Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প391 Mins Read0

    ৩৫. জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি

    জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সর্বজয়া চাহিয়া-চিন্তিয়া কোনো রকমে অপুর উপনয়নের ব্যবস্থা করিল। পরের বাড়ি, ঠাকুর-দালানের রোয়াকের কোণে ভয়ে ভয়ে কাজ সারিতে হইল। বাম্‌নী মাসি নাড়ু ভাজিতে সাহায্য করিল, দু’একজন রাঁধুনী-বামুনঠাকুরকে নিমন্ত্ৰণ করিয়া আসিল, বাহিরের সম্ভ্রান্ত লোকের মধ্যে বীবু গোমস্তা ও দীনু খাতাঞ্জি। উপনয়ন মিটিয়া যাওয়ার দিনকতক পরে অপু নিজের ঘরটিতে বসিয়া বসিয়া লীলার দেওয়া বাঁধানো ‘মুকুল’ পড়িতেছিল। খোলা দরজা দিয়া কে ঘরে ঢুকিল। অপু যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করিতেই পারিল না, তাহার পরই বলিয়া উঠিল-এ কি, বাঃ—কখন—

    লীলা কৌতুক ও হাসিভরা চোখে দাঁড়াইয়া। অপু বলিল-বাঃ,  বেশ তো তুমি। বলে গেলে সোমবারে আসবো কলকাতা থেকে, কত সোমবার হয়ে গেল-ফিরবার নামও নেই–

    লীলা হাসিয়া মেজেতে বসিয়া পড়িল। বলিল-আসবো কি করে? স্কুলে ভর্তি হয়েচি, বাবা দিয়েছেন ভর্তি করে, বাবার শরীর খারাপ, এখন আমরা কলকাতার বাড়িতেই থাকবো কি না? এখন ক’দিন ছুটি আছে তাই মার সঙ্গে এলাম-আবার বুধবার যাবো।

    অপুর মুখ হইতে হাসি মিলাইয়া গেল। বলিল-থাকবে না। আর তোমরা এখানে?

    লীলা বলিল-বাবার শরীর ভালো হলে আবার আসবো–

    পরে সে হাসিমুখে বলিল-চোখ বুজে থাকো তো একটু?

    অপু বলিল-কেন?

    –থাকো না?

    অপু চক্ষু বুজিল ও সঙ্গে সঙ্গে হাতে কি একটা ভারী জিনিসের স্পর্শ অনুভব করিল। চোখ খুলিতেই লীলা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। একটা কার্ড বোর্ডের বাক্স তাহার কোলের উপর। বাক্সটা খুলিয়া ফেলিয়া লীলা দেখাইল ভালো দেশী ধুতি চাদর ও রাঙা সিস্কের একটা পাঞ্জাবি। লীলা হাসিমুখে বলিল-মা দিয়েছেন।–কেমন হয়েচে? তোমার পৈতের জন্যে–

    ধুতি-চাদর বিশেষ করিয়া পাঞ্জাবিটা দরের জিনিস, ব্যবহার করা দূরের কথা। এ বাড়িতে পা দিবার পূর্বে অপু চক্ষেও কখনও দেখে নাই।

    লীলা অপুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—এক মাসে তোমার মুখ বদলে গিয়েছে? আরও বড় দেখাচ্চে, দেখি নতুন বামুনের পৈতো?–তারপর কান বিঁধতে লাগলো না? আমার ছোট মামাতো ভাইয়েরও পৈতে হল কিনা, সে কেঁদে ফেলেছিল–

    হঠাৎ অপু একখণ্ড ‘মুকুল’ দেখাইয়া বলিল-পড়েচো এ গল্পটা?

    লীলা বলিল—কি দেখি?

    অপু পড়িয়া শোনাইল। সমুদ্রের তলায় কোন স্থানে স্পেনদেশের এক ধনরত্নপূর্ণ জাহাজ দুই তিনশত বৎসর পূর্বে ড়ুবিয়া যায়-আজ পর্যন্ত অনেকে খোঁজ করিয়াছে, কেহ স্থানটা নির্ণয় করিতে পারে নাই। গল্পটা এইমাত্র পড়িয়া সে ভারি খুশি হইয়াছে।

    বলিল-কেউ বার কর্তে পারেনি-কত টাকা আছে জানো? একক, দশক, শতক, সহস্ৰ, অযুত, লক্ষ-পঞ্চাশ লক্ষ পাউন্ডের সোনা-রুপো… এক পাউন্ডে তেরো টাকা-গুণ করো দিকি?* তাহার পরে সে তাড়াতাড়ি একটু কাগজে আঁকটা কষিয়া দেখাইয়া বলিল-এই দ্যাখো এত টাকা!…আগেও সে আঁকটা একবার কষিয়াছে। উজ্জ্বলমুখে বলিল-আমি বড় হলে যাবো-দেখবো গিয়ে-ঠিক বার করবো দেখো-কেউ সন্ধান পায়নি এখনও সেখেনে–

    লীলা সন্দিগ্ধ হইয়া বলিল-তুমি যাবে? কোন জায়গায় আছে তুমি বার করবে কি করে?

    -এই দ্যাখো লিখেচে ‘পোর্তে প্লাতার সন্নিহিত সমুদ্র গর্ভে’-খুঁজে বার করবো।….

    সে গল্পটি পড়িয়াই ভাবিয়াছে, ভালেই হইয়াছে কেহ বাহির করিতে পারে নাই। সবাই সব বাহির করিয়া লইলে তাহার জন্য কি থাকিবে? সে বড় হইয়া। তবে কি তুলিবে? এখন সে যাওয়া পর্যন্ত থাকিলে হয়!…

    লীলার বয়স কম হইলেও খুব বুদ্ধিমতী। ভাবিয়া ভাবিয়া বলিল-ওদের মতো জাহাজ পাবে কোথায়? তোমার একখানা আলাদা জাহাজ চাই-ওদের মতন–

    -সে হয়ে যাবে, কিনবো, বড় হলে আমার টাকা হবে না বুঝি?

    এবার বোধ হয় লীলার অনেকটা বিশ্বাস হইল। সে এ লইয়া আর কোনও তর্ক উঠাইল না।

    খানিকটা পরে বলিল-তুমি কলকাতা গিয়েচ?

    অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল-আমি দেখিনি কখখনো-খুব বড় শহর?—এর চেয়ে বড়?

    লীলা হাসিয়া বলিল—ঢের ঢের–

    –কাশীর চেয়েও বড়?

    –কাশী আমি দেখিনি—

    তারপর সে অপুকে নিজের পড়ার ঘরে লইয়া আসিল। একখানা খাতা দেখাইয়া বলিল–দ্যাখো তো কেমন ফুলগাছ এঁকেচি, কি রকম ড্রইংটা?

    অপু খানিকটা পরে বলিল-আমি শুইগে, মাথাটা বড় ধরেচে—

    লীলা বলিল-দাঁড়াও আমি একটা মন্তর জানি মাথা-ধরা সারাবার-দেখি? পরে সে দুহাতের আঙুল দিয়া কপাল এমনভাবে টিপিয়া দিতে লাগিল যে অপু হাসিয়া উঠিয়া বলিল-উঃ বড় সুড়সুড়ি লাগচে।

    লীলা হাসিয়া বলিল-আমার বড় মামাতো ভাইকে কুস্তি শেখায় একজন পালোয়ান আছে, তার কাছে শেখা-বেশ ভালো না? সেরেচে তো?

    দিনকতক পরেই লীলারা পুনরায় কলিকাতায় চলিয়া গেল।

     

    অপু মাকে বলিয়া কহিয়া একটা ছোট স্কুলে যায়। যে বড় রাস্তার ধারে ইঁহাদের বাড়ি, সেখান হইতে কিছুদূর গিয়া বঁ-ধারে ছোট গলির মধ্যে একতলা বাড়িতে স্কুল। জনপাঁচেক মাস্টার, ভাঙা বেঞ্চি, হাতল-ভাঙা চেয়ার, তেলকালি ওঠা ব্ল্যাকবোর্ড, পুরানো ম্যাপ খানকতক-ইহাই স্কুলের আসবাব। স্কুলের সামনেই খোলা ড্রেন, অপুদের ক্লাস হইতে জানালা দিয়া বাহিরে চাহিলে পাশের বাড়ির চুনবালির কাজ-বিরহিত নগ্ন ইটের দেওয়াল নজরে পড়ে। সে স্কুলে যাইতে যাইতে দেখে ধাঙড়ে ড্রেন সাফ করিতে করিতে চলিয়াছে, স্থানে স্থানে ময়লা জড়ো করা। সারাদিন স্কুলের মধ্যে কেমন একটা বদ্ধ বাতাসের গন্ধ, পাশের এক হিন্দুস্থানী ভুজাওয়ালা দুপুরের পর কয়লার আঁচ দেয়, কাঁচা কয়লার ধোঁয়ার মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বাহির হয়, অপুর মাথার মধ্যে কেমন করে, স্কুলের বাহিরে আসিয়া যেন সেটা কাটিতে চায় না।

    তাহার ভালো লাগে না, মোটেই ভালো লাগে না, শহরের এই সব ইট-সিমেন্টের কাণ্ড-কারখানায় তাহার হাঁফ ধরে, কেমন যেন দম আটকাইয়া আসে। কিসের অভাবে প্ৰাণটা যেন আকুলি-বিকুলি করে, সে বুঝিতে পারে না কিসের অভাবে।

    পথে ঘাস খুব কম, গাছপালা বেশি নাই, দু’একটা এখানে ওখানে। সুরকির পথ, পাকা ড্রেন, দুই বাড়ির মাঝখানের ফাঁকে আবর্জনা, ময়লা জল, ছেঁড়া কাপড়, কাগজ। একদিন সে এক সহপাঠীর সঙ্গে তাহদের বাড়িতে গিয়াছিল। একতলা খোলার ঘর। অপরিসর উঠানের চারিধারের ঘরগুলিতে এক-একঘর গৃহস্থ ভাড়াটে থাকে। দোরের গায়ে পুরানো চটের পর্দা। ঘরের মেঝে উঠান হইতে বিঘাতের বেশি উঁচু নয়, কাজেই আদ্রতা কাটে না। ঘরের মধ্যে আলো-হাওয়ার বালাই নাই। উঠান বিশ্ৰী নোংরা, সকল গৃহস্থই একসঙ্গে কয়লার আঁচ দিয়াছে, আবার সেই মিষ্টি মিষ্টি গন্ধটা। সবসুদ্ধ মিলিয়া অপুর অত্যন্ত খারাপ লাগে, মন যেন ছোট এতটুকু হইয়া যায়, সেদিন তাহারা উহাকে বসিতে বলিলেও সে বেশিক্ষণ থাকিতে পারে নাই, সদর রাস্তায় আসিয়া তবুও অনেকটা স্বস্তি বোধ করিয়াছিল।

    বাড়ি ফিরিয়াও সেই বদ্ধতা। বরং যেন আরও বেশি। এখানে ইট-সিমেন্ট আর মার্বেল পাথরে চারিধার মায় উঠান পর্যন্ত বাঁধানো। অপু মাটি দেখিতে না পাইলে থাকিতে পারে না, এখানে যা মাটি আছে, তাও যেন অন্যরকম। যে মাটির সঙ্গে তার পরিচয় এ যেন সে মাটি নয়। তাহা ছাড়া ইহাদের বাড়ি চলিবার ফিরিবার স্বাধীনতা কই? থাকিতে হয় ভয়ে ভয়ে চোরের মতো। কে কি বলিবে, উঁচু গলায় কথা কওয়া যায় না, ভয় করে।

    এক-একদিন অপু দপ্তরখানায় গিয়া দেখিয়াছে বুড়ো খাতাঞ্জি একটা লোহার সিক বসানো খাঁচার মতো ঘরে অন্ধকারের মধ্যে বসিয়া থাকে। অনেকগুলি খেরো বাঁধানো হিসাবের খাতা একদিকে স্তুপীকৃত করা। ছোট্ট কাঠের হাতবাক্স সামনে করিয়া বুড়া সারাদিন ঠায় একটা ময়লা চিট তাকিয়া হেলান দিয়া আছে। ঘরে এত অন্ধকার যে, দিনমানেও মাঝে মাঝে ছোট্ট একটা রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলে। গিরিশ গোমস্ত জমা-সেরেস্তায় বসে। নিচু তক্তাপোশের উপর ময়লা চাদর পাতা-চারিধারে দু’কোণে কাপড়ে বাধা রাশি রাশি দপ্তর। সে ঘরটা খাতাঞ্জিখানার মতো অত অন্ধকার নয়, দু’তিনটি বড় বড় জানালাও আছে, কিন্তু তক্তপোশের নিচে রাশীকৃত তামাকের গুল ও ছেড়া কাগজ এবং কড়িকাঠে মাকড়সার জাল ও কেরোসিন আলোর ঝুল। যখন বীরু মুকুরি হ্যাঁকিয়া বলে-ওহে রামদায়াল, দেখো তো গত তৌজিতে বাদ্যকর খাতে কত খরচ লেখা আছে?… তখনই কি জানি কেন অপুর মনে দারুণ বিতৃষ্ণা আবার জাগিয়া উঠে।

    সকালবেলা। অপু দেউড়ির কাছটায় আসিয়া দেখিল বাড়ির ছেলেরা চেয়ার-গাড়িটা ঠেলিয়া খেলিতেছে। গাড়িটা নূতন তৈয়ারি হইয়া আসিয়াছে, ডাণ্ডালাগানো লোহার চেয়ার, উপরে চামড়ার গদি, বড় বড় চাকা-ঝকঝকে দেখিতে। সে কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছে, রমেন বলিল-এই এসে ঠেল তো একবার আমাদের–

    এই গাড়িটা আসা অবধি অপুর মনে মনে ইহার উপর লোভ আছে, খুশি হইয়া বলিল–ঠেলচি, আমায় একবার চড়তে দেবেন তো?

    রমেন বলল-আচ্ছা হবে, ঠেল। তো-খুব জোরে দিবি—

    খুব খানিকক্ষণ খেলা হইবার পর রমেন হঠাৎ বলিল-আচ্ছা খুব হয়েচে এবেলা-থায় আর নয়–

    পরে গাড়ি লইয়া সকলে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া অপু বলিল-আমি এটু চড়বো না?

    রমেন বলিল-আচ্ছা যা যা, এ কেলা আর চড়ে না, বেশি চড়লে আবার ভেঙে যাবে-দেখা যাবে ওবেলা–

    ক্ষোভে অপুর চোখে জল আসিল। সে এতক্ষণ ধরিয়া আশায় আশায় ইহাদের সকলকে প্ৰাণপণে ঠেলিয়াছে।

    বলিল-বা, আপনি যে বল্লেন আমাকে একবার চড়তে দেবেন আমার পালায়? আমি সকলকে ঠেললাম-বেশ তো! সেদিনও ওইরকমই চড়ালেন না শেষকালে–

    রমেন বলিল-ঠেললি কেন তুই, না ঠেলিলেই পাত্তিস-যা-কে বলেচে তোকে চড়তে দেবে? গাড়ি কিনতে পয়সা লাগে না?

    সে বলিল-কেন আপনিও বল্লেন, ওই সন্তুও তো বল্লে-ঠেলে ঠেলে আমার হাত গিয়েছে।–আর আমি বুঝি একবারটি-বেশ তো আপনি—

    রমেন গরম হইয়া বলিল-আমি বলিনি। যা—

    সন্তু বলিল-ফু-র্‌-র্‌-র্‌,-বক দেখেচ?

    কোনও কিছু না, হঠাৎ বড়বাবুর ছেলে টেবু আসিয়া তাহার গলায় হাত দিয়া ঠেলিতে ঠেলিতে বলিল—যা যা—আমরা চড়াবো না আমাদের খুশি—তোর নিজের ঘরের দিকে যা–এদিকে আসিস কেন খেলতে?

    টেবু অপুর অপেক্ষা বয়সে ছোট বলিয়া তাহার কৃত অপমানের দরুনই হউক বা সকলের ঠাট্টা বিদ্রুপের জন্যই হউক–অপুর মাথা কেমন বেঠিক হইয়া গেল-সে বাঁকুনি দিয়া ঘাড় ছিনাইয়া লইয়া টেবুকে এক ধাক্কা মারিতেই টেবু ঘুরিয়া গিয়া দেওয়ালের উপর পড়িয়া গেল-কপালটা দেওয়ালে লাগিয়া খানিকটা কাটিয়া রক্তপাত হইতে টেবু সঙ্গে সঙ্গে বিকট চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

    ঝি-চাকর ছুটিয়া আসিল, খানসামা দারোয়ান ছুটিয়া আসিল—উপরের বৈঠকখানায় বড়বাবু সকালবেলা কাছারি করিতেছিলেন, তিনি সদলবলে নিচে নামিয়া আসিলেন। দশ দিক হইতে দশ ঘটি জল…বাতাস…জলপটি, হৈ হৈ কাণ্ড।

    গোলমাল একটু কমিলে বড়বাবু বলিলেন–কই, কে মেরেচে দেখি?

    রামনিহোরা সিং দারোয়ান পিছন হইতে ঠেলিয়া অপুকে বড়বাবুর সামনে দাঁড় করাইয়া দিল।

    বড়বাবু বলিলেন—এ কে? ওই সেই কাশীর বামুনঠাকরুনের ছেলে না?

    গিরিশ সরকার আগাইয়া আসিয়া বলিল-ভারি বদ ছোকরা—আবার জ্যাঠামি ওর যদি শোনেন বাবু, সেই সেবার থিয়েটারের দিন, বসেচে একেবারে সকলের মুখের সামনে বাবুদের জায়গায়, সরে বসতে বলেচি, মুখোমুখি তর্ক কি? সেদিন আবার দেখি ওই শেঠেদের বাড়ির মোড়ে রাস্তায় একটা লাল পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বার্ডসাই খেতে খেতে আসচে–এই বয়সেই তৈরি–

    বড়বাবু রমেনকে বলিলেন–সকলে আজ তোমাদের মাস্টার আসেনি? পড়াশুনো ছিল না? এই, আমার বেতের ছড়িটা নিয়ে এসো তো কেউ? ওর সঙ্গে মিশে খেলা কর্তে কে বলে দিয়েচে তোমাদের?

    রমেন কঁদো কঁদো মুখে বলিল-ও-ই তো আমাদের খেলার সময় আসে, আমরা কেন যাবো, জিজ্ঞেস করুন, বরং সন্তুকে-আপনার সেই ছবিওয়ালা ইংরাজি ম্যাগাজিনগুলোর ছবি দেখতে চায়-আবার বড় বৈঠকখানায় ঢুকে এটা সেটা নেড়েচেড়ে দেখে–

    গিরিশ সরকার বলিল-দেখুন, শখটা দেখুন আবার—

    এবার অপুর পালা। বড়বাবু বলিলেন।–সরে এসে এদিকে-টেবুকে মেরেছ কেন?

    ভয়ে অপুর প্রাণ ইতিপূর্বেই উড়িয়া গিয়াছিল, সে রাগের মাথায় ধাক্কা দিয়াছিল বটে। কিন্তু এত কাণ্ডের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে আড়ষ্ট জিহ্বা দ্বারা অতি কষ্টে উচ্চারণ করিল-টেবু আমাকে আগে তো—আমাকে–

    বড়বাবু কথা শেষ করিতে না দিয়াই বলিলেন-টেবুর বয়স কত আর তোমার বয়স কত জানো?

    গুছাইয়া বলিতে জানিলে অপুর পক্ষ হইতেও একথা বলা চলিত যে টেবুর বয়স কিছু কম হইলেও কার্যে সে অপুর জেঠামশাই নীলমণি রায় অপেক্ষাও পাকা। বলা চলিতে পারিত যে, টেবু ও এ-বাড়ির সব ছেলেই বিনা কারণে যখন তখন তাহাকে বাঙাল বলিয়া খোপায়, বক দেখায়, পিছন হইতে মাথায় ঠোকর মারে-সে না হয় একটু খেলা করিতে যায়। এই তো তাহার অপরাধ। কিন্তু উঠানভরা লোকারণ্যের কৌতূহলী দৃষ্টির সম্মুখে বিশেষ করিয়া বড়বাবুর সঙ্গে কথা কহিতে জিহ্বা তাহার তালুর সঙ্গে জুড়িয়া গিয়াছিল-সে শুধু বলিল-টেবুও-আমাকে-শুধু শুধু-আমাকে এসে–

    বড়বাবু গর্জন করিয়া বলিলেন-স্টুপিড, ডেঁপো ছোকরা-কে তোমাকে বলে দিয়েচে এদিকে এসে ওদের সঙ্গে মিশতে-এই দাও তো বেতোটা-এগিয়ে এসো-এসো–

    সপাং করিয়া এক ঘা সজোরে পিঠে পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সে কেমন বিস্ময়ের চোখে বড়বাবু ও তাঁহার পুনর্বার উদ্যত বেতের ছড়িটার দিকে চাহিল-জীবনে সে কখনও ইহার পূর্বে মার খায় নাই, বাবার কাছেও নয়।–তাহার বিভ্রান্ত মন যেন প্রথমটা প্রহার খাওয়ার সত্যটাকে গ্ৰহণ করিতে পারিতেছিল না-পরে সে কতকটা নিজের অজ্ঞাতসারেই বেতোটা ঠেকাইবার জন্য হাত দুখানা উঠাইল। কিন্তু এবার আর তাহার দুঃখ করিবার কিছু রহিল না যে, সে তাহার পালার বেলা ফাঁকে পড়িল। বেতের সপাসপ শব্দে টেবুকেও কপালের ব্যথা ভুলিয়া চাহিয়া দেখিতে হইল। রাঁধুনীর ছেলের যাহাতে স্পর্ধা আর না হয়, বড়বাবু এ বিষয়ে তাহাকে সুশিক্ষাই দিলেন। অন্য বেত হইলে ভাঙিয়া যাইত, এ বেতটা বোধ হয় খুব দামি।

    বড়বাবু হাঁপ জিরাইয়া লইয়া বলিলেন-বুড়ো ধাড়ি বয়াটে ছোকরা কোথাকার, আজ তোমাকে সাবধান করে দিচ্চি, ফের যদি শুনি এ বাড়ির কোনো ছেলের সঙ্গে মিশেচ, কান ধরে তক্ষুনি বাড়ি থেকে বিদেয করে দেবো-পরে কাহার দিকে চাহিয়া কহিলেন-দেখুন না ধীরেনবাবু, বিধবা মা, সতীশবাবু ম্যানেজার কাশী থেকে আনলেন, ভাবলাম জাতের মেয়ে থাকুক-দেখুন কাণ্ড, মা ভাত রাঁধে-উনি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে সিগারেট খেয়ে বেড়ান–

    ধীবেনবাবু বলিলেন-ওসব ওই রকমই হয়ে থাকে-এরপর কোকেন খাবে-মা’র বাক্স ভাঙবে-ওর নিয়মই ওই-তার ওপর আবার কাশীর ছেলে–

    বাড়ির মধ্যে সব কথা গিয়া পৌঁছায় না, অপুর মার খাওয়ার কথা কিন্তু সর্বজয়া শুনিল। একটু ভালো করিয়াই শুনিল। গৃহিণী বলিলেন-ওরকম যদি গুণ্ডে ছেলে হয় তা হলে বাছা-ইত্যাদি।

    রুটির ঘর হইতে আসিয়া দেখিল অপু স্কুলে গিয়াছে, মাকে কিছু বলে নাই, এসব কথা সে কখনও মাকে বলেও না। রাগে দুঃখে, ক্ষোভে সর্বজয়ার গা ঝিম ঝিম করিতে লাগিল, সর্বাঙ্গ হইতে যেন ঝাল বাহির হইতে থাকিল, ঘরে না থাকিতে পারিয়া সে বাহিরের অপরিসর বারান্দাটাতে আসিয়া দাঁড়াইল।

    তাহার অপুর গায়ে হাত! সে যে এখনও বলে, মা সিঁড়ির ঘর দিয়ে যখন তুমি রান্নাবাড়ি থেকে আসবে তখন রাত্রে তোমায় একদিন এমন ভয় দেখাবো?…তাহার কি কোনো বুদ্ধি আছে? কত লাগিয়াছিল, কে তাহাকে বুঝিয়াছে সেখানে, কে শুনিয়াছে তাহার কান্না?

    সর্বজয়ার বুক ফাটিয়া কান্না আসিল।….

    অন্ধকার রাত, আকাশে দু’একটা তারা জ্বল জ্বল করে-আস্তাবলের মাথায় আমলকি গাছের ডালে বাতাস বাধে, দালানের কোণের লোহার ফুটা চৌবাচ্চার পাশে বসিয়া কথাটা ভাবিতে ভাবিতে কান্নার বেগে তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল–

    -ঠাকুর, ঠাকুর, ও আমার বড় আদরের ধন, তুমি তো জানো ও একদণ্ড চোখের আড়াল থেকে সরলে আমি স্থির থাকতে পারি নে, যা কিছু শাস্তি দেবার আমার ওপর দিয়ে দাও, ঠাকুর ওকে কিছু বোলো না, আমার বুক ফেটে যায় ঠাকুর, তা আমি সইতে পারবো না—

     

    সকাল সকাল অপুদের স্কুলের ছুটি হইয়া গেল। তাহার ক্লাসের ছেলেরা ধরিলে তাহদের ফুটবল খেলায় অপুকে রেফারি হইতে হইবে। অপু ভারি খুশি হইল, ফুটবল খেলা সে এ শহরে আসিবার পূর্বে কোনোদিন দেখে নাই, সে খুব ভালো খেলিতেও পারে না, তবুও কিন্তু ক্লাসের ছেলেরা তাহাকেই সকলের চেয়ে পছন্দ করে, খেলায় রেফারি হইতে প্রায়ই তাহার ডাক পড়ে।

    সে বলিল-সেই বড় হুইসিলটা বাড়ি থেকে নিয়ে আসি ভাই, বাক্সে পড়ে রয়েচে, আমি ঠিক চারটের সময় মাঠে যাবো এখন–

    পথে আসিতে আসিতে অপুর সকালের কথাটা মনে উঠিল। আজ সারা দিনটাই সে সে-কথা ভাবিয়াছে। বার্ডসাই খাইতে গিয়া সেদিন গিরিশ সরকারের সামনে পড়িয়া গিয়াছিল একথা ঠিক কিন্তু বার্ডসাই কি সে রোজ খায়? সেদিন মেজ বৌরানীর দেওয়া রাঙা পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়া স্কুল হইতে ফিরিবার-পথে তাহার হঠাৎ শখ হইয়াছিল, এই রকম পাঞ্জাবি গায়ে দিয়া বাবুরা বার্ডসাই খায়, সেও একবার খাইবে। তাই খাবারের পয়সাটায় বার্ডসাই কিনিয়া সে ধরাইয়া খাইতেছিল, কিন্তু সেই একদিন নিশ্চিন্দিপুরে লুকাইয়া খাইতে গিয়াও ভালো লাগে নাই, সেদিনও লাগিল না। তাহার মনে হইয়াছিল-দূর! এ না কিনে এক পয়সার ছোলাভাজা কিনলে বেশ হত! এ যে কেন লোকে কিনে খায়, কিন্তু গিরিশ সরকার না জানিয়া-শুনিয়া তাহাকে যা-তা বলিল কেন?

    ভাগ্যিস লীলা এখানে নাই। থাকিলে সে দেখিলে বড় লজ্জার কথা হইত। মাও বোধ হয় টের পায় নাই। পাছে মা টের পায় এই জন্যই তো সে ওবেলা তাড়াতাড়ি স্কুলে চলিয়া আসিয়াছিল!

    লীলা কতদিন এখানে আসে নাই! সেই আর বছর গিয়াছে আর আসে নাই। এখন আসিলেই কি আর উহারা তাহার সহিত কথা কহিতে দিবে?

    বাড়ি ফিরিতেই দেউড়ির কাছটায় আসিয়া শুনিল উপরের বৈঠকখানায় কলের গান হইতেছে। শব্দটা কানে যাইতেই সে খুশি-ভরা উৎসুক চোখে মুখ উঁচু করিয়া দোতলার জানলার নিচে রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া গেল। রাস্তা হইতে গানের কথা সব ভালো বোঝা যায় না। কিন্তু সুরটি ভারি চমৎকার, শুনিতে শুনিতে-স্কুল, খেলা, রেফারিগিরি, ওবেলা মারা-খাওয়া, মন হইতে সব একেবারে মুছিয়া গেল।

    গানের সুরে তাহার মনটা আপনা-আপনি কোথায় উড়িয়া যায়-সেই তখন তখন নিশ্চিন্দিপুরের নদীর ধারে বেড়াইতে গিয়া কতদিন দেখিত, ওপারে উলুখড়েব মাঠে ছোট রাঙা ফুলে-ভরা শিমুল চারা, তাহাদের পিছনে কত দূরে নীল আকাশের পট-খড়ের মাঠ যেন আঁকা, রাঙা-ফুল শিমুলচারা যেন আঁকা, শুকনো ডালে কি পাখি বসিয়া থাকিত-সব যেন আঁকা। তাঁহাদের সকলের পিছনে সেই দেশটা, ব-হু-উ-দূরের দেশটা-কোন দেশ তাহার জানা নাই, মাত্র মনের খুশিতে সেটা ধরা দিত।

    কে যেন ডাকে, কতদূর হইতে উচ্ছ্বসিত আনন্দভরা পরিচিত সুরের ডাক আসে-অপু-উ-উ-উ-উー

    মন খুশিতে ভরিয়া উঠিয়া সাড়া দেয়-যা—আ-আ-ই-ই-ই-

    তাহদের ছোট ঘরটাতে ফিরিতে তাহার মা জিজ্ঞাসা করিল–সকাল সকাল এলি যে?

    সে বলিল-ওপর ক্লাসের ছেলেরা বল খেলায় জিতেছে তাই হাফ স্কুল—

    তাহার মা বলিল-আয় বোস এখানে। খানিকক্ষণ পরে গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে একটু ইতস্তত করিয়া বলিল-আজ তোকে ওরা কি জন্যে নাকি ডেকে নিয়ে গিয়ে নাকি-বকেচে?

    –নাঃ, ওই টেবুর একটুখানি লেগেচে। তাই বড় বাবু ডেকে বলছিলেন কি হয়েচে-তাই-

    -বকে-টকে নি তো?

    –নাঃ–

    তাহার মা খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল-একটা কথা ভাবচি, এখান থেকে চলে যাবি?

    সে আশ্চর্য হইয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিল। পরে হঠাৎ খুশি হইয়া বলিয়া উঠিল–কোথায়

    মা, নিশ্চিন্দিপুর? সেই বেশ তো, চলো, আমি সেখানে ঠাকুর-পূজো করবো-পৈতেটা তো হয়ে গিয়েচে-নিজেদের দেশ, বেশ হবে-এখানে আর থাকবো না–

    সর্বজয়া বলিল-সে কথাও তো ভাবচি আজি দু’বছর। সেখানে যাবি বলচিস, কি আর আছে বল দিকি সেখানে? এক বাড়িখানা, তাও আজ তিন বছর বর্ষার জল পাচ্চে, তার কিছু কি আছে অ্যাদ্দিন? মান্ধাতার আমলের পুরোনো বাড়ি-ছিল একটু ধানের জমি, তাও তো-গিয়ে মাথা গোঁজবার জায়গাটুকু নেই-শত্তুর হাসাতে যাওয়া… খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—একটা কাজ কল্লে হয়, চল বরং-আচ্ছা কাশী যাবি?

    বিশেষ কিছু ঠিক হইল না। তাহার মায়ের তখনও খাওয়া হয় নাই। স্নান সারিয়া পুনরায় রান্নাবাড়ি চলিয়া গেল। অপুর একটা কথা মনে হইল। তাহার গানের গলা আছে, দিদি বলিত, যাত্ৰাদলের বন্ধুও সেবার বলিয়াছিল। সে যদি কোনো যাত্ৰাদলে যায়, তাহাকে নেয় না? এখানে মা’র বড় কষ্ট। এখান হইতে সে মাকে লইয়া যাইবে!

    উঃ কি গরম! রান্নাবাড়ির নলের মুখে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া উঠিতেছে, কার্নিসের গায়ে রোদ, ঘরের ভিতরটা এরই মধ্যে অন্ধকার, আস্তাবলে মাতাবিয়া সহিস কি হিন্দি বুলি বলিতেছে. পাথর-বাঁধানো মেজেতে ঘোড়ার খুর ঠুকিবার খট্‌ খট্‌ আওয়াজ, ড্রেনের সেই গন্ধ… তাহার মাথাটা এমন ধরিয়াছে যেন ছিঁড়িয়া পড়িতেছে। সে ভাবিল … এখন একটু শুয়ে নিই, এরপর উঠে খেলার মাঠে যাবো–মোটে তিনটে বেজেছে-এখন বড় রোদটা।

    বিছানায় শুইয়া একটা কথাই বার বার তাহার মনে আসিতে লাগিল। এ কথাটা এতদিন এভাবে সে ভাবিয়া দেখে নাই। এতদিন যেন তাহার মনের কোন কোণে সব সময়ই স্পষ্টভাবে জাগিয়া থাকিত যে, এ সবের শেষে যেন তাহদের গ্রাম অপেক্ষা করিয়া আছে–তাহদের জন্য! যদিও সেখান হইতে চলিয়া আসিবার সময় ফিরিবার কোনো কথাই ছিল না-সে জানে, তবুও এ মোহটুকু তার একেবারে কাটে নাই।

    কিন্তু আজকার সমুদয় ব্যাপারে বিশেষ করিয়া মাযেব ও বড়বাবুব কথায় তাহাদের নিরাশ্রয়তা ও গৃহহীনতার দিকটা তাহার কাছে বেশ স্পষ্ট হইয়া উঠিল। আর কি কখনও সে তাহাদের গায়ে ফিরিতে পাইবে না?–কখনও না?–কখনও না?

    এই বিদেশ, এই গিরিশ সরকার, এই চোর হইয়া থাকা-না হয় মায়ে ছেলে হাত ধরিয়া ছন্নছাড়া পথে পথে চিরকাল-এরাই কি কায়েম হইতে আসিয়াছে?

    আস্তাবলে দুই সহিসে বাগড়া বাধাইয়াছে, রান্নাবাড়ির ছাদে কাকের দল ভাতের লোভে দলে দলে জুটিতেছে-একটু পরে তাহার মনে হইল, একই কি কথা অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতেছে, একই কি কথা। আস্তাবলে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ থামে নাই.. সে যেন মাটির ভিতর কোথায় সেঁধিয়া যাইতেছে… খুব, খুব মাটির ভিতর. নিচের দিকে কে যেন টানিতেছে… বেশ আরাম…মাথা ধরা নাই, বেশ আরাম…

    উঃ—কি রোদটাই ঝাঁ-ঝাঁ করিতেছে! দিদির যা কাণ্ড—এত রোদ্দুরে চড়ুইভাতি! সে বলিতেছে—দিদি শুয়ে নে, এত রোদ্দুরে চড়ুইভাতি?

    রানুদি কানের কাছে বসিয়া কি সব কথা, অনেক কি সব কথা বলিয়া যাইতেছে। রানুদির ছলছল ডাগর চোখ দুটি অভিমান-ভরা! সে কি করিবে? নিশ্চিন্দিপুরে তাদের চলে না যে? রানুদি না লীলা?

    হারান কাকা বাঁশের বাঁশি বেচিবার জন্য আনিয়া বাজাইতেছে…ভারি চমৎকার বাজায়! সে বাবাকে বলিল—এক পয়সার বাঁশের বাঁশি কিনবো বাবা, একটা পয়সা দেবে?…

    তাহার বাবা তাহার বড় বড় চুল কানের পাশে তুলিয়া দিতে দিতে আদর করিয়া বলিতেছে–বেশ হয়েচে তোর গল্পটা, ছাপিয়ে এলে আমায় দেখতে দিস খোকা?

    সে বলিতেছে-কোকেন কি বাবা? গিরিশ সরকার বলেচে। আমি নাকি কোকেন খাবো—

    বাবার গলায় পদ্মবীজের মালা। সেই কথকঠাকুরের মতো।

    তাহদের মাঝেরপাড়ার ইস্টিশন। কাঠের বড় তক্তাটায় লেখা আছে, মা-ঝে-র-পা-ড়া। সে আগে আগে ভারী বোঁচকাটা পিঠে, মা পিছনে পিছনে। তাহার গায়ে রাঙা পাঞ্জাবিটা। কেমন ছায়া সারাপথে। আকাশে সন্ধ্যাতারা উঠিয়াছে। পাকা বটফলের গন্ধে-ভরা বাতাসটা।

    নিশ্চিন্দিপুরের পথ যেন ফুরাইতেছে না…সে চলিয়াছে…চলিয়াছে..চলিয়াছে…সে আর মা…এ পথে একা কখনও আসে নাই, পথ সে চিনিতে পারিতেছে না…ও কাস্তে হাতে কাকা, শুনচো, নিশ্চিন্দিপুরের পথটা এটু বলে দ্যাও না আমাদের? যশড়া-নিশ্চিন্দিপুর, বেত্ৰবতীর ওপারে?

    তাহার মা ঘরে ঢুকিয়া বলিল-হ্যাঁরে ওঠ, ও অপু, বেলা যে আর নেই, বললি যে কোথায় খেলতে যাবি?-ওঠ-ওঠ।

    সে মায়ের ডাকে ধড়মড় করিয়া বিছানার উপর উঠিয়া বসিয়া চারিদিকে চাহিল-উঃ কি বেলাই গিয়াছো… রোদ একেবারে কোথায় উঠিয়া গিয়াছে? তাহার মা বলিল-বললি যে কোথায় খেলতে যাবি, তা গেলি কই? অবেলায় পড়ে পড়ে কি ঘুমটাই দিলি? দেবো তোর সেই বাঁশিটা বের করে?

    তোরঙ্গ হইতে বাহির করিয়া বাঁশিটিা মা বিছানার কোণে রাখিয়া দিল বটে, সে কিন্তু রেফারিগিরি করিতে যাওয়ার কোনো উৎসাহ দেখাইল না। ঘরের ভিতর এরই মধ্যে অন্ধকার! উঠিয়া আসিয়া জানালার কাছে অন্যমনস্কভাবে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। বেলা একেবারে নাই। এক অসহ্য গুমোট! আস্তাবলের ড্রেনের গন্ধটা যেন আরও বাড়িয়াছে। ফটকের পেটাঘাঁড়িতে ঠং ঠাং করিয়া বোধ হয় ছটা বাজাইতেছে।

    ওই আস্তাবলের মাথাব্য যে আকাশটা, ওরই ওপারে পূর্বদিকে বহুদূরে তাঁহাদের নিশ্চিন্দিপুর।

    আজ কতদিন সে নিশ্চিন্দিপুর দেখে নাই-তি-ন বৎসর! কতকাল!

    সে জানে নিশ্চিন্দিপুর তাহাকে দিন রাতে সব সময় ডাকে, শাঁখারিপুকুর ডাক দেয়, বাঁশবনটা ডাক দেয়, সোনাডাঙার মাঠ ডাক দেয়, কদমতলার সায়েবের ঘাট ডাক দেয়, দেবী বিশালাক্ষী ডাক দেয়।

    পোড়ো ভিটার মিষ্ট লেবু ফুলের গন্ধে সজনেতলার ছায়ায় ছায়ায় আবার কবে গতিবিধি? আবার কবে তাহদের বাড়ির ধারের শিরীষ সৌদালি বনে পাখির ডাক?

    এতদিনে তাহদের সেখানে ইছামতীতে বর্ষার ঢল নামিয়াছে। ঘাটের পথে শিমুল তলায় জল উঠিয়াছে। ঝোপে ঝোপে নাটা-কাঁটা, বনকলমির ফুল ধরিয়াছে। বন অপরাজিতার নীল ফুলে বনের মাথা ছাওয়া।

    তাহাদের গ্রামের ঘাটটাতে কুঁচ-ঝোপের পাশে রাজুকাকা হয়তো এতক্ষণে তাহার অভ্যাসমতো

    মাছ ধরিবার দোয়াড়ি পাতিয়াছে, আজ সেখানকার হাট-বার, ঠাকুরঝি-পুকুরের সেই বটগাছটার পিছনে দিগন্তের কোলে রাঙা আগুনে, এফনার মতো সূর্য অস্ত যাইতেছে, আর তাহারই তলাকার মেঠোপথ বাহিয়া গ্রামের ছেলে পটু, নীলু, তিনু, ভোলা সব হাট করিয়া ফিরিতেছে।

    এতক্ষণে তাদের বনে-ঘেরা বাড়িটার উঠানটাতে ঘন ছায়া পড়িয়া আসিতেছে, কিচ্‌ কিচ্‌ করিয়া পাখি ডাকিতেছে, সেই মিষ্ট নিঃশব্দ শান্ত বৈকাল-সেই হলদে পাখিটা আজও আসিয়া পাচিলের উপরের কঞ্চির ডালটাতে সেই রকমই বসে, মায়ের হাতে পোতা লেবুচারাটাতে হয়তো এতদিনে লেবু ফলিতেছে।.

    আরও কিছুক্ষণ পরে তাহাদের সে ভিটায় সন্ধ্যার অন্ধকার হইয়া যাইবে, কিন্তু সে সন্ধ্যায় সেখানে কেহ সঁজ জ্বলিবে না, প্ৰদীপ দেখাইবে না, রূপকথা বলিবে না। জনহীন ভিটার উঠানভরা কালমেঘের জঙ্গলে বিঝি পোকা ডাকিবে, গভীর রাত্রে পিছনের ঘন বনে জগড়ুমুর গাছে লক্ষ্মীপেচার রব শোনা যাইবে…কেহ কোনোদিন সেদিক মাড়াইবে না, গভীর জঙ্গলে চাপা-পড়া মায়ের সে লেবুগাছটার সন্ধান কেহ কোনোদিন জানিবে না, ওড়া-কলমির ফুল ফুটিয়া আপনাআপনি ঝরিয়া পড়িবে, কুল নোনা মিথ্যাই পাকিবে, হলদে।-ডানা তেড়ো পাখিটা কাঁদিয়া কাঁদিয়া ফিরিবে।

    বনের ধারে সে অপূর্ব মায়াময় বৈকালগুলি মিছামিছিই নামিবে চিরদিন।

    ওবেলা এক উঠান লোকের সম্মুখে বিনাবিচারে মারা খাইয়াও তাহার চোখ দিয়া এক ফেঁটা জল বাহির হয় নাই, কিন্তু এখন নির্জন ঘরের জানালোটাতে এক-একা দাঁড়াইয়া হঠাৎ সে কাঁদিয়া আকুল হইল, উচ্ছ্বসিত চোখের জল ঝর-ঝর করিয়া পড়িয়া তাহার সুন্দর কপোল ভাসাঁইয়া দিতেই চোখ মুছিতে হাত উঠাইয়া আকুল সুরে মনে মনে বলিল-আমাদের যেন নিশ্চিন্দিপুর ফেরা হয়ভগবান-তুমি এই কোরো, ঠিক যেন নিশ্চিন্দিপুর যাওয়া হয়-নইলে বাঁচবো না-পায়ে পড়ি তোমার–

    পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন-মুৰ্থ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়? তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বোত্রাবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে…দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে…

    দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বস্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়… তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শ্যাওলা-ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয় না…চলে…চলে…চলে…এগিয়েই চলে…

    অনিৰ্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অন্যস্ত কাল আর অনন্ত আকাশ….

    সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমায় ঘরছাড়া করে এনেছি!…

    চল এগিয়ে যাই।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.