Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প391 Mins Read0

    ২৩. যাত্রা আরম্ভ হয়

    যাত্রা আরম্ভ হয়। জগৎ নাই, কেহ নাই—শুধু অপু আছে, আর নীলমণি হাজরার যাত্রা দল আছে সামনে। সন্ধ্যার আগে বেহালায় ইমন আলাপ করে, ভালো বেহালদার। পাড়াগাঁয়ের ছেলে কখনও সে ভালো জিনিস শোনে নাই।–উদাস-করুণ সুরে হঠাৎ মন কেমন করিয়া উঠে, মনে হয়। বাবা এখনও বসিযা বাড়িতে সেই কী লিখিতেছে—দিদি আসিতে চাহিয়াও আসিতে পারে নাই। প্রথম যখন জরির সাজ-পোশাক পবিয়া টাঙানো ঝাড় ও কড়ির ড়ুমের আলো-সজ্জিত আসরে বাজার মন্ত্রীর দল আসিতে আরম্ভ করে, অপু মনে ভাবে এমন সব জিনিস তাহার বাবা দেখিল না! সবাই তো আসরে আসিয়াছে গ্রামের, তাহদের পাড়ার কোনও লোক তো বাকি নাই! বাবা কেন এখনও…? পালা দ্রুত অগ্রসর হইতে থাকে। সেবার সে বালক-কীর্তনের দলের যাত্রা শুনিয়াছিলসে কি, আর এ কি! কি সব সাজ! কি সব চেহারা!…

    হঠাৎ পিছন হইতে কে বলে-খোকা বেশ দেখতে পোচ্ছ তো?…তাহার বাবা কখন আসিয়া আসরে বসিয়াছে অপু জানিতে পারে নাই। বাবার দিকে ফিরিয়া বলে-বাবা, দিদি এসেচে?.চিকের মধ্যে বুঝি?

    মন্ত্রীব গুপ্ত ষড়যন্ত্রে যখন রাজা রাজ্যচ্যুত হইয়া স্ত্রী পুত্ৰ লইয়া বনে চলিতেছেন, তখন কঁদুনে সুরে বেহালার সংগত হয়। তারপব রাজা করুণ রস বন্ধুক্ষণ জমাইয়া রাখিবার জন্য স্ত্রীপুত্রের হাত ধরিয়া এক এক পা করিয়া থামেন, আর এক এক পা অগ্রসর হইতে থাকেন, সত্যিকার জগতে কোন বনবাস-গমনোদ্যত রাজা নিতান্ত অপ্রকৃতিস্থ না হইলে একদল লোকের সম্মুখে সেরূপ করে না। বিশ্বস্ত রাজ-সেনাপতি রাগে এমন কাপেন যে মৃগী-রোগগ্ৰস্ত রোগীর পক্ষেও। তাহা হিংসার বিষয় হইবার কথা। অপু আপলক চোখে চাহিয়া বসিয়া থাকে, মুগ্ধ বিস্মিত হইয়া যায়; এমন তো সে কখনও দেখে নাই।

    তারপর কোথায় চলিয়া গিয়াছেন রাজা, কোথায় গিয়াছেন রানী!..ঘন নিবিড় বনে শুধু রাজপুত্ৰ অজয় ও রাজকুমারী ইন্দুলেখা ভাইবোন ঘুরিয়া বেড়ায়! কেউ নাই যে তাহদের মুখের দিকে চায়, কেউ নাই যে নির্জন বনে তাহদের পথ দেখাইয়া লইয়া চলে। ছোট ভাইয়ের জন্য ফল আনিতে একটু দূরে চলিয়া যাইয়া ইন্দুলেখা আর ফেরে না। অজয় বনের মধ্যে বোনকে খুঁজিয়া বেড়ায়তাহার পর নদীর ধরে হঠাৎ খুঁজিয়া পায় ইন্দুলেখার মৃতদেহ-ক্ষুধার তাড়নায় বিষফল খাইয়া সে মরিয়া গিয়াছে। অজয়ের করুণ গান-কোথা ছেড়ে গেলি। এ বনকাস্তারে প্রাণপ্রিয় প্রাণসখী রেশুনিয়া অপু এতক্ষণ মুগ্ধ চোখে চাহিয়া ছিল-আর থাকিতে পারে না, ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদে।

    কলিঙ্গরাজের সহিত বিচিত্ৰকেতুর যুদ্ধে তলোয়ার খেলা কী!..যায়, বুঝি ঝাড়গুলা গুড়া হয়, নয় তো কোন হতভাগ্য দর্শকের চোখ দুটি বা যায়। রব ওঠে-ঝাড় সামলে-ঝাড় সামলে!..কিন্তু অদ্ভুত যুদ্ধকৌশল-সব বাঁচাইয়া চলে-ধন্য বিচিত্ৰকেতু!

    মধ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া জুড়ির দীর্ঘ গান ও বেহালায় কসরত-এর সময় অপুকে তাহার বাবা ডাকিয়া বলে-ঘুম পাচ্ছে… বাড়ি যাবে খোকা?…সুম। সর্বনাশ!..না, সে বাড়ি যাইবে না। বাহিরে ডাকিয়া তাহার বাবা বলে-এই দুটো পয়সা রাখো বাবা, কিছু কিনে খেযো, আমি বাড়ি গেলাম। অপুর ইচ্ছা হয় সে এক পয়সার পান। কিনিয়া খাইবে, পানের দোকানের কাছে অত্যন্ত কিসের ভিড় দেখিয়া অগ্রসর হইয়া দ্যাখে, অবাক কাণ্ড! সেনাপতি বিচিত্ৰকেতু হাতিয়ারবন্দ অবস্থায বার্ডসাই কিনিয়া ধরাইতেছেন—তঁহাকে ঘিরিয়া, রথযাত্রার ভিড়। আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য!… রাজকুমার অজয় কোথা হইতে আসিয়া বিচিত্ৰকেতুর কনুই-এ। হাত দিয়া বলিল-এক পযসার পান খাওয়াও না কিশোরীদা? রাজপুত্রের প্রতি সেনাপতির বিশ্বস্ততার নিদর্শন দেখা গেল না-হাত ঝাড়া দিয়া বলিল-যাঃ অত পয়সা নেই-ওবেলা সাবানখানা যে দুজনে মাখলে, আমাকে কি বলেছিলে? রাজপুত্র পুনবায় বলিল-খাওয়াও না কিশোরীদা? আমি বুঝি কখনও কিছু দিইনি তোমাকে? বিচিত্ৰকেতু হাত ছাড়াইয়া চলিয়া গেল।

    অপুর সমবয়সি হইবে। টুকটুকে, বেশ দেখিতে, গানেব। গলা বড় সুন্দব। অপু মুগ্ধ হইযা তাহার দিকে চাহিয়া থাকে-বড় ইচ্ছা হয় আলাপ কবিতে। হঠাৎ সে কিসের টানে সাহসী হইয়া আগাইয়া যায়-একটু লজ্জার সঙ্গে বলে-পান খাবে?..অজয় একটু অবাক হয়, বলে-তুমি খাওয়াবে? নিয়ে এসো না। দুজনে ভাব হইয়া যায়। ভোব বলিলে ভুল হয়। অপু মুগ্ধ, অভিভূত হইয়া যায়! ইহাকেই সে এতদিন মনে মনে চাহিয়া আসিয়াছে-এই রাজপুত্ৰ অজযকে। তাহার মাযের শত রূপকথার কাহিনীর মধ্য দিয়া, শৈশবের শত স্বপ্নময়ী মুগ্ধ কল্পনার ঘোরে তাহার প্রাণ ইহাকেই চাহিয়াছে-এই চোখ, এই মুখ, এই গলার স্বর! ঠিক সে যাহা চায় তাহাই। অজয় জিজ্ঞাসা করে– তোমাদের বাড়ি কোথায় ভাই? …আমাকে একজনের বাড়ি খেতে দিয়েছে, বড্ড বেলায় খেতে দেয়। তোমাদের বাড়িতে খায় কে?…

    খুশিতে অপুর সারা গা কেমন করে, সে বলে–“ভাই, আমাদের বাড়িতে একজন খেতে যায়, সে আজ দেখলাম ঢোলক বাজাচে-তুমি কাল থেকে যেয়ো, আমি এসে ডেকে নিয়ে যাবো।– ঢোলকওয়ালা না হয় তুমি যে বাড়িতে আগে খেতে, সেখানে খাবে–

    খানিকক্ষণ দুজনে এদিক-ওদিক বেড়াইবার পর অজয় বলে-আমি যাই ভাই, শেষ সিনে আমার গান আছে-আমার পার্ট কেমন লাগচে তোমার?

    শেষ বাত্রে যাত্রা ভাঙিলে অপু বাড়ি আসে। পথে আসিতে আসিতে যে যেখানে কথা বলে, তাহার মনে হয় যাত্রাব এক্‌টো হইতেছে। বাড়িতে তাহার দিদি বলে-ও অপু, কেমন যাত্রা শূনলি?.অপুর মনে হয়, গভীর জনশূন্য বনের মধ্যে রাজকুমারী ইন্দুলেখা কি বলিয়া উঠিল। কিসের যে ঘোর তাহাকে পাইয়া বসিয়াছে। মহা খুশির সহিত সে বলে-কাল থেকে, অজয় যে মেজেছিল মা, সে আমাদের বাড়ি খেতে আসবে।–

    তাহার মা বলে-দুজনে খাবে?-দুজনকে কোত্থেকে—

    অপু বলে-তা না, একজন তো চলে যাবে, শুধু অজয় খাবে।

    দুৰ্গা বল্পে-কেমন যাত্রা রে অপু?…এমন কক্ষনো দেখিনি-কেমন গান কল্পে যখন সেই রাজকন্যা মরে গেল?..অপুর তো রাত্রে ঘুমের ঘোরে চারিধারে যেন বেহালা সংগীত হয়। ভোর হইলে একটু বেলায় তাহার ঘুম ভাঙে-শেষ রাত্রে ঘুমাইয়াছে, তৃপ্তির সঙ্গে ঘুম হয় নাই, সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোয়, চোখে যেন সুচ বিঁধে। চোখে জল দিলে জালা করে। কিন্তু তাহার কানে একটা বেহালা-ঢোল-মন্দিরার ঐকতান বাজনা তখনও যেন বাজিতেছে-তখনও যেন সে যাত্রার আসরেই বসিয়া আছে।

    ঘাটের পথে যাইতে পাড়ার মেয়েরা কথা বলিতে বলিতে যাইতেছে, অপুর মনে হইল কেহ। ধীরাবতী, কেহ কলিঙ্গদেশের মহারানী, কেহ রাজপুত্র অজয়ের মা বসুমতী। দিদির প্রতি কথায়, হাত পা নাড়ার ভঙ্গিতে, রাজকন্যা ইন্দুলেখা যেন মাখানো! কাল যে ইন্দুলেখা সাজিয়াছিল তাহাকে মানাইয়াছিল। মন্দ নয় বটে, কিন্তু তাহার মনে মনে রাজকন্যা ইন্দুলেখার যে প্রতিমা গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা তাহার দিদিকে লইয়া, ওই রকম গায়ের রং, অমনি বড়বড় চোখ, আমনি সুন্দর মুখ, অমনি সুন্দর চুল!

    ইন্দুলেখা তাহার সকল করুণা, স্নেহ মাধুরী লইয়া কোন সেকালের দেশের অতীত জীবনের পরে আবার তাহার দিদি হইয়া যেন ফিরিয়া আসিয়াছে—কাল তাই ইন্দুলেখার কথার ভঙ্গিতে, প্রতি পদক্ষেপে দিদিই যেন ফুটিয়া ফুটিয়া বাহির হইতেছিল। যখন গভীর বনে সে শতস্নেহে ছোট ভাইকে জড়াইয়া রাখিয়াছিল, তাকে খাওয়াইবার জন্য ফল আহরণ করিতে গিয়া এক নির্জন বনের মধ্যে হারাইয়া গেল-সেই একদিনের মাকাল ফলের ঘটনাটাই অপুর ক্ৰমাগত মনে হইতেছিল।

    দুপুর বেলা খাইবার জন্য অপু গিয়া অজয়কে ডাকিয়া আনিল। তাহার মা দুজনকে এক জায়গায় খাইতে দিয়া অজয়ের পরিচয় লইতে বসিল। সে ব্ৰাহ্মাণের ছেলে, তাহার কেহ নাই, এক মাসী তাহাকে মানুষ করিয়াছিল, সেও মরিয়া গিয়াছে। আজ বছরখানেক যাত্রার দলে কাজ করিতেছে। সর্বজয়ার ছেলেটির উপর খুব স্নেহ হইল-বার বার জিজ্ঞাসা করিয়া তাহাকে খাওয়াইল। খাওয়াইবার উপকরণ বেশি কিছু নাই, তবু ছেলেটি খুব খুশির সঙ্গে খাইল। তাহার পর দুৰ্গা মাকে চুপি চুপি বলিল—ম, ওকে সেই কালকের গানটা গাইতে বল না—সেই ‘কোথা ছেড়ে গেলি এ বন-কান্তারে প্রাণপ্রিয় প্ৰাণসখী রে’–

    অজয় গলা ছাড়িয়া গানটি গাহিল-অপু মুগ্ধ হইয়া গেলা-সর্বজয়ার চোখের পাতা ভিজিয়া আসিল। আহা, এমন ছেলের মা নাই! তাহার পর সে আরও গান গাহিল। সৰ্ব্বজয়া বলিলবিকেলে মুড়ি ভাজবো, তখন এসে অবিশ্যি করে মুড়ি খেয়ে যেয়ো-লজ্জা কোরো না যেন-যখন খুশি আসবে, আপনার বাড়ির মতো, বুঝলে?

    অপু তাহাকে সঙ্গে করিয়া নদীর ধারের দিকে বেড়াইতে গেল। সেখানে অজয় বলিল, ভাই, তোমার তো গলা মিষ্টি-একটা গান গাও না?…অপুর খুব ইচ্ছা হইল ইহার কাছে গান গাহিয়া সে বাহাদুরি লইবে। কিন্তু বড় ভয় করে-এ একজন যাত্ৰাদলের ছেলে-এর কাছ তার গান গাওয়া? নদীর ধারে বড় শিমুলগাছটার তলায় চলা-চলতির পথ হইতে কিছুদূরে বাঁশঝোপের আড়ালে দুজনে বসে। অপু অনেক কষ্টে লজ্জা কাটাইয়া একটা গান করে-শ্ৰীচরণে ভার একবার গা তোল হে অনন্ত-দাশু রায়ের পাঁচালীর গান বাবার মুখে শুনিয়া সে লিখিয়া লইয়াছে। অজয় অবাক হইয়া যায়, বলে-তোমার এমন গলা ভাই? তা তুমি,গান গাও না কেন?…আর একটা গাও। অপু উৎসাহিত হইয়া আর একটা ধরে-খেয়ার আশে বসে রে মন ড়ুবল বেলা খেয়ার ধারে। তাহার দিদি কোথা হইতে শিখিয়া আসিয়া গাহিত, সুরাটা বড় ভালো লাগায় অপু তাহার কোছ হইতে শিখিয়াছিল-বাড়িতে কেহ না থাকিলে মাঝে মাঝে গানটা তাহারা দুজনে গাহিয়া থাকে।

    গান শেষ হইলে অজয় প্রশংসায় উচ্ছসিত হইয়া উঠিল। বলিল-এমন গলা থাকলে যে কোনো দলে ঢুকলে পোনেরো টাকা করে মইনে সেধে দেবে বলচি তোমায়-এর ওপর একটু যদি শেখো!

    বাড়িতে কেহ না থাকিলে দিদির সামনে গাহিয়া অপু কতদিন দিদিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেহঁহা দিদি, আমার গলা আছে? গান হবে?…দিদি তাহকে বরাবর আশ্বাস দিয়া আসিয়াছে। কিন্তু দিদির আশ্বাস যতই আশাপ্ৰদ হৌক, আজ একজন সংগীতদক্ষ খাস যাত্রার দলের নামকরা মেডেলওয়ালা গায়কের মুখে এ প্রশংসার কথা শুনিয়া আনন্দে অপু কি বলিয়া উত্তর করিবে ঠাওর করিতে পারিল না।

    বলিল-তোমার ওই গানটা আমায় শেখাও না?…

    তাহার পর দুইজনে গলা মিশাইয়া সে গানটা গাহিল।

    অনেকক্ষণ হইয়া গেল। নদী বাহিয়া ছপ ছপা করিয়া নৌকা চলিতেছে, নদীর পাড়ের নিচে জলের ধারে একজন কি খুঁজিয়া বেড়াইতেছে, অজয় বলিল—কি খুঁজচে ভাই?

    অপু বলিল-ও ব্যাঙচি খুঁজচে, ছিপে মাছ ধরবে।–তাহার পর বলিল-আচ্ছা ভাই তুমি আমাদের এখানে থাকো না কেন?…যেয়ো না কোথাও, থাকবে?…

    এমন চোখ, এমন মিষ্টি গলার সুর! তাহার উপর অপুর কাছে সে সেই রাজপুত্র অজয়! কোন বনে ফিরিতে ফিরিতে অসহায় ছন্নছাড়া রূপবান রাজার ছেলের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হইয়া ভাব হইয়া গিয়াছে-চিারজন্মের বন্ধু! আর তাহাকে কি করিয়া ছাড়া যায়?

    অজয়ও অনেক মনের কথা বলিয়া ফেলিল। এমন সাখী তাহার আর জুটে নাই। সে প্রায় চল্লিশ টাকা জমাইয়াছে। আর একটু বড় হইলে সে এ-দল ছাড়িয়া দিবে। অধিকারী বড় মারে। সে আশুতোষ পালের দলে যাইবে—সেখানে বড় সুখ, বোজ রাত্রে লুচি। না খাইলে তিন আনা পয়সা খোরাকি দেয়। এ দল ছাড়িলে সে আবার অপুদের বাড়ি আসিবে ও সে সময় কিছুদিন থাকিবে। বৈকালের কিছু আগে অজয় বলিল-চল ভাই, আজ আবার এখুনি আসব হবে, সকাল সকাল ফিরি। যদি “পরশুরামের দর্প-সংহার’ হয়, তবে আমি নিয়তি সাজবো, দেখো কেমন একটা গান আছে–

    আরও তিন দিন যাত্রা হইল। গ্রামসুদ্ধ লোকের মুখে যাত্রা ছাড়া আর কথা নাই। পথে ঘাটে মাঠে গাঁয়ের মাঝি নৌকা বাহিতে বাহিতে, রাখাল গরু চরাইতে চরাইতে যাত্রার পালার নতুন শেখা গান গায়। গ্রামের মেয়েরা দলের ছেলেদের বাড়ি ডাকাইয়া যাহার যে গান ভালো লাগিয়াছে তাহার মুখে সে গান ফরমাইশ করিয়া শুনিতে লাগিলেন। অপু আরও তিন-চারটা নতুন গান শিখিয়া ফেলিল। একদিন সে যাত্রার দলের বাসায় অজয়ের সঙ্গে গিয়াছে, সেখানে তাহাকে দলের সকলে মিলিয়া ধরিল, তাহাকে একটা গান গাহিতে হইবে। সেখানে সকলে অজয়ের মুখে শুনিয়াছে সে খুব ভালো গান গাহিতে পারে। অপু বহু সাধ্যসাধনার পর নিজের বিদ্যা ভালো কবিয়া জাহির কবিবার খাতিরে একটা গাহিয়া ফেলিল। সকলে তাহাকে ধরিয়া অধিকারীর নিকটে লইয়া গেল। সেখানেও তাহাকে একটা গাহিতে হইল। অধিকারী কালো রং-এর ভূড়িওয়ালা লোক, আসরে জুড়ি সাজিয়া গান করে। গান শুনিয়া বলিল-এসো না খোকা, দলে আসবে? অপুর বুকখানা আনন্দে ও গর্বে দশহান্ত হইল। আরও সকলে মিলিয়া তাহাকে ধরে- এসো, চলো তোমাকে আমাদের দলে নিয়ে যাই। অপুর তো ইচ্ছা সে এখনই যায়। যাত্রার দলে কাজ করা মনুষ্য জীবনের চরম উদ্দেশ্য, সেকথা এতদিন সে কেন জানিত না, ইহাই তো আশ্চর্যের বিষয়। সে গোপনে অজয়কে বলিল-আচ্ছা! ভাই, এখন যদি আমি দলে যাই, আমাকে কি সাজতে দেবে?

    অজয় বলিল-এখন এই সখী-ঠখী, কি বালকের পার্ট এই রকম, তারপর ভালো করে শিখলে—

    অপু সখী সাজিতে চায় না-জরির মুকুট মাথায় সে সেনাপতি সাজিয়া তলোয়ার ঝুলাইবে, যুদ্ধ করবে। বড় হইলে সে যাত্রার দলে যাইবেই। উহাই তাহার জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য। অজয় তাহাকে চুপি চুপি কষ্টি পাথরের রং একটা ছোকরাকে দেখাইয়া কছিল, এই যে দেখছে, এর নাম বিষ্টু তেলি। আমার সঙ্গে মোটে বনে না, আমার নিজের পয়সায় দেশলাই কিনে বালিশের তলায় রেখে শুই, দেশলাই উঠিয়ে নেয়। চুবুট খেতে, আর দেয় না। আমি বলি আমার রাত্রে ভয় করে, দেশলাইটা দাও। অন্ধকারে মন ছমছম করে, তাই সেদিন চেয়েছিলাম বলে এমনি থাবড়া একটা মেরেচে! নাচে ভালো বলে অধিকারী বড় খাতির করে, কিছু বলবারও জো নেই—

    দিন পাঁচেক পরে যাত্রা দলের গাওনা শেষ হইয়া গেলে তাহারা রওনা হইল। অজয় বাড়ির ছেলের মতো যখন তখন আসিত যাইত, এই কয়দিনে সে যেন অপুরই আর এক ভাই হইয়া পড়িয়াছিল। অপুরই বয়সি ছোট ছেলে, সংসারে কেহ নাই শুনিয়া সর্বজয়া তাহাকে এ কয়দিন অপুর মতো যত্ন করিয়াছে। দুর্গাঁও তাহাকে আপন ভাইয়ের চোখে দেখিয়াছে—তাহার কাছে গান শিখিয়া লইয়াছে, কত গল্প শুনাইয়াছে, তাহার পিসিমার কথা বলিয়াছে, তিনজনে মিলিয়া উঠানে বড় ঘর আঁকিয়া গঙ্গা-যমুনা খেলিয়াছে, খাইবার সময়ে জোর করিয়া বেশি খাইতে বাধ্য করিয়াছে। যাত্ৰাদলে থাকে, কে কোথায় দ্যাখে, কোথায় শোয়, কি খায়, আহা বলিবার কেহ নাই; গৃহ-সংসারের যে স্নেহস্পর্শ বোধ হয় জন্মাবধিই তাহার ভাগ্যে ঘটে নাই, অপ্রত্যাশিত ভাবে আজ তাহার স্বাদ লাভ করিয়া লোভীর মতো সে কিছুতেই ছাড়িয়া যাইতে চাহিতেছিল না।

    যাইবার সময় সে হঠাৎ পুঁটুলি খুলিয়া কষ্টে সঞ্চিত পাঁচটি টাকা বাহির করিয়া সর্বজয়ার হাতে দিতে গেল। একটু লজ্জার সুরে বলিল-এই পাঁচটা টাকা দিয়ে দিদির বিয়ের সময় একখানা ভালো কাপড়–

    সর্বজয়া বলিল—না বাবা, না।–তুমি মুখে বললে এই খুব হল, টাকা দিতে হবে না, তোমার এখন টাকার কত দরকার-বিয়ে-থাওয়া করে সংসারী হতে হবে–

    তবু সে কিছুতেই ছাড়ে না। অনেক বুঝাইয়া। তবে তাহাকে নিরস্ত করিতে হইল।

    তাহার পর সকলে উহাদের বাড়ির দরজার সামনে খানিকটা পথ পর্যন্ত তাহাকে আগাইয়া দিতে আসিল। যাইবার সময় সে বার বার বলিয়া গেল, দিদির বিয়ের সময় অবশ্য করিয়া যেন তাহাকে পত্র দেওয়া হয়।

    গাবতলার ছায়ায় ছায়ায় তাহার সুকুমার বালকমূর্তি ভািটশ্যাওড়া ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেলে হঠাৎ সর্বজয়ার মনে হইল, বড় ছেলেমানুষ আহা, এই বয়সে বেরিয়েছে নিজের রোজগার নিজে কর্তে। অপুর আমার যদি ওইরকম হাত-মাগো!…

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.