Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথে প্রবাসে ও নির্বাচিত প্রবন্ধ – অন্নদাশঙ্কর রায়

    অন্নদাশঙ্কর রায় এক পাতা গল্প410 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    যে-দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা

    যে-দেশে বহু ধর্ম সেদেশের মূলনীতি কী হওয়া উচিত? এ প্রশ্নের উত্তর পাকিস্তান একভাবে দিয়েছে। ভারত দিয়েছে অন্যভাবে। পাকিস্তানের অধিকাংশের ইচ্ছা অনুসারে স্থির হয়ে গেছে পাকিস্তান হচ্ছে ইসলামি রাষ্ট্র।

    সেই যুক্তি অনুসরণ করলে ভারত হতে পারত হিন্দু রাষ্ট্র। কিন্তু ভারত করল অপর একটি যুক্তি অবলম্বন। ভারতের মতে সব ধর্মই সমান, সব ধর্মই সত্য, সংখ্যাগুরুর মুখ চেয়ে একটি ধর্মকেই রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করলে আর-সব ধর্মের ওপর অবিচার করা হবে, সুতরাং সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু নির্বিশেষে সর্বোদয়ের বিচারে সকলের প্রতি সমদর্শিতার খাতিরে ভারতকে হতে হবে সেকুলার স্টেট। যে রাষ্ট্র ধর্মের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ।

    এই যুক্তি বর্মাও অবলম্বন করেছিল। কিন্তু কী যে দুর্বুদ্ধি হল উ নু এবং তার দলের, তাঁরা সাধারণ নির্বাচনে জিতেই আইন পাশ করিয়ে নিলেন যে বর্মা হবে বৌদ্ধ রাষ্ট্র। অধিকাংশের ইচ্ছায় কর্ম, কে বাধা দেবে? কিন্তু এর পরিণাম হল অশুভ। শান, কারেন প্রভৃতি পার্বত্য জাতির তরফ থেকে দাবি উঠল আংশিক স্বাতন্ত্র্যের। শেষে প্রধান সেনাপতি রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা আত্মসাৎ করে শাসনতান্ত্রিক সরকার ধ্বংস করলেন। পাকিস্তানেও তাই হয়েছে। তবে ইসলামি রাষ্ট্র এখনও লোপ পায়নি, যেমন লোপ পেয়েছে বৌদ্ধ রাষ্ট্র। পাকিস্তানি জনগণ যদি কোনো গণতন্ত্রের মর্যাদা বোঝে তাহলে সেইসঙ্গে সেকুলার স্টেটের মর্যাদাও বুঝবে। যেখানে সেকুলার স্টেট নেই সেখানে গণতন্ত্র কেবলমাত্র অধিকাংশের ইচ্ছাসাপেক্ষ নয়, সর্বজনের ইচ্ছানির্ভর। গণতন্ত্রে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক থাকতে পারে না। যারা প্রতিবেশীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পর্যবসিত করে তারা ডিক্টেটরের পদানত হবেই। তারা আত্মকর্তৃত্বের যোগ্য নয়। কারণ তারা অপরের সমান অধিকার মানে না।

    ভারত সেকুলার স্টেট হয়ে বর্মা ও পাকিস্তানের দশা এড়িয়েছে। সেকুলার স্টেট যতই দৃঢ় হবে গণতন্ত্রও ততই দৃঢ় হবে। অনেকেই এটা হৃদয়ঙ্গম করেছেন, কিন্তু সকলে এখনও করেননি। তাঁরা চান হিন্দু রাষ্ট্র, হলই-বা সেটা ফ্যাসিস্টশাসিত। ইতিহাস এঁদের বাসনা পূর্ণ করলে ভারতেরও দশা হবে পাকিস্তান বা বর্মার মতোই।

    এ গেল ধর্মের কথা। ইতিমধ্যে ভাষার প্রশ্ন প্রবল হয়েছে। যেদেশে বহু ভাষা সেদেশের মূলনীতি কী হওয়া উচিত? এর উত্তর বেলজিয়াম ও সুইটজারল্যাণ্ড একভাবে দিয়েছে। ভারত দিয়েছে অন্যভাবে। কার উত্তরটা ঠিক? কারটা বেঠিক?

    বেলজিয়াম বলে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৩০ সালে। তার রাষ্ট্রভাষা হয় ফরাসি। দশটা বছর যেতে-না-যেতেই ফ্লেমিশদের দিক থেকে প্রতিবাদ ওঠে। তারাও তো বেলজিয়ান। তবে তাদের ভাষা কেন ফরাসির সমান মর্যাদা পাবে না? দীর্ঘকাল আন্দোলন চালানোর ফলে ১৮৯৮ সালে আইন করে ফরাসি ও ফ্লেমিশ উভয় ভাষাকেই বেলজিয়ামের ন্যাশনাল ভাষারূপে সমান স্থান দেওয়া হয়। এখন সেদেশের রাষ্ট্রভাষা এক নয়, দুই। সরকারি কাজকর্ম দুই ভাষায় চলে।

    তেমনি সুইটজারল্যাণ্ডে ১৮৭৪ সালের শাসনতন্ত্রে মেনে নেওয়া হয় যে, তাদের ন্যাশনাল ভাষা হবে জার্মান, ফরাসি ও ইটালিয়ান। বলা বাহুল্য এ তিনটি ভাষা শুধু উপরের দিকের কাজকর্মের ভাষা। নীচের দিকের কাজকর্ম জেলা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় চলে। জেলা স্তরে আরও দুটি ভাষারও অস্তিত্ব আছে। এ ছাড়া সর্বত্র ইংরেজির প্রচলন। সেটা অবশ্য বেসরকারিভাবে। সুইসরা একাধিক ভাষা শিখতে অভ্যস্ত।

    একটা দেশের একটাই রাষ্ট্রধর্ম হবে এ ধারণা ইউরোপেও ছিল। তার দরুন প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের জ্বালিয়েছে। আজকাল আর সে-ধারণা নেই। কিন্তু একটা দেশের একটাই রাষ্ট্রভাষা হবে, এ ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। এর ফলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে যথেষ্ট অত্যাচার হয়েছে। আলসাস-লোরেনের লোক একবার জার্মানদের হাতে মার খেয়েছে, একবার ফরাসিদের হাতে।

    এখন ভারতের কথা বলি। একটা দেশের একটাই রাষ্ট্রধর্ম হবে, এ ধারণা যাঁদের মধ্যে নেই তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে, একটা দেশের একটাই রাষ্ট্রভাষা হবে। বেলজিয়ামের চেয়ে, সুইটজারল্যাণ্ডের চেয়ে বহুগুণ বৃহৎ যে-দেশ, যার ভাষাসংখ্যা খুব কম করে ধরলেও চোদ্দো-পনেরোটি, সে দেশ যখন পরাধীন ছিল তখন একটি মাত্র বিদেশি ভাষার দ্বারা একসূত্রে গাঁথা ছিল। তার থেকে একটা সংস্কার জন্মেছে যে রাষ্ট্রভাষা একাধিক হতে পারে না। আমি কিন্তু এই সংস্কারের স্বতঃসিদ্ধতা স্বীকার করিনি। এটার সত্যতা নির্ভর করছে সকলের সম্মতির ওপরে, সুবিধার ওপরে, ন্যায়বোধের ওপরে। অধিকাংশের ভোটের জোরে কোনো একটি ভারতীয় ভাষাকে আর সকলের ওপর চাপালে পাকিস্তানের ইসলামি রাষ্ট্রের মতো একটা অপরিণামদর্শী সমাধান হয়। সেরকম একটা সমাধান যখন বেলজিয়ামে বা সুইটজারল্যাণ্ডে টিকল না তখন ভারতেও টিকতে পারে না। ইতিমধ্যেই তামিলদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রস্তাব উঠেছে। মাত্র পনেরো বছর যেতে-না-যেতেই এই। এখনও তো অর্ধশতাব্দী কাটেনি। ভারত যদি ছত্রভঙ্গ হয় তবে ভাষার ইসুতেই হবে।

    হিন্দির পিছনে সকলের সম্মতি নেই। সকলের তাতে সুবিধা হবে না। সকলের ন্যায়বোধ তার দ্বারা চরিতার্থ হবার নয়। তার পক্ষে একটি মাত্র যুক্তি—অধিকাংশ লোক হিন্দি চায়। অর্থাৎ অধিকাংশের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। পাকিস্তানে যেমন ধর্মের ব্যাপারে অধিকাংশের ইচ্ছাই চূড়ান্ত, ভারতে তেমনি ভাষার ব্যাপারে অধিকাংশের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। এরূপ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্বের আশঙ্কা জাগে। এমন কয়েকটি বিষয় আছে যা গায়ের জোরে বা ভোটের জোরে নিষ্পত্তি করা যায় না। ধর্ম তার একটি। ভাষা তার আরেকটি। ধর্মের বেলা আমরা বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছি। ভাষার বেলায়ও কি দিতে পারিনে?

    তর্কটা হিন্দি বনাম ইংরেজি নয়। ইংরেজিকে সরানোর পরে ঘোরতর বিবাদ বেঁধে যাবে। তামিলরা হিন্দিকে মানবে না, নাগারা মানবে না, কাশ্মীরিরা মানবে না। বাঙালিরাও মানবে না। এমনই না মানার লক্ষণ চারদিকে। কংগ্রেস থাকতেই এই। কংগ্রেস কি চিরস্থায়ী? পরে যে দলটার হাতে ক্ষমতা পড়বে সে-দল যদি সব ক-টা রাজ্যের আস্থা না পায় তখন হিন্দির প্রতি বিরাগ হবে মানুষকে খেপিয়ে তোলার একটা উপায়। যেমন হিন্দুর ওপর বিরাগ হয়েছিল মুসলমানকে বিভ্রান্ত করার অব্যর্থ উপায়। সেইজন্যে তর্কটা হিন্দি বনাম ইংরেজি নয়। তর্কটা আসলে হচ্ছে হিন্দি বনাম তামিল-বাংলা-পাঞ্জাবি ইত্যাদি। হিন্দি হবে কেন্দ্রীয় সরকারের একমাত্র ভাষা, এর মানে হিন্দি হবে সারা ভারতের একচ্ছত্র ভাষা। যাদের মাতৃভাষা হিন্দি নয় তারা হিন্দি শিখতে গিয়ে দেখবে যে, প্রত্যেকটি হিন্দিভাষী শিশু জন্মত স্টার্ট পেয়ে এগিয়ে রয়েছে। যেমন জন্মত স্টার্ট পেয়ে এগিয়ে থাকত প্রত্যেকটি ইংরেজ শিশু। ইংরেজিকে যারা বিদায় করবে তারা কি ইংরেজির একমাত্র উত্তরাধিকারীকেও একদিন ঘাড় থেকে নামাতে চাইবে না?

    হিন্দি যে ইংরেজির একমাত্র উত্তরাধিকারী হবার স্বপ্ন দেখছে, হিন্দি কি বুঝতে পারছে না যে আর সকলের সঙ্গে ভাগ না করে ভোগ করা যায় না? ভাগ করার নমুনা কি এই যে, হিন্দিই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ও আর সব আঞ্চলিক ভাষা? সব ক-টা ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করা চাই। সেটা যদি কাজের কথা না হয় তবে এমন একটি ভাষাকে হিন্দির সঙ্গে বন্ধনীভুক্ত করা চাই যার দ্বারা আর সকলের ন্যায়বোধ চরিতার্থ হবে। প্রতিযোগিতার বা পরীক্ষার ভাষা যদি হয় ইংরেজি, তাহলে আমাদের ন্যায়বোধ যতখানি চরিতার্থ হয় হিন্দি হলে ততখানি হয় না। বিদেশি ভাষা বলে ইংরেজিকে হটাতে চাও? বেশ। তার বদলে এমন একটি ভাষাকে হিন্দির সঙ্গে বন্ধনীভুক্ত করো, যে ভাষা আমাদের ন্যায়বোধকে পীড়া দেবে না। সে-ভাষাটি যে কোন ভাষা, অহিন্দিভাষীদের দ্বারাই সেটি স্থির হোক।

    আর কোনো ভাষা ভারতের সকল প্রান্তে ইংরেজির মতো ব্যাপকভাবে প্রচলিত নয়, এটা একটা প্রত্যক্ষ সত্য। যেখানে হিন্দি চলে না সেখানেও ইংরেজি চলে। ইংরেজির অধিকারে না থাকলে সেসব অঞ্চল হিন্দির অধিকারেও আসত না। ইংরেজি নামক সত্যটির উৎপত্তিস্থল ইংল্যাণ্ড। তেমনি আরও অনেকগুলি সত্যেরও উৎপত্তি ইংল্যাণ্ডে বা ইউরোপে। আমাদের শাসনব্যবস্থা, সংবিধান, আইন-আদালত, পার্লামেন্ট, আর্মি, নেভি, পুলিশ, স্কুল-কলেজ, ল্যাবরেটরি, রেল, স্টিমার, ডাকঘর, ডাক্তারখানা, ব্যাঙ্ক, স্টক এক্সচেঞ্জ, ছাপাখানা, খবরের কাগজ, থিয়েটার, সিনেমা, রেডিয়ো, ট্রাম, বাস, মোটর—কোনোটিই-বা বিদেশাগত নয়? এমনকী কংগ্রেসও তো বিদেশি। হিন্দ, হিন্দু, হিন্দি এসবও তো বিদেশি ভাষার শব্দ। আজকাল স্বদেশি পারিভাষিক শব্দ দিয়ে শোধন করে নেওয়া চলেছে। ‘রাজভবন’ বললে স্বদেশিয়ানার একটা বিভ্রম সৃষ্টি হয়। কিন্তু যে বস্তুর নাম পালটে দেওয়া হয় তার বস্তুসত্তা অবিকল তেমনি রয়ে যায়। টেলিফোনকে কী-একটা বিকট হিন্দি নাম দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও সেটা টেলিফোন নামক বিদেশি একটা যন্ত্রই। বিদেশি বলেই সেটা বর্জনীয় নয়।

    তেমনি ইংরেজি। তার সঙ্গে পরাধীনতার সম্পর্ক একদা ছিল, এখন তো নেই। ভবিষ্যতেও সে-সম্পর্ক ফিরবে না। ইতিমধ্যেই স্থির হয়ে গেছে যে, সব ছাত্রকেই একটা স্তরে ইংরেজি শিখতে হবে। অবশ্যশিক্ষণীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিতে কারও আপত্তি নেই। তাই যদি হল তবে শিক্ষার শেষ ধাপে পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ইংরেজি হলে আপত্তির কী কারণ থাকতে পারে? তামিলরা ও বাঙালিরা জিতে যাবে, হিন্দিভাষীরা তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না, এই কারণ নয় তো? উপরের দিকে পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যম ইংরেজি যেমন ছিল তেমনি থাকাই রাষ্ট্রের স্বার্থ। সেইভাবেই রাষ্ট্র যোগ্যতম প্রার্থী বেছে নিতে পারে। করদাতার অর্থ সেইভাবেই সৎপাত্রে পড়বে। নিকট ভবিষ্যতে আমি এই ব্যবস্থার রদবদলের পক্ষপাতী নই। প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়াই যদি নীতি হয় তবে প্রতিযোগিতার মাধ্যম ইংরেজিই থাকবে, ইংরেজি ভিন্ন আর কোনো ভাষা হবে না। যদি হিন্দিকেও অন্যতম মাধ্যমে করো তবে বাংলাকেও করতে হবে, তামিল, তেলেগু, কন্নাডিগ, মালয়ালমকেও করতে হবে।

    জাতীয় মর্যাদার খাতিরে হিন্দি ভারত রাষ্ট্রের সরকারি ভাষা হোক, কিন্তু আভ্যন্তরিক ন্যায়ের খাতিরে ইংরেজিই পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমরূপে থাকুক। ইংরেজি মাধ্যম না থাকলে পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যম হোক বাংলা, উর্দু, মারাঠি, গুজরাতি ইত্যাদি চোদ্দো-পনেরোটি ভাষা—শুধু হিন্দি নয়। যেখানে হিন্দিকে বসালে অহিন্দিভাষীদের ক্ষতি সেখানে ইংরেজিকে রাখাই সমীচীন। বিদেশি বলে তাকে খেদিয়ে দিলে স্বদেশি বলে শুধু হিন্দিকে নয়, বাংলাকে, পাঞ্জাবিকে, তামিলকেও বসাতে হবে। যেখানে কারুর কোনো ক্ষতি নেই সেখানে হিন্দি আরাম করে বসুক। কিন্তু অপরের ক্ষতি যেখানে, সেখানে হিন্দির আরাম করে বসার অধিকার নেই। জাতীয়তার জন্যে তাকেও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

    একটা দেশের একটাই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। এটা একভাষী দেশের বেলাই খাটে। ভারতের মতো বহুভাষী দেশে এটাকে খাটাতে যাঁরা চাইছেন তাঁরা মনে মনে ইংরেজিরই নজির অনুসরণ করছেন। ইংরেজি যেমন একচ্ছত্র ছিল তেমনি একচ্ছত্র হবে অন্য একটা ভাষা, অন্য একটি মাত্র ভাষা। সেই বিদেশি লজিকের জোরে হিন্দিকেও একচ্ছত্র করতে হবে। কিন্তু বিদেশি ভাষা বলে ইংরেজি যদি বিদায় হয় তবে তার নজিরটাকেই-বা মানতে যাব কেন? জাতীয় ঐক্য কি সুইসদেরও নেই? বেলজিয়ানদেরও নেই? একাধিক রাষ্ট্রভাষা কি তাদের ঐক্যহানি ঘটিয়েছে?

    শেষপর্যন্ত তর্কটা দাঁড়ায় ইংরেজি হল বিদেশির ভাষা, বিজেতার ভাষা। তাকে বিদায় না দিলে স্বাধীনতা সম্পূর্ণ হবে না। বেশ, তাই হোক। তাহলে ইংরেজির নজিরটাকেও মন থেকে ঝেড়ে ফেলা যাক। ভারতের সব ক-টা ভাষাকেই হিন্দির সঙ্গে সমান মর্যাদা দিয়ে ভারতীয় ইউনিয়নের সরকারি ভাষা করা হোক। সেটা কাজের কথা নয় এ যুক্তি আর আমরা শুনতে চাইনে। একটা বহুভাষী দেশের রাষ্ট্রভাষা একটাই হবে এটাও কি কাজের কথা? ইংরেজরা তাদের নিজেদের সুবিধের জন্যে ওরকম করেছিল। মুষ্টিমেয় শিক্ষিত ভারতীয়েরও ওতে কিছু সুবিধে হয়েছিল। কিন্তু জনগণের দিক থেকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা—হিন্দি হলেও—কাজের কথা নয়। যতগুলি ভাষা ততগুলি রাষ্ট্রভাষা এইটেই কাজের কথা। আমরা যদি এই সত্যকে স্বীকার না করি, এই সত্যের সঙ্গে আপোশ রফা না করি তবে অমীমাংসিত সমস্যা একদিন আপনার পথ আপনি করে নেবে। বহুভাষী দেশ বহু রাষ্ট্র হবে।

    ইউরোপীয়রা যদি না আসত তাহলে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষে বহুসংখ্যক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হত। এরা যে-যার সুবিধামতো এক-একটা স্বদেশি ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিক স্বদেশি ভাষাকে। হিন্দির সার্বভৌমত্ব সব হিন্দু মেনে নিত না। উর্দুর সার্বভৌমত্ব সব মুসলমান মেনে নিত না। হয়তো সবাই মিলে একদিন একটা ফেডারেশন বা কনফেডারেশন গড়ে তুলত। কিন্তু সেই সম্মিলিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা যে একমাত্র হিন্দি বা একমাত্র উর্দু হওয়া উচিত এটা সবাইকে দিয়ে মানিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন হত। অতদূর যেতে হবে কেন? ধরুন ১৯৪৭ সালে যদি জিন্না সাহেব ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনায় রাজি হয়ে যেতেন, যদি অখন্ড ভারতবর্ষের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হত তাহলে সম্মিলিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কি এক হত না একাধিক হত, না হিন্দি-উর্দুর যমজ রূপ হত? সকলেই জানেন যে, একমাত্র হিন্দির একচ্ছত্র দাবি কেউ স্বীকার করতেন না। না জিন্না, না গান্ধী। ঐক্যের খাতিরে হয় যমজ ভাষাকে সম্মিলিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা করতে হত, নয় ইংরেজিকেই অনির্দিষ্টকাল বহাল রাখতে হত।

    দেশভাগ হয়ে গেছে বলেই একদিকে হিন্দি ও অন্যদিকে উর্দু একচ্ছত্র হবার ছাড়পত্র পেয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে যে ওই ছাড়পত্রটা উর্দুভাষী মুসলমানদের শাসন-শোষণের সনদ। তাই তারা বাংলাকেও উর্দুর সমান অংশীদার করার জন্যে প্রাণপণ করছে। আক্ষরিক অর্থে প্রাণ দিয়েছেও। উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এটা তারা কোনোকালে মেনে নেবে না। তারা যেন বেলজিয়ামের ফ্রেমিশভাষী। লেগে থাকলে তাদের মাতৃভাষাও পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা হবে, শুধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা নয়। উর্দুভাষীরা যদি তাতে নারাজ হয়, তবে রাষ্ট্র দু-ভাগ হয়ে যাবে। তার জন্যে দায়ী হবে উর্দুভাষীদের জেদ। আর নয়তো ইংরেজিকেই অনির্দিষ্টকাল বহাল রাখতে হবে। আপোশের আর কোনো উপায় নেই। ইংরেজি বিদেশি ভাষা, কিন্তু আপোশের একমাত্র উপায়।

    উর্দুর বিরুদ্ধে নয়, উর্দুভাষীদের প্রচ্ছন্ন সনদের বিরুদ্ধেই পূর্ব পাকিস্তানিদের এ বিক্ষোভ। তেমনি হিন্দিভাষীরাও একটা সনদ পেয়ে গেছে। ভাবী ভারতের শাসক ও ধনিকশ্রেণি হবে হিন্দিভাষী এরকম একটা ইঙ্গিত দেখা দিয়েছে। মহাত্মাজি ভেবেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অতি অল্প ক্ষমতা দেবেন, আর সব ছড়িয়ে দেবেন প্রদেশে প্রদেশে, গ্রামে গ্রামে। ঠিক উলটোটি হয়েছে। বিকেন্দ্রীকরণের ভরসা নেই। ইণ্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন বিকেন্দ্রীকরণের অন্তরায়। দেশ ইণ্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনকেই বরণ করে নিয়েছে। অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে হিন্দিভাষীদের ধনাধিক্য ও ভোটাধিক্যের ওপর ছেড়ে দিলে সেটা গণতন্ত্রের মতো দেখায়, কিন্তু সেটা হয় উত্তর ভারতের দ্বারা ভারাক্রান্ত মাথাভারী গণতন্ত্র। তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অবশ্যম্ভাবী। তামিলদের একদল এরই মধ্যে খেপেছে। হিন্দি নামক ভাষার বিরুদ্ধে ততটা নয়, যতটা হিন্দিভাষী শাসক ও ধনিকশ্রেণির সনদের বিরুদ্ধে। মিটমাট না হলে দেশ আবার ভাঙবে। আপোশের আর কী উপায় আছে—ইংরেজিকে সহচর ভাষারূপে অনির্দিষ্টকাল বহাল রাখা ভিন্ন?

    আমাদের হাজার বছরের অভিজ্ঞতা বলছে যে, দেশ বহু খন্ড হলে স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। বিপদের সময় দেশবাসী একজোট হয় না। সুতরাং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন চাই। এতকাল পরে আমরা আমাদের নিজেদের একটি কেন্দ্রীয় সরকার পেয়েছি। কাশ্মীরি, কেরলি, বাঙালি, তামিল, অসমিয়া, গুজরাতি, পাঞ্জাবি প্রভৃতি নানা প্রান্তের লোক একবার কুরুক্ষেত্রে মিলিত হয়েছিল শুনেছি। সেটা কিন্তু মিলেমিশে দেশ-চালানোর জন্যে নয়। ইতিহাসে এই প্রথম বার আমরা একজোট হয়ে রাষ্ট্র চালাচ্ছি। এ জোট যদি ভেঙে যায় তবে আবার পরাধীনতা। একে অটুট রাখতেই হবে। অথচ একমাত্র রাষ্ট্রভাষার সনদ যে একে তলে তলে ভাঙছে। এটা এমন একটা ইসু যার একপ্রান্তে হিন্দিভাষীদের স্বার্থ, অপরপ্রান্তে অহিন্দিভাষীদের স্বার্থ, মাঝখানে ওই আপোশের প্রস্তাব। ওই সহচর ভাষা। ভাঙনকে রোধ করতে হলে ওর চেয়ে আর কোনো সহজ উপায় নেই। বিদেশি বলে ইংরেজিতে যাঁদের আপত্তি তাঁরা ইচ্ছে করলে ইংরেজির বদলে বাংলা তামিল মারাঠি ইত্যাদি চোদ্দো-পনেরোটি ভাষাকে সহচর ভাষা বানাতে পারেন। কিন্তু সেটার নাম আরও সহজ নয়, আরও জটিল।

    ‘বিদেশি’ এই বিশেষণটাই যদি যত নষ্টের গোড়া হয়ে থাকে তবে আমরা তার বদলে ‘আন্তর্জাতিক’ এই বিশেষণটি ব্যবহার করতে পারি। স্বাধীন রাষ্ট্র যদি কমনওয়েলথ নামক সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তো আন্তর্জাতিক ভাষা ব্যবহার করলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। স্বাধীনতার সঙ্গে সেটা যদি খাপ খায়, তবে এটাই-বা বেখাপ হবে কেন? আগেকার দিনে বিদেশি ভাষার বিরুদ্ধে যতগুলি যুক্তি শোনা যেত ইদানীং স্বদেশি ভাষার বিরুদ্ধেও ততগুলি শোনা যাচ্ছে। তামিলরা তো সাফ বলে দিয়েছে যে, হিন্দিও ওদের পক্ষে বিদেশি। আমরাও তো দেখছি হিন্দি শিখতে ইংরেজির চেয়ে কম শক্তি খরচ হলেও হিন্দিতে শেখবার যোগ্য বিষয় অল্পই আছে, ইংরেজিতে বিস্তর। শব্দগুলো হয়তো চেনা, কিন্তু অর্থ এক নয়। আর ব্যাকরণ তো আরবির কাছাকাছি যায়। ‘মহাত্মা গান্ধীকি’ হল কেন? ‘কা’ হল না কেন? কারণ ‘জয়’ শব্দটা স্ত্রীলিঙ্গ। আর বিশেষ্য যদি স্ত্রীলিঙ্গ হয় তবে বিশেষণকেও স্ত্রীলিঙ্গ হতে হবে, ক্রিয়াপদকেও স্ত্রীলিঙ্গ হতে হবে। কিন্তু গোড়ায় গলদ, ‘জয়’ কেন স্ত্রীলিঙ্গ হবে। ‘ফতে’ স্ত্রীলিঙ্গ বলে?

    যা-ই হোক, হিন্দি আমাদের দেশের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত ভাষা। দেশের লোকের সঙ্গে কারবার করতে হলে হিন্দি আমাদের শিখতেই হবে। রাষ্টভাষা না হলেও শিখতুম। শিখেছি। ‘মহাত্মা গান্ধী কি জয়’ হেঁকেছি। হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে বলে সুখীই হয়েছি। তাহলে বাধছে কোনখানে? বাধছে এইখানে যে, ভারত যেমন ধর্মের বেলা নিরপেক্ষ তেমনি নিরপেক্ষ ভাষার বেলা নয়। হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সে তার রাষ্ট্রকে একাকার করেনি, কিন্তু হিন্দি ভাষার সঙ্গে তা করেছে। ভারত হিন্দু রাষ্ট্র নয়, কিন্তু সংবিধানের যদি সংশোধন না হয়, তবে ১৯৬৫ সালে হিন্দি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে একমেবাদ্বিতীয়ম হওয়ামাত্র ভারতকে বলতে পারা যাবে হিন্দি-রাষ্ট্র। তখন হিন্দিভাষীরাই হবে প্রথম শ্রেণির নাগরিক। পাকিস্তানের হিন্দুরা যেমন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভারতের বাংলাভাষী, তামিলভাষী, পাঞ্জাবিভাষীরাও তেমনি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বনবে। সংবিধান রচনার সময় কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির সদস্যেরা সর্বসম্মতিক্রমে হিন্দিকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করেননি। তাঁদের মধ্যে তখনই দ্বিমত দেখা দিয়েছিল। একপক্ষ ছিলেন হিন্দির সমর্থক। অপর পক্ষ ইংরেজির। বলা বাহুল্য, ইংরেজির সমর্থকরা জানতেন যে ইংরেজি একটি বিদেশি ভাষা। শুধু বিদেশির নয় বিজেতার ভাষা। ইংরেজির সমর্থন করেছিলেন বলে তাঁরা যে কম স্বদেশি বা কম স্বাধীনতাপ্রিয় ছিলেন তা নয়। তাঁরাও কংগ্রেসের লোক। ভোটে দিয়ে দেখা গেল দু-পক্ষের ভোটসংখ্যা প্রায় সমান সমান। হিন্দির সঙ্গে ইংরেজির সামান্য একটি মাত্র ভোটের ব্যবধান। এরূপ ক্ষেত্রে হিন্দি ইংরেজি দুটি ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করা উচিত ছিল।

    এখানে আর একটি কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই। আমাদের সংবিধানে কোনো ভাষাকেই ‘রাষ্ট্রভাষা’ বা ‘জাতীয় ভাষা’ বলে আখ্যাত করা হয়নি। হিন্দিকে বলা হয়েছে ‘সরকারি ভাষা’। সংবিধান যদি সংশোধন করা হয়, তবে ইংরেজিকে বলা হবে ‘সহচর সরকারি ভাষা’। ‘রাষ্ট্রভাষা’, ‘জাতীয় ভাষা’ ইত্যাদি আখ্যা প্রকৃতপক্ষে সব ক-টি ভারতীয় ভাষারই পাওনা, কোনো একটি ভাষার নয়। হিন্দি যদি সেরকম একটা আখ্যা পেয়ে থাকে তবে সেটা বিধিসম্মতভাবে নয়, সেটা পাঁচজনের মুখে মুখে। যেমন সুবোধ মল্লিক মহাশয়কে লোকে ‘রাজা’ বলত। যেমন কংগ্রেস সভাপতিকে লোকে ‘রাষ্ট্রপতি’ বলত। রাষ্ট্রভাষা বলে হিন্দির একটা নামডাক হয়েছে। মন্ত্রীরাও তাকে রাষ্ট্রভাষা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সংবিধানে এর কোনো সমর্থন নেই। সুতরাং হিন্দি এমন কিছু হারাচ্ছে না, যা সংবিধান অনুসারে তার প্রাপ্য। আর ইংরেজিও এমন কিছু পাচ্ছে না যার বলে সে রাষ্ট্রভাষা বলে গণ্য হবে। লোকমুখে হিন্দিই থেকে যাবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সংবিধানে তার একটি সহচর সরকারি ভাষা জুটবে। সেটি যদি ইংরেজি না হয়ে উর্দু কিংবা তামিল হত তাতেও হিন্দি গোঁড়াদের আপত্তির তরঙ্গ উঠত। ইংরেজিকে যেমন তাঁরা ‘বিদেশি’ বলে অপাঙক্তেয় করতে চান, তেমনি তাকেও করতেন অন্য কোনো ছুতোয়। মোদ্দা কথা শরিক তাঁরা চান না, হলেই-বা সে স্বদেশি।

    হিন্দি থাকছে, ইংরেজিও থাকবে, ভবিষ্যতে ভাব বিনিময়ের ভাষার অভাব হবে না। যাঁরা হিন্দিতে চান তাঁরা হিন্দিতে ভাব বিনিময় করবেন, যাঁরা ইংরেজিতে চান তাঁরা ইংরেজিতে। যদি বিনিময় করবার মতো ভাব থাকে। যদি সেরকম মনোভাব থাকে। সরকারের কাজকর্মের ভাষা ছাড়া কি ভাব বিনিময় হয় না? সংস্কৃতেও হতে পারে। উর্দুতেও।

    গান্ধীজি সাধারণত হিন্দিতেই ভাব বিনিময় করতেন, কিন্তু জীবনের শেষ দিনও তাঁকে বাংলা হাতের লেখা তৈরি করতে দেখা গেছে। নোয়াখালিতে ফিরে বাংলায় ভাব বিনিময় করতেন। তামিলদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্যে তিনি তামিল ভাষা শিখেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতে। পশ্চিমা মুসলমানদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্যে তিনি উর্দুতেও কথা বলতেন। রথীবাবুর সঙ্গে, আমার সঙ্গে তিনি ইংরেজিতে কথা বললেন ১৯৪৫ সালে। ভাব বিনিময় একটি মাত্র ভাষায় হবে—হিন্দিতে; এমন অদ্ভুত ধারণা তো গান্ধীজির ছিল না।

    এই প্রসঙ্গে একটি মজার গল্প মনে পড়ল। বছর কয়েক আগে স্বাধীন ভারতের সংস্কৃতভাষী সুধীদের এক সম্মেলন হয়। আমাদের এক বিশিষ্ট অধ্যাপক গেছলেন যোগ দিতে। ফিরে এসে বললেন, আলোচনা হল—কোন ভাষায় বলুন তো? ইংরেজিতে!

    আর একটা মজার গল্প বলি। পাঞ্জাবে সেদিন দারুণ বচসা বেঁধে গেল। খোঁপা আর এলোচুলে নয়, পাঞ্জাবিতে আর হিন্দিতে। তামাশা এই যে, দু-পক্ষেরই বাক্যবাণ বর্ষিত হল উর্দু সংবাদপত্রে। মামলার ভাষা হল উর্দু। মনে আছে, ছেলেবেলায় আমি একবার লালা লাজপৎ রায়ের বন্দে মাতরম পত্রিকার নমুনা চেয়ে পাঠাই। পত্রিকা দেখে আমার চক্ষুঃস্থির। হিন্দি নয়, ইংরেজি নয়, উর্দু। যেখানে উর্দু উভয়ের জানা সেখানে ভাব বিনিময়ের ভাষা উর্দু হওয়াই স্বাভাবিক। স্কুল-কলেজে যিনি যা-ই পড়ুন-না কেন দেখা হলে হিন্দুতে আর শিখে বাতচিৎ হয় উর্দুতেই।

    সরকারি ভাষা বলে গণ্য না হলেও উর্দুতেই পশ্চিমা হিন্দু ও শিখদের স্বাচ্ছন্দ্য আমি অনেক বার লক্ষ করেছি। তেমনি সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃত না হলেও ইংরেজির কদর এদেশে দীর্ঘকাল থাকবে। কেন থাকবে তার একশো কারণ। জাতীয়তাবাদীরা যত সহজে ইংরেজকে হটিয়েছেন, তত সহজে ইংরেজিকে অচলিত করতে পারবেন না। কাজেই সে-চেষ্টা না করাই ভালো। স্বাধীনতার পরে আমাদের গ্রামে গ্রামে হাই স্কুল হয়েছে। লোকে চায় হাই স্কুল। টোল নয়, মাদ্রাসা নয়, বুনিয়াদি নয়, বিশুদ্ধ বাংলা বিদ্যালয় নয়, সেই সেকালের মতো হাই স্কুল। কিংবা টেকনিক্যাল স্কুল। কলেজের সংখ্যাও বাড়ছে। যেখানে মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি উঠে যাচ্ছে সেখানেও বিষয় হিসাবে ইংরেজি থেকে যাচ্ছে। এটাও জনগণের ইচ্ছায়।

    ইংরেজির কাজ হবে স্ট্যাণ্ডার্ড ঠিক করে দেওয়া বা ঠিক করতে সাহায্য করা, সে-কাজ হিন্দির দ্বারা হতে পারে না। সামনের দশ-বিশ বছরে তো নয়ই, এই শতাব্দীতে নয়। একবিংশ শতাব্দীর ভাবনা একবিংশ শতাব্দী ভাববে। আমরা যারা বিংশ শতাব্দীতে বাস করছি, তাদের ভাবনা বিংশ শতাব্দীকেই ঘিরে। যতদূর দেখতে পাচ্ছি ইংরেজির প্রয়োজন থাকবে। সে-প্রয়োজন প্রশাসনঘটিত নাও হতে পারে। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হত তাহলে আমরা কেউ ইংরেজিকে সরকারি ভাষা বা তার সহচর করতুম না। সব যুক্তিকে খারিজ করত সেন্টিমেন্ট। বাংলা ভাষাই হত রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সেরূপ ক্ষেত্রেও ইংরেজির প্রয়োজন ফুরোত না। লোকে ইংরেজিকে চাইত বাংলার স্ট্যাণ্ডার্ড ঠিক করে দেবার জন্যে। লেখার ও সমালোচনার আদর্শ চোখের উপর তুলে ধরার জন্যে। ইংরেজের যুগ গেছে, ইংরেজির যুগ যায়নি। আরও আধ শতাব্দী থাকবে।

    কিন্তু তাই-বা কেমন করে বলি? খাস ইংরেজের দেশে ইংরেজি যদি পেছিয়ে পড়ে, তেমন বড়ো লেখক যদি না জন্মান, বইগুলো যদি হয় অন্তঃসারশূন্য, সাময়িকপত্রগুলো যদি হয় অন্তঃসারশূন্য, খবরের কাগজগুলো যদি হয় বিশেষত্বহীন, সেই জ্বলন্ত বিবেক যদি নিবে আসে, চিন্তার স্বাধীনতা যদি চোরাবালিতে ঠেকে যায়, তাহলে অর্ধশতাব্দীকাল কে একটা মরা সাহিত্য কাঁধে করে বেড়াবে? ইংরেজি যদি বাংলাকে বা হিন্দিকে এগিয়ে দিতে না পারে তবে ইংরেজির অবস্থানকাল আধ শতাব্দীও নয়। আরও আগে তার ওপর থেকে লোকের মন উঠে যাবে। মানুষকে জোর করে ইংরেজি শেখানোর আমি পক্ষপাতী নই। ইংরেজি যে অবশ্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়েছে, এটাও আমার মতে অনুচিত। ছেলেরা যদি ইংরেজি শিখতে না চায় না শিখবে। না শিখলে পরে পস্তাবে। নিজেদের ছেলেমেয়ে হলে তাদের বলবে অমন ভুল না করতে। কতক লোকের পস্তানো দরকার। আজকাল মাড়োয়ারির ছেলেরা মন দিয়ে ইংরেজি শেখে। বাঙালির ছেলেরা ফাঁকি দেয়।

    ইংরেজির পিছিয়ে পড়া যেমন অসম্ভব নয় হিন্দির এগিয়ে যাওয়াও তেমনি সম্ভবপর। এক পুরুষের মধ্যে হিন্দির অসাধারণ উন্নতি হতে পারে। ইচ্ছা করলে সে উর্দুকে আত্মসাৎ করতেও পারে। দেবনাগরী লিপি ছাড়া অন্যান্য লিপিতে কি হিন্দি লেখা যায় না, ছাপা যায় না? রোমক লিপিতে ছাপা হলে হিন্দি বই কাগজ আরও চলবে। বাংলা লিপিতে ছাপলে বাঙালিরা অনায়াসে পড়বে। কতক হিন্দি বই কাগজ একাধিক লিপিতে ছেপে পরীক্ষা করা উচিত পাঠকসংখ্যা কী পরিমাণ বাড়ে। অনেকে দেবনাগরীর ভয়ে হিন্দির দিকে ঘেঁষতে চায় না। তাদের ওপর জোরজুলুম করে যেটুকু ফল হবে তার চেয়ে ঢের বেশি হবে বিভিন্ন লিপিতে হিন্দি বই কাগজ ছেপে। তারপর হিন্দির ব্যাকরণ আরও সরল হওয়া চাই। পশুপাখির কার কী লিঙ্গ তাই আমাদের জানা নেই। শব্দ মাত্রেরই লিঙ্গ থাকবে ও আমরা তা জানব, এ কী জ্বালা!

    শেষ কথা, ইংরেজির দীপশিখা নিভে গেলেই যে হিন্দির দীপশিখার, বাংলার দীপশিখার, অন্যান্য ভারতীয় ভাষাগুলির দীপশিখার দেওয়ালি হবে এটা একপ্রকার নঞর্থক চিন্তা। বরং ইংরেজির দীপ যতক্ষণ জ্বলছে জ্বলতে দাও, তার সাহায্যে নিজেদের দীপ জ্বালিয়ে নাও। ফুঁ দিয়ে তাকে অকালে নিবিয়ে দিলে পরে হয়তো দেখবে নিজেদের দীপও নিবু-নিবু। দেওয়ালি হবে, না কালী পুজো হবে কে এখন থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করবে?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআগুন নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়
    Next Article আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

    Related Articles

    অন্নদাশঙ্কর রায়

    বাংলার রেনেসাঁস

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আগুন নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    কন্যা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }