Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পদ্মার পলিদ্বীপ – আবু ইসহাক

    লেখক এক পাতা গল্প377 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৩-১৬. খুনের চর দখল

    লাঠালাঠি হাঙ্গামা ছাড়াই খুনের চর দখল হয়েছে। এত সহজে চরটা দখল করতে পারবে, ভাবতে পারেনি জঙ্গুরুল্লা। সে মনে করেছিল–বিপক্ষের কিছু লোক আর চাকরিয়ারা অন্তত থাকবে চরে। তারা মুখোমুখি হবে তার লাঠিয়ালদের, ছোটখাট মারামারি হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। পুলিসের ভয়ে ওদের সবাই ছুটছাট পালিয়েছিল চর খালি রেখে।

    চর দখলের পরের দিন ভোরবেলা জঙ্গুরুল্লার পানসি এসে ভিড়ে খুনের চরের ঘোঁজায়। পানসি দেখে লোকজন ভিড় করে এসে দাঁড়ায় পানসির কাছে। জঙ্গুরুল্লা রুমিটুপি মাথায় দিয়ে শালটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে খাস খোপ থেকে বেরোয়। তার পেছনে বেরোয় তার দুই ছেলে হরমুজ ও জহির।

    আসোলামালেকুম। এক সাথে সবাই সালাম দেয় জঙ্গুরুল্লাকে।

    ওয়ালাইকুম সালাম। ফরমাশ দিয়ে তৈরি তেরো নম্বরি জুতো-জোড়া পায়ে ঢোকাতে ঢোকাতে জঙ্গুরুল্লা সালামের জবাব দেয়। জহিরের হাত থেকে রূপার মুঠিবাধানো বেতের লাঠিটা নিয়ে সে দাঁড়ায় নৌকার মাথির ওপর।

    মজিদ খালাসি কই হে?

    এইতো হুজুর।

    আমিও আছি হুজুর। দবির গোরাপি বলে।

    চলো, চরটা আগে দেইখ্যা লই।

    চলেন হুজুর। মজিদ খালাসি বলে।

    জঙ্গুরুল্লা চরের মাটিতে নামে। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় মজিদ খালাসি ও দবির গোরাপি।

    জঙ্গুরুল্লা থপথপ করে পা ফেলে এগিয়ে যায় বুক টান করে, মাথা উঁচু করে। তার চলনে-বলনে দিগ্বিজয়ীর দৃপ্ত ভঙ্গি।

    চলতে চলতে চরটার চারদিকে চোখ বুলায় জঙ্গুরুল্লা। মাঝখানের কিছু জায়গা বাদ দিয়ে সারাটা চরেই লাগানো হয়েছে বোরো ধান। ধানগাছের গোছা পেখম ধরেছে বেশ। গাছের মাজা মুটিয়ে উঠেছে। কিছুদিনের মধ্যেই শিষ বেরুবে।

    কেমুন মিয়ারা! তোমরাতো চর দখলের লেইগ্যা হামতাম শুরু করছিলা। চলতে চলতে বলে জঙ্গুরুল্লা। অত ত্বরাহুড়া করলে এমুন বাহারিয়া ধান পাইতা কই? আমি তখন কইছিলাম না, ওরা ধান-পান লাগাইয়া ঠিকঠাক করুক, আমরা তৈয়ার ফসল ঘরে উডাইমু।

    হ, আল্লায় করলে তৈয়ার ফসল ঘরে উড়ান যাইব। দবির গোরাপি বলে।

    খুব মজা, না? ধান বোনে হাইল্যা, প্যাট ভরে বাইল্যা। মনে মনে হাসে জঞ্জুরুল্লা।

    আপনে জবর একখান ভোজবাজির খেইল দ্যাহাইছেন। বলে মজিদ খালাসি।

    হ, এরই নাম ভোজবাজির খেইল, আক্কেলের খেইল। দ্যাখলা তো আমার আক্কেল দিয়া ওগ কেমুন বেয়াক্কেল বানাইয়া দিছি। জঙ্গুরুল্লার চোখে-মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি।

    হ, ওরা এক্কেরে বেয়াক্কেল অইয়া গেছে।

    মাঘ মাস। উত্তুরে বাতাসে ঢেউয়ের আলোড়ন তোলে ধান খেতে। জঙ্গুরুল্লা শালটার এক প্রান্ত গলায় পেঁচিয়ে নেয়। বলে, জবর শীত পড়ছে তো। ও মজিদ, বাইরে হোগলা বিছাইয়া দ্যাও। রউদে বইয়া তোমাগ লগে কথা কইমু।

    চরের চারদিকটা ঘুরে ফিরে দেখে তারা এরফান মাতব্বরের তৈরি ভাওর ঘরের পুবপাশে এসে দাঁড়ায়।

    মজিদ খালাসি ঝুপড়ি থেকে হোগলা ও বিছানার চাদর এনে মাটিতে বিছিয়ে দেয়। জুতো ছেড়ে জঙ্গুরুল্লা আসনসিঁড়ি হয়ে বসে।

    আর লোকজন কই? জিজ্ঞেস করে জঙ্গুরুল্লা।

    বেড়ে মাছ ধরতে গেছে।

    বেড় দিছে! বানা পাইল কই?

    মাতব্বরের কোলশরিকরা ফালাইয়া গেছে। দবির গোরাপি বলে।

    আইচ্ছা! আর কি কি ফালাইয়া গেছে?

    ঢাল-কাতরা, লাডি-শরকি, ক্যাথা-বালিশ, থালা-বাসন, তিনডা টচ লাইট।

    ঝাঁকিজাল, টানাজাল, মইয়া জাল, ইলশা জাল। একজন কোলশরিক দবির গোরাপির অসম্পূর্ণ তালিকা পরিপূরণের উদ্দেশ্যে বলে।

    আরো অনেক কিছু চাই, দোয়াইর, আটি, বইচনা, খাদইন, পারন। বলে আর একজন কোলশরিক।

    এইডারে কয় বুদ্ধির খেইল, বোঝলা? আক্কেলের খেইল। জঙ্গুরুল্লা আবার তার নিজের বাহাদুরি প্রকাশ করে। দ্যাখলাতো আমার আক্কেলের ঠেলায় ওগ আক্কেল গুড়ুম।

    হ, আপনের বুদ্ধির লগে কি ওরা কুলাইতে পারে? আপনের বাইয়া পায়ের বুদ্ধিও ওগ নাই। বলে মজিদ খালাসি।

    পায়েরও আবার বুদ্ধি থাকে! মনে মনে খুশি হয় জঙ্গুরুল্লা। সে আড়চোখে তাকায় তার নিন্দিত পা দুটোর দিকে।

    বেড়ে মাছ পাওয়া যায়? জিজ্ঞেস করে জঙ্গুরুল্লা।

    আইজই বেড় পাতছে। কিছু তো পাইবই। দবির গোরাপি বলে।

    ওরা চাউল-ডাউল, তেল-মরিচ ফালাইয়া গেছে না?

    হ কিছু ফালাইয়া গেছে। আমাগ বেবাকের তিন-চারদিন চইল্যা যাইব।

    শোন, ভাটাতো শুরু অইয়া গেছে। ওরা মাছ মাইরা আসুক। বেবাক মানুষ একখানে অইলে কথা কইমু তোমায় লগে। এক কাম করো, চাউল-ডাইল তো আছেই। বেড়ে মাছও পাওয়া যাইব। রানের আয়োজন কর। আইজ বেবাক মানুষ একখানে বইস্যা আমার লগে খাইব।

    হ, আয়োজন করতে আছি। মজিদ খালাসি বলে।

    শোন, বেড়ের মাছ ধরতে গিয়ে ধানেরে পাড়াইয়া-চড়াইয়া যেন বরবাদ না করে। তোমরা গিয়া হুশিয়ার কইর‍্যা দিয়া আসো।

    হ যাই।

    মজিদ খালাসি চলে যায়।

    চরের পাহারায় কারা আছে?

    চাকইর‍্যারা আছে। আর যারা বেড়ে মাছ ধরতে গেছে তারাও নজর রাখব। দবির গোরাপি বলে।

    ওরা আর আইতে সাহস করব না। কি মনে অয় তোমাগ, আইব ওরা? ওরা আইব ক্যামনে? কি লইয়া আইব? ওগ বেবাক আতিয়ার তো আমাগো দখলে।

    হ, আতিয়ার বানাইয়া তৈয়ার অইতে বহুত দেরি। যহন আইব, আইয়া দ্যাখব রাইস্যা গাঙ চরডারে খাবলা দিয়া লইয়া গেছে।

    সবাই হেসে ওঠে।

    হঠাৎ হাঁক ছাড়ে জঙ্গুরুল্লা, মাঝিমাল্লাগুলা গেল কই? হারামজাদারা এতক্ষণের মইদ্যে এক ছুলুম তামুক দিয়া গেল না। অই কেরা, অ ফেকু–

    দবির গোরাপি উঠে পানসির দিকে দৌড় দেয়।

    জঙ্গুরুল্লা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, থাউক তোমার যাওনের দরকার নাই। আমিই নৌকায় গিয়া বসি। বেড়ে কি মাছ পাও আমারে দ্যাখ্যাইয়া নিও।

    জঙ্গুরুল্লা নৌকায় উঠে ছই-এর বাইরে পাটাতনের ওপর বসে। মাঝি কেরামত ফরসি হুঁকোয় তামাক সাজিয়ে দীর্ঘ নলটা এগিয়ে দেয় তার দিকে। সে নলে মুখ দিয়ে টানে গুড়ুক। গুড়ুক।

    দবির গোরাপি, হরমুজ, জহির ও আরো কয়েকজন দাঁড়িয়েছিল পাড়ে।

    ও জহির, ও হরমুজ।

    জ্বী।

    তোরা নৌকারতন শিকল নিয়া যা। দবিররে লইয়া চরটার মাপ-জোখ নে।

    জহির নৌকা থেকে জমি মাপার শিকল নিয়ে নামে।

    জঙ্গুরুল্লা আবার বলে, ওরা কেম্বায় জমি ভাগ করছিল, জানোনি দবির?

    হ, চরডারে দুই ভাগ করছে পয়লা। উত্তরে একভাগ আর দক্ষিণে একভাগ। হেরপর আট আতি নল দিয়া মাইপ্যা ভাগ করছিল।

    ঠিক আছে, আমরাও এই নলের মাপেই ভাগ করমু। ওরা যেই আইল বানছিল সেই আইল ভাঙ্গনের দরকার নাই। শিকল দিয়া নলের মাপ ক্যাদায় দিবা, জানোনানি?

    জানি। হরমুজ বলে। আঠারো লিঙ্কে আট হাত, মানে একনল।

    ঠিক আছে তোরা যা। দুফরে খাওনের পর জমি ভাগ-বাটারার কাম করণ যাইব।

    পুবদিক থেকে স্টিমার আসছে। এ সময়ে খাটো চোঙার জাহাজ–দেখেই জঙ্গুরুল্লা বুঝতে পারে এটা কোন লাইনের জাহাজ। চাঁদপুর থেকে গোয়ালন্দ যাচ্ছে চাটগা মেল । আবার পশ্চিম দিক থেকেও আসছে একটা লম্বা চোঙার স্টিমার। এটা নিয়মিত কোনো যাত্রীজাহাজ নয়–জঙ্গুরুল্লা বুঝতে পারে।

    কোনো একটার থেকে পানি মাপা হচ্ছে। দূর থেকে তারই ঘোষণার সুর অস্পষ্ট ভেসে আসছে কিছুক্ষণ পর পর দুই বাম মিলে-এ-এ-এ-এ–না–আ–আ—আ।

    কেরা, মজবুত কইর‍্যা নাও বাইন্দা রাখ। জবর ঢেউ ওঠব। দুই জাহাজের ঢেউ।

    কেরামত পানসিটাকে কিনারা থেকে কিছুদূর সরিয়ে দুই মাথি বরাবর লগি পুঁতে রশিতে আয় রেখে শক্ত করে বাঁধে।

    স্টিমার দুটো পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসছে।

    পুঁ–উ-ত। মেয়েলি মিহি আওয়াজে দীর্ঘ সিটি বাজায় লম্বা জাহাজ।

    ফুঁ-উ-ত। চাটগাঁ মেল সিটির জবাব দেয় পুরুষালি মোটা বাজখাই আওয়াজে।

    এই কেরা, জাহাজ দুইডা হুইসাল মারলো ক্যান্ জানস নি?

    হ, আমরা যেমুন নাও বাওনের সুময় আর একটা নাও দ্যাখলে কই, হাপন ডাইন, জাহাজ দুইডাও হুইসাল দিয়া কইল হাপন বাম–যার যার বাঁও দিগ দিয়া যাও।

    দুও ব্যাডা, পারলি না কইতে। লম্বা চুঙ্গা হুইসাল দিয়া কইল–সেলামালেকুম, কেমুন আছেন? খাডো চুঙ্গা জ’ব দিল–আলেকুম সালাম। ভালো আছি। তুমি কেমুন আছ?

    খুনের চরের উত্তর দিক দিয়ে স্টিমার দুটো একে অন্যের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। পূর্বগামী জাহাজটিতে বোঝাই হয়ে যাচ্ছে দেশী-বিদেশী সৈন্য।

    এত সৈন্য যায় কই, হুজুর। কেরামত জিজ্ঞেস করে।

    যায় লড়াই করতে। আমরা যেমুন চর দখলের লেইগ্যা বিপক্ষের লগে মারামারি করি, ওরাও তেমুন যাইতেছে বিপক্ষের লগে লড়াই করতে।

    .

    একটা চাঙারি তিনজনে ধরাধরি করে এনে পানসির মাথির ওপর রাখে। তিনজনই শীতে কাঁপছে ঠকঠক করে। ওদের সাথে এসেছে মজিদ খালাসি। সে বলে, কিরে তোরা শীতে এমুন ঠকঠকাইতে আছস ক্যান? তোগ এত শীত! এই শীত লইয়া পানির মইদ্যে মাছ ধরলি ক্যামনে?

    মাছ ধরনের কালে শীত টের পাই নাই। বলে ওদের একজন। মাছ ধরনের নিশার মইদ্যে শীত আইতে পারে নাই। এহন বাতাস গায়ে লাগতেছে আর শীত করতেছে।

    জঙ্গুরুল্লা খাস কামরায় গিয়ে গড়াগড়ি দেয়ার আয়োজন করছিল, শব্দ পেয়ে বেরিয়ে আসে। মাছ দেখে সে খুশি হয় খুব। অনেক মাছ! কমসে কম পনেরো সের দুই ওজনের একটা কালিবাউস। আর সবই ছোট মাছ-ট্যাংরা, পুটি, পাবদা, চাপিলা, বাতাসি, বেলে, বাটা, চিংড়ি।

    বড় মাছ দুইডা এহনো জিন্দা আছে। দুইডারে দড়ি দিয়া বাইন্দা জিয়াইয়া রাখো। জঙ্গুরুল্লা বলে। ঐ দুইডারে বাড়িতে লইয়া যাইমু। কইরে, কেরা, একটা দড়ি লইয়া আয়।

    কেরামত মাছ দুটোর কানকোর ভেতর দিয়ে রশি ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বার করে। তারপর গিঁট দিয়ে পানিতে ছেড়ে দেয়। রশির অন্য প্রাপ্ত বেঁধে রাখে পানসির ঘষনার সাথে।

    মাছগুলা লইয়া যাও। জঙ্গুরুল্লা বলে। হাতে হাতে কুইট্যা রানের আয়োজন করো।

    চাঙারিটা তিনজনে ধরাধরি করে নিয়ে যায়। ওদের তিনজনের একজন মজিদ খালাসির ছেলে ফজিলত।

    কিছুদূর গিয়ে ফজিলত বলে, দ্যাখলেন নি? এই মাঘ মাইস্যা শীতে ক্যাদার মইদ্যে কষ্ট কইর‍্যা মাছ ধরলাম আমরা। আর উনি বড় মাছ দুইডা থাবা মাইর‍্যা লইয়া গেল। মাইনষে কয় কথা মিছা না–শুইয়া রুই, বইস্যা কই, ক্যাদা ঘাইট্যা ভ্যাদা।

    এই ফজিলত, চুপ কর। মজিদ খালাসি ধমক দেয়। হুজুরের কানে গেলে বাঁশডলা দিয়া চ্যাগবেগা বানাইয়া দিব। তহন ভ্যাদা মাছও পাবি না।

    আপনেরা মোখ বুইজ্যা থাকেন বুইল্যাইতো আপনেগ চ্যাগবেগা বানাইয়া রাখছে।

    আরে আবার কথা কয়! চুপ কর হারামজাদা।

    একটু থেমে অন্য লোক দুটিকে অনুরোধ করে মজিদ খালাসি, ও মিয়াভাইরা, তোমরা কুন্তু এই নাদানের কথা হুজুরের কানে দিও না।

    .

    চরধানকুনিয়া পদ্মার জঠরে বিলীন হয়ে গেছে গত বর্ষার সময়। সেখানে বাইশ ঘর কোলশরিকের বসত ছিল। চরভাঙা ভূমিহীন আর সব মানুষের মতোই তারা ভেসে যায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। কয়েকজন বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে আসাম চলে গেছে। সেখানে জঙ্গল সাফ করে জমি আবাদ করলেই নাকি জমির মালিক হওয়া যায়। কয়েকজন পুরানো কাঁথা-কাপড়, হাঁড়ি-পাতিল, গাঁটরি-বোচকা বেঁধে পরিবারসহ চলে গেছে শহরে। চরভাঙা এ সব মানুষের দিনের আশ্রয় রাস্তার বট-পাকুড় গাছের তলা আর রাতের আশ্রয় অফিস আদালতের বারান্দা। যাদের সামান্য কিছু জমা টাকা আছে তারা কষ্টে-সৃষ্টে ঝুপড়ি বেঁধে নেয় বস্তি এলাকায়। পুরুষেরা কুলি-মজুরের কাজ পেলে করে, না পেলে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয় সারাদিন। বউ-ছেলে-মেয়ে চাকুরে-ব্যবসায়ীদের বাসা-বাড়িতে ঝি-চাকরের কাজ জুটিয়ে নেয়। এমনি করে খেয়ে না খেয়ে শাক-পাতা অখাদ্য-কুখাদ্য পেটে জামিন দিয়ে এরা দিন গোনে, রাত গোনে। এরা চাষের কাজে, ফসল উৎপাদনের কাজে আর কোনো দিন ফিরে আসে না চরের মাটিতে। ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারে না আর। জমি পেতে হলে সেলামি দিতে হয়। কিন্তু সেলামির টাকা সারা জীবনেও কেউ যোগাড় করতে পারে না।

    চরধানকুনিয়ার চারজন এখানে-সেখানে কাজের সন্ধানে ঘুরে হতাশ হয়ে ফিরে আসে। তারা বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে পাতনা দিয়ে আছে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি। অন্যের জমিতে কামলা খেটে তারা অনাহারে অর্ধাহারে দিন গুজরান করে।

    জঙ্গুরুল্লা খুনের চর দখল করেছে–খবর পেয়েই তারা অনেক আশা নিয়ে এসেছে তার সাথে দেখা করতে। তারা পানসির কাছে ঘোঁজার কিনারায় চুপচাপ বসে থাকে, শুনতে থাকে জঙ্গুরুল্লার নাকডাকানি। সে খাস খোপে বিশ্রাম নিচ্ছে। তার বিশ্রামের কোনো রকম ব্যাঘাত না হয় তার জন্য মাঝি কেরামত এদের সাবধান করে দিয়েছে।

    নাকডাকানি কখন শেষ হবে বুঝতে পারে না অপেক্ষমাণ লোকগুলো। তারা আশায় বুক বেঁধে ধৈর্য ধরে বসে থাকে।

    জঙ্গুরুল্লার ঘুম ভাঙে যখন পেটে টান লাগে। উঠেই সে রূপার চেনে বাঁধা পকেট ঘড়িটা বের করে দেখে।

    আরে, তিনটাতো বাইজ্যা গেছে! ইস, জহুরের নামাজটা কাজা অইয়া গেল! ও কেরা রান্দনের কি অইল?

    এহনো অয় নাই। কেরামত বলে। মনে অয় খাইল্যা ঘাসের আগুনে তেজ নাই।

    তুই খবর দে। শীতকালের বেলা। আর এট্টু পরেই আন্ধার ঘনাইয়া আইব।

    হ, খবর দিতে আছি। হুজুর, চাইরজন মানুষ আইছে আপনের লগে দ্যাহা করনের লেইগ্যা।

    কারা? কি ব্যাপারে আইছে?

    চিনি না। কি ব্যাপারে কিছু কয় নাই।

    জঙ্গুরুল্লা খাস খোপ থেকে বেরিয়ে গলুইয়ের ওপর দাঁড়ায়।

    আসলামালেকুম। একসাথে সালাম দেয় চারজন।

    ওয়ালাইকুম সালাম। তোমরাই দ্যাখা করতে আইছ?

    হ হুজুর। দলের মুরব্বি তোবারক বলে।

    কও, ত্বরাত্বরি কও। আমার অত সময় নাই।

    হুজুর, আমাগ ধানকুনিয়ার চর রসাতল অইয়া গেছে। আমাগ আর কিছু নাই।

    আমি কি করতে পারি, কও?

    আমাগ কিছু জমি দ্যান। আমাগ বাঁচনের একটা রাস্তা কইর‍্যা দ্যান।

    দুনিয়াশুদ্ধ মানুষের বাঁচনের রাস্তা কি আমার বানাইতে অইব?

    হুজুর আমাগ বাঁচনের আর কোন পথ নাই। আমরা গেছিলাম কালামাডি।

    কালামাটি মানে টাটানগর?

    হ, টাটানগর, বানপুর।

    সেইখানে তো শুনছি বহুত মানুষ কামে ভর্তি করতেছে। লড়াইর সরঞ্জাম বানাইতে আছে।

    হ, ভর্তি করতে আছে। হেই খবর পাইয়া গেছিলাম। কিন্তু সরদারগ, দালালগ দুইশ রুপিয়া না দিলে কোনো কামে ভর্তি অওয়ন যায় না।

    দিয়া দিতা দুইশ রুপিয়া।

    হুজুর দুইশ ট্যাহা কি গাছের গোড়া? আমরা গরিব মানুষ। পাইমু কই এত ট্যাহা?

    টাকা ছাড়া দুইন্যাই ফাঁকা। বোক্লা? তোমরা ওইখানে টাকা দিতে পার নাই, আমার সেলামির টাকা দিবা কইতন?

    আস্তে আস্তে শোধ কইরা দিমু।

    দুও ব্যাটারা। নগদ সেলামি দিয়া মাইনষে জমি পায় না। আর তোরা আইছস বাকিতে  জমি নিতে। যা-যা অন্য কিছু কইর‍্যা খা গিয়া।

    হুজুর। তোবারকের কথার স্বরে আকুল আবেদন।

    আর প্যাচাল পাড়িস না তো। কইলামতো অন্য কিছু কইর‍্যা খা গিয়া।

    মজিদ খালাসি ও দবির গোরাপি এসে খবর দেয়, রান্না হয়ে গেছে। তাদের আসার পর লোক চারজন আর কিছু বলার সুযোগ পায় না।

    জঙ্গুরুল্লা একটুও দেরি না করে একেবারে খাবার জায়গায় গিয়ে বসে। খাবার জায়গা বাইরেই করা হয়েছে।

    খাদিমদারির জন্য কয়েকজন বাদে সবাই যার যার থালা নিয়ে গামছা বিছিয়ে বসে।

    খেতে খেতে আছরের নামাজও কাজা হয়ে যায়। সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করে জঙ্গুরুল্লা। সে বলে, মাগরেবের নামাজের পর বৈঠক শুরু অইব।

    এরফান মাতব্বরের তৈরি ভাওরবাড়ির এক ঘরে হারিকেনের আলোয় বৈঠক বসে। বিশিষ্ট কয়েকজন কোলশরিক নিয়ে জঙ্গুরুল্লা দুই ছেলেসহ সেখানে বসে। বাকি সবাই মাথায় গামছা বেঁধে গায়ে চাদর জড়িয়ে উন্মুখ হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।

    হরমুজ, চরটার মাপজোখ নিছস?

    হ, পুবে পশ্চিমে সাড়ে ছয়চল্লিশ চেইন, উত্তর দক্ষিণে উনিশ চেইন।

    ওরা তো আটহাতি নল দিয়া মাইপ্যা ভাগ করছিল। কত নল অয় হিসাব করছস?

    হ করছি। দবির গোরাপি বলে। ওরা পুবে পশ্চিমে মাঝ বরাবর দুই ভাগ করছিল চরডারে। উত্তর দিগে ঘোঁজা বাদ দিয়া দুইশ ছয়চল্লিশ নল আর দক্ষিণ দিগে দুইশ আটান্ন নল।

    মোট কত আয়?

    পাঁচ শ’ চার নল।

    আমাগ কোলশরিক অইল সাতষট্টি। সব্বাইকে ছয় নল কইর‍্যা দিলে, কত নল লাগে? কাগজ কলম লও, ও মজিদ।

    মজিদ খালাসি অঙ্ক কষে বলে, চারশ দুই নল।

    ঠিক আছে, এম্বায়ই ভাগ করো। একশ দুই নলের হিসাব পরে অইব।

    পানসি মাল্লা ফেকু তামাক সাজিয়ে লম্বা নলটা এগিয়ে দেয় জঙ্গুরুল্লার দিকে। সকলের সামনে নিজের বাহাদুরি প্রকাশের স্পৃহা সে দমন করতে পারে না। বলে, এই মিয়ারা, বাইরে। কারা আছ? মন লাগাইয়া শোন। এরফান মাতবরের দলরে কেমুন চক্করটা দিলাম। কেমনে। ছাপ্পরছাড়া কইরা দিলাম, হুহুহু। ওরা চাকইর‍্যা রাখছিল। আমি মনে মনে ঠিক করলাম, রাখুক ওরা চাকইর‍্যা। দেখি, ওগ বেতন দিয়া, খাওন দিয়া এরফান মাতবরের মিরদিনা কয়দিন সোজা থাকে। ওগ টাকা পয়সার যখন ছেরাদ্দ অইয়া গেছে, সুতা যখন খতম, তখনি দিলাম একখান গোত্তা। ব্যস, বৌকাট্টা–আ—আ–।

    সবাই হেসে ওঠে। দবির গোরাপি বলে, হুজুর কি ছোডকালে ঘুড়ি উড়াইছেন নি?

    আরে, ছোডকালে ঘুড়ডি আবার কে না উড়ায়! শোন, তোমাগ পরামিশ মতন যদি তখন তখনি চর দখল করতে যাইতাম, তয় কি অইত? খুনাখুনি অইত, মামলা-মকদ্দমা অইত। কিন্তু এমন খেইল দ্যাখাইলাম, আমার আক্কেলের ঠেলায় ওগ আক্কেল গুড়ুম।

    আবার খিকখিক করে হেসে ওঠে সবাই। মজিদ খালাসি বলে, হু, আপনে যেই খেইল দ্যাহাইছেন, ওগ বেবাক গেছে–ট্যাহা-পয়সা, হাতিয়ার-সরঞ্জাম। আমাগও আর খুনাখুনি মামলা-মকদ্দমার ঝামেলায় পড়তে অইল না।

    ওগ টাকা পয়সা বেবাক খতম। ওরা আর আইব ক্যামনে চর দখল করতে?

    হ, ওরা আর আইতে পারব না। দবির গোরাপি বলে।

    আর দ্যাখো, তোমায় বুদ্ধি মতন যদি তখনি চর দখলের হামতাম করতাম, তয় এমনু তৈয়ার ধান পাইতা কই? কি মজা আঁ? ধান বোনে হাইল্যা, পেট ভরে বাইল্যা।

    সবাই হি-হি, হো-হো করে হেসে উঠে।

    এই বাইল্যার গুষ্টি, হাসনের কি অইল? তৈয়ার ধান তো পাইতেছ। আমারে সেলামি কত কইরা দিবা?

    আপনেই ঠিক করেন। মজিদ খালাসি বলে।

    নল পিছু পঞ্চাশ টাকা কইর‍্যা দিও।

    পঞ্চাশ ট্যাহা খুব বেশি অইয়া যাইতেছে। এরফান মাতবর নিছিল পঁচিশ ট্যাহা কইর‍্যা। একজন কোলশরিক বলে।

    আরে! এরফান মাতবরের লগে আমার তুলনা, আঁ! ঐ পঁচিশ টাকার জমি আছে? ঐ জমিতো গরবাদ! চাউলে পাতিলে তল! আমি পঞ্চাশ টাকা সেলামি নিয়া জমি দিমু। কারো বাপের সাধ্য নাই এই জমির কাছে আসে।

    সবার অনুরোধে শেষে নল পিছু চল্লিশ টাকা সেলামি নিতে রাজি হয় জঙ্গুরুল্লা।

    বৈঠক শেষ করে উঠবার সময় জঙ্গুরুল্লা বলে, আমার ফন্দি-ফিকিরে তৈয়ার ধান পাওয়া গেছে। এই ধানের অর্ধেক আমার, মনে রাইখ্য মিয়ারা।

    কোলশরিকদের কেউ আপত্তি করে না।

    মজিদ খালাসি হারিকেন নিয়ে আগে আগে চলে। তার পেছনে হাঁটে জঙ্গুরুল্লা ও তার দুই ছেলে। কোলশরিক ও তাদের জোয়ান ছেলেরা তাদের অনুসরণ করে দল বেঁধে।

    এতই রঙ্গেরই খেলা জান হায়রে মন,
    এতই রঙ্গেরই খেলা জান।

    দোতারা বাজিয়ে গান গাইছে কেউ।

    গান গাইছে কেডা ও? জঙ্গুরুল্লা জিজ্ঞেস করে।

    কোনো ব্যাপারি নায়ের মাঝি না অয় মাল্লা অইব মনে অয়। মজিদ খালাসি বলে।

    হ, অনেক পরদেশী নাও এই ঘোঁজায় পাড়া গাইড়া জিরায় তামাম রাইত। দবির গোরাপি বলে।

    বানাইয়া আদম নবী
    বেহেশত করিলা রে খুবী,
    গন্দম খাইতে মানা কেন রে,
    গন্দম খাইতে মানা কেন?
    খাওয়াইয়া গন্দম দানা
    ছাড়াইলা বেহেশতখানা ॥
    কি কৌশলে সংসারেতে আন
    হায়রে মন।
    এতই রঙ্গেরই খেলা জান ॥
    মকরমরে কও দাগা কর,
    আদমরে কও হুঁশিয়ার,
    শত্রু তোমার জানিও শয়তান রে,
    শত্রু তোমার জানিও শয়তান।
    দাগা কর, নাহি পড়,
    কে বুঝিবে খেলা তোর ॥
    এর ভেদ তুমি মাত্র জান
    হায়রে মন।
    এতই রঙ্গেরই খেলা জান॥
    নমরুদ পাপীয়ে বল,
    ইব্রাহিম অগ্নিতে ফেল
    আগুনরে করহ বারণ রে,
    আগুনরে করহ বারণ।
    ইব্রাহিমকে দাও কোরবানি ॥
    ছুরিরে নিষেধ করো পুনঃ
    হায়রে মন।
    এতই রঙ্গেরই খেলা জান ॥
    কেহ পাপী, কেহ ভক্ত
    কেহ ফকির, কেহ তখ্‌ত,
    খেলা তোমার না যায় বুঝন রে,
    খেলা তোমার না যায় বুঝন।
    কি বুঝিবে বেঙ্গু ভ্রান্ত,
    তোমার খেলার নাহি অন্ত ॥
    তোমারে না বোঝে অজ্ঞ জন
    হায়রে মন।
    এতই রঙ্গেরই খেলা জান ॥

    গানের কথা ও সুরে সবাই অভিভূত। বিমোহিত তাদের মন। যতক্ষণ গান চলছিল একটা কথাও কেউ বলেনি।

    গান শেষ হলে দবির গোরাপি বলে, একটা মনের মতো গান হুনলাম।

    হ গানডা খুব চমৎকার। অনেকেই বলাবলি করে।

    সবাই পানসির কাছে এসে গিয়েছিল গান শেষ হওয়ার আগেই। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনছিল। ঐ সময়ে জঙ্গুরুল্লার চোখ জোছনার আলোয় জরিপ করছিল ঘোঁজাটা। অনেক কয়টা বড় মালের নৌকা পাড়া গেড়ে আছে ঘোঁজায়।

    মজিদ, দেইখ্যা আস তো কয়ডা নৌকা আর নৌকায় কি মাল বোঝাই?

    জঙ্গুরুল্লা ছেলেদের নিয়ে পানসিতে ওঠে। মজিদ খালাসি আর দবির গোরাপি চলে যায় নৌকার খোঁজ খবর নিতে।

    কিছুক্ষণ পরে তারা ফিরে এসে জঙ্গুরুল্লাকে জানায়–নৌকার সংখ্যা বারো। তিনটা চালের নৌকা-খুলনা থেকে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জে। একটায় ঝুনা নারকেল বরিশালের নলসিটি থেকে ঢাকা যাচ্ছে। একটায় পেঁয়াজ যাচ্ছে কুষ্টিয়ার জগন্নাথপুর থেকে চাঁদপুর। একটায় আলু–যাচ্ছে কমলাঘাট থেকে ফরিদপুর। একটায় তেজপাতা যাচ্ছে কমলাঘাট থেকে রাজবাড়ি। একটায় খেজুর গুড়–মাদারীপুর থেকে যাচ্ছে ঢাকা। চারটা নৌকা খালি। সেগুলো বিভিন্ন বন্দরে যাচ্ছে মাল কেনার জন্য।

    এই মজিদ, আমাগ জাগায় নাও রাখছে। খাজনা আদায় করো, তোলা উডাও। জঙ্গুরুল্লা নির্দেশ দেয়।

    যদি না দিতে চায়।

    দিতে না চাইলে পাড়া উড়াইয়া চইল্যা যাইতে কও এইখানতন।

    মজিদ খালাসি ও দবির গোরাপি জঙ্গুরুল্লার নির্দেশ মতো তোলা উঠিয়ে চলে আসে কিছুক্ষণ পর। তিনটা নৌকা থেকে পাওয়া গেছে সের পাঁচেক চাল। অন্যগুলো থেকে পাওয়া গেছে একজোড়া নারকেল, সের দুই পেঁয়াজ, সের খানেক আলু, পোয়াটাক তেজপাতা আর মুছি খেজুরগুড় আটখান। সবগুলো এনে তারা পানসিতে তুলে দেয়। জঙ্গুরুল্লা খুশি হয়।

    রাইত অনেক অইছে। আর দেরি করণ যায় না। জঙ্গুরুল্লা বলে। তারপর সে হাঁক দেয়, এই কেরা, এই ফেকু নাও ছাইড়া দে তুরারি।

    পাড়া উঠিয়ে পানসি ছেড়ে দেয় কেরামত।

    খাস খোপে হারিকেন জ্বলছে। হরমুজ ও জহিরকে বলে জঙ্গুরুল্লা, নাও জিরানের এমুন সোন্দর একখান ঘোঁজা আশেপাশের কোনো চরে নাই।

    হ, ঠিকই। নাও রাখনের লেইগ্যা জায়গা খুবই চমৎকার। হরমুজ বলে।

    আইতে আছে চৈত্র-বৈশাখ মাস। আসমানে তুফাইন্যা মেঘ দ্যাখলে বহুত নাও আইয়া পাড়া গাড়ব এই ঘোঁজায়।

    হ, তহন অনেক নাও ঢুকব এই ঘোঁজায়। বলে হুরমুজ।

    শোন, আমার মস্তকে একখান বুদ্ধি খেলছে। এই ঘোঁজায় নাও রাখলেই খুঁটগাড়ি আদায় করন লাগব। তাতে আমাগ অনেক পয়সা আয় অইব।

    খুঁটগাড়ি আদায় করলে যদি এইখানে নাও না রাখে। বলে জহির।

    রাখব না ক্যান্? নাও যাতে অন্য জা’গায় না রাখে তার একটা ফিকিরও আমার মগজের মইদ্যে ঘুরতে আছে। তোরা রউজ্যারে খবর দিস। সে যে কালই আমার লগে দ্যাখা করে।

    ভাটি পানি। তবুও দূরের পথ বলে বাড়ির ঘাটে পৌঁছতে পানসিটার অনেক সময় লাগে।

    .

    ১৪.

    এরফান মাতব্বরের জ্বর সেরে গিয়েছিল। লাঠি ভর দিয়ে সে হাঁটাচলাও করছিল একটু আধটু। কিন্তু চর বেদখল হওয়ার কথা শুনেই সে আবার নেতিয়ে পড়েছে বিছানায়।

    চর গেছে, চরের ফসল গেছে। খাজনা আর সেলামির এতগুলো টাকাও গেছে বরবাদ হয়ে। তাদের তৈরি ভাওর ঘরে তালেবর হয়ে বসে গেছে জঞ্জুরুল্লার দল। হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, কাঁথা-বালিশ, লড়াইর হাতিয়ার–অনেক কিছুই মুফতে পেয়ে গেছে তারা। এসবের ওপরে গেছে মান-ইজ্জত। এর জন্যই বেশি মুসড়ে পড়েছে এরফান মাতব্বর।

    সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গালাগাল দেয় দলের লোকদের, হারামজাদারা, চর ছাইড়া পলালি ক্যান্ তোরা? ডাকাতি মামলায় আর কয়জনরে ধরত?

    ধরা পইড়্যা হেষে কি জেল খাটতামনি আমরা। একজন কোলশরিক বলে।

    চাকইর‍্যা হারামজাদারা পলাইল ক্যান। ওই নিমকহারামগুলোরে খেদাইয়া দে।

    ওগ খেদাইয়া দিমু! কিন্তু আমরা যে চরদখল করতে চাই আবার। রমিজ মিরধা বলে।

    উঁহু। পারবিনা, পারবি না। কঁকাতে কঁকাতে মাতব্বর বলে। ঐ চাকইর‍্যা দিয়া কাম অইব না। আমি ভালো অইয়া লই।

    কিন্তুক বেশি দেরি অইলে ধানগুলাতে কাইট্যা লইয়া যাইব।

    লইয়া গেলে আর কি করমু।

    জমিরদ্দি : কি করমু! এতগুলা ট্যাহা দিছি আপনের সেলামি।

    এরফান : সেলামি নিয়া জমি দিছি। হেই জমি রাখতে না পারলে কি আমার দোষ? আমিও তো নায়েবরে সেলামি দিছি।

    আহাদালী : আপনে কারে দিছেন, কি দিছেন, আমরা তার কি জানি?

    মেহের মুনশি : অ্যাই তোরা বাইরে যা দেহি। মেহের মুনশি সবাইকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।

    জমিরদ্দি : ও মিয়া মুনশির পো, আমরা সেলামি দিছি ওনারে। আমরা ওনার কাছে জমি চাই।

    মেহের মুনশি : কি শুরু করলা তোমরা? মাতবরের পো-র শরীল ভালো নাই। তোমরা। চুপ অও দেহি।

    জমিরদ্দি : ক্যান্ চুপ অইমু? আমাগ সেলামির ট্যাহা ফিরত চাই।

    রমিজ মিরধা : ক্যান ফিরত চাও। তোমারে, আমাগ বেবাকরে জমিতো দিছিলই। আমরাই তো রাখতে পারলাম না।

    আহাদালী : এমুন কাইজ্যার চরের জমির লেইগ্যা সেলামি নিল ক্যান?

    মেহের মুনশি : সেলামি না নিলে চাকইর‍্যা রাখত কি দিয়া। ওগ রোজানা দিতে, ওগ খাইয়াইতে কি কমগুলা ট্যাহা খরচ অইছে?

    রমিজ মিরধা : তোমরা যার যার বাড়িত যাও। মাতবরের পো ভালো অইয়া উড়ুক, তারপর–

    মেহের মুনশি : হ, তারপর একটা কিছু করন যাইব। তোমরা যাও। খবরদার, রাইতের বেলা নিজের ঘরে শুইও না। পুলিস কিন্তু ধরতে আইব।

    সেদিনের মতো সবাই চলে যায়।

    রোজই দু-চারজন কোলশরিক আসে এরফান মাতব্বরকে দেখতে। রুগী দেখতে এসেও তারা রুগীর বিছানার পাশে বসে ঘ্যানরঘ্যানর করে। কেউ সেলামির টাকা ফেরত চায়। এরা অনেকেই ধারকর্জ করে সেলামির টাকা যোগাড় করেছিল। কেউ বুক থাপড়ে কাঁদে। ঘরে তাদের এক দানা খাবার নেই।

    এদের সকলের অবস্থাই জানে মাতব্বর। নানা ঘাত-প্রতিঘাত সওয়া বুড়ো মন তার। সে মনে আবেগ-উচ্ছ্বাস বড় বেশি ঠাই পায় না। তবুও এদের দুরবস্থার কথা ভেবে ব্যথিত হয় সে। তার চোখ ছলছল করে ওঠে। কখনো বালিশের তলা থেকে পাঁচ-দশ টাকা তুলে ওদের হাতে দিয়ে বলে, নে, কারো কাছে কইস না। আর কিছুদিন সবুর কর। আমার ব্যারামডা সারুক। জঙ্গুরুল্লারে আমাবস্যা দ্যাহাইয়া ছাইড়া দিমু।

    কিন্তু মাতব্বরে ব্যারাম আর সারছে না। শরীরের ব্যারামের চেয়ে মনের ব্যারামেই সে বেশি কাহিল হয়ে পড়েছে। সে বিছানায়ই পড়ে থাকে রাতদিন। মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে বেরোয় গালাগালের তুবড়ি। সে সময়ে রাগ ও ঘৃণায় বিকৃত হয় তার মুখ। কখনো উত্তেজনায় সে হাত-পা ছোড়ে, মাথা উঁচু করে বসতে চায়। তার গালাগালের পাত্র জমিদার, নায়েব, জঙ্গুরুল্লা, দারোগা-পুলিস, আরশেদ মোল্লা, এমন কি তার কোলশরিকরাও। তুবড়ির বারুদ পুড়ে শেষ হয়ে গেলে অনেকক্ষণ ধরে সে হাঁপায়। তারপর মরার মতো পড়ে থাকে। এ। সময়ে একটু একটু করে বারুদ জমা হয়। তারপর আবার হঠাৎ তুবড়ি ছোটে।

    ফজল দিনের বেলা বাপের বিছানার পাশেই বসে থাকে ডাক্তারের ব্যবস্থামত ওষুধ পথ্য দেয়। রাত্রে পুলিসের ভয়ে সে বাড়িতে ঘুমায় না, চলে যায় দূরের কোনো আত্মীয়বাড়ি।

    একদিন আরশেদ মোল্লাকে গালাগাল দিতে দিতে মাতব্বরের রাগ গিয়ে পড়ে ফজলের ওপর। সে মুখ বিকৃত করে বলে, এই একটা ভ্যাদা মাছ। আমার ঘরে ক্যান্ এইডা পয়দা অইছিল–ক্যান্ অইছিল? এত দিনের মধ্যে-আরে এতদিনের মইদ্যে পারল না আহ্ আহ–পারল না নিজের পরিবার পোষ মানাইতে। যা, আইজই যা–আহ-আহ্ বউ আনতে না পারলে––আমার বাড়িতে তোর জা’গা নাই—জাগা নাই কইয়া দিলাম।

    বরুবিবি কাছেই ছিল। বলে, হ, আইজই যা। তোর হউর-হাউরিরে কইস ওনার ব্যারামের কথা। বুঝাইয়া কইস, বউমারে দ্যাহনের লেইগ্যা ওনার পরান ছটফট করতে আছে। ওনারাও তো মানুষ। ওনাগো অন্তরে কি আর দয়া-মায়া নাই?

    .

    আরশেদ মোল্লার অন্তরে সত্যিই বুঝি দয়া-মায়া নেই।

    সেদিনই বিকেলবেলা ফজল শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। সাথে নিয়ে গিয়েছিল হাশমতকে।

    ফজল কাছারি ঘরে বসে থাকে। হাশমত চলে যায় অন্দরে।

    আরশেদ মোল্লাকে সালাম দিয়ে সে বলে, ফুফাজির সাংঘাতিক অসুখ, যখন-তখন অবস্থা। মাতব্বরের অসুখের কথাটা একটু বাড়িয়ে বলবার জন্য শিখিয়ে দিয়েছিল ফজল।

    আরশেদ মোল্লা শুধু হু’ বলে চেয়ে থাকে হাশমতের দিকে।

    ফুফাজি অস্থির অইয়া গেছে ভাবিসাবেরে দেহনের লেইগ্যা।

    হুঁ।

    বউমা-বউমা কইর‍্যা খালি কান্দে।

    পরের মাইয়া দেহনের এত আহেঙ্কাত ক্যান্? নিজের বউ-মাইয়া-পোলা দেইখ্যা পরান জুড়াইতে পারে না?

    কী যেন কন তালুইজি। নিজের মাইয়াত বিয়া দিলে চইল্যা যায় পরের বাড়ি। পুতের বউ থাকে নিজের বাড়ি, নিজের মাইয়ার মতন।

    হ-হ দেছি, মাইয়ার মতন কইও না মিয়া, কও বান্দির মতন।

    তালুইজি, ভাবিরে এহনই লইয়া যাইতে কইছে। আপনেরেও যাইতে কইছে। ফুফাজির অবস্থা খুব খারাপ। এইবার যে বাইচ্যা ওড়, মনে অয় না।

    আরশেদ মোল্লা কোনো কথা বলে না।

    কি কইলেন তালুইজি?

    উঁহু। আমার মাইয়া আর ঐ বাড়ি দিমু না। এতদিন বেচছে মাছ। এহন আবার ডাকাতি শুরু করছে।

    ডাকাতি! ওইডাতো জঙ্গুরুল্লার কারসাজি। চর দখলের লেইগ্যা মিথ্যামিথ্যি ডাকাতি মামলা সাজাইছে।

    আরশেদ মোল্লা উঠে নদীর ঘাটের দিকে চলতে থাকে। অনুনয় বিনয় করতে করতে তার পেছনে চলে হাশমত। কিন্তু তার অনুরোধের কোনো উত্তরই দেয় না সে।

    আরশেদ মোল্লা তার ডিঙি বেয়ে পুবদিকে চলে যায়।

    হাশমত কাছারি ঘরে ফিরে আসে।

    ফজল দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তার চোখে।

    উঁহু, কোনো কাম অইল না। হাশমত বলে। এত কইর‍্যা কইলাম। কাকুতি-মিনতি করলাম। কোনো কথাই কানে নিল না। ব্যাডা এক্কেরে অমাইনষের পয়দা।

    হ, আমি জানতাম, লাথির পেঁকি আঙুলের টোকায় ও না।

    হাশমতের কানের কাছে মুখ নিয়ে সে আবার বলে, তুই চইল্যা যা। লালুগ বাড়িতে গিয়া থাক্। কাইল গেছে পূর্ণিমা। চান মাথার উপরে ওডনের আগেই নাও লইয়া আইয়া পড়বি। লালুরেও সঙ্গে আনিস।

    হাশমত চলে যায়।

    সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্ধকার কাছারি ঘরে চৌকির ওপর বসে আছে ফজল।

    রূপজান জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে যায় তাকে। সে ঘরে গিয়ে হারিকেন ধরায়। ওটা দেলোয়ারের হাতে দিয়ে বলে, যা কাছারি ঘরে দিয়া আয়।

    উঁহু, না–না–না। আমি যাইমু না।

    ক্যান?

    ওরে মা-রে, ডাকাইত! আমার ডর করে।

    দুও বোকা।

    ও, তুমি হোন নাই? ওরে আর আমি দুলাভাই কইমু না। ও বোলে মারু ডাকাইত। রামদা লইয়া ডাকাতি করে।

    রূপজানের চোখ ফেটে পানি আসতে চায়। সে-ও শুনেছে, ফজল ডাকাতি করে। তার বাবা কয়েকদিন আগে উঠানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলছিল, হোনছ রূপির মা, মাতবরের পোলাডা আর ইজ্জত রাখল না। মাছ-বেচা থুইয়া এইবার ডাকাতিতে নামছে। রামদা দ্যাহাইয়া মাইরপিট কইর‍্যা এক গিরস্তের পাঁচশ ট্যাহা লইয়া গেছে।

    রূপজান ধরা গলায় বলে, যা না দাদা, দিয়া আয়।

    উঁহু, আমি পারমু না।

    রূপজান নিজেই শেষে কাছারি ঘরে যায়। হারিকেনটা চৌকির ওপর রেখেই সে চলে যাচ্ছিল। ফজল খপ করে তার আঁচল ধরে ফেলে। হাসিমুখে সে তাকায় রূপজানের দিকে। কিন্তু তার চোখে পানি দেখে ফজলের হাসি মিলিয়ে যায়। তার চোখও ঝাঁপসা হয়ে আসে।

    কারো মুখ দিয়েই কোনো কথা বেরোয় না। দুজনে চেয়ে থাকে দুজনের মুখের দিকে। একজনের মনের পুঞ্জীভূত বেদনা বুঝতে চেষ্টা করে আর একজনের চোখ।

    ফজল তাকে কাছে টানে। রূপজান হারিকেনটা নিবিয়ে দিয়ে মুখ লুকায় ফজলের বুকে।

    তুমি বোলে ডাকাইত? ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে রূপজান।

    কে কইছে তোমারে?ফজল উত্তেজিত স্বরে বলে।

    দুনিয়ার মাইনষে কয়।

    তুমিও কও? তুমিও বিশ্বাস করো এই কথা?

    উঁহু।

    ফজল আরো নিবিড় করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে, সব জঞ্জুরুল্লার কারসাজি। মিথ্যা মামলা সাজাইয়া আমায় খুনের চর দখল কইরা লইয়া গেছে। আল্লার কসম, আমরা কেও ডাকাতি করি নাই।

    রূপজান একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

    শোন রূপজান, ডাকাতি কোনো দিন করি নাই। তবে আইজ কিন্তু ডাকাতি করমু।

    রূপজান কোনো কথা বলে না।

    ফজল আবার বলে, শোন, বাড়ির সবাই ঘুমাইয়া পড়লে তুমি আমার কাছে আইসা পড়বা।

    উঁহু, আমি আইতে পারমু না।

    ক্যান?

    সোন্দর সোন্দর কড়া দিয়া যে খোঁপা বান্দে, তারে যে বোলাইয়া লয়।

    ফজলের বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, কি কইলা বোঝলাম না।

    অহনতো বোঝবাই না। তোমার বালিশের তলায় মাইয়ালোকের খোঁপার কড়া আহে ক্যামনে?

    আরে, ও-হ্-হো-হো। ঐ দিন রাইতে তোমার দেরি দেইখ্যা মনে করলাম তুমি ঘুমাইয়া পড়ছ। তোমাগ পশ্চিমের ঘরের পিছনে গিয়া আন্দাকুন্দি যেই জানালা ঠেলা দিছি অমনি কো-ও কইর‍্যা ওঠছে তোমাগ উমের মুরগি। আমি তো মনে করছি কি না জানি কি? ডরে দিছি লাফ। আর পটুট কইর‍্যা ঢুকলো একটা কড়া। টান দিয়া খুইল্যা দেখি খোঁপার কাঁডা। ঐডা তোমার না?

    ঐ রহম কাঁডা কিন্যা দিছিলা কোনো দিন?

    তবে কার খোঁপার ঐডা?

    আছে এক জনের।

    দ্যাখো তো! তোমার মনে কইর‍্যাই আমি বালিশের নিচে রাখছিলাম। ঐডার খোঁচায় অনেকগুলো রক্ত ঝরছিল। পায়ে এহনো দাগ আছে দ্যাখবা?

    ফজলের গলা জড়িয়ে ধরে রূপজান একটা দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন এঁকে দেয় তার ঠোঁটে।

    আমি যাই, কেও আইয়া পড়ব।

    তোমারে ছাড়তে কি অখন মন চায়। রূপজানের হাতে গলায় হাত বুলিয়ে ফজল বলে, তোমার গা খালি ক্যান? গয়নাগুলা কই?

    বা’জানে উড়াইয়া থুইছে চোরের ডরে।

    আইজ আমি আইছি। একটু সাজ-গোজ কইর‍্যা আইও। গয়না ছাড়া কেমুন বিধবা বিধবা দ্যাহা যায়।

    ছি! অমুন কথা কইও না। আল্লায় যে কোনো দিন অমুন না করে।

    রূপজান, ও রূপজান, কই গেলি?

    ঐ মায় বোলাইতে আছে। ছাড়ো, আমি যাই।

    ফজলের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে চলে যায় রূপজান।

    কালো রাত সারা গায়ে ছোছনা মেখে কেমন মনোহারিণী হয়েছে। বসন্তের ফুরফুরে হাওয়ায় দুলছে তার ঝলমলে আঁচল।

    রাতের বয়স যত বাড়ছে, ততোই উতলা হচ্ছে ফজল। এতক্ষণে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়। কিন্তু কেন আসছে না রূপজান?

    কাছারি ঘরে চৌকির ওপর শুয়ে শুয়ে সে এপাশ-ওপাশ করে।

    হুঁকো টানার গুড়ক-গুড়ক আওয়াজ আসছে।

    তার শ্বশুর এখনো জেগে আছে তা হলে!

    রাতের খাবার সেরে ফজল দরজায় দাঁড়িয়ে কুলকুচা করছিল। সে সময়ে শ্বশুরকে বাইরে থেকে আসতে দেখেছে সে।

    ফজলের বিরক্তি ধরে। এত রাত্রে আবার তামুকের নেশা ধরল ব্যাটার!

    ঝপড়-ঝপপড় শব্দ তুলে স্টিমার চলছে। তার সার্চলাইটের আরো পশ্চিম দিকের জানালা গলিয়ে কাছারি ঘরে ঢোকে। ঘরটাকে দিনের মতো ফর্সা করে দিয়ে যায় কিছুক্ষণ পর পর।

    পশ্চিম থেকে পুবদিকে যাচ্ছে–কোন্ জাহাজ এটা? এ সময়ে তো কোনো জাহাজ নেই। নিশ্চয়ই সৈন্য বোঝাই করে যাচ্ছে।

    হ্যাঁ, মেহেরবানি কইর‍্যা রাইতের আন্ধারেই যাইস। দিনে দুফরে যাইস না কোনো দিন। মনে মনে বলে ফজল।

    কয়েকদিন আগে দুপুরবেলা একটা বড় স্টিমার পশ্চিম থেকে পুবদিকে যাচ্ছিল। ওটায় বোঝাই ছিল বিদেশী সৈন্য। দশ বারোটা গোরা সৈন্য উদাম-উবস্তর হয়ে গোলস করছিল খোলা পাটাতনের ওপর।

    চাঁদ প্রায় মাথার ওপর এসে গেছে। হাশমতের আসার সময় হলো।

    বাইরে পায়ের শব্দ শোনা যায়। পুনপুনু করে কথাও বলেছে যেন কারা। বোধ হয় হাশমত আর লালু এসেছে। কিন্তু ওরা শব্দ করছে কোন সাহসে!

    ফজল তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে সামনের দরজার খিল খোলে। একটা পাট খুলতেই জোরালো টর্চের আলো তার চোখ ধাধিয়ে দেয়।

    ধরো, এই–এই যে আসামি।

    ফজল অন্দরমুখি দরজার দিকে দৌড় দেয়। কিন্তু সেখানেও দাঁড়িয়ে আছে লোক।

    ফজল হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

    এলাকার দফাদার সামেদ আলীকে সাথে নিয়ে দুজন কনস্টেবল ঘরে ঢোকে। তাদের একজন হাতকড়া নিয়ে এগুতেই ফজল বলে, ঐডা থুইয়া দ্যান। আমি পলাইমু না।

    পলানির জন্যিতো দৌড় মারছিলা। চোর-ডাকাইতেরে বিশ্বেস আছে। বলতে বলতে হাতকড়া লাগায় কনস্টেবল।

    অন্য দরজা দিয়ে হাবিলদার, জজুরুলা চৌধুরী ও আর একজন লোক ঘরে ঢোকে।

    মোল্লা, বাড়ি আছ নি, ও মোল্লা? জঙ্গুরুল্লা চেঁচিয়ে ডাক দেয়।

    কে? কারা? বাড়ির ভেতর থেকে প্রশ্ন করে আরশেদ মোল্লা।

    আরে আসো এদিগে। দেইখ্যা যাও।

    ফজল দফাদারকে অনুরোধ করে, আপনে একটু কইয়া দ্যা না! আপনে কইলে হাতকড়াডা খুইল্যা দিব।

    খুলব নারে বাপু। তারা আইনের মানুষ। আইনের বাইরে কিছু করতে পারব না।

    হারিকেন নিয়ে আরশেদ মোল্লা আসে। সকলের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে সে এক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিস দেখে সে যেন ভেবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কথা সরছে না তার।

    চাইয়া দ্যাখ্‌ছ কি? জঙ্গুরুল্লা বলে। জামাইরে বুঝিন একলাই সমাদর করবা। আমরা বুঝি সমাদর করতে জানি না।

    সমাদর এই রাইত দুফরের সময়?

    এমুন সময় না আইলে কি জামাইমিয়ার দরশন পাওয়া যাইত?

    ডুকরে কেঁদে উঠছে কেউ। আওয়াজ আসছে অন্দর থেকে।

    দ্রুতপায়ে আরশেদ মোল্লা অন্দরে চলে যায়। কাছারি ঘর থেকে শোনা যায় এ রকম নিচু গলায় সে ধমক ছাড়ে, চুপ কর, চুপ কর হারামজাদি। মান-ইজ্জত আর রাখল না। একটু থেমে সে স্ত্রীকে বলে, তুমি কি করগো। ওরে কাঁথা দিয়া ঠাইস্যা ধরো না ক্যান্?

    উঁহু-হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ। চাপা কান্নার গুমরানিতে যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে জোছনা-রাতের ফিকে অন্ধকার।

    থাম্‌ বেহায়া শয়তান! আরে তোমারে কইলাম কি? ওর মোখের মইদ্যে টিপলা দিয়া থোও।

    কই গেলা মোল্লা? কাছারি ঘর থেকে ডাক দেয় জঙ্গুরুল্লা। আমরা গেলাম গিয়া।

    আরশেদ মোল্লা ছুটে আসে কাছারি ঘরে। অনুনয়ের সুরে বলে, চী সাব, ওরে ছাইড়া দ্যান। আমি জামিন রইলাম।

    আমি কি জামিনের মালিক? জিগাও হাওয়ালদার সাবরে।

    নেহি নেহি, হাওয়ালদার সাব কুছু করতে পারবে না। হাবিলদার বলে গম্ভীর স্বরে।

    আরশেদ মোল্লা হাতজোড় করে, হাওয়ালদার সাব। ওরে জামিনে ছাইড়া দ্যান। আমি জামিন রইলাম।

    নেহি জ্বী। এ ডাকইতি মামলার এক নম্বর আছামি আছে। হামি জামিন মঞ্জুর করতে পারবে না।

    হ, ঠিক কথাইতো। থানার বড় দারোগাও পারব না। জঙ্গুরুল্লা বলে। যাউক বেড়াইয়া আসুক। এত চিন্তার কি আছে? এক শ্বশুরবাড়িরতন যাইতে আছে আর এক শ্বশুরবাড়ি।

    আপনে আর কাডা ঘায়ে নুনের ছিড়া দিয়েন না, চদরী সাব। ক্ষুণ্ণ কণ্ঠ আরশেদ মোল্লার।

    আরে মিয়া, তোমার তো খরচ বাঁচল। জামাইর লেইগ্যা পিডা-পায়েস তৈয়ার করতে লাগব না কমসে কম সাতটা বছর।

    সাত বচ্ছর! আরশেদ মোল্লা যেন আঁতকে ওঠে।

    সাত বচ্ছর না-তো কি সাতদিন! ডাকাতি অইল মাডারের’ মানে খুনের ছোড ভাই। দফাদার বলে।

    কিন্তুক—কিন্তুক–অরশেদ মোল্লার মুখে কথা জড়িয়ে যায়। কিন্তুক আমার–আমার মাইয়ার কি অইব চদ্‌রী সাব?

    কি অইব তা তুমি জানো আর জানে তোমার গুণের জামাই।

    চদরী সার, ওরে কন আমার মাইয়া ছাইড়া দিয়া যাইতে।

    কিরে? ফজলের দিকে জঙ্গুরুল্লা বলে। তোর শ্বশুর কি কয় শোনছস?

    ফজল কোনো কথা বলে না।

    কিরে কথা কস না ক্যান্? তুই আকাম করছস, তুই একলা তার সাজা ভোগ কর। এই বেচারার মাইয়াডারে ক্যান খামাখা কষ্ট দিবি?

    হাঁ, ইয়ে ছহি বাত কইছেন চৌধুরী সাহাব। জঙ্গুরুল্লার কথার সায় দেয় হাবিলদার। তোম উহার বেটি কো তালাক দিয়ে দোও। বিলকুল সাফ হোয়ে যাও।

    না। দৃঢ়স্বরে বলে ফজল।

    ওরে বাবা! টোড়া সাপের তেজ আছে দেখি। দফাদার বলে।

    অন্দর থেকে চাপা কান্নার ফোঁপানি ভেসে আসছে।

    ফজল কান খাড়া করে। তার দিকে তাকিয়ে তাড়া দেয় জঙ্গুরুল্লা, আর দেরি করণ যায় না। চলো এই বার।

    কাছারি ঘর থেকে বেরিয়ে রওনা হয় সবাই। যেতে যেতে জঙ্গুরুল্লা বলে, ও মোল্লা, তোমার কোনো কথা থাকলে আমার নৌকায় চলো।

    বাড়ির থেকে বেশ খানিকটা দূরে নদীর ঘাটে ভিড়ে রয়েছে জঙ্গুরুল্লার পানসি। আসামি নিয়ে সেটায় চড়ে বসে সবাই। তাদের সাথে ওঠে আরশেদ মোল্লাও।

    ফজল এদিক-ওদিক তাকায়। জোছনার আলোয় দৃষ্টি চলে অনেকদূর। কিন্তু ধারে-কাছে কোনো নৌকা দেখা যায় না। ফজল ভাবে, হাশমত আসেনি। হয়তো এসেছিল, পালিয়ে গেছে। ভালোই করেছে। তাকে পেলেও ছাড়ত না এরা।

    জঙ্গুরুল্লা আবার বলে, কিরে ব্যাডা, কইলাম কি? তোর কাছে তো আর দেনমহরের টাকা দাবি করতে আছে না। কি ও মোল্লা, আছে দাবি?

    উঁহু, আমার মাইয়ার দেনমহরের ট্যাহা চাই না।

    এইতো। এখন মোখেরতন তিনডা কথা বাইর কইর‍্যা ফ্যা–তিন তালাক বায়েন। আমরা বেবাক সাক্ষী।

    না আমি কইমু না।

    ব্যাডা কইবি না। তোর গলায় পাড়া দিয়া কথা বাইর করমু। জঙ্গুরুল্লার সাথের লাঠিধারী লোকটি বলে।

    ফজল হাবিলদারকে বলে, হাওয়ালদার সাব, আমার একটা হাত ছাইড়া দ্যানতত, দেখি কে কার গলায় পাড়া দিতে পারে।

    এই দবির, আমি থাকতে তোরা ক্যান কথা কস? ধমক দেয় জঙ্গুরুল্লা। তারপর সুর নরম করে বলে, শোন ফজল, আমি তোর বাপের বয়সী। যা কই ভালোর লেইগ্যা কই। এই বেচারার মাইয়াডারে ঠেকাইয়া রাখলে তোর কী ফয়দা অইব?

    আমার ফয়দা আমি বুঝি।

    কিন্তু আমি শুনছি মাইয়া তোরে চায় না।

    মিছা কথা, একদম মিছা কথা।

    কি মোল্লা, তুমি কি কও?

    হ ঠিক কইছেন, আমার মাইয়া ওর ঘর করতে রাজি না।

    রাজি না, তয় তারেই তালাক দিতে কন। আমি দিমু না’, ফজল বলে।

    আরে মাইয়ালোকে তালাক দিতে পারলে কি আর তোরে জিগাইতাম! জঙ্গুরুল্লা বলে। মাইয়া যখন তোরে চায় না তখন–

    আমি বিশ্বাস করি না।

    আইচ্ছা, এই কথা? যাও তো দফাদার। আর কে যাইব? দবির যাও। মাইয়ারে জিগাইয়া আমার কাছে আইসা সাক্ষী দিবা।

    দফাদার ও দবির গোরাপিকে নিয়ে আরশেদ মোল্লা বাড়ি যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলে, মাইয়া কইছে, সে ডাকাইতের ঘর করব না।

    ছারেছার মিথ্যা কথা। আমি আমার নিজের কানে শুনতে চাই। ফজল বলে।

    নিজের কানে শোননের কি আছেরে ব্যাডা ঘাড়য়া? এতগুলো মাইনষে সাক্ষী দিতে আছে। জঙ্গুরুল্লা খেঁকিয়ে ওঠে।

    না, সিধা আঙ্গুলে ঘি উঠব না। দফাদার বলে।

    ঠিক কথা কইছ। কাগজ-কলম বাইর কর। লেখ, অমুকের মাইয়া অমুকেরে আমি তিন তালাক বায়েন দিলাম।

    দফাদার একটা কাগজে লিখে জঙ্গুরুল্লার দিকে এগিয়ে দেয়। জঙ্গুরুল্লা সেটা হাবিলদারের হাতে দিয়ে বলে, নেন হাওয়ালদার সাব। এইবার সই আদায় করণের ভার আপনের উপর দিলাম।

    হাবিলদার ফজলের ডানহাত থেকে হাতকড়া খুলে নিয়ে বলে, করো দস্তখত, ক দোও।

    না করুম না।

    গালে থাপ্পড় মেরে হাবিলদার বলে, কর দস্তখত।

    করমু না। আরো জোরে চেঁচিয়ে বলে ফজল।

    আবার থাপ্পড় পড়ে ফজলের গালে।

    জলদি দস্তখত কর।

    না–না–না।

    জঙ্গুরুল্লা আরশেদ মোল্লাকে বলে, তুমি বাড়ি যাও। চিন্তা কইর‍্য না। দস্তখত আদায় কইর‍্যা ছাড়মু মনে করছ? ও মাঝিরা নৌকা ছাড়ো।

    আরশেদ মোল্লা পানসি থেকে নেমে বাড়ির দিকে পথ নেয়।

    .

    ১৫.

    আসাধারণ রূপ নিয়ে জন্মেছিল বলে নাম রাখা হয়েছে রূপজান। গাছপাকা শবৃরি কলার মতো তার গায়ের রঙ। যৌবনে পা দেয়ার সাথে সাথে সে রঙের ওপর কে যেন মেখে দিয়েছে জোছনার স্নিগ্ধতা। তার ঈষৎ লম্বা মুখে টিকলো নাক। মমতা মাখানো টানা চোখ। চোখ দুটির যেন আলাদা সত্তা আছে। পাতলা ঠোঁট নেড়ে কথা বলার সময় প্রজাপতির ডানার মতো নড়ে তার চোখের পাপড়ি। ঝিলিক মেরে ওঠে ঘন নীল চোখের তারা। হাসবার সময় শশার বিচির মতো ছোট ছোট সুবিন্যস্ত দাঁত দেখা যায় কি যায় না।

    শুধু রঙ-চেহারাই নয়। স্বাস্থ্যও তার ভালো। দোহারা গড়ন। দিঘল শরীর থেকে লাবণ্য যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। মজবুত ভিতের ওপর গঠিত তার পরিপুষ্ট বক্ষে যেন বাসা বেঁধেছে সারা দুনিয়ার লজ্জা। প্রতিবেশিনীদের বিবেচনায় শরীরটা রূপজানের আমুনে। বুড়িয়ে যাবে তাড়াতাড়ি, পাকবে আমন ধানের মতো দেরিতে। শুধু একটা জিনিসের অভাব। তার চুল কালো নয়। দু-তিন দিন তেল না পড়লে তার চুলের লালচে রঙ বেরিয়ে পড়ে।

    রঙ ও চেহারা-সুরত সবটাই রূপজান পেয়েছে তার মা সোনাভানের কাছ থেকে। সোনাভানের মা চন্দ্রভান ছিল ধলগাঁয়ের কলু বংশের মেয়ে। সে বংশের সব ছেলে-মেয়ের গায়ের রঙ শশার মতো। গ্রামের লোক তাই ঐ বংশকে বলত পাকনা শোশার ঝাড়। চন্দ্রভানের স্বামী আদালত শেখ ছিল নারায়ণগঞ্জের এক পাট-কোম্পানির মালিক জন ল্যাম্বার্টের কুঠির মালি। আর আরশেদ মোল্লা ছিল তার কুত্তার রাখাল। সায়েবের একমাত্র ছেলে স্টিফেন বিলেত থেকে এসেছিল বাপের কাছে। তার নজর পড়ে সোনাভানের ওপর। সায়েব টের পেয়ে সাত-তাড়াতাড়ি আরশেদ মোল্লার সাথে সোনাভানের বিয়ে ঘটিয়ে দু’হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে বিদেয় করেন কুঠি থেকে।

    বিয়ের হাটে রূপসী মেয়ের জন্য গ্রাহকের ভিড় জমে। রূপজানের জন্যও ভিড় জমেছিল। নিলাম ডাকার মতো গয়না ও শাচকের টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে রূপজানকে ছেলের বউ করে ঘরে নিতে পেরেছিল এরফান মাতব্বর।

    রূপজানকে মাতব্বর পছন্দ করেছিল শুধু তার রূপ দেখে। ছেলের বিরহী ভাঙা মনকে জোড়া লাগাবার জন্যই দরকার ছিল জরিনার চেয়েও সুরলী মেয়ের। তাই মেয়ের বাপের কুল, মায়ের কুল দেখবার প্রয়োজন বোধ করেনি সে, গ্রাহ্য করেননি গায়ের প্রবাদ–

    বউ আনো ঘর দেখে,
    মেয়ে দাও বর দেখে।

    প্রবাদটি যে শুধু কথার কথা নয়–পরে বুঝতে পেরেছিল সে আরশেদ মোল্লার শয়তানি দেখে। আর সে জন্য আফসোসও করেছে সে বড় কম নয়। অবশ্য নিজের কৃতকর্মের সমর্থনে সে বলে, বিয়ার আসল জিনিস অইল বউ। বউডা তো রূপে-গুণে, চলা-চতিতে ভালোই আছিল।

    রূপজানের তালাকের খবর শুনে আবার ঘটকের আনাগোনা শুরু হয়েছে মোল্লাবাড়ি। সম্বন্ধের প্রস্তাব এসেছে অনেক কয়টা। দরও বাড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। সবচেয়ে লোভনীয় প্রস্তাব একটা এসেছিল জঙ্গুরুল্লার কাছ থেকে তালাকের আগেই। তার পীর মৌলানা তানবীর হাসান ফুলপুরী বছরে দু’বার আসেন এ এলাকায়। একবার বর্ষাকালে, গেরস্তের পাট বেচার সময়। আর একবার শীতকালে, আমন ধান উঠবার পরে পরেই। তিনি বজরা নিয়ে ফেরেন মুরিদানের বাড়ি। জঙ্গুরুল্লা তার জন্য নিজের বাড়িতে মসজিদের পাশে খানকাশরিফ বানিয়ে রেখেছে। পীরসাহেবের বিবিরা থাকেন সুদূর ফুলপুরে। বাঙ্গাল মুলুকের পানির ভয়ে তাদের কেউ তার সাথে আসেন না। এই বিদেশে কে তার খেদমত করে?

    তালাকের পর আবার মোল্লাবাড়ি আসে জঙ্গুরুল্লা। সে আরশেদ মোল্লাকে বলে, শোনলাম অনেক সম্বন্ধ আইতে লাগছে?

    হ, আইছে কয়েকখান।

    আরে এত কায়দা-ফিকির কইর‍্যা তালাক দেওয়াইলাম আমি। আর মাইনষে বুঝি এহন তৈয়ার ললাটে চিড়া কোটতে চায়! খবরদার মিয়া, মোখের কথা যেন ঠিক থাকে।

    মোখের কথা তো ঠিক থাকব। কিন্তু একটা কথা।

    কি কথা আবার।

    জামাইর বয়স যে শ্বশুরেরতনও বেশি। ঐ যে মাইনষে কয়, তালুইর তন পুত্ৰা ভারী, হেই রহম অইয়া যাইব।

    আরে তুমি রাখো ঐ কথা। উনি অইলেন আল্লাওয়ালা মানুষ। উনারা এত ত্বরাত্বরি বুড়া অন না। দেখছ না কেমুন নুরানি চেহারা!

    হ, পীর-দরবেশরা তো আল্লার নিজের আতের তৈয়ারি। উনাগ চেহারাই আলাদা।

    হ শোন, ইদ্দতের কয়ডা মাস পার অউক। তারপর পীরসাব যখন শাওন মাসে আইবেন, তখন ইনশাল্লাহ্ কাজটা সমাধা করণ যাইব।

    আর জমির কথা যে কইছিলেন?

    আরে হ, তোমার লেইগ্যা তো দশনল জমি রাইখ্যা থুইছি খুনের চরে।

    দশনল না। আরো দশনল দিতে লাগব। মাইয়ার গয়না আপনেগ দেওনের দরকার নাই। গয়না আমিই দিমু।

    কি কয়! আলু গয়না

    আইচ্ছা! গয়না যদি তুমি দেও, তবে নিও আরো দশ নল। কিন্তু মোখের কথা যে উডায় না।

    সব কথা পাকাপাকি করে চলে যায় জঙ্গুরুল্লা। আরশেদ মোল্লা ব্যাপারটা গোপন রাখে। এমন কি তার স্ত্রীর কাছেও বলে না কিছু। খুনের চরে গিয়ে সে মাপজোখ করে বুঝে নেয় বিশ নল জমি।

    কিন্তু গোপন কথা বেরিয়ে পড়ে। একদিন আরশেদ মোল্লা আফার থেকে বাক্স নামিয়ে খুলে মাথায় হাত দেয়। রূপজানের একটা গয়নাও তার মধ্যে নেই। সে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয় স্ত্রীর সাথে, কই গেল গয়না? তুই গুঁজাইয়া থুইছস?

    উনি কি কয়! আমি ক্যান্ গুঁজাইমু?

    হ, তুই না জাইলে যাইব কই? বুড়াকালে তোর গয়না পিন্দনের শখ অইছে।

    তোবা-তোবা! গয়না পিন্দনের শখ অইলে তো গায়ে দিয়া বইয়া থাকতাম। আর মাইয়ার শরীল খালি কইর‍্যা মাইয়ার গয়না গায় দেয় এমুন মা আছে দুইন্যায়?

    তয় গেল কই? রূপিতে সরায় নাই? রূপি, ও রূপি।

    রূপজান এসে দাঁড়ায়। তার চোখ-মুখ ফোলাফোলা। চুল উদ্ভুখু। তেল না পড়ায় নারকেলের ছোবড়ার মতো রঙ হয়েছে সে চুলের।

    আরশেদ মোল্লা তার দিকে চেয়ে বলে, গয়নাগুলা তুই সরাইয়া রাখছস?

    রূপজান কথার জবাব দেয় না।

    কি জিগাইলাম? গয়নাগুলো তুই সরাইয়া রাখছস?

    হ।

    আমারে না জিগাইয়া নিছস্ এত সাহস তোর!

    রূপজান নিরুত্তর।

    আরশেদ মোল্লা আবার বলে, কই রাখছস, লইয়া আয়। চোরের যেই উৎপাত চাইরধারে–

    যাগো জিনিস তাগো কাছে পাড়াইয়া দিছি।

    কি কইলি হারামজাদি! মোল্লা মেঝেতে পড়ে থাকা বাক্সের তালাটা হাতে নিয়ে লাফিয়ে ওঠে। ছুঁড়ে মারে ওটা রূপজানের দিকে। তার মাথাটা কেমন করে যেন তার অজান্তেই একদিকে কাত হয়ে যায়। আর তালাটা তার কানের পাশ দিয়ে শাঁ করে গিয়ে ভেঙে দেয় একটা চালের মকি।

    সোনাইবিবি ছুটে আসে। দু’হাত মেলে সে মারমুখি মোল্লার পথ রোধ করে দাঁড়ায়।

    ছাড়ো ছাড়ো, ওরে আইজ মাইরা ফালাইমু। ধুইন্যা তুলা-তুলা কইর‍্যা ফালাইমু।

    ছিঃ—ছিঃ—ছিঃ–! জুয়ানমাইয়ার গায়ে আত তোলে, শরমও নাই। ওরে মাইর‍্যা তো ফালাইছেনই। ও কি আর জিন্দা আছে?

    আরশেদ মোল্লা থামে। সে কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলে, হারামজাদি আমারে যে মাইরা ফালাইছে! এহন আমি গয়না পাই কই?

    গয়না দিয়া কি করব?

    আরে গয়না লাগব না মাইয়ার বিয়া দিতে? গয়না দিতে না পারলে দশ নল জমি ফিরত দেওন লাগব।

    জমি ফিরত দেওন লাগব! ক্যান?

    আরশেদ মোল্লা আর গোপন রাখতে পারেনা ব্যাপারটা। জঙ্গুরুল্লার কাছে তার ওয়াদার কথা সে খুলে বলে স্ত্রীকে।

    সোনাইবিবি শুনে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, মাইয়ার পরানডারে তো এক্কেরে ঝরা কইর‍্যা ফালাইছে। কায়ামরা বানাইয়া ফালাইছে। এহন আবার কবর দেওনের কারসাজি শুরু করছে।

    .

    মা বোঝে মেয়ের মন। সত্যিই ঝাঁজরা হয়ে গেছে রূপজানের বুকের ভেতরটা।

    ফজলকে ধরে নেয়ার পর তিনদিন সে বিছানায় পড়ে ছিল। দানাপানি ছোঁয়নি। তারপর যখন তালাকের খবর তার কানে এল তখন তার দাঁতকপাটি লেগে গিয়েছিল। হুশ হওয়ার পর আত্মহত্যার স্পৃহা জেগেছিল তার মনে। একটা রশি সরীসৃপের মতো তার মনের দরজায় হানা দিয়েছে বারবার। কিন্তু সে জানে আত্মহত্যা মহাপাপ। তাই সে সরীসৃপ মনের দোরগোড়া থেকেই বিদায় হয়েছে।

    রূপজান ভেবে পায়না–কেন ফজল তাকে তালাক দিয়ে গেল? সে হয়তো মনে করেছে–রূপজান জানত সব ষড়যন্ত্রের কথা। জেনেও তাকে হুশিয়ার করে দেয়নি কেন সে?

    কিন্তু রূপজান যে কিছুই জানত না। সে অবশ্য তাদের বাড়ির নিচে নদীর ঘাটে জঙ্গুরুল্লার পানসি দেখেছিল একদিন। তার বাপকেও যেতে দেখেছিল পানসিতে। তারা যে এরকম একটা চক্রান্ত করতে পারে তা সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি।

    ঐ দিন রাত্রে বাড়ির সবাই ঘুমিয়েছে মনে করে সে কাছারি ঘরে যাওয়ার জন্য নিশ্চপে বিছানা ছেড়ে উঠেছিল। আলগোছে দরজার খিল খুলে কয়েক পা এগুতেই সে দেখে তার বাপ উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। সে যেমন বেরিয়েছিল তেমনি আবার ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছিল। বাপ দেখে ফেলেছে মনে করে তার লজ্জার সীমা-পরিসীমা ছিল না। সে যদি তখন বুঝতে পারত কেন তার বাপ জেগে রয়েছে, এতরাত্রে কোন বান্ধবের জন্য অপেক্ষা করছে, তাহলে কি আর ধরতে পারত ফজলকে? কাছারি ঘরে ছুটে গিয়ে, চিৎকার দিয়ে সে হুশিয়ার করতে পারত তাকে। লজ্জা-শরমের তোয়াক্কা সে করত না তখন।

    রূপজানের মনে হয়–ফজল ইচ্ছে করে তালাক দেয়নি। যারা তাকে চক্রান্ত করে ধরিয়ে দিয়েছে তারাই জোর-জবরদস্তি করে বাধ্য করেছে তাকে তালাক দিতে। কিন্তু তার বাপ যে বলে, ফজল কাগজে লিখে তালাক দিয়ে গেছে। তবে কি সে সত্যি সত্যি নিজের ইচ্ছায় তালাক দিয়েছে?

    কেন সে এ কাজ করল? কেন সে তাকে নিষ্কৃতি দিয়ে গেল? সে-তো চায়নি। এখনো তা চায় না তার মন। কোনো দিন চাইবেও না।

    আবার প্রশ্ন জাগে রূপজানের মনে বছরের পর বছর জেল খাটতে হবে বলেই কি সে এ কাজ করল? তাকে আবার বিয়ে করার সুযোগ দিয়ে গেল?

    জেলের কথা মনে হতেই শিউরে উঠে রূপজান। সে শুনেছে–জেলে অনেক কষ্ট। সেখানে নাকি বেদম মারধর করে। পেট ভরে খেতে দেয় না। শুতে বিছানা দেয় না। গরু-মোষের মতো ঘানি টানতে হয়। চাকিতে পিষে ছাতু বানাতে হয়। কোনো কাজ না। থাকলেও একদণ্ড জিরোতে দেয়না। ডালে চালে মিশিয়ে দিয়ে বলে, বাছো বসে বসে। বাছা শেষ হলে রান্না, তার পরে খাওয়া।

    রূপজানের চোখ ফেটে পানি আসে। দু’গাল বেয়ে নামে অশ্রুবন্যা। চাপা কান্নার ঢেউয়ে। থরথরিয়ে কাঁপে তার সারা দেহ। সে অস্ফুটস্বরে বলে, তুমি বিনা দোষে জেলে পইচ্যা মরবা। আর আমি আর একজনের ঘরে গিয়া সাধ-আহ্লাদ পুরা করমু? না, কিছুতেই না। কিছুতেই না।

    তাকে কি জেল থেকে খালাস করে আনা যাবে না?–ভাবে রূপজান।

    কেন যাবে না? ঠিকমত মামলার তদবির করলে, টাকা খরচ করলে নিশ্চয় তাকে খালাস করে আনা যাবে। টাকায় কি না হয় তার শ্বশুর নিশ্চয় টাকা খরচ করবে।

    কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে সন্দেহ জাগে–শ্বশুরের কাছে যদি এখন টাকা না থাকে? তার বন্ধক দেয়া গয়না ছাড়াতে যদি সব টাকা ফুরিয়ে গিয়ে থাকে?

    এ কথা মনে হওয়ার পরেই একদিন সুযোগ বুঝে সে বাক্স খুলে তার সবকটা গয়না সরিয়ে ফেলেছিল। কি হবে গয়না দিয়ে । যার গয়না তারই কাজে লাগুক। বাপের কাছে। সেদিন মিথ্যে করে বলেছিল–যাদের গয়না তাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আসলে গয়নাগুলো তখনো তার কাছেই ছিল। লুকিয়ে রেখেছিল কাঁথার গাঁটরির মধ্যে। সে সুযোগ খুঁজছিল, কেমন করে কাকে দিয়ে ওগুলো পাঠাবে শ্বশুরের কাছে।

    অনেক ভেবে-চিন্তে রূপজান তার চাচাতো ভাই কাদিরকে ঠিক করে। সে জানে–এ পাড়ায় একমাত্র কাদিরেরই কিছুটা টান আছে ফজলের জন্য। আর তাকে বিশ্বাসও করা যায় ।

    কাদির যেদিন গয়নার পুটলি নিয়ে মাতব্বর বাড়ি পৌঁছে, সেদিন এরফান মাতব্বরের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। তার বিছানার চারপাশে বসে লোকজন দোয়া-দরূদ পড়ছে। বরুবিবি শিয়রের কাছে বসে চোখের পানি ফেলছে, চেয়ে আছে মাতব্বরের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পরে পরে চামচে করে পানি দিচ্ছে সে মাতব্বরের মুখে। ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছে বাড়ির মেয়েরা।

    মসজিদের ইমাম সাহেব এসে তওবা পড়িয়ে চলে গেছেন।

    বিছানা থেকে উঠবার শক্তি আগেই হারিয়েছিল এরফান মাতব্বর। আরশেদ মোল্লা জঙ্গুরুল্লার সাথে ষড়যন্ত্র করে পুলিস ফাঁড়ির পুলিস ডেকে ফজলকে ধরিয়ে দিয়েছে শুনে রাগে উত্তেজনায় সে চিৎকার করে উঠেছিল। ঝাড়া দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সে যেন প্রচণ্ড ঝড়ে উৎপাটিত বুড়ো বটগাছ। কাঁপতে কাঁপতে সে চৌকির থেকে নিচে পড়ে বেহুশ হয়ে যায়। তারপর থেকেই তার জবান বন্ধ। তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে দ্রুত। দিঘিরপাড় থেকে ডাক্তার এসেছিলেন। ঐষধ দিয়ে বলে গেছেন, রুগীকে যদি কিছু খাওয়াতে মন চায়, তবে খাওয়ানো যেতে পারে।

    কাদির দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ, নির্বাক। সে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

    রমিজ মিরধা কাদিরকে চিনতে পেরে বলে, তুমি আরশেদ মোল্লার ভাইপুত না? তুমি আইছ কি করতে? তোমার চাচায় বুঝিন পাডাইয়া দিছে মাতবরের পো-র মরণকষ্ট দ্যাখতে?

    মাঐজীর লগে দুইডা কথা কইমু। কাদিরের মুখে কথা জড়িয়ে যায়।

    কি কথা? কইয়া ফালাও। মেহের মুনশি বলে।

    বু আমারে পাডাইছে। এই গয়নাগুলা দিছে। এগুলা বেইচ্যা দুলাভাইর মামলার তদবির করতে কইছে।

    কাদির গয়নার পুটলিটা বরুবিবির দিকে বাড়িয়ে দেয়।

    বরুবিবি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

    মেহের মুনশি পুটলিটা হাতে নেয়। গয়নাগুলো খুলে রাখে বরুবিবির সামনে।

    বরুবিবি দু’হাত ভরে গয়নাগুলো তোলে। তার হাত কাঁপছে। মাতব্বরের মুদিত চোখের সামনে সেগুলো মেলে ধরে কাঁদে-কাঁদো স্বরে বলে, ওগো হোনছে? বউ বেবাক গয়না পাড়াইয়া দিছে।

    ও দুদু, হোনছেন? কানের কাছে মুখ নিয়ে মেহের মুনশি ডাকে। মাতব্বর চোখ মেলে। মরা মাছের চোখের মতো ঘোলাটে সে চোখ।

    ও দুদু, দ্যাহেন চাইয়া। বেবাক গয়না পাড়াইয়া দিছে বউ।

    বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে মাতব্বর। তার ঠোঁট নড়ে। কি যেন বলতে চায়, কিন্তু পারে না। সে মুখ হাঁ করে।

    বরুবিবি চামচ ভরে পানি দেয় তার মুখে। সে আবার চোখ বোজে।

    তারপর আর এক রাত বেঁচেছিল মাতব্বর। মরার আগে কিছুক্ষণের জন্য তার বাকশক্তি ফিরে এসেছিল। জিভে জড়ানো ছাড়াছাড়া অস্পষ্ট কতকগুলো শব্দে সে তার অন্তিম ইচ্ছা জানিয়ে গেছে। রূপজানের গয়না সম্বন্ধে সে শুধু বলে গেছে, বউর মহরানার হক।

    কথা ক’টির ব্যাখ্যায় সকলেই একমত–রূপজানের কাছে ফজলের দেনমহরের দেনা এরফান মাতব্বর শোধ করে গেছে। রূপজান ছাড়া ও গয়নায় আর কারো হক নেই।

    .

    ১৬.

    দু’সপ্তাহ হাজতবাসের পর আদালতে হাজির করা হয়েছিল ফজলকে। সেখানেই সে তার পিতার মৃত্যুর খবর পায়।

    মামলার তদবিরের জন্য মেহের মুনশি আদালতে এসেছিল। তার নিযুক্ত উকিল ফজলকে জামিনে খালাস করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন অনেক। আসামির পিতার মৃত্যু হয়েছে–এ কারণ দেখিয়েও তিনি জামিন মঞ্জুর করাতে পারেননি।

    বুকভরা কান্না নিয়ে আবার ফজল জেলে ঢোকে। কান্না চাপতে গিয়ে ফুলে ফুলে ওঠে তার বুক। ফুলে যায় চোখ-মুখ । অন্যান্য আসামিরা কাছে এসে দু-একটা সহানুভূতির কথা বলতেই তার রুদ্ধ কান্না বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসে।

    অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে ফজল। বুকের পুঞ্জীভূত মেঘ অনেক পানি ঝরিয়ে হালকা হয় কিছুটা। কান্নার তাণ্ডব কমে এলে প্রথমেই যে ছবিটি তার কল্পনায় ভাসে তা একটি কবরের। কবরের পাশে বসে কাঁদছে তার মা। পরিধানে তার সাদা থান। তার গা ঘেষে বসে আছে আমিনা আর নূরু। তারাও কাঁদছে।

    রূপজানও কি কাঁদছে? হ্যাঁ, এতো সে। সে-ও কাঁদছে। না-না-না, ভুল দেখছে সে।

    ফজল তার মনের পর্দা থেকে মুছে ফেলতে চায় রূপজানের ছবি। কিন্তু পারেনা। তার মনে হয় রূপজান কাঁদছে না, কাঁদার ভান করছে। সে কাঁদতে পারে না। কেন কাদবে সে? কার জন্য কাঁদবে? ফজলের বাপ তার কে? ফজলই তো তার কিছু নয়। সে ডাকাত। ডাকাতের ঘর করবে না বলে সে তালাক নিয়েছে।

    রূপজান কি সত্যিই বলেছিল–সে ডাকাতের ঘর করবে না? এখনো সন্দেহ জাগে ফজলের মনে। কিন্তু সে যদি এ কথা না-ই বলে থাকে, তবে দু-দুটো লোক কেন সাক্ষী দিল এসে? এমন ডাহা মিথ্যে কথা বলে তাদের লাভ? কিন্তু রূপজান তো সেদিন তার কাছে বলেছিল–সে বিশ্বাস করে না ডাকাতির কথা। কি জানি, হয়তো মনে করেছে যার কপালের ভোগ সে একাই ভোগ করুক। সে কেন এমন পুরুষের অদৃষ্টের সাথে নিজেরটা জড়িয়ে নিজের ভবিষ্যত নষ্ট করবে?

    ফজল আবার ভাবে, ঠিকই করেছে রূপজান। ঐদিন যদি সে এট্টুকু বুঝত, তবে আর তাকে অতটা লাঞ্ছনা ভোগ করতে হতো না। তালাকনামায় একটা দস্তখত মেরে দিলেই সে জঙ্গুরুল্লা ও হাবিলদারের অকথ্য নির্যাতন থেকে রেহাই পেত। তার বুড়ো আঙুলে কালি মাখিয়ে জোর করে তার টিপসই নেয়ার দরকার ছিল না তাদের।

    .

    দু’মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেক আসামি ছাড়া পেয়ে চলে গেছে। অনেক নতুন আসামি এসেছে। নতুনের মধ্যে দুজন তার পরিচিত। তারা বিক্রমপুরের নামকরা হা-ডু-ডু খেলোয়ার বাদল আর আল্লাস। দিঘিরপাড়ের জেদাজিদির খেলায় ঘাড়ের মতো জোবোয়ার এই বাদলকেই সে মাজায় ধরে রেখে দিয়েছিল।

    বাদল আর আকলাস জেলে ঢুকতেই ফজল ম্লান হেসে এগিয়ে যায় তাদের কাছে।

    বাদল চিনতে পেরে বলে, কিহে বাহাদুর, তুমি এখানে কেন? কবে এলে?

    এই দুই মাসের কিছু বেশি। জবাব দেয় ফজল।

    অ্যাঁ, দু’মাস!

    একজন আসামি বলে, ওনারে মিথ্যা ডাকাতি মামলায় ফাঁসাইয়া দিছে। বাপ মারা গেছে তবুও বেচারা জামিন পাইতেছে না।

    শুনে বাদল আর আল্লাস দু’জনই ব্যথিত হয়।

    কয়েক দিনের মধ্যেই ওদের সাথে ফজলের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

    ওরা নাকি কোন ষড়যন্ত্র মামলার আসামি। ইংরেজ শাসকদের দেশ থেকে তাড়াবার জন্য ওরা এক গুপ্ত রাজনৈতিক দল গঠন করেছিল। দলের নেতাসহ সাতজন ধরা পড়েছে।

    দলের নেতা মতির বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি হবে। এর আগে নাকি তিন বারে বছর দশেক জেল খেটেছে সে। তার পাতলা ছিপিছিপে শরীরে মেদের নামগন্ধ নেই। গাল দুটা বসে গেছে। চোখে পুরু চশমা। চোখেমুখে মেঘলা দিনের গম্ভীর্য। কথা বলার সময় চোখের তারায় বিদ্যুত জ্বলে, ঠোঁটের কোণে চিকচিক করে কেমন এক অদ্ভুত হাসি।

    তার দিকে তাকালেই শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে ফজলের। সে ভাবে দেশের স্বাধীনতার জন্য জেল খাটতে খাটতে মতিভাইয়ের স্বাস্থ্যের এ দশা হয়েছে।

    মতি তার দলের সবার সাথে কি সব আলোচনা করে। ফজল বুঝতে পারে না সব। তাদের আলোচনা থেকে সে এট্টুকু জানতে পারে–জাপানিরা রেঙ্গুন দখল করেছে। এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে। চাটগাঁ ও আরো অনেক জায়গায় বোমা ফেলে ছারখার করে দিয়েছে।

    কয়েকদিন পরে আবার ফজলকে আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু এবারেও তার উকিল জামিন মঞ্জুর করাতে পারেননি। মেহের মুনশির কাছে বাড়ির খবরাখবরের সাথে এক দুঃসংবাদ পায় ফজল। পুলিস আর মিলিটারি মিলে তাদের এলাকার শতশত নৌকা ফতেগঞ্জ নিয়ে আটক করেছে। ফজলদের নতুন পানসি আর ঘাসি নৌকাটাও নিয়ে গেছে। অনেকে ফতেগঞ্জ গিয়ে তাদের নৌকায় নম্বর লাগিয়ে ফেরত নিয়ে এসেছে। এর জন্য নাকি অনেক টাকা ঘুস দিতে হয়। মেহের মুনশি ফতেগঞ্জ গিয়েছিল। দেশের সব জায়গা থেকেই নৌকা আটক করা হয়েছে। হাজার হাজার নৌকার ভেতর থেকে সে ফজলদের পানসিটা খুঁজে বার করতে পারেনি। ঘাসিটা সরকার কিনে নিতে চেয়েছিল। দাম ধার্য হয়েছিল মাত্র একশ’ টাকা। তিরিশ টাকা বোট ইন্সপেক্টরকে ঘুস দিয়ে ওটায় নম্বর লাগিয়ে ফেরত আনা হয়েছে।

    ফজলের মনে হয়, নতুন পানসিটা দেখে কারো লোভ লেগেছিল। সে-ই নিজের বলে দাবি করে ঘুস দিয়ে ওটা নিয়ে গেছে।

    বিপদ কখনো একা আসে না। কথাটা একেবারে খাঁটি–ভাবে ফজল। যে পানসিটা গেল তা আর সারা জীবনেও সে গড়াতে পারবে না।

    এত নৌকা জমা করছে কেন সরকার? আবার কতগুলোয় নম্বর লাগিয়ে ছেড়েই বা দিচ্ছে কেন?–ফজল বুঝতে পারে না। বাদল বুঝিয়ে দেয় ব্যাপারটা : এই নদী-নালার দেশে নৌকা ছাড়া যুদ্ধ করা অসম্ভব। সৈন্য-সামন্ত, যুদ্ধের সরঞ্জাম ইত্যাদি পারাপার আনা-নেয়ার জন্য নৌকার দরকার। জাপানিরা এগিয়ে আসছে। দরকারের সময় যাতে নৌকার অভাব না ঘটে, আবার বেগতিক দেখলে সমস্ত নৌকা পুড়িয়ে ডুবিয়ে কৃতিত্বের সাথে পালানো যায় তাই নৌ-শুমারি করে রাখছে ইংরেজ সরকার। তারা বেছে বেছে কিছু নৌকা কিনেও রাখছে যুদ্ধের কাজে ব্যবহারের জন্য।

    ফজল অবাক হয়ে ভাবে–এত খবর রাখে এ রাজনৈতিক বন্দিরা! তারা খবরের কাগজ পড়ে। তাই দুনিয়ার খবর তাদের পেটে। এক-একজন যেন খবরের গুদাম।

    খবরের কাগজ পড়বার জন্য এরা অস্থির হয়ে পড়ে। জেলখানায় খবরের কাগজ আসার সাথে সাথে রাজনৈতিক বন্দিরা এক-একজন এক-এক পাতা নিয়ে পড়তে শুরু করে। একজন পড়া আরম্ভ করলে তিন-চারজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে পাতার ওপর। স্বাধীনতা আন্দোলন আর যুদ্ধের খবর জানার জন্য এরা সব উদগ্রীব। এদের দেখাদেখি ফজলও কাগজ পড়া শুরু করেছে। সবার পড়া হয়ে গেলে সে কাগজের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলে। মোহামেডান স্পোর্টিং-এর খেলা থাকলে সে এদের মতো অস্থির হয়ে যেত কাগজ পড়ার জন্য। লেখাপড়া ছেড়ে দেয়ার পর সে আর কাগজ পড়ার সুযোগই পায় নি। এখন অন্যান্যদের মতো সে-ও খবরের কাগজ আসার প্রতীক্ষায় সময় গোনে।

    এতদিন দুনিয়ার কোনো খবরই রাখত না ফজল। এখন খবরের কাগজ পড়ে সে বুঝতে পারে–দুনিয়ার হালচাল বদলে যাচ্ছে, যুদ্ধের কারণে দ্রুত বদলে যাচ্ছে দুনিয়ার চেহারা।

    কাগজ পড়ে সে আরো জানতে পারে, সারা দেশব্যাপী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। দুটি রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিরোধ বেড়েই চলেছে। কংগ্রেস চায় অখণ্ড ভারত আর মুসলিম লীগ চায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলিমদের জন্য আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র–পাকিস্তান।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএসো বিজ্ঞানের রাজ্যে – আবদুল্লাহ আল-মুতী
    Next Article নির্বাচিত গল্প সমগ্র – আবু ইসহাক

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }