Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পদ্মার পলিদ্বীপ – আবু ইসহাক

    লেখক এক পাতা গল্প377 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৫-০৮. আশ্বিন মাসের শেষ পক্ষ

    আশ্বিন মাসের শেষ পক্ষ। চরটার কোনো কোনো অংশ ভাটার সময় জেগে ওঠে। জোয়ারের সময় সবটাই ডুবে যায় আবার। এ পানির মধ্যে বাঁশের খুঁটি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ঝুপড়ি। টুঙ্গির মতো অস্থায়ী ঐ ঝুপড়িগুলোরই নাম ভাওর ঘর। মাতব্বরের জন্য উঠেছে তিনখানা ভাওর ঘর। চরের চারপাশ ঘিরে ভাওর ঘরগুলো পাহারা দিচ্ছে, চোখ রাখছে চারদিকে।

    জোয়ারের সময় ঝুপড়ির মধ্যে এক বিঘত, আধা বিঘত পানি হয়। পানির সমতলের হাতখানেক ওপরে বাঁশের মাচান বেঁধে নেয়া হয়েছে। যারা মাচান বাঁধতে পারেনি, তারা অন্য চর থেকে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে এসেছে লটাঘাস। পানির মধ্যে সে ঘাসের স্থূপ সাজিয়ে উঁচু করে নিয়েছে। এরই ওপর হয়েছে শোয়া-থাকার ব্যবস্থা। শরীরের ভারে পিষ্ট হয়ে ঘাস যখন দেবে যায় তখন পানি উঁকি দেয়। তাই কয়েকদিন পর পরেই আরো ঘাস বিছিয়ে উঁচু করে নিতে হয়।

    প্রথম কয়েকদিন এরফান মাতব্বরের বাড়ি থেকে সবার জন্য খিচুড়ি এসেছিল। এক গেরস্তের পক্ষে এত লোকের খাবার যোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই শরিকরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিয়েছে। যাদের বাড়ি ধারেকাছে, তাদের খাবার আসে বাড়ি থেকে। বাকি সবাই ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে ভাওর ঘরেই রান্নার ব্যবস্থা করেছে। আলগা চুলোয় একবেলা বেঁধে তারা দুবেলা খায়। নিতান্ত সাদাসিধে খাওয়া। কোনো দিন জাউ আর পোড়া মরিচ, কোনো দিন ভাত আর জালে বা বড়শিতে ধরা মাছভাজা। আর বেশির ভাগ সময়েই ডালে-চালে খিচুড়ি।

    চরের বাগ-বাটোয়ারা এখনো হয়নি। হবে পুরোটা চর জেগে উঠলে। কারণ তখনই জানা যাবে কোন দিকের জমি সরেস আর কোন দিকেরটা নিরেস। তবে এর মধ্যেই এরফান মাতব্বর চরটার মোটামুটি মাপ নিয়ে রেখেছে। পুব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য দুহাজার ষাট হাত। আর উত্তর-দক্ষিণে প্রস্ত আটশ চল্লিশ হাত। উত্তর-পূর্ব কোণের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে একটা ঘোঁজা। সেখানে আঁঠাই পানি। মাতব্বর মনে মনে ঠিক করে রেখেছে–কিভাবে ভাগ করা হবে জমি। চরটাকে মাঝ বরাবর লম্বালম্বি দুভাগ করতে হবে। তারপর টুকরো করতে হবে আটহাতি নল দিয়ে মেপে। এভাবে উত্তর অংশে ঘোঁজা বাদ দিয়ে দুই শত পয়তাল্লিশ আর দক্ষিণ অংশে দুই শ সাতান্ন–মোট পাঁচ শ দুই নল জমি পাওয়া যাবে। এক নল প্রস্থ এক ফালি জমির দৈর্ঘ্য চরের মাঝখান থেকে নদীর পানি পর্যন্ত চার শ বিশ হাতের কাছাকাছি। মোট শরিকের সংখ্যা ছাপ্পান্ন। প্রত্যেককে আট নল করে দিয়ে বেঁচে যাবে চুয়ান্ন নল। নিজের জন্য তিরিশ নল রেখে বাকিটা ভাগ করে দিতে হবে পুলকি-মাতব্বরদের মধ্যে।

    ভাগ-বাটোয়ারা না হলেও কোলশরিকরা যার যার ভাওর ঘরের লপ্তে সুবিধামতো বোরো ধানের রোয়া লাগাতে শুরু করেছে।

    .

    চর দখল হয়েছে। এবার খাজনা-পাতি দিয়ে পরিষ্কার হওয়া দরকার। দুবছরের খাজনা বাকি, নদী-শিকস্তি জমির খাজনা কম। কিন্তু জমিদার-কাছারির নায়েব ওসবের ধার ধারে না। সে পুরো খাজনাই আদায় করে। কখনো দয়া হলে মাপ করে দেয় কিছু টাকা। কিন্তু চেক কাটে সব সময় শিকস্তি জমির। বাড়তি টাকাটা যায় নায়েবের পকেটে। এজন্য মাতব্বর কিছু মনেও করে না। সে ভাবে–নায়েব খুশি থাকুক। সে খুশি থাকলে কোনো ঝড়-ঝাঁপটা আসতে পারবে না।

    এখন জমি পয়স্তি হয়েছে। চেক কাটাতে হবে পয়স্তি জমির। তাই এক পয়সাও মাপ পাওয়া যাবে না। তাছাড়া নায়েবকে খুশি করার জন্য সেলামিও দিতে হবে মোটা টাকা।

    এরফান মাতব্বর তার পুলকি-মাতব্বরদের ডেকে আলোচনায় বসে। বৈঠকে ঠিক হয়–এখন নলপিছু দশটাকা করে খাজনা বাবদ আদায় করা হবে কোলশরিকদের কাছ থেকে। পরে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেলে নলপ্রতি তিরিশ টাকা সেলামি দিতে হবে এরফান মাতব্বরকে। জমির আসল মালিক সে-ই।

    প্রায় সকলের কাছ থেকে টাকা আদায় হয়। বারো জন টাকা দিতে পারে না। তারা এত গরিব যে একবেলা দুমুঠো ভাত জোটানো মুশকিল হয় তাদের।

    মাতব্বর কয়েকদিন তাগাদা দিয়ে বিরক্ত হয়ে যায়। শেষে একদিন তাদের ডেকে সাফ কথা বলে দেয়, যদি জমি খাইতে চাও, টাকা যোগাড় করো। আরো দুইদিন সময় দিলাম।

    দিলে আমি অন্য মানুষ বোলাইয়া জমি দিয়া দিমু। জমির লেইগ্যা কত মানুষ ফ্যা-ফ্যা কইর‍্যা আমার পিছে পিছে ঘোরতে আছে।

    নিরুপায় হয়ে আহাদালী, জমিরদ্দি ও আরো কয়েকজন ফজলকে গিয়ে ধরে।

    জমিরুদ্দি বলে, কোনো রহমেই আমরা ট্যাহা যোগাড় করতে পারলাম না। কেউ কর্জও দিতে চায় না। আপনে যদি মাতব্বরের পো-রে কইয়্যা দ্যান।

    উঁহু, আমার কথা শোনব না বাজান। জানো তো, কত বছর ধইর‍্যা খাজনা চালাইতে আছি আমরা?

    আহাদালী বলে, তিন মাসের সময় চাই, খালি তিন মাস। তিন মাস পরেই বা দিবা কইতন? তা যোগাড় কইরা দিমু, যেইভাবে পারি। ধান লাগাইছি, দেহি—

    ধানতো প্যাটেই দিতে অইব। ওতে কি আর টাকা আইব?

    আইব। প্যাডেরে না দিয়া বেইচ্যা ট্যাহা যোগাড় করমু।

    ফজলের চোখে-মুখে অবিশ্বাসের হাসি! সে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। কি যেন চিন্তা করে।

    টাকাপয়সার টানাটানি চলছে এরফান মাতব্বরের সংসারেও। এ চরে আসার পরই ফজল পয়সা আমদানির একটা সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেছে। এতদিন কথাটা সে কাউকে বলেনি আজ এদের দুর্দশা দেখে সে আর থাকতে পারে না। বলে, একটা কাজ যদি করতে পারো তবে টাকার যোগাড় অয়। পারবা করতে?

    পারমু না ক্যান, পারমু। কি কাম? জমিরুদ্দি বলে।

    জোয়ারের সময় চরের উপরে মাছ কেমন ডাফলা-ডাফলি করে, দ্যাখছ?

    হ দেখছি। একজন কোলশরিক বলে।

    যদি বানা বানাইতে পার তবে এই মাছ বেড় দিয়া ধরা যায়।

    বেড়ওয়ালা মালোগ মতন? আহাদালী জিজ্ঞেস করে।

    হ।

    মাছ ধইর‍্যা হেষে–?

    শেষে আবার কি?

    ফজল এমন করে হাসে যার অর্থ বুঝতে কষ্ট হয় না কারো।

    জমিরদ্দি বলে, ও, আপনে মাছ বেচনের কথা কইতে আছেন!

    তাতে দোষ কি?

    দোষ না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তোবা তোবা তোবা! মাইনষে হোনলে কইব কি?

    কি কইব?

    জাউল্যা কইব। ছাই দিব মোখে।

    কোলশরিকদের একজন বলে, মাছ বেচলে পোলা-মাইয়ার বিয়া দেওয়ন কষ্ট আছে।

    আরে ধ্যাত! হালাল রুজি খাইবা, চুরি-ডাকাতি তো করবা না।

    কিন্তু জাইত গেলে যে আর জাইত পাওয়া যাইব না।

    প্যাটে ভাত জোটে না, তার আবার জাত। যাও জাত ধুইয়া পানি খাও গিয়া। আমার কাছে আইছ ক্যান্? আমি তোমায় জন্যই কইলাম। নইলে আমার ঠ্যাকাডা পড়ছে কি? ফজল রেগে ওঠে।

    আহাদালী বলে, রাগ করেন ক্যান? মাইনষে তো আর দ্যাখব না প্যাডে ভাত আছে, নাই। তাগ টিটকারির চোডে—

    যে টিটকারি দিব তার গলায় গামছা লাগাইয়া কইও, চাউল দে খাইয়া বাঁচি। টাকা দে জমিদারের খাজনা দেই।

    একটু থেমে আবার বলে ফজল, কামলা খাইলে যদি জাত না যায়, ধান-পাট বেচলে যদি জাত না যায়, তবে মাছ বেচলে জাত যাইব ক্যান, অ্যাঁ?

    জমিরদ্দি বলে, আপনেত কইতে আছেন। আপনে পারবেন মাছ বেচতে?

    ফজল মনে মনে হাসে। মুখে বলে, হ পারুম। তোমরা মনে করছ, তোমাগ কুয়ার মধ্যে নামাইয়া দিয়া, আমি উপরে বইস্যা আতে তালি দিমু। উঁহু, আমিও আছি তোমাগ লগে।

    জমিরদ্দি : আপনেও আছেন!

    আহাদালী : অ্যাঁ, আপনেও থাকবেন আমাগ লগে!

    ফজল : হ-হ-হ, আমিও থাকমু।

    আহাদালী : মাতবরের পো জানে এই কথা?

    ফজল : এখনো জানে না। তারে জানান লাগব।

    আহাদালী : উনি কি রাজি অইব?

    ফজল : তারে রাজি করানের ভার আমার উপর।

    জমিরদ্দি : উনি যদি রাজি অয়, আর আপনে যদি আমাগ লগে থাকেন, তয় আর ডরাই কারে! কি কও তোমরা?

    সকলে : হ, তাইলে আর ডর কি?

    ফজল : আমি এখনি বাড়ি যাইতেছি। জমিরদ্দি আর আহাদালী চলো আমার সাথে।

    .

    এরফান মাতব্বর বিষম ভাবনায় পড়ে যায়। আর সবার মতো তারও সেই একই ভয়। ফজল মাছ বিক্রি করে লুকিয়ে-চুরিয়ে। কাজটা একা করে বলে কেউ জানবার সুযোগ পায় না। কিন্তু যেখানে দশজন নিয়ে কারবার, সেখানে ব্যাপারটা গোপন রাখা কোনো রকমেই সম্ভব নয়।

    মাতব্বর বলে, নারে, পরের দিনই মুলুকের মানুষ জাইন্যা ফালাইব।

    জানুক, তাতে কী আসে যায়। ফজল বলে।

    কী আসে যায়! তখন মাইনষেরে মোখ দেখান যাইব? মাতব্বরের কণ্ঠে রাগ ও বিরক্তি।

    একজন তো না যে মুখ দ্যাখাইতে শরম লাগব। বইতে পড়ছি–দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। যখন এতজনে একসাথে কাজটা করতে চাই তখন আর লজ্জা-শরম কিসের? এত মাইনষের বদনাম করতে মুখ বেদনা অইয়া যাইব না মাইনষের!

    অনেক ভেবে-চিন্তে মাতব্বর শেষে নিমরাজি হয়। ফজল আশ্বাস দেয়–রোজ ভোর রাত্রে মাছ নিয়ে তারা চলে যাবে তারপাশা। সেখানে কেউ তাদের চিনবে না। কেউ জানতে পারবে না মাছ বেচার কথা।

    .

    দশজন যোগ দিয়েছে ফজলের সাথে। দুজন কেটে পড়েছে। তারা বলে দিয়েছে–না খেয়ে শুকিয়ে মরবে তবু তারা ইজ্জতনাশা কাজ করতে পারবে না।

    নৌকা নিয়ে পরের দিনই ফজল হাটে যায়। সাথে যায় দলের কয়েকজন। তারা মাকলা আর তল্লা বাঁশ কেনে গোটা চল্লিশেক। আর কেনে সাত সের নারকেলের কাতা।

    কাতা আর বাশগুলো ভাগ করে নেয় সবাই। প্রত্যেককে চারহাত খাড়াই আর পাঁচহাত লম্বাই ছ’খানা করে বানা তৈরি করতে হবে।

    মাত্র দুদিন সময় দিয়েছিল ফজল। কিন্তু কাজ অনেক। বাঁশগুলোকে খণ্ড করা, খণ্ডগুলোকে ফেড়ে চটা বের করা, চটাগুলো চেঁচেছুলে এক মাথা চোকা করা, শেষে একটার পর একটা কাতা দিয়ে বোনা। এত ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার তৈরি হয় বানা আর তার জন্য লেগে যায় পুরো চারটে দিন।

    বানা তৈরি করতেই যা ঝঞ্ঝাট। ও দিয়ে মাছ ধরা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। ভরা জোয়ারের পর ভাটার টান লাগার কিছুক্ষণ আগে বানা পুঁতে বেড় দিতে হয়। ধনুকের আকারে সে বানা ঘিরে থাকে অনেক জায়গা। ভাটার সময় পানি নেমে যায় আর মাছ আটকা পড়ে বেড়ের ভেতর। আড়, বোয়াল, বেলে, বাটা, ট্যাংরা, টাটকিনি, পাবদা, চিংড়ি ইত্যাদি ছোট-বড় নানা রকমের মাছ। রাত্রের বেড়ে দু-চারটে রুই-কাতলা-মৃগেল-বাউসও পাওয়া যায়। পানির মাছ ডাঙায় পড়ে লাফালাফি ছটকাছটকি করে।

    ফজল আর তার সঙ্গীরা হৈ-হুঁল্লোড় করে হাত দিয়ে ধরে সে মাছ। অনেক সময় পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষাও করে না তারা। অল্প পানির মধ্যে গোলাগুলি করে, আছাড় পাছাড় খেয়ে মাছ ধরায় আনন্দ বেশি, উত্তেজনা, বেশি। এজন্য অবশ্য মাঝে মাঝে বাতাশি, বজুরি আর ট্যাংরা মাছের কাঁটার জ্বলুনি সইতে হয়, চিংড়ি আর কাঁকড়ার চেঙ্গি খেয়ে ঝরাতে হয় দু-চার ফোঁটা রক্ত।

    একবার দিনের বেলা প্রকাণ্ড এক রুই মাছ আটকা পড়েছিল বেড়ে। এত বড় মাছ দিনের বেলা তো দূরের কথা, রাত্রেও কদাচিৎ আসে অগভীর পানিতে। বোধহয় শুশুকের তাড়া খেয়ে কিনারায় এসেছিল মাছটা। ভাটার সময় বেড়ে বাধা পেয়েই ওপর দিয়ে লাফ মেরেছিল। লাফটা কায়দা মতো দিতে পারলে বানা ডিঙ্গিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত। আরেকবার লাফ দেয়ার আগেই ফজল সবাইকে নিয়ে ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর সে যে কি পাছড়া পাছড়ি! পানির জীবকে পানির ভেতর কাবু করা কি এতই সোজা! ধস্তাধস্তির সময় মাছের গুঁতো খেয়ে কয়েকজনের শরীরে জায়গায় জায়গায় কালশিরা পড়ে গিয়েছিল।

    পঁচিশ সের ওজন ছিল মাছটার। বেচার সময় মাপা হয়েছিল। দাম পাওয়া গিয়েছিল আট টাকা।

    রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টায় জোয়ার-ভাটা খেলে দু’বার। এ দু’বারই শুধু বানা পুঁতে বেড় দিয়ে মাছ ধরা যায়। দিনের জোয়ারে খুব বেশি সুবিধে হয় না। সুবিধে হয় রাত্রের জোয়ারে।

    দিনে বেড় দিয়ে যে মাছ পাওয়া যায় তার কিছুটা খাবার জন্য ফজল ও তার সাথীরা ভাগ করে নেয়। মাঝে মাঝে চরের আর শরিকদেরও দেয়া হয় কিছু কিছু। বাকিটা বড় বড় চাই-এর মধ্যে ভরে পানির ভেতর জিইয়ে রাখে। রাত্রে ধরা মাছের সাথে সেগুলো নিয়ে তারা ভোর রাত্রে চলে যায় তারপাশা।

    চিংড়ি আর বড় মাছ কেনে মাছের চালানদাররা। তারা কাঠের বাক্সে ভরে বরফ দিয়ে সে মাছ চালান দেয় কলকাতায়। এদের কাছ থেকে ভালো দাম পাওয়া যায়। ছোট মাছগুলো সস্তায় বেচে দিতে হয় নিকারি-কৈবর্তের কাছে।

    মাছ বিক্রি করে তারা ভোর আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে আসে। জমিরদ্দিন সরু ডিঙি সাত বৈঠার টানে ছুটে চলে বাইচের নৌকার মতো। উজান ঠেলে মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা পৌঁছে যায় তারপাশা। সেখান থেকে ভাটি পানিতে ফিরে আসতে আধঘণ্টাও লাগে না। রোজ পনেরো-বিশ টাকা আসে মাছ বেচে। এভাবে আরো পনেরোটা দিন চালাতে পারলে যোগাড় হয়ে যাবে দশ জনের খাজনার টাকা।

    টাকার গন্ধে অনেকেরই লোভ জাগে, ভিড়তে চায় দলে। কিন্তু ফজল তাদের পাত্তা দেয় না। যে দুজন মান-ইজ্জত নিয়ে সরে-পড়েছিল, তারা এসে যোগ দিতে চায়।

    ফজল রেগে ওঠে। তাদের মুখের ওপর বলে দেয়, ওঃ, এখন জুইতের নাও বাইতে আইছ। তোমরা। উঁহু, তোমরা তোমাগ জাত-মান লইয়া থাক গিয়া। আমাগ দলে জায়গা নাই।

    কিন্তু ফজলের রাগ মাটি হয়ে যায় দুদিনেই। সে তাদের ডেকে বলে, যদি আসতে চাও তবে আর সবাইর মতন বানা তৈরি করো।

    .

    ০৬.

    দিঘিরপাড় কাছারির নায়েব সীতানাথ ভৌমিককে দেখে ভদ্র বলেই মনে হয়েছিল ফজলের। কিন্তু তার কথা-বার্তার ধরন দেখে সে বুঝতে পারে, লোকটা ভদ্র শুধু কাপড়-চোপড়ে। সে তার পিতার সাথে তুমি-তুমি করে কথা বলছে, যদিও বয়সে সে তার চেয়ে কম করে হলেও পনেরো বছরের ছোট।

    ফজলের রাগ ধরে যায়। রাগটাকে কোনো রকমে বাগ মানিয়ে সে ধীরভাবে বলে নায়েব মশাই, আপনাদের বয়স ষাট পার হইয়া গেছে না?

    নায়েবের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। প্রশ্নকারীকে দেখে নিয়ে সে এরফান মাতব্বরকে বলে, ছেলেটা তোমার না মাতবর?

    হ বাবু।

    বলিহারি ছোঁড়ার আন্দাজ। ফজলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তারপর বলে, আমার বয়স দিয়ে তোর দরকার কিরে অ্যাঁ।

    না, এমনিই জিজ্ঞাস করলাম। বাজানের বয়স পঞ্চান্ন। তার সাথে যখন তুমি তুমি’ কইর‍্যা কথা কইতে আছেন, তখন আন্দাজ করলাম আপনের বয়স ষাট পার হইয়া গেছে।

    এরফান মাতব্বর ধমকে ওঠে, অ্যাই ফজু, শতয়তা–ন, চো-প।

    ধমক তো নয়, যেন একটা বাঘ গর্জে উঠেছে। নায়েবের কলজে পর্যন্ত কেঁপে ওঠে সে ধমক শুনে। মাতব্বরের গম্ভীর মুখ আর ক্রোধরক্তিম চোখের দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে সে।

    মুখ-চোখের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনে মাতব্বর অনুনয়ের সুরে বলে, নায়েব বাবু, রাগ কইরেন না। পোলাডার বুদ্ধি-বিবেচনা এহনো পাকে নাই। কার লগে ক্যামনে কথা কইতে অয়, এহনো হিগে নাই। আপনে ওরে মাপ কইরা দ্যান। অ্যাই ফজু? বাবুর কাছে মাপ চা। মাতব্বর পেছন দিকে মুখ ঘোরায়।

    ফজল নেই।

    মাতব্বর উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেখে ফজল অনেক দূর চলে গেছে, হেঁটে যাচ্ছে হনহন করে।

    ফিরে এসে সে বলে, বাড়িতে গিয়া লই। ওরে আচ্ছা মতন মালামত করমু। আপনে রাগ অইয়েন না।

    ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখান হয়েছে বোধহয়? নায়েব বলে। আগের মতো তুমি উচ্চারণ করতে আর উৎসাহ পায়না তার মুখ।

    হ, এই কেলাস নাইন পর্যন্ত পড়ছে। সংসারের কাজ-কামের লেইগ্যা আর পড়াইতে পারলাম না।

    যতটুকু পড়েছে তার জন্য অনেক ভোগান্তি আছে। শেখের ছেলে একটু লেখাপড়া শিখলেই জাত-গোত্রের কথা ভুলে যায়। মনে করে নওয়াব সিরাজদ্দৌলা হয়ে গেছে। ছেলেটা কাজ-কর্ম কিছু করে, না খালি আলফেট কেটে ঘুরে বেড়ায়?

    না কাম-কাজ করে। আমি তো বুড়া অইয়া গেছি সংসারের বেবাক কাম এহন ও-ই করে।

    করলেই ভালো। দেখি, পুরান চেক-দাখিলা কি আছে।

    এরফান মাতব্বরের হাত থেকে খাজনার পুরানো চেক নিয়ে সে কাছারির খাতাপত্র দেখে। দু’বছরের খাজনা বাকি।

    নায়েব বলে, জমিতো ভগবানের ইচ্ছায়, গঙ্গার কৃপায় পয়স্তি হয়েছে। সেলামি দিতে হবে এবার।

    তা দিমু।

    দিমু তো বুঝলাম, কিন্তু কবে?

    আইজই দিমু। আপনে খাজনার চেক কাডেন। একসাথে দিতে আছি।

    উঁহু আগে সেলামির টাকা, তারপর খাজনা।

    এরফান মাতব্বর এক হাজার টাকা নায়েবের হাতে তুলে দেয়।

    কত?

    পুরা হাজার টাকাই দিলাম।

    উঁহু। আরো এক হাজার লাগবে।

    এরফান মাতব্বর হাতজোড় করে বলে, আর দাবি কইরেন না, বাবু। চরডা লায়েক অউক। তখন আপনেরে খুশি করমু।

    কিন্তু খুশি করার সময়ই তো এখন। কই, আর কি আছে দেখি?

    আর দুই সনের খাজনার টাকা আনছি।

    কই দেখি।

    নায়েব হাত পেতে আরো চারশ’ টাকা নিয়ে মাতব্বরের কাছ থেকে। বাংলা ১৩৪৭ সালের চেক কেটে মাতব্বরের হাতে দেয়।

    এক সনের চেক দিলেন নি বাবু?

    হ্যাঁ, গত সনের চেক দিলাম। এই সনের খাজনা পরে দিলেই চলবে।

    মাতব্বর কাছারি থেকে বেরোয়। তার মনে আফসোস–এক থেকে অনেকগুলো টাকা। নেমে গেল। জমিদারের সেলামি দিতেই গেল বারো শ টাকা। মাতব্বর জানে–জমিদারের না, নায়েবের কাম। সেলামির টাকা সবটাই উঠবে নায়েবের সিন্দুকে। সে মনে মনে বলে, যত কাড়ি সুতা, সব নেয় বামনের পৈতা।

    মাতব্বর নৌকাঘাটে আসে। নৌকায় কেউ নেই। হাঁক দেয়, কই গেলিরে তোরা?

    মেরামতের জন্য ডাঙার ওপর কাত করে রাখা ঢুশা নৌকার আবডালে ছায়ায় বসে ষোলঘুটি খেলছিল ‘বাইছা’ দু’জন। ডাক শুনে তারা গামছা ঝাড়তে ঝাড়তে ছুটে আসে। দু’জনই কোলশরিক। নৌকা বাইতে তাদের নিয়ে এসেছে মাতব্বর।

    ফজল কইরে? সে নায় আহে নাই?

    আইছিল। সে আমাগ লগে যাইব না। পরে যাইব।

    পরে যাইব! ক্যান?

    হে কইছে, আইজ দিঘিরপাড় খেলা আছে। তারিখের খেলা। হেই খেলা দেইখ্যা যাইব।

    কিয়ের খেলা?

    কপাটি খেলা।

    তারিখ দিছে কারা?

    তারিখ দিছে। মাঝেরচরের আক্কেল হালদার আসুলিগ লগে। গেল হাটবার চর আর আসুলিগ মইদ্যে জিদাজিদি অইছে।

    তারিখ তো দিছে। পারব আসুলিগ লগে?

    পারব না ক্যান্। আক্কেল হালদার দক্ষিণপাড় গেছে। পালং আর ভোজেশ্বর তন বড় বড় খেলোয়াড় লইয়া আইব।

    তোরা আল্লার নাম লইয়া নাও ছাড়। ফজু থাউক পইড়া। খেলা দ্যাখলেই প্যাড ভরব। জোরে বৈডা চালা। বাড়িতে গিয়া যে আছরের নামাজ পড়তে পারি।

    উজান পানি। স্রোত ভেঙে ছলচ্ছল আওয়াজ তুলে নৌকা চলছে দুলতে দুলতে।

    নৌকায় ছই নেই। মাতব্বর ছাতা মাথায় দিয়ে বসে। তার মনে নানা ভাবনা-চিন্তার জটলা লেগেই থাকে সব সময়। আজ আবার সেখানে যোগ দিয়েছে আর এক ভাবনা।

    ভাবনা হয়েছে ফজলের আজকের ব্যবহারে। নায়েব না হয় বেতমিজের মতো তুমি তুমি করে কথা বলছিল। সে জন্য ওভাবে ঠেস দিয়ে কথা বলার কী দরকার ছিল ওর? সে হলো নায়েব। জমির মালিক যে জমিদার, তার নায়েব। এদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তোয়াজ-তাজিমের সাথে। কটু কথা বললেও গায়ে মাখতে হয় না তা। এদের সাথে আড়ি দিয়ে, মেজাজ দেখিয়ে কি চরে বসত করা যায়? একটু নারাজ হলেই এরা এদের মেহেরবানির ঝাপি তুলে দেবে অন্যের হাতে। দিনকে বানিয়ে ফেলবে রাত। তার বয়স উমরেই সে কত দেখেছে–আসল হকদারকে ভোজবাজি দেখিয়ে কেমন করে এরা নতুন চরের আলমদারি দেয় অন্য লোককে। তারপর আর কি! চরের দখল নিয়ে বেঁধে যায় মারামারি খুনাখুনি। মামলা-মোকদ্দমার অতল গহ্বরে নেমে যায় বেশুমার টাকা। এভাবে সে নিজেও বড় কম ভোগেনি।

    মাতব্বর বুঝতে পারে, এরকম মেজাজ নিয়ে ফজল কোনো দিনই চরে বসত করতে পারবে না। তাই তাকে নসিহত করার কথা চিন্তা করে সে। কিন্তু ছেলেকে নসিহত করার মতো মনের জোর নেই তার।

    অভাবের সময়ে সে পুতের বউর গয়না বন্ধক দিয়েছে। সে ছুতোয় ছেলের শ্বশুর আরশেদ মোল্লা তার মেয়ে আটকে রেখেছে। বউ আনবার জন্য দুবার লোক পাঠিয়েছিল মাতব্বর। মোল্লা বলে পাঠিয়েছে, মাইয়ার শরীলের গয়না পুরা না লইয়া যেন আর মাইয়া নেওনের কথা মোখ দিয়া কয় না।

    তারপর সাত মাস পার হয়ে গেছে, ছেলে আর বউর দেখাসাক্ষাৎ একদম বন্ধ। যদিও এর জন্য বেয়াইকেই দায়ী করে, তবুও নিজের দোষটাও মাতব্বর অস্বীকার করে না। তার মনেও ঢুকেছে কেমন একটা সঙ্কোচ যার ফলে সে ছেলেকে আগের মতো কড়া কথায় ভর্ৎসনা করতে পারে না আজকাল।

    মনের পর্দায় আরশেদ মোল্লার ছায়া পড়তেই তার রাগ ফণা বিস্তার করে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে মনে মনে বলে, সোনাদানা আমি দিছিলাম। আমিই বন্দক দিছি। আল্লায় দিন দিলে আবার আমিই ছাড়াইয়া আনমু। তুই ত আধা পয়সার গয়নাও দেস নাই। তুই ক্যান্ মাইয়া আটকাবি? মাইয়া আকটাইয়া করবি কি তুই?

    তার মনের অনুচ্চারিত প্রশ্ন থামে। যেন উত্তর চায় প্রতিপক্ষের। তারপর আবার তার ক্ষুব্ধ মন চেঁচিয়ে ওঠে, মাইয়া আটকাইয়া ঘরে খাম্বা দিবি? দে খাম্বা। দেহি কদ্দিন ঘরে রাখতে পারস মাইয়াডা। আমি আবার আমার পোলারে বিয়া করাই।

    বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়ে। মাতব্বরের মনের ঝগড়াও থামে তখনকার মতো।

    রাত্রে খেতে বসে সে স্ত্রী-কে বলে, হোন ফজুর মা, আরশেদ মোল্লারে এমুন একটা ঠাসা দিমু–

    ক্যান?

    ক্যান্ আবার! মাইয়া আটকানের মজা দেহাইয়া দিমু। ওর মাইয়া আননেরও দরকার নাই, ছাড়নেরও দরকার নাই। ওর মাইয়া ওর বাড়িতেই পচুক, বুড়ি অউক। ফজুরে আবার আমি বিয়া করাইমু।

    যা করে যে চিন্তা-ভাবনা কইর‍্যা করে।

    এর মইধ্যে চিন্তা-ভাবনার কি আছে?

    চিন্তা-ভাবনার কিছু নাই? অইবার সারদা আইনের বচ্ছর ‘ওঠ ছ্যামড়া তোর বিয়া’ কইয়া ফজুরে বিয়া করাইল। কয়ডা বচ্ছর পরেই আবার ভাইঙ্গা দিল বিয়া। এতে আল্লা বেজার অয় না?

    অতীতের ভুলের কথা তুলতেই চুপ হয়ে যায় মাতব্বর।

    অনেকক্ষণ পর সে বলে, আমার দোষ দিলে কি অইব। আসলে তোমার পোলাডারই বউর ভাগ্য নাই।

    .

    ০৭.

    হা-ডু-ডু খেলার প্রতিযোগিতা। খেলার ভেতর দিয়ে চর আসুলির শক্তি পরীক্ষা হবে আজ।

    সামান্য কথার খোঁচা থেকে এ আড়াআড়ির সৃষ্টি হয়েছে। দিঘিরপাড়ের গুড়ের আড়তদার হাতেম শিকদার তার পাশের ধানের আড়তদার আক্কেল হালদারকে সেদিন কথায় কথায় বলেছিল, আরে দ্যাখা আছে। তোমাগ চরে আবার খেলোয়াড় আছেনি! আছে সব–

    কি কইলা! খেলোয়াড় নাই!

    নাই-ইতো। তোমরা পার ঢাল-কাতরা লইয়া খুনাখুনি করতে।

    আমরা খুনাখুনি করতেও পারি, খেলতেও পারি।

    পার আমার ইয়ে। আমাগ মাকুহাটির ফরমানের খেলা দ্যাখছ? ও একবার ‘কপাইট’ কইয়া ডু’ দিলে তোমায় খেলোয়াড়রা ছ্যাড়া খাইয়া ভাইগ্যা যাইব।

    ‘আর ছাড়ান দ্যাও। ওই রহম খেলোয়াড় গণ্ডা গণ্ডা আছে আমাগ চরে।

    আছে! তবে খেইল্যা দ্যাহাও না একদিন।

    হ দ্যাহাইমু।

    কবে? তারিখ দ্যাও।

    তুমি দ্যাও তারিখ।

    পরশু মঙ্গলবার।

    না, তার পরের দিন বুধবার।

    আজ সেই খেলার তারিখ বুধবার।

    খেলার মাঠ লোকে লোকারণ্য। জেদাজেদির খেলা। দর্শকের ভিড় তো হবেই। দুই অঞ্চলের উগ্র সমর্থকদের মনে উত্তেজনার বারুদ। শান্তিরক্ষার জন্য সশস্ত্র পুলিস এসে হাজির হয়েছে।

    বড় ময়দানের মাঝখানে দাগকাটা খেলার কোট। ষোল হাত দীর্ঘ আর দশ হাত প্রস্থ কোটটিকে মাঝখানে দাগ কেটে সমান দু’ভাগ করা হয়েছে দুই দলের জন্য। কোটের চারপাশে বাঁশের খোটা পুঁতে তার সাথে মোটা রশির ঘের বাঁধা হয়েছে। সে ঘেরের বাইরে সারি সারি লোক বসে গেছে। তাদের পেছনে গায়ে গায়ে মেশামিশি হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশির ভাগ দর্শক।

    বিকেল চারটায় খেলা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু চরের দল এখনো আসেনি। আসুলির খেলোয়াড়রা অনেক আগেই এসে গেছে। বিক্রমপুরের দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় সব। বজ্রযোগিনীর বাদল, মাকুআটির ওসমান আর ফরমান দুই ভাই, কামারখাড়ার ভজহরি, কলমার আল্লাস, সোনারং-এর কালীপদ আর পাঁচগাঁর শাসমু এসেছে। হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরে তারা কোটের এক অংশে তৈরি হয়ে বসে আছে।

    দর্শকরা অধৈর্য হয়ে ওঠে। অধৈর্য হয়ে ওঠেন স্বয়ং রেফারিও। তার মুখের বাঁশির আওয়াজে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিছুক্ষণ পরে পরেই তিনি তাঁর হাতঘড়ি দেখছেন আর জোড়া ফুঁ দিচ্ছেন বাঁশিতে।

    অতি উৎসাহী ছেলে-ছোকরার দল নৌকাঘাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চরের দিক থেকে লোক বোঝাই কোনো নৌকা দেখলেই তারা হৈ-হৈ করে ওঠে, ঐ যে–ঐ ঐ আইতে আছে! তারপর ছড়া আবৃত্তি করতে থাকে সমস্বরে–

    হেঁই কপাটি তুলা ধোন,
    মশা করে ভোন্‌ ভোন্‌।
    মাছির কপালে ফোঁটা,
    মইষ মারি গোটা গোটা।

    কোলাহল শুনে দর্শকরা একটু আশান্বিত হয়। কিন্তু নৌকা কাছে এলে দেখা যায়– খেলোয়াড়দের কেউ আসেনি। এসেছে তাদের নৈরাশ্যের কয়েকজন ভাগীদার শুধু।

    আসুলির লোকেরা ভুড় দিতে শুরু করে। তারা বলে, চরুয়ারা আইব না। ওরা ডরাইয়া গেছে।

    চরাঞ্চল থেকেও বহু লোক খেলা দেখতে এসেছে। আসুলির লোকদের ঠেস-টিটকারি শুনে তাদের মুখ কালো হয়ে যায়। কচ্ছপের মতো সুবিধে থাকলে হয়তো তারা তাদের মাথা লুকিয়ে ফেলত লজ্জায়।

    এক পক্ষ যখন আসেনি তখন অন্য পক্ষ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করবে। সেই জয় ঘোষণা করতে হবে রেফারিকে। তিনি বাঁশি বাজান, হাত নেড়ে প্রতিপক্ষের খালি কোটে ‘ডু’ দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন আসুলির দলকে।

    হঠাৎ ভিড় ঠেলে খালি মাঠে নামে একজন লোক। লোকটিকে সবাই চেনে। সাতকচরের সোলেমান। সে এক কালের নামকরা খেলোয়াড়। এখন বয়স হয়েছে। মাথার কাঁচা-পাকা চুল দেখেই বোঝা যায়, বয়স তার চল্লিশ পার হয়ে গেছে। সাত-আট বছরের মধ্যে তাকে কোথাও খেলায় নামতে দেখা যায়নি।

    রেফারির দিকে এগিয়ে সোলেমান বলে, নগেন বাবু, চরের খেলোয়াড়রা আহে নাই। কিন্তু আমরা আছি চরের মানুষ। আমরা খেলুম বিনা খেলায় আসুলিগ জিত্যা যাইতে দিমু না।

    রেফারি বলেন, কিন্তু তোমাদের আক্কেল হালদার কোথায়? খেলার তারিখ দিয়ে এমন–

    হুনছি, সে খেলোয়াড় আনতে গেছে দক্ষিণপাড়। মানুষটা এহনো আইল না ক্যান্ কে জানে?

    দর্শকদের ভেতর থেকে একজন বলে, আইব কি, ডরের চোডে পথ ভুইল্যা গেছে।

    রেফারি সোলেমানকে বলেন, তবে নেমে পড়। কোথায় তোমার খেলোয়াড়রা?

    এই আনতে আছি। দশটা মিনিট সময় দ্যান।

    সোলেমান চারদিকের দর্শকদের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে হাঁক দেয়, কে আছস রে তোরা? চরের ইজ্জত না যাইতে শিগগির আয়।

    ভিড়ের মাঝ থেকে ফজল ও আরো তিনজন এসে যোগ দেয় সোলেমানের সাথে।

    খেলা হবে না ভেবে দর্শকরা মনমরা হয়ে গিয়েছিল। এবার তারা আনন্দে কোলাহল করে ওঠে, হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়, উৎসাহ দেয় চরের খেলোয়াড়দের।

    এখনো দু’জন খেলোয়াড়ের অভাব। সোলেমান ও ফজল দর্শকদের মধ্যে পরিচিত লোক খুঁজে বেড়ায়।

    ফজলের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় একটি ছেলের। রূপজানের মুখের আভাস আনন্দ জাগায় তার মনে।

    দশ বছরের ছেলেটি তার শ্যালক। সে রশির বেড়া ঘেঁষে বসে আছে। দুলাভাই মাঠে নামার পর থেকেই সে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বারবার হাত নাড়ছিল।

    হাসি বিনিময় করে ফজল তার কাছে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে, এই দেলু কার সাথে আসছ?

    কাদিরভাইর সাথে। আরো কত মানুষ আইছে!

    ফজল গায়ের জামা খুলে দেলোয়ারের হাতে দিয়ে তার কানে কানে বলে, এইডার মধ্যে টাকা আছে সাবধানে রাইখ্য।

    আচ্ছা। জানেন দুলাভাই, কাদিরভাই কিন্তু খুব ভালো খেলে।

    তাই নাকি?

    হ, খুব লেংড়ি দিতে পারে।

    তাই নাকি! কই সে?

    দেলোয়ার পেছন দিকে তাকায়। কাদিরকে খুঁজে পেয়ে সে বলে, ওই যে দুলাভাই।

    ফজলের চোখে চোখ পড়তেই তার চাচাতো শ্যালক কাদির হেসে ওঠে।

    ফজল তাকে ডাকে, তাড়াতাড়ি নামো। সময় নাই।

    কাদির হাত নেড়ে খেলতে অসম্মতি জানায়। কিন্তু দর্শকরা তাকে ঠেলে মাঠে নামিয়ে দেয়।

    অন্য দিক থেকে সোলেমানও একজনকে জোর করে মাঠে নামায়।

    খেলার পোশাক নেই কারো। এভাবে খেলায় নামতে হবে কে জানত? খুঁজে-পেতে একটা প্যান্টও যোগাড় করতে পারে না কেউ। কি আর করা! খেলোয়াড়রা সবাই লুঙ্গিতে কাছা মেরে নেয়।

    সোলেমান তার খেলোয়াড়দের কোটের এক কোণে জড় করে নিচু গলায় পরামর্শ দেয়, দ্যাখো, তোমরা ওগ বড় বড় খেলোয়াড় দেইখ্যা ঘাবড়াইয়া যাইও না। খালি ঠ্যাকা দিয়া যাইবা। কোনো উপায়ে ড্র’ রাখতে পারলেই আইজ ইজ্জত বাঁচে। তোমরা ধীরে-সুস্থিরে খেলবা। ওরা চেতলেও চেতবা না। আবার সুযোগ পাইলেও ছাড়বা না। ঐ যে বাদল ফরমান। দাঁতাল শুয়রের মতন শক্তি ওগ গায়। ওরা কিন্তু গোতলাইয়া লইব। কায়দা মতন না পাইলে ওগ ধরবা না। আর ঐ যে কালীপদ–ব্যাডা কুলুপের ওস্তাদ। ডু দেওয়ার সময় হুঁশিয়ার। ভজার পায়ে কিন্তু সাংঘাতিক জোর। ও পাও আউগাইয়া দিব, লেংড়িও দিব। কিন্তু কেও ধরবা না। ধরলেই কিন্তু ঘোড়ার মতন ছিটা লাথি মাইর‍্যা যাইব গা। শামসু ঢুশ দিয়া ধরে। আর ঐ যে আলাস–ওরে বেড় দিলেই লাফা মাইর‍্যা চইল্যা যাইব।

    রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে তৈরি হওয়ার জন্য তাড়া দেন।

    সোলেমান রেফারিকে দুটো আঙুল দেখায়। আরো দুমিনিট সময়ের প্রার্থনা।

    সে আবার শুরু করে, তোমাগ মইদ্যে কুলুপ জানে কে?

    আমি জানি। ফজল বলে।

    ঠিক আছে, তুমি ডান কিনারে থাকবা। আর আমি থাকমু বাঁ কিনারে।

    আচ্ছা, তবে আমার পাশে থাকব লখাই। ও কুলুপ দেওনের ভান করব, তা অইলে যে ডু দিতে আইব, তার নজর থাকব লখাইর উপরে। তখন পাশের তন কুলুপ দিমু আমি?

    হ দিও। কিন্তু যখন তখন কুলুপ দিও না। তুমিতো ডু দিতেও পারবা?

    হ পারমু।

    আর কার কি গুণ আছে কও দেহি শিগগির।

    নিজের মুখে নিজের গুণ জাহির করতে লজ্জা পায় সবাই।

    ফজল বলে, এই যে কাদির, ও পারে লেংড়ি দিতে।

    বেশ বেশ! সাবধানে ডু দিবা। কালীপদর দিগে কিন্তু ঠ্যাং বাড়াইও না।

    আর ঐ যে কোরবান। ও পারে হাতে কুলুপ দিতে।

    উঁহু। ওরা যেমুন জুয়ান, হাতে কুলুপ দিয়া জুত করতে পারবা না। ঠিক আছে, তুমি হাতে কুলুপ দেওনের ভান করবা আর আমি তখন সুবিধা পাইলে কুলুপ দিমু বাইয়া পায়ে।

    মধু আর তালেবের তেমন কোনো বিশেষ গুণ নেই। তারা মাঝে মাঝে ডু’ দেবে আর বিপক্ষের খেলোয়াড় ধরার সময় সাহায্য করবে।

    সোলেমান আরো বলে, যে পয়লা ধরবা, হে যদি বোঝ ধরা ঠিক অইছে, তয় ‘ধর’ কইয়া আওয়াজ দিবা। তখন আর সবাই ঝাপাইয়া পড়ব। যাও আর সময় নাই। যার যার জায়গা লও গিয়া।

    খেলা শুরু হয়।

    রেফারির বাঁশির নির্দেশ পেয়ে আসুলির দলের বাদল প্রথমে ‘ডু’ দেয়, ডিগিড্‌ডিগিড্‌ডি গিড্‌ডিগি–

    তার উত্তরে সোলেমান ডু’ দেয়, কপাইচ-কপাইচ—কপাইচ–

    আলকাস : ট্যাগাট্টাগাট্টাগা–

    ফজল : ড্যাগাড্‌ড্যাগাড্‌ড্যাগাড্‌ড্যাগা—

    ফরমান : কপাইট–কপাইট–কপাইট–

    উত্তেজনাহীন ‘ডু’-এর মহড়া চলে কিছুক্ষণ। তারপরই আসুলির দল মেতে ওঠে। বাদল, ফরমান আর আল্লাসের ‘ডু’-এর দাপটে বিব্রত বোধ করে চরের দল।

    ছোট্ট সীমিত কোটের মধ্যে সাতজন খেলোয়াড়ের দাঁড়াবার জায়গা। এর মধ্যে থেকেই বিপক্ষের আক্রমণের মোকাবেলা করতে হবে। চরের দল তাড়া খেয়ে শেষ সীমারেখার কাছে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করে।

    ফরমান ‘ডু’ দিয়ে এগিয়ে যায়, মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে থাবা মারে। কোরবান লোভ সামলাতে পারে না। সে ফরমানের হাতে কুলুপ দিয়ে বসে। কিন্তু তার হাতের ঝটকা টানে কোরবান উপুড় হয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়।

    দলের একজন কমে গেল। সোলেমান ‘ডু’ দেয়। সময় কাটাবার জন্য মধ্য রেখার কাছ দিয়েই ঘুরে ঘুরে সে ‘কপাইচ–কপাইচ’ করে। সময় বেশি নিচ্ছে দেখে রেফারির সন্দেহ হয়, দম চুরি করছে বোধ হয় সোলেমান। তাইতো! তিনি বাঁশিতে ফুঁ দেন। কিন্তু কেউ ছুঁয়ে মারবার আগেই সোলেমান লাফিয়ে ভেগে আসে।

    ভজহরি ‘ডু’ দিতে এগিয়ে আসে। ফজলের দিকে ডান পা এগিয়ে দেয় সে। চোখে তার অবজ্ঞার হাসি। ভাবটা এই–সাহস থাকলে ধরো না দেখি, কত মুরোদ। ফজল লখাইকে কনুইর গুঁতো মেরে ইশারা করতেই সে কুলুপ দেয়ার ভান করে। ভজহরি লেংড়ি দেয় লখাইকে। অমনি ফজল ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মাজার ওপর। জাপটে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, ধর।

    সাথে সাথে আর তিনজনে ধরে রেখে দেয় ভজহরিকে।

    সোলেমান ফজলকে বাহবা দেয় আবার চুপিচুপি সাবধানও করে, ওইভাবে ঝাপাইয়া পইড় না। বুকে চোট লাগতে পারে।

    ভজহরি মরে যাওয়ায় কোরবান তাজা হয়েছে। ফজল ‘ডু’ দেয়। সোলেমানের মতো সে-ও সময় ধ্বংস করে।

    ‘ট্যাগাট্টাগা’ করতে করতে আসে আল্লাস। সে বাঁ দিকের খেলোয়াড়দের সোজা তাড়িয়ে নিয়ে চলে। সোলেমান আর কোরবানের ‘জল্লা’ যাওয়ার মতো অবস্থা। ফজল দৌড়ে যায় আল্লাসকে ধরতে। কিন্তু সে সোলেমানকে ছুঁয়ে, লাফ মেরে ফজলকে ডিঙিয়ে পালিয়ে যায়।

    আসুলির সমর্থকরা আনন্দে হাততালি দেয়।

    দলের দুই প্রধান খেলোয়াড় মারা গেছে। এবার আর উপায় নেই।

    কাদির ‘ডু’ দেয়ার জন্য মধ্যরেখার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সতেরো বছরের নব যুবক। সুপারি গাছের মতো ওর দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থ নেই। হাত-পা কাঠিকাঠি, যেন তালপাতার সেপাই। ওকে দেখে আসুলির খেলোয়াড়রা অবহেলার হাসি হাসে, হাতে তুড়ি মেরে ঠাট্টা করে। তাদের ঠাট্টার জবাবে সে ‘ডু’ দেয়–

    ‘হেঁই কপাটি কয় বাড়ি?
    সাবু খাইছ কয় বাট্টি?’

    রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দেন। হাত নেড়ে বলেন, এরকম ছড়া কেটে ‘ডু’ দেয়া চলবে না। আবার ‘ডু’ দাও।

    কাদির ‘ডিগডিগ’ করতে করতে এগিয়ে যায়।

    কালিপদ আর ওসমান মাটির ওপর থাবড়া মেরে ওকে ভয় দেখায়। কিন্তু ও ঘাবড়ায় না। ওর ‘ডু’ চলতে থাকে।

    হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে কালীপদর পায়ে লেংড়ি মেরে সে চলে আসে।

    চারদিক থেকে হাততালি পড়ে। কেউ কেউ বলে, পচা শামুকেও পা কাটে।

    সোলেমান আনন্দের আতিশয্যে কাদিরকে কাঁধের ওপর নিয়ে নাচতে থাকে। কালীপদ মারা পড়ায় বেঁচে ওঠে সোলেমান ও ফজল। আবার পুরো হয় চরের দল।

    কিন্তু একটু পরেই ফরমানের আক্রমণে মারা যায় কাদির আর মধু। তারও কিছুক্ষণ পরে তালেব ‘ডু’ দিতে গিয়ে ধরা পড়ে।

    বিরতির বাঁশি বাজে। খেলার অর্ধেক সময় শেষ হলো। আসুলির দলের সবাই তাজা। চরের দলে বেঁচে আছে চারজন।

    দশ মিনিট বিশ্রামের পর আবার খেলা শুরু হয়।

    সোলেমান ‘ডু’ দিয়ে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে যায়। একটু এগিয়ে ওসমানের ওপর থাবা মারতেই শামসু ঢুস দিয়ে ধরবার জন্য ছুটে আসে। সোলেমান চক্কর মেরে শামসুকে ঘূর্ণা খাইয়ে চলে আসে।

    আক্‌লাস ‘ডু’ দিয়ে সোলেমান ও তার পাশের খেলোয়াড়দের দাবড়ে নিয়ে যায়। লাফ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করাই তার উদ্দেশ্য। ফজল তাকে বেড় দেয়। আল্লাস লাফ দিতেই সে সটান খাড়া হয়ে যায়, দু’হাত বাড়িয়ে আলাসের ডান হাঁটুর কাছে জাপটে ধরে। আলাস ফজলের কাঁধের ওপর ঝুলতে থাকে। তার মাথা নিচের দিকে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে হাতদুটো তার মাটি ধরবার জন্য আকুলি-বিকুল করছে।

    ‘ডু’-এর আদান-প্রদান চলে কিছুক্ষণ। চরের খেলোয়াড়রা সব ধীর-স্থির। তারা ‘ডু’ দিয়েও বেশি দূর এগোয় না, ধরবার জন্যও বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে না। শামসু আর আল্লাস তাজা না হওয়া পর্যন্ত আসুলির দলও বেশি মাতে না। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর মধু ও লখাইকে মেরে তারা দল পুরো করে। কিন্তু সময় আর বেশি নেই। এ পর্যন্ত তারা এক পাট্টিও বানাতে পারেনি। কয়েকটা অখ্যাত অজ্ঞাত পুচকে খেলোয়াড় তাদের এভাবে ঠেকিয়ে রাখবে, এর চেয়ে লজ্জার ব্যাপার আর কি হতে পারে?

    তারা বাদল আর ফরমানকে গোয়ার্তুমি করার জন্য ছেড়ে দেয়। মাতামাতি করে ‘ডু’ দিয়ে চেষ্টা করতে দোষ কি? ধরা পড়লে পড়ুক। আর বেঁচে আসতে পারলে তো কথাই নেই।

    বাদল আর ফরমান খ্যাপার মতো ‘ডু’ দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে চরের দলকে।

    সোলেমান সাবধান করে দেয় সবাইকে, অ্যাকদিগে দাবড় লাগাইলে অন্য দিগ থিকা আউগ্‌গাইয়া আসবা। কিন্তু ধরবা না, খবদ্দার। করুক না ওরা গোলাগুলি যত পারে!

    সোলেমানের উদ্দেশ্য সময় নষ্ট করা। সময় কাবার করে কোনো রকমে ‘ডু’ রাখতে পারলেই চরের ইজ্জত বজায় থাকে। কিন্তু বাদল আর ফরমান ‘ডু’ দিয়ে শেষ সীমারেখার কাছে দাবড়িয়ে নিয়ে যায় তাদের। সীমারেখার বাইরে গেলেই জল্লা যেতে হবে। এ অবস্থায় সোলেমানের হুঁশিয়ারি ভেস্তে যায়। ঠিক থাকতে পারে না সোলেমান নিজেও। না-মরদের মতো জল্লা গিয়ে মরার চেয়ে ধরে মরা অনেক ভালো।

    কিন্তু ধরতে গিয়েই শুরু হয় মড়ক। কোরবান আর তালেব ধরেছিল বাদলকে। কিন্তু সে দু’জনকেই হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যায়। তারপর ফরমানকে ধরতে গিয়ে মারা যায় সোলেমান। আর বাদলের দাবড় খেয়ে কাদির জল্লা যায়। টিকে থাকে শুধু ফজল।

    উত্তেজনা টগবগ করছে দর্শকদের ভেতর। এবার আসুলির ভাগ্যে নিশ্চিত জয়লাভ।

    মিনিট দুয়েক সময় আছে আর। ফজল ডু’ দেয়। কিন্তু তাকে ধরবার আগ্রহ দেখায় না কেউ। সে দম শেষ করে ফিরে আসে।

    বাদল ‘ডু’ দেয়, এগিয়ে যায় লম্বা হাত বাড়িয়ে। ফজল সরতে থাকে কোণের দিকে, ধরবার ভান করে। কিন্তু বাদল ওসব গ্রাহ্যের মধ্যেই নেয় না। আর নেবেই বা কেন? দিঘে পাশে কোনোটায়ই ফজল তার সমকক্ষ নয়। ফজল মাথা নুইয়ে কুলুপ দেয়ার ভান করে। আর সেই সময় তার মাথায় থাবা মারবার জন্য বাদল একটু বেশিই এগিয়ে যায়। অমনি ফজল তড়িৎগতিতে এগিয়ে গিয়ে বাদলের মাজায় ধরে ফেলে। বাদল কোস্তাকুস্তি করে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে ফজল তাকে শূন্যে তুলে ফেলেছে।

    চারদিকে হৈচৈ কলরোল। হাততালির চোটে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়।

    লখাই তাজা হয়ে ডু’ দিতে যায়। তার ডু’ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রেফারি খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

    চরের জনতা বেড়া গলিয়ে ছুটে আসে মাঠে। হৈ-হুঁল্লোড় করে তারা তাদের খেলোয়াড়দের ঘিরে ধরে। এক একজন খেলোয়াড়কে চার-পাঁচজনে মিলে মাথার ওপর তুলে নেয়।

    আক্কেল হালদারের ছোট ভাই তোয়াক্কেল হালদার এতক্ষণ দর্শকদের ভিড়ের মাঝে চুপটি মেরে ছিল। সে এসে বলে, খেলোয়াড়গ নিয়া চলো বাজারে। আইজ তারা আমাগ ইজ্জত বাঁচাইছে। তাগ এট্টু মিষ্টিমুখ করাইয়া দেই।

    সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খেলোয়াড়দের নিয়ে জলধর ময়রার দোকানে ঢোকে তোয়াক্কেল। ফজল আর কাদিরের জামা বগলে নিয়ে দেলোয়ার জনতার পেছনে পেছনে আসছিল। সে ও ঢুকে পড়ে দোকানে। ফজল তাকে আদর করে পাশে বসায়। বাইরে দাঁড়িয়ে জটলা করে বিশ-পঁচিশ জন হুজুগমত্ত ছেলে-ছোকরা।

    ময়রাকে তোয়ালে বলে, তোমার দোকানডা আইজ কিন্যা ফালাইমু আলইকর।

    তা কিন্যা ফলাওনা। আমারে শুদ্ধা কিন্যা ফালাও।

    হ কিনমু। এহন কও দেহি, কত ট্যাহার মিষ্টি আছে তোমার দোকানে।

    ময়রা হেসে বলে, কত আর অইব! দ্যাও তিরিশ ট্যাহা।

    তোয়াক্কেল তিনটা দশ টাকার নোট ময়রার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, নেও তিরিশ ট্যাহাই দিলাম। তুমি দিতে শুরু কর। আমাগ প্যাড ভরাইয়া বাইরের তাগও দিবা। দিয়া ফুরাইয়া ফালাইবা বেবাক।

    মিষ্টি খাওয়া শেষ করে রওনা হয় সবাই।

    কাদির আগে আগে চলছে। তার পেছনে চলছে ফজল দেলোয়ারের হাত ধরে।

    দেলোয়ার নিচু গলায় বলে, দুলাভাই আপনেরে বহুত দিন বিচ্‌রাইছি।

    ক্যান?

    বু আপনেরে যাইতে কইছে। হাশাইলের হাটে, দিঘিরপাড় হাটে কত বিচরাইছি আপনেরে!

    হাটে আসি নাই বহুদিন। নতুন চর লইয়া বড় ঝামেলার মইদ্যে আছি। চল, আজই ইমু তোমাগ বাড়ি।

    যাইবেন! ঠিক! দেলোয়ার খুশি হয়ে ওঠে।

    হ যাই। তোমাগ নায় জায়গা অইব তো?

    হ্যাঁ।

    ফজল একটু চিন্তা করে কাদিরকে ডাকে, ও কাদির।

    জ্বি।

    এত তাড়াতাড়ি যাইতে আছ ক্যান্? তোমায় বাড়ি যাইমু দেইখ্যা বুঝি পলাইতে আছ?

    না-না, কি যে কন! লজ্জা পেয়ে বলে কাদির। চলেন না যাই। আপনে তো আমায় বাড়ির পথ ভুইল্যাই গেছেন।

    তবে চলো দেখি, কাপুড়িয়া দোকানে।

    কাপড় কিনবেন নি?

    হ।

    নিতাই কাপড়ের দোকানে গিয়ে ফজল শ্যালকদের পছন্দমতো এক জোড়া নকশিপাড় শাড়ি কেনে। তার পরিধানের লুঙ্গিটা মাটিকাদা মেখে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। এটা পরে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। তাই নিজের জন্যও সে কেনে একটা মাদ্রাজি লুঙ্গি। তারপর গগন ময়রার দোকান থেকে এক পাতিল মিষ্টি কিনে তারা নৌকায় উঠে রওনা হয়।

    .

    ০৮.

    মোল্লাবাড়ির একমাত্র জামাই ফজল। শ্বশুরবাড়ির আদর-আপ্যায়নের মাত্রাটা তাই একটু বেশিই জুটত তার ভাগ্যে। তার আগমনে উৎসব শুরু হয়ে যেত মোল্লাবাড়ি। শ্বশুর-শাশুড়ি ব্যস্ত হয়ে উঠত–মুরগি জবাই করোরে, গুঁড়ি কোটরে, পিঠা বানাওরে! সে যে কত পদের পিঠা। কখনো বানাত পাটিসাপটা, বুলবুলি, ভাপা, কখনো বানাত ধুপি, চন্দ্রপুলি, চিতই, কখনো বা পাকোয়ান, শিরবিরন, বিবিখানা। চালের গুঁড়ি কুটে পিঠা বানাতে বানাতে রাতদুপুর হয়ে যেত। সে পিঠা তৈরির আসর আনন্দমুখর হয়ে উঠত গীত-গানে, কেচ্ছা-শোলকে।

    সাত-আট মাস আগেও একবার শ্বশুরবাড়ি এসেছিল ফজল। সেবারও উৎসব লেগে গিয়েছিল মোল্লাবাড়ি। জামাইয়ের আদর-যত্নের কোনো রকম ত্রুটিই হতে দেয়নি শ্বশুর-শাশুড়ি। ফজল দু’দিন ছিল সেখানে। শালা-শালীরা তাকে ঘিরে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ছিল দুদিন। ঠাট্টা-মশকরা, হাসি-হুল্লোড়ে তারা ভরে দিয়েছিল তার মন-প্রাণ।

    আজও এ বাড়িতে পা দেয়ার পর শালা-শালীরা ছুটে এসেছিল। এসেছিল কলরব করতে করতে, দুলাভাই আইছে, দুলাভাই আইছে!

    শালা-শালীরা হৈ-চৈ করতে করতে তাকে ভেতরবাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। বেঁকি বেড়ার কাছে পৌঁছতেই শোনা যায় শ্বশুরের গলা, অ্যাই দেলা, অতিথরে কাছারি ঘরে নিয়া বইতে দে।

    অন্দর থেকে ছেলে-মেয়েদের লক্ষ্য করে ধমক ছাড়ে সে আবার, অ্যাই পোলাপান, কিয়ের এত চিল্লাচিল্লি? বান্দরের খেইল আইছে, আঁ? যা, ঘরে যা শিগগির।

    ধমক খেয়ে সুড়সুড় করে চলে গিয়েছিল সবাই। তারপর আর একজনও আসেনি তার কাছে। যে দেলোয়ার এত আগ্রহভরে তাকে নিয়ে এল, তার মুখের হাসিও মিলিয়ে যায়। ফজল বুঝতে পারে, তার এ বাড়িতে আসায় খুশি হয়নি শ্বশুর। কিন্তু কেন? তার বাবা রূপজানের গয়না বন্ধক দিয়েছে সে জন্য? রূপজান তো চিঠিতে লিখেছিল, শ্বশুরের রাগ তার ওপরে নয়। কেন সে লিখেছিল এমন কথা? আর তাকে আসতেই বা লিখেছিল কেন এত মিনতি করে? কেন দেলোয়ারকে পাঠিয়েছিল হাটে-বাজারে তাকে খুঁজতে?

    রূপজানকে দেখার জন্য ব্যাকুল বাসনা রয়েছে তারও মনে। রূপজানের আকুল আহ্বান না পেলে তার সে বাসনা পথ খুঁজে পেত না। আসত না সে এ বাড়ি। দেলোয়ার হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে যায় কাছারি ঘরে। রূপজান কোন ঘরে কি করছে জানতে ইচ্ছে হয়েছিল ফজলের। কিন্তু জিজ্ঞেস করা আর হয়ে ওঠে না। সে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে।

    মোরগের ক্ব-ক্ব চিৎকার শোনা যায়। খোপ থেকে মোরগ টেনে বার করছে কেউ।

    মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুৎ চমকের মতো আনন্দ খেলে যায় ফজলের মনে। সে ভাবে, মোরগ জবাই করার আয়োজন হচ্ছে যখন তখন তার অনাদর হবে না নিশ্চয়।

    অন্দরে শ্বশুরের গলা শোনা যায় আবার, মোরগ ধরছে ক্যাডারে?

    কেউ উত্তর দিল কিনা শোনা গেল না।

    শ্বশুর আবার বলে, রাইতের বেলা ঘুমের মোরগ লইয়া টানাটানি শুরু করছে কাঁ? আল্লা রাইত দিছে ঘুমানের লেইগ্যা। ঘুমের পশু-পক্ষীরে কষ্ট দিলে আল্লার গজব পড়ে।

    মোরগের ক্ব-ক্ব আর শোনা যায় না। খোপের মোরগ খোপেই চলে গেছে, বুঝতে পারে ফজল।

    আবার মেঘ জমে তার মনে। বাড়ি চলে যাওয়ার কথা ভাবে সে। কিন্তু এত রাত্রে নৌকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে অবাঞ্ছিত মুসাফিরের মতো একা বসে থাকে কাছারি ঘরে।

    এর আগে যতবার সে এ বাড়িতে এসেছে প্রত্যেক বারই শ্বশুর-শাশুড়ি হাসিমুখে এগিয়ে এসেছে। সেও তাজিমের সাথে তাদের কদমবুসি করেছে। তাকে ভেতরবাড়ি নিয়ে গিয়ে তারা জিজ্ঞেস করেছে সকলের কুশল-বার্তা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছে জমাজমি আর ফসলাদির খবরাখবর। আজ তাদের আলাঝিলাও দেখতে পায়নি সে। তাই কদমবুসি করার সুযোগও হয়নি। দেলোয়ার হারিকেন দিয়ে সেই যে গেছে আর একবারও আসেনি তার কাছে। সে এলে তাকে সাথে করে সে অন্দরে গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির কদমবুসি করে আসতে পারত।

    ঢুকুর-ঢুক্ আওয়াজ আসছে পেঁকির। ধান ভানার শব্দ। দ্রুততালের মৃদু শব্দ হলে বোঝা যেত পিঠের জন্য চালের গুঁড়ি কোটা হচ্ছে। পেঁকিটা যে রকম বিলম্বিত তালে ওঠা-নামা করছে তা থেকে সহজেই বুঝতে পারে ফজল, চেঁকিতে পাড় দিচ্ছে শুধু একজন। রূপজান নয় তো!

    ফজল উঠে অন্দরমুখী দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার চোখ দুটো খুঁজে বেড়ায় একটি মুখ। কিন্তু কোনো ঘরের খিড়কি-জানালা দিয়েই সে মুখ দেখা যায় না। ঢেঁকিঘরে কোনো খিড়কি নেই। সেখানে আছে কিনা কে জানে? পশ্চিমভিটি ঘরের বারান্দায় শুধু দেলোয়ারকে দেখা যায়। সে স্কুলের পড়া তৈরি করছে বোধ হয়।

    নিঃশব্দ পায়ে ফজল সেদিকে এগিয়ে যায়। জানালার পাশে গিয়ে নিচু গলায় ডাকে, দেলু।

    জ্বী।

    তোমার বু’ আছে এই ঘরে?

    না।

    ঢেঁকিঘরে আছে?

    উঁহু, সে পাকের ঘরে, মা-র লগে রানতে লাগছে।

    মিয়াজি কোন ঘরে?

    উত্তরের ঘরে।

    আমারে নিয়া চলো দেখি, মিয়াজিরে সেলাম কইর‍্যা আসি।

    দেলোয়ারের পেছনে পেছনে উত্তরভিটি ঘরে ঢোকে ফজল।

    আরশেদ মোল্লা বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিল। শব্দ পেয়ে সে মাথা তুলে তাকায়।

    আস্‌লামু আলাইকুম। ফজলের সশ্রদ্ধ সালাম।

    আরশেদ মোল্লা সালামের জবাব দেয় না।

    কদমবুসি করার জন্য ফজল তার পায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই সে পা গুটিয়ে বসে পড়ে। হাত নেড়ে বলে, উঁহু উঁহু দরকার নাই। এই পাও ধরলে লাভ অইব না। যাও নিকারি-কৈবর্তের পায়ে ধর গিয়া। দুইডা পয়সা উৎপন্ন অইব।

    ধক করে ওঠে ফজলের বুক। তার মুখ কালো হয়ে যায়। সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় সেখানে। কাছারি ঘরে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে চৌকির ওপর।

    এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে কুয়াশা। তার মাছ বেচার কথা জেনে ফেলেছে শ্বশুর। আর এ জন্যই এ বাড়িতে উল্টো হাওয়া বইছে আজ।

    আর একদও এ বাড়িতে থাকা চলে না। ফজল বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে। নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালে হয় তো ধরতে পারবে কোনো নৌকা।

    .

    কাছারি ঘর থেকে বেরিয়ে কিছু দূর গিয়েই সে থমকে দাঁড়ায়। তার কুঁকড়ে-যাওয়া মন হঠাৎ চিড়বিড়িয়ে ওঠে–এভাবে চুপিচুপি চোরের মতো কেন যাবে সে? এটা তো মরদের কাজ নয়। সে কি চুরি-ছ্যাচড়ামি করেছে, না ডাকাতি বাটপাড়ি করেছে। সে করছে হালাল রুজি। এতে শ্বশুরের রাগ হওয়ার কি আছে? তার রাগের মাখা তামুক কে খেতে চায়? শুধু একজন রাগ না হলেই হয়। সে যদি বাধ্য থাকে তবে কারো তোয়াক্কা সে করে না। আজই–এই রাতেই রূপজানের সাথে বোঝাঁপড়া করবে সে।

    সে কাছারি ঘরে ফিরে এসে দেখে দেলোয়ার খাবার আনতে শুরু করেছে।

    আগে ভেতর বাড়িতেই তার খাবার দেয়া হতো। সামনে বসে পরিবেশন করত শাশুড়ি, নয় তো রূপজান। আজকের অবস্থা বিবেচনা করে এ ব্যবস্থায় আশ্চর্য হয় না সে।

    তার খিদে নেই তেমন। বেশি মিষ্টি খেয়ে তার মুখটা কেমন বাই-বাইতা করে। পেটের ভেতরেও কেমন বেতাল ভাব। ঝাল তরকারি দিয়ে দুটো ভাত খেলে হয়তো সে ভাবটা কেটে যেত। কিন্তু এ বাড়ির তেতো আবহাওয়ায় তার খাবার ইচ্ছে একেবারেই মরে গেছে। তবুও সে খেতে বসে। কিছু না খেলে আবহাওয়াটা হয়তো আরো তেতো, আরো বিষাক্ত হয়ে উঠবে।

    কৃষক পরিবারের নিত্যকার খাবার ডাল, ভাত, মাছের সালুন। কোনো বিশেষ পদ তৈরি হয়নি জামাইয়ের জন্য। ফজল নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুটো মুখে দিয়ে খাওয়া শেষ করে।

    দেলোয়ার মিষ্টিও নিয়ে আসে। তারই আনা মিষ্টি। ফজল বলে, মিষ্টি এত খাইছি আইজ! প্যাডের মইদ্যে মিষ্টির চর পইড়া গেছে। ওগুলা লইয়া যাও।

    মিষ্টি খেয়ে দেলোয়ারেরও একই অবস্থা। তাই আর সাধাসাধি না করে সে মিষ্টির থালা নিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই সে কথা-বালিশ এনে ধপাৎ করে ফেলে চৌকির ওপর।

    শব্দটার প্রতিশব্দ হয় ফজলের বুকের ভেতর।

    দেলোয়ার বিছানা পেতে দিয়ে চলে যায়। ফজল কাঁথা আর বালিশটার দিকে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে।

    আগে শ্বশুরবাড়ি এলে তার শোয়ার ব্যবস্থা হতো অন্দরের কোনো নিরালা ঘরে। সেখানে। থাকত পাশাপাশি দুটো বালিশ। দোসরহীন বালিশটা যেন মুখ লুকিয়ে কাঁদছে আজ।

    ফজল বসে বসে বিড়ি টানে। তার নাক আর মুখ দিয়ে গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরোয়। তার বুকের ভেতর জ্বলছে যে ক্ষোভের আগুন, এ যেন তারই ধোয়া।

    সে উঠে পায়চারি করে এদিক-ওদিক। ঢেঁকিঘর থেকে এখনও ধানভানার শব্দ আসছে।

    হারিকেনের আলো যথাসম্ভব কমিয়ে দিয়ে অন্দরমুখি দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় ফজল। উত্তর ও পশ্চিমভিটি ঘরে বাতি জ্বলছে।

    কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে দুটো বাতিই নিবে গেল। তাকে উপহাস করে যেন মুখ লুকাল অন্ধকারে।

    ফজল দরজা দুটোয় খিল লাগিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। হাত বাড়িয়ে হারিকেনটা নিবিয়ে দেয়।

    একটা সম্ভাবনা হঠাৎ উঁকি দেয় তার মনে। সে উঠে পড়ে। অন্ধকার ঘর অন্ধের মতো । হাতড়াতে হাতড়াতে গিয়ে সে অন্দরমুখি দরজাটার খিল খুলে রেখে আসে।

    সম্ভাবনাটা তার অন্তরের উমে রূপান্তরিত হয় নিশ্চিত বিশ্বাসে। আর সে বিশ্বাসের ওপর ভর দিয়েই চলে তার প্রতীক্ষা।

    কিন্তু আসছে না কেন রূপজান? এখনো কি সবাই ঘুমোয়নি? ভারাভানুনি এখনো ধান ভানছে পেঁকি ঘরে। বোধহয় তার জন্যই আসতে পারছে না।

    ঢেঁকিটা যেন কিছু বলছে। কি বলছে? ফজল শুনতে পায়–ওটা বলছে, আসি গো আসি, আসি গো আসি।

    রাত অনেক হয়েছে। টেকির শব্দ আর শোনা যায় না। ফজল অধীর প্রতীক্ষায় এ-পাশ ও-পাশ করে।

    এখনও দেরি করছে কেন রূপজান? ঘুমিয়ে পড়েনি তো?

    উঁহু কিছুতেই না। মনে মনে বলে সে। চউখের দেখা দেখনের লেইগ্যা পরান যার ছটফট করে, তার চউখে কি ঘুম আইতে পারে?

    তার মনে হয়, রূপজান জেগেই আছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না বেরুবার।

    সে বিছানা ছেড়ে খালি পায়ে ঘর থেকে বেরোয়। পা টিপে টিপে পশ্চিম ভিটি ঘরের দক্ষিণ পাশের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে হয়তো এ ঘরেই শুয়ে আছে রূপজান।

    আধ-ভেজানো জানালার ফাঁক দিয়ে সে তাকায় ভেতর। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে সব একাকার। তার দৃষ্টি হারিয়ে যায় সে অন্ধকারে। সে মৃদু শিস দেয় বারকয়েক। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।

    ফজলের মনে হয় রূপজান এ ঘরে নেই। থাকলে জেগেই থাকত সে। এ অন্ধকারেও তার নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যেত। আর হয়তো পাওয়া যেত রেশমি চুড়ির মিষ্টি রিনিঠিনি আওয়াজ।

    উত্তরভিটি ঘরেই তাহলে শুয়েছে রূপজান। কিন্তু সে ঘরের বারান্দায় থাকে শ্বশুর। সে-দিকে যেতে তাই সাহস হয় না তার। নিরাশ মনে কাছারি ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য সে পা বাড়ায়। এমন সময় শোনা যায় হালকা আওয়াজটুক-টুক-টুক। কাঠ বা অন্য কিছুর ওপর টোকা দেয়ার শব্দ।

    আনন্দ-শিহরণে কেঁপে ওঠে তার সমস্ত শরীর। সে তাড়াতাড়ি টিনের বেড়ায় আঙুলের টোকা দেয় তিনবার। কোনো সাড়া না পেয়ে সে আবার টোকা দেয়। কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কিন্তু প্রত্যাশিত ঠকঠক আওয়াজ আর শোনা যায় না।

    তার মনে সন্দেহ জাগে–এ কি রূপজানের সঙ্কেত? না আর কিছু শব্দ? টিকটিকির শিকার ধরে আছাড় মারার শব্দ নয়তো?

    জানালাটা আরো একটু ফাঁক করার জন্য সে একটা পাট ভেতরের দিকে ঠেলে দেয় আর অমনি ক্রুদ্ধ আওয়াজ শোনা যায়, কোঁ-ওঁ-ওঁ।

    সে লাফ দিয়ে পিছিয়ে যায় ভয়ে। তার এক পায়ে কাঁটা ফুটে যায় কয়েকটা। কাঁটাযুক্ত শুকনো ডালটা সে টান দিয়ে খুলে ফেলে। একটা কাঁটা বোধহয় ভেঙে রয়েই গেল।

    আচমকা ভয়ে পিছিয়ে গেলেও সাথে সাথেই ফজল বুঝতে পেরেছিল, ক্রুদ্ধ আওয়াজটা একটা উমে-বসা মুরগির। সে আবার জানালার কাছে ফিরে যায়। দৃষ্টি ফেলে ঘরের ভেতর। এবারেও কিছুই ধরা দেয় না চোখে।

    তাকে চমকে দিয়ে আবার সেই আওয়াজ হয়–ঠুকঠুকঠুক। কিন্তু সেই সাথে শোনা যায় চিঁও চিঁও ডাক। ডিম ফুটে মুরগির বাচ্চা বেরুচ্ছে।

    ঠুক-ঠুক শব্দটা কিসের এতক্ষণে ধরতে পেরেছে ফজল। হতাশায় ভারাক্রান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে সে ফিরে যায় কাছারি ঘরে। কলসিতে রাখা অজুর পানি দিয়ে পা ধুয়ে সে শুয়ে পড়ে।

    কাঁটাটা বড় যন্ত্রণা দিচ্ছে পায়ে। বরই কাঁটা বোধ হয়। তাই এত ব্যথা করছে। এটা খুলতে না পারলে ঘুম আসবে না আজ। ফজল উঠে হারিকেন ধরায়। কিন্তু কি দিয়ে খুলবে কাটা? নখ দিয়ে সরু করা ম্যাচবাতির কাঠি দিয়ে সে খোঁচায় চামড়ার ওপর। কিন্তু চার পঁচটা কাঠি ধ্বংস করেও কাঁটার নাগাল পাওয়া যায় না।

    কিসের সামান্য একটু শব্দ শুনে মাথা তোলে ফজল। একটা পাটশলা পুবদিকের জানালা দিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। বাঁ হাতে পাটশলাটা ধরে সে জানালার দিকে তাকায়। একটা হাত আবছায়ার মতো সরে গেল।

    ফজলের মনের বীণায় আনন্দের সুর বেজে ওঠে। আর সেই সুরের সাথে নেচে ওঠে তার দেহের সমস্ত অণু-পরমাণু।

    মনের উল্লাস গোপন করে সে হাসিমাখা মুখে চেয়ে থাকে জানালার দিকে। অনুচ্ছ স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলে, এত রাইতে আর রংটং করণ লাগব না। আসনের ইচ্ছা থাকলে আইসা পড় শিগগির। দেরি করলে কিন্তু কপাটে খিল লাগাইয়া থুইমু।

    জানালা থেকে দরজার দিকে চোখ ফেরাবার সময় তার নজর পড়ে হাতের পাটশলার দিকে। ওটার আগায় একটা সাদা বেলোয়ারি পুঁতি। পুঁতিটা ধরতেই পাটশলাটার ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসে একটা খোঁপার বেলকুঁড়ি কাঁটা।

    আনন্দের সুর ছাপিয়ে হঠাৎ বেজে ওঠে করুণ সুর। তার মনের গহনে সমাহিত একটা পুরাতন স্মৃতি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ঠিক এমনি একটা খোঁপার কাঁটা দিয়ে তার পায়ের কাঁটা তুলে দিয়েছিল জরিনা।

    সারদা আইনের বছর। বাংলা ১৩৩৬ সাল। সবার মুখে এক কথা–আইন পাশ হয়ে গেলে ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদি দেয়া মুশকিল হবে। তাই বিয়ের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল দেশে। সদ্যোভূমিষ্ঠ অনেক ছেলে-মেয়েরও বিয়ে হয়েছিল সে সময়। দুই পেটের অজাতশিশুর বিয়ের ঘটকালির নজিরও নাকি আছে প্রচুর। সেই সময়ে ফজলের সাথে বিয়ে হয়েছিল জরিনার। ফজলের বয়স তখন এগারো আর জরিনার দশ। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই জরিনা হাতে-পায়ে বেড়ে উঠল। তার সারাদেহে নেমে এল যৌবনের ঢল। আর ফজলের তখন গোঁফের রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তারপর একদিন। ফজল তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র কয়েকদিন বাকি। রাত জেগে পড়া তৈরি করছিল সে। জরিনা ঐ সময়ে ঢুকে পড়েছিল তার পড়ার ঘরে। তার খোঁপা থেকে বেলকুঁড়ি খুলে সে ফজলের পায়ের কাঁটা তুলে দিয়েছিল। কাঁটা তোলার সময় তার পা-টা ছিল জরিনার কোলের ওপর। আর ঐ অবস্থায় তাদের দেখে ফেলেছিল ফজলের বাবা।

    গুরুতর ভাবনায় পড়ে যায় এরফান মাতব্বর। তার মনে হয় সেয়ানা বউটা নষ্ট করে ফেলবে তার আবাত্তি ছেলেটাকে। ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবে। আর ওকে দূর না করলে ছেলের পড়াশুনা একেবারেই হবে না। ছেলে বই সামলাবে, না বউ সামলাবে?

    কয়েকদিনের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করে ফেলে এরফান মাতব্বর। জরিনাকে আবার বিয়ে দিতে যে খরচ লাগবে সে বাবদ কিছু টাকা সে জরিনার ভাইয়ের হতে গুঁজে দেয়। তারপর একদিন ফজলকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে খেজুরগাছ-কাটা চকচকে ধারালো দা হাতে নিয়ে মাতব্বর গর্জে ওঠে, অ্যাদে ফউজ্যা, ছ্যান দেখছস? তালাক দে, কইয়া ফ্যাল–তিন তালাক বায়েন। তেড়েংবেড়েং করলে তিরখণ্ড কইর‍্যা ফালাইমু।

    নিতান্ত নিরুপায় ফজল উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়েছিল, তিন তালাক বায়েন।

    সেদিনই রাগে দুঃখে ফজল বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। নিরুদ্দেশ হয়ে ছিল তিন মাস। সেই থেকে তার লেখা-পড়ারও ইতি ঘটেছিল।

    স্মৃতিটাকে নির্মম শক্তিতে দাবিয়ে দেয় ফজল। আজকের এ আনন্দঘন মুহূর্তে একে কোনো রকম প্রশ্রয় দিতে রাজি নয় তার মন। মৃত অতীত মনের গহ্বরে চাপা পড়ে থাক। পড়ে থাক গহন অন্ধকারে।

    খোঁপার কাঁটাটা দিয়ে ফজল পায়ের কাঁটাটা তুলে ফেলে। আর ওটা তুলবার সময় ছলছল করে তার চোখ দুটো।

    খোঁপার কাঁটাটা দিয়ে পালালো কোথায় রূপজান? সে নিশ্চয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে আলো জ্বলছে, তাই বোধ হয় সে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।

    ফজল হারিকেনটা নিবিয়ে দেয়। ঘুমের ভান করে সে পড়ে থাকে বিছানায় আর মাঝে মাঝে বালিশে চিবুক রেখে দৃষ্টি ফেলে অন্ধকারে অদৃশ্য ভেজানো দরজার ওপর।

    সময় এগিয়ে চলছে। চলছে ফজলের মনের ওপর দিয়ে আশা-নিরাশার মই টেনে। বারবার মাথা তুলতে গিয়ে তার ঘাড়ে ব্যথা ধরে গেছে। ক্লান্ত হয়েছে চোখ দুটো।

    ফজল অস্থির হয়ে ওঠে। চঞ্চল হয় রক্তস্রোত শিরা-উপশিরায়। নিজেকে সে আর বিছানায় ধরে রাখতে পারে না। সে উঠে বসে। মনে মনে ভাবে–রূপজান তো এমনিতেই লজ্জাবতী লতা। এতদিনের অসাক্ষাতে লজ্জার মাত্রাটা হয়তো আরো বেড়ে গেছে। তাকে দেখলে লজ্জায় দৌড় মারবে নাতো সে? নাহ, তাকে কোনো মতেই পালাবার সুযোগ দেয়া যায় না। সে বাইরমুখি দরজার খিল নিঃশব্দে খুলে নিশ্রুপে বেরিয়ে যায়। কাছারি ঘরের পশ্চিম পাশ দিয়ে গিয়ে বেঁকিবেড়ার আড়াল থেকে সে উঁকি মারে। নাহ! রূপজানের আলাঝিলাও দেখা যায় না উঠানে। তবে কি সে কাছারি ঘরের পুবপাশে আছে? পুবদিকের জানালা দিয়েই তো সে পাটশলাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।

    ফজল উঠান পার হয়ে ঢেঁকিঘরের উত্তরপাশ ঘুরে পুবপাশ দিয়ে আলগোছে পা ফেলে এগিয়ে যায়।

    একটু দূরেই কাছারি ঘরের পুব পাশে ঘন অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তির আভাস পাওয়া যায়।

    হ্যাঁ, ঐ তো রূপজান বসে রয়েছে। তাকে দেখে পালিয়ে যাবে নাতো আবার! এত চোখপলানি খেলা ভালো লাগে না তার।

    ফজল পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়। কিন্তু রূপজান নড়ছে না তো একটুও! নড়লে আন্দোলিত হতো কালো অন্ধকার। বোধ হয় কাছারি ঘরের দিকে চোখ তার। তাকে ঘর থেকে বেরুতে দেখেনি তো? দেখলে সে এরকম নিশ্ৰুপ বসে থাকত না। উঠে দাঁড়াত অন্তত।

    ফজল নিঃশব্দে এগিয়ে যায়, পেছন থেকে বেঁধে ফেলে তাকে দুই বাহুর আবেষ্টনীতে।

    মূর্তিটি গা মোচড়ামুচড়ি করে। দুহাত দিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করে নিজেকে।

    আরে এমুন করতেছ ক্যান্?

    ফজল তাকে পাজাকোলা করে নেয়। চুমোয় চুমোয় ভরে দেয় তার ঠোঁট, দুটি গাল। নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করছে না আর সে এখন।

    ফজল তাকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। নিবিড় করে বুকে টেনে নিতে নিতে ফিসফিস করে সে বলে, বাপের বাড়ির ভাতে রস নাই? কেমুন হুগাইয়া গ্যাছ মনে অইতাছে!

    এই কি! কাঁপতে আছ ক্যান্ তুমি? কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে ফজল।

    প্রেমিকের বুকের সাথে আরো নিবিড় হয়ে মিশে যায় প্রেমিকা। নবম হাত দিয়ে গলা জাপটে ধরে তার। কিন্তু তবুও তার কাঁপুনি থামে না, কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে।

    ফজল তার গালে চুমো এঁকে দিয়ে বলে, কথা কওনা ক্যান, আঁ? তোমারে কি ডরে ধরছে? কিসের ডর আঁ? এত রাইতে আর কেও জাগব না। আর জাগলেই বা কি। আমি কি অন্য মাইনষের বউ লইয়া হুইয়া রইছি?

    একটু থেমে আবার সে বলে, আইজ ভারি কষ্ট দিছ। খোঁপার কাঁটাডা দিয়া আবার পলাইয়া রইছিলা ক্যান, আঁগো? কি, মুখ বুইজ্যা রইছ যে! একবারও তো জিগাইলা না, কেমুন আছি?

    এবারও কোনো জবাব পায় না ফজল। বুকের সাথে এক হয়ে মিশে যেতে চাইছে যেন তার প্রিয়া। তার গলায় মুখে সে চুমো দিচ্ছে বারবার।

    ফজলের চঞ্চল রক্ত আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে। সারা দেহে জাগে পুলক-শিহরণ । তার ডান হাত কাপড়ের জঞ্জাল সরিয়ে অবতরণ করে প্রিয়ার দেহভূমিতে।

    কিন্তু এরকম লাগছে কেন? এ কোন চরে নেমেছে সে? তাকে কি কানাভুলায় পেয়েছে? পথ ভুলিয়ে নিয়ে এসেছে অন্য চরে?

    সন্দেহ জাগতেই হাতের পাঁচটি খুদে অনুচর একজোট হয়ে জরিপ করতে লেগে যার চরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।

    তাইতো! এ চরটা তো তার পরিচিতি নয়! এর আকার-আয়তন চড়াই-উত্রাই, হালট ঢালট, খাজ-ভাঁজ তার অচেনা।

    ফজল এবার স্পষ্ট বুঝতে পারে এ রূপজান নয়। সে বলে ওঠে, কে? কে তুমি?

    কোন জবাব পাওয়া যায় না। তার মুখের ভাষা যখন মুক, তখন তার দেহের ভাষা মুখর। হয়ে উঠেছে। তার অঙ্গে অঙ্গে সার্বজৈবিক ভাষার কলরব।

    ফজলের ব্যস্ত হাতটি বালিশের তলা থেকে ম্যাচবাতি বের করে। সে কাঠি খুলে ধরাতে যাবে অমনি একটা হাতের ঝটকা খেয়ে তার হাত থেকে ম্যাচবাতিটা ছিটকে পড়ে যায়। কাঠিগুলো শব্দ করে ছড়িয়ে যায় মেঝের ওপর। তার হতভম্ব হাতটি অন্য একটি হাতের আমন্ত্রণে ফিরে যায় কিছুক্ষণ আগের পরিত্যক্ত জায়গায়।

    দুটি কবোষ্ণ ঠোঁট ফজলের ঠোঁটে গালে সাদর স্পর্শ বুলায় বার-বার। তার সারা দেহে সঞ্চারিত হয় বাসনা-বিদ্যুৎ। রক্তে জাগে পরম পিপাসা।

    শয্যাসঙ্গিনী তাকে অনাবৃত বুকের ওপর টেনে নেয়। ফজল বাধা দেয় না বরং এগিয়ে দেয় নিজেকে। সে ভুলে যায় ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়। ভুলে যায় নিজের নাম পরিচয়। এ মুহূর্তে তার কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই। এখন সে শুধু একটি পুরুষ। তার দেহ অতিথি হয়েছে যে দেহের, তা শুধুই একটি রমণীর। তারও কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই। এ মুহূর্তে পরিচয়ের কোনো প্রয়োজনও বোধ করে না তারা। দুটি নর-নারী। আদিম রক্তবাহী দুটি দেহ। রক্ত-মাংসের অমোঘ দাবির কাছে তারা পরাজয় মানে। এক দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সাথী খুঁজে পায় অন্য দেহে। তারা মগ্ন হয় উচ্ছল আলাপনে, এক হয়ে দোলে তরঙ্গের দোলায়।

    কালো রাত্রি তখন চোখ বুজে প্রহর গুনছে।

    ফজল লুঙ্গিটা খুঁজে নিয়ে কোমরে জড়ায়। শুয়ে থাকে বিছানার এক পাশে। কি রকম একটা অশুচিতায় ছেয়ে গেছে তার আপাদমস্তক। পাপ-চিন্তায় বিব্রত তার মন।

    সে সন্তর্পণে চৌকি থেকে নামে। নিঃশব্দে মেঝে হাতড়িয়ে বেড়ায় অন্ধকারে। কিছুক্ষণ খোঁজার পর ম্যাচবাক্সটা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় একটা কাঠিও। সে শিয়রের কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঠিটা ধরায়।

    চিৎ অবস্থায় শায়িত তিমির-সঙ্গিনী হকচকিয়ে ওঠে। সে মুখ ঢেকে ফেলে এক হাতের দাবনায়। অন্য হাতে আঁচল টেনে বুক ঢাকে, ঠিকঠাক করে বেশবাস।

    এক হাতে জ্বলন্ত কাঠিটা ধরে ফজল অন্য হাত দিয়ে তার মুখের ওপর থেকে জোর করে হাতটা সরিয়ে দেয়।

    কে! কে!! জরিনা! জরু! জরু!!

    পলাতক অতীত ফিরে আসে। সাত বছরের বিচ্ছেদ-প্রাচীর ডিঙিয়ে সে অতীত আশ্রয় খোঁজে বর্তমানের বুকে। ফজল নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সে জ্বলন্ত কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বিছানায় উঠে সে নিবিড় করে জরিনাকে বুকে টেনে নেয়। সে বুকের ভেতর তোলপাড় করছে আবেগ ও বেদনার বাম্প।

    পুঞ্জীভূত বেদনা গুমরে মরছে জরিনারও বুকের ভেতর। সেই বুকের দ্রুত ওঠা-নামা অনুভব করতে পারে ফজল। রুদ্ধ কান্না বক্ষপঞ্জর ভেদ করে বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইছে।

    সে পরম স্নেহে জরিনার পিঠে, মাথায় হাত বুলায়। বেদনার্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, জরিনা–জরু–জরু, তুমি এই বাড়িতে কবে আইছ? ক্যান আইছ?

    জরিনা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার চোখের পানিতে ফজলের কাঁধ ভিজে যায়।

    ফজল শঙ্কিত হয়। এখনই হয় তো গলা ছেড়ে কেঁদে উঠবে জরিনা। সে শাড়ির এক অংশ টেনে নিয়ে তার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, জরিনা, লক্ষ্মীসোনা কাইন্দ না। চলো তোমারে আউগ্যাইয়া দিয়া আসি।

    জরিনা আরো নিবিড় করে ফজলের গলা জড়িয়ে ধরে। তার ফোঁপানির শব্দ আরো স্পষ্টতর হয়।

    জরু, জরু, অবুঝের মতো কইর‍্য না। কেও টের পাইলে কেলেঙ্কারি অইয়া যাইব।

    ফজল তাকে টেনে তোলে। বাহুবেষ্টনীতে বেঁধে, মাথায় মুখে সস্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে তাকে সে সামনের দরজায় নিয়ে যায়। তারপর দরজা খুলে একরকম জোর করেই তাকে বের করে দেয় সে।

    জরিনা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ফজল দাঁড়িয়ে থাকে খোলা দরজার মুখে। তার এক হাতে ছিল স্নেহ-প্রীতির স্নিগ্ধ পরশ। আর অন্য হাতে? অন্য হাতে ছিল নিরেট নিষ্ঠুরতা। সে নিষ্ঠুরতা এখন শত হাতে তার বুকে আঘাত হানছে। আঘাতে আঘাতে বেদনার বাম্প গলে দরদর ধারায় তার দুগাল বেয়ে পড়তে থাকে।

    নিকষ কালো অন্ধকার। জরিনা পা টিপে টিপে ফিরে আসে চেঁকিঘরে। বলতে গেলে গেরস্তের চেঁকিঘরই তার আশ্রয় আজকাল। চেঁকিই তার অন্নদাতা।

    মেঝেতে মাদুর একটা বিছানোই ছিল। সে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। সে চোখের পাতা বন্ধ করে। আর সাথে সাথেই সক্রিয় হয়ে ওঠে তার মনের চোখ। সে চোখের পাতা নেই। সে চোখ বন্ধ করা যায় না। সে চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতীতের দৃশ্যপট। পটের নিশ্চল ছবিগুলো আবার চলতে শুরু করে একের পর এক।

    একটি মেয়ে। বয়স তার দশ হবে কি হবে না। তাকে ঘিরে বসে গীত গাইছে বোন বেয়ান-ভাবির দল, এমন সোন্দর বইনডি আমার পরে লইয়া যায়।

    নতুন বাক্স ভরে আসে নতুন শাড়ি-সেমিজ, সোনা-রূপার নতুন গয়না। চাচি-ফুফু খালারাও আসে। তাকে তারা সাজায় মনের মতো করে। আসে সাক্ষী-উকিল। তারা কবুল আদায় করে, শরবত দেয়।

    পরের দিন ভোর বেলা। পালকি আসে উঠানে। মেয়েটিকে কোলের ওপর নিয়ে বসে আছে তার দাদি। কারা সব বলে, যাও, কোলে কইরা লইয়া যাও দেহি কেমনতরো জুয়ান। যাও, নিজের জিনিস, শরম কি?

    কৌতূহলী মেয়েটি টান দিয়ে সরিয়ে ফেলে বিরক্তিকর লম্বা ঘোমটাটা। একটা ছেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ছেলেটি তারই বয়সী বা তার চেয়ে বড়জোর বছর খানেকের বড় হবে। রেশমি আচকান তার পরনে। মাথায় ঝলমলে জরির টুপি।

    দাদির কোল থেকে তাকে তুলবার চেষ্টা করে ছেলেটি। মেয়েটি তাকে হাতের ঝটকায় সরিয়ে দেয়।

    হো-হো-করে হেসে ওঠে উঠানভর্তি লোকজন।

    আবার আসে ছেলেটি। আবার তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সে। দাদি তার কানে কানে বলে, যাও সোনাবইন। আল্লার নাম লইয়া পালকিতে গিয়া ওড।

    পালকিতে! এতক্ষণ কও নাই ক্যান্। বারে কি মজা!

    মেয়েটি দাদির কোল থেকে ঝটকা মেরে বেরিয়ে এক দৌড়ে গিয়ে ওঠে পালকিতে। হাসি আর হাততালির হট্টগোল ওঠে চারদিক থেকে।

    ছেলেটি পালকিতে ওঠে। বসে মেয়েটির মুখোমুখি হয়ে। পালকি চলে। সুর করে সারি গাইতে গাইতে চলছে বেহারারা–

    আল্লা-হা ব-লো
    জোরে–হে চ-লো,
    বিয়া খাইয়া বল অইছে
    জোরে–হে চ-লো,
    ইনাম মিলব দশ টাকা
    হুঁশে–হে চ-লো,
    সামনে আছে কলই খেত
    কোনা-হা কা-টো।
    পায়ের তলে মান্দার কাঁটা
    দেইখ্যা হাঁ-টো।

    বিয়েটা যে কী ব্যাপার, স্পষ্ট কোনো ধারণাই ছিল না জরিনার। বিয়ের দিনের ঘটনা নিয়ে কতজনে কত ঠাট্টা করত তাকে।

    আর স্বামী কাকে বলে তা-ও কি সে জানত তখন! একটা ছবি মনে ভাসতেই হাসি পায় তার।

    ঈদের দিন। ফজল আসে তাদের বাড়িতে। আসে ঠিক নয়। নতুন বাচ্চা জামাইকে সাথে করে নিয়ে আসে তার বাবা। পাশাপাশি খেতে বসে সে ও ফজল। পরিবেশন করে তার মা। ফজলের পাতের দিকে আড়চোখে চেয়ে গাল ফুলিয়ে উঠে পড়ে জরিনা। বলে, আর এক বাড়ির এক ছ্যামড়া আইছে। তারেই কেবুল বেশি বেশি দিতে আছে।

    জরিনার মা চোখ রাঙায়, এই জরিনা, চুপ।

    চুপ করমু ক্যান্? ওরে আমার রাঙা মোরগার কল্লাডা দিছ, রান দিছ। আর আমারে দিছ দুইডা আড়ডি।

    এই মাইয়া! ছি! ছি! চোখ রাঙায় তার মা।

    ফজল নিজের থালা থেকে রানটা তুলে দেয় জরিনার থালায়।

    জরিনা আবার ফুঁসে ওঠে, ইস! আর একজনের পাতের জুডা খাইতে বুঝিন আক্ কইর‍্যা রইছি আমি।

    বাতে শয্যাগত বুড়ি দাদি পাশের ঘর থেকে টিপ্পনি কাটে, বিয়ার দিনতো আ কইর‍্যা আছিলি। আধা গেলাশ শরবত হেঁচার মতন এক চুমুকে গিল্যা ফালাইছিলি! নিজের পুরুষের জুডা খাইতে ঘিন্না কিলো আঁ?

    পরে দাদি তাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে অনেক কথা বলেছিল, অনেক উপদেশ দিয়েছিল। কি যে সব বলেছিল তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি তখন। তারপরেও তারা দু’জন একসাথে খেলেছে চোখপলানি, নলডুবি, ঝগড়া করেছে, মারামারি করেছে। তাদের কাণ্ড দেখে হেসেছে বাড়ির লোকজন, আত্মীয়-প্রতিবেশী।

    ফজল ও জরিনা বেড়ে ওঠে। সেই সাথে বেড়ে ওঠে তাদের লজ্জা আর সঙ্কোচ। শেষ হয় একসাথে খেলাধূলা। ফজলকে দেখলেই জরিনার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে সলাজ হাসি। সে দৌড়ে পালায়। ফজলের হাস্যোজ্জ্বল চোখ দুটো পিছু ধাওয়া করে তার।

    কিন্তু লজ্জা ও সঙ্কোচ যত বাড়তে থাকে তত বাড়তে থাকে একজনের প্রতি আর একজনের আকর্ষণ।

    পনেরোয় পা দিয়ে জরিনা গায়ে-গতরে বেড়ে ওঠে লকলকিয়ে। জরিনার শ্বশুর এরফান মাতব্বর চিন্তিত হয়। কারণ মেয়ের অনুপাতে ছেলে বড় হয়নি। আর ফজল তখন স্কুলে পড়ে। এ সময়ে বউয়ের আঁচলের বাও যদি ছেলের গায়ে লাগে একবার, তবে কি আর উপায় আছে? লেখাপড়া একেবারে শিকেয় উঠে যাবে।

    জরিনার বাবা-মা তখন মারা গেছে। তার ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে এরফান মাতব্বর। ঠিক হয়–ফজল ম্যাট্রিক পাশ না করা পর্যন্ত জরিনা ভাইয়ের বাড়িতে থাকবে। সেখানে ফজলও যেতে পারবে না। শুধু উৎসব-পরবে তারা দু-একদিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসা করতে পারবে। ফজল দিঘিরপাড় স্কুলে পড়ত। তার স্কুলে যাওয়ার পথে পড়ত শ্বশুরবাড়ি। তাকে সে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো আট মাইল দূরের নড়িয়া হাই স্কুলে। তার জন্য জায়গিরও ঠিক হলো সেখানের এক বাড়িতে।

    কিছু ফুল যখন পাপড়ি মেলে তখন মধুকর টের পায়। দীর্ঘ পথের বাধা-বিঘ্ন তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। তুচ্ছ মনে হয় কাটার ভয়।

    জরিনা পাশ ফিরে শোয়। স্মৃতি-কোঠার দরজা খুলে যায় আবার। দুপুর বেলা। দাওয়ায় বসে একটি তরুণী ফুল-সুপারি কাটছে। হঠাৎ শোনা যায় হট্টিটির ডাক–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট, টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট।

    বাড়ির পেছনে লটাবন নদীর কিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডাকটা আসছে সেদিক থেকে। সে ছাঁচতলা গিয়ে দাঁড়ায়। আবার শোনা যায়–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট। এ ডাকের অর্থ জানে একমাত্র সে-ই। সে বোঝে–একটা হট্টিটি ডাকোছে তার হডিটিনীকে।

    সে উঠানে আসে। ভাবি সরষে ঝাড়ছে। ওজন করছে ভাই। সরষে বেচতে হাটে যাবে সে। তাদের চোখের সামনে থেকে জরিনা একটা ভরা বদনা তুলে নেয়। ইচ্ছে করেই একটু পানি ফেলে দেয় ছলাৎ করে। তারপর ছাঁচতলা দিয়ে সে চলে যায় লটাবনে।

    অনেকক্ষণ পরে সে ফিরে আসে। আঁচলের তলায় লুকিয়ে নিয়ে আসে ঝকঝকে নতুন এক ডজন বেলকুঁড়ি কাঁটা।

    জরিনা তার খোঁপায় হাত দেয়। সেই খোঁপার কাঁটার চার-পাঁচটা এখনও টিকে আছে। টিকে আছে এক রাতের এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে।

    ঘটনা নয়, দুর্ঘটনা। আর তার জন্য দায়ী তার দুঃসাহস।

    ফজল পরীক্ষায় পড়া নিয়ে ব্যস্ত। সে সময়ে তার পড়ার ঘরে ঢুকেছিল সে। অতো রাত্রে শ্বশুর যে আবার দেখে ফেলবে, কে জানত? কিন্তু কি অন্যায় দেখেছিল সে? কাঁটা তুলতে দেখেছিল ফজলের পা থেকে। এই টুকুইতো!

    জরিনা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে। তার মুদিত চোখের পাতা বেঁধে রাখতে পারে না অশ্রুর প্লাবন।

    অনেক আলোর আশীর্বাদ নিয়ে, শিশিরের স্নেহ নিয়ে বেড়ে উঠেছিল একটি লতা। তাতে ফুটেছিল ফুল যার বুকে ছিল আশার পরাগ, পাপড়ি-পাতায় রঙিন স্বপ্ন। ঐ রাতের দুর্ঘটনায় উৎপাটিত হলো সে লতা। তারপর যে মাটিতে পুঁতে দেয়া হলো তার শিকড়, তাতে না আছে সার না আছে রস।

    হেকমতের চেহারা চোখে ভাসতেই তার সমস্ত সত্তা বিতৃষ্ণায় ভরে যায়। ঘৃণায় কুঁচকে যায় সারা শরীর। হেকমত চোর। সে সিঁদ কেটে চুরি করে। বিয়ের মাস খানেক পরেই চুরির মালসহ ধরা পড়ে সে। তার জেল হয় তিনবছর। খালাস হয়ে আসার কিছু দিন পরেই আবার তার খোঁজ পড়ে। তারপর থেকেই সে ফেরার। চৌকিদার-দফাদারের চোখ এড়িয়ে সে কৃচিৎ কখনো আসে। একদিনের বেশি থাকে না। কিন্তু তার আসা না আসা সমান কথা জরিনার কাছে। শীতের মেঘের কাছে কে প্রত্যাশা করে বৃষ্টি?

    বৃষ্টি নেই, ছায়া নেই এমনি এক মরুভূমি যেন জরিনার জীবন। উদগ্র পিপাসা বুকে নিয়ে ছটফট করছিল সে বছরের পর বছর। আজ মরুর আকাশে হঠাৎ মেঘ দেখে আকুলি-বিকুলি করছিল তার চাতক-মন। সে আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে। এ মেঘ যে তার পরিচিত।

    জীবনে একমাত্র ফজলের সাথেই হয়েছিল তার অন্তরঙ্গ পরিচয়। সে-ই তার জীবনের প্রথম পুরুষ। বিকাশোম্মুখ সে পুরুষটি এখন পূর্ণবিকশিত। সে লাভ করেছে পূর্ণ যৌবন। যেমন হয়েছে সে দেখতে সুন্দর, তেমনি হয়েছে বলিষ্ঠ। তার অঙ্গে প্রত্যঙ্গে শক্তির সজীবতা। আজকের সান্নিধ্যের অপূর্বতায় তা স্পষ্ট অনুভূত। এর কাছে হেকমত কি? সে একটা অপদার্থ পুরুষ। তার যৌবন নেই, আছে শুধু যৌবনের পায়তারা যা শুধু হাস্যকর নয়, অসহ্য। তার কোমরে লুঙ্গির প্যাঁচে গোঁজা থাকে একটা সোডার পুটলি সব সময়। পিত্তশূলের ব্যথা উঠলেই এক খাবলা মুখে দিয়ে সে মরার মতো পড়ে থাকে বিছানায়।

    জরিনা চোখ মেলে। ফিকে জোছনায় জমাট অন্ধকার তরল হয়েছে কিছুটা। বিছানায় পড়ে থাকতে আর ভালো লাগে না তার। সে উঠে টেকির ওপর গিয়ে বসে কাতলা হেলান দিয়ে।

    এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক পানি ঝরিয়েছে তার চোখ। এখন কিছুটা শান্ত হয়ে সে অনুভব করতে পারে, তার অন্তরের বেদনার সাথে মিশে আছে আজকের সফল অভিসারের আনন্দ। তখনই তার সারা দেহ-মনে নতুন করে সঞ্চারিত হয় তৃপ্তির অনুভূতি। সুখের আবেশে চেঁকির কাতলা দুটোকে সে জড়িয়ে ধরে দুহাতে। এই মুহূর্তে সব কিছুই তার কাছে আপন মনে হয়। এই নিঝঝুম রাত্রিকেও মনে হয় একান্ত আপন।

    মনের আঁধারে বাসনার চামচিকেটা আবার পাখা মেলতে চায়। তাকে আর আটকে রাখতে পারছে না জরিনা। সে ঝপ সরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়।

    কৃষ্ণা নবমীর চাঁদ পূর্বদিগন্ত ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেকদূর। ক্ষয়িষ্ণু প্রতিবেশীর আগমনে সচকিত হয়ে উঠেছে আকাশের লক্ষ কোটি তারা। হয়তো বা বিদ্রুপের হাসি হাসছে। ঝিরঝিরিয়ে বইছে শরতের স্নিগ্ধ বাতাস। যেন ঘুমন্ত পৃথিবীর নিশ্বাস-প্রশ্বাস।

    মোহময়ী এ রাত। এমন লজ্জাহারিণী আশ্রয়দায়িনী রাতটা পলে পলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এমন প্রীতিময়ী রাত তার জীবনে আর আসবে না কোনো দিন। এ রাতের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।

    জরিনা সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে উঠানের দিকে পা বাড়ায়। এ রাতের একটি মুহূর্তকণাও সে বিফলে যেতে দেবে না।

    উঠানে পা দিয়েই তার দৃষ্টি হঠাৎ থমকে যায়। একটা ছায়ামূর্তি–নারীমূর্তি ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে কাছারি ঘরের দিকে। ভেজানো দরজা ঠেলে মূর্তিটা ঢুকে পড়ে ঘরে। তার খিল এঁটে দেয়ার অস্পষ্ট শব্দ বিকট আঘাত হানে জরিনার বুকে। তার আহত আশা আক্রোশে কাঁপে, ফণা বিস্তার করে।

    সে টেকিঘরের বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর একপা-দু’পা করে এগিয়ে যায় কাছারি ঘরের দিকে। পশ্চিম পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পুব দিকের জানালা দিয়ে চাঁদের ক্ষীণ আলোর রেশ এসে পড়ছে ঘরের ভেতর। ঘরের ঘন অন্ধকার তাতে হালকা হয়েছে কিছুটা।

    জরিনা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নিশূপে। ফিকে অন্ধকার ভেদ করে দৃষ্টি চলে তার । স্পষ্ট দেখা যায় না কিছুই শুধু রেখাচিত্র, ছায়া-অভিনয়। অস্পষ্ট ছবিগুলো তার কল্পনার তুলিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার শিরা-উপশিরায় দ্রুত আনাগোনা করে একটা উষ্ণ প্রবাহ। রোমাঞ্চিত হয় তার সারা অঙ্গ। তার চোখ নেমে আসে আপনা থেকেই।

    জরিনা ঢেঁকিঘরে ফিরে আসে। তার বুকের মধ্যে অশান্ত চামচিকের পাখা ঝাঁপটানি। কিছুতেই ওটা থামছে না। সে রান্নাঘরে গিয়ে ঢকঢক করে পানি খায়। পানি দিয়ে যেন ভিজিয়ে দিতে চায় চামচিকের অস্থির ডানা দুটো। কিন্তু থামাতে পারছেনা।

    সে বিছানায় শুয়ে ছটফট করে। আবার উঠে গিয়ে মাথায় পানি দেয়। সারা দেহে অসহ্য দাবদাহ। এ দাহ কিসে শান্ত হবে?

    অনেকক্ষণ কেটে গেছে। রাত আর বেশি নেই। নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ায় জরিনা । এগিয়ে চলে যন্ত্রচালিতের মতো। কাছারি ঘরে গিয়ে বসে চৌকির পাশে।

    ফজল বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। অন্ধকারের আবরণে ঢাকা তার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জরিনা। হাত বুলায় তার কপালে, মাথায়। ঘুমের ঘোরে ফজল হাত বাড়ায় তার দিকে। হাতটা তুলে নেয় জরিনা। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ফজল ডাকে, রূপজান, রূপজান।

    জরিনা তার মাথা রাখে ফজলের বুকে। হঠাৎ ফজলের ঘুম ভেঙে যায়।

    আমার রূপজান!

    জরিনা সাড়া দেয় না। ফজল ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। অনুচ্চ স্বরে বলে, ও তুমি! আবার আইছ! তুমি নিজে তে জাহান্নামে যাইবাই, আমারেও নিয়া ছাড়বা।

    একটু থেমে আবার বলে, জরিনা, তুমি অন্যের বউ। তোমার গায়ে আমার আঙুলের একটু ছোঁয়া লাগলেও পাপ অইব।

    জরিনা তার পায়ে মাথা কুটতে থাকে। ফজল পা সরিয়ে নেয়। সে উঠে দাঁড়ায়, জরিনাকে টেনে তোলে। বলে, জরিনা যাও। আর কোনো দিন আইও না। তুমি আর আমার কেউ না।

    কেউ না! অস্ফুট কথা জরিনার আর্তনাদের মতো শোনায়। সে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

    জরিনা চলে গেছে। সে আর কেউ নয় ফজলের। তবুও এমন হাহাকার করে উঠছে কেন, ব্যথায় ভরে উঠছে কেন তার বুকের ভেতরটা?

    এ হাহাকার, এ ব্যথা কখন থামবে, কিসে থামবে?

    ফজল ভাবে, রূপজান কাছে থাকলে এ হাহাকার উঠবে না আর। দূর হবে মনের সব দুঃখ-ব্যথা।

    ভোর হতে না হতেই ফজল কাদিরকে ডেকে আনে পাশের বাড়ি থেকে। বলে, তোমার বু’রে লইয়া যাইতে চাই। মিয়াজিরে গিয়া কও।

    দুদু কি রাজি অইব?

    রাজি অইব না ক্যান্? তোমার বু’তো আমার লগে যাওনের লেইগ্যা তৈয়ার।

    কাদির বাড়ির ভেতর যায়। ফিরে আসে অল্পক্ষণ পরেই। আরশেদ মোল্লা যা বলেছে, কাদির এসে কোনো রকম ঢাকা-চাপা না দিয়ে তাই বলে, দুদু কয়, মাইয়ার গয়নাগুলা তো বেইচ্যা খাইছে বেবাক। আবার শুরু করছে মাছ-বেচা। এই জাউল্যা বাড়ি আমার মাইয়া দিমু না।

    দিব না কি করব? মাইয়াখান সিন্দুকে ভইরা রাখব? তোমার দুদুরে কইও, একদিন এই জাউল্যা ভাগাইয়া লইয়া যাইব ভদ্রলোকের মাইয়ার। তখন ইজ্জত লইয়া টান পড়ব, কইয়া রাখলাম আমি। এখন চলাম। তোমার ডিঙি দিয়া আমারে দাত্রার চরে নামাইয়া দিয়া আসো।

    দেরি করেন দুলাভাই, নাশতা খাইয়া–

    উঁহু। তুমি জলদি ডিঙি লইয়া ঘাটে আসো।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএসো বিজ্ঞানের রাজ্যে – আবদুল্লাহ আল-মুতী
    Next Article নির্বাচিত গল্প সমগ্র – আবু ইসহাক

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }