Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প391 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩২. কোনোরূপে মাসখানেক কাটিল

    কোনোরূপে মাসখানেক কাটিল। এই একমাসের মধ্যে সর্বজয়া নানা উপায় চিন্তা করিয়াছে কিন্তু কোনোটাই সমীচীন মনে হয় না। দু-একবার দেশে ফিরিবার কথাও যে তাহার না মনে হইয়াছে এমন নয়, কিন্তু যখনই সে কথা মনে ওঠে, তখনই সে তাহা চাপিয়া যায়। প্রথমত তো দেশের এক ভিটাটুকু ছাড়া বাকি সব কতক দেনার দায়ে, কতক এমনি বেচিয়া কিনিয়া আসা হইয়াছে, জমিজমা কিছুই আর নাই। দ্বিতীয়ত সেখান হইতে বিদায় লইবার পূর্বে সে পথে-ঘাটে বৌ-বিদের সম্মুখে নিজেদের ভবিষ্যতের সুখের ছবি কতভাবে আঁকিয়া দেখাইয়াছে। নিশ্চিন্দিপুরের মাটি ছাড়িয়া যাওয়ার অপেক্ষা মাত্র, এ পোড়া মুখের দেশে তাহার স্বামীর কদর কেহ বুঝিল না, কিন্তু যেখানে যাইতেছে সেখানে যে তাঁহাকে সকলে লুফিয়া লইবে, অবস্থা ফিরিতে যে এক বৎসরও দেরি হইবে না-এ কথা হাতমুখ নাড়িয়া সর্বজয়া কতভাবে তাহদের বুঝাইয়াছে! এই তো চৈত্র মাস, এক বৎসর এখনও পূর্ণ হয় নাই। ইহারই মধ্যে এরূপ নিঃসম্বল দীন অবস্থায়, তাহার উপরে বিধবার বেশে সেখানে ফিরিয়া গিয়া সকলের সম্মুখে দাঁড়াইবার কথাটা ভাবিতেই সে লজ্জায় সংকোচে মাটিতে মিশিয়া যাইতেছিল। যাহা হইবার এখানেই হউক, ছেলের হাত ধরিয়া কাশীর পথে পথে ভিক্ষা করিয়া ছেলেকে মানুষ করিবে, কে দেখিতে আসিবে এখানে?

    মাসখানেক পরে একটা সুবিধা হইল। কেদার ঘাটের এক ভদ্রলোক মিশনের অফিসে জানাইলেন যে তাঁহার পরিচিত এক ধনী পরিবারের জন্য একটি ব্রাহ্মাণের মেয়ে আবশ্যক, জগতের মেয়ে, ঘরে আসিবেন, কাজকর্মে সাহায্য করিবেন। মিশন এরূপ কোনো লোকের সন্ধান দিতে পারেন কি না? শেষ পর্যন্ত মিশনের যোগাযোগে ভদ্রলোকটি অপূদের সেখানে পাঠাইতে রাজি হইলেন। সর্বজয়া অকুল সমুদ্রে কুল পাইয়া গেল। দিন-দুই পরে সেই ভদ্রলোকটি বলিয়া পাঠাইলেন যে, বাসা একেবারে উঠাইয়া যাইবার জন্য যেন ইহারা প্ৰস্তুত হয়, কারণ সেই ধনী গৃহস্থদের বাটী লইয়া যাইবেন।

     

    প্রকাণ্ড বড় হলদে বঙের বুড়িটা। কাশীতে যে রকম বড় বড় বাড়ি আছে, সেই ধরনের খুব বড় বাড়ি। সকলেব পিছনে পিছনে সর্বজয়া ছেলেকে লইয়া সংকুচিতভাবে বাড়ির ভিতর ঢুকিল।

    অন্তঃপুরে পা দিতেই অভ্যর্থনার একটা রোল উঠিল–তাহার জন্য নহে-যে দলটি এইমাত্র কাশী হইতে বেড়াইয়া ফিরিল, তাহাদের জন্য।

    ভিড় ও গোলমাল একটু কমিলে বাড়ির গিন্নি সর্বজয়ার সম্মুখে আসিলেন। খুব মোটাসোটা, এক সময়ে বেশ সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়, বয়স পঞ্চাশের উপর। গিন্নিকে প্ৰণাম করিতেই তিনি বলিলেন-থাক, থাক, এসো, এসো-আহা এই অল্প বয সেই এই–এটি ছেলে বুঝি? খাসা ছেলে–কি নাম?

    আর একজন কে বলিলেন-বাড়ি বুঝি কাশীতেই? না?–তবে বুঝি—

    সকলের কৌতূহল-দৃষ্টির সম্মুখে সর্বজয়া বড় লজ্জা ও অস্বস্তি বোধ করিতেছিল। গিন্নির হুকুমে যখন ঝি তাহার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে তাহাকে লইয়া গেল, তখন সে হাঁপ ফেলিয়া বাঁচিল।…

    পরদিন হইতে সর্বজয়া চুক্তিমতো রান্নার কাজে ভর্তি হইল। রাঁধুনী সে এক নয়, চার-পাঁচজন আছে। তিন-চারটা বান্নাঘর। আঁশ নিরামিষ, দুধের ঘর, রুটির ঘর, বাহিরের লোকদিগেব রান্নার আলাদা ঘর। ঝি-চাকরের সংখ্যা নাই। রান্নাবাড়িটা অন্তঃপুরের মধ্যে হইলেও একটু পৃথক। সেদিকটা যেন বি-চাকিব-বামুনের রাজত্ব। বাড়ির মেয়েরা কাজ বলিয়া ও বুঝাইয়া দিয়া যান মাত্র, বিশেষ কারণ না ঘটিলে রান্নাবাড়িতে বড় একটা থাকেন না।

    সর্বজয়া কি রাঁধিবে একথা লইয়া আলোচনা হয়। সর্বজয়ার বরাবরই বিশ্বাস সে খুব ভালো রাঁধিতে পারে। সে বলিল, নিরামিষ তরকারি রান্নার ভার বরং তাহার উপর থাকুক। রাঁধুনী বামনী মোক্ষদা মুচকি হাসিয়া বলিল-বাবুদের রান্না তুমি করবে? তা হলেই তো চিত্তির। পরে পাচিবিকে ডাক দিয়া কহিল, শূনচিস, ও পাঁচি, কাশীর ইনি বলচেন নাকি বাবুদের তরকারি রাধবেন! কি নাম গো তোমার? ভুলে যাই-মোক্ষদার ওষ্ঠের কোণের ব্যঙ্গের হাসিতে, সর্বজয়া সেদিন সংকোচে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল বটে, কিন্তু দু-একদিনেই সে বুঝিতে পারিল যে তাহার পাড়াগাঁয়ের কোনো তরকারি রান্না সেখানে খাটিবে না। ঝোলে যে এত চিনি মিশাইতে হয় বা বাঁধাকপি ফ্রিটার্স বলিয়া যে একটা তরকারি আছে, একথা সে এই প্রথম শুনিল।

    গৃহিণী সর্বজয়াকে মাস দুই বেশ যত্ন করিয়াছিলেন। হালকা কাজ দেওয়া, খোঁজখবর নেওয়া। ক্রমে ক্রমে অন্য পাঁচজনের সমান হইয়া দাঁড়াইতে হইল। বেলা দুইটা পর্যন্ত কাজ করার পর প্রথম প্রথম সে বড় অবসন্ন হইয়া পড়ে, এভাবে অনবরত আগুনের তাতে থাকার অভ্যাস তাহার কোনো কালে নাই, অত বেলায় খাইবার প্রবৃত্তি বড় একটা থাকে না। অন্য অন্য রাঁধুনীরা নিজেদের জন্য আলাদা করিয়া মাছ তরকারি লুকাইয়া রাখে, কতক খায়, কতক বাহিরে কোথাও লইয়া যায়। সে পাতের কাছে একবার বসে মাত্র!

    রান্নার বিরাট ব্যাপার দেখিয়া সর্বজয়া অবাক হইয়া যায়, এত বড় কাণ্ড-কারখানার ধারণা কোনো দিন স্বপ্নেও তাহার ছিল না, বিস্মিত হইয়া মনে মনে ভাবে, দু’বেলায় তিন সেরা করে তেলের খরচ? রোজ একটা যজ্ঞির তেল-ঘি এর খরচ!… পাড়াগায়ের গরিব ঘরের ছোট সংসারের অভিজ্ঞতা লইয়া সে এসব বুঝিয়া উঠিতে পারে না।

    একদিন সবু চালের ভাত রান্নার বড় ডেকচিটা নামাইবার সময় মোক্ষদা বামনীকে ডাক দিয়া বলিল-ও মাসিমা, ডেকচিটা একটুখানি ধরবে?

    মোক্ষদা শুনিয়াও শুনিল না।

    এদিকে ভাত ধরিয়া যায় দেখিয়া নিজেই নামাইতে গিয়া ভারী ডেকচিটা কত করিযা ফেলিল, গরম ফেন পায়ের পাতায় পড়িয়া তখনই ফোস্কা পড়িয়া গেল। গৃহিণী সেই দিনই তাঁহাকে বুটির ঘরে বদলি করিয়া বলিয়া দিলেন, পা না। সারা পর্যন্ত তাহাকে কোনো কাজ করিতে হইবে না।

    সর্বজয়া ছেলেকে লইয়া নিচের একটা ঘরে থাকে। ঘরটা পশ্চিমদিকের দালানের পাশেই। কিন্তু সেটা এত নিচু, আর মেঝে এত স্যাতসেঁতে এবং ঘরটাতে সব সময় এমন একটা গন্ধ বাহির হয় যে, কাশীর ঘরাও এর চেয়ে অনেক ভালো ছিল। দেয়ালের নিচের দিকটা নোনা-ধরা, বাঙা, রাঙা বড় বড় ছোপ, প্রতিবার বাহির হইতে ঢুকিয়াই অপু বলে-উঃ, কিসের গন্ধ দেখচোঁ মা, ঠিক যেন পুরোনো চালের কি কিসের গন্ধ বলো দিকি?…নিচের এ ঘরগুলা কর্তৃপক্ষ মনুষ্যবাসের উপযুক্ত করিয়া তৈয়ারি করেন নাই, সেইজন্যই এগুলিতে চাকর-বাকর রাঁধুনীরা থাকে।

    উপরের দালানের সব ঘরগুলি অপু বাহির হইতে বেড়াইয়া বেড়াইয়া দেখিয়াছে, বড় বড় জানালা দরজা। জানালায় সব কাচ বসানো। ঘরে ঘরে গদি-আঁটা বড় বড় চেয়ার, ঝকঝকে টেবিল, যেন মুখ দেখা যায়, এত ঝকঝকি করে। অপুদের বাড়িতে যেমন কর্পোেটর পুরানো আসন ছিল, ওই রকম কিন্তু ওর চেয়েও ঢের ভালো, পুরু ও প্রায় নতুন-কার্পেট মেজেতে পাতা! দেওয়ালে আয়না টাঙানো, এত বড় বড় যে, অপুর সমস্ত চেহারাখানা তাহাতে দেখা যায়। সে মনে মনে ভাবে-এত বড় বড় কাচ পায় কোথায়? জুড়ে জুড়ে করেচে। বোধ হয়–

    দোতলার বারান্দায় আর একটা বড় ঘর আছে–সেটা প্রায়ই বন্ধ থাকে, মাঝে মাঝে চাকরবাকরে আলো হাওয়া খাওয়াইবার জন্য খোলে। সেটার মধ্যে কি আছে জানিবার জন্য অপুর অদম্য কৌতূহল হয়। একদিন ঘরের দরজা খোলা দেখিয়া সে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়াছিল। কি বড় বড় ছবি! পাথরের পুতুল! বড় বড় গদি-আঁটা চেয়ার-আয়না,-সে ঘুরিয়া বেড়াইয়া সব দেখিতেছে, এমন সময় ছটু খানসামা তাহাকে ঘরের মধ্যে দেখিতে পাইয়া বুখিয়া আসিয়া বলিল—কোন বা?… কাহে ইসমে ঘুসা?

    হয়তো সেদিন সে মারই খাইত, কিন্তু বাড়ির একজন ঝি দালান দিয়া যাইতে যাইতে দেখিয়া বলিল-এই ছটু, ছেড়ে দাও, কিছু বোলো না-ওর মা এখানে থাকে-দেখচে দেখুক না–

    সকলের খাওয়া-দাওয়া সারা হইলে সর্বজয়া বেলা আড়াইটার সময়ে নিজের ঘরটিতে আসিয়া খানিকটা শোয়। সারাদিনের মধ্যে এই সময়ের মধ্যে কেবল মায়ের সঙ্গে মন খুলিয়া কথা হয় বলিয়া মাঝে মাঝে অপু এসময়ে ঘরে আসে। তাহার মা তাহাকে একবার করিয়া দিনের মধ্যে চায়। এ বাড়িতে আসা পর্যন্ত অপু যেন দূরে চলিয়া গিয়াছে। সারাদিন খাটুনি আর খাটুনি-ছেলের সঙ্গ হইতে দূরে থাকিতে হয়। বহু রাত্রে কোজ সারিয়া আসিতে অপু ঘুমাইয়া পড়ে, কথা হয় না। এই দুপুবটার জন্য তার মন তৃষিত হইয়া থাকে।

    দোরে পায়ের শব্দ হইল। সর্বজয়া বলিল-কে, অপু! আয়-দোর ঠেলিয়া বামনী মাসি ঘরে চুকিল। সর্বজয়া বলিল-আসুন, মাসিম বসুন। সঙ্গে সঙ্গে অপুও আসিল। বামনী মাসি বাবুদের সম্পর্কে আত্মীয়া। কাজেই তাঁহাকে খাতিব করিয়া বসাইল। বামনী মাসির মুখ ভারী-ভারী। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল-দেখলে তো আজ কাণ্ডখানা বড়-বৌমার? বলি কি দোষটা, তুমি তো বরাবরই বুগির ঘরে ছিলে? মাছ, ঘি এনে চুপড়িতে করে রেখে গেল, আমি ভাবলাম বাঁধাকপিতে বুঝি-কি রকম অপমানটা দেখলে তো একবার? পোলোয়ার মাছ তো সে কথা বিকে দিয়ে বলে পাঠালে তো হত। সন্দু বিও কি কম বদমায়েশের ধাড়ি নাকি?.. গিন্নির পেয়ারের ঝি কিনা? মাটি মাড়িয়ে চলে না, ওপরে গিয়ে সাতখানা করে লাগায়। –ওই তো ছিরিকণ্ঠ ঠাকুরও ছিল—বলুক দিকি? গল্প করিতে করিতে বেলা যায়। মাসি বলে, যাই জলখাবারের ময়দা মাখি গো-চারটে বাজালো–

    মাসি চলিয়া গেলে অপু মায়ের কাছে ঘেঁষিয়া বসিল। তাহার মা আদর করিয়া চিবুকে হাত দিয়া বলিল—কোথায় থাকিস দুপুরে বলা তো?…

    অপু হাসিয়া বলিল-ওপরের বৈঠকখানা ঘরে কলেব গান বাজাচে মা-শুনছিলাম–ওই বারান্দাটা থেকে–

    সর্বজয়া খুশি হইল।

    –হ্যাঁরে, তোর সঙেগ বাবুদের ছেলেদের ভাব-সাব হয় নি?…তোকে ডেকে বসায়?

    –খু-উ-উব!…

    অপু এটা মিথ্যা বলিল। তাহাকে ডাকিয়া কেহ বাসায় না। ওপরের বৈঠকখানাতে গ্রামোফোন বাজানোর শব্দ পাইলেই খানিকটা ইতস্তত করিয়া পরে ভয়ে ভয়ে উপরে উঠিয়া যায় ও বৈঠকখানার দোরের পাশে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া গান শোনে। প্রতি মুহুর্তেই তাহার ভয় হয় এইবার হয়তো উহারা তাহাকে বলিবে নিচে চলিয়া যাইতে। গান শেষ হইলে নিচে নামিবার সময় ভাবে– কেউ তো কিছু বক্‌লে না? কেন বক্‌বে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনি বাইরে, আমি তো বাবুদের ঘরের মধ্যে যাচ্ছি নে? এরা ভালো লোক খুব–

    এ বাড়ির ছেলেদের সঙ্গেও তার মেলামেশা হইল না। তাহারা উহাকে আমলই দেয় নাই। সেদিন রমেন, টেবু, সমীর, সন্তু-ইহারা একটা চৌকা পিড়ির মতো তক্তা সামনে পাতিয়া কাঠের কালো কালো গুটি চলিয়া এক রকম খেলা খেলিতেছিল, নাম নাকি ক্যাবাম খেলা—সে খানিকটা দূরে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া খেলোটা দেখিতেছিল–তার চেয়ে বেগুনবিচি খেলা ঢের ভালো।

    বৈশাখেব প্রথমে বড়বাবুর মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে বাড়ি সরগরম হইয়া উঠিল। গয়া, মুঙ্গের, এলাহাবাদ, কলিকাতা, কাশী নানাস্থান হইতে কুটুম্ব-কুটুম্বিনীদের আগমন শুরু হইল। সকলেই বড়লোকের ঘরের মেয়ে ও বড়ঘরের বধূ, প্রত্যেকের সঙ্গে নিজেদের ঝি-চাকর আসিয়াছে নিচের তলার দালান-বারান্দা রাত্রে তাহারাই দখল করে। সারারাত্ৰি হৈ চৈ।

    সকালে সর্বজয়াকে ডাকিয়া গিন্নি বলিলেন—ও অপূর্বের মা, তুমি এক কাজ করো, এখন দিন দুই রান্নাঘরের কাজ তোমার থাকুক, নানান জায়গা থেকে তত্ত্ব আসচে, তুমি আর ছোট মোক্ষদা সে সবগুলো গুছিয়ে তোমাদের বুটির ঘরের ভঁড়ারে তোলাপাড়া করো-মিষ্টি খাবার ওখানেই রেখো, ফল-ফুলুরি যা দেখবে পাঁচবার মতো, সদৃঝির হাতে পাঠিয়ে দেবে, নয়তো রেখে দিয়ো, জলখাবারের সময় নিয়ে আসলে বামনী মাসি–

    সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিস্তু-বেহারাদের মাথায় কত জায়গা হইতে যে কত তত্ত্ব আসিতে লাগিল সর্বজয়া গুনিয়া সংখ্যা করিতে পারে না। মিষ্টান্নের জায়গা দিতে পারা যায় না, ছোট ছোট রূপার চন্দনের বাটি জমিয়া গেল পনেরো-ষোলটা। আমি এখনও উঠে নাই, তবুও একটা বড় ধামা আমে বোঝাই হইয়া গেল।

    সর্বজয়া বামনী মাসির হাতে খাবার তুলিয়া দিতে দিতে ভাবে -এই এত ভালোমন্দ, এত কাণ্ড, তাই কি ছেলেটার জন্যে কিছু-আহা, বাছা আমার সরকারীদের খাবার ঘরের কোণটায় কাঁচুমাচু হয়ে বসে দুটো ভাত খাম, না দিতে পারি পাতে দুখানা ভালো দেখে মাছ, না একটু ভালো তরকারি, না এক হাত দুধ – তখখুনি ওই সদু হারামজাদী লাগবে নিজের ছেলের পাতে বাবুদের হেঁসেল থেকে সব–

    বিবাহের দিন খুব ভিড়। বাবপক্ষ সকালের গাড়িতে আসিয়া পৌঁছিয়া শহরের অন্য এক বাড়িতে ছিল। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে প্রকাণ্ড শোভাযাত্ৰা করিয়া বর আসিল।

    বাহিরের উঠান নিমন্ত্রিতাদের দলে ভরিয়া গিয়াছে। সারা উঠানটাতে শতরঞ্চি পাতা, এক কোণে চওড়া জরিপাড় লাল মখমলে মোড়া উঁচু ববাসন, জুরির ঝালরী-দোলানো নীল সাটিনের চাদোষা, দুপাশে কিংখাবের তাকিয়া, বড় বড় বেলফুলেব মালা তিনগাছ করিয়া চাঁদোয়ার খিলানে খিলানে টাঙানো। চারিপাশে বরযাত্ৰীগণের চেয়ার ও কৌচ। বিলাতি সেন্ট ও গোলাপ জলের পিচকারি ঘন ঘন ছুটিতেছে।

    অপু এ সমস্ত বিশেষ কিছু দেখে নাই, সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। একবার মাত্র সে বাড়ির মধ্যে গিয়াছিল, তখন স্ত্রী-আচার হইতেছে, রাত্রি অনেক! মাকে কোথাও খুঁজিয়া পাইল না, উৎসবের ভিড়ে কে জানে কোথায় কি কাজে ব্যস্ত আছে। দামি বেনারসী শাড়ি-পরা মেয়েদের ভিড়ে উঠানের কোথাও এতটুকু স্থান ফাঁকা নাই। ছোটবাবুর মেয়ে অরুণা কাহাকে ডাকিয়া বাহিরের বৈঠকখানা হইতে বড় অর্গানটা বাড়ির ভিতর আনিতে বলিতেছে।

    বিবাহের দিন দুই পরে শখের থিয়েটার উপলক্ষে আবার খুব হৈ চৈ! উঠানের এক কোণে স্টেজ বাঁধা হইয়াছে। গোলাপফুলে ও আর্কিডে স্টেজটা খুব চমৎকার সাজানো! পাঁচশত ডালের প্ৰকাণ্ড ঝাড়টা স্টেজের মধ্যে খাটানো হইল। এ কয়দিনের ব্যাপারে তো একেই অপুর তাক লাগিয়াছে, আজকার থিয়েটার জিনিসটি কি সে আদৌ জানে না, আগ্রহ ও কৌতূহলের সহিত পূর্ব হইতেই ভালো জায়গাটি দখল করিয়া রাখিবার জন্য সে আসরের সামনের দিকে সন্ধ্যা হইতে বসিয়া রহিল।

    ক্ৰমে ক্ৰমে একে একে নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকেরা আসিতে লাগিলেন, চারিদিকে আলো জ্বলিয়া উঠিল। বাড়ির দারোয়ানেরা জরির উর্দি পরিয়া আসরের বাহিরে ও দরজার কাছে দাঁড়াইল। সরকার ইতস্তত দুটাছুটি করিয়া কাজ দেখাইতে লাগিল। কনসার্ট আরম্ভ হইল। যখন ড্রপসিন উঠিবার আর বেশি দেরি নাই, বাড়ির গোমস্ত গিরিশ সরকার তাহার কাছে আসিয়া নিচু হইয়া চাহিয়া দেখিয়া বলিল-কে? অপু মুখ উঁচু করিয়া চাহিয়া দেখিল কিন্তু মুখচোরা বলিয়া খানিকক্ষণ কথা কহিতে পারিল না। তাহাকে জবাব দিবার অবকাশ না দিয়াই গিরিশ সরকার বলিল-ওঠো, ওঠো, এখানে বাবুরা বসবেন-ওঠো-গিরিশ সরকার আন্দাজে তাহাকে চিনিতে পারিয়াছিল।

    অপু পিছনে চাহিয়া বিপন্নমুখে নামতা পড়ার সুরে বলিল-আমি সন্দে থেকে এইখানটায় বসে আছি, পেছনে যে সব ভর্তি, কোথায় যাবো?…তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে গিরিশ সরকার তাহার হাতের নড়া ধরিয়া জোরে ঝাঁকুনি দিয়া উঠাইয়া দিয়া বলিল—তোর না কিছু করেছে, জ্যাঠা ছোকরা কোথাকার, জ্ঞান নেই, একেবারে সামনে-বাবুরা বসবেন, উনি রাঁধুনীর ব্যাটা এসেছেন মুখের কাছে বসতে! কোথায় যাবো ওঁকে বলে দাও-ফাজিল জ্যাঠা কোথাকার-যা এখান থেকে যা, ওই থামটার কাছে বসগে, যা কোথাও–

    পিছন হইতে দু’একজন কর্মকর্তা বলিলেন–কি হয়েচে, কি হয়েচে গিরিশ-কিসের গোল? কে ও?

    -এই দেখুন না ম্যানেজারবাবু, এই জ্যাঠা ছোকরা বাবুদের এখানে এসে বসে আছে, একেবারে সামনে-চন্দননগরের ওঁরা এসেচেন, বসাবার জায়গা নেই।–উঠতে বলচি, আবার মুখোমুখি তর্ক!

    ম্যানেজারবাবু বলিলেন–দাও না দুই থাপ্পড় বসিয়ে–

    অপু জড়সড় হইয়া কোনো দিকে না চাহিয়া অভিভূতের মতো আসরের বাহির হইয়া আসিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল আসরের সকলের চোখ তাহার দিকে, সকলেই কৌতূহলের সহিত তাহার দিকে চাহিয়া আছে! প্রথমটা ভাবিল হঠাৎ এক দৌড় দিয়া সে এখনই এক আসর লোকের চোখের আড়ালে যে কোনো জায়গায় ছুটিয়া পলায়। তাহার পর সে গিয়া এক থামের আড়ালে দাঁড়াইল। তাহার গা ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছিল ভয়ে; অপমানে, লজ্জায়, তাহার সূক্ষ্ম অনুভূতির পর্দাগুলিতে হঠাৎ বেখাপ্পা গোছের কাঁপুনি লাগিয়াছিল। একটু সামলাইয়া লইয়া থামের আড়াল হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল. কিন্তু চারিধারে চাকর-বাকর, ওপরের বারান্দায় চিকের আড়ালে মেয়েরা, বিরাঁধুনীরা নিচের বারান্দায় দাঁড়াইয়া আছে-তাহারা তো সকলেই ব্যাপারটা দেখিয়াছে, কি মনে করিতেছে। উহারা! না জানিয়া কি কাণ্ডই করিয়া বসিয়াছে! সে তো জানে না। ওটা বাবুদের জায়গা! সে বার বার মনকে বুঝাইতে চেষ্টা করিল। তাহাকে সম্ভবত কেহ চিনিতে পারে নাই। কে না কে, কত তো বাইরের লোক আসিয়াছো-কে তাহকে চিনিয়াছে?

    তাহার পর থিয়েটার আরম্ভ হইয়া গেল। সেদিকে তাহার লক্ষ্যই রহিল না। সম্মুখের এই লোকের ভিড়, বদ্ধ বায়ু, আলোর মেলা, দারোয়ান চাকরের হৈচৈ-কোনোদিকে তাহার খেয়াল রহিল না! ছটু খানসামা একটা রূপার হাঁসের পানদান লইয়া নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সারিতে পান বিলি করিতেছিল-সেইটার দিকে চাহিয়া অপুর গা যেন কেমন করিয়া উঠিল। ওপরের ঘেরা বারান্দার দিকে চাহিয়া ভাবিল, ওদিকে মা নাই তো? যদি মা একথা জানিতে পারে? কিন্তু অপুর ভয় সম্পূর্ণ অমূলক, তাহার মা তখন সে অঞ্চলেও ছিল না, এসব কথা তাহার কানেও যায় নাই।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Our Picks

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }