Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প391 Mins Read0

    ৩০. অক্রুর সংবাদ

    অক্রুর সংবাদ
    ৩০. ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    দুপুরের পর রানাঘাট স্টেশনে গাড়ি বদল করিতে হইল। অপুর চোখে দু-দুবার কয়লার গুঁড়া পড়া সত্ত্বেও সে গাড়ির জানোলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া সারাদিনটা বাহিরের দিকে চাহিয়া আছে। স্টেশনে স্টেশনে। ওগুলাকে কি বলে? সিগন্যাল? পড়িতেছে উঠিতেছে কেন? গাড়ি যেখানে লাগিতেছে সেখানটা উঁচুমতো ইটের গাথা, ঠিক যেন রোয়াকের মতো। তাকে প্ল্যাটফর্ম বলে? কাঠের গায়ে বড় বড় অক্ষরে ইংরাজি ও বাংলাতে সব স্টেশনের নাম লেখা আছে-কুড়ুলগাছি, গোবিন্দপুর, বানপুর। গাড়ি ছাড়িবার সময় ঘণ্টা পড়ে-ঢং ঢেং ঢেং ঢেং-চার ঘা-অপু গুনিয়াছে, একটা বড় লোহার চাকার চারিধারে হাতলপরানো, তাহাই ঘুরাইলে সিগন্যাল পড়ে-কুড়ুলগাছি স্টেশনে অপু লক্ষ করিয়া দেখিল।

    সর্বজয়া এবার লইয়া মোটে দুইবার রেলে চড়িল। আর একবার সেই কোন কালে–উনি তখন নতুন কাশী হইতে আসিয়া দেশে সংসার পাতিয়াছেন-জ্যৈষ্ঠমাসে আড়ংঘটায় যুগলকিশোর ঠাকুর দেখিতে গিয়াছিল-সে কি আজকার কথা। সে খুশির সহিত স্টেশনে স্টেশনে মুখ লোকজনের ওঠা-নাম লক্ষ করিতেছিল—বউঝিরা উঠিতেছে নামিতেছে-কেমন সব চেহারা, কেমন কাপড়-চোপড়, গহনাপত্র। জগন্নাথপুর স্টেশনে ভালো মুড়ির মোয়া ফিরি করিতেছে দেখিয়া সে ছেলেকে বলিল-অপু, মুড়ির মোয়া খাবি? তুই তো ভালোবাসিস, নেবো তোর জন্যে? টেলিগ্রাফের তারের ওপর কি পাখি বসিয়া দোল খাইতেছে, অপু ভালো করিয়া চাহিয়া চাহিয়া আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-দ্যাখো মা, কাদের বাড়ির খাঁচা থেকে একটা ময়নাপাখি পালিয়ে এসেচে।

    নৈহাটি স্টেশনে গাড়ি বদলাইয়া গঙ্গার প্রকাণ্ড পুলটার উপর দিয়া যাইবার সময় সূর্য অস্ত যাইতেছিল, সর্বজয়া একপৃষ্টে চাহিয়া ছিল-ওপার হইতে হু হু বাতাস বহিতেছে, গঙ্গার জলে নৌকা, দুপারে কত ভালো ভালো বাড়ি বাগান, এ সব দৃশ্য জীবনে সে কখনও দেখে নাই। ছেলেকে দেখাইয়া বলিল-দেখেচিস অপু, একখানা ধোঁয়ার জাহাজ? পরে সে যুক্তকর কপালে ঠেকাইয়া আপন মনে বলিল-মা গঙ্গা, তোমার ওপর দিয়ে যাচ্চি, অপরাধ নিয়ো না মা, কাশীতে গিয়ে ফুলবিথিপত্রে তোমায় পুজো করবো, অপুকে ভালো রেখো, যে জন্যে যাওয়া তা যেন হয়, সেখানে যেন আশ্রয় হয় মা–

    আনন্দে পুলকে, অনিশ্চিততার রহস্যে তার হৃদয় দুলিতেছিল-এরকম মনোভাব এর আগে সে কখনও অনুভব করে নাই। সুবিধায় হৌক, অসুবিধায় হৌক, অবাধ মুক্ত জীবনের আনন্দ সে পাইল এই প্ৰথম, তার চিরকালের বাঁশবনের বেড়া ঘেরা ক্ষুদ্র সীমায় বদ্ধ পল্পীজীবনে এরকম সচল দৃশ্যরাজি, এরকম অভিনব গতির বেগ, এত অনিশ্চয়ের পুলকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় কখনও হয় নাই—যে জীবন চারিধারে পাঁচিল দেওয়াল তুলিয়া আপনাকে আপনি ছোট করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা আজ চলিয়াছে, চলিয়াছে, সম্মুখে চলিয়াছে-ওই পশ্চিম আকাশের অস্তমান সূর্যকে লক্ষ করিয়ানদ-নদী, দেশবিদেশ-ডিঙাইয়া ছুটিয়াছে-এই চলিয়া চলার বাস্তবতাকে সে প্রতি হৃদয় দিয়া অনুভব করিতেছিল আজ।-এই তো সেদিন এক বৎসর আগেও নিশ্চিন্দিপুবের বাড়িতে কত রাত্রে শুইয়া যখনই সে ভাবিত, সুবিধা হইলে একবার চাকদা কি কালীগঞ্জে গঙ্গাস্নানে যাইবে, তখনই তাহা সম্ভবের ও নিশ্চয়তার বহু বাহিরের জিনিস বলিয়া মনে হইয়াছে।–আর আজ?

    ব্যান্ডেল স্টেশনে গাড়ি আসিবার একটু আগে সম্মুখের বড় লাইন দিয়া একখানা বড় গাড়ি হু হু শব্দে ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া চলিয়া গেল। অপু বিস্ময়ের সঙ্গে সেদিকে চাহিয়া রহিল। কি আওয়াজ!–উঃ! ব্যান্ডেল স্টেশনে পৌঁছিয়া তাহারা গাড়ি হইতে নামিল। এদিকে-ওদিকে এঞ্জিন দৌড়িতেছে, বড় বড় মালগাড়িগুলা স্টেশন কাঁপাইয়া প্রতি পাঁচমিনিট অন্তর না থামিয়া চলিয়া যাইতেছে। হৈ হৈ শব্দ-এদিকে এঞ্জিনের সিটির কানে-তাল-ধরা আওয়াজ, ওদিকে আর একখানা যাত্রীগাড়ি ছাড়িয়া যাইতেছে, গার্ড সবুজ নিশান দুলাইতেছে-সন্ধ্যার সময় স্টেশনের পূর্বে পশ্চিমে লাইনের ওপব এত সিগন্যাল ঝাঁকে ঝাঁকে-লাল সবুজ আলো জুলিতেছে-রেল, এঞ্জিন, গাড়ি, লোকজন!–

    একটু রাত্রি হইলে তাঁহাদের কাশী যাইবার গাড়ি আসিয়া বিকট শব্দে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইল। বিশাল স্টেশন, বেজায় লোকের ভিড়-সর্বজয়া কেমন দিশেহারা হইয়া গেল।–তাড়া খাইয়া অনভ্যস্ত আড়ষ্ট পায়ে পায়ে স্বামীর পিছনে এখাখানা কামরার দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইতেই হরিহর অতিকষ্টে দুর্জয় ভিড় ঠেলিয়া বেপথুমান স্ত্রীকে ও দিশেহারা পুত্ৰকে কায়ক্লেশে গাড়ির বেঞ্চিতে বসাইয়া দিয়া কুলির সাহায্যে মোট–গাঁট উঠাইয়া দিল।

    ভোরের দিকে সর্বজয়ার তন্দ্ৰা গেল ছুটিয়া। ট্রেন ঝড়ের বেগে ছুটিয়াছে-মাঠ, মাটি, গাছপালা একাকার করিয়া ছুটিয়াছে।–রাত্রের গাড়ি বলিয়া, তাহারা সকলে এক গাড়িতেই উঠিয়াছে-হরিহর তাহাকে মেয়ে-কামরায় দেয় নাই। গাড়িতে ভিড় আগের চেয়ে কম-এক এক বেঞ্চে এক একজন লম্বা হইয়া শুইয়া ঘুমাইতেছে। উপরের বেঞ্চে একজন কাবুলী নাক ডাকাইতেছে। অপু কখন উঠিয়া হ্যাঁ করিয়া জানোলা দিয়া মুখ বাহির করিয়া একদৃষ্টি চাহিয়া আছে।

    হরিহর জাগিয়া উঠিয়া ছেলেকে বলিল-ওরকম করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে না। খোকা, এখখুনি চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়বে।–

    কয়লার গুঁড়া তো নিরীহ জিনিস, চোখ দুটা যদি উপড়িাইয়া চলিয়াও যায়। তবুও অপুর সাধ্য নাই যে, জানালার দিক হইতে এখন সে চোখ ফিরাইয়া লইতে পাবে। সে প্রায় সারারাত্ৰি ঠায় এইভাবে বসিয়া। বাবা মা তো ঘুমাইতেছিল-সে যে কত কি দেখিয়াছে। কত স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ায় নাই, আলো লোকজন সুদ্ধ স্টেশনটা বুশ করিয়া হাউইবাজির মতো পাশ কাটাইয়া উড়িয়া চলিয়া যাইতেছিল-রাত্রে কখন তাহার একটু তন্দ্ৰা আসিয়াছিল, হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া যাইতেই সে মুখ বাহির করিয়া দেখিল যে, গভীর রাত্রির জ্যোৎস্নায় রেলগাড়িখানা ঝড়ের বেগে একটা কোন নদীর ছোট সাঁকো পার হইতেছে-সামনে খুব উঁচু একটা কালোমতো টিবি, টিবিটার ওপরে অনেক গাছপালা, নদীর জলে জ্যোৎস্না পড়িয়া চিক চিক করিয়া উঠিল, আকাশে সাদা সাদা মেঘ-তারপর সেই ধরনের বড় বড় আরও কয়েকটা টিবি, আরও সেই রকম গাছপালা। তাহার পর একটা বড় স্টেশন, লোকজন, আলো-পাশের লাইনে একখানা গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিল–একজন পানওয়ালার সঙ্গে একটা লোকের যা ঝগড়া হইয়া গেল।-স্টেশনে একটা বড় ঘড়ি ছিল-সে তাহার মাস্টার মশায় নীরেনবাবুর কাছে গাড়ি দেখিতে শিখিয়াছিল, গুনিয়া গুনিয়া দেখিল রাত্রি তিনটা বাজিয়া বাইশ মিনিট হইয়াছে। তারপর আবার গাড়ি ছাড়িল-আবার কত গাছ, আবার সেই ধরনের উঁচু উঁচু টিবি-অনেক সময়ে রেলের রাস্তার দুধারেই সেইরকম টিবি-গাড়িতে সবাই ঘুমাইতেছে, ইহারা যদি কিছু দেখিবে না। তবে রেলগাড়ি চড়িয়াছে যে কোন! কাহাকে সে জিজ্ঞাসা করে যে অত টিবি কিসের? এক-একবার সে জানোলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া বুকিয়া মাটির দিকে চাহিয়া নিবৃপণ করিবার চেষ্টা কবিতেছিল গাড়িখানা কত জোরে যাইতেছে- চুল বাতাসে উড়িয়া মুখে পড়ে, মাটি দেখা যায় না, যেন কে মাটির গায়ে কতকগুলি সরল রেখা টানিযা চলিয়াছে- উঃ! রেলগাড়ি কি জোরে যায়!—কৌতুহলে, উত্তেজনায় সে একবার এদিকের জানালায়, একবার ওদিকের জানালায় মুখ বাড়াইয়া দেখিতেছিল।

    মাঝে মাঝে পূর্বদিকের দ্রুতবিলীয়মান অস্পষ্ট জ্যোৎস্নাভিরা মাঠের দিকে চাহিয়া চাহিয়া তাহার মনে হইতেছিল, কত দূরে তাহারা আসিয়াছে! এসব কোন দেশের উঁচু নিচু মাঠ দিয়া তাহারা চলিয়াছে?

    সকালের দিকে সে আবার একটু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, একটা প্ৰকাণ্ড স্টেশনে সশব্দে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইতেই তাহার। তন্দ্ৰা দুটিয়া গেল-প্ল্যাটফর্মের পাথরের ফলকে নাম লেখা আছে– পাটনা সিটি।

    তাহার পর কত স্টেশন চলিয়া গেল। কি বড় বড় পুল! গাড়ি চলিয়াছে, চলিয়াছে, মনে হয় বুঝি পুলটা শেষ হইবে না-কত ধরনের সিগন্যাল, কত কল-কারখানা, একটা কোন স্টেশনের ঘরের মধ্যে একটা লোহার থামের গায়ে চোঙ্‌লাগানো মতো।–তাহারই মধ্যে মুখ দিয়া একজন রেলের বাবু কি কথা কহিতেছে-প্রাইভেট নম্বর?…হ্যাঁ আচ্ছা-সিক্সটি নাইন-সিক্সটি নাইনহ্যাঁ?…ঊনসত্তর… ছয়ের পিঠে নয়-হ্যাঁ-হ্যাঁ–

    সে অবাক হইয়া বাবাকে জিজ্ঞাসা করিল-ও কি কল বাবা? ওর মধ্যে মুখ দিয়ে ওরকম বলচে কেন?

    তখন বেলা খুব পড়িয়া গিয়াছে, এমন সময় হরিহর বলিল-এইবার আমরা কাশী পৌঁছে যাবো, বাঁ দিকে চেয়ে থেকে, গঙ্গার পুলের উপর গাড়ি উঠলেই কাশী দেখা যাবে–

    অপু একটা কথা অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতেছিল। আজ সে সারা পথ টেলিগিরাপের তার ও খুঁটি দেখিতে দেখিতে আসিতেছে–সেই একটিবার ছাড়া এমন করিয়া এর আগে কখনও দেখে নাই জীবনে। এইবার যদি সে রোল-রেল খেলার সুযোগ পায়, তখনই সে ওই ধরনের তারে খুঁটি বসাইবে। কি ভুলটাই করিত আগে! যেখানে যাইতেছে, সেখানকার বনে গুলঞ্চলতা পাওয়া যায় তো?

     

    দিন পনেরো কাটিয়া গিয়াছে। বাঁশফট্‌কা গলির একখানা মাঝারি গোছের তেতলা বাড়ির একতলায় হরিহর বাসা লইয়া আছে। কোনো পূর্বপরিচিত লোকের সন্ধান সে মিলাইতে পারে নাই। আগে যাহারা যেসব জায়গায় ছিল, এখন সেসব স্থানে তাহদের সন্ধান কেহ দিতে পারে না। কেবল বিশ্বেশ্বরের গলির পুরাতন হালুইকর রামগোপাল সাহু এখনও বাঁচিয়া আছে।

    বাড়ির ওপরের তলায় একজন পাঞ্জাবী সপরিবারে থাকে, মাঝের তলায় এক বাঙালি ব্যবসায়ী থাকে, বাইরের ঘরটা তার দোকান ও গুদাম-আশেপাশের দু’তিন ঘরে তার রন্ধন ও শয়নঘর।

    এ পাঁচ ছয় দিনে সর্বজয়া নিকটবর্তী সকল জায়গা স্বামীর সঙ্গে ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিয়াছে। স্বপ্নেও কখনও সে এমন দৃশ্যের কল্পনা করে নাই,–এমন মন্দির! এমন ঠাকুর-দেবতা! এত ঘরবাড়ি! আড়ংঘাটার যুগলকিশোরের মন্দির এতদিন তাহার কাছে স্থাপত্য-শিল্পের চরম উৎকর্ষের নিদর্শন জানা ছিল–কিন্তু বিশ্বনাথের মন্দির?-অন্নপূর্ণার মন্দির? দশাশ্বমেধ ঘাটের ওপরকার লালপাথরের মন্দিরগুলা?

    মধ্যে একদিন সে পাঞ্জাবী ভদ্রলোকটির স্ত্রীর সঙ্গে রাত্রে বিশ্বনাথের আরতি দেখিতে গিয়াছিল-সে যে কি ব্যাপার তাহা সে মুখে বলিতে পারে না। ধূপ-ধুনার ধোঁয়ায় মন্দির অন্ধকার হইয়া গেল-সাত-আটজন পূজারী একসঙ্গে মন্ত্র পড়িতে লাগিল—কি ভিড়, কি জাঁকজমক, কত বড় ঘরের মেয়েরা দেখিতে আসিয়াছিল, তাহাদের বেশভুষারই বা কি বাহার! কোথাকার একজন রানী আসিয়াছিলেন–সঙ্গে চার-পাঁচজন চাকরানী। দামি বারাণসী শাড়ি পরনে, সোনার কন্ধাবসানো আঁচলটা আরতির পঞ্চপ্রদীপের আলোয় আগুনের মতো জুলিতেছিল–কি টানা ডাগর চোখ-কি ভুবু কি মুখশ্ৰী-সত্যিকার রানী সে কখনও দেখে নাই-গল্পেই শুনিয়াছে-হ্যাঁ, রানীর মতো রূপ বটে! তাহাকে বেশিক্ষণ ধরিয়া দেখিয়াছে, কি ঠাকুরের আরতি বেশিক্ষণ দেখিয়াছে, তাহা সে জানে না।

    ঠাকুর-দেবতার মন্দির ছাড়া এক-একখানা বসতবাড়িই বা কি!.দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রণে নিশ্চিন্দিপুরের গাঙ্গুলি-বাড়ি গিয়া সে গাঙ্গুলিদের নাটমন্দির, দো-মহলা বাড়ি, বাঁধানো পুকুরঘাট দেখিয়া মনে মনে কত ঈর্ষান্বিত হইত—মনে আছে একবার দুৰ্গাকে বলিয়াছিল–দেখেচিস বড়লোকের বাড়িঘরের কি লক্ষ্মছিরি?—এখন সে যেসব বাড়ি রাস্তার দুধারে দেখিতেছে—তাহার কাছে গাঙ্গুলি-বাড়ি–

    এত গাড়িঘোড়া একসঙ্গে যাইতে কখনও সে দেখে নাই। গাড়িই বা কত ধরনের! আসিবার দিন রানাঘাটে, নৈহাটিতে সে ঘোড়ার গাড়ি দেখিয়াছে বটে, কিন্তু এত ধরনের গাড়ি সে আগে কখনও দেখে নাই। দু-চাকার গাড়িই যে কত যায়!..তাহার তো ইচ্ছা করে পথের ধারে দাঁড়াইয়া দুদণ্ড এইসব দ্যাখে-কিন্তু পাঞ্জাবী স্ত্রীলোকটি সঙ্গে থাকে বলিয়া লজ্জায় পারে না।

    অপু তো একেবারে অবাক হইয়া গিয়াছে। এরকম কাণ্ডকারখানা সে কখনও কল্পনায় আনিতে পারে নাই। তাদের বাসা হইতে দশাশ্বমেধ ঘাট বেশি দূর নয়, রোজ বিকালে সে সেখানে বেড়াইতে যায়। রোজই যেন চড়কের মেলা লাগিয়াই আছে। এখানে গান হইতেছে, ওখানে কথা হইতেছে, ওদিকে কে একজন রামায়ণ পড়িতেছে, লোকজনের ভিড়, হাসিমুখ, উৎসব, অপু সেখানে শুধু ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইয়া দেখে আর সন্ধ্যার পর বাড়ি আসিয়া মহাউৎসাহে গল্প করে।

    কাহাদের চাকর একটি ছোট ছেলেকে কোমরে দড়ি বাঁধিয়া রোজ বেড়াইতে আনে, অপু ভাব করিয়াছে—তার নাম পল্টু, ভালো কথা কহিতে জানে না, ভারি চঞ্চল, তাই পাছে হারাইয়া যায় বলিয়া বাড়ির লোকেদের এই জেল-কয়েদির মতো ব্যবস্থা। অপু হাসিয়া খুন। চাকরকে অনুরোধ করিয়াছিল। কিন্তু সে ভয়ে দড়ি খুলিতে চাহে না। বন্দী নিতান্ত ক্ষুদ্র ও অবোধ-এ ধরনের ব্যবহার যে প্রতিবাদযোগ্য, সে জ্ঞানই তাহার নাই আসিলে সর্বজয়া রোজ তাহাকে বকে-একলা একলা ওরকম যাস কেন? শহর বাজার জায়গা, যদি রাস্তা হারিয়ে ফেলিস?…মায়ের আশঙ্কা যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, একথা সে মাকে হাত নাড়িয়া দুবেলা অধ্যবসায়-সহকারে বুঝায়।

    কাশীতে আসিয়া হরিহরের আয়ও বাড়িল। কয়েক স্থানে হাঁটাহাঁটি করিয়া সে কয়েকটি মন্দিরে নিত্য পুরাণ-পাঠের কার্য জোগাড় করিল। তাহা ছাড়া একদিন সর্বজয়া স্বামীকে বলিল-দশাশ্বমেধ ঘাটে রোজ বিকেলে পুঁথি নিয়ে বোসো না কেন? কত ফিকিরে লোক পয়সা আনে, তোমার কেবল বসে বসে পরামর্শ আঁটা–

    স্ত্রীর তাড়া খাইয়া হরিহর কাশীখণ্ডের পুথি লইয়া বৈকালে দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে। পুরাণ পাঠ করা তাহার কিছু নতুন ব্যবসায় নহে, দেশে শিষ্য বাড়ি গিয়া কত ব্ৰতপার্বণ উপলক্ষে সে এ কাজ করিয়াছে। পুঁথি খুলিয়া সুস্বরে সে বন্দনা গান শুরু করে–

    বৰ্হপীড়াভিরামং মৃগমদতিলকং কুণ্ডলাক্রান্তগণ্ডং।
    …মিতসুভগামুখং স্বাধরে ন্যস্ত রেণুং
    …ব্রহ্মগোপালবেশিং।

    ভিড় মন্দ হয় না।

    বাসায় ফিরিয়া বালির কাগজে কি লেখে। স্ত্রীকে বলে, শুধু শ্লোক পড়ে গেলে কেউ শুনতে চায় না-ওই বাঙালি কথকটার ওখানে আমার চেয়ে বেশি ভিড় হয়-ভেবেচি গোটাকতক পালা লিখবো, গান থাকবে, কথকতার মতোও থাকবে নৈলে লোক জমে না-বাঙালটার সঙ্গে পরশু, আলাপ হল, দেবনাগরীর অক্ষর-পরিচয় নেই, শুধু ছড়া কেটে মেয়ে ভুলিয়ে পয়সা নেয়…আমার রেকবি কুড়িয়ে ছ’আনা, আট আনা, আর ওর একটা টাকার কম নয়…শুনবে একটু কেমন লিখচি?

    খানিকটা সে পড়িয়া শোনায়। বলে-ওই কথকের পুঁথি দেখে বনের বর্ণনাটা লিখে নেবো ভেবেচি—তা কি দেবে?

    –তুমি কোনখানটায় বসে কথা বলে বল তো? একদিন শুনতে যেতে হবে–

    –যেয়ো না, ষষ্ঠীর মন্দিরের নিচেই বসি-কালই যেয়ো, নূতন পালাটা বলবো, কাল একাদশী আছে দিনটা ভালো–

    -আসবার সময় বিশ্বেশ্বরের গলির দোকান থেকে চার পয়সার পানফলের জিলিপি এনো দিকি অপুর জন্যে-সেদিন ওপরের খোট্টা বউ কি পুজো করে আমায় ডেকে নিয়ে গিয়ে জল খেতে দিলে, বল্পে, পানফলের জিলিপি, বিশ্বেশ্বরের গলিতে পাওয়া যায়, খেতে গিয়ে ভাবলাম অপু জিলিপি খেতে বড় ভালোবাসে-তা জল খেতে দিয়েচে আমি আর কি বলে নিয়ে আসি-এনো দিকি আজ চার পয়সার।

     

    কয়েকদিন ধরিয়া হরিহরের কথকতা শুনিতে বেশ ভিড় হইতেছে। একখানা বড় বারকোশে করিয়া নারদঘাটের কালীবাড়ির ঝি বড় একটা সিধা আনিয়া অপুদের দাওয়ায় নামাইল। সর্বজয়া হাসিমুখে বলিল-আজ বুঝি বারের পুজো? উনি বাড়ি আসচেন দেখলে, হ্যাঁয়া ঝি? চলিয়া গেলে ছেলেকে ডাকিয়া বলিল-এদিকে আয় অপু-এই দ্যাখ! তোর সেই নারকেলের ফোঁপল-তুই ভালোবাসিস? কিশমিশ, কলা, কত বড় বড় আমি দেখেছিস, আয় খাবি, দিই-বোস এখানে

    উৎসাহ পাইয়া হরিহর পুরাতন খাতাপত্রের তাড়া আবার বাহির করে। সর্বজয়া বলেধ্রুবচরিত্র শুনতে শুনতে লোকের কান যে ঝালাপালা হল, নতুন একটা কিছু ধরো না?

    সারা সকাল ও দুপুর বসিয়া হরিহর একমনে জড়ভরতের উপাখ্যানকে কথকতার পালার আকারে লিখিয়া শেষ করে। মনে পড়ে এই কাশীতেই বসিয়া আজ বাইশ বৎসর পূর্বে যখন সে গীতগোবিদের পদ্যানুবাদ করে, তখন তাহার বয়স ছিল চব্বিশ বৎসর। দেশে গিয়া জীবনের উদ্দেশ্য যেন নিজের কাছে আরও পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। কাশীতে এত ছিল না-দেশে ফিরিয়া চারিধারে দাশূরায়ের গান, দেওয়ানজীর গান, গোবিন্দ অধিকারীর শুকসারীর দ্বন্দ্ব, লোকা ধোপার দলের মতি জুড়ির গানের বিস্তৃত প্রচলন ও পাসার তাহার মনে একটা নতুন ধরনের প্রভাব বিস্তার করিল।

    রাত্রে স্ত্রীর কাছে গল্প করিত-বাজারের বারোয়ারিতে কবির গান হচ্ছে বুঝলে? বসে বসে শুনলাম, বুঝলে?…সোজা পদ সব.কিছুই না, রও না, সংসারটা একটু গুছিয়ে নিয়ে বসি ভালো হয়ে-নতুন ধরনের পালা বাঁধবো- এরা সকলে গায় সেই মান্ধাতার আমলের পদ-রাজুকে তাই কাল বলছিলাম।

    অনেক রাত্রে উঠিয়া এক-একদিন হরিহর বাহিরে দাওয়ায় বসিয়া কি ভাবিত, অনির্দিষ্ট কোন আনন্দে তাহার মন যেন পালকের মতো হালকা হইয়া উঠিত।

    কি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তাহার সম্মুখে!…

    ঝাড়লন্ঠনের আলো-দোলানো বড় আসরে সে দেখিতে পায়, দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে তাহার ছড়া, গান, শ্যামাসংগীত, পদ রাত্রির পর রাত্রি ধরিয়া গাওনা হইতেছে। কত দূর-দূরান্তর হইতে মাঠ ঘাট ভাঙিয়া লোক খাবারের পুঁটুলি বাঁধিয়া আনিয়া বসিয়া আছে শুনিতে। দলের অধিকারীরা তাহার বাড়ি আসিয়া সাধিয়া পালা চাহিয়া লইয়া গিয়াছে।

    বাঃ! ভারি চমৎকার তো। কার বাঁধা ছড়া?—‘কবির গুরু ঠাকুর হবু-’ হরু ঠাকুরের?– না। নিশ্চিন্দিপুরের হরিহর রায় মহাশয়ের।

    এই দশাশ্বমেধ ঘাটেই বসিয়া তো বাইশ বৎসর পূর্বে মনে মনে কত ভাঙাগড়া করিয়াছেতারপর কবে সে সব ধীরে ধীরে ভুলিয়া গেল-কবে ধীরে ধীরে নতুন খাতাপত্রের তাড়া বাক্সের অনাদৃত, গুপ্ত কোণ আশ্রয় করিয়া দিনের আলো হইতে মুখ লুকাইয়া রহিল-যৌবনের স্বপ্নজাল জীবন-মধ্যাহ্নে কুয়াশার মতো দিগন্তে মিলাইয়া গেল।

     

    হারানো যৌবনের দিকে চাহিয়া দেখিলে বুকের মধ্যে কেমন করিয়া ওঠে, কত কথা মনে পড়ে-জীবনের সে সব দিনকে আর একটিবারও ফেরানো যায় না?

     

    দশাশ্বমেধ ঘাটে অনেক ছেলের সঙ্গে অপুর ভাব হইয়াছে। কিন্তু এখানে তাহার বয়সি সব ছেলেই স্কুলে পড়ে, সে-ই কেবল এখনও স্কুলে পড়ে নাই। নিশ্চিন্দিপুরে মাছ ধরিয়া ও নৌকায় বেড়াইয়া দিন কাটানো চুলিত বটে, কিন্তু এখানে সমবয়সিদের কাছে কিছু পড়ে না বলিতে লজ্জা করে।

    তাহা ছাড়া দশাশ্বমেধ ঘাটে যেসব ছেলের সঙ্গে তাহার ভাব হইয়াছে, সবাই অবস্থাপন্ন ঘরের চলে। পল্টুর দাদা একদিন কথায় কথায় বলিয়াছিল যে তাহার বাবাকে খুব বিদেশে বেড়াইতে হয়। অপু বলিয়াছিল-কেন, তোমাদের বুঝি খুব শিষ্য-বাড়ি আছে?

    পটুর দাদা আশ্চর্য হইয়া বলিল-শিষ্য-বাড়ি? কিসের ভাই?…

    অপু সদুত্তর দিবার পূর্বেই সে বলিল-আমার বাবা কন্ট্রাক্টরি করেন কি না? তা ছাড়া কাঁথিতে ছোট জমিদারি আছে- তবে আজকাল কিস্তি দিয়ে কী-ই বা থাকে?

    এক-একদিন বৈকালে অপু দশাশ্বমেধ ঘাটে বেড়াইতে গিয়া বাবার মুখে পুরাণপাঠ শোনে। হরিণশিশু শ্বাপদ কর্তৃক নিহত হইলে হরিণ-বালকের স্নেহাসক্ত রাজর্ষি ভারতের করুণ বিরহবেদনা ও পরিশেষে তাহার মৃত্যুর কাহিনী ষষ্ঠী মন্দিরে পৈঠার উপর বসিয়া একমনে শুনিতে শুনিতে তাহার চোখে জল আসে-এদিকে আবার যখন সিন্ধু সৌবীরের রাজা রঘুগণ তাঁহার স্বরূপ না জানিয়া ব্ৰহ্মার্ষি ভরতকে শিবিকাবাহক নিযুক্ত করেন-তখন হইতে কৌতুহলে ও উৎকণ্ঠায় তাহার বুক দুবু দুরু করে, মনে হয় এইবার একটা কিছু ঘটিবে; ঠিক ঘটবে। কথকতার শেষে পূরবী সূরের আশীৰ্বাচনটি তাহারা ভারি ভালো লাগে–

    কালে বৰ্ষতৃ পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী
    লোকাঃ সন্তু নিরাময়াঃ…

    সন্ধ্যার দিকে মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে অস্তসূর্যের রাঙা আভা ও পূরবীর মুৰ্দ্ধনার সঙ্গে হরিণ-বালকের বিয়োগবেদনাতুর রাজর্ষির ব্যথা যেন মিশাইয়া থাকে।

    বাড়িতে কাগজ কলম বাবার কাছে লইয়া গিয়া বলে-আমায় লিখে দাও না বাবা, ওই যে তুমি গাও-কালে বৰ্ষতু পর্জন্যং?

    হরিহর খুশি হইয়া বলে-তুই বুঝি শূনসি খোকা?

    -আমি তো রোজই থাকি।–তুমি কাল যখন ভারতের মা মারা যাওয়ার কথা বলছিলে আমি তখন তো তোমার পিছন দিকে বসে-ষষ্ঠীর মন্দিরের ধাপে–

    –তোর কি রকম লাগে।–ভালো লাগে?

    –খু-উ-উ-ব। আমি তো রোজ রোজ শুনি—

    অপু কিন্তু একটা কথা লুকায়। যেদিন তাহার সঙ্গীরা থাকে, সেদিন কিন্তু বাবার দিকে সে যায় না। সেদিন বাবার নিকট দিয়া যাইতেছিল, তাহার বাবা দেখিতে পাইয়া ডাকিল।–খোকা, ও খোকা–

    তাহার সঙ্গের বন্ধুটি বলিল-তোমাকে চেনে নাকি?

    –অপু শুধু ঘাড় নাড়িয়া জানায়, হ্যাঁ। সে বাবার কাছে আসে নাই সেদিন। তাহার বাবা ঘাটে কথকতা করিতেছে, একথা বন্ধুরা পাছে টের পায়! সে পল্টুর দাদা ছাড়া অন্য বন্ধুদের কাছে গল্প করিয়াছে, কাশীতে তাহদের বাড়ি আছে, তাহারা কাশীতে হাওয়া বদলাইতে আসিয়াছে, দেশে খুব বড় বাড়ি, তাহার বাবা কন্টট্রাক্টরি করেন, তা ছাড়া দেশে জমিদারিও আছে। শেষে বলে-কিন্তু জমিদারি থাকলে কি হবে, কিস্তি দিযে কীইবা থাকে?

    তাহার বন্ধুদের বয়স তাহার অপেক্ষা খুব বেশি নয় বলিয়াই বোধ হয় তাহার বর্ণিত গল্পের সঙ্গে তাহার পোশাক-পরিচ্ছদের অসঙ্গতি ধরা পড়ে না, বিশেষত তাহার সুন্দব মুখের গুণে সব মানাইয়া যায়।

     

    পূৰ্ণিমার দিন কথক ঠাকুরেব ওখানে বেশ ভিড় হইল। সন্ধ্যার পব হরিহর কথা শেষ করিযী। ঘাটের রানায় বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে, কথক ঠাকুর জলে হাত মুখ ধুইতে নামিল। হরিহরকে দেখিয়া বলিল-এই যে আপনিও আছেন, দেখলেন তো কাণ্ড, পুস্নিমের দিনটা—বলি আজ দিনটা ভালো আছে, বামন-ভিক্ষে লাগাই।–মাসে মাসে এই কাশীতে বামন-ভিক্ষা হলে পরে পনেরো সের আধমণ করে চাল পড়তো-আজকাল মশাই মহা বামন-ভিক্ষেতেও লোকে আর ভেজে না-চালের তো একটা দানাও না-এদিকে সিকে পাঁচেক হবে, তবে মধ্যে আবার দুটো অচল দোয়ানি!.মশায়ের শিক্ষা কোথায়?

    –শিক্ষা তো ছিল এ কাশীতেই অনেকদিন আগে। তবে এত দিন দেশেই ছিলাম-এইবার এখানে এসে বাসা করে আছি.

    —মশায়ের বাসা কি নিকটে?…একটু চা খাওয়াতে পারেন?…কদিন থেকে ভাবচি একটু চা থাবো।-এই দেখুন না, চাদরের মুড়োয় চা বেঁধে নিয়ে নিয়ে ঘুরি, বলি না হয় কোনো হালুইকরের দোকানে একটু গরম জল করিগে…গলা বসে গিয়েচে, একটু লোন-চা খেলে গলাটা…

    -হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন না। এই তো নিকটেই আমার বাসা-চলুন না? কথককে লইয়া হরিহর বাড়ি আসিল।

    চা খাওয়ার পাট কোন কালে নাই। কড়ায় জল গরম করিয়া চা তৈরি হইল। অপু’ৰ্কাসার গ্লাসে চা ও রেকাবিতে কিছু খাবার কথকের সামনে লইয়া আসিল। খাবার দেখিয়া কথকঠাকুর ভারি খুশি হইল-খাবারের আশা সে করে নাই।

    –এটি ছেলে বুঝি! বাঃ বেশ ছেলে তো আপনার? ভারি সুন্দর দেখতে–বাঃ–এসো এসো বাবা, থাক থাক কল্যাণ হোক-লোন-চা করিয়েছেন তো মশায়?…দেখি–

    হরিহর বলিল-আপনার কি ছেলেপিলে সব এখানেই-

    –সংসারই নেই তো ছেলেপিলে?…দশ বিঘে জমিও বেরিয়ে গেল অথচ ও মূলেও হাভাত-জমি ক’বিঘে যদি আজ থাকতো-তো আজ কি এই এতদূরে আসি।–আপনিও যেমন!…এসব কি আর দেশ মশাই?…বিশ্বেশ্বর অবিশ্যি মাথায় থাকুন-এমন শীতকাল যাচ্চে মশাই-না একটু খেজুর রস, না একটু গুড় পাটালি–আমার নিজের মশাই দু’কুড়ি খেজুর গাছ–

    –মশাইয়ের দেশটা কোথায়?

    –সাতক্ষীরের সন্নিকট-বাদুড়ে-শীতলকাটি জানেন? শীতলকাঠির চক্কত্তিরা খুব ঘবানাহরিহর তামাক সাজিয়া নিজে কয়েক টান দিয়া কথক ঠাকুবের হাতে দিয়া বলিল-খান—

    –কিছু না মশায়, ফাগুন মাসের দিকে তো যাই-একটা বাগান আছে, দিয়ে আসি বিক্লি করে- আমরা আবার শ্রোত্রিয় কিনা?… তা জমি দশ বিঘে ছিল তাই বন্ধক দিয়ে পণ জোগাড় করলাম–বিয়েও করলাম। –মশাই দশ বছর ঘর করলাম। –হল কি জানেন? সন্ধ্যাবেলা রান্নাঘরের চাল থেকে কুমড়ো কাটতে গিয়েচে-ছিল মশাই সেখানে সাপ আমার জন্যে তৈরি হয়ে-হাতে দিয়েচে কামড়ে–আমি আবার নেই সেদিন বাড়ি–কেইবা বদ্যি কবরেজ দেখিয়েচে, কেই বা করেচে-পাটুলির ঘাট পার হচ্চি–গায়ের মহেশ সাধুখ ওপার থেকে আসচে, আমায় বল্লেশিগগির বাড়ি যান মশায়—আপনার বাড়ি বড় বিপদ-কি বিপদ তা বলে না-বাড়ি পৌঁছে দেখি আগের রাত্ৰিতেই বৌ তো গিয়েচে মারে!–এই গোল ব্যাপার মশাই…জমিকে জমিও গেল।– এদিকেও–। সেই থেকে বলি যাই, দেশে থেকে আর কী-ই বা হবে।–কোথেকে পাবো তিন-চারশ টাকা যে আবার বিয়ে করবো?…যাই বিশ্বনাথের ওখানে.অন্নকক্টটা তো হবে না…আজ বছর আষ্টেক হয়ে গেল-এক খুড়তুতো ভাই আছে৷–জমিজমা সামান্য যা একটু আছে, দখল করে বসে আছেবলে তোমার ভাগ নেই।–বেশ বাপু, নেই তো নেই।–গোলমালের মধ্যে কখখনো আমি যাবো না-কবগে যা দখল। উঠি মশাই–আপনাব এখানে বেশ চা খাওয়া গেল-আপনার ছেলেটি কোথায় গেল? বেশ ছেলে, খাসা ছেলে–

    পুরানো চামড়ায় তালি দেওয়া ক্যাম্বিসের জুতা জোড়াটা ঝাড়িয়া লইয়া কথকঠাকুর পায়ে দিয়া দবাজার কাছে আসিল-যাইতে যাইতে বলিল-কালও লাগাবো বামনভিক্ষ্যে-দেখি কি হয়—

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.