Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প391 Mins Read0

    ২৭. দেখিতে দেখিতে দিন কাটিয়া গেল

    দেখিতে দেখিতে দিন কাটিয়া গেল। শীতকালও শেষ হইতে চলিয়াছে।

    দুৰ্গার মৃত্যুর পর হইতে সর্বজয়া অনবরত স্বামীকে এ গ্রাম হইতে উঠিয়া যাইবার জন্য তাগিদ দিয়া আসিতেছিল, হরিহরও নানাস্থানে চেষ্টার কোন ত্রুটি করে নাই। কিন্তু কোনো স্থানেই কোনো সুবিধা হয় নাই। সে আশা সর্বজয়া আজকাল একরূপ ছাড়িয়াই দিয়াছে। মধ্যে গত শীতকালে হরিহরের জ্ঞাতিভ্রাতা নীলমণি রায়ের বিধবা স্ত্রী এখানে আসিয়াছেন ও নিজেদের ভিটা জঙ্গলাবৃত হইয়া যাওয়াতে ভুবন মুখুজ্যের বাটীতে উঠিয়াছেন। হরিহর নিজের বাটীতে বৌদিদিকে আনাইয়া রাখিবার যথেষ্ট আগ্রহ দেখাইয়া ছিল কিন্তু নীলমণি রায়ের স্ত্রী রাজি হন নাই। এখানে বর্তমানে তাঁহার সঙ্গে আসিয়াছে মেয়ে অতসী ও ছোট ছেলে সুনীল। বড় ছেলে সুরেশ কলিকাতায় স্কুলে পড়ে, গ্ৰীষ্মের বন্ধের পূর্বে এখানে আসিতে পরিবে না। অতসীর বয়স বছর চৌদ, সুনীলের বয়স আট বৎসর। সুনীল দেখিতে তত ভালো নয়; কিন্তু অতসী বেশ সুশ্ৰী, তবে খুব সুন্দরী বলা চলে না। তাহা হইলেও বরাবর। ইহারা লাহোরে কাটাইয়াছে, নীলমণি রায় সেখানে কমিসারিয়েটে চাকরি করিতেন, সেখানে ইহাদের জন্ম, সেখানেই লালিত পালিত; কাজেই পশ্চিম-প্ৰদেশ-সুলভ নিটোল স্বাস্থ্য ইহাদের প্রতি অঙ্গে।

    ইহারা এখানে প্রথম আসিলে সর্বজয়া বড়মানুষ জায়ের সঙ্গে মেশামেশি করিবার চেষ্টা পাইয়াছিল। সুনীলের মা নগদে ও কোম্পানির কাগজে দশ হাজার টাকার মালিক এ কথা জানিয়া জায়ের প্রতি সম্রামে তাহার হৃদয় পূর্ণ হইয়া যায়, গায়ে পড়িয়া আলাপ জমাইবার চেষ্টা কম করে নাই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সর্বজয়া নির্বোিধ হইলেও বুঝিতে পারিল যে, সুনীলের মা তাহাকে ততটা। আমল দিতে প্ৰস্তুত নহেন। তাহার স্বামী চিরকাল বড় চাকরি করিয়া আসিয়াছেন, তিনি ও তাহার ছেলেমেয়ে অন্যভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। শুরু হইতেই তিনি দরিদ্র জ্ঞাতি পরিবার হরিহরের সঙ্গে এমন একটা ব্যবধান রাখিয়া চলিতে লাগিলেন যে সর্বজয়া আপনিই হটিয়া আসিতে বাধ্য হইল। কথায়, ব্যবহারে, কাজে, খুঁটিনাটি সব ব্যাপারেই তিনি জানাইয়া দিতে লাগিলেন যে, সর্বজয়া কোনরকমেই তাহদের সঙ্গে সমানে সমানে মিশিবার যোগ্য নহে। তঁহাদের কথাবার্তায়, পোশাকপরিচ্ছদে, চালচলনে এই ভাবটা অনবরত প্ৰকাশ পায় যে, তাহারা অবস্থাপন্ন ঘর। ছেলেমেয়ে সর্বদা ফিটফটী সাজিয়া আছে, কাপড় এতটুকু ময়লা হইতে পায় না, চুল সর্বদা আঁচড়ানো, অতসীর গলায় হার, হাতে সোনার চুড়ি, কানে সোনার দুল, একপ্রস্থ চা ও খাবার না খাইয়া সকালে কেহ কোথাও বাহির হয় না, সঙ্গে পশ্চিমা চাকর আছে, সে-ই সব গৃহকর্ম করে-মোটের উপর সব বিষয়েই সৰ্ব্বজয়াদের দরিদ্র সংসারের চাল-চলন হইতে উহাদের ব্যাপারের বহু পার্থক্য।

    সুনীলের মা নিজের ছেলেকে গ্রামের কোনো ছেলের সঙ্গেই বড় একটা মিশিতে দেন না, অপুর সঙ্গেও নয়–পাছে পাড়াগাঁয়ের এই সব অশিক্ষিত অসভ্য ছেলেপিলেদের দলে মিশিয়া তাহার ছেলেমেয়ে খারাপ হইয়া যায়। তিনি এ গ্রামে বাস করিবার জন্য আসেন নাই, জরিপের সময় নিজেদের বিষয়-সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করিতে আসাই তাহার উদ্দেশ্য। ভুবন মুখুজ্যেরা ইহাদের কিছু জমা রাখেন, সেই খাতিরে পশ্চিম কোঠায় দুখানা ঘর ইহাদের জন্য ছাড়িয়া দিয়াছেন, রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়াও ইহাদের পৃথক হয়। ভুবন মুখুজ্যেদের সঙ্গে ব্যবহারে সুনীলের মায়ের কোনো পার্থক্য দৃষ্ট হয় না; কারণ ভুবন মুখুজ্যের পয়সা আছে, কিন্তু সর্বজয়াকে তিনি একেবারে মানুষের মধ্যেই গণ্য করেন না।

    দোলের সময় নীলমণি রায়ের বড় ছেলে সুরেশ কলিকাতা হইতে আসিয়া প্রায় দিন দশেক বাড়ি রহিল। সুরেশ অপুরই বয়সি, ইংরাজি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। দেখিতে খুব ফরসা নয়, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। নিয়মিত ব্যায়াম করে বলিয়া শরীর বেশ বলিষ্ঠ, স্বাস্থ্যবান। অপুর অপেক্ষা এক বৎসর মাত্র বয়স বেশি হইলেও আকৃতি ও গঠনে পনেরো-ষোল বৎসরের ছেলের মতো দেখায়। সুরেশও এপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বড় একটা মেশে না। ওপাড়ায় গাঙ্গুলি-বাড়ির রামনাথ গাঙ্গুলির ছেলে তাহার সহপাঠী। গাঙ্গুলি-বাড়ি রামনবমী দোলের খুব উৎসব হয়, সেই উপলক্ষে সেও মামার বাড়ি বেড়াইতে আসিয়াছে। সুরেশ অধিকাংশ সময় সেখানেই কটায়, গায়ের অন্য কোনো ছেলে মিশিবার যোগ্য বলিয়া সেও বোধ হয় বিবেচনা করে না।

    যে পোড়ো ভিটাটা জঙ্গলাবৃত হইয়া বাড়ির পাশে পড়িয়া থাকিত সে জ্ঞান হইয়া অবধি দেখিতেছে, সেই ভিটার লোক ইহারা। সে হিসাবে ইহাদিগের প্রতি অপুর একটা বিচিত্র আকর্ষণ। তাহার সমবয়সি সুরেশ কলিকাতায় পড়ে-ছুটিতে বাড়ি আসিলে তাহার সহিত আলাপ করিবার জন্য অনেকদিন হইতে সে প্রতীক্ষায় ছিল। কিন্তু সুরেশ আসিয়া তাহার সহিত তেমন মিশিল না, তা ছাড়া সুরেশের চালচলন কথাবার্তার ধরন এমনি যে সে যেন প্রতিপদেই দেখাইতে চায়, গ্রামের ছেলেদের চেয়ে সে অনেক বেশি উঁচু। সমবয়সি হইলেও মুখচোরা অপু তাহাতে আরও ভয় পাইয়া কাছে ঘেষে না।

    অপু এখনও পর্যন্ত কোনো স্কুলে যায় নাই, সুরেশ তাহাকে লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিয়াছে, আমি বাড়িতে বাবার কাছে পড়ি। দোলের দিন গাঙ্গুলিদের পুকুরে বাঁধাঘাটে জলপাইতলায় বসিয়া সুরেশ গ্রামের ছেলেদিগকে দিগ্বিজয়ী নৈয়ায়িক পণ্ডিতের ভঙ্গিতে এ-প্রশ্ন ওপ্রশ্ন করিতেছিল। অপুকে বলিল-বলো তো ইন্ডিয়ার বাউন্ডারি কি? জিওগ্রাফি জানো?

    অপু বলিতে পারে নাই। সুরেশ আবার জিজ্ঞাসা করিল, অঙ্ক কি কষেচ? ডেসিমল ফ্র্যাকশন কষতে পারো?

    অপু অতশত জানে না। না জানুক, তাহার সেই টিনের বাক্সটাতে বুঝি কম বই আছে? একখানা নিত্যকর্মপদ্ধতি, একখানা পুরানো প্রাকৃতিক ভূগোল, একখানা শুভঙ্করী, পাতা-ছেড়া বীরাঙ্গনা কাব্য একখানা, মায়ের সেই মহাভারত-এই সব। সে ওই সব বই পড়িয়াছে।–অনেকবার পড়া হইয়া গেলেও আবার পড়ে। তাহার বাবা প্রায়ই এখান ওখান হইতে চাহিয়া চিন্তিয়া বই আনিয়া দেয়, ছেলে খুব লেখাপড়া শিখিবে, পণ্ডিত হইবে, তাহাকে মানুষ করিয়া তুলিতে হইবে, এ বিষয়ে বিকারের রোগীর মতো তাহার একটা অদম্য অপ্ৰশমনীয় পিপাসা। কিন্তু তাহার পয়সা নাই, দূরেব স্কুলের বোর্ডিং-এ রাখিয়া দিবার মতো সংগতির একান্ত অভাব, নিজেও খুব বেশি লেখাপড়া জানে না। তবুও যতক্ষণ সে বাড়ি থাকে নিজের কাছে বসাইয়া ছেলেকে এটা ওটা পড়ায়, নানা গল্প করে, ছেলেকে অঙ্ক শিখাইবার জন্য নিজে একখানা শুভঙ্করীর সাহায্যে বাল্যের অধীত বিস্মৃত বিদ্যা পুনরায় ঝালাইয়া তুলিয়া তবে ছেলেকে অঙ্ক কষায়। যাহাতেই মনে করে ছেলের জ্ঞান হইবে, সেইটাই হয় ছেলেকে পড়িতে দেয়, নতুবা পড়িয়া শোনায়। সে বহুদিন হইতে বঙ্গবাসীর গ্রাহক, অনেক দিনের পুরানো বঙ্গবাসী তাঁহাদের ঘরে জমা আছে, ছেলে বড় হইলে পড়িবে এজন্য হবিহব সেগুলিকে সযত্নে বান্ডিল বাঁধিয়া তুলিয়া রাখিয়া দিয়াছিল, এখন সেগুলি কাজে লাগিতেছে। মূল্য দিতে না পারায় নূতন কাগজ আর তাঁহাদের আসে না, কাগজওয়ালারা কাগজ দেওয়া বন্ধ করিয়া দিয়াছে। ছেলে যে এই ‘বঙ্গবাসী’ কাগজখানার জন্য কিরূপ পাগল, শনিবার দিনটা সকালবেলা খেলাধুলা ফেলিয়া কেমন করিয়া সে যে ভুবন মুখুজ্যোব চণ্ডীমণ্ডপে ডাকবাক্সটার কাছে পিওনের প্রত্যাশায় হ্যাঁ করিয়া বসিয়া থাকে-হরিহর তাহা খুব জানে বলিয়াই ছেলের এত আদরের জিনিসটা জোগাইতে না পারিয়া তাহার বুকের ভিতর বেদনায় টনটন করে।

    অপু তবুও পুরাতন ‘বঙ্গবাসী’ পড়িয়া অনেক গল্প শিখিয়াছে। পটুর কাছে বলে—লিউকা ও রাফেল মাটিনিক দ্বীপের অগ্ন্যুৎপাত, সোনাকরা জাদুকরের গল্প, আরও কত কথা। কিন্তু স্কুলের লেখাপড়া তাহার কিছুই হয় না। মোটে ভাগ পর্যন্ত অঙ্ক জানে, ইতিহাস নয়, ব্যাকরণ নয়, জ্যামিতি পরিমিতির নামও শোনে নাই, ইংরাজির দৌড় ফাস্ট বুকের ঘোড়ার পাতা।

    ছেলের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাহার মায়ের একটু অন্যরূপ ধারণা। সর্বজয়া পাড়াগায়ের মেয়ে। ছেলে স্কুলে পড়িয়া মানুষ হইবে। এ উচ্চ আশা তাহার নাই। তাহার পরিচিত মহলে কেউ কখনও স্কুলের মুখ দেখে নাই। তাহদের যে সব শিষ্য-বাড়ি আছে, ছেলে আর কিছুদিন পরে সে সব ঘরে যাতায়াত করিবে, সেগুলি বজায় রাখিবে, ইহাই তাহার বড় আশা। আরও একটা আশা সর্বজয়া রাখে। গ্রামের পুরোহিত দীনু ভট্টাচার্য বৃদ্ধ হইয়াছে। ছেলেরাও কেহ উপযুক্ত নয়। রানীর মা, গোকুলের বউ, গাঙ্গুলি-বাড়ির বড়বন্ধু সকলেই মত প্রকাশ করিয়াছেন যে তাহারা ইহার পর অপুকে দিয়া কাজুর্ম করাইবেন, দীনু ভট্টাচার্যের অবর্তমানে তাঁহার গাঁজাখোর পুত্র ভোম্বলের পরিবর্ত্তে নিষ্পাপ, সরল, সুশ্ৰী এই ছেলেটি গ্রামের মনসা-পূজায় লক্ষ্মী-পূজায় তাহাদের আয়োজনের সঙ্গী হইয়া থাকিবে, গ্রামের মেয়েরা এই চায়। অপুকে সকলেই ভালোবাসে। ঘটে পথে প্রতিবেশিনীদের মুখে এ ইচ্ছা প্ৰকাশ করিতে সর্বজয়া অনেকবার শুনিয়াছে এবং এইটাই বর্তমানে তাহার সব চেয়ে উচ্চ আশা। সে গরিব ঘরের মেয়ে, গরিব ঘরের বধূ, ইহা ছাড়া কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ধারণা নাই। এই যদি ঘটে তাহা হইলেই শেষ রাত্রের স্বপ্নকে সে হাতের মুঠায় পায়।

    একদিন এ কথা ভুবন মুখুজ্যের বাড়িতে উঠিয়াছিল। দুপুরের পর সেখানে তাসের আড্ডায় পাড়ার অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সর্বজয়া সকলের মন জোগাইবার ভাবে বলিল-এই বড় খুড়ি আছেন, ঠাকুমা আছেন, মেজদি আছেন, এঁদের যদি দয়া হয় তবে অপু আমার সামনের ফাগুনে পৈতেটা দিয়ে নিয়ে গায়ের পুজোটাতে হাত দিতে পারে। ওর আমার তা হলে ভাবনা কি? আট দশ ঘর শিষ্যবাড়ি আছে, আর যদি মা সিদ্ধেশ্বরীর ইচ্ছেয় গাঙ্গুলি-বাড়ির পুজোটা বাঁধা হয়ে যায় তাহলেই

    সুনীলের মা মুখ টিপিয়া হাসিলেন। তঁহার ছেলে সুরেশ বড় হইলে আইন পড়িয়া-ৰ্তাহার জেঠতুতো ভাই পাটনার বড় উকিল, তাঁহার কাছে আসিয়া ওকালতি করিবে। সুরেশের সে মামা নিঃসন্তান। অথচ খুব পসারওয়ালা উকিল। এখন হইতেই তাঁহাদের ইচ্ছা যে সুরেশকে কাছে রাখিয়া লেখাপড়া শেখান,-কিন্তু সুনীলের মা পরের বাড়ি ছেলে রাখিতে যাইবেন কেন ইত্যাদি সংবাদ নির্বোিধ সর্বজয়ার মতো হাউ হাউ না বকিয়াও, ইতিপূর্বে মাঝে-মিশালে কথাবার্তার ফাঁকে তিনি সকলকে বুঝাইয়া দিয়াছেন।

    ভুবন মুখুজ্যের বাড়ির বাহিরে আসিয়া সর্বজয়া ছেলেকে বলিল-শোনা একটা কথা-পরে চুপি চুপি বলিল-তোর জেষ্ঠীমার কাছে গিয়া বলিস না যে, জেষ্ঠীমা আমার জুতো নেই-আমায় একজোড়া জুতো দাও না কিনে?

    অপু বলিল, কেন মা?

    —বলিস না, বড়লোক ওরা, চাইলে হয়তো ভালো একজোড়া জুতো দেবে এখন-দেখিসনি যেমন ওই সুরেশের পায়ে আছে? তোর পায়ে ওইরকম লাল জুতো বেশ মানায়—

    অপু লাজুক মুখে বলিল-আমার বড় লজ্জা করে, আমি বলতে পারবো না-কি হয়তো ভাববে-আমি…

    সর্বজয়া বলিল-তা। এতে আবার লজ্জা কি!..আপনার জন—বলিস না।–তাতে কি?

    –হুঁ…উ-আমি বলতে পারবো না মা। আমি কথা বলতে পারিনে জেষ্ঠীমার সামনে…

    সর্বজয়া রাগ করিয়া বলিল-তা পারবে কেন? তোমার যত বিদ্ধি সব ঘরের কোণে-খালি পায়ে বেড়িয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আজ দু’বছর পায়ে নেই জুতো সে ভালো, বড়লোক, চাইলে হয়তো দিয়ে দিত কিনে-তা তোমার মুখ দিয়ে বাক্যি বেরুবে না-মুখচোরার রাজা—

    পূর্ণিমার দিন রানীদের বাড়ি সত্যনারায়ণের পূজার প্রসাদ আনিতে অপু সেখানে গেল। রানী তাহাকে ডাক দিয়া হাসিমুখে বলিল-আমাদের বাড়ি তো আগে আগে কত আসতিস, আজকাল আসিস নে কেন রে?

    -কেন আসবো না রানুদি,-আসি তো?

    রানু অভিমানের সুরে বলিল-হ্যাঁ আসিস। ছাই আসিস। আমি তোর কথা কত ভাবি। তুই ভাবিস আমার, আমাদের কথা?

    –না বই কি বা রে-মাকে জিজ্ঞেস করে দেখো দিকি?

    এ ছাড়া অন্য কোনো সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ তাহার জোগাইল না। রানী তাহাকে সেখানে দাঁড় করাইয়া রাখিয়া নিজে গিয়া তাহার জন্য ফল প্ৰসাদ ও সন্দেশ লইয়া আসিয়া হাতে দিল। হাসিয়া বলিল,-থালা সুদ্ধ নিয়ে যা, আমি কাল গিয়ে খুড়িমার কাছ থেকে নিয়ে আসবো–

    রানীর মুখের হাসিতে তাহার উপর একটা পরম নির্ভরতার ভাব আসিল অপুর। রানুদি কি সুন্দর দেখিতে হইয়াছে আজকাল, রানুদির মতো সুন্দরী এ পর্যন্ত অন্য কোনো মেয়ে সে দেখে নাই। অতসীদি সর্বদা বেশ ফিটফাট থাকে বটে, কিন্তু দেখিতে রানুদির কাছে লাগে না। তাহা ছাড়া অপু জানে এ গ্রামের মেয়েদের মধ্যে, রানুদির মতো মন কোনো মেয়েরই নয়। দিদির পরই যদি সে কাহাকেও ভালোবাসে তো সে রানুদি। রানুদিও যে তাহার দিকে টানে তাহা কি আর অপু জানে না?

    সে থালা তুলিয়া চলিয়া যাইবার সময় একটু ইতস্তত করিয়া বলিল-রানুদি, তোমাদের এই পশ্চিমের ঘরের আলমারিতে যে বইগুলো আছে সত্যুদা পড়তে দেয় না! একখানা দেবে পড়তে? পড়েই দিয়ে যাবো।

    রানী বলিল-কোন বই আমি তো জানিনে, দাঁড়া আমি দেখছি–-

    সতু প্রথমে কিছুতেই রাজি হয় না, অবশেষে বলিল-আচ্ছা পড়তে দিই, যদি এক কাজ করিস। আমাদের মাঠের পুকুরে রোজ মাছ চুরি যাচ্ছে- জেঠামশায় আমাকে বলেছে, সেখানে গিয়ে দুপুরবেলা চৌকি দিতে,-আমার সেখানে একা এক ভালো লাগে না, তুই যদি যাস আমাব বদলে তবে বই পড়তে দেবো–

    রানী প্রতিবাদ করিয়া বলিল—বেশ তো? ও ছেলেমানুষ, সেই বনের মধ্যে বসে মাছ চৌকি দেবে বই কি? তুমি বুড়ো ছেলে পারো না, আর ও যাবে? যাও তোমায় বই দিতে হবে না, আমি বাবার কাছে চেয়ে দেবো।–

    অপু কিন্তু রাজি হইল। রানীর বাবা ভুবন মুখুজ্যে বিদেশে থাকেন, তাহার আসিবার অনেক দেরি অথচ এই বইগুলার উপর তাহার বড় লোভ। এগুলি পড়িবার লোভে সে কতদিন লুক্কচিত্তে সতুদের পশ্চিমের ঘরটায় যাতায়াত করিয়াছে। দু-একখানা একটু-আধটু পড়িয়াছেও। কিন্তু সন্তু নিজে তো পড়েই না, তাহাকেও পড়িতে দেয় না। নায়কের ঠিক সংকটময় মুহুর্তটিকেই হাত হইতে বই কড়িয়া লইয়া বলে-রেখে দে অপু, এ সব ছোট কাকার বই, ছিড়ে যাবে, দে।

    অপু হাতে স্বৰ্গ পাইয়া গেল।

    প্রতিদিন দুপুরবেলা আলমারি হইতে বাছিয়া এক-একখানি করিয়া বই সত্যুর নিকট হইতে চাহিয়া লইয়া যায় ও বাশবনের ছায়ায় কতকগুলো শ্যাওড়াগাছের কাঁচা ডাল পাতিয়া তাহার উপর উপুড় হইয়া শুইয়া একমনে পড়ে। বই অনেক আছে-প্ৰণয়-প্রতিমা, সরোজ-সরোজিনী, কুসুমকুমারী, সচিত্র যৌবনে যোগিনী নাটক, দসু্য-দুহিতা, প্ৰেম-পরিণাম বা অমৃতে গরল, গোপেশ্বরের গুপ্তকথা…সে কত নাম করিবে! এক-একখানি করিয়া সে ধরে, শেষ না করিয়া আর ছড়িতে পারে না। চোখ টাটাইয়া ওঠে, রাগ টিপ টপ করে; পুকুরধারের নির্জন বাঁশবনের ছায়া ইতিমধ্যে কখন দীর্ঘ হইয়া মজা পুকুরটার পাটা-শ্যাওলার দামে নামিয়া আসে, তাহার খেয়ালই থাকে না কোন দিক দিয়া বেলা গেল!

    কি গল্প! সরোজিনীকে সঙ্গে লইয়া সরোজ নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদে যাইতেছেন, পথে নবাবের লোকে নৌক লুঠিয়া তাহাদের বন্দী করিল। নবাবের হুকুমে সরোজের হইয়া গেল প্ৰাণদণ্ড, সরোজিনীকে একটা অন্ধকার ঘরে চাবিতালা বন্ধ করিয়া রাখিয়া দিল। গভীর রাত্রে কক্ষের দরজা খুলিয়া গেল, নবাব মত্ত অবস্থায় কক্ষে প্রবেশ করিয়া বলিলেন-সুন্দরী, আমার হুকুম সরোজ মরিয়াছে, আর কেন.ইত্যাদি। সরোজিনী সদৰ্পে ঘাড় বাঁকাইয়া বলিলেন-রে পিশাচ, রাজপুত রমণীকে তুই এখনও চিনিস নাই, এ দেশে প্ৰাণ থাকিতে…ইত্যাদি। এমন সময় কাহার ভীম পদাঘাতে কারাগারের জানালা ভাঙিয়া গেল। নবাব চমকিয়া উঠিয়া দেখিলেন-একজন জটাজুটধারী তেজঃপুঞ্জকলেবর সন্ন্যাসী, সঙ্গে যমদূতের মতো বলিষ্ঠ চারি-পাঁচজন লোক। সন্ন্যাসী রোষকষায়িতনয়নে নবাবের দিকে চাহিয়া বলিলেন-নরাধম, রক্ষক হইয়া ভক্ষক? পরে সরোজিনীর দিকে চাহিয়া বলিলেন-মা, আমি তোমার স্বামীর গুরু-যোগানন্দ স্বামী, তোমার স্বামীর প্রাণহানি হয় নাই, আমার কমণ্ডলুর জলে পুনজীবন লাভ করিয়াছে, এখন তুমি চল মা আমার আশ্রমে, বৎস সরোজ তোমার অপেক্ষা করিয়া আছে।.গ্ৰন্থকারের লিপিকৌশল সুন্দর,-সরোজের এই বিস্ময়জনক পুনরুজীবন আরও বিশদভাবে ফুটাইবার জন্য তিনি পরবর্তী অধ্যায়ের প্রতি পাঠকের কৌতুহল উদ্দীপ্ত করিয়া বলিতেছেন-এইবার চল পাঠক, আমরা দেখি বধ্যভূমিতে সরোজের প্রাণদণ্ড হইবার পর কি উপায়ে তাহার পুনজীবন লাভ সম্ভব হইল…ইত্যাদি।

    এক-একটি অধ্যায় শেষ করিয়া অপুর চোেখ ঝাপসা হইয়া আসে-গলায় কি যেন আটকাইয়া যায়। আকাশের দিকে চাহিয়া সে দুই-এক মিনিট কি ভাবে,–আনন্দে বিস্ময়ে, উত্তেজনায় তাহার দুই কান দিয়া যেন আগুন বাহির হইতে থাকে, পরে বুদ্ধনিঃশ্বাসে পরবতী অধ্যায়ে মন দেয়। সন্ধ্যা হইয়া যায়, চারিধারে ছায়া দীর্ঘ হইয়া আসে, মাথার উপর বাঁশঝাড়ে কত কী পাখির ডাক শুরু হয়, উঠিউঠি করিয়াও বইয়ের পাতার এক-ইঞ্চি ওপরে চোখ রাখিয়া পড়িতে থাকে-যতক্ষণ অক্ষর দেখা যায়।

    এইরকম বই তো সে কখনও পড়ে নাই! কোথায় লাগে সীতার বনবাস আর ড়ুবালের গল্প? বাড়ি আসিলে তাঁহার মা বকে—এমন হাবলা ছেলেও তুই? পরের মাছ চৌকি দিস গিয়ে সেই একলা বনের মধ্যে বসে একখানা বই পড়বার লোভে? আচ্ছা বোকা পেয়েছে তোকে।

    কিন্তু বোকা অপুর লাভ যেদিক দিয়া আসে, তাহার মায়ের সেদিক সম্বন্ধে কোন ধারণাই নাই!

    কিন্তু বোকা অপুর লাভ যেদিক দিয়া আসে, তাহার মায়ের সেদিক সম্বন্ধে কোন ধারণাই নাই। আজকাল সে দুইখানা বই পাইয়াছে ‘মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত’ ও ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’। …উইঢিবি, বৈঁচিবনের প্রেক্ষাপটে নিস্তব্ধ দুপুরের মায়ায় দৃশ্যের পর দৃশ্য পরিবর্তিত হইয়া চলে-জেলেখা নদীর উপর বসিয়া আহত নরেনের শুশ্রুষা করিতেছে, আওরঙ্গজেবের দরবারে নিজেকে পাঁচহাজারী মনসবদারের মধ্যে স্থান পাইতে দেখিয়া শিবাজী রাগে ফুলিয়া ভাবিতেছেন-শিবাজী পাঁচ-হাজারী? একবার পুনায় যাও তো, শিবাজীর ফৌজে কত পাঁচ-হাজারী মনসবদার আছে গনিয়া আসিবে!…

    রাজবারার মরুপর্বতে, দিল্লি-আগ্রার রঙমহালে, শিশমহালে, ওড়না-পেশোয়াজ-পরা সুন্দরীদলের সঙ্গে তাহার সারা দিনমান কাটে। এ কোন জগৎ-যেখানে শুধু জ্যোৎস্না, তলোয়ারখেলা, সুন্দর মুখের বন্ধুত্ব, আহেরিয়া-উৎসবে দীর্ঘ বর্শা হাতে ঘোড়ায় চড়িয়া উষর উপত্যকা ও ভুট্টাক্ষেত্র পার হইয়া ছোটা?…

    বীরের যাহা সাধ্য, রাজপুতের যাহা সাধ্য, মানুষের যাহা সাধ্য-প্রতাপসিংহ তাহা করিয়াছিলেন। হলদিঘাটের পার্বত্য বর্ক্সের প্রতি পাষাণ-ফলকে তাহার কাহিনী লেখা আছে। দেওয়ারের রণক্ষেত্রের দ্বাদশ সহস্র রাজপুতের হৃদয়রক্তে তাহার কাহিনী অক্ষয় মহিমায় লেখা আছে।

    বহুদিন পরেও প্রাচীন যোদ্ধৃগণ শীতের রাত্রিতে অগ্নিকুণ্ডের পাৰ্থে বসিয়া পৌত্রপৌত্ৰিগণের নিকট হলদিঘাটের অদ্ভুত বীরত্বের কথা বলিত।…

    অদৃশ্যহস্তনিক্ষিপ্ত একটি বর্শ আসিল।–অপু এই গ্রামের চিরশ্যাম বনভূমির ছায়ায়, লতাপাতার নিবিড়তায়, ভিজামাটির গন্ধে মানুষ হইয়াছে।–তবুও সে জানে রাজপুতানার ভীলপ্রদেশের বা আরাবল্পী-মেবারের প্রত্যেকটি স্থান, নাহারা মগরোর অপূর্ব বন্য সৌন্দর্য সে ভালো করিয়াই চেনে।. পর্বত হইতে অবতরণশীল শস্ত্ৰপাণি তেজসিংহের মূর্তি কি সুন্দর মনে হয়!…

    “সেই চপ্পন প্রদেশে অনেকদিন অবধি সেই ভীল গ্রামের নির্জন কন্দরে ও উন্নত শিখরে রজনী দ্বিপ্রহরের সময় একটি রমণী-কণ্ঠ-নিঃসৃত গীত শ্রুত হইত। অতি প্ৰত্যুষে নির্জন প্রান্তরে, পথিকগণ কখনও কখনও একটি রমণীর পাণ্ডুর মুখ ও চঞ্চল-নয়ন দেখিতে পাইত; লোকে বলিত কোনো বিশ্রামশুন্যা উদ্বিগ্ন বনদেবী হইবে’…সেই গানের অস্পষ্ট করুণ মূৰ্ছনা যেন অপুর কানে বাঁশবাগানের পিছন হইতে ভাসিয়া আসে!…

    কমলমীর, সূর্যগড়ের যুদ্ধ, সেনাপতি শাহবাজ খাঁ, সুন্দরী নুরজাহান, পুস্পকুমারী, বন্য ভীলপ্রদেশ, বীরবালক চন্দনসিংহ-দূর সুদূর কল্পনা।–তবুকত নিকট, কত বাস্তব মনে হয়। রাজবারার মরুভূমি আর নীল আরাবল্লীর উন্নত পর্বতের শিখরে শিখরে চেনার বৃক্ষে ফুল ফুটিয়া ঝরিয়া পড়িয়াছে, দেবী মিবার লক্ষ্মীর অলক্ত-রক্তপদচিহ্ন আঁকা রহিয়াছে বুনাস ও বরী নদীর তটভূমির শিলাখণ্ডে, ঝরনার উপলরাশির উপরে, বাজরা ও জওয়ার-ক্ষেতে ও মৌউল বনে।…

    চিতোর রক্ষণ হইল না! রানা অমরসিংহ বাদশাহের সম্মান গ্রহণ করিলেন। সর্বহার পিতা প্রতাপসিংহ যিনি পঁচিশ বৎসর ধরিয়া বনে পর্বতে ভীলের পোল লইয়া যুদ্ধ করিয়াছিলেন, তিনি ব্যথাক্ষুব্ধচিত্তে কোথা হইতে দেখিয়াছিলেন এ সব?…

    তপ্ত চোখের জলে পুকুর, উইঢিবি, বৈঁচিবন, বাঁশবাগান-সব ঝাপসা হইয়া আসে।

    সেদিন দুপুরে তাহার বাবা একটা কাগজের মোড়ক দেখাইয়া হাসিমুখে বলিল-দ্যাখো তো খোকা, কি বলো দিকি?

    অপু তাড়াতাড়ি বিছানার উপর উঠিয়া বসিল; উৎসাহের সুরে জিজ্ঞাসা করিল—খবরের কাগজ? না বাবা?

    সেদিন রামকবচ লিখিয়া দিয়া বেহারী ঘোষের শাশুড়ির নিকট যে তিনটি টাকা পাইয়াছে, স্ত্রীকে গোপন করিয়া হরিহর তারই মধ্যে দুটাকা খবরের কাগজের দাম পাঠাইয়া দিয়াছিল, স্ত্রী জানিতে পারিলে অন্য পাঁচটা অভাবের গ্রাস হইতে টাকা দুইটাকে কোনো মতেই বাঁচানো যাইত না।

    অপু বাবার হাত হইতে তাড়াতাড়ি কাগজের মোড়কটা লইয়া খুলিয়া ফেলে। হ্যাঁ—খবরের কাগজ বটে। সেই বড় বড় অক্ষরে “বঙ্গবাসী’ কথাটা লেখা, সেই নতুন কাগজের গন্ধটা, সেই ছাপা সেই সব-যাহার জন্য বৎসরখানেক পূর্বে সে তীর্থের কাকের মতো অধীর আগ্রহে ভুবন মুখুজ্যেদের চণ্ডীমণ্ডপের ডাকবাক্সটার কাছে পিওনের অপেক্ষায় প্রতি শনিবারে হা করিয়া বসিয়া থাকিত! খবরের কাগজ! খবরের কাগজ! কি সব নতুন খবর না জানি দিয়াছে? কি অজানা কথা সব লেখা আছে ইহার বড় বড় পাতায়?

    হরিহরের মনে হয়-দুইটি টাকার বিনিময়ে ছেলের মুখে যে আনন্দের হাসি ফুটাইয়া তুলিয়াছে, তাহার তুলনায় কোন বন্দকী মাকড়ী খালাসের আত্মপ্রসাদ মোটেই বেশি হইত না!

    অপু খানিকক্ষণ পড়িয়া বলে-দ্যাখো বাবা, একজন বিলাত যাত্রী’র চিঠি বেরিয়েছে, আজ থেকেই নতুন বেবুলো। খুব সময়ে আমাদের কাগজটা এসেচে-না বাবা?

    তবুও তার মনে দুঃখ থাকিয়া যায় যে গত বৎসর কাগজখানা হঠাৎ উহারা বন্ধ করিয়া দেওয়াতে জাপানী মাকড়সাসুরের গল্পটার শেষ ভাগ তাহার পড়া হয় নাই, রাইকো রাজসভায় যাওয়ার পর তাহার যে কি ঘটিল। তাহা সে জানিতে পারে নাই।…

    একদিন রানী বলিল—তোর খাতায় তুই কি লিখচিস রে?

    অপু বিস্ময়ের সুরে বলিল-কোন খাতায়? তুমি কি করে–

    –আমি তোমাদের বাড়ি সেদিন দুপুরে যাইনি বুঝি? তুই ছিলিনে, খুড়িমার সঙ্গে কতক্ষণ বসে কথা বোল্লাম। কেন, খুড়িমা তোকে বলেনি? তাই দেখলাম তোর বই-এর দপ্তরে তেশ্বর সেই রাঙা খাতাখানায় কি সব লিখিচিস-আমার নাম রয়েচে, আর দেবী সিংহ না কি একটা–

    অপু লজ্জায় লাল হইয়া বলিল-ও একটা গল্প।

    –কি গল্প রে? আমায় কিন্তু পড়ে শোনাতে হবে।

    পরদিন রানী একখানা ছোট বাঁধানো খাতা অপুর হাতে দিয়া বলিল-এতে তুই আমাকে একটা গল্প লিখে দিস-একটা বেশ ভালো দেখে। দিবি তো? অতসী বলছিল তুই ভালো লিখতে পারিস নাকি! লিখে দে, আমি অতসীকে দেখাবো।…

    অপু রাত্রে বসিয়া বসিয়া খাতা লেখে। মাকে বলে–আর একটা পলা তেল দাও না মা। এইটুকু লিখে রাখি আজ…

    তাহার মা বলে-আজ রাত্তিরে আর পড়ে না-মোটে দু’পলা তেল আছে, কাল আবার রাধবো কি দিয়ে? এই খানে রাধছি, এই আলোতে বসে পড়।

    অপু ঝগড়া করে।

    মা বকে-এঃ, ছেলের রাত্তির হলে যত লেখা-পড়ার চাড়-সারাদিন চুলের টিকিট দেখবার জো নেই। সকালে করিস কি? যা তেল দেবো না।

    অবশেষে অপু উনুনের পাড়ে কাঠের আগুনের আলোয় খাতাখানা আনিয়া বসে। সর্বজয়া ভাবে-অপু আর একটু বড় হলে আমি ওকে ভালো দেখে বিয়ে দেবো। এ ভিটতে নতুন পাকা বাড়ি উঠবে। আসচে বছর পৈতেটা দিয়ে নিই, তারপর গাঙ্গুলি-বাড়ির পুজোটা যদি বাঁধা হয়ে যায়–

    ..চার-পাঁচদিন পরে সে রানীর হাতে খাতা ফিরাইয়া দিলে রানী আগ্রহের সহিত খাতা খুলিতে খুলিতে বলিল-লিখেচিস?

    অপু হাসি-হাসি মুখে বলিল-দ্যাখো না খুলে?

    রানী দেখিয়া খুশির সুরে বলিল—ওঃ, অনেক লিখেচিস যে রে! দাঁড়া অতসীকে ডেকে দেখাই।

    অতসী দেখিয়া বলিল-অপু লিখেচে না আরও কিছু-ইস! এ সব বই দেখে লেখা।

    অপু প্রতিবাদের সুরে বলিল—ইঃ, বই দেখে বইকি? আমি তো গল্প বানাই-পাটুকে জিজ্ঞেস কোরো দিকি অতসীদি? ওকে বিকেলে গাঙের ধারে বসে বসে কত বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলিনে বুঝি?

    রানী বলিল-না ভাই, ও লিখেচে, আমি জানি!! ও ওই রকম লেখে। খাসা যাত্রার পালা লিখেছিল খাতাতে, আমায় পড়ে শোনালে।… পরে অপুকে বলিল-নাম লিখে দিসনি তোর? নাম লিখে দে।

    অপু এবার একটু অপ্রতিভতার সুরে বলিল যে, গল্পটা তাহার শেষ হয় নাই, হইলেই নাম লিখিয়া দিবে এখন। ‘সচিত্র যৌবনে-যোগিনী’ নাটকের ধরনে গল্প আরম্ভ করিলেও শেষটা কিরূপ হইবে সে ভাবিয়া ঠিক করিতে পারে নাই। অথচ দীর্ঘ দিন তাহার কাছে খাতা থাকিলে বানুদিবিশেষ করিয়া অতসীদি পাছে তাহার কবিপ্রতিভা সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া পড়ে, এই ভয়ে অসমাপ্ত অবস্থাতেই সেখানা ফেরত দিয়াছে।…

    তাহার বাবা বাড়িতে নাই। সকালে উঠিয়া সে তাহদের গ্রামের আর সকলের সঙ্গে পাশের গ্রামে এক আদ্যশ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে গেল। সুনীলও গেল তাহার সঙ্গে। নানা গ্রামের ফলারে বামুনের দল পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূর হইতেও হ্যাঁটিয়া আসিয়াছে। এক এক ব্যক্তি পাঁচ-ছয়টি করিয়া ছেলেমেয়ে সঙ্গে করিয়া আসিয়াছে; সকলকে সুবিধামতো স্থানে বসাইতে গিয়া একটা দাঙ্গা বাধিবার উপক্ৰম। প্রত্যেকের পাতে চারিখানি করিয়া লুচি দিয়া যাইবার পর পরিবেশনকারীরা বেগুনভাজা পরিবেশন করিতে আসিয়া দেখিল কাহারও পাতে লুচি নাই,–সকলেই পার্শ্ববতী চাদরে বা গামছায় লুচি তুলিয়া বসিয়া আছে৷…ছোট ছোট ছেলে অতশত না বুঝিয়া পাতের লুচি ছিড়িতে যাইতেছে-তাহার বাপ বিশ্বেশ্বর ভট্টচোয হোঁ মারিয়া ছেলের পাত হইতে লুচি উঠাইয়া পাশের চাদরে রাখিয়া বলিলএগুলো রেখে দাও না! আবার এখুনি দেবে, খেয়ো এখন।

    তাহার পর খানিকক্ষণ ধরিয়া ভীষণ শোরগোল হইতে লাগিল-“লুচির ধামাটা এ সারিতে” “কুমড়োটা যে আমার পাতে একেবারেই’, “ওহে, গরম গরম দেখে৷’, “মশাই কি দিলেন হাত দিয়ে দেখুন দিকি, স্রেফ কাঁচা ময়দা”…ইত্যাদি। ছাঁদার পরিমাণ লইয়া কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের তুমুল বিবাদ! কে একজন চিৎকার কবিয়া বলিতে লাগিল-তা হলে সেখানে ভদরলোকেদের নেমস্তেন্ন করতে নেই। স-পাঁচ গণ্ডা লুচি এ একেবারে ধরা-বাঁধা হ্যাঁদার রেট-বল্লাল সেনের আমল থেকে বঁধা রয়েচে। চাইনে তোমার ছাদা, কন্দ্দশ্লো মজুমদার এমন জায়গায় কখনও–

    কর্মকর্তা হাতে-পায়ে ধবিয়া কন্দৰ্প মজুমদারকে প্রসন্ন করিলেন।

    অপুও এক পুটুলি ছাঁদা বহিয়া আনিল। সর্বজয়া তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া হাসিমুখে বলিল-ওমা, এ যে কত এনেচিস-দেখি খোল তো? লুচি, পানতুয়া, গজা-কত রে! ঢেকে রেখে দি, সকালবেলা খেয়ো এখন।

    অপু বলিল-তোমায়ও কিন্তু মা খেতে হবে-তোমাব জন্যে আমি চেয়ে দু’বার করে পানতুয়া নিইচি।

    সর্বজয়া বলিল–হ্যাঁরে, তুই বল্লি নাকি আমাব মা খাবে দাও?–তুই তো একটা হাবলা ছেলে!

    অপু ঘাড় ও হাত নাড়িয়া বলিল-হ্যাঁ, তাই বুঝি আমি বলি। এমন করে বল্লাম তাবা ভাবলে আমি খাবো।

    সর্বজয়া খুশির সহিত পুঁটুলিটা তুলিয়া ঘরে লইযা গেল।

    খানিকক্ষণ পরে অপু সুনীলদের বাড়ি গেল। উহাদেব ঘবেব বোযিাকে পা দিযই শুনিল, সুনীলের মা সুনীলকে বলিতেছেন-ওসব কেন বযে আনলি বাড়িতে? কে আনতে বলেচে তোকে?

    সুনীলও সকলের দেখাদেখি ছাঁদা বাধিঁয়াছিল, বলিল-কেন মা, সবাই তো নিলে–অপুও তো এনেচে।

    সুনীলের মা বলিলেন–অপু আনবে না কেন-ও ফলারে বামুনের ছেলে। ও এরপরে ঠাকুরপুজো করে আর ছাদা বেঁধে বেড়াবে,-ওই ওদের ধারা। ওর মা-টাও অমনি হ্যাংলা। ওইজন্যে আমি তখন তোমাদের নিয়ে এ গাযে আসতে চাইনি। কুসঙ্গে পড়ে যত কুশিক্ষে হচ্ছে! যা, ওসব অপুকে ডেকে দিয়ে আয়—যা; না হয় ফেলে দিগে যা। নেমস্তন্ন করেচে। নেমস্তন্ন খেলিছোটলোকের মতো ওসব বেঁধে আনবার দরকাব কি!

    অপু ভয় পাইয়া আর সুনীলদের ঘরে ঢুকিল না। বাড়ি ফিরিতে ফিবিতে ভাবিল-যাহা তাহার মা পাইয়া এত খুশি হইল, জেঠাইমা তাহা দেখিয়াই এত রাগিল কেন? খাবারগুলো কি ঢেলামাটি যে, সেগুলো ফেলিয়া দিতে হইবে? তাহার মা হাংলা? সে ফলাবে বামুনের ছেলে? বা রে, জেঠিমা যেন অনেক পানতুয়া-গজা খাইয়াছে, তাহার মা তো ও-সব কিছুই খাইতে পায় না। আর সে-ই বা নিজে এসব ক’দিন খাইয়াছে? সুনীলের কাছে যাহা অন্যায়, তাহার কাছে সেটা কেমন করিয়া অন্যায় হইতে পারে।

    লেখাপড় বড় একটা তাহার হয় না, সে এই সবই করিয়া বেড়ায়। ফলার খাওয়া, হ্যাঁদা বাঁধা, বাপের সঙ্গে শিষ্যবাড়ি যাওয়া, মাছধরা। সেই ছোট্ট ছেলে পটু-জেলে পাড়ায় কড়ি খেলিষ্ঠে গিয়া যে সে-বার মারা খাইয়াছিল-সে এ সব বিষয়ে অপুর সঙ্গী। আজকাল সে আরও বড় হইয়াছে, মাথাতে লম্বা হইয়াছে, সব সময় অপুদার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। ওপাড়া হইতে এপাড়ায় আসে। শুধু অপুদার সঙ্গে খেলিতে, আর কাহারও সঙ্গে সে বড় একটা মেশে না। তাহাকে বাঁচাইতে গিয়া অপুদা যে জেলের ছেলেদের হাতে মারা খাইয়াছিল, সেকথা সে এখনও ভোলে নাই।

    মাছ ধরিবার শখ অপুর অত্যন্ত বেশি। সোনাডাঙা মাঠের নিচে ইছামতীর ধারে কাঁচিকাটা খালের মুখে ছিপে খুব মাছ ওঠে। প্রায়ই সে এইখানটি গিয়া নদীতীরে একটা বড় ছাতিম গাছের তলায় মাছ ধরিতে বসে। স্থানটা তাহার ভারি ভালো লাগে, একেবারে নির্জন, দুধারে নদীর পাড়ে কত কি গাছপালা নদীর জলে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, ওপারে ঘন সবুজ উলুবন, মাঝে মাঝে লতাদোলানো কদম-শিমুল গাছ, বেগুনী রং-এর বনকলমি ফুলে ছাওয়া ঝোপ, দূরে মাধবপুর গ্রামের বাঁশবন, পাখির ডাকে বনের ছায়ায় উলুবনের শ্যামলতায় মেশামোশি মাখামাখি স্নিগ্ধ নির্জনতা!

    সেই ছেলেবেলায় প্রথম কুঠির-মাঠে আসার দিনটি হইতে এই মাঠ-বন-নদীর কি মোহ যে তাহাকে পাইয়া বসিয়াছে! ছিপ ফেলিয়া ছাতিম গাছের ছায়ায় বসিয়া চারিদিকে চাহিতেই তাহার মান অপূর্ব পুলকে ভরিয়া ওঠে। মাছ হোক বা না হোক, যখনই ঘন বৈকালের ছায়া মাঠের ধারের খেজুর ঝোপের ডাসা খেজুরের গন্ধে ভরপুর হইয়া ওঠে, স্নিগ্ধ বাতাসে চারিধার হইতে বৌ-কথা-কও, পাপিয়ার ডাক ভাসিয়া আসে, ডালে-ডালে অভ্র-আবীর ছড়াইয়া সূর্যদেব সোনাডাঙার মাঠের সেই ঠ্যাঙাড়ে বটগাছটার আড়ালে হেলিয়া পড়েন, নদীর জল কালো হইয়া যায়, গাঙশালিকের দল কলরব করিতে করিতে বাসায় ফেলে, তখনই তাহার মন বিভোর হইযা ওঠে, পুলক-ভরা চোখে চাবিদিকে চাহিয়া দেখে; মনে হয়–মাছ না পাওযা গেলেও রোজ রোজ সে এইখানটিতে আসিয়া বসিবে, ঠিক এই বড় ছাতিম গাছের তলাটাতে।

    মাছ প্রায়ই হয় না, শরেব ফাতনা স্থির জলে দণ্ডের পর দণ্ড নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতো অটল। একস্থানে অতিক্ষণ বসিয়া থাকিবার ধৈর্য তাহার থাকে না, সে এদিকে ওদিকে ছটফট করিয়া বেড়ায়, ঝোপের মধ্যে পাখির বাসার খোজে, ফিরিয়া আসিয়া হয়তো চোখে পড়ে ফাতনা একটু একটু ঠাকুরাইতেছে! ছিপ তুলিয়া বলে-দূৰ! বেয়া মাছের ঝাক লেগেচে, এখানে কিছু হবে না। পবে সেখান হইতে ছিপ তুলিয়া একটু দূলে শ্যাওলা দামের পাশে গিয়া টোপ ফেলে। জলটার গভীব কালো রঙ-এ মনে হয় বড় বুই কাতলা এখনই টোপ গেলে আর কি! ভ্ৰম ঘুচিতে বেশি দেবি হয় না, শবের ফাতনা নির্বিকল্প সমাধির অবস্থা প্ৰাপ্ত হয়…

    এক-একদিন সে এক-একখানা বই সঙ্গে করিয়া আনিয়া বসে।

    ছিপ ফেলিয়া বই খুলিয়া পড়ে। সুরেশের নিকট হইতে সে একখানা নিচের ক্লাসেব ছবিওয়ালা ইংরাজি বই ও তাহার অর্থপুস্তক চাহিয়া লইয়াছে। ইংরাজি সে বুঝিতে পারে না, অর্থ পুস্তক দেখিয়া গল্পের বাংলাটা বুঝিয়া লয় ও ইংরাজি বইখানাতে শুধু ছবি দেখে। দূর দেশেব কথা ও সকল রকম মহত্ত্বের কাহিনী ছেলেবেলা হইতেই তাহার মনকে বড় দোলা দেয়, এই বইখানাতে সে ধরনের অনেকগুলি গল্প আছে। কোথাকার মুক্ত প্রান্তরে একজন ভ্ৰমণকারী বিষম তুষাবঝটিকার মধ্যে পথ হারাইয়া চক্রাকারে ঘুরিতে ঘুরিতে শীতে প্ৰাণ হারায়, অজানা মহাসমুদ্রে পাড়ি দিয়া ক্রিস্টোফার কলম্বাস কিরূপে আমেরিকা আবিষ্কাব করিলেন-এমনি সব গল্প। যে দুটি ইংরাজ বালক-বালিকা সমুদ্রতীরের শৈলগাত্রে গাঙচিলের বাসা হইতে ডিম সংগ্ৰহ করিতে গিয়া বিপদগ্ৰস্ত হইয়াছিল, যে সাহসিনী বালিকা প্রাসকোভিয়া লপুলফ নির্বাসিত পিতার নির্বাসনদণ্ড প্রত্যাহার করিবার আশায় জনহীন তুষারাবৃত প্রান্তরের পথে সুদূর সাইবেরিয়া হইতে এক বাহির হইয়াছিল- তাহাদের যেন সে দেখিলেই চিনিতে পারে।

    স্যার ফিলিপ সিডনির ছোট্ট গল্পটুকু পড়িয়া তাহার চোখ দুটি জলে ভরিয়া যায়। সুরেশকে গিয়া জিজ্ঞাসা করে-সুরেশদা, এই গল্পটা জানো তুমি? বড় করে বলো না?

    সুরেশ বলে-ও, জুটফেনের যুদ্ধের কথা!

    অপু অবাক হইয়া বলে-কি সুরেশদা? জুটফেন! কোথায় সে?

    সুরেশ ওইটুকুর বেশি আর বলিতে পারে না।…

    মাসেখানেক পরে একদিন।

    মাছ ধরিতে গিয়া একটা বড় সরপুঁটি মাছ কি করিয়া তাহার ছিপে উঠিয়া গেল। লোভ পাইয়া সে জায়গাটি আর অপু ছাড়ে না-গাছের ডালপালা ভাঙিয়া আনিয়া বিছাইয়া বসে।

    ক্ৰমে বেলা যায়, নদীর ধারের মাঠে আবার সেই অপূর্ব নীরবতা, ওপারের দেয়াড়ের মাঠের পারে সুদূরপ্রসারী সবুজ উলুবনে কাশঝোপে, কদম-শিমুল গাছের মাথায় আবার তাহার শৈশব পুলকের শুভমুহুর্তের অতি পরিচিত, পুরাতন সাথী-বৈকালের মিলিয়ে-যাওয়া শেষ রোদ!

    বঙ্গবাসীতে বিলাত-যাত্রীর চিঠির মধ্যে পড়া সেই সুন্দর গল্পটি তাহার মনে পড়ে…

    সে সুরেশদাদার ইংরাজি ম্যাপে ভূমধ্যসাগর কোথায় দেখিয়াছে, তারই ওপারে ফ্রান্স দেশ সে জানে। কতকাল আগে ফ্রান্স দেশের বুকে তখন বৈদেশিক সৈন্যবাহিনী চাপিয়া বসিয়াছে, দেশ বিপন্ন, রাজা শক্তিহীন, চারিদিকে অরাজকতা, লুঠ-তরাজ! জাতির এই ঘোর অপমানের দিনে, লোরেন। প্রদেশের অন্তঃপাতী এক ক্ষুদ্র গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক দুহিতা পিতার মেষপাল চরাইতে যায়, আর মেষের দলকে ইতস্তত ছাড়িয়া দিয়া নিভৃত পত্নীপ্রান্তরে তৃণভূমির উপর বসিয়া সুনীল নয়ন দুটি আকাশের পানে তুলিয়া নির্জনে দেশের দুর্দশা চিন্তা করে। দিনের পর দিন এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে তাহার নিম্পাপ কুমারী-মনে উদয় হইল কে তাহাকে বলিতেছে-তুমি ফ্রান্সের রক্ষাকত্রী, তুমি গিয়া রাজসৈন্য জড়ো করো, অস্ত্র ধরো, দেশের জাতির পরিত্রামের ভার তোমার হাতে। দেবী মেরী তাহার উৎসাহদাত্রী-দূর স্বৰ্গ হইতে তাঁহার আহ্বান আসে দিনের পর দিন। তারপর নব্বতেজোদৃপ্ত ফরাসি সৈন্যবাহিনী কি করিয়া শত্রুদলকে দেশ হইতে তাড়াইয়া দিল, কি করিয়া ভাবময়ী কুমারী নিজে অস্ত্র ধরিয়া দেশের রাজাকে সিংহাসনে বসাইলেন, তাব।পর অজ্ঞানান্ধ লোকে কি করিয়া তাহাকে ডাইনি অপবাদে জীবন্ত পুড়াইয়া মারিল, এ সকল কথাই সে আজ পড়িয়াছে।

    এই বৈকাল বেলাটাতে, এই শান্ত নদীর ধারে গল্পটি ভাবিতে ভাবিতে কি অপূর্ব ভাবেই তাহার মন পূর্ণ হইয়া যায়!-কুমারীর যুদ্ধের কথা, জয়ের কথা, অন্য সব কথা সে তত ভাবে না। কিন্তু যে ছবিটি তাহার বার বার মনে আসে, তাহা শুধু নির্জন প্রান্তরে চিন্তারতা বালিকা আর চারিধারে যাদৃচ্ছিবিচরণশীল মেষদল, নিম্নে শ্যাম তৃণভূমি, মাথার উপর মুক্ত নীল আকাশ। একদিকে দুর্ধর্ষ বৈদেশিক শত্ৰু, নিষ্ঠুরতা, জয়লালসার দপ, রক্তস্রোত,-অপরদিকে এক সরলা, দিব্য ভাবময়ী নীলনীযনা পল্লীবালিকা। ছবিটা তাহার প্রবর্ধমান বালকমনকে মুগ্ধ করিয়া দেয়।

    আরও ছবি মনে আসে। কতদূরের নীল-সমুদ্র-ঘেরা মাটিনিক দ্বীপ। চারিদিকে আখের খেত, মাথার উপর নীল আকাশ-বহু-বহু দূর-শুধু নীল আকাশ আর নীল সমুদ্র!—শুধু নীল আর নীল! আরও কত কি, তাহা বুঝানো যায় না-বলা যায় না।

    ছিপ গুটাইয়া সে বাড়ির দিকে যাইবার জোগাড় করে। নদীর ধারে ধারে নতশীর্ষ বাবলা ও সাইবাবলার বন নদীর স্নিগ্ধ কালো জলে ফুলের ভার ঝরাইয়া দিতেছে। সোনাডাঙা মাঠের মাঝে ঠাঙাড়ে বটগাছটার আড়ালে প্ৰকাণ্ড রক্তবর্ণ সূর্য হেলিয়া পড়িয়াছে’-যেন কোন দেবশিশু অলকার জুলন্ত ফেনিল সোনার সমুদ্র হইতে ফু দিয়া একটা বুদ্ধৃদ তুলিয়া খেলাচ্ছলে আকাশে উড়াইয়া দিয়াছিল, এইমাত্র সেটা পশ্চিম দিগন্তে পৃথিবীর বানান্তরালে নামিয়া পড়িতেছে!

    পিছন হইতে কে তাহার চোখ টিপিয়া ধরিল। সে জোর করিয়া হাত দিয়া চোখ ছাড়াইয়া লাইতেই পটু খিলখিল করিয়া হাসিয়া সামনে আসিয়া বলিল-তোকে খুঁজে খুঁজে কোথাও পাইনে অপুদা, তারপল ভাবলাম তুই ঠিক মাছ ধর্তে এইছিস, তাই এলাম। মাছ হয়নি?…একটাও না? চল বরং একখানা নৌকা খুলে নিয়ে বেড়িয়ে আসি –যাবি?

    কদমতলায় সাহেবের ঘাটে অনেক দূরদেশ হইতে নৌকা আসে,–গোলপাতা-বোঝাই, ধানবোঝাই, ঝিনুক-বোঝাই নৌকা সারি সারি বাঁধা। নদীতে জেলেদের ঝিনুক-তোলা নৌকায় বড় জাল ফেলিয়াছে। এ সময় প্রতি বৎসরই ইহারা দক্ষিণ হইতে ঝিনুক তুলিতে আসে; মাঝ নদীতে নৌকায় নৌকায় জোড়া দিয়া দাঁড় করিয়া রাখিয়াছে। অপু ডাঙায় বসিয়া দেখিতেছিল,—একজন কলোমতো লোক বার বার ড়ুব দিয়া ঝিনুক খুঁজতেছে ও অল্পীক্ষণ পরে নৌকার পাশে উঠিয়া হাতের থলি হইতে দু’চারিখানা কুড়ানো ঝিনুক বালি-কাদার রাশি হইতে ছাঁকিয়া নৌকার খোলে ছুড়িয়া ফেলিতেছে। অপু খুশির সহিত পটুকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-দেখছিস পটু, কতক্ষণ ড়ুব দিয়ে থাকে? আয় গুনে দেখি এক-দুই করে! পারিস তুই অতক্ষণ ড়ুবে থাকতে?…

    নদীর দুর্বাঘাস-মোড়া তীরটি ঢালু হইয়া জলের কিনারা পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে, এখানে-ওখানে বোঝাই নৌকায় খোটা পোঁতা-নোঙর ফেলা। ইহারা কত দেশ হইতে আসিয়াছে, কত বড় নদী খাল পার হইয়া, বড় বড় নোনা গাঙের জোয়ার-ভাটা-তুফান খাইয়া বেড়ায়,–অপুর ইচ্ছা করে মাঝিদের কাছে বসিয়া সে সব দেশের গল্প শোনে। তাহার কেবল নদীতে নদীতে সমুদ্রে সমুদ্রে বেড়াইতে ইচ্ছা হয়, আর কিছু সে চায় না। সুরেশের বইখানাতে নানা দেশের নাবিকদের কথা পড়িয়া অবধি ওই ইচ্ছাই তাহার মনে প্রবল হইয়া উঠিয়াছে! পটু ও সে নৌকার কাছে গিয়া দর করে-ও মাঝি, এই গোলপাতা একপাটি কি দর?…তোমার এই ধানের নৌকো কোথাকার, ও মাঝি?…ঝালকাঠির? সে কোন দিকে, এখান থেকে কতদূর?…

    পটু বলিল-অপু-দা, চল তেঁতুলতলার ঘাটে একখানা ডিঙি দেখি, একটু বেড়িয়ে আসি চল। দুজনে তেঁতুলতলার ঘাট হইতে একখানা ছোট্ট ডিঙি খুলিয়া লইয়া, তাহাকে এক ঠেলা দিয়া ডিঙির উপর চড়িয়া বসিল। নদীজলের ঠাণ্ডা আদ্ৰ গন্ধ উঠিতেছে, কলমি-শাকের দামে জলপিপি বসিয়া আছে, চরের ধারে-ধারে চাষীরা পটলক্ষেত নিড়াইতেছে, কেহ ঘাস কাটিয়া আঁটি বাঁধিতেছে, চালতেপোতার বাঁকে তীরবতী ঘন ঝোপে গাঙশালিকের দল কলরব করিতেছে, পড়ন্ত বেলায় পুব আকাশের গায়ে নানা রঙের মেঘস্তুপ।

    পটু বলিল-অপু-দা একটা গান কর না? সেই গানটা সেদিনের!

    অপু বলিল–সেটা না। বাবার কাছে সুর শিখে নিয়েছি একটা খুব ভালো গানের। সেইটে গাইবো, আর-এাষ্ট্র ওদিকে গিয়ে কিন্তু ভাই, এখানে ডাঙায় ওই সব লোক রয়েচে—এখানে না।

    –তুই ভারি লাজুক অপু-দা। কোথায় লোক রয়েচে কতদূরে, আবাঁ তোল গান গাইতে-দূৰ, ধরা সেইটো!

    খানিকটা গিয়া অপু গান শুরু করে। পটু বাঁশের চটার বৈঠাখানা তুলিয়া লইয়া নৌকোর গলুইএ চুপ করিয়া বসিয়া একমনে শোনে; নৌকা বাহিবার আবশ্যক হয় না, স্রোতে আপনা- আপনি ভাসিয়া ডিঙিখানা ঘুরিতে ঘুরিতে লা-ভাঙার বড় বাঁকের দিকে চলে। অপুর গান শেষ হইলে পটু একটা গান ধরিল। অপু এবার বাহিতেছিল। নৌকা কম দূরে আসে নাই–লা-ভাঙার বাঁকটা নজরে পড়িতেছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ পটু ঈশানকোণের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বুলিল– ও অপু দা, কি রকম মেঘ উঠেচে দেখছিস! এখুনি ঝড় এলো বলে-নৌকা ফেরাবি?

    অপু বলিল-হোকগে ঝড়, ঝড়েই তো নৌকা বাইতে–গান গাইতে লাগে ভালো, চল আরও যাই।

    কথা বলিতে বলিতে ঘন কালো মেঘখানা মাধবপুরের মাঠের দিক হইতে উঠিয়া সারা আকাশ ভরিয়া ফেলিল, তাহার কালো ছায়া নদীজল ছাইয়া ফেলিল। পটু উৎসুক চোখে আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। অনেক দূরে সো সে রব উঠিল, একটা অস্পষ্ট গোলমালের সঙ্গে অনেক পাখির কলরব শোনা গেল, ঠাণ্ডা হাওয়া রহিল, ভিজা মাটির গন্ধ ভাসিয়া আসিল। পাখাওয়ালা আকোদর বীজ মাঠের দিক হইতে অজস্র উড়িয়া আসিতে লাগিল, দেখিতে দেখিতে গাছপালা মাথা লুটাই যা দোলাইয়া ভাঙিয়া ভীষণ কালবৈশাখীর ঝড় উঠিল।

    নদীর জল ঘন কালো হইয়া উঠিল, তীরের সাইবাবলা ও বড় বড় ছাতিম গাছের ডালপালা ভাঙিয়া পড়িবার উপক্ৰম হইল, সাদা বকের দল কালো আকাশের নিচে দীর্ঘ সারি বাঁধিয়া উড়িয়া পলাইল! অপুর বুক ফুলিয়া উঠিল, উৎসাহে উত্তেজনায় সে হাল ছাড়িয়া চারিধারে চাহিয়া ঝড়ের কাণ্ড দেখিতে লাগিল, পটু কেঁচার কাপড় খুলিয়া ঝড়ের মুখে পালের মতো উড়াইয়া দিতেই বাতাস বাধিয়া সেখানা ফুলিয়া উঠিল।

    পটু বলিল-বড্ড মুখোড় বাতাস অপু-দা, সামনে আর নৌকা যাবে না। কিন্তু যদি উলটে যায়? ভাগ্যিস সুনীলকে সঙ্গে করে আনিনি!

    অপু কিন্তু পটুর কথা শুনিতেছিল না, সেদিকে তাহার কান ছিল না-মনও ছিল না। সে নৌকার গলুইয়ে বসিয়া একদৃষ্টি ঝটিকাঙ্কুব্ধ নদী ও আকাশের দিকে চাহিয়া ছিল। তাহার চারিধারে কালো-নদীর নর্তনশীল জল, উড়ন্ত বকের দল, ঝোড়ো মেঘের রাশি, দক্ষিণ দেশের মাঝিদের ঝিনুকের স্তুপগুলা, স্রোতে ভাসমান কচুরিপানার দাম সব যেন মুছিয়া যায়! নিজেকে সে “বঙ্গবাসী’ কাগজের সেই বিলাত-যাত্রী কল্পনা করে! কলিকাতা হইতে তাহার জাহাজ ছাড়িয়াছে; বঙ্গোপসাগরের মোহনায় সাগরদ্বীপ পিছনে ফেলিয়া সমুদ্র-মাঝের কত অজানা ক্ষুদ্র দ্বীপ পার হইয়া, সিংহল-উপকূলের শ্যামসুন্দর নারকেলবনশ্ৰী দেখিতে দেখিতে কত অপূর্ব দেশের নীল পাহাড় দূরচক্রবালে রাখিয়া, সূর্যাস্তের রাঙা আলোয় অভিষিক্ত হইয়া, নতুন দেশের নব নব দৃশ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়া চলিয়াছে!-চলিয়াছো-চিলিয়াছে!

    এই ইছামতীর জলের মতোই কালো, গভীর ক্ষুব্ধ, দুরের সে অদেখা সমুদ্রবক্ষ; এই রকম সবুজ বনঝোপ আরব সমুদ্রের সে দ্বীপটিতেও। সেখানে এইরকম সন্ধ্যায় গাছতলায় বসিয়া এডেন বন্দরে সেই বিলাত-যাত্রী লোকাটিব মতো সে রূপসী আরবী মেয়ের হাত হইতে এক গ্লাস জল চাহিয়া লইয়া খাইবে। চালিতেপোতার বাকের দিকে চাহিলে খবরের কাগজে বৰ্ণিত জাহাজের পিছনেব সেই উড়নশীল জলচর পক্ষীর বাঁককে সে একেবারে স্পষ্ট দেখিতে পায় যেন!..

    সে ওই সব জায়গায় যাইবে, ওই সব দেখিবে, বিলাত যাইবে, জাপান যাইবে, বাণিজ্যযাত্রা করিবে, বড় সওদাগর হইবে, অনবরত দেশে-বিদেশে সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরিবে, বড় বড় বিপদের মুখে পড়িবে; চীনসমুদ্রের মধ্যে আজিকার এই মনমাতানো কালবৈশাখীর ঝড়েব মতো বিষম ঝড়ে তাহার জাহাজ ড়ুবু ড়ুবু হইলে “আমার অপূর্ব ভ্ৰমণ’-এ পঠিত নাবিকদের মতো সেও জালি-বোটে করিয়া ড়ুবোপাহাড়ের গায়ে-লগা গুগলি-শামুক পুড়াইয়া খাইতে খাইতে অকূল দরিযায় পাড়ি দিবে! ওই যে মাধবপুর গ্রামের বাশবনের মাথায় তুতে রং-এর মেঘের পাহাড় খানিকটা আগে ঝুঁকিয়া ছিল— ওরই ওপারে সেই সব নীল-সমুদ্র, অজানা বেলাভূমি, নারিকেলকুঞ্জ, আগ্নেয়গিরি, তুষাববষী প্রান্তর, জেলেখা, সরযু, গ্রেস ডার্লিং, জুটুফেন, গাঙচিল-পাখির-ডিম-আহরণরতা সেই সব সুশ্ৰী ইংরাজ বালক-বালিকা, সোনাকর জাদুকর বটগার, নির্জন প্ৰান্তরে চিস্তারিতা লোরেনের সেই নীলনয়না পল্লীবালা জোয়ান-আরও কত কি আছে! তাহার টিনের বাক্সের বই কখানা, রানু-দিদিদের বাড়ির বইগুলি, সুরেশ-দাদার কাছে চাহিয়া লওয়া বইখানা, পুরাতন “বঙ্গবাসী’ কাগজগুলো ওই সব দেশের কথাই তাহকে বলে; সেসব দেশে কোথায় কাহারা যেন তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। সেখান হইতে তাহারও ৬কি আসিবে একদিন-সো-ও যাইবে!

    এ কথা তাহার ধারণায় আসে না কতদূরে সে সব দেশ, কে তাহাকে লইয়া যাইবে, কি করিয়া তাহার যাওয়া সম্ভব হইবো! আর দিনকতক পরে বাড়ি-বাড়ি ঠাকুরপূজা করিয়া যাহাবের সংসার চালাইতে হইবে, রাত্রিতে যাহার পড়িবার তেলের জন্য মায়ের বকুনি খাইতেও হয়, অত বয়স পর্যন্ত যে ইস্কুলের মুখ দেখিল না, ভালো কাপড়, ভালো জিনিস যে কাহাকে বলে জানে না-সেই মূর্খ, অখ্যাত সহায়-সম্পদহীন পল্লীবালককে বৃহত্তর জীবনের আনন্দ-যজ্ঞে যোগ দিতে কে আহ্বান করিবে?

    এ সব প্রশ্ন মনে জাগিলে হয়তো তাহার তরুণ-কল্পনার রথবেগ-তাহার আশাভরা জীবনপথের দুর্বর মোহ, সকল ভয় সকল সংশয়কে জয় করিতে পারিত; কিন্তু এসকল কথা তাহার মনেই ওঠে না। শুধু মনে হয়-বড় হইলেই সব হইবে, অগ্রসর হইলেই সকল সুযোগ-সুবিধা পথের মাঝে কুড়াইয়া পাইবে…এখন শুধু বড় হইবার অপেক্ষা মাত্র। সে বড় হইলে সুযোগ পাইবে, দিক দিক হইতে তাহার সাদর আমন্ত্রণ আসিবো,-সে জগৎ জানার, মানুষ চেনার দিগ্বিজয়ে যাইবে।

    রঙিন ভবিষ্যৎ জীবন-স্বপ্নে বিভোর হইয়া তাহার বাকি পথটুকু কাটিয়া যায়। বৃষ্টি আর পড়ে না, ঝড়ে কালো মেঘের রাশি উড়াইয়া আকাশ পরিষ্কার করিয়া দিতেছিল। তেঁতুলতলার ঘাটে ডিঙি ভিড়িতেই তাহার চমক ভাঙে; নৌকা বাঁধিয়া পটুর আগে আগে সে বাঁশবনের পথে উল্লাসে শিস্য দিতে দিতে বাড়ির দিকে চলে। সে-ও তাহার মা ও দিদির মতো স্বপ্ন দেখিতে শিখিয়াছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.