Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পথে প্রবাসে ও নির্বাচিত প্রবন্ধ – অন্নদাশঙ্কর রায়

    অন্নদাশঙ্কর রায় এক পাতা গল্প410 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    টোমাস মান শতবার্ষিকী

    মধ্যযুগের জার্মানিতে ধনপতি সওদাগরদের একটি সংঘ ছিল। হান্স সংঘ বা হানসিয়াটিক লিগ। সেই লিগের শাসনাধীন ছিল কয়েকটি সামুদ্রিক বন্দর শহর। তাদের অবস্থান সাম্রাজ্যের ভিতরে অথচ তাদের বাণিজ্য সাম্রাজ্যের বাইরে। এমনই এক হানসিয়াটিক বন্দর শহরের নাম লুএবেক। এরই এক পুরাতন সওদাগর বংশে টোমাস মানের জন্ম। তাঁর পিতা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে না হোক দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সুন্দরী বধূ ঘরে এনেছিলেন। টোমাসের মাতৃকুল জার্মান নয়। স্প্যানিশ বা পোর্তুগিজ ঔপনিবেশিক ঘরানা। শোনা যায় তাঁদের কেউ একজন রেড ইন্ডিয়ান বিবাহ করেছিলেন। দক্ষিণ আমেরিকায় এটা এক পুরাতন রীতি। এতে কারও সম্ভ্রমহানি হয় না। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রহণ করলে পরে বর্ণ একটা সমস্যা নয়।

    টোমাসের পিতৃকুল নিরেট বুর্জোয়া। সমৃদ্ধি, সম্মান, শৃঙ্খলাবদ্ধ সামাজিক জীবন, অনিন্দনীয় আচরণ, পিউরিটান নীতি এইসব তাঁদের লক্ষ্য। ব্যবসাবাণিজ্যে অবহেলা, অর্থোপার্জনের অনীহা, শৃঙ্খলাহীন অসামাজিক জীবন, সংগীতে বা সাহিত্যে মনোযোগ, সৌন্দর্যের জন্যে ঘরসংসার ত্যাগ এসব তাঁদের কাছে দুর্বোধ্য ও দুরাচরণীয়। তিন শতাব্দীর পৈতৃক বাসভবনে এমন অঘটন কখনো ঘটেনি। কারণ মাতৃকুলও ছিল পিতৃকুলের অনুরূপ। নববধূর সঙ্গে সঙ্গে এল নতুন কেতা। বাড়িতে শ্রী এল। কিন্তু সৌভাগ্য চলে গেল। পতন হল বাণিজ্যের। মৃত্যু হল কর্তার। সম্পত্তি বিক্রি করে মান পরিবার প্রস্থান করলেন উত্তরের বন্দর শহর থেকে দক্ষিণের রাজ্য-রাজধানী মিউনিখ নগরে।

    শিল্প-সংগীত-সাহিত্যের জন্যে মিউনিখ প্রসিদ্ধ। প্যারিসের দিকে ওর এক মুখ, আর এক মুখ ভিয়েনার দিকে। কিছুকাল ইটালিতে কাটিয়ে এসে মিউনিখেই টোমাস বসতি করেন ও জীবিকার জন্যে বেছে নেন সাহিত্যিক জীবন। বাইশ বছর বয়সে শুরু করে পঁচিশ বছর বয়সে শেষ করেন বুডেনব্রুকস নামক যে বিরাট উপন্যাস সে-গ্রন্থ প্রকাশিত হতে-না-হতেই জার্মান সাহিত্যের একটি ক্ল্যাসিক বলে গণ্য হয়। যশ আর অর্থ, গৃহিণী আর গৃহ তাঁর প্রতিষ্ঠা পরিপূর্ণ করে। সেই যে তিনি উঠলেন তারপরে আর পড়লেন না। প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় ম্যাজিক মাউন্টেন। প্রকাশের পাঁচ বছরের মধ্যেই বহন করে নিয়ে আসে সাহিত্যের জন্যে নোবেল প্রাইজ ও বিশ্বখ্যাতি। তিনিই দ্বিতীয় জার্মান সাহিত্যিক যাঁকে এই সম্মান প্রদান করা হয়। প্রথম জন গেরহার্ড হাউপ্টমান। ততদিনে হাউপ্টমানের দেহান্ত হয়েছে। সুতরাং টোমাস মানই হন অদ্বিতীয়।

    এখানে বলে রাখি যে, টোমাসের অগ্রজ হাইনরিখও ছিলেন সমসাময়িক ঔপন্যাসিকের মধ্যে সমান শক্তিশালী। হাইনরিখ বাস করতেন বার্লিনে। আর বার্লিনের জীবন ছিল মহারাজধানীর আরও বিচিত্র জীবন। সেদিক থেকে হাইনরিখের সৌভাগ্য বেশি। এ যেন গভীরতরের সঙ্গে উদারতরের প্রতিযোগিতা। অনেক দিন পর্যন্ত অনিশ্চিত ছিল কোন ভাই কোন ভাইয়ের কাছে হারবেন। কিন্তু নোবেল প্রাইজের পর আর সন্দেহ রইল না যে, ছোটোভাই মিউনিখে বসে বার্লিনবাসী বড়োভাইয়ের চেয়ে অধিকতর সম্মানের অধিকারী।

    কিন্তু নিয়তির এমনই কৌতুক যে এর চার বছরের মধ্যেই দুই ভাইকেই দেশত্যাগ করতে হয়। যঃ পলায়তি সঃ জীবতি। হিটলারের ক্রোধ থেকে। তিন শতাব্দীর বনেদি জার্মান যাঁরা তাঁরা আর জার্মান বলে পাঙক্তেয় নন। কারণ তাঁদের রক্ত বিশুদ্ধ আর্যরক্ত নয়। টোমাস আবার ইহুদি কন্যা বিবাহ করে আরও কয়েকটি অশুদ্ধ আর্যসন্তানের জনক। আর হাইনরিখ তো পাকা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট। নাতসিদের চক্ষুশূল। হিটলার যেখানে সর্বেসর্বা সেখানে বাস করা মানে জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ। হাইনরিখ কোথায় যান জানিনে, কিন্তু টোমাস প্রথমে যান সুইটজারল্যাণ্ডে ও সেখানে কয়েক বছর থেকে তারপরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন। আরও কয়েক বছর বাদে সেদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। হিটলারের পতনের পরে আবার যখন স্বদেশে ফিরে আসেন তখন দেখেন দেশ হয়েছে দু-ভাগ। তাঁর সাহিত্যগুরু গ্যেটে আর শিলারের কর্মক্ষেত্র পড়েছে পূর্ব জার্মানিতে। আর পশ্চিম জার্মানিতে তাঁর নিজের কর্মক্ষেত্র। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির প্রতি সমান অনুরক্ত এটা পশ্চিম জার্মানির লোক পছন্দ করে না। তা ছাড়া তিনি যে যুদ্ধকালে শত্রুশিবিরে ছিলেন এটাও দেশানুরাগীরা ভালো চোখে দেখেন না। তাঁকে আবার চলে যেতে হয় সুইটজারল্যাণ্ডে। সেখানেই তিনি তাঁর জীবনের কাজ শেষ করেন। অবশ্য কিছু অসমাপ্ত রয়ে যায়। এখানে বলে রাখি যে, তাঁর মিউনিখের ঘরবাড়ি টাকাকড়ি হিটলার অনেক আগেই বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। কেড়ে নিয়েছিলেন তাঁর জার্মান নাগরিকত্ব। আমেরিকান নাগরিকত্ব গ্রহণ করার আগে তাঁকে দীর্ঘকাল অনাগরিক অবস্থায় কাটাতে হয়। নাৎসিরা পুড়িয়ে ফেলে বুডেনব্রুকস।

    জার্মানি একদা আরও বৃহৎ ছিল। তার কেন্দ্রভূমি ছিল অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়ার রাজবংশ তথা অভিজাতকুলে যাঁদের জন্ম তারা কেউ বিশুদ্ধ আর্যরক্তের অধিকারী ছিলেন না। বিশুদ্ধ আর্যরক্তের ওপর বিশুদ্ধ জার্মানত্ব নির্ভর করে এই আইডিয়াটা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের প্রাশিয়াকেন্দ্রিক জার্মানির। মান-এর জন্মস্থান লুএবেক ও কর্মস্থান মিউনিখ ছিল প্রাশিয়ান আধিপত্যের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে দুই প্রান্তে। সেখানকার লোক কারও চেয়ে কম জার্মান নয়, কিন্তু তাদের জার্মানত্বের সংজ্ঞা নাৎসি আমলের মতো সংকীর্ণ নয়। তাই যদি হত তবে বুডেনব্রুকস জার্মান জাতির একটি জাতীয় গ্রন্থ বলে ত্রিশ বছর ধরে সমাদৃত ও ঘরে ঘরে পঠিত হত না। তার অপরাধ রক্তগত, জার্মানত্বের থিসিসের সঙ্গে তার মেলে না। যে থিসিস জার্মানিকে যুদ্ধে টেনে নিয়ে গিয়ে হারিয়ে দিয়ে দু-ভাগ করে ছাড়ল সে-থিসিস টোমাস মান বা হাইনরিখ মানদের মতো বড়ো জার্মানদের থিসিস নয়, সে-থিসিস হিটলারের মতো ছোটো জার্মানদের থিসিস। জার্মানিকে ছোটো করে দিয়ে গ্যেটের জন্মস্থান ফ্রাঙ্কফুর্টকে করে দিল তাঁর কর্মস্থান ভাইমারের থেকে বিচ্ছিন্ন।

    নোবেল প্রাইজ পাবার পূর্বেই টোমাস মান তাঁর জার্মান জাতীয়তাবাদী মানসিকতার ঊর্ধ্বে ইউরোপীয় সভ্যতার অভিন্ন চেতনায় উপনীত হয়েছিলেন। তাই তাঁর ম্যাজিক মাউন্টেন ছিল জার্মান সাহিত্যের তথা ইউরোপীয় সাহিত্যের একটি শৈলশিখর। জার্মানিতে নয়, সুইটজারল্যাণ্ডে তার উপস্থাপনা। একটি স্যানাটোরিয়ামে সমবেত হয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন জাতির যক্ষ্মারোগী ও তাদের বন্ধুবান্ধব। জার্মানির ঘরোয়া সমস্যাকে অতিক্রম করেছে ইউরোপের জটিল ও দুরারোগ্য সমস্যা। এ গ্রন্থের যিনি গ্রন্থকার তিনি ইউরোপকে নিয়েই চিন্তিত ও শঙ্কিত। ইউরোপের সেটা প্রথম মহাযুদ্ধের পুরোগামী যুগ। বুর্জোয়াদের স্বর্ণযুগ বললেও চলে। কে জানত তার ভিতরে রয়েছে ব্যাধিবীজ! ভিতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ইতিপূর্বে ভেনিসে মৃত্যু লিখে মান তার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। সেটিও একটি অনবদ্য সৃষ্টি। সে-কাহিনি পড়লেই বোঝা যায় সেখানে যার নাম কলেরা এখানে তার নাম যক্ষ্মা। আর ব্যাধিটা ভিতরের।

    ইউরোপীয় স্তরে উত্তীর্ণ হবার পরেও মান তাঁর নোবেল প্রাইজ গ্রহণকালীন ভাষণে ঘোষণা করেন যে, তিনি জার্মান জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। জার্মানি তখন প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজিত শুধু নয়, যুদ্ধাপরাধে অপরাধী ও লিগ অফ নেশনস থেকে একঘরে। তার স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক সমাবেশে দুটি কথা বলারও জো ছিল না। তাই প্রথম সুযোগেই মান স্বদেশের স্বপক্ষে দুটি কথা বলেন। জার্মানিকে তখনও ক্ষমা করেনি যারা তারা বিরক্ত হয়। কিন্তু জার্মানদের তো বিরূপ হবার কথা নয়। তবু তারাই বা তাদের একদলই হল তাঁর দেশত্যাগের হেতু। নিয়তির এমনই বিড়ম্বনা!

    মান ইতিমধ্যে ইউরোপকেও অতিক্রম করেছিলেন। মানবসভ্যতার অন্যতম মূলগ্রন্থ ইহুদিদের পুরাতন টেস্টামেন্ট। তার একটি অসাধারণ অংশ যোসেফের উপাখ্যান। মান সেটিকে পুনর্লিখনের ও পুনর্ব্যাখ্যানের দায় নেন। জার্মানিতে বাস করে হিটলারি আমলে ইহুদিদের অতীতকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অবলোকন কি নির্বিবাদে সম্ভবপর হত! বিশেষত চার ভলিয়ুম জুড়ে এপিক আকারে। এ কীর্তি ইউরোপের অতীত ও বর্তমানের সঙ্গে জড়িত হলেও কালোত্তর ও মহাদেশোত্তর। প্রথম তিন ভাগ সুইটজারল্যাণ্ডের নির্বাসনে বসে লেখা। শেষ ভাগ আমেরিকায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে। তাঁর জীবনের এই কীর্তিই বোধ হয় পরম কীর্তি। এরপরে তিনি আর এর চেয়ে উচ্চে উঠতে পারেননি।

    তবে আমেরিকায় থাকতেই তিনি তাঁর স্বদেশ সম্বন্ধে নির্ভয়ে ও মুক্তকন্ঠে স্পষ্ট কথা বলে শেষ করেন। ডকটর ফাউসটাস রূপক আকারে জার্মানিরই উত্থান ও পতনের ইতিকথা। চিরকালের জার্মানির নয়, আধুনিক জার্মানির। ফাউস্ট যেমন তার উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্যে শয়তানের সঙ্গে চুক্তি করেছিল ও আপনার আত্মাকে হারিয়েছিল, আধুনিক জার্মানিও তেমনি। নায়ক একজন সংগীতকার। উদ্দেশ্যসাধনের জন্যে স্বেচ্ছায় তিনি সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন। মহাত্মা গান্ধীও তো আধুনিক সভ্যতাকে এক কালব্যাধির সঙ্গে তুলনা করেছেন। ইংল্যাণ্ড যার দ্বারা স্বেচ্ছায় আক্রান্ত হয়েছে। ভারতকেও সংক্রামিত করতে চেয়েছে।

    মান তাঁর বক্তব্য প্রতিপাদনের জন্যে বার বার মারাত্মক রোগের আশ্রয় নিয়েছেন। অথচ তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যের অধিকারী। আশি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। সে-বয়সেও তাঁর কী ঋজু বলিষ্ঠ সুঠাম শরীর! আর কী ফুর্তি! চোখে দেখিনি, ফিলমে দেখেছি। যেদিন আমরা পশ্চিমবঙ্গ পিইএন সংস্থার তরফ থেকে কলকাতার ম্যাক্সমুলার ভবনে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করি সেদিন। তাঁর বিধবা পত্নী কাতিয়া এখনও জীবিত। ফিলমে তাঁকে দেখা গেল। তিনি বলেন, তাঁরা কেউ বিশ্বাসই করতেন না যে হিটলার কখনো জার্মানির সর্বেসর্বা হবেন। আশ্চর্য! হিটলারও তো মিউনিখবাসী। মান তাহলে কতটুকু মানুষের সঙ্গে মিশতেন বা আশেপাশের খবর রাখতেন! মানস সরোবরেই তাঁর বিহার। সে-সরোবর সমতল থেকে অনেক উচ্চে।

    কিন্তু সমকাল থেকে কী পরিমাণ উচ্চে তা ঠাহর করা শক্ত। সে-জার্মানি আর নেই, সে-ইউরোপও কি আর আছে? আর ইউরোপের সেই বুর্জোয়া শ্রেণি তার পশ্চিমাংশে এখনও বিভবশালী হলেও সংঘবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণির বর্ধিত হারে মজুরির দাবি মেটাতে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল রাখতে অক্ষম। তিন শতাব্দীর একটি বনেদি বার্গার পরিবার কেন, শত শত বার্গার পরিবার এখন দেউলে হতে বসেছে। টোমাস মান তাঁর আটাশ বছর বয়সে লেখা টোনিও ক্রোএগার গল্পে তাঁর নিজের সমস্যাটা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন। পিতৃপুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে তিনি কোনোদিন আর্টিস্ট হতে পারতেন না। সেটা নিরেট বুর্জোয়ার ঐতিহ্য নয়। তাতে না আছে অর্থ, না আছে কৌলীন্য। কবি বা চিত্রকর বা সংগীতকার বলে লোকের কাছে পরিচয় দেওয়া লজ্জাকর। তাদের জীবন যেন জিপসির জীবন—ছন্নছাড়া ভবঘুরে উচ্ছৃঙ্খল। কোনো ভদ্রলোকের ছেলে কখনো সাধ করে আর্টের পেছনে ছোটে! সে হয় অধ্যাপক, আইনজীবী, ডাক্তার, সিভিল বা মিলিটারি অফিসার, ব্যাঙ্কার, ইঞ্জিনিয়ার, কোম্পানি পরিচালক বা পলিটিশিয়ান। লোকে এঁদের দেখলে টুপি তুলে অভিবাদন করে। এঁদের তুলনায় একজন ঔপন্যাসিক বা নাট্যকারের পোজিশনটা কী! সফল হলে হাতে দুটো টাকা আসে। নয়তো অদ্যভক্ষ্য অবস্থা। কেই-বা এঁদের বিয়ে করতে, এঁদের ঘরসংসার করতে, এঁদের সন্তানের জননী হতে ইচ্ছুক! নিজে চরিত্রহীন হয়ে একাধিক চরিত্রহীনার সঙ্গে রাত কাটানো কি কাউকে তৃপ্তি দিতে পারে?

    মাতৃকুল থেকে মান পেয়েছিলেন তাঁর শিল্পে ও সৌন্দর্যে সর্বগ্রাসী আগ্রহ, কিন্তু সে-আগ্রহ তাঁর পক্ষে সর্বনাশা হতে পারত, যদি-না তিনি তাঁর পিতৃকুলের পরিশ্রমী, সংযত, পিউরিটান, হিসাবি জীবনযাত্রার আদর্শে অবিচলিত থাকতেন। সমসাময়িক সাহিত্যিক গোষ্ঠীগুলির ওপর তিনি বীতশ্রদ্ধ হন। কিন্তু এর উলটো দিক হল জীবনবৈচিত্র্য থেকে স্বেচ্ছায় দূরে সরে থাকা। লেখার ভাগটা বেড়ে যায়। দেখার ভাগটা কমে যায়। ফাঁক ভরাতে হয় কল্পনা দিয়ে। কল্পনার দৌড় জীবনের দৌড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে কি? মানের সৃষ্টি দুরূহ থেকে দুরূহতর হয়ে ওঠে। জীবনটাও অপেক্ষাকৃত নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর। তাঁর ভিতরে যে বোহেমিয়ান ছিল, তাকে তিনি শক্ত হাতে দমন করেন। তবু সে অদম্য, তাই তাঁর রচনার একটা হালকা দিকও ছিল। ছোটো ছোটো নভেলে বা গল্পে তার প্রকাশ।

    কাইজারের জার্মানিতে রক্ষণশীল, ভাইমার রিপাবলিকে গণতন্ত্রী, অথচ সমাজতন্ত্রী নন, হিটলারি জমানায় আরও উদার, তিনি ছিলেন সামাজিক তথা রাজনৈতিক বিবর্তনে প্রগতিশীল। কিন্তু দেশ-বিদেশের ইন্টেলেকচুয়ালদের কাছে লোকে যে লিডারশিপ প্রত্যাশা করে স্বকালের একজন অগ্রগণ্য ইন্টেলেকচুয়াল হয়েও মান সেরকম কোনো নেতৃত্ব দিয়ে যাননি। যেমন দিয়েছিলেন টলস্টয় বা ইবসেন, বার্নার্ড শ বা রম্যাঁ রলাঁ। এই পর্যন্ত বলা যেতে পারে যে, তিনি কখনো কারও মুখ চেয়ে বা মন জুগিয়ে লেখেননি। লিখেছেন নিজের শর্তে। ধনাগম হোক আর না-ই হোক। নামযশ হোক আর না-ই হোক। যেটি লিখবেন সেটি নিখুঁত হবে, এই তাঁর সাধ আর সাধনা, এইখানেই তাঁর সিদ্ধি আর ঋদ্ধি। উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন মান। এমন এক বিক্ষুব্ধ দেশে আর কালে জন্মগ্রহণ ও জীবনধারণ করে দেশ থেকে দেশে বিতাড়নের মাঝখানে স্বকীয় লক্ষ্যে সর্বদা তন্ময় থাকাও কি একপ্রকার নেতৃত্ব নয়? কোথায় আমরা পাচ্ছি তাঁর দোসর? রম্যাঁ রলাঁও রাজনৈতিক কারণে দেশান্তরি হয়েছিলেন, কিন্তু বিদেশে বসে অখন্ড একাগ্রতার সঙ্গে ‘মন্ত্রমুগ্ধ আত্মা’ লিখতে পারেননি। সমসাময়িক ইউরোপের তথা বিশ্বের প্রত্যেকটি সমস্যা তাঁকে চিন্তান্বিত করেছিল। মান তাঁর তুলনায় স্বক্ষেত্রে অগ্রসর।

    তবে মানের কোনো সৃষ্টি তাঁর সমসাময়িক ফরাসি কথাশিল্পী মার্সেল প্রুস্তের বিগত কালের স্মৃতির মতো কালজয়ী হবে কি না সন্দেহ। এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের নাম করতে হলে প্রুস্তের সেই কীর্তিও উল্লেখ করতে হয়। যদিও তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। দেবার সম্ভাবনাও ছিল না। কারণ বই শেষ করতে-না-করতেই তাঁর জীবন শেষ হয়। সে-সময় কেউ চিনতেও পারেনি তাঁকে। বুঝতেও পারেনি কী তিনি করে গেলেন। আর একখানি কালজয়ী উপন্যাসেরও উল্লেখ করা উচিত। জেমস জয়েস রচিত ইউলিসিস। জয়েসও ছিলেন দেশান্তরি। সেটা কিন্তু রাজনৈতিক কারণে নয়। প্রুস্তেরও তেমন দুর্ভাগ্য হয়নি। তাঁর দুর্ভাগ্য তাঁর শ্বাসরোগ। শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি লিখতেন। সঙ্গিনীও ছিলেন না তাঁর। মান সেদিক থেকে ভাগ্যবান।

    সমালোচক হিসেবেও মানের খ্যাতি ছিল। টলস্টয়, গ্যেটে, শিলারের উপর তাঁর প্রবন্ধ প্রণিধানযোগ্য। এঁরাই ছিলেন তাঁর সাহিত্যগুরু। একলব্যের মতো মনে মনে তিনি এঁদের শিষ্য হতে, সমানধর্মা হতে, উত্তরসূরি হতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। পারলে হয়তো সমকক্ষ হতেন। কিন্তু সে কি সহজ কথা! তবে তাঁর স্বদেশের সমসাময়িক সাহিত্যাচার্যদের মধ্যে তিনিই শীর্ষস্থানীয়।

    যুবক টোনিওর অন্তর্দ্বন্দ্বের কাহিনি শুনে তার রুশ শিল্পী বান্ধবী লিজাবেথা বলেছিলেন, ‘তুমি একজন ভুল পথে চলা বুর্জোয়া। A bourgeois manque।’ কথাটা বোধ হয় মানের বেলাও খাটে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআগুন নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়
    Next Article আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

    Related Articles

    অন্নদাশঙ্কর রায়

    বাংলার রেনেসাঁস

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আগুন নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    কন্যা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }