Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পদ্মার পলিদ্বীপ – আবু ইসহাক

    লেখক এক পাতা গল্প377 Mins Read0
    ⤷

    ০১-০৪. পুর্বের আকাশ ফরসা

    পদ্মার পলিদ্বীপ – উপন্যাস – আবু ইসহাক
    উৎসর্গ – বড় ভাই মোহাম্মদ ইসমাইল-এর স্মৃতির উদ্দেশে

    পদ্মার পলিদ্বীপ সম্পর্কে দেশি-বিদেশী অভিমত

    …একখানা উচ্চাঙ্গের উপন্যাস। ইহার অনেক জায়গা একাধিকবার পড়িয়াছি। বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব ছাড়িয়াই দিলাম।…এত ব্যাপক, বিস্তৃত, জটিল অথচ সুসংহত এবং স্বচ্ছন্দ কাহিনী কমই পড়িয়াছি।…এই উপন্যাসে নানা কাহিনীর সুষম সমাবেশ হইয়াছে, পদ্মার বিধ্বংসী লীলার যথাযথ বর্ণনা আছে,…। এই বর্ণনা প্রত্যক্ষ, পুঙ্খানুপুঙ্খ অথচ সংযত, অশ্লীল কাহিনীতে কোথাও শ্লীলতার অভাব দেখা যায় না। জরিনা-ফজলের যৌনমিলনের যে চিত্র আঁকা হইয়াছে তাহার মধ্যে জরিনাই অগ্রণী। তাহার ধর্মবোধ তীক্ষ্ণ। সে জানে সামাজিক রীতি ও ধর্মীয় নীতির দিক দিয়া সে পাপিষ্ঠা, কিন্তু মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় বলা যাইতে পারে, পর্বত গৃহ ছাড়ি বাহিরায় যবে নদী সিন্দুর উদ্দেশে, কার সাধ্য রোধে তার গতি। ব্যভিচারের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ, অথচ সংযত বর্ণনা আর কোথাও পড়িয়াছি বলিয়া মনে হয় না।

    ইতিহাস মানুষের কাহিনী বলে, যে কাহিনী ঘটিয়া গিয়া স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। সাহিত্য জীবন্ত, তাহার প্রধান গুণ উধ্বমুখী অভীপ্সা এবং তাহার প্রাণ আইডিয়া। চরের প্রজারা জমিদার ও তাহার সাঙ্গোপাঙ্গোদের দ্বারা অপমানিত হয়। হেকমত সমস্ত জীবন মহাজনের ঋণ শোধ করিতেই চুরি করিয়া বেড়ায়। ফজল ছেলেমানুষ, কিন্তু জমিদারের নায়েব যে তাহার পিতাকে যথেষ্ট মর্যাদা দেয় নাই তাহার যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর সে দিয়াছে। রূপজান কিছুতেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে পীরসাহেবের বিবি হইতে চায় নাই। জরিনা ধর্মভীরু। কিন্তু যে শাস্ত্র তাহার হৃদয়ের অন্তরতম সত্যকে উপলব্ধি করে নাই তাহাকে সে মানে নাই আর আদর্শবাদী বিপ্লবী এই উপন্যাসকে নূতন আলোকে উদ্ভাসিত করিয়াছে।

    ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ইংরেজী বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
    ১৯ জুন, ১৯৯১ তারিখে আবু ইসহাককে লিখিত তাঁর পত্রের কিছু অংশ।
    সম্পূর্ণ পত্রটি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র-এর মাসিক মুখপত্র ‘বই’ নভেম্বর, ১৯৯১-এ প্রকাশিত।

    .

    …পদ্মার পলিদ্বীপ প্রতিভার সৃষ্টি। …এই উপন্যাসের জরিনার মত চরিত্র এক শরচ্চন্দ্র আঁকিতে পারিতেন। একাধিক বার পড়ার পরও আমি এই চরিত্রটির রহস্য অনুধাবন করার চেষ্টা করি। বারংবার প্রশ্ন জাগে–যদি হেকমত জীবিতাবস্থায় ফিরিয়া আসিত তাহা হইলে এই ধীর স্থির অবিচলিত রমণী কি উত্তর দিত।

    আবু ইসহাক-এর নিকট ২৮ জুলাই, ১৯৯১ তারিখে ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত-এর লিখিত পত্র থেকে উদ্ধৃতি।

    .

    তাঁর প্রথম উপন্যাসের মতো এটাও পল্লীজীবন ভিত্তিক, এখানেও জীবনবোধ তীক্ষ্ণ, বাস্তব জীবনের পরিবেশন অকৃত্রিম ও সত্যনিষ্ঠ। তবে সূর্য-দীঘল বাড়ী–র চাইতে বর্তমান উপন্যাসের পরিমণ্ডল বৃহত্তর, জীবন সগ্রামের চিত্র এখানে আরো দ্বন্দ্বমুখর ও তীব্র নাটকীয়তা তা অধিকতর উজ্জ্বল। এবং কাহিনীর পটভূমি-পরিবেশও ভিন্নতর।…উপন্যাসটিতে লেখক একই সঙ্গে গভীরতা ও বিস্তার এনে একে এপিকধর্মী করার প্রয়াস পেয়েছেন।

    দীর্ঘদিন পরে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশিত হলেও আবু ইসহাক ‘পদ্মার পলিদ্বীপ উপহার দিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর পূর্বখ্যাতিকে শুধু অমলিন রাখেননি, আমার বিবেচনায় তাকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন।

    অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : বেতার বাংলা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭.

    .

    আবু ইসহাকের এই উপন্যাসটিও সাহিত্য-রসাস্বাদক। প্রতিটি ব্যক্তির কাছে চ্যালেনজ রাখার সাহস রাখে। টানাপোড়েন সমাজ-জীবনের জলজ্যান্ত নিখুঁত ছবিতে উপন্যাসটি ভরিয়ে তোলায় লেখক আরেকবার প্রমাণ করলেন নিছক কাহিনী নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থা, জীবনসগ্রাম, প্রেম, যা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে ভাবায়, প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, কাদায়, সেগুলোই সাহিত্যের আসল মূলধন। এই মূলধনকে সাহিত্য করে তোলায় আবু ইসহাকের ক্ষমতা অপরিসীম। তাই এই রচনা সমাজের রসকষহীন প্রিনটেড ডকুমেন্ট হয়ে ওঠেনি।

    … একথা স্বীকার করতেই হয়, আবু ইসহাক পাঠককে টেনে রাখার জাদু জানেন। গ্রাম্য সেন্টিমেন্টের সঙ্গে ত্রিকোণ প্রেম, ত্রিকোণ প্রেমের সঙ্গে বাস্তব বোধ, বাস্তব বোধের সঙ্গে গ্রাম্য রাজনীতি সব মিলিয়ে একটি আদর্শ উপন্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    চতুরঙ্গ : কলকাতা : এপ্রিল, ১৯৮৭.

    .

    প্রাণবন্ত, যথাযথ আঞ্চলিক ভাষার বলিষ্ঠ ব্যবহার উপন্যাসকে খুবই আকর্ষণীয় করেছে; বলাবাহুল্য, পড়তে শুরু করলেই বই শেষ না করে থাকা সম্ভব নয়’–কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। একই কারণে বইয়ের প্রতিটি চরিত্রই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে।…জরিনার চরিত্রটি নায়ক ফজল ও নায়িকা রূপজানের চরিত্রের চাইতেও বেশি জীবন্ত মনে হয়েছে। যেন টলস্টয়ের বিখ্যাত নায়িকা আনা কারেনিনার গ্রাম-বাংলার চর অঞ্চলের অতি চেনা সংস্করণ।

    দীপঙ্কর : মাসিক সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা : বৈশাখ, ১৩৯৪.

    .

    কিন্তু এই মিলনান্ত নাটকীয়তার সঙ্গে মিশেছে একটা বলিষ্ঠ আধুনিক চেতনা। এটাও এ উপন্যাসের একটা বৈশিষ্ট্য বটে, এ কালের আধুনিকতার সেই মেরুদণ্ডহীন শিল্পাদর্শ থেকে যা ভিন্ন। বিবাহ, তালাক ইত্যাদিকে ঘিরে ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কার মনের অন্ধকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করে, এই গল্পের নায়ক সেটিকে পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিয়েছে।

    দৈনিক বাংলা : ঢাকা :১১ আষাঢ়, ১৩৯৪.

    .

    …’পদ্মার পলিদ্বীপ’ ব্যতিক্রমী চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, ভাষা বাকভঙ্গী নিয়ে এক অনবদ্য সৃষ্টি। সূর্য-দীঘল বাড়ীতে যে আবু ইসহাক অপরিমেয় অভিজ্ঞতায় সমতলের সাধারণ মানুষের জীবন-সগ্রামের নিবিড় কাহিনী তুলে ধরেছিলেন; পদ্মার পলিদ্বীপে তিনি হয়েছেন আরো বেশি জীবনঘনিষ্ঠ, চরের সংগ্রামী মানুষের ব্যথা বেদনায়, ক্রোধ-মমতায় আরো বেশি নিবিষ্ট। তাই ‘পদ্মার পলিদ্বীপে’ জীবন ধরা দিয়েছে কোন তন্ত্র কিংবা দর্শন নির্ভর করে নয়। এই উপন্যাসে চিত্রিত জীবন-সগ্রামে নদীনালা-নির্ভর বাংলাদেশের এক উপেক্ষিত অথচ বৃহত্তর পরিধির আকাশ-বাতাস, ঘাস-জমিন, মাছ-ফসল, প্রকৃতি আবহাওয়া যেন কথা কয়ে গেছে একান্ত নির্লিপ্তভাবে।….

    দৈনিক ইত্তেফাক : ঢাকা : ২৯ অক্টোবর, ১৯৮৭.

    .

    ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’-এ চিত্রিত হয়েছে পদ্মার চরাঞ্চলের জীবন, এই জীবনের সঙ্গে আবু ইসহাক ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত।…তিনি একটি জটিল জীবনের চিত্র এঁকেছেন, এই জটিলতা সূর্য-দীঘল বাড়ীতে নেই ।…আবু ইসহাক পল্লীজীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন। পদ্মার পলিদ্বীপে পল্লীজীবনের একটা বিশেষ দিক, চরাঞ্চলের সংঘাতময় জীবনের কথা নিয়ে লিখেছেন। এই বিশেষ দিকটির সঙ্গে তিনি উত্তমরূপে পরিচিত। বিশেষ আঞ্চলিক ভাষার জগৎকে তিনি জানেন এবং তার অনেক চিত্র দিয়েছেন।

    উত্তরাধিকার : বাংলা একাডেমীর সাহিত্য-পত্রিকা, অকটোবর-ডিসেম্বর, ১৯৮৭.

    .

    সবশেষে ঔপন্যাসিক যে ভাবেই শেষ করুন না কেন ফজল-জরিনার মানবিক সম্পর্ককে সত্যিকারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং সামাজিকতা, ধর্মীয় অন্ধতা, বিবেকের উত্তেজনা সবকিছুকে ছাপিয়ে কিভাবে দুটি কাক্ষিত হৃদয় পরস্পর কাছাকাছি নিবিড় আলিঙ্গনে যায় তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। পটভূমি গ্রাম কিন্তু বিশ্লেষণটা আধুনিক এখানেই আবু ইসহাকের শিল্পের সার্থকতা।

    দৈনিক বাংলা : ঢাকা : ৩ জুন, ১৯৯৪.

    .

    … Though the total context and plot of Ishaq’s second novel Padmar Palidwip is a different one, here the indomitable human spirit is also present as a theme as experienced in the first novel. The vast canvas encompassing the whole populace of the story’s locality, their thoughts and feelings, love and hatred, their invincible zeal and their defeat, gives the book and epic disposition.

    Weekend Magazine of the Independent:
    Dhaka, dated May 28, 1999.

    .

    ০১.

    পুর্বের আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে। টুকরো টুকরো মেঘের ওপর লাল হলুদের পোচ। দপদপ করে জ্বলছে শুকতারা। ঐদিকে তাকিয়ে ফজল বলে, ধলপহর দিছেরে নূরু, পোয়াত্যা তারা ওঠেছে। আরো জলদি করণ লাগব।

    দুজনেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সূর্য ওঠার আগেই কাঁকড়ামারির মুখে পৌঁছতে হবে তাদের। আলো দেখার সাথে সাথে মাছ তাদের রাতের আস্তানা ঢালু কিনারা ছেড়ে সরে যাবে গভীর পানিতে।

    নদীর ঢালে জাল দিয়ে মাছ ধরছে চাচা। দশ বছরের ভাইপো ডুলা নিয়ে ফিরছে তার পিছু পিছু। চাচা জাল ঝেড়ে মাছ ফেলে। ভাইপো কুড়িয়ে নিয়ে রাখে ডুলার ভেতর। চিংড়ি আর বেলে মাছই বেশির ভাগ।

    ফজল আবার জালটাকে গোছগাছ করে তার একাংশ কনুইর ওপর চড়ায়। বাকিটা দু’ভাগ করে দু’হাতের মুঠোয় তুলে নেয়। তারপর পানির দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝাঁকি মেলে ছুঁড়ে দেয় নদীর পানিতে। দূরে গিয়ে অনেকটা জায়গার ওপর ওটা ঝপ করে ছড়িয়ে পড়ে।

    ঝাঁকি জাল। কড়া পাক দেয়া সরু সুতোয় তৈরি। পানিতে ভিজে ভিজে সুতো পচে না যায় সেজন্য লাগানো হয়েছে গাবের কষ। কষ খেয়ে খেয়ে ওটা কালো মিশমিশে হয়েছে। জালের নিচের দিকে পুরোটা ঘের জুড়ে রয়েছে ‘ঘাইল’–মাছ ঘায়েল করার ফাঁদ। ঘাইলগুলোর সাথে লাগান হয়েছে লোহার কাঠি।

    এ লোহার কাঠির কাজ অনেক। কাঠির ভারে ভারী হয় বলেই জালটাকে দূরে ছুঁড়ে মারা সম্ভব হয়। আর ওটা তাড়াতাড়ি পানির তলায় গিয়ে মাটির ওপর চেপে বসতে পারে। জাল টেনে তুলবার সময় আবার কাঠির ভারের জন্য ফাঁদগুলো মাটির ওপর দিয়ে ঘষড়াতে ঘষড়াতে গুটিয়ে আসে। গুটিয়ে আসে চারদিক থেকে মুখ ব্যাদান করে। জালের তলায় আটকে পড়া মাছ পালাবার পথ পায় না।

    জালটা স্রোতের টানে কিছুটা ভাটিতে গিয়ে মাটির ওপর পড়েছে। ফজল তার কবজিতে বাঁধা রাশি ধরে ওটা আস্তে আস্তে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে টেনে তোলে। যেন কোনো জলরাক্ষসীর উপড়ে তোলা একমাথা চুল।

    জালের মধ্যে ছড়ছড় আওয়াজ। চকচকে সাদা মাছগুলো অন্ধকারেও চেনা যায়। কয়েকটা টাটকিনি। নূরু খুশি হয়ে ওঠে।

    ফজল মাছগুলো জাল থেকে ঝেড়ে ফেলে। নূরু চটপট হাত চালিয়ে ডুলায় তোলে শুনে শুনে, এক-দুই-তিন। বড় একটা টাটকিনি তার হাত থেকে পিছলে লাফ দিয়ে গিয়ে পানিতে পড়ে। ওটা ধরবার ব্যর্থ চেষ্টায় ওর কাপড় ভিজে যায়। কাদা মেখে যায় শরীরে।

    জাল ফেলতে ফেলতে তারা উজানের দিকে এগিয়ে যায়। রাত তিন প্রহরের সময় তারা। মাছ ধরতে এসেছে। ডুলাটা মাছে ভরে গিয়েছিল একবার। ফজল সেগুলো গামছায় বেঁধে নিয়েছে। ডুলাটা আবারও ভরভর হয়েছে। ওটা বয়ে নিতে নূরুর কষ্ট হচ্ছে খুব।

    পশু-পাখির ঘুম ভেঙেছে। জেগে উঠেছে কাজের মানুষেরা। গস্তি নৌকার হালে গুঁড়ি মারার শব্দ আসছে কেড়োত-কোড়োত। ঝপ্‌পত্‌ঝপ্‌ দাঁড় ফেলছে মাঝিরা। অনুকূল বাতাস পেয়ে নৌকায় পাল তুলে দিয়েছে কেউ বা রাত্রির জন্য কোনো নিরাপদ ঘোঁজায় তারা পাড়া গেড়ে ছিল। বিশ্রামের পর আবার শুরু হয়েছে যাত্রা। অন্ধকার মিলিয়ে যেতে না যেতে অনেক পানি ভাঙতে হবে তাদের।

    আলো আর আঁধারের বোঝাঁপড়া শেষ হয়ে এসেছে। আঁচল টেনে আঁধার ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে। চরের লটা আর কাশবন মাথা বের করেছে। স্পষ্ট হয়ে উঠছে ঘোলাটে পানি।

    আশ্বিন মাস। পদ্মা এখন বিগতযৌবনা। তার ভরা যৌবনের তেজ আর দুরন্তপনা থেমেছে। দুর্দম কাটালের কলকলানি আর নেই। পাড়ের দেয়ালে নিয়ন্ত্রিত তার গতি শ্রান্ত শিথিল স্রোত কুলুকুলু ধ্বনি তুলে বয়ে যাচ্ছে এখন।

    দুদু, অ দুদু!

    কি রে?

    শিগগির আহো। ঐখানে একটা বড় মাছে ডাফ দিছে।

    দুও বোকা! ডাফ দিয়া ও কি আর অইখানে আছে!

    ফজল তবুও জাল ফেলে। পায় দুটো বড় বেলে মাছ। বেশ মোটাসোটা। সে নিজেই এ দুটো ডুলায় তুলে দেয়। নূরুর ছোট হাতের মুঠোয় এ দুটোকে সামাল দেয়া সম্ভব নয়।

    ফজল চারদিকে চোখ বুলায়। তরতর করে উজিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। মাঝনদীতে চেরা চিচিঙ্গের মতো লম্বা জেলে নৌকা মৃদু ঢেউয়ের দোলায় দুলছে এদিক ওদিক। জগতবেড় জাল ফেলে রাতভর প্রহর গুনছিল জেলেরা। রাতের অন্ধকার মিলিয়ে যাওয়ার আগেই জাল টানতে শুরু করেছে তারা।

    পুব আকাশে সোনালি সূর্য উঁকি দিয়েছে। কালো রেখার মতো দিগন্তে গাছের সারির আভাস ফুটে উঠেছে।

    ফজল এগিয়ে গেছে কিছু দূর। চটপট পা চালিয়ে নূরু ধরে ফেলে চাচাকে। সে সামনের দিকে তাকায়। কাঁকড়ামারির মুখ এখনো দেখা যায় না। তাদের ডিঙিটা কাঁকড়ামারির খাড়িতে লটাখেতের আড়ালে বেঁধে রেখে এসেছে তারা। সামনের বাঁকটা পার হলেই সেই খাড়ির মুখ দেখা যাবে। নদীর এ সরু প্রশাখাঁটি উত্তর-পশ্চিম থেকে চরের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে নদীর দক্ষিণ শাখায় গিয়ে মিশেছে।

    ও-ও-ও-দুদু, দুদু…!

    কিরে কি…কি?

    ফজল জালের মাছ ঝেড়ে রেখে কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিল। নূরুর ভীত কণ্ঠের ডাক শুনে ছুটে আসে সে।

    মাছ কুড়াবার সময় নূরুর ডান হাতে একটা কাঁকড়া লেগেছে। দুই দাঁড়া দিয়ে চেঙ্গি দিয়েছে ওর বুড়ো আর কড়ে আঙুলে।

    ফজল দাঁড়া দুটো ছিঁড়ে ফেলে কাঁকড়াটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাড়ের দিকে। দাঁড়া দুটো খসে পড়ে আঙুল থেকে।

    ইস্, রক্ত ছুটছে রে! তুই নায় যা গিয়া নূরু। লটা চাবাইয়া ঘায়ে রস লাগাইয়া গো। আমি এডুক শেষ কইর‍্যা আইতে আছি।

    নূরু ডুলাটা রেখে রওনা হয়। ওর লুঙ্গি থেকে পানি ঝরছে। পানিতে ভিজে শিটে মেরে গেছে পা দুটো। ভোরের বাতাসে শীত-শীত করছে, খাড়া হয়ে উঠেছে শরীরের রোম। হাঁটতে হাঁটতে সে কাঁকড়ামারির মুখে চলে যায়। লটাখেতের ভেতর দিয়ে পানি ভেঙে নৌকায় গিয়ে ওঠে।

    দূরে স্টিমারের সিটি শোনা যায়। চাটগাঁ মেল বহর এসে ভিড়ল।

    নূরু একটা লটা ভেঙে দাঁতের তলায় ফেলে। চিবিয়ে রস দেয় ঘায়ে। রসটা মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। সে লটা চিবিয়ে চিবিয়ে রস চুষতে শুরু করে দেয়।

    জালের খেপ শেষ করেছে ফজল। দূর থেকে সে দেখতে পায়, নূরুলটা চিবোচ্ছে। তার হাসি পায়। সে ডেকে বলতে যাচ্ছিল, কিরে নূরু, গ্যাণ্ডারি পালি কই? কিন্তু বলতে পারে না সে। লটা চিবোতে দেখে হাসি পায় বটে, আবার একই সঙ্গে মায়াও লাগে। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে ওর। ভোর হয়েছে। ভোরের নাশতা চিড়ে-মুড়ি নিয়ে এতক্ষণে বসে গেছে সব বাড়ির ছেলে-মেয়েরা।

    ফজল নৌকার দিকে আসছে। শব্দ পেয়ে নূরু চট করে লটাটা ফেলে দেয় পানিতে। চাচা দেখে ফেলেনি তো!

    মুখ থেকে লটার রস নিয়ে সে ঘায়ে লাগাতে থাকে। চাচাকে বোঝাতে চায়, ঘায়ে রস লাগাবার জন্যই সে লটা চিবুচ্ছিল।

    ফজলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। হাসি গোপন করার জন্য সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, এই নূরু, আরো পাঁচটা ছাডা ইচা পাইছি রে! মুগুরের মতন মোট্টা এক-একটা।

    ফজল নৌকায় ওঠে। ডুলার আর গামছায় বাঁধা মাছগুলো সে ঢেলে দেয় নৌকার উওরায়।

    বেলে বা অন্য কোনো মাছ দেখে নয়, বড় বড় গলদা চিংড়ি দেখে খুশি হয় নূরু। সে একটা একটা করে গুনতে শুরু করে।

    গলদা চিংড়ি আঠারোটা, বেলে মাছ ছোট-বড় মিলিয়ে তিন কুড়ি চারটা আর কিছু টাটকিনি আর গুড়োগাড়া মাছ।

    নাও ছাইড়্যা দে নূরু। এইবার দাউন কয়ডা উড়াইয়া ফালাই

    দু’জনেই বৈঠা হাতে নেয়। নূরু পাছায়, ফজল গলুইয়ে। কিছুদূর উজিয়ে তারা দাউন বড়শি তুলতে শুরু করে। লম্বা ডোরের সাথে খাটো খাটো ডোরে পরপর বাঁধা অনেকগুলো বড়শি। টোপ গেঁথে তিন জায়গায় পাতা হয়েছে এ বড়শি।

    ফজল একটা একটা করে দাউন তিনটে তুলে নেয়। প্রথমটায় বেঁধেছে একটা শিলন। আর একটা ছোট পাঙাশ মাছ। দ্বিতীয়টা একদম খালি। তৃতীয়টায় বেঁধেছে বড় একটা পাঙাশ মাছ। তেলতেলে মাছটা চকচক করছে ভোরের রোদে।

    ফজল বলে, মাছটা খুব বুড়ারে। তেল অইছে খুব। এইডার পেডির মাছ যে গালে দিব, বুঝব মাছ কয় কারে! মাইনষে কি আর খামাখা কয়–পক্ষীর গুড়া আর মাছের বুড়া, খায় রাজা আঁটকুড়া।

    মাছ ধরা শেষ হয়েছে। এবার বেচবার পালা। নূরুকে বলতে হয় না। সে নৌকার মাথা ঘুরিয়ে দেয় নিকারির টেকের দিকে। ভাটির টানে ছুটছে নৌকা। নূরু হালটা চেপে ধরে বসে থাকে মাথিতে। ফজল তার হাতের বৈঠা রেখে মাছগুলো বাছতে শুরু করে। আকার অনুযায়ী সে হালি ঠিক করে রাখে। গোটা দশেক টাটকিনি আর ছ’টা গলদা চিংড়ি বাদে সবগুলোই বেচে দিতে হবে। বড় পাঙাশ মাছটা নিজেদের জন্য রাখবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা হলে বাকিগুলোয় আর কটা পয়সাই আসবে। সের চারেক ওজনের পাঙাশ মাছটায় কমসে কম বারো গণ্ডা পয়সা পাওয়া যাবে। ঘরে চাল নেই। তেল-নুন আরো অনেক কিছুই কিনতে হবে। শুধু মাছ খেয়ে তো আর পেট ভরবে না। মাছটার দামে কেনা যাবে দশসের চাল– সংসারের চারদিনের খোরাক।

    গত তিন বছর ধরেই টানাটানি চলছে সংসারে। ডিঙ্গাখোলা আর লক্ষ্মীচর ভেঙে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে এ দুর্দিন। এই দুই চরে অনেক জমি ছিল তাদের। বছরের খোরাক রেখে অন্তত পাঁচশ টাকার ধান বেচতে পারত তারা। প্রতি বছর পাট আর লটা ঘাসে আসত কম করে হলেও হাজার টাকা। পদ্মার অজগরস্রোত গিলে খেয়েছে, উদরে টেনে নিয়েছে সব জমি। গুণগার নমকান্দি থেকে শুরু হয়েছিল ভাঙা। তারপর বিদগাঁও কোনা কেটে, দিঘলির আধাটা গিলে, কাউনিয়াকান্দা, ডিঙ্গাখোলা, লক্ষ্মীচর আর মূলভাওরকে বুকে টেনে চররাজাবাড়ির পাশ কেটে উন্মাদিনী পদ্মা গা দোলাতে দোলাতে চলে গেছে পুব দিকে। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এঁকেবেঁকে চলেছে ডানে আর বাঁয়ে।

    চরের বসত আজ আছে, কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে চরের আয়ু। তার খুশিতে চর জাগে। তারই খেয়ালে ভেঙে যায় আবার। এ যেন পানি আর মাটির চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ, দশ, বিশ বছরের মেয়াদে বুকের ওপর ঠাই দেয় পানি। মেয়াদ ফুরালেই আবার ভেঙেচুরে নিজের জঠরে টেনে নেয়। চরবাসীরা তাই স্থায়ী হয়ে বসতে পারে না কোনো দিন। তাদের বাপ-দাদার ভিটে বলতে কিছু নেই। বাপ-দাদার কবরে চেরাগ জ্বালবার প্রয়োজন হয় না তাদের কোনো দিন। ফজলের বাবা এরফান মাতব্বর প্রায়ই একটা কথা বলে থাকে, চরের বাড়ি মাটির হাঁড়ি, আয়ু তার দিন চারি।

    এরফান মাতব্বরের বাড়ি ছিল লক্ষ্মীচরে। এগারো বছর কেটেছিল সেখানে। এ এগারো বছরের আয়ু নিয়েই জেগেছিল চরটা। মেয়াদের শেষে পদ্মা গ্রাস করেছে। এই নিয়ে কতবার যে লক্ষ্মীচর জেগেছে আর ভেঙেছে তার হিসেব রাখেনি এরফান মাতব্বর। সে ঘর-দোর ভেঙে, পরিবার-পরিজন, গরু-বাছুর নিয়ে ভাটিকান্দি গিয়ে ওঠে। দুটো করে টিনের চালা মাটির ওপর কোনাকুনি দাঁড় করিয়ে খুঁটিহীন কয়েকটা দোচালা তৈরি হয় মামাতো ভাইয়ের বাড়ির পাশে। মাতব্বরের সংসার এভাবে ‘পাতনা দিয়ে ছিল বছর খানেক। তারপর ঐ চরেই জায়গা কিনে বছর দুয়েক হলো সে আবার বাড়ি করেছে।

    ফজল আগে শখ করে মাছ ধরতে যেত। মাছ ধরাটা ছিল তখন নেশার মতো। এখন অনেকটা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ উপজীবিকার আশ্রয় না নিয়ে উপায় ছিল না। সংসারে খাবার লোক অনেক। সে তুলনায় এখন জমির পরিমাণ সামান্য। চরদিঘলিতে মাত্র কয়েক নল জমি আছে তাতে যে ধান হয় তাতে টেনেটুনে বছরের চারমাস চলে। বাকি আটমাসের পেটের দায় ছাড়াও খাজনা রয়েছে। চর থাকুক আর না থাকুক জমিদারের নায়েবরা খাজনার টাকা গুনবেই। নয়তো তাদের কোনো দাবিই থাকবে না যদি আবার কখনো চর জেগে ওঠে সে এলাকায়।

    ফজল লুকিয়ে-চুরিয়ে মাছ বেচে। গেরস্তের ছেলের পক্ষে মাছ-বেচা নিন্দার ব্যাপার। আত্মীয়-কুটুম্বরা জানতে পারলে ছি-ছি করবে। হাসাহাসি করবে গাঁয়ের লোক। দুষ্ট লোকের মুখে মুখে হয়তো একদিন মালো বা নিকারি খেতাব চালু হয়ে যাবে।

    দিনের পর দিন অভাব অনটনের ভেতর দিয়ে সংসার চলছিল। মাছ বেচার কথা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেনি ফজল। শখ করে একদিন সে লেদ বড়শি নিয়ে নদীতে গিয়েছিল। বড়শিতে উঠেছিল একটা মস্ত বড় আড় মাছ। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল নিকারি-নৌকা। মাছ দেখে ডাক দেয় মাছের ব্যাপারি, ও ভাই মাছটা বেচুবানি?

    ফজল কৌতুক বোধ করে। মজা করবার জন্য উত্তর দেয় সে, হ বেচুম। কত দিবা?

    তুমি কত চাও?

    এক টাকা।

    এক টা–কা! মাছখানের লগে নাওখান দিবা তো?

    উঁহু, বৈডাখান দিমু।

    বোঝলাম, বেচনের মত নাই তোমার। বেচতে চাও তো উচিত দাম কইয়্যা দ্যাও।

    তুমিই কও।

    আটআনা দিমু।

    আট আনা!

    পয়সার অঙ্কটা মধুর লাগে ফজলের কানে। লোভ হয় তার। পয়সার অভাবে তিনদিন ধরে একটা বিড়ির মুখ দেখেনি সে।

    সে এদিক ওদিক তাকায়। না, ধারে কাছে কেউ নেই। নিকারি-নৌকাটা ভাটিয়ে গিয়েছিল কিছুদূর। ফজল ডাক দেয়, ও ভাই, আইও লইয়া যাও।

    নিকারি নৌকায় মাছটা তুলে দিয়ে আট আনা গুনে নেয় ফজল। তার মাছ বেচার বউনি হয় এভাবে।

    সেদিন কয়েকটা ছোট ছোট শিলন, ট্যাংরা মাছও পেয়েছিল ফজল। সেগুলো নিয়ে যখন সে বাড়ি আসে তখন মা চেঁচিয়ে ওঠে, মাছ খাইলেই দিন যাইব আঁ? এতদিন বীজ-ধান ভাইন্যা খাওয়াইছি। দেহি আইজ খাওয়ন আহে কইতন।

    মাছগুলোকে ধপাত্ করে মাটিতে ফেলে ফজল ডিঙিতে উঠেছিল আবার ডিঙি ছুটিয়ে হাশাইলের বাজার থেকে মাছ-বেচা পয়সায় কিনে এনেছিল ছয় সের চাল।

    তারপর থেকে মাছ বেচা পয়সায় সংসারের আংশিক খরচ চলছে। ফজলের বাবা-মা প্রথম দিকে আপত্তির ঝড় তুলেছিল। অভাবের তাড়নায় সে ঝড় এখন শান্ত হয়ে গেছে।

    মাছের গোনা-বাছা শেষ করে ফজল। মাছের গায়ের লালায় তার হাত দুটো চটচট করে। হাত ধুয়ে সে গামছায় মোছে। তারপর গলুইয়ে গিয়ে মাথির চরাট সরিয়ে বের করে বিড়ি আর ম্যাচবাতি।

    অত কিনার চাপাইয়া ধরছস ক্যান্ নূরু? সামনে ফিরা আওড়। আরো মাঝ দিয়া যা।

    নুরুকে সাবধান করে দেয় ফজল। কিনার ঘেষে কিছুদুর গেলেই আবর্ত। সেখানে স্রোত বইছে উল্টোদিকে। ওখানে গিয়ে পড়লে নৌকা সামলানো সম্ভব হবে না ছোট ছেলেটির পক্ষে। এক ঝটকায় তাদের নৌকা বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাবে অনেক দূর।

    নূরু নৌকা সরিয়ে নিয়ে যায় কিনারা থেকে দূরে। মাঝের দিকে সোতের টান বেশি তরতর করে এগিয়ে যায় নৌকা।

    ফজল এবার বিড়ি ধরিয়ে মাথিতে চেপে বসে। সে বিড়িতে লম্বা টান দেয় আর মুখ ভরে ধোয়া ছাড়ে।

    দূরে নদীর মাঝে সাদা সাদা দেখা যায়, কি ওগুলো?

    ফজল চেয়ে থাকে। তার চোখে পলক পড়ে না। ঐখানেই বা ওর আশেপাশে কোথাও ছিল তাদের খুনের চর।

    নূরুকে সরিয়ে বৈঠা হাতে নেয় ফজল। জোর টানে সে নৌকা ছোটায় পুব-উত্তর কোণের দিকে।

    কিছুদূর গেলেই সাদা বস্তুগুলো স্পষ্ট দেখা যায়।

    কি আশ্চর্য! নদীর মাঝে হেঁটে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো বক।

    ফজল বৈঠা হাতে দাঁড়িয়ে যায়। কিছু দেখবার জন্য সে উত্তর দিকে তাকায়। হ্যাঁ ঐ তো, ঐ-তো বানরির জোড়া তালগাছ!

    উল্লসিত হয়ে ওঠে ফজল। বলে, চর জাগছেরে নূরু, চর জাগছে!

    কই, কই?

    ঐ দ্যাখ, ঐ যে ঐ।

    বকগুলো আঙুল দিয়ে দেখায় ফজল।

    আনন্দে লাফিয়ে ওঠে নূরু। সে দেখতে পায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে বকগুলো। মাছ ধরার জন্য গলা বাড়িয়ে আছে। লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মারছে মাঝে মাঝে।

    এইডা কি আমাগ চর, দুদু?

    হরে হ। আমাগ খুনের চর। ঐ দ্যাখ, ঐযে দ্যাখা যায় বানরির জোড়া তালগাছ। ছোডকালে আমরা যখন ঐ চরে যাইতাম তখন সোজা উত্তরমুখি চাইলে দ্যাখা যাইত আসুলির ঐ উঁচা তালগাছ দুইডা।

    ফজল বকগুলোর দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, নূরু, তুই বৈঠা আতেল। টান দে জোরে, বকগুলোরে দেখাইয়া দেই।

    ক্যান্ দুদু?

    এখনো কেও টের পায় নাই। বক দেখলেই মাইনষে টের পাইয়া যাইব, চর জাগছে।

    চাচা-ভাইপো বৈঠা টেনে এগিয়ে যায়। কিছুদূর গেলেই বৈঠা ঠেকে মাটির সাথে।

    আর আউগান যাইবনারে নূরু, চড়ায় ঠেইক্যা যাইব নাও। মাডিতে নাও কামড় দিয়া ধরলে মুশকিল আছে। তখন দুইজনের জোরে ঠেইল্যা নামান যাইব না।

    বৈঠাটানা বন্ধ করে দুজনেই। বকগুলো এখনো বেশ দূরে। ফজল পানির ওপর বৈঠার বাড়ি মারে ঠপাস-ঠপাস। কিন্তু বকগুলো একটুও নড়ে না। ওরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, এত দূরের শত্রুকে ভয় করবার কিছু নেই।

    ফজল আরো কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যায় নৌকা। কিন্তু কিভাবে তাড়াবে বক? মারবার মতো একটা কিছু পেলে কাজ হত।

    হঠাৎ ফজলের নজর পড়ে বেলে মাছগুলোর ওপর। সে ডওরা থেকে একটা বেলে মাছ নিয়ে জোরে বকগুলোর দিকে ছুঁড়ে মারে। বকগুলো এবার উড়াল দেয়। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই আবার নেমে পড়ে চরে।

    বকগুলোতো বড় বজ্জাতরে। এইখানে মাছ খাইয়া জুত পাইয়া গেছে। অত সহজে যাইব না।

    দুদু, পানিতো এটটুখানিক, আমি নাইম্যা গিয়ে দেখাইয়া দিয়া আহি?

    নারে, তুই পারবি না। কাফালের মইদ্যে পইড়া যাবি।

    ফুঁত্‌-ফুঁত্‌।

    স্টিমারের ফুঁ শুনে ফজল ও নূরু তাকায়। চাটগাঁ মেল আসছে। সামনে নৌকা পড়েছে। বোধ হয়। তাই ফুঁত্‌-ফুঁত্ শব্দ করল দু’বার।

    ফজল বলে, খাডো চুঙ্গার জাহাজ। শুয়োরের মতোন ‘গ’ দিয়া আইতে আছেরে! শিগগির টান দে নূরু। নাওডা সরাইয়া লইয়া যাই। চড়ার উপর ঢেউয়ে আছাড় মারব।

    নৌকা নিয়ে সরে যায় তারা। তাদের অনেক দূর দিয়ে নতুন চরেরও উত্তর পাশ দিয়ে স্টিমার চলে যায়। তার চলার পথের আন্দোলিত পানি ঢেউ হয়ে ছুটে আসছে। ফজল ঢেউ বরাবর লম্বিয়ে দেয় নৌকা, শক্ত হাতে হাল ধরে। নূরুকে বলে, তুই বৈডা থুইয়া দে নূরু। শক্ত কইর‍্যা পাডাতন ধইর‍্যা থাক। উজান জাহাজে ঢেউ উঠব খুব।

    ডলে-মুচড়ে উঁচু হয়ে ঢেউ আসছে। বিপদ বুঝে বকগুলো এবার উড়াল দেয়।

    দ্যাখ দ্যাখ নূরু। ঐ দ্যাখ, বকগুলো উড়াল দিছে।

    বকগুলোর অবস্থা দেখে নূরুর হাসি পায়। সে বলে, এইবার। এইবার যাও ক্যান্? ঢেউয়ের মইদ্যে ডুবাইয়া ডুবাইয়া মাছ খাও এইবার।

    বকগুলো ওপরে উঠে দু-একবার এলোমেলো চক্কর দেয়। নিচে ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখে নামবার আশা ছেড়ে দেয় ওরা। তারপর ঝাক বেঁধে পশ্চিম দিকে উড়ে চলে যায়।

    ঢেউয়ের বাড়িতে ওঠানামা করছে নৌকার দুই মাথি। এক মাথিতে ফজল, অন্য মাথির ঠিক নিচেই পাটাতন ধরে বসে আছে নূরু। ফজল বলে, নূরু, সী-সঅ, সী-সঅ, কিরে ডর লাগছে নি? সী-সঅ, সী-সঅ।

    ঢেউ থামলে নূরু বলে, সী-সঅ কি দুদু?

    সী-সঅ একটা খেইল। বাচ্চারা খেলে। নারাণপুর চৌধুরী বাড়ি খাজনা দিতে গেছিলাম। সেইখানে দেইখ্যা আইছি।

    একটু থেমে সে আবার বলে, আইজ আর নিকারির টেঁকে যাইমু নারে।

    ক্যান?

    ক্যান্ আবার! বাড়িতে খবর দিতে অইব না! মাছ বেচতে গেলে দেরি অইয়া যাইব অনেক। তুই বৈডা নে শিগগির। টান দে।

    দু’জনের বৈঠার টান, তার ওপর অনুকূল স্রোত। নৌকা ছুটছে তীরের মতো।

    ফজল নলতার খাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় নৌকা। নতুন চর দখলের এলোমেলা ভাবনায় আচ্ছন্ন তার মন।

    খাঁড়ির পুবপাড়ে ঢোনের মধ্যে বাঁধা একটা নৌকা। ওটার ওপর চোখ পড়তেই ফজলের চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যায়। নৌকাটা তার চেনা।

    নূরু সামনের দিকে চেয়ে বৈঠা টেনে যাচ্ছে। ফজল একবার দেখে নেয় তাকে। তারপর সে চরাটের ওপর নিঃশব্দে দাঁড়ায়, তাকায় পুবদিকে।

    কিছুদূরে কলাগাছে ঘেরা একটা বাড়ি। কলাগাছের ফাঁক দিয়ে বাড়ির উঠানের একাংশ দেখা যায়। আর দেখা যায় একখানা লাল শাড়ি হাওয়ায় দুলছে।

    ফজলের বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। সে বসে পড়ে। নূরুকে বলে, মোল্লাবাড়ি চিন্যা যাইতে পারবি নূরু?

    হ্যাঁ, নূরু ঘাড় কাত করে।

    কোনমুখি ক দেখি?

    নূরু দাঁড়ায়। পুবদিকে তাকিয়ে বলে, ও-ই তো দ্যাখা যায়।

    ঠিক আছে। কয়েকটা মাছ দিয়া আয় গিয়া। এতগুলো মাছ আমরা খাইয়া ছাড়াইতে পারমু না।

    ফজল পুবপাড়ে নৌকা ভিড়ায়। উওরায় রাখা মাছগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে সে জিজ্ঞেস করে, কোনডা দিমুরে নূরু? ইচা, না পাঙাশ?

    বড় পাঙাশটা দ্যাও।

    আইচ্ছা, পাঙাশ মাছটাই লইয়া যা। আর তোর নানাজানরে আমাগ বাড়ি জলদি কইর‍্যা আইতে কইস। জরুরি কাম আছে। আমার কথা কইলে কিন্তু আইব না। তোর দাদাজানের কথা কইস।

    আইচ্ছা।

    নূরু চরাটের নিচে দলা-মুচড়ি করে রাখা জামাটা পরে নেয়।

    ফজল একখণ্ড রশি মাছটার কানকোর ভেতর ঢোকায়। মুখ দিয়ে সেটা বের করে এনে দু’মাথায় গিঠ দিয়ে ঝুলনা বাঁধে।

    মাছটা হাতে ঝুলিয়ে পাড়ে নেমে যায় নূরু। ফজল নৌকা ছেড়ে দেয়। বৈঠায় টান দিতে দিতে সে ডেকে বলে, শোন্ নূরু, চর জাগছে–এই কথা কই না কারোরে, খবদ্দার! তোর নানার লগে আইয়া পড়িস। ইস্কুলে যাইতে অইব কিন্তু।

    আইচ্ছা।

    বড় মাছ। হাতে বুঝিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে নূরুর। সে হাতটা উঁচু করে নিয়েছে। তবুও মাছের লেজের দিকটা মাটির ওপর দিয়ে ঘষড়াতে ঘষড়াতে যাচ্ছে।

    .

    বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়ায় ফজল। শব্দ পেয়ে ছোট বোন আমিনা ছুটে আসে।

    নূরু কই, মিয়াভাই?

    ও মোল্লাবাড়ি গেছে। তুই মাছগুলোরে ডুলার মইদ্যে ভইরা লইয়া আয়।

    ফজল লাফ দিয়ে নৌকা থেকে নামে। থালা-বাসন নিয়ে বরুবিবি ঘাটের দিকে আসছিল। ফজল জিজ্ঞেস করে, বাজান কই, মা?

    ঘরে হুইয়া রইছে। শরীলডা ভালো না।

    ঘরের দরজায় পা দিয়ে ফজল ডাকে, বাজান।

    কিরে? শুয়ে শুয়ে সাড়া দেয় এরফান মাতব্বর।

    চর জাগছে।

    চর জাগছে!

    হ, আমাগ খুনের চর।

    খুনের চর!

    এরফান মাতব্বর বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। কার কাছে হুনলি?

    হুনি নাই। দেইখ্যা আইছি। এক ঝক বক বইছিল চরে।

    খুনের চর ক্যামনে বুঝলি?

    উত্তরমুখি চাইয়া দ্যাখলাম, বানরির জোড়া তালগাছ।

    এরফান মাতব্বর চৌকি থেকে নেমে বেরিয়ে আসে। কিছুদিন থেকেই ভালো যাচ্ছিল না তার শরীর। মাঝে মাঝে জ্বর হয়। আজও ভোর বেলায় শীত-শীত করছিল। কাঁপুনি শুরু হয়েছিল শরীরে। জ্বর আসার পূর্বলক্ষণ। তাই সে বিছানায় বসে বসে কোনো রকমে ফজলের নামাজ পড়েই আবার শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু এ মুহূর্তে খবর শুনে শীত আর কাঁপুনি কোথায় পালিয়ে গেছে! বার্ধক্যে নুয়ে পড়া শরীরটা সোজা হয়ে উঠেছে। পাকা জ্বর নিচে বড় বড় হয়ে উঠেছে ঘোলাটে চোখদুটো। মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে শিথিল হাত।

    ফজু, শিগগির মানুষজনরে খবর দে। দ্যাখ, জমিরদ্দি, লালুর বাপ, রুস্তম, আহাদালী, মেহের মুনশি কে কুনখানে আছে। মান্দ্রায় আর শিলপারনে কারুরে পাডাইয়া দে। কদম শিকারি, ধলাই সরদার, জাবেদ লশকর আর রমিজ মিরধারে খবর দে। নাশতা খাইছস?

    না, পরে খাইমু।

    আইচ্ছা, পরেই খাইস। তুই বাইর অইয়া পড়। ঢোলে বাড়ি দিসনা কিন্তু। চর জাগনের কথা কানে কানে কইয়া আহিস। দুফরের মইদ্যে বেবাক মানুষ আজির অওয়ন চাই। যার যার আতিয়ার যে লগে লইয়া আহে।

    ফজল রওনা হয়।

    ফজু, হোন। ভাওর ঘরের বাঁশ-খুঁড়া নাও ভইরা লইয়া আইতে কইস যার যার।

    একটু দম নিয়ে হাঁক দেয় মাতব্বর, নূরু…নুরু কইরে? তামুক ভইর‍্যা আন।

    নূরুরে মোল্লাবাড়ি পাডাইছি। মোল্লার পো-রে আইতে খবর কইয়া আইব। ফজল বলে।

    আইচ্ছা যা তুই, আর দেরি করিস না।

    মাতব্বর মনে মনে বলে, মোল্লা কি আর আইব? মাইয়া আটকাইছে। চোরামদ্দি এহন কোন মোখ লইয়া আইব আমার বাড়ি।

    ফজল চলে গেলে বিড়বিড় করে বলতে থাকে মাতব্বর, আইব না ক্যান্? আইব– আইব। চর জাগনের কথা হুনলে শোশাইয়া আইব, হুহ । না আইয়া যাইব কই? কলকাডি বেবাক এই বান্দার আতে। দেহি, এইবার আমার পুতের বউ ক্যামনে আটকাইয়া রাহে।

    মাতব্বর ঘরে যায়। আফার থেকে ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি নামিয়ে উঠানে নিয়ে আসে।

    থালা-বাসন মেজে ঘাট থেকে ফিরে আসে বরুবিবি। স্বামীকে হাতিয়ার নাড়াচাড়া করতে দেখে সে অবাক হয়। কিছুক্ষণ আগেই যে মানুষটিকে সে শুয়ে শুয়ে কাঁপতে দেখে গেছে, সে মানুষটিই কিনা এখন বাইরে বসে ঢাল-কাতরা-শড়কি নাড়াচাড়া করছে। সে বলে, এই দেইখ্যা গেলাম ওনারে বিছানে। কোনসুম আবার এগুলা লইয়া বইছে? ওনারে কি পাগলে পাইল নি?

    হ, পাগলেই পাইছে। তুমি হোন নাই, ফজু কয় নাই কিছু?

    কই, না তো!

    আরে, আমাগ চর জাগছে।

    চর জাগছে! কোন চর?

    খুনের চর!

    খুনের চর?

    বরুবিবির বুকের ভেতর কে যেন চেঁকির পাড় দিতে শুরু করেছে। তার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। কোনো রকমে রান্নাঘরে গিয়ে সে বসে পড়ে। তার মনের আবেগ, তার বুকের ঝড় বিলাপ হয়ে বেরোয়, ও আমার রশুরে, বাজান। কত বচ্ছর না যে পার অইয়া গে-ল, রশু-রে-আ-মা-র। তোরে না-যে ভোলতে না-যে পা-রি, মানিকরে-আ-মা-র।

    দশ বছরের পুরাতন শোক। সংসারের পলিমাটিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সে মাটি এখন কাঁপতে শুরু করেছে। মাতব্বরের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তার দুচোখের কোলে পানি জমে। ঝাঁপসা দৃষ্টি মেলে সে চেয়ে থাকে হাতিয়ারগুলোর দিকে।

    .

    ০২.

    খুনের চর।

    দশ বছর আগে একবার জেগেছিল এ চর। তখন নাম ছিল লটাবনিয়া। এ চরের দখল নিয়ে মারামারি হয়েছিল দুই দলে। দুই দলের দুই প্রধান ছিল এরফান মাতব্বর আর চেরাগ আলী সরদার। দুই দলের পাঁচজন খুন হয়েছিল। এরফান মাতব্বরের দলের দু’জন আর চেরাগ আলীর দলের তিনজন। এরপর থেকেই লোকের মুখে মুখে লটাবনিয়ার নাম হয়ে যায় খুনের চর।

    এরফান মাতব্বরের বড় ছেলে রশিদ চরের এ মারামারিতে খুন হয়েছিল।

    বাইশ বছরের জোয়ান রশিদ। গায়ে-পায়ে বেড়ে উঠেছিল খোদাই ষাড়ের মতো। মাত্র বিশজন লোক নিয়ে সে চেরাগ সরদারের শ’খানেক লোকের মোকাবেলা করেছিল।

    সেদিন ছিল হাটবার। চরের পাহারায় যারা ছিল তাদের অনেকেই সেদিন দিঘিরপাড় গিয়েছিল হাট-সওদা করতে। সত্তরটা ভাওর ঘরের অর্ধেকের বেশি ছিল সেদিন ঝাঁপবন্ধ। একটানা দুমাস ধরে পাহারা দিতে দিতে তাদের মধ্যে একটা অবহেলার ভাব এসে গিয়েছিল। তাদের কাছে ফুরিয়ে এসেছিল পাহারা দেয়ার প্রয়োজন। বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই ভেবে কেউ কেউ আবার ভাওর ঘরে বউ ছেলে-মেয়ে এনে ঘর-সংসারও পেতে বসেছিল। চেরাগ সরদার যে এমনি একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তারা।

    দুপুর তখন গড়িয়ে গেছে। ভাওর ঘরের ছায়ায় বসে ইলশা জাল বুনছিল রশিদ। আর পাশে বসে গল্প করছিল তার দোস্ত রফি। হঠাৎ তাদের নজর পড়ে নদীর দিকে।

    ষোলটা নৌকা বোঝাই লোক এ চরের দিকে আসছে।

    তারা দুজনেই লাফ দিয়ে দাঁড়ায়, রশিদ গলার সবটুকু জোর দিয়ে হাঁক দেয়, আইছে রে-এ-এ, আইছে, শিগগির বাইর-অ-আউগ গা…আউগ গা-আ-আ-আ…

    রফিও গলা ফাটিয়ে হাঁক দেয়, তোরা কইরে—? আউগ্ গা–শিগগির আউগগা।

    এদিকে-ওদিকে যারা ছিল তারা যার যার ভাওর ঘর থেকে বেরোয়। চারদিকে চিৎকার আর শোরগোল।

    রশিদ আর রফি গুলেল বাঁশ আর লুঙ্গির টোপর ভরে মাটির গুলি নিয়ে নদীর দিকে দৌড় দেয়। তাদের পেছনে আসে বাকি আর সবাই। কারো হাতে ঢাল-কাতরা, কারো হাতে শুধু শড়কি, কারো হাতে লম্বা লাঠি।

    রশিদ আর রফি গুলির পর গুলি মারে নৌকার লোকদের ওপর। কিন্তু তারা বেতের ঢাল দিয়ে ফিরিয়ে দেয় সে গুলি। দুই বন্ধু বুঝতে পারে, এভাবে ওদের ঠেকানো যাবে না। তারা দৌড়ে গিয়ে ভাওর ঘর থেকে নিজেদের ঢাল-শড়কি নিয়ে আসে।

    নৌকাগুলোর দশটা কিনারায় এসে ঠেকে। বাকি ছয়টা বড় নৌকা। ভাটা-পানিতে এগোতে না পেরে সেগুলো মাথা ঘোরায় পাশের চলপানির দিকে।

    আধ-হাঁটু পানিতে নামে চেরাগ সরদারের লোকজন। ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি নিয়ে তারা মার-মার করতে করতে এগিয়ে আসে।

    চরের কাইজ্যায় একদল চায় অন্য দলকে হটিয়ে তাড়িয়ে দিতে। বেকায়দায় না পড়লে খুন-খারাবির মধ্যে কেউ যেতে চায় না। খুন-জখম হলেই থানা-পুলিসের হাঙ্গামা আছে, মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলা আছে, জেল-হাজতের ভয় আছে।

    চেরাগ সরদারও তাই খুনাখুনি এড়াবার জন্য হাটের দিনটি বেছে নিয়েছিল। সে ভেবেছিল, তাদের এত লোকজন ও মারমার হামাহামি শুনে এরফান মাতব্বরের গুটিকয়েক লোক চর ছেড়ে ভেগে যাবে। তখন সহজেই দখল করা যাবে চর।

    কিন্তু অত সহজে চারটা দখল করা যায়নি।

    রশিদ তার লোকজন নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। চেরাগ সরদারের দল ডাঙায় উঠতে না উঠতেই শুরু হয়ে যায় মারামারি।

    দলের একজনকে খুন হতে দেখেই রশিদ খেপে যায়। মারমার ডাক দিয়ে এগিয়ে যায় সে। তার শড়কির ঘায়ে একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে তিরতিরে পানির মধ্যে।

    প্রথম দশটা নৌকা থেকে দলটি নেমেছিল, রশিদ ও তার দল তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায়। আরো একটা লাশ ফেলে তাদের অনেকেই পিছু হটে নৌকার দিকে। কিন্তু আরো ছ’খানা নৌকায় করে যারা এসেছিল তারা অন্য দিক দিয়ে নেমে এসে রশিদ ও তার লোকদের ঘিরে ফেলে। আর সকলের মতো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে রশিদও বাঁচতে পারত। সাঁতার দিয়ে নাগরারচরে গিয়ে উঠতে পারত। কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়ায়। আরো একজনের জান নিয়ে নিজের জান দেয় সে।

    তারপর থানা-পুলিস, তদন্ত-তল্লাশ, ধর-পাকড়, হাজত। আদালতে দুই দলের বিরুদ্ধেই মামলা ওঠে খুন আর হাঙ্গামার। এক মামলায় আসামি চেরাগ সরদার ও তার দলের বিশজন; অন্য মামলায় এরফান মাতব্বরের দলের তেরো জন।

    আসামিরা সবাই দিশেহারা। তারা বুঝতে পারে, ফাঁসির দড়ি না হোক, ঘানির জোয়াল ঝুলে আছে সবারই ঘাড়ের ওপর।

    এখন কি করা যায়?

    চেরাগ সরদার নিজেই এক মামলার আসামি। তাই প্রথমে সে-ই আপোসের প্রস্তাব পাঠায় এরফান মাতব্বরের কাছে।

    আপোসের কথা শুনেই রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে মাতব্বরের। তার জানের টুকরো ছেলেকে যারা খুন করেছে, তাদের সাথে আপোস!

    প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল এলাকার দফাদার সামেদ আলী। মাতব্বরের দলেরও জনকয়েক এসেছিল তার পিছু পিছু।

    ক্রোধে মাতব্বরের মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথা বেরোয় না। শেষে নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তেজিত স্বরে সে বলে, না, কিছুতেই না। ওর সাথে কোনো আপোস নাই। ওরে জেলের ভাত না খাওয়াইয়া ছাড়মু না–ছাড়মু না, কইয়া দিলাম। তুমি যাও, কও গিয়া তারে।

    মাতব্বরের দলের আহাদালী বলে, হে অইলে জেলের ভাত তো আমাগ কপালেও লেখা আছে, মাতব্বরের পো।

    তার কথায় সায় দিয়ে জমিরদ্দি বলে, মিটমাট কইর‍্যা ফালানডাই ভালো। কেবুল ওগই জেলের ভাত খাইয়াতে পারতাম তয় এক কথা আছিল। ওগ সাথ সাথ যে আমাগও জেলে যাইতে অইব।

    মাতব্বর এ কথা ভাবেনি তা নয়। কিন্তু আপোসের কথা ভাবলেই তার প্রতিশোধকামী মনে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। ক্রোধে ফুলে ওঠে সারা শরীর। তার কাছে আপোস মানেই পরাজয়, মৃত ছেলের স্মৃতির অবমাননা।

    শেষ পর্যন্ত দলের লোকজনের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না এরফান মাতব্বর। চেরাগ সরদার আর চরের দাবি করবে না, এই শর্তে আপোস করতে রাজি হয় সে। এ সিদ্ধান্ত নিতে দশ দিন লেগেছিল তার।

    কিন্তু আপোস করলেই তো আর চুকে গেল না সব। মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়? খুনের মামলা। এ তো ছেলেখেলা নয় যে, চায় মন খেলোম, না চায় মন চলোম।

    দফাদার সে বুদ্ধিও দেয়, তার লেইগ্যা চিন্তা নাই। আদালতে উল্ট-পাল্ডা, আবোল তাবোল সাক্ষী দিলেই মামলা ঢিশমিশ অইয়া যাইব। কোন সওয়ালের পিডে কি জওয়াব দিতে অইব তা উকিলরাই ঠিক কইর‍্যা দিব।

    শেষে সে রকম ব্যবস্থাই হয়েছিল। দুই বিবাদী পক্ষের দুই উকিল মিলে সাক্ষীদের ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে দেন। সরকার পক্ষের উকিলের প্রশ্নের জবাবে সাক্ষীরা সেই শেখানো বুলি ছেড়ে দেয়। একজনের জবানবন্দির সাথে আর একজনেরটার মিল হয় না। ঘটনা চোখে দেখেছে এমন সাক্ষীরাও বিনা দ্বিধায়, কোনো রকম লজ্জা-শরমের ধার না ধেরে বলে যায়, তারা নিজের চোখে দেখেনি, অমুকের কাছে শুনেছে। সাক্ষীদের কয়েকজনকে বিরুদ্ধাচারী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোনো ভাবেই সরকারবাদি মামলা টেকে না। যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে দুটো খুনের মামলার আসামিরাই খালাস পেয়ে যায়।

    খুনাখুনির পরই চারটাকে ক্রোক করে সাময়িকভাবে সরকারি দখলে রাখার হুকুম দিয়েছিল আদালত। ভবিষ্যতে যাতে আবার শান্তিভঙ্গ না হয় সে জন্যই থানার পুলিস এ ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করেছিল। পরে যে পক্ষ মামলায় জিতবে, সে-ই হবে চরের মালিক।

    আপোসের শর্ত অনুসারে চেরাগ সরদার আর চরের দাবি করেনি। তাই আদালতের রায়ে এরফান মাতব্বরই চরটা ফিরে পায় আবার।

    খবর পেয়ে আটিগাঁর পাঞ্জু বয়াতি বখশিশের লোভে এরফান মাতব্বরের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। দোতারা বাজিয়ে সে নিজের বাধা পুরাতন একটা গান জুড়ে দেয়–

    লাঠির জোরে মাটিরে ভাই
    লাঠির জোরে মাটি,
    লাঠালাঠি কাটাকাটি,
    আদালতে হাঁটাহাঁটি,
    এই না হলে চরের মাটি
    হয় কবে খাঁটি…রে।

    পাঞ্জু বয়াতির এ গান এখন চরবাসীদের কাছে আপ্ত বাক্যের মর্যাদা লাভ করেছে। তাদের মুখে মুখে ফেরে এ গান। তাদের অভিজ্ঞতার থেকেও তারা বুঝতে পেরেছে, নতুন চর জাগলে এসব ঘটনা ঘটবেই। লটাবনিয়ার বেলায়ও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। লাঠালাঠি হলো, কাটাকাটি হলো। আদালতে হাঁটাহাঁটিও হলো প্রায় দু’বছর। তারপর ফিরে এল শান্তি। খাঁটি হলো চরের মাটি।

    এরফান মাতব্বর তার বর্গাদার ও কোলশরিকদের মধ্যে চরের জমি ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়। চরের বুকে গড়ে ওঠে নতুন বসতি। শুরু হয় নতুন জীবন।

    কিন্তু এত কাণ্ডের পর খাঁটি হলো যে মাটি, তা আর মাত্র তিনটি বছর পার হতে না হতেই ফাঁকি হয়ে গেল। পদ্মার জঠরে বিলীন হয়ে গেল খুনের চর।

    সেই খুনের চর আবার জেগেছে।

    এরফান মাতব্বর গামছায় চোখ মোছে। বরুবিবির বিলাপ থেমেছে কিন্তু হায়-মাতম থামেনি। থেকে থেকে তার বক্ষপঞ্জর ভেদ করে হাহাকার উঠছে–আহ্ বাজান, আহ সোনা-মানিক!

    এরফান মাতব্বর উঠে দাঁড়ায়। রান্নাঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে নিজে নিজেই বলে, আর কাইন্দা কি করমু! কান্দলেই যদি পুত পাইতাম তয় চউখের পানি দিয়া দুইন্যাই ভাসাইয়া দিতাম।

    তারপর রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে সে বলে, অ্যাদে ফজুর মা, আর কাইন্দ না। আল্লার বেসাত আল্লায় লইয়া গেছে। কাইন্দা আর কি রকমু। ওডো এইবার। মানুষজন আইয়া পড়ল বুইল্যা। তুমি চাইলে-ডাইলে বড় ডেগটার এক ডেগ চড়াইয়া দ্যাও শিগগির।

    বরু বিবি কাঁদতে কাঁদতে বলে, কাইজ্যা করতে ওনরাই যে যায়। আমার ফজুরে চরের ধারেকাছেও যাইতে দিমু না।

    আইচ্ছা না দ্যাও, না দিবা। অখন যা কইলাম তার আয়োজন কর। আমি মাডি খুইদ্যা চুলা বানাইয়া দিতে আছি উডানে।

    বরুবিবির বুকের ঝড় থামতে অনেক সময় লাগে। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সে মসলা বাটে, চুলো ধরায়। তারপর চাল-ডাল ধুয়ে এনে খিচুড়ি বসিয়ে দেয় এক ডেগ। চুলোর মধ্যে শুকনো লটা খুঁজতে খুঁজতে তার কেবলই দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

    .

    ০৩.

    মান্দ্রা আর শিলপারনে ‘খবরিয়া’ পাঠিয়ে আশপাশের লোকজনকে খবর দিয়ে ফজল বাড়ি ফিরে আসে। এসেই সে নূরুর খোঁজ করে।

    তার মনটা চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে রয়েছে। নূরু ফিরে এলে শোনা যাবে মোল্লাবাড়ির খবরাখবর। ওকে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কথার জাল পাতলে রূপজানের কথাও কিছু বের করা যাবে।

    স্কুলের বেলা হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও তার ফেরবার নাম নেই। সে আন্দাজ করে, নূরু ঠিক রূপজানের পাল্লায় পড়েছে। আদর দিয়ে দিয়ে সে ছেলেটার মাথা খেয়ে ফেলবে।

    এজন্য রূপজানের ওপর কিন্তু রাগ হয় না ফজলের। বরং প্রসন্নই হয় তার মন। বাপ মার স্নেহ বঞ্চিত ছেলেটাকে সে নিজেও বড় কম আদর করে না। পড়াশুনার জন্য মাঝে মাঝে সে একটু তয়-তম্বি করে। ব্যস, ঐ পর্যন্তই। ওর দাদা-দাদির জন্য ওর গায়ে একটা ফুলের টোকা দেয়ার যো নেই।

    নূরুর বয়স যখন পাঁচমাস তখন তার বাবা রশিদ চরের কাইজ্যায় খুন হয়। কোলের শিশু নিয়ে বিধবা হাজেরা তিন বছর ছিল মাতব্বর বাড়ি। দু’মাস-তিন মাস পরে সে বাপের বাড়ি মুলতগঞ্জে বেড়াতে যেত। দশ-বারো দিন পার হতে না হতেই এরফান মাতব্বর নিজে গিয়ে তাকে নিয়ে আসত আবার। বলত, নাতিডা চউখের কাছে না থাকলে ভালো ঠেকে না।

    এমনি একবার বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল হাজেরা। তার বাবা শরাফত দেওয়ান। জোর করে আবার তার নিকে দিয়ে দেয়। মেয়ের কোনো রকম আপত্তিই সে শোনেনি। নূরুর কি হবে ভেবে সে অনেক কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ-মুখ। স্বামীর বাড়ি গিয়েও তার চোখের পানি শুকোয়নি। অবস্থা দেখে পরের দিনই তার স্বামী জালাল মিরধা দেওয়ানবাড়ি থেকে নূরুকে নিয়ে যায়। তাকে হাতুয়া পোলা হিসেবে রাখতে রাজি হয় সে।

    এ নিকেতে এরফান মাতব্বরকে দাওয়াত দেয়া দূরে থাক, একটু যোগ-জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি শরাফত দেওয়ান। সম্বন্ধের যোগাড়যন্ত্র সবই খুব গোপনে সেরেছিলো সে। তার ভয় ছিল, খবরটা কোনো রকমে মাতব্বরের কানে গেলে সে হয়তো গোলমাল বাঁধাবে।

    তিন দিন পর এরফান মাতব্বরের কাছে খবর পৌঁছে। শুনেই সে রাগে ফেটে পড়ে।

    অনেক আরজু নিয়ে দেশ-কুলের এ মেয়েকে ছেলের বউ করে ঘরে নিয়েছিল মাতব্বর। আসুলির ভাল মাইনষের সাথে একটা প্যাঁচ দেয়ার জন্য সে পানির মতো টাকা খরচ করেছিল। মেয়ের বাপকে রাজি করাবার জন্য তিনশ একটাকা শাচক দিতে হয়েছিল। মেয়েকে সোনা দিতে হয়েছিল পাঁচ ভরি।

    হাজেরার নিকে দিয়েছে, মাতব্বরের রাগ সেজন্য নয়। ছেলের মৃত্যুর পরই সে বুঝতে পেরেছিল, এ মেয়ের ওপর তার আর কোনো দাবি নেই। কাঁচা বয়সের এ মেয়েকে বেশি দিন ঘরে রাখা যাবে না, আর রাখা উচিতও নয়। তবু তিন-তিনটে বছর শ্বশুরবাড়ির মাটি কামড়ে পড়েছিল হাজেরা। দুধের শিশুকে সাড়ে তিন বছরেরটি করেছে। তার কাছে এর বেশি আর কি আশা করা যায়?

    কিন্তু রাগ হয়েছিল তার অন্য কারণে। শরাফত দেওয়ান তার মেয়ের নিকে দিয়েছে। দিক, তাকে যোগ-জিজ্ঞাসা করেনি, না করুক। কিন্তু তার নাতিকে তার হাতে সোপর্দ করে দিয়ে যায়নি কেন সে? সে কি মনে করেছে মাতব্বরকে?

    রাগের চোটে তার মনের স্থৈর্য লোপ পায়। বিড়বিড় করে সে বলে, আসুলির হুনা ভাল মানুষ। হালার লাশুর পাইলে দুইডা কানডলা দিয়া জিগাইতাম, কোন আক্কেলে ও আমার নাতিরে আউত্যা বানাইয়া মাইনষের বাড়ি পাড়াইছে।

    একবার সে ভাবে, যাবে নাকি লাঠিয়াল-লশকর নিয়ে মির বাড়ি? পয়লা মুখের কথা, কাজ না হলে লাঠির গুতা। তার বিশ্বাস, লাঠির গুতা না পড়লে নাতিকে বের করে আনা যাবে না। কিন্তু ফৌজদারির ভয়ে শেষ পর্যন্ত সে নিরস্ত হয়।

    ফজলের বয়স তখন সতেরো বছর। সে এক বাড়িতে জায়গীর থেকে নড়িয়া হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। মাতব্বর তাকে গোপনে খবর পাঠায়, ভুলিয়ে-ভালিয়ে, চুরি করে বা যেভাবেই হোক নূরুকে যেন সে বাড়ি নিয়ে আসে।

    মুলতগঞ্জ ও নড়িয়া পাশাপাশি গ্রাম। ফজল সুযোগ খুঁজতে থাকে। হাজেরা বাপের বাড়ি নাইয়র এলে সে একদিন দেওয়ানবাড়ি বেড়াতে যায়। নূরুকে জামা কিনে দেয়ার নাম করে মুলতগঞ্জের হাটে নিয়ে যায় সে। সেখান থেকে নৌকা করে দে পাড়ি! নূরুকে বুকের সাথে জাপটে ধরে সে বাড়ি গিয়ে হাজির হয়।

    সেদিন থেকেই সে দাদার আবদার, দাদির আহ্লাদ আর চাচার আদর পেয়ে বড় হয়ে উঠছে। বাপ-মার অভাব কোনোদিন বুঝতে পারেনি। সে এতখানি বড় হয়েছে, এখন পর্যন্ত দাদির আঁচল ধরে না শুলে তার ঘুম হয় না। দাদার পাতে না খেলে পেট ভরে না। আর চাচার সাথে হুড়োকুস্তি না করলে হজম হয় না পেটে ভাত।

    ফজল ঘরের ছাঁচতলা গিয়ে পুবদিকে তাকায়। না, নূরুর টিকিটিও দেখা যায় না।

    সে তামাক মাখতে বসে যায়। এত লোকের কল্কে সাজাতে অল্প-স্বল্প তামাকে হবে না। সে দেশী তামাকের মোড়া মুগুরের ওপর রেখে কুচিকুচি করে কাটে। তলক হওয়ার জন্য কিছু মতিহারি তামাক মিশিয়ে নেয় তার সাথে। শেষে মিঠাম করার জন্য রাব মিশিয়ে হাতের দাবনা দিয়ে ডলাই-মলাই করে।

    লোকজন মাতব্বর বাড়ি এসে জমায়েত হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। প্রত্যেকেই ভাওর ঘরের জন্য বাঁশ-খোটা, দড়াদড়ি যে যা পেরেছে নৌকা ভরে নিয়ে এসেছে। নিজ নিজ হাতিয়ারও নিয়ে এসেছে সবাই।

    ধারে-কাছের কিছু লোক আগেই এসেছিল। এরফান মাতব্বর তাদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। দুজন গেছে চুলার ধারে তাদের চাচিকে সাহায্য করতে। তিন-চারজন জং ধরা শড়কি আর কাতরা ঘষতে লেগে গেছে পাথরের ওপর। একজন বালিগচার ওপর কোপা। দা আর কাটারিতে ধার দিচ্ছে।

    কয়েকজন গেছে কাশ আর চুইন্যা ঘাস কাটতে। ভাওর ঘর তুলতে দরকার হবে এসব ঘাস-পাতার। এগুলোর গোড়ার দিকটা দিয়ে হবে বেড়া আর আগার দিকটা দিয়ে ছাউনি। খুঁটির বাঁশে টান পড়বে। তাই কয়েকজন চলে গেছে নদীর উত্তর পাড়। বানরি ও হাশাইল গ্রাম থেকে বাঁশ কিনে তারা সোজা গিয়ে চরে উঠবে।

    লোক এসেছে একশরও বেশি। এত লোকের জন্য থালা-বাসন যোগাড় করা সোজা কথা নয়। ফজল কলাপাতা কাটতে লেগে যায়। কঞ্চির মাথায় কাস্তে বেঁধে সে কলাগাছের আগা থেকে ডাউগ্গা কাটে। তারপর এক একটাকে খণ্ড করে চার-পাঁচটা।

    খেতের আল ধরে নূরু আসছে। ধানগাছের মাথার ওপর দিয়ে ওর মাথা দেখা যায়।

    ওকে দেখেই ফজলের পাতা কাটা বন্ধ হয়ে যায়। তার বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে।

    ইস, আবার টেরি কাটছে মিয়াসাব। নূরুর দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ফজল।

    কাছে এলে সে আবার লক্ষ্য করে, শুধু পরিপাটি করে চুলই আঁচড়ায়নি নূরু, তেলে চকচক করছে চুল। চোখে সুরমাও লাগিয়েছে আবার। গায়ের জামা আর লুঙ্গিটাও তত বেশ পরিষ্কার মনে হচ্ছে। তার বুঝতে বাকি থাকে না, এসব কাজে কার হাত লেগেছে।

    বাড়ির কাছে আসতেই ফজল ডাক দেয়, এই নূরু, এই দিগে আয়।

    কাছে এলে সে কপট রাগ দেখায়, কিরে তোরে না বারহায় বারহায় কইয়া দিছিলাম জদি কইর‍্যা আইয়া পড়িস। ইস্কুলে যাইতে অইব।

    চাচি আইতে দিল না যে।

    ফজলের অনুমান ঠিকই হয়েছে। সে আবার জিজ্ঞেস করে, আইতে দিল না ক্যান্?

    চাচি কয়, এদ্দিন পরে আইছস, না খাইয়া যাবি কই?

    ও তুমি প্যাট তাজা কইর‍্যা আইছ?

    না খাইয়া আইতে দিল না যে! আবার কইছিল, আইজ থাইক্যা কাইল যাইস।

    ইস্ আদরের আর সীমা নাই। কি খাওয়াইলরে?

    বেহানে গিয়া খাইছি কাউনের জাউ আর আন্তেশা পিডা। দুফরে পাঙাশ মাছ ভাজা, পাঙাশ মাছের সালুন, ডাইল। হেষে দুধ আর ক্যালা।

    ক্যালা কস ক্যারে? ইস্কুলে পড়স, কলা কইতে পারস না? মুচকি হেসে আবার বলে সে, কলা কইতে পারে না, জাদু আমার ট্যাড়া সিঁথি কাটছে, হুঁহ!

    নূরু লজ্জা পেয়ে হাতের এক ঝটকায় চুলগুলো এলোথেলো করে দিয়ে বলে, আমি বুঝি কাটছি, চাচি আঁচড়াইয়া দিছে।

    ফজল নূরুকে হাত ধরে পরম স্নেহে কাছে টেনে নেয়। আঙুলের মাথা দিয়ে বিস্রস্ত চুল দু’দিকে সরিয়ে সিঁথিটা ঠিক করতে করতে বলে, তোর চোখে সুরমা লাগাইয়া দিছে কে রে?

    চাচি।

    লুঙ্গি আর জামাডাও বুঝি তোর চাচি ধুইয়া দিছে?

    হ।

    তোর চাচি কিছু জিগায় নাই?

    হ জিগাইছে, তোর দাদা কেমুন আছে? তোর দাদি কেমুন আছে?

    আর কারো কথা জিগায় নাই?

    হ জিগাইছে, তোর চাচা কেমুন আছে?

    তুই কি কইছস? কইছি বেবাক ভালো আছে।

    আর কি কইছে?

    আর কইছে তোগ লাল গাইডা বিয়াইছে নি?

    আর …?

    নূরু তার পকেট থেকে একটা ছোট মোড়ক বের করে। কাগজের মোড়কটা ফজলের হাতে দিয়ে সে বলে, চাচি কইছে, এইডার মইদ্যে একখান তাবিজ আছে। পীরসাবের

    তাবিজ।

    হ তোমারে এইডা মাজায় বাইন্দা রাখতে কইছে।

    ক্যান?

    চাচি কইছে, বালা-মসিবত আইতে পারব না। আর অজু না কইর‍্যা এইডা খুলতে মানা করছে চাচি।

    ক্যান, খুললে কি অইব?

    খুললে বোলে চউখ কানা অইয়া যাইব।

    ফজল মনে মনে হাসে। রূপজানের চাল ধরে ফেলে সে। নূরু যাতে খুলে না দেখে, সে-জন্যই সে চোখ কানা হওয়ার ভয় দেখিয়েছে।

    ফজল মোড়কটা পকেটে পুরে বলে, আইচ্ছা যা তুই।

    নূরু কিছুদূর যেতেই ফজল ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিরে তোর নানাজান আইল না?

    হে বাড়িতে নাই, গরু কিনতে মুনশিরহাট গেছে।

    নূরু চোখের আড়াল হতেই ফজল কলাগাছের ঝাড়ের মধ্যে গিয়ে ঢোকে। পকেট থেকে বের করে মোড়কটা। সুতা দিয়ে ওটাকে আচ্ছামতো পেঁচিয়ে দিয়েছে রূপজান। সুতার প্যাঁচ খুলে সে মোড়কটার ভেতরে পায় একটা সাদা রুমাল আর ভাঁজ করা একটা কাগজ। রুমালটার এক কোণে এমব্রয়ডারি করা ফুল ও পাতা। তার নিচে সুচের ফোর দিয়ে লেখা, ভুলনা আমায়।

    ফজল রুমালটা গালের সাথে চেপে ধরে। তারপর ওটাকে পকেটে রেখে সে ভাঁজ করা কাগজটা খুলে পড়ে।

    প্রাণাধিক,
    হাজার হাজার বহুত বহুত সেলাম পর সমাচার এই যে আমার শত কোটি ভালবাসা নিও। অনেক দিন গুজারিয়া গেল তোমারে দেখি না। তোমারে একটু চউখের দেখা দেখনের লেইগ্যা পরানটা খালি ছটফট করে। তুমি এত নিষ্ঠুর। একবার আসিয়া আমার খবরও নিলা না। বাজান তোমার উপরে রাগ হয় নাই। সে রাগ হইছে মিয়াজির উপরে। সে আমার গয়না বেচিয়া খাইছে। সেই জন্যই বাজান রাগ হইছে। কিন্তু আমি গয়না চাই না। তুমিই আমার গয়না, তুমিই আমার গলার হার। তুমিই আমার পরানের পরান। যদি তোমার পরানের মধ্যে আমারে জায়গা দিয়া থাক তবে একবার আসিয়া চউখের দেখা দিয়া যাইও। তোমার লেইগ্যা পথের দিগে চাহিয়া থাকিব।

    নূরুর কাছে শোনলাম, খুনের চর জাগছে। তোমার আল্লার কিরা, চরের কাইজ্যায় যাইও না। ইতি।

    অভিগানী
    রূপজান

    ফজল কাগজটা উল্টে দেখে, সেখানে একটা পাখি আঁকা। তার নিচে লেখা রয়েছে, যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে।

    তারও নিচে লেখা আছে একটা পরিচিত গানের কয়েকটা লাইন–

    যদি আমার পাখারে থাকত,
    কে আমারে ধরিয়া রাখত,
    উইড়া যাইতাম পরান বন্ধুর দ্যাশেরে ॥

    ফজল চিঠিটা আবার প্রথম থেকে পড়তে শুরু করে।

    ফজু কই রে? অ ফজু…

    জ্বী আইতে আছি। পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে ফজল তাড়াতাড়ি চিঠিটা পকেটে পোরে। সে আরো কিছু কলাপাতা কেটে বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলছে এরফান মাতব্বর।

    খিচুড়ি রান্না শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।

    মাতব্বর বলে, এই হানে খাওনের হেঙ্গামা করলে দেরি অইয়া যাইব। এক কাম করো, খিচুড়ির ডেগটা নায় উড়াইয়া লও। নাও চলতে চলতে যার যার নায়ের মইদ্যে বইয়া খাইয়া লইও।

    রমিজ মিরধা বলে, হ এইডাই ভালো। খাইতে খাইতে যদি দিন কাবার অইয়া যায় তয় কোনো কাম অইব না।

    লোকজন খিচুড়ির ডেগটা ধরাধরি করে মাতব্বরের ছই-বিহীন ঘাসি নৌকায় তোলে। কলাপাতাগুলো লোক অনুসারে প্রত্যেক নৌকায় ভাগ করে দেয় ফজল। বাঁশ-খোঁটা, লাঠি শড়কি, ঢাল-কাতরা আগেই নৌকায় উঠে গেছে। এবার লোকজনও যার যার নৌকায় উঠে যায়।

    নূরু এসে ফজলকে ডাকে, ও দুদু, দাদি তোমারে বোলায়।

    ফজল উঠানে গিয়ে দেখে, তার বাবা আর মা ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে।

    মাতব্বর বলে, জুয়ান পোলা দশজনের লগে যাইব না, এইডা কেমুন কথা! মাইনষে হুনলে কইব কি? বাঘের ঘরে মেকুর পয়দা অইছে।

    কইলে কউক। আমার পোলা আমি যাইতে দিমু না।

    যাইতে দিবা না, তয় কি মুরগির মতন খাঁচায় বাইন্দা রাখতে চাও?

    মাইনষের কি আকাল পড়ছে নি? দুইডা না, তিনডা না, একটা পোলা আমার। ও না গেলে কি অইব?

    কি অইব, তুমি যোবা না। আমার দিন তো ফুরাইয়া আইল, আমি চউখ বুজলে ও-ই অইব মাতব্বর। আপদে-বিপদে মাইনষের আগে আগে চলতে না হিগলে মাতবরি-সরদারি করব কেমন কইর‍্যা?

    থাউক, আমার পোলার মাতবরি-হরদারি করণ লাগব না।

    ফজল এগিয়ে গিয়ে মা-কে বাধা দেয়, তুমি চুপ অওতো মা। কি শুরু করছ?

    তারপর সে তার পিতার দিকে চেয়ে বলে, বাজান, বেবাক জিনিস নায়ে উইট্যা গেছে। আপনে ওঠলেই এখন রওনা দিতে পারি।

    বরুবিবি এবার ফজলকে বলে, অ ফজু, বাজানরে তুই যাইস না।

    ক্যান যাইমু না?

    ক্যান্ যাইমু না, হায় হায়রে আবার উল্ডা জিগায় ক্যান্ যাইমু না। তয় যা-যা তোরা বাপে পুতে দুইজনে মিল্যা আমার কল্ডাডা কাইট্যা থুইয়া হেষে যা।

    মাতব্বর কাছে এসে ধীরভাবে বলে, ও ফজুর মা, হোন। আমরা তো কাইজ্যা করতে যাইতে আছি না। এইবার আর কাইজ্যা অইব না। চেরাগ আলী ঐ বচ্ছর যেই চুবানি খাইছে, এই বচ্ছর আর চরের ধারে কাছে আইতে সাহস করব না।

    তয় ফজুরে নেওনের কাম কি?

    ও না গেলে মানুষ-জনেরে খাওয়াইব কে? আর হোন, কাইজ্যা লাগলে ওরে কাইজ্যার কাছে যাইতে দিমু না। তুমি আর ভাবনা কইর‍্য না। চলরে ফজু, আর দেরি করণ যায় না।

    বাপের পেছনে পেছনে ছেলে রওনা হয়। নূরু বরুবিবির কাছেই দাঁড়ানো ছিল। তাম্‌শা দেখবার জন্য সে-ও নৌকাঘাটার দিকে রওনা হয়। বরুবিবি খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। তারপর তাকে কোলের মধ্যে নিয়ে সে বিলাপ করতে শুরু করে দেয়, ও আমার রশুরে, বাজান তোরে না যে ভোলতে না যে-পা-আ-আ-রি, সোনার চান ঘরে থুইয়া কেমনে চইল্যা গে-এ-এ-লি, বাজানরে-এ-এ-এ, আ-মা–র।

    এরফান মাতব্বর নৌকায় উঠেই তাড়া দেয়, আর দেরি কইর‍্য না। এইবার আল্লার নাম লইয়া রওনা দ্যাও।

    লোকজন যার যার নৌকা খুলে রওনা হয়। মেহের মুনশি হাঁক দেয়, আল্লা-রসুল বলো ভাইরে ম-মী-ঈ-ঈ-ন…

    আল্লা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুনশির কথার শেষ ধরে বাকি সবাই জাক্কইর দেয়।

    মাতব্বরের ঘাসি নৌকার আগে-পিছে তেইশখানা নৌকা চলছে। কোনোটায় চারজন, কোনোটায় বা পাঁচজন করে তোক। কিছুদূর গিয়েই ফজল খিচুড়ি পরিবেশন করতে লেগে যায়। সে ইরি হাতে ডেগের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। চলতে চলতে এক একটা ডিঙি এসে নৌকার সাথে ভিড়ে। ফজল লম্বা হাতলওয়ালা কাঠের ইযারি দিয়ে ডেগ থেকে খিচুড়ি তুলে কলাপাতার ওপর ঢেলে দেয়।

    এরফান মাতব্বর লোকজনদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে, যার যার প্যাট ভইরা খাইও মিয়ারা। রাইতে কিন্তু খাওয়ার যোগাড় করণ যাইব না।

    এরফান মাতব্বর সকলের ওপর দিয়ে গাছ-মাতব্বর। তার সাথে ঘাসি নৌকায় বসে আলাপ-আলোচনা করছে পুলকি-মাতব্বর রমিজ মিরধা, জাবেদ লশকর, মেহের মুনশি আর কদম শিকারি। পুলকি অর্থাৎ সদ্য উদ্গত গাছের শাখার মতোই তারা কচি মাতব্বর। তাদের চারপাশে বসেছে সাত-আটজন কোলশরিক।

    তারা পরামর্শ করে ঠিক করে, চরের উত্তর দিকটা পাহারা দেয়ার জন্য জাবেদ লশকর ও তার লোকজন ভাওর ঘর তুলবে। এভাবে দক্ষিণদিকে কদম শিকারি, পশ্চিমদিকে রমিজ মিরধা আর পুবদিকে মেহের মুনশি তাদের লোকজন নিয়ে পাহারা দেবে। যদি কেউ চর দখল করতে আসে তবে পুবদিক দিয়ে আসার সম্ভাবনাই বেশি। তাই এরফান মাতব্বর ও তার আত্মীয়-স্বজন পুবদিকটায় ভাওর ঘর তুলবার মনস্থ করে।

    সবগুলো ডিঙির লোকজন খাওয়া শেষ করেছে। এবার মাতব্বর ঘাসি নৌকার সবার সাথে খেতে বসে। খেতে খেতে সবাই তারিফ করে খিচুড়ির। রমিজ মিরধা বলে, চাচির আতের খিচুড়ি যে খাইছে, হে আর ভেলতে পারব না কোনোদিন।

    রান্নার প্রশংসা শুনে মাতব্বর খুশি হয়। কিন্তু সবার অজান্তে সে একটা দীর্ঘশ্বাসও ছাড়ে। আর মনে মনে ভাবে, এ তারিফ যার প্রাপ্য সে আর মাতব্বর বাড়ি নেই এখন।

    আসুলির ভাল মাইনষের ঘরের মেয়ে ক’টা বছরের জন্য এসে মাতব্বর বাড়ির রান্নার ধরনটাই বদলে দিয়ে গেছে। হাজেরা এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর বরুবিবি তার হাতেই রসুইঘরের ভার ছেড়ে দিয়েছিল। হাজেরা বাপের বাড়ি নাইয়র গেলে মুশকিল বেঁধে যেত। স্ত্রীর হাতের রান্না খেয়ে মাতব্বর মুখ বিকৃত করে বলত, নাগো, ভাল্ মাইনষের মাইয়ার রান্দা খাইতে খাইতে জিব্বাডাও ভাল মানুষ অইয়া গেছে। তোমাগ আতের ফ্যাজাগোজা আর ভাল লাগে না।

    নিরুপায় হয়ে বরুবিবিকে শেষে পুতের বউর কাছে রান্না শিখতে হয়েছিল।

    এরফান মাতব্বর তার লোকজন নিয়ে যখন নতুন চরে পৌঁছে, তখন রোদের তেজ কমে গেছে।

    মাতব্বর সবাইকে নির্দেশ দেয়, যার যার জাগায় ডিঙ্গা লইয়া চইল্যা যাও। আমরা ‘আল্লাহু আকবর’ কইলে তোমরা ঐলগে আওয়াজ দিও। এই রহম তিনবার আওয়াজ দেওনের পর ‘বিছমিল্লা’ বুইল্যা বাঁশগাড়ি করবা।

    একটু থেমে সে আবার বলে, তোমরা হুঁশিয়ার অইয়া থাইক্য। রাইতে পালা কইর‍্যা পাহারা দিও এক একজন।

    লোকজন নিজ নিজ নির্ধারিত স্থানে ডিঙি নিয়ে চলে যায়।

    আছরের নামাজ পড়ে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মাতব্বর। তারপর লোকজন নিয়ে নৌকা থেকে নামে। বাঁশের খোটা হাতে এক একজন হাঁটু পানি ভেঙে মাতব্বরের নির্দেশ মতো দূরে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।

    ফজলকে ডেকে মাতব্বর বলে, অ ফজু, এইবার আল্লাহু আকবর আওয়াজ দে।

    ফজল গলার সবটুকু জোর দিয়ে হাঁক দেয়, আল্লাহু আকবর।

    চরের চারদিক থেকে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আওয়াজ ওঠে, আল্লাহু আকবর।

    তিনবার তকবির ধ্বনির পর একসাথে অনেকগুলো বাঁশ গেড়ে বসে চরের চারদিকে। দখলের নিশান হয়ে সেগুলো দাঁড়িয়ে থাকে পলিমাটির বুকে।

    .

    ০৪.

    উত্তরে মূলভাওড়, দক্ষিণে হোগলাচর, পুবে মিত্রের চর আর পশ্চিমে ডাইনগাঁও–এই চৌহদ্দির মধ্যে ছোট বড় অনেকগুলো চর। চারদিকে জলবেষ্টিত পলিদ্বীপ। এগুলোর উত্তর আর দক্ষিণদিক দিয়ে দ্বীপবতী পদ্মার দুটি প্রধান স্রোত পুব দিকে বয়ে চলেছে। উত্তর দিকের স্রোত থেকে অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা বেরিয়ে চরগুলোকে ছোট বড় গোল দিঘল নানা আকারে কেটে-হেঁটে মিশেছে গিয়ে দক্ষিণদিকের স্রোতের সঙ্গে।

    চরগুলোর বয়স দুবছরও হয়নি। এগুলো জেগেছে আর জঙ্গুরুল্লার কপাল ফিরেছে। প্রায় সবগুলো চরই দখল করে নিয়েছে সে। আর এ চরের দৌলতে নানাদিক দিয়ে তার কাছে টাকা আসতে শুরু করেছে। কোলশরিকদের কাছ থেকে বাৎসরিক খাজনার টাকা আসে। বর্গা জমির ধান-বেচা টাকা আসে। আসে ঘাস-বেচা টাকা।

    কোলশরিক আর কৃষাণ-কামলারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, ট্যাহারা মানুষ চিনে। ওরা বোঝে, কোন মাইনষের ঘরে গেলে চিৎ অইয়া অনেকদিন জিরাইতে পারব।

    হ, ঠিক কথাই কইছ। আমরা তো আর ট্যাহা-পয়সারে এক মুহূর্তুক জিরানের ফরসত দেই না। আইতে না আইতেই খেদাইয়া দেই।

    টাকারা জঙ্গুরুল্লাকে চিনেছে মাত্র অল্প কয়েক বছর আগে। ভালো করে চিনেছে ধরতে গেলে চরগুলো দখলে আসার পর। আজকাল টাকা-পয়সা নাড়াচাড়া করার সময় বিগত জীবনের কথা প্রায়ই মনে পড়ে তার। জঙ্গুরুল্লার বয়স পয়তাল্লিশ পার হয়েছে। গত পাঁচটা বছর বাদ দিয়ে বাকি চল্লিশটা বছর কি দুঃখ কষ্টই না গেছে তার। জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়টাই কেটেছে অভাব-অনটনের মধ্যে। পেটের ভেতর জ্বলেছে খিদের আগুন। অথচ তার শরীরের ঘামও কখনো শুকোয়নি।

    সাত বছর বয়সের সময় তার মা মারা যায়। বাপ গরিবুল্লা আবার শাদি করে। জঙ্গুর সত্মা ছিল আর সব সত্মাদের মতোই। বাপও কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। অতটুকু বয়সেই সে বুঝতে পেরেছিল–গাঁয়ের লোক শুধু শুধুই বলে না, মা মরলে বাপ অয় তালুই।

    ঘোপচরে গরিবুল্লার সামান্য কিছু জমি ছিল। সেই জমি চাষ করে আর কামলা খেটে কোনো রকমে সে সংসার চালাত। জঙ্গুর বয়স দশ বছর হতে না হতেই সে তাকে হোগলাচরের এক চাষী গেরস্তের বাড়ি কাজে লাগিয়ে দেয়। সেখানে পাঁচ-ছবছর পেটে-ভাতে রাখালি করে সে। তারপর দুটাকা মাইনেয় ঐ চরেরই আর এক বড় গেরস্তের বাড়ি হাল চাষের কাজ জুটে যায়।

    বছর চারেক পরে তার বাপ মারা যায়। সত্য তার ছবছরের মেয়েকে নিয়ে নিকে বসে অন্য জায়গায়। জঙ্গু ঘোপচরে ফিরে আসে। গাঁয়ের দশজনের চেষ্টায় তার বিয়েটাও হয়ে যায়। অল্পদিনের মধ্যেই। গরিব চাষীর মেয়ে আসমানি। গোবরের খুঁটে দেয়া থেকে শুরু করে ধান ভানা, চাল ঝাড়া, মুড়ি ভাজা, ঘর লেপা, কাঁথা সেলাই, দুধ দোয়া ইত্যাদি যাবতীয় কাজে তার হাত চলে। আর অভাব-অনটনের সময় দু-এক বেলা উপোস দিতেও কাতর হয় না সে। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে গুছিয়ে নেয় সে গরিবের সংসার।

    জঙ্গুরুল্লা বাপের লাঙ্গল-গরু নিয়ে চাষ-বাস শুরু করে। মাঝে মাঝে কামলা খাটে অন্যের জমিতে। সারাদিন সে কি খাটুনি! পুরো পাঁচটা দিন কামলা খেটে পাওয়া যেত। একটিমাত্র টাকা। টাকাটা নিয়ে সে মুলতগঞ্জের হাটে যেত। দশ আনায় কিনত সাত সের চাল আর বাকি ছ’আনার ডাল-তেল-নুন-মরিচ ও আরো অনেক কিছু।

    এ সময়ের একটা ঘটনার কথা মনে পড়লেই তার কপাল কুঁচকে ওঠে। চোখদুটো ক্রুর দৃষ্টি মেলে তাকায় নিজের পা দুখানার দিকে। দুপাটি দাঁত চেপে ধরে নিচের ঠোঁট।

    ঘোপচরের মাতব্বর ছিল সোহরাব মোড়ল। তার ছেলের বিয়ের বরযাত্রী হয়ে জঙ্গুরুল্লা দক্ষিণপাড়ের কলুকাঠি গিয়েছিল। আসুলির ভা, মানুষ। মেহমানদের জন্য সাদা ধবধবে ফরাস বিছিয়েছিল বৈঠকখানায়। সেই ফরাসের ওপর জঙ্গুরুল্লা তার থেবড়া পায়ের কয়েক জোড়া ছাপ ফেলেছিল। তা দেখে চোখ টেপাটিপি করে হেসেছিল কনেপক্ষের লোকেরা। তাদের অবজ্ঞার হাসি বরপক্ষের লোকদের চোখ এড়ায়নি। রাগে সোহরাব মোড়লের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। কোনো রকমে সে সামলে নেয় নিজেকে।

    কিন্তু বাড়ি ফেরার পথেই সে পাকড়াও করে জঙ্গুরুল্লাকে জুতা খুলে মারতে যায়। আর সবাই না ঠেকালে হয়তো জুতার বাড়ি দু-একটা পড়ত জঙ্গুরুল্লার পিঠে।

    সোহরাব মোড়ল রাগে গজগজ করে, শয়তান, ওর কি এট্টু আক্কেল-পছন্দ নাই? ও আধোয় পায়ে ক্যামনে গিয়া ওঠল অমন ফরাসে। দেশ-কুলের তারা আমাগ কি খামাখা নিন্দে? খামাখা কয় চরুয়া ভূত?

    দুলার ফুফা হাতেম খালাসি বলে, এমুন গিধড় লইয়া ভর্দ লোকের বাড়িতে গেলে কইব কি ছাইড়া দিব? আমাগ উচিত আছিল বাছা বাছা মানুষ যাওনের।

    ঠিক কথাই কইছ, এইবারতন তাই করতে অইব।

    আইচ্ছা, ওর ঘাড়ের উপরে দুইটা চটকানা দিয়া জিগাও দেহি, ওর চরণ দুইখান পানিতে চুবাইলে কি ক্ষয় অইয়া যাইত?

    বরযাত্রীদের একজন বলে, কারবারডা অইছে কি, হোনেন মোড়লের পো। জুতাতে বাপ-বয়সে পায়ে দেয় নাই কোনো দিন। নতুন রফটের জুতা পায়ে দিয়া ফোস্কা পড়ছে। নায়েরতন নাইম্যা খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে কিছুদূর আইছিল। হেরপর খুইল্যা আতে লয়। বিয়াবাড়ির কাছে গিয়া ঘাসের মইদ্যে পাও দুইখান ঘইষ্যা রাত্বরি জুতার মইদ্যে ঢুকাইছিল।

    ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ! জাইতনাশা কুত্তা! ওর লেইগ্যা পানির কি আকাল পড়ছিল? কই গেল পা-না-ধোয়া শয়তানডা?

    একটা হাসির হল্লা বরযাত্রীদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সবাই খোঁজ করে জঙ্গুরুল্লার, কইরে পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা? কই? কই গেল পা-না-ধোয়া গিধড়?

    জঙ্গুরুল্লাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি সেখানে। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সে পেছন থেকে সরে পড়েছিল।

    কিন্তু সরে পড়লে কি হবে? দশজনের মুখে উচ্চারিত সেদিনকার সেই পা-না-ধোয়া বিশেষণটা তার নামের আগে এঁটে বসে গেছে। নামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিরাজ করছে সেদিন থেকে। নামের সঙ্গে এ বিশেষণটা যোগ না করলে তাকে চেনাই যায় না আর।

    পা-না-ধোয়া বললে প্রথম দিকে খেপে যেত জঙ্গুরুল্লা। মারমুখী হয়ে উঠত। কিন্তু তার ফল হতো উল্টো। সে যত বেশি চটত তত বেশি করে চটাত পাড়া-প্রতিবেশীরা। শেষে নিরুপায় হয়ে নিজের কর্মফল হিসেবেই এটাকে মেনে নিতে সে বাধ্য হয়।

    চার বছর পর ঘোপচর নদীতে ভেঙে যায়। জঙ্গুরুল্লা চণ্ডীপুর মামুর বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ কাজে সে কাজে সাতঘাটের পানি খেয়ে সে যখন জীবিকার আর কোনো পথ পায় না তখন ঘড়িশার কাছারির নায়েবের কথা মনে পড়ে তার।

    চণ্ডীপুর আসার মাস কয়েক পরের কথা। ঘড়িশার কাছারির নায়েব শশীভূষণ দাস স্টিমার ধরবার জন্য নৌকা করে সুরেশ্বর স্টেশনে গিয়েছিলেন। খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে তিনি প্রাতঃকৃত্যের জন্য নদীর পাড়ে কাশঝোঁপের আড়ালে গিয়ে বসেছিলেন। ঐ সময়ে জঙ্গুরুল্লা ঝকিজাল নিয়ে ওখানে মাছ ধরছিল। জালটা গোছগাছ করে সে কনুইর ওপর চড়িয়েছে এমন সময় শুনতে পায় চিৎকার। জালটা ঐ অবস্থায় নিয়েই সে পেছনে ফিরে দেখে একটা পাতিশিয়াল এ্যাকখ্যাক করে একটা লোককে কামড়াবার চেষ্টা করছে। লোকটা চিৎকার করছে, পিছু হটছে আর লোটা দিয়ে ওটাকে ঠেকাবার চেষ্টা করছে। জঙ্গুরুল্লা দৌড়ে গিয়ে জাল দিয়ে খেপ মারে পাতিশিয়ালের ওপর। পাতিশিয়াল জালে জড়িয়ে যায়। লোকটার হাত থেকে লোটা নিয়ে সে ওটার মাথার ওপর মারে দমাদম। ব্যস, ওতেই ওর জীবনলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়।

    ডাক-চিৎকার শুনে বহু লোক জমা হয়েছিল সেখানে। তাদের কাছে জানা যায়–আগের দিন ঐ এলাকার পাঁচ জনকে পাগলা শিয়ালে কামড়িয়েছে। সবাই বুঝতে পারে–ওটাই সেই পাগলা শিয়াল।

    জঙ্গুরুল্লার বুদ্ধি ও সাহসের প্রশংসা করে সকলেই। নায়েব তাকে দশ টাকা বখশিশ দিয়ে বলেন, যদি কখনো দরকার পড়ে, আমার ঘড়িশার কাছারিতে যেও।

    দুঃসময়ে নায়েবের কথা মনে পড়তেই সে চলে গিয়েছিল ঘড়িশার কাছারিতে। নায়েব তাকে পেয়াদার চাকরিতে বহাল করে নেন। মাসিক বেতন তিন টাকা। বেতন যাই হোক, এ চাকরির উপরিটাই আসল। আবার উপরির ওপরে আছে ক্ষমতা যাকে জঙ্গুরুল্লা বলে ‘পাওর’। এ কাজে ঢুকেই জঙ্গুরুল্লা প্রথম প্রভুত্বের স্বাদ পায়। সাড়ে তিন হাত বাঁশের লাঠি হাতে সে যখন মহালে যেত তখন তার দাপটে থরথরিয়ে কাপত প্রজারা। নায়েবের হুকুমে সে বকেয়া খাজনার জন্য প্রজাদের ডেকে নিয়ে যেত কাছারিতে। দরকার হলে ধরেও নিত। কখনো তাদের হাত-পা বেঁধে চিৎ করে রোদে শুইয়ে রাখত, কখনো কানমলা বাঁশডলা দিয়ে ছেড়ে দিত।

    একবার এক প্রজাকে ধরতে গিয়েছিল জঙ্গুরুল্লা। লোকটা অনেক কাকুতি-মিনতি করে শেষ সম্বল আট আনা এনে দেয় তার হাতে। কিন্তু কিছুতেই জঙ্গুরুল্লার মন গলে না। শেষে লোকটা তার পা জড়িয়ে ধরে।

    চমকে ওঠে জঙ্গুরুল্লা। অনেকক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে। শেষে বলে, যা তোরে ছাইড়া দিলাম। পাট বেইচ্যা খাজনার টাকা দিয়া আহিস কাছারিতে।

    তারপরেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। প্রত্যেকবারই মাপ করে দেয়ার সময় তার অন্তরে আকুল কামনা জেগেছে, সোহরাব মোড়লরে একবার পায়ে ধরাইতে পারতাম এই রহম!

    শুধু কামনা করেই ক্ষান্ত হয়নি জঙ্গুরুল্লা। সোহরাব মোড়লকে বাগে পাওয়ার চেষ্টাও অনেক করেছে সে। তার চেষ্টা হয়তো একদিন সফল হতো, পূর্ণ হতো অন্তরের অভিলাষ। কিন্তু পাঁচটা বছর–যার বছর দুয়েক গেছে ওত-ঘাত শিখতে–পার হতে না হতেই তার পেয়াদাগিরি চলে যায়। প্রজাদের ওপর তার জুলুমবাজির খবর জমিদারের কানে পৌঁছে। তিনি জঙ্গরুল্লাকে বরখাস্ত করার জন্য পরোয়ানা পাঠান নায়েবের কাছে। জমিদারের পরোয়ানা। না মেনে উপায় কি? নায়েব জঙ্গুরুল্লাকে বরখাস্ত করেন বটে, তবে কৃতজ্ঞতার প্রতিদান হিসেবে নতুনচর বালিগাঁয়ে তাকে কিছু জমি দেন।

    জঙ্গুরুল্লা বালিগাঁয়ে গিয়ে ঘর বাঁধে। লাঙ্গল-গরু কিনে আবার শুরু করে চাষ বাস। আগের মতো হাবা-গোবা সে নয় আর। একেবারে আলাদা মানুষ হয়ে ফিরে এসেছে সে। আগে ধমক খেলে যার মূৰ্ছা যাওয়ার উপক্রম হতো, সে এখন পানির ছিটে খেলে লগির গুঁতো দিতে পারে।

    জমিদারের কাছারিতে কাজ করে নানা দিক দিয়ে তার পরিবর্তন ঘটেছে। সে দশজনের সাথে চলতে ফিরতে কথাবার্তা বলতে শিখেছে। জমা-জমি সংক্রান্ত ফন্দি-ফিকির, প্যাঁচগোছও শিখেছে অনেক। তাছাড়া বেড়েছে তার কূটবুদ্ধি ও মনের জোর। যদিও প্রথম দিকে গায়ের বিচার-আচারে তাকে কেউ পুছত না, তবুও সে যেত এবং সুবিধে মতো দু-চার কথা বলতো। এভাবে গায়ের সাদাসিধে লোকদের ভেতর সে তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই সে গাঁয়ের অন্যতম মাতব্বর বলে গণ্য হয়।

    তারপর আসে ১৩৪৬ সাল–জঙ্গুরুল্লার ভাগ্যোদয়ের বছর। বর্ষার শেষে আশ্বিন মাসে মাঝ-নদীতে একটার পর একটা চর পিঠ ভাসাতে শুরু করে। পদ্মার প্রধান স্রোত দু’ভাগ হয়ে সরে যায় উত্তরে আর দক্ষিণে। জঙ্গুরুল্লা বালিগাঁয়ের লোকজন নিয়ে কয়েকটা চরই দখল করে নেয়। তারপর কুণ্ডু আর মিত্র জমিদারদের কাছারি থেকে বন্দোবস্ত এনে বসিয়ে দেয় কোলশরিক। তাদের কাছ থেকে মোটা হারে সেলামি নিয়ে সে তার অবস্থা ফিরিয়ে ফেলে।

    চরগুলো দখল করার পর জঙ্গুরুল্লা চরপাঙাশিয়ায় নতুন বাড়ি করে। উত্তর, পুব আর পশ্চিম ভিটিতে চৌচালা ঘর ওঠে। দক্ষিণ ভিটিতে ওঠে আটচালা কাছারি ঘর। নতুন ঢেউটিনের চালা আর পাতটিনের বেড়া নিয়ে ঘরগুলো দিনের রোদে চোখ ঝলসায়। রাত্রে চাঁদের আলোয় বা চলন্ত স্টিমারের সার্চলাইটের আলোয় ঝলমল করে।

    ঘরগুলো তুলতে অনেক টাকা খরচ হয়েছিল জঙ্গুরুল্লার। সে নিজের পরিবার-পরিজনের। কাছে প্রায়ই বলে, গাঙ অইল পাগলা রাকস। কখন কোন চরের উপরে থাবা মারে, কে কইতে পারে? এইডা যদি চর না অইত, তয় আল্লার নাম লইয়া দালানই উডাইতাম।

    যত বড় পয়সাওয়ালাই হোক, পদ্মার চরে দালান-কোঠা তৈরি করতে কেউ সাহস করে না। দালান মানেই পোড়া মাটির ঘর। মাটির ওপর যতক্ষণ খাড়া থাকে ততক্ষণই এ মাটির ঘরের দাম। ভেঙে ফেললে মাটির আর কী দাম? তাই চরের লোক টিনের ঘরই পছন্দ করে। চর-ভাঙা শুরু হলে টিনের চালা, টিনের বেড়া খুলে, খাম-খুঁটি তুলে নিয়ে অন্য চরে গিয়ে ঠাই নেয়া যায়।

    বিভিন্ন চরে জঙ্গুরুল্লার অনেক জমি আছে। কোলশরিকদের মধ্যে জমির বিলি-ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজের জন্য বাছাবাছা জমিগুলো রেখেছে সে। নিজে বা তার ছেলেরা আর হাল চাষ করে না এখন। বর্গাদার দিয়ে চাষ করিয়ে আধাভাগে অনেক ধান পাওয়া যায়। সে ধানে বছরের খোরাক হয়েও বাড়তি যা বাঁচে তা বিক্রি করে কম সে-কম হাজার দুয়েক টাকা ঘরে। আসে। নিজেরা হাল-চাষ না করলেও জমা-জমি দেখা-শোনা করা দরকার, বর্গাদারদের থেকে ভাগের ভাগ ঠিকমতো আদায় করা দরকার। এ চর থেকে দূরের চরগুলোর দেখাশোনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই সে কিছুদিন আগে কুমিরডাঙ্গা আর বগাদিয়ায় আরো দুখানা বাড়ি করেছে। কুমিরডাঙ্গায় গেছে প্রথমা স্ত্রী আসমানি বিবি তার সেজো ছেলে জহিরকে নিয়ে। ঘরজামাই গফুর আর মেয়ে খায়রুনও গেছে তাদের সাথে। বড় ছেলে জাফর বগাদিয়ায় গিয়ে সংসার পেতেছে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী শরিফন আর মেজো ছেলে ও ছেলে বউ রয়েছে বড় বাড়িতে। জঙ্গুরুল্লা বেশির ভাগ সময় ও বাড়িতেই থাকে। মাঝে মাঝে নিজের পানসি নিয়ে চলে যায় কুমিরডাঙ্গা, না হয় বগাদিয়া।

    টাকার জোর, মাটির জোর আর লাঠির জোর–এ তিনটার জোরে জোরোয়ার জঙ্গুরুল্লা। এখন সর্মানের জোর হলেই তার দিলের আরজু মেটে। সম্মানের নাগাল পেতে হলে বিদ্যার জোরও দরকার–সে বুঝতে পারে। বড় তিন ছেলেতো তারই মতো চোখ থাকতে অন্ধ। তারা ‘ক’ লিখতে কলম ভাঙে। তাই সে ছোট ছেলে দুটিকে স্কুলে পাঠিয়েছে। তারা হোস্টেলে থেকে মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুলে পড়ে।

    মান-সম্মান বাড়াবার জন্য জঙ্গুরুল্লা টাকা খরচ করতেও কম করছে না। গত বছর সে মৌলানা তানবীর হাসান ফুলপুরীকে বাড়িতে এনে মস্ত বড় এক জেয়াফতের আয়োজন করেছিল। সে জেয়াফতে গরুই জবাই হয়েছিল আঠারোটা। দাওয়াতি-বে-দাওয়াতি মিলে অন্তত তিন হাজার লোক হয়েছিল। সে জনসমাবেশে মৌলানা সাহেব তাকে চৌধুরী পদবিতে অভিষিক্ত করে যান। সেদিন থেকেই সে চৌধুরী হয়েছে। নতুন দলিলপত্রে এই নামই চালু হচ্ছে আজকাল। চরপাঙাশিয়ার নামও বদলে হয়েছে চৌধুরীর চর। কিন্তু এত কিছু করেও তার নামের আগের সে পা-না-ধোয়া খেতাবটা ঘুচল না। তার তাবে আছে যে সমস্ত কোলশরিক আর বর্গাদার, তারাই শুধু ভয়ে ভয়ে তার চৌধুরী পদবির স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তা-ও সামনা-সামনি কথা বলার সময়। তার অগোচরে আশপাশের লোকের মতো এখানে তারা পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লাই বলে।

    কিছুদিন আগে তার সেজো ছেলে জহিরের বিয়ের সম্বন্ধের জন্য সে ঘটক পাঠিয়েছিল উত্তরপাড়ের ভাটপাড়া গ্রামের কাজিবাড়ি। শামসের কাজি প্রস্তাব শুনে ‘ধত ধ্যত’ করে হকিয়ে দেন ঘটককে। বলেন, চদরি নাম ফুডাইলে কি অইব! সাত পুরুষেও ওর বংশের পায়ের ময়লা যাইব না।

    এ সবই জঙ্গুরুল্লার কানে যায়। রাগের চোটে সে দাঁতে দাঁত ঘষে। নিন্দিত পা দুটোকে মেঝের ওপর ঠুকতে থাকে বারবার। তার ইচ্ছে হয়, পা দুটো দিয়ে সে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু, পদানত করে চারদিকের সব মাটি আর মানুষ। এমনি করেই এক রকমের দিগ্বিজয়ের আকাক্ষা জন্ম নেয় তার মনে। তাই আজকাল আশেপাশে কোনো নতুন চর জাগলেই লাঠির জোরে সে তা দখল করে নেয়। জমির সত্যিকার মালিকেরা উপায়ান্তর না দেখে হাতজোড় করে এসে তার কাছে দাঁড়ায়। দয়া হলে কিছু জমি দিয়ে সে তাদের কোলশরিক করে রাখে।

    চরদিঘলির উত্তরে বড় একটা চর জেগেছে–খবর পায় জঙ্গুরুল্লা। চরটা তার এলাকা থেকে অনেক দূরে, আর কারা নাকি ওটা দখল করে বসেছে। এসব অসুবিধের কথা ভেবেও দমে না সে। নানা প্রতিকূল অবস্থার ভেতর পরপর অনেকগুলো চর দখল করে তার হিম্মত বেড়ে গেছে। তাই কোনো রকম অসুবিধাই সে আর অসুবিধা বলে মনে করে না। চর আর চরের দখলকারদের বিস্তারিত খবর আনবার জন্য সে তার মেজো ছেলে হরমুজকে দু’জন কোলশরিকের সাথে নতুন চরের দিকে পাঠিয়েছিল। তারা ফিরে এসে খবর দেয়–চরটার নাম খুনের চর, দখল করেছে এরফান মাতব্বর, ভাঙর ঘর উঠেছে ঊনষাটটা।

    সেদিনই জঙ্গুরুল্লা তার বিশ্বস্ত লোকজন ডাকে যুক্তি-পরামর্শের জন্য। তার কথার শুরুতেই শোনা যায় অনুযোগের সুর, কি মিয়ারা, এত বড় একটা চর জাগল, তার খবর আগে যোগাড় করতে পার নাই?

    কোলশরিক মজিদ খালাসি বলে, ঐ দিগেত আমাগ চলাচল নাই হুজুর।

    ক্যান্?

    আমরা হাট-বাজার করতে যাই দিঘিরপাড় আর হাশাইল। হাশাইলের পশ্চিমে আমায় যাওয়া পড়ে না।

    যাওয়া পড়ে না তো বোঝলাম। কিন্তুক এদিকে যে গিট্টু লাইগ্যা গেছে।

    গিট্টু! কিয়ের গিট্টু? দবির গোরাপি বলে।

    হোনলাম, এরফান মাতব্বর চরডা দখল কইরা ফালাইছে।

    হ, আগের বার আট-দশ বচ্ছর আগে যহন ঐ চর পয়স্তি অইছিল তহন এরফান মাতব্বরই ওইডা দখল করছিল।

    হ, তার বড় পোলা ঐ বারের কাইজ্যায় খুন অইছিল। মজিদ খালাসি বলে।

    প্রতিপক্ষ খুবই শক্তিশালী, সেটাই ভাবনার কথা। জঙ্গুরুল্লার কথা-বার্তায় কিন্তু ভাবনার বিশেষ কোনো আভাস পাওয়া যায় না।

    সে স্বাভাবিক ভাবেই বলে, খবরডা আগে পাইলে বিনা হ্যাঁঙ্গামে কাম ফতে অইয়া যাইত। যাক গিয়া, তার লেইগ্যা তোমরা চিন্তা কইর‍্য না। চর জাগনের কথাডা যখন কানে আইছে তখন একটা উল্লাগুল্লা না দিয়া ছাইড়্যা দিমু!

    কিন্তু হুজুর, রেকট-পরচায় ঐ চরতো এরফান মাতব্বরের নামে আছে। মজিদ খালাসি বলে।

    আরে রাইখ্যা দ্যাও তোমার রেকট-পরচা। চরের মালিকানা আবার রেকট-পরচা দিয়া সাব্যস্ত অয় কবে? এইখানে অইল, লাডি যার মাডি তার।

    তবুও কিছু একটা….।

    সবুর করো, তারও ব্যবস্থা করতে আছি। ঐ তৌজিমহলের এগারো পয়সার মালিক বিশুগায়ের জমিদার রায়চৌধুরীরা। আমি কাইলই বিশুগাঁও যাইমু। রায়চৌধুরীগ নায়েবরে কিছু টাকা দিলেই সে আমাগ বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ করব।

    নালিশ করব!

    হ, কয়েক বচ্ছরের বকেয়া খাজনার লেইগ্যা নালিশ করব। আমরাও তখন খাজনা দিয়া চেক নিমু। তারপর এরফান মাতব্বরও যেমুন রাইয়ত, আমরাও তেমুন।

    কি কইলেন হুজুর, বোঝতে পারলাম না। মজিদ খালাসি বলে।

    থাউক আর বেশি বুঝাবুঝির দরকার নাই। যদি জমিন পাইতে চাও, তবে যার যার দলের মানুষ ঠিক রাইখ্য। ডাক দিলেই যেন পাওয়া যায়। কারো কাছে কিন্তু ভাইঙ্গা কইও না, কোন চর দখল করতে যাইতে লাগব। এরফান মাতব্বরের দল খবর পাইলে কিন্তু হুঁশিয়ার অইয়া যাইব।

    কবে নাগাদ যাইতে চান হুজুর? দবির গোরাপি জিজ্ঞেস করে।

    তা এত ত্বরাত্বরির কি দরকার? আগে নালিশ অউক, খাজনার চেক-পত্র নেই, আর ওরাও ধান-পান লাগাইয়া ঠিকঠাক করুক। এমুন বন্দোবস্ত করতে আছি, দ্যাখবা মিয়ারা, তোমরা ঐ চরে গিয়া তৈয়ার ফসল ঘরে উডাইতে পারবা।

    লোকজন খুশি মনে যার যার বাড়ি চলে যায়।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএসো বিজ্ঞানের রাজ্যে – আবদুল্লাহ আল-মুতী
    Next Article নির্বাচিত গল্প সমগ্র – আবু ইসহাক

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }