভয়ের দৃষ্টি-কৃষাণ গিয়াই গোকুলের হাত হইতে দা-খানা কড়িয়া লইল; পরে তাহাকে ধরিয়া দালানের বাহিরে আনিতে আনিতে বলিতে লাগিল—কি করেন। দ-ঠাকুর, থামুন-আঃ—আসুন–

    গোকুলের বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের কম নয়, কিন্তু দেহ তেমন সবল নহে, বলিষ্ঠ কৃষাণের সহিত ম্যালেরিয়া-দুর্বল দেহ লইয়া হাত ছাড়াছাড়ির চেষ্টা করিতে গেলে দুর্বলতাটাই অধিকতর প্রকাশ হইয়া পড়িবে বুঝিয়া বলিতে বলিতে নামিল-দ্যাখো না-একটা ডোল ধান, বীজ ধান, জল পেয়ে যদি কলিয়ে যায়, ও কি আর রোয়া হবে? আজ তিনদিন ধরে বলচি-আবার তেজডা দেখলে তো?–তোমার তেজ আমি–

    দুর্গা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল, কিন্তু এ সময়ে খুড়িমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় কথাবার্তার সময় নাই বুঝিয়া সে একপ্রকার নিঃশব্দেই অন্নদা রায়ের বাড়ির বাহির হইয়া পড়িল।

    পাঁচু বাঁড়ুজ্যের বাড়ির কাছে জামতলায় একজন লোক ঘটিবাটি সারাইতে বসিয়াছে। কাঠের কয়লার হাপরে গানগনে আগুন, পাড়ার লোকের অনেক ভাঙা ঘটিবাটি জড়ো করা। বেঁটে ধরনের লোকটা, পাকসিটে গড়নের চেহারা, বয়স কত বুঝিবার উপায় নেই, ত্ৰিশও হইতে পারে, পঞ্চাশও হইতে পারে, গলায় ত্রিকাঠি তুলসীর মালা, মুখের ডান দিকে একটা কাটার দাগ-হাতের কজিতে দড়ির মতো শিরা বাহির হইয়া আছে, পরনে আধময়লা ধুতি। পাড়ার অনেক ছেলেমেয়ে তাহাকে ঘিরিয়া ঘটিবাটি সারানো দেখিতেছে। দুৰ্গাঁও গেল। লোকটা বলিল-কি চাই খুকি?

    সে বলিল-কিছু না, দেখবো।

    বাড়ি ফিরিয়া মা’র কাছে বলিল-আজ মা গোকুল কাকা খুড়িমাকে যা মেরেছে সে কি বলবো-পরে সে আনুপূর্বিক বর্ণনা করিল।

    সর্বজয়া বলিল-গোঁয়ার গোবিন্দ চাযা একটা বই তো নয়!—আহা, ভালোমানুষ বৌটা এমন হাতে আর এমন বাড়িতে পড়েচে-ঠেঙা খেতে খেতেই জীবনটা গেল।

    -আমাকে তো বড় ভালোবাসে-যখন যা বাড়িতে হবে, আমার জন্যে তুলে রেখে দেবে। খুড়িমার কান্না দেখে এমন কষ্ট হল মা! সখী ঠাকুমা আবার এখন উলটে খুড়িমাকেই বকে—

    সে তিন-চার দিন জামতলায় ঘটিবাটি সারানো দেখিতে গেল। লোকটি তাহার বাড়ি, বাপের নাম সব খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা করে। বলিল–তোমাদের বাড়ির জিনিসপত্তর সারাবে না? নিয়ে এসো না খুঁকি?

    দুর্গা বাড়ি আসিয়া মাকে বলিল-আমাদের ভাঙা ঘটি-গাড়গুলো দেবে মা, একজন বেশ ভালোমানুষ লোক এসেচে-ওপাড়ার পথে জামতলায় বসে সারাচ্ছে–

    লোকটা তার নাম বলে পিতম-জাতে নাকি কাসারি। হাপর জ্বালাইতে জ্বালাইতে একএকবার সোজা হইয়া বসিয়া বলে–জয় রাধে!–রাধে গোবিন্দ!

    সকাল বেলা তাহার কাছে পাড়ার অনেকে আসিয়া জোটে। সে চিমটা দিয়া হাপর হইতে আগুন উঠাইয়া অনবরত তামাক সাজিয়া ভদ্রলোকদের হাতে দিতেছে–দিবার সময় মুখখানা বিনয়ে কঁচুমাচু করিয়া ঘাড় একধারে কাত করিয়া বলে-হেঁ হেঁ, তামাক ইচ্ছে করুন, বাবাঠাকুর!– রাধারানী-পদ ভরসা!..নারকেলের কথা আর বলবেন না বাবাঠাকুর, আর বছর জষ্টিমাসে বলি দিই গোটাকতক চারা বসিয়ে!–আন্ধকাঠ-খানেক জমিতে ছগণ্ডা চারা কিনে লাগিয়ে দিলাম–তা ব্যাঙের উপদ্রুতে—একেবারে মূলশেকড়-টুল শেকড় সবসুদ্দ…কটা টাকাই মাটি।

    মুখুজ্যে মশায় সকাল হইতে ঠায় বসিয়া আছেন, কোনো রকমে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া একটা পিতলের ঘাড়া বিনামূল্যে সারাইয়া লইবেন। তামাক খাইতে খাইতে পূর্ব কথার খেই ধরিয়া বলিলেন—এই তো গেল কাণ্ড বাপু -তো-এবারও তো ভেবেছিলাম কুড়িখানেক চারা বাড়ির পেছনে-তা এমন ম্যালেরিয়া ধরল–তোমাদের ওদিকে কি রকম হে কারিগর? (তিনি সকাল হইতেই তাহাকে কারিগর বলিয়া ডাকিতেছেন)।

    -পরিপুন্নু-আজ্ঞে পরিপুন্নু-ম্যালেরিয়ার কথা বলবেন না বাবাঠাকুর-হাড় জ্বালিয়ে খেয়েচে–এই নিন। আপনার ঘাড়াটা, ছটা পয়সা দেবেন—

    মুখুজ্যে মশায় ঘড়াটা হাতে লইয়া উঠিয়া পড়িয়া বলেন-হ্যাঁ! এর জন্যে আবার পয়সা।– দিলে একটা জিনিস ব্রাহ্মণকে সারিয়ে আমনি কীর্তিক মাসের দিনটা-তার আবার

    পিতম তাড়াতাড়ি মুখুজ্যে মশায়ের হাতের ঘড়াটা ধরিয়া অত্যন্ত অমায়িক ভাবে হাসিয়া বলে-আজ্ঞে না, মাপ করবেন বাবাঠাকুর, এমনি সারিয়ে দিতে পারবো না-এখনও সক্কাল বেলা বউনি হয়নি। আজ্ঞে না।–তা পারবো না।–ঘড়াটা রেখে যান-বাড়ি গিয়ে পাহা কটা পাঠিয়ে দেবেন—

    দুৰ্গার মা বলে-দেখিস দিকি-ভাঙা বাসন-কোসন বদলে নতুন বাসন-কোসন অনেক সময় ওরা দেয়-জিজ্ঞেস করিস তো।

    পিতম খুব রাজি। দুর্গা বাড়ি হইতে বহিয়া বহিয়া এক রািশ পুরানো গাড় ঘটিবাটি ঘড়া তাহার কাছে লইয়া গিয়া হাজির করে। অর্ধেক দিনটা সে জামতলাতেই কাটায়-হাপর জ্বালানো, রং ঝাল করা বসিয়া বসিয়া দেখে। পিতম বলিয়াছে তাহাকে একটা পিতলের আংটি গড়াইয়া দিবে-ইহাও বলিয়াছে যে, সারাইবার পয়সা তাহাদের লাগিবে না। সর্বজয়া শুনিয়া বলে-আহা বড় ভালো লোকটা তো! আসচে বুধবার অপুর জন্মবারটা, বলিস তাকে আসতে—আমাদের এখানে দুটো ডালভাত পেরসাদ পেয়ে যাবে এখন–

    বুধবার সকালে উঠিয়া দুৰ্গা জামতলায় গিয়া দেখিল লোকটা নাই। জিজ্ঞাসা করিয়া শুনিল পূর্বদিন সন্ধ্যার পর কোন সময়ে সে দোকান উঠাইয়া চলিয়া গিয়াছে—হাপরের গর্ত ও পোড়া কয়লার রাশি ছাড়া অন্য কোন চিহ্ন নাই। দুৰ্গা এখানে ওখানে খোঁজ করিল-একে ওকে জিজ্ঞাসা করিল, কেহ জানে না। সে কোথায় গিয়াছে। ভয়ে দুর্গার মুখ শুকাইয়া গেল-মা শুনিলে কি বলিবে! সংসারের অর্ধেক বাসন তাহার কাছে যে! সে দুর্গাকে বলিয়াছিল, ঝিকরহাটির বাজারে তাহার কাঁসারির দোকান আছে, সেখানে সে খবর পাঠাইয়াছে।–তাহার ভাই একদিনের মধ্যে নতুন বাসন লইয়া আসিয়া পড়িল বলিয়া-আসিলেই ভাঙাচোরা বাসনগুলা সব বদলাইয়া দিবে। কোথায়ই বা সে-আর কোথায়ই বা তাহার ভাই! কোথায় সে যে গেল তাহা দুৰ্গা অনেক খুঁজিয়াও পাইল না। কেবলমাত্র তাহদেরই জিনিস গিয়াছো-অন্য খুঁশিয়ার লোকের এক টুকরা পিতলও খোয়া যায় নাই।

    সারাদিনের পরে সন্ধ্যার সময় দুৰ্গা কঁদো কঁদো মুখে মাকে সব বলিল। হরিহর বিদেশেকেই বা খোজ করে, কেই বা দেখে। সর্বজয়া অবাক হইয়া যায়! বলে–একবার তোর রায় জেঠামশায়কে গিয়ে বল তো! ওমা এমন কথা তো কখনও শুনিনি!…

    হরিহর বাড়ি আসিলে ঝিকরহাটির বাজারে খোজ করা হইয়াছিল-পিতাম নামক কোন লোকের সেখানে কাসারির দোকান নাই বা উক্ত চেহারার কোনো লোকও সেখানে নাই।

    কয়েক মাস কাটিয়া গিয়াছে। ভাদ্র মাস।

    অপু বৈকাল বেলা বেড়াইতে যাইবার সংকল্প করিতেছে, এমন সময় তাহার মা পিছনে ডাকিয়া বলিল-কোথায় বেবুছিস রে অপু?-চাল ভাজা আর ছোলা ভাজা ভাজচি-বেরিয়ো না যেন। …এক্ষুনি খাবি–

    অপু শুনিয়াও শুনিল না-যদিও সে চাল-ছোলা ভাজা খাইতে ভালোবাসে বলিয়াই মা তাহার জন্য ভাজিতে বসিয়াছে ইহা সে জানে-তবুও সে কি করিতে পারে?—এতক্ষণ কি খেলাটাই চলিতেছে নীলুদের বাড়িতে? সে যখন বাহির দরজায় পা দিয়াছে, মার ডাক আবার কানে গেলবেবুলি বুঝি -ও অপু, বা রে, দ্যাখো মজা ছেলের! গরম গরম খাবি—-আমি তাড়াতাড়ি ঘাট থেকে এসে ভাজতে লাগলাম-ও অপু-উ-উ-

    অপু এক ছুট দিয়া নীলুদের বাড়ি গিয়া পৌঁছিল। অনেক ছেলে জুটিয়াছিল, অপু আসিবার আগেই খেলা সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে। নীলু বলিল-চল অপু, দক্ষিণ মাঠে পাখির ছানা দেখতে যাবি? অপু রাজি হইলে দুজনে দক্ষিণ মাঠে গেল। ধান ক্ষেতের ওপারেই নবাবগঞ্জের বাঁধা সড়কটি পূর্ব পশ্চিমে লম্বা হইয়া যেন মাঠের মাঝখান চিরিয়া চলিয়া গিয়াছে। গ্রাম হইতে এক মাইলেব উপব হইবে। অপু এতদূর কখনও বেড়াইতে আসে নাই।–তাহার মনে হইল যেন সমস্ত পরিচিত জিনিসের গণ্ডি ছাড়াইয়া কোথায় কতদূরে নীলুদা তাহাকে টানিয়া আনিল। একটুখানি পরেই সে বলিল, বাড়ি চল নীলুদা, আমায় মা বকবে, সন্দে হয়ে যাবে, আমি এক গাবতলার পথ দিয়ে যেতে পারবো না। তুমি বাড়ি চল——

    ফিরিতে যাইয়া নীলু পথ হারাইয়া ফেলিল। ঘুরিয়া ফিরিয়া কাহাদের একটা বড় আমবাগানের ধারা দিয়া একটা পথ মিলিল। সন্ধ্যা হইবার তখনও কিছু বিলম্ব আছে, আকাশে আবার মেঘ ঘনাইয়া আসিতেছে—এমন সময় চলিতে চলিতে নীলু হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া অপুর কনুই-এ টান দিয়া সম্মুখ দিকে চাহিয়া ভয়ের সুরে বলিল-ও ভাই আপু!

    অপু সঙ্গীর ভয়ের কারণ বুঝিতে না পারিয়া বলিল-কি রে নীলুদা? পরে সে চাহিয়া দেখিল, যে সুড়িপথটা দিয়া তাহারা চলিতেছিল, তাহা কাহাদের উঠানে গিয়া শেষ হইয়াছে-উঠানে একখানা ছোট্ট চালাঘর ও একটা বিলাতী আমড়ার গাছ। তাহার কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার পূর্বেই নীলু। ভয়ের সুরে বলিয়া উঠিল-আতুরী ডাইনির বাড়ি!

    অপুর মুখ শুকাইয়া গেল.আতুরী ডাইনির বাড়ি: .সন্ধেবেলা কোথায় আসিয়া ব্ৰাহারা পড়িয়াছে! কে না জানে যে ওই উঠানের গাছে চুরি করিয়া বিলাতি আমড়া পাড়িবার অঙ্গরাধে ডাইনিটা জেলেপাড়ার কোন এক ছেলের প্রাণ কড়িয়া লইয়া কচুর পাতায় বাঁধিয়া জলে ড়ুবাইয়া রাখিয়াছিল, পরে মাছে তাহা খাইয়া ফেলিবার সঙ্গে সঙ্গে বেচারির আমড়া খাইবার সাধ এ জন্মের মতো মিটিয়া যায়! কে না জানে সে ইচ্ছা করিলে চোখের চাহনিতে ছোট ছেলেদের রক্ত চুষিয়া খাইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিতে পারে, যাহার রক্ত খাওয়া হইল, সে কিছুই জানিতে পরিবে না, কিন্তু বাড়ি গিয়া খাইয়া-দাইয়া সেই যে বিছানায় শুইবে আর পরদিন উঠিবে না! কতদিন শীতের রাত্রে লেপের তলায় শূইয়া দিদির মুখে আতুরী ডাইনির গল্প শুনিতে শুনিতে সে বলিয়াছে।–রাত্রিতে তুই ওসব গল্প বলিসনে দিদি, আমার ভয় করে,-তুই সেই কুচবরণ রাজকন্যের গল্পটা বল দিকি?

    ঝাপসা দৃষ্টিতে সে সম্মুখে চাহিয়া দেখিতে গেল বাড়িতে কেহ আছে কিনা এবং চাহিবার সঙ্গে সঙ্গেই তাহার সমস্ত শরীরা যেন জমিয়া হিম হইয়া গেল. বেড়ার বাঁশের আগড়ের কাছে.অন্য কেহ। নয়, একেবারে স্বয়ং আতুরী ডাইনি তাহদের—এমন কি যেন শুধু তাঁহারই দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া!…

    যাহার জন্য এত ভয়, তাহাকে একেবারে সম্মুখেই এভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া অপুর সামনে পিছনে কোনো দিকেই পা উঠিতে চাহিল না।

    আতুরী বুড়ি ভুবু কুঁচকাইয়া তোবড়ানো গালটা আরও ঝুলাইয়া ভালো করিয়া লক্ষ করিবার ভঙ্গিতে মুখটা সামনের দিকে একটু বাড়াইয়া দিয়া পায়ে পায়ে তাহদের দিকে আগাইয়া আসিতে লাগিল। অপু দেখিল সে ধরা পড়িয়াছে, কোনো দিকেই আর পলাইবার পথ নাই।–যে কারণেই হউক ডাইনির রাগটা তাহার উপরেই—এখনই তাহার প্রাণটি সংগ্ৰহ করিয়া কচুর পাতায় পুরিবে! মুখের খাবার ফেলিয়া, মায়ের ডাকের উপর ডাক উপেক্ষা করিয়া সে যে আজ মায়ের মনে কষ্ট দিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে তাহার ফল। এই ফলিতে চলিল। সে অসহায়ভাবে চারিদিকে চাহিয়া বলিল-আমি কিছু জানিনে-ও বুড়ি পিসি-আমি আর কিছু করবো নাআমায় ছেড়ে দাও, আমি ইন্দিকে আর কখনও আসবো না-আজ ছেড়ে দাও ও বুড়ি পিসি–

    নীলু। তো ভয়ে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল-কিন্তু অপুর ভয় এত হইয়াছিল যে, চোখে তাহার জল ছিল না।

    বুড়ি বলিল-ভয় কি মোরে, ও বাবারা? মোরে ভয় কি?… পরে খুব ঠাট্টা করা হইতেছে ভাবিয়া হাসিয়া বলিল, মুই কি ধরে নেবো খোকারা? এসো মোর বাড়িতি এসো-আমচুর দেবানি এসো–

    আমচুর!…ডাইনি বুড়ি ফাকি দিয়া ভুলইয়া বাড়িতে পুরিতে চাহিতেছে—গেলেই আর কি! ডাইনিরা রাক্ষসীরা যে এ-রকম ভুলইয়া ফাঁদে ফেলে-এ-রকম কত গল্প তো সে মা’র মুখে শুনিয়াছে।

    এখন সে কি করে!…উপায়?

    বুড়ি তাহার দিকে আরও খানিক আগাইয়া আসিতে আসিতে বলিল-ভয় কি ও মোরে বাবারা? মুই কিছু বলবো না, ভয় কি মোরে?

    আর কি, সব শেষ! মায়ের কথা না শুনিবার ফল ফলিবার আর দেরি নাই, হাত বাড়াইয়া তাহার প্রাণটা সংগ্ৰহ করিয়া এখনই কচুর পাতায় পু-রিল! প্রতি মুহুর্তেই তাহার আশঙ্কা হইতেছিল যে এখনই এ বুড়ি হাসিমুখ বদলাইয়া ফেলিয়া বিকট মূর্তি ধরিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিবে।–রাক্ষসী রানীর গল্পের মতো! বনের অজগর সাপের দৃষ্টির কুহকে পড়িয়া হরিণশিশু নাকি অন্য দিকে চোখ ফিরাইতে পারে না, তাহারও চোখদুটির কুহক-মুগ্ধ দৃষ্টি সেরূপ বুড়ির মুখের উপর দৃঢ়নিবদ্ধ ছিলসে আড়ষ্ট কণ্ঠে দিশহারা ভাবে বলিয়া উঠিল, ও বুড়ি পিসি, আমার মা কঁদবে, আমায় আজ আর কিছু বোলো না-আমি তোমার গাছে কোনো দিন আমড়া নিতে আসিনি-আমার মা কঁদবেআতঙ্কে সে নীলবৰ্ণ হইয়া উঠিয়াছে।…বাড়ি, ঘরদোর, গাছপালা, নীলু, চারিধারা যেন ধোঁয়া ধোঁয়া। কেহ কোনোদিকে নাই…কেবল একমাত্র সে আর আতুরী ডাইনির ক্রুর দৃষ্টি মাখানো একজোড়া চোখ..আর অনেক দূরে কোথায় যেন মা আর তাহার চাল-ভাজা খাওয়ার ডাক।!…

    পরক্ষণেই কিন্তু অত্যধিক ভয়ে তাহার একরূপ মৰীয়া সাহস জোগাইল, একটা অস্পষ্ট আর্তরব করিয়া প্রাণভয়ে দিশাহারা অবস্থায় সে সম্মুখের ভাট, শেওড়া, রাংচিতার জঙ্গল ভাঙিয়া ডিঙাইয়া সন্ধ্যার আসন্ন অন্ধকারে যেদিকে দুই চোখ যায় ছুটিল-নীলুও ছুটিল তাহার পিছনে পিছনে।…

    ইহাদের ভয়ের কারণ কি বুঝিতে না পারিয়া বুড়ি ভাবিল-মুই মাত্তিও যাইনি, ধত্তিও যাইনি-কঁচা ছেলে, কি জানি মোরে দেখে কেন ভয় পালে সন্দেবোলা? খোকাডা কাদের?

    অপু যখন বাড়ি আসিল, তখন সন্ধা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সর্বজয়া সবে উনুন ধরাইয়া তালের বড়া ভাজিবার আয়োজন করিতেছে, দুর্গা নিকটে বসিয়া তাল চাচিয়া রস বাহির করিতেছে-ছেলেকে দেখিয়া বলিল-কোথায় ছিলি বল দিকি? সেই বেরিয়েচো বিকেলবেলা, কিছুই তো আজ খাবার খেলিনে-খিদেতেষ্টা পায় না?

    মায়ের নিকট বলিবার জিনিস অপুর মনে স্তুপাকার হইয়া সকলেই একসঙ্গে বাহিরে আসিবার জন্য এরূপভাবে চেষ্টা পাইতেছিল যে, পরস্পরের ঠেলা ঠেলিতে পরস্পরের নির্গমপথ এককালীন বুদ্ধ হইয়া গিয়া অপুকে একেবারে নির্বক করিয়া দিল। সে শুধু বলিল-আমি কি কাপড় ছাড়বো মা? আমার এখানা ওবেলার কাপড়–

    পরে সে বিস্ময়ের সহিত দেখিল যে, মা তাহাকে চালভাজা দিবার কোনো আগ্রহই না দেখাইয়া তালের রসটা ঘন না পাতলা হইয়াছে, তাহাই অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পরীক্ষা করিতেছে। পরীক্ষা শেষ হইয়া গেলে দুৰ্গাকে বলিল-দু-চারখানা ভেজে দেখি, না হয়, বড় তক্তপোশের নিচেটায় চালের গুড়ো আছে, আর দুটো নিয়ে আসিস এখন-পরে ছেলের দিকে চাহিয়া বলিল-দাঁড়া অপু, তোকে গরম গরম ভেজে দিচ্ছি।

    অপু বলিল-কেন মা, চাল-ছোলা ভাজা কই?

    –তা চাল ভাজা তুই খেলি কই? এতবার ডাকলাম, তুই বেরিয়ে চলে গেলি -ঠাণ্ডা হয়ে গেল, দুৰ্গা খেয়ে ফেল্পে, তা এই বড় তো হয়ে গেল বলে। ভাজবো আর দেবো–

    অপু সেই বৈকালবেলা হইতে মনের মধ্যে যে তাসেব ঘর নির্মাণ করিতেছিল, এক ফুযে কে তাহা একেবারে ভূমিসাৎ করিয়া দিল। এই তাহার মা তাহাকে ভালোবাসে! সে বৈকালবেলা বাটীব বাহিরে যাওয়ার পর হইতে অনবরত ভাবিতেছে-মা না জানি কত দুঃখই করিতেছে তাহার জন্য! অপু আমার এখনও কেন যে এলো না, তার জন্যে এত করে ঘাট থেকে এসে ভাঁজলাম, আহা সে দুটো খেলে না-হা, দায় পড়িযছে, তাহার জন্য ভাবিয়া তো মায়েব ঘুম নাই-মা দিব্যি সেগুলি দিদিকে খাওয়াইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া আছে–সে-ই শুধু এতক্ষণ মিছামিছি ভাবিয়া মরিতেছিল।

    দুর্গা বলিল-মা শিগগির শিগগির ভেজে নাও। বড় মেঘ করে আসচে, বিষ্টি এলে আর ভাজা হবে না,-ঘরে যে জল পড়ে!—সেদিনকার মতো হবে কিন্তু–

    দেখিতে দেখিতে চারিধার ঘিরিয়া ঘনাইয়া-আসা মেঘের ছায়ায় বাশবনেৰ মাথা কালো হইয়া উঠিল। খুব মেঘ জমিয়া আকাশ অন্ধকার হইয়াছে, অথচ বৃষ্টি এখনও নামে নাই-এসময় মনে এক প্রকার আনন্দ ও কৌতুহল হয়—না জানি কি ভয়ঙ্কর বৃষ্টিই আসিতেছে, পৃথিবী বুঝি ভাসাইয়া লইয়া যাইবে-অথচ বৃষ্টি হয় প্রতিবারই, পৃথিবী কোনোবারেই ভাসায় না, তবুও এ মোহটুকু ঘোচে না! দুৰ্গার মন সেই অজানার আনন্দে ভরিয়া উঠিল, সে মাঝে মাঝে দাওয়ার ধারে আসিয়া নিচু চালের ছাঁচ হইতে মুখ বাড়াইয়া মেঘান্ধকার আকাশের দিকে চাহিয়া দেখিতেছিল।

    সর্বজয়া খানকতক বড়া ভাজিয়া বলিল–এই বাটিটা করে ওকে দে তো দুগগা।-ওরা খিদে পেয়েচে, বিকেল থেকে কিছু তো খায় নি! এই শেষ কথাই কাল হইল-এতক্ষণ অপু যা হয় এক রকম ছিল। কিন্তু মায়ের শেষের দিকের আদরের সুরে তাহার অভিমানের বাঁধি একেবারে ভাঙিয়া পড়িল, সে বড়াসুদ্ধ বাটিটা উঠানে স্টুড়িয়া দিয়া বলিল-আমি খাবো না তো বড়া, কখখনো খাবো না—যাও–

    সর্বজয়া ছেলের কাণ্ড দেখিয়া অবাক হইয়া রহিল। গরিবের ঘরকন্না, কত কষ্টে যে কি জোগাড় করিতে হয় সে-ই জানে। আর হতভাগা ছেলেটা কিনা। দু-দুবার সেই কত কষ্টে সংগৃহীত মুখের জিনিস নষ্ট করিল! ক্ষোভে, রাগে সে ছেলের দিকে চাহিয়া বলিল–তোমার আজ হয়েছে কি! তোমার অদৃষ্ট আজ ছাই লেখা আছে, খেয়ো এখন তাই গরম গরম–

    এবার অপুর পালা। এ রকম কথা মা’র মুখে সে কখনও শোনে নাই। কোথায় সে চাহিতেছে, মা দুটো আদরের কথা বলিয়া সাত্ত্বনা করিবে, না সন্ধ্যাবেলা এমন নিষ্ঠুর কথা! সে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, আচ্ছা মা, আমি চালভাজা খাইনি তাতে আমার মনে কষ্ট হয় না? আমি বিকেল থেকে ভাবছিনে বুঝি? আমি-আমি কখখনো তোমার বাড়ি আর আসচিনে-আমি ছাই খাবো, কেন আমি ছাই খাবো? আর দিদি বুঝি সব ভালো ভালো জিনিস খাবে? আমি আসবো না তোমার বাড়ি, কখখনো আসবো না–

    পরে সে আতুরী বুড়ির বাড়ি হইতে এইমাত্র যেরূপ অন্ধকার, কঁটাবন, আমবন না মানিয়া ছুটিয়াছিল এখনও রাগে আত্মহারা হইয়া দাওয়া হইতে নামিয়া বাহিরের উঠানের দিকে ঠিক সেইরূপ মরীয়ার মতো ছুটিল। ভাই-এর অভিমান-ভরা দৃষ্টি, ফুলা ঠোঁট ও কথা বলিবার ধরন দুর্গার নিকট এরূপ হাস্যকর ঠেকিল যে, সে হাসিয়া প্ৰায় গড়াইয়া পড়িল।–হি-হি-অপুটা-একেবারে পাগল মা, কেমন বল্লে-পরে ভাই-এর কথা বলিবার উক্তির নকল করিয়া বলিল-আমি চালভাজা খাইনি-হি-হি-তাতে বুঝি আমার কষ্ট হয় না? বোকা একেবারে যা-ও অপু, শুনে যা, ও অপু-উ-উ–

    অপু ছুটিয়া পাচিলের পাশের পথ দিয়া পিছনের বাঁশবাগানের দিকে ছুটিল। আকাশে মেঘ তখনও থমকিয়া আছে, বাশবনের তলাটা ঝোপেঝাড়ে নির্জন বৰ্ষসিন্ধ্যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। সহজ অবস্থায় এরূপ স্থানে এ-সময় এক আসিবার কল্পনাই সে করিতে পারিত না কোনদিনও। কিন্তু বর্তমানে চারিধারের নির্জনতা ও অন্ধকার, বাঁশঝাড়ের মধ্যে কিসের খড়মড় শব্দ, অদূরে সলতেখাগী আমগাছে ভূতের প্রবাদ প্রভৃতি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ভাবিতে লাগিল—আমি কখখনো বাড়ি যাবো না তো!—এ জন্মে আর বাড়ি যাবো না–

    অভিমানের প্রথম বেগটা কাটিয়া গেলে তাহার একটু গা ছমছম কবিতে লাগিল—ভয়ে ভয়ে সে একবার দূরের সলতে-খাগী আমগাছটার দিকে চাহিয়া দেখিল। তাহার মনে হইল—এখন যদি একটা ভুতে আমায় তুলে একবারে মগডালে নিয়ে যায় তো বেশ হয়-মা খুঁজে খুঁজে কেঁদে মরেভাবে, কেন সন্দেবোলা ছাই খাও বল্লাম, তাই তো খোকা আমার রাগ করে কোথায় অন্ধকারে মেঘ মাথায় বেরিয়ে চলে গেল, আর ফিরে এলো না। ভূতের হাতে সে মরিয়া গেলে মা’র কি রকম কষ্ট হইবে তাহা সে খানিকক্ষণ প্রতিহিংসার আনন্দে উপভোগ করিল। পরে সেখান হইতে সে গিয়া পাচিলের পাশের পথে দাঁড়াইল। তাহার ভয় ভয় করিতেছিল-সম্মুখের বাঁশঝাড়ে একটা যেন অস্পষ্ট শব্দ হইল, অপু একবার ভয়ে ভয়ে চোখ উঁচু করিয়া চাহিয়া দেখিল। তাহার মা ও দিদি রানুদের বাড়ির দিকে ডাকিতেছে-ও অপু-উ-উ! বাঁশঝাড়ে আবার যেন একটা শব্দ হইল। সে মনে মনে বড় অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল। কিন্তু মুশকিল। এই যে, তাহাকে খোেশামোদ না করিলে সে নিজেই এত রাগের মাথায় বাড়ি গিয়া ঢুকিবে, সত্য সত্য এতটা আত্মসম্মানজ্ঞানশূন্য সে নয়। নিশ্চয়ই। এবার তাহার দিদি রানুদের বাড়ির খিড়কি দিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে যেন। সে ছুটিয়া দরজার সামনে পাচিলের কোণটাতে দাঁড়াইল। হঠাৎ আসিতে আসিতে পাচিলের পাশে চোখ পড়িতেই দুর্গা চেঁচাইয়া বলিয়া উঠিল, ওই দাঁড়িয়ে রয়েছে মা! …এই দ্যাখো পাচিলের পাশে। পরে সে ছুটিয়া গিয়া ভাইয়ের হাত ধরিল। (ছুটিবার আবশ্যকতা ছিল না।)-ওরে দুষ্ট, এখানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা হয়েচে, আর আমি আর মা সমস্ত জায়গা খুঁজে বেড়াচ্চি, এই দ্যাখে।

    দুজনে মিলিয়া তাহাকে বাড়ির মধ্যে ধরিয়া লইয়া গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.