Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প391 Mins Read0

    ১৮. অপু সেদিন জেলেপাড়ায়

    অপু সেদিন জেলেপাড়ায় কড়ি খেলিতে গিয়াছিল। বেলা দুইটা বা আড়াইটার কম নয়, রৌদ্র অত্যন্ত প্রখর। প্রথমে সে তিনকড়ি জেলের বাড়ি গেল। তিনকড়ির ছেলে বঙ্কা পেয়ারাতলায় বাখারি চাচিতেছিল, অপু বলিল–এই কড়ি খেলবি?

    খেলিবার ইচ্ছা থাকিলেও বঙ্কা বলিল, তাহাকে এখনই নৌকায় যাইতে হইবে, খেলা করিতে গেলে বাবা বকিবে! সেখান হইতে সে গেল রামচরণ জেলের বাড়ি।

    রামচরণ দাওয়ায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল; অপু বলিল-হৃদয় বাড়ি আছে?

    রামচরণ বলিল-হৃদয়কে কেন ঠাকুরী? কড়ি খেলা বুঝি? এখন যাও, হৃদে বাড়ি নেই।

    ঠিক-দুপুর বেলায় ঘুরিয়া অপুর মুখ রাঙা হইয়া গেল। আরও কয়েক স্থানে বিফলমনোরথ হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে বাবুরাম পাড়ুইয়ের বাড়ির নিকটবতী তেঁতুলতলার কাছে আসিয়া তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তেঁতুলতলায় কড়ি খেলার আডডা খুব জমিয়াছে। সকলেই জেলেপাড়ার ছেলে কেবল ব্ৰাহ্মণপাড়ার ছেলের মধ্যে আছে। পটু। অপুর সঙ্গে পটুর তেমন আলাপ নাই, কারণ পটুর যে পাড়ায় বাড়ি, অপুদের বাড়ি হইতে তাহা অনেক দূর। অপুর চেয়ে বয়সে পঢ়ি কিছু ছোট; অপুর মনে আছে, প্রথম যেদিন সে প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালায় ভর্তি হইতে যায়, সেদিন এই ছেলেটিকেই সে শান্তভাবে বসিয়া তালপাতা মুখে পুরিয়া চিবাইতে দেখিয়াছিল।…অপু তাহার কাছে গিয়া বলিল-কটা কড়ি?… পটু কড়ির গেজে বাহির করিয়া দেখাইল। রাঙা সুতার বুনানি ছোট্ট গেজেটি-তাহার অত্যন্ত শখের জিনিস। বলিল, সতেরোটা এনেছি।–সাতটা সোনাগেটে; হেরে গেলে আরও আনবো।… পরে সে গেজেটা দেখাইয়া হাসিমুখে কহিল-কেমন দেখচিস? গেজেটায় একপণ কড়ি ধরে।

    খেলা আরম্ভ হইল। প্রথমটা পটু হারিতেছিল, পরে জিতিতে শুরু করিল। কয়েকদিন মাত্র আগে পটু আবিষ্কার করিয়াছে যে, কড়ি-খেলায় তাহার হাতের লক্ষ্য অব্যর্থ হইয়া উঠিয়াছে; সেইজন্যই সে দিগ্বিজয়ের উচ্চাশায় প্রলুব্ধ হইয়া। এতদূর আসিয়াছিল। খেলার নিয়মানুসারে পটু উপর হইতে টুক করিয়া বড় কড়ি দিয়া তাক ঠিক করিয়া মারিতেই যেমন একটা কড়ি বৌ করিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া যায় আমনি পটুর মুখ অসীম আহ্বাদে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। পরে সে জিতিয়া পাওয়া কড়িগুলি তুলিয়া গেজের মধ্যে পুরিয়া লোভে ও আনন্দে বার বার গেজেটির দিকে চাহিয়া দেখে, সেটা ভর্তি হইতে আর কত বাকি!

    কয়েকজন জেলের ছেলে কি পরামর্শ করিল। একজন পটুকে বলিল-আর এক হাত তফাত থেকে তোমায় মারতে হবে ঠাকুর, তোমার হাতে টিপ বেশি!

    পটু বলিল-বা রে, তা কেন, টিপ বেশি থাকাটা দোষ বুঝি? তোমরাও জেতো না, আমি তো কাউকে বারণ করিনি।

    পরে সে চারদিকে চাহিয়া দেখিল, জেলের ছেলেরা সব একদিকে হইয়াছে। পটু ভাবিল-এত বেশি কড়ি আমি কোনদিন জিতি নি; আজ আর খেলচি নে-খেল্লে কি আর এই কড়ি বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো? আবার একহাত বাধা বেশি! সব হেরে যাব!..হঠাৎ সে কড়ির ছোট্ট থলিটি হাতে লইয়া বলিল-আমি এক হাত বেশি নিয়ে খেলবো না, আমি বাড়ি যাচ্ছি।… পরে জেলের ছেলেদের ভাবভঙ্গি ও চোখের নিষ্ঠুর দৃষ্টি দেখিয়া সে নিজের অজ্ঞাতসারে নিজের কড়ির থলিটি শক্ত মুঠায় চাপিয়া রাখিল।

    একজন আগইয়া আসিয়া বলিল—তা হবে না ঠাকুর, কড়ি জিতে পালাবে বুঝি?.সঙ্গে সঙ্গে সে হঠাৎ পিটুর থলিসুন্ধ হাতটা চাপিয়া ধরিল। পটু ছাড়াইয়া লইতে গেল, কিন্তু জোরে পরিল না; বিষণ্ণমুখে বলিল-বা-রে, ছেড়ে দাও না। আমার হাত-পিছন হইতে কে একজন তাহাকে ঠেলা মারিল; সে পড়িয়া গেল বটে, কিন্তু কড়ির থলি ছাড়িল না। সে বুঝিয়াছে এইটিই কাড়িবার জন্য ইহাদের চেষ্টা!! পড়িয়া গিয়া সে প্রাণপণে থলিটা পেটের কাছে চাপিয়া রাখিতে গেল; কিন্তু একে সে ছেলেমানুষ, তাহাতে গায়ের জোরও কম, জেলেপাড়ার বলিষ্ঠ ও তাহার চেয়ে বয়সে বড় ছেলেদের সঙ্গে কতক্ষণ যুঝিতে পরিবে! হাত হইতে কড়ির থলিটি অনেকক্ষণ কোন ধারে ছিটকাইয়া পড়িয়াছিল-কড়িগুলি চারিধারে ছত্রাকার হইয়া গেল।

    অপু প্রথমটা পটুর দুর্দশায় একটু খুশি না হইয়াছিল তাহা নহে, কারণ সে-ও অনেক কড়ি হারিয়াছে। কিন্তু পটুকে পড়িয়া যাইতে দেখিয়া, বিশেষ করিয়া তাহাকে অসহায় ভাবে পড়িয়া মার খাইতে দেখিয়া তাহার বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিল, সে ভিড় ঠেলিয়া আগাইয়া গিয়া বলিলছেলেমানুষ। ওকে তোমরা মারচ কেন? বা রে, ছেড়ে দাও-ছাড়ো! পরে সে পটুকে মাটি হইতে উঠাইতে গেল, কিন্তু পিছন হইতে কাহার হাতেব ঘুষি খাইয়া খানিকক্ষণ সে চোখে কিছু দেখিতে পাইল না; তারপর ঠেলা ঠেলিতে সে-ও মাটিতে পড়িয়া গেল।

    অপুকেও সেদিন বেদম প্রহার খাইতে হইত নিশ্চয়ই, কারণ তাহার মেয়েলী ধরনের হাতেপায়ে কোন জোর ছিল না, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে নীরেন এই পথে আসিয়া পড়াতে বিপক্ষদল সরিয়া পড়িল। পটুর লাগিয়াছিল খুব বেশি; নীরেন তাহাকে মাটি হইতে উঠাইয়া গায়ের ধূলা ঝাড়িয়া দিল। একটু সামলাইয়া লইয়াই সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল-ছড়ানো কড়িগুলার দু’একটি ছাড়া বাকিগুলি অদৃশ্য, প্রায় কড়ির থলিটি পর্যন্ত। পরে সে অপুর কাছে সরিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল– অপুদা, তোমার বেশি লাগে নি তো?

    এতদূরে ঠিক দুপুরবেলা জেলের ছেলেদের দলে মিশিয়া কড়ি খেলিতে আসিবার জন্য নীরেন দুজনকেই বকিল। সময় কাটাইবার জন্য নীরেন পাড়ার ছেলেদের লইয়া অন্নদা রায়ের চণ্ডীমণ্ডপে পাঠশালা খুলিয়াছিল, সেখানে গিয়া কাল হইতে পড়িবার জন্য দুজনকেই বার বার বলিল। পটু চলিতে চলিতে শুধুই ভাবিতেছিল–কেমন সুন্দর কড়ির গেজেটা আমার, সেদিন অত করে ছিবাসেব কাছে চেয়ে নিলাম-গেল!! আমি যদি কড়ি জিতে আর না খেলি তা ওদের কি? সে তো আমার ইচ্ছে!…

     

    বাড়ি ঢুকিয়াই অপু দুৰ্গাকে বলিল-দিদি, শিউলিতলায় গুড়ির কাছে আমি একটা বাঁকা কঞ্চি রেখে গিাইছি, আর তুই বুঝি সেটাকে ভেঙে দুখণ্ড করে রেখেচিস?

    দুৰ্গা সেখানাকে ভাঙিয়াছিল ঠিকই। —আহা, ভাবি তো একখানা বাঁকা-কঞ্চি! তোর যত পাগলামি—বাঁশ-বাগানে খুঁজলে কঞ্চি আর মিলবে না বুঝি। কঞ্চির ভারি অমিল কিনা!

    অপু লজ্জিত মুখে বলিল-অমিল না তো কি? তুই এনে দে দিকি ওইরকম একখানা কঞ্চি! আমি কত খুঁজেপেতে নিয়ে আসবো, আর তুই সব ভেঙেচুবে রাখবি।–বেশ তো!

    তার চোখে জল আসিয়া গেল।

    দুৰ্গা বলিল-দেবো এখন এনে যত চাস, কান্না কিসের?

    বাঁকা-কঞ্চি অপুর জীবনে এক অদ্ভুত জিনিস! একখানা শুকনো, হালকা, গোড়ার দিক মোটা, আগার দিক সরু বাঁকা-কঞ্চি হাতে করিলেই অপুর মন পুলকে শিহরিয়া ওঠে, মনে অদ্ভুত সরু কল্পনা জাগে। একখানা বাঁকা-কঞ্চি হাতে করিয়া একদিন সে সারা সকাল কি বৈকাল আপনমনে বাঁশবনের পথে কি নদীর ধারে বেড়াইয়া বেড়ায়; কখনও রাজপুত্র, কখনও তামাকের দোকানী, কখনও ভ্ৰমণকারী, কখনও বা সেনাপতি, কখনও মহাভারতের অর্জন-কল্পনা করে ও আপনমনে বিড় বিড় করিয়া কাল্পনিক ঘটনা যাহা ওই অবস্থায় তাহার জীবনে ঘটিলে তাহার আনন্দ হইত, সেই সব ঘটনা বলিয়া যায়। কঞ্চি যত মনের মতো হালকা হইবে ও পরিমাণমতো বাঁকা হইবে, তাহার আনন্দ ও কল্পনা ততই পরিপূর্ণতা লাভ করে; কিন্তু সে রকম কঞ্চি সংগ্ৰহ করা যে কত শক্ত অপু ত্যাহা বোঝে। কত খুঁজিয়া তবে একখানা মেলে।

    অপু যে বাঁকা-কঞ্চি হাতে এরকম করিয়া বেড়ায়, এ কথা কেউ না শুনিতে পারে অপুর সেদিকে অত্যন্ত চেষ্টা। এরূপ অবস্থায় লোকে তাহাকে আপনমনে বকিতে দেখিলে পাগল ভাবিবে বা অন্য কিছু মনে করিবে, এই আশঙ্কায় সে পারতপক্ষে জন-সমাগমপূর্ণ স্থানে অথবা যেদিকে কেহ হঠাৎ আসিয়া পড়িতে পারে, সে সব দিকে না গিয়া নদীর ধারে-নির্জন বাঁশবনেব পথেনিজেদের বাড়ির পিছনে তেঁতুল-তলায় ঘোরে। এ অবস্থায় তাহকে কেহ না দেখে, সেদিকে তাহার অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি! কাচিৎ যদি কেহ আসিয়া পড়ে, তখনই সে জিভ কাটিয়া হাতের কঞ্চিখানা ফেলিয়া দেয়-পাছে কেহ কিছু মনে করে—এজন্য তাহারা ভারি লজ্জা।

    কেবল জানে তাহার দিদি। দিদি তাহাকে এ অবস্থায় দু’একবার দেখিয়া ফেলিয়াছিল, কাজেই দিদির কাছে আর লুকাইয়া কি হইবে? তাই সে বাঁকা-কঞ্চির কথা দিদিকে স্পষ্টই জিজ্ঞাসা করিল। অন্য লোক হইলে, লজ্জায় অপু কখনই এ কথার উল্লেখ করিতে পারিত না, যদিও কেহই জানে না অপুর সহিত বাঁকা-কঞ্চির কি রহস্যময় সম্পর্ক, তবুও অপুর মনে হয়। সকলেই সেকথা জানে, বলিলেই সকলে তাহাকে পাগল বলিয়া ঠাট্টা করিবে। কে বুঝিবে-একখানা বাঁকা-কঞ্চি হাতে পাইলে, সে না খাইয়া-দাইয়া নদীর ধারে কি কোনো জনহীন বনের পথে কি অপূর্ব আনন্দেই সারাদিন একা একা কাটাইয়া দিতে পারে!…

    দিদিকে অনুরোধ করিয়াছিল-মাকে যেন এসব বলিসনে দিদি!…দুর্গা বলে নাই!

    সে জানে, অপু একটা পাগল! ভারি মমতা হয় ওর ওপর, ছোট বোকা আদুরে ভাইটা—এসব মাকে বলিয়া কি হইবে?…

    মধুসংক্ৰাস্তির ব্রতের পূর্বদিন সর্বজয়া ছেলেকে বলিল-কাল তোদের মাস্টার মশায়কে নেমস্তন্ন করে আসিস–বলিস দুপুর-বেলা এখানে খেতে।

    মোটা চালের ভাত, পেঁপের ডালনা, ড়ুমুরের সুক্তনি, থোড়ের ঘণ্ট, চিংড়ি মাছের ঝোল, কলার বড়া ও পায়েস।

    দুৰ্গাকে তাহার মা পরিবেশন-কার্যে নিযুক্ত করিয়াছে। নিতান্ত আনাড়ি-ভয়ে ভয়ে এমন সন্তৰ্পণ সে ডালের বাটি নিমন্ত্রিতের সম্মুথে রাখিয়া দিল–যেন তাহার ভয় হইতেছে এখনই কেহ বকিয়া উঠিবে। অত মোটা চালের ভাত নীরোনের খাওয়া অভ্যাস নাই; এত কম তৈলঘূতেব বান্না তরকারি কি করিয়া লোকে খায় তাহা সে জানে না। পায়েস পানসে-জলমিশানো দুধের তৈরি, একবার মুখে দিয়াই পাযোস-ভোজনের উৎসাহ তাহার অর্ধেক কমিয়া গেল। অপু মহা খুশি ও উৎসাহসহকারে খাইতেছিল; এত সুখাদ্য তাঁহাদের বাড়িতে দু’একদিন মাত্র হইয়াছে।–আজ তাহার স্মরণীয় উৎসবের দিন!—আপনি আর একটু পায়েস নিন মাস্টার মশায়।. নিজে সে এটা-ওটা বার বার দিদির কাছে চাহিয়া লইতেছিল।

    বাড়ি ফিরিলে গোকুলের বউ হাসিমুখে বলিল-দুগগাকে পছন্দ হয়। ঠাকুরপো? দিব্যি দেখতে শুনতে! আহা! গরিবের ঘরের মেয়ে, বাপের পয়সা নেই। কার হাতে যে পড়বে?–সারা জীবন পড়ে পড়ে ভুগবে। তা তুমি ওকে বিয়ে করো না কেন ঠাকুরপো, তোমাদেরই পালটি ঘর-মেয়েও দিব্যি; ভাইবোনের দুজনেরই কেমন বেশ পুতুল-পুতুল গড়ন!…

     

    জরিপের তাঁবু হইতে ফিরিতে গিয়া নীরেন সেদিন গ্রামের পিছনের আমবাগানের পথ ধরিয়াছিল। একটা বনে-ঘেরা সবু পথ বাহিয়া আসিতে আসিতে দেখিল বাগানের ভিতর হইতে একটি মেয়ে সম্মুখের পথের উপরে আসিয়া উঠিতেছে, সে চিনিল।–অপুর বোন দুৰ্গা। জিজ্ঞাসা করিল–কি খুকি, তোমাদের বাগান বুঝি এইটে?

    দুর্গা পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিয়া লজ্জিত হইল, কিছু বলিল না।

    পরে সে পথের পাশে দাঁড়াইয়া নীরেনকে পথ ছাড়িয়া দিতে গেল। নীরেন বলিল-না না খুকি, তুমি চল আগে আগে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালেই হল। ওইদিকে একটা পুকুরের ধারে গিয়ে পড়েছিলাম, তারপর পথ খুজে হয়রান। যে বন তোমাদের দেশে!

    দুর্গা যাইতে যাইতে হঠাৎ থামিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া নীরেনের মুখের দিকে চাহিবার চেষ্টা করিল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার কাপড়ের ভিতর হইতে কিসের ফল গোটাকতক পথের উপর পড়িয়া গেল।

    নীরেন বলিল-কি যেন পড়ে গেল খুকি! কিসের ফল ওগুলো?

    দুর্গা নিচু হইয়া কুড়াইতে কুড়াইতে সংকুচিতভাবে বলিল-ও কিছু না, মেটে আলু।

    –মেটে আলু? খেতে ভালো লাগে বুঝি? কি করে খায়?

    এ প্রশ্ন দুৰ্গার কাছে অত্যন্ত কৌতুহলজনক ঠেকিল। একটি পাঁচ বছরের ছেলে যা জানে, চশমাপরা একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি তাহা জানে না! সে বলিল -এ ফল তো খায না, এ তো তেতো।

    –তবে তুমি যে—

    দুৰ্গা সলজ্জসুরে বলিল-আমি নিয়ে যাচ্ছি। এমনি-খেলবার জন্যে।… একথা তাহার মনে ছিল যে, এই চশমা-পরা ছেলেটির সঙ্গেই সেদিন খুড়িমা ঠাট্টাচ্ছলে তাহার বিবাহের কথা তুলিয়াছিল। তাহারা ভারি কৌতুহল হইতেছিল, ছেলেটিকে সে ভালো করিয়া দেখে। কিন্তু মধুসংক্ৰাস্তির ব্রতের দিনেও তাহা সে পাবে নাই, আজও পারিল না।

    —অপুকে বোলো কাল সকালে যেন বই নিয়ে যায়–বলবে তো?

    দুর্গা চলিতে চলিতে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল। আর একটু গিয়া পাশেব একটা পথ দেখাইয়া বলিল–এই পথ দিয়ে গেলে আপনাব খুব সোজা হবে।

    নীরেন বলিল-আচ্ছা, আমি চিনে যাবো এখন, তোমাকে একটু এগিয়ে দিই। তুমি একলা যেতে পারবে?

    দুৰ্গা আঙুল দিযা দেখাইযা কহিল—ওই তো আমাদেব বাড়ি একটু এগিযে গিয়েই, আমি তো-এইটুকু একলা যাবো এখন। আপনি আর

    দুৰ্গাকে ইহার আগে নীরেন কখনও ভালো করিয়া দেখে নাই,- চোখ দুটির অমন সুন্দর ভাব কেবল দেখিয়াছে ইহারই ভাই অপুব মধ্যে। যেন পল্লীপ্রান্তের নিভৃত চুত-বকুল-বীথির প্রগাঢ় শ্যামস্নিগ্ধতা ডাগর চোখ দুটির মধ্যে অর্ধসুপ্ত রহিয়াছে। প্রভাত এখনও হয় নাই, রাত্রিশেষের অলস অন্ধকার এখনও জড়াইয়া আছে। তবে তাহা প্ৰভাতের কথা স্মরণ করাইয়া দেয় বটে, -ক’ত সুপ্ত আঁখির জাগরণ, কত কুমারীর ঘাটে যাওয়া, ঘরে ঘরে কত নবীন জাগরণের অমৃত উৎসবজানালায় জানালায় ধূপগন্ধ।

    দুৰ্গা খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া কেমন যেন উসখুসি করিতে লাগিল। নীরেনের মনে হইল সে কি বলিবে মনে করিতে পারিতেছে না। সে বলিল-না খুকি, তোমাকে আর একটু এগিয়ে দিই? চল, তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাই।

    দুর্গা ইতস্তত করিতে লাগিল, পরে একটু মুখ টিপিয়া হাসিল। নীরেনের মনে হইল এবার সে কথা বলিবে। পরীক্ষণে কিন্তু দুৰ্গা ঘাড় নাড়িয়া তাহার সহিত যাইতে হইবে না জানাইয়া দিয়া, বাড়ির পথ ধরিয়া চলিয়া গেল।

     

    দুপুর বেলা। ছাদে কাপড় তুলিতে আসিয়া গোকুলের বউ নীরেনের ঘরের দুয়ারে উঁকি দিয়া দেখিল। গরমে নীরেন বিছানায় শুইয়া খানিকটা এপাশ-ওপাশ করিবার পর, নিদ্রার আশায় জলাঞ্জলি দিয়া, মেজেতে মাদুর পাতিয়া বাড়িতে পত্র লিখিতেছিল।

    গোকুলের বউ হাসিয়া বলিল-ঘুমোও নি যে ঠাকুরপো? আমি ভাবলাম ঠাকুরপো ঘুমিয়ে পড়েচে বুঝি, আজ মোচার ঘণ্ট যে বড় খেলে না-পাতেই রেখে এলে, সেদিন তো সব খেয়েছিলে?

    –আসুন বৌদি। মোচার ঘণ্টা খাবো কি? বাঙালে কাণ্ড সব; যে ঝাল তাতে খেতে বসে কি চোখে দেখতে পাই-কোনটা ঘণ্ট, কোনটা কি?

    গোকুলের বউ ঘরের দুয়ারের গবরাট মাথাটা হেলাইয়া ঠেস দিয়া অভ্যস্তভাবে মুখের নিচু দিকটা আঁচল দিয়া চাপিয়া দাঁড়াইল।

    -ইস, ঠাকুরপো, বড় শহুরে চাল দিচ্ছ যে! ওইটুকু ঝাল আর তোমাদের সেখানে কেউ খায় क्रा-न्म?

    –মাপ করবেন বৌদি, এতে যদি “ওইটুকু’ হয়, তবে আপনাদের বেশিটা একবার খেয়ে না। দেখে আমি এখান থেকে যাচ্ছি নে! যা থাকে কপালে-যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্লান্না! দিন একদিন চক্ষুলজার মায়া কাটিয়ে যত খুশি লঙ্কা।

    -ওমা আমার কি হবে! চক্ষুলজার ভয়েই শিল-নোড়ার পাঠ তুলে দিয়ে চুপ করে বসে আছি নাকি ঠাকুরপো? শোনো কথা ঠাকুরপোর-বলে কিনা যাহা বাহান্ন…হাসির চোটে তাহার চোখে জল আসিয়া পড়িল। খানিকটা পরে সামলাইয়া লইয়া বলিল-আচ্ছা তোমাদের সেখানে গরম কেমন ঠাকুরপো?

    —সেখানে, কোথায়? কলকাতায় না। পশ্চিমে? পশ্চিমের গরম কি রকম সে এখান থেকে কি বুঝতে পারবেন! সে বাংলাদেশে থেকে বোঝা যাবে না। বোশেখ মাসের দিকে রাত্রে কি কেউ ঘরের মধ্যে শূতে পারে? ছাদে বিকেলে জল ধরে ছাদ ঠাণ্ডা করে রেখে তাইতে রাত্রে শূতে হয়।

    -আচ্ছা, তোমরা যেখানে থাকো এথান থেকে কতদূর?

    —এখান থেকে রেলে প্রায় দু’দিনের রাস্তা। আজ সকালের গাড়িতে মাঝেরপাড়া স্টেশনে চড়লে কাল দুপুর-রাত্রে পৌছানো যায়।

    –আচ্ছা ঠাকুরপো, শুনিচি নাকি গয়াকাশীর দিকে পাহাড় কেটে রেল নিয়ে গিয়েচে-সত্যি?

    –সত্যি। অনেক বড় বড় পাহাড়, ওপরে জঙ্গল—তার ভেতর দিয়ে যখন রেলগাড়ি যায়। — একেবারে অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না, গাড়ির মধ্যে আলো জ্বলে দিতে হয়।

    গোকুলের বউ উৎসুকভাবে বলিল-আচ্ছা, ভেঙে পড়ে না?

    –ভেঙে পড়বে কেন বৌদি? বড় বড় এঞ্জিনিয়ারে সুড়ঙ্গ তৈরি করেচে, কত টাকা খরচ করেচে, ভাঙলেই হল! এ কি আপনাদের রায়পাড়ার ঘাটের ধাপ যে দু’বেলা ভাঙচে?

    এঞ্জিনিয়ার কোন জিনিস গোকুলের বউ তাহা বুঝিতে পারিল না। বলিল-পাহাড়টা মাটির না পাথরের?

    –মাটিরও আছে, পাথরেরও আছে। নাঃ বৌদি, আপনি একেবারে পাড়াগোঁয়ে। আচ্ছা! আপনি রেলগাড়িতে কতদূর গিয়েছেন?

    গোকুলের বউ আবার কৌতুকের হাসি হাসিয়া উঠিল। চোখ প্রায় বুজিয়া মুখ একটুখানি উপরের দিকে তুলিয়া ছেলেমানুষের ভঙ্গিতে বলিল-ওঃ, ভারি দূর গিাঁইচি, একেবারে কাশী গয়া মক্কা গিাইচি! সেই ও-বছর পিসশাশুড়ি আর সতুর মা’র সঙ্গে আড়ংঘাটার যুগলকিশোর দেখতে গিাইছিলাম। সেই আমার জন্মের মধ্যে কৰ্ম্ম–রেলগাড়িতে চড়া!

    এই মেয়েটি অল্পক্ষণের মধ্যেই সামান্য সূত্র ধরিয়া তাহার চারিপাশের এমন একটা হাসিকৌতুকের জাল বুনিতে পারে-যাহা নীরেনের ভারি ভালো লাগে। যে ধরনের লোকের মনের মধ্যে আনন্দের এমন অফুরন্ত ভাণ্ডার থাকে, যার কারণে অকারণে অন্তর্নিহিত আনন্দের উৎস মনের পত্র উপচাইয়া পড়িয়া অপরকেও সংক্রামিত করিয়া তোলে, এই পল্লীবধুটি সেই দলের একজন আজকাল নীরেন মনে মনে ইহারই আগমনের প্রতীক্ষা করে– না আসিলে নিরাশ হয়, এমন কি যেন একটু গোপনু অভিমানও হইয়া থাকে।

    -আচ্ছা বৌদি, আপনাদের সবাই চলুন, একবার পশ্চিমে সব বেড়িয়ে নিয়ে আসি।

    -এ বাড়ির লোকে বেড়াতে যাবে পশ্চিম! তুমিও যেন ঠাকুরপো! তাহলে উত্তর মাঠের বেগুন-ক্ষেতে চৌকি দেবে কে?

    কথার শেষে সে আর একদফা ব্যঙ্গমিশ্রিত কৌতুকের হাসি হাসিয়া উঠিল। একটু পরে গম্ভীর হইয়া নিচু সুরে বলিল-দ্যাখো ঠাকুরপো, একটা কথা রাখবে?

    –কি কথা বলুন আগে?

    —যদি রাখো তো বলি!

    -ও সাদা কাগজে সই করা আমার দ্বারা হবে না, বৌদি! জানেন তো আইন পড়ি। আগে কথাটা শুনবো, তারপর কথার উত্তর দেবো।

    গোকুলের বউ দুয়ার ছাড়িযা ঘরের মধ্যে আসিল। কাপড়ের ভিতর হইতে একটা কাগজের মোড়ক বাহির করিয়া বলিল-এই মাকড়ি দুটো রেখে আমায় পাঁচটা টাকা দেবে?

    নীরেন বিস্ময়ের সুরে বলিল-কেন বলুন তো?

    -সে এখন বলবো না। দেবে ঠাকুরপো?

    –আগে বলুন টাকা দিয়ে কি হবে? নইলে কিন্তু—

    গোকুলের বৌ নিম্নসুরে বলিল-আমি এক জায়গায় পাঠাবো। দ্যাখো তো এই চিঠিখানার ওপরের ঠিকানাটা ইংরিজিতে কি লেখা আছে!

    নীবেন পড়িয়া বলিল-আপনার ভাই, না বৌদি?

    —চুপ চুপ, এবাড়ির কাউকে বোলো না যেন। পাঁচটা টাকা চেয়ে পাঠিয়েচে, কোথায পাবো ঠাকুরপো, কি রকম পরাধীন জানো তো? তাই ভাবলাম এই মাকড়ি দুটো-টাকা পাঁচটা দাও গিযে ঠাকুরপো-হতভাগা ছোঁড়াটির কি কেউ আছে ভূভারতে?…গোকুলের বউ-এবা গলাব স্বর চোখের জলে ভারী হইয়া উঠিল।

    নীরেন বলিল-টাকা আমি দেবো বৌদি, পাঁচটা হয় দশটা হয়, আপনি যখন হয় শোধ দেবেন; কিন্তু মাকড়ি আমি নিতে পারবো না

    গোকুলের বউ কৌতুকের ভঙ্গিতে ঘাড় দুলাইয়া হাসিমুখে বলিল—তা হবে না ঠাকুরপো, বাঃ বেশ তো তুমি! তারপর আমি তোমার ঋণ রেখে মরে যাই আর তুমি-সো হবে না, ও তোমায় নিতেই হবে। আচ্ছ। যাই ঠাকুরপো, নিচে অনেক কাজ পড়ে রয়েচে–

    সে দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, কিন্তু সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া পুনরায় নিম্নস্বরে বলিল-কিন্তু টাকার কথা যেন কাউকে বোলো না ঠাকুরপো! কাউকে না–বুঝলে?

     

    দুৰ্গা কাঁথার তলা হইতে অত্যন্ত খুশির সহিত ডাকিল।–অপু, ও অপু!

    অপু জাগিয়াই ছিল, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন কথা বলে নাই। বলিল-দিদি, জানালাটা বন্ধ করে দিবি? বড় ঠাণ্ডা হাওয়া আসচে।

    দুৰ্গা উঠিয়া জানালা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিল-রানুর দিদির বিয়ে কবে জানিস? আর কিন্তু বেশি দেরি নেই। খুব ঘটা হবে, ইংরিজি বাজনা আসবে। দেখিচিস্তুই ইংরিজি বাজনা?

    -হ্যাঁ, সব মাথায় টুপি পরে বাজায়, এই বড় বড় বাঁশি-মস্ত বড় ঢাক, আমি দেখেচি-আর একরকম বাঁশি বাজায়, কালো কালো, অত বড় নয়, ফুলেট বাঁশি বলে–এমন চমৎকার বাজে! ফুলোট বাঁশি শুনিচিস?

    দুৰ্গা আর একটা কথা ভাবিতেছিল।

    কাল সে বৈকালে ওপাড়ার খুড়িমার কাছে বেড়াইতে যায়। একথা-সেকথার পর খুড়িমা জিজ্ঞাসা করিল, দুগগা, তোর সঙ্গে ঠাকুরপোর কোথায় দেখা হয়েছিল রে?

    সে বলিল-কেন খুড়িমা?… পরে সে সেদিনের কথা বলিল। কৌতুকের সুরে বলিল, পথ হারিয়ে খুড়িমা ওতেই-একেবারে গড়ের পুকুর-সেই বনের মধ্যে

    খুড়িমা হাসিয়া বলিল-আমি কাল ঠাকুরপোকে বলছিলাম তোর কথা-বলছিলামগরিবের মেয়ে ঠাকুরপো, কিছু দেবার থোবার সাধ্যি তো নেই বাপের-বড্ড ভালো মেয়ে-যেন একালেরই মেয়ে না।–তা। ওকে নাওগে না? তাই ঠাকুরপো তোর কথা-টথা জিজ্ঞেস করছিলবল্পে, ঘাটের পথে সেদিন কোথায় দেখা হল-পথ ভুলে ঠাকুরপো কোথায় গিয়ে পড়েছিল–এই সব। তারপর আমি আজ তিনদিন ধরে বলচি শ্বশুর-ঠাকুরকে দিয়ে তোর বাবাকে বলবো। ঠাকুরপোর যেন মত আছে মনে হল, তোকে যেন মনে লেগেচে

    দুৰ্গা গোয়াল হইতে বাছুর বাহির করিয়া রৌদ্রে, বাঁধিল বটে, কিন্তু অন্যদিন বাড়ির কাজ তবু তো যাহোক কিছু করে, আজ সে ইচ্ছা তাহার মোটেই হইতেছিল না। এক-একদিন, তাহার এরকম মনের ভাব হয়; সেদিন সে কিছুতেই বাড়ির গণ্ডিতে আটকাইয়া থাকিতে পারে না-কে তাহাকে পথে পথে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরাইয়া লইয়া বেড়ায়। আজ যেন হাওয়াটা কেমন সুন্দর, সকালটা নাগরম-না-ঠাণ্ডা, কেমন মিষ্ট গন্ধ পাওয়া যায় লেবু ফুলের—যেন কি একটা মনে আসে, কি তাহা সে বলিতে পারে না।

    বাড়ির বাহির হইয়া সে রানুদের বাড়ি গেল। ভুবন মুখুজ্যে অবস্থাপন্ন গৃহস্থ, এই তার প্রথম মেয়ের বিবাহ, খুব ঘটা করিয়াই বিবাহ হইবে। বাজিওয়ালা আসিয়া বাজির দরদস্তুর করিতেছে। সীতানাথ ও-অঞ্চলের বিখ্যাত রসুনাচৌকি বাজিয়ে, তাহারও বায়না হইয়াছে, বিবাহ উপলক্ষে নানাস্থান হইতে কুটুম্বের দল আসিতে শুরু করিয়াছে। তাহাদের ছেলেমেয়েতে বাড়ির উঠান সরগরম। দুৰ্গার মনে ভারি আনন্দ হইল-আর দিনকতক পরে ইহাদেরই বাড়িতে কত বাজি পুড়িবে। সে কোনো বাজি কখনও দেখে নাই, কেবল একবার গাঙ্গুলি বাড়ির ফুলদোলে একটা কি বাজি দেখিয়াছিল, হ্রস করিয়া আকাশে উঠিয়া একেবারে যেন মেঘের গায়ে গিয়া ঠেকে, সেখান হইতে আবার পড়িয়া যায়, এমন চমৎকার দেখায়! অপু বলে, হাউই বাজি।

    দুপুরের পর মা দালানে আঁচল বিছাইয়া একটু ঘুমাইয়া পড়লে, সে সুড়ুৎ করিয়া পুনরায় বাড়ির বাহির হইল। ফায়ুনের মাঝামাঝি, রৌদ্রের তেজ চড়িয়াছে, একটানা তপ্ত হাওয়ায় রানুদের বাগানের বড় নিমগাছটার হলদে পাতাগুলো ঘুরিতে ঘুরিতে ঝরিয়া পড়িতেছে-কেহ কোনদিকে নাই, নেড়াদের বাড়ির দিকে কে যেন একটা টিন বাজাইতেছে। বু-উ-উ-উ করিয়া কি একটা শব্দ হইল। কঁচপোকা! দুৰ্গা নিজের অনেকটা অজ্ঞাতসারে তাড়াতাড়ি আঁচল মুঠার মধ্যে পাকাইয়া চকিত দৃষ্টিতে চাহিতে লাগিল।

    কাঁচপোকা নয়, সুদৰ্শন পোকা।

    তাহার মুঠার আঁচল আপনা-আপনি খুলিয়া গেল—আগ্রহের সহিত পা টিপিয়া টিপিয়া সে পোকাটার দিকে আসিতে লাগিল। সামনের পথের উপর বসিয়াছে, পাখ্যার উপর শ্বেত ও রক্ত চন্দনের ছিটার মতো বিন্দু বিন্দু দাগ।

    সুদৰ্শন পোকা-ঠিক পোকা নয়—ঠাকুর। দেখিতে পাওয়া অত্যন্ত ভাগ্যের কাজ-তাহার মোর মুখে, আরও অনেকের মুখে সে শুনিয়াছে। সে সন্তৰ্পণে ধুলার উপর বসিয়া পড়িল, পরে হাত একবার কপালে ঠেকাইয়া আর একবার পোকার কাছে লইয়া গিয়া বার বার দ্রুতবেগে আবৃত্তি করিতে লাগিল—সুদর্শন, সুভালাভালি রেখো…সুদর্শন, সুভালাভালি দেখো…সুদর্শন, সুভালাভালি রেখো (অবিকল এই রূপই সে অপরের মুখে বলিতে শুনিয়াছে)। পরে সে নিজের কিছু কথা মন্ত্রের মধ্যে জুড়িয়া দিল–অপুকে ভালো রেখো, মাকে ভালো রেখো, বাবাকে ভালো রেখো, ওপাড়ার খুড়িমাকে ভালো রেখো-পরে একটু ভাবিয়া ইতস্তত করিয়া বলিল-নীরেনবাবুকে ভালো রেখো, আমার বিয়ে যেন ওখানেই হয়। সুদর্শন, রানুর দিদির মতো বাজিবাজনা হয়।

    ভক্তের অর্ঘ্যের আতিশয্যে পোকাটা ধুলার উপর বিপন্নভাবে চক্রাকারে ঘুরিতেছিল, দুৰ্গা মনের সাধ মিটাইয়া প্রার্থনা শেষ করিয়া শ্ৰদ্ধার সহিত পাশ কাটাইয়া গেল।

    পাড়ার ভিতরকার পথে পথে মাথার উপর প্রথম ফায়ুনের সুনীল, এমন কি অনেকটা ময়ুরকষ্ঠী রং-এর আকাশ গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে।

    শ্যাওড়া বনের মাঝখান দিয়া নদীর ঘাটের সরু পথ। স্টুড়ি পথের দুধারেই আমবাগান। তপ্ত বাতাস আল-বাউলের মিষ্ট গন্ধে, বনে বনে মৌমাছি ও কাঁচপোকার গুঞ্জনরবে, ছায়াগহন আমবনে কোকিলের ডাকে, স্নিগ্ধ হইয়া আসিতেছে।

    বাগানগুলি পার হইয়া চড়কতলার মাঠ। ঘাসে-ভরা মাঠে ছায়া পড়িয়া গিয়াছে। দুর্গা ঝোপের মধ্যে মধ্যে সেয়াকুল খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল-সেঁয়াকুল এখন আর বড় থাকে না, শীতের শেষে ঝরিয়া যায়। ওই উঁচু ঢিবিতে ঝোপের মধ্যের একটা গাছে অনেক সেয়াকুল সেদিনও তো সে খাইয়া গিয়াছে, কিন্তু এখন আর নাই, সব ঝরিয়া গিয়াছে, গোলমরিচের মতো শুকনা সেয়াকুল ঘন ঝোপের তলা বিছাইয়া পড়িয়া আছে। এক ঝাক শালিক পাখি ঝোপের মধ্যে কিছু কিচু করিতেছিল, দুৰ্গা নিকটে যাইতে উড়িয়া গেল।

    তাহার মনে খুশির আবার একটা প্রবল ঢেউ আসিল। উৎসবের নৈকট্য, রানুর দিদিব বাসরে রাত জাগা ও গান শুনিবার আশা

    খুশিতে তাহার ইচ্ছা হইল সে মাঠের এধাব হইতে ওধার পর্যন্ত ছুটিয়া বেড়ায়।

    একবার সে হাত দুটা ছড়াইয়া ডানার মতো লম্বা করিয়া দিয়া খানিকটা ঘুরপাক খাইযা খানিকটা ছুটিয়া গেল। সে উড়িতে চায়!..শরীর তো হালকা জিনিস-হাত ছড়াইয়া ডানার মতো বাতাস কাটিতে কাটিতে যদি যাওয়া হইত!

    শুধু শব্দ করিবার আনন্দে সে শূকনো ঝবাপাতার রাশির উপর ইচ্ছা করিয়া জোরে জোরে পা ফেলিয়া মাচু মচু শব্দ করিতে করিতে চলিল। পাতা ভাঙিয়া গিয়া শুকনা শুকনা ধূলা মিশানো, খানিকটা সোদা সোদা খানিকটা তিক্ত গন্ধে জায়গাটা ভরিয়া গেল।

    সামনে একটু দূরে সোনাডাঙার মাঠের দিকে যাইবার কাঁচা সড়ক। একখানা গরুর গাড়ি ক্যাঁচু ক্যাঁচু শব্দে মাঠের পথের দিকে যাইতেছে। টাটকা কাটা কঞ্চির ঘেরা বাঁধিযা তাহার উপর কাঁথা ও ছেড়া লাল নকশাপাড় কাপড় ঘিরিয়া ছাই তৈয়ারি করিয়াছে। ছাঁই-এর মধ্যে কাহাদের একটা ছোট মেয়ে একঘেয়ে, একটানা ছেলেমানুষ ধরনে কাঁদিতে কাঁদিতে যাইতেছে-কোন গায়ের চাষাদের মেয়ে বোধ হয় বাপের বাড়ি হইতে শ্বশুরবাড়ি চলিয়াছে।

    দুর্গা অবাক হইয়া একদৃষ্টি গাড়িখানার দিকে চাহিয়া রহিল।

    বিয়ের পর মা, বাবা, অপু-সব ছাড়িয়া এই রকম কোথায় কতদূরে চলিয়া যাইতে হইবে হয়তো-যখন তখন সেখান হইতে তাহারা আসিতে দিবে কি? সে এতক্ষণ একথা ভাবিয়া দেখে নাই—এই বাগান, বাসকফুলের ঝাড়, রান্তী গাইটা, উঠানের কাঁঠালতলাটা যাহা সে এত ভালোবাসে, এই শূকনো পাতার গন্ধ, ঘাটের পথ এইসব ছাড়িয়া যাইতে হইবে চিরকালের জন্য! ছই-এর মধ্যের ছোট্ট মেয়েটা বোধ হয় সেই দুঃখেই কাঁদিতেছে।

    কাঁচা সড়কটা ছাড়াইয়া আর একটা ছোট্ট পোড়ো মাঠ পার হইলেই নদী।

    ওপারের জেলেরা কি মাছ ধরিতেছে? খয়রা? এপারে আসিলে দু’পয়সার মাছ কিনিয়া বাড়ি লইয়া যাইত। অপু খয়রা মাছ খাইতে বড় ভালোবাসে।

    বাড়ি ফিরিয়া সন্ধ্যার পর সে অনেকক্ষণ ধরিয়া পুতুলের বাক্স গোছাইল। ঘরের মেঝেতে তাহার মা তেল পুরিতে গিয়া অনেকটা কেরোসিন তেল ফেলিয়া দিয়াছে, তাহার গন্ধ বাহির হইতেছে, হাওয়াটা যেন একটু গরম। পুতুল-গুছানো প্রায় শেষ হইয়াছে, অপু আসিয়া বলিল-তুই, বুঝি আমার বাক্স থেকে ছোট্ট আরশিখানা বের করে নিয়েচিস দিদি?

    –হুঁ-আরশি তো আমার-আমিই তো আগে দেখতে পেয়েছিলাম, তক্তপোশের নিচে পড়েছিল। যাও, আমি আরশি আমার বাক্সে রাখবো। বেটা ছেলে আবার আরশি নিয়ে কি হবে?

    —বা রে, তোমার আরশি বই কি? ও-পাড়ার খুড়িমাদের বাড়ি থেকে মা তো কি বের্তেীতে আরশি এনেছিল, আমি তো আগেই মা’র কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। না দিদি, দাও

    কথা শেষ করিয়াই সে দিদির পুতুলের বাক্সের কাছে বসিয়া পড়িয়া তাহার মধ্যে আরশি খুঁজিতে লাগিল।

    দুৰ্গা ভাইয়ের গালে এক চড় লাগাইয়া দিয়া বলিল-দুন্টু কোথাকার-আমি পুতুল গুছিয়ে রাখচি আর উনি হাণ্ডুল-পাণ্ডুল করছেন- যা আমার বাক্সে হাত দিতে হবে না তোমায়-দোবো না আমি আরশি।

    কিন্তু কথা শেষ না হইতেই অপু ঝাপাইয়া তাহার ঘাড়ের উপর পড়িয়া তাহার বৃক্ষ চুলের গোছা ধরিয়া টানিয়া আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। কান্না আটকানো গলায় বলিতে লাগিল-কেন তুমি আমাকে মারবে? আমার লাগে না বুঝি?–দাও আমায়া-মাকে বোলে দেবো-লক্ষ্মীর চুপড়ি থেকে আলতা চুরি কোরেচ–

    আলতা চুরির কথায় দুর্গা ক্ষেপিয়া গেল। ভাই-এর কান ধরিয়া তাহাকে কঁকুনি দিয়া উপরি উপরি পটাপট কয়েকটা চড় দিতে দিতে বলিল-আলতা নিইচি?-আমি আলতা নিইচি, লক্ষ্মীছাড়া দুষ্ট বাঁদর! আর তুমি যে লক্ষ্মীর চুপড়ির থেকে কড়িগুলো খুলে লুকিয়ে রেখেচ, মাকে বলে দেবো না?

    চিৎকার, কান্না ও মারামারির শব্দ শুনিয়া সর্বজয়া ছুটিয়া আসিল।

    ততক্ষণে দুর্গা অপুর কান ধরিয়া তাহাকে মাটিতে প্রায় শোয়াইয়া ফেলিয়াছে।–অপুও প্রাণপণে দুর্গার চুলের গোছা মুঠি পাকাইয়া টানিয়া এরূপ ধরিয়া আছে, যে দুর্গার মাথা তুলিবার ক্ষমতা নাই।

    অপুর লাগিয়াছিল বেশি। সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল-দ্যাখো না মা, আমার আরশিখানা বাক্স থেকে বের করে নিজের বাক্সে রেখে দিয়েচে-দিচ্ছে না-এমন চড় মেরেচে। গালে–

    দুৰ্গা প্রতিবাদ করিয়া বলিল-না মা, দ্যাখো না আমার পুতুলের বাক্স গোছাচ্ছি, ও এসে সেগুলো সব–

    সর্বজয়া আসিয়া মেয়ের পিঠের উপর দুম দুম করিয়া সজোরে কয়েকটি কিল বসাইয়া দিয়া বলিল-ধাড়ি মেয়ে-কেন তুই ওর গায়ে হাত দিবি যখন তখন?-ওতে আর তোতে অনেক তফাৎ জনিস?—আরশি-আরশি তোমার কোন পিণ্ডিতে লাগবে শুনি? কথায় কথায় উনি যান ওকে তেড়ে মারতে। মরণ আর কি! পুতুলের বাক্স-রোসো–

    কথা শেষ না করিয়াই সে মেয়ের গুছানো পুতুলের বাক্স উঠাইয়া একটান মারিয়া বাহির উঠানে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল।

    -ধাড়ি মেয়ের কোনো কাজ নেই, কেবল খাওয়া আর পাড়ায় পাড়ায় টো টো করে বেড়ানো-আর কেবল পুতুলের বাক্স আর পুতুলের বাক্স! ও সব টেনে এক্ষুনি বাঁশবাগানে ফেলে দিয়ে আসচি। দিচ্চি তোমার খেলা ঘুচিয়ে একেবারে–

    দুৰ্গার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। পুতুলের বাক্স তাহার প্রাণ, দিনের মধ্যে দশবার সে পুতুলের বাক্স গোছায়া-পুতুল, রাংতা, ছোপানো কাপড়, আলতা, কত কষ্টের সংগ্ৰহ করা নাটফল, টিনমোড়া আরশিখানা, পাখির বাসা-সব অন্ধকার উঠানের মধ্যে কোথায় কি ছড়াইয়া পড়িল। মা যে তাহার পুতুলের বাক্স এরূপ নির্মমভাবে ফেলিয়া দিতে পারে, একথা কখনও সে ভাবিতে পারিত না! কত কষ্টে কত জায়গা হইতে জোগাড় করা কত জিনিস উহার মধ্যে!

    কোনো কথা বলিতে সাহস না করিয়া সে কেমন অবাক হইয়া রহিল।

    অপুর কাছেও বোধ হয় শাস্তিটা কিন্তু বেশি কঠোর বলিয়াই ঠেকিল। সে আর কোনো কথা না বলিয়া চুপচাপ গিয়া শুইয়া পড়িল।

    রাত্রি অনেক হইয়াছে, মেজেতে কেরোসিন তেলের গন্ধ বাহির হইতেছে, ঘরের মধ্যে বাঁশবাগানের মশা বিন বিনা করিতেছে। খানিকক্ষণ বসিয়া বসিয়া দুর্গা গিয়া চুপ করিয়া শুইয়া পড়িল।

    ভাঙা জানোলা দিয়া ফাগুন জ্যোৎস্নার আলো বিছানায় পড়িয়াছে, পোড়ো ভিটার দিক হইতে ভুর ভুর করিয়া লেবু ফুলের গন্ধ আসিতেছে।

    একবার তাহার মনে হইল উঠিয়া গিয়া পুতুলের বাক্সট ও ছড়ানো জিনিসগুলা তুলিয়া আনে-কাল সকালে কি আর পাওয়া যাইবে? কত কষ্টের জিনিসগুলা! কিন্তু সাহস পাইল না। আনিতে গেলে মা যদি আবার মারে?

    অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। হঠাৎ সে গায়ের উপর কাহার হাত অনুভব করিল। অপু ভয়ে ভায়ে ডাকিল-দিদি? দুৰ্গা কোনো জবাব দিবার পূর্বেই অপু বালিশে মুখ গুজিয়া হাউ হাউ কবিয়া কঁদিয়া উঠিল-আমি আর করবো না-আমার ওপর রাগ করিসনে দিদি-তোর পায়ে পড়ি। কান্নাব আবেগে তাহার গলা আটকাইয়া যাইতে লাগিল।

    দুৰ্গা প্রথমটা বিস্মিত হইল-পরে সে উঠিয়া বসিয়া ভাইয়ের কান্না থামাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল-কাঁদিসনে, চুপ চুপ, মা শুনতে পেলে আবার আমায় বকবে, চুপ, কঁদতে নেই-আচ্ছা! আমি রাগ করবো না, কেঁদে না ছিঃ-চুপ–

    তাহার ভয় হইতেছিল অপুর কান্না শুনিলে মা আবাব হয়তো তাহাকেই মারিাবে।

    অনেক করিয়া সে ভাইয়ের কান্না থামাইল। পরে শুইয়া শুইয়া তাহাকে নানান গল্প, বিশেষত রানুর দিদির বিয়ের গল্প বলিতে লাগিল। একথা-ওকথাব পর অপু দিদিব গায়ে হাত দিয়া চুপি চুপি বলিল-একটা কথা বলবো দিদি?–তোর সঙ্গে মাস্টার মশায়ের বিয়ে হবে। —

    দুৰ্গার লজ্জা হইল, সঙ্গে সঙ্গে তাহার অত্যন্ত কৌতূহলও হইল; কিন্তু ছোট ভাই-এর কাছে এ সম্বন্ধে কোনো কথাবার্তা বলিতে তাহার সংকোচ হওয়াতে সে চুপ করিয়া রহিল।

    অপু আবার বলিল—খুড়িমা বলছিল রানুর মায়ের কাছে আজ বিকালে। মাস্টার মশায়ের নাকি অমত নেই–

    কৌতুহলের আবেগে চুপ করিয়া থাকা অসম্ভব হইয়া উঠিল। সে তাচ্ছিল্যের সুরে বলিল— হ্যাঁ বলছিল-যাঃ-তোর সব যেমন কথা–

    অপু প্রায় বিছানায় উঠিয়া বসিল,—সত্যি বলচি দিদি, তোর গা ছুঁয়ে বলচি। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে, আমাকে দেখেই তো কথা উঠল। বাবাকে দিয়ে পত্তর লেখাবে সেই মাস্টার মশায়ের বাবা যেখানে থাকেন সেখানে–

    –মা জানে?

    —আমি এসে মাকে জিজ্ঞেস করবো ভাবলাম-ভুলে গিইচ। জিজ্ঞেস করবো দিদি মা বোধ হয় শোনে নি; কাল খুড়িমা মাকে ডেকে নিয়ে বলবে বলছিল–

    পরে সে বলিল-তুই কত রেলগাড়ি চড়বি দেখিস, মাস্টার মশাইরা থাকেন। এখান থেকে অনেক দূরে-রেলে যেতে হয়–

    দুৰ্গা চুপ করিয়া রহিল।

    সে রেলগাড়ির ছবি দেখিয়াছে।–অপুর একখানা বইয়ের মধ্যে আছে। খুব লম্বা, অনেকগুলো চাকা, সামনের দিকে কল, সেখানে আগুন দেওয়া আছে, ধোঁয়া ওড়ে। রেলগাড়িখানা আগাগোড়া লোহার, চাকাও তাই-গরুর গাড়ির মতো কাঠের চাকা নয়। রেল লাইনের ধারে কোনো খড়ের বাড়ি নাই, থাকিতে পারে না, পুড়িয়া যায়। রেলগাড়ি যখন চলে তখন তাহার নল হইতে আগুন বাহির হয়। কিনা! সে ভাই-এর গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল-তোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। তাহার পর দুজনেই চুপ করিয়া ঘুমাইবার জোগাড় করিল। ঘুমাইতে গিয়া একটা কথা বার বার দুর্গার মনে হইতেছিল–ঠাকুর সুদৰ্শন তাহার কথা শুনিয়াছেন! আজই তো সুদর্শনের কাছে সে-ঠাকুরের বড় দয়া-মা তো ঠিক কথা বলে!

    অপু বলিল-লীলাদির জন্যে কেমন চমৎকার শাড়ি কেনা হযোচে, আজ লীলাদির কাকা বিয়ের জন্যে কিনে এনেচে রানাঘাট থেকে, সেজ জেঠিমা বললে-বালুচরের শাড়ি–

    দুৰ্গা হাসিমুখে বলিল–একটা ছড়া জানিস?…পিসি বলতো,

    বালুচরের বালুর চরে একটা কথা কই–
    মোষের পেটে ময়ুরছানা দেখে এলাম সই।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.