Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথে প্রবাসে ও নির্বাচিত প্রবন্ধ – অন্নদাশঙ্কর রায়

    অন্নদাশঙ্কর রায় এক পাতা গল্প410 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    সেকুলারিজম

    সংকটকালে সৈনিকের কর্তব্য যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া, নাগরিকের কর্তব্য যেমন যে যার জায়গায় স্থির থেকে নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদন করা, ইন্টেলেকচুয়ালের কর্ম তেমনি প্রত্যেকটি বিষয় পরিচ্ছন্নভাবে চিন্তা ও প্রকাশ করা। মানসিক বিশৃঙ্খলাও দেশের পক্ষে অহিতকর।

    এই সংকটে ভারতের আভ্যন্তরিক দুর্বলতা হচ্ছে, সাধারণ লোক বোঝে না সেকুলার স্টেট বলতে কী বোঝায়। যাঁরা সাধারণ নন, অসাধারণ, তাঁরাও সেকুলার শব্দটির বিভিন্ন অর্থ করেন। তার ফলে সাধারণের মনে ধাঁধা লাগে।

    অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে সব দেশেই রাজতন্ত্রের সঙ্গে পুরোহিততন্ত্রের বা সন্ন্যাসীতন্ত্রের মণিকাঞ্চনযোগ ছিল। তখনকার দিনে কল্পনাই করতে পারা যেত না যে রাষ্ট্র আর ধর্ম দুই স্বতন্ত্র সত্তা, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মের হস্তক্ষেপ বা অনুপ্রবেশ অন্যায়, ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বা অনুপ্রবেশ অন্যায়।

    আমেরিকার তেরোটি ব্রিটিশ উপনিবেশ যখন স্বাধীনতা লাভ করে রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে তখন তাদের সেই প্রজাতন্ত্রে রাজতন্ত্রের সাথি পুরোহিততন্ত্র বা সন্ন্যাসীতন্ত্রের ঠাঁই হয় না। মণির সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনও বাদ যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি আছেন, কিন্তু তাঁর যে কী ধর্ম তার উল্লেখ নেই। গভর্নমেন্ট আছে, কিন্তু তার যে কী ধর্ম তারও সন্ধান নেই। কংগ্রেস আছে, কিন্তু তার যে কী ধর্ম তারও ঠিকানা নেই। অর্থাৎ যাঁর যে ধর্মে রুচি সে-ধর্মে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তিনি খ্রিস্টান না ইহুদি, খ্রিস্টান হয়ে থাকলে ক্যাথলিক না প্রোটেস্টান্ট, প্রোটেস্টান্ট হয়ে থাকলে লুথারপন্থী না ক্যালভিনপন্থী বা কোয়েকার না মেথডিস্ট না অন্যান্য শাখার অন্তর্ভুক্ত কেউ তা জানেও না, জানতে চায়ও না। মনে রাখবেন ‘রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে’। সামাজিক ক্রিয়াকর্মের বেলা জানতে চায়, জানে। হয়তো বাছবিচার করে। কিন্তু সংবিধান সে-বিষয়ে নীরব।

    আমেরিকার বিপ্লবের পর এই যে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের বিয়োগ এটা ফরাসি বিপ্লবেরও অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়। ফরাসিরা আরও এক-পা এগিয়ে গিয়ে রাজার ও চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। একদল তো ঈশ্বরকে পর্যন্ত অস্বীকার করে। আমেরিকানরা নাস্তিককে সহ্য করে না কিন্তু ফরাসিরা করে।

    তারপর একে একে অনেকগুলি দেশ রাজতন্ত্র ছেড়ে প্রজাতন্ত্র গ্রহণ করেছে। কিন্তু মার্কিন বা ফরাসির মতো রাজার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় হস্তক্ষেপ বা অনুপ্রবেশকে রাষ্ট্রীয় ব্যাপার থেকে বিদায় দিতে হবে এটা অনেকেই মানে না। সেইজন্য প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেও সংবিধানের ললাটে এঁকে দিয়েছে ‘ক্যাথলিক’ বা ‘ইসলামি’, ‘ইহুদি’ বা ‘বৌদ্ধ’। আমাদের প্রতিবেশী বর্মা প্রথমে হয়েছিল আমাদেরই মতো সেকুলার স্টেট। কিন্তু সুবুদ্ধি থাকিন নু-র কুবুদ্ধি হল। তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাহায্যে ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হবার পর তাদের সহায়তার মূল্য দেবার জন্যে ‘বৌদ্ধ রাষ্ট্র’ প্রবর্তন করেন। সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টধর্মী কারেন, কাচিন, শানরা পৃথক শাসন দাবি করে। তা দেখে সেনাপতি নে উইন ক্ষমতা হাতে নেন। থাকিন নু এখনও বন্দি। বর্মা এখন আবার সেকুলার স্টেট। ভোটের বালাই নেই বলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও রাজনৈতিক ওজন নেই।

    দূরদর্শী নেহরু এইসব কারণেই হিন্দু রাষ্ট্র প্রবর্তন করেননি। তখন গান্ধীজি জীবিত ছিলেন। তিনিও পরামর্শ দেন সেকুলার স্টেট সংস্থাপন করতে। ‘আমাদের সংখ্যার জোর বেশি। আমরা আমাদের খুশিমতো হিন্দু রাষ্ট্র প্রবর্তন করব।’ এই যাদের যুক্তি তাদের হাতে পড়লে এদেশ বেশিদিন সংহতিরক্ষা করতে পারবে না। খ্রিস্টধর্মী নাগারা তো স্বাধীনতার জন্যে লড়বেই। লড়বে বৌদ্ধধর্মী সিকিম, ভুটান। লড়বে পাঞ্জাবের শিখরা, কেরলের খ্রিস্টানরা ও সর্বোপরি কাশ্মীরের মুসলমানরা। হিন্দুদেরও তো বারো রাজপুতের তেরো হাঁড়ি। এক বার ভাঙন ধরলে এ রাষ্ট্র চৌচির হয়ে যাবে।

    সুতরাং সেকুলার স্টেট হচ্ছে সেই ভিত্তি যা আমাদের রাষ্ট্রকে ধারণ করে আছে। যে ধারণ করে আছে তাকেও ধারণ করা অত্যাবশ্যক। এটা একজনের একটা খেয়াল নয় যে একে বিসর্জন দিলেও চলে। অথচ এরকম বিপরীত বুদ্ধি আমাদের দেশে অতি সুলভ। হিন্দুরাই যেন এদেশের মালিক, আর সকলে হিন্দুদের কৃপায় বাস করছে। প্রকৃত সত্য তা নয়। হিন্দুরাও আর-সকলের কৃপায় বাস করছে। তারা যদি বিমুখ হয় তবে রাষ্ট্র ভেঙে যাবে, শিখরা প্রাণ দিয়ে লড়বে না, পারসিরা সেনা পরিচালনা করবে না, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা শত্রুবিমান ভূতলে নামাবে না, খ্রিস্টানরা নার্স হয়ে রণাঙ্গনে যাবে না। আর মুসলমানরা প্রাণভয়ে পালিয়ে গেলে অর্থনীতি বিধ্বস্ত হবে। অর্থনীতির বিভিন্ন ধাপ তাদের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দুর চেয়ে মুসলমান কম দরকারি নয়। এখানে মানুষ হিসেবে বিচার করতে হবে। টিকি দেখে বা দাড়ি দেখে নয়। ঘরে আগুন লাগলে যারা নিবিয়ে ফেলতে ছুটে আসে তারা কে কোন ধর্মের লোক, কোন সমাজের লোক এটা মূর্খের গণনা। তেমনি শিল্পে-বাণিজ্যে-কৃষিতে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যার কর্ম তারে সাজে। তাকে পরম সমাদরে তার স্বস্থানে নিযুক্ত রাখতে হবে। তাকে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দেওয়া চলবে না। তাকে কথায় কথায় সন্দেহ করাও নির্বুদ্ধিতা। কোটি কোটি নাগরিককে সন্দেহ করলে মানুষ বিশ্বাস করবে কাকে? শেষকালে নিজের সম্প্রদায়কেও অবিশ্বাস করে বসবে।

    সংকটকালে শুভবুদ্ধি জাগ্রত থাকলে সংকট পার হওয়া তত কঠিন হবে না, যত কঠিন হবে ঘরে বাইরে সর্বত্র জুজু দেখলে। সেকুলার স্টেটের বিরোধী যাঁরা তাঁরা এতকাল বলে এসেছেন, লোক বিনিময় করা উচিত। তাঁদের মতে সব মুসলমানই কালো, সব হিন্দুই সাদা। মানুষকে অমন করে সাদায়-কালোয় ভাগ করা যায় না। সেটা যে আমরা করিনি এরজন্যে ভগবানকে ধন্যবাদ। পূর্ব পাঞ্জাবে মুসলমান নেই, সুতরাং সেখানকার জনগণের ওপর বোমা ফেলতে পাকিস্তানি বোমারু বৈমানিকদের বাধে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান আছে। এখানকার জনগণের ওপর বোমা ফেললে মুসলমানেরাও মরবে। তাই পশ্চিমবঙ্গের ওপর পাকিস্তানি বোমারু বৈমানিকরা বোমাবর্ষণ করছে না। লোক বিনিময়বাদীরা যদি পশ্চিমবঙ্গকে নির্মুসলমান করতেন তবে তাঁরাই বোমার বলি হতেন।

    হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে থাকা কেন প্রয়োজন, একথা হাজার তর্ক করেও বোঝানো যায়নি। এতদিনে ওটা সকলেরই হৃদয়ঙ্গম হবে। তাই যদি হয় তবে মুসলমানকে ধরে রাখাই প্রাণে বাঁচার উপায়। যাকে রাখ সেই রাখে। একথা ওপারের হিন্দুদের বেলায়ও খাটে। ওখানকার মুসলমানরা এবার হিন্দুদের প্রাণপণে রক্ষা করেছে। হিন্দুরা থাকলে এপারের বৈমানিকরা বোমাবর্ষণ করবে না। মুসলমানদেরও প্রাণরক্ষা হবে। এর থেকে একদিন আসবে ইসলামি রাষ্ট্রে অরুচি ও সেকুলার রাষ্ট্রে রুচি। তর্ক করে যেটা বোঝানো যায়নি সংকটের লজিক সেটা বোঝাবে। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের অন্তঃপরিবর্তন যখন আরও গভীর হবে তখন পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান হতে পৃথক হয়ে যেতে পারে। আর যদি পূর্ব পাকিস্তানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরাও উপলব্ধি করে যে বিপৎকালে অপর সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই শ্রেয় তাহলে তাদেরও অন্তঃপরিবর্তন ঘটবে। তখন পাকিস্তান আর ইসলামি স্টেট বলে অহংকার বোধ করবে না। বরং পূর্ব পাকিস্তানকে সঙ্গে রাখার জন্যে সেকুলার মতবাদ অবলম্বন করতে চাইবে।

    একদিন ক্লাসের পরে আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে আমার প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক নিশিকান্ত সান্যাল মহাশয় বলেন, ‘অশোকের ওই বিশাল সাম্রাজ্য পরে ভেঙে পড়ল কেন, তার আসল কারণ জান? বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। যে-দেশে বহু ধর্ম সেদেশে একটি ধর্ম যদি রাজধর্ম হয় ও সেই ধর্মটির প্রতি যদি রাজানুকূল্য বর্ষিত হয় তবে সে-রাজ্য টেকে না।’

    আমি তাঁর সঙ্গে তর্ক করি। আমার মনে হয়েছিল তিনি নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব বলেই অমন উক্তি করলেন। তিনি আমাকে বোঝান যে, তিনি বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে নন, বৌদ্ধ ধর্মের রাজধর্ম হওয়ার বিরুদ্ধে। অশোকের বৌদ্ধ হওয়াটা ভুল নয়, বৌদ্ধ ধর্মকে রাজধর্ম করাটাই ভুল।

    তেতাল্লিশ বছর পরে তাঁর সঙ্গে আমি একমত। ব্যক্তিগত মুক্তি বা নির্বাণ বা পরিত্রাণের জন্যে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো ধর্মে বিশ্বাস করতে পারেন, কিন্তু রাজা তাঁর নিজের ধর্মকে রাজধর্ম করবেন ও আর-সব ধর্মের উপর অগ্রাধিকার দেবেন এটা হয়তো সেই ধর্মটির দিক থেকে সুবিধের, রাজ্যের দিক থেকে সুবুদ্ধি নয়। বৌদ্ধ ধর্মেরও শেষপর্যন্ত এতে লাভ হয়নি। বিস্তার ঘটেছে, কিন্তু শিকড় ক্ষয়ে গেছে।

    প্রত্যেক রাষ্ট্রের একটা কাঠামো থাকে। সেটা যদি মজবুত হয়ে থাকে তবে বহিঃশত্রুর আক্রমণ, ক্ষমতা নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রজাদের অসন্তোষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নেপোটিজমের অবশ্যম্ভাবী কুফল ইত্যাদি বহু শতাব্দী ধরে সে পোহাতে পারে। প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রের কাঠামো মোটের ওপর শক্ত ছিল। সেটা ছিল ব্রাহ্মণে-ক্ষত্রিয়ে একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। রাজা ক্ষত্রিয়, মন্ত্রী ব্রাহ্মণ। সামরিক ক্ষমতা ক্ষত্রিয়ের, অসামরিক ক্ষমতা ব্রাহ্মণের। ক্ষত্রিয় শব্দটির সংজ্ঞা যথেষ্ট উদার ছিল। গায়ের জোরে যে জবরদখল করত সে-ই ক্ষত্রিয় হতে পারত। কে মনে রাখতে যাচ্ছে যে তার গর্ভধারিণী শূদ্রাণী? চন্দ্রগুপ্তের জননী যেমন শূদ্রাণী অশোকের তেমনি ব্রাহ্মণী। আর ব্রাহ্মণ শব্দটির সংজ্ঞাও যথেষ্ট উদার ছিল। শকদের সঙ্গে তাদের পুরোহিতরাও আসেন ও পরে ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হন। যেমন একালের নমঃশূদ্রদের পুরোহিতরাও ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিচ্ছেন ও ব্রাহ্মণের পদবি নিচ্ছেন।

    চন্দ্রগুপ্ত ব্যক্তিগত জীবনে জৈন হলেও ক্ষত্রিয়ই ছিলেন। ক্ষত্রিয়সমাজই তাঁর সমাজ। তেমনি অশোকও ব্যক্তিগত জীবনে বৌদ্ধ হলেও ক্ষত্রিয়ই ছিলেন। বৌদ্ধদের গ্রন্থে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে। ক্ষত্রিয়সমাজই তাঁর সমাজ। তবে শেষের দিকে তিনি বোধ হয় বৌদ্ধদের সংঘে যোগ দেন। সংঘে যারা যোগ দিত তারা জাত দিত। সমাজে যারা থাকত তারা জাত রাখত। অমুক ব্যক্তি জৈন বা বৌদ্ধ বা শিখ বললে এমন কথা বোঝায় না যে অমুক ব্যক্তি জাতে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বা শূদ্র নন; জাতি ও ধর্ম এদেশে একার্থক নয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও চেয়েছিলেন যে ব্রাহ্ম হবার পরেও লোকে ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ বা নাপিত বা মুচি থাকে। এটা কেশবচন্দ্র প্রমুখের অসহ্য হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সেই যে বিদ্রোহ সে-বিদ্রোহ ইতিহাসে অপূর্ব। জাতিভেদের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে এখন আর কাউকে সন্ন্যাস নিতে বা সংঘে যোগ দিতে হয় না। সমাজে থেকে ও গৃহস্থ হয়েও এখন জাত দেওয়া যায়। নতুন একটা জাত তৈরি করারও দরকার হয় না।

    চন্দ্রগুপ্ত জৈন হবার দরুন বা অশোক বৌদ্ধ হবার দরুন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। সামরিক ক্ষমতা, শাসকের ক্ষমতা ক্ষত্রিয়দের হাতেই রয়ে গেছে। অসামরিক ক্ষমতা, মন্ত্রীর ক্ষমতা ব্রাহ্মণদের হাতছাড়া হয়নি। এসব সাধারণত বংশানুক্রমিক। জাত জিনিসটা আসলে পেশার ধারাবাহিকতা। যার যেমন পেশা তার তেমন জাত। পরে, যার যেমন জাত তার তেমন পেশা। সাধারণত সেটা বংশানুক্রমিক ছিল। কেউ একজন বৌদ্ধ বা কোনো একটি পরিবার জৈন হলেই অমনি তার বা তাদের পেশা বদলে যেত না। তাই জাত বদলে যেত না। ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব বলতে একালে যা বোঝায় প্রাচীন ভারতে তা বোঝাত না। তার সূচনা মুসলমান আগমনের পর থেকে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সেই প্রথম আঘাত পড়ে। মুসলমান হলেই সবরকম পদে অধিকার বর্তায়। যে চন্ডাল মুসলমান হয়েছে সে রাজাও হতে পারে, মন্ত্রীও হতে পারে, সেনাপতিও হতে পারে, সওদাগরও হতে পারে। চিরন্তন কাঠামোটিকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।

    মুসলমানি আমলের গোড়ার দিকে ইসলামি রাষ্ট্রের কাঠামো আমদানির চেষ্টা যে হয়নি তা নয়, কিন্তু এদেশের মাটিতে ও-জিনিস টেকে না। বহু অঞ্চল হিন্দুদের দখলে থেকে যায়, যেসব অঞ্চলে পুরাতন বন্দোবস্ত। মুসলমান অধিকৃত অঞ্চলেও হিন্দুদের সঙ্গে একটা নয়া বন্দোবস্ত হয়। সাধারণত দেওয়ানি হিন্দুদের হাতে, ফৌজদারি মুসলমানদের হাতে। তার মানে সেই ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়। তবে ঠিক সাবেক অর্থে নয়। জাতে ব্রাহ্মণ নন এমন বহু লোক মুসলমান সরকারে অসামরিক পদ পান, পরে জমিদারি পান। ক্ষত্রিয় নন এমন বহু লোক সামরিক পদ পান, সামন্তরাজা হন। ওদিকে সৈয়দরা বা মৌলানারা ব্রাহ্মণের মর্যাদা পান। ক্ষত্রিয় মর্যাদা পান। ক্ষত্রিয় মর্যাদা যে সব মুসলমানকেই দেওয়া হয় তা নয়। আভিজাত্যের সৃষ্টি হয়। মুসলমান সমাজ আর ডেমোক্র্যাটিক থাকে না।

    ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি হিন্দুতে মুসলমানে নয়, হিন্দুতে হিন্দুতে, মুসলমানে মুসলমানে। সব উপরের স্তরে। নীচের স্তরে কারও সামনে কোনো লোভনীয় পদ বা মর্যাদা ছিল না। যে ভিস্তি সে ভিস্তিই। যে দর্জি সে দর্জিই। তেমনি যে তাঁতি সে তাঁতিই। যে কামার সে কামারই। নীচের স্তরে যেটা ছিল সেটা গোহত্যা নিয়ে দাঙ্গা বা সেই-জাতীয় ব্যাপার। ধর্মের লড়াই বলতে মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসে যা বোঝায়, যার জন্যে বহু লোক আমেরিকায় চলে গিয়ে স্বাধীনভাবে বিশ্বাস করতে চাইল, সে-জিনিস ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসে অনুপস্থিত। বিশ্বাসের স্বাধীনতা এখানে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো নিত্য প্রবাহিত ছিল। মুসলমানরা বিশ্বাসের স্বাধীনতায় যেটুকু হস্তক্ষেপ করেছিল সেটুকু মানুষকে দেশছাড়া বা ঘরছাড়া করবার মতো নয়। হিন্দু রাজাদের উৎপীড়নে হিন্দুরা হিন্দুরাজ্য ছেড়ে পালিয়েছে, আবার ফিরে এসেছে। তেমন উৎপীড়নকে ধর্মের উৎপীড়ন বলে না। মুসলমান রাজারাই এদেশে ইসলামি রাষ্ট্র প্রবর্তনে আপত্তি করেন। রাজা মুসলমান হলেই রাষ্ট্র ইসলামি হয় না। দেশটাও তার উপযোগী হওয়া চাই। অধিকাংশ মুসলমান রাজার সেটুকু বাস্তবজ্ঞান ছিল। যাঁদের ছিল না তাঁদের বুদ্ধির ভুলে তাঁদের ধর্ম অশোকের আমলের বৌদ্ধ ধর্মের মতো রাজ-আনুকূল্য পেয়ে রাজ্যের স্থায়িত্বের অন্তরায় হল। ধর্মের বিস্তার ঘটল, কিন্তু রাজ্যের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগল। ফলে পলাশিতে পরাজয়।

    আমি ইসলামের বিরুদ্ধে নই, ইসলামকে রাজধর্ম করার বিরুদ্ধে। তেমনি হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে নই, হিন্দুত্বকে রাজধর্ম করার বিরুদ্ধে। মারাঠাদের আমলে রাজধর্ম দস্যুধর্মে পরিণত হয় ও স্বধর্মীকে রক্ষণের নামে ভক্ষণ করে। বর্গির হাঙ্গামায় যত লোক পালিয়েছে তুর্কের হাঙ্গামায় তত লোক নয়। ইংরেজরা যে অত সহজে এদেশ করায়ত্ত করে তার প্রধান কারণ তারা তাদের ধর্মকে কোনোরকম বিশেষ মর্যাদা বা অগ্রাধিকার দেয় না। প্রথম থেকেই এই নীতি স্থির হয় যে, ইংরেজ সরকার সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দেবে, কোনো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না। এটার নজির আকবর দেখিয়েছিলেন, তাঁর আগেও এর নজির খুঁজলে পাওয়া যায়, কিন্তু এবার সমসাময়িক ইউরোপের নতুন সুরে বাধা। ইউরোপে ওটার নাম এনলাইটেনমেন্টের যুগ। লণ্ডন থেকে যাঁরা নীতি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন তাঁরা ধর্মের যুগ পেরিয়ে এসেছেন, মধ্যযুগ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এদেশে যেটা কোনো একজন রাজা বা সম্রাটের ব্যক্তিগত উদারতা হিসেবে গণ্য ছিল সেটা এখন থেকে রাষ্ট্রের নৈর্ব্যক্তিক ভিত্তিশিলা হিসেবে পুরুষানুক্রমিক হল। একজন রাজা পরধর্মসহিষ্ণু হন তো তাঁর বংশধর পরধর্ম অসহিষ্ণু হন। কিংবা তিনি এক এক বয়সে এক এক মূর্তি ধরেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের হিন্দু বৌদ্ধ জৈন মুসলমান এক একজন রাজার এক এক নীতি। পাকাপাকিভাবে রাষ্ট্রের নৈর্ব্যক্তিক নীতি তা নয়। সেইজন্যে উদারচরিত রাজন্যদের সংখ্যা যত বেশিই হোক-না কেন তাঁদের কারও রাষ্ট্রকেই ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায় না। সেকুলার বলা যায় না।

    কেউ কেউ সেকুলারের অর্থ করেন ধর্মে নিরপেক্ষতা। সেটা ঠিক নয়। যে মানুষ ধর্মে নিরপেক্ষ তারও একটা নিজের ধর্ম থাকে। কিন্তু এমন তো হতে পারে যে তার কোনো ধর্মে বিশ্বাস নেই, সে অজ্ঞেয়বাদী বা নাস্তিক। ইংরেজ আমলে ধর্মে নিরপেক্ষতা ছিল, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল না। নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদীকে ইংল্যাণ্ডের সিংহাসনে বা বিশিষ্ট রাজপদে অধিষ্ঠান করতে দেওয়া হত না। শপথ নিতে হত ভগবানের নামে। এমনকী পার্লামেন্টেও ব্র্যাডলকে বসতে দেওয়া হয়নি, তিনি শপথ নিতে রাজি হলেও তাঁকে নিতে দেওয়া হয়নি যেহেতু তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী নন। সেই ইংরেজই তো ছিল এদেশের হর্তাকর্তা বিধাতা।

    ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পত্তন ইতিহাসের প্রাচীন বা মধ্যযুগে তো নয়ই, ইংরেজ আমলেও নয়। এটা কংগ্রেস আমলেরই বিশেষত্ব। এরজন্যে আমরা গর্ব অনুভব করতে পারি। আমাদের হাত দিয়েই বা ভোট দিয়েই এটা সম্ভব হয়েছে। একে রক্ষা করা আমাদের পরম দায়িত্ব। ধর্মের জন্যে কেউ যদি এ রাষ্ট্র ছেড়ে পালায় তবে সেটা আমাদের কলঙ্ক, আমাদের ওপর অনাস্থাসূচক।

    এই নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তিশিলা সর্বধর্মসহিষ্ণুতা তো বটেই, তার চেয়েও কিছু বেশি। এ রাষ্ট্র ধর্মের এলাকার বাইরে যারা থাকবে, তাদের প্রতিও সহিষ্ণু। না, তার চেয়েও বেশি। এ রাষ্ট্র তাদের নাস্তিক হবার, অজ্ঞেয়বাদী হবার অধিকারও মেনে নেয়। তারা যে যার নিরীশ্বরতায় অবিচল থেকে ধাপে ধাপে রাষ্ট্রীয় পদে আরোহণ করতে পারে। একদিন হয়তো দেখা যাবে যে রাষ্ট্রপতি নিরীশ্বরবাদী। তিনি না হিন্দু, না মুসলমান, না খ্রিস্টান, না শিখ, না পারসি, না বৌদ্ধ, না ইহুদি, না জৈন। হয়তো আরেকটি লেনিন কি স্টালিন। তাঁকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে এমন কোনো শপথবাক্য আমাদের সংবিধানে নেই।

    আজকালকার পরিভাষায় যাকে কনস্টিটিউশন বলা হয়, আগেকার যুগে সেরকম কিছু বিবর্তিত হয়নি এদেশে। কিন্তু সেই যে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সেটাও এক হিসাবে একটা অলিখিত সংবিধান। মুসলমান আমলে সেটার অদলবদল হয়, কিন্তু পুরোপুরি রদ হয় না সেটা। ইংরেজ আমলে সেটা পাকাপাকিভাবে রদ হয়। তার বদলে দেখা দেয় আরেকরকম বন্দোবস্ত। এগজিকিউটিভ, জুডিশিয়াল, লেজিসলেটিভ এই তিন অঙ্গ। সব ক-টাই ইংরেজদের মুঠোর মধ্যে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মুঠোর ভিতর থেকে বেরোয়। যাঁদের হাতে একটু একটু করে যায় তাঁরা প্রধানত হিন্দুসমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উচ্চশিক্ষিত স্তরের ব্যক্তি। তাঁদের প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলমান সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুচ্চশিক্ষিত স্তরের ব্যক্তি। সরাসরি প্রতিযোগিতায় না পেরে এঁরা ধর্মের নামে দাবি করতে শুরু করেন ও প্রশ্রয় পান। এইভাবে যে ঝগড়ার সূচনা তা ক্রমশ নীচের স্তরে সঞ্চারিত হয়, উপরের স্তরেও সংক্রামিত হয়। অভিজাতদের মধ্যে কোনোকালেই ধর্ম নিয়ে বিরোধ ছিল না। অন্তত মোগল আমলে তো নয়ই। এই সেদিন দেখা গেল। ইংরেজ চলে গেলে তার উত্তরাধিকারী কে হবে, এই নিয়ে বেঁধে গেল দুই শরিকের লড়াই। কিছুতেই মিটমাট হল না। উপর থেকে নীচ অবধি ফাটল। প্রত্যেকটি বিভাগ দু-ফাঁক। সৈন্য, পুলিশ, পেয়াদা, কেরানি, হাকিম।

    আমরা স্বচক্ষে দেখলুম যে, আমাদের দেশ দু-চির হয়ে গেল। যে ফাটল তাকে দু-চির করতে পারল সেই ফাটলের মতো আরও দু-চারটি ফাটল কি তাকে চৌচির করতে পারত না? হিন্দুরাষ্ট্র হলে শিখরা কি বলত না, লড়কে লেঙ্গে শিখিস্থান? নাগা খ্রিস্টানরাও কি বলত না, লড়কে লেঙ্গে নাগাল্যাণ্ড? সিকিমের বৌদ্ধরাও কি বলত না, লড়কে লেঙ্গে স্বাধীন সিকিম? কাশ্মীরের মুসলমানরাও কি বলত না, লড়কে লেঙ্গে স্বাধীন কাশ্মীর?

    যে যার ধর্মকে রাজধর্ম বা রাষ্ট্রধর্ম করতে চাইলে এদেশ দু-চির কেন, চৌচির হবে; চৌচির কেন, ছ-চির হবে। এই সর্বনাশা ফাটল দিয়ে আবার বাইরের শত্রু ঢুকবে। স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। স্বাধীনতার জন্যে এতকালের তপস্যা ব্যর্থ হবে। এসব কথা চিন্তা করেই ভারতীয় ইউনিয়নের কনস্টিটিউশনে হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়নি। হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং অধিকাংশের ভোটে হিন্দুরাষ্ট্র পত্তন করা অনায়াসেই সম্ভব ছিল। কিন্তু ওটা একটা ফাঁদ। ওতে পা দিলে মৌর্য সাম্রাজ্য বা গুপ্ত সাম্রাজ্য বা হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়া যেত না। মাঝখান থেকে হারিয়ে যেত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রাম, জাতীয় মুক্তি, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। জাতীয়তার অর্থ এখানে হিন্দু জাতীয়তা নয়, হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান পারসি নির্বিশেষে ও সবাইকে সমমূল্য দিয়ে ভারতীয় জাতীয়তা। যে জাতীয়তা শিখকে বলে এটাও তোমারই স্থান, আলাদা একটা স্থান নিয়ে কী করবে? যে জাতীয়তা নাগা খ্রিস্টানকে বলে, এটাও কি তোমার ল্যাণ্ড নয়? স্বাধীন নাগাল্যাণ্ড নিয়ে কী করবে? যে জাতীয়তা কাশ্মীরি মুসলমানকে বলে, এটা হিন্দুস্তান নয়, এটা ইন্ডিয়া, এখানে তুমি চিরকাল ছিলে, চিরকাল থাকবে। স্বাধীন কাশ্মীর নিয়ে কী করবে, কেনই-বা পাকিস্তানে যোগ দেবে?

    সেকুলারিজম ভারতের সীমান্ত রক্ষা করছে। শুধুমাত্র বন্দুক কামান যা না-পারে একটি কলমের খোঁচা তা পারে। একটি শব্দ তা পারে। সেকুলারিজম তেমনি একটি কলমের খোঁচা। তেমনি একটি শব্দ। একে ওলটপালট করে দাও, দেখবে সীমান্তবর্তী অহিন্দু অঞ্চলগুলি এক এক করে খসে যাবে, যারা ছিল ঘরের লোক তারাই হবে বাইরের শত্রু। হিন্দুরাষ্ট্র অনায়াসেই সম্ভব, পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট তাকে যেকোনো দিন সম্ভব করতে পারে। কিন্তু তার পরের দিন তার সীমান্তগুলিতে ভাঙন ধরবে। হিন্দুরাষ্ট্র নিজেই নিজেকে কোণঠাসা করবে। অভ্যন্তরে অহিন্দু যারা থেকে যাবে তারাও অশান্ত হবে। তারা দাবি করবে চাকরিবাকরিতে আনুপাতিক অংশ ও তার উপর ওয়েটেজ। তারপর দাবি করবে স্বতন্ত্র নির্বাচন, সেক্ষেত্রেও ওয়েটেজ। তারপর দাবি করবে মন্ত্রীমন্ডলীতে স্থান, কংগ্রেসি হিসেবে নয়, কংগ্রেস ভিন্ন অন্য এক সাম্প্রদায়িক দলের সদস্যরূপে। এগজিকিউটিভ, জুডিশিয়াল, লেজিসলেটিভ, সর্বত্র ফাটল ধরবে। দেশ অরাজক হবে। পুলিশ বা মিলিটারি যা না-পারে সেকুলার স্টেট তা পারে। সীমান্তরক্ষা তথা শান্তিরক্ষা।

    সেকুলার স্টেট ভারতের ইতিহাসে একটি নতুন এক্সপেরিমেন্ট। এ যদি হিন্দুদের মনে না বসে, যদি শুধু মুখের বুলি হয়, যদি তাদের মনের কথাটা হয় হিন্দু আধিপত্য, যার অন্য নাম ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বেনিয়া মনোপলি, তাহলে ভিতরের সত্যটা একদিন-না-একদিন বাইরে ফুটে বেরোবে। কী করে মনে বসবে, যদি যুগ সম্বন্ধে কোনো ধারণা তাদের না থাকে? যুগটাই ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে রাজতন্ত্র তথা ধর্মতন্ত্র তথা উভয়ের মণিকাঞ্চনযোগে বিশ্বাস হারিয়েছে। ইংরেজ চলে গেছে বলে যুগটা তো চলে যায়নি। যুগের হাওয়া থেকে কোনো দেশই মুক্ত নয়। ভারতের স্বাধীনতার অর্থ যুগের হাত থেকে মুক্তি নয়। আমরা বরং আমাদের যুগের সঙ্গে আরও অবাধে যুক্ত হবার সুযোগ পেয়েছি। এ হাওয়া যে বার্তা বহন করে এনেছে তার অনুরূপ অতীতের আর কোনো যুগে শোনা যায়নি। না মহাভারতের যুগে, না মৌর্য যুগে, না গুপ্ত যুগে, না মুঘল যুগে। যাকে আমরা ব্রিটিশ যুগ বলে জানি সেটা একটা বৃহত্তর যুগের অঙ্গ। এ যুগ ভারতকে বিশ্বের মধ্যে ও বিশ্বকে ভারতের মধ্যে সঞ্চারিত করেছে। আমাদের অতীত বিচ্ছিন্ন হতে পারে, বর্তমান বিচ্ছিন্ন নয়, ভবিষ্যৎ বিচ্ছিন্ন থাকবে না। এ যুগের যা শিক্ষা তাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে হবে।

    একদিন পাকিস্তানের মুসলমানরাও করবে। তারজন্যে ধৈর্য ধরতে হবে। ওরা যদি সেকুলার নাও হয় তবু আমরা হব। সেইভাবে আমরা অন্যান্য অগ্রসর দেশগুলির সঙ্গে পা মিলিয়ে নেব। পাকিস্তানের অনুকরণে ধর্মরাষ্ট্র প্রবর্তন নয়, সেকুলার স্টেট অগ্রগতির শর্ত।

    সম্পাদকের সঙ্গে আমি একমত নই যে পশ্চিমবঙ্গে সেকুলার মানসিকতা বিরাজমান। সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র কীসের সাক্ষ্য দেয়? বারোয়ারি দুর্গা পূজা, কালী পূজা, বিশ্বকর্মা পূজা এমনকী শীতলা পূজার এমন উৎকট প্রাদুর্ভাব ইংরেজ আমলেও তো দেখিনি। সরকারি অফিসে ও থানাতেও আজকাল পূজাপার্বণ হয়। রাষ্ট্রের যাঁরা কর্ণধার তাঁরা তাঁদের কর্ণ গুরুমহারাজদের হাতে সঁপে দিয়েছেন দেখা যায়। দিল্লিতে না কি হেন মন্ত্রী নেই যাঁর জ্যোতিষী নেই। বছরের ক-টা দিন কাজকর্ম হয়? সম্প্রদায়ের—প্রধানত হিন্দুদের—ধর্মকর্মের জন্যে ছুটি। সরকারি কর্মচারীরা ভুলে যান যে তাঁদের মাইনে জোগায় সব সম্প্রদায়ের লোক। কালী পূজার উদ্বোধন কি বেসরকারি ব্যক্তিদের দিয়ে হত না? সম্পাদকের প্রশ্নের উত্তরে বলি, কাশ্মীরের বোমাবর্ষণ বিমানবন্দর প্রভৃতি সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর নিবদ্ধ ছিল বলেই জানি। অসামরিক জনতার ওপর দুটো-একটা বোমা পড়ে থাকলে সেটা আকস্মিক। জনতা যেখানে মিশ্র সেখানে বিপদ অপেক্ষাকৃত কম।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআগুন নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়
    Next Article আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

    Related Articles

    অন্নদাশঙ্কর রায়

    বাংলার রেনেসাঁস

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আগুন নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    কন্যা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }