Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প391 Mins Read0

    ৩১. হরিহরের বাসাটা বিশেষ ভালো নয়

    হরিহরের বাসাটা বিশেষ ভালো নয়। নিচের তলায় স্যাৎসোঁতে ঘর, তাও মাত্ৰ দুখানি, এত অন্ধকার যে হঠাৎ বাহির হইতে আসিলে ঘরের কোনো জিনিস নজরে পড়ে না। এরকম স্থানে সর্বজয়া কখনও বাস করে নাই, তাহাদের দেশের বাড়ি পুরানো হইলেও রৌদ্রহাওয়া খেলিবার বড় বড় দরজা জানোলা ছিল, সেকালের উঁচু ভিতের কোঠা, খটু খটু করিত, শুকনা। এ বাসার স্যাৎসেঁতে মেজে ও অন্ধকারে সর্বজয়ার মাথা ধরে। অপু তো মোটেই ঘরে থাকে না, সূর্যালোকপুষ্ট নবীন তবুর ন্যায়। শুধু আলোর দিকে তার মুখটি থাকে ফিরানো, নিশ্চিন্দিপুরের মুক্ত মাঠে, নদীর আলো হাওয়ায় মানুষ হইয়া এই বদ্ধঘরের অন্ধকারে তার প্রাণ হাঁপাইয়া ওঠে, একদণ্ডও সে সেখানে তিষ্ঠিতে পারে না।

    কাশী দেখিয়া সে একটু নিরাশ হইয়াছে। বড় বড় বাড়িঘর থাকিলে কি হইবে, এখানে বন নাই মোটেই।

    সন্ধ্যার দিকে একদিন কথকঠাকুর হরিহরের বাসায় আসিল। একথা ওকথার পর বলিল-কই আপনার ছেলেকে দেখচি নে?

    হরিহর বলিল–কোথায় বেরিয়েচে খেলা করতে, দশাশ্বমেঘ ঘাটের দিকেই বোধ হয় বেরিয়েচে–

    কথকঠাকুর উড়ানির প্রান্তে কি দ্রব্য খুলিতে খুলিতে বলিল-আপনার ছেলের সঙ্গে বড় ভোব হয়ে গিয়েচে মশাই-সেদিন ঘাটে কাছে ডেকে বসিয়ে অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে কথা কইলাম-কড়ি খেলতে ভালোবাসে তাই এই দুটো বড় বড় সমুদ্রের কড়ি সেদিন ব্রতের সিধে কারা দিইছিল, ভাবলাম ওকে দিয়ে আসি-রেখে দিন আপনি, ও এলে দেবেন–

    অগ্রহায়ণ মাসের শেবে অপু বাবাকে ধরিল সে স্কুলে ভর্তি হইবে। বলিল-সবাই পড়ে ইস্কুলে বাবা, আমিও পড়বো-ওই তো গলির মোড় ছাড়িয়ে একটুখানি গিয়েই ভালো ইস্কুল–

    হরিহর ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়া দিল। যদিও ছাত্রবৃত্তিস্কুল তবে ইংরাজি পড়াও হয়। প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালা ছাড়িয়া দেওয়ার পরে-সে। প্রায় চার পাঁচ বছর হইয়া গিয়াছে-এই তাহার পুনরায় অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া।

    মাঘ মাসের মাঝামাঝি কথকঠাকুর এক টুকরা বালির কাগজ হাতে একদিন হরিহরের বাসায় আসিয়া হাজির। কাগজের টুকরা দেখাইয়া বলিল-দেখুন তো মশাই পড়ে, এই রকম যদি লিখি তবে হয়?

    হরিহর পড়িয়া দেখিল, কাশীবাসী রামগোপাল চক্ৰবতী নামে কোনো লোক কথকঠাকুরের নামে স্বগ্রামের দশবিঘা জমি দানপত্র লিখিয়া দিতেছে, অমুক অমুক সাক্ষী, স্থান দশাশ্বমেধ ঘাট, অমুক তারিখ। কথকঠাকুর বলিল-ব্যাপারটা কি জানেন! আমাদের দেশে কুমুরে গ্রামের রামগোপাল চকৃত্তি ভারি পণ্ডিত ছিলেন, মরবার বছর খানেক আগে আমাকে বল্পেন-রামধন, তোমার তো কিছু নেই, ভাবচি তোমাকে বিঘে দশেক জমি দান করব।–তুমি নেবে কি? তা ভাবলাম সদব্ৰাহ্মণ, দিতে চাচ্ছেন, দোেষই বা কি? তারপর তিনি মুখে মুখে জমিটা আমায় দিয়ে দিলেন। দিলেন দিলেন-এতকাল তত গা করিনি, কাশীতেই থাকবো, দেশে ঘরে থাকবো না, কি হবে জমি? তারপর চাকত্তি মশায় গেলেন মারা। জমির দানটা মুখে মুখেই রয়ে গেল। এতকাল পরে ভাবচি দেশে ষাবো-ছেলেপিলে না হলে কি আর মানুষ মশাই? আপনাকে বলতে কি, শ’তিনেক টাকা হাতে করেচি-করেচি জলাহার করে.মশাই-আর শ’দুই টাকা পেলে শ্রোত্ৰিয় ঘরের মেয়ে পাওয়া যায়–তা যদি তাই ঘটে, তবে জমিটা দরকার হবে তো? ভাবলুম মুখে মুখে দান, সে কি আর চাকত্তি মশাই-এর ছেলেরা মানবে? ভেবে চিন্তে এই কাগজখানা বসে বসে লিখিচি-নিজেই লিখিচি মশাই, সাইটই সব-দুজন সাক্ষী, সব বানানো-দেখি লেখা কাগজ যদি মানে। গিয়ে বলবো এই দ্যাখো তোমার বাবা এই জমিটা দান করেচেন–

    উঠিবার সময় কথকঠাকুর বলিল-ভালো কথা মশাই, মঙ্গলবারে মাধবী-পূর্ণিমার দিন আপনার ছেলেকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাবো ওই টেওটার রাজার ঠাকুরের বাড়িতে, ঠিক মানমন্দিরের গায়েই একেবারে। সন্ধের পর বছর বছর ব্রাহ্মণভোজন করায় কি না। একটু সগর্বে বলিল-আমায় একখানা করে নেমন্তন্ন পত্তর দ্যায়, বেশ ভালো খাওয়ায়, চমৎকার। আমি এসে নিয়ে যাবো সেদিন কিন্তু।

    মাঘী–পূর্ণিমার দিন শেষরাত্রি হইতে পথে স্নানাধীদের ভিড় দেখিয়া সর্বজয়া অবাক হইয়া গেল। দলে দলে মেয়ে পুরুষে ‘জয় বিশ্বনাথজী কি জয়’, ‘বোলো বোম’, ‘বোলো বোম’ বলিতে বলিতে দুরন্ত মাঘের শীতকে উপেক্ষা করিয়া স্নানের জন্য চলিয়াছে। একটু বেলা হইলে পাঞ্জাবী স্ত্রীলোকটির সঙ্গে সর্বজয়াও স্নান করিতে গোল–গঙ্গার ঘাটের জল, সিঁড়ি, মন্দির, পথ সব উৎসববেশে সজিত নরনারীতে পূর্ণ। জলে নামা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। ষষ্ঠীর মন্দিরে লাল নিশান উড়িতেছে।

    সন্ধ্যার আগে কথকঠাকুর অপুকে লাইতে আসিল। সর্বজয়া বলিল-পাঠিয়ে দাও গিয়ে, কেউ নেই, অপুর ওপর একটা দাম হয়েচে, দশাশ্বমেধ ঘাটে ওকে ডেকে কাছে বসিয়ে গল্প করে, একদিন নাকি পোপে কিনে খাইয়েচে-পাঠিয়ে দাও, লোক ভালো–

    অপু প্ৰথমে কথকঠাকুরের সঙ্গে তাহার বাসায় গেল। খোলার ঘর, মাটির দেওয়ালের নানাস্থানে খড়ি দিয়া হিসাব লেখা। নমুনা–

    সিয়ারসোলের রানীর বাড়ি ভাগবত পাঠ …৪্‌

    মুসম্মত কুন্তার ঠাকুর বাড়ি… ওই … … ২্‌

    ধারক লালজী দেবের একদিনের খোরাকি… ৪।০

    বিশেষ কিছু আসবাবপত্র নাই। একখানা সবু চৌকি পাতা, একটা ছোট টিনের তোরঙ্গ, একটা দড়ি-টাঙানো আলনা, একজোড়া খড়ম। দেওয়ালের গায়ে পেরেকে একটা বড় পদ্মবীজের মালা টাঙানো।

    কথকঠাকুর বলিল-কমললেবুখাবে?

    অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল-আছে আপনার?

    কি জানি কেন এই কথকঠাকুরের কাছে তাহার কোনোপ্রকার লজ্জা কি সংকোচ বোধ হইতেছিল না। লেবুর খোসা ছাড়াইতে ছাড়াইতে জিজ্ঞাসা করিল-‘কালে বৰ্ষতৃ পর্জন্যং’ জানেন আপনি?

    –কালে বৰ্ষতু পর্জন্যং? খুব জানি, রোজ বলি তো, একদিন শুনো না—

    এখন বলুন না একটিবার?

    কথক সুর করিয়া বলিল বটে। কিন্তু অপুর মনে হইল তাহার বাবার মুখে শুনিলে আরও ভালো লাগে, কথকের গলা বড় মোটা।

    দেশে লইয়া যাইবার জন্য কথকঠাকুর নানা খুচুরা মাটির ও পাথরের জিনিস—পুতুল, খেলনা, শিবলিঙ্গ মালা, কাঠের কঁকই সংগ্ৰহ করিয়া রাখিয়াছে। অপুকে দেখাইয়া বলিল-কাশীর জিনিস, সবাই বলবে কি এনেচ দেখি! তাই নিয়ে যাবো–

    নানা সরু গলি পার হইয়া একটা অন্ধকার বাড়ির দরজার সামনে আসিয়া কথকঠাকুর দাঁড়াইল। নিচু দরজা দিয়া অতি কষ্টে কথকের সঙ্গে ঢুকিয়া অপুর মনে হইল বাড়িটায় কেহ কোথাও নাই, সব নিঝুম। কথকঠাকুর দু’একবার গলায় কাশির শব্দ করিতে কে একজন দালানের চারপাই হইতে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া মোটা গলায় হিন্দিতে কি জিজ্ঞাসা করিল, অপু ত্যাহা বুঝিতে পারিল না। কথকঠাকুর পরিচয় দিবার পরেও মনে হইল লোকটা তাহাকে চিনেও না বা তাহাদের আগমন প্রত্যাশাও করে নাই। পরে লোকটা যেন একটু বিরক্তির সহিত কাহাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে গেল। কিন্তু ফিরিতে এত দেরি করিতে লাগিল যে, অপুর মনে হইল হয়তো ইহারা বলিবে তোমাদের তো নিমন্ত্রণ হয় নাই, যাও তোমরা। যাহ্যাঁই হউক, অন্ধকারে ঠায় পনেরো মিনিট দাঁড়াইবার পরে লোকটা ফিরিয়া আসিয়া দালানের একস্থানে আধ-অন্ধকারে খানকতক শালপাতা পাতিয়া ইহাদের বসাইয়া দিল। একটা মোটা পিতলের লোটায় জল দিয়া গিয়াছে। কথকঠাকুর যেন ভয়ে ভয়ে গিয়া আসনের উপর বসিল। রাজার বাড়ি, কি না জানি খাওয়ায়? অধীর আগ্রহে অপু প্রায় আরও বিশ মিনিট পাতা পাতিয়া বসিয়া রহিল-কাহারও দেখা নাই। নিমন্ত্রণ খাইতে পাইবার নিশ্চয়তার সম্বন্ধে যখন পুনরায় অপুর মনে সন্দেহ দেখা দিতেছে ঠিক সেই সময় পরিবেষ্টার আবির্ভাবরূপ অঘটন ঘটিল। মোটা মোটা আটার পুরী ও স্বাদ-গন্ধহীন বেগুনের ঘণ্ট-শেষে খুব বড় বড় লাড়ু। অপু কামড়াইতে গিয়া লাড়ুতে দাঁত বসাইতে পারিল না, এত কঠিন। কথকঠাকুর চাহিয়া চাহিয়া সেই মোটা পুরী খান দশ-বারো আগ্রহের সহিত খাইল। মাঝে মাঝে অপুর দিকে চাহিয়া বলিতেছিল–পেট ভরে খাও, লজ্জা কোরো না, বেশ খাওয়ায়।–বেশ লাড়ু না? দাঁতে এখনও খুব জোর আছে, বেশ চিবুতে পারি।

    একশত বৎসর একসঙ্গে থাকিলেও কেহ হয়তো আমার হৃদয়ের বাহিরে থাকিয়া যায়। যদি না কোনো বিশেষ ঘটনায় সে আমার হৃদয়ের কবাট খুলিতে পারে। আজকার এই নিমন্ত্রণ খাইতে আসার অনাদর, অবজ্ঞা, অপু বালক হইলেও বুঝিযাছিল। তাহার পরও এই খাইবার লোভে ও আনন্দে অপুর অন্তরতম হৃদয়ে ঘা লাগিল। তাহার মনে হইল এ কথকঠাকুর অতি অভাজন। ভাবিল, কথকঠাকুর কখনও কিছু খেতে পায় না, আহা, এই লাড়ু তাই আমন করে খাচ্ছে-ওকে একদিন মাকে বলে বাসাতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবো–

    করুণা ভালোবাসার সব চেয়ে মূল্যবান মশলা, তার গাঁথুনি বড় পাকা হয়। তাহার শৈশব মনে এই বিদেশী, দুদিনের পরিচিত, বাঙালি কথকঠাকুর তাহার দিদি ও গুলকীর সঙ্গে এক হারে গাঁথা হইয়া গেল সুদ্ধ এক লাড়ু খাইবার অধীর লোভের ভঙ্গিতে।

    ইহার অল্পদিন পরেই কথকঠাকুর দেশে চলিয়া গেল। রাজঘাটের স্টেশনে কথকঠাকুরের নির্বন্ধতিশয্যে হরিহর অপুকে সঙ্গে করিয়া তাহাকে গাড়িতে তুলিয়া দিতে গেল। হবিহরের মনে হইল আজ বাইশ বৎসর পূর্বে সে যাহা করিতে দেশে গিয়াছিল-এ ব্যক্তি তাহার বর্তমান বয়সের চেয়েও অন্তত আট বৎসর বেশি বয়সে তাহ্যাঁই করিতে অর্থাৎ নূতন করিয়া সংসার পাতিতে দেশে চলিয়াছে। সুতরাং তাঁহারই বা বয়সটা এমন কি হইয়াছে? কোন কাজ করিবার সময়ের অভাব হইতে পারে তাহার?

    গাড়ি ছাড়িলে অপুর চোখে জল আসিল। বালকের প্রাণে সময়ে সময়ে বয়স্ক লোকের উপর স্থায়ী সত্যিকার মেহ আসে। দুর্লভ বলিয়াই তাহা বড় মূল্যবান।

     

    মাঘ মাসের শেষের দিকে একদিন হরিহর হঠাৎ বাড়ি ঢুকিয়াই উঠানের ধারে বসিয়া পড়িল। সর্বজয়া কি করিতেছিল, কাজ ফেলিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া বলিল-কি হয়েচে, এমন করে বসে পড়লে যে? স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া কিন্তু মুখের কথাটা তাহার মুখেই রহিয়া গেল। হরিহরের চোখ দুটা জবাফুলের মতো লাল, ডান হাতখানা যেন কাঁপিতেছে। সর্বজয়া হাত ধরিয়া তুলিতে আসিতে সে ঘোর-ঘোর আচ্ছন্নভাবে বলিল-খোকা কোথায় গেল? খোকা?

    সর্বজয়া গায়ে হাত দিয়া দেখিল জ্বরে তাহার গা পুড়িয়া যাইতেছে। সস্তপণে হাত ধবিয়া ঘরে লইয়া গিয়া তাহাকে বিছানায় শোয়াইয়া দিয়া বলিল-অপু আসচে, তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েচে ওপরের ওই নন্দবাবু, বোধ হয় গোধুলিয়ার মোড়ে তার দোকানে নিয়ে গিয়েচে–

    অপু দোকানে যায় নাই, নন্দবাবুর ঘরের সামনে ছাদে বসিয়া বসিয়া বই পড়িতেছিল। মাসখানেক হইল নন্দবাবুর সঙ্গে অপুর খুব আলাপ জমিয়াছে। নন্দবাবুর বয়স কত তাহা ঠিক করিয়া বুঝিবার ক্ষমতা তাহার হয় নাই, তবে তাহার বাবার চেয়ে ছোট মনে হয়। নন্দবাবুর উপরের ঘরে সে অনেকগুলি বই আবিষ্কার করিয়াছো-নন্দবাবু যখন ঘরে থাকে তখন বই লইয়া ছাদে বসিয়া পড়ে। কিন্তু ভয় হয় পাছে নন্দবাবু পড়িতে না দিয়া বই কড়িয়া লয়, কারণ একদিন সেরাপ ব্যাপার ঘটিয়াছিল। ছাদের এক কোণে রৌদ্রে বসিয়া অপু বই পড়িতেছিল, নন্দবাবুঘরের ভিতর কি খুঁজতে খুঁজতে বাহিরে আসিয়া তাহাকে দেখিতে পাইয়া ধমক দিয়া বলিল-আরো রেখে দাও, তোমার বসে বসে যত ওই সব বই পড়া, কোথাকার জিনিস কোথায় রাখে। তার ঠিক নেই, কাজের সময় খুঁজে মেলে না-যাও, রাখো বই, যাও–

    সে তো ঘরের অন্য কোনো জিনিসে হাত দেয় না, তবে তাহাকে বকিবার কারণ কি? সেই হইতে সে ভয়ে ভয়ে রই লইয়া থাকে।

    নন্দবাবু সন্ধ্যার সময় টেরি কাটিয়া ভালো জামা কাপড় পরিয়া শিশি হইতে কি গন্ধ মাখিয়া রোজ বেড়াইতে যায়। অপুর গায়ে একদিন একটু শিশি হইতে ছড়াইয়া দিয়াছিল, বেশ ভুরিভুরে গন্ধটা।

    সন্ধ্যার পরও সে আগে আগে নন্দবাবুর ঘরে পড়িতে যাইত। কিন্তু সন্ধ্যার পরে নন্দবাবু আলমারি হইতে একটা বোতল লইয়া লাল-মতো একটা ঔষধ খায়। সে সময়ে সে একদিন ঘরে গিয়া পড়িলে তাহাকে ভারী বকিয়াছিল। নন্দবাবুদের ঘরে উঠিবার সিঁড়ি অন্যদিকে-আর একদিন রাত্রে হঠাৎ ওপরের ঘরে গিয়া সে দেখিয়াছিল একটি কে স্ত্রীলোক ঘরের মধ্যে বসিয়া আছে। তাহাকে দেখিয়া নন্দবাবু বলিয়াছিল–এখন যাও অপূর্ব, ইনি আমার শালী-দেখতে এসেচেন, এখুনি চলে যাবেন। ফিরিয়া আসিতে আসিতে সে শুনিয়াছিল নন্দবাবু বলিতেছে-ও আমাদের নিচের ভাড়াটের ছেলে–কিছু বোঝে-সোঝে না।

    নন্দবাবু তাহকে প্রায়ই তাহার মার কথা জিজ্ঞাসা করে। বলে-তোমার মাকে বলে পান নিয়ে এসো দিকি? আমার চাকরিটা পান সাজতে জানে না–

    অপু মায়ের কাছে আবদার করিয়া ওপরে প্রায়ই পান আনে। নন্দবাবু মাঝে মাঝে বলে– তোমার মা আমার কথা কিছু বলেন-টলেন নাকি-না?–

    অপু বাড়ি আসিয়া মাকে বলে–নন্দবাবু বেশ লোক মা–তোমার কথা রোজ জিজ্ঞেস করে–

    –আমার কথা? আমার কথা কি জিজ্ঞেস করে—

    –বলছিল তোমার মাকে বোলো, আমি তার কথা জিজ্ঞেস করি-টরি–বেশ লোক—

    –করুক গে—তুই পাঁজি ছেলে অত ওপরের ঘরে যাস-টাস কেন? বিকেলে ওপরে বসে বুসে কি কবিস?

     

    হরিহরের জ্বরটা একটু কমিল। অপু স্কুল হইতে আসিয়া বই নামাইয়া রাখিতেছে। পায়ের শব্দ পাইয়া হরিহর বলিল-খোকা এসো, একটু বসো বাবা–

    অপু বসিয়া বসিয়া স্কুলের গল্প করিতে লাগিল। হাসিমুখে নিচু সুরে বলিল-এই দুমাস তো স্কুলে গিাঁইচি, এরই মধ্যে বাবা, স্কুলের সবাই খুব ভালোবাসে, রোজ রোজ ফাস্ট বসি-স্কুলে আমাদের ক্লাসে একখানা কাগজ ছাপিয়ে বাব করবে এক মাস অন্তর। আমাকে সেই দলে নিয়ে চে–তোমায় দেখাবো বাবা বেবুলে–

    হরিহরের বুকের ভিতরটা মমতায় বেদনায় কেমন করে। অপু একখানা কাগজ বাহির করিয়া বলে–একটা লেখা লিখেচি-কাগজখানা ছাপাবে বলেচে, আমার নামে-কিন্তু যারা দুটাকা করে চাঁদা দেবে শুধু তাদেরই লেখা ছাপবে বলেচে-দুটাকা দেবে বাবা?

    হরিহর অধীর আগ্রহে ছেলের হাত হইতে কাগজখানা লইয়া পড়িতে শুরু করে। ছেলে যে লেখে, সে খবর সে জানিত না। রাজপুত্রের মৃগয়ার গল্প সুন্দর বানানো, হরিহর খুশি হইয়া বালিশে ভরা দিয়া উঠিয়া বসে, বলে-তুই লিখিচিস খোকা?

    -আমি তো আরও কত লিখিচি বাবা, ভূতের গল্প, রাজকন্যের-বাড়ি থাকতে রানুদির খাতায় লিখে লিখে দিতাম তো–

    সর্বজয়া টাকার নাম শুনিয়া দিতে চাহে না। স্বামী অসুখে পড়িয়া এ অবস্থায় যাহা আছে তাহা সংসারের খরচেই কুলাইবে না, দরকার নাই ছাপানো কাগজে। হরিহর বুঝাইয়া বলিয়া টাকা দেওয়ায়, বলে–দাও গিয়ে, আহা খোকার লেখাটা ছাপিয়ে আসুক, সেরে উঠে পথ্যি করলেই ঠাকুর-বাড়ির ভাগবত পাঠটা তো ঠিকই রয়েচে-ওতেও তো গোটা দশেক টাকা পাবো–

    দিন দুই পরে অপু নিরাশ মুখে রাঙা ঠোঁট ফুলাইয়া বাবার কাছে চুপি চুপি আসিয়া বলে–হলো না বাবা। ছাপাখানাওয়ালার লোকেরা বেশি দাম চেয়েচে, তাই আজ স্কুলে বলে দিয়েচে, চার টাকা করে চাঁদা চাই–

    ছেলের মুখের নিরাশার ভাব হরিহরের বুকে খচ্‌ করিয়া বিঁধে। খানিকক্ষণ অন্য কথার পর সে বলে-দ্যাখ দিকি খোকা তোর মা কোথায় গেল।…বালিশের তলা হইতে চাবির থোলো বাহির করিয়া দিয়া বলে-চুপি চুপি ওই কাঠের ছাপ বাক্স, যেটাতে আমার কঞ্চির কলমের বান্ডিল আছে, ওইটে খোল তো?…কোণে দাখা তো কটাকা আছে? তাহার পর হরিহর সন্তৰ্পণে বাক্সখোলা-নিরত পুত্রের দিকে মমতার চোখে চাহিয়া থাকে। অবোধ, অবোধ, নিতান্ত অবোধ!.ওর সুন্দর, শূদ্র চাঁদের মতো ললাটটি ওর মায়ের ললাট, চোখ দুটি ওর মায়ের চোখ। যখন হরিহর প্রথম যৌবনে বিবাহ করিয়া স্ত্রীকে ঘরে আনে, নববধূ সর্বজয়ার অবিকল সেই মুখের হাসি এগারো বছরের অপুর অনাবিল, নবীন মুখে।

    অকারণে হরিহরের বুকের মধ্যে স্নেহসমুদ্র উদ্বেল উত্তাল হইয়া উঠিয়া চোখে জল ভরিয়া আনে।

    অপু যেন প্রথম বসন্তের নবকিশলয়, তাহার মুখের আনন্দ যেন প্ৰভাতের নব-অরুণ আভা, তার ডাগর ডাগর নীলাভ চোখ দুটির চাহনির মধ্যে নিজের অতীত যৌবনদিনের সে অসীম স্বপ্ন, সুনীল পাহাড়ের নবীন শালতারুশ্রেণীর উল্লাস-মর্মর.কুলহারা সমুদ্রের দূরাগত সংগীতধ্বনি।

    অপু চুপি চুপি বাবাকে দেখাইয়া বলে—চারটে টাকা আছে বাবা!—হরিহরি সময় অসময়ের জন্য টাকা কয়টি রাখিয়া দিয়াছে নিজের বাক্সে লুকাইয়া, স্ত্রী জানে না, কাজেই সে নিশ্চিন্তমনে বলিতে পারিল–নিয়ে যা খোকা, চাঁদা দিয়ে দিস, কিন্তু তোর মাকে যেন বলিসনে।

    অপু খুশির সুরে বলে-ছাপা বেবুলে তোমায় দেখাবো বাবা, আমার নামে ছাপিয়ে দেবে বলেচে—এই সোমবারের পরের সোমবারে বেরুবে—

     

    পরদিন সকাল হইতে হরিহরের অসুখ আবার বাড়িল।

    সর্বজয়া ভয় পাইয়া ছেলেকে বলিল-নন্দবাবুকে বলগে যা তো—একবার এসে দেখে যান–

    নন্দবাবু দেখিয়া বলিল-একজন ডাক্তার ডাকতে হবে অপূর্ব, তোমার মাকে বলো।

    বৈকালে নন্দবাবুই একজন ডাক্তার সঙ্গে করিয়া আনিল। ডাক্তার দেখিয়া শুনিয়া বলিল— ঠাণ্ডা লেগে হয়েচে, ব্রাঙ্কো-নিমোনিয়া-ভালো নার্সিং চাই,–নিচের ঘরে কি এমনি করে। থাকে!… খোকা, তুমি একটা শিশি নিয়ে এসো আমায় ডাক্তারখানায়, ওষুধ দেবো–

    অপু কয়দিন গিয়া দশাশ্বমেধ ঘাটের উপর ডাক্তারের ডিসপেন্সারি হইতে ঔষধ আনিল।

    বিশেষ কোনো ফল দেখা গেল না। দিন দিন হরিহর দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিল। এদিকে টাকা যে কয়টি ছিল-ভিজিটে ও পথ্যে খরচ হইয়া গেল। ডাক্তার বলিল, অন্তত এক সেরা করিয়া দুধ ও অন্যান্য ফল না খাইতে দিলে রোগী দুর্বল হইয়া পড়িবে। সাড়ে তিন টাকা দামের একটা বিলাতী পথ্যের ব্যবস্থাও দিয়া গেল। বিদেশী-বিভূই জায়গা। একবার দেখিয়া সাহস দেয় এমন লোক নাই, সর্বজয়া চারিদিক অন্ধকার দেখিল।

    এই বিপদের মধ্যে সর্বজয়া আবার এক নূতন বিপদে পড়ল। উপরের ছাদে দাঁড়াইয়া ঝুঁকিয়া দেখিলে রাঁধিবার ঘর দেখা যায়। ইতিপূর্বেও সে মাঝে মাঝে নন্দবাবুকে ছাদ হইতে তার রান্নাঘরের দিকে উঁকিঝুঁকি মারিতে দেখিয়াছে, সম্প্রতি হরিহরের অসুখ হইবার পর হইতে নন্দবাবু বড় বাড়াইয়া তুলিল। নানা অছিলায় সে দিনে দশবার ঘরের মধ্যে আসে-আগে আগে অপুকে আড়াল করিয়া জিজ্ঞাসা করিত-আজকাল সরাসরিই তাহাকে সম্বোধন করিয়া কথাবার্তা বলে। প্রথমটা সর্বজয়া কিছু মনে করে নাই-বরং বিপদের সময়ে এই অনাত্মীয় লোকটি যথেষ্ট সাহায্য ও দেখাশুনা করিতেছে ভাবিয়া মনে মনে কৃতজ্ঞই ছিল, কিন্তু ক্ৰমেই যেন তাহার মনে হইতে লাগিল যে, এই যে বাড়াবাড়ি-ইহা কোথায যেন বেখাপ ঠেকিতেছে। নন্দবাবু নিজে পান কিনিয়া আনিয়া সম্মুখে রাখিয়া বলে–চাকরদের হাতে পান সাজা–জীবনটা গেল বৌঠাকুরন—সাজুন দিকি একবার–তাহাতেও সর্বজয়া দোষ ধরে নাই, বরং এই প্রবাসী আত্মীয়স্নেহবঞ্চিত লোকটির উপর মনে মনে একটু করুণাই হইত-কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ক্ৰমে শোভনতার সীমা ডিঙাইতে চলিল। আজকাল পান আনিয়া বলে-রাখো দিকি বৌঠাকরুন। হাত হইতে সর্বজয়া লইবে-এইরূপই যেন চায়। অপু তো পাগল-অধিকাংশ সময়ই বাটীতে তাহাকে খুঁজিয়া মেলে না-ওঘরে হরিহর অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া থাকে-আর ঠিক সেই সময়টিতেই নন্দবাবু ঘরে আসিবে রোগী দেখিতে!..ছলছুতায় একথাওকথায় আধঘণ্টা না কাটাইয়া সে ঘর হইতে যায় না। বলে—কোনো ভয় নেই বৌঠাকরুন-আমি আছি ওপরে-অপূর্ব থাকে না থাকে-ওই সিঁড়িটার ওপর গিয়ে ডেকো না! বিপদের সময় অত বাছতে গেলে…একটু চুন দাও তো! বোঁটা নেই? আহা আঙুলের মাথাতে করেই একটু দাও না অমনি–

    হরিহরের জ্ঞান হইলেই ছেলের জন্য অস্থির হইযা উঠে। এদিকে ওদিকে চাহিয়া ক্ষীণসুরে বলে–খোকা কই! খোকা কই!…সৰ্বজয়া বলে-আসচে, তাই কি হতচ্ছাড়া ছেলে একটু কাছে বসবে…বেরিযেচে বুঝি সেই ঘাটে। ছেলে বাড়ি এলে বলে-বসতে পারিসনে একটু কাছে। খোকা খোকা করে পাগল-খোকার তো ভেবে ঘুম নেই—যা বসগে, যা, গায়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে নেই বুঝি? ছেলে হয়ে স্বগগে ঘণ্টা দেবেন কি না?

    অপু অপ্রতিভ মুখে বাবার শিয়রের পাশে বসে। কিন্তু খানিক বসিয়াই মনে ভাবে—ওঃ। কতক্ষণ বসে থাকবো।–বেশ তো? আমার বুঝি একটু বেড়াতে কি খেলা করতে নেই। কনকনে ঠাণ্ডায় পা অবশ হইয়া আসে। তাহার মন ছটফট করে-একদৌড়ে একেবারে সেই দশাশ্বমেধ ঘাট। জলের রানা, নির্মল মুক্ত হাওয়া, সুরেশ নবনারীর ভিড়। পটু, সুবীর…গুলু-পটল-পল্টুর দাদা। রামনগরের রাজার সেই ময়ুরপঙ্খীটায় আজ আবার বাচ, বেলা চারটার সময়! উসখুসি করিতে করিতে চক্ষুলজ্জায় সন্ধ্যা করিয়া ফেলে, মায়ের ভয়ে যাইতে সাহস পায় না।

    সকালে সর্বজয়া একদিন ছেলেকে বলিল-হ্যারে, ওই সাদা বাড়িটার পাশে কোন ছত্তর জানিস?

    –উঁহু–

    –তুই ছত্তরে খাসনি একদিনও এখানে এসে? কাশীতে এসে ছত্তরে খেতে হয় কিন্তু, জানিসনে বুঝি! খেয়ে আসিস না আজ?…দেখেই আসিস না?

    –কাশীতে এসে ছত্তরে খেতে হয় কেন?

    —খেলে পুণ্য হয়—আজ দশাশ্বমেধ ঘাটে নেয়ে অমনি ছত্তর থেকে খেয়ে আসিস বুঝলি। বেলা বারোটার সময় সত্ৰ হইতে খাইয়া অপু বাড়ি ফিরিল। তাহার মা বান্নাঘবেব বাবান্দায বসিয়া বাটিতে কি লইয়া খাইতেছিল–তাহাকে দেখিয়া প্রথমটা লুকাইবার চেষ্টা করিলা বটে কিন্তু অপু অত্যন্ত কাছে আসিয়া পড়িয়াছে-লুকাইতে গেলে সন্দেহ জাগানো হয়। ভাবিয়া সহজ সুরে বলিবার চেষ্টা করিল-খেয়ে এলি? কেন খাওয়ালে রে?

    মা অড়হরের ডাল-ভিজা খাইতেছে।

    —ভালো না-কুমড়োর একটা ছাই ঘণ্ট-বসে বসে হয়রান—বড্ড ময়লা কাপড়-পরা লোক সব খেতে যায়-আমি আর যাচ্ছি নে, পুণ্যতে আমার দরকার নেই-ওকি খাচ্ছ মা? তোমার বের্তো নাকি? রান্না হয় নি?

    –আজি তো আমার কুলুইচণ্ডী—এই দুটো অড়লের ডাল ভিজে-বেশ খেতে লাগে-আমি বড় ভালোবাসি… খাবি দুটো ওবেলা?

    রাত্ৰিতেও রান্না হইল না। তাহার মা বলিল-আড়ালের ডাল ভিজে খেয়ে দ্যাখা দিকি? বেশ লাগবে এখন-এবেলা রাঁধলাম না, ভারি তো খাস, এত কটা ভাতে বসিস বই তো নয়- ওই খেয়ে কি আর খেতে পারবি?

    পরদিন দুপুরে নন্দবাবু একতাড়া পান অপুর হাতে দিয়া বলিল-তোমার মার কাছ থেকে সেজে নিয়ে এসো তো? রোগীর ঘরের পাশের ঘরে সর্বজয়া বসিয়া পান সাজিতেছে। নন্দবাবু জুতার শব্দ করিতে করিতে উপর হইতে নামিয়া রোগীর ঘরে ঢুকিল এবং অতি অল্পক্ষণ পরেই সেখান হইতে বাহির হইয়া সর্বজয়া যে-ঘরে পান সাজিতেছে সেখানে ঢুকিল। সারারাত্রি জাগিয়া কাটাইয়া সর্বজয়ার ঝিামানি ধরিয়াছিল, জুতার শব্দে চমক ভাঙিলে একেবারে সম্মুখে নন্দবাবুকে দেখিয়া সে জড়সড় হইয়া ঘোমটা টানিয়া দিল। নন্দবাবু বলিল-পান সাজা হয়েচে বৌঠাকরুন? সর্বজয়া নীরবে সাজা পানের খিলিগুলি রেকরিতে করিয়া সামনে দিকে ঠেলিয়া দিতে নন্দবাবু এক খিলি তুলিয়া মুখের মধ্যে পুরিয়া বলিল-চুন বড় কম হয় বৌঠাকরুন তোমার পানে, সরো দেখি আমি নিচ্চি–

    সর্বজয়ার কোলের কাছে পানের বাটা। বাড়িতে কেহ নাই, অপু কোথায় বাহির হইয়াছে। পাশের ঘরে হরিহর ঔষধের বশে ঘুমাইতেছে। নিস্তব্ধ দুপুর। হঠাৎ সর্বজয়ার মনে হইল যেন নন্দবাবু চুন লইবার অছিলায় অনাবশ্যকরূপে–তাহার অত্যন্ত কাছে ঘোষিয়া আসিতে চাহিতেছে-একটা অস্পষ্ট চিৎকার করিয়া এক লহমার মধ্যে সে উঠিয়া গিয়া ঘরের বাহিরে দাঁড়াইল! একটা বিদ্যুতের মতো কিসের স্রোত তাহার পা হইতে মাথা পর্যন্ত খেলিয়া গেল। আঙুল দিয়া সিঁড়ি দেখাইয়া তীব্রস্বরে বলিল-চলে যান। এখখনি ওপরে।–কখখনো আর নিচে আসবেন না-নিচে এলে আমি মাথা খুঁড়ে খুন হবো-কেন আপনি আসেন? খবরদার আর আসবেন না–

    সর্বজয়া পড়িল মহা ফাপারে। বিদেশ জায়গা, এই রোগী ঘরে-নিঃসহায়, হাতে একটি পয়সা নাই, একটি পরিচিত লোক কোনো দিকে নাই, ছেলের বছর এগারো বয়স মোটে-তাও বুদ্ধিসুদ্ধি নাই, নিতান্ত নির্বোধ। এদিকে এই সব উৎপাত।

    উপরের পাঞ্জাবী স্ত্রীলোকটি কালেভদ্রে নিচে নামে-এক আধা বার সর্বজয়াকে উপরে তাহার ঘরে লইয়া গিয়াছিল, কিন্তু পাঁচ-ছয় মাস কাশীতে আসিয়াও সর্বজয়া না পারে হিন্দি বলিতে, না পারে ভালো বুঝিতে, কাজেই আলাপ মোটেই জমে নাই। অদ্য তাহার কাছে গিয়া নন্দবাবুর ঘটনা আনুপূর্বিক বলিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। পাঞ্জাবী মেয়েটির নাম সূরযকুঁয়ারী, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পাঞ্জাবের রোয়ালসার জেলার অধিবাসী; স্বামীটি রেলে ওভারসিয়ারের কাজ করে। মেয়েটির বয়স খুব অল্প না হইলেও দেখিতে কম বয়সি, গৌরাঙ্গী, আয়তনয়না, আঁটসাঁট দীর্ঘগড়ন। সে সব শুনিয়া বলিল– কোনো ভয় নাই, আপনি নিৰ্ভয়ে থাকুন, আবার যদি কিছু বদমায়েশির ভাব দেখেন আমায় বলবেন, আমার স্বামীকে দিয়া উহার নাক কাটিয়া ঠাণ্ডা করিয়া ছাড়িব।…

    ঠিক দুপুর। কয়রাত্রি জাগিবার পর সর্বজয়া মেজেতে আঁচল পাতিয়া শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। উত্তরের ঘরের জানোলা দিয়া একফালি রৌদ্র আসিয়া সবু উঠানটাতে বাঁকাভাবে পড়িয়াছে। অপু মাটির মালসাতে গাঁদাফুলের গাছ লাগাইয়াছিল, দু-তিনটা একপেটে গাদা নিতান্ত বিরক্তভাবে ফুটিয়া আছে।–তলায় একটা বিড়াল-ছানা বসিয়া। অপু বাবার বিছানার পাশেই বসিয়া ছিল। তাহার বাবা আজ সকাল হইতে একটু ভালো আছে—ডাক্তার বলিয়াছে বোধহয় জীবনের আশা হইল। ভালো থাকিলেও রোগীর খুব চৈতন্য আছে বলিয়া মনে হয় না, বেহুঁশ অবস্থা। তাহার বাবা হঠাৎ চোখ খুলিয়া তাহার দিকে খানিকটা চাহিয়া থাকিয়া কি বলিল। অপুর মনে হইল বাবা তাহাকে আরও কাছে সরিয়া যাইতে বলিতেছে। অপু সরিয়া যাইতে হরিহর রোগশীর্ণ ক্ষীণ দুই হাতে ছেলের গলা জড়াইয়া ধরিয়া নীরবে তাহার মুখের দিকে অনেকক্ষণ ধরিয়া একদৃষ্টি চাহিয়া রহিল। অপু একটু অবাক হইল, বাবার চোখের ওরকম দৃষ্টি কখনও সে দেখে নাই।

    রাত্রি দশটার সময় নিদ্ৰিত অপুর কি শব্দে ঘুম ভাঙিয়া গেল। ঘরে ক্ষীণ আলো জ্বলিতেছে– মা অঘোরে ঘুমাইতেছে, বাবার গলার মধ্যে নানাসুরে যেন কি একটা শব্দ হইতেছে। তাহার কেমন ভয় ভয় ঠেকিল। বুঝলমাখানো কড়িকাঠ, স্যাঁতা মেঝে, হাড়ভাঙা শীত, কাঠকয়লার আগুনের ধোঁয়া–সব মিলিয়া যেন একটা কঠিন দুঃস্বপ্ন। বাবার অসুখ সারিলে যে বাঁচা যায়!

    শেষ রাত্রে তাহার মায়ের ঠেলা পাইয়া তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল!–অপু, ও অপু ওঠ, শিগগির গিয়ে ওপরে থেকে হিন্দুস্তানী বৌকে ডেকে আনতো–

    অপু উঠিয়া শুনিল বাবার গলার সেই শব্দটা আরও বাড়িয়াছে। উপর হইতে সূরযকুঁয়ারী আসিবার একটু পরেই রাত্রি চারটার সময় হরিহর মারা গেল।

     

    মাঝ-বর্ষার ধারামুখর কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে মনে হয় যে পৃথিবীর রৌদ্রদীপ্ত দিনগুলো স্বপ্ন না সত্য? এই মেঘ, এই দুর্দিন, অনন্ত ভবিষ্যতের পথে এরাই রহিল চিরসখী–দিগন্তের মায়ালীলার মতো চৈত্র-বৈশাখের যে দিনগুলা অতীতে মিলাইয়া গিয়াছে–আর কি তাহা ফিরিয়া আসে?

    চারিধার হইতে সর্বজয়াকে কি এক কুয়াশায় ঘিরিয়া ফেলিল। তাহার মাধ্য দিয়া না দেখা যায় পথ, না চেনা যায় সাখী, না জানা যায় কোথায় আছি। সন্দেহ হয় এ কুয়াশা বোধ হয় বেলা হইলে রৌদ্র উঠিলেও কাটিবে না, এর পেছনে আছে আকাশ-ছাওয়া ফিকে ধূসর রং-এর সারাদিনব্যাপী অকাল বাদলের মেঘ।

    বিপদের দিনে পাঞ্জাবী ওভারসিয়ার জালিম সিং ও তাহার স্ত্রী যথেষ্ট উপকার করিল। জালিম সিং অফিস কামাই করিয়া সৎকারের লোকের জন্য বাঙালিটোলায় ঘোরাঘুরি করিতে লাগিল। খবর পাইয়া রামকৃষ্ণ মিশনের কয়েকজন সেবকও আসিয়া পৌঁছিল।

    মণিকর্ণিকার ঘাটে সৎকার অন্তে সন্ধ্যাবেলা অপু স্নান করিয়া ঠাণ্ড পশ্চিমে বাতাসে কাঁপিতে কাঁপিতে পৈঠার উপর উঠিল। রামকৃষ্ণ মিশনের একজন সেবক ও নন্দবাবু তাহাকে উত্তরীয় পরাইতেছিল। বেলা খুব পড়িয়া গিয়াছে, অস্ত-দিগন্তের স্নান আলো পাথরের মন্দিরগুলার আগাটুকুতে মাত্ৰ চিকচিক করিতেছে। সারাদিনের ব্যাপারে দিশেহারা অপুর মনে হইল। তাহার বাবার পরিচিত গলায় উৎসুক শ্রোতাগণের সম্মুখে কে যেন বসিয়া আবৃত্তি করিতেছে–

    কালে বৰ্ষতু পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী….
    লোকাঃ সন্তু নিরাময়াঃ…

    যে বাবাকে সকলে মিলিয়া আজি মণিকণিকার ঘাটে দাহ করিতে আনিয়াছিল, — রোগে, জীবনের যুদ্ধে পরাজিত সে বাবা স্বপ্ন মাত্র–অপু তাহাকে চেনে না, জানে না–তাহার চিরদিনের একান্ত নির্ভরতার পাত্র, সুপরিচিত, হাসিমুখ বাবা জ্ঞান হইয়া অবধি পরিচিত সহজ সূরে, সুকণ্ঠে, প্রতিদিনের মতো কোথায় বসিয়া যেন উদাস পূরবীর সুরে আশীর্বাচন গান করিতেছে–

    কালে বৰ্ষতু পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী….
    লোকাঃ সন্তু নিরাময়াঃ…

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.